০৬.

বড়োবিল, ওড়িশা
এবং সারাণ্ডা, বিহার

আবারও পলাতক!

 চৈত্রমাস এলেই জঙ্গলের ঝরাপাতা আমাকে ডাক পাঠায়। মন বড়ো উচাটন হয়। চোত বোশেখের জঙ্গলের পূর্ণিমার জন্যে মন কেমন করে।

যাওয়ার কথা ছিল, মধ্যপ্রদেশের কানহাতে। জব্বলপুর হয়ে। শেষমুহূর্তে যাওয়া হল না। তাই গতবার পুজোয় যেমন করেছিলাম, পূর্ণদের ফোন করে মনোজকে হাওড়া স্টেশনের ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে বললাম। তারপর সাড়ে সাতটা নাগাদ ওকে তুলে নিয়ে গাড়িতে আন্দুল হয়ে মুম্বই রোডে পড়লাম।

ঘাটশিলা, মৌভান্ডার-হলুদপুকুর-হাটা হয়ে, চাঁইবাসা, হাটগামারিয়া-বড়োজামদা বড়োবিল। বড়বিল-এ পৌঁছোলাম যখন, তখন সবে সন্ধে হচ্ছে। মিত্র এস. কে-র গেস্ট হাউসে তপনকুমার ব্যানার্জি এবং সুধীররঞ্জন সেন এসে অভ্যর্থনা করলেন। চন্দ্রভান তো অ্যাজ-ইউজুয়াল, বাসমতী এবং পানুইও ছিল।

পরদিন সকালে ওঁদের জিপেই রওনা হলাম। রাউরকেল্লার রাস্তাতে কইরাভ্যালি অবধি গিয়ে রাউরকেল্লার পথ ছেড়ে কাঁচাপথে ঢুকলাম। উঁচু-নীচু লৌহ-আকরের লাল ভারী ধুলোমাখা জঙ্গলের পথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গল পাহাড়ের এবং পাহাড়ি নদীর সংগমে এসে মন ভরে গেল। গা-মাথা ভরে উঠল আবিরের মতো লাল-রঙা ভারী আকরিক ধুলোয়।

সারকুণ্ডাতে এস, লালা কোম্পানির লোহার খনি আছে। চমৎকার জায়গা। কুড়ারি নদীর রূপ এখানে বড়ো সুন্দর এবং আরও সুন্দর তার অববাহিকা। সারকুণ্ডার পরই শুরু হল খাড়া চড়াই। বড়ো, খুব উঁচু একটা পাহাড়ের পর পাহাড়। এইসমস্ত পাহাড়-বন ওড়িশার সুন্দরগড় জেলার মধ্যে পড়ে।

কখনো আসিনি এই জেলাতে এর আগে।

 মহুলশুখা ম্যাঙ্গানিজ মাইনে এসে পৌঁছোলাম। পথে কুড়ারি নদীকে যে কতবার পেরোলাম তার ইয়ত্তা নেই। মহুলশুখাতে ঢুকতেও পেরোতে হয়। মেয়েরা নগ্ন হয়ে চান করছে নদীতে বাঁধ বেঁধে। বেশিই হো, মুণ্ডা, আদিবাসী সব। ভারি সরল আর ভালো। এখনও।

মহুলশুখা এরিয়ানস-এর মাইন। এরিয়ানস আসলে জার্ডিন হেণ্ডারসনেরই একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। শুনলাম, ম্যানেজার আগ্রার লোক। এম. ডি. গোয়েল। বিপত্নীক। অ্যাসিন্ট্যান্ট ম্যানেজার সুশ্রী ছটফটে ধর্মদাস মিশ্র। মুজফফরপুরের লোক। বউ, ছেলে থাকে সেখানে। খেতিজমিন আছে। বাবা-মা নেই। চাচা-চাচির কাছে বউ, ছেলেকে রেখে এই জঙ্গলে পড়ে আছে।

ডিসপেনসারির ওড়িয়া ডাক্তার মিশ্র। সুন্দরগড়ের কাছে বাড়ি। সম্বলপুর থেকে ডিপ্লোমা নিয়েছে। যথারীতি মুৎসুদ্দিবাবু বাঙালি।

 শাকরেদ জুটল ওড়িয়া দুটি ছেলে। সুরেন্দ্রকুমার কর ও দ্বারিকানাথ পাত্র। জেনারেটর অপারেটর আর্তমোহন মহাপাত্র। বিহারের লোক পাঁড়েজি। কেয়ারটেকার। ম্যালেরিয়া আর পেটের রোগে প্যাকাটি হয়ে গেছে। চারদিকে বড়ো বড়ো মহানিম গাছ। উজ্জ্বল কুসুমপাতার মতো লাল-রঙা পাখি। অচিন পাখি কখনো আসে, কখনো আসে না।

মহুলশুখার কথা বিস্তারিত লিখব এবার আনন্দলোক-এর পুজোসংখ্যাতে বড়ড়া করে। তাই এখানে আর লিখলাম না। নাম দেব, মহুলশুখার চিঠি। আনন্দ পাবলিশার্স বই ছাপবেন পরে।

মহুলশুখা থেকে আরও এগিয়ে গেলে বারসুয়া রেলস্টেশন। আর খন্ডাধার। ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশনের মাইন।

উনিশ-শো বাষট্টি সনে বিজু পট্টনায়েক শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ মশাইকে চেয়ারম্যান করে এই ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশান ওপেন করেন।

খন্ডাধার ফলস বিখ্যাত। উল্লেখ করার মতো জলপ্রপাত। কিন্তু কুড়ারি নদীর জন্মদাত্রী নয়।

মহুলশুখার সবই ভালো। শুধু আমার খিদমদগার পদ্মনাভ যদি না খাবার ঠাণ্ডা করে আনত এবং চা-টাও ঠাণ্ডা না করত প্রতিবার, তাহলে হয়তো থেকে যেতাম আরও ক-দিন। তা ছাড়া, সন্ধে হতে না হতেই জেনারেটরের গুন-গুনানি এবং চাঁদের আলোর সর্বনাশ। অথচ চাঁদ দেখতেই তো এইসময় অত পাহাড়ে নদী পেরিয়ে বনে যাওয়া! তাই-ই চলে এলাম।

ফিরে এসে বড়োবিলে তো রই-রই ব্যাপার। রোজই মুনলাইট পিকনিক। ইণ্ডিয়া ট্রেডস কোম্পানির অভিজিৎ (এন্টু রায়), শান্তি চ্যাটার্জি, এইচ এস এল এর কে জি ঘোষ (কৃষ্ণগোপাল), এসলাল-এর ঠাকুরাল আর শর্মা, মিত্র এস কে-র সুধীরকুমার সেন, প্রণব বাবু, বিপ্লব বাবু (কেমিস্ট), হাজরাবাবু (ক্যাশিয়ার) ব্যাচেলার, দাড়িওয়ালা মাইতি, বিপ্লবও (ব্যাচেলার), ব্রিগস কোম্পানির ভট্টাচায্যি সাহেব। দুর্গাপুর স্টিলের সান্যালবাবু।

পরদিন কুমড়ি গেলাম। থলকোবাদে জায়গা পাওয়া গেল না। তার আগের দিন আত্রেয়ী ও আহলুয়ালিয়া; দুই কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে দেখা হল। চা-পান খাওয়াল। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সর্দারজিকাং-এর সঙ্গে খুব ভাব। গাঙ্গুলি ও যাদব ড্রাইভার এবং চন্দ্রভান, আমার সঙ্গে চলল। ম্যানেজার ব্যানার্জিবাবুও। মনে হল ওঁরা আমার মাধ্যমেই জঙ্গল এবং জঙ্গলে চাঁদের আলোর স্বরূপ প্রথম প্রত্যক্ষ করলেন। ভগবান মানুষকে চোখ দেন বটে কিন্তু সেই চোখ দিয়ে দেখা বা কান দিয়ে শোনার ক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে সকলকে দিয়ে পাঠান বলে মনে হয় না। অথচ সেনবাবু ও ব্যানার্জিবাবুর বড়োবিলেই আবাস। একজনের বাবা বাড়ি করে স্থায়ী বাসিন্দা এখানের। অন্যজনের বাবাও এখানেই ছিলেন এবং জন্মস্থানও বড়োবিলে। অথচ আমি না গিয়ে পৌঁছেলে হয়তো সিংভূম জেলার বিখ্যাত সারাণ্ডার ওখানে যাওয়াই ঘটত না ওঁদের।

বড়োজামদাতে ফিরে এসে কিরিবুরুর রাস্তা ধরে এগিয়ে এসে ফরেস্ট গেটে পৌঁছোলাম বড়াইবুরুতে। লেখা আছে, ল্যাণ্ড অব সেভেন হানড্রেড হিলস। ব্রিটিশদের সময় একেবারে গুনেগেঁথে রেখেছিল তারা। সাত-শো পাহাড়ের দেশ। সারাণ্ডা ডিভিশনের ভেতরে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম, কথাটা কতখানি সত্যি। সমতল বলতে প্রায় কিছুই নেই, কেবল পাহাড় আর পাহাড়। চড়াই আর উতরাই।

কুমডি, থলকোবাদ, মনোহরপুর, সালাই-এইসব বিভূতিবাবুর বড়ো প্রিয় জায়গা ছিল। এই প্রথম এলাম আমি। এবারে বেশ কিছুদিন ঘনঘন আসতে হবে। যতদিন না যথেষ্ট ভালো করে পুরো অঞ্চলটিকেজানছি। বিহারে এক নেতারহাটের পাদদেশে এবং পালামৌর বাড়েষাঁনা ব্লক ছাড়া কোথাওই এমন গভীর ও ঘন শালবনের জঙ্গল দেখিনি। শাল ছাড়াও নানারকম গাছ আছে। সেগুন আছে। তবে হয়তো ফেলিং হয়ে গেছে। থলকোবাদ অবধি পরদিন ঘুরে যা দেখলাম, তাতে মনে হলসবই নতুন প্ল্যানটেশন। শাল ছাড়া বড়ো গাছের মধ্যে কারি-কেন্দু, মহানিম, বট, শিশু, কুরচি, ধাতিকা, নিম, ঢোঁড়া, অসল, করম এবং বাঁশও আছে জায়গায় জায়গায়। কারো নদী বয়ে গেছে ঝর ঝর করে কুমডি বাংলোর পেছন দিয়েও। ভারি সুন্দর নদী। ড্যাম বানাচ্ছে বাংলোর পেছনেই। দিনেব্লাস্টিং-এর আওয়াজ এবং রাতে কুলি ও রেজাদের সম্মিলিত নাচ-গানে জায়গাটা মুখর হয়ে থাকে। জংলি জানোয়াররা বোধ হয় পালিয়েছে ভয়ে।

চৈত্রশেষে শাল গাছগুলো থোকা থোকা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। গন্ধে ম-ম করে জঙ্গল। মহুয়াও ফুটতে শুরু করেছে। কুসুম গাছগুলোতে পাতা এসেছে উজ্জ্বল বাদামি লাল। কোনো গাছে-বা নতুন পাতাতে সবুজের ছোপ লেগে গেছে। ওই কুসুম গাছ আমাকে বড়ো আকৃষ্ট করে। কোনোদিন একটি উপন্যাস লিখব হয় ওড়িশার বড়োবিল, নয় পালামৌর কোনো পর্বত নিয়ে। পরে নাম দেব বাসনাকুসুম।

জংলি আমের গাছে গাছে বোল বা কচি আম এসেছে। কাঁঠাল গাছ ভরে গেছে এঁচড়ে এবং গুটিতে। জংলি বেলও আছে অনেক। আমলকী।

ফলসা জাতীয় কেন্দু ও চাঁর ফল আদিবাসীদের বড়ো প্রিয়। গিলিরী ফুলের ঝাড়ে ঝাড়ে এখন লাল ফুল ধরেছে, পালামৌতে যাকে বলে ফুলদাওয়াই। শিয়ারী লতার নতুন পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাই দিয়ে বড়ো বড়ো দোনা বানিয়ে আদিবাসীরা হাটের দিনে হাঁড়িয়া খায়। এইসব গভীর জঙ্গলে পলাশ কম, প্রায় নেই বললেই চলে। তবে শিমুল অনেক আছে। বিরাট বিরাট গাছ। ফুল ফুটবে, তাই পাতা ঝরিয়ে প্রদীপের আকারে দুধভরা স্তনের মতো বীজ বুকে নিয়ে শিমুল অপেক্ষা করছে ঝরাপাতার মর্মরধ্বনির গানের মধ্যে।

 এখানে একরকমের ফুল হয় টগরের মতো দেখতে, তবে আকারে অনেক বড়ো, যখন ফোটে; তখন সাদা, পরে হলুদ হয়ে যায়। আদিবাসীরা বলে গরভু। বড়ো বড়ো জংলি চাঁপার গাছ আছে। ধাতিং ফুল পাটকিলে লাল হয়। তাদের রস নাকি চিনির মতো মিষ্টি।

 চৈত্রশেষে লাল টুকটুকে গোল গোল একরকমের ছোট্ট মার্বেলের মতো ফল হয় ঝোঁপঝাড়ে। আদিবাসীরা বলে হেল। সেই ফল বেটে নদীর জলে মিশিয়ে দিলে নাকি মাছ মরে ভেসে ওঠে। নদীতে মাছ পাওয়া যায় পাহাড়ি চেং। বর্ষাকালে খানাখন্দে মাগুর।

মনোজ আর আমি ঠিক করলাম যে, ফেরবার সময়ে কেওনঝড়গড় হয়ে ফিরব সিংগাদা মোড়, যশীপুর হয়ে। ব্যানার্জিসাহেব বললেন, উনি শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষের জঙ্গলে জঙ্গলে বইয়ে পড়েছেন যে, এক ব্যক্তি বলেছিলেন, হনুমান নাকি গন্ধমাদন পাহাড়টার সবটা তুলে নিয়ে যেতে পারেনি বলে খানিকটা এখনও ওঁর মামাবাড়ির দেশ পূর্ব-বাংলার বরিশালের সুয়াকাটিতে পড়ে আছে।

 বিশল্যকরণী এসব জঙ্গলে আছে। মুসকালি, বাচ্চাদের পেটের গোলমালে অব্যর্থ ওষুধ। ওখাই গাছের ছাল, কাটা-ছেঁড়া সারায়। চুনকুড়ির ছাল আমাশার মহৌষধ। কুসুমের নতুন পাতাও খুব পুষ্টিকর। জঙ্গলে হাড় জোড়বার, রক্তপড়া বন্ধ করবার হরেকরকম অব্যর্থ ওষুধের ছড়াছড়ি। আমার পারিধী উপন্যাসে এসবের অনেক উল্লেখ করেছি।

কুমডির ফরেস্ট-গার্ড বলেছিল যে, সে শুনেছে, সিদ্ধমঠ বলে একটি টিলা আছে। বড়োবিলের কাছাকাছি। প্রাচীন ছবিআঁকা গুহাও আছে। সেসব ঠিক কোথায় জানা গেল না। জানতে পারলে দেখতে যেতাম।

কুমডি বাংলোতে যখন পৌঁছোলাম তখন সবে সন্ধে হচ্ছে। নানান পাখি ডাকছে, চারদিক থেকে। ময়ূর, ধনেশ, টিয়া নানারকম ফ্লাইক্যাচার, থ্যাশার, ব্যবলার, নানা জাতের মৌ-টুসকি।

 চাঁদটা উঠল। দিনের আলো নিভে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে বেইন-ফিভার, বউ কথা-কও, কপারস্মিথ, ঘুঘু পাখি এবং ক্কচিৎ প্যাঁচা ও ডাকতে লাগল। মনে হল, বসন্ত এখানে আসেনি; না হয় অপগত। কোকিল একেবারেই অনুপস্থিত। গভীর জঙ্গলে বিশেষ করে, শাল-সেগুনের জঙ্গলে কোকিলের ডাক বিশেষ শুনিনি।

ব্যানার্জিসাহেব তো চাঁদনি রাতের জঙ্গল দেখে মন্ত্রমুগ্ধ।

আমাকে পৌঁছে দিতে গেছিলেন। কিন্তু বললেন, আমিও থেকে যাই। চন্দ্রভান তাড়াতাড়ি খিচুড়ি বসিয়ে দিল। গাঙ্গুলি ও যাদব হেল্প করল।

 চৌকিদার হাইড্রোসিল অপারেশান করতে হাসপাতালে গেছে, একথা আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল রিজার্ভেশন দেওয়ার সময়। ফরেস্ট গার্ডের দেখাশোনা করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা এসে পৌঁছোবামাত্র সে, তার শেয়ালে-রঙা আলোয়ান সরিয়ে বাঁ-হাতটা উঁচু করে বগলের নীচে এমন একখানা সাদা হয়ে ওঠা ফোঁড়া দেখিয়ে দিল যে, তা দেখে তাড়সে আমাদেরই জ্বর আসার উপক্রম।

বললাম, থাক থাক বাবা। তোমাকে দিয়ে কাজ করালে মহাপাতকের কাজ হবে।

 রাতে খিচুড়ি খাওয়ার পর ডিজেলের জিপে চেপে অন্যরা চলে গেলেন। আমি আর ব্যানার্জিসাহেব রয়ে গেলাম।

ভোর বেলা ঘুম ভাঙল নানান পাখির গানে। বাইরে বেরিয়ে গেটের কাছে গিয়ে দেখি, একজোড়া লেসার ইণ্ডিয়ান হর্নবিলস এবং একজোড়া ময়ূর। ধনেশ অনেকদিন পরে দেখলাম। মহানদীর অববাহিকাকার জঙ্গল ছাড়া, এই ধনেশ আমি খুব বেশি জায়গায় দেখিনি। তবে গ্রেটার ইণ্ডিয়ান হর্নবিলসও আছে নিশ্চয়ই জঙ্গলের গভীরে।

সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে, জিপ নিয়ে আর স্টপগ্যাপ আদিবাসী সুগানকে নিয়ে শিকারি রোড় হয়ে থলকোবাদের নীচ দিয়ে করমপাধা মাইনসে গেলাম।

আত্রেয়ী কন্ট্রাক্টারের কাজ হচ্ছে এখানে।

 দুপুর হয়ে যাওয়াতে না চা পেলাম, না-পান। শেষে বাণ্ডিল বাণ্ডিল মেঘনা-বিড়ি কিনে খেয়ে ও দান করে সান্ত্বনা পেলাম। সমস্ত পথে কোনোই জানোয়ার পেলাম না। পথে, একটি ঝরনার বালির নীচে বিয়ার ঠাণ্ডা করে ঝাঁকড়া মহানিম আর কারি-কেন্দু গাছের তলাতে বসে বিয়ার খাওয়া হল।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় বসে বাইনাকুলার দিয়ে পাখি দেখছি, এমন সময় একটি কালো ছিপছিপে স্মার্ট আদিবাসী ছেলে লুঙ্গি হাঁটু অবধি গুটিয়ে তুলে বাংলোর হাতায় ঢুকেপড়া ছাগলগুলোকে ছু: ছু: করে তাড়াতে তাড়াতে এসে বলল, আমিই বাংলোর চৌকিদার। সাহেব।

সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম, তোমার অপারেশন হয়ে গেল? আসলে ওই-ই চৌকিদার কি না, সে-নিয়ে সন্দেহ হচ্ছিল আমার।

সে বলল, না সাহেব। আমার অপারেশান আর হবে না। দশ দিন ছুটি নষ্ট হল। এই গরম, তার উপর ডাক্তার নেই; ডাক্তার থাকলে, বেড নেই। এই নিয়ে তিন বার গেলাম।

তার মুখ দেখে মনে হল ভগবানের একটি বিশেষ দান যদি ফুলেফেঁপে পুরুষের ভাগ্যে কিঞ্চিৎ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকেই তাহলে, তা নিয়ে অপরিচিতর মুখে এত আলোচনা তার আদৌ মনঃপূত নয়। সে যে কোনো বিশেষ অসুবিধেতে আছে এমন কোনো লক্ষণও তার হাঁটা-চলা এবং স্বচ্ছন্দ কথোপকথনে বোঝা গেল না। অতএব, প্রসঙ্গ বদলালাম।

ও বলল, রাতে বেরোবেন তো জানোয়ার দেখতে?

আমি বললাম, আলো ফেলে জানোয়ার দেখতে আমার ভালো লাগে না। তা ছাড়া দশ বছর বয়েস থেকে শুরু করে আজ থেকে দশ বছর আগে শিকার ছেড়ে দিয়েছি। এখানকার ধুলোতে এত লোহা যে আমার এই ধুলো হজম হয় না। তুমি বরং ওই সাহেবকে নিয়ে যেয়ো।

বলে, ব্যানার্জিসাহেবকে দেখালাম।

চৌকিদার আবার জিজ্ঞেস করল কোনো ঘাতক অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে আসেননি তো আপনারা স্যার? বললাম, আমার মুখ আছে। তাই-ই যথেষ্ট। তা ছাড়া আর কিছুই আনিনি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

সত্যিই। এইসব অঞ্চলের ধুলোর সঙ্গে পূর্ব-আফ্রিকার গোয়রাং গোররা ক্র্যাটারের ধুলোর অনেক মিল আছে। জমে-যাওয়া লাভাস্রোতের ধুলো আর এখানকার এই লোহা ম্যাঙ্গানিজ ডায়োস্কাইডের ধুলো; দুই-ই ধাতব পদার্থে ভারী। নাকে কানে ঢুকলে, ভারী ভারী লাগে। তবুও ব্যানার্জিসাহেব এবং বিপ্লব, যে-এসেছিল রাতে, যাদবের সঙ্গে, আমাকে ছাড়লেন না। ধুলো খেতেই হল বিস্তর। জিপে করে অনেক পথ ঘুরেও একটি খরগোশও দেখলাম না।

 মাঝে মাঝেই জিপ থামিয়ে দিয়ে চাঁদনি রাতের জঙ্গলের শোভা ও আওয়াজ দেখছিলাম ও শোনাচ্ছিলাম ওঁদের। ব্যানার্জিসাহেবরা নামতে ভয় পাচ্ছিলেন জিপ থেকে প্রথম বার। তারপর সত্যিই খুশি হলেন। শেষকালে, পথে জিপ রেখে যাদব ড্রাইভারকে পনেরো-কুড়ি মিনিট পর আমাদের পেছনে এসে তুলে নিতে বলে চাঁদের আলোয় বিপ্লব আর ব্যানার্জিসাহেবকে জঙ্গলে হাঁটালাম। এমন নিবিড় জঙ্গলে টর্চ না জ্বালতে দিয়ে চাঁদের আলোর হাঁটতে ওঁদের মনে জঙ্গল সম্বন্ধে অনেক অহেতুক ভয় কমে গেল বলেই আমার বিশ্বাস।

 বিপ্লবরা চলে গেল খেয়ে দেয়ে। আরও কিছুক্ষণ চাঁদ দেখে ও পাখির ডাক শুনে শুয়ে পড়লাম আমরা। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ ধাঁই-ধাঁই করে দরজা ধাক্কাতে লাগল চৌকিদার।

হার্থি আয়া।

হস্তী অথবা হস্তিনী জানি না। পায়জামা, পাঞ্জাবি একবারেই কুঁচড়ে-মুছড়ে আছে ইস্ত্রির ইও অবশিষ্ট নেই। এইভাবে রাতের পোশাকে ভদ্রমহিলার সামনে বেরোনো ঠিক হবে কি না, তা ভাবার সময় পর্যন্ত পেলাম না। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেই দরজা খুলে দৌড়ে গেলাম।

একটা একরা হাতি চৌকিদারের বাড়ির বাগানের কলাগাছ থেকে কাঁচা কলার কাঁদি ভেঙে নিয়ে ঝাঁকড়া বড়ো কাঁঠল গাছের ছায়ায় নিয়ে খাচ্ছে। এত কাঁচকলা? সে আমাশায় ভুগছে কি না, সেকথাও জিজ্ঞেস করা গেল না। ঘুম-ভাঙা চোখে গাছতলার অন্ধকারে ভালো দেখতে পেলাম না প্রথমে। হাতির পাগুলোকে অন্য গাছের গুঁড়ি বলে মনে হচ্ছিল। যেমন হয়।

হঠাৎ হাতিটা, মানে গাছের গুঁড়িগুলো চলতে আরম্ভ করল। সামনে শুড় লুটিয়ে। ভালো করে দেখার জন্যে আমরা দৌড়ে বাংলোর সামনের গেটের কাছে গেলাম। হাতিটা আমাদের থেকে অনেক আগেই বড়ো বড়ো পা ফেলে সেখানে পৌঁছে একটা গাছের ছায়ায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চৌকিদার ব্যানার্জিসাহেবকে টর্চ জ্বালতে মানা করছিল। এই হাতিটা নাকি টর্চ জ্বাললেই তেড়ে আসে। যাইহোক, দয়া করে সে নিরস্ত্র-আমাদের প্রতি তেড়ে-ফুড়ে না এসে গাছের ছায়া ছেড়ে, চাঁদের আলোভরা বাংলোর সামনের ফাঁকা জমিটুকু ধীরেসুস্থে হেলে দুলে পেরিয়ে নীচের ঢালে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জঙ্গলের এবং জঙ্গলের জানোয়ারের ভয় বহুদিন হল আর নেই। কবে থেকে যে, মনে করাও মুশকিল। কিন্তু এতবছর হাতে রাইফেল নিয়েই জঙ্গলে ঘুরেছি। খালি হাতে, একেবারেই খালি হাতে মাঝে মাঝে যে একটু অসহায়, সম্বলহীন লাগে না, এমন কথা বলব না। পয়েন্ট থ্রি সিক্সটি সিক্স ম্যান লিকার শুনার রাইফেলটা আমার একটা অতিরিক্ত অঙ্গের মতো হয়ে গেছিল। রিফ্লেক্স অ্যাকশন এমনই কাজ করত যে, নিজেই জানতে পেতাম না কখন সেফটি-ক্যাচটি সরে গেল এবং গুলি করার পরমুহূর্তেই কখন আবার রাইফেল রিলোড করলাম। বত্রিশ ইঞ্চি ডাবল-ব্যারেল গ্রীনার বন্দুকটির বেলাতেও সেকথাই প্রযোজ্য। কোনো তরুণীর সুন্দর কোমরের মতো স্মল অফ দ্য বাট-এর কথা মনে হয় প্রায়ই। সেখানে হাত থাকত বলে, পৃথিবীতে ভয় কাকে বলে জানিনি কখনো। তাই, তারা ছাড়া, মাঝে মাঝেই মনে হয় যে, আমার অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে এবং জঙ্গল পাহাড়ে আগে যে দাপটের সঙ্গে দিনেরাতে ডোন্ট-কেয়ার করে ঘুরে বেড়িয়েছি, এখন ততখানি বোধ হয় আর করতে পারব না। তবে জানি না, হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই এই নিরস্ত্ৰতাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাব। কিন্তু এমতাবস্থায় কোনো খ্যাঁকশিয়ালে বা চিতিসাপে পা কামড়ে দিলে বা জংলি শুয়োরে ঢু মারলে বা ভাল্লুকভায়া নাক খামচে নিলে আপশোসের আর অন্ত থাকবে না।

ওরা যদি বন্দুক হাতে আমার ক্রিয়া-কলাপের খোঁজ খবর রেখে থাকে তাহলে কখনো আমার ওপর বদলা নিশ্চয়ই নেবে। নিরস্ত্র অবস্থাতেই। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, ওদের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট খুবই দড়।

আবার যাব সারাণ্ডাতে। ল্যাণ্ড অব সেভেন হানড্রেড হিলস-এ। বার বার যাব। যতদিন না, হাজারিবাগ-পালামৌর মতোই পরিপূর্ণভাবে জানছি এই জঙ্গলকে।

কলকাতা
অপর্ণাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি ছ-বছর হল চিনি। ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা নিয়ে ডাবর কোম্পানির প্রদীপ বর্মনের সুপারিশে ও আমার কাছে প্রথম আসে। তখনও মুকুল শর্মার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়নি, কিন্তু সঞ্জয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

আমি ওর স্তুতিকার হয়েছিলাম প্রথম মানিকদার সমাপ্তি দেখে। তিনকন্যায় সমাপ্তি। তখন সত্যজিৎ রায়ও আমার কাছে একটি নামই ছিলেন। যদিও বড়োবউদির আত্মীয় হিসেবে দেখেছি তাঁকে, আমার বিয়ের সময় থেকেই ঋতুদের বাড়ির সমস্ত অনুষ্ঠানে।

 অপর্ণার (রীণার) সঙ্গে আলাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিতুদার সঙ্গে আলাপ হল, যখন প্রথমবার নিউ আলিপুরের ভাড়াবাড়িতে খেতে নেমন্তন্ন করল ও। চিতুদাকে আমার দারুণ লেগেছিল। আপাদমস্তক ব্রাহ্ম, পন্ডিত এবং রসিক ভদ্রলোক। হুইস্কির ভক্ত এবং সমঝদার। মেয়েকেই বেশি নম্বর দেব না বাবাকে, ভেবে পেলাম না!

 চিদানন্দ দাশগুপ্ত ও সত্যজিৎ রায় খুব বন্ধু, একথা আগেই জানতাম। কিন্তু চিতুদার সঙ্গে আলাপিত হওয়ার পরে চিতুদার মিষ্টিব্যক্তিত্ব ও পান্ডিত্যের কাছাকাছি এসে দুই বন্ধুর সম্বন্ধে খুবই শ্রদ্ধাশীল হয়েছিলাম। মানিকদার সঙ্গে চিতুদার তফাত হচ্ছে এই যে, মানিকদার কাছে বসে থেকেও কাছে যাওয়া যায় না, চিতুদার দূরে থেকেও কাছে যাওয়া যায়। অবশ্য যেকোনো অতিব্যস্ত লোকের পক্ষেই একটি দূরত্বের নিৰ্মেক গড়ে তোলা নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই প্রয়োজন। অতিব্যস্ত না হলেও কেবলমাত্র ব্যস্ত বলেই, একথা অবশ্যই বুঝি। দুঃখের বিষয় এই যে, একথা কম মানুষেই বোঝেন বুঝতে পারি।

রীণা, নিউ আলিপুরের বাড়িতেই নেমন্তন্ন করে প্রথম সরষে-মুরগি খাওয়ায়। সে পার্টিতেচিতুদা-বউদি, টিটো (দীপংকর দে) এবং রীণার অন্যান্য কয়েকজন বন্ধু ও মুকুলও এসেছিল।

এরপর আর একবার গেছিলাম দোলের দিন ওদের নেমন্তন্নে, যখন মে-ফেয়ারের ওনারস কোর্ট-এ ওরা একটা ছোটোফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত বিয়ের পর। গোপা দারুণ গান গেয়েছিল। এবং আমার খারাপ গান।

তারও পর একাধিকবার আলিপুরের ফ্ল্যাটে। রীণা-মুকুলের ফ্ল্যাটের বাইরে ইলেকট্রিক কলিং বেল ছিল না। একটা ঘণ্টা ঝুলোনো থাকত। সেই ঘণ্টা বাজিয়ে লোক ডাকতে হত।

ঘণ্টাটা এখনও আছে।

ওদের ফ্ল্যাটের উলটোদিকেই ছিল প্রীতীশের ফ্ল্যাট। প্রীতীশ নন্দী। আর এক সেলিব্রিটি।

অপর্ণার ইংরিজি, বাংলা এবং সংস্কৃতের জ্ঞান দেখে আশ্চর্য হতাম। একবার সস্ত্রীক এফ জে জিলানিকে নিয়ে গেছিলাম ওর কাছে ফিলমের আলোচনা করতে। জিলানি তখন এখানের সিনেমা সার্কেল-এর কমিশনার ছিলেন এবং নানা ম্যাগাজিনে, সানডে, ডেবোনেয়র ইত্যাদিতে ফিলম সম্বন্ধে লিখতেন। জিলানির সঙ্গে রীণা ঘণ্টাখানেক ফিলমের ওপরে যে আলোচনা করেছিল ইংরিজিতে, তাতে ওর ইংরিজি উচ্চারণ, ছবি সম্বন্ধে অসাধারণ জ্ঞান ও শব্দচয়ন আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

 জিলানির ইংরিজি ও চলচ্চিত্র সম্বন্ধে জ্ঞানও অনেকের কাছেই সুবিদিত ছিল। যাই-ই হোক, এতদিন অসাধারণ ভালো অভিনেত্রী, সাহিত্যানুরাগী এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, এই সমাজ এবং সমাজের লোকজন সম্বন্ধে ওর যে-প্রচ্ছন্ন ঘৃণা-মেশা উদাসীনতা ছিল তা, আমাকে মুগ্ধ ও খুশি করত। খোলস ও মুখোশ-সর্বস্ব এই সমাজকে না-মানতে পারলে খুশি হয় অনেক লোকই। কিন্তু সমাজকে অখুশি করতে চাওয়ার পেছনে যে-সাহসের প্রয়োজন তা, অনেকেরই থাকে না। ওর মধ্যে এই আশ্চর্য চাপা নিষ্ঠুরতাও দেখতে পেতাম–যার কারণ, হয়তো একান্তই ওর ব্যক্তিগত। সেই নিষ্ঠুরতার কোনো আভাস, আমার সঙ্গে ওর নিতান্তই বহিরঙ্গ সম্পর্কে কখনো এসে পৌঁছোয়নি। আমার অনুভূতি দিয়ে তা বুঝতে পারতাম। ওর মতো এমন আত্মবিশ্বাসী, আত্মবিলাসী বাঙালি মেয়ে আর দেখিনি।

মুকুল-রীণা তারপর একদিন ম্যাকলাস্কিগঞ্জে আমার কটেজে গেল বেড়াতে। তারপর আমার বাড়ি যদি কখনো বিক্রি করি, তাহলে ওদের যেন বলি, একথা বলে গেল ওখান থেকে ফিরে। তারপর হঠাৎ-ই বাড়ি বিক্রি করা মনস্থির করাতে বাড়িটা ওদেরই বিক্রি করে দিই।

 রীণার সঙ্গে বিশেষ কথা বা দেখা হত না ইদানীং। ট্যাক্সের ব্যাপারে মুকুলই যাওয়া-আসা করত। অনেকদিন যাওয়াও হয়নি ওদের বাড়িতে। সম্পর্কটা আস্তে আস্তে মক্কেল-উকিলের সম্পর্ক হয়ে উঠছিল। চিতুদা দিল্লিতে চলে গেছিলেন। SPAN-এর সম্পাদক হয়ে যাওয়ার পর ওঁর কোনো আত্মীয়ার ট্যাক্স সংক্রান্ত ব্যাপারে দু-তিন বার চিঠি লিখেছিলেন। তারপর কোনোই যোগাযোগ আর ছিল না।

ঠিক তখনই একদিন মুকুল ফোন করল 36, Chowrangee Lane দেখতে যাওয়ার নেমন্তন্ন করে। অত শর্ট নোটিশে যাওয়া হল না। পরে একদিন দুটো টিকিট পাঠাল ইভনিং শোর, শুক্রবারের। সেদিনও টিকিট নষ্ট হল। অফিস থেকে কিছুতেই সাড়ে সাতটার আগে বেরোতে পারলাম না।

পরে, নিজেই টিকিট কেটে দেখতে গেলাম এক শনিবারে।

ছবি দেখলাম। রীণাকে গভীরভাবে ভালো লাগত ওর মুখশ্রী এবং নানা গুণের জন্যে। কিন্তু ছবিটা দেখে, সেই ভালোলাগাটা হঠাৎ-ই শ্রদ্ধাতে গড়িয়ে গেল।

বহুদিন এত সুখমিশ্রিত দুখানুভূতিতে আপ্লুত হইনি বলেই মনে হল। ওর ছবির নানা রিভিউ নানা কাগজে পড়েছিলাম তার আগে। কিন্তু ছবি দেখে মনে হল, পূর্ণেন্দুর মতো ফিলম লাইনের অসাধারণ লোকেদের চোখেও কতগুলো সাধারণ ছোটোখাটো জিনিস পড়েনি। পড়লেও, অন্তত তাঁদের সমালোচনাতে তা প্রকাশিত হয়নি।

জেনিফারের অভিনয় যে ভালো, সে তো কিণ্ডারগার্টেনের ছেলেও বলবে, কিন্তু ছবিতে ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক হিসেবে টি-টি বা অন্যান্য পাখির একলা স্বর, জেনিফার ডেভিডের সম্পর্কের ফ্ল্যাশব্যাক; ব্রাইডাল রোব-পরা জেনিফারের স্বপ্নের বাড়ি পেরিয়ে কফিনের কাছে। পৌঁছোনোর সেকোয়েন্সের মাধ্যমে যে অকৃতজ্ঞ, নীচ, খল ও ভন্ড মানসিকতাসম্পন্ন অল্পবয়েসিদের অপর্ণা বিধৃত করেছে তা হয়তো ওদের প্রজন্মের যথার্থ প্রতিফলন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সকলেই নিজেকে সুন্দর দেখে, কিন্তু আয়নায় নিজেদের যথার্থ প্রতিফলন ফেলতে ও তা দেখে তা পূর্ণপ্রতিফলন করতে বুকের জোর এবং নিজের ওপর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। জেনিফারের ভাই-এর অভিনয়ও অসাধারণ। ধৃতিমান এবং দেবশ্রীর চরিত্রে অভিনয়ের কিছু ছিল না। তাই, তাদের অভিনয়ের মূল্যায়ন এই ছবিতে করা অপ্রাসঙ্গিক।

আশ্চর্য সুন্দর ছবি। এই কলকাতা শহরকে বড়ো ভালোবেসে, বুকে জড়িয়ে ধরে করা ছবি। প্রায় নিখুঁত। বহু ভালো ছবি দেখার পরও যখন হল থেকে বেরিয়েছি তখন নানা লোককে নানা বিরূপ কথাও বলতে শুনেছি। কিন্তু ৩৬, চৌরঙ্গি লেন, দেখে বেরোবার পর, কারো মনে কোনো কথা ছিল না। প্রথমবার সমুদ্র অথবা হিমালয় দেখে মানুষ যেমন স্তব্ধ হয়ে যায় বিস্ময়ে, মুখে কথা সরে না একেবারে; তেমন অবস্থা। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, একেবারে সামনে বসে যাঁরা ছবি দেখলেন, যাঁদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ইংরেজিও জানেন না, তাঁদের মুখেও কোনো কথা নেই। অপর্ণার সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার এই-ই। এর চেয়ে বড়ো কোনো পুরস্কার, কোনো শিল্পী আশা করতে পারেন?

ছবির খুঁত বলতে আমার যা মনে হয়েছে, অবশ্য আমি ফিলমের কিছুই বুঝি না, সাধারণ দর্শক হিসেবে, তা এই-ই

১। পুরোনো গ্রামোফোনটা বারংবার সিম্বল হিসেবে ব্যবহার করায় সিম্বল হিসেবে তার ধার ভোঁতা হয়েছে।

২। বাথরুমে বেড়াল খোঁজার সময় ব্রেসিয়ার-পরা দেবশ্রীর ব্লাউজের হাতার মধ্যে হাত ঢোকাতে বড্ড বেশি সময় লেগেছে। এইরকম নিখুঁত ছবিতে এ, একটু খুঁত। সময় কেটে যায় এতে।

৩। ঝড়ের বিকেলে জেনিফার স্কুল থেকে ফিরে এসে যখন দেখলেন দরজা খোলা, তালা ভাঙা এবং শুকনো পাতা ঝরনার পাতা তোড়ে ঢুকছে ঘরে সেই পুরোদৃশ্যটি যথেষ্ট লাউড এবং প্রোলোঙ্গড এবং ইমপ্র্যাকটিকেবল বলে মনে হয়েছে। অত উঁচুতলার ফ্ল্যাটে অত রাশি রাশি ঝরাপাতা আসা বস্তুত অসম্ভব। অতটুকু ফ্ল্যাটে তালা-ভাঙা দরজাটা অমন বিকট শব্দ করলে অতক্ষণ ধৃতিমান-দেবশ্রীর পক্ষে না শোনা এবং অতখানি দায়িত্ব জ্ঞানশূন্য হওয়াও অসম্ভব ছিল, শারীরিক সান্নিধ্যে তারা যতই ঘনিষ্ঠ থাকুক-না কেন।

৪। চুরি করা, প্রিমারিটাল লাভ-মেকিং-এ যে-উত্তেজনা, আবেগ এবং রক্তচাপ বৃদ্ধি ঘটার কথা ছিল, তার কিছুই ফোটেনি ধৃতিমান এবং দেবশ্রীর অভিনয়ে। সপ্রতিভতাই অভিনয়ের একমাত্র গুণ হতে পারে না। অভিনেতাকে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে ভেঙে গড়তে হবে। সপ্রতিভ অভিনেতা অপ্রতিভ হতে পারলেই অভিনয়ের মান বাড়ে।

৫। ৩৬, চৌরঙ্গি লেন গলিতে জর্জদার গান একেবারেই বেমানান। কোনো হিন্দি ফিলমের গান অথবা সস্তা ইংরেজি গান বাজানো উচিত ছিল।

৬। পার্টি-সিনটি আর্টিফিশিয়াল বলে মনে হয়েছে। বড় সাজানো। যাই-ই হোক, অপর্ণাঅসাধ্য-সাধন করেছে। ঋতু গুহর গলাতে একী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ গানটি সুরুচির পরিচায়ক বটে কিন্তু ওই ধরনের পার্টিতে রবীন্দ্রসংগীতের কি মান বাড়ে?

একথাও বলব যে, তবে প্রথম উপন্যাসেরই মতো প্রথম ছবিতে সফল হওয়া খুবই সহজ এবং স্বাভাবিক। অপর্ণা কত বড়ো নির্দেশক তা প্রমাণ হবে ওর দ্বিতীয় ছবিতে। যে-ভুল অনেক বড়ো বড়ো পরিচালকও করে থাকেন, আশা করি অপর্ণা সেই ভুল করবে না। বার বারই নিজের গল্প নিয়েই ছবি করবে না আশা করব। যদি প্রতিবারই নিজের গল্পে অসামান্যতা দেখাতে পারে তাহলে তাকে প্রতিভাবতী বলে অবশ্যই মেনে নেব।

শুধুমাত্র এই কারণেই সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ এবং পূর্ণেন্দু পত্রী প্রমুখকে আমি কখনো বার্গম্যান বা আন্তোনিওনি বা কুরাসাওয়ার সঙ্গে একাসনে বসাতে রাজি নই। শেষোক্তক-জন ছবি না করে, যদি শুধু লিখতেন, তাহলেও হয়তো নোবেল পুরস্কার পেতেন।

ফিলমিওয়ালারা মনে করেন ছবিই সব। যাঁরা ভালো ছবি করতে পারেন, তাঁরা ইচ্ছে করলেই ভালো লিখতেও পারেন। কিন্তু যাঁরাই একটু-আধটু লেখালেখি করেন, তাঁরাই জানেন যে, কোনো কিছুই চালাকি করে হয় না। ভালো ছবি যেমন হয় না একরাতের সাধনায়, ভালো লেখাও হয় না। লেখা বা গান এসব ফিলম মেকিং-এর চেয়ে অনেক নিকৃষ্ট শিল্প এমন একটা জিগির এই সস্তা, মেকি ও জনগণের দাবির দিনে ধীরে ধীরে সোচ্চার হচ্ছে বুঝতে পারছি। অন্যান্য দেশে বৈজ্ঞানিক ও ইলেকট্রনিকসের উন্নতির কারণে ফিলম হয়তো অনেকখানি জায়গা নিয়েছে তবে আমার মনে হয় সাহিত্য ও গান, ফিলমিওয়ালাদের দয়া দাক্ষিণ্য ব্যতিরেকেই, তাদের নিজগুণেই সময়-এর পরীক্ষায় কৃতকার্য হবে।

এ দেশে তো নিশ্চয়ই হবে।

শিল্পে, কেউ কারো চেয়ে ছোটো বা বড়ো নয়।

 যে শিল্প বা শিল্পীকে ছোটোচোখে দেখে বা দেখেন তাঁর নিজের শিল্পগুণ ও শিল্পীগুণ সম্বন্ধে করুণা প্রদর্শনের কারণ আছে। এবং আমার এই বিশ্বাস, চিরদিনই একই থাকবে।

.

০৭.

প্যাহেলগাঁও
কাশ্মীর

অবশেষে কাশ্মীরে আসা হল। সপরিবারে। আদর্শ স্বামী এবং বাবার মতো।

শ্রীনগরে নেমেই ভালো লাগে। কোনোরকম সন্দেহই থাকে না যে, অন্যরকম একটা জায়গায় এসেছি। চিনার আর পপলার। আপেল, উইলো, জাফরানের খেত, সুন্দরীর ঘন, চাপ চাপ অনুলোমের মতো মসৃণ, পেলব, নয়নভুলানো সবুজ ঘাস দিকে দিকে। মধ্যে এই। আর চারদিকে মাথা উঁচু বরফাবৃত পর্বতমালা। একদিকে গুলমার্গ রেঞ্জ, বড়োমূলা; অন্যদিকে চলে গেছে প্যাহেলগাঁও, অমরনাথের পথ। অপরদিকে বানিহাল পাস।

শ্রীনগর ছাড়িয়ে প্যাহেলগাঁও-এর দিকে কিছুটা যেতেই প্রাচীন পপলার শ্রেণির মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া সোজা পথের দু-পাশে ক্রিকেটের ব্যাটের কারখানা। প্যাহেলগ্রামের কাছাকাছি আসতেই যা সবচেয়ে বেশি চোখ ও মন কাড়ে তা লিডার নদী ও তার উপত্যকা।

মেঘ করেছে। লিডার নদী তার এলেবেলে করে বইয়ে-দেওয়া শরীর ঘাসের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোনো গাঁওয়ালি কাশ্মীরি মেয়ের মতো খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। লাল ঘোড়ার বাচ্চা চড়ছে উইলো গাছের ছায়ায় নদীর দু-পাড়ের মাঝের নরম ঘাসে। উপত্যকা, দূরের বরফঢাকা পাহাড়, মেঘলা আকাশ, বয়ে যাওয়া বহুধা-বিস্তৃত অগভীর, চপল অথচ সংযমী নদীর রূপ মিলেমিশে এমন এক ছবি হয়েছে, যা পৃথিবীর খুব কমপ্রান্তেই দেখেছি।

আমার মতে, লিডার ভ্যালির কোনো তুলনা নেই পৃথিবীতে। অন্তত আমার দেখা পৃথিবীতে; যার মধ্যে পৃথিবীর অনেক মহাদেশই পড়ে, আফ্রিকাসুদ্ধ।

প্যাহেলগাঁও-এ দিন কয় থাকলে তবেই জায়গাটা এবং তার চারপাশ ভালো করে দেখা যায়। আমাদের হোটেলের সামনেই দু-দিক থেকে আসা দুটি নদী কত যে, ভাগে ভাগ হয়ে বয়ে গেছে। সেই দিকে তাকিয়ে সারাদিন বসে থাকা যায়। বাঁ-দিকের নদীটি লিডার। ডান দিকের নদীটি এসেছে অমরনাথের পাহাড় থেকে, নাকি শোনমার্গ থেকে। অমরনাথের পথে চন্দনবাড়ি যেতে, পথে, সেই নদীটির শোভা মনকে বিবাগি করে দেয়। মনে হয়, চিরদিনের জন্যে এখানেই থাকি এসে। একটা জায়গাতে নদীটি একটা ফাঁসির লুপের মতো হয়েছে। চন্দনবাড়ির উঁচু পথ থেকে নীচে নদীটা আর সবুজ উপত্যকার দিকে চেয়ে মনে হয় চাঁদনিরাতে জিন-পরিরা ওখানে নিশ্চয়ই খেলতে নামে। এমন জায়গাতে পরিরা না খেলবে তো কোথায় খেলবে তারা?

সারাদুপুরে কাঁসা-রোদে ঘোড়ারা চরে বেড়ায়, সৃষ্টির প্রথমে তাদের যে স্বাধীনতার অঙ্গীকার বিধাতা করেছিলেন, পরে স্বার্থপর মানুষ যে-অধিকার কেড়ে নেয়, সেই প্রাচীন প্রমত্ত অধিকারে। ওখানে দাঁড়িয়ে নীচের নদী ও উপত্যকার দিকে চাইতেও ভয় করে, পাছে চোখের ছোঁওয়াতেও তাদের সৌন্দর্য কলুষিত হয়, অপার্থিব, স্বর্গীয়, পেলব উপত্যকার গায়ে ব্যথা লাগে।

চন্দনবাড়ির বরফের ব্রিজ। যাওয়ার পথে বরফের ওপর দিয়ে ঘোড়াতে যাওয়া। কতগুলো সংকীর্ণ জায়গা পেরোতে হয় গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে। মা এবং দুই মেয়ের ভালো লাগে। আমার ভয় লাগে।

চন্দনবাড়ির পথে প্রায়ই হাঁটতে যেতাম। দোকানি বন্ধু হয়েছিল। ওদের মাটির উনুনে বানানো সেঁকারুটি, কাশ্মীরি লালচে-নোনতা চা এবং গড়গড়া-কাম-কোর তামাক খেতাম। ওদের তামাক পাইপে ভরে দেখলাম, খেতে মন্দ লাগে না। কিন্তু গড়গড়ার তামাকের মতোই বড়ো আঠা-আঠা। পাইপে ভরলে, পাইপ ধরে না।

ওদের কবরের ওপরে রাশ রাশ সাদা পপির মতো নার্সিসাস ফুটে থাকে। নার্সিসাসই তো!

নদীর জল বয়ে যায় কুলকুল করে দোকানের সামনে দিয়ে, ঘরের পাশ দিয়ে, বাজারের মধ্যে দিয়ে। বছরের সাতমাস বরফ চাপা থাকে আর পাঁচ মাস প্রকৃতি ফ্রিজ থেকে বের হয়ে এসে তার রূপের জেল্লা দেখায় এখানে।

শীতকালে, চারদিকে বরফ, শুধুই বরফ। ঘোড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমোয়। গরমে জড়ো করে রাখা শুকনো ঘাসপাতা খায়। মানুষ পশ্চাৎদেশের নীচে কাঙরি রেখে বসে বসে হুঁকো খায়, শাল বোনে, উল বানায়, ঝগড়া করে আর স্ত্রীদের অকাতরে গর্ভবতী করে। কাজ নেই তো, খই ভাজ। খই ফুটে বাচ্চা হয় নির্বিবাদে সবুজ উষ্ণতায়।

গোলবাবার দোকানে গিয়ে বেজায় গোল বাধল। ব্যবসায়ীমাত্রই ভালো কথা বলেন। এবং সেটা জানা সত্ত্বেও সেই ব্যবসায়ীর কাছে ঠকাটা মূর্খামি। ছুটিতে গেলেই আমার যেটুকু-বা বুদ্ধি আছে তা শ্লথ ও ভোঁতা হয়ে যায়, আমার মুখের চেহারারই মতো। লাভের মধ্যে পাওয়া খেলাম। দারচিনি, এলাচ, বাদাম ইত্যাদি দিয়ে বানানো। ঠাকুমার পাঁচনের মতো। ফাস্ট ক্লাস ওদের চা।

কাশ্মীরিরা বাঙালিদের মতোই ভাত খেতে ভালোবাসে। শ্রীনগর উপত্যকাতে যে-চাল হয়, তা গোল গোল, মিষ্টি খেতে। তবে আজকাল সার এবং কৃত্রিম সার পড়ে আদি স্বাদের সর্বনাশ হয়েছে। গোস্তাবা খায় ওরা। বিরিয়ানি, পোলাউ, দই-মাংস। খেতে এসব বিশেষ আহামরি নয়। এর চেয়ে আমাদের উত্তর ভারতীয় মুসলমানদের রান্না অনেক ভালো। আহস রেস্তরাঁতে ভালো কাশ্মীরি খাওয়া পাওয়া যায় শ্রীনগরে।

এখন চেরির সময়। ছোটো চেরিগুলো বেশি মিষ্টি। ডাবল চেরি টক। তবে তাড়াতাড়ি পচে যায় না। শ্রীনগরের চশমাশাহি (ফাউন্টেন অফ দ্য শাহ), নিষাদ বাগ, শালিমার এই তিন বাগান দেখার মতো। হজরতবালের লালচে-সাদা পাথরের মিনার আর গম্বুজ দেখার মতো। বোধ হয় স্যাণ্ডস্টোনের। চার চিনার ডাললেকের মধ্যে। চারটি চিনার গাছ। ডাললেকের পাশে বুলেভার্ড। যুবরাজ করণ সিং-এর বাড়িতে ওবেরয় প্যালেস হোটেল। থাকবার মতো নয়। বড্ডই খরচ।

হাউস-বোটের জীবন চমৎকার।

সোহিনি, সুলতানের সঙ্গে বসে মাছ ধরত, ছেড়ে দিত আবার। শিকারা করে ফুল, ফল, স্টেশনারি বিক্রি করতে আসত। সন্ধে বেলা যখন আলো জ্বলে উঠত বোটে-বোটে, উলটোদিকের আরবদের  ডিক্স বোটে লাল নীল আলোর মালা দুলত, আর সেই মালার ছায়া কাঁপত জলে। তখন মনে হত আরব্য রজনির কোনো গল্পই জীবন্ত হয়ে উঠল বুঝি-বা।

উইলো গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছায়াচ্ছন্ন সংকীর্ণ জলপথে শিকারায় বেড়ানো এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। ফর্সা, সুন্দর, সাদাটে লাল উলঙ্গ ছেলেরা জলে চান করছে, সাঁতার কাটছে, হাঁস প্যাঁক-প্যাঁকাচ্ছে, তরুণী হাউসবোটের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাসন ধুচ্ছে, নৌকার ঘরে বসে সাদা-দাড়ি-বুড়ো তামাক টানছে। এক আশ্চর্য সুন্দর সচল ছবি।

আরও এগিয়ে গেলে ভাসা-বাগান। বাগান চুরি হয়ে যায় এখানে মাঝে মাঝেই। নৌকা চালিয়ে দড়িতে বেঁধে অন্যত্র নিয়ে চলে যায়। সাদা ধবধবে শিকারা– সাদার ওপর লাল অথবা নীল অথবা হলুদ কাজ করা শিকারা। আর রঙিন শিকারার তো কথাই নেই।

ডাললেকের জল তত গভীর নয়। যে-দিকটা খোলা, সেই দিকটার জল অবশ্য ব্যতিক্রম। কিন্তু নাগিন লেকের জল গভীর। ওয়াটার-স্কিয়িং, সুইমিং এবং বোটিং করে সকলে এখানে।

কাশ্মীরিদের হাতের কাজ দেখবার মতো। পার্সিয়া থেকে গালচে, পেপার-মেশি (ফরাসি দেশে হয়) এবং কাঠের কাজের তুলনা নেই। আখরোট, পাইন, পপলার চিনার সব গাছের কাঠ দিয়েই কিছু না কিছু তৈরি হয়। আমার মনে হয়, বছরের বেশির ভাগ সময়ই বরফে ঢাকা থাকে বলে ঘরের মধ্যে বসে যেসব কাজ করা যায়, সেইসব কাজের উৎকর্ষ হয়েছে এখানে। সূচিশিল্প, ছুতোরের কাজ, গালচে বোনা সবকিছুই।

শাহতুষ-এর শাল ও মলিদা এখন কম পাওয়া যায়। ইগলের মতো একরকমের বড়ো পাখি পাওয়া যায় তিব্বত এবং লাডাক-এ। সেই পাখিগুলোর গায়ে এমন কিছু শক্তি হঠাৎ জেগে ওঠে বিদ্যুতের মতো যে, তারা যে-কাঁটাগাছে বসে, সেই কাঁটাগাছে তাদের নোম আটকে যায়। সেই লোম কুড়িয়ে কুড়িয়ে এনে তা থেকে শাহতুষ হয়। তিব্বত চীনারা নিয়ে নিয়েছে। লাডাকেও যে পাখি আছে তার সংখ্যা সামান্য। শিকারিরাও আগে আগে, এ শাহতুষের জন্যে শিকার করে সেই পাখি শেষ করে দিয়েছে। শাহতুষ যতই কম উৎপন্ন হচ্ছে ততই তার দাম বাড়ছে। বাবার একটি শাহতুষের আলোয়ান আছে! সেইটির মতো একটির দাম আজকে কম করেও দু-লাখ টাকা।

পেপার-মেশি ও কাঠের কাজও দেখার মতো। পেপার মেশির কাজ তো দু-হাজার বছর অবধি থাকে। বুড়ো বুড়ো কারিগর তাদের নিজেদের তৈরি ভেষজ রং-এ কাগজের মন্ডের ওপরে যে কত কী কারুকাজ করে তা বলার নয়। এইসব রইসি জিনিসের কদর করার মতো লোক আজকাল কমে গেছে। ভারতবর্ষে বড়োলোক অনেক আছেন কিন্তু আজকালকার বড়োলোকদের কৌলীন্য নেই সেই অর্থে। টাকার প্রকৃত ও যথার্থ ব্যবহার যাঁরা জানেন না, টাকা তাঁদেরই হাতে এসে জমা হয়েছে।

 গুলমার্গ এলাম তানমার্গ হয়ে। ছোট্ট জায়গা। হাইল্যাণ্ড পার্ক হোটেল আর নেডুস হোটেল। নেডুসের চারদিকে গলফ লিঙ্কস। গুলমার্গের সৌন্দর্যই আলাদা। বরফের জন্যে। পাইন গাছ। ছোটো ছোটো সাদা রোঁয়ার ফুল। সোহিনি উইশ করত। ড্যাণ্ডিলিয়ন পাইনের কোণ। নির্জনে কটেজ। আর্মির হেলিকপ্টার নামত রোজ নীচে। বোধ হয় ব্রিগেডিয়ার বা ফুল-কর্নেলকে নিয়ে যেত ওপরে। প্রায়এক-শো বছর আগের হোটেল–পাইন কাঠের-হট ওয়াটার বটল–ক্রুড রুম হিটার, প্লাস ইলেকট্রিক হিটার। ভেড়ার মাংস।

খিলানমার্গ। সর্দারজিদের ধাবা। জমে যাওয়া নদীতে বেদনাদায়ক স্লেজ আরোহণ। কাঠের ডাণ্ডার ব্রেক। দুর্গন্ধ চালক। নাক ভাঙার অতীব সোজা রাস্তা। ঘোড়ার চাঁট। খাইনি। খেতে নিশ্চয়ই উপাদেয়।

শিকারা করে নতুন শ্রীনগর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা লোমহর্ষক। ব্রিজগুলোর নীচে বিপদ। চান করার কাঠের ঘর। সিঁড়ি দু-পাশে। ঝিলম নদী। নৌকার জীবন। বড়ো নৌকার গুনটানা। শিকারায় তিনজন দাঁড়ি। তাও ডোবো ডোবো।

রাতের বেলা ডাললেকে শিকারাতে।

 ছাদের বাগান। ছাতা, ইজিচেয়ার, অলস দিন, ছুটি, ছুটি, ছুটি।

 পরের কাজ থেকে ছুটি, নিজের কাজ থেকে ছুটি; নিজের কাছ থেকেও ছুটি।

.

০৮.

বাংরিপোসি
ওড়িশা

এবারে পুজোর পর, বর্ধমানের বিখ্যাত ডাক্তার শৈলেন মুখার্জির ছেলে কাজল মুখার্জি, বীরভূমের আদুড়িয়া বনবাংলো বুক করেছিলেন আমার জন্যে।

কনসার্ভেটর, দার্জিলিং-এর বর্ধন রায় সাহেব বুক করেছিলেন খুঁটিমারি ও চাপড়ামারি। কিন্তু শেষমুহূর্তে যাওয়া হল না। সোনাইয়ের বাবার শরীর খুবই খারাপ হল। হায়দরাবাদে ট্রাঙ্ককল করে সোনাইকে আনিয়ে নিউ আলিপুর পৌঁছোলাম।

অষ্টমী ছিল সেদিন। মনোজকে সঙ্গে নিয়ে আদুড়িয়াতে গরমের মধ্যে অতিখারাপ রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে গিয়ে ও শেষে আউশগ্রাম ও গুসকরা হয়ে ফিরেই আসতে হল সিঙ্গুর। পূর্ণর ডেরায়। সিঙ্গুরে সিদ্ধির শরবত আর খিচুড়ি খেয়ে শুয়ে থাক, পরদিন একেবারে ভাঙা-মনে ফিরে এলাম কলকাতাতে।

আদুড়িয়ার জঙ্গলকে জঙ্গল বলে না। জঙ্গল না-থাকলেও ক্ষতি ছিল না, যদি জায়গাটা নির্জনও হত। সামনেই ধানখেত।–একটা গর্তের মধ্যে বাংলোটা। কাজলের দোষ নেই। তার আন্তরিকতার অভাব ছিল না। দোষ বাংলোটার। এবং জঙ্গল সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতার।

মনের দুঃখে দু-দিন শুয়ে থেকে কলকাতায়, জোর করেই বেরিয়ে পড়লাম বিজয়া দশমীর পরদিন ভোর বেলা গাড়ি নিয়ে। মনোজকে সঙ্গে নিয়ে, নিরুদ্দেশ যাত্রায়।

বারিপদাতে গেলাম প্রথমে। কিন্তু শুনলাম, ওড়িশাতে অফিস-কাছারি নাকি বন্ধ লক্ষ্মীপুজো অবধি। ভেবেছিলাম ডি এফ ও সাহেবের সঙ্গে দেখা করে কোনো জঙ্গলের বাংলোর রিজার্ভেশন করে নেব। তাও হল না।

হাইওয়েতে, পথে একটি ধাবাতে রুটি-তড়কা খেয়ে নিয়ে চলে এলাম বাংরিপোসিতে। সেখানে এখন বড় করে ওড়িশা ট্যুরিজম-এর বোর্ড লেগেছে। মাউসীর সঙ্গে দেখা হল। সে জানত না যে, তাদের বাংরিপোসির দু-রাত্তির কত বিখ্যাত করে দিয়েছে।

ওই বাংলো কলকাতার কোন লোক পনেরো তারিখ অবধি রিজার্ভ করে টাকা পাঠিয়ে রেখেছিলেন। তাই মাউসী বলল যে, সন্ধে বেলার আগে বাংলো খোলা যাবে না। ওঁরা না এলে খুলে দেবেন। তাই ভাবলাম, সময়টুকু অন্যত্র কাটিয়ে আসি।

 যখন বিসোইর দিকে যাচ্ছি, তখন পথে দেখা হল বাংরিপোসির দ্বিতীয় চৌকিদার গুরবার

সে বলল, কলকাতার বহুলোক এসে তাদের কথা জিজ্ঞেস করেছে, বাংরিপোসির দুরাত্তির বই পড়ে।

ওকে মুরগা কেনার টাকা দিয়ে, ঘাট পেরিয়ে, বিসোইতে চলে গেলাম।

বিসোই ইন্সপেকশন বাংলোটিও সুন্দর। তবে আমার বাংরিপোসি বেশি ভালো লাগে। বিসেই জায়গাটিকে অবশ্য খুবই ভালো লাগে। এত ভালো খুব কম জায়গাকেই লাগে। এখানে জমি পেলে একটি ছোট্ট বাংলো বানাতাম।

বিকেলে বিসোই থেকে ফিরে এলাম বাংরিপোসিতে।

আগামীকাল লক্ষ্মীপূর্ণিমা। চান-টান করে বাংলার বারান্দাতে বসলাম। আকাশে মেঘ ছিল। সামান্য বৃষ্টি হল। তারপর চাঁদ উঠল। বাংলোর সামনে বড়ো অশ্বত্থ গাছটা এবং ক্ষীরকুঁড়ি গাছ এবং অন্যান্য গাছ থাকায় জ্যোৎস্না ভালো পড়ে না। তাই গাড়ি নিয়ে বাংরিপোসির ঘাটের ঠিক নীচে গাড়ি দাঁড় করিয়ে মনোজের সঙ্গে হুইস্কি খেলাম।

এখন হাতির ভয় খুব। ধান পেকে এসেছে প্রতি খেতে খেতে, উপত্যকায় আর মালভূমির মাইলে মাইলে। প্রতিখেতে লোক জাগছে গাছের ওপর মাচা করে অথবা যেখানে গাছ নেই, সেখানে ধানখেতেই, খড়ের ছোটো ঝুপড়ি বানিয়ে হাতি পাহারা দেওয়ার জন্যে। তাদের কারো গান বা বাঁশির আওয়াজ রাতচরা পাখির ডাকের সঙ্গে মিশে ভেসে আসছে দূর থেকে। নেশা লেগে যায়।

কোথায় কলকাতা! অথচ এত কাছে এইসব জায়গা কলকাতা থেকে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার তফাত।

 কলকাতার লোককে নিছক বেঁচে থাকবার জন্যেই প্রাণ, মন ও শরীরকে সঞ্জীবিত করে রাখার জন্যেই এইসব জায়গায় আসতে হবে একদিন।

 কেন যে এখনই আসেন না তাঁরা, তাঁরাই জানেন। তবে শিক্ষিত লোকেরা মাউসী ও গুরবার যা-ক্ষতি করার, তাই-ই করে চলে যান। কলকাতার এক ডাক্তার নতুন লাগানো ফ্রিজ-এর স্ট্যাবিলাইজারটি বিছানার ভেতর পুরে নাকি চলে এসেছিলেন। অনেক লোক নিয়ে গেছিলেন তাঁরা। মেয়ে-মদ্দ, বাচ্চা কাচ্চা। মাউসী দয়া করে থাকতে দিয়েছিল তাদের। কারণ, নিয়ম নেই দুজনের বেশি একঘরে থাকার।

সেই ভালো ব্যবহারের এই পরিণাম। বড়োশহরে থাকতে থাকতে বেশির ভাগ মানুষইচোর-ছ্যাঁচোড় হয়ে যায়।

ভাবলেও খারাপ লাগে।

অনেকক্ষণ সেই শিশিরে-ভেজা চাঁদের আলোয় ভিজে, নিজেকে পাখির ডাকে আর হাতির আসার সম্ভাবনার আনন্দে শিহরিত করে, ফিরে এলাম বাংলোতে।

মুরগির ঝোল আর সেই কিশা অরি পিকুর ভালোলাগার শুকনো লঙ্কা দেওয়া আলুভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে, শুয়ে পড়লাম নানা রাতপাখির ডাক শুনতে শুনতে।

অশ্বত্থ গাছের ডালে ডালে লাল ফল এসেছে। ভোরবেলাতে পাখিদের মেলা সেখানে। রোদে চেয়ার টেনে বসে ভালোবেসে পাখিদের দেখতে দেখতে বেলা অনেক হল। মনোজমাস্টার ফাস্ট-ক্লাস চা নিয়ে এসে ব্রেকফাস্টের ইন্তেজাম করতে লেগে গেল। ও স্নানও করে নিল।

আমি বললাম, চলো, ঘুরে আসি, ফিরেই করব। লক্ষ্মীপূর্ণিমার শেষবিকেলে। এখানে বড়াইপানি ফলস দেখবেন সিমলিপালের। কাল সকালের বাসে যোশীপুরে যাবেন।

ভদ্রলোক কানে শোনেন খুবই কম। বাঁ-কানে একদমই শোনেন না। শুনলাম, সমরেশ বসু। সাহিত্যিকের বাল্যবন্ধু হবেন। নাও-বা হবেন। সমরেশদাকে আমি চিনি, যশস্বী সাহিত্যিক টাহিত্যিকদের আমি সমীহ করি। দূরে থাকি। হয়তো, নিজে কখনো যশস্বী হব না বলে, যশস্বীদের সম্বন্ধে ঔৎসুক্য কম।

ভদ্রলোক বললেন, সামর্থ্য থাকলে আরও কদিন থেকে যেতেন এসব জায়গায়। মাত্র পঞ্চাশ টাকা সঙ্গে আছে তাই দিয়ে বড়াইপানি দেখতেও চান, যেখান থেকে বুড়াবালাং নদীর জন্ম।

 মনোজকে দিয়ে, আমি ওকে বললাম যে, রাতে আমাদের জন্যে খিচুড়ি হচ্ছে। মাউসী, গুরবা ওরা সকলেই খাবে; তাই উনিও আমাদের সঙ্গেই খাবেন। মিছিমিছি কেন আর শুধু শুধু পাউরুটি ডিমসেদ্ধ খেয়ে থাকবেন?

তাতে উনি বললেন, খাব। কিন্তু পয়সা নিতে হবে।

মনোজ বুঝিয়ে বলল, যে, আপনি এত বড়ো সাহিত্যিক সমরেশ বসুর বন্ধু। তার ওপর আজ লক্ষ্মীপূর্ণিমার চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। না-হয় আমাদের অতিথিই হলেন।

ভদ্রলোককে আমার প্রথম দর্শনেই ভালো লেগেছিল। ভারি প্রকৃতি-পাগল লোক। ওঁকে নিয়ে একটি গল্প লিখব কখনো। নাম দেব, বাদামপাহাড়ের যাত্রী।

উনি বললেন, যা বাব্বা, অদ্ভুত লোক তো মশাই আপনারা।

 চাঁদ, মেঘে ঢেকে গেল। আকাশ কালো করে ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি আর জলকণা ভাসানো দমকা-হাওয়া।

আমাদের সকলকে ঘরে গিয়েই বসতে হল। বৃষ্টি থামল ঘণ্টাখানেক বাদে। চরাচর উদ্ভাসিত করে চাঁদ উঠল। লক্ষ্মীপূর্ণিমার কোজাগরি চাঁদ। আমরা গাড়ি নিয়ে, ওঁকে বাংরিপোসির ঘাট দেখিয়ে আনলাম। অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের বইয়ে লেখা ছিল যে, এই ঘাটে সন্ধেবেলা গাড়িনা-চালানোই ভালো। হাতির উপদ্রব হয়। উনি জানতেন। একটু ভয়ও পেলেন। ওঁর কারণেই আমরা নীচে নেমে এসে ঘাটের কাছে গাড়ি রেখে বাইরে দাঁড়িয়ে হুইস্কি খেলাম। শুধু অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের বই কেন? ছাপার অক্ষরে যাই ই লেখা থাকে, তাই-ই মিথ্যে।

বড়ো চমৎকার পরিবেশ। হাতি-তাড়ানো মাচা থেকে গান ও বাঁশির সুর ভেসে আসছিল। জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করছিল চারদিক। একটি বাচ্চাছেলে, হাতি-তাড়ানো মাচা থেকে নেমে এল। আমার গান শুনতে আমাদের জল ফুরিয়ে গেছিল। জলও এনে দিল।

আমাদের এই সুন্দর হতভাগা দেশের পাহাড়-বনের মানুষরা এত ভালো যে, বলার নয়। এরাই আসল ভারতবর্ষ। শহরের মানুষরা কেউই নয়। তারা একশতাংশও নয়। অথচ পরোটা, আলুভাজা ডিমভাজা আর পাঁশকুড়ো থেকে আনা চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে কানচিনা বাংলোর পথে চলোম গাড়ি নিয়ে। কানচিনা বাংলো সিমলিপালের ভেতরে। রিজার্ভেশনও করতে হয় যোশীপুর থেকে। কিছুদূর পথটা ঘুঘুডাকা আর ছোটো ছোটো পুকুরভরা ছায়াঘেরা গ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়ে বুড়াবালাং নদীর কাছে পৌঁছেছে। তারপর কানচিনা বাংলোর এককিলোমিটার মতো আগে, বাঁ-দিকে এক বিরাট গভীর দহ-এর সৃষ্টি করেছে। নীল জল। সেই দহ থেকে আবার চলকে গিয়ে নদীটা বয়ে গেছে সমতলে।

 কানচিনা বাংলোর আগে ফিয়াট গাড়ি নদী পেরোতে পারে এমন উপায় নেই। স্পেশ্যাল গিয়ার না থাকলে এবং জিপ না হলে নুড়িভরা নদী ও চড়াইটার শেষভাগ পেরোনো খুবই মুশকিল।

 আমি গাড়ির কাছেই রইলাম। মনোজকে বললাম যে, তুমিই গিয়ে বাংলোটা দেখে এসো। কানচিনডাতে থাকিনি কখনো আমি। ও দুজন স্থানীয় লোকের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে দেখতে গেল। মনোজ নামেরই একটি মুণ্ডা ছেলেকে পাঠালাম। আমাদের মনোজের দেরি দেখে। সেই মনোজ, সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে আমাদের মনোজকে নিয়ে এল। মনোজ-এর সঙ্গে মনোজ-এর মনের মিল তো হবেই।

গাড়িতে জায়গা আছে দেখে একটি চামুণ্ডি-মুণ্ডা ছেলে আমাদের সঙ্গে বাংরিপোসি অবধি লিফট চাইল। সেখান থেকে বাসে করে চলে যাবে বাহালদা না মানাদা কোথায় যেন।

বাংলোয় ফিরতে ফিরতে আমাদের আড়াইটে হয়ে গেল। খেয়ে উঠতে উঠতে সাড়ে তিনটে। খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

হঠাৎ অপরিচিত কণ্ঠস্বরে ঘুম ভেঙে গেল। একজন লম্বা কালো চশমা-পরা ভদ্রলোক। দোহারা চেহারা। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। খুব জোরে জোরে কথা বলছিলেন।

গুরবা তখন ছিল না

মনোজকে জিজ্ঞেস করলেন, চৌকিদার কোথায়?

মনোজ, মাউসীর ঘর দেখিয়ে দিল ওকে।

মেয়েমানুষ দেখে, ভদ্রলোক মাউসীকে বললেন, চৌকিদার কোথায়?

 মাউসী তার ওড়িয়াতে কী বলল তা বোধ হয় ভদ্রলোক বুঝলেন না। খুব চেঁচিয়েই কথা বলছিলেন উনি। এবং দেখলাম, ওড়িয়া একেবারেই জানেন না। তাই, আমি মনোজকে পাঠালাম ওঁকে সাহায্য করতে।

ভদ্রলোক বিহারের এক ছোট্ট শহরে চাকরি করেন। তাঁর এক ছেলেও চাকরি করে। মেয়ে এখনও পড়ে। বিয়ে বাকি। রিটায়ার করবেন মাত্র তিন মাস পরে। ওঁর স্ত্রী ওঁকে বলেছেন, রিটায়ার করলে তো পেনশন-এর টাকায় আর বেড়ানো চলবে না, তাই শেষবারের মতো বেড়িয়ে এসো। উনি চাঁদিপুর ঘুরে, এখানে এসে পৌঁছোলেন। এই তাদের কথা, যারা আসল, যারা দেশের মেরুদন্ড, তাদের কথা বাংলা কাব্য-সাহিত্যে এখনও প্রায় অনুপস্থিত।

পরদিন খুব ভোরে গৌরমোহন ঘোষ, সেই ভদ্রলোক বাস ধরে যোশীপুর চলে গেলেন। আমার একটা কার্ড দিলাম ওঁকে। যোশীপুরের কনসার্ভেটর সরোজরাজ চৌধুরীকে দেওয়ার জন্যে। যাতে যাওয়ার খরচ নিজে দিলে, অন্য অসুবিধে না হয় কোনো।

দুপুরে হাট বসেছিল বাংরিপোসিতে। ঝাঁটা কিনলাম। ঘইতা পিটিবাকু ঝড়। মানে বর ঠ্যাঙাবার ঝাঁটা। সবজি-টবজি কিনলাম। লাল কন্দমূল। অমৃতভান্ড। লাল, টক ঢাঁরস! টক খাওয়ার জন্যে। কাঁসার বাসন। রুপোর বালা। আর পায়-জোর। তারপর বারিপদাতে গেলাম তেল নিতে। গুরবাকে বলে গেলাম যে, আমরা ফিরে এসে আড়াইটের সময় খাব, মাউসী যেন রান্না করে রাখে। ওকে আরও টাকা দিলাম মাছ কেনার জন্যে।

 বারিপদাতে তেল নিয়ে, চাকার হাওয়া, ব্যাটারির জল, সব চেক করে যখন বাংরিপোসিতে ফিরলাম তখন প্রায় তিনটে বাজে। ফেরার রাস্তাতে বুড়াবালাং নদী পেরিয়ে আসতে হয়। বড়ো সুন্দর নদী। ব্যাঙ্কের পাশ দিয়ে একটা রাস্তায় এককিলোমিটার গেলেও নদীটা পড়ে। বড়ো সুন্দর দেখায় নদীটা।

ফিরে দেখি, এত বেলায় রান্না কিছুই করেনি। গুরবা নাকি আড়াইটের সময় বাজার দিয়ে গেছে মাউসীকে। মাছও কেনেনি।

বড়োই অভিমান হল। আমি পৌঁছেই মাউসীকে এক-শো টাকা বকশিশ দিয়েছিলাম। তা ছাড়া, আমাদের সঙ্গে গুরবা এবং মাউসীর সমস্ত পরিবার খাচ্ছিল। তবুও ওরা এমন ব্যবহার করল। রাগ করে, না-খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেই বাংলো ছেড়ে চলে গেলাম। ভেবেছিলাম, এখানেই ছুটিটা কাটাব। হল না। অভিমান বড়ো ক্ষতি করে মানুষের। অথচ মানুষেরই অভিমান থাকে। জানোয়ারের নয়। আমি এত বড়ো ইডিয়ট যে, চিরজীবনই অন্যের ওপর অভিমান করে নিজের নাক কাটলাম।

 বিসোইতে চা-শিঙাড়া খেয়ে যখন যোশীপুরে এসে পৌঁছোলাম তখন সন্ধে হয়ে গেছে। পি-ডাব্লু ডির বাংলোতে জায়গা নেই। বললেন ওভারসিয়র। বললেন, স্টেট-গেস্টদের রিজার্ভেশন আছে।

চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম।

ইনিই সরোজরাজ চৌধুরী। সিমলিপাল টাইগার প্রোজেক্টের ডিরেক্টর। খৈরী খ্যাত। একটা হাতি সিমলিপালে খাদে পড়ে গেছিল, মুভি ক্যামেরাতে তার ছবি নিয়েছিলেন উনি, সেই ছবি দেখছিলেন তখন। আমাকেও দেখতে বললেন। তারপর ওঁর বাংলোতেই থাকতে বললেন। আমি পি ডাব্লু ডির বাংলোর কথা বলতে বললেন, ওঁরা জানেন না যে, স্টেট-গেস্টরা চলে গেছেন জঙ্গল ছেড়ে চাঁদিপুরে। উনি সঙ্গে চাহালার রেঞ্জারকে দিলেন আমাদের সঙ্গে গিয়ে পি ডাব্লু ডির বাংলো ঠিক করে দিতে।

অতএব বাংলো পাওয়া গেল।

 ওই অল্পবয়েসি স্মার্ট রেঞ্জার ভদ্রলোক আমার অনেক লেখা পড়েছেন। বললেন, প্রত্যেক শিক্ষিত ওড়িয়াই বাংলা জানেন। অথচ বাঙালিরা ওড়িয়া জানেন না। এটা লজ্জার কথা। ভদ্রলোকের স্ত্রী কলকাতায় বাংলা-মিডিয়ামে পড়েছেন। তাঁর শ্বশুরমশাই একজন ওড়িয়া লেখক। কে সি দাশ।

সরোজরাজ চৌধুরীর মতো একজন ডেডিকেটেড ফরেস্ট অফিসার আমাদের দেশে বড়ো একটা দেখা যায় না। এমন লোক দেশে অনেক দরকার। খাবারঘর-ভরতি ভাল্লুকের কলা ঝুলছে। নানারকম মিল্ক-পাউডারের কৌটো। আর বসার ঘরে ট্রাঙ্কুলাইজার গান আর ফিলম, আর কাগজ আর জন্তু জানোয়ারের লগবুক। খৈরীর ওপর উনি যা-লিখেছেন তার সাইক্লোস্টাইল্ড কপি আমাকে দিলেন। পড়বার জন্যে। খৈরীর কবর দেখালেন।

সাত-কেজি ওজন কমে গেছে ভদ্রলোকের। খৈরীর শোকে।

যোশীপুরে রাতটা কাটিয়ে সকালে আবার বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশ যাত্রায়। এমনি করে বেড়াতেই আমার ভালো লাগে, সঙ্গে মহিলা কেউ না-থাকলে। এদেশে মহিলাদের নিয়ে বেরোলে অনেক ভাবনা-চিন্তা করতে হয়। এটা দুঃখের। বাদামপাহাড় জায়গাটা ভারি ভালো। ছোট্ট স্টেশন। চল্লিশ ভাগ বাঙালি। মিষ্টির দোকানদার বাঙালি মনোজের কাছে আমার নাম। শুনে এসে আলাপ করতে এলেন। মনোজের ওপর খুব রাগ হল। সে-কথা ওকে বললামও। পরিচয় জানালেই বেড়াবার আনন্দ সব মাটি হয়ে যায়। ইনকগনিটো না থাকলে স্বাধীনভাবে ঘুরে-ঘারে সবকিছু দেখা যায় না। শোনা যায় না।

বাদামপাহাড়ে আমার পরিচয় জানাজানি হওয়াতেই আর থাকা গেল না। চলে এলাম টিরিং। তখন বেলা একটা। একটিমাত্র দোকানে আলুভাজা আর কলাভাজা (রম্ভাভাজা) দিয়ে ভাত খাব ঠিক করে বাংলোতে গিয়ে উঠেছি, এমন সময় তিন চারজন পুলিশ অফিসার এসে হাজির। তাঁরা ওখানে লাঞ্চ করতে এসেছেন, একটি খুনের কেসের তদন্ত করতে যাওয়ার আগে। সেই সুবাদেই মিস্টার মহাপাত্র আর পাধীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার গাড়িতেই গেলাম স্পট-এ। সে এক অভিজ্ঞতা। মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে একটি উপন্যাস লিখব। নাম দেব সোপর্দ।

মানুষ যে কী দেখে আমার মধ্যে, তা অন্য মানুষেই জানে।

আমি ওড়িয়া বলতে পারি দেখে ওঁরা খুব খুশি। সন্ধেবেলা মহাপাত্র সাহেব বাসে করে রাইরাংপুরে চলে গেলেন। রাতে পাধী সাহেবের অতিথি হিসেবে ওই বাংলোতেই মুরগির মাংস এবং পরোটা দিয়ে ডিনার সারা হল চাঁদের আলোতে টেবল লাগিয়ে। তার আগে একটু রাম খাওয়া হল সকলে মিলে।

খাওয়ার পরে গাড়ি নিয়ে রাত দেড়টা অবধি হাতি দেখার জন্যে মাকড়িঘাটি এবং বিহার বর্ডার অবধি ঘুরলাম। দেখা গেল না।

 মাতাজির ঘর আছে বিহার বর্ডারের কাছে। তাঁর যুবতী মেয়ে কলকাতাতে এম বি বি এস পড়ে। সেও তখন আশ্রমে ছিল।

পরদিন দেখা করতে গেছিলাম মাতাজির সঙ্গে। তাঁর চেহারায় ও কথাবার্তায় অসাধারণত্ব কিছুই চোখে পড়ল না। মেয়েটিকে দূর থেকে দেখলাম। কাছে যখন গেলাম, তখন ঘরের মধ্যেই রইল। হয়তো আমার ডাকাতের মতন চেহারা দেখে ভয় পেয়েছিল। মা কালীর একটি মূর্তি এবং অন্যান্য বিগ্রহ দেখলাম।

 দুপুরে নবাব খানের বাড়িতে, টিরিং বস্তিতে লাঞ্চের নেমন্তন্ন ছিল। ওই গ্রামের শরপঞ্চ উনি। সকালের ব্রেকফাস্ট এসেছিল পাধী সাহেবের বাড়ি থেকে। আলুপরোটা আর অমৃতভান্ডর তরকারি। সুজির বরফি। চমৎকার।

পাধী সাহেব গেছিলেন পোটকা পুলিশ স্টেশন, কী কাজে। ফিরে আসার পরই সকলে খেতে যাওয়া হল। নবাব খান-এর খড়ে ছাওয়া মাটির ঘরে। সঙ্গে দু-রকমের মাংস। খাসি আর কুকুড়া। তারপর সুজির ফিরনি। অবশেষে পান খেয়ে গাড়িতে বসলাম।

হাটা-পোটকা; হলুদ-পুকুর, জাদুগোড়া, মোসানি, মৌভান্ডার, ঘাটশীলা হয়ে হাইওয়েতে এসে পড়লাম।

কলকাতা ফিরলাম রাত সোয়া ন-টাতে।

আবার ডিজেলের ধোঁয়া। আবার দমবন্ধ। টেলিফোন। লোকজন। কাজ। অবিরাম কথা বলা। প্রুফ দেখা। ভালো লাগে না।

.

০৯.

কলকাতা

কাল গোর্কি সদনে পূর্ণেন্দুর মালঞ্চ দেখতে গেছিলাম।

 চমৎকার লাগল। কিন্তু জায়গায় জায়গায় বড়ো ধীর। সব মিলিয়ে যেন, স্ত্রীর-পত্র আরও ভালো লেগেছিল।

রঙিন ছবি বলে রঙিন ফুলের পুরোপুরি সদব্যবহার করেছেন পূর্ণেন্দু। কিন্তু বড়ো গাছের কোনো ব্যবহার করেননি। টবের গাছ আর কেয়ারি-করা বাগান কখনোই ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো বড়ো গাছের পরিপূরক নয়। বিষয় হিসেবে বড়ো গাছ-গাছালি এমনই এক বিষয় যে, তা ব্যবহার করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল এই ছবিতে।

টুনটুনির গান ভালো। যখন রেকর্ডিং হয় তখন ও মায়ের বোঝা বইছিল তার দমের কষ্ট ছিল। সেই কষ্টটা গানকে একটা আশ্চর্য ভরাটত্ব দিয়েছে মাতৃত্বেরই মতো। প্রথম গান, একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে। দ্বিতীয় গান ও চাঁদ চোখের জলে লাগল জোয়ার! টপ্পাঙ্গের গান। কিন্তু সেইসময় পূর্ণেন্দু মাধবীকে দিয়ে যেভাবে রি-অ্যাক্ট করিয়েছেন দেওয়ালের কাছে, গোরুর গাছে চড়ার মতন; তাতে চমৎকারভাবে গাওয়া ভালো গানটি মাঠে মারা গেছে।

টপ্পার গান শুনতে মনকে কেন্দ্রীভূত করতে হয়। যেমন গায়ককে করতে হয় গাইতে।

দর্শক ও শ্রোতার কষ্ট হয়, যখন বাগান থেকে গাওয়া সরলার টপ্পা ভেসে আসে কানে আর ঘরের মধ্যে মাধবীকে ঠাকুর! ঠাকুর! করে আর্তিতে মরতে দেখেন। এইখানে মাধবী চুপ করে বাগানের দিকে চেয়ে থাকলে গানটির এফেক্ট ছবির ওপর অনেক গভীরতর হত। মাধবী এমনিতে যথেষ্ট ভালো অভিনেত্রী। তাঁকে এই নীরবতার সুযোগ দিলে তিনি তার সম্পূর্ণ সদব্যবহার করতে পারতেন বলেই আমার মনে হয়।

 রমেন চরিত্রটি সম্পূর্ণতা পায়নি কারণ তাকে মালঞ্চের বাইরে এত কম দেখা গেছে যে, মনে হয়েছে, দ্বিতীয় কোনো পুরুষ না থাকলে, নারী চরিত্রগুলি মন খুলতে পারত না কারো কাছে। শুধুমাত্র সেই কারণেই রমেনের অস্তিত্ব।

তার রাজনৈতিক ক্রিয়া-কলাপ অতিসামান্যই দেখানো হয়েছে। সেটা আর একটু বেশি দেখালে সেই বিশেষ যুগটি প্রতিভাত হত। দেশের ওই সময়ে শুধু মালঞ্চ-মালঞ্চই, অভ্যন্তরস্থ প্রেমই মানুষের জীবনের একমাত্র উপজীব্য বিষয় ছিল, এমনও মনে হতে পারে ছবিটি দেখে।

অন্যসব জায়গায় পূর্ণেন্দু জামা-কাপড়, আসবাব সবকিছু সম্বন্ধে নিষ্ঠাপূর্ণভাবে সময়ানুগ হয়েছেন। শুধু হননি, মনে হয়, হাসপাতালের দৃশ্যে। ওইসময়ে অপারেশন থিয়েটারে এত আধুনিক যন্ত্রপাতি কি ছিল?

এই সামান্য ত্রুটি বাদ দিলে, পূর্ণেন্দু একটি অসাধারণ ছবি উপহার দিয়েছেন আমাদের। পূর্ণেন্দু সাধারণ পরিচালক কখনোই ছিলেন না। বহুমুখী তাঁর প্রতিভা। ছবি আঁকায়, কবিতাতে, গদ্য রচনায়, প্রবন্ধ রচনায় এবং সেলুলয়েডের ছবি রচনাতে তো বটেই। তাঁর বিশেষত্বর ছাপ ছবিটির আপাদমস্তক জুড়ে রয়েছে।

বহুদিন পর কোনো ভালো বাংলা ছবি দেখলাম। রঙিন ছবি তো বটেই।

 পূর্ণেন্দু ভবিষ্যতে আরও ভালো ছবি করুন–এই প্রার্থনা করি।

অভিনয় প্রত্যেকরই ভালো। মাঝে মাঝে নায়ক একটু আড়ষ্ট এবং অন্যমনস্ক।

সে যুগের ধনীরা বোধ হয়, এরকমই হতেন।

.

১০.

কলকাতা

একজন রাজা ছিলেন আর একজন মন্ত্রী। যাই-ই ঘটুক না কেন, মন্ত্রী বলতেন, ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যে। মন্ত্রীর এ-হেন নির্বিচার, ভগবান-বিশ্বাস দেখতে দেখতে রাজা মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠলেন।

একদিন রাজার আঙুলের (তর্জনীর) ডগাতে একটি ফোঁড়া হল। রাজা বললেন, দেখেছ মন্ত্রী।

মন্ত্রী বললেন, ভগবান যা-করেন মঙ্গলের জন্যে।

পরদিন ফোঁড়াটা পেকে ফুলে লাল হয়ে উঠল। বৈদ্য ডাকা হল। রাজা যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে বললেন, দেখছ মন্ত্রী!

মন্ত্রী রাজাকে প্রবোধ দিয়ে আবারও বললেন, ভগবান যা-করেন, তা মঙ্গলের জন্যে।

দিনকয়েক পর বৈদ্য রাজার তর্জনী কর্তন করে দিলেন, ফোঁড়ার অবস্থা এমনই বেহাল হয়ে গেছিল। রাজা তর্জনীহারা হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, দেখছ মন্ত্রী! আমার কী সর্বনাশ হল।

মন্ত্রী তবুও বললেন, ভগবান যা-করেন মঙ্গলের জন্যে।

এর কিছুদিন পর রাজা আর মন্ত্রী গেছেন শিকারে। মনে মনে রাজার রাগ পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে মন্ত্রীর ওপর। একেবারে বিরক্ত। শিকারে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে, অনেক ছুলোয়া করার পরও কোনো শিকার পাওয়া গেল না। জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে দুজনে একটা শুকনো কুয়ো দেখতে পেলেন জঙ্গলের মধ্যে। রাজা আর মন্ত্রী যখন ঝুঁকে পড়ে কুয়োটা দেখছেন তখন রাজা একধাক্কা দিয়ে মন্ত্রীকে ফেলে দিলেন কুয়োর মধ্যে। মন্ত্রী পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারলেন না।

রাজা বললেন, কী মন্ত্রী? থাকো সারারাত এই কুয়োর মধ্যে! কাল লোক পাঠাব তোমাকে তোলার জন্যে।

মন্ত্রী বললেন, ভগবান যা-করেন, মঙ্গলের জন্যে।

 মন্ত্রীকে ফেলে দিয়ে রাজা একা একা ফিরে যাচ্ছেন, যেখানে তাঁর সাঙ্গপাঙ্গোরা অপেক্ষা করছেন ঘোড়া ও খাবার-দাবার নিয়ে। কিন্তু ফেরবার পথে রাজার পথ ভুল হয়ে গেল জঙ্গলে এবং তিনি গিয়ে পড়লেন জংলিদের খপ্পরে। এমন জংলি লোক যারা নরবলি দিয়ে দেবদেবীর পুজো করে। রাজাকে তারা ধরে নিয়ে গিয়ে চান করিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে দু-হাত বেঁধে সিঁদুর মাখিয়ে একেবারে বলির জন্যে তৈরি করে গভীর জঙ্গলের মধ্যে তাদের মন্দিরে নিয়ে চলল, বলি দেবে বলে।

 তখন তাদের পুরোহিত রাজাকে সামনে বসিয়ে মন্ত্র পড়তে পড়তে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে, চেঁচামেচি করতে লাগল। তখন অন্যরা দেখল যে, রাজার তর্জনী কাটা। যে-মানুষকে বলি দেওয়া হবে তার তো কোনো খুঁত থাকলে চলবে না। বনের দেবতা তাহলে জংলিদের ওপর রুষ্ট হবেন খুব। তাই তারা হই হই করে রাজাকে ছেড়ে দিল, হাতের বাঁধন খুলে।

রাজা প্রাণ নিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে অন্ধকারে কোথায় সেই কুয়ো তা খুঁজতে খুঁজতে চললেন, আর ভাবতে লাগলেন, মন্ত্রী তো ঠিক-ই বলেছিলেন, ভগবান যা, করেন, তা মঙ্গলের জন্যে। তাঁর তর্জনীতে যদি ফোঁড়া না হত, আর যদি কাটা না যেত, তা বৈদ্যের হাতে, তবে তো আজ তাঁর জীবনই চলে যেত।

অনুতপ্ত হয়ে, খুঁজতে খুঁজতে তিনি কুয়োটি দেখতে পেলেন। কুয়োর কাছে এসে পাশের বট গাছের ঝুরি টেনে এনে নামিয়ে দিলেন কুয়োর মধ্যে। বললেন, মন্ত্রী! আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। আমার খুব অন্যায় হয়েছে?

মন্ত্রী লতা ধরে ওপরে উঠে এসে বললেন, না মহারাজ! অন্যায় কিছুই হয়নি। ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যে।

রাজা বললেন, সে তো আমার প্রাণ বাঁচল বলে বুঝতেই পারছি কিন্তু আমি তোমাকে কুয়োয় ফেলাতে তোমার কী মঙ্গল হল।

মন্ত্রী বললেন, আমরা যদি দুজনে একসঙ্গে থাকতাম, এবং জংলিদের হাতে ধরা পড়তাম, তাহলে ওরা আমাকে নিশ্চয়ই বলি দিত দেবতার কাছে। আমার তো আর কোনো খুঁত ছিল। না। তাই-ই তো সব সময় বলি ভগবান যা-করেন, তা মঙ্গলের জন্যে। সব সময় সকলেরই জানা উচিত যে, ভগবান যা-করেন তা, মঙ্গলের জন্যে।

.

এক বাঁকুড়ার বামুন, খল, ধূর্ত, ইতর মানুষ, আমার মক্কেল সেজে আমার কাছে এসে, আমাকে তিনমাস ১২/১৪ ঘণ্টা করে খাঁটিয়ে আমার হার্ট-অ্যাটাক করিয়ে তারপর ন্যায্য ফিস দেওয়া দূরস্থান, আমাকে অপমান করে চলে গেল।

একেও ভগবানই পাঠিয়েছিলেন।

ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যে। সে তার মঙ্গলের জন্যে আমার কাছে এসেছিল, নীচ মানুষ। সেই মঙ্গল আমি তার সাধন করে দিয়েছি। বিবেক এবং ভগবানের কাছে আমি পরিষ্কার। এখনভগবানই তাকে যা-করার করবেন। সে আমাকে যা-শেখাল, তাও ভগবানেরই শেখানো এবং তাকেও ভগবানই শেখাবেন, যা তিনি তাকে শেখানো উচিত বলে মনে করেন।

আমি তাকে সর্বস্বান্ত করতে পারি, তার মতো একজন অশিক্ষিত, ইতর, একমাত্র টাকারগর্বে-গর্বিত মানুষকে ভিক্ষাপাত্র হাতে পথে পথে ঘোরাতে পারি, যে-ব্যবহার সে আমার সঙ্গে করেছে সেই কারণে। কিন্তু আমি কারও ক্ষতি করিনি জীবনে। আমার কর্ম আমি করেছি। তোমার কর্ম তুমি।

আমাদের নিজ নিজ কর্ম আমরা সারাজীবনই করে যাব।

 কারণ, না-করে, উপায় নেই। করে যাব, এমনি করেই।

একজন ঋষি নদীতে চান করছিলেন। এমন সময় দেখেন, একটা বিছে জলে ভেসে যাচ্ছে। –এই জলে ডুবে মরল বলে! এই জলে ডুবে মরবে। উনি তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে বিছেটিকে তুলে নিলেন। যেই হাতে নিয়ে জল থেকে তুললেন, অমনি বিছেটা তাঁর হাতে কামড়ে দিল। কামড়ে দিতেই, যন্ত্রণায় তিনি হাতের ঝটকাতে তাকে ফেলে দিলেন।

 বিছেটা আবার হয়তো মরবে বলেই জলে গিয়ে পড়ল এবং ভেসে যেতে লাগল। উনি আবার বিছেটাকে তুলে নিলেন।

আবারও কামড়াল বিছেটা।

আবারও হাত ঝাড়তে বিছেটা পড়ে গেল।

 এমনি করে চার বার কামড়াবার পর উনি তবুও বিছেটাকে পঞ্চমবার জল থেকে তুলেই, বাঁচাবার জন্যে পাড়ে ছুঁড়ে দিলেন।

মাটি পেয়ে, বিছেটা জঙ্গলে চলে গেল।

ঋষির সঙ্গে একজন শিষ্য ছিলেন। তিনিও চান করছিলেন নদীতে। সমস্ত ব্যাপারটা দেখে উনি বললেন, গুরুদেব, আপনি বার বার কামড়ানো সত্ত্বেও কেন বিছেটাকে এতবার জল থেকে তুললেন? দেখুন তো আপনার হাতটার কী অবস্থা হয়েছে! আমি না-হয় আপনার শুশ্রূষা করব, কিন্তু এমন করতে গেলেন কেন?

ঋষি হেসে বললেন, ওর কাজই কামড়ানো। ও বার বার কামড়েছে। আর আমার কাজ ওকে বাঁচানো। আমি বার বার ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছি। তারপর বললেন, বুঝলে বৎস। সংসারে নানারকম ধর্মের জীব হয়। এই বিছের ধর্ম নিয়ে যারা আসে, তারা কেবল কামড়ায়ই। আর ভালো করার ধর্ম নিয়ে যারা আসে, তারা সেই বিছেকেই বার বার বাঁচিয়ে যায়।

সংসারে যে-যেমন চরিত্রের, সে সেইরকম কর্মই করে। ও বার বার কামড়েছে বলে আমি তো আর বিছের ধর্ম আচরিতে পারি না।

রাঢ়ভূমের আজীব জানোয়ার, মস্ত টাকাওয়ালা লোকটি বিছে। বিছের ধর্মই তার ধর্ম। তাই-ই তাকে আমি বাঁচিয়েছিলাম। তবে তার ধর্মের লোকই সংসারে বেশি। তারাই তাকে কামড়ে ছিঁড়ে খাবে যে, সে-বিষয়ে আমার সন্দেহমাত্র নেই। সে বিছে; বিছেই থাকবে।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ