শুটিং থেকে রাত করে ফিরে বেশ ক্লান্ত লাগছিল, তাই খেয়ে নিয়েই শুতে চলে গেলাম। আগামীকাল অত ভোরে ওঠার দরকার নেই, কারণ সকালে শুধুই পুষ্করের মেলার ভিড়ের শট নেওয়া হবে, তাতে কোনও অভিনেতার দরকার হবে না। মেলা শুরু হবে কাল থেকেই, কাজেই খুব বেশি ভিড় হবার আগে কিছু শট নিয়ে রাখা দরকার। সন্ধেবেলা আবার কাজ আছে রাজবাড়িতে। এবারে হিরো শঙ্কর মল্লিককে লাগবে। দৃশ্যটা হচ্ছে–রাজা পুলিশে খবর দেবার পর ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত এসে অমৃৎকে জেরা করে। সব ব্যাপারটা জেনে নিচ্ছে। কাজেই আমারও কাজ আছে, আর পুলকেশ ব্যানার্জিরও আছে।

ওঠার তাড়া না থাকলেও সাতটার বেশি বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলাম না। এক হিসেবে ভালই হল। কারণ বারান্দায় বেরিয়েই বিশুদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বিশুদা বলল, তুই আমাদের সঙ্গে আসবি?

আমি বললাম, কোথায়?

জায়গাটার নাম দৌরাল। এখান থেকে ষোলো কিলোমিটার দূর। গল্পের মতো একটা নালা পাওয়া গেছে, সেটা কৃষ্ণণকে দেখিয়ে দেব। ও একবার পরখ করে দেখতে চায় মোটর সাইকেলে টপকে পেরোনো যায় কিনা।

স্টান্টম্যান এসে গেছে?

আর বলিস না! বলল বিশুদা, ট্রেন প্রায় তিন ঘণ্টা লেট। কৃষ্ণণকে নিয়ে আমি ফিরেছি প্রায় রাত দেড়টায়।

তার মানে মোটর সাইকেলও থাকবে আমাদের সঙ্গে?

তা থাকবে বইকী! সেটা যাবে বাসের মাথায়। ওখানে গিয়ে চড়বে কৃষ্ণণ।

কৃষ্ণণ কোন দেশি লোক বিশুদা? ম্যাড্রাসি?

সেটা দেখলেই বুঝতে পারবি।

আটটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট হয়ে গেল। আজ বাস ছাড়া কিছুই যাচ্ছে না, কারণ তিনটে গাড়িই পুষ্কর চলে গেছে শুটিং-এ। তবে আউটিং-এ অনেকেরই উৎসাহ। তাই যারা শুটিং-এ যায়নি তারা প্রায় সকলেই বাসে উঠে পড়ল। সবশেষে বিশুদার সঙ্গে এল একজন লোক যার বছর ত্রিশেক বয়স, গায়ের রঙ মোটামুটি পরিষ্কার, আর হাইট মাঝারির চেয়ে একটু বেশি। ভদ্রলোকের শরীর যে অত্যন্ত ফিট সেটা তার হাঁটাচলা দেখলেই বোঝা যায়।

স্টান্টম্যান-স্টান্টম্যান করছিলি–ইনিই ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ, বলে বিশুদা ভদ্রলোককে আমার পাশের খালি সিটে বসিয়ে দিল। ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ আমার দিকে চেয়ে ঝলমলে দাঁত বার করে হেসে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, নমস্কার।

আমি তো অবাক! ভাবতেই পারিনি যে কৃষ্ণণ বাঙালির নাম হতে পারে।

বাসের মাথায় মোটর সাইকেল চড়ে গেছে, দুবার হর্ন দিয়ে ডিলাক্স বাস রওনা দিয়ে দিল।

বাসের সবাই ঘুরে ঘুরে নতুন-আসা স্টান্টম্যানের দিকে দেখছে; আমার চোখটাও চলে গেল তাঁর দিকে। ভদ্রলোক এখনও মিটিমিটি হাসছেন। শেষে আর না থাকতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বাঙালি বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু আপনার নাম তো–?

আমার নাম কৃষ্ণপদ সান্যাল, হেসে বললেন ভদ্রলোক, বম্বেতে বাঙালি স্টান্টম্যানকে কেউ পাত্তা দেয় না, তাই একটা দক্ষিণী নাম নিয়েছি। ওখানে ভাঙাভাঙা হিন্দি আর ইংরেজি বলি। কথা তো বলতে হয় না বেশি–আমাদের কথায় কেউ কান দেয় না, শুধু দেখে কাজটা ঠিক হচ্ছে কিনা!

আমার অদ্ভুত লাগছিল ভদ্রলোককে দেখে। ইনিই শঙ্কর মল্লিক হয়ে সব কঠিন প্যাঁচের কাজগুলো করবেন, আর লোকে ছবি দেখে ভাববে সব বুঝি শঙ্কর মল্লিকই করছেন। বিশুদা বলছিল, হিন্দি ছবির হিরোরা যত ফাইটিং করে, যত ঘোড়া থেকে পড়ে, যত এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি লাফ মেরে চলে যায়–সবই আসলে করে স্টান্টম্যানরা, কিন্তু বাইরের লোকে সেটা জানতেও পারে না।

আমি আরেকবার আড়চোখে চাইলাম ভদ্রলোকের দিকে। কৃষ্ণপদ সান্যাল। তার মানে ব্রাহ্মণ। তাদের বাড়ির ছেলে স্টান্টম্যান হল কী করে? এসব তোতা জানতে হবে ভদ্রলোকের কাছ থেকে। এটা বেশ বুঝছি যে, একে একটা গোঁফ লাগিয়ে দিলে একটু দুর থেকে শঙ্কর মল্লিকের সঙ্গে বেশি তফাত করা যাবে না। দুজনের গায়ের রঙ আর গড়ন মোটামুটি একই রকম। বিশুদার বাছাইয়ের প্রশংসা করতে হয়। সে-ই যে এই স্টান্টম্যানকে জোগাড় করে এনেছে সেটা জানি।

তোমার নাম কী?

নাম বললাম। তারপর বললাম, আমাকে তো বোধহয় আপনার পিছনে বসতে হবে মোটরবাইকে।

তা বসবে, বললেন ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ, ভয়ের কোনও কারণ নেই। মোেটর সাইকেলের স্টান্ট আমার মতো কেউ করতে পারে না। বাইশটা হিন্দি-তামিল ছবিতে আমি মোটর সাইকেল চালিয়েছি, একবারও গড়বড় হয়নি।

তাই বুঝি?

ইয়েস স্যার।

ভদ্রলোককে দেখে কেন জানি বেশ ভাল লাগছিল। চেহারার মধ্যে এমন একটা নির্ভীক ভাব চট করে দেখা যায় না। আর এমন পরিস্কার হাসি যে মানুষের, তার মধ্যে কোনও নিচুভাব থাকতে পারে কি? মনে তো হয় না।

ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ গুনগুন করে হিন্দি গানের সুর ভাঁজছেন দেখে আমি আর কোনও কথা বললাম না। ভাল করে আলাপ করার অনেক সময় আছে। নালা টপকানোর শুটিংটা হবে দুসপ্তাহ পরে, সেটা আমি জেনে নিয়েছি।

দৌরাল একটা ছোট্ট শহর। সেটা ছাড়িয়ে বাস আরও কিছুদূর যাবার পর বিশুদা এক জায়গায় থামতে বলল। বাঁয়ে বনের মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ চলে গিয়েছে। বুঝতে পারলাম সেটা দিয়ে আর বাস যাবে না, আর সেটা দিয়েই আমাদের যেতে হবে। এইসব জায়গা বাছার জন্য সুশীলবাবু বিশুদা আর ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নিয়ে গত মাসেই একবার আজমীর ঘুরে গেছেন। জায়গা বাছার কাজটা সবসময় আগেই সেরে নিতে হয়; শুটিং একবার আরম্ভ হয়ে গেলে তখন আর অন্য কিছুর সময় থাকে না। এই নালাটা ডিরেক্টর সাহেবের পছন্দ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যাকে মোটর সাইকেল করে এটা টপকে পেরোতে হবে তারও তো পছন্দ হওয়া চাই!

বিশুদা বলল, জায়গাটা বড় রাস্তা থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ। জিপে করে অনায়াসেই যাওয়া। যায়, এমনি গাড়ি বা বাসে সম্ভব নয়।

আমরা বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। মোটর সাইকেলটাও নামানো হয়েছে; ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ তাতে চড়ে বিকট আওয়াজ তুলে স্টার্ট দিয়ে আমাদের পাশে-পাশেই চললেন।

পাতলা বন, গাছ পালাগুলো সব অচেনা, এ দৃশ্যের সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের কোনও মিল নেই। ক্রমে বড় রাস্তার গাড়ি চলাচলের শব্দ একেবারে মিলিয়ে এল। এখন শুধু মোটর সাইকেলের শব্দ আর পাখির ডাক।

মিনিটখানেক পরে একটা কুলকুল শব্দ পেলাম। বুঝলাম নালা এসে গেছে। এখানে পথটা একটু চওড়া আর একটু চড়াই। খানিকদূর চড়াই গিয়ে রাস্তাটা হঠাৎ ঢালু নেমে গিয়ে একেবারে নালায় পড়েছে। নালাটা হাত দশেক চওড়া হলেও মোটর সাইকেলকে লাফিয়ে পার হতে হবে প্রায় বিশ পঁচিশ হাত, তা হলে ঠিক এদিকে চড়াই-এর মুখ থেকে ওদিকে উতরাইয়ের মুখে গিয়ে পড়বে।

কী কাপ্তেন, কী মনে হচ্ছে?

বিশুদা ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল। কৃষ্ণণ ইতিমধ্যে বাইক থেকে নেমে সেটাকে দাঁড় করিয়ে নালা আর রাস্তাটাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে।

দাঁড়ান, একবার ওপারটা দেখে আসি।

কৃষ্ণণ ঢাল দিয়ে নেমে জলের ধারে গিয়ে প্যান্টটাকে গুটিয়ে খানিকটা উপরে তুলে ছপ ছপ করে জল পেরিয়ে ওপারে চলে গেলেন। মিনিটখানেক ওদিকটা দেখার পর আবার এদিকে ফিরে এসে বললেন, আমি একবার ট্রাই করে দেখব। আপনারা একটু পাশে সরে দাঁড়ান।

দলের সবাই হুড়মুড় করে নালার ধারে নেমে রাস্তার দুপাশে ভাগ হয়ে দাঁড়াল। আমি বাঁ দিকের দলের সঙ্গে রয়েছি, আমার চোখ রাস্তার দিকে। কৃষ্ণণ ইতিমধ্যে আবার ওপরে ফিরে এসে মোটর সাইকেলের দিকে এগিয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশে ঝোঁপ থাকার জন্য কৃষ্ণণকে আর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ফটফটানি শোনা যাচ্ছে। আওয়াজ যেভাবে কমে আসছে তাতে বুঝতে পারছি কৃষ্ণণ বাইকটাকে বেশ দূরে নিয়ে যাচ্ছেন স্পিড় তোলার সুবিধার জন্য।

রেডি হলে বলবেন! হাঁক দিল বিশুদা।

কয়েক সেকেন্ড পরেই উত্তর এল—

রেডি! আই অ্যাম কামিং।

এবার বাইকের শব্দটা ক্রমে বেড়ে যাওয়াতে বুঝতে পারলাম সেটা রওনা দিয়েছে। রওনা দেওয়া, আর ঝোঁপের পিছন থেকে হঠাৎ ম্যাজিকের মতো বেরোনো–এই দুটো অবস্থার মধ্যে ব্যবধান বড়জোর তিন সেকেন্ডের। আর তার পরেই ঘটল তাক লাগানো ব্যাপারটা। একটা হিংস্র, ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে অনায়াসে দশ হাত দূরে তার শিকারের উপর লাফিয়ে পড়ে, সেইভাবে, আর ঠিক সেই রকম সহজে আর সতেজে ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণের মোটরবাইক শূন্য দিয়ে লাফিয়ে নালা টপকে উলটোদিকের উতরাইয়ের মুখটাতে পড়ে গড়গড়িয়ে নেমে ওদিকের ঝোঁপের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এর পরে একটাই জিনিস হবার ছিল, আর হলও তাই। দলের সব কটি লোক একসঙ্গে হাততালি দিয়ে কৃষ্ণণের এই আশ্চর্য স্টান্টের তারিফ করল।

কিন্তু এইখানেই খেলার শেষ নয়। এর পরে যেটা হল সেটা আমি সারাজীবন ভুলতে পারব না। ওপার থেকে হঠাৎ কৃষ্ণণের ডাক শোনা গেল।

মাস্টার অংশুমান।

আমি আমার নামটা শুনে হঠাৎ কেন জানি থতমত খেয়ে গেলাম। অংশুমান যেন আমি নই; নামটা যেন অন্য কারুর।

কোথায়–মাস্টার অংশুমান! আবার এল ডাক।

এদিকে বিশুদা আমার দিকে এগিয়ে এসেছে।

তোকে ডাকছে–তুই যাবি?

যাব।

হঠাৎ মনের সমস্ত ভয় যেন ম্যাজিকের মতো উবে গেল। আমার মন বলল, ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ যেখানে সারথি সেখানে ভয়ের কিছু থাকতে পারে না।

আমি চেঁচিয়ে বলে দিলাম, এক্ষুনি আসছি। তারপর প্যান্ট তুলে নালা পেরিয়ে হাজির হলাম ওপারে। বিশ হাত দূরে ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ বসে আছেন বাইকে; আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

রিহার্সালটা হয়ে যাক!

আমি এগিয়ে গেলাম ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণের দিকে। ভদ্রলোক ক্যারিয়ারের উপর একটা চাপড় মেরে বুঝিয়ে দিলেন আমায় কোথায় বসতে হবে। আমি বসলাম।

কিচ্ছু ভয় নেই; শুধু আমার কোমরটাকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে।

আমি ধরলাম। ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ বাইকটাকে ঘুরিয়ে আরেকটু দূরে নিয়ে গেলেন। তারপর আবার নালার দিকে ঘুরিয়ে এঞ্জিনে একটা হুঙ্কার দিয়ে বাইকটা ছেড়ে দিলেন।

কোমর জড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি কিছুই দেখিনি, শুধু জানি যে যখন চোখ খুললাম তখন আমি উলটো পারে চলে এসেছি, আমার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে, আর সকলে নতুন করে হাততালি দিচ্ছে আর শাবাশ শাবাশ বলছে।

কেমন লাগল? জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন কৃষ্ণণ।

আমি বললাম, দারুণ মজা, দারুণ আরাম।

যাক, আর কোনও ভাবনা নেই। কাল স্টেশন থেকে আসার পথে বিশুবাবু বলেছিলেন সিনটার কথা। আমি বললাম, কোনও চিন্তা নেই। ছেলেটি যদি সাহস করে বাইকে চড়তে পারে তা হলে আমার দিক দিয়ে কোনও গড়বড় হবে না।

এর মধ্যে আরও অনেকে আমাদের কাছে এসে পড়েছে। সুশীলবাবু পুষ্করে শুটিং করছেন, নাহলে উনিও নিশ্চয় খুবই খুশি আর নিশ্চিন্ত হতেন। শঙ্কর মল্লিক আমার পিঠ চাপড়ে ব্রেভ বয় বলে তারিফ করলেন, তারপর কৃষ্ণণের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার এই স্টান্টের ব্যাপারে সত্যিই চিন্তা ছিল। জানি আমাকে এসব কিছুই করতে হবে না, কিন্তু যে করবে তাকে মানাবে কিনা সেইটেই ছিল ভাবনা। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার মতো একটা গোঁফ লাগিয়ে দিলে একটু দূর থেকে বা পিছন থেকে কেউ আর তফাতই করতে পারবে না।

যে কাজের জন্য আসা হয়েছিল সেটা হয়ে গেছে বলে সবাই আবার বাসে উঠল। বারোটার মধ্যে সার্কিট হাউসে দুপুরের খাওয়া সেরে যেতে হবে মিঃ লোহিয়ার বাড়ি।

নালা টপকানোর ব্যাপারে রিহার্সালটা এভাবে উতরে যাওয়াতে আমার যে কী নিশ্চিন্ত লাগছে তা বলতে পারি না। সমস্ত ছবিটাতে এটাই আমার সবচেয়ে কঠিন কাজ, আর এটা নিয়েই ছিল সবচেয়ে বেশি ভাবনা। ভাগ্যিস কৃষ্ণণকে পাওয়া গিয়েছিল! ভাল স্টান্টম্যান যে কী জিনিস সেটা আজ প্রথম। বুঝলাম।

<

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়