প্রথম দিনের কাজটা খুব ভাল ভাবেই উতরে গেল। প্রথম শটই ছিল আমার–মোহনের পোশাকে এসে ঘরে ঢুকছি দেওয়ানের সঙ্গে। সামনে বাবা, পোশাক বদল দেখে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা। প্রথমবারেই ঠিক হওয়ার জন এক চোট সকলের হাততালি পেলাম। এমনকী মিঃ লোহিয়া শুটিং দেখছিলেন তাঁর নাতিকে সঙ্গে নিয়ে, তিনিও হাততালিতে যোগ দিলেন। আজ বাবা-মার কথা মনে হয়ে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এমন সুন্দর শুটিং তাঁরা দেখলে না জানি কত খুশি হতেন! কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার দ্বিতীয় শটের জন্য তৈরি হতে হবে বলে দুঃখটা ঝেড়ে ফেলে দিতে হল। বিশুদা প্রথম শট-এর সময় ছিল। সে শট-এর পর আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে ফিসফিস করে বলে গেল, এইভাবে চালিয়ে যা। কুছ পরোয়া নেহি!

রাজার পার্টে পুলকেশ ব্যানার্জিও বেশ ভালই করলেন, কিন্তু তিনি একটা কথা বললেন লাঞ্চের সময়, সেটা আমার খুব মজার লাগল।–জানো মাস্টার অংশুমান, শিশু অভিনেতা পাশে থাকলে আর বড়দের দিকে কেউ চায় না। আমরা মিথ্যেই খেটে মরছি। এটাও লক্ষ করলাম যে প্রত্যেক শট-এর আগে পুলকেশবাবু চোখ বুজে বিড়বিড় করে কী যেন বলে নেন। বোধহয় ঠাকুরের নাম করে নেন।

মমতামাসির অ্যাকটিং-ও আমার খুব ভাল লাগল। বিশেষ করে চোখে জল আনার ব্যাপারটা। অনেক অ্যাক্টর নিজে থেকে চোখে জল আনতে পারে না। কান্নার দরকার হলে তারা শটের আগে চোখের কোনায় গ্লিসারিনের ফোঁটা দিয়ে নেয়। তার ফলে চোখ জ্বালা করে, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ জলে ভরে যায়। মমতামাসি বললেন তাঁর গ্লিসারিনের দরকার হবে না। অবাক হয়ে দেখলাম যে, সত্যিই তাই। দস্যুরা তাঁর ছেলেকে না নিয়ে ভুল করে অন্য ছেলেকে নিয়ে গেছে জেনে তাঁর এত আনন্দ হয়েছে যে, কান্নায় ভেঙে পড়ে নিজের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

বিকেল পাঁচটার মধ্যে পুরো দৃশ্যটা শেষ হয়ে গেল। এর পরের কাজটা অন্ধকার হলে পর হবে; তার মানে সাতটার আগে নয়। পুলকেশবাবু আর মমতামাসি সার্কিট হাউসে ফিরে গেলেন। বাকি কাজটা খুবই সোজা; আমাকে শুধু এ ঘর ওঘর ঘুরতে হবে, আর ক্যামেরা সেটা পাঁচিলের বাইরে থেকে এমনভাবে তুলবে যে, মনে হয় যেন দস্যুরাই ব্যাপারটা দেখছে।

দুটো ঘণ্টা দিব্যি বেরিয়ে গেল গ্রামোফোন শুনে। মিঃ লোহিয়ার একটা চোঙাওয়ালা পুরনো গ্রামোফোন আছে, আর আছে রাজ্যির পুরনো হিন্দি ওস্তাদি গানের রেকর্ড। সেই সব রেকর্ড তিনি বাজিয়ে শোনাচ্ছিলেন। দম দেওয়া গ্রামোফোন এর আগে আমি কখনও দেখিনি। অ্যাসিস্ট্যান্ট মুকুল চৌধুরী খুব ওস্তাদি গানের ভক্ত; সে বলল, এসব রেকর্ড নাকি আজকাল একেবারেই পাওয়া যায় না। অথচ মিঃ লোহিয়া সেগুলোকে এমন যত্নে রেখেছেন যে, এতদিনেও পুরনো হয়নি।

সাতটার কিছু আগেই গান শোনা বন্ধ করে শটের জন্য তৈরি হতে শুরু করলাম। এবার রাজপুত্রের পোশাক, ঠিক পনেরো মিনিট লাগল তৈরি হতে। কিন্তু তা হলে কী হবে, খবর এল যে কাজে একটু দেরি হবে; আসল দস্য মগনলাল যে সাজবে সেই জগন্নাথ দে বা জগু ওস্তাদকে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশুদা হন্তদন্ত হয়ে সকলকে জিজ্ঞেস করে বেড়াচ্ছে কেউ জগন্নাথকে দেখেছে কিনা। বিকেলে আমি নিজে দেখেছি ভদ্রলোককে; এর মধ্যে হঠাৎ তিনি গেলেন কোথায়?

এখানে বলে রাখি যে, অ্যাকটর হিসেবে তিনি যতই ভাল হন, লোক হিসেবে আমার জগু ওস্তাদকে তেমন ভাল লাগছে না। তার দুটো কারণ আছে। এক হল, জগু ওস্তাদের হাসিটা পরিষ্কার নয়। সত্যি বলতে কি, পান-দোক্তা খাওয়া অমন দাঁতে পরিষ্কার হতেও পারে না। দ্বিতীয় কারণ হল, দলের দুই চাকর ভিখু আর পঞ্চাননের সঙ্গে ভদ্রলোকের ব্যবহার মোটেই ভাল না। এটা আমার ভীষণ খারাপ লাগে, বিশেষ করে এই কারণে যে, ওরা দুজনেই দারুণ পরিশ্রম করতে পারে।

বিশুদা জগু ওস্তাদকে খুঁজতে যাবার আগে সুশীলবাবুর সঙ্গে কথা বলে গেল যে, ইতিমধ্যে যেন আমার শটটা নেওয়া হয়ে থাকে। আমি তো তৈরি, এখন শুধু বাকি আলো বসানো। সাধারণ বিজলিবাতিতে শুটিং সম্ভব নয়, তাই স্টুডিওর বড় আলো ব্যবহার করতে হবে। ডিরেক্টর সুশীলবাবু এসে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কেমন করে এ-ঘর থেকে ও-ঘর চলাফেরা করতে হবে। মনে মনে গুনগুন করে গান গাও, বললেন সুশীলবাবু, আর সেই গানের তালে তালে পা ফেলল। তা হলে চলাটা স্বাভাবিক আর মজাদার হবে। আসলে রাজপুত্রের কিছু করার নেই তাই সে আপনমনে এ-ঘর ও-ঘর করছে। এই ভাবটা ছবিতে ফুটে ওঠা চাই।

আমি একটু একটু গাইতে পারি, কিন্তু কী গান গাইব সেটা চট করে ভেবে পেলাম না। সুশীলবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে উনি একটু ভেবে বললেন, ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় জানো?

আমি হ্যাঁ বলতে সুশীলবাবু বললেন, ভেরি গুড, তা হলে ওটাই গুনগুন কোরো। আমি মনে মনে গানটা একবার গেয়ে নিলাম। পুরো গানের কথা মনে নেই, আর তার দরকারও নেই।

আধঘণ্টার মধ্যে শটটা খুব সুন্দরভাবেই হয়ে গেল। তারও আধঘণ্টা পরে বিশুদা এসে খবর দিল যে, জগু ওস্তাদকে পাওয়া গেছে। বিশুদা একেবারে ফায়ার হয়ে আছে দেখে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, কিন্তু কথাবার্তাতে বুঝলাম যে জগু ওস্তাদের নেশা করার বাতিক আছে; সে চলে গিয়েছিল রাজবাড়ি থেকে কিছু দূরে বাজারের মধ্যে একটা মদের দোকানে। সন্ধ্যা হলেই সে নাকি নেশা না করে পারে না।

এদিকে অন্য দুজন দস্যু তৈরি হয়ে বসে আছে, এবার জগু ওস্তাদকে মেক-আপ করে পোশাক পরে ছগনলাল সাজতে হবে। কাজেই আরও প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। বিশুদা এর মধ্যে একবার জিজ্ঞেস করে গেছে আমি বাড়ি যেতে চাই কিনা। আমার কিন্তু সব ব্যাপারটা ভীষণ ভাল লাগছে, তাই বলে দিলাম যে দস্যুদের শট না দেখে ফিরব না।

শট হতে হতে হয়ে গেল সাড়ে নটা। তিন গুণ্ডা রাজবাড়ির পাঁচিলের বাইরে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। পাঁচিলটা উঁচু হওয়াতে রাজবাড়ির শুধু চুড়োটা দেখা যাচ্ছে। তাই মগনলাল তরতরিয়ে গাছে উঠে যায়। আর তার দেখাদেখি অন্য দুজন গুণ্ডাও। এবার তারা অমৃৎকে দেখতে পায়। ঠিক এই সময় একজন টহলদার সেপাই এসে পড়ে। তার হাঁক শুনে তিন গুণ্ডা গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে দৌড়ে গিয়ে তাদের গাড়িতে উঠে পালায়।

শুটিং দেখে এটা বুঝতে পারলাম যে নেশাই করুক আর যাই করুক, জগু ওস্তাদ অ্যাকটিং-এ দারুণ পাকা। বিশুদা পরে বলেছিল, লোকটা মারাত্মক অভিনেতা। তাই ওর শত বদখেয়াল সত্ত্বেও ওকে না নিয়ে উপায় নেই। আমি মনে মনে বললাম, আর যাই করো বাবা, আমার সঙ্গে অ্যাকটিং করার সময়

নেশা করে এসো না। আমি শুনেছি মদের গন্ধ ভয়ানক খারাপ।

<

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়