‘টেলিফোনটা কে করেছিল ফেলুদা ?’
প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারলাম যে বোকামি করেছি, কারণ যোগব্যায়াম করার সময় ফেলুদা কথা বলে না। এক্সারসাইজ ছেড়ে ফেলুদা এ-জিনিসটা সবে মাস ছয়েক হল ধরেছে। সকালে আধঘণ্টা ধরে নানারকম আসন করে সে। এমনকী, কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথা নীচের দিকে আর পা উপর দিকে শূন্যে তুলে শীর্ষসিন পর্যন্ত। এটা স্বীকার করতেই হবে যে একমাসে ফেলুদার শরীর আরও ফিট হয়েছে বলে মনে হয়; কাজেই বলতে হয় যে যোগাসনে রীতিমতো উপকার হচ্ছে।
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেই পিছন দিকে টেবিলের উপরে রাখা ঘড়ির টাইমটা দেখে নিলাম। ঠিক সাড়ে সাত মিনিট পরে আসন শেষ করে ফেলুদা জবাব দিল—
‘তুই চিনবি না।’
এতক্ষণ পরে এরকম একটা উত্তর পেয়ে ভারী রাগ হল। চিনি না তো অনেককেই, কিন্তু নামটা বলতে দোষ কী ? আর না চিনলেও, চিনিয়ে দেওয়া যায় না কি ? একটি গম্ভীরভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি চেনো?’
ফেলুদা জলে-ভেজানো ছোলা খেতে খেতে বলল, আগে চিনতাম না। এখন চিনি!’ কয়েকদিন হল আমার পুজোর ছুটি হয়ে গেছে। বাবা তিনদিন হল জামসেদপুরে গেছেন কাজে। বাড়িতে এখন আমি, ফেলুদা আর মা। এবার আমরা পুজোয় বাইরে যাব না। তাতে আমার বিশেষ আপশোস নেই, কারণ পুজোয় কলকাতাটা ভালই লাগে, বিশেষ করে যদি ফেলুদা সঙ্গে থাকে। ওর আজকাল শখের গোয়েন্দা হিসাবে বেশ নামটাম হয়েছে, কাজেই মাঝে মাঝে যে রহস্য সমাধানের জন্য ওর ডাক পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী? এর আগে প্রত্যেকটা রহস্যের ব্যাপারেই আমি ফেলুদার সঙ্গে ছিলাম। ভয় হয় ওর নাম বেশি হওয়াতে হঠাৎ যদি ও একদিন বলে বসে নাঃ, তোকে আর এবার সঙ্গে নেব না। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা ঘটেনি। আমার বিশ্বাস ওর আমাকে সঙ্গে রাখার একটা কারণ আছে। হয়তো সঙ্গে একটা অল্পবয়স্ক ছেলেকে দেখে অনেকেই ওকে গোয়েন্দা বলে ভাবতে পারে না। সেটা তো একটা মস্ত সুবিধে। গোয়েন্দারা যতই আত্মগোপন করে থাকতে পারে ততই তাদের লাভ।
‘ফোনটা কে করল জানতে খুব ইচ্ছে করছে বোধহয় ?’
এটা ফেলুদার একটা কায়দা ও যখনই বুঝতে পারে আমার কোনও একটা জিনিস জানবার খুব আগ্রহ, তখনই সেটা চট করে না-বলে আগে একটা সাসপেন্স তৈরি করে। সেটা আমি জানি বলেই বিশেষ উৎসাহ না দেখিয়ে বললাম, ফোনটার সঙ্গে যদি কোনও রহস্যের ব্যাপার জড়িয়ে থাকে তা হলে জানতে ইচ্ছে করে বইকী।’
ফেলুদা গেঞ্জির উপর তার সবুজ ডোরাকাটা শার্টটা চাপিয়ে নিয়ে বলল, লোকটার নাম নীলমণি সান্যাল। রোল্যান্ড রোডে থাকে। বিশেষ জরুরি দরকারে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।’
‘কী দরকার বলেনি?’
না। সেটা ফোনে বলতে চায় না। তবে গলা শুনে মনে হল ঘাবড়েছে।’ “কখন যেতে হবে ?’ ট্যাক্সিতে করে যেতে মিনিট দশেক লাগবে। ন’টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সুতরাং আর দুমিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়া উচিত।’

ট্যাক্সি করে নীলমণি সান্যালের বাড়ি যেতে যেতে ফেলুদাকে বললাম, অনেক রকম তো দুষ্ট্র লোক থাকে; ধরে নীলমণিবাবুর যদি কোনওরকম বিপদ না হয়ে থাকে—তিনি যদি শুধু তোমাকে পাচে ফেলার জন্যই ডেকে থাকেন।”
ফেলুদা রাস্তার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, সে রিস্ক তো থাকেই। তবে সেরকম লোক বাড়িতে ডেকে নিয়ে প্যাঁচে ফেলবে না, কারণ সেটা তাদের পক্ষেও রিসকি হয়ে যাবে। সে সব কাজের জন্য অল্প টাকায় ভাড়াটে গুণ্ডার কোনও অভাব নেই।’
একটা কথা বলা হয়নি—ফেলুদা গত বছর অল ইন্ডিয়া রাইফল কম্পিটিশনে ফাস্ট হয়েছে। মাত্র তিনমাস বন্দুক শিখেই ওর যা টিপ হয়েছিল সে একেবারে থ মেরে যাবার মতো। ফেলুদার এখন বন্দুক রিভলবার দুই-ই আছে, তবে বইয়ের ডিটেকটিভের মতো ও সারাক্ষণ রিভলবার নিয়ে ঘোরে না। সত্যি বলতে কী, এখন পর্যন্ত ফেলুদাকে ও দুটোর একটাও ব্যবহার করতে হয়নি; তবে কোনওদিন যে হবে না সে কথা কী করে বলি?
ট্যাক্সি যখন ম্যাডক্ স্কোয়ারের কাছাকাছি এসেছে, তখন জিজ্ঞেস করলাম, ভদ্রলোক কী
ফেলুদা বলল, ভদ্রলোক পান খান, বোধহয় কানে একটু কম শোনেন, “ইয়ে” শব্দটা একটু বেশি ব্যবহার করেন, আর অল্প সর্দিতে ভুগছেন—এ ছাড়া আর কিছুই জানি না।’
এর পরে আর আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
নীলমণি সান্যালের বাড়িতে পৌছতে ট্যাক্সিভাড়া উঠল এক টাকা সত্তর পয়সা। একটা দুটাকার নোট বার করে ট্যাক্সিওয়ালার হাতে দিয়ে ফেলুদা হাতের একটা কায়দার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে তার চেঞ্জ ফেরত চাই না। গাড়ি থেকে নেমে পোর্টিকের তলা দিয়ে গিয়ে সামনের দরজায় পৌছে কলিং বেল টেপা হল।
দোতলা বাড়ি, তবে খুব যে বড় তাও নয়, আর খুব পুরনোও নয়। সামনের দিকে একটা বাগানও আছে, তবে সেটা খুব বাহারের কিছু নয়।
একজন দারোয়ান গোছের লোক এসে ফেলুদার কাছ থেকে ভিজিটিং কার্ড নিয়ে আমাদের বৈঠকখানায় বসতে বলল। ঘরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে বেশ তাক লেগে গেল। সোফা, টেবিল, ফুলদানি, ছবি, কাচের আলমারিতে সাজানো নানারকম সুন্দর পুরনো জিনিস-টিনিস মিলিয়ে বেশ একটা জমকালো ভাব মনে হয় অনেক খরচ করে মাথা খাটিয়ে কিনে সাজানো হয়েছে।
ফেলুদা নিজেই উঠে পাখার রেগুলেটারটা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গেই একজন ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন। গায়ে স্লিপিং সুটের পায়জামার উপর একপাশে বোতামওয়ালা আদির পাঞ্জাবি, পায়ে হরিণের চামড়ার চটি, আর দুহাতের আঙুলে অনেকগুলো আংটি। হাইট মাঝারি, দাড়ি গোঁফ কামানো, মাথায় চুল বেশি নেই, রং মোটামুটি ফরসা, আর চোখ দুটো ঢুলুঢুলু–দেখলে মনে হয় এই বুঝি ঘুম থেকে উঠে এলেন। বয়স কত হবে? পঞ্চাশের বেশি নয়।
‘আপনারই নাম প্রদোষ মিত্তির ?’ জিজ্ঞেস করলেন। আপনি যে এত ইয়ং সেটা জানা ছিল না। ’
ফেলুদা একটু হেঁ হেঁ করে আমার দিকে দেখিয়ে বলল, ‘এটি আমার খুড়তুতো ভাই। খুব বুদ্ধিমান ছেলে। আপনি চাইলে আমাদের কথাবার্তার সময় আমি ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারি।’
আমার বুকটা ধুকপুক করে উঠল। কিন্তু ভদ্রলোক আমার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই বললেন, ‘কেন, থাকুক না—কোনও ক্ষতি নেই। তারপর ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, ইয়ে—আপনারা কিছু খাবেন-টাবেন? চা বা কফি ?’
‘নাঃ ! এই সবে চা খেয়ে বেরিয়েছি।‘
‘বেশ, তা হলে আর সময় নষ্ট না করে কেন ডেকেছি সেইটে বলি। তবে তার আগে আমার নিজের পরিচয়টা একটু দিই। বুঝতেই পারছেন আমি একজন শৌখিন লোক। পয়সা কড়িও কিছু আছে সেটাও নিশ্চয়ই অনুমান করেছেন। তবে বললে বিশ্বাস করবেন না, আমি চাকরিও করি না, ব্যবসাও করি না, বা বাপের সম্পত্তিও এক পয়সাও পাইনি।‘
নীলমণিবাবু রহস্য করার ভাব করে চুপ করলেন।
ফেলুদা বলল, ‘তা হলে কি লটারি ?’
‘আজ্ঞে ?’
‘বলছিলাম—তা হলে কি কখনও লটারি-টটারি জিতেছিলেন ?’
‘এগজাক্টলি ? ভদ্রলোক প্রায় ছেলেমানুষের মতো চেচিয়ে উঠলেন। এগারো বছর আগে রেঞ্জার্স লটারি জিতে এক ধাক্কায় পেয়ে যাই প্রায় আড়াই লাখ টাকা। তারপর সেই টাকা দিয়ে, খানিকটা বুদ্ধি আর খানিকটা ভাগ্যের জোরে, বেশ ভালভাবেই চালিয়ে এসেছি। বাড়িট তৈরি করি বছর আষ্টেক আগে। আপনি হয়তো ভাবছেন, এরকম অকেজোভাবে একটা মানুষ বেঁচে থাকে কী করে; কিন্তু আসলে একটা কাজ আমার আছে—একটাই কাজ—সেটা হল, অকশন থেকে এইসব জিনিসপত্র কিনে ঘর সাজানে!’
ভদ্রলোক তাঁর ডান হাতটি বাড়িয়ে চারিদিকের সাজানো জিনিসপত্রগুলোর দিকে দেখিয়ে দিলেন। তারপর বললেন— ‘যে ঘটনাটা ঘটেছে তার সঙ্গে আমার এইসব আর্টিস্টিক জিনিসপত্তরের কোনও সম্পর্ক আছে কি না জানি না, কিন্তু আমার মনে সন্দেহ হয় যে হয়তো থাকতেও পারে। এই যে— ।‘
নীলমণিবাবু তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে কয়েকটা কাগজের টুকরো বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন। ফেলুদার সঙ্গে সঙ্গে আমিও কাগজগুলো দেখে নিলাম। তিনটে কাগজ, তার প্রত্যেকটাতেই লেখার বদলে লাইন করে ছোট ছোট ছবি আঁকা। সেই ছবির মধ্যে কিছু কিছু বেশ বোঝা যায়—যেমন, প্যাঁচা, চোখ, সাপ, সূর্য—এইসব। আমার কেমন যেন ব্যাপারটাকে দেখা দেখা বলে মনে হচ্ছিল, এমন সময় ফেলুদা বলল, ‘এসব তো হিয়েরোগ্লিফিক লেখা বলে মনে হচ্ছে।‘
ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে ?’
ফেলুদা বলল, ‘প্রাচীনকালে ইজিসিয়ানরা যে লেখা বার করেছিল, এটা সেই জিনিস বলে মনে হচ্ছে।’
‘তাই বুঝি?’
‘হুঁ। তবে এ লেখা পড়তে পারে এমন লোক কলকাতায় আছে কি না সন্দেহ।‘
ভদ্রলোক যেন একটু মুষড়ে পড়ে বললেন, তা হলে? যে জিনিস দুদিন অন্তর অন্তর ডাকে আমার নামে আসছে, তার মানে না করতে পারলে তো ভারী অস্বস্তিকর ব্যাপার হবে! ধরুন যদি এগুলো সাংকেতিক হুমকি হয়—কেউ হয়তো আমাকে খুন করতে চাইছে, আর তার আগে আমাকে শাসাচ্ছে।’
ফেলুদা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনার যে-সমস্ত জিনিসপত্র সাজানো রয়েছে— তার মধ্যে ইজিন্সিয়ান কিছু আছে? –
নীলমণিবাবু হেসে বললেন, ‘দেখুন, আমার কোন জিনিস যে কোথাকার, সেটা আমি নিজেই ঠিক ভালভাবে জানি না। আমি কিনি, কারণ আমার পয়সা আছে এবং আর পাঁচজন শৌখিন লোককে এ সব জিনিস কিনতে দেখেছি, তাই।’
কিন্তু আপনার এত জিনিসের মধ্যে একটিকেও তো খেলো বলে মনে হচ্ছে না। যারা শুধু এগুলো দেখবে, তারা তো আপনাকে রীতিমতে সমঝদার লোক বলে মনে করবে।
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ওটা কী জানেন? এ সব ব্যাপারে সচরাচর জিনিস ভাল হলেই তার দাম বেশি হয়। টাকা যখন আছে, তখন আমি সেরা জিনিসটা কিনব না কেন! অনেক ভারী ভারী খদ্দেরের উপরে টেক্কা দিয়ে নিলাম থেকে এ সব কিনেছি মশাই, কাজেই ভাল জিনিস আমার কাছে থাকাটা কিছু আশ্চর্য নয়।’
কিন্তু মিশরের জিনিস কিছু আছে কি না জানেন না ?
নীলমণিবাবু সোফা ছেড়ে উঠে একটা কাচের আলমারির দিকে গিয়ে তার উপরের তাক থেকে একটা বিঘতখানেক লম্বা মূর্তি নামিয়ে এনে সেটা ফেলুদার হাতে দিলেন। সবুজ পাথরের মূর্তি, তার গায়ে আবার নানা রঙের ঝলমলে পাথর বসানো। দু-এক জায়গায় যেন সোনাও রয়েছে। তবে আশ্চর্য এই যে, মূর্তিটার শরীর মানুষের মতো হলেও, তার মুখটা শেয়ালের মতো। এটা দিন দশেক আগে কিনেছি অ্যারাটুন ব্রাদার্সের একটা নিলাম থেকে। এটা বোধহয়—’
ফেলুদা মূর্তিটায় একবার চোখ বুলিয়েই বলল, আনুবিস।”
আনুবিস ? সে আবার কী?
ফেলুদা মূর্তিটা সাবধানে নেড়েচেড়ে নীলমণিবাবুর হাতে ফেরত দিয়ে বলল, আনুবিস ছিল প্রাচীন মিশরের গড অফ দ্য ডেড। মৃত আত্মাদের দেবতা।..চমৎকার জিনিস পেয়েছেন এটা।’
কিন্তু— ভদ্রলোকের গলায় ভয়ের সুর —এই মূর্তি আর এইসব চিঠির মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে কি? আমি কি এটা কিনে ভুল করলাম? কেউ কি এটা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে বলে শাসাচ্ছে?
ফেলুদা মাথা নেড়ে বলল, সেটা বলা মুশকিল। চিঠিগুলো কবে থেকে পেতে শুরু করেছেন ??
‘গত সোমবার থেকে ৷ ”
‘অর্থাৎ, মূর্তিটা কেনার ঠিক পর থেকেই?
‘হ্যাঁ।’
‘খামগুলো আছে?”
না, ফেলে দিয়েছি। রেখে দেওয়া হয়তো উচিত ছিল—তবে খুবই সাধারণ খাম, সাধারণ টাইপরাইটারে ঠিকানা লেখা পোস্টঅফিস এলগিন রোড়।’
ঠিক আছে ফেলুদা উঠে পড়ল। ‘আপাতত কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। শুধু সেফ সাইডে থাকার জন্য মুর্তিটাকে ওই আলমারিতে না রেখে আপনার হাতের কাছে রাখবেন। সম্প্রতি একজনদের বাড়ি থেকে এ ধরনের কিছু জিনিস চুরি হয়েছিল।’
তাই বুঝি ?
‘হ্যাঁ। একজন সিন্ধি ভদ্রলোক যদ্দূর জানি এখনও সে চোর ধরা পড়েনি।’
আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে ল্যান্ডিং-এ এলাম।
ফেলুদা বলল, আপনার সঙ্গে রসিকতা করতে পারে এমন কারুর কথা মনে পড়ছে?
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, ‘কেউ না। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।’
‘আর শত্রু ??
ভদ্রলোক কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বললেন, ধনীর তো শত্রু সব সময়ই থাকে, তবে তারা তো কেউ আর শত্রু বলে নিজেদের পরিচয় দেয় না। সামনাসামনি দেখা হলে সকলেই খাতির করে কথা বলে |’
আপনি মূর্তিটা তো নিলামে কিনেছিলেন বললেন।’
‘হ্যাঁ। অ্যারাটুন ব্রাদার্সের নিলামে।”
‘ওটার ওপর আর কারও লোভ ছিল না ?’
কথাটা শুনে ভদ্রলোক হঠাৎ যেন বেশ একটু উত্তেজিত হয়ে হাত কচলাতে শুরু করলেন। তারপর বললেন, আপনি কথাটা জিজ্ঞেস করে আমার ভাবনার একটা নতুন দিক খুলে দিলেন। আমার সঙ্গে একটি ভদ্রলোকের অনেকবার নিলামে ঠোকাঠুকি হয়েছে—সেদিনও হয়েছিল।
তিনি কে ?’
‘প্রতুল দত্ত।’
‘কী করেন?’
‘বোধহয় উকিল ছিলেন। রিটায়ার করেছেন। সেদিন ওর আর আমার মধ্যে শেষ অবধি রেষারেষি চলে। তারপর আমি বারো হাজার বলার পর উনি থেমে যান। মনে আছে, নিলামের পর আমি যখন বাইরে এসে গাড়িতে উঠছি, তখন হঠাৎ ওর সঙ্গে একবার চোখচুখি হয়ে পড়ে। ওর চোখের চাহনিটা মোটেই ভাল লাগেনি।’
‘আই সি।”
আমরা নীলমণিবাবুর বাড়ি থেকে বেরোলাম। গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ফেলুদা প্রশ্ন করল, “এ বাড়িতে কি আপনারা অনেকে থাকেন ?’
নীলমণিবাবু হেসে বললেন, “কী বলছেন মশাই? আমার মতো একা মানুষ বোধহয় কলকাতায় দুটি নেই। ড্রাইভার, মালি, দুটি পুরনো বিশ্বস্ত চাকর, ও আমি—ব্যস।
ফেলুদার পরের প্রশ্নটা একেবারেই এক্সপেক্ট করিনি—
‘বাচ্চা ছেলে কি কেউ থাকে না এ বাড়িতে ?
ভদ্রলোক একমুহূর্তের জন্য একটু অবাক হয়ে তারপর হো হো করে হেসে বললেন, ‘দেখেছেন—ভুলেই গেছি! আসলে আমি লোক বলতে বয়স্ক লোকের কথাই ভাবছিলাম। আজ দিন দশেক হল আমার ভাগনে ঝুন্টু এখানে এসে রয়েছে। ওর বাবা ব্যবসা করেন। এই সেদিন সস্ত্রীক জাপানে গেছেন। ঝুন্টুকে রেখে গেছেন আমার জিন্মায়। বেচারি এসে অবধি ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগছে।’
তারপর হঠাৎ ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, আপনার বাচ্চার কথা মনে হল কেন ?
ফেলুদা বলল, “বৈঠকখানার একটা আলমারির পিছন থেকে একটা ঘুড়ির কোনা উকি মারছিল। সেইটে দেখেই…”
নীলমণিবাবুর চাকর একটা ট্যাক্সি ডাকতে গিয়েছিল, সেটা নুড়ি ফেলা পথের উপর দিয়ে কড় কড় শব্দ করে পোর্টিকের তলায় ঠিক আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ফেলুদ ট্যাক্সিতে ওঠার সময় বলল, সন্দেহজনক আরও কিছু যদি ঘটে তা হলে তৎক্ষণাৎ আমাকে জানাবেন। আপাতত আর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।’
বাড়ি ফেরার পথে ফেলুদাকে বললাম, শেয়াল-দেবতার চেহারাটা দেখে কীরকম ভয় করে—তাই না ?’ –
ফেলুদা বলল, মানুষের ধড়ে অন্য যে-কোনও জিনিসের মাথা জুড়ে দিলেই ভয় করে—শুধু শেয়াল কেন ??
আমি বললাম, পুরনো ইজিন্সিয়ান দেবদেবীর মূর্তি ঘরে রাখা তো বেশ বিপজ্জনক।’ ‘কে বলল ?’ . বাঃ—তুমিই তো বলেছিলে।’ – ‘মোটেই না। আমি বলেছিলাম, যে সব প্রত্নতাত্ত্বিকরা মাটি খুঁড়ে প্রাচীন ইজিন্সিয়ান মূর্তি টুর্তি বার করেছে, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে বেশ নাজেহাল হতে হয়েছে।’
হ্যাঁ-হাঁ—সেই যে একজন সাহেব—সে তো মরেই গিয়েছিল—কী নাম না ? লর্ড কারনারভন।
কুকুর তার সঙ্গে ছিল না। কুকুর ছিল বিলেতে। সাহেব ছিলেন ইজিপ্টে। তুতানখামেনের কবর খুঁড়ে বার করার কিছুদিনের মধ্যেই কারনারভন হঠাৎ ভীষণ অসুখে পড়ে মারা যান। তারপরে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, যে সময় সাহেব মারা যান, ঠিক সেই একই সময় বিনা অসুখে রহস্যজনকভাবে বেশ কয়েক হাজার মাইল দূরে তার কুকুরটিও মারা যায়।’
প্রাচীন ইজিপ্টের কোনও জিনিস দেখলেই আমার ফেলুদার কাছে শোনা এই অদ্ভূত ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। শেয়াল দেবতা আনুবিসের মূর্তিটাও নিশ্চয়ই কোনও মান্ধাতার আমলের ঈজিন্সিয়ান সম্রাটের কবর থেকে এসেছে। নীলমণিবাবু কি এ সব কথা জানেন না? সাধ করে বিপদ ভকে আনার মধ্যে কী মজা থাকতে পারে তা তো আমি ভেবেই পাই না।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়