ঠুঠা বাইগা আর দেবী সিং দুজনেই হাঁপাচ্ছিল।

আগের দিন তো আর নেই!

একটা সময় ছিল যখন এর চেয়েও উঁচু পাহাড়ে ওরা চোদ্দ পাউন্ড ওজনের ডাবল ব্যারেল রাইফেল কাঁধে করেও প্রায় দৌড়ে উঠেছে।

চমৎকার মালভূমি। টাইগার প্রোজেক্ট হওয়ার পর থেকে জানোয়ার বেড়ে গেছে অনেক। গাছপালা, ঘাসবন সবই বেড়েছে। বছরের বারোমাস, জঙ্গল নিজেই নিজের মালিক হয়ে রয়েছে এখন। অন্য কারওরই তাঁবেদার নয় সে। অনেকদিন শরিকে শরিকে মামলা চলার পর মহা ফিরে পেলে জমিদারের মনে যেমন এক আত্মপ্রসাদ আসে, কাহার জঙ্গলের মনের এখন সেইরকম অবস্থা। বৃষ্টিও বেড়েছে জঙ্গল বাড়াতে; শুকনো নদী-নালা বেয়ে জল ছুটছে, দিগন্ত থেকে দিগন্তে, সবুজ শাড়ি পরা মেয়ের মতো সবুজ চুল উড়িয়ে, সবুজ পাড় ছড়িয়ে দৌড়ে যাচ্ছে জঙ্গল। তাতে ঠুঠা বাইগার হারিয়ে যাওয়া গ্রামকে খুঁজে পাওয়া আরওই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে দেবী সিং বলল, চল, মালভূমির অন্য দিকটাতে যাই। তারপর দ্যাখো ভালো করে, কোনও চিহ্ন দেখতে পাও কি না।

বিন্ধ্য আর সাতপুরা পর্বতমালাকে জুড়ে দিয়েছে মাইকাল পাহাড়শ্রেণী। এই বৃত্তের মধ্যেই বয়ে চলেছে একদিকে বাজার, অন্যদিকে হাঁলো। এই দুই উপত্যকার মধ্যবর্তী অঞ্চলই কানহা। অপরূপ।

ঠুঠা বাইগা একটা চুট্টা বের করে, হাঁটু গেড়ে বসল, কাঁধ থেকে ঝোলা আর বন্দুকটা নামিয়ে রেখে দেবী সিংকে বলল, ধরাও ধরাও। অত তাড়া কিসের। চল, যাব এখন। দিনের তো অনেকই বাকি। আর রাত হলেই বা কী? রাতের আর দিনে তফাত কি খুব আছে আমাদের? তাছাড়া, এ যাত্রা তিনদিন তিন রাত থাকব বলে তো ঠিকই করে এসেছি।

আসলে, মনে মনে ঠুঠা হাল ছেড়ে দিতে আরম্ভ করেছে। এ জীবনে ও আর ওর শিকড়ে ফিরতে পারল না বোধহয়।

দেবী সিং বলল, জানো তো, এখন জঙ্গলে চুট্টা খাওয়াও মানা। কখন আগুন লেগে যাবে। ফোরেস্ট-ফায়ার।

ঠুঠা বাইগা মুখ বিকৃত করে বলল, গুলি মারো। তিনকাল পার করে এককালে ঠেকলাম এসে, জঙ্গলের পোকা আমরা, আমাদের জঙ্গলের নিয়ম শেখাতে এলেন। বাঘ মারা মানা! বাঘ দেখাও মানা। বাঘ-বাঘিনীর আদরকরা দেখলে মহা সর্বনাশ হবে। যেন তোমার ছোট ভাই আর ভাদ্র বউয়ের কারবারই দেখছ! শালারা! কালে কালে কতই দেখব আর! গ্রাম, গ্রামের চিহ্ন পর্যন্ত উড়িয়ে দিল, এখন ফোরেস্ট ফায়ারের ভয়ে গর্তে গিয়ে ঢুকব ছুঁচোর মতো। মনের সুখে একটা বিড়ি পর্যন্ত খেতে পারব না।

দেবী সিং, ঠুঠার চেয়ে অনেক ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। অনেক সাহেব-সুবো শিকারির সঙ্গে শিকার খেলেছে সারা জীবন। তাছাড়া, সানজানা সাহেবের কাছে এক সময় থেকেছিল বলে সুশিক্ষাও পেয়েছে। সহবৎ শিখেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে শিখেছে নিজেকে।

ও বলল, রাগ করলে হবে কেন? তা হিসাব করে বলো তোদেখি, শুধু তুমি আর আমি মিলেই সারা জীবনে নিজেরাই ক’টা মারলাম এবং শিকারিদের দিয়েই বা কটা মারালাম? বাঘ। শুধু বাঘই। বাঘের হিসেবেই ধরো শুধু। অন্য জানোয়ারদের কথা ছেড়েই দাও।

দেবী সিং-এর কথাতে দুজনেই আঙুল গুণতে লাগল নিজের হিসাব করে। ঠুঠা প্রথমে বলল, নিজে দশটা, শিকারিরা বারোটা।

দেবী সিং বলল, আমি নটা। শিকারিরা পনেরোটা। তবে? তবেই হিসাব করো। আমরা দুজনেই ছেচল্লিশটা সাবড়ে দিয়েছি। তা এমন চললে, বাঘের বংশ লোপই হয়ে যেত না কি আর কিছুদিনেই? আমরা এবং আমাদের মতোই অন্যরাও এমন করলে?

ঠুঠা বলল, কিন্তু এর জন্যে দায়িটা কারা বল দেখি? আমরা? না সরকার নিজে? যেই ইন্ডিপিণ্ডিরি হয়ে গেল, অমনি…।

ঠুঠা এই ইংরিজিটা শিখেছে।

দেবী সিং শুধোল, মানেটা কি?

ভারত স্বাধীন, মানেই ইন্ডিপিণ্ডিরি। ইন্ডিপিণ্ডিরি হয়ে যেতেই সব শিকার কোম্পানী গড়ে উঠল রাতারাতি, বর্ষার দিনে শালের জঙ্গলের নীচে অসংখ্য কুকুরমুত্তার মতো বিদিশি টাকার ভীষণই দরকার ছিল না কি সরকারের সেই সময়। ফোরিন ইক্সচিঞ্জ। একটা বাঘ মারতে পারলে, বা একটা বাঘকে মাচার নীচে বা জীপ থেকে দেখাতে পারলেই এক এক কম্পানী পাঁচ-পাঁচ হাজার দশ-দশ হাজার ডলার পেত। সে শিকারী ছাই, বাঘ মারতে পারুক আর নাই-ই পারুক। গরমেন্টের ‘ফুরেন ইক্সচিঞ্জি’ হত। তা ফুরেন ইক্সচিঞ্জি’ করতে গিয়েই তো সব বাঘ ফুটে গেল। হিসেব করে বল দেখি, ইংরেজ আমলে ক’টা বাঘ মারা পড়েছে এই মুক্তি, সুকর, ভাইসেনঘাট, কিলি কি সীওনী বা মান্দলাতে? ক’টাই বা মারা পড়েছে ইন্ডিপিন্ডিরির পর? ইংরিজি আমলে আইন, শৃঙ্খলা, ভয়-ডর ছিল। ইন্ডিপিন্ডিরি হয়ে, সবই গেল। যাই-ই বল, আর তাই-ই বল।

দেবী সিং চুট্টায় বড় একটা টান লাগিয়ে বলল ‘সবই গেল’ এ কথাটা তোমার বোধহয় ঠিক নয়। অনেকেই ভাল হয়েছে। সবই খারাপ হয়েছে এ কথা বলাটা অন্যায়। তোমার নজরটা বড়ই একপেশে ঠুঠা।

তা হবে!

অভিমানের গলায় বলল ঠুঠা!

তারপর তাকিয়ে রইল বিস্তীর্ণ ঘাসে ছাওয়া মালভূমিটার দিকে। বেশ ঠাণ্ডা এখানে। সকালের রোদেও গা-হাত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মেমসাহেবের ‘চুলের মতো নরম, সোনালি দেখাচ্ছে হাওয়াতে ইলিবিলি কাটা ঘাসের মাঠকে। ধু ধু করছে ভোঁর ঘাড়ের মাঠ। মধ্যে একটি মাত্র শিমুল দাঁড়িয়ে আছে, একা। যেন, বস্তির গাওয়ান। একটি ঝণা মালভূমি ফুঁড়ে বেরিয়ে কোনাকুনি নেমে গেছে পাহাড়ের গায়ের হরজাই জঙ্গল, বাঁশের ঘন ঝাড় বেয়ে নীচের ঘন গভীর কালচে শাল জঙ্গলের দিকে।

পাহাড়ের পায়ের কাছে বাঁশই বেশি। বাইসন, বাঘ, শুয়োররা পছন্দ করে, এই বাঁশ জঙ্গল। এইসব জঙ্গলে হাতি নেই। কেন নেই, তা বলতে পারবে না ওরা, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই দেখেছে যে, নেই। হরজাই জঙ্গল, পাহাড়ের গায়ে গায়ে। জঙ্গল খুবই ঘন। নীচে নেমে গেলে শালই বেশি। আর মাঝে-মাঝেই প্রকাণ্ড সব ঘাসীমাঠ, যাদেরই কোনও একটার মধ্যে লুকিয়ে আছে ঠুঠার গ্রাম। গ্রাম, গ্রামের স্মৃতি।

এই সমস্ত জঙ্গলই পাতা ঝরা জঙ্গল। কোনওদিনও পাতা ঝরে না, এমন চির সবুজ জঙ্গল আছে বলেও শুনেছে ঠুঠা ও দেবী সিং, অনেক বিদিশি শিকারির কাছে। কত দেশের শিকারিই দেখল ওরা এ জীবনে! কত সাহেব, মেমসাহেব, কত হাসির, কত দুঃখের, মজার সব কাণ্ড কারখানা। ভাবতে বসলে, সময় উড়ে যায় কাপাস তুলোর মতো। তাই-ই ভাবে না। সে সব নিয়ে লিখতে পারলে, যদি তেমন লেখাপড়া জানত ওরা, তবে কত কীই না লিখতে পারত। মোটা-মোটা সব দুঃখ-হাসির বই।

আজ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে, ইংরেজদের আমলে, পশ্চিমে বাজ্জার-এর উপত্যকা এবং পুবে হাঁলোর উপত্যকায় প্রথমে এই কান্ পার্ক-এর পত্তন হয়েছিল। পরিষ্কার মনে আছে দেবী সিং-এর। মধ্যপ্রদেশ বলে কোনও জায়গাই ছিল না তখন। সি পি, সেন্ট্রাল প্রভিন্স। সাহেবরা বলত। সি পি টিক। সি পি টাইগার। সেগুন ও শাল দুই-ই যদিও বিখ্যাত, তবুও, সেগুনেরই নাম ছিল বেশি। বার্মার স্যালউইন নদীর উপত্যকায় নাকি সবচেয়ে ভাল সেগুন হত। কন্তু ভারতবর্ষের সবচেয়ে ভাল সেগুন হত এই সেন্ট্রাল প্রভিন্স বা সি পি-তেই। সি পি ছাড়াও মোর সীমান্তে, মণিপুরেও ভাল সেগুন পাওয়া যেত।

সান্‌জানা সাহেবের কাছেই এসব শুনেছিল দেবী সিং।

এসব গল্প দেবী সিং-এর ছেলে বা নাতিকে করলে তারা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সে সব এক জগতের; অন্য সময়ের খবর। এরা জানবে কী করে! তাছাড়া, ওসব ব্যাপারে ওদের কোনও আগ্রহও নেই।

ঠুঠা ভাবছিল, উনিশশো পঞ্চান্ন-ছাপান্ন সালে কাহার ন্যাশনাল পার্কের পত্তন করলেন ফরেস্ট ডিপার্ট। ইন্ডিপিন্ডিরির পর। কিন্তু সেই পার্কের এলাকা ছিল বার্জার-এর উপত্যকার এ এলাকাই। তাই না?

চুট্টার ছাই ঝেড়ে উঠা শুধোল দেবী সিংকে।

যতদূর মনে পড়ে, ঠিকই। তবে, ওই সময় বোধহয় এলাকা বাড়িয়েও ছিল একটু। মনে নেই? সেই যেবার কলকাতার গুহ সাহেব এসেছিলেন। ফারস্ট-ক্লাস একটা বাঘ মারলেন। নর বাঘ। সঙ্গে তার বন্ধু এসেছিলেন জনসন সাক্। সেই যে মাদীন্ বাঘ মারলেন যিনি। কোন্ জনসন? সেই যে হে, দণ্ডকারণ্যর লেসলি জনসন সাহেব, আই সি এস-এর ছোট ভাই! কে, এই জনসন। কি হে ঠুঠা! ভুলেই গেলে? সাহেবরা ঘড়ি দিয়ে গেলেন দুটো আমাদের। যাওয়ার সময়। গুহ সাহেবের সেই বাঘটা নিয়ে গণ্ডগোল হল না কত?

ও হ্যাঁ হ্যাঁ। এবার মনে পড়েছে। সেই জনসন সাব তো দিল্লীর রেভিন বোর্ড-এর মেম্বার ছিলেন। তাই না? মনে আছে না? খুব আছে। আরে গণ্ডগোল বলে গণ্ডগোল। গুলি খেয়ে বাঘ গিয়ে সেঞ্চুরি-এরিয়ার মধ্যে ঢুকল। গুহসাহেব পায়ে হেঁটে বাঘকে ফলো করে মারলেন। তুমি আর

আমি দুজনেই তো ছিলাম এক সঙ্গে। কি দেবী সিং? ঠিক বলছি তো নাকি?

হ্যাঁ হ্যাঁ। সব মনে আছে। চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ঠুঠার। হ্যাঁ। ফোরেস্ট-ডিপার্ট কেস করবে বলল। বলল, বাঘ মারা হয়েছে সেঞ্চুরীর ভিতরে।

দ্যাখো মজা! বাইরে গুলি খাওয়া বাঘকে যদি সেঞ্চুরি এরিয়ার মধ্যে ছেড়ে দিতেন গুহসাহেব, তাহলে লাভটা কার হত?

বাঘেরই হত! আর কার? জমিয়ে ফোরেস্ট-ডিপার্টের গার্ডদেরই খেত, মানুষখেকো হয়ে।

ওরা দুজনে হাসল একসঙ্গে।

হ্যাঁ তখন সেঞ্চুরীর এরিয়া বাড়িয়ে করল কত?

ঠিক কত মনে নেই, বোধ হয় সাড়ে চারশ মতো হবে।

সাড়ে চারশ’? কি মাইল?

আরে ইস্‌কুয়ার। ইস্‌কুয়ার কিঃ মিঃ। তখন তো কিমিটিমি ছিল না। মাইল। ওরকমই হবে। কাছাকাছি।

ঠুঠা বলল, হবে কিমি কিংবা মাইল তা যতখানি হোক। বাইশটা গ্রাম তো উচ্ছেদই করে দিল।

ওই বাইশটা ছাড়া, আগে যেসব গ্রাম মহামারীতে উজোড় হয়েছিল সেগুলোকে খেয়েছিল জঙ্গল। আমার গ্রামটাও খেয়ে দিল। গ্রাম-খাকী। থুঃ!

আওয়াজ করে থুথু ফেলল ঠুঠা বাইগা।

এখন সেঞ্চুরীর এরিয়া কত?

এখন? সবসুন্ধু দু হাজার ইয়ার কি মির উপরই হবে। কম নয়। বাফার জোন-টোন নিয়ে। অবশ্য, বন এবং জানোয়ার বাড়াবার জন্যে অনেক কিছুই করছে কিন্তু এখন ফরেস্ট ডিপার্ট।

তা করুক। কিন্তু এই শালা রেঞ্জার মহা টেটিয়া আছে। আমরা সব আদিবাসী। আমাদেরও শিকার একেবারে বন্ধ করে দিল। একদিন হয়ে যাবে ইসপার-উসপার।

দেবে একদিন একঠে তীর ঠুকে, কোনও ছেলে-ছোকরা।

হুঁ! ছেলে-ছোকরারা কি আমাদের মতো? আমাদের মতো হিম্মৎ নেই তাদের।

তা যা বলেছো। হিম্মৎ নেই। গায়ে জোর নেই।

চল, এবার যাওয়া যাক।

কোনদিকে?

চল, এই ঘাসবনের শেষে কী আছে দেখে আসি। যদি পাহাড়ের ওই মাথায় গিয়ে কিছু দেখতে পাও।

এ তো মস্ত মাঠ। দেবী সিং। এর শেষই নেই।

আছে। আছে। শেষ নেই এমন কিছু আছে নাকি পৃথিবীতে? সব কিছুরই শেষ আছে।

শেষে পৌঁছেও যদি না দেখি? না দেখতে পাই?

তবে আবারও দেখব। মানে, খুঁজব। খুঁজতেই যখন এসেছি।

তারপর ঠুঠাকে প্রবোধ দেওয়ার গলায় বলল, তুমি বড় সহজেই নিরাশ হয়ে পড় ঠুঠা।

যত সহজে ভাবছ, তত সহজে নয়।

কি? করবেটা কী?

আবার নতুন জায়গায় খুঁজব। তোমার গ্রাম বের করবই। আচ্ছা, তোমাদের গ্রামে, মঙ্গলা বলে কোনও মেয়ে ছিল? ভারী মিষ্টি মেয়ে।

ছিল!

উদাসীন গলায় বলল ঠুঠা।

ছিল? বললাম তো হ্যাঁ। কেন? তুমি চিনতে?

হুঁ।

যাঃ শালা!

কেন?

আমারও ভাল লাগত ওকে। তা বিয়ে করল ইতোয়ার। দেখো দেবী সিং, দোস্তী আমাদের জবরদস্ত হওয়ার আরও একটা কারণ ঘটল বল?

ঠিক।

তাহলে, গ্রামটা বোধহয় পেয়েই যাব, কী বল?

বান্‌জারী যাব বলেই তো আসা। আচ্ছা, তোমাদের বান্‌জারী গ্রামের সেই শিমুল গাছ দুটো ঠিক কেমন ছিল?

দেবী সিং শুধোল।

ওরে বাবাঃ। মস্ত শিমুল। অত বড় জোড়া শিমুল এ তল্লাটেই ছিল না। বাবার কাছে গল্প শুনেছি নাঙ্গা বাইগা আর নাঙ্গা বাইগীনের নামে আমার বাবার ঠাকুর্দা পুঁতেছিল শিমুল দুটো। বাজারের পাশের এক বাইগা গ্রাম থেকে চারা তুলে এনে।

নাঙ্গা বাইগা নাঙ্গা বাইগীনের নামেই যদি লাগাল, তো সাজা গাছ লাগাল না কেন? শাকুয়াও তো পারত লাগাতে?

দেবী সিং শুধোল?

কেন, তা কী করে জানব।

চলো। এবার ওঠো। অনেকক্ষণ আরাম হয়েছে।

ওরা দুজনে হাঁটতে লাগল, পৌষের রোদে, সোনালি ধু ধু ঘাসের বনে, সাতপুরা পর্বতশ্রেণীর মাথার উপরের এক অনামা মালভূমিতে। শীতের হাওয়া হু হু করে ঘাসে বিলি কেটে ওদের চুল এলোমেলো করে বয়ে আসছিল পশ্চিম থেকে, পাহাড়শ্রেণীর গায়ের শীতের দিনের রুখু, কিন্তু মিষ্টি গন্ধ বয়ে নিয়ে। সোঁ সোঁ করছে হাওয়াটা। হাওয়ার স্রোতের বিপরীতে, ওদের মাথা সামনে সামান্য ঝুঁকিয়ে, একটি হারিয়ে যাওয়া গ্রামের ইতিহাস পুনরাবিষ্কারের উদ্দেশ্যে জঙ্গল পাহাড়ের দুজন আদিম প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী হেঁটে চলেছে। তাদের একজনের কাঁধে একটি দোনলা বন্দুক। অন্যজনেরও কাঁধে একটি এক নলা। গাদা। একটি করে সস্তা কাপড়ের থলে, তাতে দুটি কম্বল। কছু চাল-ডাল, আলু, নুন। অনেকই সম্ভার।

প্রকৃতি সব কিছুই দিয়েছিলেন মানুষকে, এবং অন্যান্য প্রাণীদের। অন্যদের সকলেরই কুলিয়েও গেল তাতে। কুলোল না একমাত্র মানুষেরই। বড় লোভী, মূর্খ জানোয়ার এ। সকলের জন্যেই সব ছিল। জংলি কুকুর ঢোলদের জন্যে বারাশিঙা, খরগোশ-এর জন্যে ঘাস, শেয়ালের জন্যে খরগোশ, হরিণের জন্যে আমলকি, চিতার জন্যে হরিণ, শম্বরের জন্যে বহেড়া, কুলথী, অড়হর, আর বাঘের জন্যে শম্বর।

একটি বন্দুক আর একমুঠো চাল ডাল এবং একটি কম্বলেই স্বচ্ছন্দে হেসে, গেয়ে, নেচে, হয়তো চলে যেত দিন, সাধারণ মানুষের। এত দৌড়তে হতো না, টেনশান থাকত না, লোভ মানুষকে এমন করে গলায় দড়ি বাঁধা কুকুরের মতো টেনে নিয়ে যেত না ক্রমাগত তার অবধারিত মৃত্যুর দিকে। মানুষই সর্বনাশ করেছে মানুষের। মানুষের লোভ আর অতিমাত্রায় ঔৎসুক্য-ভরা মস্তিষ্কই তার সবচেয়ে বড় শত্রু। অথচ যে শত্রুর বাস তার বুকের ভিতর, তার মস্তিষ্কর ভিতরেই, তাকে সে চিরদিন খুঁজে বেড়িয়েছে বাইরে।

ঠুঠা খুঁজছে ওর হারিয়ে-যাওয়া জঙ্গলের গ্রামকে। ঠুঠার অত সব গভীর ভাবনা ভাবার মতো মানসিকতা নেই। শিক্ষা নেই, বুদ্ধি নেই। যদি থাকত, তবে ও নিশ্চয়ই জানত যে ও একা নয়, জানত যে হাটচান্দ্রার সাহেবদের মতো, এ পৃথিবীর অসংখ্য পোকার মতো অগণ্য শিক্ষিত সর্বজ্ঞ মানুষদেরও একাধিক গ্রাম ছিল, যেখানে ছিল মানুষের আদিবাস; সেই সমস্ত আদিবাস শহরের মালটিস্টোরি বাড়ি, টিভির অ্যানটেনা, কনস্যুমার গুডস-এর বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। যা-কিছু অনাবিল ছিল, সেই সমস্ত কিছু অনাবিলকে মানুষ তার নিজের হাতেই আবিল করেছে, লোভে, ঈর্ষায়, অন্য মানুষের প্রতি জীঘাংসায়। হয়তো, ঠুঠার গ্রামেরই মতো, আদিবাসটিকে এরা কেউই ইচ্ছে করলেও আর খুঁজে বের করতে পারবে না। অপ্রয়োজনের বিলাস, অকারণ প্রতিযোগিতা, অনভিপ্রেত ঈর্ষার ইথারে হারিয়ে গেছে, সেই সব সুন্দর সুখী গ্রামগুলি, দিনগুলি চিরতরে, যে সব গ্রামে, যে সব সুন্দর শান্তির, নূপুর-নিকণিত অবকাশে মানুষ নামক একদল জীবের স্থায়ী ভাবে এবং সুখে বাস করার কথা ছিল।

তফাৎটা এই-ই।

প্রাকৃত, ইংরিজি না-জানা “অশিক্ষিতো ঠুঠা তবু খোঁজ করে, তার আদিবাসের। উজোন বেয়ে যাবার মতো মানসিক জোর এই সামান্য মানুষটার তবুও আছে। সে পরশ পাথরের মতো তবুও খুঁজে ফেরে। খোঁজে না, বুদ্ধিমান শিক্ষিত মানুষেরা।

ওরা দুজনে চলেছে। সারা দুপুরই প্রায় চলতে হবে ওদের ওই ঘাসী মালভূমিটুকু পেরুতে। কাঁধে-ঝোলানো দুটি বন্দুকের কালো নল উঁচু হয়ে আছে ওদের দুজনের মাথার উপরে। ওদের দুজনকে দূর থেকে দুটি আলাদা মানুষ বলে আর চেনা যাচ্ছে না। আসলে, বোধ হয় কোনও মানুষই আলাদা নয়।

এখন ওরা আরও দূরে চলে গেছে, হাওয়ায় ঢেউ-খেলা ঘাসবনে। এতই দূরে যে, এখন মানুষ বলেও ওদের চেনা যাচ্ছে না। বন্দুকের নল দুটিকে মনে হচ্ছে, দুটি শিং। মনে হচ্ছে, অদ্ভুত দর্শন, দুশিং এবং চার-পা-ওয়ালা কোনও এক বিদঘুটে জানোয়ার এলোমেলো পা ফেলে হেঁটে চলেছে সাতপুরা পাহাড়শ্রেণীর মাথার উপর দিয়ে, আদিম গন্ধ-ভরা ঘাসে ঘাসে কোনও অজানা গন্তব্যের দিকে। তারা নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলতে বলতে যাচ্ছে, পাখিরই ভাষার মতো, বারাশিঙারই ভাষার মতো, তাদেরও এক ভাষা আছে। যদিও কথা বলছে ওরা, কিন্তু বড়হা দেব-এর ফু-এর হু-হু হাওয়া ওদের সব কথা উড়িয়ে নিচ্ছে, কাপাস তুলোর মতো ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘাস বনে। বনে বনে কানাকানি উঠছে। বড়হা দেব, কিছুটা ক্ষমা, কিছুটা স্নেহ, কিছুটা অনুকম্পার সঙ্গে চেয়ে আছেন তাঁরই সৃষ্টির এই আশ্চর্য, গোলমেলে দুটি দু-পেয়ে প্রাণীর দিকে।

মালভূমির ঘাসী-প্রান্তর পেরোতে ওদের প্রায় দু ঘণ্টা লাগল। এই দু’ঘণ্টার সমস্ত সময়ই এক ঝাঁক লাল আর হলুদ প্রজাপতি ওদের মাথার উপরে ঘুরে ঘুরে উড়তে উড়তে, কাঁপতে কাঁপতে গেল, যেন রাজার মাথায় ছাতা ধরে।

প্রান্তরের শেষে পৌঁছে আবারও ওদের অবাক হবার পালা।

একটা বড় পাথরের উপরে বসে পড়ল দুজন। যারা উলঙ্গাবস্থা থেকে জঙ্গলের মধ্যেই বড় হয়েছে তাদেরও অবাক করার মতো অনেক কিছু এখনও গোপন আছে বনের বুকের কোরকে। কী আশ্চর্য! ভোঁর ঘাসের এক আদিগন্ত মাঠ। লাল-সাদা ফুলে, বুড়ি বিকেলে সেই মাঠকে কোনও স্বপ্নের মাঠ বলে মনে হচ্ছে। বাঁয়ে, মাঠের সীমানা দিয়ে বয়ে গেছে বার্জার নদী। সাদা বালি এবং পাথরের রেখায়। এত উপর থেকে দূরের নদীকে মনে হচ্ছে একটি দুধরঙা অজগর সাপ, এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে তার স্বপ্নের গুহার দিকে।

দেবী সিং প্রথমে ঘোর কাটিয়ে উঠে কথা বলল।

বলল, এই মাঠের মধ্যে কতগুলো গ্রাম ঘুমিয়ে আছে কে জানে?

ঠুঠা কথা না বলে, চেয়ে ছিল নীচে।

কোথায় গেল? শিমুল দুটো? কোথাও কোনও চিহ্ন নেই। নাঃ। এখানে ছিল না তাদের গ্রাম। গ্রামের কাছের নদীর চেহারাও ছিল অন্যরকম। নদীতে একটা মস্ত দহ ছিল উঁচু প্রপাতের নীচে। সাঁতার কাটত ওরা ছেলেবেলায়। হসোকে একদিন আদর করেছিল চ্যাটালো গরম পাথরে শুইয়ে এক শীতের দুপুরে সেইখানে।

কিংবা কে জানে? হয়তো এত দূর থেকে ওরই ঠিক ঠাহর হচ্ছে না।

দেবী সিং বলল, কী বুঝছো হে, ঠুঠা?

এত কাটাং আর ছোটা বাঁশ এল কোত্থেকে বলত? ঘাসী মাঠের ডানদিকে? পাহাড়ের পায়ের কাছে?

স্বগতোক্তির মতো বলল ঠুঠা।

আমার “বান্‌জারী” গ্রামের কাছে কোনওরকম বাঁশই ছিল না। বস্তির বড়দের যেতে হত তিন। ক্রোশ পথ কাটাং বাঁশ আর ছোট বাঁশ কেটে আনতে ঘর তৈরি বা মেরামতের সময়।

তবে?

এ নয়।

কী করবে?

যাব।

কোথায়?

ওই মাঠে নামব।

তারপর?

মাঠ পেরোব।

তারপর?

শ্রাবণের ঘন কালো মেঘের মতো শালের বন পেরোব।

তারপর?

আরও অনেক বন, নদী, সাতপুরা, মাইকাল; সব পাহাড়, সব মাঠ।

তারও পর যদি না পাও?

পাব।

মনে মনে নিরুচ্চারে বলল, পাবই!

আমি মানুষের বাচ্চা। প্রকৃতি, এই বন, এই পাহাড় নদী এদের কারও কাছেই আমি হার মানব না। দেবী সিং। তুমি শুধু আমাকে একটু সাহায্য কোরও। আমার হারানো গ্রামকে আমি খুঁজে বের করবই। যতদিন প্রকৃতির মধ্যে, প্রকৃতিরই এক জানোয়ার হয়ে বাস করেছিলাম ততদিন অন্য কথা ছিল। এখন বেরিয়েই যখন এসেছি, অন্য জাতের হয়ে গেছি, অন্য গ্রামে বাস করছে আমার জ্ঞাতি গগাষ্ঠীরা, গা থেকে বনের গন্ধ মুছেই যখন গেছে, তখন আমি তো বেজাত সাহেব কোম্পানীর কর্মচারী, এখন আর ছাড়াছাড়ি নেই। প্রকৃতিকে ভাল করে আমিও শেখাব। শালী! আমার গ্রাম না দেবে তো আমিও ওঁকে দেখে নেব। সাইআম, উইকে, কুসরে, ধারয়া, মারাই, বড়াদেব সব দেব-দেবীরই আমি মাথা ফাটিয়ে দেব পাথর মেরে, যদি-না এই কাহার বন আমাকে আমার গ্রাম ফিরিয়ে দেয়।

দেবী সিং ঠুঠা বাইগার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে একটা চুট্টা বের করে মুখে দিতে যাচ্ছিল। ওর দিকে ফিরে ঠুঠা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, পাব। ঠিক পাব। দেখে নিও তুমি, দেবী সিং।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ