কলকাতায় ফিরে এসেই ফেলুদা প্রবন্ধের কথাটা উল্লেখ করে একটা জরুরি অ্যািপয়েন্টমেন্ট চেয়ে টেলিগ্ৰাম করে দিল ভগওয়ানগড়ের এক্স মহারাজা ভূদেব সিংকে। তার আগেই অবিশ্যি পুষ্পক ট্র্যাভেলসে ফোন করেছিল ফেলুদা! ও ঠিকই আন্দাজ করেছিল; ভগওয়ানগড় মধ্যপ্রদেশেই, তবে আমাদের প্রথমে যেতে হবে নাগপুরে। সেখান থেকে ছাট লাইনের ট্রেনে ছিন্দওয়ারা। ছিন্দওয়ারা থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার পশ্চিমে হল ভগওয়ানগড়।

টেলিগ্রামের উত্তর এসে গেল পরের দিনই। এই সপ্তাহে যে-কোনওদিন গেলেই ভূদেব সিং আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন। কবে যাচ্ছি জানিয়ে দিলে ছিন্দওয়ারাতে রাজার লোক গাড়ি নিয়ে থাকবে।

সুদৰ্শনবাবুকে ফোন করতে ভদ্রলোক বললেন, আপনাদের তাড়া থাকলে কাল বুধবার ভোরে একটা নাগপুর ফ্লাইট আছে। সাড়ে ছাঁটায় রওনা হয়ে পৌঁছবেন সোয়া আটটায়। তারপর নাগপুর থেকে সাড়ে দশটায় ট্রেন আছে, সেটা ছিন্দওয়ারা পৌঁছবে বিকেল পাঁচটায়। ট্রেনের টিকিট আপনাদের ওখানেই কেটে নিতে হবে।

আর ফেরার ব্যাপারটা? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

আপনি বিষুদৃদবার রাত্রে আবার ছিন্দওয়ারা থেকে ট্রেন ধরতে পারবেন। সেটা নাগপুর পৌঁছবে শুক্রবার ভোর পাঁচটায়। সেদিনই কলকাতার ফ্রাইট আছে তিন ঘণ্টা পরে। সাড়ে দশটায় ব্যাক্‌ ইন ক্যালকাটা।

সেইভাবেই যাওয়া ঠিক হল, আর রাজাকেও জানিয়ে টেলিগ্ৰাম করে দেওয়া হল।

আজকের বাকি দিনটা হাতে আছে, তাই ফেলুদা ঠিক করল এই ফাঁকে একটা জরুরি কাজ সেৱৈ নেবে।

টেলিফোনে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট করে আমরা বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গিয়ে হাজির হলাম। আমীর আলি অ্যাভিনিউতে লোটাস টাওয়ারসে হীরালাল সোমানির ফ্ল্যাটে।

বেল টিপতে একটি বেয়ারা এসে দরজা খুলে আমাদের বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল।

ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায়। ভদ্রলোকের সংগ্রহের বাতিক আছে, আর অনেক জিনিসেরই যে অনেক দাম সেটাও বুঝতে অসুবিধে হয় না। যেটা নেই সেটা হল সাজানার পারিপাট্য।

ঝাড়া দশ মিনিট বসিয়ে রাখার পর সোমানি সাহেব প্রবেশ করলেন, আর করা মাত্র একটা পারফিউমের গন্ধ ঘরটায় ছড়িয়ে পড়ল। বুঝলাম তিনি সবেমাত্র গোসল সেরে এলেন। সাদা ট্রাউজারের উপর সাদা কুতর্গ। পায়ে সাদা কোলাপুরি চটি। পালিশ করে আঁচড়ানো চুলেও সাদার ছাপ লক্ষ করা যায়। যদিও সরু করে ছাঁটা গোঁফটা সম্পূর্ণ কালো।

ভদ্রলোক আমাদের সামনের সোফায় বসে ফেলুদা ও লালমোহনবাবুকে সিগারেট অফার করে নিজে একটা ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন–

বলুন কী ব্যাপার।

আমি কয়েকটা ইনফরমেশন চাইছিলাম, বলল ফেলুদা।

আপনি রিসেন্টলি একটা ছবির খোঁজে বৈকুণ্ঠপুর গিয়েছিলেন। তাই না?

ইয়েস

ওরা বিক্রি করতে রাজি হননি।

নো।

আপনি ছবির কথাটা কীভাবে জানলেন সেটা জানতে পারি কি?

ভদ্রলোক প্রশ্নটা শুনে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেলেন, যেন ফেলুদা বাড়াবাড়ি করছে, এবং উত্তর দেওয়া-না দেওয়াটা তাঁর মার্জি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উত্তরটা এল।

আমি জানিনি। আরেকজন জেনেছিলেন। আমি তাঁরই রিকোয়েস্টে ছবি কিনতে গিয়েছিলাম।

আই সি।

আপনি কি সেই ছবি আমায় এনে দিতে পারেন? তবে, জেনুইন জিনিস চাই। ফোজারি হলে এক পইসা ভি নহী মিলেগ।

জাল না। আসল সেটা আপনি বুঝবেন কী করে?

আমি বুঝব কেন? যিনি কিনবেন তিনি বুঝবেন। হি হ্যাঁজ থাটিফাইভ ইয়ারস এক্সপিরিয়েন্স অ্যাজ এ বাইয়ার অফ পেন্টিংস।

তিনি কি এদেশের লোক?

সোমানি সাহেবের চোয়ালটা যেন একটু শক্ত হল। ভদ্রলোক ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছেন, কিন্তু দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য সরেনি। ফেলুদার দিক থেকে। এই প্রথম ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণে একটা হাসির আভাস দেখা গেল।

এ ইনফরমেশন আমি আপনাকে দেব কেন? আমি কি বুদ্ধু?

ঠিক আছে।

ফেলুদা ওঠার জন্য তৈরি হচ্ছিল, এমন সময় সোমানি বললেন, আপনি যদি আমাকে এনে দিতে পারেন, আমি আপনাকে কমিশন দেবী।

শুনে সুখী হলাম।

টেন থাউজ্যান্ড ক্যাশ।

আর তারপর সেটা দশ লিখে বিক্রি করবেন?

সোমানি কোনও উত্তর না দিয়ে একদৃষ্টি চেয়ে রইল ফেলুদার দিকে।

ছবি পেলে আপনাকে দেব কেন, মিস্টার সোমানি? বলল ফেলুদা। আমি সোজা চলে যাব আসল লোকের কাছে।

নিশ্চয় যাবেন, বাট ওনলি ইফ ইউ নো হায়্যার টু গো।

সে সব বার করার রাস্তা আছে, মিস্টার সোমানি। সকলের না থাকলেও, আমার আছে।..আমি আসি।

ফেলুদা উঠে পড়ল।

অনেক ধন্যবাদ।

গুডডে, মিস্টার প্রদোষ মিত্র।

শেষ কথাটা ভদ্রলোক এমনভাবে বললেন যেন উনি ফেলুদার নাম ও পেশা দুটোর সঙ্গেই বিশেষভাবে পরিচিত।

একরকম মাংসাশী ফুল আছে না, বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, লালমোহনবাবু, দেখতে খুব বাহারে, অথচ পোকা পেলেই কপি করে গিলে ফেলে?

আছে বই কী।

এ লোক যেন ঠিক সেইরকম।

ফেলুদার উৎকণ্ঠার ভাবটা বুঝতে পারলাম যখন সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে এসেই ও বৈকুণ্ঠপুরে একটা ফোন করল।

তবে নবকুমার বললেন আর নতুন কোনও ঘটনা ঘটেনি।

বাড়িতে ফিরে বৈঠকখানায় বসে ভাই, শ্ৰীনাথকে একটু চা করতে বলে না, বলে লালমোহনবাবু পকেট থেকে একটা বই বার করে সশব্দে টেবিলের উপর রাখলেন। বইটা হল সমগ্র পাশ্চাত্য শিল্পের ইতিহাস, লেখক অনুপম ঘোষদস্তিদার।

কী বলছেন ঘোষদস্তিদার মশাই? আড়চোখে বইটা দেখে প্রশ্ন করল ফেলুদা। ও নিজে আজই দুপুরে সিধু জ্যাঠার বাড়িতে গিয়ে দুটো মোটা আর্টের বই নিয়ে এসেছে সেটা আমি জানি।

ওঃ, ভেরি ইউজফুল মশাই। আপনি আর রাজা কথা বলবেন আর্ট নিয়ে, আর আমি হংসমধ্যে বক যথা, এ হতে দেওয়া যায় না। এটা পড়ে নিলে আমিও পার্টিসিপের্ট করতে পারব।

গোটা বইটা পড়ার কোনও দরকার নেই; আপনি শুধু রেনেসাঁস অংশটা পড়ে রাখবেন। রেনেসাঁস আছে তো ও বইয়ে?

তা তো বলছে না।

তবে কী বলছে?

রিনেইস্যান্স।

ঘোষদস্তিদারের জবাব নেই।

জিনিসটা তো একই?

তা একই।

ইয়ে, রেনেসাঁস বলতে বোঝাচ্ছেটা কী?

পঞ্চদশ আর ষোড়শ শতাব্দী। এই দেড়শো-দুশো বছর হল ইটালির পুনর্জন্মের যুগ। রেনেসাঁস হল পুনর্জন্ম, পুনর্জাগরণ।

কেন পুনঃ বলছে কেন? হোয়াই এগেইন?

কারণ প্রাচীন গ্রিক ও রোম্যান সভ্যতার আদর্শে ফিরে যাওয়ার একটা ব্যাপার ছিল এই যুগে-যে আদর্শ মধ্যযুগে হারিয়ে গিয়েছিল। তাই রেনেসাঁস। ইটালিতে শুরু হলেও রেনেসাঁসের প্রভাব ক্ৰমে ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত ইউরোপে। বহু প্ৰতিভা জন্মেছে এই সময়টাতে। শিল্পে, সাহিত্যে, সংগীতে, বিজ্ঞানে, রাজনীতিতে। ছাপাখানার উদ্ভব এই সময়; তার মানে শিক্ষার প্রসার এই সময়। কোপনিকাস, গ্যালিলিও, শেক্সপিয়র, দাভিঞ্চি, রাফেল, মাইকেল এঞ্জেলো—সব এই দেড়শো-দুশো বছরের মধ্যে।

তা আপনার কি ধারণা বৈকুণ্ঠপুরের খীশুও আঁকা হয়েছে এই রেনেসাঁসের যুগে?

তার কাছাকাছি তো বটেই। আগে নয় নিশ্চয়ই, বরং সামান্য পরে হতে পারে। মধ্যযুগের পেন্টিং-এ মানুষ জন্তু গাছপালা সব কিছুর মধ্যে একটা কেঠো-কেঠো, আড়ষ্ট, অস্বাভাবিক ভাব দেখতে পাবেন। রেনেসাঁসে সেটা আরও অনেক জীবন্ত, স্বাভাবিক হয়ে ऊ6।?

এই যে সব নাম দেখছি এ বইয়ে-গায়োট্টো–

গায়োট্টো লিখেছে নাকি?

তই তো দেখছি। গায়োট্টো, বটিসেল্লি, মানটেগনা…

আপনি ও বইটা রাখুন। আমি আর্টিস্টের নামের একটা তালিকা করে দেব-আপনি চান তো সে নামগুলো মুখস্থ করে রাখবেন। গায়োষ্ট্রো নয়। ইংরিজি উচ্চারণে জিয়োটা, ইটালিয়ানে জ্যোত্তো। জ্যোত্তো, বত্তিচেল্লী, মানতেন্যা…

এরা সব বলছেন জাঁদরেল আকিয়ে ছিলেন?

নিশ্চয়ই! শুধু এঁরা কেন? এ রকম অন্তত ত্ৰিশটা নাম পাবেন শুধু ইটালিতেই।

আর এই ত্ৰিশ জনের মধ্যে একজনের আঁকা ছবি রয়েছে বৈকুণ্ঠপুরে? বোঝো!

রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলুদা নিয়োগীদের বংশলতিকা খাটে বিছিয়ে সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। সেই সঙ্গে অবিশ্যি চন্দ্ৰশেখরের জীবন সংক্রান্ত তারিখগুলোও ছিল। সে কার দাদু, কে কার কাকা, কে কার ভাই, এগুলো আমার একটু গুলিয়ে যাচ্ছিল। এবার সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল।

দুটো জিনিসের চেহারা এই রকম—

বংশলতিকা

১। অনন্তনাথ (১৮৬২-১৯৪১)

  • সূর্যশেখর (১৮৮৮-১৯৪৮)
    • সৌম্যশেখর (১৯১৩-)
      • নবকুমার (১৯৪১-)
    • চন্দ্ৰশেখর (১৮৯০-?)
      • রুদ্রশেখর (১৯২০–)
        • নন্দকুমার (১৯৪৪)?

২। চন্দ্ৰশেখর নিয়োগী

১৮৯০ –জন্ম (বৈকুণ্ঠপুর)
১৯১২ –প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. পাশ
১৯১৪ –রোমযাত্ৰা। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের ছাত্র
১৯১৭ – কার্লা ক্যাসিনিকে বিবাহ
১৯২০ — পুত্র রুদ্রশেখরের জন্ম
১৯৩৭ –কার্লার মৃত্যু
১৯৩৮ –স্বদেশে প্রত্যাবর্তন
১৯৫৫ –গৃহত্যাগ

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়