১১.

হোটেল সিনক্লেয়ার
শিলিগুড়ি

তোমাকে অনেক অনেকদিন পর চিঠি লিখতে বসেছি। কতদিন পর যে, তা মনে করতে গেলেও অপস্রিয়মাণ দিগন্তেরই মতো ক্রমশই মিলিয়ে যাচ্ছে। ভুলে গেছি, সেই শেষ চিঠি লেখার ক্ষণ-তারিখটি।

 তোমাকে আগেও বলেছি বহুদিন যে, তুমি নিয়ত আমার আত্মার কাছাকাছি থাকো, তাই তুমি আমার আত্মীয়া। শারীরিক দুরত্বটা বড় কথা নয়। নয়, শারীরিক নৈকট্যটাও! আসল কথা হচ্ছে, মনের সঙ্গে মনের মিল।

তাই, কাছে থাকলে, কাছেই থাকি; দূরে গেলেও কাছেই।

সারাদিন কাজ শেষ করে এখন হোটেলে ফিরে স্নান করে চিঠি লিখতে বসলাম। বসলাম না বলে, শুলাম বলাই ভালো। বিছানাতে উপুড় হয়ে উত্তরের জানালার কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছি শেষ-বরষার গভীর ব্যঞ্জনাময় ঈষৎ-সাদা মেঘপুঞ্জ শ্রীকৃষ্ণর গায়ের রঙের মতো নীল-রঙা হিমালয়ের শরীর জড়িয়ে আছে। আমি যেমন, তোমাকে জড়িয়ে থাকি মনে মনে, তেমন করে।

 এই ঘরটির নম্বর এক-শো বারো। একতলাতে একেবারে কোনার ঘর। খুব নিরিবিলি। লেখার জন্যে চমৎকার। বিকাশ আমাকে প্লেনে উড়িয়ে নিয়ে এসে, এই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে রেখেছে শুধু তার কাজের জন্যেই নয়–যাতে আমি একটু একা থাকতে পারি, কিছু লিখতে পারি; তার জন্যেও।

খুবই কনসিডারেট ও। নৃপতিরঞ্জন ছেলেটিও খুব ভালো।

 খারাপ লোক তো খুব বেশি দেখলাম না, এ-জীবনে। যাদের সঙ্গে দেনা-পাওনা, প্রত্যাশা আর প্রত্যাশা-পূরণের হীন মুচলেকা নেই, তারা সকলেই ভালো।

 কত ভালোবাসা, ভালো ব্যবহার; কত যে-সম্মান পেলাম এই জীবনে, তা বলে শেষে করতে পারি না। কৃতজ্ঞতায় বুক ভারী হয়ে ওঠে।

চিঠিটা আরম্ভ করেছিলাম, তোমার কাছে নিঃশর্তে ক্ষমা চাইবার জন্যে, এতদিন চিঠি না লেখার জন্যে।

 একটা সময় ছিল, যখন একদিনের জন্যে বাইরে গেলেও তোমাকে চিঠি লিখতাম। যেখানেই থোক এবং যত অসুবিধের মধ্যেই থাকি না কেন, জঙ্গলে, পাহাড়ে, জনারণ্যে সব জায়গা থেকে লিখতাম তোমাকে। তখন চিঠি পেতে পেতে তুমি এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলে যে, সেই চিঠি পাওয়ার জন্যে, কারণে তোমার কিছুমাত্র চমক অথবা প্রত্যাশা ছিল না মনে মনে।

তুমি অবশ্য একটি হান্ড্রেড পার্সেন্ট আকাট। না বোঝো কাব্য, না সাহিত্য, না প্রেম। সারাজীবনইআমি অতিসাধারণ আকাট মেয়েদেরই ভালোবেসে আমার কলমের মাধ্যমে তাদের অসাধারণ রূপবতী, গুণবতী, প্রেমময়ী করে গড়ে তুললাম। আমার পাঠক-পাঠিকারা যদি আমার নায়িকাদের অনুপ্রেরণাদের জানত তবে তারা আমার কল্পনাশক্তির জন্যে নোবেল প্রাইজ দিত। শুধু Beauty-ই না সবকিছুই, বুদ্ধি, সাহিত্যবোধ, রুচি সবকিছুই lies in the eyes of the beholder.

তুমি কোনোদিনও জানবেও না তোমার মতন একজন থার্ডক্লাস মেয়েকে, অযোগ্য জনকে আমি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্থায়ী করে গেলাম।

অভ্যেস সব কিছুকেই নষ্ট করে। কিন্তু হয়তো আবার সবকিছুকে ভালোও করে, স্ফুরণ করে; গড়ে তোলে। আমার চিঠি পাওয়ার অভ্যেস তোমার কাছে আমার ভালোবাসাকে মূল্যহীন সস্তা, অযাচিত করে তুলেছিল হয়তো। তাই-ই মাঝে মাঝে তোমাকে একেবারেই চিঠি না-লিখে এক নিষ্ঠুর আনন্দ বোধ যে করি না, তাও হলপ করে বলতে পারব না।

আজকে তুমি আমার চিঠি পেলে খুশি হও। আমার চিঠির শব্দগুলির সঙ্গে তোমার, আমাকে-ঘেরা স্মৃতি ও আমাকে নিয়ে কল্পনা মিশিয়ে মনে মনে তুমি অনেক প্যাস্টেল-রঙা ছবি আঁকো। তোমার জীবনে আমার ভালোবাসার যে এক বিশেষ মূল্য ছিল, ভূমিকা ছিল– আমার ভালোবাসা, রাজ্ঞীর পায়ের সামনে বিছানো লালরঙা নরম গালচের মতো তোমার প্রথম যৌবনের অনভিজ্ঞ মনের পা দু-খানিকে সবচেয়ে আগে যথার্থ মর্যাদা যে-দিয়েছিল, এসব কথা তখন না-বুঝলেও, আজ হয়তো বোঝে।

চিঠি লিখি না আমি, তার মানে এই-ই নয় যে; চিঠি লিখতে চাই না। আসলে, সময়ের কলে আমি আচমকা ইঁদুরের মতো আটকে গেছি। হঠাৎ, অতর্কিতে। আমার সময়ের একটুও আর আমার নিজের নেই। যে-সামান্য ফালিটুকু ছিল, তোমার সেদিন রাতে-পরা টাঙ্গাইল শাড়ির পাড়ের এক চিলতে ফলসারঙা বর্ডারের মতো; তাও কেড়ে নিয়েছেন প্রকাশক ও সম্পাদকেরা। এখন আমি কলম ধরলেই টাকা পাই। কিন্তু তোমায় চিঠি লিখলে কিছুই পাই না। এমনকী প্রাপ্তিসংবাদ পর্যন্তও নয়।

তাই, চিঠি তোমায় লিখি না।

বেশ করি!

আর কেউই না জানুক, তুমি অন্তত জানো যে, টাকার জন্যে আমি লিখি না। লিখতে ভালো লাগে বলে লিখি। যেদিন ভালো লাগবে না, সেদিন হঠাৎ-ই লেখা ছেড়ে দেব। চুনী, যেমন করে ফুটবল খেলা ছেড়েছিল একদিন।

দেখছ, পুরো সওয়াল আমার কেমন এলমেলো হয়ে যাচ্ছে? অথচ আমি ভালো সওয়াল করতে পারি। এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে অনেকেরই মনে। আসলে, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা যে সওয়াল-জবাব, বিধিবদ্ধতার নয়, পুরো সম্পর্কটাই নিয়ম-ভাঙা, সমাজবহির্ভূত, এলেবেলে,তাই-ই তো সম্পর্কটা এত গভীর। এই সন্ধেবেলায় আকাশের আলতো লালের পটভূমিতে মহাস্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে-থাকা নগাধিরাজ হিমালয়ের সঙ্গে সতত সঞ্চারমান মেঘপুঞ্জর সম্পর্ক যেন। বেলা নেই, অবেলা নেই, নিয়ম নেই, শাসন নেই, সাজানো গোছানো, ফোলানো-ফাঁপানো, মুগ্ধ বা জব্দ করার কোনো নীচ অনুপ্রেরণা নেই, আমার এই স্বতঃস্ফূর্ত অপ্রয়োজনীয় শব্দমঞ্জরির মধ্যে।

তোমাকে যে আমি ভালোবাসি! সেই ভালোবাসা কোনো হিসেব জানে না, কানুন মানে না, আদালত অবমাননাকে ভয় করে না।

ভালোবাসি, তাই লিখি এই ভেবে যে; তুমি ভালোবেসে পড়বে। শুধু এই-ই। এইটুকুই।

এ-চিঠি তো কেউ দেখবে না। তুমি ছাড়া অন্য কারো হাতেই পড়ার নয় এই চিঠি। তাই অগোছালো, এবং বিশ্রীরকম বিবস্ত্র-হওয়া, শুধু, আমার এই চিঠির মাধ্যমেই সাজে।

কী? ঠিক বলিনি?

 তুমি এখন কী করছ?

 অনুমান করতে পারি। তোমার স্বামী এখনও অফিস থেকে ফেরেননি। রুহীকে তুমিসাজিয়ে-গুছিয়ে প্যারামবুলেটারে বসিয়ে কারো সঙ্গে সি সি এফ সির মাঠে পাঠিয়েছ। ওরা বেরোলেই, তুমি চান করতে ঢুকেছ। ঠিক এক্ষুনি, এইমুহূর্তে তুমি নিশ্চয়ই চান করছ। তোমার গায়ে সাবানের ফেনা, শাওয়ারের সরু সরু জলের তির তোমার ক্লান্তি, ঘাম, গ্লানি সব ধুয়ে নিয়ে ঝাঁঝরির দিকে চলে যাচ্ছে দুধের সরের মতো। চাকচিক্যময় তোমার তরুণী ইউক্যালিপটাস গাছের মতো পেলব তোমার শরীরে, তোমার মসৃণ, যুগল-স্তন গড়িয়ে দ্রুত জলের ধারা নামছে। তাদের লাল ঠোঁট দুটি শীতের পরিযায়ী ঠোঁটেরই মতো উদ্ধত। সাবানের ফেনার বুদবুদের মধ্যে লক্ষ রঙের নাগরদোলায় চেপে আমার কামনা কোটি কোটি টুকরো হয়ে চেকোশ্লোভাকিয়ান কাট-গ্লাসের বাসনের মতো ঝনঝন করে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, তোমার বাথরুমের আয়নায় তোমার জল-ভেজা নগ্নতার ছায়ায়। অথচ তবুও, শুনেও তুমি শুনতে পাচ্ছ না। আমার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ার শব্দ তুমি শুনতে পাচ্ছ না। আমার চিঠির অক্ষরগুলি চিনতে পাচ্ছ না।

হঠাৎ-ই মনে পড়ে গেল, কত বছরের সাধ ছিল আমার, তোমাকে একদিন চান করাব নিজের হাতে। অন্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অশিক্ষিত, হিন্দু বিধবা যেমন, পরম ভালোবাসায় তার ঠাকুরকে চান করান। হাজারিবাগের নাজিম-মিয়া যেমন, নিষ্কলুষ ধর্ম এবং কলুষিত মাংসলোলুপতারর রমরমে গন্ধমাখা চোখে বকর-ইদে কোতল-হোনেওয়ালা সযত্নবর্ধিত সাদারঙা লালোয়াব খাসিকে চান করান। নাকে বিরিয়ানির গন্ধ মেখে। যেমন করে পেঙ্গুইন-মা তার পেঙ্গুইন বাচ্চাকে বরফের মিহি গুঁড়ো দিয়ে অপত্যস্নেহে চান করায় জমে-থাকা আন্টার্কটিকায়, তেমনই ভালোবাসায়, ধর্মে, কামে, লোভে, প্রেমে, অপত্যস্নেহের বাধ-না মানা অঝোর ধারায় তোমায় আমি একদিন আমার সব বাসনার আতরদান উজাড় করে চান করাব। আমার ভীরু ভালোবাসার ঝাঁঝরির সব মুখ উন্মুক্ত করে।

কবে? কবে? কবে? কবে? কবে?

মনে পড়ে? তোমার বাথরুমের টিকটিকি হয়ে এ-দেওয়াল থেকে ও-দেওয়াল ঘুরে বেড়িয়ে এক চমৎকার জীবন কাটাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল আমার একসময়।

আগেকার দিনে কত কী হত। প্রস্তরীভূত অহল্যা রামচন্দ্রের নখরাঘাতে প্রাণ পেল। আর আমি! তোমার অঙ্গুলি-স্পর্শে একটি টিকটিকিও হতে পারলাম না।

সাধে কি আর বলে, সেই রাম নেই; নেই সে অযোধ্যা!

কে যেন, দরজায় নক করছে।

বিকাশও আসতে পারে।

আমাদের কালিঝোড়ায় যাওয়ার কথা ছিল।

থামছি এখন।

***

এখন রাত এগারোটা। এইমাত্র কালিঝোড়া থেকে ফিরলাম।

 তোমাকে একবার নিয়ে আসব কালিঝোড়াতে। কী সুন্দর যে জায়গাটা। কালিম্পং-এর রাস্তাতে সেভকের করোনেশন ব্রিজকে ডাইনে ফেলে তিস্তাকে ডান হাতে রেখে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলে দেখা যায় বাঁ-দিক থেকে কালিঝোড়া, একটি ছোটো নীলচে নদী নেমে এসেছে হিমগিরি থেকে। নেমে এসে মিলিত হচ্ছে তিস্তা নদের সঙ্গে।

কোনো নদ ও নদীর এমন মিলন বড়ো একটা দেখা যায় না। মিলনমাত্রই রোমাঞ্চকর। যারা মিলিত হয় এবং যারা সেই মিলন প্রত্যক্ষ করে তাদের সকলেরই কাছে। তাই এই জায়গাটা আমার বড়ো প্রিয়।

নদ ও নদীর এই সংগমস্থলে একটি ছোট্ট বাংলো আছে। তার নামও কালিঝোড়া।

বিকাশ, ব্যাগে করে একটি চিবাস-রিগ্যাল হুইস্কি আর ফ্রায়েড-প্রন নিয়ে এসেছিল। আমরা রাতের মেঘলা আকাশের পটভূমিতে দুর্দম বেগে ছুটে-যাওয়া তিস্তার দিকে মুখ করে অন্ধকারে বসে,রেলিং-এ পা তুলে দিয়ে হুইস্কি খাচ্ছিলাম।

পৌরুষের যদি কোনো সংজ্ঞা কেউ চায়, তাহলে কর্তাকে তিস্তা নদের রেফারেন্স দিয়ো।

তার বুকের মধ্যে সমূলে উৎপাটিত মহিরুহ,হস্তীসদৃশ গোলাকার প্রস্তরখন্ড এবং নিয়ত আবর্তিত প্রচন্ড বেগবতী জলরাশিকে মন্থন করে উলটে পালটে টুকরো করে, গুঁড়ো করে, পলি করে আবার নতুন আকার দিতে দিতে গড়িয়ে নিয়ে চলেছে সে, সমারোহে; সমতলের দিকে। তিস্তার রূপ, বর্ষাকালে। বাঘের রমণ-রূপ। তার শরীরের সঙ্গে, তার জলীয়, বাষ্পীয় সত্তার সঙ্গে তার পুরুষালি বুকের মধ্যে, অনেক কিছুই ঘর্ষণে, স্পন্দনে, নিক্কণে, গর্জনে, প্রতিনিয়তই কোনো চিরন্তন নারীকে গর্ভবতী করে চলেছে সে।

বর্ষার তিস্তাকে দেখলে সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়কে একইসঙ্গে প্রত্যক্ষ করা হয়। ধরা দিয়েই ছুটে যাচ্ছে সে, ধরা দিয়েও অধরা থাকছে। নিজেকে নিজেই ডাক দিয়ে নিরুত্তর থাকছে। আবার কখনো কালিঝোড়া না-ডাকতেই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বিস্ফোরণের মতো এসে প্রেমিকার ঊরুসন্ধিতে উদ্দাম উচ্ছ্বাসে তার ফেনিল সত্তায় লীন হচ্ছে।

তিস্তা নদী না, নদ। তিস্তা বাঙালি পুরুষও নয়। হতেই পারে না।

তোমায় আসতেই হবে এখানে একবার। আমার সঙ্গে। শুধু আমি আর তুমি। তিস্তা আর কালিঝোড়া আর আমাদের দুই যুগলের মিলনের নিবিড় নরম, ঢেউ-ভাঙা নৈ:শব্দ্য আর শরীরের মধ্যের সবকিছু বিদীর্ণ করার দুর্দান্ত শব্দময়তার শব্দ চতুর্দিকে।

এই উত্তরবঙ্গ বড়ো ভালো লাগে আমার। পূর্ব-আফ্রিকার শীতের সেরেঙ্গেটি–পানাডার পাতা-ঝরার আগের সময়ের জঙ্গলের মতে, এই হিমালয়। তিস্তা এবং শাল-সেগুনের জঙ্গলের মধ্যে আমি আমার নিজের গায়ের গন্ধ পাই। একটা আদিমতার গন্ধ। প্রাগৈতিহাসিক গন্ধ। সমকালীনতা এখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। অতীত দিকভ্রষ্ট হয়। ভবিষ্যৎ, রবাট ফ্রস্ট এর কবিতারই মতো বনপথের মোড়ে এসে কোন পথ বেছে নেবে বা নেবে না, এ-নিয়ে চিন্তায় পড়ে স্তব্ধ হয়।

তোমার মনে আছে, একদিন হাজারিবাগের সীমারীয়ার জঙ্গলের বাংলো থেকে বেরিয়ে এক শীতের চাঁদের রাতে তুমি আর আমি হাত-ধরাধরি করে ঝরাপাতার পথে হাঁটছিলাম?

আমি রবার্ট ফ্রস্ট আবৃত্তি করছিলাম স্বগতোক্তির মতো!

I shall be telling this with a sigh
Somewhere ages and ages hence :
Two roads diverged in a wood, and I
I took the one less travelled by
And that has made all the difference.

কত কথাই মনে পড়ে। কত দিন ও রাতের কথা। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের কথা। দিঘার কথা। চিল্কা হ্রদ আর সমুদ্রের মধ্যবর্তী ছরপড়িয়ার কথা–যেখানে আমি আমার জীবনের প্রথম কৃষ্ণসার হরিণ মেরেছিলাম। বালিয়াড়ির ওপরে, আমার চিরদিনের সাদাপেট, নরম, ওম ধরানো কৃষ্ণসার হরিণীটির পাশে শুয়ে, থার্টি ও সিক্স রাইফেল দিয়ে। হরিণের বুকের রক্ত দেখে তুমি কেঁদেছিলে! মনে আছে?

তোমরা মেয়েরা এক অদ্ভুত জাত। একটি পুরুষহরিণ, যাকে নির্ভুল নিশানায় অস্ট্রিয়ার তৈরি রাইফেলে, ইংল্যাণ্ডের তৈরি গুলি দিয়ে একমুহূর্তের কষ্ট-না-দিয়ে মেরে ফেললাম– তার বুকের রক্ত দেখে তোমার দু-চোখ জলে ভরে গেছিল। আর আমি? এই পুরুষহরিণটির বুকের রক্তাক্ত ক্ষতটি এখনও তোমার চোখে পড়ল না? একবারের জন্যও না?

হায়!

 বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল আবার। কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি! কালিঝোড়া থেকে এত দূর গাড়িতে এলাম। সারাপথই বৃষ্টি। তিস্তা এখন বৃষ্টিতে ভিজছে-ভিজছে। ভিজছে কালিঝোড়া। কত হাজার বছর ধরে ওরা দুজনে মিলিত হচ্ছে এইভাবে। সাক্ষী থাকছেন জংলি কলাগাছের বন আর নানারকম কটুগন্ধি অর্কিড আর হাইবিসকাস ফুলেরা। হিমালয়ে হাইবিসকাস ফুল থাকবেই।

অনেকদিন আগে ডম মোরেসের একটি কবিতাতে কোনো নেপালি মেয়ের কথা পড়েছিলাম। তার উরুসন্ধির বর্ণনা।

Show me the hibiscus flower between your thigh!

দারুণ উজ্জ্বল না পঙক্তিটি? তখন খুব ছেলেমানুষ ছিলাম বলে, উচ্ছলতায় চোখই শুধু বেঁধে গেছিল যে, তাই-ই নয়, কর্ণমূল, গন্ডমূল এবং যাবতীয় পুরুষালি মূল, উত্তেজনায় এবং এক দুর্বোধ্য অপরাধবোধে লাল হয়ে গেছিল।

ইংরিজি ভাষাটার মজাই আলাদা। Its language of Bangs. And not of whimper! কিন্তু কী করা যাবে? আমি যে বাঙালি–বাংলাতেই লিখি। ইংরিজি ভালো জানি না বলেও বটে, তা ছাড়া বিজাতীয় কোনো কিছুকেই জাতীয় কোনো কিছুর মতো সর্বান্তকরণে গ্রহণ করতে পারি না বলেও। আমি মনে-প্রাণে বাঙালি ভারতীয়। এবং গর্বিত সে কারণে।

আজকে ছুটি চাইছি, মহুয়া। অনেক আনপার্লামেন্টারি এবং অসভ্য কথা লিখলাম এ চিঠিতে। ঘরের এয়ারকণ্ডিশনারটা চালিয়ে শুয়ো। নইলে কষ্ট পাবে গরমে। কলকাতা তো আর শিলিগুড়ির মতো ঠাণ্ডা নয়। আমি আমার ঘরের এয়ারকণ্ডিশনার বন্ধ করে শুতে যাচ্ছি। পাছে একেবারে ঠাণ্ডা মেরে যাই, সেই ভয়ে।

আসলে, বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমোব বলে।

বৃষ্টির পায়ের শব্দ তুমি ভালো করে শুনেছ কখনো? এল তো, বৃষ্টি কীরকম জুতো পরে? হিল-তোলা না হিল-ছাড়া? চটি, না জুতো? বৃষ্টির পায়ের শব্দ ভারি মিষ্টি। আমার জানালার কাঁচে সে দৌড়ে এসে, তার ছোটো ছোটো নরম হাত দিয়ে আলতো করে করাঘাত করছে এখন, কোনো কিশোরীর নরম আলতো ফিসফিসে ভালোবাসায় মতো। যেন জানালা খুললেই কোনো রূপকথার রাজকুমারীর মতো বৃষ্টি আমার বিছানার ভাগীদার হবে। তারপর সারারাত সব রূপকথার রাজকুমারীর মতো চিরকুমারী হয়ে শুয়ে থেকে, ভোরের বেলা ডাগর চোখে আমায় বলবে, উঃ, কী ব্যথাই না লেগেছে পিঠে, … সারারাত ঘুমুতে পারিনি।

 তখন বিছানার গদি তুলে দেখব আমি যে নীচে একটি ছোটো মসুর ডাল।

অবাক হয়ে তখন তার দিকে তাকাব। সে বলবে, আমার ওই ছোটো মসুর ডালেই ব্যথা লাগে যে বড়ো। ওতেই ব্যথা লাগে–আমি যে রাজকুমারী।

কিন্তু মহুয়া, মসুর ডালেই যাদের ব্যথা লাগে, তেমন রাজকুমারীরা আমার পাশে যেন কখনো এসে না শোয়। মিষ্টি বৃষ্টির মতো ফিসফিসে, এমন আলতো, ইনডিফারেন্ট, ইনসিপিড রাজকুমারীদের কোনোই প্রয়োজন নেই আমার। এমন রাজকুমারী চাই যে পজিটিভ, যে ভালোবাসায় পার্টিসিপেট করতে জানে, যে ঐতিহ্য ও সংস্কারাচ্ছন্ন বিশুদ্ধ ভারতীয় মরা নারীদেহ নয়।

যে জীবন্ত, প্রাণবন্ত, যে শুধুই আদর খায় না; আদর করেও। ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ।

দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়া, তোমায় আমায় এই চলেছে জনম জনম। মরণ কভু তারে থামায়, দেওয়া, নেওয়া…।

পাৰ্ডন মি! গুরুদেব টেগোর!

.

১২.

তাজমহল হোটেল
বম্বে

কাজে এসেছি সাতদিনের জন্যে।

বম্বেতে এলে মনেই হয় না যে, ভারতবর্ষেরই কোনো প্রান্তে আছি। দিল্লিতে গেলেও তা মনে হয় না, তবে তা মনে না হওয়ার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।

যাঁদের কাজে এসেছি, তাঁরা একটা স্যুইস কোম্পানি। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট-এ ইণ্ডিয়ানইজেশান হয়েছে। এখন বিদেশি শেয়ার-হোল্ডিং মাত্র ফর্টি-পার্সেন্ট। যেমন নিয়ম। এই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর বম্বে শহরে তাঁদের অফিস থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে একটি ছিমছাম নিরিবিলি সমুদ্রপাড়ের এলাকাতে থাকেন। সেখান থেকে গাড়িতে করে অফিস পৌঁছোন সকাল সাড়ে নটার মধ্যে-বাড়ি ফিরে যান সাতটার মধ্যে। কলকাতায় বসে একথা ভাবলেও অবাক লাগে। তিন মাইল দূর থেকে অফিস পৌঁছোতে এখানে যে, একই সময় লাগে প্রায়। বম্বের তুলনায় কলকাতাকে গ্রাম বলে মনে হয়। আর লোক?

কলকাতায় কী লোক! কী লোক!

বম্বের হালচালই আলাদা। পয়সা উড়ছে আকাশে। ধরে নিলেই হল। তা বলে, বম্বেতে যে, গরিব নেই একথা মহামূর্খও বলবেন না। তবু, পুরো দেশের ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেক এখন এই পশ্চিমপ্রান্তে। কলকাতা তার স্থান হারিয়ে ফেলেছে বহুদিন হল।

তারজন্যে আমরা নিজেরাই পুরোপুরি দায়ী। এই পেছনে পড়াতে বাঙালির ভালো হয়নি। রাজনীতি যদি দেশ বা দশের ভালোর চেয়ে বড়ো হয়, তাহলে যা-ঘটবার তাই-ই ঘটে, ঘটেছে। একথা নেতাদের ভাববার। নিজেদের কোনোমতে চোখঠারার জন্যে নয়, নিজেদের বিবেকের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার তাঁদের।

বম্বের যানবাহনপথ-ঘাট নিয়মানুবর্তিতা, বৈদ্যুতিক বন্দোবস্ত সবই কলকাতার চেয়ে অনেক ভালো। টাটা কোম্পানি নাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন করেন। লোডশেডিং মূলত হয়ই না বলতে গেলে। প্রখর গরমের সময়ে সামান্য হয়। এখানে বিদ্যুৎও আসে মূলত হাইডাল পাওয়ারে। থার্মাল পাওয়ারের বালাই নেই।

এই কষ্টের কারণটা ব্যাখ্যা করা চলে, কারণ অসুবিধে হয় অতিঅল্প সময়ের জন্যে জলের কষ্টও হয় সেইসময়। জল কমে গেলে স্বাভাবিক কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয় কিন্তু ইন্টার ইউনিয়ন রাইভালরি এবং এক দলের সঙ্গে অন্য দলে কামড়াকামড়িতে একটা রাজ্যের ব্যাবসা-বাণিজ্য-কলকারখানা প্রায় উঠে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে লোডশেডিং-এর বাড়াবাড়িতে। একথা বম্বের লোকদের পক্ষে বিশ্বাস করাও কষ্ট।

এখনও আমাদের চোখ না খুললে, কবে খুলবে জানি না। বাঙালি ক্রমশ ভিখিরি, আর ছিঁচকে চোরাচালানকারী এক আত্মসম্মানজ্ঞানহীন দূরদৃষ্টিহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছে। বিধানবাবু যা-কিছু গোড়াপত্তন করে গেছিলেন, দুর্গাপুর, দিঘা, সল্টলেক, কল্যাণী সবকিছুই একে একে গড়ে উঠেছে। কিন্তু নতুন কি কিছু হল? দেখি, জ্যোতিবাবুরা যদি করেন এবার। জ্যোতিবাবু এবং প্রমোদবাবুর ব্যক্তিত্বে এখনও অবধি ভরসা রাখি। একটা কথা বলতে হবেই যে, বামফ্রন্ট ক্ষমতাতে আসার পর থেকে, ভেসে যাওয়া বাঙালি জাতি একটা নতুন জোর পাচ্ছে। এই জোরকে আরও জোরদার করার সময় হয়েছে।

শুধুই গলাবাজি নয়, স্লোগান নয়, যা-আপাতদৃষ্টিতে দৃষ্টিকটু এবং যেসব সমস্যার প্রতিকার অবশ্য করণীয় সেইসব সমস্যার সমাধান করা উচিত। সাধারণ অথবা অসাধারণ নাগরিকমাত্রই এইটুকু ন্যায্য দাবি নিশ্চয়ই সরকারের কাছে করতে পারেন। আত্মতুষ্টি এবং সমালোচনা-ভীতি কোনো সরকারকেই সুপথে এগিয়ে নিয়ে যায় না। একদিন বাঙালি বলে নিজেরা পরিচিত হতে, পরিচয় করাতে গর্বে বুক ফুলে উঠত, আর আজ বাঙালি সব দিক দিয়ে ক্রমাগত পিছোতে পিছোতে কোথায় যে পৌঁছেছে। সর্বভারতীয়ক্ষেত্রে বাঙালি নেতা নামক যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে নেতার মতো নেতা আছেনক-জন? বর্তমানে, কেন্দ্রে, বাঙালিদের নেতৃত্ব যাঁরা করছেন তাঁরা বাঙালি জাতের সম্মানবৃদ্ধি করার মতো কেউই নন।

তোমার কি মনে হয় না যে, আমাদের দেশে আমাদের সমাজ এবং রাজনীতির পুরোভাগে যাঁরা আছেন, তাঁরা ভন্ডামির এক কট্টর কম্পিটিশনে নেমেছেন? দেশের কাজ করলে, অথবা। গরিবদের প্রতি দরদ থাকলে সেই ব্যক্তিকে গান্ধিজির মতো কৌপীন পরে বেড়াতে হবেই যে এমন মতবাদের সঙ্গে আমার মতের একেবারেই মিল নেই।

প্রায়ই লোককে বলতে শুনেছি, এয়ারকণ্ডিশনড ঘরে বসে গরিবের জন্যে কেঁদে কুল পাচ্ছেন না অমুকে। এই উক্তির পেছনে এক ধরনের মূখামি ও হীনম্মন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই বলেই কি মনে হয় না তোমার? যাঁরা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেন এবং মাথার কাজ, তাঁরাই জানেন যে, এয়ারকণ্ডিশনিং থাকলে কাজ করাতে ক্লান্তি আসে না। বাইরের রোদ, পাখার হাওয়ায় কাগজপত্র ওড়া, এসবের হাত থেকে বাঁচা যায়। এবং স্বাভাবিক কারণে কাজও বেশি করা যায়। অনেকমূর্খরই জানা নেই যে, এয়ার-কণ্ডিশনার আদৌ সুখবাহী না।

একথা সত্যি যে, যাঁরাই এয়ারকণ্ডিশনড ঘরে বসে কাজ করেন তাঁরাই নানারকম শারীরিক অস্বস্তিতে ভোগেন। কারো সর্দি লাগে। যাঁদের সাইনাসাইটিস বা ইসিনোফিলিয়ার রোগ আছে, তাঁরাও খুবই কষ্ট পান। বাতেও ভোগেন অনেকে। কিন্তু যেহেতু এতে তাঁদের কাজের সুবিধে হয় অনেকখানি এবং যেহেতু একজন মানুষের জীবনে তার কাজের চেয়ে বড়ো অন্য আর কিছুই হওয়া উচিত নয়, সেইহেতু এইসমস্ত অসুবিধে সত্ত্বেও এয়ারকণ্ডিশনড অফিসে বসে তাঁরা কাজ করতে বাধ্য হন।

তথাকথিত জনদরদি মানুষের এই আরাম হারাম হ্যায়-এর ফালতু স্লোগান সত্যিই লোকদেখানো। যেদিন আমরা এইসব বাইরের ভড়ং ছুঁড়ে ফেলে সত্যিকারের এক কেজো জাত হতে পারব, কাজ-পাগলা জাত, সেদিনই আমাদের উত্তরণের পথ খুলবে। এবং হয়তো অয়ন-পথও।

বম্বেতে এলেই কলকাতার হীনাবস্থা এবং সর্বভারতীয়ক্ষেত্রে বাঙালিদের ক্রমশ নেমে যাওয়াটা প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে এবং কষ্ট হয়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কবে বলেছিলেন যে, ব্যাবসা না করলে বাঙালির উন্নতি নেই–অথচ আজও! তবে বাঙালি হয়তো একটু একটু করে ব্যাবসার দিকে ঝুঁকছে। এটা সুখের বিষয়।

বললে, বিশ্বাস করবে না হয়তো, প্রতিদিন আমার কাছে চার থেকে আটজন ছেলে বিভিন্নরকম চাকরির খোঁজে কারো না কারো সুপারিশ নিয়ে আসে। তাদের বেশির ভাগেরই যা বিদ্যা, মানে অ্যাকাডেমিক বিদ্যা; তাতে মাড়োয়ারি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি সংস্থায় সামান্য মাইনের কোনো চাকরি হলেও হতে পারে। তাদের প্রত্যেককে বোঝাবার চেষ্টা করি যে, যেকোনো ব্যাবসা করো। একটা পানের দোকানদারও, টাই-পরা, হাতে ব্রিফকেস ঝোলানো চাকুরীজীবীদের অনেকের থেকেই বেশি রোজগার করে। পানের দোকান করতে বেশি ক্যাপিটাল লাগে না। কলকাতায় কোনো বাঙালির একটিও পানের দোকান দেখেছ? ক-টি? কিন্তু এসব কথা বললে, তারা মুখ ব্যাজার করে চলে যায়।

আমি জানি, তাদের মধ্যে অধিকাংশই বাইরে গিয়েই বলে, শালা! এয়ারকণ্ডিশনড় ঘরে বসে জ্ঞান দিচ্ছে!

কী করব? আমি নিজে বাঙালি বলে এবং ছেলেমেয়েদের জন্যে করার মতো কিছু করতে পারি না বলে ভারি দুঃখ হয় আমার। আমার দুঃখের গভীরতা ও স্বরূপ ঠিক কী তা আমিই জানি। আর অন্তর্যামীই জানেন। একটা এত মহান ঐতিহ্যসম্পন্ন এবং মহৎ সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল জাত কীরকম লক্ষ্যভ্রষ্ট নেতৃত্বহীন, উদ্দেশ্যহীন হয়ে কচুরিপানার মতো বদ্ধজলে ভেসে রয়েছে একথা মনে হলেই আমার বুকের মধ্যে বড়োই কষ্ট হয়। খুবই কষ্ট।

.

১৩.

সেরোনারা লজ
 সেরেঙ্গেটি প্লেইনস
ইস্ট-আফ্রিকা

আঃকী সুন্দর সকাল।

বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। কিন্তু ঝকঝকে দিন। একটা জিরাফ চরছে জানলার পাশে এবং কতগুলো ম্যারাস্যু স্টর্কস। মাঝে মাঝেই থমসনস গ্যাজেলের ঝাঁক দেখা যায়। তবে দিনের বেলা খুব বেশি থাকে না ওরা।

এই সেরোনারা লজ একজন ফ্রেঞ্চ স্থপতির প্ল্যানে তৈরি। স্বাভাবিক কালো পাথরের টিলা ও গোলাকৃতি মসৃণ সব পাথরের সঙ্গে কংক্রিট ঢেলে চমৎকার লজটি বানানো হয়েছে। সত্যিই চোখ জুড়োনো এর স্থাপত্য। চোদ্দো হাজার বর্গকিমি ঘাসবনের মধ্যে এই কোপিগুলির বুকে লজটি বহুমাইল দূর থেকে দেখা যায়। এই অদ্ভুতাকৃতি টিলাগুলোর ইংরিজি নাম–KOPJE সোয়াহিলি উচ্চারণ হচ্ছে কোপি।

 তানজানিয়া আমাদের দেশের তুলনায় অনেকই অনুন্নত ও গরিব দেশ। কিন্তু এঁদের বন জঙ্গলকে এঁরা এমনভাবে কাজে লাগিয়েছেন যে, বছরে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেন এঁরা বিদেশিদের কাছ থেকে। কেমন সুসংবদ্ধ সুব্যবস্থাতে আপাদমস্তক মোড়া এঁদের পর্যটনি ফাঁদ। অতিথিরা পা দেবেই দেবেন তাতে। আমার কথা স্বতন্ত্র। আমি জংলি মানুষ, জঙ্গলের টানে যেখানে-সেখানে দৌড়ে যাই। কিন্তু যাঁরা জঙ্গল ভালোবাসেন না, তাঁরাও তানজানিয়াতে এসে এসব না দেখে চলে যেতে পারবেন না।

তুমি যদি আসতে আমার সঙ্গে। জানি, তুমি মুখ নীচু করে বলবে, যা হয় না, তা হয় না; তবে মিছিমিছি বার বার এককথা বলা কেন? আমিও জানি। তবুও বলি। কারণ, না বলে পারি না তাই। তোমাকে ভালো-না-বেসে পারি না, বার বার তাই একথা না-বলেও পারি না। কল্পনাতে মনে করি, তুমি আমার সঙ্গে এসেছ আফ্রিকায়, অন্ধকার আদিম আফ্রিকায়। যাওয়ার পথে আমরা ভারত মহাসাগরের বুকে অনেকেরই অজানা, অদেখা, ছোটো সরষে দানার মতো পৃথিবীর ম্যাপে হারিয়ে যাওয়া সেশেলস দ্বীপপুঞ্জে ঘুরে আসতাম।

 আমার একা একা একটুও ভালো লাগে না। একা একা কোনো সুন্দর কিছু করতে একেবারেই ভালো লাগে না। সেশেলস-এর এয়ার স্ট্রিপটি এমন যে, মনে হয় প্লেনটা বুঝি সমুদ্রের মধ্যেই নামল। প্লেনটা যখন নামতে থাকে তখন নীচে নীলচে সবুজ কোরাল রিফস জলের তলায় চোখে পড়ে। আর দ্বীপগুলো তাদের গেরুয়া বালির তটভূমিতে সবুজ-কালো বনপাহাড়ে একেবারে অনবদ্য ছবির মতো।

চোখের এত বড়ো তৃপ্তিপ্রদ ভোজ বড়ো কম পেয়েছি জীবনে, এত মুগ্ধ, বিস্মিত খুব বেশি হয়নি। হয়তো, তোমায় প্রথমবার নগ্নাবস্থায় দেখার সময় ছাড়া।

 তুমিও এমনই সুন্দর। সুনীল, অতলান্ত জলরাশি থেকে কোটি কোটি বছর ধরে তিল তিল করে ভূস্তরের উত্থান-পতনের প্রক্রিয়া ও নানাবিধ জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতে যেমন এই হাতছানি দেওয়া গাছগাছালি, আর কোরাল রিফে ঘেরা দ্বীপপুঞ্জ তৈরি হয়ে উঠেছে, তুমিও তেমনি করেই সৃষ্ট হয়েছ। কত কোটি বছরের পুরুষের কল্পনার, কামনার অস্পষ্ট ছেনি হাতুড়িতে মৃদুভাবে কেটে কেটে বিধাতা তোমাকে গড়েছিলেন। তোমার আনত চোখ, তোমার নরম চোখের দৃষ্টি, কালো ভোমরার মতো তোমার চোখের মণি, তোমার ভূভারতে নেই ভুরু, তোমার চলন, তোমার মিষ্টি বলন, তোমার হাতের আঙুল, পায়ের পাতা, তোমার হাত, তোমার ঠোঁট দু-খানি, তোমার স্তনযুগল, আহা কী সান্ত্বনাদাত্রী ঠাণ্ডা, করোঞ্জ ফুল গন্ধি। তোমার আরও অনেক কিছু।

সমস্ত তুমির বর্ণনা তোমার পছন্দ নয়; দেওয়া সম্ভবও নয়।

এতকথা, শুধু এই-ই ভেবে যে, যদি তুমি আসতে সেশেলস-এ আমার সঙ্গে। কী মজাই না হত তাহলে।

 পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি এবং ভারতীয় জলদস্যুদের বিচরণভূমি ছিল একসময়ে ভারত মহাসাগরের এই ভারত ও আফ্রিকা মধ্যবর্তী সমুদ্র; ভারত-সাগর। কত জাহাজডুবি হয়েছে তখন এইসব অঞ্চলে, কত পুরুষের আর্ত চিৎকারে সমুদ্রের ঢেউ ভারী হয়েছে, কত অত্যাচারিত নারীর করুণ কান্নায়।

সেশেলস-এ একটি জায়গা আছে তার নাম এেলমা। সেখানে সমুদ্রের পাড়ে জোর খোঁড়াখুঁড়ি চলেছে, অনেকদিন ধরে এই বিশ্বাসে যে, ওখানে জলদস্যুরা অনেক ধনরত্ন ইত্যাদি পুঁতে রেখেছে। ওই তটে গভীর গর্ত করে, একেবারে সমুদ্রের গায়েই এক আশাবাদী ভদ্রলোক এই খননকার্য করে চলেছেন কোনোদিন মণিমাণিক্য পাবেন বলে। এবং এই প্রক্রিয়াতে, প্রায় সর্বস্বান্ত হতে বসেছেন।

মহুয়া, জানো, ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দারুণ মিল। আমিও আমার জীবন, বর্তমান ভবিষ্যৎ খুঁড়ে চলেছি অনুক্ষণ, মণি-মাণিক্য পাওয়ার আশায়। আর তুমি! জলদস্যুদের লুষ্ঠিত হিরে-জহরতের মতোই গভীরে প্রোথিত আছ তোমার স্বামী-পুত্রের, সংস্কারের, অনীহার, ভালো-লাগানোর, অপ্রয়োজনীয় জীবনের সমুদ্রতটে।

এ-ভদ্রলোকের মতো আমি সর্বস্বান্ত। তবুও, দুজনে খুঁড়ে চলেছি সমানে। কেউ কেউ এ-জীবনে, পৃথিবীতে খোঁড়াখুঁড়ি করেই মরে। আবার কেউ-কেউ অঙ্গুলিহেলনের বিন্দুমাত্র চেষ্টা ব্যতিরেকেই সব মণিমাণিক্য পেয়ে যায়। তারা যা-পেল, তার দাম পর্যন্ত বোঝে না–তোমার স্বামীরই মতো। আমার কেবলই মনে হয় যে, প্রেমিকার স্বামীর মতো ঘৃণিত থিকথিকে পোকা-সদৃশ জীব ভগবান এই গ্রহে, আর কিছু সৃষ্টি করেননি। তাই-না?

একটু পরেই ব্রেকফাস্ট করে চিপ্লো পুলে যাব। আমার সঙ্গে একটি ভোকসওয়াগানকোম্বি গাড়ি আছে। আফ্রিকান ড্রাইভারের নাম কিলালা। এই কিলালা, সেৎসি মাছ, গাব্বন-ভাইপার সাপ এবং আমার আফ্রিকা সফরের সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছি পঞ্চম প্রবাস উপন্যাস। আর ইয়োরোপ সফরে ফাস্টহ্যাণ্ড অভিজ্ঞতা, যারা কখনো ইয়ারোপে যাননি এবং হয়তো যাবেনও না, তাঁদের যাতে ইয়োরোপ সম্বন্ধে একটি মোটামুটি ধারণা হয়, একথা মনে রেখে লিখেছিলাম প্রথম প্রবাস। বড়ো ভ্রমণণাপন্যাস।

সেদিন তুমি অনুযোগ করেছিলে, ইদানীং তোমাকে আমার সদ্য প্রকাশিত বই দিই না আমি। এবং কেন দিই না? দিই না, কারণ তুমি অনেকই বদলে গেছ। তুমি আজকাল আমার বই তো দূরের কথা, এতকষ্টে লেখা চিঠি পড়ো না। তোমার ছেলে, তোমার স্বামী, তোমার ছোট্ট বাড়ি, ছোট্ট জীবনে, বইয়ের মতো উদার উন্মুক্ত আকাশ কি আঁটে? তুমি আজ নীড়ের পাখি নও, দাঁড়ের পাখি। সমাজের, অভ্যেসের, সংস্কারের দেওয়া দয়ার দান, দয়ার দানা খুঁটে খেয়ে বেঁচে থাকো।

 তোমাকে নিয়ে যেসব বই লিখেছিলাম একদিন, সেসব বইয়ের নায়িকা তুমি; সেইসব বই পড়েও তুমি এমন ভাব করেছ তখন যেন তুমি বুঝতে পর্যন্ত পারোনি যে, তোমাকে নিয়েই লিখেছি।

মানুষকে, অন্য মানুষ অনেকভাবে অপমান করতে পারে। লক্ষ না করা উদাসীনতার অপমান কিন্তু ভীষণ লাগে। তার চেয়ে অত্যাচার, অসম্মান অনেক সহনীয়। তুমি বড়ো নিষ্ঠুর। তোমাকে আর কতদিন চুরি করে ভালোবাসব? চুরি করে দেখব?

চুরি করে করে যে, একেবারেই চোর হয়ে গেলাম।

নাঃ। আর হেরিব না এ কালো বরণ। যে যে সখী কালো আছে, তাদের বলে দে যেন না আসে কাছে; আমার কৃষ্ণ মনে পড়ে পাছে; আমি তাই করি বারণ। আমি হেরিব না এ কালো বরণ।

গানটি মনে পড়ে গেল। চন্ডীদাস মাল মশায়ের গলায় শোনা। পুরাতনিটপ্পা। রাধার কৃষ্ণ ছিল কালো, আর আমার রাধা হচ্ছে কালো। কিন্তু রাধা আমার বড়ো লাজুক, বড়ো বিমুখ।

সমস্ত জীবনটা তবে কি আরাধনা করেই কেটে যাবে আমার? পাওয়া হল না। হবে না?

আটটা বেজে গেছে। এক্ষুনি বেরোতে হবে ব্রেকফাস্ট করে। কিলালা, লবি থেকে ফোন করে তাড়া দিল এক্ষুনি।

***

সেরোনারা লজ
সেরেঙ্গেটি প্লেইনস
তানজানিয়া

কিলালা গতকাল বলেছিল বটে যে, আমার মতো ট্যুরিস্ট নিয়ে ও আর আসবে না।

যে আমার সঙ্গে একবার ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে, সেই-ই আমার প্রেমে পড়েছে, অনেক দোষ সত্ত্বেও, এমনকী কিলালার মতো কালো কদমফুল-চুলের গুণ্ডামার্কা আফ্রিকাবাসী পুংলিঙ্গও। তুমিই একমাত্র মেয়ে যে, আমাকে অপছন্দ করে গেলে সারাজীবন।

 আফ্রিকা এবং বিশেষ করে আদিবাসী ভ্যালি সত্যিই এক দেখবার মতো জায়গা। এখানকার লোকেদের চেহারা, তাদের চরিত্র, আশ্চর্য সব আদিবাসী, বিশেষ করে মাসাইরা আমাকে জাদু করেছে। সুযোগ-সুবিধে এবং আমাকে বহন করার মতো মক্কেলের শক্ত কাঁধ পেলেই বার বার আসব আফ্রিকাতে।

জায়েরে যাওয়ারও খুব ইচ্ছে ছিল। ওখানে আমার এক বন্ধু আছেন। মুমুম্বাসিতে তানজানিয়া এবং কেনিয়া থেকে ওখানে যাওয়ার সুবিধে নেই। জায়ের যেতে সুবিধে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস থেকে। কারণ, জায়ের বেলজিয়ান কলোনি ছিল। তাই ব্রাসেলস থেকে ডায়রেক্ট ফ্লাইট নিয়ে যাওয়া যায়। জায়ের গেলে, কঙ্গো-বেসিনের সৌন্দর্য দেখা যাবে।

কঙ্গো নদ বেয়ে কিনশাশা অবধি আসব স্টিমারে। যদি যেতে পারি। ফিরে এসে, লিখব আমার বাঙালি পাঠক-পাঠিকার জন্যে, যাঁরা বেড়াতে ভালোবাসেন খুব; অথচ যাঁরা যেতে পারেন না তেমন দূরে কোথাও।

 ভাবলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন দুঃখ হয় যে, বাঙালি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত সমস্তর কদর করেন কেবল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বাঙালিরা। বাঙালি, বড়োলোক হলেই ইঙ্গ-বঙ্গ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরেও এমন দুদৈর্বর কথা ভাবা যায় না।

 কেনিয়া আর তানজানিয়াতে ট্রপিক্যাল জঙ্গল আছে, তবে খুব কম। সাভানা গ্রাস ল্যাণ্ডস এবং উঁচু পাহাড় এবং জঙ্গল। আফ্রিকার শীতকাল জুন-জুলাইয়ের। গোরেংগোরোতে খুবই ঠাণ্ডা। আরুশতেও। নাইরোবিতে তো বটেই। নাইরোবি কথাটার মানে জানো? নাইরোবি একটি মাসাই শব্দ। নাইরোবি কথার মানে হচ্ছে, খুব ঠাণ্ডা। আসলে মাসাইদেরই ঘাঁটি ছিল কেনিয়ার নাইরোবি। কিন্তু জার্মান ও ইংরেজদের হোম-এর মতো আবহাওয়া বলে মাসাইরা সেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। এখন তো নাইরোবি মস্ত শহর, কেনিয়ার রাজধানী।

কেনিয়া থেকে তানজানিয়াতে ঢুকে পড়তে কোনো অসুবিধে নেই। একই দেশ, একই বিস্তৃতি, শুধু রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণেই অন্য দেশ। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার মতো। কিন্তু সম্পর্ক দু-রাজ্যের মধ্যে একেবারে আদায়-কাঁচকলায়। তাই এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে সরাসরি আসা যায় না। সেশেলস-এ অন্তত রাত কাটিয়ে, তারপর আসতে হবে। এ এক মহা অসুবিধে। ভবিষ্যতে কখনো হয়তো বম্বে থেকে ডায়রেক্ট ফ্লাইট হবে, অথবা মরিশাস হয়ে। আশা করা যায়।

গতবার ফেরবার সময় মরিশাস দ্বীপপুঞ্জে মাত্র ঘণ্টা খানেক ছিলাম। এয়ার ইণ্ডিয়াতে আসছিলাম। অভীকের দেওয়া দারুণ সুন্দর স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান পাইপটা সিটের সামনের পকেটে রেখে নেমেছিলাম। হাওয়া হয়ে গেল একঘন্টার মধ্যে। ধন্য এয়ার ইণ্ডিয়া। নামের আদ্যক্ষরে হাওয়া বলে হয়তো কোনো কিছুই হাওয়া হতে সময় লাগে না।

মাসাই আর সোয়াহিলি শব্দগুলো কানের আর মাথার মধ্যে যেন বাজে, ঝুমঝুমির মতো ন্যাশনাল পার্কেরও লেখা-জোখা নেই কেনিয়া-তানজানিয়াতে। আর কতরকম তাদের নাম। সেরেঙ্গেটি,লেক-মানিয়ারা, সাভো, আরুশা, মাসাই-মারা, টারাঙ্গিরে, উঁহুরু, রুআহা ইত্যাদি।

 রুআহা নামে আমার একটি বই আছে। ঋজুদা, রুউ এবং তিতিরের অ্যাডভেঞ্চার, আফ্রিকার জঙ্গলে। আরও একটি আছে শুশুনোশুম্বারের দেশে। শুশুনোশুম্বার আফ্রিকার একটি আদিবাসীদের ভূত। এই দুটি বই-ই ঋজুদা সমগ্রতে সংকলিত হবে শিগগিরই ঋজুদার অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে।

 উহুরু বলে রবার্ট রুয়ার্কের একটি বই আছে। পারলে পোডড়া। রুয়ার্কের লেখার একটি আলাদা স্বাদ আছে। হেমিংওয়ের ওপরে কার্লোস বেকারের লেখা, হেমিংওয়ের জীবনী আছে একটি। সেই বইটিও, পারলে পোড়া। আর হেমিংওয়ের গ্রিন হিলস অফ আফ্রিকা। মজার এবং ভালো লাগার বই। সেই বইতে পাহাড়ি মাসাইদের স্তুতি করেছিলেন। হেমিংওয়েকে খুব ভালো লাগে। আর দেশিজগতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

দেশ ছেড়ে বাইরে এলেই বোঝা যায় পৃথিবীটা কত বড়ো, অথচ কত একরকম। চেহারাই শুধু অন্যরকম, কিন্তু সমগ্র পৃথিবীর মানুষই এক। তাদের চেহারা, রীতিনীতি, ধর্মাধর্ম, খাদ্যা-খাদ্য, পোশাক-আশাক আলাদা হতে পারে, কিন্তু ভেতরে, মূল ভাবাবেগে, কামনা বাসনা, উচ্চাশায় সবমানুষই এক। এইকথাটা উপলব্ধি করে খুব ভালো লাগে মনে মনে। পল রোবসন-এর গাওয়া সেই বিখ্যাত গানের দারুণ পঙক্তিটি মনে পড়ে যায়। সাউথ-আফ্রিকার সাদা সাহেবদের বলতে ইচ্ছে করে ওই গান গেয়েই যে

We are in the same boat brother,
If you rock the one end,
You are going to rock the other.

সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে মাত্র চার ভাগে ভাগ করা যায় আমার মতো ভালো এবং খারাপ। শোষক এবং শোষিত।

তানজানিয়ার ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যাবসাদারেরা–তাঁরা অনেকেই যদিও ভারতে কখনো আসেননি, সবাই ব্রিটিশ পাসপোর্ট হোল্ডার। তাঁরা যেভাবে তানজানিয়া-কেনিয়ার কালো কালো গরিব লোকগুলোররক্ত চুষছেন, তা দেখে একজন ভারতীয় হিসেবে নিজের বড়ো লজ্জা হয়।

শুধু সাদা চামড়ারাই শোষক নন, বাদামি, কালো, এবং হলুদ চামড়ারাও শোষক। শোষণ একই ধরনের যা সবরকম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।

নেপালের ধুলাবাড়ির ব্যাবসাদারের মতোই ডার-এস-সালাম-এর ব্যাবসাদার এবং নিউ ইয়র্ক, লানডান, প্যারিস, ব্রাসেলস, কলকাতা এবং পৃথিবীর সব জায়গার বানিয়ারা প্রায় একইরকম। সামান্য ইতর-বিশেষ মাত্র। তফাত কিছু নেই। তাদের অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে তারাই দুর্ভিক্ষ, মহামারি ঘটিয়েছে যুগে যুগে, দেশে দেশে। পতন হয়েছে শুভবুদ্ধির, ন্যায়ের, সদ্ভাবের, শ্রদ্ধার এবং সতোর।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে তারাই সবচেয়ে বড়ো শত্ৰু মানুষের। এটা বড়োই দুঃখের। কালকেই ভোরে রওনা হব কেনিয়ার সীমান্তে লোবো লজ-এর উদ্দেশ্যে। গতবার ওদিকে যাওয়ার সময় হয়নি। খুব ভোরে উঠে সারাদিনের মতো তৈরি হতে হবে।

এখানে কিছুই পাওয়া যায় না, নিয়ে যাওয়ার মতন। আফ্রিকার মেয়েদের বহুবর্ণ পোশাককঙ্গো-কিটেঙ্গে, জাপানিজদের কিমোনোর কাছাকাছি, নিয়ে যাব। আর নিয়ে যাব কাঠের নানারকম জিনিস। কাকই মুখ, নানারকম মোটিফ ইত্যাদি।

ইচ্ছে আছে সেশ্যেলস থেকে ফেরার সময় একটি পছন্দসই প্রেজেন্ট কিনব তোমার জন্যে। খুব সম্ভব, পারফিউম। তোমার শরীর সুগন্ধি হবে; সুগন্ধি হবে আমার কটুগন্ধি স্বপ্ন।

ভালো থেকো।

.

১৪.

চিফ ইঞ্জিনিয়ারস বাংলো
পনিয়াটি ওয়ার্কশপ
জামুরিয়া হাট
বর্ধমান

বাইরে একহাজার ব্যাং ডাকছে।

সত্যি!

তুমি বলবে, সবকিছুই বাড়িয়ে বলা আমার অভ্যেস।

আমি বলব, হয়তো বাড়িয়ে বলি; সময়ে সময়ে, কিন্তু সবকিছু, সবসময় নয়।

তোমাকে আকাশের সমান ভালোবাসি এটাও যেমন বাড়ানো নয়, এই রাতের ব্যাং ডাকাটাও নয়। জানি, অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স হল।

কিন্তু ব্যাং মোটেই ফেলনা জিনিস নয়। গতসপ্তাহে শিলিগুড়িতে ছিলাম। শিলিগুড়ির কাছেই বাগডোগরা এয়ারপোর্টের রাস্তা থেকে ডান দিকে ব্যাংডুবি বলে একটি জায়গা আছে। ইণ্ডিয়ান আর্মির বড়ো ঘাঁটি। সেখানে ব্যাং কবে ডুবেছিল অথবা কাকে ডুবিয়েছিল তা জানি না। কিন্তু একটি মিলিটারি গেস্ট-হাউস আছে সেখানে। একেবারে লা-জায়াব। কিন্তু আমি তো আর কেউকেটা নই যে, আমাকে ওখানে থাকতে দেবেন মিলিটারি টপ বসেরা? আমি তো রাজনীতি করি না। আমি যে, সামান্য একজন লেখক। শুনেছি, ইন্দিরা গান্ধিও হেলিকপ্টারে করে এসে ওখানে ওঠেন। হবে! নেতা-ভোগ্যা বসুন্ধরা!

আজকে ভি-আই-পি মানেই তো পোলিটিশিয়ান। লেখক, গায়ক, চিত্রকর, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কেউই ইম্পর্ট্যান্ট নন এদেশে। যাঁরা রাজনীতি করেন এবং নিজেদের সংকীর্ণস্বার্থে এত বড়ো দেশ এবং দেশ-এর এতভালো সাধারণ মানুষগুলির প্রতি অশেষ অন্যায়ের বেসাতি করেন; তাঁরাই সবচেয়ে সম্মানিত এই অদ্ভুত দেশে। পাবলিক সারভেন্টের সারভেন্ট, এখানে পাবলিকরাই। শিবঠাকুরের দেশের আইন-কানুনই আলাদা। জানি না, কখনো এই অবস্থা পরিবর্তন হবে কি না। এয়ারপোর্টে, রেলওয়ে স্টেশনে, সব জায়গায় ভি আই-পি-লিস্টে, ভিআইপি লাউঞ্জে শুধু এঁরাই? অন্যরা কেউই নন?

চক্ষুলজ্জা ব্যাপারটা বিন্দুমাত্রও থেকে থাকলে, বোধ হয় রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায় না।

 যাক রাজনৈতিক নেতাদের কথা ছেড়ে আবার ব্যাঙের কথাতে আসি। ব্যাং ডাকছে। একহাজার। সোনাব্যাং, ধলাব্যাং, কালোব্যাং, কুটুরেব্যাং, সকলে মিলেই ডাকছে তারস্বরে। যেন, সামনেই ইলেকশান।

পনিয়াটিতে কাপুরসাহেবের এই বাংলোটি চমৎকার। বেঙ্গল কোল কোম্পানির আমল থেকেই সাহেবদের চিফ এঞ্জিনিয়ারের বাংলো ছিল এটি। একপাশে প্রকান্ড লন, বড়ো বড়ো গাছগাছালি হাতাতে। অন্যদিকে বিস্তৃত জায়গা। ভোর না হতেই পাখি আর হনুমানদের ভিড়। আর পেছন দিকে, আদিগন্ত ধানখেত। সেখানে ব্যাঙেদের রাজ।

ব্যাঙেরই মতন হনুমান দেখলেই আমার কেবলই রাজনৈতিক নেতাদের কথা মনে পড়ে যায়। কী যে করি!

আমাকে যে-ঘরে শুতে দিয়েছেন ওঁরা, তার পেছনে বাংলোর হাতা, কুয়োতলা এই-ই সব।তারপরই ধানখেত। ঘরে একটা মান্ধাতার আমলের এয়ারকণ্ডিশনার আছে। তার প্রচন্ড আপত্তি চলতে হয় বলে। তবুও, পুরোনো জুতো এবং স্ত্রীর মতোই বিশ্বস্ত। যদিও ঘর যত-না ঠাণ্ডা হয়, আওয়াজ হয় তার চেয়ে বেশি। হয়তো ঘর ভালোই ঠাণ্ডা হয়, কিন্তু এমনিতেই এত বৃষ্টি হচ্ছে আর ঠাণ্ডা আছে যে; আমি তাকে নিবৃত্তি দিয়ে পাখা চালিয়ে জানালা খুলে শুয়ে শুয়ে তোমাকে চিঠি লিখছি। জানালা খুলোম বলেই ব্যাঙেদের ঐকতান কানে আসছে! তোমার শরীর-মনের সব জানালাও খুলে রেখো সবসময়, দেখবে কত শব্দ ও গন্ধের শরিক হবে। আমার আদরের শামিল হবে তুমি।

 তুমি কখনো অপরিচিত বিড়াল, কুকুর বা পাখি বা বাঁদরের মুখের দিকে যত্ন করে চেয়ে দেখেছ কি?

দেখলে, দেখতে পেতে। তারা প্রত্যেকেই কত আলাদা এবং তাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিত্ব কত লক্ষ করবার।

এমনকী টিকটিকিরও।

তোমার বাথরুমের টিকটিকি নয়, যেকোনো টিকটিকির চোখেই ভালো করে তাকিয়ে দেখো, ওরা ভীষণ ভালোমানুষ। মিষ্টি। মেয়েলি, মেয়েলি।

তা বলে কুমির কিন্তু নয়। কুমিরের চোখে তাকানোই যায় না। কারণ যতক্ষণ চরে বা ডাঙাতে রোদ পোয়ায়, ততক্ষণই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমোয়। ওরা মেয়েলিও নয়, পুরুষালিও নয়। ওরা প্যাতপেতে, থিকথিকে, কাদা-ঘাটা এক উদ্ভট জীব। ওদের দেখলেই ঘেন্না হয়, গা শিউরে ওঠে।

ওদের কান্না আর রাজনৈতিক নেতাদের কান্না একইরকম।

 ব্যাং ডাকছে। ব্যাংদের ডাকও, স্টিমারের ভোঁ-এর মতো একটি সরলীকৃত, স্থির, নিষ্কম্প ব্যাপার। উত্থান-পতন বা আরোহণ-অবরোহণের কোনো বালাই আছে বলে মনে হয় না ওদের গলায়। ওদের গলাতেও স্টিমারের ভোঁ-এর মতোই কোনো কোমল পর্দা দেননি ভগবান। শুদ্ধ পর্দাতেই সব স্বর নয়, মাত্র কয়েকটি স্বর ওঠা-নামা করে। সেইজন্যে একটু একঘেয়ে লাগে। কিন্তু ওরা জানে না যে, একঘেয়েমিটাই ওদের স্ট্রং-পয়েন্ট। মনোটোনি সর্বক্ষেত্রে বর্জনীয়, একথা বলা চলে না।যেমন আমাদের সাঁওতাল ওরাঁওদের গান। ওঁদের গানের দোলানি সুরের পুরো মজাটাই ওই মনোটোনিরই মধ্যে।

ধরো, এই গানটি

রাজা চলে সড়কে সড়কে,
রানি চলে বিন সড়কে,
রাজা মাথে সোনা-ছাতা
 টুকুরি যো উড়ে গে
রানি হাসসে দেখে মনে মনে ….

 এই গানের তাল, আর সুর ছন্দ সবই যেন, ঘুম পাড়িয়ে দেয়। মনে আছে। দ্বারিকদার জসিডিহর চিড়িয়াখানার কাছের সেই কুকড়াডিহ সাঁওতাল গ্রামে রাতভর নাচের কথা? ও ও সরি! তুমি তো যাওইনি সেখানে। অথচ স্বপ্নে, চাঁদনি রাতে, তোমাকে আদুর-গা করিয়ে সাঁওতালি মেয়েদের মতো শুধু একটি শাড়ি পরিয়ে সেই বড়ো অশ্বত্থ গাছের নীচে রাতের পর রাত কল্পনায় কতই না নাচ নেচেছি। এবং নাচের পরে, উদোম গায়ে, খোলা-হাওয়ায় ঝরঝর করে হাওয়া-বওয়া অশ্বত্থ গাছের তলায় শুয়ে কল্পনায় শব্দহীন সমারোহে তোমার সঙ্গে পৌনঃপুনিক চরম পুলকে সংগম করেছি।

সৈয়দ মুজতবা আলী কোথায় যেন লিখেছিলেন, কোথায় ঠিক মনে নেই। লিখেছিলেন : স্বপ্নেই যখন পোলাউ রাঁধছ, ভায়া, তখন আর ঘি ঢালতে কঞ্জুষী করছ কেন?

কঞ্জুষি আমি করি না। তুমি তো হাতে আমার স্বপ্নেরই পোলাও! তাই দরাজ হাতে মহুয়া, ঘি ঢালি আমি। ওয়াট আ পিটি! তবুও তুমি প্রস্তরীভূতই রয়ে গেলে! থাকবেও! তোমার উদ্ধার নেই।–উত্তরণ নেই।–সবচেয়ে দুঃখের কথা, তোমার অধঃপতিত হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই! এর চেয়ে বড়ো দুর্যোগ যেন, কোনো মানুষের জীবনে না আসে। গতিহীনতা, ভয়াল-পতন-হীনতা, থেমে থাকা মানেই মৃত্যু। এর চেয়ে জাহান্নমে যাওয়া ভালো।

এই জামুরিয়া-হাট পেরিয়ে, পনিয়াটি ওয়ার্কশপে এসেছি মিষ্টার অ্যাণ্ড মিসেস কাপুরের অতিথি হয়ে। ওঁদেরই কাজে। কাজ আসানসোলে। কিন্তু আসানসোল থেকে প্রায় সতেরো আঠেরো মাইল দূরে ওদের বাংলোতে এসেই উঠতে হল। আদর-যত্নের ত্রুটি নেই। স্কচ হুইস্কির পর চারকোর্স ডিনার। এবং এখন ব্যাংদের গার্ড অফ অনার। বেশ লাগছে।

কিন্তু ব্যাং ডাকলেই আমার খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করে। আর বৃষ্টি পড়লেও। মনে পড়ে যায়, কুকুরের ঘ্যাটের মতো খিচুড়ি রান্না করে খাইয়েছিলে তুমি একদিন!

রাগ কোরো না, যদিও তুমি নিজে খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত সুখাদ্যর মধ্যেই গণ্য, কিন্তু তোমার হাতের রান্না অতিঅখাদ্য।

রান্না কিন্তু মেয়েদের মস্ত গুণ। এিলল কটাক্ষ যা না পারে, ভালো রান্না করা তৈল-কই অথবা চিতলের পেটি তাই-ই পারে!

শুনে রাখো কথাটা।

 দেখো, আমি না বললে, কে এমন সত্যিকথা বলবে তোমাকে বলো? সংসারে সত্যিকথা শোনার বা বলার লোক বড়ো বেশি জোটে না। আমার তুমি। তোমার আমি!

আজ বড্ড ঘুম পেয়েছে। চার ঘণ্টা ট্রেনে বসে থাকা এবং তারপর একঘন্টা গাড়িতে। বড়োই ক্লান্তিকর। যাঁরাই নিজেরা গাড়ি চালান তাঁদের পক্ষে গাড়িতে প্যাসেঞ্জার হয়ে বসে যাওয়াভীষণই ক্লান্তিকর।

তোমার বরকে জিজ্ঞেস কোরো। দেখবে, ও-ও তাই-ই বলবে।

আসলে চিঠিটা আরম্ভ করেছিলাম বেশ জুত করে। অনেক কিছু লিখব ভেবে, কিন্তু ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। অ্যাইরে, একটা ব্যাং ধরল সাপে।

এবার গিলছে। শনৈঃ শনৈঃ।

গিলুক। আমি ঘুমোই। তুমিও ঘুমোও। মনে মনে আমার এখানের ব্যাংদের অর্কেস্ট্রা ল্যাসার-বিম-এ তোমার শোয়ার ঘরে ট্রান্সফার করে দিলাম। মাইনাস, সাপের ব্যাং গেলার আওয়াজ।

গুডনাইট।

স্লিপ টাইট।

 সুইট ড্রিমস।

সুইটি নাইট। তোমার বুদ্ধদেবদা।

.

১৫.

পূর্ণাকোট
অঙ্গুল সাবডিভিশন
ওড়িশা

কটকে এসেছিলাম মাঝে, ভুবনেশ্বরে কাজ সেরে। একসঙ্গে তিনদিন ছুটি পড়ে গেল শনি, রবি নিয়ে। অনেকদিন আসিনি এদিকে, তাই চলে এলাম।

টিটাগড় পেপার মিলের টিকড়পাড়ার বাংলোতে থাকতে পারতাম। দ্বারিকদা, ঘোষ সাহেবকে (কনক ঘোষ) বলেছিল। মহানদীর পাশে টিটাগড় পেপার মিলের খুব সুন্দর বাংলো আছে একটি। ছবির মতো।

কিন্তু যখন আসার ইচ্ছে ছিল তখন আসা হল না।

টিকড়পাড়ায় তেমন জঙ্গল নেই আর এখন। যদিও মহানদী আছে। সরি, নদ।

যত সুন্দর সব নদী, সব-ই কিন্তু নদ-। অন্তত আমার যা-দেখা, সুন্দর মানে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন খুব। ওড়িশার মহানদী, অসমের ব্রহ্মপুত্র আর আমাদের তিস্তা।

 এই পূর্ণাকোট জায়গাটি আমার বিশেষই প্রিয়। আমার নানা লেখাতে এই পূর্ণাকোট এবং এর আশপাশের নানা অঞ্চলের কথা আছে। তখন আমার শরীরে-মনে ভরা জোয়ার। যা-কিছু দেখতাম, তখন তাই-ই ভালো লাগত, যে-সুন্দরী মেয়ে দেখতাম তাকেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করত। এবং ভালোবাসতে চাইলে তারাও ভালো না-বেসে থাকত না। সেইসব ভিনি-ভিডি ভিসির দিন অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। জীবনের নৌকো এখন নদীর ঘাটে, বটের ছায়ায় বাঁধা। একটিমাত্র ঘাটেই যে, বাঁধা এমন মিথ্যে কথা বলব না। তবুও বলি, পাটাতনে শুয়ে, নৌকোর খোলে স্নিগ্ধ শীতল জলের ছলাৎছলাৎ শব্দ শুনতে শুনতে স্মৃতিচারণ করতে ভালো লাগত। বুকের রক্তও আর আগের মতো ছলাৎছলাৎ করে না সবসময়। ধমনিতে রক্তের দ্রুত দৌড়োদৌড়িতে দিন শেষ। তবু এখন যে, খুব স্থিতপ্রজ্ঞ হয়েছে মানুষটা একথাও বলব না। এখনও ভালোবাসি, ভালোবাসার মতো কাউকে দেখলে। তবে, চোখ বড়োই বদলে গেছে। খুব কম মানুষকেই মনে ধরে। মনে ধরলে, ভয় করে; যদি সে…।

শীতের শিমুলের মতো পাতাঝরা রুক্ষ, উদাসী হয়ে গেছি এখন। কিছুতেই ভালো লাগে না। কাউকেই ভালো লাগে না। বড়ো বিপদ।

মস্ত ভরসা এই-ই যে, তোমাকে এখনও ভালো লাগে।

কটক থেকে ঢেনকানল হয়ে অঙ্গুল হয়ে যে-পথটি চলে গেছে টিকড়পাড়া অবধি, সেইপথেইএ-পূর্ণাকোট। পূর্ণাকোটের একটু আগে ডান হাতে একটি রাস্তা বেরিয়ে গেছে বাঘমুন্ডা। বন-বাংলোর দিকে। বাঘমুন্ডা আবার নগ্ন-নির্জন উপন্যাসের পটভূমি।

পূর্ণাকোট থেকে বাঁ-দিকে একটি রাস্তা বেরিয়ে গেছে। টুলকা বন-বাংলোয়। টুলকা বন বাংলো, কুচিলা-খাঁই এবং অন্য নানা গল্পের পটভূমি। ভীমধারার জলপ্রপাত। সিনথিয়া জোনস এবং তার দুঃখের কথা আছে কুচিলা-খাঁই গল্পে। পূর্ণাকোট থেকে একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে ডান দিকে এবং সেই রাস্তাতেও গিয়ে পৌঁছানো যায় বাঘমুন্ডা বাংলোতে। এই রাস্তায় কূপ-কাটা ক্যাম্প এবং পূর্ণাকোট–ওপরের টিকরপাড়ার পথের তৈলা।

জঙ্গলের জার্নাল উপন্যাসের পটভূমি। অঙ্গুল থেকে পূর্ণাকোটে আসবার পথে করতপটা বলে একটি ঘুমন্ত গ্রাম পড়ে। তারই আগে পানমৌরি আর সলপরাসর দোকান। সলপ একরকমের গাছ, অনেকটা আমাদের তালগাছের মতো দেখতে,–সেই গাছের রস থেকে প্রচন্ড কড়া একরকমের মদ তৈরি হয়। তোমার ঠোঁটের মতো মাদকতা তাতে।

 একবার জিপ থামিয়ে, এই দোকানে, পানমৌরি কিনতে নেমেছে কটকের কটকচন্ডী রোডের ফুটুদাদের দুর্গা মুহুরি। আমি জিপের ড্রাইভিং-সিট-এ বসে পাইপ খাচ্ছি। হঠাৎ দেখি, একটা লোক মাতাল হয়ে, পানমৌরির বোতল বগলদাবা করে গান গাইছে।

আলো, শুকিলা সাড়ু, মন মরি গলা দ্বিপাহারু।

এই লাইনটি দর্শনশাস্ত্রের অতিগভীর বাণী বহন করে নিয়ে এসেছিল তখন আমার তাৎক্ষণিক মনে। ওড়িয়া ভাষাতে ওই লাইনটির মানে হল, ওরে শুকনো কচু, তোর মন মরে গেল দ্বিপ্রহরে। গায়ক নিজেকেই নিজে শুকনো কচু বলে ভাবছে আর বলছে, হায় হায়, তোমার মন মরে গেল দুপুরবেলায়।

এই ভরদুপুরে আমাদের অনেকেরই মন মরে। মন-মরা থাকি অনেকই সময়। কিন্তু মনের মরার মুহূর্তটিকে, এমন সামান্য কথায় অসামান্যভাবে প্রকাশ করা সহজকথা নয়।

আরও একদিনের কথা মনে পড়ে। সেবারে কটক থেকে জঙ্গলে আসতে রাত হয়ে গেছিল। জঙ্গলের মধ্যে জিপ থামিয়ে, বনেটের ওপর হুইস্কির গ্লাস রেখে আমরা হুইস্কি খাচ্ছি। একটু আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। শিরশিরে বাতাস বইছে জঙ্গলের বুকের মিশ্রগন্ধ বয়ে। জঙ্গলের মধ্যে জোনাকিরা নীলচে আলোর স্পন্দিত বিন্দু দিয়ে আলোর আলপনা আঁকছিল ভিজে, সুগন্ধি অন্ধকারে।

 বর্ষার বনের বৃষ্টিভেজা গায়ের এক আশ্চর্য নিজস্ব গন্ধ আছে। ক্যামে সাবান মেখে তুমি চান করে বেরোবার পরই তোমার স্তনসন্ধিতে নাক রাখলে, যে-সুগন্ধে আমি কুঁদ হয়ে যাই, তার চেয়েও মিষ্টি ও মাতাল-করা সে-গন্ধ।

তুমি ছাড়াও হাজার নারীর ভালোবাসা পেয়ে ধন্য বোধ করেছি এ-জীবনে। আজীবন কৃতজ্ঞ থেকেছি এবং থাকব। কিন্তু প্রকৃতির মতো এত ভালো আর কোনো নারীকেই বাসতে পারিনি। এবং দয়া করে কোনোদিনও পারব না। কোরো মার্জনা, কোরো মার্জনা– পারব না কোনোদিনও।

 ঝিঁঝি ডাকছে চার ধার থেকে। শম্বরের ঢাক ঢং ডাক ভেসে আসছে নীচের খাদ থেকে। নিশ্চয়ই বড়ো বাঘ রোদে বেরিয়েছে। ঠিক এমন সময় মেয়েলি গলায় গান গাইতে গাইতে একটি বাচ্চা ছেলে ওই শ্বাপদসংকুল জঙ্গলের পথে পূর্ণাকোটের দিক থেকে হেঁটে আসছিল।

গানটির কথা ছিল ওরে মোর সজনি, ছাড়ি গলা গুণমণি; কা কর ধরিবি?

মানে হচ্ছে, ও মোর প্রিয়া, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে; এখন আমি কার হাতে হাত রাখব?

 বন্ধু, রহো রহো সাথে, কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখো, হাতে–গানখানি কোনো নিস্তব্ধ বৃষ্টিভেজা রাতে নীলিমা সেনের গলায় শুনলে বুকের মধ্যে যে এক তীব্র কষ্ট উঠে এসে শ্বাসরোধ করে ফেলে, এই ছেলেটির গানের কথায় এবং গায়কিতে তেমনই কিছু ছিল।

এই গানটি পারিধী উপন্যাসে একটি বিশেষ চরিত্রে, বলরামের চরিত্রে এবং এক বিশেষ ব্যঞ্জনাতে ব্যবহার করেছি। পারিধী কথাটি একটি খ উপজাতীয় শব্দ। অর্থ, মৃগয়া। অনেক বইয়ের দোকানে পাঠকেরা শুধিয়েছেন, বুদ্ধদেববাবু কি, পারিধি বানানটাও জানেন না? আমি নিতান্ত মূর্খ যে,একথা কখনো অস্বীকার করি না। কিন্তু এত বড়ো মূর্খ বলে মনে করলে পরমমূর্খরও দুঃখ হয়। এই নামের জন্যই অনেক পাঠক এই ব্যতিক্রমী বইটি পড়ার আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছেন।

নিজের মনে ভাবলে, মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই যে, একটুকরো কথা, এককলি গান, এক ঝলক দেখা, একচিলতে হাসি, মুহূর্তের বাঙময় নীরবতা, সবই কেমন অবচেতনের অশেষ শক্তিশালী কম্পিউটারে বিধৃত থাকে আর ঠিক সময়মতো কেমন দৌড়ে আসে কলমের মুখে আশ্চর্য!

পূর্ণাকোটে পৌঁছোবার বেশ কিছু আগে, করতপটার পর একটি রাস্তা চলে গেছে বাঁয়ে। সেই রাস্তা পৌঁছেছে গিয়ে লবঙ্গীতে। চমৎকার ছবির মতো খড়ের চালের বন-বাংলো। টিলার মাথায়। চারপাশে নিচ্ছিদ্র ও দুর্ভেদ্য জঙ্গল। এখানের জঙ্গলের নিচ্ছিদ্রতা এমনই যে, মনে হয় সুন্দরবনের বা অন্য কোনো ম্যানগ্রোভ বনের জঙ্গল বুঝি। এই লবঙ্গীর পটভূমিতে লেখা আমার লবঙ্গীর জঙ্গলে।

পারিধী উপন্যাসের উত্তরসূরি; দ্বিতীয় খন্ড।

পূর্ণাকোটের পথের ওপর যে-পুরোনো দোতলা বাংলো, আমি এবারে সেই বাংলোতে উঠেছি। আরও একটি পাকা বাংলো হয়েছে জঙ্গলের ভেতরে, টিলার মধ্যে, সেখানটাতে বড়ো দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে আমার। হানিমুন-কটেজের মতো কৌটো-বন্ধ বাংলোটা। তাই-ই সেখানে থাকিনি। তুমি যদি কখনো একা আমার সঙ্গে জঙ্গলে আসতে, তাহলে ওই বাংলোতেই উঠতাম। আমাদের কেউই দেখতে পেত না। কত গল্প করতাম, কত চুপ করে থাকতাম; বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা কত অপূর্ব ঝুমঝুমি শব্দের সঙ্গে কত দেখতাম একে অন্যেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, নিভৃত পাখি-ডাকা বনগন্ধের নিবিড় নির্জনে! ভাব ভাব কদমের ফুলের মতো ভাব হত তোমার, আমার সঙ্গে। কী গভীর আনন্দ!

থাক। যে-স্বপ্ন সত্যি হয়নি, হবে না কখনো, তাকে মনে মনে বেশি নাড়াচাড়া করলে, তেতো হয়ে যায় তা। স্বপ্নও লেবুরই মতো। বড়ো ডেলিকেট। সহজেই কালশিরে পড়ে তার গায়।

এখন বেশ শীত বাইরে। আমার খাওয়া হয়ে গেছে। বারান্দাতে বসে আছি ইজিচেয়ারে। কোটের কলার তুলে দিয়ে বাঁ-হাত পকেটে, আর ডান হাত গরম পাইপে রেখে। পা-দুটি তুলে দিয়েছি বারান্দার রেলিঙে।

ঘোর অন্ধকার রজনি।

সামনে বিস্তীর্ণ ধানখেত। ধান পেকে গেছে। শীতের কুয়াশায় ধুয়ো ধুয়ো হয়ে আছে সব দিক। সারারাত হাতি অত্যাচার করবে এই ধানখেতে। ছোটো ছোটো মাচান বানিয়ে পাহারা দিচ্ছে ওরা, দূরে দূরে। কিন্তু তাতে হাতিরা ক্ৰক্ষেপ মাত্র করে না। শুয়োর, হরিণ, শম্বর হয়তো ভয় পায়। হাতি মোটেই পায় না।

আছাড়ি পটকাও ফাটায় ওরা মাঝেমধ্যে। কিন্তু নিষ্ফল।

এই জঙ্গলে সব জানোয়ারই দেখেছি, কিন্তু নীল-গাই দেখিনি। নীল-গাইয়েরা বোধ হয় এত ঘন-জঙ্গল পছন্দ করে না এবং এত পাহাড়ি জায়গাও। মোটামুটি সমতল এবং টিলাপ্রধান জঙ্গলে,একটু শুখা জায়গায়, যেমন বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশেই এদের বেশি দেখেছি।

কিন্তু দশপাল্লার খন্দদের আবাস, উঁচু পাহাড় বিডিগড়ে নীলগাই দেখেছিলাম। ওড়িয়াতে নীলগাইকে বলে ঘড়িং। পারিধী উপন্যাসে একটি পুরুষ নীলগাই-এর কথা আছে। নীলগাইকে কে বা কারা গুলি করে মেরে ফেলে গেছিল। পুরুণাকোটে কেন দেখা যায় না নীলগাই তার কারণ ন্যাচারালিস্টরাই বলতে পারবেন।

তোমাকে বোধ হয় আমার একতরফা বুকনিতে একেবারে ক্লান্ত করে দিলাম এতক্ষণে। ঠিক আছে। রাত হয়েছে, ঘুমোও এখন।

আমি দেখতে পাচ্ছি মনের দূরবিনে, ঘুমোচ্ছ তুমি। গলা, বুক ও কাঁধের কাছে ফ্রিল দেওয়া হালকা নাইটি পরেছ একটি। হালকা গোলাপি ফুল-ফুল কটন প্রিন্ট-এর ওপর। পাশ ফিরে শুয়ে আছ,দু-হাতের পাতা এক করে। খাটের পাশের ছোটো আলোটা জ্বলছে। তোমার শায়িত শরীরের ছায়া পড়েছে ড্রেসিং টেবলের আয়নাতে!

তুমি ঘুমিয়ে পড়ছ, খুব আস্তে আস্তে, সন্ধেবেলায় স্থলপদ্মরা যেমন, পাপড়ি গুটোয়, তেমন করে।

ঘুমোবার সময় তুমি দু-হাতের পাতাজুড়ে, গালের নীচে রেখে শোও কেন এল তো? তুমি কি তোমার অপারগতার জন্যে আমার কাছে বরাজ ক্ষমা চাও? হাতজোড় করে?

 ক্ষমা আমি করব না, করিনি। মৃত্যুর পরও করব না। ভূত হয়ে তোমার ঘরে, তোমার আদর খাওয়ার খাটে দাপিয়ে বেড়াব।

তোমার স্বামীর কাঁধে ভর করে ধেই-ধেই করে নাচব। তোমার গুণ্ডা ছেলের মাথায় উড়নচাঁটি মারব। তোমাকে জ্বালিয়ে খাব। কেটে-কুটে; চেটে-পুটে। আমাকে তুমি যে-কষ্ট দিয়েছ এ-জীবনে, তার প্রতিকার এ-জীবন এবং আরও অনেক জীবনেও হবে না। অতএব তৈরি থেকো। একেবারে টিট ফর ট্যাট যাকে বলে, তাই-ই করব।

হুঁ! হু! পেতনি! আমি ভূত হয়েও তোমাকে আদর করব।

চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন : If you pay evil with good, what do you pay good with?

সুতরাং I will pay evil with evil i

আঁতএব আঁতি সাবধানে ঘেঁকোঁ।

তোমার চোখের পাতায় চুমু দিলাম। ছোট্ট মেয়ে। সুইট ড্রিমস।

.

১৬.

প্রিন্স হোটেল
হাজারিবাগ

আনন্দবাজার-এ খবরটা নিশ্চয়ই দেখেছ যে, হাজারিবাগে মানুষখেকো লেপার্ড বেরিয়েছে এবং আমি মারতে যাচ্ছি।

নাও পড়ে থাকতে পারো, কারণ তোমার স্বামী তো আনন্দবাজার রাখা বন্ধ করে দিয়েছে। বদলে, গণশক্তি রাখছে। আনন্দবাজার, যুগান্তর, আজকাল সবই নাকি বুর্জোয়াদের কাগজ। তাই নিজে পরমবুর্জোয়া হয়েও বাড়িতে একমাত্র গণশক্তি রেখে সে প্রমাণ করতে চাইছে যে, সে প্রলেতারিয়েত।

এদেশে সবই মানিয়ে যায়। নেতারাই যখন ভন্ডামির প্রতিযোগিতাতে গোল্ড মেডালিস্টএক-একজন, তখন তোমার স্বামীর মতো সাধারণ একজন সুযোগ-সন্ধানীকে দোষ দিই কেন?

আসল কারণটা কী জানো? আনন্দবাজারে আমার লেখা বেরোয় যে! যুগান্তরে কি আজকালেও বেরোতে পারে। কিন্তু গণশক্তিতে হয়তো বেরোবে না–

তাঁরা লিখতে বলেননি।

একথা আর কেউ না জানুক ধূর্তচুড়ামণি কিন্তু মূখের-ভেকধারী তোমার স্বামী বিলক্ষণ জানে।

পাছে আমার লেখা পড়ে, আমার কথা তোমার মনে পড়ে যায়, পাছে তুমি আমাকে হঠাৎ ফোন করে বসো, পাছে দেখা করো, অথবা আদর করো, সেই ভয়েই তোমার স্বামী সবসময় সিঁটিয়ে থাকে। সম্মুখ সমরে সে, চিরদিনই হারবে আমার কাছে সব দিকেই। আমার সঙ্গে কোনোভাবেকোনো প্রতিযোগিতাতে নামারই যোগ্যতা নেই তার। তাই তো সে, চোরাগোপ্তা ছুরি চালায়,ছলে-বলে-কৌশলে। ছোট্ট-সুখের, ধূর্তমুখের, ক্ষুদ্রমনের সংকীর্ণ-বাসার চড়াই পাখি ও। আর আমি বাজ। চড়াই পাখির মতো সে ছোটো-ছোটো ইতর-হানা হানে আমার বুকে। বিষের ঠোঁটে। কিন্তু ও জানে না যে, আমি বাজ। ছোঁ মেরে নিতে চাইলে, তোমাকে একছোঁতেই উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম নিরুদ্দেশ আকাশে, আমার উষ্ণ লোমে-ঢাকা বুকে তোমার ভয় পাওয়া ধুকপুকবুক আশ্রয় পেত। চিরদিনের মতো। কিন্তু বাজ বলেই চড়াই পাখির ঘর ভাঙার ইচ্ছে নেই আমার I am not the least interested in any episode of sparrows। তার সুখ তারই থাক। তার স্ত্রী তারই থাক।

একজন পুরুষ, একজন নারী, তাদের সামাজিক স্থিতাবস্থাতে বাঘবন্দির ঘরের খুঁটি হিসেবে তাদের নিজ নিজ যাথার্থ্য প্রমাণ করেও অন্যকে অনেক কিছু দিতে পারে, নিতে পারে অন্যের কাছ থেকে যে, একথাটা বোঝার মতো উদারতা বা বুদ্ধি তোমার স্বামীর নেই। হবেও না কোনোদিন। তাই সে সবসময়ইভয়ে মরে, উৎকণ্ঠায় সিঁটিয়ে থাকে কী করে আমার কোন সর্বনাশ করবে। এই মতলবে থাকে। তার সংসারের নিশ্চিন্ত আবর্তে আবর্তিত হয়ে কাজ খাওয়া–রমণ–ঘুম–কাজ–খাওয়া–রমণ– ঘুমে লেপটে থাকতে চায় ল্যাজে-গোবরে হয়ে, ফসল-ন্যাড়ামাঠের একলা লোলচর্ম, রোমহীন ষাঁড়ের মতো।

থাকুক।

ওর মনে বিঘ্ন না ঘটিয়েও আমি আমার যা-পাওয়ার তা পেতে পারি, পেয়েছি। এবং পাব। সে-কথা ও যেমন জানে, তুমিও জানো। তুমি কিন্তু ওর প্রতি যত ভালো, আমার প্রতিও ততই ভালো হতে পারতে। তুমি ওর সন্তানের জননী বলেই যে, ওর প্রতি বেশি বিশ্বস্ত হতে হবে এর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ বা যুক্তি আমি অন্তত দেখতে পাই না।

এক বিশেষ রাতে ওর আদর না-খেয়ে আমার আদর খেলেও তো তুমি ওর সন্তান না বয়ে আমার সন্তান বইতে পারতে গর্ভে। যদি ভালোবাসা না থাকে তেমন, যদি প্রেম বা সম্মান না থাকে সম্পূর্ণ তাহলে কে কার গর্ভে কোন বীজ রোপণ করল তাতে কার কী এসে যায়?

 তুমিও দারুণ ভন্ড। হয়তো মেয়েমাত্রেই ভন্ড। প্রথম শ্রেণির অভিনেত্রী তোমরা। জন্মাবধি। মঞ্চে বা পর্দায় না-নেমেও। তুমি আবার কুসংস্কারাচ্ছন্নও। তুমি আমার সঙ্গে আশ্লেষে অঙ্গাঙ্গি হয়ে পরমানন্দের চাপা, উষ্ণ, মনোসিলেবেলের হঠাৎ, অনিচ্ছাকৃত প্রকাশে আমার প্রেমিকা হতে পারো, আনন্দে, আবেশে, শিউরে শিউরে উঠতে পারো, কালনাগের আলিঙ্গনাবদ্ধ কালনাগিনির মতো; কিন্তু তবু, আমার সন্তানের মা হতে পারো না। কোনোদিনও কি মূর্খপুরুষ ও জাতি সঠিক জেনেছে তার কোন সন্তান কার? জয়! ভন্ডরাজের জয়! জয় ভন্ডরাজ্যের জয়।

 শিকার ছেড়ে দিয়েছি বহুদিন। ভালো লাগে না। একটা বয়েস বোধ হয় থাকে, বাহাদুরিপ্রবণতার। সেই বয়েসটা পেরিয়ে এলে এবং বাহাদুরি যাদের কাছ থেকে প্রাপ্য ছিল আমার, সেই লোকেদের অনুপস্থিতির ফলে, বাহাদুরি-প্রবণতাটাও দিনশেষের রোদের মতোই নিঃশব্দে মরে যায়।

কিন্তু কী বিপদেই পড়েছি! খবরের কাগজে ছাপা হয়ে গেল বুদ্ধদেব গুহ হাজারিবাগে মানুষখেকো মারতে যাচ্ছেন। এখন তো না গেলে ইজ্জত থাকে না। অন্তত বর্ধমান অবধি যাওয়া বিশেষই দরকার।

সোমবার সকালে, গোপালকে আমি ফোন করেছিলাম অন্য লোকের মুখে শুনে।

 ও বলল, হ্যাঁ আমি যাচ্ছি। আমার নামেই পারমিট। ম্যানইটিং লেপার্ড! তুমি চলে এসো।

কিন্তু গোপালের যে হাজারিবাগি-তিড়িবাজির অভ্যেসটি ধেড়ে খোকা হয়েও যায়নি, তা আমার জানা ছিল না।

যাব, এই কথা আমার কাছ থেকে শুনে পার্থ বসু টুকরো খবরে এক সোমবার এ-খবর প্রচার করে দিলেন। তারপরই কেলেঙ্কারি। টেলিফোন, চিঠি; সমূহ সর্বনাশ!

 কাল অফিসের পর কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলাম ছ-টা নাগাদ। সঙ্গে এ-বি কাকু। জি টি রোড-এর অবস্থা যে এমন হয়েছে, জানা ছিল না। বর্ধমান পৌঁছোতেই রাত দশটা হয়ে গেল। বর্ধমানের পর পথের ধাবাতে রুটি-তড়কা দিয়ে ডিনার সারলাম।

ধাবার মালিক সর্দারজি শুধোল, বীর পিজিয়েগা সাব?

প্রথমে বুঝতে পারিনি। ভীরু লোকেরা, আমার মতো, বীর কথাটি শুনতেও ভয় পায়।

তারপর তিনি বললেন, বিলকুল ঠাণ্ডা হ্যায়।

 তখন বুঝলাম বিয়ার।

কিন্তু না খেলেই ভালো হত। ওই গুরুর চেলা হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। গুরুরাই ওই বিশেষ গুরু ভক্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখে।

 বর্ধমান থেকে রাত এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে আসানসোলে যখন পৌঁছোলাম, তখন রাত আড়াইটে। একটা নতুন হোটেল করেছে। এয়ার-কণ্ডিশানড। জি টি রোডের ওপরেই। সেখানেই তিন চার ঘন্টা ঘুমিয়ে নেব বলে ভাবলাম।

প্রচন্ড গরম ছিল, গুমোট দমবন্ধ গরম, রাতের বেলাও।

পথে অনেকেই বলছিল যে, আজকাল রাতে জি টি রোডে যাতায়াত করা ঠিক নয়। গাড়িতে। আমি তো বেঠিকের কিছু দেখলাম না। অবশ্য বেঠিক হলেও হয়তো ঠিক হয়ে যেত। কারণ এ-বি কাকু এবং আমার দুজনেরই কোমরে যার যার পিস্তল বাঁধা ছিল। গাড়ি চালাচ্ছিল রবি, তাই প্রয়োজন ঘটলে মোকাবিলার জন্যে দু-হাতই মুক্ত ছিল। অবশ্য আজকাল পিস্তল কোনো অস্ত্রই নয় প্রতিরক্ষার।

আজ ভোরে উঠেই তৈরি হয়ে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু দেখি, বরাকরের সংকীর্ণ ব্রিজে লরি উলটে রয়েছে। অতএব প্রধানতম জাতীয় সড়ক বন্ধ। শয়ে শয়ে লরি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এত ইম্পর্ট্যান্ট রাস্তার এত ইম্পর্ট্যান্ট একটা ব্রিজকে যে কেন চওড়া করেন না কর্তৃপক্ষ তা তাঁরাই জানেন।

তেমনই আর একটা ব্রিজ বর্ধমানের আগের নুনিয়া ব্রিজ। যাইহোক, দেশের ভাবনা ভাবার জন্যে এতসব হোল-টাইম তালেবর প্রফেশনাল লোক থাকতে আমার মতো অর্বাচীনের এসব ভাবনা না ভাবাই ভালো। শুধু মনে হয় যে, সহ্যশক্তি আমাদের অসীম। কান ধরে সবরকম খাজনা চোখ রাঙিয়ে আদায় করতে সরকার প্রচন্ড দড়, তার বদলে কাউকেই কিছু দিতে নারাজ। যারা ট্যাক্স দেয় সবরকম তাদের বলা হয় জনগণের সেবার জন্যেই তা আদায় করা হচ্ছে। ট্যাক্সের টাকা সাত ভূতে মিলে ছয়লাপ করে। জনগণও যে তিমিরে, সেই তিমিরেই। যেকোনো দেশেই পাবলিক এক্সপেণ্ডিচারের ক্ষেত্রে সুদৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে, পাবলিক ইনকামের তা বাড়ানোর কোনো সংগত কারণ থাকে না। এই রঙ্গই চলে আসছে স্বাধীনতার পর থেকেই।

.

মাইথন হয়ে ঘুরে আবার জি টি রোডে পড়ে বাগোদর, বিষেণপুর এবং টানিঝারিয়া, কোররা হয়ে যখন হাজারিবাগ পৌঁছোলাম তখন প্রায় বিকেল।

কথা ছিল, গোপালের বাড়িতেই উঠব, কিন্তু সঙ্গে এ-বি কাকু থাকায় প্রিন্স হোটেলেই গেলাম প্রথমে।

হোটেলে ঢোকার মুখেই সাউথ-ক্যালকাটা রাইফেল ক্লাবের এক দলের সঙ্গে দেখা।

সাধনদা পালের গোদা। জিপে করে ফিরছেন ওঁরা সবে সারাদিনের বিটিং শিকার সেরে। কাল ঝালদা থেকে এসেছিলেন জিপ নিয়ে। আজই আবার ফিরে যাবেন। গোপাল, সাধনদা অ্যাণ্ড কোম্পানি, ঝরিয়ার বদিবাবু (বদ্যিনাথ রায়) সকলেই বিটিং-এ গেছিলেন শুনলাম। এখন বদিবাবু হাজারিবাগেই সেটল করেছেন। বদিবাবুর ছেলেরাও বিটে গেছিলেন।

সাধনদার মুখেই শুনলাম যে, জন্তুটি লেপার্ড মোটেই নয়। নেকড়ে বাঘ। বিহারে যাকে বলে, হুণ্ডার। একদল।

খুবই মন খারাপ হয়ে গেল। প্রথমত জন্তু লেপার্ড নয়, হুণ্ডার বলে।

দ্বিতীয়ত, ইতিমধ্যেই এত শিকারির সমন্বয় ঘটেছে বলে। এবং শিকারি তাঁরা, কেউই আমার চেয়ে ভালো ছাড়া, খারাপ নন।

গোপালের ওপর রাগও হল খুব। সন্ধেবেলা ওদের বাড়ি গিয়ে বুঝলাম যে, ব্যাপারটা ও জানত। বহুদিন আমি হাজারিবাগে যাইনি বলে ও নাকি বন্ধুকে ট্রিক করে আনিয়েছিল। আমি টোটালি ডিসঅ্যাপয়ন্টেড এবং ফ্রাস্টেটেড হলাম। এই গরমে এতখানি গাড়ি চালিয়ে, এত টাকাপয়সা খরচ করে আসাই বৃথা হল। বন্ধু যে আমাকে ভালোবাসে এবং আমার সঙ্গ চায় এজেনে ভালো লাগল যেমন, তেমন রাগও হল।

নেকড়েরা ছোটো ছোটো দলে থাকে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে এত ব্যস্ততার মধ্যে নেকড়ে মারার জন্যে এখানে অনির্দিষ্টকালের জন্য বসে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। গোপাল বলল, বরহি রোডের বাঁ-পাশে, পদ্মার রাজার বাড়ির অনেক আগে কতগুলো নালা আছে। সেখানে নাকি মর্গ থেকে বেওয়ারিশ সব মৃতদেহ ফেলা হত। কয়েকটি নেকড়ে, মড়া খেয়ে খেয়ে মানুষখেকো হয়ে যায়। তারপর হাজারিবাগ–বরহি রোডের দু-পাশের গ্রাম থেকে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে ধরা আরম্ভ করে। দু-একজন বুড়িকেও নাকি ধরে। সবসুদ্ধ ন জনকে ধরার খবর ছিল তখন।

ন-জনকে ধরার পরই, ডি এফ ও এবং ডি এম ম্যানইটার ডিক্লেয়ার করে, পারমিট দেন।

 যাইহোক, পরদিন বদিবাবুর ছেলে ও গোপালের সঙ্গে হাজারিবাগের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার মুখার্জির সঙ্গে আলাপ করতে গেলাম। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অতিসুন্দর ও সুন্দরী। প্রবাসী বাঙালি। কমবয়েসি। দুঃখ হল, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে ওঁদের সম্পর্ক ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে বলে। কী করে নেকড়ে নিধন করা যায়, সেই নিয়ে সকলে মিলে আলাপ আলোচনা করা গেল।

গোপালের হাজারিবাগেই একটি সুন্দর বাড়ি আছে। বরহি রোডে। হাজারিবাগেই অফিসের ব্রাঞ্চ পর্যন্ত খুলে বসেছে ও। ওর পক্ষে মৌরসিপাট্টা গড়ে ওখানে নেকড়েদের মোকাবিলা করা অনেক সহজ।

ক্কোসমাতে গিয়ে পিকনিক হল অনেকদিন পর। খুব ভালো লাগল আশোয়া, আশোয়ার পরিবার কাড়য়ার বেটা রত্না, রত্নার বউ সকলের সঙ্গে দেখা হয়ে। পুরোনো দিনের অখন্ড অবসর ও ছেলেমানুষি, অনাবিল আনন্দের স্মৃতিভরা দিনগুলি চকিতে ফিরে এল মনে। সেসব দিন আর ফিরবে না। দুঃখ হল, কাড়য়ার সঙ্গে দেখা হল না।

নাজিমসাহেবের পাঠানো বাখরখানি-রোটি, কাবাব এবং জয়শ্রীর তত্ত্বাবধানের ফার্স্ট ক্লাস খিচুড়ি এবং নানারকম ভাজাভুজি দিয়ে পিকনিক চমৎকার জমল তার সঙ্গে আবার পিস্তল প্র্যাকটিসও গাছের ডালে বিয়ারের বোতল ঝুলিয়ে রেখে।

সেদিনই রাতে, যে-অঞ্চলে নেকড়েরা বাচ্চা ধরছে, সেই অঞ্চলে ঘণ্টা দুয়েক ঘোরাঘুরি করলাম আমি, গোপাল আর বিশু।

কিন্তু ক-টি শিয়াল এবং একটি বনবিড়াল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।

কাল ভোর বেলা এখান থেকে বেরোব। জি টি রোডের যা-অবস্থা, জি টি রোড দিয়ে যাব না। রাঁচি হয়ে হাইওয়ে ধরে বহড়াগড়া, খড়গপুর, হয়ে ফিরে যাব কলকাতা।

হাজারিবাগ-বৃত্তান্ত আপাতত শেষ হল।

খবরটা কাগজে বেরোনোর পর তুমি ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলে, তাই তোমাকে সবিস্তারে জানালাম।

গোপাল নিশ্চয়ই কয়েকটি নেকড়ে মারবে সবগুলো না মারতে পারলেও।

 টুটু ইমামের ছেলে বুলু ইমামের চিঠি দেখলাম গোপালের কাছে।

তার মতে, যে-জন্তুটি বাচ্চা ধরছে, তা নাকি ক্যানারি হিলের একটি লেপার্ড। নেকড়ে নয়। শিকারিদের মধ্যেও অনেক রেষারেষি, মন-কষাকষি, ও রাজনীতি চলে। চলাই স্বাভাবিক। শিকারিরাও মানুষ। অথচ স্পোর্টস-এ এই ঘৃণিত ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকলে কতই না ভালো হত।

.

১৭.

কলকাতা

পৌঢ়ত্বের প্রথম-প্রহরে পা রেখেছি আমি। জীবনের দীর্ঘ ধূলিমলিন পথে, দ্বন্দ্ব, দ্বেষ, ঈর্ষার কাঁটায় চলে চলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছি। হৃদয়ের সব সততা ও আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছি মানুষকে, বদলে পেয়েছি অভিনয়, শঠতা এবং হৃদয়হীনতা।

সেদিন তোমাদের বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে যখন বলেছিলাম যে, সত্যিই বড় কষ্ট হয় আজকাল তোমার কাছে আসতে; জানি না সেদিন আমার কষ্টের স্বরূপ কতখানি তুমি বুঝেছিলে।

বলেছিলে, মঙ্গলবার ফোন করবে।

আমি জানতাম যে, তুমি ফোন করবে না। গতবারো বছরে ন্যূনতম ভদ্রতা বজায় রাখতেও মানুষ যেটুকুও ভালো ব্যবহার করে, সেটুকুও তুমি করোনি আমার সঙ্গে। তবুও তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে এসেছি, ভালোবেসেছি। কারণ, না-বেসে পারিনি। ভুল করে, ভুল জনকে ভালোবেসেছিলাম, জীবনের ভুল সময়ে তার মূল্য দিচ্ছি জীবনভর, জীবন দিয়েই। তোমার কাছে যত কষ্ট করেই যাই না কেন, তোমার সঙ্গে পাঁচ মিনিটও কথা বলার সুযোগ পাই না। বলতে পারি না। মজিদ, নিশীথ, অনুপম, নিরূপম, যম, জহ্লাদ, রাবণ, দুর্যোধন, তারকা, হিড়িম্বারা সব, ঘরজুড়ে বসে থাকে।

 তোমার মধ্যে যেটুকু সাহিত্যপ্রীতি, গভীরতা, আত্মমগ্নতা, ব্যক্তিত্ব, আমার মনের মতো করে গড়ে তুলেছিলাম তোমার বিয়ের আগে, তার চিহ্নমাত্র আর তোমার মধ্যে অবশিষ্ট দেখি না। চোখে জল আসে। তোমার মিষ্টি ব্যবহারটুকু ছাড়া, পুরোনো তুমির কিছুই বাকি নেই তোমার মধ্যে। ইলেকশনে-দাঁড়ানোর মানুষের মতো অহেতুক আজেবাজে লোকের কাছে দুর্বোধ্য জনপ্রিয়তার কামনা তোমার মধ্যে শিকড় গেড়ে বসেছে। একদিন, জীবনের সায়াহ্নে এসে যখন, নিজে আয়নার সামনে দাঁড়াবে, তখন বুঝতে পারবে কী আশ্চর্য হেলাফেলায় নিজের একটাই জীবনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছ! তোমার বা তোমার স্বামীর মতো অজাতশত্রু হওয়ার সাধনা আমি কোনোদিনও করিনি। অজাতশত্রু শব্দটাই বোগাস। একটা সস্তা গিমিক। কারণ, যে-মানুষের ন্যায়-অন্যায় বোধ আছে, জীবনে পালন করার মতো কোনো ব্রত আছে, নিজস্ব মতামত আছে, তিনি কোনোদিনও সর্বজনপ্রিয় অজাতশত্রু হতে পারেন না। যিনি ভালো, খারাপরা তাঁকে খারাপ বলবেই, যিনি সফল, অসফলেরা তাঁকে কটু-কাটব্য করবেই, যিনি ন্যায়পরায়ণ, অন্যায়কারীরা তার সঙ্গে চিরদিনই শত্রুতা করবে এবং করছে। এ-নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি, হবে না।

তোমাকে অনুরোধ, তুমিও কোরো না।

 নির্বাচনে যারা দাঁড়ান তাঁদের চোর-জোচ্চোর গুণ্ডা-বদমাশ সকলের কাছেই গিয়ে হাতজোড় করে দাঁড়াতে হয় ভোটের ভিক্ষা চেয়ে। প্রত্যেক ভোটদাতাই ভোটের বদলে কিছু চায়ই। আর এই চাহিদা পূরণের প্রতিশ্রুতির মধ্যেই দেশ ও দশ-এর সর্বনাশের বীজ নিহিত থাকে।

আমি বুঝেছি চিরদিনের মতো যে, তোমার জীবনে আমার আর কোনো জায়গা নেই। আমি তোমাকে আর কখনো কোনো বই দেব না, তোমার কাছে যাব না, চিঠি লিখব না, ফোনও করব না। কারণ একতরফা, একজনের চেষ্টায় কোনো সম্পর্কই এ-পৃথিবীতে রাখা যায় না। তুমি যখন চাও না তখন থাকবে না। যা-গড়ে উঠেছিল তিল তিল করে, হাসি কান্নায়, মানে-অভিমানে, আনন্দে-কষ্টে।সুখে-অসুখে। আমার ছুটি হয়ে গেছে জানি। তাতে দুঃখ নেই। দুঃখ হয় এই বয়েসে, এই স্বাস্থ্যে, এই ব্যস্ততার মধ্যে এত অসুবিধার ভিড়ে নতুন করে অপমানিত হতে। যে-সম্পর্ক সম্বন্ধে তোমার এত অনীহা, এতই উদাসীনতা, এতদিনেও এত সুখ-দুঃখ ভুল-বোঝাবুঝির পর, ঠিক-বোঝাবুঝির পরও, সে-সম্পর্ক আমার পক্ষে জোর করে রাখতে যাওয়াটাই অসম্মানের। তা ছাড়া, আমার বর্তমান জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে অসম্ভবও। তোমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছাড়া এ-সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখা আর সম্ভব হবে না।

আমি তোমার কেউই নই। কেউ ছিলামও না। এবং তোমার কাছে কিছু স্কুল আর্থিক সাহায্যকারী ছাড়া আমার দাম ছিল না কোনো কালেই। পার্থিব এবং জাগতিক জিনিসই তুমি ভালো বুঝেছ চিরদিন। যা অপার্থিব, যার দাম একজীবনে শোধ করা যায় না, সেই প্রাপ্তির মূল্য দেওয়া দূরের কথা, সেই প্রাপ্তির স্বরূপ বোঝার মতো মনের গভীরতা তোমার সত্যিই কি ছিল? কখনো? যতটুকু বা ছিল, আজ যে তার কিছুমাত্রও অবশিষ্ট নেই, ক্রমাগত ভিড়ে আর লোকসমাগমে আর অর্থহীন ব্যাক্যালাপের ঘনঘটাতে, তাতে আমার কণামাত্রও সন্দেহ নেই। তোমার আজকের মানসিকতার যারা শরিক তেমন সবমানুষই তোমার আজকের বন্ধু হতে পারে। এত দামি, এত চোখের জলের, এত বদনামের ভালোবাসা, এত গভীর যন্ত্রণার প্রেম, তোমাকে যে কেউ কখনো দিয়েছিল, এত দুঃসাহসী ঝুঁকির ভালোবাসা,একথা ভেবে একদিন তুমি নিজেই শিউরে উঠবে।

সেদিন নিজেকেই জিজ্ঞেস কোরো, আমার সঙ্গে তুমি কি ঠিক ব্যবহার করেছিলে?

আমি আর ক-দিন বাঁচব? ঘোড়ার মতো জীবনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। পড়ব আর মরব। তখন তুমি একটু সময় করবে হয়তো একদিনও নয়, একবেলাও নয়, হয়তো এক-আধ ঘণ্টা দরজা বন্ধ করে একা ঘরে বসে বোঝবার চেষ্টা করবে, তোমার কী ছিল। আর কী হারিয়েছে! না হারালে, তোমার মতো মানুষেরা তাদের কী ছিল যে তার হিসেব পর্যন্ত বুঝতে পারে না।

তোমার সঙ্গে বাইরে অনেক জায়গায়ই যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে অনেক কিছুই করে, কিন্তু উপায় কী? তোমাদের মতো মানুষেরা আর তোমার কাকার মতো কিছু স্বার্থপর চক্ষুলজ্জাহীন অথচ ভন্ডরাজ বুড়োরাই তো এই সমাজ গড়েছে। ঘোমটার তলায় খেমটা নাচলে এখানে দোষ হয় না। যত দোষ, সহজ সরল সৎ গভীর হৃদয়াবেগের সিনসিয়ার ভালোবাসায়। ছিঁচকে চুরি দোষের নয়, শুধু ডাকাতি করা ঘোরতর অন্যায়। আমি যে চিরদিনের ডাকাত। চোরদের আমি ঘেন্না করি। আমি পৃথ্বীরাজ। আমি শ্বেতকেতুর মাকে নিয়ে যাওয়া ব্রাহ্মণ। বেশ্যালয়ে গমনে দোষ নেই কোন, ভালোবেসে পরম যতনে কারো শরীর চাইলে মহাপাতকের অপরাধ এই সমাজে।

আমার বয়েস হয়ে গেছে। অনেক সয়েছি। প্রতীক্ষারও কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

তোমার কাছ থেকে অনেকই পেয়েছি, বদলে আর কিছুর প্রত্যাশা নেই। যে-সম্পর্ক সম্বন্ধে তুমি ভীত, যে-সময়ে তোমার বন্ধু-বান্ধব, অর্থ-যশ, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির মানুষজন, বাপের বাড়ি এবং তোমার আজকের কেউকেটা দাদারা, জামাইবাবুরা, তোমার চন্দ্রহার মুকুটমণি, সেই একসময়ের তোমার একমাত্র শুভার্থী, একমাত্র কাছের মানুষ আমাকে খুব সহজেই ফেলে দেওয়া যায়। এবং দিয়েছও।

 রাগ কোরো না। সত্যিকথা সবসময়েই শুনতে খারাপ লাগে। আমি জানি যে, তুমি বলবে, সত্যিকথা তুমিও বলতে পারো। কী বলতে পারো, তাও জানি। কিন্তু সেখানেই মস্ত ভুল তোমার। তুমি যা সত্যি ভেবে বলবে, তা সত্যি নয়। এবং এতদিনেও এ-সত্যটা যে তুমি বুঝতে পারলে না, এইকথাটা ভেবেই কষ্টে বুক ভেঙে যায়।

ছি! ছি :! যে আমার ভালোবাসা পেল তার এতটুকু বুদ্ধিও কি নেই?

আমাকে নিয়ে বাকিজীবনে তোমার আর কোনো সমস্যা হবে না। কখনো তোমাকে দেখেও চিনতে না পারলে দুঃখিত হোয়ো না। যদি দুঃখ পাও, তখন জানবে যে, তুমি আমাকে যা-দুঃখ দিয়েছ সমুদ্রের মতে, তার তুলনায় তোমার পাওয়া দুঃখ একবিন্দু নোনা জলমাত্র।

ভগবান তোমার ভালো করুন। তোমার স্বামী-পুত্র-ঘর-ভরা আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অর্ধপরিচিত, অপরিচিত রবাহূত, অনাহূত, গন্ধ-আহূত,সংগীত-শ্রুত কিছু গোলমেলে মানুষের মধ্যে এবং জনতার সান্নিধ্যে এবং সঙ্গে প্রতিমুহূর্তই যে ঘৃণিত গন্ডগোলকে তুমি সুখ বলে জেনেছ, তারমধ্যেই থাকো, পচে মরো, মৃত হয়ে প্রশ্বাস নাও এবং নিঃশ্বাস ফেলল। | তোমাদের মতো সুন্দর অঙ্গপ্রত্যঙ্গসম্পন্ন মড়াদের বাসভূমির নামই কলকাতা। জীবন কাকে বলে, বাঁচার মানে কী, তার কিছুই তোমরা জানো না। তোমাদের জন্যে দুঃখ হয়, অনুকম্পা হয়। কিন্তু কী করব? কীই বা করতে পারি আমি!

পরের ইলেকশানে তুমি কোনো ডাকসাইটে পার্টির টিকিট নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ো। নইলে, তোমার এই বিপুল জনপ্রিয়তা কোনো সৎকাজেই লাগবে না। যারা রাজনীতি করে সচরাচর তাদের বিদ্যাবুদ্ধি তোমারই মতো হয়। অনেক স্তাবক হবে, কাউকে সিমেন্টের পারমিট দেবে, কাউকে টিনের, কারোর ছেলের চাকরি দেবে, কাউকে থানায় নিয়ে গিয়ে বারংবার পুলিশ দিয়ে পেটাবে,–যা তুমি জানো, বোঝো। কিন্তু তুমি আমার মতো কারো ভালোবাসা পাবেও না, কাউকে ভালোবাসতেও পারবে না। কারণ কী জানো?

 কারণ, ভালোবাসা ইলেকট্রিসিটির মতো। নেগেটিভ ও পজিটিভ জড়াজড়ি করলে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁওয়ালে আলো জ্বলে। কিন্তু সেই আলো জ্বালাবার ক্ষমতাকে স্টোর করে রাখা যায় না কোনো ভাঁড়ারে, পৃথিবীর কোনো হিমঘরেই। ভালোবাসা, আলু অথবা চিংড়িমাছ নয়। তুমি আমার ভালোবাসা তোমার মনের ডিপ-ফ্রিজে ফ্রিজ করে রাখতে চাও, পুরুষ-শিঙ্গাল হরিণের লাল, তাল-তাল ভেনিসনের মতো। যাতে, ইচ্ছে ও অবসরমতো বের করে কুরে কুরে খেতে পারো নানারকম সস ও চেরি দিয়ে রমরমে করে বেঁধে।

সে গুড়ে বালি!

মহুয়া, ভালোবাসা ধরে রাখা যায় না। যখন সে মন-এর তার বেয়ে চকিতে আসে তখনই তাকে জায়গা করে দিয়ে আদরে, শরীরে-মনে পুলকভরে গ্রহণ করে সম্পৃক্ত, শিহরিত, মর্মরিত হতে হয়। আশ্লেষ থেকে আশ্লেষে। আনন্দ থেকে গভীর দুঃখে এবং গভীর দুঃখ থেকে আনন্দে ঝুলার ঝুলিনের মতো অঙ্গাঙ্গি হয়ে দুলতে হয়।

তুমি অভ্যেসের, লোকভয়ের, দাম্পত্য দাসী হয়ে গেছ। ভালোবাসা তোমার জন্যে নয়। আর নয়। কোনোদিনও নয়।

এসব বলেই বা লাভ কী তোমাকে? এত কথাই যদি বুঝবে, তাহলে তো আমার ভালোবাসার মূল্যও বুঝতে!

তার চেয়ে তুমি ইলেকশনেই দাঁড়াও।

ভোট দেবেন কাকে? মহুয়া চৌধুরীকে।

ভোট দেবেন কেন?

মেয়ে নেই, মহুয়া চৌধুরী হেন।

 মহুয়া চৌধুরী লক্ষজনের প্রিয়।

 যুগ যুগ জিও, যুগ যুগ জিও!

 ঝুগ ঝুগ ঝুগ ঝুগ।

 ঝুগ ঝুগ জিও।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ