ছটা বাজতে পাঁচ মিনিটে আমরা প্রতুল দত্তর বাড়ির গেটের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামলাম। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি যে বাবাও আমাদের দেখে চিনতে পারতেন না। ফেলুদা সেজেছে একটা ষাট বছরের বুড়ো। কাঁচা-পাক মেশানো ঝোলা গোঁফ, চোখে মোটা কাচের চশমা, গায়ে কালো গলাবন্ধ কোট, হাঁটুর উপর তোলা ধুতি, আর মোজার উপর বাটার তৈরি ব্রাউন কেড্রস জুতো আধঘণ্টা ধরে ঘরের দরজা বন্ধ করে মেক-আপ করে বাইরে এসেই বলল, “তোর জন্য দু-তিনটে জিনিস আছে—চট করে পরে নে।’ 8
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমাকেও মেক-আপ করতে হবে নাকি ?’
আলবাৎ!’ – দুমিনিটের মধ্যে আমার মাথায় একটা কদম-ছুটি পরচুলা, আর আমার নাকের উপর একটা চশমা বসে গেল। তারপর একটা কালো পেন্সিল দিয়ে আমার পরিষ্কার করে ছাঁটা-জুলপিটা ফেলুদা একটু অপরিষ্কার করে দিল। তারপর বলল—
তুই আমার ভাগনে, তোর নাম সুবোধ—অর্থাৎ শাস্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট ভালমানুষটি। ওখানে মুখ খুলেছ কি বাড়ি এসে রদা!
প্রতুলবাবুর বাড়ির চুনকাম প্রায় হয়ে এসেছে। ডিজাইন দেখে বোঝা যায় বাড়ি অন্তত পচিশ-ত্রিশ বছরের পুরনো, তবে নতুন রঙের জন্য দরজা জানলা দেয়াল সব কিছু ঝলমল করছে।
গেট দিয়ে ঢুকে এগিয়ে গিয়েই দেখি বাইরে একটা খোলা বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক বসে আছেন। আমাদের এগোতে দেখেও তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন না। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারেও বুঝলাম তাঁর মুখটা বেশ গম্ভীর।
ফেলুদ দুহাত তুলে মাথা হেঁট করে নমস্কার করে তার নতুন বুড়ো মিহি গলায় বলল, মাপ করবেন—আপনিই কি প্রতুলবাবু?
ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ।’ আজ্ঞে আমারই নাম জয়নারায়ণ বাগচি। আমিই আপনাকে আজ দুপুরে টেলিফোন করেছিলাম। এটি আমার ভাগনে সুবোধ।’
“আবার ভাগনে কেন? ওর কথা তো টেলিফোনে হয়নি।’ আমার মাথায় পরচুলা কুটকুট করতে শুরু করেছে।
ছেড়ে উঠলেন।
আপনারা আমার জিনিসগুলি দেখতে চাইছেন তাতে আপত্তি নেই; তবে সরিয়ে রাখা জিনিস সব টেনে বার করতে হয়েছে। অনেক হ্যাঙ্গাম। একে বাড়িতে রাতদিন মিস্ত্রিদের ঝামেলা, এটা ঠেলো, ওটা ঢাকো, চারিদিকে কাঁচা রং. রঙের গন্ধটাও ধাতে যায় না। সব ঝক্কি শেষ হলে যেন বাঁচি। আসুন ভেতরে…’
লোকটাকে ভাল না লাগলেও, ভিতরে গিয়ে তার জিনিসপত্তর দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল !
ফেলুদা বলল, আপনার কাছে মিশর দেশের শিল্পকলার অনেক চমৎকার নিদর্শন রয়েছে দেখছি।
তা আছে। কিছু জিনিস কায়রোতে কেনা, কিছু এখানে অকশনে।’ – ‘দ্যাখো বাবা সুবোধ ভাল করে দ্যাখো।’ ফেলুদা আমার পিঠে একটা চিমটি কেটে আমায় জিনিসগুলোর দিকে ঠেলে দিল। কতরকম দেবদেবী-দাখো! এই যে বাজপাখি, এও দেবতা, এই যে প্যাঁচা-এও দেবতা।.মিশরদেশে কতরকম জিনিসকে পুজো করত লোকের দাখো।’
প্রতুলবাবু একটা সোফায় বসে চুরুট ধরালেন। – হঠাৎ কী খেয়াল হল, আমি বলে উঠলাম, শেয়াল দেবতা নেই, বড় মামা ?
প্রশ্নটা শুনেই প্রতুলত্বাবু যেন হঠাৎ বিষম খেয়ে উঠলেন। বললেন, চুরুটের কোয়ালিটি ফল করছে। আগে এত কড়া ছিল না।’
ফেলুদা সেই রকমই মিহি সুরে বললেন, ‘হেঁ হেঁ—আমার ভাগনে আনুবিসের কথা বলছে। কালই ওকে বলছিলাম কিনা ?’
প্রতুলবাবু হঠাৎ ফোঁস করে উঠলেন, ‘হু!—আনুবিস। স্টুপিড ফুল!’ আজ্ঞে ? ফেলুদা চোখ গোল গোল করে প্রতুলবাবুর দিকে চাইলেন। আনুবিসকে মূখ বলছেন আপনি?’
আনুবিস না। সেদিন নিলামে—লোকটাকে আগেও দেখেছি আমি—হি ইজ এ ফুল। ওর বিডিং-এর কোনও মাথামুণ্ডু নেই। চমৎকার একটা মূর্তি ছিল। এমন এক অ্যাবসার্ড দাম হাঁকল যে যার ওপর আর চড়া যায় না। অত টাকা কোথায় পায় জানি না।’ – ফেলুদা চারিদিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভদ্রলোককে নমস্কার করে বললেন, অশেষ ধন্যবাদ। আপনি মহাশয় ব্যক্তি। পরম আনন্দ পেলাম আপনার শিল্প সংগ্রহ দেখে|’
এ সব জিনিসপত্র ছিল দোতলায়। আমরা এবার নীচে রওনা দিলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফেলুদা বলল, আপনার বাড়িতে লোকজন আর বিশেষ… ?
“গিন্নি আছেন। ছেলে বিদেশে।’ প্রতুল দত্তর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সির জন্য হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম পাড়াটা কত নির্জন। সাতটাও বাজেনি, অথচ রাস্তায় প্রায় লোক নেই বললেই চলে। দুটি বাচ্চা ভিখারি ছেলে শ্যামাসংগীত গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে। একটু কাছে এলে পরে বুঝলাম একজন গাইছে আর অন্যজন বাজাচ্ছে। ভারী সুন্দর গান করে ছেলেটা। ফেলুদা তাদের সঙ্গে গলা মিশিয়ে গেয়ে উঠল—
বল মা তাঁরা দাড়াই কোথা
আমার কেহ নাই শঙ্করী হেথা..
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড দিয়ে কিছুদূর হেঁটে একটা চলন্ত খালি ট্যাক্সির দেখা পেয়েই ফেলুদা হাঁক দিয়ে সেটাকে থামাল। ওঠার সময় দেখি বুড়ো ড্রাইভার ভারী অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে দেখছে। এই চিমড়ে বুড়োর গলা দিয়ে ওরকম জোয়ান চিৎকার বেরোল কী করে সেটাই বোধহয় চিত্তা করছে ও।

পরদিন সকালে যখন টেলিফোনটা বাজল, তখন আমি বাথরুমে দাঁত মাজছি। কাজেই ফোনটা ফেলুদাই ধরল।
জিজ্ঞেস করে জানলাম নীলমণিবাবু ফোন করেছিলেন একটা খবর দেবার জন্য।
প্রতুলবাবুর বাড়িতেও কাল ডাকাতি হয়ে গিয়েছে, আর এ খবরটা কাগজেও বেরিয়েছে। টাকা পয়সা কিছু যায়নি; গেছে শুধু কিছু প্রাচীন কারুশিল্পের নমুনা। আট-দশটা ছোট ছোট জিনিস, সব মিলিয়ে যার দাম বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার কম না। পুলিশ নাকি তদন্ত আরম্ভ করে দিয়েছে।
প্রতুলবাবুর বাড়িতে যে সকালেই পুলিশের দেখা পাব, আর তার মধ্যে যে ফেলুদার চেনা লোকও বেরিয়ে পড়বে সেটা কিছুই আশ্চর্য না। আমরা যখন পৌঁছেছি তখন সোয়া সাতটা। অবিশ্যি আজ আর মেক-আপ করিনি। ফেলুদা দেখলাম তার জাপানি ক্যামেরাটা নিতে ভোলেনি।
আমরা গেটের ভিতর সবে ঢুকেছি—এমন সময় একজন বেশ হাসিখুশি মোটাসোটা চশমা পরা পুলিশ–বোধহয় ইনস্পেক্টর-টিনস্পেক্টর হবেন—ফেলুদাকে দেখেই এগিয়ে এসে ওর পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, কী হে, ফেলুমাস্টার?—গন্ধে গন্ধে এসে জুটেছ দেখছি!’
ফেলুদা বেশ নরমভাবেই হেসে বলল, আর কী করি বলুন—আমাদের তো ওই কাজ।” কাজ বোলো না। কাজটা তো আমাদের। তোমাদের হল শখ। তাই না ?” ফেলুদা একথার কোনও উত্তর না দিয়ে বলল, কিছু কিনারা করতে পারলেন। বার্গলারি কেস ?
তা ছাড়া আর কী? তবে ভদ্রলোক খুব আপসেট। খালি মাথা চাপড়াচ্ছেন আর বলছেন কাল এক বুড়ো নাকি এক ছোকরা সঙ্গে করে ওঁর জিনিস দেখতে এসেছিল। ওঁর ধারণা এই দুজনেই নাকি আছে এই বার্গলারির পেছনে।’ ।
আমার কথাটা শুনেই গলা শুকিয়ে গেল। সত্যি, ফেলুদা মাঝে মাঝে বড্ড বেপরোয়া কাজ করে ফেলে।
ফেলুদা কিন্তু একটু ঘাবড়ে না গিয়ে বলল, তা হলে তো সেই বুড়োর সন্ধান করতে পারলেই চোর ধরা পড়বে। এ তো জলের মতো কেস।
গোলগাল পুলিশটি বললেন, ‘বেশ বলেছ—একেবারে খাঁটি উপন্যাসের গোয়েন্দাদের মতো বলেছ—বাঃ!’
ভদ্রলোকের পারমিশন নিয়ে ফেলুদা আর আমি বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রতুলবাবু দেখি আজও সেই বারান্দাতেই বসে আছেন। বুঝলাম তিনি এতই অন্যমনস্ক যে আমাদের দেখেও দেখতে পেলেন না।
কোন ঘরটা থেকে চুরি হয়েছে দেখবে?’ মোটা পুলিশ জিজ্ঞেস করল।
চলুন না।’
কাল সন্ধেবেলা দোতলার যে ঘরটায় গিয়েছিলাম, আজও সেটাতেই যেতে হল। অন্য কিছুর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ফেলুদা সটান ঘরের দক্ষিণ দিকের ব্যালকনিটার দিকে চলে গেল। সেটা থেকে ঝুঁকে নীচের দিকে চেয়ে বলল, ‘হু, পাইপ বেয়ে অনায়াসে উঠে আসা যায়—তাই না?
মোটা পুলিশ বললেন, তা যায়। আর মুশকিল হচ্ছে কী—দরজার রং কাঁচা বলে ওটাকে আবার দুদিন থেকে বন্ধ করা হচ্ছিল না।’
ঠিক কখন হয়েছে চুরিটা ?
‘রাত পৌনে দশটা।’
‘কে প্রথম টের পেল ?’ ‘এদের একটি পুরনো চাকর আছে, সে ওদিকের ঘরে বিছানা করছিল। একটা শব্দ পেয়ে আসে। ঘর তখন অন্ধকার। বাতি জ্বালানোর আগেই সে একটা প্রচণ্ড ঘুষি খেয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই সুযোগে চোর বাবাজি হাওয়া।’
ফেলুদার কপালে আবার সেই বিখ্যাত ভ্রাকুটি। বলল, ‘একবার চাকরটার সঙ্গে কথা বলব।’
চাকরের নাম বংশলোচন। দেখলাম ঘুষিটা খাওয়ার ফলে তার এখনও যন্ত্রণা আর ভয়— কোনওটাই যায়নি। ফেলুদা বলল, “কোথায় ব্যথা ?
চাকরটা চি চি করে উত্তর দিল, তলপেটে।’
তলপেটে? ঘুষি তলপেটে মেরেছিল?’
‘সে কী হাতের জোর-বাপরে বাপ! মনে হল যেন পেটে এসে একখানা পাথর লাগল। আর তার পরেই সব অন্ধকার।’
‘আওয়াজটা শুনলে কখন? তখন তুমি কী করছিলে ?’
‘টাইম তো দেখিনি বাবু! আমি তখন মায়ের ঘরে বিছানা করছি। দুটো ছেলে এসে কীর্তন গান করছিল তাই শুনছিলাম। মা ঠাকরুণ ছিলেন পুজোর ঘরে; বললেন ছেলেটাকে পয়সা দিয়ে আয়। আমি যাব যাব করছি এমন সময় বাবুর ঘর থেকে ঘটিবাটি পড়ার মতো একটা শব্দ পেলাম। ভাবলাম—-কেউ তো নাই—তা জিনিস পড়ে কেন ? তাই দেখতে গেছি—আর ঘরে ঢুকতেই…’
বংশলোচন আর কিছু বলতে পারল না।
সব শুনে-টুনে বুঝলাম, আমরা চলে যাবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চোর এসেছিল। আমি ভাবলাম ফেলুদা বোধহয় আরও কিছু জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও আর কোনও কথাই বলল না। সেই মোটা পুলিশকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে রাস্তায় এসে ফেলুদার মুখের চেহারা একদম বদলে গেল। এ চেহারা আমি জানি। ফেলুদা কী জানি একটা রাস্তা দেখতে পেয়েছে, আর সে রাস্তা দিয়ে গেলেই রহস্যের সমাধানে পৌঁছনো যাবে।
পাশ দিয়ে খালি ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল, কিন্তু ফেলুদা থামাল না। আমরা দুজনে হাঁটতে লাগলাম। ফেলুদার দেখাদেখি আমিও ভাবতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাতে খুব বেশিদূর এগোতে পারলাম না। প্রতুলবাবু যে চোর নন সেটা তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, যদিও প্রতুলবাবুকে বেশ জোয়ান লোক বলে মনে হয়, আর ওঁর গলার আওয়াজটা বেশ ভারী। কিন্তু তাও এটা কিছুতেই সম্ভব বলে মনে হচ্ছিল না যে, প্রতুলবাবু একটা বাড়ির পাইপ বেয়ে দোতলায় উঠতে পারেন। তার জন্য যেন আরও অনেক কম বয়সের লোকের দরকার। তা হলে চোর কে? আর ফেলুদা কোন জিনিসটার কথা এত মন দিয়ে ভাবছে ?
কিছুক্ষণ হাঁটার পরে দেখি আমরা নীলমণিবাবুর বাড়ির পাঁচিলের পাশে এসে পড়েছি। ফেলুদা পাঁচিলটা বাঁয়ে রেখে ধীরে ধীরে হাঁটতে আরম্ভ করল।
কিছুদূর গিয়ে পাঁচিলটা বাঁ দিকে ঘুরেছে। ফেলুদাও ঘুরল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে আমিও। এদিকে রাস্ত নেই, ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে হয়। মোড় ঘুরে আঠারো কি উনিশ পা হাঁটার পর ফেলুদা হঠাৎ থেমে গিয়ে পাঁচিলের একটা বিশেষ অংশের দিকে খুব মন দিয়ে দেখল। তারপর সেই জায়গাটার খুব কাছ থেকে একটা ছবি তুলল। আমি দেখলাম সেখানে একটা ব্রাউন রঙের হাতের ছাপ রয়েছে। পুরো হাত নয়—দুটো আঙুল আর তেলোর খানিকটা অংশ–কিন্তু তা থেকেই বোঝা যায় যে সেটা বাচ্চা ছেলের হাত।
এবার আমরা যে পথে এসেছিলাম সে পথে গিয়ে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে সোজা একেবারে বাড়ির দিকে চলে গেলাম।
খবর পাঠাতেই নীলমণিবাবু বেশ ব্যস্ত হয়ে নীচে চলে এলেন। আমরা তিনজনেই বৈঠকখানায় বসার পর নীলমণিবাবু বললেন, আপনি শুনলে কী বলবেন জানি না, তবে আমার মনটা আজ কালকের চেয়ে কিছুটা হালকা। আমার মতো দুর্দশা যে আরেকজনেরও হয়েছে, সেটা ভেবে খানিকটা কষ্টের লাঘব হচ্ছে। কিন্তু তাও একটা প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া অবধি কষ্ট
যাবে না—কোথায় গেল আমার আনুবিস ? বলুন ? আপনি এত বড় ডিটেকটিভ—দু-দুটো

ডাকাতি দুদিন উপরি উপরি হয়ে গেল আর আপনি এখনও যেই তিমিরে সেই তিমিরে?
ফেলুদা একটা প্রশ্ন করে ফেলল।
আপনার ভাগনেটি কেমন আছে?
‘কে, বুন্টু ? ও আজ অনেকটা ভাল। ওষুধে কাজ দিয়েছে। আজ জ্বরটা অনেক কমে গেছে?
আচ্ছা—বাইরের কোনও ছেলেটেলে কি পাঁচিল টপকে এখানে আসে? ঝুন্টুর সঙ্গে খেলতে-টেলতে ?’
পাঁচিল টপকে? কেন বলুন তো?
আপনার পাঁচিলের বাইরের দিকটায় একটা বাচ্চা ছেলের হাতের ছাপ দেখছিলাম।
ছাপ মানে ? কীরকম ছাপ ?’
‘ব্রাউন রঙের ছাপ।
টাটকা ?’
বলা মুশকিল—তবে খুব পুরনো নয়।’
কই, আমি তো কোনওদিন কোনও বাচ্চাকে আসতে দেখিনি। বাচ্চা বলতে এক আসে— তাও সেটা পাঁচিল টপকে নয়—একটা ছোকরা ভিখিরি। দিব্যি শ্যামাসংগীত গায়। তবে হ্যাঁ— আমার বাগানের পশ্চিম দিকে একটা জামরুল গাছ আছে! মধ্যে মধ্যে বাইরের ছেলে পাঁচিল টপকে এসে সে গাছের ফল পেড়ে খায় না, এমন গ্যারান্টি আমি দিতে পারি না।’
‘হুঁ…’
নীলমণিবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘চোরের বিষয় আর কিছু জানতে পারলেন কি ?’
ফেলুদা সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল।
‘লোকটার হাতের জোর সাংঘাতিক এক ঘুষিতে প্রতুলবাবুর চাকরকে অজ্ঞান করে দিয়েছিল।’
তা হলে এচুরি-ওচুরি এক চোরই করেছে তাতে সন্দেহ নেই।
হতে পারে। তবে গায়ের জোরটা এখানে বড় কথা বলে আমার মনে হয় না। একটা বীভৎস বুদ্ধিরও ইঙ্গিত যেন পাওয়া যাচ্ছে।’
নীলমণিবাবু যেন মুষড়ে পড়লেন। বললেন, আশা করি সে বুদ্ধিকে জব্দ করার মতো বুদ্ধি আপনার আছে। না হলে তো আমার মূর্তি ফিরে পাবার আশা ছাড়তে হয়।’
ফেলুদা বলল, আরও দুটো দিন অপেক্ষা করুন। এখন পর্যন্ত কখনও ফেলুমিত্তিরের ডিফিট হয়নি।’
নীলমণিবাবুর বাড়ির গাড়িবারান্দা থেকে গেট অবধি নুড়ি পাথর দেওয়া রাস্তা। সেটার মাঝামাঝি যখন পৌছেছি তখন একটা কট্ কট্ শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি নীলমণিবাবুর দোতলার একটা ঘরের জানালার পিছনে দাঁড়িয়ে একটা ছোট ছেলে—বুন্টুই বোধহয়—জানালার কাচটাতে হাত দিয়ে টোকা মারছে।
আমি বললাম, ‘বুন্টু।”
ফেলুদা বলল, “দেখেছি।”

সারা দুপুর ফেলুদা তার নীল খাতায় অভ্যাস মতো গ্রিক অক্ষরে কী সব হিজিবিজি লিখল। আমি জানি ভাষাটা আসলে ইংরিজি, কিন্তু অক্ষরগুলো গ্রিক, যাতে আর কেউ পড়ে মানে বুঝতে না পারে। আমার সঙ্গে ওর কথা একেবারেই বন্ধ, তবে সেটা এক হিসেবে ভাল। এখন ওর ভাববার সময়, কথা বলার সময় নয়। মাঝে মাঝে শুনছিলাম ও গুন গুন করে গান গাইছে। এটা সেই ভিখিরি ছেলেটার গাওয়া রামপ্রসাদী গানটা।

বিকেলে পাঁচটা নাগাত চা খেয়ে ফেলুদা বলল, আমি একটু বেরুচ্ছি। পপুলার ফোটো থেকে আমার ছবির এনলাজমেন্টগুলো নিয়ে আসতে হবে।’
আমি একাই বাড়িতে রয়ে গেলাম।
দিন ছোট হয়ে আসছে। তাই সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সূর্য ডুবে অন্ধকার হয়ে এল। পপুলার ফোটো দোকানটা হাজরা রোডের মোড়ে। ফেলুদার ছবি নিয়ে ফিরে আসতে কুড়ি মিনিটের বেশি লাগা উচিত না। তবে এত দেরি হচ্ছে কেন? অবিশ্যি অনেক সময় ছবি তৈরি না হলে দোকানে বসিয়ে রাখে। আশা করি অন্য কোথাও যায়নি ও । আমাকে ফেলে ঘোরাঘুরিটা আমার ভাল লাগে না।
একটা করতালের অHওয়াজ কানে এল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে চেনা গলায় সেই গান—
বল মা তারা দাঁড়াই কোথা
আমার কেহ নাই শঙ্করী হেথা…
সেই ছেলে দুটো। আজ আমাদের পাড়ায় ভিক্ষে করতে এসেছে।
গান ক্রমে এগিয়ে এল। আমি আমাদের ঘরের জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। ওই যে ছেলে দুটো—একজন গাইছে, একজন করতাল বাজাচ্ছে কী সুন্দর গলা ছেলেটার।
এবার গান থামিয়ে ছেলেটি ঠিক আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে মুখ করে বলল, ‘মা দুটি ভিক্ষে দেবে মা ?
কী মনে হল, আমার ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ নয়া বার করে জানলা দিয়ে ছেলেটার দিকে ফেলে দিলাম। টিং শব্দ করে পয়সাটা মাটিতে পড়ল। দেখলাম ছেলেটা সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ঝোলার মধ্যে পুরে আবার গান গাইতে গাইতে হাঁটতে শুরু করল।
একটা ব্যাপারে আমার মাথাটা কেমন জানি গোলমাল হয়ে গেল। যদিও আমাদের রাস্তাটা বেশ অন্ধকার, তবু ভিখিরি ছেলেটা যখন ওপর দিকে মুখ করে ভিক্ষে চাইল তখন যেন মনে হল তার মুখের সঙ্গে বুন্টুর একটা আশ্চর্য মিল আছে। হয়তো এটা আমার দেখার ভুল, কিন্তু তাতে মনের মধ্যে কেমন খটকা লাগতে লাগল। আমি ঠিক করলাম ফেলুদা এলেই কথাটা ওকে বলব ।
প্রায় সাড়ে ছটার সময় মেজাজ বেশ গরম করে ফেলুদা এনলার্জমেন্ট নিয়ে বাড়ি ফিরল। যা ভেবেছিলাম তাই, ওকে দোকানে বসে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বলল, ‘এবার থেকে নিজেই একটা ডার্করুম তৈরি করে ছবি ডেভেলপিং-প্রিন্টিং করব। বাঙালি দোকানের কথার কোনও ঠিক নেই।’
ফেলুদা যখন ওর বিছানার ওপর ছবিগুলো বিছিয়ে বসেছে, তখন আমি ওকে গিয়ে ভিখিরি ছেলেটার কথা বললাম ও কিন্তু একটুও অবাক না হয়ে বলল, সেটা আর আশ্চর্য কী?
“আশ্চর্য না ?’
উহুঁ।’ ..
“কিন্তু তা হলে ভীষণ গণ্ডগোল বলতে হবে।’ গণ্ডগোল তো বটেই। সেটা তো আমি প্রথম থেকেই বুঝেছি।’
‘তুমি বলতে চাও যে ওই ছেলেটা চুরির ব্যাপারে জড়িত?
“হতেও পারে।’
কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলের খুঁষির এত জোর যে একটা ধেড়ে লোককে অজ্ঞান করে দেবে?
বাচ্চা ছেলে ঘুষি মেরেছে তা তো বলিনি।’
তাও ভাল!’
যদিও ভাল বললাম, কিন্তু আসলে মোটেই ভাল লাগছিল না। ফেলুদাও যে কেন পরিষ্কার করে কিছু বলছে না তা জানি না।
খাটের উপর বিছানো বারোটা ছবির মধ্যে দেখলাম একটা ছবি ফেলুদা বিশেষ মনোযোগ দিয়ে দেখছে। কাছে গিয়ে দেখি সেটা আজই সকলে তোলা নীলমণিবাবুর পাঁচিলে বাচ্চা ছেলের হাতের দাগের ছবিটা। এনলার্জমেন্টের ফলে হাতের তেলোটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বললাম, তুমি তো বলে হাত দেখতে জান–বলে তো ছেলেটার কত আয়ু।’
ফেলুদা কোনও উত্তর দিল না। সে তন্ময় হয়ে ছবিটার দিকে চেয়ে আছে। লক্ষ করলাম যে তার মধ্যে একটা দারুণ কনসেনট্রেশনের ভাব।
কিছু বুঝতে পারছিস ?
হঠাৎ ওর প্রশ্নটা আমাকে একেবারে চমকে দিল।
কী বুঝব?
সকালে কী বুঝেছিলি, আর এখন কী বুঝলি—বল তো।
সকালে ? মানে, যখন ছবিটা তুললে ?
‘হ্যাঁ।’
কী আর বুঝব? বাচ্চা ছেলের হাত—এ ছাড়া আর কী বোঝার আছে?
‘ছাপের রংটা দেখে কিছু মনে হয়নি?’
‘রং তো ব্রাউন ছিল।’
‘তার মানে কী ?’
তার মানে ছেলেটার হাতে ব্রাউন রঙের কিছু একটা লেগেছিল।’
কিছু মানে কী? ঠিক করে বল।’
‘পেন্ট হতে পারে।’
‘কোথাকার পেন্ট ?’
‘কোথাকার পেন্ট…কোথাকার… ?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
প্রতুলবাবুর ঘরের দরজার রং!
‘এগ্জ্যাক্টলি সেদিন তোরও শার্টের বাঁদিকের আস্তিনে লেগে গিয়েছিল। এখনও গিয়ে দেখতে পারিস লেগে আছে।’
‘কিন্তু’—আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল, ‘–যার হাতের ছাপ, সেই কি প্রতুলবাবুর ঘরে ঢুকেছিল ?’
‘হতেও পারে। এখন বল—ছবি দেখে কী বুঝছিস।’
আমি অনেক ভেবেও নতুন কিছু বোঝার কথা বলতে পারলাম না।
ফেলুদা বলল, ‘তুই পারলে আশ্চর্য হতাম। শুধু আশ্চর্য হতাম না—শক পেতাম। কারণ তা হলে বলতে হত তোর আর আমার বুদ্ধিতে কোনও তফাত নেই।’
‘তোমার বুদ্ধিতে কী বলছে?’
বলছে যে এটা একটা সাংঘাতিক কেস। ভয়াবহ ব্যাপার। আনুবিস যেরকম ভয়ঙ্কর—এই রহস্যটাও তেমনি ভয়ঙ্কর।’

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়