বাড়ি এসে লালমোহনবাবু বললেন, সোমেশ্বরবাবুর কথাগুলো ভারী রহস্যজনক মনে হচ্ছিল, তাই না?

ঠিকই বলেছেন। বলল ফেলুদা।

আমার মনে হয়, ভদ্রলোক বেশ কিছু কথা লুকিয়ে গেলেন।

আমারও সেই রকমই মনে হয়েছে।

আপনি নিজে কী বুঝেছেন?

একেবারে অন্ধকারে আছি, তা নয়। তবে ম্যাজিকের জগৎ নিয়ে একটু অনুসন্ধান চালাতে হবে। তা ছাড়া অকশন-হাউসও একটা ব্যাপার আছে। আমি বরং একটু ঘুরে আসি। আপনারা দুজনে আড্ডা মারুন।

আমি একটা কথা এই বেলা ফেলুদাকে না বলে পারলাম না। আচ্ছ ফেলুদা, নিখিলবাবুর কথা শুনে কি তোমার কিছু মনে হয়েছিল?

সেটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কেন নয়, সেটা অবিশ্যি তোকে ভেবে বার করতে হবে। ফেলুদা বেরিয়ে গেল।

লালমোহনবাবু বললেন, আমার কিন্তু এই আর্টিস্ট ভদ্রলোককে মোটেই ভাল লাগছে না। অবিশ্যি চাপ-দাড়ির বিরুদ্ধে আমার একটু প্রেজুডিস আছে এমনিতেই।

সূর্যকুমার ভদ্রলোকটিকে আপনার ভাল লাগছে?

ও-ও কেমন যেন পিকিউলিয়ার। তবে প্রথম দিন এসেই ও সিন্দুক খুলবে বলে মনে হয় না। ওই বাড়ির সঙ্গে তো ওর বিশেষ পরিচয় নেই। কোনটা কার ঘর, কোথায় সিন্দুক আছে, কোথায় সিন্দুকের চাবি আছে~—এসব জানা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এটা ঠিক যে এ চার খুনি-চার। ওকে যখন বেয়ারা দেখে ফেলল, তখন তো ও ওকে ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দিতে পারত। পালানো নিয়ে তো কথা, আর বেয়ারার বয়সও ষাটের কাছাকাছি। বোঝা যাচ্ছে যে চার ছুরি হাতে নিয়েই কুকীর্তিটা করতে বেরিয়েছিল।

এটা আপনি ঠিকই বলেছেন।

সোমেশ্বরবাবুও কী বলতে গিয়ে বললেন না, সেটা জানতে ইচ্ছা করে। আমার মনে হয়। ওখানে একটা ইম্পট্যান্ট কু লুকিয়ে আছে।

ঠিক এই সময় একটা ফোন এল। তুলে হ্যালো বলতে ওদিক থেকে প্রশ্ন এল, মিঃ মিত্তির আছেন?

ইনস্পেক্টর ঘোষ। বললাম, ফেলুদা একটু বেরিয়েছে।

ভদ্রলোক বললেন, ওঁকে বলে দেবেন। যে কালপ্রিট ধরা পড়েছে। গোপচাঁদ বলে এক চোর—রিসেন্টলি জেল থেকে বেরিয়েছে। অবিশ্যি লোকটা স্বীকার করেনি এখনও, কিন্তু সেদিন রাত্রে ও বেরিয়েছিল, সে খবর আমরা পেয়েছি। এটা আপনি জানিয়ে দেবেন। আর স্বীকারোক্তি পেলে, আবার আপনাকে টেলিফোন করব। আপনার দাদাকে নিশ্চিন্ত হতে বলে দেবেন।

আমি ফোন রেখে দিলাম। মনটা কেমন জানি দমে গেল। এ তো ঠিক জমল না।

ঘণ্টা দেড়েক পরে ফেলুদা আসাতে, আমি প্রথমেই ওকে ইনস্পেক্টরের কথাটা বললাম। ফেলুদা যেন গা-ই করল না। বলল, সূর্যকুমারের ম্যাজিক খুব ভাল চলছে না, নিখিলবাবুর দোকানের অবস্থাও ভাল নয়। আর আমাদের আর্টিস্ট রণেন তরফদার গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টের ছাত্র ছিলেন না। প্যারিসে আঁকা শিখেছিলেন। কিনা, সেটা অবিশ্যি জানতে পারিনি।

তা হলে এখন কী করণীয়? লালমোহনবাবু প্রশ্ন করলেন।

আমার দিক থেকে মোটামুটি কাজ শেষ। এখন রইল। শুধু রহস্য উদঘাটন। দাঁড়ান, আগে ইনস্পেক্টর ঘোষকে একটা ফোন করি।

ফেলুদা ফোনে প্রথমেই বলল, আপনার সমাধান যে মানতে পারছি না, মিঃ ঘোষ।

ঘোষের উত্তরের পর ফেলুদা বলল, আমার ধারণা খুনি ওই বাড়িরই লোক। আপনি এক কাজ করুন। আমার সমাধান রেডি। আমি আজ বিকেলে সেটা ঘোষণা করতে চাই সোমেশ্বরবাবুর ওখানে। আপনিও আসুন। আমার কথা শুনে আপনার যদি কিছু বলার থাকে বলবেন। আমার এ অনুরোধটা আপনাকে রাখতেই হবে। তা ছাড়া আপনাকে খুনিকে গ্রেপ্তার করার জন্য তৈরি হয়ে আসতে হবে।… থ্যাঙ্ক ইউ।

ফেলুদা ফোন রেখে বলল, ভদ্রলোক রাজি। গোপচাঁদ-ছাঁ! এইজন্যই মাঝে মাঝে পুলিশের উপর থেকে ভক্তি চলে যায়।

এরপর ফেলুদা সোমেশ্বরবাবুকে একটা ফোন করে, বিকেলে ওঁর ওখানে যাবার কথাটা বলে দিল। সেই সঙ্গে এ-ও বলে দিল যে সবাই যেন উপস্থিত থাকে।

 

বিকেল পাঁচটায় আমরা সোমেশ্বরবাবুর নীচের বৈঠকখানায় জমায়েত হলাম। ইনস্পেক্টর ঘোষ আর দুজন কনস্টেবল এসে গিয়েছিল আগেই।

সকলে যো-যার জায়গায় বসলে পর, ফেলুদা শুরু করল।

প্রথমেই আমাদের যে প্রশ্নটার সামনে পড়তে হচ্ছে, সেটা হল চোর বাইরের লোক না। ভেতরের লোক। এখানে প্রথম যেদিন চোর আসে, তার পরদিন আমি এসেছিলাম। বাড়ির চারদিকে ঘুরে মনে হয়েছিল—এখানে বাইরে থেকে চোর ঢোকা খুব মুশকিল। বারান্দার থাম বেয়ে উঠলেও, জিনিসপত্তর চুরি করে থাম বেয়ে নামার সুবিধে নেই। কাজেই আমার বাড়ির লোকের কথাই বেশি করে মনে হয়েছিল, এবং চোরের দৃষ্টি যে কীসের দিকে, সে সম্বন্ধেও আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না।

এবার চুরি এবং খুনের পর আমি সকলকে জেরা করি। সোমেশ্বরবাবুকে জেরা করতে জানতে পারলাম। তিনি এটা টেক্স পেয়েছিলেন, কিন্তু বাধা দেবার কোনওরকম চেষ্টা করেননি। এতে মনে হয় তিনি চোরকে দেখে একেবারে হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু চুরির পর যে খুন হবে, সেটা তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। চুরির মোটিভ অবশ্য একটাই হতে পারে; চোরের হঠাৎ বেশ কিছু টাকার দরকার পড়ে গেসল।

এ-বাড়িতে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মধ্যে রণেন তরফদার ছবি এঁকে রোজগার করছিলেন, সাময়িকভাবে তাঁর অবস্থা স্বচ্ছন্দই বলা যেতে পারে। এ অবস্থায় তাঁর পক্ষে চুরি করাটা অস্বাভাবিক। অনিমেষবাবু ভালই আছেন বন্ধুর আতিথেয়তায়, কাজেই তাঁকে বাদ দেওয়া যেতে পারে।

এবার নিখিলবাবুতে আসা যাক। নিখিলবাবুর একটা অকশন-হাউস আছে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সে অকশন-হাউসের অবস্থা খুব ভাল না। সুতরাং নিখিলবাবুর পক্ষে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণটা পাওয়া খুবই লাভজনক হবে। কারণ তিনি নিজের অবস্থা সামলে নিতে পারবেন। আমার ধারণা, প্রথম দিন নিখিলবাবুই চুরির চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন।

নিখিলবাবু বলে উঠলেন, আপনি বিনা প্রমাণে দোষী সাব্যস্ত করছেন?

ফেলুদা বলল, এখানে শেষ তো হয়নি–আপনি তো চুরি করতে পারেননি। কাজেই আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমি বলছি না যে আমার যুক্তি অকাট্য। আমি শুধু অনুমান করছি। আপনি আপত্তি করতে চান তো করতে পারেন, কারণ আসল ঘটনা হল দ্বিতীয় দিনের।

প্রথম আর দ্বিতীয় দিনের ঘটনার মধ্যে একটি নতুন লোক এসে এ বাড়িতে উঠেছেন, তিনি হলেন জাদুকর সূৰ্যকুমার! এটাও আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে সূৰ্যকুমার তাঁর প্রদর্শনীতে লোকসান দিচ্ছে। আমরা যেদিন তাঁর ম্যাজিক দেখতে যাই, সেদিনও হলে অনেক সিট খালি ছিল। এই সূৰ্যকুমার কি চুরি করে থাকতে পারেন? কারণ তাঁর টাকার দরকার ছিল অবশ্যই। সূৰ্যকুমার বলে উঠলেন,ভুলে যাচ্ছেন মিঃ মিত্তির, আমি সোমেশ্বর বর্মনের সিন্দুক ও তার মধ্যে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না।

সূর্যকুমারবাবু, ফেলুদা বলল, এবারে আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। সোমেশ্বরবাবুর আপনাকে খুব ভাল লেগে গিয়েছিল, তাই না?

তা লেগেছিল নিশ্চয়ই, তা না হলে আর আমাকে এখানে থাকতে বলবেন কেন? কেন ভাল লেগেছিল, সে বিষয় আপনার কিছু বলার আছে?

না।

আমি যদি বলি যে আপনি তাঁকে তাঁর প্রথম সন্তানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ইন ফ্যাক্ট তিনি বিশ্বাস করেছিলেন। আপনিই তাঁর বড় ছেলে? সোমেশ্বরবাবু, আমি কি খুব ভুল বলেছি?

কিন্তু আমার ছেলেই আমার শত্ৰু হল শেষ পর্যন্ত?

সূৰ্যকুমারবাবুর গলার আওয়াজ একটু পাতলা, যার ফলে তাঁর ব্যক্তিত্বের কিছুটা হানি হয়। আমি নিখিলবাবুর কণ্ঠস্বরেও ঠিক একই পাতলা ভাব পেয়েছি। চেহারা দাড়ি-গোফ লাগিয়ে যতই পরিবর্তন করা যাক না কেন, কণ্ঠস্বর তো আর বদলানো যায় না। আমার মনে হয়। এই কণ্ঠস্বরেই সোমেশ্বরবাবু চিনেছিলেন।

ঠিকই বলেছেন মিঃ মিত্তির, অখিলের গলার আওয়াজ আমি চিনেছিলাম।

তা হলে সূৰ্যকুমারও পঞ্চরত্নের কৃষ্ণের কথাটা জানতেন?

আমি জানতে পারি, বললেন সূৰ্যকুমার ওরফে অখিল বৰ্মন, কিন্তু সে কৃষ্ণ সিন্দুকে ছিল না। আমি কিছুই চুরি করিনি।

ঘরের মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে গেল। আমিও অবাক! কৃষ্ণ ছিল না। সিন্দুকের মধ্যে, তবে সেটা কোথায় গেল?

না, কৃষ্ণ ছিল না ঠিকই! বলল ফেলুদা, আপনি চোর নন, কিন্তু আপনি খুনি।

কিন্তু আমার কৃষ্ণ কোথায় গেল? চেঁচিয়ে উঠলেন সোমেশ্বরবাবু।

এই যে আপনার কৃষ্ণ। ফেলুদা তার কোটের পকেট থেকে জিনিসটা বার করে তার সামনে টেবিলের উপর রেখে দিল।

আপনাদের বাড়িতে দুবার চোর আসেনি। তিনবার এসেছিল। আমি যখন খবর পাই সূৰ্যকুমার এ-বাড়িতে এসে থাকছেন, তখনই আমার সাবধানতা অবলম্বন করার ইচ্ছেটা জাগে। নিখিলবাবুর সঙ্গে গলার আওয়াজ আর কথা বলার ঢং-এ মিল পেয়ে, আমার প্রথমেই সন্দেহ হয়েছিল যে সূৰ্যকুমার আসলে অখিল বৰ্মন। উনি যখন নিজের পরিচয় গোপন করে রাখলেন, তখনই আমার মনে হল যে ওঁর কোনও এক দুরভিসন্ধি আছে। তারপর জানতে পারলাম ওঁর রোজগার ভাল যাচ্ছে না-উনি দেনা করে বসে আছেন, প্রতিবারই লোকসান দিচ্ছেন। তখনই আমি স্থির করি যে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণটা আর সিন্দুকে থাকতে দেওয়া উচিত নয়। দারোয়ানকে মোটা ঘুস দিয়ে আমি বাড়িতে ঢুকি। তারপর বারান্দার থাম বেয়ে ওপরে উঠে, আমার হাতসাফাইয়ের জোরে সোমেশ্বরবাবুর বালিশের তলা থেকে চাবিটা নিয়ে সিন্দুক খুলে, তার থেকে কৃষ্ণটা বার করে নিই। তারপর আবার একই পথে ফিরে আসি। দুঃখের বিষয়, আমি অবিনাশের হত্যাটাকে রুখতে পারলাম না।

ইনস্পেক্টর ঘোষ ততক্ষণে এগিয়ে গেছেন। সূৰ্যকুমারের দিকে। ফেলুদা বলল, এই একটা ব্যাপার, যেখানে আপনার ম্যাজিক খাটবে না, অখিলবাবু!

সোমেশ্বরবাবু উঠে এসে ফেলুদার হাতটা আঁকড়ে ধরলেন। আপনার জন্য আমার কৃষ্ণ বেঁচে গেল। আপনাকে ধন্যবাদ দেবার ভাষা আমার নেই।

 

বাড়ি ফিরে এসে লালমোহনবাবু ফেলুদাকে বললেন, মশাই, এতদিন আপনার ওপর ভক্তির ভাবই ছিল; এবার ভয় ঢুকল। আপনি যে তস্করের শিরোমণি, সেটা তো জানা ছিল না!

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়