এ সপ্তাহটায় আর কোনও ঘটনা ঘটল না। তারপর যেটা হল, সেটা একেবারে বজ্রপাত! মঙ্গলবার দিন সোমেশ্বরবাবু ফোন করে জানালেন যে তাঁর বাড়িতে খুন হয়েছে তাঁর বহুদিনের বেয়ারা অবিনাশ, আর সেইসঙ্গে সিন্দুক থেকে পঞ্চরত্নের কৃষ্ণ হাওয়া! একসঙ্গে ডবল ট্রাজেডি।

ফেলুদা তৎক্ষণাৎ লালমোহনবাবুকে ফোন করে বলে দিল সোমেশ্বরবাবুর বাড়িতে আসতে, আর আমরা ট্যাক্সি করে চলে গেলাম।

গিয়ে দেখি, পুলিশকেও খবর দেওয়া হয়েছে। ইনস্পেক্টর ঘোষ ফেলুদার চেনা, দেখে বললেন, স্রেফ ডাকাতির কেস। খুন করার মতলব ছিল না; সামনে বাধা পেয়ে খুন করেছে। আসল উদ্দেশ্য ছিল সিন্দুক থেকে ওই কৃষ্ণটা নেওয়া। এ বাইরের লোকের কাজ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই সেদিন একটা ডাকাতির কেস হয়ে গেছে।

ওই কৃষ্ণের কথা কিন্তু এ বাড়ির লোক ছাড়া কেউ জানত না।

তা হলে এ বাড়ির ভেতর থেকেই ব্যাপারটা হয়েছে। সোমেশ্বরবাবুর ছেলে আছেন, সেক্রেটারি আছেন, বন্ধু আছেন, আর্টিস্ট রণেন তরফদার আছেন, সূর্যকুমার বলে সেই ম্যাজিশিয়ান কাল থেকে এখানে রয়েছেন; এর মধ্যেই কেউ গিলটি। আর যদি তাই হয়, তা হলে তো আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে।

খুনটা কখন হয়েছে?

রাত একটা থেকে তিনটের মধ্যে।

বেয়ারা কি চোরকে বাধা দিতে গোসল?

তাই তো মনে হচ্ছে।

আমরা বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। একতলার বৈঠকখানায় সোমেশ্বরবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। ঘরে আর সকলেই রয়েছে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ চেয়ারে বসে।

ফেলুদা সোমেশ্বরবাবুকে বলল, ঘটনাটা একটু বলবেন? এই বেয়ারা কি আপনার অনেকদিনের বেয়ারা?

ত্রিশ বছর। অবিনাশের মতো ভাল লোক পাওয়া খুব দুরূহ।

খুনটা কোথায় হয়?

একতলায়।

চোর সিন্দুক থেকে কৃষ্ণটা নিয়ে পালাচ্ছিল, সেই সময় হয়তো অবিনাশের ঘুম ভেঙে যায়। সে চোরের সামনে পড়ে, হয়তো তাকে ধরতে যায়; সেই সময় চোর তাকে ছুরি মেরে খুন করে।

আপনারা কে কোথায় শোন, জানতে পারি?

আমার ঘর তো আপনি দেখেইছেন। আমি আর অনিমেষ দোতলায় শুই বাকি সকলে একতলায় শোয়। কাল সূৰ্যকুমার এখানে এসেছেন। ক’দিনের জন্য, তাকে একতলায় একটা গেস্টরুম দিই।

কিন্তু আপনার এই কৃষ্ণর কথা তো বাইরের কেউ জানত না?

তা তো না-ই। অথচ বাড়ির কেউ এমন কাজ করে থাকতে পারে, সেটা ভাবা অসম্ভব মনে হচ্ছে।

আপনার বালিশের নীচ থেকে চাবি নিল, আর আপনি টের পেলেন না?

আমি যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোই। সে গভীর ঘুম।

সিন্দুকের চাবিটা কি রেখে গেছে?

হ্যাঁ। সেটা তালাতেই ঝুলিছিল।

যে অস্ত্রটা দিয়ে খুন হয়েছিল, সেটা পাওয়া গেছে?

না।

ইনস্পেক্টর ঘোষ এ সময় এসে বললেন, তিনি সকলকে জেরা করতে চান।

ফেলুদা বলল, আপনার জেরার পর আমি যদি একটু জেরা করি, তা হলে আপনার আপত্তি নেই তো?

মোটেই না। আপনার কীর্তিকলাপের সঙ্গে আমি বিলক্ষণ পরিচিত। নইলে প্রাইভেট ডিটেকটিভকে আমরা বিশেষ পাত্তা দিই না।

ইনস্পেক্টর ঘোষ সোয়া ঘণ্টা ধরে সকলকে জেরা করলেন। আমরা ততক্ষণ চা-টা খেলাম। সোমেশ্বরবাবু যথেষ্ট আঘাত পেয়েছেন—খুনের ব্যাপারেও, চুরির ব্যাপারেও। কিন্তু তাতে আতিথেয়তার কোনওরকম ত্রুটি হল না।

আমরা চা খেয়ে বাইরে বাগানে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ইনস্পেক্টর ঘোষ এসে বললেন, আমার কাজ শেষ; এবার আপনি টেক-ওভার করুন।

ফেলুদা ভিতরে গিয়ে প্রথমেই সোমেশ্বরবাবুর ছোট ছেলে নিখিলবাবুকে নিয়ে পড়ল। আমরা নিখিলবাবুর ঘরেই বসলাম।

ফেলুদা প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, আপনি কী করেন?

আমার একটা অকশন-হাউস আছে। মিরজা গালিব স্ট্রিটে।

কী নাম?

মডার্ন সেলস ব্যুরো।

জানি, দোকানটা দেখেছি।

তা দেখে থাকতে পারেন। ওখানে আমি সকাল দশটা থেকে ছটা পর্যন্ত থাকি।

ব্যবসা কী রকম চলে?

ভালই।

আপনি আর্ট সম্বন্ধে ইন্টারেস্টেড?

আমার কাজের মধ্যে দিয়ে তো অনেক রকম আর্টের জিনিসপত্র আমাদের ঘাঁটতে হয়। সেই সূত্রে বেশ কিছু জানা হয়ে গেছে।

কত বছর হল আপনি এ কাজ করছেন?

সাত বছর।

আপনার বয়স কত?

তেত্রিশ চলছে।

আপনার দাদা আপনার চেয়ে কত বড়?

তিন বছর।

দাদার সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?

দাদা মিশুকে ছিলেন না। কথাও বেশি বলতেন না, বন্ধু-বান্ধবও বেশি ছিল না। সত্যি বলতে কী, দাদার কারুর উপরেই টান ছিল না—এমনকী আমার উপরেও না।

নিখিলবাবুর কথা শুনে আমার কেন যে একটু অদ্ভুত লাগছিল, সেটা কিছুতেই ভেবে বের করতে পারলেন না।

বিদেশে গিয়ে দাদা আপনাকে চিঠি লেখেননি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

না। শুধু আমাকে না, কাউকেই লেখেননি।

বাবার ম্যাজিকে আপনার কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না?

নিশ্চয়ই ছিল। তবে বাবা তো বেশির ভাগ ম্যাজিক বাইরে দেখাতেন; সেগুলো আর আমার দেখা হত না।

নিজে ম্যাজিক করার শখ হয়নি?

ত হয়নি। শুধু দেখতেই ভাল লাগত।

এই যে অঘটনটা ঘটল, এটার জন্য কে দায়ী, সে সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণা আছে?

না। একেবারেই নেই। তবে বাবাকে আমি অনেকবার বলেছি কৃষ্ণটা বাড়িতে না রেখে ব্যাঙ্কে রাখা উচিত। বাবা আমার কথায় কান দেননি।

নিখিলবাবুর সঙ্গে কথা শেষ করে, আমরা সোমেশ্বরবাবুর বন্ধু অনিমেষবাবুর কাছে গেলাম।

খাট আর চেয়ার ভাগ করে আমরা বসলাম ভদ্ৰলোকের ঘরে।

ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, আপনি কী করেন?

আমি কিছুই করি না। বললেন অনিমেষবাবু, আমার বাবা ছিলেন উকিল। তিনি অনেক তলার একটা বাড়ি তৈরি করে গেসলেন, সেটার ভাড়া থেকেই আমার চলে যায়।

সোমেশ্বরবাবুর সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব কত দিনের?

তা প্রায় বিশ বছর।

কী করে সূত্রপাত হয়?

আমি এককালে জ্যোতিষ করতাম। সোমেশ্বর আমার কাছে এসেছিল তার ভাগ্য গণনা করাতে। ও তখন সৰ্ব্বে মাজিক দেখাতে শুরু করেছে। আমি ওর ভবিষ্যতের খ্যাতির কথা বলে দিই। এই ঘটনার পাঁচ বছর পরে ও আমার বাড়িতে আবার আসে, এবং আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তখন থেকেই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। সোমেশ্বরের স্ত্রী মারা যাবার পর ও আমাকে ওর বাড়িতে এসে থাকতে বলে–বোধহয় একাকিত্ব খানিকটা কাটবে বলে। তখনই আমি চলে আসি। সে আজ পনেরো বছর হল।

পঞ্চরত্নের কৃষ্ণটা আপনি কবে দেখেন?

ওটার কথা তো আমি আমার গণনায় বলি। ওটা পাওয়া মাত্র ও আমাকে দেখায়।

এই চুরি এবং খুন কে করতে পারে, সে বিষয়ে আপনার কোনও ধারণা আছে?

বাড়ির চাকরের সঙ্গে যোগসাজশ আছে, এমন কোনও চোর বলেই আমার বিশ্বাস। আমার ধারণা, ও সিন্দুক খুলে টাকা নিতে গোসল। তারপর সামনে ওই ঝিলমলে কৃষ্ণটা দেখে, সেইটে নিয়ে নেয়। বাড়ির কোনও লোক এ ব্যাপারে জড়িত, এ বিশ্বাস করতে আমার মন চায় না।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়