নীপাবউদি বলল, এই সব ছবি, সত্যি একটা কামিন এঁকেছে?

চন্দনদা বলল, হ্যাঁ। নীলু ওর বাড়ি দেখে এসেছে। ওর শ্বশুরও ছবি আঁকে, সেগুলোও তো দেখলে।

নীপাবউদি বলল, এত ভাল যে আঁকতে পারে, তাকে দিয়ে তোমরা জনমজুরি করাচ্ছ? যার মাথায় রয়েছে এমন সব দারুণ ছবির আইডিয়া, তার মাথায় ইট বওয়াচ্ছ? চিনের কালচারাল রেভোলিউশানের পরেও তোমাদের শিক্ষা হল না?

চন্দনদা ছাত্রজীবনে নকশালপন্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, সেই প্রসঙ্গে একটা খোঁচা দেওয়া হল!

চন্দনদা তর্কের মধ্যে না গিয়ে বলল, আমি কী করব বলো। এ ধরনের শিল্পীদের সাহায্য করা সরকারের কাজ। জীবিকার জন্য বেচারা ইট বওয়া ছাড়া আর কী করবে?

নীপাবউদি বলল, কেন, তোমাদের কোম্পানিও তো অনেক কিছু করে। পাহাড়ে চড়ার জন্য টাকা দেয়। আর এক জন শিল্পীকে দিতে পারে না?

মেয়েদের একটা পর্বত অভিযানের টিমকে স্পনসর করেছিল চন্দনদার কম্পানি। সেই দলের লিডার ছিল রোহিণী। সেই সময় ওই পর্বত অভিযান ও রোহিণীর সঙ্গে চন্দনদা একটু বেশি বেশি জড়িয়ে পড়েছিল। সেই ব্যাপারে আর একটি খোঁচা।

চন্দনদা আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল, যার মানে হল, ফুলমণিকে এনে একবার তোর বউদির সামনে হাজির করাতে হবে। যাতে নীপা বোঝে যে, ফুলমণির সঙ্গে প্রেম করা সম্ভব নয়।

নীপাবউদি বৃষ্টিভেজা মেয়েটার ছবিটা তুলে ধরে বলল, এই ছবিটা আমার এত ভাল লাগছে, রেখে দিতে ইচ্ছে করছে। এটা যদি আমি কিনে নিই?

লালুদা এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল, যদিও চুপ করে থাকা তার স্বভাব নয়। এবারে ছবি বিষয়ে নীপাবউদিরমতামত সবটা শুনে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, কেননা না, কেননা! কত দাম? সত্যিই অসাধারণ ছবি। একসেলেন্ট। মাস্টারপিস। কত দাম দিতে হবে, বলো না নীলমাধব! দুটোও তো কেনা যেতে পারে। এইটা আর ওইটা।

লালুদা অন্য হাতে হনুমানের সমুদ্র পার হবার ছবিটা তুলে ধরল।

নীপাবউদি বললো, ধ্যাৎ। ওটা তো ওর শ্বশুরের আঁকা, একেবারে বাজে। দুটো ছবির তফাৎ বোঝেন না?

লালুদা সঙ্গে সঙ্গে বলল, অফকোর্স তফাৎ আছে! খুবই তফাৎ। কোনও তুলনাই চলে না। বাচ্চা মেয়েটার ছবি, অপূর্ব, অপূর্ব! এটা কিনে ফেলা যাক। নীলাচল, কত দাম দিতে হবে? বেশি করে বলো, যাতে মেয়েটির সাহায্য হয়।

নীপাবউদি বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, একবার মেয়েটিকে কিছু টাকা দিলে এমন কী সাহায্য হবে? ওর আত্মীয় স্বজনরা সেই টাকা খেয়ে ফেলবে। একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে আজেবাজে কাজ ছেড়েও শুধু ছবি আঁকতে পারে। গভর্নমেন্টের কোনও স্কলারশিপ-টলারশিপ জোগাড় করা যায় না?

চন্দনদা বলল, এমনি এমনি কি হয়? একটা একজিবিশন করা দরকার, ক্রিটিকদের মতামত দরকার। সে-সব এখানে বসে কে করবে? কে ওর ব্যাপারে মাথা ঘামাবে?

হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় চন্দনদা থেমে গেল। একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে হেসে নিয়ে বলল, একটা কাজ করা যেতে পারে। শিগগিরই আমি কলকাতায় যাব। শুককুরবার মহরমের ছুটি, শনিবারটা ম্যানেজ করলে পর পর তিন দিন, নীলু, তুইও আমার সঙ্গে কলকাতায় যেতে পারিস। ছবিগুলো নিয়ে চল। আমি তো সময় পাবনা, তুই কয়েক জনকে দেখিয়ে আন।

সেই রকমই ব্যবস্থা হল। লালুদার ছোট গাড়িতে জায়গা হবে না। তাই এক সঙ্গেই বেরিয়ে চন্দনদা আর আমি এলাম ট্রেনে, অন্যরা গেল গাড়িতে।

কলকাতায় কোনও বড় আর্টিস্ট কিংবা ক্রিটিককে আমি চিনিনা। মানে, আমি অনেককে চিনি, কিন্তু তারা আমাকে চেনেন না। এ পর্যন্ত কখনও কোনও শিল্পীর বাড়িতে যাইনি।

শিল্পী শান্তনু চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে আমি হতাশ।

গলফগ্রিনের একটা ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি, চন্দনদাই নিয়ে গেল সেখানে। চন্দনদার সঙ্গে তার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। সারা ভারতেই তার খ্যাতি, খুব ব্যস্ত মানুষ, তাই টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছিল।

শিল্পীদের চেহারা ও চরিত্র সম্পর্কে আমাদের মনের মধ্যে একটা ছবি তৈরি হয়ে আছে। গল্প উপন্যাসে, সিনেমার আসরে সেইরকম শিল্পীদেরই দেখি, তারা বোহেমিয়ান, মাথায় বাবরি চুল, মুখে। দাড়ির জঙ্গল, মদের নেশায় সব সময় চোখ লাল, পোশাক উদ্ভট, তাদের স্টুডিয়োতে সব কিছু এলোমেলো ভাবে ছড়ানো, মেয়েদের নিয়ে তারা ছিনিমিনি খেলেন।

কোথায় কী! শান্তনু চৌধুরীর ফ্ল্যাটটা নিখুঁত ভাবে সাজানো, মাথায় অল্প টাক, দাড়ি কামানো, ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা, ফর্সা, গোলগাল চেহারায় তাকে মনে হয় একবিশিষ্ট ভদ্রলোক। বসবার ঘরটির দেয়ালে একটি মাত্র ছবি, দেলাক্রোয়ার একটি ছবির বড় প্রিন্ট। এখনও যে দেলাক্রোয়ার এরকম কোনও ভক্ত আছে, তা আমার জানা ছিল না।

বসবার ঘরে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর শিল্পী নিজেই এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর স্টুডিওতে। উত্তর আর পূর্ব ধার খোলা একটা বড় ঘর, দেয়ালের গায়ে ঠেসান দেওয়া বেশ কয়েকটি ক্যানভাস, ইজেলে একটি অসমাপ্ত ছবি। আগেই শুনেছি, শান্তনু চৌধুরী প্রতি দিন নিয়ম করে আঁকেন, মাসে অন্তত দুটি অয়েলের ছবি শেষ করেন। তার এক-একটি ছবির দাম অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকা।

চন্দনদার সঙ্গে কথায় কথায় তিনি জানালেন যে, তার এই স্টুডিওতে আর কুলোচ্ছে না, এই গলফ গ্রিনেই তার নিজস্ব একটা বাড়ি হচ্ছে, সম্পূর্ণ তিন তলা জুড়ে হবে স্টুডিও। চন্দনদাকে বাড়ির প্ল্যান দেখিয়ে অভিমত নিলেন, সিমেন্ট ও ইটের দাম কত যাচ্ছে তার খোঁজখবর জানালেন। তারপর আমরা তার ছবিগুলো দেখলাম। ছবি তিনি খুবই ভাল আঁকেন, রঙের ব্যবহার অসামান্য, শিগগিরই তার এই সব ছবির একটা বড় প্রদর্শনী হবে দিল্লিতে।

ইতিমধ্যে চা এসে গেছে।

 চন্দনদা আমাকে বলল, নীলু, এবার বার কর।

 শান্তনু চৌধুরী ঈষৎ চঞ্চল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ছবি আঁকো নাকি?

 চন্দনদা বলল, না না, ও আঁকে না, ছোটপাহাড়িতে একটি আদিবাসী মেয়ে…।

ফুলমণির কাহিনিটা বলতে লাগল চন্দনদা, শান্তনু চৌধুরী অন্যমনস্ক ভাবে শুনতে শুনতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, তাই নাকি? বাঃ ইন্টারেস্টিং। দেখি, দেখি, ছবিগুলো দেখি।

আমি ছবিগুলো মেলে ধরলাম।

শান্তনু চৌধুরী ছবিগুলোর দিকে দ্রুত চোখ বোলালেন, তার মুখের কোনও ভাবান্তর হল না।

তিনি বললেন, বাঃ, বেশ ভাল, বেশ ভাল!

বৃষ্টিভেজা মেয়েটির ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে চন্দনদা জিজ্ঞেস করল, এটা কীরকম লাগছে?

শান্তনু চৌধুরী একই সুরে বললেন, বেশ ভাল, বেশ ভাল।

চন্দনদা জিজ্ঞেস করল, ছবিগুলোর বিশেষ কোনও গুণ আছে বলে আপনার মনে হয়?

শান্তনু চৌধুরী বললেন, বললাম তো, ভালই এঁকেছে। এক জন আদিবাসী মেয়ের পক্ষে, ভালই বলতে হবে।

তারপরই প্রসঙ্গ পালটে বললেন, আপনাদের কোম্পানি এবার কারছবি দিয়ে ক্যালেন্ডার করছে?

চন্দনদা বলল, খুব সম্ভবত হেমেন মজুমদারের। ওঁর ফ্যামিলির সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। এসব তো আমি একা ঠিক করি না। আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টার।

শান্তনু চৌধুরী খুব চাপা বিদ্রুপের সুরে বললেন, ওঃ, হেমেন মজুমদার? আচ্ছা!

বেশ বেশ। এরপর তিনি আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকালেন, যেটা স্পষ্ট উঠে যাওয়ার ইঙ্গিত।

বোঝাই গেল, ফুলমণির ছবিগুলোকে উনি কোনও গুরুত্বই দেননি। যেটুকু প্রশংসা করেছেন, তা নিছক ভদ্রতার। তবে কি ফুলমণির ছবি নিয়ে আমরা বাড়াবাড়ি করছি? আমাদের উচ্ছাস সবটাই ভুল!

দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে শান্তনু চৌধুরী বললেন, অনেক ইয়াং ছেলে মেয়ে আমাকে ছবি দেখাতে চায়, আমি সময় পাই না, সকলের জন্য সময় দিতে গেলে আমার নিজের কাজ…তবে যত দূর সম্ভব চেষ্টা করি সাহায্য করার।

আমাদের মুখে আর কথা নেই। ফুলমণি সামান্য মনোযোগেরও অযোগ্য। বাইরে বেরিয়ে আমি খানিকটা রাগের সুরে বললাম, চন্দনদা, শান্তনু চৌধুরীর এত নাম, কিন্তু দেখলে শিল্পী বলে মনেই হয় না। মনে হয়, কোনও বড় অফিসার!

চন্দনদা বলল, তুই বুঝি ভেবেছিলি, সকালবেলাতেই মাতাল হয়ে একটা মেয়ের গলা জড়িয়ে বসে থাকবে? ও-সবনাইনটিথ সেঞ্চুরির ধারণা! তখন একটা বোহেমিয়ানিজম আর খ্যাপামির যুগ ছিল। এখন শিল্পীরাও সামাজিক মানুষ। মাতলামি আর বেলেল্লাপনা করলে সীরিয়াস কাজ করা যায় না এ যুগে। কী দারুণ কমপিটিশন! ছবি আঁকাও অন্য আর পাঁচটা কাজের মতো একটা কাজ।

একথাটা আমার পছন্দ হল না। ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, এ-সব কিছুতেই অন্য কাজের মতো নয়। তাহলে চেষ্টা করলেও সবাই পারে না কেন? যারা পড়াশুনোয় ফার্স্ট হয়, তারা কি এগুলো পারে? চন্দনদাই আগে উলটো কথা বলেছে।

আমরা গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, এই সময় এক জন কেউ বলল, এই চন্দন, এখানে কোথায় এসেছিলি?

একজন প্রায় ছ’ফুট লম্বা, ছিপছিপে ভদ্রলোক, ব্রোঞ্জের মতো গায়ের রঙ, তীক্ষ্ণ নাক, কৌতূহলী চোখ, দাড়ি কামানো, কিন্তু মাথার চুল বড় বড়, প্যান্টের ওপর ফতুয়া জাতীয় একটা জামা পরা, হাতে একটা ছড়ি, তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে।

ভদ্রলোকের বয়েস চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, ঋজু শরীর, হাতে ছড়ি নেবার কথা নয়, ওটা বোধহয় স্টাইল করার জন্য।

তিনি আবার বললেন, শান্তনুর কাছ থেকে ছবি কিনতে এসেছিলি বুঝি? কত টাকা খসল?

 চন্দনদা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, নীলু, এ হচ্ছে অনিন্দ্য দাস। আমরা স্কুলে এক সঙ্গে পড়েছি।

নাম শুনেই চিনতে পারলাম। ইনিও খুবই বিখ্যাত শিল্পী। কয়েক বছর আগে একটা ফরাসি কাগজে এর সম্পর্কে একটা বড় আর্টিকেল বেরিয়েছিল ছবি-টবি দিয়ে, তার অনুবাদ আবার ছাপা হয় বাংলা কাগজে। ফরাসি দেশের সার্টিফিকেট পাওয়ার পরেই এঁকে নিয়ে পড়ে যায় কলকাতায়।

চন্দনদা বলল, না রে, ছবি কিনতে আসিনি। শান্তনু চৌধুরীকে কয়েকটা ছবি দেখাতে এসেছিলাম।

 তুই আবার ছবি আঁকছিস বুঝি? আবার ইচ্ছেটা চাগিয়েছে? টাকা তো কম বোজগার করিস না।

ধ্যাৎ, আমি কী আঁকব। এগুলো একটা আদিবাসী মেয়ের। আমাদের ভাল লেগেছিল, তাই শান্তনু চৌধুরীকে দেখিয়ে মতামত জানতে এসেছিলাম।

শালা, তুই আমাকে আগে দেখাসনি কেন? তুই কাকে বেশি দিন চিনিস, আমাকে, না শান্তনুকে? শান্তনু বড় আটিস্ট?

তোর কথাটা মনে পড়েনি, মানে, তুই তো মেইনলি স্কালপটর, তুই মূর্তি গড়িস।

স্কলপচার করি বলে ছবি বুঝি না? স্কালপটররা ছবি আঁকে না? তোদের র‍দ্যাঁ ছবি আঁকেনি? দেবীপ্রসাদ, রামকিঙ্কর ছবি আঁকেনি?

আমার দিকে ছড়িটা তুলে অনিন্দ্য দাস বললেন, এই ছেলে, হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কী, বার কর ছবিগুলো।

শান্তনু চৌধুরীর তুলনায় অনিন্দ্য দাসকে প্রায় প্রথম নজরেই আমার ভাল লেগে গেল। প্রাণবন্ত মানুষ, মিষ্টি মিষ্টি ভদ্রতার ধার ধারেন না।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করে ছবি দেখাব! চন্দনদার গাড়ির বনেটের ওপর মেলে ধরলাম।

অনিন্দ্য দাস বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়েই পাঁচটা ছবি দেখলেন। তারপর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কে এঁকেছে?

চন্দনদা ফুলমণির বৃত্তান্ত সবিস্তার বলতে যেতেই অনিন্দ্য দাস তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সে কোথায়?

সে তো ছোটপাহাড়িতে থাকে।

তাকে নিয়ে আয়।

সেটা খুব মুশকিলের ব্যাপার। আচ্ছা অনিন্দ্য, বল তো, এই ছবিগুলো ঠিক কেমন? মেয়েটার সত্যিই কোনও ট্যালেন্ট আছে?

ধুস! বোগাস! এ-রকম ছবি যে-কেউ আঁকতে পারে। আর্টিস্টকে না দেখলে, তার সঙ্গে কথা না বললে কি ছবি বোঝা যায়? তার কতটা ভিশান আছে, তার ডেপথ কতটা, তার স্ট্রাগল করার ক্ষমতা, এ-সব না বুঝলে শুধু ক’টা ছবি দেখে কী হবে?

আঁকার ক্ষমতা, নতুনত্ব আছে কি না, সেটুকু তো অন্তত– ।

আবার বাজে কথা বলছিস, চন্দন! এ কি ইম্প্রেশানিস্টদের ছবি যে, প্রত্যেকটা ছবিরই আলাদা একটা প্রাণ আছে, আলাদা একটা সত্তা আছে? কে এঁকেছে তা বলে দেবার দরকার হয় না, প্রত্যেকটা ছবিই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

আমি বললাম, সব ভাল ছবিই তো এ-রকম হয়। ছবি দেখে যা মনে হয়।

অনিন্দ্য দাস এক ধমক দিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে তর্ক কোরো না ছোকরা, তর্ক কোরোনা। যা বলছি শুনে যাও।

আমি তবু প্রতিবাদ করে বললাম, আর্টিস্টদের দেখে, কথা বললেও তো মনে হয় না।

অনিন্দ্য দাস ঠিক আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরে এবার হে-হে করে হেসে ফেললেন। শান্তনু চৌধুরীর বাড়ির দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বললেন, ছবি আঁকলেই কি শিল্পী হওয়া যায়? শান্তনু খুব নাম করেছে, ভালই আঁকে, নিশ্চয়ই ভাল আঁকে, কিন্তু সবই রঙের পোঁচ, বুঝলে, রঙের পোঁচ! ওর মধ্যে যে ফাঁকিবাজি আছে, তা আমরা বুঝি, তোমরা বুঝবে না। স্কালপচার করতে গেলে কব্জির জোর লাগে, আর লাগে এই দুটো এক সঙ্গে।

অনিন্দ্য দাস নিজের মাথায় আর বুকে দুটো টোকা দিলেন।

তারপর চন্দনদাকে বললেন, তুই বুঝি শান্তনুর ছবি দিয়ে তোদের কোম্পানির ক্যালেন্ডার করবি ভাবছিস? দে, যত ইচ্ছে তেল দে! কেন, স্কালপচার দিয়ে বুঝি ক্যালেন্ডার করা যায় না? শালা বাঙালিরা ভাস্কর্যের কিছুই বোঝে না। কেষ্ট নগরের পুতুল দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। কলকাতা শহরে যে-মূর্তিগুলো বসিয়েছে, ইচ্ছে করে লাথি মেরে সেগুলো সব ভেঙে দিই।

অনিন্দ্য দাস শান্তনু চৌধুরীর বাড়িতেই যাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, উনি শান্তনু চৌধুরীকে একটুও পছন্দ করেন না। তবু দু’জনে নিশ্চয়ই এখন হেসে হেসে গল্প করবেন।

গাড়িতে উঠে চন্দনদা বিমর্ষভাবে বলল, কী হল রে নীলু। দু-দুজন বিখ্যাত আটিস্ট এ ছবিগুলোকে তো পাত্তাই দিল না। আমরা তাহলে বোকার মতো নাচানাচি করেছি?

কোনও নিরপেক্ষ আর্ট ক্রিটিককে একবার দেখালে হয় না?

তুই যে অদ্ভুত কথা বললি রে নীলু। নিরপেক্ষ ক্রিটিক বলে পৃথিবীতে কোনও বস্তু আছে নাকি? সব ক্রিটিকই কোনও না কোনও দিকে হেলে থাকে।

খবরের কাগজে যাঁরা সমালোচনা লেখেন।

তুই দেখবি, একই শিল্পীর ছবি, স্টেটসম্যান যাচ্ছেতাই বলে উড়িয়ে দিচ্ছে আর আনন্দবাজার তাকেই মাথায় তুলে নাচছে। আবার এর উলটোটাও হয়। ছবির জগতে যে-রকম গ্রুপিজম আছে, তা তোর-আমার বোঝার সাধ্য নেই।

তবু তো কিছু কিছু শিল্পীর সারা দেশেই নাম ছড়িয়ে যায়। তাদের ছবির কদর হয়।

সে হচ্ছে জনসাধারণের বিচার। জনসাধারণই তো আলটিমেট ক্রিটিক। কিন্তু ফুলমণির ছবি জনসাধারণের কাছে পৌঁছবার কোনও উপায় নেই। কষ্টে সৃষ্টে একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করলেও কেউ আসবে না, ক্রিটিকরা পাত্তা দেবেনা। আজকাল গণ্ডায় গণ্ডায় প্রদর্শনী হয় প্রতি সপ্তাহে। বিরাট করে পাবলিসিটি দিতে হবে, উদ্বোধনের দিন মস্ত পার্টি দিয়ে মদের ফোয়ারা বইয়ে দিতে হবে, তবে তো গণ্যমান্যরা আসবে!

তাহলে আর কিছু করা যাবে না?

নাঃ।

 একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর চন্দনদা জিজ্ঞেস করল, তোর মন খারাপ লাগছে না নীলু?

হুঁ।

কেন মন খারাপ লাগছে জানিস? আমরা সবাই ভেতরে ভেতরে স্বার্থপর। ফুলমণির ছবির কিছু হলনা, সেজন্য আমরা যতটা না দুঃখিত, তার চেয়ে বেশি দুঃখিত এই জন্য যে, আমরা ওর উপকার করার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম, সেটা ব্যর্থ হল! আমরা হেরে গেলাম। তাই না!

তা-ও বলা যেতে পারে।

 মন খারাপ হলে আমার কাবাব আর পরোটা খেতে ইচ্ছে করে। খাবি?

 কাবাব আর পরোটা খুব আনন্দের সময়েও খেতে আমার কোনও আপত্তি থাকে না।

 তাহলে চল পার্ক সার্কাসের দিকে। ওখানে একটা ভাল রেস্তোরাঁয়।

হঠাৎ থেমে গিয়ে চন্দনদা গাড়ির ড্রাইভারকে বলল, এই, এই, গাড়ি ঘোরাও, চলো তো একবার আলিপুরের দিকে।

আমার বিস্ময় দেখে বলল, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল রে। সিরাজুল তারিক-এর বাড়ি গিয়ে একবার কাবাব খেয়েছিলাম, কী অপূর্ব তার স্বাদ, এখন জিভে লেগে আছে।

এখন হঠাৎ তার বাড়িতে গেলেও কি তিনি কাবাব খাওয়াবেন নাকি?

তুই কী ইডিয়েট রে! নাম শুনে চিনতে পারলিনা? সিরাজুল তারিক।

মানে, যিনি আর্টিস্ট?

তাছাড়া সিরাজুল তারিক আবার কজন আছে? আমার সঙ্গে এক দিন আলাপ হয়েছিল। বার বার তিনবার। ওঁর মতামতটাও নেওয়া যাক। উনিও যদি উড়িয়ে দেন, তাহলে ফুলমণির ছবি নিয়ে আমরা আর মাথাই ঘামাবনা।

কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে গেলে কি উনি সময় দেবেন?

একটা জিনিস লক্ষ্য করলি তো। বড় কোম্পানির ক্যালেন্ডারে ছবি দেখার জন্য আর্টিস্টরা বেশ ব্যস্ত। অন্তত লাখ খানেক টাকা তো পাওয়াই যায়। সিরাজুল সাহেবকে প্রথমে সেই টোপটা দেব। তাহলে ঠিকই সময় পাবেন কথা বলার।

ঠিক আলিপুর নয়, খিদিরপুর ব্রিজের কাছাকাছি সিরাজুল তারিকের পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। ইনি বাংলার প্রবীণ, বিখ্যাত শিল্পীদের অন্যতম। মতামতের দিক থেকে খানিকটা ট্র্যাডিশনাল। কিছু দিন আগে খবরের কাগজে ওঁর একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। উনি অল্প বয়সে অয়েলের কাজ কিছু করেছেন, এখন আর অয়েল ছোঁন না। ওয়াটার কালার আর ওয়াশ-এর কাজই বেশি করেন। আজকালকার অনেক শিল্পীর মতো উনি অ্যাক্রিলিকের চকচকে রঙ একেবারে পছন্দ করেন না। অয়েল সম্পর্কে উনি একটা গল্পও বলেছেন। আমাদের দেশে তো আগে অয়েলের কাজ হত না। জাহাঙ্গির বাদশার দরবারে ইংরেজদের দূত হিসেবে গিয়েছিলেন স্যার টমাস রো। অনেক রকম উপহার-উপঢৌকন নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জিনিসগুলো খুলে খুলে দেখাচ্ছেন। তার মধ্যে একটা অয়েল পেইন্টিং ছিল। সেটা দেখে জাহাঙ্গির বাদশা মুখ কুঁচকে বলেছিলেন, ওটা সরিয়ে নাও, বড্ড চকচক করছে।

ওয়াশ-এর ছবির মতোই সিরাজুল তারিক মানুষটি শান্ত, মিগ্ধ। চোখ দুটি আশ্চর্য মায়াময়।

 নিজেই তিনি দরজা খুলে দিয়ে আমাদের ভেতরে বসালেন। সরু পাজামা ও গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা, মুখে ধপধপে সাদা দাড়ি, মাথার চুলও সাদা, তবে বেশ পাতলা হয়ে গেছে। গলায় ঝুলছে কালো সুতোয় বাঁধা চশমা। কথা বলেন খুব নরম গলায়। তাকে দেখলে ঋষি দরবেশদের কথা মনে পড়ে।

সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে প্রখ্যাত শিল্পী এম এফ হুসেনের চেহারার খানিকটা মিল আছে। কিন্তু হুসেন ফাইভ স্টার হোটেলে উঠলেও রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে হাঁটেন, খবরের কাগজের হেডলাইন দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছবি এঁকে ফেলেন, এই সব গিমিক সিরাজুল সাহেবের চরিত্রে একেবারেই নেই। তার ছবির বাজারদর বেশ ভাল। তবু তিনি আগেকার চালচলন পালটাননি, পুরনো বাড়িটা ছাড়েননি। নিরিবিলিতে থাকতে পছন্দ করেন।

চন্দনদার ক্যালেন্ডারের প্রস্তাবটাকে উনি আমলই দিলেন না। হেসে বললেন, না না। আমি ছবি দেব কী করে? আমি বছরে পাঁচ-সাতখানার বেশি ছবি আঁকি না। কেউ অর্ডার দিলে তাড়াতাড়ি এঁকে দিতেও পারি না। ছবি আঁকবো কী, ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে বসে থাকতে থাকতেই দিন কেটে যায়। কত ছবি চোখে ভাসে। সেগুলো এঁকে ফেলার চেয়ে সেগুলো নিয়ে কল্পনায় খেলা করতেই বেশি ভালবাসি। আমার যে ক’খানা ছবি বিক্রি হয় আপনাদের দয়ায়, তাতে বেশ চলে যায়।

চন্দনদা তখন বলল, আমি একটি মেয়ের আঁকা কয়েকটি ছবি এনেছি। অনুগ্রহ করে একটু দেখবেন?

সিরাজুল সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, অবশ্যই। নিজের ছবি আঁকার চেয়েও ছবি দেখতেই আমি বেশি পছন্দ করি।

প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিট ধরে তিনি ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন। একটাও কথা বললেন না। আকাশে মেঘ জমেছে, তিনি আলো জ্বেলে দিলেন ঘরের। ছবিগুলো নিয়ে একবার জানালার কাছে গেলেন, একবার আলোর নিচে ধরলেন, নিজের ইজেলে চাপিয়েও দেখলেন।

তারপর বিহ্বল চোখে চন্দনদার দিকে চেয়ে বললেন, এ আমাকে কী দেখালেন ঘোষালবাবু? এ ছবি কে এঁকেছেন?

চন্দনদা নার্ভাস গলায় বলল, এ ছবিগুলো কী ভাল? এর কোনও মূল্য আছে?

সিরাজুল সাহেব বললেন, ভাল মানে কী! আমার আজকের সকালটা ধন্য হয়ে গেল। অসাধারণ। তুলনা নেই। আর মূল্যের কথা বলছেন? এই প্রত্যেকটা ছবির জন্য আমি পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে রাজি আছি। দেবেন আমাকে?

.

০৬.

এত দ্রুত যে ব্যাপারগুলো ঘটবে তা আমি ধারণাও করতে পারিনি।

সিরাজুল সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ হল আকস্মিক ভাবে। খুব ছোটখাটো ঘটনা থেকে কোনও মানুষের নিয়তিটাই বদলে যেতে পারে। চন্দনদার যদি হঠাৎ কাবাব-পরোটা খাবার কথা মনে না পড়ত, তাহলে সিরাজুল সাহেবের কাছে আসাই হত না। কিংবা, ফুলমণি যদি ছোট পাহাড়ির বদলে জামসেদপুরে ইট বওয়ার কাজ করতে যেত, তাহলে সে চন্দনদার নজরে পড়ত না, তার ছবি আঁকা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না।

সিরাজুল সাহেব আমাদের ছাড়লেন না, দুপুরে তার বাড়িতেই খেতে হল। কাবাব-পরোটা নয় অবশ্য, ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ ও ডিমভরা কই মাছের ঝোল। খুব সম্প্রতি তিনি সব রকম মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।

ছবিগুলো সম্পর্কে তিনি উচ্ছ্বসিত।

আমাদের তিনি বোঝালেন ছবিগুলোর বিশেষত্ব কোথায়। যে-কোনও শিল্পীই তার কাছাকাছি পরিবেশ, মানুষজন ও প্রকৃতির যে-বাস্তবতা, তা ফুটিয়ে তুলতে বাধ্য। সমসাময়িক বাস্তবতা সব শিল্পের ভিত্তি। তবে নিছক বাস্তবতা নয় এবং নিছক সমসাময়িকতাও নয়। তারমধ্যে একটা বিশ্বজনীনতা ও চিরকালীনতার ছোঁয়া লাগলেই তা সার্থক শিল্প হয়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, যেমন ধরুন, হ্যামলেট। এর কাহিনিটা আসলে কী? ডেনমার্কের একটা ছোট্ট রাজ্যের রাজপরিবারের ঘরোয়া কোন্দল। কিন্তু পৃথিবীর যে-কোনও প্রান্তের মানুষ ওর রস অনুভব করতে পারে। কিংবা ধরুন মোনালিসার মুখখানা। লিওনার্দো তো এক জন ইতালিয়ান মহিলার মুখ এঁকেছেন, তার চোখের সামনে ছিল সমসাময়িক বাস্তবতা, তবু ওই মহিলার মুখের হাসি চিরকালীন হয়ে গেল।

আমি বললাম, সিরাজসাহেব, এক আদিবাসী মহিলার ছবি প্রসঙ্গে হ্যামলেট আর মোনালিসার প্রসঙ্গ টানা কি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?

সিরাজসাহেব প্রশংসার ব্যাপারে কার্পণ্য বিশ্বাস করেন না। তিনি বললেন, কেন তুলনা করা যাবে? আমরা সবাই তো আদিবাসী, তাইনা? এখানে দেখুন, এই মহিলাটিকে কাছাকাছি যেসব মানুষজন দেখেছে, গাছপালা, গোরু-মোষ, এই সবই এঁকেছে। ফোক ট্র্যাডিশনও আছে তার রেখার মধ্যে। যামিনী রায়ের মতো মোটমোটা দাগ। ড্রয়িংয়ে হাত পাকা, কিন্তু নিখুঁত ড্রয়িং করেনি, স্টাইলাইজড। এই যে তিনটে মোষ, এই মোষগুলো ছোটপাহাড়ি নয়, সারা পৃথিবীর। এ মেয়েটির অন্তদৃষ্টি আছে। এ বড় দুর্লভ, বুঝলেন, খুবই দুর্লভ।

আমি এবার ফস করে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, আপনি তো এত প্রশংসা করছেন, কিন্তু শান্তনু চৌধুরী আর অনিন্দ্য দাস একেবারে পাত্তাই দিলেন না কেন? তারাও তো বড় শিল্পী, তাঁরা এ ছবিগুলোর মধ্যে কোনও গুণই দেখতে পেলেন না।

সিরাজসাহেব চুপ করে গেলেন।

তিনি এতই ভদ্র যে সমসাময়িক কোনও শিল্পী সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য করতে চান না।

চন্দনদা বলল, ওঁদের অ্যাটিচুডটা আমি বুঝতে পেরেছি। ওঁদেরও দোষ দেওয়া যায় না নীলু। কোনও কোনও শিল্পী হয় খুব সেলফ সেনটারড। নিজের ছবি ছাড়া আর কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। নিজের সৃষ্টি নিয়েই মগ্ন থাকে। আবার কেউ কেউ গোটা শিল্পজগতে নতুন কিছু ঘটলেই তারা খুশি হয়ে ওঠে। আমি ঠিক বলছি না সিরাজসাহেব?

সিরাজসাহেব আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন।

এরপর তিনি আর একটি চমকপ্রদ কথা বললেন।

চন্দনদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছোটপাহাড়িতে কী করে যেতে হয়? আমি মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে চাই। আজই যাওয়া যায় না?

চন্দনদা বলল, আপনি যাবেন সেখানে?

হ্যা। শুধু এই পাঁচখানা ছবি দেখলেই তো চলবে না। ও আরও কী কী ছবি এঁকেছে দেখতে হবে। ওর আঁকার পদ্ধতিটাও জানা দরকার। ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই!

ঠিক আছে, আপনি চলে যান না নীলুর সঙ্গে। আমি সব ব্যবস্থা কবে দিচ্ছি। আমার অফিসের দু একটা কাজ, আমাকে থাকতে হবে কলকাতায়। নীলু তো আজই ফিরছে।

আমি যেতে চাই, তার আরও একটা বিশেষ কারণ আছে ঘোষালবাবু। সামনের সপ্তাহে অ্যাকাডেমিতে সারা বাংলা তরুণ শিল্পীদের একটা বড় প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে। ছবি বাছাইয়ের ভার দেওয়া হয়েছে আমার ওপর। আমি এই মেয়েটিকে সুযোগ দিতে চাই। ওর একটা এক্সপোজার হবে। অন্য সব শিল্পীদের ছবির পাশে ওর ছবিও থাকবে, লোকে দেখবে। লোকেরাই ওর বিচার করুক।

এ তো অতি চমৎকার ব্যাপার। এমন সুযোগ তো আশাই করা যায় না! আমাদের আর কিছু বলতে হবে না। শিল্প-রসিকরাই ওর বিচার করবে।

মেয়েটিকে কলকাতায় আনা যাবেনা? প্রদর্শনীতে অন্য শিল্পী সবাই থাকবে!

কেন আনা যাবে না? ওর ভাড়ার টাকা আমি দিয়ে দেব। থাকার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে!

এবার আমি বাধা দিয়ে বললাম, চন্দনদা, ফুলমণি কি আসতে চাইবে? এত লাজুক, কথাই বলতে চায় না, কোনও দিন নিজের জায়গা ছেড়ে বাইরে যায়নি।

সিরাজুল সাহেব বললেন, আমি বুঝিয়ে বলব। আমি তো যাচ্ছি।

চন্দনদা জোর দিয়ে বলল, তাকে আসতেই হবে, যদি সে সত্যিই শিল্পী হতে চায়। শুধু ঘরে বসে ছবি আঁকলেই তো চলে না। শিল্পীকে ছবির ফ্রেমিং পর্যন্ত শিখতে হয়। অন্য কে কী-রকম আঁকছে তা জানতে হয়। নিজের অভিজ্ঞতার জগতটাকে বাড়াতে হয়। এই সবই পার্ট অফ দ্য গেইম। ফুলমণি যদি আসতে না চায়, ছবিগুলো তাকে ফেরত দিয়ে আসবি। বাকি জীবন তাহলে সেইট বওয়া কুলি হয়েই কাটাক। সিরাজুল তাবিকের মতো এত বড় একজন শিল্পী নিজে তার কাছে যেতে চাইছেন।

সিরাজুল সাহেব বললেন, আচ্ছা, আগে গিয়েই দেখা যাক না।

চন্দনদা রয়ে গেল কলকাতায়। সিরাজুল সাহেবকে নিয়ে আমি ছোটপাহাড়ি পৌঁছলাম পরদিন দুপুরবেলা। গেস্ট হাউসে একটা ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমি বললাম, আপনি খেয়ে-দেয়ে এখন বিশ্রাম নিন। কাল সকালবেলা যাওয়া যাবে ফুলমণির গ্রামে।

কিন্তু বৃদ্ধের কী অদম্য উৎসাহ।

তিনি বললেন, ট্রেনে বসে বসে এসেছি, পরিশ্রম তো কিছু হয়নি। বিশ্রামের কী দরকার? চলুন, বিকেলেই দেখা করি আমাদের শিল্পীর সঙ্গে।

আজ ছুটির দিন নয়, ফুলমণি কাজে এসে থাকতে পারে। তার গ্রামে যাবার বদলে আগে একবার কনস্ট্রাকশন সাইটটা দেখা দরকার। অনেকটা হেঁটে যেতে হবে।

সিরাজুল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে আমার সাইকেলে যদি ক্যারি করি, আপত্তি আছে?

উনি হেসে বললেন, আপত্তি কীসের। গেলেই তো হল।

এত বড় একজন শিল্পীকে আমি আমার সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এটা যেন ভাবাই যায় না। শিল্পীরাও কত সাধারণ মানুষ হয়ে যেতে পারেন!

সিরাজুল সাহেবের এক-একখানা ছবির দাম পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকা। ঘরে বসে নিজের ছবি আঁকার বদলে ইনি এত দূর ছুটে এসেছেন এক অজ্ঞাত কুলশীল শিল্পীকে প্রমোট করার জন্য। একেই বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান!

আমাদের লেবরেটরি বাড়িটার গেটের সামনে নামলুম সাইকেল থেকে। পড়ন্ত বিকেলের আলো হলুদ হয়ে এসেছে। দূরের পাহাড়ের চূড়ার কাছে মুকুট হয়ে আছে সূর্য। একঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে সে-দিকে।

বাড়িটার বাইরের দেয়ালে বাঁশের ভারা বাঁধা। সেই ভারা বেয়ে মাথায় ইটের বোঝা নিয়ে উঠছে এক রোগা নারী। রোদ ঝলসাচ্ছে তার পিঠে।

সেই দিকে আঙুল তুলে বললাম, ওই দেখুন আমাদের শিল্পী।

সিরাজুল সাহেব অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলেন সে-দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, কবে আমরা আমাদের দেশের মা-বোনেদের এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারব? মেয়েদের কি আমরা অন্য কাজ দিতে পারি না?

আমি বললাম, সিরাজুল সাহেব, মফস্বল শহরে মেথরানি মেয়েরা মাথায় করে গুয়ের পাত্র বয়ে নিয়ে যায়, দেখেননি? এর চেয়ে হীন কাজ কি আর কিছু আছে? কে জানে, সেই মেথরানিদের কেউ ছবি আঁকতে পারে কি না। কিংবা হয়তো আশা ভোঁসলের মতো গানের গলা আছে।

সিরাজুল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

তারপর বললেন, আমার মেয়ে, আমিনা, তার কথা আপনি শুনেছেন নীলুবাবু?

আমি বললাম, না।

দূরের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, সে ছিল আমার চোখের মণি, সে একদিন…যাক, আর একদিন বলব।

সিরাজুল সাহেব হঠাৎ বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ভেতরে এনে আমার ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে তাকে বসালাম। ]

 হেড মিস্তিরি ইরফান আলি এসে আমাকে বলল, সাহেব, আমাদের পেমেন্ট এনেছেন না মহিমবাবু দেবেন?

এখানকার প্রত্যেক মজুরদের আলাদা ভাবে প্রতি দিন টাকা দিয়ে একসঙ্গে থোক টাকা দেওয়া হয় ইরফান আলিকে। সে অন্যদের কাজ অনুযায়ী মজুরি দেয়। এরকমই প্রথা। আমার ছুটি, মহিমবাবুই টাকা আনবেন।

 সেকথা বলতে ইরফান আলি খানিকটা অপ্রসন্ন ভাবে ঘড়ি দেখে বলল, উনি কখন আসবেন, ছুটির সময় হয়ে এল।

আমি বললাম, আপনি সাইকেল নিয়ে মহিমবাবুর কাছে চলে যান না।

এরপর আমি ফুলমণিকে ডাকিয়ে আনলাম এ-ঘরে।

একটা মলিন ছাপা শাড়ি পরে আছে ফুলমণি। সেটা অটুটও নয়। লাল ধুলো লেগে আছে এখানে ওখানে। মুখখানা ঘামে মাখা।

আমি বললাম, ফুলমণি, ইনি হচ্ছেন সিরাজুল তারিক সাহেব। খুব বড় শিল্পী। এঁর আঁকা ছবি দেশ-বিদেশে অনেক জায়গায় দেখানো হয়। তোমার ছবিগুলো এঁর ভাল লেগেছে। তাই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।

অন্য দিন ফুলমণি যাকে বলে সাত চড়ে রা কাড়ে না, আজ এক জন শিল্পীর কথা শুনে তার প্রতিক্রিয়া হল।

সে মাটিতে বসে পড়ে সিরাজুল সাহেবের দুটি পায়ের পাতা স্পর্শ করল। সিরাজুল সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, আরে, না না, ওঠো মা। ওঠো।

হাত ধরে তিনি ফুলমণিকে তুলতে তুলতে বললেন, ইস, এত রোগা কেন? গায়ের জোর না থাকলে ছবি আঁকবে কী করে? মাথায় অতগুলো ইট নিয়ে ওঠো, যদি পা পিছলে পড়ে যাও? ভাবলেই ভয় করে।

আমার মনে হল, আমার কর্তব্য শেষ হয়ে গেল এখানেই। ফুলমণিকে আমি সঁপে দিলাম সিরাজুল সাহেবের হাতে। এবার থেকে উনিই যা কিছু করার করবেন।

পরদিন ভোরে অবশ্য সিরাজুল সাহেবকে ফুলমণিদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে হল আমাকেই। আমি মহিমবাবুকে বলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সিরাজুল সাহেব হেঁটেই যেতে চান। পায়ে হেঁটে নদী পেরুলেন।

এর মধ্যে ফুলমণি সম্পর্কে খানিকটা খোঁজখবর পাওয়া গেছে।

ফুলমণির স্বামী মারা গেছে দু’বছর আগে। এর মধ্যে ওর আবার বিয়ে হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল, ওদের সমাজে এ-রকমই হয়। কিন্তু ফুলমণি বিয়ে না করে রয়ে গেছে শ্বশুরের কাছে। ওর শ্বশুর বৃদ্ধ ও পঙ্গু, তাকে দেখবার আর কেউ নেই। একটা চোদ্দ বছরের ভাতুয়া ছেলেকে ওরা বাড়িতে রেখেছে, ফুলমণি যখন কাজে যায়, তখন সেই ছেলেটি ওর শ্বশুরের দেখাশুনো করে। এই শ্বশুর ফুলমণির ছবি আঁকার গুরুও বটে।

প্রথম দেখে বৃদ্ধকে আমার স্বার্থপর ধরনের মনে হয়েছিল। অবশ্য অসহায়ও বটে। অসহায় ও দুর্বলেরা বেশি স্বার্থপর হয়ে ওঠে।

এবার আমরা যাবার পর গ্রামের অনেক লোক ভিড় করে দেখতে এল। ফুলমণি সম্পর্কে বাবুশ্রেণীর লোকেরা এত আগ্রহ দেখানোতে ফুলমণি এখানে বেশ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ফুলমণি ছবি আঁকে তা এরা জানে, কিন্তু সেই ছবি নিয়ে বাবুদের এত মাথাব্যথা কেন তা তারা বুঝতে পারে না। অনেকেই বাড়ির দেয়ালের গায়ে ছবি আঁকে, বৃষ্টির জলে তা এক সময় ধুয়ে যায়। ছবির আবার এর চেয়ে বেশি মূল্য আছে নাকি?

আমি এলেবেলে হলেও সিরাজুল সাহেবের চেহারা দেখলেই সম্ভ্রম জাগে। তিনি একটা ছেঁড়া জামা পরে থাকলেও বোঝা যাবে তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাছাড়া, আমি ছোটপাহাড়িতে চাকরি করি, আমার পক্ষে এ গ্রামে আসাটা খুব একটা আশ্চর্যের কিছুনা, কিন্তু সিরাজুল সাহেবের মতো এক সম্ভ্রান্ত মানুষ কলকাতা থেকে এসে ফুলমণির সঙ্গে দেখা করতে, এর মর্ম এখানকার মানুষ বুঝতে পারে না। অনেকগুলো কৌতূহলী, উৎসুক মুখ ঘিরে রইল আমাদের।

সিরাজুল খুব সহজেই ফুলমণির জড়তা কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি ফুলমণির অন্য ছবি দেখতে দেখতে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। ফুলমণি কীভাবে ছবি আঁকে, তা-ও সে ঘরের বারান্দায় বসে তখনই এঁকে দেখাল।

বৃদ্ধটি এতসব ব্যাপারে তেমন খুশি নয়। সে চায় তার ছবি সম্পর্কে কথা বলতে। তাকে বাদ দিয়ে তার পুত্রবধুর অসমাপ্ত ছবিগুলো নিয়ে এত মাতামাতি করা হচ্ছে কেন?

আমাকে একটা কায়দা করতে হল। চন্দনদা আমাকে আলাদা ভাবে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলেছিল, ফুলমণি যদি কলকাতায় আসতে রাজি হয়, তাহলে ওর শ্বশুরকে এই টাকাটা দিয়ে আসবি কয়েক দিনের সংসার খরচের জন্য।

আমি বৃদ্ধকে বললাম, আপনার ছবিগুলো কলকাতায় অনেকের খুব ভাল লেগেছে। সবাই জিজ্ঞেস করছিল আপনার কথা।

বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন, ভাল লেগেছে? ভাল লেগেছে?

আমি বললাম, হ্যাঁ। আপনার সব ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। চারশো টাকায়। এই নিন সেই টাকা। একশো টাকা আমি সরিয়ে রাখলাম, ওটা ফুলমণিকে হাতখরচ হিসেবে দিতে হবে। ফুলমণি যদি দিন সাতেকও বাইরে থাকে, তার মধ্যে এই বৃদ্ধের জন্য চারশো টাকাই যথেষ্ট।

বৃদ্ধ শিশুর মতো খুশি হয়ে বার বার বলতে লাগলেন, আমার ছবি… শহরের মানুষ দাম দিয়ে কিনেছে? আমি আরও ছবি আঁকব!

কিন্তু ফুলমণিকে নিয়ে যাবার প্রস্তাব শুনে বৃদ্ধের সেই খুশি অন্তর্হিত হয়ে গেল।

একটুক্ষণ মুখ গোমড়া করে বসে থাকার পর বললেন, না না, ও কী করে একা একা কলকাতায় যাবে? আমার তবিয়ৎ ঠিক থাকলে আমি যেতাম। ও যাবে না!

পেছনের দর্শকদের মধ্যে থেকে এক ছোকরা বলল, ফুলমণি কি গান গাইবে না নাচবে? ছবি দেখাবার জন্য ওকে যেতে হবে কেন? শুধু ছবিগুলো নিয়ে গেলেই হয়!

আরও কয়েক জন হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, ফুলমণি গান গাইবে না, নাচবে? মুখচোরা, হারজিড়জিড়ে ফুলমণির গান গাওয়া কিংবা মঞ্চের ওপর নাচের দৃশ্যটা এমনই অবিশ্বাস্য যে অনেকেই হাসি পায়।

ফুলমণির শ্বশুর জনসমর্থন পেয়ে উৎসাহিত হয়ে বললেন, ও চলে গেলে আমাকে দেখবে কে? আমি একা এই খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে মরব?

বাসন্তী এগিয়ে এল ভিড় ঠেলে। ফুলমণির প্রতি তার সহানুভূতি হয়েছে সম্প্রতি। সম্ভবত ছবি এঁকে টাকা পাওয়ার ব্যাপারটা তাকে আকৃষ্ট করেছে।

বাসন্তী বলল, যাক না ফুলমণি। আবার তো ঘুরে আসবে। এই কদিন আমি তোমাকে দেখব।

এরপর ফুলমণির যাওয়ার পক্ষে ও বিপক্ষে নানা রকম কথা শুরু হয়ে গেল। আমি বসে রইলাম চুপ করে।

খানিক বাদে ফুলমণির শ্বশুর সিরাজুল তারিককে জিজ্ঞেস করলেন, আপনিই বলুন না, আপনি বুঝার মানুষ, ফুলমণির কলকাতায় যাওয়ার কি প্রয়োজন আছে?

সিরাজুল সাহেব শান্তভাবে বললেন, আছে। গেলে ভাল হয়। ছবির প্রদর্শনী হলে অনেকে শিল্পীকে দেখতে চায়। ফুলমণিরও উপকার হবে, জানাশুনা হবে, অনেক লোকের সঙ্গেই, ও আরও অনেক ছবি দেখবে, শিখতে পারবে।

বৃদ্ধ বললেন, কলকাত্তা বড় খিটকেল জায়গা। আমি তো জানি।

সিরাজুল সাহেব বললেন, ফুলমণিকেই জিজ্ঞেস করা যাক না, ও যেতে চায় কি না। না চাইলে জোর করে তো কেউ নেবেনা।

উঠোনে ফুলমণির শ্বশুরের খাটিয়া ঘিরে কথা হচ্ছে আমাদের। ফুলমণি বসে আছে ঘরের দাওয়ায়। সে ছবিগুলো সব গুছিয়ে রাখছে।

সবাই এবার সে দিকে তাকাল। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, তুই যাবি?

 ফুলমণি মাথা তুলল, নিচু গলায়, কিন্তু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, যাব!

শুনেই মনে হল সে অনেকক্ষণ আগেই মন ঠিক করে রেখেছে। অন্যদের মতামতের কোনও মূল্য নেই তার কাছে। ওই একটা শব্দ শুনেই ফুলমণির ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। মেয়েটা যতই লাজুক হোক, এই ছোট গণ্ডির বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তার আকর্ষণ আছে, ছবির প্রদর্শনীতে সে উপস্থিত থাকতে চায়, তার মানে প্রকৃত শিল্পী হবার বীজ রয়েছে ওর মধ্যে।

বৃদ্ধ এবার আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, আপনারা তোওকে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ও ফিরবেকী করে? কোনওদিন একলা কোথাও যায়নি, লোকের সঙ্গে কথা বলতে জানে না।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমার সঙ্গে ফিরবে। আমি তো কলকাতায় থাকি না, এখানে চাকরি করি, দু’চারদিনের মধ্যেই আমাকে ফিরতে হবে।

এরপর আর আপত্তির কারণ রইল না। কিন্তু বাধা এল অন্য দিক থেকে।

সন্ধেবেলা গেস্ট হাউসে এসে উপস্থিত হলেন মহিম সরকার। চোখ সরু করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মি. নীললোহিত, আপনি নাকি একটা কামিনকে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ। কামিন মানে ওই ফুলমণি, যে খুব ভাল ছবি আঁকে।

মহিমবাবু বললেন, ছবি-ফবি আমি বুঝি না। আমি বুঝি কোম্পানির কাজ। এখানকার একটা ওয়ার্কার মেয়েকে আপনারা কাজ নষ্ট করে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? অন্য ওয়ার্কাররা কী ভাববে?

তারা কী ভাববে আমি কি করে জানব বলুন তো?

তারা চটে যাবেনা? একজনকে, একটা মেয়েকে বেশি বেশি খাতির করা হচ্ছে, এটা তারা সহ্য করবে কেন! আপনি এ কাজটা ভাল করছেন না।

আমি তো নিজের দায়িত্বে নিয়ে যাচ্ছি না মহিমবাবু। আমাকে চন্দনদা, আই মিন, মি. চন্দন ঘোষাল বলেছেন, এটা তারই নির্দেশ।

মি, ঘোষালের পার্সোনাল ব্যাপার হলে আমি কিছু বলতে চাইনা। কিন্তু কোম্পানির কাজ হ্যামপার হলে —

এটাও কোম্পানির কাজের মধ্যে পড়ে। কোম্পানি ঠিক করেছে, এখানে শুধু বাড়ি আর কারখানা বানালেই চলবে না। স্থানীয় লোকদের উন্নতির দিকটাও দেখতে হবে। অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক দুটো দিকই।

সেই ছুঁতোয় একটা ইয়াং মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া।

দেখুন মহিমবাবু, ফুলমণি ইয়াং ঠিকই এবং মেয়েও বটে। কিন্তু আপনি যে সেনসে বলছেন, সেটা এখানে খাটে না। ছবি আঁকতে পারাটাও ওর একমাত্র যোগ্যতা। এখানকার একটি মেয়ে যদি শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, তাহলে এই জায়গাটারও তো সুনাম হবে।

আপনি ওকে নিয়ে যাচ্ছেন, আপনি সদ্য কাজে যোগ দিয়েছেন, এরমধ্যেই ছুটি নিয়েছেন দু’দিন, আবার কলকাতায় চলে যাচ্ছেন।

আবার ছুটি নেব। চাকরিতে ক্যাজুয়াল লিভ, আর্নড লিভ এসব পাওয়া যায় না?

আপনি কি পার্মানেন্ট স্টাফ যে ছুটি পাবেন? আপনার চাকরির মোট তিন সপ্তাহও হয়নি, হে হে হে, এর মধ্যে ছুটি।

দেখুন আমাকে চাকরিটা দিয়েছেন মি.চন্দন ঘোষাল। তিনিই আমার বস, তাইনা? তিনি যে কাজ দেবেন, আমাকে সেই কাজই করতে হবে।

সে আপনি যাই-ই বলুন মশাই, ব্যাপারটা ভাল হচ্ছেনা। ঝাড়খণ্ডী আন্দোলন চলছে, এখানকার কোনও মেয়েকে বাইরে নিয়ে চলে যাওয়া এরা মোটেই ভাল চোখে দেখবে না, এই আমি বলে যাচ্ছি।

মহিম সরকার আমাকে মোটামুটি শাসানি দিয়েই চলে গেলেন।

চন্দনদা এসে পৌঁছল রাত্তিরের দিকে। মহিম সরকারের আপত্তির কথাটা জানাতে চন্দনদা পাত্তাই দিল না। বাঁ-হাতে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বলল, দুর দুর, ও লোকটা একটা মাথা-মোটা। একটা সাঁওতাল মেয়ের আঁকা ছবি অন্য সব শিল্পীর সঙ্গে সমান মর্যাদায় একটা বড় প্রদর্শনীতে স্থান পাচ্ছে, এরকম আগে কখনও ঘটেছে? বিরাট ব্যাপার। এক জন গুণীর মর্যাদা দেওয়াটা কখনও অপরাধ হতে পারে? ঝাড়খণ্ডী নেতারা এটা ঠিক বুঝবে। ওদের সঙ্গে আমার ভাব আছে।

পরদিন সকালেই রওনা হলাম আমরা। বাসে যেতে হবে না, চন্দনদার জিপ আমাদের বেল স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। ফুলমণির ছবিগুলো ভালভাবে প্যাক করে নিয়েছেন সিরাজুল সাহেব। একটা পুঁটলিতে ভরে নিয়ে এসেছে ফুলমণি তার অন্য জিনিসপত্র। পায়ে রবারের চটি, পরনে একটা নীল পাড় সাদা শাড়ি।

গেস্ট হাউসের সামনে আমাদের বিদায় জানাতে এসেছে কয়েক জন। বাসন্তী আর ওদের গ্রামের কয়েকটি ছেলে। এবং মহিম সরকার। তিনি এখন দিব্যি হেসে হেসে গল্প করছেন চন্দনদার সঙ্গে। হঠাৎ এক সময় কাছে এসে ফুলমণির দিকে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে তিনি বললেন, ফুলমণি, তোর কিন্তু ফার্স্ট হওয়া চাই। তুই প্রাইজ নিয়ে ফিরে এলে আমি সবাইকে মিষ্টি খাওয়াব।

জিপে ওঠার আগে ফুলমণি একবার দূরের মাঠের দিকে ঘুরে তাকাল। আজকে আকাশ সজল মেঘে ঢাকা। পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে না। ডান পাশের জঙ্গলের ভেতর থেকে কয়েকটা মোষকে তাড়িয়ে নিয়ে এল একটা বাচ্চা রাখাল। একটা কুকুর অকারণে সেখানে চ্যাঁচাচ্ছে, উড়ে গেল একঝাক কোচ বক।

ফুলমণি যেন তার ছবির পটভূমিকাগুলি একবার দেখে নিল চোখ ভরে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়