পরদিন ভোর পৌনে ছটায় আমাদের বারান্দায় খবরের কাগজের বান্ডিলটা পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোনটা বেজে উঠল। আমি ফোনটা তুলে হ্যালো’ বলেছি, কিন্তু উলটোদিকের কথা শোনার আগেই ফেলুদা সেটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। পর পর তিনবার ‘হু, দুবার ‘ও’, আর একবার আচ্ছা ঠিক আছে বলেই ফোনটা ধপ করে রেখে দিয়ে ও ধরাগলায় বলল, আনুবিস গায়েব। এক্ষুনি যেতে হবে।’
সকালবেলায় ট্রাফিক কম বলে নীলমণি সান্যালের বাড়ি পৌছাতে লাগল ঠিক সাত মিনিট। ট্যাক্সি থেকে নেমেই দেখি নীলমণিবাৰু কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাক ভাব করে বাড়ির বাইরেই আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। ফেলুদাকে দেখেই বললেন, নাইটমেয়ারের মধ্যে দিয়ে গেছি মশাই। এরকম হরিবল অভিজ্ঞতা আমার কক্ষনও হয়নি।’
আমরা ততক্ষণে বৈঠকখানায় ঢুকেছি। ভদ্রলোক আমাদের আগেই সোফায় বসে প্রথমে তাঁর হাতের কজিগুলো দেখালেন। দেখলাম, লোকে যেখানে ঘড়ি পরে, তার ঠিক নীচ দিয়ে দুই হাতে দড়ির দাগ বসে গিয়ে হাতটা লাল হয়ে গেছে।
ফেলুদা বলল, কী ব্যাপার বলুন।
ভদ্রলোক দম নিয়ে ধরা গলায় বলতে শুরু করলেন, আপনার কথা মতো গতকাল মূর্তিটা শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে একেবারে বালিশের তলায় রেখে দিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে যেখানে ছিল সেখানেই রাখলে আর কিছু না হোক, অন্তত শারীরিক যন্ত্রণাটা ভোগ করতে হত না। যাক গে—মূর্তিটা তো মাথার তলায় নিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছি, এমন সময়–রাত কত জানি না—একটা বিশ্রী অবস্থায় ঘুম ভেঙে গেল। দেখি কে জানি আমার মুখটা আষ্ট্রেপৃষ্ঠে গামছা দিয়ে বাঁধছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবার পথ বন্ধ দেখে হাত দিয়ে বাধা দিতে গেলুম, আর তখনই বুঝতে পারলুম যে আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী লোকের পাল্লায় পড়েছি। দেখতে দেখতে আমার হাত পিছমোড়া করে দিলে। ব্যাস্—তারপর বালিশের তলা থেকে মূর্তি নিতে আর কী ?
ভদ্রলোক দম নেবার জন্য কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ঘণ্টা তিনেক বোধহয় হাত বাঁধা অবস্থায় পড়েছিলুম। সমস্ত শরীরে ঝি ঝি ধরে গেসল। সকালে চাকর নন্দলাল চা নিয়ে এসে আমাকে ওই অবস্থায় দেখে বাঁধন খুলে দেয়, আর তৎক্ষণাৎ আমি আপনাকে ফোন করি।”
ফেলুদার দেখলাম চোখ-মুখের ভাব বদলে গেছে। সে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার ঘরটা একবার দেখব, আর প্রয়োজন হলে আপনার বাড়ির কিছু ছবি তুলব।’ ক্যামেরাটাও ফেলুদার নতুন বাতিকের মধ্যে একটা।
নীলমণিবাবু দোতলায় তাঁর শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে ঢুকেই ফেলুদা বলল, এ কী— জানলার শিক নেই?’
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, আর বলবেন না—বিলিতি কায়দার বাড়ি তো! আর আমি আবার জানলা বন্ধ করে শুতেই পারি না।’
ফেলুদা জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে নীচের দিকে দেখে বলল, ‘খুব সহজ— পাইপ রয়েছে, কার্নিশ রয়েছে। একটু জোয়ান লোক হলেই অনায়াসে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসতে পারে।’
অন্য অংশও এবার ঘুরে দেখতে চাই। নীলমণিবাবু প্রথমে দোতলা দেখালেন। পাশের ঘরটাতে দেখলাম একটা খাটে বারো-তেরো বছর বয়সের একটা ছেলে গলা অবধি লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। তার চোখগুলো বড় বড়, আর দেখলেই মনে হয় তার স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়। বুঝলাম এই হল ঝুন্টু। নীলমণিবাবু বললেন, কালই আবার ডাক্তার বোস বুন্টুকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছেন। তাই ও রাত্রে কিছুই শুনতে পায়নি।’
দোতলার আরও দুটাে ঘর দেখে, একতলার ঘরগুলোতে চোখ বুলিয়ে আমরা বাড়ির বাইরে এলাম। নীলমণিবাবুর ঘরের জানলার ঠিক নীচেই দেখলাম কয়েকটা ফুলের টবে পামজাতীয় গাছ লাগানো। ফেলুদা টবগুলোর ভিতর কিছু আছে কি না দেখতে লাগল। প্রথম দুটোয় কিছু পেল না। তৃতীয়টার পাতার ভিতর হাতড়ে একটা ছোট্ট টিনের কৌটাে পেল। সেটার ঢাকনা খুলে নীলমণিবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল, এ বাড়িতে কারুর নসির বাতিক আছে? নীলমণিবাবু মাথা নেড়ে না বললেন। ফেলুদা কোটােটা নিজের প্যান্টের পকেটে রেখে দিল। এবার নীলমণিবাবু যেন বেশ মরিয়া হয়েই বললেন, ‘মিস্টার মিত্তির—আর কিছু না—মূর্তি একটা গেছে, আরেকটা না হয় কিনব—কিন্তু একটা ডাকাত আমার বাড়িতে এসে আমার ঘরে ঢুকে আমার উপর যা-তা অত্যাচার করে চলে যাবে—এ কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। আপনার এর একটা বিহিত করতেই হবে। যদি লোকটাকে ধরে দিতে পারেন তা হলে আমি
আপনাকে ইয়ে–মানে, ইয়ে আর কী—’
পারিশ্রমিক ?’ হ্যাঁ হ্যাঁ। পারিশ্রমিক—মানে, রিওয়ার্ড দেব!’ مخصصة ফেলুদা বলল, রিওয়ার্ডট বড় কথা নয়। সে আপনি দিতে চান দেবেন। কিন্তু আমি কাজটার ভার নিচ্ছি তার প্রধান কারণ হল, এ ধরনের অনুসন্ধানে একটা চ্যালেঞ্জ আছে, একটা আনন্দ আছে।’
এটা শুনে আমার মনে হল, বড় বড় গোয়েন্দাকাহিনীতে ডিটেকটিভরা যে ভাবে কথা বলে, ফেলুদাও যেন ঠিক সেইভাবেই কথাটা বলল।
এর পরে প্রায় দশ মিনিট ধরে ফেলুদা নীলমণিবাবুর ড্রাইভার গোবিন্দ, চাকর নন্দলাল আর পাঁচু, আর মালি নটবরের সঙ্গে কথা বলল। তারা সবাই বলল রাত্রে অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি। বাইরের লোক আসার মধ্যে এক রাত নটা নাগাত ডাক্তার বোস এসেছিলেন বুন্টুকে দেখতে। নীলমণিবাবু নিজে নাকি তারপর একবার বেরিয়েছিলেন—ও এন মুখার্জির ডাক্তারখানা থেকে ঝুন্টুর জন্য ওষুধ কিনে আনতে।
ফেরার পথে একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হল ট্যাক্সি আমাদের বাড়ির রাস্ত ছাড়িয়ে অন্য কোথাও চলেছে ফেলুদাকে গভীর দেখে তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। ট্যাক্সি থামল ফ্রি স্কুল ষ্ট্রিটের একটা বাড়ির সামনে। দেখলাম বাড়ির সদর দরজার উপরে সাইনবোর্ডে উচু উঁচু রুপোলি অক্ষরে লেখা রয়েছে—আরাটুন ব্রাদার্স—অকশনিয়ার্স’। এটাই সেই নিলামের দোকান ।
আমি কোনওদিন নিলামঘর দেখিনি। এই প্রথম দেখে একেবারে চোখ ছানবিড়া হয়ে গেল। এত রকম হিজিবিজি জিনিস একসঙ্গে এর আগে কখনও দেখিনি।
ফেলুদার কাজ দুমিনিটের মধ্যে সারা হয়ে গেল। প্রতুল দত্তের ঠিকানা সেভেন বই ওয়ান লাভলক ষ্ট্রিট। আমি মনে ভাবলাম প্রতুল দত্তের বাড়ি গিয়েও যদি ফেলুদাকে হতাশ হতে হয়, তা হলে আর ওর কোথাও যাবার থাকবে না। তার মানে এবার ফেলুদাকে হার স্বীকার করতে হবে। আর তা হলে আমার যে কী দশা হবে তা জানি না। কারণ এখন পর্যন্ত ফেলুদা কোথাও হার মানেনি। ও কোনও ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়ে মুখ চুন করে বসে আছে—এ দৃশ্য আমি কল্পনাই করতে পারি না। আশা করি শিগগিরই ও একটা ‘কু’ পেয়ে যাবে। আমি অন্তত এখন পর্যন্ত চোখে অন্ধকার দেখছি।
দুপুরে খেতে খেতে ফেলুদাকে বললাম, এর পর?’
ও ভাতের টিপির মধ্যে একটা গর্ত করে তাতে এক বাটি সোনামুগ ডাল ঢেলে বলল, ‘এর পর মাছ। তারপর চাটনি, তারপর দই!’
‘তারপর ?”
তারপর জল খেয়ে মুখ ধোব। তারপর একটা পান খাব।”
‘তারপর ?’
তারপর একটা টেলিফোন করে আধঘণ্টা ঘুম দেব।’
এর মধ্যে টেলিফোনটাই একমাত্র ইন্টারেস্টিং খবর, কাজেই আমি সেটার অপেক্ষায় বসে রইলাম।
ডিরেকটরি থেকে প্রতুল দত্তর নম্বরটা আমি বার করে দিয়েছিলাম। নম্বরটা ডায়াল করে হ্যালো’ বলার সময় দেখলাম ফেলুদা গলাটা একদম চেঞ্জ করে বুড়োর গলা করে নিয়েছে। যে কথাটা হল ফোনে, তার শুধু একটা দিকই আমি শুনতে পেয়েছিলাম, আর সেইভাবেই সেটা লিখে দিচ্ছি—
হ্যালো—আমি নাকতলা থেকে কথা কইচি।’
আজ্ঞে, আমার নাম শ্ৰীজয়নারায়ণ বাগচি। আমি প্রাচীন কারুশিল্প সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহী। এই বিষয় নিয়ে আমি একটি পুস্তক রচনা করচি।
হ্যাঁ..আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার সংগ্রহের কথা শুনেছি। আমার একান্ত অনুরোধ, আপনি যদি অনুগ্রহ করে আপনার কিছু জিনিস আমাকে দেখতে দেন…’
‘না না না ; পাগল নাকি ?
‘আচ্ছা!
‘হ্যাঁ–নিশ্চয়ই!’
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। নমস্কার।’ টেলিফোন শেষ করে ফেলুদা বলল, ভদ্রলোকের বাড়িতে চুনকাম হচ্ছে—তাই জিনিসপত্রগুলো সরিয়ে রেখেছেন। তবে সন্ধের দিকে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে।’
আমি একটা কথা না বলে পারলাম না।
আমাদের দেখাবেন না। ’
ফেলুদা বলল, যদি তোর মতো বোকা হয় তা হলে দেখাতেও পারে; তবে না দেখানোটাই সম্ভব। আমি মূর্তি দেখার জন্য যাচ্ছি না, যাচ্ছি লোকটাকে দেখতে।”
তার কথা মতো ফেলুদা টেলিফোনটা করেই নিজের ঘরে চলে গেল ঘুমোতে। ফেলুদার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা হল, ও যখন তখন প্রয়োজন মতো একটু-আধটু ঘুমিয়ে নিতে পারে। শুনেছি নেপোলিয়নেরও নাকি এ-ক্ষমতা ছিল; যুদ্ধের আগে ঘোড়ায় চাপা অবস্থাতেই একটু ঘুমিয়ে নিয়ে শরীরটাকে চাঙ্গ করে নিতেন।
আমার বিশেষ কিছুই করার ছিল না, তাই ফেলুদার তাক থেকে একটা ইজিন্সিয়ান আর্টের বই নিয়ে সেটা উলটে পালটে দেখছিলাম, এমন সময় ক্রি-–ং করে ফোনটা বেজে উঠল।
আমি এক দৌড়ে বসবার ঘরে গিয়ে ফোনটা তুলে নিলাম। ‘হ্যালো!” কিছুক্ষণ কেউ কিছু বলল না, যদিও বেশ বুঝতে পারছিলাম ফোনটা কেউ ধরে আছে। আমার বুকের ভিতরটা টিপ টিপ করতে শুরু করল। ‘ প্রায় দশ সেকেন্ড পরে একটা গম্ভীর, কর্কশ গলা শুনতে পেলাম। ‘প্রদোষ মিত্তির আছেন?’ আমি কোনওমতে ঢোক গিলে বললাম, উনি একটু ঘুমোচ্ছেন। আপনি কে কথা বলছেন? আবার কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর কথা এল, ঠিক আছে। আপনি তাকে বলে দেবেন যে মিশরের দেবতা যেখানে যাবার সেখানেই গেছেন। প্রদোষ মিত্তির যেন ও ব্যাপারে আর নাক গলাতে না আসেন, কারণ তাতে কারুর কোনও উপকার হবে না। বরং অনিষ্ট হবার সম্ভাবনা বেশি।’
এর পরেই কট করে ফোনটা রাখার শব্দ পেলাম, আর তার পরেই সব চুপ। কতক্ষণ যে ফোনটা হাতে ধরে প্রায় দম বন্ধ করে বসেছিলাম জানি না, হঠাৎ ফেলুদার গলা
পেয়ে তাড়াতাড়ি রিসিভারটাকে জায়গায় রেখে দিলাম।
‘কে ফোন করেছিল ?’
আমি ফোনে যা শুনেছি তা বললাম। ফেলুদা গম্ভীর মুখ করে ভুরু কুচকে সোফায় বসে বলল, ইস—তুই যদি আমাকে ডাকতিস!
কী করব ? কাঁচ ঘুম ভাঙালে যে তুমি রাগ করো।’
‘লোকটার গলার আওয়াজ কীরকম?”
ঘড়ঘড়ে গম্ভীর।’
হু… যাক গে, আপাতত প্রতুল দত্তর চেহারাটা একবার দেখে আসি। মনে হচ্ছিল একটু আলো দেখতে পাচ্ছি; এখন আবার সব ঘোলাটে ।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়