আনন্দ। আনন্দম্। আনন্দ…

পৃথুর ঘুম ভেঙে গেল। শীতের সোহাগী রোদ, পেয়ারা গাছের ডাল পাতা পিছলে বিছানাতে এসে কম্বলের উপর হলুদ-রঙা বেড়ালছানার মতো নরম থাবা মেলে গুটিসুটি হয়ে বসেছে। এখনও নেশাটা ওকে পুরোপুরি ছাড়েনি। সিদ্ধির এবং বিজ্‌লীর নেশা।

একটি অচেনা মেয়ে এসে চা দিয়ে গেল। সাধারণত খাবার ঘরে ছাড়া কোথাওই খাওয়া-দাওয়া পছন্দ করে না রুষা। খুব কড়া শাসন। ওর কাছে নিয়মানুবর্তিতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সত্যিই শেখার আছে। কিন্তু সব নিয়মের পেছনেই কোনও-না-কোনও উদ্দেশ্য থাকেই। সেই কথাটাই রুষা কখনও বুঝে দেখার চেষ্টা করেনি। বোঝেনি যে, মানুষের মন ও মনের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সম্পর্ক মানুষের বানানো সব নিয়মের চেয়েই বড়। ওর সমস্ত জীবনীশক্তি বেচারি নিয়ম মানতে এবং মানাতেই নিঃশেষ করে ফেলছে। অথচ একটি জীবন নিয়ে একজন মানুষ, রুষার মত অশেষ গুণসম্পন্ন ও রূপবতী মানুষ কত কীই-ই না করতে পারত।

এই মেয়েটিই নিশ্চয়ই মেরী। আদিবাসী ক্রীস্টান। বাড়িতে পুরুষ চাকর আছে এবং পৃথুর মতো দুশ্চরিত্র মনিব আছে বলে বাড়িতে আয়া রাখার ঘোরতর বিপক্ষে ছিল রুষা। পৃথুর অক্ষমতা, অথবা নির্বিষতা সম্বন্ধে ও নিঃসন্দেহ হয়েছে কি এতদিনে?

মেরী ঘরে ঢুকেই বলল, গুড মর্নিং স্যার।

চমকে গেল পৃথু। আদব কায়দা জানে। সাহেবরা যে অনেকদিন আগে এদেশ ছেড়ে চলে গেছে একথাটা রুষারই মতো এই মেয়েটিও নিশ্চয়ই মানে না। মেয়েটির দিকে ভাল করে তাকাল ও। বেশ। তার মুখের মধ্যে এক ঢলঢলে সুখ আর জীবন সম্বন্ধে প্রচণ্ড আগ্রহ ঝম করছে। তবে রুষা, খুব সম্ভব ইন্টারভ নিয়েই শহরের সবচেয়ে কুৎসিত মেয়েটিকেই নিয়োগ করেছে। রুষার চোখে হয়ত ওর বাইরের আপাত সৌন্দর্যহীনতাটাই চোখে পড়েছে, মেরীর ভেতরের গভীর পবিত্র সৌন্দর্যটা নজরেই আসেনি।

চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসে চা খাচ্ছে পৃথু এমন সময় মেরী আবার ঘরে এসে বলল, গিরিশবাবু বলে একজন সাহেব এসেছেন।

গিরিশদার সঙ্গে পৃথিবীর কোনও সাহেবের বিন্দুমাত্র মিল নেই। তাই-ই কথাটা শুনে পৃথুর হাসি পেল। মেরীকে বলা দরকার যে, সাহেব আর বাবুকে একসঙ্গে মেশালে গুরুচণ্ডালি দোষ হয়।

পৃথু বলল, কি চাইছেন, মানে, বলছেন গিরিশবাবু?

আপনাকেই।

 

এত্তো সকালে!

অবশ্য এ পৃথুরই কৃতকর্মের ফল। যৌবনের মূখামি যখন তুঙ্গে কবিযশপ্রার্থী গিরিশদার একখানি কবিতার বই ছাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল পৃথু। খরচ অবশ্য তিনিই দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই তিনি এই হতভাগ্য পৃথুকেই বেছে নিয়েছেন তাঁর কাব্যপ্রতিভার কষ্টিপাথর হিসেবে।

এত সকালে গিরিশদার আসার একটাই মানে হতে পারে। কাল গভীর রাতে অথবা ঊষাকালে তিনি একটি কবিতার জন্ম দিয়েছেন। হাঁস-মুরগীর ডিম সদ্য-গর্ভ-নির্গত অবস্থায় যেমন নরম ও গরম থাকে, গিরিশদার কবিতাও এখন সেরকম। টেপাটেপি করা যেতে পারে। সুবিবেচনা অথবা আত্মসমালোচনার হাওয়া লেগে তা শক্ত হয়ে যাবার আগেই তিনি তা দায়িত্ববান এবং প্রতিভাবান পৃথুর হেফাজতে দিয়ে দিতে চান।

কিন্তু এই অসময়ে বসাবেই বা কোথায় তাঁকে। পৃথুদের এখানে পৃথুর কাছে-আসা লোকজনের বড়ই দুর্দশা। এমনিতে তো কেউই আসে না। গিরিশদার মতো দু একজন আত্মসম্মানহীন অবিবেচক মানুষ শান্তিপ্রিয় পৃথুকে সাংঘাতিক বিপদে ফেলার জন্যেই এমন না বলে কয়ে তবুও মাঝে-মধ্যে এসে পড়েন। কাব্যর কামড়, বড় কামড়। রুষা তো এক্ষুনি চান করে, শায়া আর ব্রা পরে, শাড়িটিকে বুকের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে বাথরুম থেকে বেরুবে। দিনের এই সময়টাই তার ক্ষিপ্ত মেজাজ ক্ষিপ্ততার চুড়োয় থাকে।

বসবার ঘরেও রুষা এবং ছেলেমেয়েদেরই একচেটে অধিকার। আজ তো আবার ছুটির দিন। রুষা এবং মিলি-টুসুরও ছোট বড় বন্ধু-বান্ধবীরা আসবে। গানবাজনা, সিনেমার আলোচনা হবে। কাম্পাকোলা, মিল্কশেক খাওয়া হবে। অ্যাটেনবোবরার ‘গান্ধী’, কুররাসোওয়ার ‘কাগেমুশা’, ফোর্থ। জেনারেশান রায়ের ফটিকচাঁদ’, এবং সত্যজিৎ রায়-এর ‘পিকু’ নিয়েও আলোচনা হবে।

পৃথুর মনে হয়, এখনকার ছেলেমেয়েরা পৃথুদের তুলনায় অনেকই বেশি বুদ্ধিমান। তাদের কোনও জেস্টেশান পিরিয়ডও নেই। অনেক অল্প সময়ে, অনেক বেশি কিছু করার ক্ষমতা এবং আইকিউ নিয়েই তারা জন্মায়। পৃথু ওদের সামনে এলেই, কেমন হীনমন্য বোধ করে। ওদের অ্যাডমায়ারও করে। পৃথু ভাবে, হয়ত পৃথুরাও ওদের বয়সে ঠিক এমনিই ভাবত এক ধাপ এগিয়ে। পৃথুর বাবাদের প্রজন্মর তুলনায় ওরা অনেক বেশি সপ্রতিভ ছিল।

মিলি-টুসুরা এখন উঠছে; আর পৃথুরা নামছে। ওরাও একসময়ে নামবে, যখন ওদের পরের প্রজন্ম উঠবে। এ এক নাগরদোলা!

গিরিশদাকে বসার ঘরে বসানোর মতো দুঃসাহস না দেখিয়ে বাড়ির লাগোয়া ফাঁকা জায়গাটুকুতে নিয়ে গিয়ে চেয়ার পেতে তাঁকে বসাতে বলল পৃথু; মেরীকে। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে নিয়েই গেল ও। গাছতলায় মিষ্টি রোদ। হাওয়াটা ছাড়বে বেলা বাড়লেই। মুচুর মুচুর, কুচুর কুচুর আওয়াজ করে শুকনো পাতাদের ডাবল-আপ করিয়ে নিয়ে তাদের পেছন পেছন ছুটে যাবে নিজেও।

মেরী চা নিয়ে এল। ভিতর থেকে গজগজ কানে আসছে। রুষা অসময়ে অবাঞ্ছিত অতিথি আসাতে ক্ষিপ্ত। রুষার সুসময় কখন হবে জানা নেই। খুব সম্ভব পৃথুর জীবৎকালে হবে না। মেরীর উপরও সে খঙ্গহস্ত হয়ে উঠল, অর্ডার ছাড়া, আগন্তুককে চা খাওয়ানোর বাড়াবাড়িতে। মেয়েটার চাকরিটাই গেল বলে। পৃথুদের এ বাড়িতে কাজের লোকজন চড়ুই পাখির মতো যাওয়া-আসা করে। আসে আর যায়, যায় আর আসে। একটা ট্রানজিট সেন্টার। আগ্নেয়গিরির উপর বেশিদিন কেই-ই বা বসে থাকতে চায়? চাইলেও পারে না। একমাত্র দুখীটাই রয়ে গেছে। অনেক বছর হল। ছেলেটার বোধ হয় মায়াও পড়ে গেছে। বাড়ির লোকের মতোই হয়ে গেছে। অগ্ন্যুৎপাত ভালবাসে। ওর মা-বাবা ভবিষ্যদ্রষ্টা বলেই ওর নাম রেখেছিল দুখী।

গিরিশদা রিটায়ার করেছেন ভাল পেনশান এবং গ্র্যাচুইটি নিয়ে। পৈতৃক অবস্থা অত্যন্তই স্বচ্ছল ছিল। ওঁর বাবা জবলপুরের এক বিখ্যাত বাঙালি ছিলেন। আগে নিজেও থাকতেন জবলপুরেই। ওঁর বাবার বাগানবাড়ি ছিল একটা, হাটচান্দ্রাতে। বাডিটার প্ল্যান খুবই সুন্দর। স্কটিশ কটেজ’-এর মতো। গিরিশদাকে প্রায়ই বলতে শোনে কথাটা। স্কটিশ কটেজ’টাকেই মেরামত করে, রঙ ফিরিয়ে আস্তানা গেড়েছেন বরাবরের মতো এখানে এসে এখন। নানারকম উদ্ভট উদ্ভট শখ আছে গিরিশদার। স্বচ্ছল ব্যাচেলরদের শখটাই বোধহয় বাতিকে দাঁড়িয়ে যায়। সেই বাতিকগ্রস্ততা উত্তরোত্তর বাড়ছেই। অনেক বাতিকের মধ্যে একটি কবিতা লেখা। পড়াশোনাও কিন্তু করেন নানা বিষয়ের উপর। ওঁর লাইব্রেরিটিও বেশ ভাল।

গিরিশদা চায়ে এক চুমুক দিয়েই পকেট থেকে ফুলস্ক্যাপ কাগজ বের করলেন।

একটা লিখেছি। কাল মাঝরাতে ব্রেইনওয়েভ এল। রাত জেগেই লিখে ফেলোম। এটাকে কি ‘সীমান্ত’র দপ্তরে পাঠাবে? এক্ষুনি কি পাঠানো দরকার?

শোনো, গিরিশদা। এখন প্রথমেই তোমার যা দরকার, তা হল। সীমান্ত’ শব্দটাই খুব সেনসিটিভ। এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত অত তড়িঘড়ি নিতে নেই।

পৃথু আন্তরিকতার সঙ্গে বলল। কাল রাতের বিজ্‌লী অথবা কুর্চি, এবং সিদ্ধি এবং রুষার সঙ্গে শরীরী প্রেম পৃথুকে বেশ হালকা মেজাজে ঠেলে দিয়েছে। এমন মেজাজে সে বহুদিন আবিষ্কার করেনি নিজেকে।

তার মানে? পাঠাব না, বলছ?

ক্ষেপে উঠেছ যখন, তখন পাঠিয়েই দাও। তবে, কপি রেখে পাঠিও। এটা কনম্বর হবে?

একশ সাঁইত্রিশ।

‘সীমান্ত’তেই?

হ্যাঁ।

রবার্ট ব্রুসও তোমার কাছে কিছুই নয়। তোমার হবে। ব্যাদেব-এর হয়েছিল যখন তখন তোমারও নিশ্চয়ই হবে। সম্পাদকদের নানারকম ব্যাপার থাকে। ক্লিশে। পেটোয়া—পোষণ। বোঝোই তো।

বুঝি আর না। হাড়ে হাড়ে বুঝি। কিন্তু তুমি একবারটি শুনবে না? পৃথু?

আমি কি সম্পাদক? তাঁদের পছন্দটাই শেষ কথা। বেনাবনে মুক্ত ছড়াতে যাবে কেন? ভাল। কথা। তোমার বাঁদরটা কেমন আছে বল।

ও! সুখময়ের কথা বলছ? ওকে এমন করে বাঁদর বাঁদর করে হেনস্থা কোরো না। চেহারাতে বাঁদর হলেই সব সময় বাঁদর হয় না। ওর চেয়ে বাঁদরতর অনেক মানুষ এই হাটচান্দ্রাতেই আছে। আমাদের দুজনেরই চেনাজানা।

পৃথু মনে মনে বলল, হাটচান্দ্রাতে শুধু বাঁদর নয়, শুয়োরও আছে।

তারপর বলল, সরি, গিরিশদা, বাঁদর বলা ঠিক হয়নি। সুখময়।

হ্যাঁ, সুখময়।

সুখময়কে এক শনিবারের লাড়ুয়ার হাটে আদিবাসীদের কাছ থেকে কিনেছিলেন গিরিশদা বাচ্চাবস্থায়। সে রীতিমত ষণ্ডাগুণ্ডা হয়ে উঠেছিল ইদানীং। গিরিশদার ভাষায়, ‘আ প্লেজেন্ট হীম্যান’।

গিরিশদা বললেন, কদিন আগে বন্ধনমুক্ত করে দিয়েছি ওকে, আমার সুখময়-এর কোনও সুখই যাতে ব্যাহত না হয়, সেই উদ্দেশ্যে।

সেকি? তোমার কাছে কি ও অসুখে ছিল? এত ভালবাসার সুখময় তোমার, এত খরচ করে এই। তো সেদিনই শীতের পোশাক বানালে। সিল্কের ওয়ার-দেওয়া লেপ, তোষক, সব…

তা ঠিক। তবে একটা ঘটনা ঘটেছিল।

কী?

মাসখানেক হল একটি সুন্দরী বাঁদরী আসছিল আমার বাগানে। সুখময়ের কাছেই এসে বসত। সুখময়ের মাথার উকুন বেছে দিত। নানারকম খেলা খেলত। দুজনে মিলে। অভব্য খেলাও কিছু ছিল। সেই বাঁদরীটিকেও আমি আদর করে খাওয়াতাম, সুখময়েরই সঙ্গে। একদিন, বুঝলে পৃথু; হঠাৎই লক্ষ করলাম…এবং লক্ষ করেই…

গিরিশদা চুপ করে গেলেন।

পৃথু বলল, কী হল?

না, লক্ষ করেই সুখময়ের তুলনায় দারুণই ছোট মনে হল নিজেকে। দারুণ ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স এল একটা।

লক্ষটা কী করলেন?

সুখময়ের প্রেমে পড়েছে মেয়েটি।

কী করে জানলেন? সারাজীবনে একজনও মানুষীর প্রেম চিনে উঠতে পারলেন না আপনি, নিঃশব্দ চরণে কম প্রেম এসে চলে গেল। আর আপনি চিনলেন বাঁদরীর প্রেম।

ছিঃ। প্রেম কি চাপা থাকে পৃথু? সে মানুষীর প্রেমই হোক কি বাঁদরীর প্রেমই হোক। যদিও অনেকদিন হল সুখময়ই ছিল আমার বন্ধু, সখা; তবু তার নিজের পরিপূর্ণতার জন্যে তাকে মুক্তি না দিয়ে পারলাম না। পরিপ্লুত হতে বাঁদরেরও তো ইচ্ছে করতে পারে। আফটার অল, আমাদেরই পুর্বপুরুষ। তবে, প্রেমটা অবশ্য খাঁটি না মেকি, তা পরখ করে নিয়েছিলাম বিয়ে দেওয়ার আগে। বাঁদরীও তো মানুষীর মতোই ফোরটুয়েন্টি হতে পারে।

তা তো পারেই। কিন্তু পরখ করে নিয়েছিলেন মানে? পরখটা করলেন কী করে?

শোননই না। পাঁউরুটি আর কলার মধ্যে ভাই একদিন একেবারে একডজন ব্রুকলাক্স গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিয়েছিলাম।

তুমি কখনও খেয়েছ?

হ্যাঁ। সে তো পারগেটিভ নয়, একেবারে মলটভ ককটেল।

হ্যাঁ। সে কী করুণ অবস্থা ভাই! বেচারি বাঁদর মেয়েটি, থুড়ি, মেয়ে বাঁদরটি, একবার এ-ডালে একবার ও-ডালে। তারপর বিকেলের দিকে দেখি, একেবারেই ঝিমিয়ে পড়ল। ভাবলাম, এবারে হাতকড়াই পড়ল বুঝি নারীহত্যার দায়ে। সত্যিই ভয় হল মরেই যাবে। মরা মরো হল, কিন্তু মরল না। মেয়েমানুষের জান, কইমাছের মতো। আর আমার সুখময়ের—তার গার্লফ্রেন্ডের ওই অবস্থা দেখে সে কী কান্না। গালে হাত দিয়েই বসে রইল সারাটা দিন। খেল না কিছুই। পরদিন আমি বাঁদরের গড় আয়ুর সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর একটা কমপ্যারেটিভ স্টাডি করে, হিসাব করে দেখলাম যে পঁচিশ বছরের যৌবনের একটি মানুষ আর আমার সুখময়ের বর্তমান বয়স একই। পঁচিশ বছরের গিরিশ বোসের কামনা বাসনা, প্রেমের তীব্রতার কথা ভেবে সুখময়ের কারণে অসহ্য কষ্ট এবং পাপবোধ হল আমার।

জানো পৃথু আমার নাগপুরের পিসি বলতেন, গিরো, বাবা কারও ভাল করতে পারলে করিস, খারাপ করিসনি কারওই। তাই-ই দুকাঁদি মর্তমান কলা মুনেশ্বরকে দিয়ে লাড়য়াহাট থেকে আনিয়ে ওদের গত মাসের আঠারো তারিখে বিয়ে দিয়ে দিলাম। পাঁজিও দেখেছিলাম। দিনক্ষণ ভালই ছিল। মুনেশ্বর উলু দিল। সেটাই একটা যাচ্ছেতাই ব্যাপার হল। সিদ্ধিখোর কুন্তীগীরের গলা দিয়ে কি আর বঙ্গললনার উলু বেরোয়?

পৃথু বলল, মন খারাপ লাগে না? সুখময়কে ছেড়ে?

আমার আবার মন তার আবার খারাপ-ভাল। কতকিছুই তো ছেড়ে আছি। সে সব কিছু নয়। প্রত্যেক দিনই তো জোড়ে একবার করে এসে দেখা দিয়ে যায়। ছেলেমেয়ে থাকলে ভায়া, তারা যা করত, আমার সুখময়ও তাই-ই করছে।

বাঁদর বলেই করছে গিরিশদা। মানুষের ছেলেমেয়ে হলে হয়তো মাসের মধ্যে একবারও আসত।

তা যা বলেছ ভায়া। মানুষের মতো খচ্চর জানোয়ার বিধাতা আর দুটি গড়েননি। আমার অভিজ্ঞতায় লোকেদের যদি চোখ খুলত, তাহলে সকলকেই বলতাম; পুষ্যি নিলে মানুষের ছানা নিয়ো না, বাঁদরের ছানা কুকুরের ছানা নাও।

গিরিশদা চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলেন ঘাসের ওপর। পৃথুর চোখে দুচোখ রেখে বললেন, শুনবে না কবিতাটা? খুবই সময়াভাব?

আমি তো এখন ছুটিতে? বেকার। সময়ের কোনওই অভাব নেই। কিন্তু…

ঠিক সেই সময়ই মেরী এসে বলল,

মেমসাহেব ডাকছেন আপনাকে। আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।

গিরিশদা বললেন, দাঁড়াও মেয়ে। দাঁড়াও। সব গোলমাল করে দিলে। অত হড়বড় করে কথা বলো কেন? ভোপালের বাস কি ছেড়ে যাচ্ছে?

তারপরই পৃথুর দিকে ফিরে বললেন, তোমার বাড়িতে কে এল? কার কথা বলছে মেমসাহেবটি কে পৃথু?

মুখ নামিয়ে নিল পৃথু।

পৃথুকে দেখিয়ে মেরী বলল, সাহেবের মেমসাহেব।

অঃ। গিরিশদাই লজ্জিত হলেন। আবারও বললেন, অঃ।

পৃথু প্রসঙ্গ বদলে, বলল, আমিই না-হয় কাল পরশু আপনার কাছে যাব। বিকেলের দিকে। কবিতাটিও শুনে আসব। কী নাম দিলেন নতুন কবিতার?

হাত।

হাত!

বাঃ। কোন হাত? ডান, না বাঁ?

উল্লেখ করিনি স্পেসিফিক্যালী। তবে, আসলে বাই-ই। এখন তো বাঁ-এরই যুগ। ডান হাতে এখন কবিতা লেখার মত অপকর্ম ছাড়া আর প্রায় কোনও কর্মই হয় না। যদি আসো তুমি, পৃথু, তবে ভায়া, বিকেল বিকেলই এসো। তারপর রাতে আমার সঙ্গে দুপাত্তর রাম চড়িয়ে, মুনেশ্বরের বাঁধা সুজির খিচুড়িও খেয়ে আসবে। সুখময়রাও প্রায় রোজই বিকেল বিকেলই আসে। চারটে নাগাদ। সুখময়ের স্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেব। ভারী ওয়েল বিহেভড় মেয়ে। ওর জন্যেও একটি লাল শাটিনের শাড়ি বানাতে দিয়েছি বসির দর্জিকে। এবং ব্লাউজও। আজই দেবে বলেছে বিকেলে।

সে কি! একি নাচানাচি করার গলায় দড়ি বাঁধা বাঁদরী নাকি? জেনুইন বন-ফ্রী বাঁদরী। দড়াম দড়াম্ করে আছাড় খাবে যে!

খাবে না রে বাবা, খাবে না। মানুষের ছেলেমেয়েরা, ছ ইঞ্চি উঁচু হীলওয়ালা জুতো পরে নাচানাচি করতে গিয়েও যখন আছাড় খায় না, তখন ও-ও শাড়ি পরে খাবে না।

কিন্তু ওসব ওকে পরাবে কে? আপনি? সে তো আর সুখময়ের মতো পোষ মানেনি। সে তো জঙ্গলের বাঁদরী। তাছাড়া, আপনাকে ও তো লজ্জাও…

আহা! সে সুখময়ই পরাবে! লজ্জাহরণ করতে পারল, আর এটুকু করতে পারবে না? ওসব মাইনর প্রবলেম। মেজর প্রবলেম হচ্ছে ওই কবিতাটা। তুমি যতক্ষণ না আসছ, আমি কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছি না। যাই, গিয়েই কপি করে ফেলি। একটা কপি “সীমান্ত”তে পাঠাব, আর অন্যটা ভাবছি, ভোপালের “অশনিতে পাঠিয়ে দেব। তুমি কী বলে?

পৃথু উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চেয়ার ঠেলে দিল পিছনে। নইলে গিরিশদা যেতে যেতেও আরও আধঘণ্টা কথা বলবেন। বিয়ে না করা পুরুষমানুষের এত উদ্বৃত্ত জীবনীশক্তি থাকে যে, তাদের ট্যা করা বড়ই মুশকিল হয়ে ওঠে।

আমি উঠি।

এসো তাহলে ভায়া। কাল তাহলে এ কথাই রইল। সুজির খিচুড়ি।

বেশ। যাব। পৃথু বলল।

গিরিশদা ম্যাজেন্টার বোগোনভোলিয়ার আর্চটি পেরিয়ে লাল পাতিয়ার ঝাড়ের পাশ দিয়ে গেট খুলে বাইরে ব্লেলেন। গেটটা বন্ধ করে দিলেন। একটা অশ্লীল শব্দ করে বন্ধ হল গেটটা ওঁর হাতের ঠেলাতে।

ভুচুর গ্যারাজ থেকে চেয়ে এনে পোড়া মবিল দিতে হবে দরজার কজাতে। রোজই ভুলে যায়। রুষা অনেকবার বলেছিল।

কপালে আছে…

 

চান করতে করতেই পৃথুর হঠাৎই শুয়োরটার কথা মনে পড়ল। মাথায় গরম জল পড়তেই বোধ। হয়, সিদ্ধিতে উধাও বুদ্ধিটা ফিরে এল। নেশা কেটে যেতে লাগল দ্রুত। কুয়াশার মতো এবং ও হঠাৎই বুঝতে পারল যে শুয়োরটা শুয়োর নয়। বিনোদ ইদুরকার। ন্যাশনাল হাইওয়ে রিপেয়ার করার ব্যবসাতে বহু পয়সা কামিয়েছে। ঠিকাদারী করে ও। আরও নানারকম ব্যবসা আছে। দুটি নতুন ইন্ডাস্ত্রী খুলবে ভাবছে। ব্যাঙ্ক থেকে নানা অছিলায় মোটা মোটা লোন নিয়ে সাবড়ে দিয়েছে। ব্যাঙ্কমারা মোচ্ছবে অনেক লোকের মতো ভিনোদও সামিল হয়েছে।

সমিতির সমস্ত অনুষ্ঠানেই অনেক টাকার অ্যাডভাটাইজমেন্ট জোগাড় করে দেয় সে। প্রায়ই বম্বে থেকে রুষাকে নানারকম ‘ফোরেন গুডস্ এনে দেয়। জাগতিক সবকিছুর প্রতিই রুষার যে এক গভীর অদম্য লোভ আছে, তার অনেকটাই পূরণ করে ইদুরকার।

বিনোদ ইদুরকার যে শুধু রুষার সুন্দর বাঁধনের শরীরটার প্রতিই অনুরক্ত তাই-ই নয়। রুষার মাধ্যমে ও ডি. সি. পি. ডাব্লু. ডি. ও. সি. পি. ডাব্লু, ডির ইঞ্জিনিয়র ইত্যাদির সঙ্গেও পরিচিত হয়ে ওর ব্যবসার নানারকম মুনাফা ওঠায়।

এতক্ষণে দুয়ে দুয়ে চার মিলল। অঙ্ক মিলে গেল। জীবনে এই প্রথমবার, কোনও অঙ্ক মিলে যাওয়াতে দুঃখিত হল পৃথু।

একথা ও জানে যে, জীবনে প্রত্যেক মানুষকেই কোনও না কোনও পরীক্ষাতে হারতেই হয়, অন্য প্রতিযোগীর কাছে। সব পরীক্ষা শুধু যোগ্যতা দিয়েই পাশ করা যায় না। আজকাল হয়ত খুব কম পরীক্ষাই যায়। যোগ্যতা চেষ্টা, এসবের বাইরেও একটা ফ্যাক্টর থাকে। হয়ত বা একাধিকও। সব পরীক্ষাতেই জিতব বলে যে মানুষ পণ করে আসে এখানে সেই বোকা-জেদির কপালে অনেকই দুঃখ। জানে পৃথু। তবু হারতে কারই বা না দুঃখ হয়! পৃথুর মতো সামান্য চাহিদার মানুষেরও বড় লাগে। যে হেরে যায়, তার পক্ষে হারটা স্বীকার না করেও উপায় থাকে না। তবু…

রুষার ন্যায় অন্যায় বোধ তারই। কিন্তু তবু রুষার কি ন্যায় হল এটা? পৃথুর নিজের কথা না-হয় ছেড়েই দিল। কিন্তু মিলি আর টুসু! ও তো একটা ল্যাজে-গোবরে, নালাখ্যাবা কবিতা লেখা অপদার্থ পুরুষমানুষ। ওকে নিয়ে রুষা যে সুখী হতে পারেনি, এ কথাটা না বোঝার মতো বোকা সে নয়। বিয়ে করেছিল পৃথু, ভোপালের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সাহেবিভাবাপন্ন শিক্ষিত, মিষ্টি, সুন্দরী একটি মেয়েকে। সেই রুষা আর নেই। অনেকই বদলে গেছে সে এখন। বদলানোই তো স্বাভাবিক। মানুষ নিজেকে ক্রমাগত না বদলালে সভ্যতা তো থেমে থাকত। কোনওদিনও বদলকে ভয় পায়নি পৃথু।

রুষার বাবা সেন্ট্রাল প্রভিন্স সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। প্রকৃত শিক্ষিত চমৎকার মানুষ। বাবা এবং মাকেও হারিয়েছিল রুষা অল্পবয়সে। রুষার এক মাসির কাছে সে মানুষ। মাসতুতো ছোটভাই দেবাশিস ও শুভাশিসকে বলতে গেলে, পৃথুই মানুষ করে। ওর সীমিত সাধ্যের মধ্যেও। দেবাশিস এখন এঞ্জিনিয়ার। মিলিটারী এঞ্জিনীয়ারিং সার্ভিস-এ আছে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। জবলপুরে পোস্টেড। শুভাশিস কস্ট অ্যাকাউন্ট্যাসী এবারেই পাশ করে দিল্লিতে চাকরি করছে এখন। রুষার নিজের জন্যে না হলেও, তার মাসির পরিবারের জন্যে, পৃথু আজ অবধি যা করেছে সে কারণেও কিছুটা কৃতজ্ঞতা আশা করেছিল রুষার কাছ থেকে। কৃতজ্ঞতাবোধ ব্যাপারটাও বোধহয় আজকের পৃথিবীতে অলিট হয়ে গেছে। টাইমবাররড়। রুষার প্রকৃতির মধ্যে যতটুকু খারাপত্ব, তা তার মা-বাবার কাছ থেকে বোধহয় পাওয়া নয়, তার মাসির কাছ থেকে পাওয়া। ভোপালের বাঙালিরা তাকে “অ্যাংলো” বলে ডাকতেন। পৃথুর জ্যাঠামশাইও ছিলেন একটু অদ্ভুত ধরনের মানুষ। বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর, বাঘের হাতে, পৃথু বিদেশ থেকে ফেরার পর উনিই এই সম্বন্ধ করে বিয়েটা দেন। মা তখন বেঁচেছিলেন, কিন্তু মার মতামতের দাম ছিল না কোনও। পৃথুর পছন্দ ছিল নিমুকাকার মেয়ে কুর্চিকে। তারা গরীব এবং পরিচয়হীন বলে সে বিয়ের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন জ্যাঠামশায়।

বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়াল পৃথু। চোখ দুটো জ্বালা জ্বালা করতে লাগল। বাথরুমের আয়না আর জন্মদাত্রী মা ছাড়া আপন বলতে সংসারে মানুষের বোধহয় আর কেউই থাকে না থাকার মতো। এই রকম কোনও কথা একটা বাংলা উপন্যাসে যেন পৃথু পড়েছিল। নাম মনে করতে পারছে না উপন্যাসটার।

পৃথু ভাবছিল, প্রত্যেক স্ত্রী ও পুরুষ জন্মের পর থেকে মৃত্যু অবধি, বোধ হয় গাছেরই মতো বাড়ে, মনে মনে। কেউ সটান ঋজু শিমুল হয়ে আকাশ ছুঁতে চায়। তার ঋজুতা দিয়ে সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। কেউ বিনয় এবং নম্রতাতে লজ্জাবতী লতা হয়েই থাকে। কেউ আশশ্যাওড়া হয়। কেউ নিম; নিজে তেতো থেকেই পরের ভাল করে। কেউ কাঁটা গাছ। কেউ ধুত্ররা। কেউ বা আফিম হয়ে নেশা জোগায় অন্যদের। কেউ “হেল’-এর ঝাড়। বিষ বয়ে বেড়ায় বুকে করে। বিষাক্ত করে সারা পৃথিবীকে। বিশল্যকরণীও বোধহয় কেউ কেউ। কে জানে? কেউ আবার বা ম্যাংগ্রোভ জঙ্গলের গাছ-গাছালির মতো শিকড় ছড়াতে থাকে বিস্তারে যে-জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে, তারই গভীরে। প্রত্যেক মানুষের এই বিচিত্র বিভিন্নমুখী অগ্রগতি, বা উচ্চতার বিভিন্নতা; তার নিজের মানসিকতা, শিক্ষা, পরিবেশ, সঙ্গী-সাথী রুচি এই সমস্তকিছুর উপরই নির্ভর করে। যে-কোনও কারণেই হোক, পৃথু আর রুষার এই উন্নতির রকমটাতে পার্থক্য গড়ে উঠেছিল। কিছুটা অবধানে, এবং কিছুটা অনবধানে। তাই-ই বোধহয় এরকম হল। হয়ে গেল। ইসস্ সত্যিই কি? রুষা-কি সত্যিই…

পৃথু দাড়ি কামাবে বলে মুখে সাবান লাগাচ্ছিল। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল, বাথরুমের টুলটার উপরে বসে পড়ে। পায়ে যেন হঠাৎই জোর কমে গেল। জন্মাবধি অনেকই দিন বয়েছে তার শরীরকে এই দুটি পা। ওরা ক্লান্ত। মাথাটা ঝিঝিম্ করে উঠল। টুলটাতে বসেই পড়ল পৃথু। কল দিয়ে জল পড়ে যাচ্ছে বাথটাবে। ভর্তি হতে একটু দেরি। জল পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে এবং জল দেখতে দেখতে পৃথু ভাবছিল। জলের সঙ্গে জীবনের কেমন যেন মিল আছে। দৃশ্যত শূন্য : চোখের আড়ালে মাটির নীচে গিয়ে জমে।

চোখ কান খুলে রাখলেই কত কী শেখে মানুষ। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি প্রত্যেকটি মানুষই শেখে। প্রতি মুহূর্ত। এই শিক্ষা মানে, কোনও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নয়; ভেতরের শিক্ষা। বাইরে থেকে আমরা কিছু নিই, আর বেশিটাই বোধ হয় নিই তৈরি করে, নিজেদেরই ভেতর থেকে। তাই প্রতিটি দম্পতি এক ঘরে, এক খাটে শুলেও, দুজনে মিলে অনেক ভালোবাসায় সন্তান আনলেও, বিবাহোত্তর জীবনে মানসিকতায় তারা যে একই ভাবে, একই দিকে, একই গড়নে বেড়ে উঠবে, এটা ভাবাই বোধ হয় বোকামি। এই বাড়ের নিশ্চয় স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তা আছে। তফাৎ থাকে, পৃথু ভাবে; এই কারণেই যে, ওরা মানুষ। মানুষ হয়ে জন্মেছে বলেই, মন আছে বলেই, মানুষকে এত সইতে হয়। তার যা সয়, তা অন্য কোনও প্রাণীরই সয় না। অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী সমান্তরালভাবে এগোতে থাকলেও জ্যামিতিক নিয়মেই দুটি সমান্তরাল রেখা কখনওই একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হয় না। দূর দিগন্তে বা বহু বছরের সংসারের ঘোর পেরিয়ে আসার পর হয়ত একমসয় মনে হতে থাকে যে রেখা দুটি মিলেছে; কিন্তু তখনও সেটা প্রকৃত মিলন নয়; অপটিক্যাল, ইশান। আসলে প্রত্যেক পুরুষ প্রত্যেক নারীই একা। একা আসা এখানে, একা ফিরে যাওয়া।

দাড়িতে ক্ষুর লাগায় পৃথু। সেটি রেজরও পুরোপুরি সে নয়। অ্যাবসলুট সেটি বলে কোনও কথা নেই। গালের অনেকগুলো জায়গা কেটে যায়। জীবনেরও যেমন কাটে। রক্তক্ষরণ হয়ই মাঝে মধ্যে। পৃথু বুঝতে পারে যে, ও বোধহয় এমন প্রকৃতিস্থ নেই। কিন্তু খুব আশ্চর্যও হয় এই-ই ভেবে যে, এখনও ওর রাগ হচ্ছে না। ও যদি পুরুষ হত সত্যিকারের, তাহলে কি এতক্ষণে ইদুরকারকে খুন করাই উচিত ছিল না?

গায়ে ভাল করে সাবান ঘষতে লাগল ও। ভাবল এই গ্লানি অথবা লজ্জা বা অপমান সবই সাবানের সুগন্ধি ফেনায় ধুয়ে ফেলবে; রুষা যেমন করে সহজে ওর ভ্রষ্টতা ঘোয়। শরীরে তো লেগে থাকে না কিছুই। সবই ধুয়ে দেয় সাবান বা শাওয়ার; যায় না শুধু মনেরই দাগ। জম্মদাগের মতোই তা মন কামড়ে থাকে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। “আমার হৃদয় তোমার হোক, তোমার হৃদয় আমার হোক, আমাদের মিলিত জীবন ঈশ্বরের হোক” বললেইতো আর তা হয়ে যায় না। এই মন্ত্রোচ্চারণ একটা আদর্শকেই অনুধাবন করার অঙ্গীকার মাত্র। এই অঙ্গীকার প্রায়শই পূর্ণ হয় না। পূর্ণতার কাছাকাছি আসতে পারলেও অনেকখানি হত।

কিন্তু মিলি টুসু? ওরাও তো একা। ছোটবেলায় একা হওয়াই ভাল। একাকিত্বতে অভ্যেস হয়ে যায়। পরনির্ভরতায় অভ্যেস হয়ে গেলে, দীর্ঘদিন পরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে বড় কষ্ট হয়। ওর যেমন হচ্ছে। আসলে, পৃথু ভাবছিল, কাউকেই সম্পূর্ণতায় পেতে চাওয়ার ভাবনাটাই হয়তো ভুল। একান্ত করে আজকের মানুষ কেউই কাউকে নিতে বা দিতে পারে না, নিজেদের টুকরো করে টুকরো-টাকরাই ভেঙ্গে ভেঙ্গে বা-চকোলেটের মতো তুলে দেয় বোধ হয়, আমরা অপরের হাতে, পৃথু রুষার হাতে, টুসু বা মিলির হাতে, অফিসের বস্-এর হাতে, বন্ধুদেরও। সবাই-ই তাই-ই দেয়। টুকরো-টাকরাই। কথাটা, সম্পূর্ণ করে পাওয়ার নয়। তা ও বোঝে। কিন্তু রুষা তুমি দাম্পত্যর মতো একটা মাডেন মোটাদাগের, জাগতিক, ব্যবসায়িক লেনদেন-এর মধ্যে অসাধুতা এনে ফেললে। যতটুকু নিলে, তার মূল্যটুকু সমান করলে না বিনিময়ে। এটা কিন্তু মানাল না তোমাকে।

পৃথুর ভাবনার জগৎ হঠাৎই ছিঁড়ে খুড়ে গেল। দরজায় ধাক্কা পড়ল দড়াম্ দড়াম। এমন যে, মনে হল ভেঙ্গে যাবে।

রুষা চেঁচিয়ে উঠল।

তারপর গলা নামিয়ে বলল, টুসুর বন্ধু মিঃ মজুমদারের বাচ্চারা, জয় আর পিংকি এসেছে। ডে-স্পেন্ড করার জন্যে। বিকেলে এখান থেকেই একসঙ্গে আমাদের “শো”-এ যাবে। বাথরুম নোংরা করবে না। মেঝেতে জল ফেলবে না। বেসিনে যেন দাড়িকাটা সাবানের এক ফোঁটাও না পড়ে থাকে। শুনতে পাচ্ছ? কী হল? বেরোবে কি না বলো।

পৃথু বিড়বিড় করে বলল : শুয়োর।

কী?

শুয়োর!

নিজেও পাগল হবে; তুমি, আমাকেও পাগল করবে।

শুয়োর! পৃথু আবার বলল।

ছোটবেলাতেও পৃথুরা বড়লোক ছিল, কিন্তু সাহেব ছিল না। যদিও ওর বাবা কাকাদের মধ্যে দুজন ইংল্যান্ডেই পড়াশুনো করেছিলেন হায়ার স্টাডিজ। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ও পড়াশুনা শিখেছিল। তখনও সব ভারতীয়ই সাহেব হবার চেষ্টাতে উঠে পড়ে লাগেনি। যৌথ-পরিবারেই মানুষ হয়েছিল। প্রতি ছিল, ওড়িশা টাইপের। এয়ারকণ্ডিশনার ছিল না। গীর্জার ছিল না। বাথটাব ছিল না। এমনকি বেসিনও ছিল না তাদের বাড়িতে। তখন এসব কিছুকে আবশ্যিক বলে মনে করত না অনেকেই। মেঝেতে জোড়াসনে বসে মহানন্দে খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো এবং পিসতুতো ভাইদেরও সঙ্গেও বসে পঙক্তিভোজন করত পৃথু। কুয়ো বা চৌবাচ্চা থেকে ঝপাং ঝপাং করে জল তুলে, চান করত ওরা। হাপুস্হুপুস্ শব্দ করে ডাল ভাত মেখে খেত। তাতে লজ্জাবোধের কোনও কারণই দেখেনি। মানুষের প্রকৃত শিক্ষা আর টেবল ম্যানার্স, পৃথুর চোখে কখনওই সমার্থক ছিল না। পৃথু নিজেও ইংলন্ডে ছিল দু বছর, কিন্তু তার চোখে তা “বিদেশই ছিল। হামলে পড়ে ওদের সবকিছু নকল করার মধ্যে একরকমের হীনমন্যতা আছে বলেই মনে করত ও। আজও তাইই করে।

কিন্তু শুধু রুষা একাই নয়, রুষার ভয়ে এবং শাসনে ছেলেমেয়েরাও প্রোটোটাইপ হয়ে উঠেছে। ওরা পৃথুকে জংলি, অমানুষ ভাবে। পান খাওয়াকে ওরা “প্রি-হিস্টরিক” “ঘাস্টলী হ্যাবিট” বলে। বলে, কোনও ভদ্রলোক পান খায় না। পান খেয়ে পানের পিক ফেললে বলে উ্য ডোন্ট হ্যাভ এনী সিভিক সেন্স, বাবা।

বাথরুম যদিও এ যুগের পুরুষ ও নারীর একমাত্র স্যাংচুয়ারী; তবু একসময় বাথরুমের দরজাও খুলতে হয়। কিন্তু খোলার আগে, পৃথু হাঁটু গেড়ে বসে, ভাল করে ঝাঁটা দিয়ে বাথরুমটাকে পরিষ্কার করল। বেসিন পরিষ্কার করল ঝকঝক করে।

টুসুর চোখ তার মায়ের চোখের চেয়েও তীক্ষ্ণ। কোনওই সন্দেহ নেই, পৃথুর যে, তার মায়ের শিক্ষায়, হাটচান্দ্রার প্রি অ-ওয়েলস্ টুসু ঘোষ, বড় হলে আর কিছু হোক আর নাইই হোক, একজন ফারস্ট-রেট স্যানিটারী ইন্সপেক্টর হবেই।

বাথরুম থেকে বেরিয়েই খোলা হাওয়াতে, ওর বাড়ির স্বাভাবিকতাতে, ছেলেমেয়ের, রুষার গলার স্বরে, খাওয়ার ঘরের ছোটো-হাজরির টেবল লাগানোর পরিচিত শব্দে ওর মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কী সব যা তা ভাবছিল এতক্ষণ! মিলি-টুসুরুষাকে নিয়ে তার কান্না-হাসির বিরাগ-অনুরাগের জড়ানো-মড়ানো সংসার। আঃ চমৎকার।

রুষা? কোন দুঃখে?

ইদুরকার? ছিঃ ছিঃ! নাঃ

আর উ্য ক্রেইজী মিষ্টার পৃথু ঘোষ? ফ্রেন্ডস আর ফ্রেন্ডস। হি ইজ আ গুড ফ্রেন্ড। দ্যাটস্ ও। মাথাটাই গেছে পৃথুর। যত্ব সব নেই ভাবনা।

ও প্রতিজ্ঞা করল, জীবনে আর কখনও সিদ্ধি খাবে না। কাল রাতমোহনা থেকে ফেরার পর কী কী ঘটনা সত্যিই ঘটেছে, আর কী কী ঘটেছে কল্পনায় পৃথু তার কিছুই ঠিক করে উঠতে পারছে না। যে কোনও ভদ্রলোকেরই, জদা-পানেরই মতো; সিদ্ধি খাওয়া একদম উচিত নয়। সিদ্ধির সিদ্ধিতে তার আদৌ প্রয়োজন নেই। ছেঃ।

জামাকাপড় পরে এসে পিছনের কপিক্ষেতে ও গেল একবার। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট-এর মতো। সত্যিই তো! শুয়োরে তছনছ করেছে কপিতে। সত্যিই কচকচ তচনচ। পিছনের বেড়াটাকেই ভেঙে ঢুকেছে। কী বিপদেই পড়া গেল। সাবির মিঞার কাছে যেতে হবে কাল। নইলে, শামীমকেই বলতে হবে। এসে, মেরে দিয়ে যাবে শুয়োর। ওরা দুজনেই শুয়োর শিকার করে বটে, কিন্তু শুয়োরের মাংস খেলে হারাম হয় বলে খায় না। অনেক ওয়েপন-এর মধ্যে এখন পয়েন্ট থ্র-টু পিস্তলটাকে রেখেছে। কোল্ট-এর। আর আছে পৃথুর মৃত বাবার উপহার দেওয়া একটি ফোর ফিফটি ফোর হান্ড্রেড ডাবল ব্যারেল রাইফেল। কাস্টম বিলট। নানা কারুকার্য করা। জেফরী, নাম্বার টু। তবে দুটিই রাখা আছে অনন্ত বিশ্বাসের বন্দুকের দোকানে। জবলপুরে।

গৃহস্থবাড়িতে শুয়োরের এমন অবাধ যাতায়াত কোনওক্রমেই বরদাস্ত করা যায় না। হেস্তনেস্ত করবে পৃথু। প্রয়োজন হলে, অনেক বছর পরে নিজেই রাইফেল ধরবে। মেরী এসে বলল, স্যার, ডিমের কী খাবেন?

স্ক্রাম্বল।

বলল পৃথু। মুখ বিকৃত করে।

কটা টোস্ট? স্যার?

দুটো।

স্যার এই। মনে মনে বলল।

প্রত্যেকদিনই সকালে নতুন করে রাগ হয় পৃথুর। এমন প্রাতঃকালীন রেজিমেন্টেশন্ বোধহয় কোনও কমুনিস্ট দেশেও নেই! রোজ একই প্রশ্ন, যদিও প্রশ্নকর্তা বিভিন্ন।

১। কটা ডিম?

২। ডিমের কী?

৩। কটা টোস্ট?

এখন আবার একটা করে মাটি-ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে হচ্ছে। রুষার অর্ডার। নতুন অত্যাচার। মালটিভিটামিনস খেলেই, পৃথুর অম্বল হয়। পেট ঢাক হয়ে যায়। অতএব মাটি-ভিটামিন-এর পরেই অম্বলের জন্যে দুটি গোলাপি রঙা জেলুসেল-এম-পিএস। তারপর পথে বেরিয়ে দুটি জর্দা-পান মুখে পড়লেই ওর মনে হয়, প্রাণটা এবার খাঁচা-ছাড়া হবে। আবার জেলুসেল গোলাপি রঙা এম-পি-এস। রোজই এই একই নিয়ম; একই চক্র। দুটো ডিম, স্ক্র্যাম্বল, নয় ফ্রাই, নয় পোচ, নয় ওয়াটার-পোচ্অথবা ওমলেট। যদিও ওমলেট তো চিকেন-ওমলেট, নয় চিজ ওমলেট, নয়, অ্যাসপারাগাস ওমলেট, অথবা ওমলেট উইথ হ্যাম এন্ড বেকন।

দুটো টোস্ট, হয় মাখন। নয়-মাখন নয়। ক্লোরোস্ট্রোল। হ্যামও নয়, বেকনও নয়। ক্লোরোস্ট্রোল হয় জ্যাম, নয় জেলী। জ্যাম জেলী নয়; ব্লাডসুগার। নয় মার্গারীন, নয় মার্মালেড, বাটার নয় চিজ। তারপরই মালটিভিটামিন্স। তারপর? জেলুসেল। সার্টেনলি ইয়েস। তারপর? জদা পান; ঘাস্টলী; আসিভিলাইজড়। ক্যুডন্‌ট্‌ কেয়ারলেস! তারও পর প্রাণ যাব যাব; খাবি খাব-খাব ভাব। আবার জেলুসেল। প্রতিদিনই সকালে।

দিন শুরু এইভাবেই। মিল্ক-কেক, ড্রিঙ্কিং চকোলেট, রুটি, ডিম, চা, কফি, পান। বিশ্বাস, সন্দেহ, ঈর্ষা, বৈরাগ্যর সী-স। এইই.এই করেই পৃথুর বেঁচে থাকা। যার আরেক নাম অভ্যেস। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় বললে, “অব্যেস”।

ইয়ে।

ছেলেমেয়েরা স্কুলে। পৃথু, তার চিরাচরিত ইরেসপনসিবল ওয়েতে চরাবরা করতে বেরিয়েছে। যদি খাবার সময়ে ফেরে, তাহলে ভালই। নইলে, খাবে না। দেড়টা অবধি দেখতে বলা আছে। সবাইকে।

দুখীটা কাজে আসে সেই কাক-ভভারে। মেরী তো এখানেই থাকে। দুপুরেও যদি কাজের লোকজনকে একটু রেস্ট না দেওয়া যায় তাহলে তারা কাজ করবেই বা কেন? একটু খেতে পাওয়া, একটু ভাল ব্যবহার, একটু ভালবাসা এই জন্যেই তো নিজেদের মা-বাবা ছেড়ে, বউ ছেলেমেয়ে ছেড়ে মাসের পর মাস পড়ে থাকে।

এই অবস্থা, এই সিসটেম চলবে না বেশিদিন। মালাঞ্জখণ্ড-এ বিরাট কারখানা হয়েছে। মেগাওতেও নানারকম ব্যবসা। এন্সিলারি, ইন্ডাস্ট্রিজ গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রদেশ নিশ্চয়ই চিরদিনই কিছু বন-পাহাড় আর পৃথুর মতো ব্যর্থ কবিদের রোম্যান্টিসিজম-এর সাবজেক্ট হয়ে থাকবে না। নানারকম ইন্ডাস্ত্রী বসেছে চারদিকে, গভর্নমেন্ট সিরিয়াসলী চেষ্টা করছেন। ওয়েস্ট বেঙ্গল বিহার এবং আসাম থেকে নাকি অনেক ইন্ডাস্ট্রিজ এখানে চলে আসছে। কলকারখানা গড়ে উঠলেই তখন বাড়িতে কাজ করার জন্যে একজনকেও আর পাওয়া যাবে না। স্বাভাবিক! কে কাজ করবে, এত অল্প মাইনেতে সারা মাস? না-ছুটি, না-বোনাস, না প্রভিডেন্ট-ফান্ড, না অন্য-কোনও পার্ক! রুষাদের জেনারেশনই শেষ জেনারেশন; যারা লোকজন রাখার বিলাসিতা করে গেল।

লোকজন কি লাগে ওর নিজের জন্যে? অদ্ভুত স্বভাব ওর স্বামী পৃথুর। ঘরের মধ্যে লেখার টেবলে বসে ছাই-ভস্ম কিছু হয়তো লিখছে, হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল। কী ব্যাপার? না, টেবলরই এক কোণায় কালির শিশিটা আছে, নিজের হাতের নাগালের সামান্য বাইরে, সেটাকে কারও তার হাতের কাছে এগিয়ে দিতে হবে। অথবা পাখাটাকে, যদি গরমের দিন হয়; তবে এক পয়েন্ট বাড়াতে বা কমাতে হবে। যদি এয়ার কন্ডিশনার চলে, তবে হয়ত একসস্ট-এর নক্টা ঘোরাতে হবে। চেয়ারে বসলে, সেখান থেকে এক পা, এক চুলও নড়বে না। অদ্ভুত স্বভাব!

এমন জমিদারী মেজাজের মানুষের সঙ্গে ঘর করা চলে না, আর যাইই করা চলুক। রুষা শুনেছে। যে, পৃথুর বাবা-জ্যাঠামশাইরা আগেকার দিনের পা-তোলা ইজিচেয়ারে বসে গড়গড়া খেতেন। আলবোলার নল আসত অন্য ঘর থেকে। ভোপাল বা ইন্দোর থেকে আনা অম্বুরী তামাক-এর গন্ধে নাকি পুরো মহল্লা ভুরভুর করত। তামাক খেতে খেতে যদি অসাবধানে বা ঘুমের ঘরে হাত থেকে আলবোলাটি পড়েও যেত কারও, তখনও চাকরদের পুরা নাম ধরে ডেকে নিজেদের মৌজ নষ্ট করতে আদৌ রাজী ছিলেন না তারা একজনও। তারা তখন আস্তে বলতেন রে…

“রে” মানে, ওরে! বা কে আছিস রে? এসে আলবোলার নলটা তুলে দিয়ে যা। “ওরে বা “কেরে” বলার মতো কষ্টটুকু করতেও তারা নারাজ ছিলেন। শুধু “রে” বলেই খালাস। তাদেরই বংশধর পৃথু। অতএব…

যখন বিয়ে হয়েছিল, অনেক কিছুই স্বপ্ন দেখেছিল। বিলেত-ফেরৎ এঞ্জিনীয়র। মধ্যপ্রদেশের এতবড় নামী, শৌখীন পরিবারের ছেলে। গানবাজনা, পায়রা-ওড়ানো, সাহিত্য, শিকার বটেরের লড়াই ইত্যাদি নানারকম পরস্পর বিরোধী ব্যাপারের জন্যে এই পরিবারের সুনাম-দুনাম দুইই ছিল পুরো মধ্যপ্রদেশের বাঙালি সমাজে। এক নামে চিনত সকলে।

কিন্তু হতাশ হয়েছে রুষা। একেবারেই। কেন যেন মনে হয় ওর এখন, পৃথুর বড় জ্যাঠামশাই-এর সঙ্গে রুষার মাসির কোনও একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিল। ওর বিয়েটা একটা স্যাক্রিফাইসাল ঘটনা!

বিয়ের পর পর সকলেরই একটা ঘোরের মধ্যে কাটে। কি স্ত্রী কি পুরুষ। শরীরের ঘোরটাও কম বড় ঘোর নয়। যদিও বেশিদিনের জন্যে হয়তো থাকে না সেই ঘোর। তবে, রুষার মধ্যে কাম ব্যাপারটা চিরদিনই কম। ও ছোটবেলা থেকে এমনভাবে মানুষ হয়েছিল যে, শরীরী ব্যাপারের মধ্যে এক ধরনের নিষিদ্ধতা ছিল বলে মনে করত রুষা। এখন অবশ্য তাতে যায় আসে না কিছুই। তার স্বামী পৃথুর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তার নেই বললেই চলে। শরীর তো কখনও শরীরের সঙ্গে মিলিত হয় না, মন মনের সঙ্গে সঙ্গমেচ্ছু হলেই শরীর ক্রিয়াপদের ভূমিকা নেয় শুধু। কী করতে যে পৃথু এমন হঠাৎ ছুটি নিল তা সেইই জানে। ভেবেছিল এবারে পাঁচমারী যাবে গরমে। ছুটিই নষ্ট করে দিল।

সকাল থেকে সন্ধে কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়ায়। যেমন জামা কাপড়ের ছিরি! তেমনই সঙ্গীসাথীর। কেউ জুতোর দোকানদার, কেউ ঘড়ি সারাই করে, কেউ মোটর-মেকানিক। না আছে। তাদের কোনও শিক্ষা-দীক্ষা; না সহবৎ। আকালচার ব্রুটস্ সব। আর এক ইডিয়টিক বুড়ো আছে, গিরিশ বোস।

জোটেও বটে।

“আ ম্যান ইজ নোন, বাই দ্যা কম্পানী হী কীপস্।”

হাটচান্দ্রা ছোট্ট জায়গা। পৃথুর জন্যে মুখ দেখাতে পারে না রুষা কোথাওই। এই লাক্ষা কোম্পানীকে ঘিরেই আজ থেকে অনেক বছর আগে গড়ে উঠেছিল এই জনপদ। সেই কোম্পানীর অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজারকে কুলি কামিনরা “পাগলা ঘোষা” বলে ডাকে। “পৃথু” নামটা ওদের পক্ষে খুবই কমপ্লিকেটেড। উচ্চারণ করলেও, কোলীগ্রা প্রায়ই বলেন পিরথু। পারথু; এই সব। লেবারাররা শর্টকার্ট করে “পাগলা ঘোষা” করে দিয়েছে।

ওরা পৃথুর আসল স্বভাব জানলে ওর নাম হয়ত দিত “পাগলা গোস্সা”। লোকটাকে বাইরে তার কাজের জগতের সকলে বলে, আহা! মাটির মানুষ! দেবতুল্য লোক! কোনও এয়ার নেই, অহং নেই; কারও সঙ্গে ঝগড়া বা খারাপ ব্যবহার নেই। অমন মানুষই নাকি হয় না। কিন্তু সেই জগতটাই একমাত্র জগৎ নয়। এমন একটা খিটখিটে, ইরিটেবল, ইকসিডারেট ইনসিসট্যান্ট লোকের সঙ্গে রুষা বলেই ঘর করে গেল। এই যুগে এই অলে, এরকম লোক একেবারেই অচল। এই দাম্পত্যজীবনে রুষার আর বিন্দুমাত্রও ইন্টারেস্ট নেই। ও নিজেই জানে না কবে কী করে ফেলবে!

চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে, রুষা বেডরুমে এল একবার। অসময়ে, নিজেকে দেখল রট-আয়রনের ফ্রেমে ঘেরা বেলজিয়ান কাঁচের আয়নাতে। রুষা জানে যে, সে অত্যন্ত সুন্দরী। যে-কোনও পুরুষকেই বশ করতে চাইলে, তার পাঁচ মিনিট লাগে। যত বড় জিতেন্দ্রিয়ই সে হোক না কেন! এমনকী, সেদিন কোনও কাগজের সানডে এডিশানে যখন সে পড়ছিল যে, হিন্দী ফিল্ম ওয়ার্লড-এর রেখা বলেছেন যে-কোনও পুরুষকেই তিনি যে কোনও সময়ে আধগেলাস জল দিয়ে গিলে খেয়ে নিতে পারেন। তখন রুষা তার নিজের সম্বন্ধেও সেরকম একটা প্রাইড ফীল করেছিল।

বশ করতে পারল না শুধু এই আশ্চর্য মানুষটাকে, তার স্বামী পৃথুকে। ও আসলে হয়তো মানুষ নয়ও। ছোটবেলা থেকে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে, তার জংলি, শিকারী বাবার সঙ্গে একদল আনকালচারড় ব্লুটদের সঙ্গে মিশে মিশে একেবারে অসভ্য, আনসিভিলাইজড় হয়ে গেছে। কোনও উবয়-এর মতো। কিপলিং-এর মোওগলির মতো।

এমন নেশা নেই যে, সে করে না। মাঝে মাঝে শাওন নদীর পারের শ্মশানে গিয়েও বসে থাকে। মড়া-পোড়ানো ডোমদের সঙ্গে থুথু-ভেজা লাল শালুতে মোড়া গাঁজার কলকে থেকেই নাকি গাঁজা খায়। মদ খায়। সিদ্ধি খায়। এই তো সেদিন কোথা থেকে মাঝ রাতে সিদ্ধি খেয়ে এসে শুয়োর! শুয়োর! করে কী কাণ্ডই না করল।

শুয়োর অবশ্য এসেছিল। কপিক্ষেতে।

কিন্তু পৃথু যাকে শুয়োর ভাবছিল, সে শুয়োর নয়। সে বিনোদ ইদুরকার। খুব বেঁচে গেছে সেদিন ওরা দুজনেই। আহা! ভারী সুইট ছেলেটি। ছেলেটি মানে, বয়সে হয়ত রুষার সমবয়সীই হবে, কিংবা একটু ছোটও হতে পারে। কিন্তু ভারী ম্যাচিওড়। পৃথুর উপর কোনও ব্যাপারেই ডিপেন্ড করা যায় না, বিনুর উপরে সব ব্যাপারেই যায়। ও সেদিন রাতে সত্যি সত্যিই এসেছিল। পৃথু ভেবেছিল শুয়োর। হাউ ফানী! ভাগ্যিস মেরী ঘুমিয়ে পড়েছিল। পৃথু ফিরছে না দেখে খুবই চিন্তিত হয়ে রুষা সেদিন বসবার ঘরেই বসেছিল। আলো নিবিয়ে। ভয় করছিল, আলো জ্বালিয়ে বসে থাকতে। পাছে, বাইরে থেকে লোকে জানে যে বাড়িতে ও একা। এত রাতে। মালীটাও বাড়ি গেছিল তিনদিন হল ছুটি নিয়ে। কুক, লছমার সিং সেই যে দেশে গেছে স্ত্রীর অসুখ বলে, তারও আসার নামটি পর্যন্ত নেই।

রাত বাড়তে বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিল রুষা। হঠাৎ গেট খোলার শব্দ হল। তারপর টলটলায়মান পায়ে কারও হেঁটে আসার শব্দ। পৃথু এসেছে ভেবে রুষা মনে মনে বলেছিল, “ন্যাউ, আই উইল গিভ উ্য আ উঈ বিট অফ মাই মাইন্ড।” দরজাটা খুলতেই পৃথু নয় ইদুরকার এসে রুষাকে জড়িয়ে ধরল। ড্রাঙ্ক ছিল ও।

বলল, রুষা, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। চিরদিনের মতো না হও, তো অন্তত একবারটির জন্যে আমার হও। আজ। এখুনি। বলেই চুমু খেয়েছিল রুষার ঠোঁটে।

রুষা দরজা ভেজিয়ে ওকে সরিয়ে এনে সোফাতে বসিয়েছিল। ওকে ফিসফিস্ করে বোঝাচ্ছিল, ওকি পাগল হয়ে গেল? ইদুর, কি করছটা কী? ইয়াং, হ্যান্ডসাম, অ্যাফ্লুয়েন্ট ব্যাচেল। ইমপোর্টেড গাড়ি, চমৎকার বাংলোবাড়ি, পাঁচমারিতে কটেজ, ধনী মা বাবার একমাত্র সন্তান, সে রুষার মতো দু ছেলেমেয়ের মায়ের জন্যে তার জীবন তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে তা রুষা চায়নি।

একবারটির জন্যে চায়। যা চায়, তা দেরে এখন, সময় সুযোগ বুঝে, যথেষ্ট সাবধানতা অবল করে। রুষও যে ওকে চায় না এমন নয়। রুষা তেমন সংস্কারাবদ্ধ জীব নয় যে, ও বিশ্বাস করবে যে একদিন স্বামী ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সহবাস করলেই তার চরিত্র বা তার বিবাহ নষ্ট হয়ে যাবে। শুচিবাই থাকলে, বিয়ে আজকালকার দিনে একজনেরও করা উচিত নয়। দুঃখ পেতে হবে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে।

চরিত্র কথাটা অনেকই বড় কথা! কটা লোকই বা তার মানে বোঝে। আর বিয়েও, বিশেষ করে ছেলেমেয়ে আসার পর, অনেকই বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাকে ভাঙা এত সোজা নয়, ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে ভাঙা উচিতও নয় হয়ত। তবে, এক-জীবনে, একটিই জীবনে; কোনও আধুনিকা নারীর কেবলমাত্র তার স্বামীর সঙ্গেই একমাত্র শারীরিক ও মানসিক হারমনি থাকবে, অন্য কারও সঙ্গেই নয়, এমন অদ্ভুত কথায়, রুষা বিশ্বাস করে না।

ইদুর ছেলেটা সত্যিই ভাল। সব দিক দিয়েই ভাল। গোয়ালিয়র পাবলিক স্কুলে পড়াশুনো শেষ করে কলেজ করেছিল ভোপালে। তারপর স্টেট এ গিয়ে ম্যানেজমেন্ট-এ ডিপ্লোমা নিয়ে এসেছে। ও এখানে একটি সোয়াবিন অয়েল একস্ট্রাকশান্ প্ল্যান্ট বসাচ্ছে। অন্য ফ্যাক্টরী করছে লাক্ষা থেকে, লাক্ষার গয়না তৈরি করার, ফেরো-অ্যালয়ের বা লো ক্যারেটের সোনার বা লোহার বা তামার বা রূপোর বেস-এ। স্টেটস জার্মানী কানাডা এবং জাপানে একসপোর্ট-এর পসিবিলিটি নাকি দারুণ।

ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ইদুর। ও পাগলেরই মতো ভালবাসে রুষাকে। আগে ভাবী বলে ডাকত। এখনও তাইই বলে।

সে রাতে, ইদুরকে শুধু একটুই দিয়েছিল। ওর স্তনসন্ধিতে মুখ রেখেছিল ইদুর, ঠোঁটে চুমু খাওয়ার পরে। সবকিছুই একটু একটু করে দেওয়া ভাল। তাতেই মোহ থাকে, মজা থাকে, বাঁচার  ফান অটুট, আনস্পয়েন্ট থাকে। উত্তেজিত, ভীত রুষা ওকে বলেছিল, আর নয়; অ্যাই! আজ আর নয়।

পরে, পরে কখনও…।

রুষার শরীর বলে যে কোনও একটা ব্যাপার, এমন সুন্দর একটা ব্যাপার এখনও আছে, এমন জীবন্তভাবে আছে; তা মধ্য তিরিশের রুষা একেবারে ভুলেই গেছিল। পৃথুর সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক তো নেই-ই বলতে গেলে। পৃথুর হাতের আর শরীরের ছোঁওয়া তার কাছে নতুন কোনও কিছুই আর বয়ে আনে না। কী করে যে আদর করতে হয়, মেয়েরা কী যে চায়, কতটুকু চায় একজন পুরুষের কাছে, কেমনভাবে পেতে চায়, তার কোনও খোঁজই রাখে না পৃথু। একটা জংলি। উল্ফ-চাইল্ড। বড়লোকের স্পয়েল্ট-ওয়ার্ড। হাফ-উইট লুনাটি। কী করে বিলেতে ছিল, কী করে পাশ করল এঞ্জিনীয়ারিং কে জানে!

যখন রুষার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে ইদুর ওর বুকে মুখ রেখেছে, যখন বহু বহু বছর পর, সারা শরীর থরথর করে শরত-ভোরের শিউলির মতো নরম নরম ফুল ঝরাচ্ছে, ভালোগায় তিরতির করে কাঁপছে জরি-মোড়া জরায়ু, ঠিক অমনি সময় আবার গেট খোলার আওয়াজ হল।

ইদুর শোনেনি। ও পাগলেরই মতো ঘোরে ছিল। গভীর ঘোর। অভিজ্ঞ এবং সাবধানী রুই শুনেছিল শুধু।

শুনেই, এক ধাক্কায় ইদুরকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, পালাও শিগগিরী। পৃথু আসছে। পিথু দাদা বলেই, ইদুরও উঠে দাঁড়িয়েছিল।

রুষা কিন্তু আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি। কী হয়; কী হল, কী ঘটছে তা দেখবার জন্যে যে মূখরা দাঁড়িয়ে থাকে, জীবনের যে-কোনও ক্ষেত্রেই তারাই তলপেটে ছুরি খায়, তাদেরই গুলি লাগে বুকে। বোকা পুরুষের প্রাণের চেয়ে, বুদ্ধিমতী নারীদের সতীত্বর সার্টিফিকেটের দাম অনেকই বেশি। চিরদিনই। নারী মাত্রই নির্দয় খুনী; যখন তাদের সতীত্বর গায়ে ধুলো লাগার প্রশ্ন ওঠে। রুষা দৌড়ে এসে যে ঘরে ও আর টুসু শোয়, সে ঘরে শুয়ে পড়েছিল। তারপর দরজায় ধাক্কা—একটা ধস্তাধ্বস্তির মতো আওয়াজ। কুকুরের চিৎকার। টলায়মান পায়ে বাগান দিয়ে ঘোড়ার মতো কারও ছুটে যাওয়ার শব্দ।

ভগবানের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ লাগছে রুষার। যদি…।

নাঃ। ও ভাবতেই পারে না। হাতে-নাতে ধরা পড়লে পৃথু হয়ত দুজনকেই গুলি করে মেরে ফেলত!

তা অবশ্য পারত না। কারণ, পিস্তল ও রাইফেল সব অনন্ত বিশ্বাসের দোকানে জমা আছে, জবলপুরে। ভাগ্যিস। কিন্তু পৃথু রাগে না সচরাচর। রাগ বলে কোনও রিপু ওর আদৌ আছে বলে মনেই হয় না বেশি সময়। কারণ রুষার প্রতিক্ষণের খোঁচাতেও ও নির্জীবের মতোই পড়ে থাকে। যেন ঢোঁড়া সাপ। ভুসস ভুসস করে সিগারেট খায়। কিন্তু যদি ওর রাগ কোনওদিন হয়, সেদিন কী হবে জানে না রুষা। রাগের আভাস পেয়েছে। রাগ কখনও দেখেনি। আভাসই যথেষ্ট। তাইই মনে মনে ও ডাকে ‘পাগলা গোসসা।

খুব ভাল লাগছিল ওর। পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে, দিনে ও রাতে অনেকই গোপন দেওয়া-নেওয়ার খেলা চলে, ঘটে যায় অনেক ছিচকে চুরি, দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি। তার অতি সামান্যই, আইসবার্গ-এরই মতো চোখে পড়ে। লক্ষভাগের এক ভাগেরই মতো কথায় বলে, “চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা; যদি না পড় ধরা”।

কিন্তু রুষার চরিত্রে কিন্তু চৌর্যবৃত্তি আদৌ নেই। ওর মতো সোজা, সৎ, স্ট্রেইট ক্যারাকটারের মানুষ মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা যায় বলে ওর নিজের মনে হয় না। মাঝে মধ্যে এই স্ট্রেইটনেসটা একটু স্টিম-ইঞ্জিনের মতো বিহেভ করে। রুষা সেটাও জানে। ওর মধ্যে ন্যাকামি নেই, ঈর্ষা নেই, মীননেস নেই, যাও অধিকাংশ মেয়ের মধ্যেই দেখে। হয়তো ওর জীবনে সেক্স নেই বলেই মাঝে মাঝেই ও পাগল পাগল বোধ করে ইদানীং। ওর বয়স আর কী? দিনে রাতে অসংখ্য পুরুষের ধূর্ত, লুব্ধ চোখকে ও ওর চোখ দিয়ে চাবকায়। তবু, কারও প্রতিই ও বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বোধ করে না। এত্ব পুরুষ দেখে। চোখ তো কতই দেখে, দেখল; এই জীবনে, কিন্তু চোখে যা পড়ে তার সবই কি মনে ধরে? মনে যে বড়ই কম আঁটে। লক্ষে হয়ত একজনকেই মনে ধরে, কি ধরে না। কিন্তু তবু, ওর যে হাত-পা বাঁধা।

একটা কাক এসে বসল পেঁপে গাছে। বেশ সুন্দর দেখাল ওর চোখে আজ কাকটাকে।

দেখার জিনিস একই থাকে হয়তো,চোখই বদলে যায়। কখনও একই জিনিসকে সুন্দর দেখে, অথবা কুৎসিত।

আশ্চর্য। ভাবে রুষা। ওর চৌত্রিশ বছর বয়সে ও কি এইই প্রথম একটা কাকের দিকে। মনোযোগ দিয়ে তাকাল? কী সুন্দর গ্রীবা কাকটার! ময়ূরের চেয়েও সুন্দর মনে হল। ব্ল্যাক-এন্ড-হোয়াইট ফটোগ্রাফিতে যে গভীরতা আলোছায়ার, কালো-সাদার গ্র্যাঞ্জার তা কি কালার-ফটোগ্রাফিতে কখনওই থাকে? কাক তো সাদা কালোর, তাইই ভাল, রিয়্যাল। কাককে বোঝা যায়; ভালবাসা যায়। ময়ুর থাকে তার রঙের ঔজ্জ্বল্য আর চোখ ধাঁধানো চমক নিয়ে শুধু কাব্যে-সাহিত্যে, পৃথুর মতো ব্যর্থ কবির আটারলি ইউসলেস কবিতাতেই।

এই কাকটাই কি সেদিন চামচ নিয়ে গেছিল? ঠোঁটে করে? যাক! কত কিছুই তো কতলোক ঠোঁটে করে নিয়ে উড়ে যায়। সেদিন গভীর রাতের অষ্টমীর জোছনায় ইদুর যেমন রুষার ঠোঁটের সিক্ততা, তার স্তনসন্ধির দুর্লভ সুগন্ধ ঠোঁটে করে একটি ইদুরেরই মতো পালিয়ে গেছিল। যাক। যাক। কতটুকুই বা কে নিতে পারে? সবার উপরই কি রাগ করা যায়? না, করতে আছে। যখের ধন-এর মতো আজীবন সব ধন আগলে রাখারও বা মানে কী হয়? শরীরের ধন তো চিরদিন থাকার নয়, তা তো পেরিশেবল।

দরজা খোলাই ছিল। উর্দিপরা ড্রাইভার বলল : মেমসাব।

কী ব্যাপার আজাইব সিং?

চমকে উঠে, বলল রুষা।

বাজার করে এনেছি মেমসাব।

বেশ করেছ! তুমি মেরীকে সব বুঝিয়ে দাও। ইটালিয়ান অলিভ অয়েল পেয়েছ?

না। পদ্মা স্টোর্স তো বলল, আসেনি। এলেই ফোন করবে।

নাঃ। কী যে করে এরা।

রুষা বলল বিড় বিড় করে।

গাড়িটা রুষারই কাছে থাকে। যদিও কম্পানীর গাড়ি। এ সব ব্যাপারে পৃথুকে কিছু বলারই নেই। মানুষটাকে সব সময় গালাগালি করে বটে, তার আগোছালামির জন্যে তার ভুলো মনের জন্যে, তার অদ্ভুত, ইমাজিনারি, হ্যালুসিয়েশনের জগতে বাস করার জন্যে। কিন্তু পৃথুর চরিত্রে কোথাও এখনও কিছু লেগে আছে ধুলো-ময়লার বা ডায়মন্ড-ডাস্ট এরই মতো, অ্যাজ ওয়ান সীজ ইট, যার জন্যে ওকে এক ধরনের শ্রদ্ধা না করেও পারে না। টাকা পয়সা, ক্ষমতা, দেমাক, বড় চাকরি করার অহমিকা, মাসে পাঁচ হাজার টাকা রোজগারের গর্ব, কোনও কিছুই মানুষটাকে ছুঁতে পারে না। জাগতিক কোনও কিছুর প্রতিই মানুষটার বিন্দুমাত্র আসক্তি নেই। যতক্ষণ বাড়ি থাকে, সবসময় সে তার বইপত্র, লেখালেখি নিয়ে থাকে। সব সময় বিছানায় বালিশ বুকে লেখালেখি করে, দলাই-মলাই করে বিছানা বালিশ। যাচ্ছেতাই। ডাস্টিং করার জন্যে সময় মত ঘর ছাড়ে না, সময় মত চান করে না, দাড়ি কামায় না, দিনের পর দিন ঘর ছেড়ে বেরোয় না। খাটের উপর বসে বালিশের উপর ব্রিফকেস তুলে মেকশিফ্ট টেবল করে ঘাড় ঝুঁকিয়ে লেখে।

কী যে অত লেখে, কী যে ভাবে ভুসস ভুসস করে সিগারেট খেতে খেতে, তা ওইই জানে। যদি বুঝত রুষা যে, ওর নাম হয়েছে কবি হিসেবে, লেখক হিসেবে, তবেও বুঝত। ভবিষ্যতের জন্যে পৃথু ওর বর্তমানটাকে পায়ের নীচে অবহেলায় মাড়িয়ে যায় প্রতিমুহূর্ত।

ও বলে, ওর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। বলে কিছুই হল না এ জীবনে! আর কী হবে? ওর যা ৪৮

হয়েছে, তার কিছুমাত্রও হলে, অন্য অনেক পুরুষ গর্বে বেঁকে থাকত। ও কি ভাবে যে, ও মরে গেলে ওর নামে হাটচান্দ্রায় কি ভোপালে ওর স্ট্যাচু হবে? ও কি ভাবে ও কোনও লিটারারী এওয়ার্ড পাবে মৃত্যুর পর? ওকে কি কালিদাস এওয়ার্ড দেওয়া হবে? পশথুমাস? ইফ হী থিংকস সো, হী মাস্ট বী হা স্টুপিড চ্যাপ।

মৃত্যুর পর কী হবে তা নিয়ে রুষা কখনও মাথা ঘামায়নি। একটাই জীবন। জীবনকে ও খুব ভালবাসে। প্রতিটি মুহূর্ত ও এ জীবনে দারুণ ভাবে বাঁচতে চায়। পৃথু কখনওই জীবনের প্রতি রুষার এই তীব্র ভালবাসাটা বুঝতে পারল না। অ্যাজ আ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, কখনও পৃথু স্বামীর মতো বিহেভ করল না, করল না ছেলেমেয়ের বাবার মতো। একদিনের জন্যেও না। এমন লোকের বয়ে করার, ছেলেমেয়ে হবার কোনওই প্রয়োজন ছিল না। কোন ঘোরে থাকে ও সবসময় তা পৃথুই জানে। পান চিবোয়, সিগারেট ফোঁকে, জামা কাপড় সব পানের পিক ফেলে নষ্ট করে। কালকে রুষা দেখেছে, ওর লেখার টেবলের উপরে একটি নস্যির কৌটো। নস্যি! সত্যি! আনথিঙ্কেবল। কোনও ভদ্রলোক নস্যি নেয়? খইনিও খায় পৃথু মাঝে মধ্যে। চুন দিয়ে খইনি মারে দু হাতের তেলোতে। ছিঃ ছিঃ।

এই সব কারণেই টুসু ও মিলিও তাদের বাবাকে আজকাল দেখতে পারে না। অন্য ভদ্রলোক, কনসিডারেট বাবারা ছেলেমেয়েদের কম্পানি দেয়, তাদের নিয়ে বেড়াতে যায়, তাদের জীবনের অনেকখানিই জুড়ে থাকে তাদের বাবা। পৃথুর সময় নেই কারও জন্যেই। ছেলেমেয়েরাও তাই। স্বাভাবিক কারণেই তাকে ভাবে নন-এনটিটি। তাদের কাছে মা-ইই সব। সবকিছু। পৃথু, এতে দুঃখ পর্যন্ত পায় না। আশ্চর্য! কারখানায় যায়, ঘড়ির কাঁটা ধরে। লাঞ্চ-এও বাড়ি আসে না। অন্য সকলেই আসেন। কারখানা বন্ধ হওয়ার পরও অনেকক্ষণ কাজ করে। নিজের জীবিকার কাজের বেলাতে কিন্তু মানুষটা খুবই দায়িত্ববান। সবাই সেই কথাই বলে। কাজের সময়ে কাজ-পাগলা মানুষ। কোম্পানিটা ফেরা অ্যাক্ট-এ যখন ইন্ডিয়ানাইজড় হয়ে যায়, তখন ফরেন কোম্পানির বোর্ড পৃথুকে কোম্পানির টুয়েন্টি পার্সেন্ট শেয়ার গিট করে দেন। অন্য টুয়েন্টি পার্সেন্ট রেসিডেন্ট ডিরেক্টরকে। কোম্পানির সবাইই বলেন,“পাগলা ঘোষা” পাগলামি করে এই কোম্পানি ছেড়ে না চলে গেলে তার ম্যানেজিং ডিরেক্টর হওয়াটা কেউই ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু পাগলা যে কী করবে, তা পাগলাই শুধু জানে। এ কথাও বলেন সকলে।

রুষার প্রায়ই ভয় করে। পৃথুর মেজ-ঠাকুর্দা পাগল ছিলেন। ওর মধ্যে পাগলামির বীজ আছেই। পৃথুকে রুষা সর্বক্ষণই টাইট করে রাখে, গালাগালি করে; যাতে ওর পাগলামিটা বাড়তে না পায়। রুষাই জানে, কতখানি ভালবাসে সে পৃথুকে। শ্রদ্ধা করে। এখনও। আফটার অল, মানুষ তো দোষগুণেই হয়! কিন্তু পৃথুটা এমনই বোকা, এমনই আউট-অফ-দ্যা ওয়ার্ড রোমান্টিক যে, ওর ধারণা, ভালবাসা মানে সবসময় হাতে হাত রেখে বসে কবিতা পড়া। ভাবা যায় না। আটারলি ইরিজিব ওর ভালবাসা, পৃথু যে এ-জীবনে বুঝতে পারল না; একথাটা রুষাকে বড়ই ব্যথা দেয়। যে-ছেলেমানুষকে কিছু দিয়েই ভোলানো যায় না, যার কান্না, যার ন্যাগিং কিছুতেই বন্ধ করা যায় না, না ক্যাডবেরী, না কাম্পা-কোলা, না রুষার শরীর দিয়ে; তাকে নিয়ে সবসময়ই বড়ই বিব্রত, ব্যতিব্যস্ত, চিন্তিত থাকে রুষা।

ছেলেমেয়েদের মানুষ করা বলতে যা বোঝায়, সবই ও একা হাতেই করেছে। তাছাড়া, এত বড় সংসারের এতরকম দায়িত্ব, মাসের বাজার, দৈনিক খাবারের মেনু, বাগানের পরিচর্যা, মালী থাকা সত্ত্বেও, বাড়ি-ঘর সবসময় ঝকঝকে তকতকে রাখা এবং সবচেয়ে বড় কথা, এই শেকল-ছাড়া পাগলকে চোখে চোখে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। যদিও লোকজন অনেকই আছে। নিজের হাতে খুব কিছু একটা করতে হয় না, এবং ছোটবেলা থেকে করা অভ্যেসও নেই ওর। নিজের জন্যে খুব দুঃখ হয় রুষার। জীবনটা কত সুন্দর, কত মজার, কত সুখের, কত অন্যরকম হতে পারত।

পৃথু সম্বন্ধে আরও একটা ভাল কথা বলবে রুষা। সকলকেই বলে, মেয়েদের সম্বন্ধে ওর কোনও আদেপনা নেই। অথচ কোনও দুর্বোধ্য কারণে ওর ন্যালাখ্যাবা স্বামীকে ওর জানা-শোনা অনেক মেয়েই বিশেষ পছন্দ করে। তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতা, সফিটিকেটেড, পার্সোনালিটি সম্পন্ন অনেক মেয়েই আছে। পৃথু তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই মেশে। যদিও পৃথু যখন ইচ্ছে করে, মানে হোয়েনেভার হি চুজেস, তখন সুন্দর কথা বলতে পারে, ইংরিজি বাংলা দুই ভাষাতেই, গানও গায় মোটামুটি। তবে রভিন্দর সঙ্গীত। রুষা দেখতে পারে না এই গান। তবে অনেক স্টুপিড মেয়েরা আছে, দোজ হু ফল ফর হিম। এই অবসলিটু অফ-হোয়াইট, ওলমোস্ট কালারলেস বাংলা গান শুনেও। রিয়ালী সিলী! রুষার নারী-চোখ বোঝে তাদের মধ্যে কেউ কেউ পৃথু সম্বন্ধে একেবারে ‘পজেসড়’। পৃথুর মধ্যে একটা এরাটিক কিন্তু ম্যাজিকাল পার্সোনালিটি আছে। যেটাকে ড়ুয়াল বলে মনে হয় রুষার। কিন্তু দুটিই রিয়্যাল।

পৃথুর দুর্বলতা কেবল একটিই। তার ‘আকীলীজেজ হীল। সে হচ্ছে কুর্চি। এবং এই কারণেই খুব অপমানিত, হীনমন্য বোধ করে ও। পৃথু যদি রূপেগুণে রুষার কাছাকাছিও আসতে পারে এমন কোনও মেয়েকেও ভালবাসত তবে ওর এত অপমানিত লাগত না। কুর্চি। অফ ওল পার্সনস্। কী আছে ওর? যা রুষার নেই? রুষার বাঁদী হবার যোগ্যতাও কুর্চির নেই। আর এই কুর্চিকে নিয়েই ওর সবচেয়ে বড় ভাবনা।

আজ সকালবেলাতে অনেকই সময় নষ্ট হল। তবু, শুধু এই সময়টুকুতেই একটু ভাবার সময় পায় ও। ভাবতে তো শুধু মানুষই পারে। ভাগ্যিস পারে। নিরিবিলি বসে ফাঁকা বাড়িতে এক কাপ চা খায়। দু’-একটি ফোন করে। দু-একটি ফোন আসেও।

দেওয়ালের ইলেকট্রনিক ঘড়িটা দেখল রুষা। পৌনে এগারোটা। সময় হয়েছে। ইদুর রোজ এগারোটার সময় ওকে একটা ফোন করে। নিয়মিত। পৃথু বাড়ি থাকলেও করে। কারণ ও বাড়ি থাকলেও কখনওই নিজের ঘর ছেড়ে বাইরেই বেরোয় না। কারও ফোন এলেও ধরে না। মিথ্যে কথা বলতে বলে। বলে; বলে দাও, বাড়ি নেই। ফোনটা লিভিং রুমে। পৃথু তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে সবসময়।

রুষার জীবনে সত্যিই কোনও আনন্দ নেই। সংসারের কাজ করে ও মেশিনের মতো। মহিলা সমিতির কাজও করে, কারণ গার্ল গাইডে ও শিখেছিল, সমাজে মানুষ কেবল নিজেরটুকু করার জন্যেই আসে না। সমাজ একটা সমষ্টি। নিজেরটুকু করেও যদি অন্যর জন্যে, লেস্ ফরচুনেটসদের জন্যে নীডীদের জন্যে কিছুই না করে মানুষ, তবে তার মানবজন্ম বৃথা। এই পৃথিবীকে অন্যদের জন্যে সুন্দরতর করে রেখে যাওয়া প্রত্যেক মানুষের মরাল ডিউটি হওয়া উচিত।

ফোনটা আসবে এবার। ইদুরের ফোন এলে, ওর সঙ্গে ফোনেও একটু কথা বলে রুষার অগাজমিক আনন্দ হয়। একেই কি ভালবাসা বলে?

ওর জীবনে ইদুরই একমাত্র আনন্দ। রামু ইদুরকার। ওর সুইটি-পাঈ! ওর একার ইদুর। সুন্দর গিনিপিগ রুষার।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ