সোমেশ্বরবাবুর সেক্রেটারি প্রণবেশবাবু বললেন, উনি পাঁচ বছর থেকে সেক্রেটারির কাজ করছেন। ওঁর নিজের বাড়ি একটা ছিল ভবানীপুরে, কিন্তু এ-বাড়িতে এত ঘর আছে দেখে, সোমেশ্বরবাবুই প্রস্তাব করেন এই বাড়িতে এসে থাকার জন্য। প্ৰণবেশবাবুও আপত্তি করেননি।

চমৎকার। সেদিক দিয়ে আমার কিছু বলার নেই।

কাজটা কেমন লাগে?

সোমেশ্বরবাবু যে-সব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, সেগুলো আশ্চর্য। টাইপ করতে করতে আমি যে কত কী নতুন জিনিস জানতে পারছি, তা বলতে পারি না।

আপনি কটা পৰ্যন্ত করেন?

রাত আটটা, নটা…

আপনি ত একতলায় শোন।

হ্যাঁ।

ঘুম কেমন হয়?

ভালই।

কাল কোনও কারণে–কোনও শব্দে বা ওই জাতীয় কিছুতে আপনার ঘুম ভেঙে যায়নি?

না। আমি ঘটনাটা জেনেছি। সকালে উঠে।

এ-বাড়ির কাউকে আপনার সন্দেহ হয়? কৃষ্ণটার বিষয় যখন শুধু এ-বাড়ির লোকেরাই জানত, তখন হয়তো অপরাধীও এ-বাড়িতেই রয়েছে।

সে হতে পারে। আমিও তো সাসপেক্টদের মধ্যে পড়ছি।

তা পড়ছেন বইকী।

পুলিশ অবিশ্যি পুরো বাড়ি সার্চ করবে, কিন্তু অতটুকু জিনিস লুকোনোর জায়গার তো অভাব নেই। তারপর সুযোগ বুঝে বার করে নিলেই হল।

সোমেশ্বরবাবুর যিনি অয়েল পেন্টিং করছিলেন, তিনিও এই বাড়িতেই থাকেন। অন্তত যতদিন না। ছবি শেষ হচ্ছে, ততদিন থাকবেন। এই ভদ্রলোককে আমার কেন জানি একটু অদ্ভুত লাগে। প্রথমত চেহারাটা অদ্ভুত-চাপ-দাড়ি, চুল কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। তারপর ভদ্রলোক কথা অত্যন্ত কম বলেন। কাজ অবিশ্যি ভালই করেন, কারণ সোমেশ্বরবাবুর যেটুকু ছবি আঁকা হয়েছে সেটা আমি দেখেছি, আর সেটা ভালই হয়েছে।

ইনিও একতলায় থাকেন। ফেলুদা তাঁর দরজায় গিয়ে টোকা মারল।

ভদ্রলোক দরজা খুলে ফেলুদার দিকে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন।

আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল। বলল ফেলুদা।

বেশ তো, ভেতরে আসুন!

অগোছালো ঘর, যেটা হবে বলে আমি আন্দাজ করেছিলাম। আমরা মোড়া চেয়ার বিছানা মিলিয়ে বসলাম।

আপনার নাম তো রাশেন তরফদার?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আপনি ক’দিন হল এ-বাড়িতে আছেন?

যেদিন থেকে ছবিটা আঁকা শুরু করেছি। তার মানে দেড় মাস।

আপনার একটা পোট্রেট করতে কত সময় লাগে?

ফুল ফিগার হলে, এবং দিনে অন্তত দুঘণ্টা সিটিং পেলে, মাস দেড়েক হয়ে যায়।

তা হলে এখানে এতদিন লাগছে কেন?

এখানে সোমেশ্বরবাবু দিনে এক ঘণ্টার বেশি সিটিং দেন না। তারপর আমাকে ওঁর ভাল লেগেছে বলে, উনি চান আমি এখানেই থাকি। আসলে সোমেশ্বরবাবু বেশ সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে থাকতে ভালবাসেন। ওঁর এক ছেলে বিলোতে। মেয়ের বিয়ে এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পরে, উনি ভয়ানক একা হয়ে গেসলেন। এ-বাড়িটাকে উনি খানিকটা ভরাট করতে চান, এটা আমার ধারণা।

আপনি পেন্টিং কোথায় শিখেছিলেন?

আমি ফ্রান্সে শিখি তিন বছর। তা ছাড়া প্রথমে কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্টে শিখেছি।

পোর্ট্রেট করে রোজগার ভাল হয়?

এখন আর হয় না। ফোটাগ্রাফির যুগে আসল-পোট্রেটের কদর অনেক কমে গেছে। আমিও তাই অ্যাবস্ট্র্যাক্ট পেন্টিং-এ চলে যাচ্ছি। সোমেশ্বরবাবুর পৃষ্ঠপোষকতা না-পেলে, আমার অবস্থা খুবই কাহিল হত।

আপনি পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ সম্বন্ধে জানতেন?

হ্যাঁ। ওটা আমাকে সোমেশ্বরবাবু দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুমি আর্টিস্ট, তুমি এর কদর করতে পারবে।

কালকের খুন এবং ডাকাতি সম্বন্ধে আপনার নিজের কোনও থিওরি আছে?

বাড়ির লোক এ-কাজ করতে পারে না। আমার মনে হয়, চোর সিন্দুক থেকে টাকা নিতে গিয়ে কৃষ্ণটা দেখে সেটা নিয়ে নেয়। তারপর নীচে বেয়ারার সামনাসামনি পড়ে, ওকে খুন করে। আত্মরক্ষা ছাড়া খুনের আর কোনও মোটিভ আছে বলে আমার মনে হয় না।

অনেক ধন্যবাদ।

ফেলুদা উঠে পড়ল। আর দুজন বাকি রইল—সূৰ্যকুমার আর সোমেশ্বরবাবু। আমরা সূৰ্যকুমারের কাছেই আগে গেলাম! ভদ্রলোক কেমন যেন গুম মেরে গেছেন। তিনি এ-বাড়িতে আসার দিনই ঘটনাটা ঘটল, এই জন্যই বোধহয়।

ফেলুদা বলল, আপনার ভাগ্যটা খুব খারাপ দেখছি।

আর বলবেন না। বললেন ভদ্রলোক, সোমেশ্বরবাবু এত আপ্যায়ন করে আমায় থাকতে বললেন, আর প্রথম রাত্রেই কী কাণ্ড! আমি একবারে থ মেরে গেছি!

রাত্রে কোনওরকম শব্দ-টব্দ পাননি?

একেবারেই না। আমি এমনিতে খুব ভাল ঘুমোই। এক ঘুমে রাত কাবার হয় আমার।

কাজেই আমি কিছুই শুনিনি।

এ-বাড়ির সকলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে?

যা হয়েছে, তাকে আলাপ বলা যায় না। একমাত্র সোমেশ্বরবাবু ছাড়া।

যে জিনিসটা চুরি হয়েছে, সেটা আপনি দেখেননি?

কী করে দেখব? প্রথমত ঠিক করে জানি না জিনিসটা কী। শুধু কৃষ্ণ শুনেছি, এই পর্যন্ত।

কৃষ্ণই বটে, তবে পঞ্চরত্বের তৈরি। যেমন সুন্দর, তেমন ভ্যালুয়েবল লাখখানেকের উপর দাম হবে।..আপনি কি এখনও এখানেই থাকবেন?

সোমেশ্বরবাবু তো তাই বলছেন। বলছেন, আপনাকে ডেকে এনে, চলে যেতে বলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবে আপনার থাকাটা আপনার পক্ষে তেমন সুখকর হতে পারল না, এই যা দুঃখ!

আপনি যখন আছেন, তখন প্রয়োজনে আপনাকে আবার প্রশ্ন করা চলবে তো?

নিশ্চয়ই। এ নিয়ে তো কোনও কথাই উঠতে পারে না।

এরপর আমরা সোমেশ্বরবাবুর কাছে গেলাম। ভদ্রলোক এখনো মুহ্যমান অবস্থায় রয়েছেন।

ফেলুদা বলল, আপনি কতটা ঘা খেয়েছেন, সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি যখন এখানে উপস্থিত রয়েছি, তখন কৌতুহলবশত আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন না-করে পারছি না।

তা তো করবেনই। আপনার তো পেশাই এটা।

আপনি কোনওরকম টের পাননি, না?

টের পাইনি, তবে আঘাত পেয়েছি প্ৰচণ্ড। প্রথমত আমার অবিনাশ বেয়ারার এই দশা। লোকটা যে কী কাজের ছিল, তা বলতে পারি না। আর আমাকে কতটা মান্য করুত, সেও বলে বোঝাতে পারব না। দ্বিতীয়ত, আমার পঞ্চরত্বের কৃষ্ণ। দয়াল সিং নিজে হাতে তুলে দিয়েছিলেন জিনিসটা আমায়। বললেন, তুমি শিল্পীর সেরা শিল্পী-তোমাকে এর চেয়ে কম পারিশ্রমিক দেওয়া যায় না। আর সেই পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ চলে গেল!! আর তা ছাড়া— সোমেশ্বরবাবু কী যেন বলতে গিয়ে, অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।

তারপর কয়েক মুহূর্ত পরে প্রায় আপন মনেই বললেন, আমি কি ভুল করলাম? আশা করি ভুল করেছি। কারণ জিনিসটা সত্যি হলে, আমার পক্ষে আরও দ্বিগুণ বেদনাদায়ক হবে।

আপনি কীসের কথা বলছেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

সে আপনি জানতে চাইবেন না, কারণ আপনাকে বলতে পারব না।

আপনি কিছু টের পাননি?

টের পেয়েছি, কিন্তু পেয়েও কিছু করতে পারিনি।

আপনার কথায় একটা রহস্যের সুর রয়েছে, সেটা আপনি উদঘাটন করবেন কি? করলে, আমাদের অনেক সুবিধে হত।

সে অনুরোধ আমায় করবেন না, মিঃ মিত্তির। আপনি যদি এবার আমাকে রেহাই দেন, আমি বাধিত হব।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই-।

আমরা তিনজন উঠে পড়লাম। তবে আমি নিজের স্বার্থে তদন্ত করতে চাই আপনার বাড়ির এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে। তাতে আশা করি আপনার আপত্তি হবে না।

মোটেই না, অপরাধী যেই হোক না, তাকে ধরা কর্তব্য।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়