যাবে বলে ঠিক করে বাড়ি থেকে বেরোয়নি পৃথু, কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে শেষে গিরিশদার বাড়ির পথই ধরল।

গিরিশদার বাড়িটা ভুলভুলাইয়ার উল্টো দিকে। হাটচান্দ্রার মূল সীমানা পেরুনোর পরই এদিকটা বেশ নির্জন। কাঁচা রাস্তাটা গিয়ে পুন্নার গভীর জঙ্গলের ফরেস্ট রোডে মিশে গেছে। রাস্তাটা ঢালু হয়ে গড়িয়ে গিয়ে একটা ছোট্ট নালা পেরিয়েছে। তার নাম পিরপিরি। উপরে একটা কওয়ে। নালাটার পরই সেগুনের প্ল্যানটেশান। চল্লিশ বছরের পুরনো। যখনই এই প্ল্যানটেশানটা পেরোয়, পৃথু ভাবে; যদিও এই সেগুনেরা এখন পৃথুরই সমবয়সী, ওর জীবনাবসানের অনেক দিন পর অবধিও ওরা সতেজ প্রাণবন্ত থেকে যাবে। সৃষ্টিতে মানুষ অনেকেরই চেয়ে কম দীর্ঘজীবী। ক্ষিদে জ্বালায় শরীরকে; আর চিন্তা জ্বালায় মনকে। থাকার মতো মন তো শুধু মানুষেরই থাকে। এই মন জ্বলে গেলে, নির্মন মানুষের আর বাকিটা কী থাকে? খোলসটার দাম তো সাপের খোলসের চেয়েও কম। মানুষ কি একটি সেগুনের চেয়েও কম মূল্যবান যে, এই জমকালো রঙ্গমঞ্চে তার অবস্থান এতই স্বল্প সময়ের জন্যে?

বেলা পড়ে এসেছে। কার্তিকের বিকেলের এক বিশেষ কারুণ্য আছে, এবং তা যেন দিনশেষেই সবচেয়ে বেশি করে প্রতীয়মান হয়। বড়কি ধনেশের একটি ছোট্ট ঝাঁক গ্লাইডিং করে স্থির ডানায় পশ্চিমের আকাশকে এক গভীর স্তব্ধতা ও গাম্ভীর্যে মুড়ে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ড়ুবন্ত সূর্যের গলে-যাওয়া টেরাকোটা বিধুর বৃত্তর মধ্যে। দিনান্তর মধ্যেও অন্য দিনান্ত থাকে। সুর্যের গলিতাৰ্থর মধ্যেও অন্য গলিতাৰ্থ; যার রহস্য বিজ্ঞানীদের আজ অবধিও অজানা, কিন্তু সেই রহস্যর খোঁজ যেন ইতিহাসের সমবয়সী ধনেশ পাখিরাই একমাত্র রাখে।

কত রহস্য চারদিকে। রহস্যময়তায় দিগন্তবেলার পেঁয়াজখসী কাতান বেনারসী-জড়ানো প্রকৃতি যেন বিশ্বচরাচরের দূর দূরান্তরের শীতার্ত প্রান্তর থেকে মাধুকরী শেষে তার পর্ণকুটিরে ফেরে। আসন্ন সন্ধ্যার নিবাত নির্লিপ্তিতে হেমন্তের হিমের গন্ধ ভাসে। পৃথুর চারপাশে, কারা যেন যায় আসে, কাঁদে হাসে; অশরীরী, আশ্চর্য সব বোধ। এমনই কচিৎ স্তব্ধ, শান্ত, নিলোম অনুভূতির সীমিত বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে ও অন্য পৃথিবীর জীবাশ্ম এবং প্রাণের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে। খুব ভাল লাগতে থাকে ওর। তারপরই; হঠাৎ, ভয় করে।

একদিন যেতে বলেছিলেন গিরিশদা ওকে। রাম আর সুজির খিচুড়ি খাওয়াবেন বলেছিলেন। সেদিনটা কবে, পৃথু ভুলে গেছিল। আজকাল কোনও কিছুই তেমন স্পষ্ট করে মনে থাকে না। একদা-পরিচিত মানুষের মুখ, নেমন্তন্নর দিন, কে বা কারা তাকে একদিন অনেক ভালবেসেছিল অথবা অপমান করেছিল এ সবই ভুলে যায়।

ভুলে যাওয়াই ভাল। ভুলে না যেতে পারলে কি কোনও মানুষ বাঁচে? এই অকৃতজ্ঞতার, কৃতঘ্নতার পৃথিবীতে; সব কিছুই মনে রাখতে গেলে মনের মধ্যে এক বিরাট ক্যানসারাস গ্রোফ হয়ে উঠবে যে কুৎসিত; তারপর সেই দলা-পাকানো ভীতিজনক স্মৃতি নিঃশব্দে ফেটে যাবে এক সময় মস্তিষ্ক খান খান করে দিয়ে। তাই-ই ও সহজে সব কিছু ভোলে। সুন্দর অতীত এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ-এর স্বপ্ন ছাড়া তার ক্লিষ্ট মস্তিষ্কে আর কিছুই ধরে রাখতে চায় না পৃথু।

মুনেশ্বর বাগানে ঝারি হাতে জল দিচ্ছিল। ওকে দেখে, মুখ নিচু করেই বলল, পরনাম পিরথুবাবু।

পর্‌নাম। তোর বাবু কোথায়?

বাবু, হাওয়া ধরছেন।

হাওয়া ধরছেন?

পৃথু ভাবল, মুনেশ্বরও কি তাকে ইয়ার ঠাওরাল না কি? যাকে দেখলে মনে হয়, পয়সা নেই; পদমর্যাদা নেই, যার কাউকেই ভয় দেখাবার, ভয় পাওয়াবার ক্ষমতা নেই, তাকে সকলেই ইয়ার ভাবে। ইয়ার্কি করে তার সঙ্গে।

হাওয়া ধরছেন? কোথায়?

ওই তো! পেছনের টাঁড়ে।

গিরিশদার “স্কটিশ কটেজ”-এর পেছনে অনেকখানি টাঁড় মতো জায়গা। সেখানে লাল মাটি, খোয়াই, ঝাঁটি জঙ্গল, তিতির আর খরগোশের বাস। মাঝে-মধ্যে কোটরা হরিণ চলে আসে উদ্ভ্রান্তের মতো জঙ্গলের গন্ধ মেখে। শেয়ালরা ধূর্ত চোখে ইতি-উতি চাইতে চাইতে শর্টকাট করে যায় পুন্নার জঙ্গলের দিকে আসতে-যেতে। সেই টাঁড়েরই মধ্যে একটা প্লাটফর্ম মতো দাঁড় করানো। শালবল্লী আর লতা দিয়ে বানানো হয়েছে পোক্ত করে। গিরিশদা কোনওরকম অপোক্ত ব্যাপারে বিশ্বাস করেন না। সেই প্লাটফর্ম-এর উপরে বাঘ শিকারের মাচার মতো করে বানানো হয়েছে পেল্লায় এক মাচা, শালের চেরা-তক্তা ফেলে। যজ্ঞিবাড়ির একটা প্রকাণ্ড কেলে-পেছন, কাকরানো হাঁড়িকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়েছে সেই মাচার উপর। সেই হাঁ-হাড়িটার কেলে-পেছনে একটি ফুটো। দেখা যাচ্ছে না; কিন্তু আছে। সেই ফুটোর মুখে কপি, শালগম আর লেটুসের ক্ষেতে জল দেওয়ার স্বচ্ছ পলিথিনের পাইপ। পাইপের অপর প্রান্ত স্কটিশ কটেজ”-এর ভিতর অবধি চলে গেছে। সাপের মতো ঢুকে গেছে এঁকে বেঁকে সেই ঘরে, যেখানে বসে গিরিশদা কাব্য এবং নানাবিধ গা-শিউরানো সৃষ্টশীলতার চর্চা করে থাকেন। সেই ঘরে। মাচার নীচে, লাল মাটিতে একটি রঙ-চটা টেবল ফ্যান, কেরে পড়ে উপরের হাঁড়ির দিকে সন্দেহজনক চোখে চেয়ে আছে। লাল-নীলে জড়ামড়ি করা তার এসেছে দূরের “স্কটিশ কটেজ”-এরই ভিতর থেকে। গিরিশদা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে এবং প্রাণপণ চেষ্টাতে তাঁর একজোড়া ক্রিয়েটিভ দুলা পাতলা হাতে টেল-ফ্যানটাকে একটা ছোট্ট কাঠের পুলির সাহায্যে মাচার উপরে ওঠাবার নিষ্ফল চেষ্টা করছিলেন। পৃথু যে গিয়ে তাঁর একেবারে পেছনেই দাঁড়িয়েছে, তা লক্ষ্য পর্যন্ত করেননি। হঠাৎই মুখ ফিরোতেই পৃথুকে দেখতে পেলেন।

কি গিরিশদা? এটা আবার কী হচ্ছে? নতুন কোনও এক্সপেরিমেন্ট?

অ্যাই তো!

খুশি হয়ে গিরিশদা বললেন, এসে গেছ। বাঃ এক্কেবারে গড়-সেন্ট। হোলি-মিশানে, এরকমই হওয়ার কথা।

কী হচ্ছে কি এটা? কিসের হোলি-মিশান?

এখনও কিছু হয়নি। তবে, হতে পারে। সাকসেসফুল হলে, একটা হওয়ার মতো হওয়া হবে। পুরো কলকাতা শহরের চেহারাটাই পাল্টে যাবে তখন। ঠাট্টা কোরো না। কলকাতার জমি বাড়ির দাম বম্বে ব্যাঙ্গালোরের মতো হয়ে যাবে। আর ইন দ্যা প্রসেস আমিও কোটিপতি হয়ে যাব। অক্সিজেন-হীন ডিজেলের ধোঁয়ায় খাবি-খাওয়া শহরে ছেলে-মেয়েরা সব ফুটফুটে ফুলের মতো হয়ে যাবে। তুমি এজেন্সী নিতে চাও আমার নতুন কোম্পানির, তো দিতে পারি। ভেবে দ্যাখো। কিন্তু এদেশে মানুষ কিছু করছে কি? করতে গেলেই তো বাধা। নিজের কাজে কেউ বাধা দেয় না। দেশের কাজ করতে গেলেই টিটকিরি! এসো তো ভায়া, একটু হাত লাগাও দেখি। এই ফ্যানটাকে তুলে ঠিক ওই হাঁড়ির মুখ থেকে তিন হাত পেছনে করে মাচাটার উপর দাঁড় করাতে হবে। পুরনো আমলের ফ্যান। বাবা নাগপুরে থাকতে কিনেছিলেন। তাঁর মাথার পেছনে রেখে রাত দুটো অবধি শুয়ে শুয়ে ওয়েস্টার্ন ব্যাংব্যাং নভেল পড়তেন। এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দোকান থেকে কিনেছিলেন এই ফ্যানটা। খাঁটি বিলিতি জিনিস। এ-সবের কোনও প্রোটোটাইপ হয় না। আর দ্যাখোনা, ওজনও তখনকার দিনের দশাসই খাঁটি মেমসাহেবদেরই মতো। একা উঠোনোই যায় না। ওইরকম সব গামা-গগাবর-মাকা মেমসাহেবদের, সাহেবরা কোলে তুলে কী করে আদর করত বল দিকি?

পৃথু কিছুই বলল না উত্তরে।

ব্যাচেলর মানুষকে কিছু বলে, ও লজ্জা দিতে চায় না। আদর করতে হলেই যে পিসতুতো ভাইয়ের অন্নপ্রাশন-খাওয়া কন্যার মতো নিজের বউকেও কোলে কাঁখে করতেই হবে এর কী মানে আছে?

কথা না বলেই, অকর্মার-ধাড়ি পৃথু হাত লাগাল। দেশের কাজে। ফর আ চেঞ্জ! যতক্ষণ সম্ভব ফ্যানটার তলায় হাত রেখে নিচ থেকে সেই অচেতন পদার্থর উন্নতিকে সাপোর্ট করা যায়; তাই-ই করতে লাগল। করতে করতে আড়চোখে একবার দেখে নিল; পুলির সঙ্গে লাগানো দড়িটার স্বাস্থ্যটা কী প্রকার।

নাঃ। ভাল মোটেই নয়। ন্যাবা ধরেছে। অথচ, হাটচান্দ্রার জল তো খারাপ নয়!

ফ্যান উপরে উঠতে লাগল। গিরিশদা এবং পৃথুর যুগ্ম চেষ্টাতে। গিরিশদা দড়ি ধরে ক্ষেপে ক্ষেপে টানছেন; কুঁয়োতলা থেকে জল তোলার মতো করে। আর পৃথু নিচ থেকে ঠেলছে। যার যেমন কপাল! চিরদিনই অধঃপতিত বস্তু বা ব্যক্তিকে উখিত করার কর্তব্যই ওকে দিয়ে সবাই-ই করিয়ে নিতে চায়। অথচ, ওর স্বাভাবিক প্রবণতা সবরকম অধঃপতনেরই দিকে। ঠেলছে, মানে, হাঁড়িটাকে ধরে আছে মাথার উপরে। অনেকটা, হনুমানের গন্ধমাদন ধরে উড়ে যাবার পোজ-এ। যখন টেবল-ফ্যানটা পৃথুর উখিত দু হাতেরই নাগালের উপরে চলে গেল তখন হাত খালি হওয়ায় ও গিরিশদার সঙ্গে দড়িতেই হাত লাগাল। কিন্তু পৃথুর প্রত্যয় এ বিষয়ে বিশেষই দৃঢ় হল যে, মাধ্যাকর্ষণ, শক্তি হিসেবে, এখনও যথেষ্ট জোরালো শক্তি। ফ্যানটা ইনকনসিডারেটের মতো অল-অন-আ-সাড়ন গিরিশদার মাথা এবং পৃথুর ডান পা গুড়িয়ে দিতে দিতেও, না-দিয়ে; মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল গোঁত্তা মেরে। গোব্দা মেমসাহেব মাকা ফ্যানের মূল শরীর এবং এলিজাবেথীয়ান গাউনের মতো পাখা ঝাকা গ্রীলটা আলাদা হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। মুক্তির আনন্দে পাখার বিযুক্ত গ্রীলটা চার পাক ঘুরে নিয়েই থিতু হল।

গিরিশদা দু কোমরে দুই হঠাৎ-খালি হাত রেখে দীর্ঘ সময় ধরে ঘটনাটাকে ঘটতে দেখলেন।

বললেন, দেখলে। পৃথু! অধঃপতন!

পতন তো চিরকাল অধঃলোকেই হয় গিরিশদা, কে আর কবে উর্ধলোকে পড়েছে বলো?

পৃথু বলল। তারাশঙ্করের দুই পুরুষের নুটু মোক্তারের লোজোয়াব ডায়ালগ কোট করো।

ঠাট্টা নয় হে! ক্যালামিটি। রিয়্যাল, গ্রেট ক্যালামিটি।

বড় কিছু করতে গেলে এরকম ছোট-খাটো ক্যালামিটি হয়ই।

পৃথু বলল।

ক্যালামিটি ইজ আ ক্যালামিটি, ইরেসপেকটিভ অফ ইটস্ স্কেল।

ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে ফ্যানটা পড়লে বড়ই লাগত, কারণ সেখানে সবে একটা লোম-ফোঁড়া গজিয়েছিল পৃথুর। বেঁচে যে গেছে, এই ঢের! পৃথু সে কথাই ভাবছিল। লেসার ক্যালামিটি সামলাতেই হিমসিম ও সমস্তক্ষণ, গ্রেটার ক্যালামিটি থেকে দূরেই থাকতে চায়।

পৃথু বলল, কী করবেন এখন?

মুনেশ্বরকে দেখেছ? কোথায় যে থাকে রাসকেলটা!

জল দিচ্ছে। বাগানে। দেখে এলাম।

ডেকে আনো তো! ও ইচ্ছে করেই নন-কোপারেট করছে। কোনওরকম সায়েন্টিফিক ব্যাপারেই ব্যাটার এক ফোঁটা ইন্টারেস্ট নেই। টিপিক্যাল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয়।

পৃথু, মুনেশ্বরকে ডাকতে যেতে যেতে আবারও শুধোল, তা সায়েন্টিফিক ব্যাপারটা হচ্ছে কী? খুড়োর কলটা, কিসের? বলে ফেললেই তো হয়। খামোখা টেসানের মধ্যে আমাকে রেখে কি লাভ হচ্ছে কিছু আপনার?

মুনেশ্বরকে ডেকে আনো। পরে বলব। আর শোন পৃথু, তোমার কি ফ্ল্যাক্ট-ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান অয়েল-এর কারও সঙ্গে জানাশোনা আছে? কোনও বড় অফিসার? বোর্ডের কেউ?

নাঃ।

আদার ব্যাপারী, থাকে ধ্যাতধেড়ে গোবিন্দপুরে; ও চিনবে কী করে?

নো ওয়ান্ডার! তোমরা যে লেখাপড়া কেন শিখেছিলে তা-ই ভাবি মাঝে মাঝে।

পৃথু উত্তর না দিয়ে মুনেশ্বরকে ডাকতে চলে গেল। মুখর কথার উত্তর মূর্খরাই দেয়।

মুনেশ্বরকে নিয়ে ফিরে আসতেই গিরিশদা ওকে হাঁড়ি, ফ্যান ও পুলি সব স্টোররুমে তুলে সেদিনের মতো রেখে দিতে বললেন। তারপর বাড়ির ভেতরে এলেন। বসবার ঘরে এনে বসালেন পৃথুকে।

সন্ধে হয়ে এসেছিল। টাঁড়ে আর ঝটিজঙ্গলে গিরিশদার সায়েন্টিফিক ক্রিয়াকাণ্ডে তিতির বটেররা এতক্ষণ সব সন্দেহে এবং ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। এখন প্রাণ খুলে দিনের প্রাত্যহিক ফেয়ারওয়েল-সঙ গাইতে লাগল।

গিরিশদা বললেন, কী খাবে? বল।

যা হয়।

ন্যাকামি কোরো না। জোয়ান-মন্দ লোকের ন্যাকামি আমার একেবারেই পছন্দ হয় না। তোমার সব ভাল, কিন্তু তুমি বড় মেয়ে-মেয়ে। কী খাবে তাই-ই বল। মন খুলে।

আপনি যা খাবেন।

আশ্চর্য! আমার সঙ্গে তোমার কী?

বিরক্ত হয়ে গিরিশদা বললেন।

তাহলে, হুইস্কিই খাব।

তাই-ই বল। বেশ! মনে পড়ে গেল, তোমার জবলপুরের লেফটেনান্ট শালাকে বলে এক বোতল স্কচ জোগাড় করে দিতে পারো? স্বাদই ভুলে গেছি। কত করে দাম এখন। অফিসারস ক্যান্টিনে?

স্কচ আমি খাই না। জানি না। চেষ্টা করব।

পৃথু বলল।

ভাবল, শালাকে বলে কিছুই হবে না। পৃথু যতদিন শালার কাছে দামি ছিল, শালাবাহন ছিল, ততদিনই সে-শালার মুখ-মিষ্টি। এখন প্রয়োজন সবই ফুরিয়ে গেছে। পৃথুকে কেউই পোছে না। দু একটি অনুরোধ করে দেখেছে; গ্রাহ্যই করে না। বড় অপমান লাগে। এরা যখন ছোট, তখন থেকেই পৃথু এদের দেখেছে। এই পৃথিবী বড় নির্লজ্জ। চক্ষুলজ্জা পর্যন্ত নেই। কৃতজ্ঞতাবোধ-টোধ তো অনেক বড় ব্যাপার সব। তার চেয়ে বরং রুষাকেই বলবে। রুষার মতো রিসোর্সফুল মানুষ হাটচান্দ্রাতে আর একজনও নেই। রুষা, ইদুরকারকে বললেই সে জোগাড় করে দেবে। নে-প্রবলেম। গিরিশদাকে একটা না-হয় প্রেজেন্টই করবে।

মুখে শুধু বলল, আচ্ছা গিরিশদা, বলব। মানে, লিখে দেব জবলপুরে। আপনি নেবেন না? হুইস্কি? আমাকে একা কেন?

না ভায়া। এ ব্যাপারে আমি এক্কেবারে সাহেব। ‘স্কটিশ কটেজ’-এর মালিক বলে ব্যাপার। নট বিফোর সানডাউন। তা সুজির খিচুড়ি খাবে তো তুমি!

ঘাড় নাড়িয়ে লোভীর মতো পৃথু বলল, হ্যাঁ।

রুষা কিছুই অন্যায় বলে না। সত্যিই, ও একটা এপিকিউরিয়ান। প্রি-হিস্টরিক পিগ। গ্লাটন। হওয়ার ব্যাপারে। আ বিলিভার ইন কোয়ানটিটিকাম-কোয়ালিটি। তা হবে। পৃথুর জ্যাঠামশায় সম্বন্ধে একটা জনশ্রুতি চালুও ছিল এক সময়ে। পেট-রোগা, অথবা খেতে-না-পাওয়া মানুষেরা প্রায়ই বলে বেড়াত, “মিঃ জগদানন্দ ঘোষ বিলিভস দ্যাট দ্যা ওনলি ওয়ে টু দ্যা হার্ট ইজ থ্রু দ্যা স্টম্যাক।”

আসুক মুনেশ্বর। জোগাড় যন্ত্র করে দিক। আমিই রাঁধব।

গিরিশদা বললেন।

তুমি? তুমি কিছু রাধতে-টাঁধতে পারো? পৃথু?

না। তবে, চা আর ওমলেট পারি।

হাঃ হাঃ।

গিরিশদা জোরে হেসে উঠলেন।

হাসিতে মানুষের চরিত্র ফুটে ওঠে। মানুষটা খুবই সরল। মনের মধ্যে কোনও ঘোর-পাঁচ নেই।

তবে তো পারোই! তুমি যদিও শিখতে চাও, তাহলে তোমাকে রান্নাও শেখাতে পারি। কুলিনারি আর্ট হচ্ছে হাইট অফ অল আর্টস। কেভ-পেইন্টিংস-এর আগে এর জন্ম। বুঝে দ্যাখো, আমাদের এই মধ্যপ্রদেশের ভীম বৈঠকা বা স্পেনের আল্টামিরারও অনেক আগে মানুষ রন্ধন শিল্পে পারদর্শী হয়েছিল। বাগান করারই মতো আনন্দ পাই আমি রান্না করার মধ্যে। ফুল-ফোটানোর মতো, এও এক ক্রিয়েশান। কিন্তু বেঁধে খাওয়াবটা কাকে? হোয়াট আ পিটি? বল?

কেন? গিরিশদা? আমাকে আর সুখময়কে। এবং তার স্ত্রীকেও। যখন আপনি ডাকেন তখনই ত আসি। আপনিও খাবেন। গিরিশদা হাসলেন।

বললেন, ঠাট্টা করছ; করো। যে মানুষের পুরো জীবনটাই একটা মস্ত ঠাট্টা, তার গায়ে এসব ছোটখাটো ঠাট্টা বাজে না হে!

উঠে গিয়ে ছোট্ট সেলার খুলে হুইস্কি ঢেলে নিয়ে এসে পৃথুকে দিলেন। তারপর বললেন, শম্বরের আচার খাবে?

শম্বরের আচার?

হ্যাঁ! বানিয়েছিলাম নাইনটিন সেভেন্টিতে। আস্ত একটা শম্বর। সাবির মিঞা আর শামী মেরেছিল পুন্নার জঙ্গলে। একদম বড়কা নরপাঠঠা শম্বর। পুরোটাকেই আচার বানিয়ে রেখে দিয়েছিলাম ডীপ-ফ্রীজ-এ। খেয়ে দেখো। উমদা জিনিস!

আচার নিয়ে এলেন গিরিশদা।

তারপর বললেন, শোনো পৃথু, আজ সুজির খিচুড়ি নাই-ই বা খেলে। মনটা আজ সাহেবী খানা খেতে চাইছে না। চলো তোমার জন্যে ফ্রেঞ্চ অ্যানিয়ন স্যুপ বাঁধব। আর ডীপ-ফ্রীজ-এ আমার ভাইপো প্রণব-এর মারা নাকটা হাঁস রাখা আছে; তার রোস্ট করব। নাকটা মেরে প্রেজেন্ট করেছিল। নাইনটিন এইট্টিতে। খেয়ে দ্যাখো; মনে থাকবে চিরদিন।

সন্ধে তো হয়ে এল। আপনি এবার একটা নিন গিরিশদা। কিছুক্ষণ পর পৃথু বলল।

বাইরে তাকিয়ে গিরিশদা বললেন, হাঁ। ওয়াক্ত হো গ্যয়া। গিরিশদা উঠে গিয়ে রাম ঢেলে নিয়ে এলেন।

ব্যাপারটা কী করছেন, বললেন না তো!

কোন ব্যাপারটা?

ওই যে! মুনেশ্বর বলল, আপনি নাকি হাওয়া ধরছেন?

হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ। হাওয়াই ধরছি। এনভায়রনমেন্টের যে রকম পলুশ্যান হচ্ছে বড় বড় শহরে তাতে মানুষের বেঁচে থাকাটাই মুশকিল। আরে, আমাদের ভোপাল, ইন্দোর, জবলপুর, রায়পরের কথাই ভাব না। আরও বড় শহরের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম। হাটচান্দ্রার মতো আনপত্মটেড জায়গার হাওয়া এবং এনভায়রনমেন্টের সবরকম নারিশমেন্ট সুদ্ধ যদি কোনও বড় শহরে সটান চালান করে দেওয়া যায়, তাহলে কী হয়। ওই যে হাঁড়িটা দেখলে; ওটা কিছুই নয়। ওটা জাস্ট একটা এপিটম। ডেকরেটরের কাছ থেকে ভাড়া করে এনেছি। পেছনে ছ্যাঁদা অবশ্য করেছি। আমিই। ফেরৎ নেওয়ার সময় ঝামেলা করবে বিলক্ষণ। কিন্তু ওটার দরকার ছিল। ওই হাঁড়ির মতো ব্যাপারটি আসলে হবে কয়েক হাজার গুণ বড়। উল্টো দিক থেকে বড় বড় ব্লোয়ার, ব্লো করে সেই হাঁড়ির মুখে ঢুকিয়ে দেবে বিশুদ্ধ হাওয়া। তার পর এয়ার-টাইট, ওয়াটার-টাইট পাইপলাইনে করে তা চলে যাবে বড় বড় শহরে। পাইপ লাইনের মাঝে মাঝেও চার্জার স্টেশন থাকবে। ব্লোয়ার থাকবে, বিশুদ্ধ হাওয়া চারিয়ে, ভাগিয়ে, ডেস্টিনেশানে নিয়ে যাবার জন্যে অক্সিজেনের ওজনের ডোজ দিয়ে দিয়ে। বড় বড় পলুটেড শহরে স্টোরেজ ট্যাঙ্ক থাকবে। ট্যাঙ্ক থেকে পলিথিনের সীলিল্ডারে করে, যেমনভাবে রান্নার গ্যাস সাপ্লাই হয়, গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি, অফিস কাচারিতে এই বিশুদ্ধ হাওয়াও সাপ্লাই দেওয়া হবে। বেডরুমে, স্কুলে, কলেজে, কারখানায়, অফিসে ওই সিলিন্ডার রেখে দিলেই হল সামান্য খুলে। ভোপালে কি কলকাতায় বসে হাটচান্দ্রার অফিসে ওই সীলিন্ডার রেখে দিলেই হল সামান্য খুলে। ভোপালে কি কলকাতায় বসে হাটচান্দ্রার পরিবেশে! চিন্তা করো, একবার। আমার এক এনভায়রনমেন্ট এঞ্জিনীয়ার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলব এ নিয়ে। বম্বেতে তাকে চিঠিও লিখেছি। এখানে আসতে বলেছি। এই ভেঞ্চার সাকসেসফুল হলে বিশুদ্ধ জল নিয়েও এমন কথা যাবে। একটা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানী ফর্ম করব ভাবছি। নাম দেব, আনপল্মটেড এনভায়রনমেন্ট প্রাঃ লিমিটেড। তুমি কি ডিরেক্টর হতে চাও? ক্যাপিটাল লাগবে না। তুমি শুধু আমার কোম্পানির দারুণ সব চমকে-দেওয়া বিজ্ঞাপনের কপি লিখবে। যাকে বলে, সত্যিকারের ক্রিয়েটিভ কপিরাইটিং। কি হে? পৃথুবাবু ঝুলে পড়বে নাকি? হাঃ হাঃ। বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। পি. সি. রায়ের কথা, বি. সি. রায়ের কথা শুনল না তো বাঙালি!

গিরিশদার চরিত্র সত্যিই বহুমুখী! ওঁর বহুমুখী বাতিকগুলোর একটিও প্রতিভার পাকা রাস্তায় গিয়ে পৌঁছতে পারল না, এইটে ভেবেই দুঃখ লাগে। প্রতিভার পথ বোধহয় বড়ই দুর্গম। খুব কম লোকই বোধহয় সে পথ বেয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। আর যাঁরা পেরেছেন বলে ভাবেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগেরই প্রতিভা কাকে যে বলে সে সম্বন্ধে কোনও স্পষ্ট ধারণাই হয়তো নেই। আজকালকার মেডিয়াবাহিত যশ, প্রচার আর নাম-ডাকের সঙ্গে হয়তো প্রতিভার কোনও সাযুজ্যই নেই। গিরিশদা প্রতিভাবান না হতে পারেন; কিন্তু চমৎকার মানুষ। চমৎকার মানুষই বা ক’জন হতে পারেন? বাতিকগ্রস্ত হতেও এক ধরনের কুঁড়ি-প্রতিভা লাগে হয়তো। খুবই জীবন্ত মনের একজনের ঝকঝকে রসিক মানুষ তিনি। পৃথুর একঘেয়ে, ক্লান্তিকর মন-খারাপ বিষণ্ণ দিনগুলি আনন্দর ফুলফোটা সোনাঝুরি গাছ হয়ে ওঠে যেন গিরিশদার কাছে এলেই। এখানে এসে, নিজেকে নবীকৃত করে ও। বারে বারে।

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। রাম-এ এক চুমুক দিয়েই গিরিশদা বললেন, তাহলে শুরু করি ভায়া, কি বল?

কথাটা তবুও না বোঝার ভান করে পৃথু বলল, কী?

কবিতাটা শুরু করি?

সুখময় কোথায়? আজ এল না তো! তার স্ত্রী? দেখা হল না।

কথা ঘোরাবার জন্যে বলল পৃথু।

সুখময়রা সুখেই আছে। যেদিন আসতে বললাম, সেদিন তো তুমি এলে না! তাদের দেখো পরে, অন্যদিন। আজই জানতে পেলাম সুখময়ের স্ত্রী, পরম কল্যাণীয়া, মানে আমার পুত্রবধু; ইজ ইন দ্যা ফ্যামিলি ওয়ে!

কনগ্রাটস।

পৃথুর মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল কথাটা। ইংরিজি ভাষাটা বোধহয়, কোনও কোনও আগ্নেয়াস্ত্ররই তো; হেয়ার-ট্রিগার আছে। হাওয়া লাগলেও কিছু বোঝার আগেই; গুলির মতোই চকিতে শব্দ ছুট যায়। ভারী খারাপ!

তারপর বলল, কোন কবিতাটি? যার নাম দিয়েছিলেন হাত?

সে কবিতাটি ছিঁড়ে ফেলেছি।

কেন?

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কী বলতেন জানো?

কী?

বলতেন যে, যিনি যত নির্মম ভাবে লেখা কাটতে পারেন, ছিড়তে পারেন। তিনি তো বড় লেখক। নিজেকে বাতিল না করতে পারলে প্রতি মুহূর্ত, পেরিয়ে না যেতে পারলে; সে মানুষ কছুই সৃষ্টি করতে পারে না। যে ক্রিয়েটিভ আর্টিস্ট তাঁর নিজের সম্বন্ধে বা নিজের সৃষ্টি সম্বন্ধে বন্দুমাত্রও শ্লাঘা জন্মিয়েছেন, নিজের মস্তিষ্কের অনবধানে হলেও; সেইটুকু তাঁর কবর খোঁড়ার জন্যে যথেষ্ট।

বাঃ, আপনি সুন্দর বললেন কিন্তু। সত্যি। আপনি চমৎকারই বলেন। ইংরিজিও।

বাঃ! বাংলা কবিতা লিখলে কী হয়, ছাত্র তো ইংরিজিরই ছিলাম! ইংরিজিতেই তো এম. এ. করি। বেশির ভাগ বড় বাঙালী কবিই তো ইংরিজির ছাত্র, ইংরিজির অধ্যাপক। ভাষা জলেরই মতো। জমিতে বেড়া লাগালেও তলে তলে চুইয়ে চলে যায় অন্য মাঠে।

তা ঠিক! ভাষা মাত্রই একে অন্যের পরিপূরকও। একটি ভাষা ভাল যে জানে; সে অন্য একাধিক ভাষাও বেশ ভাল জানে বলেই দেখা যায় সাধারণত।

পৃথু হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে, জ্ঞানী-গুণীদের মতো বলল। কিন্তু, ব্যতিক্রমও থাকে। যেমন আমাদের চাঙ্গু, মানে অতিক্রম সেন। “অশনি” পত্রিকায় তার কলাম বেরুচ্ছে প্রতি সপ্তাহে। অথচ সে বাংলাতে একটি প্যারাও লিখতে পারে না। লিখছে ইংরিজিতেই। অশনির নুচুবাবু অনুবাদ করে দিচ্ছেন হর-সপ্তাহে। বাঙালি পাঠকরা ভাবছেন, কী অসাধারণ প্রতিভাবান লোক এই অতিক্রম সেন। ইংরিজি এবং বাংলা দুটোতেই অসাধারণ দখল!

যেতে দিন।

তা দিলাম। কিন্তু চালাকির দ্বারা কোনও মহৎ কর্ম হয় না।

সকলকেই যে মহৎ কর্ম করতেই হবে এমন মাথার দিব্যিই বা দিয়েছে কে আমাদের?

হুইস্কিতে একটি বড় চুমুক দিয়ে পৃথু বলল।

তা অবশ্য ঠিক। এবার তাহলে শুরু করি?

নতুনটা কী নিয়ে লিখলেন? নাম দিয়েছেন?

নাম দিয়েছি। “একটি করে আয়না”।

‘একটি করে আয়-না? মানে? কুস্তি-ফুস্তির ব্যাপার নাকি? জুডো? ক্যারাটে? এক একজন করে এসে একা-একা লড়তে বলছেন।

 

এমন এমন সময়ে নিজেকে খুবই অপরাধী লাগে। গিরিশদা মানুষটা সত্যিই ভাল, পৃথুকে যথার্থই ভালবাসেন, কাছে ডাকেন, আদর করেন। খাদ্য-পানীয়র আদরও ওঁর কাছে। পৃথু যা পেয়েছে তা এ জীবনে শোধ করতে পারবে না কোনওদিনও। অথচ, বাড়িতে ডেকে তাঁকে যে একদিন খাওয়াবে, সে উপায়ও তার নেই। কিন্তু এত কৃতজ্ঞতা সত্ত্বেও অকবিতাকে কবিতা বলে মানতে সে অপারগ। এটা তার সততা। অভদ্রতা বা অকৃতজ্ঞতা নয়। ও পারে না; মিথ্যাচার করতে। চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন; “ইফ উ্য পে ইভিল উইথ গুড, হোয়াট ড়ু উ্য পে গুড উইথ? ভালকে ভাল বলো, খারাপকে খারাপ। এই অবিবেচনা, এই ট্যাক্টলেনেস্ অথবা ভণ্ডামিতে অপারগতার কারণে, পৃথুকে কম কিছু হারাতে হয়নি আজ পর্যন্ত এই জীবনে। তবুও, বদলাতে পারল না নিজেকে। স্বভাব কি বদলায়? স্বভাব বদলায় চিতাতে।

জুডো কুস্তির ব্যাপার নয়। আয়না মানে; আয়না। লুকিং-গ্লাস।

একটু ক্ষুব্ধ গলায় বললেন গিরিশদা।

তারপর বললেন, শুরু করছি কিন্তু…

পৃথু, পরাজিত সেনাপতির মতো চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। আরও একটা বড় চুমুক দিল গ্লাসে। তারপর নিজের শ্রবণেন্দ্রিয় ও বোধকে ফাঁস-খুলে-ফেলা টাইয়ের মতো আলগা করে দিয়ে চোখ দুটি খুঁজে ফেলল।

পড়ছি : “আয়না দেব একটি করে—
দিনরাত ঢাকের শব্দে কেঁপে উঠছে পাড়া
ভাই সব জানেন কি এই নতুন বাবুরা কারা?
ঢাকীরা বাজাত ঢাক খালে আর বিলে
নেশা করে পেশাদার চাঁটি দিত ঢাকে
পুজো ও পার্বণে, ব্ৰতবন্ধ ও ব্ৰতখোলার দিনে
বাজাত পাড়ায়, বেপাড়ায় গঞ্জে ও হাটে;
প্রতিমায় আলোকরা হ্যাজাক জ্বলা মাঠে
দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রি দ্রি দ্রিম…

কাল রাতে ধরা পড়ে গেল হাতে নাতে, বাবুগণ
যশের বাগানে চুপি চুপি ফুলচোর এতদিন
জীবনের চোরাগলি ঘুরে ঘুরে
অহর্নিশ নিশপিশ হাতে নিজেদের ঢাক নিজেরাই
বাজিয়েছে প্রচণ্ড বিক্রমে সাজানো যশের
ঘুষ-খাওয়া কেঁদো বাঘ ওদেরই পায়ের কাছে
শুয়ে শুয়ে লেজ নেড়ে গেছে যেন দীর্ঘদিন
ঘৃণিত কুকুর!
আসুন দাদারা! চাঁদা তুলে অবহেলা অপমানে একীভূত
নাম গোত্রহীন সব শত্ৰুমিত্র প্রতিবেশী মিলে
তুলে দিই এদের প্রত্যেকেরই হাতে হাতে
একটি, একটি করে আয়না…আত্মসম্মানের…

কাল, বৈতালিকে আমরাই যাব আগে আগে
শিশির আর শিউলির গন্ধভরা ভোরে
গান গেয়ে যাব সকলের আগে;
পিছু পিছু হেঁট-মাথা, নিচু-মুখ;
শ্লথপায়ে ওরা হেঁটে যাবে…

গিরিশদা! পৃথু বলে উঠল।

আবারও হেয়ার-ট্রিগারের গুলির মতো গুলি বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।

গিরিশদা থেমে গিয়ে বললেন, থামিয়ে দিলে পৃথু! ভাল লাগল না? শেষ হয়নি এখনও। আরও অনেকটা আছে।

দীর্ঘ নীরবতা।

আরেকটা চুমুক দিল পৃথু গ্লাসে।

কি? কিছু বলছ না যে! কবিতার কথা?

দীর্ঘতর নীরবতা!

কি পৃথু?

পৃথু ভাবছিল, কবিতাটিতে কি তার প্রতিই খোঁচা? পৃথু ঘোষ আর মণি চাকলাদার ছাড়া তো কবিতার বন্ধ্যা চাষ হাটচান্দ্রায় বেশি লোক করে না। মণি, গিরিশদার কবিতা, ছাপা পত্রিকা দূরস্থান, হতে-লেখা দেওয়াল পত্রিকাতেও ছাপতে রাজি হয়নি। তাই-ই কি?

কি পৃথু?

পৃথু বলল, ও. কে। তবে, বড়ই দীর্ঘ গিরিশদা, অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘ। বলছিলেন, আরও আছে? শেষ হয়নি?

হ্যাঁ। আরও তিনটি স্ট্যাঞ্জা আছে। তুমি বললে, এখানেই শেষ করে দেব?

একটু চুপ করে থেকে বলল, না, না। আমি তা বলছি না। আমি কেন তা বলব? আপনার কবিতা, আপনি ভাল বুঝবেন!

কি হুইস্কি এটা গিরিশদা? খুব ভাল তো! আমাকে আরেকটা দেবেন।

গিরিশদা গ্লাসটি নিয়ে সেলারের কাছে গেলেন।

পৃথু ঘর ছেড়ে বারান্দায় এল। এক পাশে পুন্নার গভীর জঙ্গল। অন্য পাশে সেগুন বন। পেছনে, তিতির বটেরের টাঁড়। চাপ চাপ অন্ধকার। রাতে জঙ্গলের গায়ের মিশ্র গন্ধ।

কী হুইস্কি এটা?

গিরিশদা বারান্দায় এলেন। দুটি গ্লাস হাতে করে। ওঁর জন্যে রাম, পৃথুর জন্যে হুইস্কি।

কী হুইস্কি এটা? খুব ভাল তো!

পৃথুর কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, এবার বলো।. ইমপ্যাকটটা কেমন হল? থামিয়ে দিলে কেন, মাত্র অর্ধেকটা পড়লাম…।

কবিতায় এত রাগ কেন? এত অভিযোগ। ছায়ার লড়াই। কেন?

জীবনে রাগ আছে, তাই…

কথা ঘুরিয়ে গিরিশদাই বললেন, তা হুইস্কিটা ভালই বলছ? নতুন ব্র্যান্ড একটা। চারটে গ্লাস দিল। তাই-ই কিনেছিলাম।

খুবই ভাল গিরিশদা। খুবই ভাল।

পৃথু বলল, গিরিশদার চোখে চেয়ে।

কবিতা খারাপ লেগেছে বলার দুঃখটা হুইস্কি ভাল লেগেছে বলার সুখ দিয়ে পুষিয়ে দিতে চাইল ও।

হুইস্কির ভালত্বর সঙ্গে কবিতার ভালত্বর সমীকরণ করতে চাইছেন না নিশ্চয়ই গিরিশদা! ভাবল ও। হুইস্কিটা কি ঘুষ? না, না, উনি অমন নীচ নন। তবে, কিছু মানুষ সংসারে নিশ্চয়ই থাকেন, হাইলি ডায়াবেটিকদের মতন; সবসময়ই সাধুবাদের ইনসুলিনের উপর যাঁদের বেঁচেবর্তে থাকাটা নির্ভরশীল। গিরিশদা সেই ধাঁচের মানুষই নন।

 

কোনও ভদ্রলোকই গৃহস্বামীর ভাল হুইস্কি খেয়ে তাঁর স্বরচিত কবিতাকে খারাপ বলার কথা ভাবতে পর্যন্ত পারেন না। কিন্তু পৃথু পারল। এ জন্যেই “ভদ্রলোক হওয়া হল না ওর। রুষা ঠিকই বলে। ভদ্রসমাজে অচল। একেবারেই!

কী হল? বলছ না যে ভায়া। আরও কিছু বল। একটু বিশদে…

কবিতার আমি কী-ই বা বুঝি গিরিশদা! আমার মতামতের দামই বা কী! যা মনে হল, তা তো বললামই।

তা না, রাগের কথা বলছিলে কী যেন, একটু আগেই…

হ্যাঁ। তা বলছিলাম। বলছিলাম যে, রাগ ভাল নয়…

কেন? ভাল না হওয়ার কী?

মানে…

মুখে কিছু বলতে পারল না পৃথু।

নিরুচ্চারেই বলল : রাগ না থাকলে হয়তো বিপ্লব হয় না, যুদ্ধও হয়তো জেতা যায় না; জানি। কিন্তু রাগের সঙ্গে কবিতা…মানে অন্যভাবে বললে…কবিতা রাগের সঙ্গে সচরাচর সহবাস করে না।

 

কবিতা-প্রসঙ্গ তারপর গিরিশদা আর তুললেন না। অত্যুৎসাহীদেরও উৎসাহে ভাঁটা পড়ে; কখনও কখনও। নির্লজ্জরও লজ্জা হয়; কখনও কখনও।

সেদিন খাওয়া-দাওয়ার পর গভীর রাতে টর্চ হাতে যখন পৃথু হুইস্কির খুশি বুকে নিয়ে গিরিশদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফিরে আসছিল, তখন ফেউ ডাকতে লাগল পিপিরি নালার কাছে সেগুন জঙ্গলের মধ্যে থেকে।

জংলি জানোয়ারের ভয় পৃথুর নেই। মনে হল, হঠাৎ একটা বোঁটকা গন্ধও যেন এল নাকে। দুর্বল ব্যাটারির টর্চের আলোটা বৃত্তাকারে পড়ছিল অন্ধকার জঙ্গলে। সেই আলোর ফিকে বৃত্ত, অন্ধকারকেই গাঢ় করে তুলছিল শুধু।

ফেউটা আবারও ডাকল। হঠাৎই পৃথুর বুকের হুইস্কির খুশিটা মরে গিয়ে এক গভীর অপরাধবোধে ছেয়ে দিল তাকে। কার্তিকের হিমের রাতের তারা ভরা অন্ধকার আকাশ তাকে নিরুচ্চারে বলল : পৃথু! তুমি নিজেও একটি ফেউ। এ সংসারে; ভগবান কেউই নও। বাঘ নও কেউ।

গিরিশদার জন্যে যেমন মনটা হঠাৎ খুবই খারাপ হয়ে গেল, তেমনই হল রুষার জন্যেও। কুর্চির জন্যে। এমনকী নিজের জন্যেও। নিজে একশ ভাগ সৎ হতে পারলেই খুশি হত ও।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ