প্লেনে নাগপুরে সাড়ে আটটার সময় পৌঁছে, সেখান থেকে দশটা পঞ্চাশের প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে ছিন্দওয়ারা পৌঁছতে প্ৰায় ছটা বেজে গেল। স্টেশনে শেভরোলে গাড়ি নিয়ে হাজির ছিলেন ভূদেব সিং-এর লোক। হাসিখুশি হৃষ্টপুষ্ট মাঝবয়সী এই ভদ্রলোকটির নাম মি. নাগপাল; চারজন গাড়িতে রওনা দিয়ে পৌনে সাতটার মধ্যে পৌঁছে গোলাম ভগওয়ানগড়ের রাজবাড়ি।

নাগপাল বললেন, আপনাদের জন্য ঘর ঠিক করা আছে, আপনারী হাত-মুখ ধুয়ে নিন, সাড়ে সাতটার সময় রাজা আপনাদের মিট করবেন। আমি এসে আপনাদের নিয়ে যাব।

ঘরের চেহারা দেখেই বুঝলাম যে আজ রাতটা আমাদের এইখানেই থাকার জন্য ব্যবস্থা হয়েছে। বিছানা, বালিশ, লেপ, মশারি, বাথরুমে তোয়ালে সাবান—সবই রয়েছে। যে কোনও ফাইভ-স্টার হোটেলের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। লালমোহনবাবু বললেন, এখানকার বাথরুমে নাকি তাঁর গড়পারের বাড়ির পাঁচটা বেডরুম ঢুকে যায়। নেহাত টাইম নেই, নইলে টবে গরম জল ভরে শুয়ে থাকতুম আধা ঘণ্টা।

কাঁটায় কটায় সাড়ে সাতটার সময় মিঃ নাগপাল আমাদের রাজার সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন। শ্বেতপাথরের মেঝোওয়ালা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন ভুদেব সিং। চেহারা যাকে বলে সীম্যাকাস্তি। বয়স সাতত্তর, কিন্তু মোটেও থুত্থুড়ে নন।

আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে রাজার সামনে তিনটে বেতের চেয়ারে বসলাম। হাসনাহানা ফুলের গন্ধে বুঝতে পারছি বারান্দার পরেই বাগান, কিন্তু অন্ধকারে গাছপালা বোঝা যাচ্ছে না।

কথাবার্তা ইংরেজিতেই হল, তবে আমি বেশির ভাগটা বাংলা করেই লিখছি। জটায়ুত বলেছিলেন, পার্টিসিপেট করবেন। কতদূর করেছিলেন সেটা যাতে ভাল বোঝা যায়। তাই নাটকের মতো করে লিখছি।

ভূদেব–আমার লেখাটা কেমন লাগল?

ফেলুদা–খুবই ইন্টারেস্টিং। ওটা না পড়লে এরকম একজন শিল্পীর বিষয় কিছুই জানতে পারতাম না।

ভূদেব–আসলে আমরা নিজের দেশের লোকদের কদর করতে জানি না। বিদেশ হলে এ রকম কখনওই হত না। তাই ভাবলাম—আমার তো বয়স হয়েছে, সেভেনটি-সেভেন–মরে যাবার আগে এই একটা কাজ করে যাব। চন্দ্ৰশেখরের বিষয় জানিয়ে দেব দেশের লোককে। আমার ছেলেকে পাঠিয়ে দিলাম। বৈকুণ্ঠপুর। চন্দ্রর সেলফপোট্রেট আমার কাছে ছিল না। সে আমাকে ছবি তুলে এনে দিল।

ফেলুদা–আপনার সঙ্গে চন্দ্ৰশেখরের আলাপ হয় কবে?

ভূদেব—দাঁড়ান, এই খাতাটায় সব লেখা আছে।..হ্যাঁ, ৫ই নভেম্বর ১৯৪২ সে আমার পোট্রেট আঁকতে আসে এখানে। তার কথা আমি শুনি ভূপালের রাজার কাছ থেকে। রাজার পোট্রেট চন্দ্র করেছিল। আমি দেখেছিলাম। আমার খুব ভাল লেগেছিল। চন্দ্র হ্যাঁড ওয়ান্ডারফুল স্কিল।

জটায়ু–ওয়ান্ডারফুল।

ফেলুদা–আপনার লেখায় পড়েছি তিনি ইটালিতে গিয়ে একজন ইটালিয়ান মহিলাকে বিয়ে করেন। এই মহিলা সম্বন্ধে আরেকটু কিছু যদি বলেন।

জটায়ু–সামথিং মোর…

ভূদেব–চন্দ্ৰশেখর রোমে গিয়ে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ভর্তি হয়। ওর ক্লাসেই ছিল কাল ক্যাসিনি। ভেনিসের অভিজাত বংশের মেয়ে। বাবা ছিলেন কাউন্ট। কাউন্ট আলবেতো ক্যাসিনি। কাল ও চন্দ্ৰশেখরের মধ্যে ভালবাসা হয়। কালা তার বাবার সঙ্গে চন্দ্ৰশেখরের পরিচয় করিয়ে দেয়। এখানে বলে রাখি, চন্দ্ৰশেখর আয়ুৰ্বেদ চৰ্চা করেছিল। ইটালি যাবার সময় সঙ্গে বেশ কিছু শিকড় বাকল নিয়ে গিয়েছিল। কালার বাপ ছিলেন গাউটের রুগি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ভুগতেন। চন্দ্ৰশেখর তাঁকে ওষুধ দিয়ে ভাল করে দেয়। বুঝতেই পারছি, এর ফলে চন্দ্রর পক্ষে কাউন্টের মেয়ের পাণিগ্রহণের পথ। অনেক সহজ হয়ে যায়। ১৯১৭-তে বিয়েটা হয়, এবং এই বিয়েতে কাউন্ট একটি মহামূল্য উপহার দেন চন্দ্ৰকে।

ফেলুদা–এটা কি সেই ছবি?

জটায়ু–রেনেসাঁস?

ভূদেব–হ্যাঁ। কিন্তু এই ছবিটা সম্বন্ধে কতটা জানেন আপনারা?

ফেলুদা–ছবিটা দেখেছি, এই পর্যন্ত। মনে হয় রেনেসাঁস যুগের কোনও শিল্পীর আঁকা।

ভূদেব–আপনারা ঠিকই ধরেছেন, তবে যে-কোনও শিল্পী নয়।

জটায়ু—(বিড়বিড় করে)—বত্তিজাত্তো…দাভিঞ্চেল্লি…

ভূদেব—আপনারা ঠিকই ধরেছেন, তবে যে কোনও শিল্পি নয়। রেনেসাঁসের শেষ পর্বের অন্যতম। সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্পী। টিনটোরেটো!

জটায়ু–ওফ্‌ফ্‌ফ্‌ফ্‌ফ্‌!

ফেলুদা–টিনটারেটার নিজের আঁকা তো খুব বেশি ছবি আছে বলে জনা যায় না, তাই না?

ভূদেব–না। অনেক ছবিই আংশিক ভাবে টিনটারেটোর আঁকা, বাকিটা এঁকেছে তার স্টুডিয়ো বা ওয়র্কশপের শিল্পীরা। এটা তখনকার অনেক পেন্টার সম্পর্কেই খাটে। তবে কাজটা যে উঁচুদরের তাতে সন্দেহ নেই। সে ছবি চন্দ্ৰ এনে আমাকে দেখিয়েছিল। টিনটোরেটের সব লক্ষণই রয়েছে ছবিটায়। ষোড়শ শতাব্দী থেকেই ক্যাসিনি। প্যালেসে ছিল ছবিটা।

ফেলুদা—তার মানে ওটা তো একটা মহামূল্য সম্পত্তি।

ভূদেব—ওর দাম বিশ-পঁচিশ লাখ হলে আশ্চর্য হব না।

জটায়ু–(নিশ্বাস টেনে)—হিঁ ই ই ই ই!

ভূদেব—সেই জন্যেই তো আমি পেন্টারের নামটা বলিনি প্রবন্ধটায়।

ফেলুদা–কিন্তু তাও বৈকুণ্ঠপুরে লোক এসে খবর নিয়ে গেছে।

ভূদেব—কে? ক্রিকোরিয়ান এসেছিল নাকি?

ফেলুদা—ক্রিকোরিয়ান? কই না তো! ও নামে তো কেউ আসেনি।

ভূদেব—আর্মেনিয়ান ভদ্রলোক। আমার কাছে এসেছিল। ওয়ালটার ক্রিকোরিয়ান। টাকার কুমির। হংকং-এর ব্যবসাদার এবং ছবির কালেক্টর। বলে ওর কাছে ওরিজিনাল রেমব্রান্ট আছে, টানার আছে, ফ্রাগোনার আছে। আমাদের বাড়িতে একটা বুশের-এর ছবি আছে, আমার ঠাকুরদাদার কেনা। সেটা কিনতে এসেছিল। আমি দিইনি। তারপর বলল ও আমার লেখাটা পড়েছে। জিজ্ঞেস করছিল নিয়োগীদের ছবিটার কথা। ও নিজে এত বড়াই করছিল যে আমি উলটে একটু বড়াই করার লোভ সামলাতে পারলাম না। বলে দিলাম টিনটোরেটের কথা। ও তো লাফিয়ে উঠেছে চেয়ার থেকে। আমি বললাম, ও ছবিও তুমি কিনতে পাবে না, কারণ পয়সার লোভের চেয়ে প্রাইড অফ পোজেশন আমাদের ভারতীয়দের অনেক বেশি। এটা তোমরা বুঝবে না। ও বললে, সে ছবি আমার হাতে আসবেই, তুমি দেখে নিয়ো। বলেছিল নিজেই যাবে বৈকুণ্ঠপুরে। হয়তো হঠাৎ কোনও কাজে ফিরে গেছে। তবে ওর এক দালাল আছে—

ফেলুদা—হীরালাল সোমানি?

ভূদেব—হ্যাঁ।

ফেলুদা—ইনিই গিয়েছিলেন বৈকুণ্ঠপুরে।

ভূদেব-অত্যন্ত ঘুঘু লোক। ওকে যেন একটু সাবধানে হ্যান্ডল করে।

ফেলুদা—কিন্তু ও ছবি তো চন্দ্ৰশেখরের ছেলের সম্পত্তি। সে তো এখন বৈকুণ্ঠপুরে।

ভূদেব—হোয়াট! চন্দ্রর ছেলে এসেছে? এতদিন পরে?

ফেলুদা—তাকে দেখে এলাম আমরা।

ভূদেব—ও। তা হলে অবিশ্যি সে ছবিটা ক্লেম করতে পারে। কিন্তু টিনটোরেটো তার হাতে চলে যাচ্ছে এটা ভাবতে ভাল লাগে না মিস্টার মিট্রা!

ফেলুদা—এটা কেন বলছেন?

ভূদেব—চন্দ্রর ছেলের কথা তো আমি জানি। চন্দ্রকে কত দুঃখ দিয়েছে তাও জানি। এসব কথা তো নিয়োগীরা জানবে। না, কারণ চন্দ্ৰ আমাকে ছাড়া আর কাউকে বলেনি। পরের দিকে অবিশ্যি ছেলের কথা আর বলতেই না, কিন্তু গোড়ায় বলেছে। ছেলে মুসোলিনির ভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুসোলিনি তখন ইটালির একচ্ছত্র অধিপতি। বেশির ভাগ ইটালিয়ানই তাকে পুজো করে। কিন্তু কিছু বুদ্ধিজীবী-শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সংগীতকার—~ ছিলেন মুসোলিনি ও ফ্যাসিস্ট পাটির ঘোর বিরোধী। চন্দ্ৰ ছিল এদের একজন। কিন্তু তার ছেলেই শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট পাটিতে যোগ দেয়। তার এক বছর আগে কালর্স মারা গেছে। ক্যানসারে। এই দুই ট্রাজিডির ধাক্কা চন্দ্র সইতে পারেনি। তাই সে দেশে ফিরে আসে। ছেলের সঙ্গে সে কোনও যোগাযোগ রাখেনি। ভাল কথা, ছেলেকে দেখলে কেমন? তার তো ষাটের কাছাকাছি বয়স হবার কথা।

ফেলুদা–বাষট্টি। তবে এমনিতে শক্ত আছেন বেশ। কথাবার্তা বলেন না বললেই চলে।

ভূদেব–বলার মুখ নেই বলেই বলে না।..স্ত্রীর মৃত্যু ও ছেলের বিপথে যাওয়ার দুঃখ চন্দ্ৰ কোনওদিন ভুলতে পারেনি। শেষে তাই তাকে সংসার ত্যাগ করতে হয়েছিল। এই নিয়ে অবশ্য তার সঙ্গে আমার কথা কটাকাটিও হয়। তাকে বলি–তোমার মধ্যে এত ট্যালেন্ট আছে, এখনও কাজের ক্ষমতা আছে, তুমি বিবাগী হবে কেন? কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি।

ফেলুদা–আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন কি?

ভূদেব–মাঝে মাঝে একটা করে পোস্টকার্ড লিখত, তবে

অনেক’দিন আর খবর পাইনি। ফেলুদা-শেষ কবে পেয়েছিলেন মনে আছে?

ভূদেব-দাঁড়াও, এই বাক্সের মধ্যেই আছে তার চিঠিগুলো। হ্যাঁ, সেপ্টেম্বর ১৯৭৭। হৃষীকেশ থেকে লিখেছে এটা।

ফেলুদা—অর্থাৎ পাঁচ বছর আগে। তার মানে তো আইনের চোখে তিনি এখনও জীবিত!

ভূদেব–সত্যিই তো! এটা তো আমার খেয়াল হয়নি।

ফেলুদা–তার মানে রুদ্রশেখর এখনও তার সম্পত্তি ক্লেম করতে পারেন না।

 

পরদিন ভূদেব সিং গাড়িতে ঘুরিয়ে ভগওয়ানগড়ের যা কিছু দ্রষ্টব্য সব দেখিয়ে দিলেন। আমাদের। গড়ের ভগ্নস্তূপ, ভবানীর মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ গার্ডেনস, পিথেরি লেক, জঙ্গলে হরিণের পাল–কিছুই বাদ গেল না।

কথাই ছিল এবার শেভরোলে গাড়ি আমাদের একেবারে নাগপুর অবধি পৌঁছে দেবে, যাতে আমাদের আর প্যাসেঞ্জার ট্রেনের ঝক্কি পোয়াতে না হয়। গাড়িতে ওঠার আগে ভূদেব সিং ফেলুদার কাঁধে হাত রেখে বললেন——

সি দ্যাট দ্য টিনটোরেটা ডািজনট ফল ইনটু দ্য রং হ্যান্ডস।

মি. নাগপালকে আগেই বলা ছিল; তিনি ওই আর্মেনিয়ান ভদ্রলোকের নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে ফেলুদাকে দিলেন, ফেলুদা সেটা সযত্নে ব্যাগে পুরে রাখল।

পরদিন এগারোটায় বাড়ি ফিরে এক ঘণ্টার মধ্যে বৈকুণ্ঠপুর থেকে নবকুমারবাবুর টেলিফোন এল।

চট করে চলে আসুন মশাই। এখানে গণ্ডগোল ।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়