পুবে সবে আলো ফুটেছে। পূবের পাহাড়টার জন্যে আলো পৌঁছতে একটু দেরি হয় উপত্যকাতে। আলো এসে পৌঁছতেই ভোঁর ঘাসের মাঠের উপর রাতভর জমা শিশিরে লক্ষ লক্ষ হীরে ঝিকমিক করে। লাল সাদা ফুল এসেছে ঘাসগুলোতে। ঘাসের মাঠের আঁচল ঘিরে ধরা বা চোরকাঁটার বর্ডার। তারপরই গহীন জঙ্গল।

চারদিকে সাজা, শাল, ধাওয়া, বহে, কাসসী কুহমী, বেল, চাঁর, জামুন, পলাশ ইত্যাদি নানা গাছগাছালি। শালই বেশি। সোজা, সবুজের পতাকার মতো উঠে গেছে নীল অকলঙ্ক আকাশে। সাজা গাছের আর এক নাম সাজ। গোঁদ-বায়গারা পুজো করে ওই গাছ। শালকে, যেমন করে ওঁরাও-সাঁওতালরা। ধাওয়া হচ্ছে গদ-এর গাছ। আঠা হয় এ গাছ থেকে। বহেড়া গাছগুলো বিরাট বিরাট। শখ করে খায় হরিণ ওদের ফল। কাসসী গাছের কদর গরুর গাড়ির চাকা বানাতে। বড় শক্ত কাঠ এ। কুহমি অনেকটা বেলের মতো। চাঁর গাছও মস্ত মস্ত হয়। চমৎকার ছায়া দেয় এ গাছ। চিরাঞ্জীদানাও বলে, অনেকে এর ফলকে। ফুল ফোটে সাদা সাদা মিষ্টি গন্ধর, ফাল্গুন চৈত্রে। চার-এর ফল ধরে বৈশাখের শেষে বা জ্যৈষ্ঠেতে। মিষ্টি ফল। জামুনও, বড় ও ছোট অনেক আছে হাটচান্দ্রার আশে পাশের জঙ্গলে। গরমের শেষে আষাঢ় শ্রাবণে পাকে। পলাশ। পলাশ গাছে গাছে গরমের শুরুতে ফুল যেমন লালে লাল করে দেয় দিগন্ত, তেমন সে গাছের গুটি পোকা থেকেই লাক্ষা সংগ্রহ করে আদিবাসী ছেলেমেয়েরা। কারখানায় নিয়ে যায়। মেটিরিয়াল ম্যানেজার শর্মা পা ছড়িয়ে বসে সওদা করতে করতে অনেক কিছু দেখে। কোকিলের মতো কালো ও মধুরকণ্ঠী মেয়েগুলো জানে যে, শমার চোখ দুটি অসভ্য। ওরা এও জানে যে, বেশির ভাগ পুরুষের চোখই অসভ্য।

শর্মাকে কারখানার অফিসের সকলেই ডাকে ইম্‌মেটিরিয়াল ম্যানেজার বলে।

এই জংগলের দূর গভীরে দিগা পাঁড়ে থাকে। তুলসীদাস পড়ে, সূর্য ওঠার আগেই চান করে। বড় সৎ, ভগবৎপ্রেমী লোক। কথায় কথায় রামচরিত মানস থেকে; ভাগবত থেকে উদ্ধৃতি দেয়। ওকে দেখেই মনে হয়, দিগা খুব উঁচু ধরনের সাধক। ভুজুং-ভাজুং দেয় না। কোনওরকম ভোগবিলাসের প্রতি ওর কিছুমাত্রও আকর্ষণ নেই। ওর কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলে, প্রখর মধ্যাহ্নে কোনও পাহাড়ি ঝর্নার পাশের মাথা উঁচু চাঁর গাছের নিচে বসার অনুভূতি হয়। ভাল লাগায়, শান্তিতে, অপনোদিত শ্রান্তিতে ঘুম এসে যায়। পৃথুর মনে হয়, বাকি জীবনটা এইখানেই শুয়ে কাটিয়ে দিতে পারলে বেশ হত, হাওয়ায় পাতার চিরুনি বোলানোর ঝরঝরানি শব্দে, বাসরঘরের নববধূর গলার স্বর আর গয়নার মৃদু নিক্কনেরই মতো ঝোপঝাড় লতা পাতার আড়ালে লুকিয়ে বয়ে যাওয়া ঝর্নার ঝরঝরানি ঝালরের ঘেরে।

দিগার স্নান হয়ে গেছিল। ছোট্ট মাটির ঘরের সামনে একটি বড় কালো শিলাসন। সামনে পুঁথি মেলে সে তার উপরে বসে ছিল। পাথরটা প্রায় মানুষ সমান উঁচু। উপরটা সমান এবং চ্যাটালো। দশ পনেরোজন লোক অনায়াসেই বসতে পারে। তার ঠিক পেছনেই একটি মস্ত আকাশমণি গাছ। আফ্রিকান টিউলিপ। কোনও শিকারি সাহেব কবে তৎকালীন সেন্ট্রাল প্রভিলে শিকারে এসে লাগিয়ে গেছিলেন হয়ত। পাথরটির দুপাশে দুটি প্রকাণ্ড বহেড়া গাছ। দিগার কুটিরের সামনের ও পেছনের কিছুটা জায়গাই শুধু পরিষ্কার। চারদিকেই ঘিরে আছে গভীর জঙ্গল। হাঁলো নদী বয়ে গেছে ডান পাশ দিয়ে। একটা পথ চলে গেছে, পায়ে চলা। পুনোয়া বস্তির দিকে। হাটচান্দ্রা থেকে পায়ে চলা পথও আছে এখানে আসার। জঙ্গল, পাহাড়, নালা মাড়িয়ে। আর একটা রাস্তা আছে, সেটা চিলপির পাকা রাস্তা থেকে বেরিয়েছে। তাকে রাস্তা বলে না, জীপ আসে না কোনও মতে।

দিগা পাঁড়ের চেহারাকে ছিপছিপে বললে ঠিক বলা হয় না, বলতে হয় ফিনফিনে। জলফড়িং-এর ডানার মতোই স্বচ্ছ। ওর শিরা উপশিরার নীলচে রঙ কপি-পেপারের রঙের মতো চামড়া ভেদ করে দেখা যায়। তুলসীদাস পড়ার সময় ওর সাদা গলার চামড়ার নীচে নীল শিরাকে ফুলে ফুলে উঠতেও দেখা যায়। গহরজান বাঈজী পান খেয়ে পানের পিক গিললে নাকি নীল শিরা বেয়ে পানের লাল পি নামতে দেখা যেত। শুনেছিল, পৃথু, তার বাবার কাছে। অনেকটা সেরকমই দিগ। দিগা প্রথম জীবনে ছিল কুখ্যাত ডাকাত। করেনি, এমন অপকর্ম নেই। বিহারের কোনও কোনও অঞ্চলে, উত্তরপ্রদেশের এটাওয়ার কাছাকাছি বেহড়ে এবং পরে চম্বল এলাকাতেও ওর নাকি যাতায়াত ছিল। হাটচান্দ্রার একদল বাসিন্দার, যাঁরা দিগাকে জানেন, অথবা ওর কথা শুনেছেন; বলেন যে, দিগা পাঁড়ে আদপে পাঁড়েই নয়। বিহারীই নাকি নয় সে। আসলে ঠাকুর। বাগী-হয়ে-যাওয়া ঠাকুর। এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত। এখন নাম ভাঁড়িয়ে এখানে এসে বসেছে পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্যে।

দিগাকে দেখার পর থেকে কথাটা পৃথুর বিশ্বাস হয়নি। যে, শ্রীরামচন্দ্রের পায়ে নিজেকে সমর্পণ করেছে, দিগা যদি সেই রামচন্দ্রর চোখেই ধরা না পড়ে থাকে অসাধু বলে; পুলিশ তাকে অসাধু বলে ধরবে কেমন করে?

সংসারে অতি অল্প সংখ্যক মানুষ থাকেন, যাঁদের কাছে এলেই এক সুন্দর শান্তভাব মনে জাগে। কোনও দেনা-পাওনা, লেন-দেনের ব্যাপার নয়, কিছুমাত্র চাওয়া-পাওয়ার জন্যেও নয়, নিছক তাদের সঙ্গই অন্যকে আনন্দে ভরপুর করে তুলতে পারে। একটু কথা, অথবা দীর্ঘ নীরবতা, এক চিলতে মৃদু হাসি, চোখের একটু চাওয়া; চৈত্রের প্রহরশেষের রাঙা আলোর রেশ-এর মতো; এই-ই যথেষ্ট। প্রেমে বোধহয় মানুষ বা মানুষী এমন আত্মার সঙ্গেই পড়ে। প্রথম দর্শনেই। কিন্তু দিগা যে মানসিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই এভারেস্টে পৌঁছনোর মতো; সেখানে মানব মানবীর প্রেমের কথা উঠলে তার মুখে এক স্মিত প্রেমময়, ক্ষমাময়, লীলাময় হাসিই ফুটে ওঠে। শুধু। ভগবানের প্রেমে যে সত্যিই মশগুল তার কাছে মানুষী প্রেমের কোনও আকর্ষণই থাকে না বোধহয়।

কাল রাতে ঠুঠা বাইগা দিগার কাছে ছিল। এবং পৃথুও।

রাতে, দিগা পাঁড়ে কিছুই খায় না। যদি কেউ কিছু দেয়; নিয়ে আসে, হাটের দিনে যদি কেউ পাঠায় কিছু, তাইই। না খেলেও চলে যায় ওর। খেলেও একবেলা; একচড়া খায়। ঠুঠা বাইগা কিন্তু খেতে খুবই ভালবাসে। অনেক দিন আগে দিগা পাঁড়ের পর্ণকুটিরে একটা ময়ুর মেরে এনেছিল তার গাদা বন্দুক দিয়ে। বন্দুক এখনও সারেন্ডার করেনি সে। অবশ্য করার কথাও ওঠে না, কারণ বন্দুকটাই বে-পাশি। আর যে কটা দিন বাঁচে, বন্দুক ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেই পারে না উঠা বাইগা। যুবতীর আস্কল পাখির মতো বুকের খাঁজের শালফুল শালফুল গা-সিরসির গন্ধও তাকে ফোটা কার্তুজের বারুদের গন্ধর মতো টানেনি কখনও, সে যখন জোয়ানও ছিল। এ কথা ঠুঠা বাইগার কথা শুনেই বোঝা যায়। আজ তো ও বুড়োই হয়ে গেছে। বিয়ে করেনি ঠুঠা। ছোট্টবেলায় কাংড়ীতে আগুন পোয়াতে গিয়ে দুটো হাতেরই কয়েকটি আঙুলের ডগা তার জ্বলে খসে গেছিল। ডান হাতটার চারটি আঙুল। তাই-ই থেকে তার নাম ঠুঠা। বিয়ে করেনি বটে, কিন্তু হন্‌সো নামের একটি গা-ছমছম মেয়ে তাদের বাড়িতে ঢুকে এসেছিল। ঘরঘুসি’ বিয়ের জন্য। সে কী কেলেঙ্কারী। মেয়েও যাবে না। ঠুঠাও বিয়ে করবে না। ঠুঠার বাবার কী রাগ!

গাওয়ান আর প্যাটেলদের সভা বসেছিল। ফাইন দিয়েছিল। তবুও বিয়ে করেনি।

হন্‌সো বাঈ-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল গত বছর সীওনীর কাছে একটা গ্রামে। বালাঘাটের কাছাকাছি। এক গাওয়ানের বউ সে। গায়েগতরে হয়ে উঠেছে একেবারে পৌষালী বোদে। নাতি-নাতনীতে ঘর ভরা। কী খিটক্যাল! কী খিটক্যাল! অমন শাওন-ভাঁদোর মতো চলকে যাওয়া যৌবন নিয়ে যদি দেওয়ালের আধ-শুকনো এবড়ো-থেবড়ো গোবর গন্ধের খুঁটেই বনবি শেষকালে, তাহলে আর জুলুনি যৌওন নিয়ে জন্মালি কেন? নদীর মতোই চলকে চলকে চলতিস সারা জীবন তবে না বুঝতাম রে ছিঃ ছিঃ। মনে মনে বলেছিল ঠুঠা। এখনও ঠুঠা শিকার পাগল। জঙ্গলে এলেই রক্ত না দেখলে দু হাতে পাখির পালক ফরফর করে বা জানোয়ারের চামড়া চড়চড় পৎ-পৎ শব্দ করে নিজে হাতে না ছিড়লে ওর দিলখুশ হয় না মানুষটার মধ্যে এক ধরনের আদিম, গভীর প্রাগৈতিহাসিকতা আছে। কিন্তু দিগার হাসিটা যেন তীরের মতো বিধে যায় ঠুঠা র পাঁজরের মধ্যে। নড়তে চড়তে পারে না। দিগা তুলসীদাস আউড়ে বলে :

“জো মধু মরৈ না মারিএ মাহুর দেই সো কাউ।
জগ জিতি হারে পরসুধর হারি জিতে রঘুরাউ ॥”

দিগা আবার মানেও বুঝিয়ে দেয়, এই দোঁহার। “মধুতেই যে মরে, তাকে বিষ দিয়ে মারতে নেই। সমস্ত পৃথিবী জয় করলেন পরশুরাম কিন্তু হার হল তাঁর শ্রীরামচন্দ্রের কাছে। রঘুরাজ হেরেও কিন্তু আসলে জিতেই গেলেন।”

বলে, অনেকইত মারামারি করলে সারাজীবন, এবার বন্ধ করো শিকার-টিকার। বন ছেড়ে উঠা বইগা এবার নিজের মনের বনে ফিরে এসো। সেখানে মৃগয়া ক’জন করতে পারে।

এসব কথা চৈত্র মাসের দামাল হাওয়ার মতোই ঠুঠা বাইগার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। ঠুঠার কোনওই বৈকল্য ঘটে না। কিন্তু পৃথুর হয়। পৃথু যখনই আসে দিগার কাছে, তখনই সারা বেলা কাটিয়ে যায়। ভারী ভাল লাগে ওর মনটা।

আজ কোথাওই বেরোতে হয়নি দিগার। কাল, পৃথুই চাল ডাল আর আলু নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে। রুষা, কাল বাড়িতে ছিল না। মিলি ও টুসু গেছে মনিবাবুদের ওখানে। উইকএন্ড স্পেন্ড রবে। আর রুষা গেছে কুর্চিদের ওখানে। হাটচান্দ্রা থেকে মোটে দশ মাইল, রায়নাতে নতুন সংসার পেতে বসেছে কুর্চি। ওকেও নেমন্তন্ন করেছিল। পৃথু, ইচ্ছে করেই যায়নি। যেতে চায় না ও। রুষার সঙ্গে তো নয়ই। রুষা গেছে। শনিবার বলে, রাত কাটিয়েই আসবে।

কুর্চি আর ভাঁটুর এদিকে আসার খবরে পৃথু বিশেষই বিচলিত হয়ে রয়েছে কদিন হল। ভাঁটু একটা সমেন্ট ফ্যাক্টরীর মাঝারি অফিসার ছিল। কোনও কারণে তার চাকরি গেছে। এখানে নাকি লাক্ষার ব্যবসা করবে। অন্য ব্যবসাও করবে টুকটাক। ব্যবসা করতে পারলে ওর ভালই হবে। কারণ ভাঁটু এমনিতে খুবই ঘুঘু ছেলে। ভেরী স্মথ-টকার। ভাল সেলসম্যান।

ভাঁটুর কারণে পৃথু আদৌ চিন্তিত নয়। ও চিন্তিত, কুর্চির কারণে। বেশ ছিল। চোখের দেখাও ছিল না গত পাঁচ বছর। মানে, ওর বিয়ের পর থেকে। প্রথম প্রথম পৃথু মাঝে মাঝেই চিঠি লিখেছে। পাগলের চিঠি যেমন হয়। সাবধানী কুর্চি তখন শ্বশুরবাড়ি থেকে সাবধানে উত্তর দিয়েছে। বুদ্ধিমতী মেয়েদের মতন।

ভাঁটুর সঙ্গে ওর মনের সঙ্গম হয়নি। মনের সঙ্গম আর ক’জন দম্পতির মধ্যে হয়?

কুর্চি আবার রায়নাতে ফিরে আসাতে পৃথুর সমস্যাসঙ্কুল জীবনে সমস্যা আরও বাড়বে। কোনওই সন্দেহ নেই। কুর্চি কাছে থাকবে অথচ তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না, তার কাছে যাবে না, একথা ভাবাও ওর পক্ষে মুশকিল। কুর্চি তার ভালবেসে বিয়ে করা স্বামীর ঘরে থেকেই, ভিক্ষা চাইতে যাওয়া পৃথুর হাতে, দূর থেকে হাত বাড়িয়ে একটু ভিক্ষা দেবে। নরম চোখে চাইবে, মিষ্টি গলায় কথা বলবে, মিটিমিটি হাসবে আর না বলে প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দেবে যে; পৃথু তার কেউই নয়।

কুর্চি। তুমি কেন ফিরে এলে? কেন এলে কুর্চি? বেশ তো ছিলাম, প্রায় ঘর-জামাই, স্ত্রী-তাড়িত, রুজি-রোজগার করা অঙ্গপ্রত্যঙ্গওয়ালা একটা মেশিন। তেল, মবিল, ডিপ্রিশিয়েশা, ইনপুট, আউটপুট সব প্রায় ঠিক-ঠাকই ছিল। ব্রেক-ইভিন পয়েন্টে পৌঁছে গিয়ে সার্থক বশংবদ মুখে-জাল পরানো এঁড়ে বাছুরের মতো নিজেকে, অনবরত মেরে মেরে ঘেন্নায়, চোনায়, গোবরে তবুও আহা! কী চমৎকার বেঁচেছিল। মানুষেরই মতো। দশজন ভদ্রলোক মানুষ যেমন করে বাঁচে।

পৃথু বলছিল, নিরুচ্চারে, তুমি কেন এলে কুর্চি?

কেন এলে?

আহা! কত্বদিন দেখিনি তোমাকে!

কুর্চি! তুমি কেন এলে?

পৃথু বেশ ছিলে তুমি। ভেবেছিলে, অন্য কোনও ঝড়ের মধ্যে আর পড়বে না। কোনওরকম ঝড়। ঝড় ঝগড়া না, মারামারি না।

একটি কবিতা মনে পড়ে গেল। কেবলি কবিতা মনে পড়ে যায় ব্যর্থ কবির। ব্যর্থ প্রেমিকের। সফল কবিতা তাকে চেনে না, জানে না, তার পাঠানো কবিতাকে ব্যঙ্গ-ভরা হাসিতে পুড়িয়ে তারপর কুচি কুচি করে ছিড়ে, ওঁরাই ছেড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেন। অথচ এঁদের জন্যেই পৃথুর মতো একজন ব্যর্থ কবির বেঁচে থাকা। এদেরই বুকের গভীরে শিকড় ছড়িয়ে রস টেনে এনে স্বর্ণলতার মতো নিজের ঊষর জ্বালাধরা অস্তিত্বতে একটু জলসিঞ্চন।

কেন এলে? কুর্চি? কেন যে এলে তুমি?

মনে আছে? তুমি একটি কবিতা শুনিয়েছিলে আমায়?

কী যেন নাম কবিতাটির? “তোমাকে বলেছিলাম”?

হাঁ, হ্যাঁ, খুব সম্ভব তাই-ই হবে।

“তোমাকে বলেছিলাম, যত দেরিই হক,
আবার আমি ফিরে আসব।
ফিরে আসব তল আঁধারি অশ্বথগাছটাকে বাঁয়ে রেখে,
ঝালোডাঙ্গার বিল পেরিয়ে,
হলুদ ফুলের মাঠের ওপর দিয়ে
আবার আমি ফিরে আসব।
আমি তোমাকে বলেছিলাম।
আমি তোমাকে বলেছিলাম, এই যাওয়াটা কিছু নয়,
আবার আমি ফিরে আসব।
ডগডগে লালের নেশায় আকাশটাকে মাতিয়ে দিয়ে
সূর্য যখন ড়ুবে যাবে,
নৌকোর গলুইয়ে মাথা রেখে
নদীর ছলছল জলের শব্দ শুনতে শুনতে
আবার আমি ফিরে আসব।
আমি তোমাকে বলেছিলাম।”

কিন্তু এলে কেন?

কেন?

কাছে এলেই কি কাছে আসা যায় কুর্চি? তুমিও তো আরেকজন রক্তমাংসের সাধারণ মেয়েই। তুমি রুষার চেয়েও সাধারণ। অথচ আমার ভালোবাসা তোমাকে ঈশ্বরীর স্বমহিমাতেই না মহিমামণ্ডিত করে রেখেছে! তুমি তোমার নিজের কাছেও বোধহয় ঈশ্বরী হয়ে গেছ। তোমাকে নিয়েই আমার বোধন, যত আগমনী গান, কুমারী পুজো। দেবীত্ব থেকে নেমে এসে, আমার জন্যে মানবত্বে ফিরতে পারবে তো কোনওদিন? কঠিন বড়। বিমল কর-এর ‘ভুবনেশ্বরী’র মতোই ঈশ্বরী, তুমি হয়তো ঈশ্বরীই থেকে যেতে চাইবে।

তুমিও আমার কেউ নও। আমি জানি। কেউ হবেও না। কোনওদিন।

কাছে আসো আর দূরেই থাকো; সবই আসলে দূরই। বড় দূর। বৃত্ত কখনও সম্পূর্ণ হয় না কুর্চি। ঘুরে, ঘুরে, দূরে, দূরে, সুরে, সুরে, আলো-ছায়ায়, মেঘ-রোদুরে হেঁটে যাওয়ারই আর এক নাম জীবন। রিলকের ‘সনেটস টু অরফুসু মনে আছে? তা কেন থাকবে? বিবাহিত নারীরা কবিতা শুধু পড়ে না তাই-ই না, মনেও রাখে না। কবিতা, শুধুই কুমারীদের জন্যে।

“থিংক অফ দ্যা স্প্যান টু আ ম্যান ফ্রম আ মেইড, হুজ প্লেজার লিংগারস্ উইথ হিম্ শী ফ্লাইজ!”

“ও ইজ রিমোট—নো হোয়্যার ডাজ দ্যা সার্কল ক্লোজ…”

 

কাছেই আসো আর দূরেই যাও। ঘুরে, ঘুরে, দূরে, দূরে, সুরে, সুরে, আলো-ছায়ায়, মেঘ-রোদুরে হেঁটে যাওয়ারই আর এক নাম জীবন।

বৃত্ত কখনওই সম্পূর্ণ হয় না।

ঘটনা, এটাই।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ