চন্দনদাকে নিয়ে আর পারা যায় না! সন্ধেবেলা যে-মুরগিটা নিয়ে এল, পালক ফালক ছাড়াবার পরও সেটার ওজন দেড় কিলোর কম নয়। এত বড় একটা মুরগি রান্নার জন্য তেল-মশলা-আলু পেঁয়াজ জোগাড় করা কি সোজা কথা? তাছাড়া এত মাংস খাবে কে?

চন্দনদা বলল, তুই রান্না কর, দেখবি খাওয়ার লোকের অভাব হবে না। হরিলাল, শিবলাল, যাদবলাল, কত আছে! দুমকায় আমার দাদু কী বলতেন জানিস? বিরাশি বছর বয়স, তবু রোজ মাছ চাই, মাংস চাই, তিন রকম তরকারি চাই। সব সাজিয়ে দেওয়া হত, নিজে কিন্তু কিছুই খেতেন না। একটু একটু ছুঁয়ে উঠে পড়তেন। আর বলতেন, আমার টাকা আছে, আমি হুকুম করব সব রান্না হবে, তাতে আমার নাতি-নাতনিরা ভাল করে খেতে পাবে।

আমি বললাম, তা তো বুঝলাম। কিন্তু তোমার বাংলোতে বাবুর্চি আছে, তাকে দিয়ে না রাঁধিয়ে শুধু শুধু আমাকে খাটাচ্ছ কেন?

চন্দনদা বলল, আরে দুর দুর, বাবুর্চির হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে জিভ পচে গেছে। তোর এখানে খেলে বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব হয়।

আমি মনে মনে বললাম, দেখাচ্ছি মজা! আজ ভাতের তলা ধরিয়ে দেব ডালে নুন দেব দু’বার, আর মাংসে এমন ঝাল দেব যে, কাল সকাল পর্যন্ত হু-হু করে জ্বলবে।

আমার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চন্দনদা বলল, এক-এক সময় মনে হয়, জীবনটা যদি গোড়া থেকে শুরু করা যেত। তোর মতো এই রকম একটা ঘরে থাকতাম, নিজে রান্না করে খেতাম, ইচ্ছে না হলে দু’দিন দাড়ি কামাতাম না! সন্ধের সময় নিজের বাংলোতে থাকি না কেন জানিস? বাড়িতে থাকলেই অন্য অফিসাররা চলে আসে, এসেই অফিসের গল্প শুরু করে। সব সময় অফিসের গল্প!

হঠাৎ আবার উঠে বসে বলল হ্যাঁ, ভাল কথা। মহিমবাবু তোর নামে কী যেন বলছিল! তুই কী করেছিস?

এই রে। তুমিও তো অফিসের গল্প শুরু করলে!

 না না, মহিমবাবু তোর নামে অভিযোগ করছিল। তুই নাকি ওয়ার্কারদের লাই দিচ্ছিস, তারা কাজে ফাঁকি দেয়।

এসব কথা কাল আলোচনা করলে হয় না?

 তোর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি মহিমবাবুর?

 চন্দনদা, তুমি এক সময় গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলে না?

হ্যাঁ। কে বলল তোকে?

তোমার প্রাণের বন্ধু তপনদার কাছ থেকে শুনেছি। তুমি বহরমপুর থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছিলে। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েও ভর্তি হয়েছিলে আর্ট কলেজে। তোমার বাবা খবর পেয়ে এসে কান ধরে, তোমাকে টানতে টানতে শিবপুরে নিয়ে গিয়েছিল।

কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তপনের বানানো, না তুই বানালি? আমার বাবার চোখরাঙানিটা আমি যথেষ্ট ভয় পেতাম। বাবা দুঁদে উকিল ছিলেন।

বাবার ভয়ে তুমি ছবি আঁকা ছেড়েই দিলে? ইঞ্জিনিয়ার হলে বুঝি আর শিল্পী হওয়া যায় না? অনেক ইঞ্জিনিয়ার তো কবিতা লেখেন। কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত…।

আমার কাজটা যে বড্ড ঝামেলার। চাকরিতে জড়িয়ে পড়ার পর আর চর্চা রাখতে পারিনি।

নীপাবউদির কাছে তোমার আঁকা কয়েকটা ছবি আমি দেখেছি। নীপাবউদির ইচ্ছে সেগুলো বাঁধিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখবে। কিন্তু তুমি…।

আরে দুর, দুর, সেগুলো খুব কাঁচা ছবি। লোকে দেখলে হাসবে!

নীপাবউদির একখানা স্কেচ তুমি বেশ ভালই এঁকেছ। দেখলে চেনা যায়।

আমি ঠিক পঁয়তিরিশ সেকেন্ডে মানুষের মুখ আঁকতে পারতাম। একটানে। কিন্তু, কিন্তু, তুই কথা ঘোরাচ্ছিস রে নীলু? মহিমবাবু তোর নামে নালিশটা করেছে, আমি এসেছি তার বিচার করতে।

মহিমবাবু তোমাকে আসল কথাটাই বলেননি।

আসল কথাটা কী শুনি?

আমার ওখানে যারা কাজ করে, তাদের মধ্যে একটা আদিবাসী মেয়ে দেওয়ালে একটা ছবি এঁকেছে, তাতে মহিমবাবুর আপত্তি। আমি ভাবলাম, ছবিটা তোমাকে একবার দেখাব।

ছবি এঁকেছে মানে কী? ফিগার ড্রয়িং আছে?

হ্যাঁ, একটা ছোট ছেলে, একটা কুকুর।

রিয়েলিস্টিক? নাকি বাচ্চারা যে-রকম আঁকে, কিংবা মধুবনী স্টাইলের।

রিয়েলিস্টিক, মানে, ছেলেটাকে ছেলে বলে চেনা যায়, কুকুরটা অবিকল কুকুর। ব্যস্তভাবে খাট থেকে নেমে চন্দনদা বলল, চল তো, চল তো, আমি এ পর্যন্ত কোনও আদিবাসীর আঁকা রিয়েলিস্টিক ছবি দেখিনি।

এখন এই রাত্তিরে যাবে নাকি? কাল সকালে।

চল দেখে আসি। এমন কিছু রাত হয়নি।

রান্নাবান্না?

সে-সব পরে হবে। জামাটা পরে নে।

জিপ এনেছে চন্দনদা, ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছে, নিজেই চালাবে। আজ অন্ধকার নেই, ফট ফট করছে জ্যোৎস্যা। বাতাসে সেই জ্যোৎস্নার সুঘ্রাণ।

এখনও মাদল বাজেনি, আর কোনও শব্দ নেই, জিপের আওয়াজটাকেই মনে হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র আওয়াজ। আকাশ এত পরিষ্কার যে, ছায়াপথ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।

লেবরেটরি বাড়িটায় এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। একটা গুদাম ঘরে সিমেন্ট জমা থাকে, তার জন্য এক জন পাহারাদার থাকার কথা, কিন্তু তার পাত্তা পাওয়া গেল না।

চন্দনদার হাতে একটা তিন ব্যাটারির লম্বা টর্চ। আমরা উঠে এলাম দোতলায়। দেয়ালটার ঠিক জায়গায় টর্চের আলো পড়তেই চন্দনদা বিস্ময়ে শিস দিয়ে উঠল।

চতুর্দিকে অন্ধকার, টর্চের জোরালো আলোয় ছবিটা স্পষ্ট দেখা গেল, দিনেরবেলার চেয়েও ভাল মনে হল।

চন্দনদা দু’পাশ থেকে ছবিটা দেখে বলল, তুই ঠিক বলছিস নীলু, এটা কোনও আদিবাসী মেয়ের আঁকা?

হ্যাঁ। মেয়েটা পিকিউলিয়ার। কানে শুনতে পায়, কথা বলে না।

এ যে পাকা হাতের কাজ। সামথিং ইউনিক। আদিবাসীরা রিয়েলিস্টিক ছবি, যাকে বলে ফটোগ্রাফিক রিয়েলিস্টিক, সে-রকম আঁকতে পারে বলে জানা নেই। এখানে দেখ, যে-ছেলেটাকে এঁকেছে, তার ফিগারটা পুরোপুরি প্রোপোরশানেট। তারমানে শরীরের সঙ্গে হাত-পা, মুখের সাইজ একেবারে ঠিক ঠিক। খানিকটা ট্রেইনিং না থাকলে তো এ-রকম আঁকা যায় না।

মেয়েটাকে দেখে মনে হয়, ও কিছু জানে না।

তা তো হতে পারে না। ভাল করে দেখ ছবিটা। গাছতলায় একটা ছেলে বসে আছে, এক জন রাখাল, হাতে একটা বাঁশি। সাধারণত এই ছবি আঁকা হলে সবাই বাঁশিটা মুখের কাছে দেয়। বাঁশি বাজাচ্ছে তাই বোঝায়। কিন্তু এখানে বাঁশিটা একটু দূরে ধরা, ছেলেটার মুখ দেখলে মনে হয়, সে এখনও বাঁশি বাজানো শুরু করেনি। বাঁশিটা হাতে নিয়ে কিছু একটা ভাবছে। তার মানে, শিল্পী এখানে ট্র্যাডিশানের চেয়ে একটু আলাদা হতে চেয়েছে। এটা বাঁশি হাতে কেষ্টঠাকুর নয়। আর একটা জিনিস দেখ, গাছ আর ছেলেটা ছবির বাঁ-দিকে, তাই ব্যালান্স করবার জন্য ডান দিকের কোণে কুকুরটাকে বসিয়েছে। এটা যে কেষ্টঠাকুর নয়, সাধারণ রাখালের ছবি, সেটাও বোঝানো হয়েছে ওই কুকুরটাকে দিয়ে। কেষ্টঠাকুরের সঙ্গে কুকুরের অনুষঙ্গ নেই, ময়ুর কিংবা হরিণ-টরিণ কিছু থাকত।

বাবাঃ, তুমি তো অনেক কিছু বলে ফেললে চন্দনদা। আমি এত সব বুঝি না।

ভাল করে দেখলেই বোঝা যায়। মহিমবাবুটা একটা পাঁচ নম্বুরি গাড়ল। এই রকম ছবি দিয়ে কেউ নালিশ করে? ক্যামেরাটা আনলাম না, এর একটা ছবি তুলে রাখা উচিত। কয়েকজনকে দেখাতাম।

কাল সকালে ক্যামেরা নিয়ে এসো।

কী দিয়ে এঁকেছে বল তো? সরু আর মোটা, দুরকম রেখাই আছে। কুকুরটাকে মোটা আউট লাইনে এঁকে গায়ে ছোট ছোট লোমও দিয়েছে। দু’রকম তুলির কাজ?

নানা, চন্দনদা। ও মেয়েটা তুলি-ফুলি কোথায় পাবে? ওর কাছে কিছু থাকে না। টিফিনের সময় কোনও কাঠি দিয়ে আপন খেয়ালে এঁকেছে।

আরও কিছুক্ষণ ধরে ছবিটা দেখার পর টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে চন্দনদা বলল, তাহলে তো খুব মুশকিল হল রে নীলু। যে-মেয়ে এ-রকম ছবি আঁকে, সে এক জন খাঁটি শিল্পী, তাকে দিয়ে আমরা মাথায় ইট বওয়াবার কাজ করাব? এটা তো একটা সামাজিক অন্যায়।

আমি বললাম, বেশি বাড়াবাড়ি কোরোনা চন্দনদা। ছবি তো অনেকেই আঁকে। আমি তো দেখেছি, কলকাতার রাস্তায় অনেক সময় কেউ কেউ ফুটপাথের ওপর রঙিন চক দিয়ে বড় বড় ছবি এঁকে ভিক্ষে করে। তারাও তো শিল্পী।

চন্দনদা জোর দিয়ে বলল, না। সে-সব ছবি আমিও দেখেছি। সেগুলো ডাল। নিষ্প্রাণ। যে-সব ছবিতে একটা অন্তদৃষ্টি থাকে, সেগুলোই আসল ছবি হয়। আমি ছবি চিনি।

যারা বাউল গান করে, কী চমৎকার গলা। তারাও তো গায়ক। কিন্তু তাদের ট্রেনে ভিক্ষে করতে হয়।

তুলনা দিবি না, খবরদার তুলনা দিবিনা। ভেরি ব্যাড লজিক। বাউলদের ঠিকমতো কদর হয় না বলে শিল্পীদেরও অনাদর করতে হবে? তাছাড়া আজকাল ছবির বাজার ভাল। মধুবনী পেইন্টিংসও তো সাধারণ গ্রামের মেয়ের ছবি আঁকে, ভাল দামে বিক্রি হয়। আমি ছবি চিনি, এটা একটা…।

একখানা ছবি দেখেই কি কোনও শিল্পীকে চেনা যায়!

এই এতক্ষণে একটা দামি কথা বলেছিস নীলু। না, শুধু একটা ছবি দেখলে কিছু বলা যায় না। এই ছবিটা কপি হতে পারে। অন্য কারুর ছবি দেখে যদি এঁকে থাকে, তাহলে অবশ্য কিছুই না। কপি করতে দক্ষতা লাগে বটে, সিনেমার বড় বড় হোর্ডিং যারা আঁকে তারাও এক ধরনের আঁকিয়ে, কিন্তু শিল্পী নয়। নিজের মাথা থেকে একা নতুন বিষয়কে নতুন ভাবে আঁকা আলাদা ব্যাপার। কাল সকালে এসে আমি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলব!

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চন্দনদা আবার বলল, ছবিটা দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল রে আমার!

পরদিন নটার সময় এসে আমি চমকে গেলাম। দোতলার দেয়ালের ছবিটা কেউ মুছে ফেলেছে!

 মিস্তিরি-মজুররা জমা হচ্ছে এসে এসে। সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কিছু জানে না। ফুলমণি অন্য দিনের মতোই নিস্তব্ধ। কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেয় না। এক সময় ধৈর্য হারিয়ে আমি অন্য এক জন সাঁওতালকে জিজ্ঞেস করলাম, এই মেয়েটা কথা বলতে পারে না?

সে বলল, হ্যাঁ গো বাবু, পারে। কিন্তু বলে না।

খানিক বাদে চন্দনদা এসে খুব রাগারাগি করতে লাগল। ক্যামেরা এনেছে সঙ্গে। ফুলমণিকে জেরা করা হল অনেক, সে শুধু মাথা নাড়ে। তবু আমার সন্দেহ হল, ফুলমণিই ছবিটি মুছে ফেলেছে।

চন্দনদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, টিফিনের সময় আমি আবার আসছি।

অন্য দিনের মতোই শুরু হয়ে গেল কাজ। তিন তলার গাঁথনি শুরু হয়েছে, এক তলা থেকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে ইট, বালি, সিমেন্ট। লক্ষ্য করলাম, ইরফান আলি যেন অন্য দিনের চেয়ে ফুলমণিকে বেশি খাটাচ্ছে। ছবিটা আঁকার জন্য ফুলমণি খানিকটা গুরুত্ব পেয়ে গেছে, সেটা ইরফান আলির পছন্দ হয়নি। যেখানে লাভ-লোকসানের প্রশ্ন নেই, সেখানেও মানুষের মনে এক ধরনের ঈর্ষা কাজ করে।

বাঁশের ভারা বেয়ে আমিও উঠে গেলাম দো-তলার ছাদে। সিঁড়ি এখনও তৈরি হয়নি। এক পাশে কাজ চলছে, আর একপাশটা ফাঁকা। এ-রকম ন্যাড়া ছাদের প্রান্তে এসে নিচের দিকে তাকালে ভয় ভয় করে। খানিকটা দূরেই ছোট ছোট টিলা। বনতুলসীর ঝোপঝাড়টাও দেখা যায় এখান থেকে। ছোট নদীটার ধারে বসে আছে কয়েকটা বক। গোটা চারেক কালো কালো মোষ, এখানে ওদের বলে কাড়া, হেঁটে পার হচ্ছে নদী।

মাঝে মাঝে ফুলমণির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে আমার। সে মাথায় করে ইট আনছে ওপরে, আবার নেমে যাচ্ছে, কোনও দিকে তার দৃষ্টি নেই। এত রোগা মেয়ের এক সঙ্গে বারো-চোদ্দটা ইট বয়ে আনছে কী করে? পড়ে না যায়। ইরফান আলি মাঝে মাঝে তাকে অকারণ তাড়া দিয়ে বলছে, ইতনা দের কাঁহে হোতা? জলদি করো, জলদি করো।

টিফিনের সময় হোটেল থেকে খেয়ে এসে আমি দেখলাম, চন্দনদা বসে আছে বারান্দায়। পাশে একটা বড় ব্যাগ।

আমাকে দেখে বলল, খেয়ে এসেছিস? গুড! ওদেরও খাওয়া হয়ে এল। এবার একটা এক্সপেরিমেন্ট করব।

ব্যাগটা থেকে চন্দনদা বার করল ফুলস্কেপ সাইজের অনেকগুলো কাগজ আর অনেকগুলো পেন্সিল, সেগুলোর এক দিকে লাল অন্য দিকে নীল শীস।

আঠেরো জন মিস্তিরি-মজুদের সবাইকে ডেকে চন্দনদা একখানা করে সেই কাগজ ও পেন্সিল ধরিয়ে দিল। তারপর বলল, তোমরা সবাই আঁকো যার যা খুশি। যেমন ইচ্ছে আঁকো। তাড়াতাড়ির কিছু নেই।

বাচ্চাদের যেমন সিট অ্যান্ড ড্র প্রতিযোগিতা হয়, সেই রকমছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গেল আঠেরো জন। তিনটি সাঁওতাল মেয়ে শুধু খিলখিলিয়ে হাসে। ফুলমণি সকলের থেকে অনেক দূরে একটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল।

চন্দনদা বলল, এদের কাছাকাছি থাকা ঠিক নয়। তাতে ওরা লজ্জা পাবে।

গাড়ি থেকে একটা আইস বক্স আর গেলাস নামিয়ে চন্দনদা চলে এল একটা কোণের ঘরে। আইস বক্স থেকে বেরুল ঠাণ্ডা বিয়ারের বোতল। একটা বোতলের ছিপি খুলে চন্দনদা বলল, তোকে কিন্তু দিচ্ছি না নীলু। এখানে তুই আমার কর্মচারী। সাব অরডিনেট স্টাফ-এর সঙ্গে কাজের সময় বিয়ার খেলে আমার বদনাম হয়ে যাবে।

একটু পরেই এসে হাজির হলেন মহিমবাবু।

ঠোঁটের এক কোণে হেসে চন্দনদাকে বলল, স্যার, আপনি নাকি কুলি-কামিনদের দিয়ে ছবি আঁকাচ্ছেন?

চন্দনদা বলল, হ্যাঁ। আপনাকে কে খবর দিল?

 মহিমবাবু বলল, খবর ঠিক ছড়িয়ে যায়।

চন্দনদা বলল, আপনি এসেছেন, ভাল করেছেন। বসুন, আপনিও দেখে যাবেন ছবিগুলো।

চেয়ার মাত্র একখানা। জানালা-দরজাও এখনও বসানো হয়নি। মহিমবাবুকে আমারই মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হল।

চন্দনদা মহিমবাবুকে জিজ্ঞেস করল, বিয়ার খাবেন? গেলাস অবশ্য একটাই, আপনাকে বোতল থেকে চুমুক দিতে হবে।

মহিমবাবু জিভ কেটে বললেন, আমার ও-সব চলে না। জীবনে কখনও ছুঁইনি।

তারপর আমার দিকে চেয়ে তিনি সমর্থন আশা করলেন।

চন্দনদা বলল, গুড। আপনি বিড়ি-সিগারেট খান না, মদ খান না, কাজে ফাঁকি দেন না, বউয়ের খুব বাধ্য, আপনার তো স্বর্গের টিকিট কাটা হয়েই আছে।

আমি সরে পড়লাম সে-ঘর থেকে। মহিমবাবু দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমি শুধু শুধু সে-শাস্তি পেতে চাই কেন।

মিস্তিরি-মজুররা কেউ একতলার বারান্দায়, কেউ দোতলার সিঁড়িতে বসে ছবি আঁকায় নিমগ্ন। কেউ কেউ এখনও হেসে যাচ্ছে।

ওদের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমি নেমে গেলাম মাঠে। এদিকে সেদিকে কয়েকটা গাছ পোঁতা হয়েছে মাত্র, পরে বাগান হবে। আজ থেকে তিন-চার বছর বাদে জমজমাট হয়ে যাবে এই জায়গাটা। কত লোক কাজ করবে, কত নোংরা জমা হবে, মানুষের রেষারেষিতে দূষিত হবে বাতাস। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তুলসীর জঙ্গল। বনতুলসীর প্রতি মায়া করে তো সভ্যতার অগ্রগতি থেমে থাকবেনা।

এখানকার সীমানা-পাঁচিলের ওপারেও কিছু বনতুলসী ফুটে আছে। একটা পাতা ছিঁড়ে গন্ধ নিলাম। এই গন্ধটাই স্মৃতিতে থেকে যাবে।

খানিক বাদে একটা ঘণ্টা বাজার ঝনঝন শব্দ হল। অর্থাৎ টিফিন টাইম শেষ। অন্য দিন ওই ঘণ্টা আমি বাজাই।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চন্দনদা বলল, এই নীলু, কাগজগুলো নিয়ে যায়।

পরীক্ষার হলের গার্ডের মতো ছাত্রদের কাছ থেকে উত্তরপত্র সংগ্রহ করার মতো আমি ওদের কাছ থেকে ছবিগুলো নিতে লাগলুম। নিতে নিতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওরা কি আমাদের সঙ্গে মস্করা করছে নাকি? ফুলমণির কাগজটা নিয়ে আমি কটমট করে তাকালাম তার দিকে। সে মুখ ফিরিয়ে আছে, তার মুখখানা বিষাদ মাখান।

চন্দনদা বলল, দেখি দেখি!

একটার পর একটা সবকাগজ উলটে গিয়ে চন্দনদা হাহাকারের মতো বলে উঠল, এ কী? ওই মেয়েটার কোনটা?

কোনও কাগজেই কোনও ছবি নেই। যা আছে তা কহতব্য নয়।

ইরফান আলি এঁকেছে একটা বাড়ির নকশা। সোজা সোজা দাগে। আর কয়েক জন এঁকেছে কাঠি-কাঠি, হাত-পা-ওয়ালা আর গোল মুণ্ডু যেসব মানুষ গুহাচিত্রে আঁকা হয়, সেই রকম কিছু। কেউ এঁকেছে পদ্মফুল, কেউ এঁকেছে পাঁচ ইঞ্চি আমগাছে দেড় ইঞ্চি সাইজের আম ঝুলছে। সাঁওতালরা কেউ কিছু আঁকেনি। সারা কাগজ ভরে কাটাকুটি করেছে। কেউ-বা পেন্সিলের চাপে কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছে।

প্রত্যেকটা কাগজে আমি নম্বর লিখে দিয়েছিলাম। সুতরাং কে কোন কাগজ পেয়েছিল তা আমার আন্দাজ আছে। ফুলমণির কাগজটা একনম্বর, যে শুধু গোল গোল দাগ দিয়েছে, আর কিছুনা।

সেই কাগজটা চন্দনদা উলটেপালটে অনেক ভাবে দেখল। তারপর হতাশ ভাবে বলল, না কিছু না! এ কী হল রে নীলু?

মহিমবাবু কাগজগুলোকে নিয়ে দ্রুত চোখ বোলালেন। তারপর হ্যা হ্যা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন। এরা যে কেউ কোনও ছবি আঁকতে পারেনি, সেটা যেন তারই বিপুল জয়।

চন্দনদা বলল, সবাই ছবি আঁকতে পারে না ঠিকই, কেউ কেউ একটা সোজা দাগও টানতে পারে । কিন্তু এত জনের মধ্যে এক জনও অন্তত… কাল দেয়ালে যে ছবিটা দেখলাম।

মহিমবাবু বললেন, বাজে, সব বাজে।

আমি বললাম, চন্দনদা, আমাদের বোধহয় গোড়াতেই একটা ভুল হয়ে গেছে।

চন্দনদা মুখ তুলে আমার দিকে সরু চোখে তাকাল।

আমি বললাম, আমরা ওদের কাগজ-পেন্সিল দিয়েছি। ওদের মধ্যে অনেকে জীবনে কখনও পেন্সিলই ধরেনি। কলম-পেন্সিল দিয়ে কী করে লিখতে হয়, সেটাও তো শেখা দরকার। হাতে-খড়ির সময় বাচ্চাদের কলম ধরতে শেখানো হয় না? এদের হাতে-খড়িই হয়নি, এরা আরও শিশু।

চন্দনদা বলল, এটা একটা পয়েন্ট বটে। এরা পেন্সিল ধরতে জানে না।

আমি বললাম, যারা জীবনে কখনও দেশলাই কাঠি জ্বালেনি, তার হাতে তুমি একটা দেশলাই দাও, জ্বালতে পারবে না। অথচ কাজটা খুব সোজা! মেয়েরা কত সহজে সূচ-সুতো দিয়ে সেলাই করে, কিন্তু তুমি আমি চেষ্টা করলে…।

মহিমবাবু বললেন, বাদ দিন, এবার ও-সব কথা বাদ দিন। মি. ঘোষাল, আমাদের চার নম্বর প্লটের ঢালাইটা কি কালই হবে? আকাশে মেঘ জমেছে। আজই তাহলে সব ব্যবস্থা করতে হয়।

চন্দনদা মহিমবাবুর মুখের দিকে খানিকটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আমার মাথায় আর একটা আইডিয়া এসেছে। আজ আর টিফিনের পরে কাজ করতে হবে না। ওদের হাফ ডে ছুটি।

এমনি এমনি ছুটি দিয়ে দেবেন?

এমন এমনি নয়। ওদের দিয়ে আবার ছবি আঁকাব!

মি. ঘোষাল, কোম্পানি ওদের বিনা কাজে মাইনে দেবে?

কোম্পানির ব্যাপারটা আমি দেখব। বিনা কাজ মানে কী, ছবি আঁকাটা একটা কাজ নয়?

 আমি অস্বীকার করছিনা। কিন্তু সেটা কি কোম্পানির কাজ?

আলবাত! আমরা এখানে কারখানা বানাব, শহর বসাব, কিন্তু তাতে স্থানীয় লোকদের জীবনযাত্রার কোনও ক্ষতি যাতে না হয়, সেটা দেখাও আমাদের কোম্পানির দায়িত্ব। জীবনযাত্রা মানে শুধু খাওয়া পরা আর চাকরি নয়। কালচারাল অ্যাকটিভিটিও তো আছে। কেউ যদি ভাল ছবি আঁকে কিংবা গান গায় কিংবা খেলাধুলোয় ভাল হয়, তাদেরও এনকারেজ করতে হবে। এখন কে কেমন ছবি আঁকে দেখছি, পরে গানের ব্যাপারটা দেখতে হবে। তারপর খেলাধুলোর প্রতিযোগিতা।

আমার দিকে চেয়ে চন্দনদা বলল, সবাইকে ডাক।

মিস্তিরি মজুররা এর মধ্যে আবার কাজে লেগে গেছে।

আমি বুঝতে পারি, আমার চাকরিটাই এখানে অবান্তর। এরা এখানে ফাঁকি দিতেই শেখেনি। কেউ দেরি করে আসেনা, কত দূরের গ্রাম থেকে আসে, তবু ঠিক সময় আসে, ছুটির আগে কেউ পালাবার ছুতো খোঁজে না। মাইনেটা এদের কাছে নিমক, নিমক খেলে তা ঠিক ঠিক শোধ দিতে হবে। আমার কাজটাই বরং ফাঁকির।

কাজ ছেড়ে চলে আসবার জন্য সবাইকে ডাকতে, এরা বেশ অবাক হল।

চন্দনদা হাত তুলে সবাইকে চুপ করার ইঙ্গিত দিয়ে বক্তৃতার ঢঙে বলতে লাগল, শোনো, অন্য দিন তোমরা যা কাজ করো, আজ তোমাদের তা করতে হবে না। রোজ রোজ এককাজ আর ভাল লাগে? আজ তোমরা সবাই ছবি আঁকো। যে যা পারো আঁকো। চেষ্টা করলে কিছুনা কিছু পারবেই। গামলায় চুন গুলে নাও, তারপর আঙুল দিয়ে কিংবা কাঠি বা বুরুশ দিয়ে যার যেমন খুশি দেয়ালে আঁকো। যার ছবি আমার পছন্দ হবে, তাকে আমি একশো টাকা প্রাইজ দেব।

ইরফান আলি অপ্রসন্ন ভাবে বলল, আজ তিন তলা গাঁথনি আরম্ভ করেছি, এক ধারটা শেষ হয়ে যেত।

চন্দনদা বলল, কাল হবে, কাল হবে। যাও, যাও, সবাই শুরু করো।

মিস্তিরি-মজুররা ছত্রভঙ্গ হবার পর চন্দনদা মহিমবাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি আঁকতে পারেন?

মহিমবাবুর বিয়ার খাওয়ার প্রস্তাবে যেরকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেই রকম ভাবেই প্রায় আঁৎকে উঠে বললেন, ছবি? আমি? না, না, না।

চন্দনদা বলল, তাহলে চলুন, আপনি আর আমি কাজ করতে যাই। চার নম্বর সাইটটা দেখে আসি। এরা আঁকুক। নীলু, তুই চেষ্টা করতে পারিস। এক যাত্রায় আর পৃথক ফল হবে কেন? তোর ছবি ফার্স্ট হলে তুই পাবি একশো টাকা।

 চন্দনদার জিপ সশব্দে বেরিয়ে গেল।

এদিকে চুন গোলা শুরু হয়ে গেছে। ছবি আঁকতে পারুক বা না পারুক, চন্দনদার আদেশটাকেও এরা কাজ বলে ধরে নিয়েছে। হতে পারে এটা সাহেবের খেয়াল, কিন্তু এর জন্য তো মাইনে কাটা যাবেনা।

ফুলমণি সম্পর্কেই আমার বেশি কৌতূহল। ওই বোবা মেয়েটা কালকের ছবিটা কেন মুছে দিল আজ সাত সকালে এসে? অত ভাল ছবি আঁকে, ও কি সত্যিই পেন্সিল ধরতে জানে না? কিংবা ও লজ্জা পেয়ে গেছে?

অন্যদের সঙ্গে ফুলমণিও চুন গুলছে।

আমি কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসে রইলম ঘরটার মধ্যে। আধ ঘণ্টা বাদে অন্য দিনের মতোই বেরিয়ে পড়লাম কাজ পরিদর্শনে। ইরফান আলি ও আর দু’জন এক জায়গায় বসে বিড়ি ফুঁকছে। ইরফান আলি হেড মিস্তিরি, চুনের কাজে হাত দিতে বোধহয় তার সম্মানে বাধে।

অন্য অনেকে কিন্তু বিভিন্ন দেয়ালে ছবি আঁকতে শুরু করেছে। কাঠির পাতায় ন্যাকড়া জড়িয়ে তৈরি করেছে বুরুশ। কেউ কেউ আঁকছে শুধু আঙুলে।

ফুলমণি আঁকছে দোতলার একটা দেয়ালে! সে খুব দ্রুত হাত চালাচ্ছে। ওই দেয়ালে যে রোদ পড়েছে, তার রঙটা যেন অন্য রকম। ওঃ হহ, উলটো দিকটা উত্তর, সে-দিকটা খোলা। উত্তরের আলো ছবি আঁকার পক্ষে প্রকৃষ্ট, মেয়েটা তা জানল কী করে?

চুনে আঙুল ডুবিয়ে সে লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে। কী আঁকছে বোঝাই যাচ্ছেনা। মেয়েটার চোখ শুধু আঙুলের ডগায়।

দূর থেকে আমি তার টেকনিকটা লক্ষ্য করলাম। কখনও আঙুল চ্যাপ্টা করে টানছে মোটা মোটা রেখা, কখনও নখ দিয়ে ফুটিয়ে তুলছে সরু সরু রেখা। তার ডান হাতের একটা নখ বেশ বড়।

ওর মনঃসংযোগের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমি নেমে গেলাম নিচে। অন্য যে তিনটি সাঁওতাল মেয়ে সবসময় হাসাহাসি করে, তারাও এখন আঁকায় ব্যস্ত, একজন তীর-ধনুক হাতে এক বীরপুরুষের রূপ ফুটিয়ে তুলেছে অনেকটা, মন্দ নয় তো ছবিটা।

একা একা একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার মনে হল, চন্দনদাকেই একটা কিছু পুরস্কার দেওয়া উচিত। এমনিতে চন্দনদাকে আমার খুব একটা পছন্দ নয়। নানা রকম হুজুগ তুলে প্রায়ই নিজের সংসারে নানা রকম গোলমাল পাকায়। একবার তো নীপাবউদির সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। বাবা-মায়ের ঝগড়ায় তিতিবিরক্ত হয়ে ওদের মেয়ে মুমু আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল।

কিন্তু একটা কোম্পানির বড় সাহেব হয়ে, নিজের মিস্তিরি-মজুরদের দিয়ে কাজ করাবার বদলে ছবি আঁকাচ্ছে, এ-রকম কি ভূভারতে আর কোথাও পাওয়া যাবে? চন্দনদার হুজুগগুলোও আলাদা ধরনের।

হঠাৎ গোঁ গোঁ শব্দ করে একটা লরি এসে থামল গেটের সামনে। লরিভর্তি বালি।

অন্যদিন লরিতে সুরকি, বালি, ইট বা সিমেন্ট এলে ইরফান আলিই সবকিছু বুঝে নেয়। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় পাশে, মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে। আমাদের লোকেরাই ওসব নামিয়ে নেয় লরি থেকে।

আজ তো সে-প্রশ্নই ওঠেনা।

প্রথম কথা, আমাদের মিস্তিরি মজুররা এখন শিল্পী, তাদের শারীরিক পরিশ্রম করার কথা নয়। শিল্পীর আঙুল এখন বালিতে ডুবতেই পারে না।

দ্বিতীয় কথা, লরিওয়ালা তার লোকেদের যদি মালটা নামিয়ে দিতে চায়, তাতেও শব্দ হবে, শিল্পীদের ব্যাঘাত ঘটবে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা যামিনী রায় ছবি আঁকছেন। আর কাছেই কিছু লোক হুসহাস শব্দ করে লরি থেকে বালি নামাচ্ছে, এ দৃশ্য কি কল্পনা করা যায়? আমাদের এই নবীন শিল্পীরা কেউ যে অবনী ঠাকুর বা যামিনী রায় হচ্ছে না, তা কে বলতে পারে?

লরি ড্রাইভার নেমে দাঁড়িয়েছে, তাকে আমি বললাম, আজ মাল নামানো হচ্ছে না, ওয়াপস যাও, কাল আও!

বিকেলবেলা জায়গাটা এত নিস্তব্ধ দেখে লরিওয়ালা কিছুটা কৌতূহলী হয়েছে, আমার কথা শুনে আরও অবাক হল।

সে জিজ্ঞেস করল, কিউ।

 আমি বললাম, মিস্তিরি লোক আভি ছবি আঁকতা হ্যাঁয়। তসবির, তসবির, তসবির বানাতে হ্যায়।

সে বলল, কেয়া?

বিস্ময়ে লোকটির চোয়াল ঝুলে গেছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। লোককে চমকে অবাক করে দেওয়াটা আমার প্রিয় খেয়াল। আমি ওকে আরও গুলিয়ে দেবার জন্য এক হাতের পাঞ্জায় পেন্সিল বুলোবার ভঙ্গি করে বললাম, ছবি, ছবি!

এই সময় ইরফান আলি ছুটতে ছুটতে এল। এক মুঠো বালি নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে বলল, কেইসান বালি লায়া? মোটা দানা। ঠিক হ্যায়, ওহি কোনাসে উতারো।

আমি বললাম, আজ বালি উতারোবে না। কাল আনবে।

 ইরফান আলি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, আমি জোর করে বললাম, কাল, কাল। এক দিন পরে বালি এলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

ইরফান আলিকে জব্দ করে এবং হতভম্ব লরি ড্রাইভারকে ফিরিয়ে দিয়ে আমার বেশ তৃপ্তি হল। প্রতি দিন তো আর এ-রকম ঘটনা ঘটে না।

পাঁচটা বাজার একটু পরে আকাশে ঘনিয়ে এল মেঘ। আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে আলো। এরপর আর ছবি আঁকা যাবেনা, ইলেকট্রিসিটিও নেই। ওদের মেয়াদ ছটা পর্যন্ত।

আকাশের অবস্থা দেখেই সাত তাড়াতাড়ি চন্দনদা চলে এল মহিমবাবুকে সঙ্গে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল, যত দূর হয়েছে তাই-ই দেখা যাক। আর দেরি করা যাবে না।

শুরু হল এক তলার দেয়াল থেকে।

ইরফান আলি কিছুই আঁকেনি। অন্য দু’জন কলের মিস্তিরিও চুন ছোঁয়নি, হয়তো তাদের কোনও রকম সংস্কার আছে।

চন্দনদা ইরফান আলিকে জিজ্ঞেস করল, কী আলিসাহেব, আপনি কিছু আঁকলেন না?

ইরফান আলি চাপা বিদ্রুপের সুরে বলল, আমার একশো টাকার ইনাম দরকার নেই বড়বাবু। ওরা কেউ নিক।

আমি চন্দনদার হাতে মৃদু চাপ দিলাম। যারা কিছু আঁকেনি, তাদের কোনও চাপ না দেওয়াই ভাল।

এক তলার দেওয়ালগুলো দেখতে দেখতে এগোলাম আমরা। অন্যদের তুলনায় সাঁওতালদের আঁকাই চোখে পড়ার মতো। তারা প্রত্যেকেই কিছু না-কিছু এঁকেছে। সাঁওতালদের গ্রামে গিয়েও দেখেছি, তারা বাড়ির সামনে আল্পনা দেয়, মাটির দেয়ালে অনেক কিছু এঁকে রাখে। বাসন্তী নামে একটি মেয়ে, যে সবসময় ফিকফিকিয়ে হাসে আর উঁচু স্কেলে কথা বলে, সে এঁকেছে একটা সম্মিলিত নাচের দৃশ্য। সাত-আটটি নারী-পুরুষ কোমর ধরাধরি করে আছে।

চন্দনদা সেই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, বাঃ।

 বাসন্তী হেসে উঠে জিজ্ঞেস করল, কেমন গো বাবু?

চন্দনদা আবার বলল, বাঃ।

আমি চন্দনদাকে ওপরে যাবার জন্য তাড়া দিতে লাগলাম।

সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সবাই শিল্পী হয় না, এক জন দুজনই হয়। কোনও সন্দেহ নেই ফুলমণিই এখানে একমাত্র শিল্পী। অন্যরা দর্শনীয় কিছু কিছু এঁকেছে বটে কিন্তু খাঁটি অর্থে ছবি বলতে যা বোঝায়, তা এই একখানাই।

ফুলমণি তখনও ছবিটা শেষ করছিল, আমাদের দেখে এক পাশে সরে গেল।

বড় দেয়াল জুড়ে ফুলমণি এঁকেছে একটা ল্যান্ডস্কেপ। পাহাড়ের তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট নদী, সেই নদী দিয়ে পার হচ্ছে কয়েকটা মোষ, একা মোষের পিঠে বসে আছে রাখাল, তার মাথার ওপরে উড়ছে কয়েকটা বক। শুধুচুন নয়, খানিকটা কাঠকয়লাও ব্যবহার করা হয়েছে। চুনের ফ্যাটফেটে সাদা ভাবটার মধ্যে খানিকটা কালো মিশিয়ে গভীরতা আনা হয়েছে অনেকখানি।

চন্দনদা অভিভূত ভাবে একবার ছবিটার দিকে, আর একবার ফুলমণির দিকে তাকাতে লাগল। সত্যিই বিশ্বাস করা যায় না যে, যে-মেয়েটা সারা দিন মাথায় ইট বয়ে জীবিকা অর্জন করে, সে কী করে এমন ছবি আঁকে। লেখাপড়া জানে না, দুনিয়াটা চেনেনা। ছবির ইতিহাস সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই, অথচ আধুনিক ছবির ধারার সঙ্গে এ ছবির রীতিমতো মিল আছে। কোনও রকম শিক্ষা ছাড়া এ-রকম ছবি আঁকা যায়?

চন্দনদা ফুলমণির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ও মেঝেন, তোমাকে ছবি আঁকা কে শেখাল? তুমি অন্য কোনও ছবি দেখে এটা এঁকেছ?

ফুলমণি কোনও উত্তর দিল না।

আমি বললাম, চন্দনদা, ছাদ থেকে এই নদীটা দেখা যায়। আজ সকালেই আমি দেখেছি।

আমাকে মাথায় করে ইট বইতে হয় না, দেয়ালে গাঁথতে হয় না, আমি ছাদে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দূরের দৃশ্যটা উপভোগ করেছিলাম। ফুলমণি সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত ছিল। তার মধ্যেই সে এই দৃশ্যটা দেখল কখন? শুধু দেখেনি, মনে গেঁথে নিয়েছে।

অন্যরা ভিড় করে এই ছবি দেখতে এসেছে। অনেকেই ছবি আঁকতে পারে না, ছবি দেখার চোখও থাকে না। ছবি দেখার অভ্যেস যাদের নেই, তারা রিয়েলিস্টিক ছবি দেখেও বিষয়বস্তু চিনতে পারে না।

আমি ছাদের দৃশ্যটা উল্লেখ করায় ওদের এক জন বলল, হ হ, লদী বটে!

অন্য এক জন বলল, কালা কালা উগুলান কী, খাসি লয়?

 বাসন্তী, যে কিছুটা আঁকতে পারে, সে বলল, কানা নাকি তুই, খাসী কুথায়, ওগুলান কাঁড়া, বড় বড় শিং…।

চন্দনদা বলল, এই মোষগুলো দেখ, লাইনের কী জোর! একটাও স্ট্যাটিক নয়। প্রত্যেকটার ঘাড় ঘোরানো, পা তোলা আলাদা। কেউ কম জলে, কেউ বেশি জলে। যারা সাধারণ ছবি আঁকে, তারা মোষ আঁকতে গেলে আখাম্বা একটা মোষ এঁকে দেয়। এ ছবি অসাধারণ।

আমি বললাম, পাখিগুলো দেখো। সামান্য একটা করে প্যাঁচ দিয়েছে, কিন্তু ঠিক বোঝা যায়, ওগুলো কাক কিংবা চিল নয়, উড়ন্ত বক।

চন্দনদা আঙুল তুলে বলল, আমার সব চেয়ে ভাল লাগছে এই মোষটা।

এবার আমারও অবাক হবার পালা। চারটে মোষ ঠিক চেনা যাচ্ছে। কিন্তু চন্দনদা যেখানে আঙুল দেখাচ্ছে, সেখানে মোষ কোথায়? প্রথম মনে হয়েছিল, ছবির মধ্যে এমনি একটা ধ্যাবড়া পড়ে গেছে। ভাল করে দেখে মনে হল, জলে একটা কিছু ভেসে যাচ্ছে।

আমি বললাম, মোষ কই? ওটা, ওটা যেন জলে ভাসছে একটা তিনকোণা কিছু, অনেকটা যেন মনে হচ্ছে সাইকেলের সিট।

চন্দনদা বিরাট জোরে হা-হা করে হেসে উঠল।

তারপর বলল, তুই যে পিকাসোর ঠিক উলটো বললি! পিকাসোর সেই বিখ্যাত গল্পটা জানিস?

কোনটা?

পিকাসোর বাড়িতে একবার চোর এসেছিল। খুটখাট শব্দে পিকাসোর ঘুম ভেঙে যায়। পিকাসো কে কে বলে চেঁচাতেই চোরটা বারান্দা দিয়ে লাফিয়ে পালাল। পিকাসো দৌড়ে বারান্দায় এসে এক ঝলক শুধু দেখতে পেলেন গলি দিয়ে সাইকেল চেপে চোরটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। পরদিন সকালে পুলিশ এসে সব খোঁজ খবর নিতে নিতে পিকাসোকে জিজ্ঞেস করল, আপনি চোরটাকে কেমন দেখেছিলেন, একটু বর্ণনা করতে পারবেন? পিকাসো মুখে কিছু না বলে ছবি এঁকে দিলেন। কী আঁকলেন জানিস? একটা মোষের মাথা।

মহিমবাবু এতক্ষণ কোনও কথা বলেননি, এবার বললেন, অ্যাঁ?

 চন্দনদা বলল, পিকাসো যা দেখেছিলেন, হুবহু তাই এঁকেছিলেন। একরকম সাইকেল হয়, দুদিকের হ্যান্ডেল উঁচু হয়ে থাকে। রেসিং সাইকেল যাকে বলে। সেই সাইকেলে বসে মাথা নিচু করে কেউ যদি খুব জোরে চালায়, দূর থেকে একটা শিংওয়ালা মোষের মাথাই মনে হবে। এখানে এই ছবিতে, মোষটা সারা শরীর ডুবিয়ে আছে জলে, শুধু মাথার ওপরটা দেখা যাচ্ছে। তাই তোর মনে হচ্ছে সাইকেলের সিট।

মহিমবাবু বললেন, পিকাসো, খুব বড় শিল্পী, না? নাম শুনেছি। দু’একখানা ছবিও দেখেছি। কিছু বোঝা যায় না মাথামুণ্ডু। না বোঝা গেলে সেটা কি করে ভাল ছবি হয় মশাই?

চন্দনদা মহিমবাবুর কাঁধে চাপড় মেরে বলল, মশাই, এ বিষয়েও পিকাসোর নিজেরই গল্প আছে। প্যারিসে একটা পার্টিতে একটি খুব সাজগোজ করা মহিলা এসে পিকাসোকে ধরেছিল। নাকি সুরে অনুযোগ করে বলেছিল, মি. পিকাসো, আপনার ছবি দেখে কিছুই বুঝতে পারি না। উলটো না সোজা, তা পর্যন্ত বোঝা যায় না। এ-রকম ছবি আঁকার কি কোনও মানে আছে? পিকাসো উত্তর দিলেন, ম্যাডাম, আপনি কখনও চিনে ভাষা শুনেছেন? তার একটি বর্ণও বোঝেন? তার মানে কি আপনার ধারণা, চিনে ভাষার কোনও মানে নেই? সমস্ত চাইনিজরা মিনিংলেস ভাষায় কথা বলে? শিখলেই চিনে ভাষার ঐশ্বর্য বোঝা যায়। ছবি দেখাও শিখতে হয়। না শিখে কথা বলতে আসে মূর্খরা।

চন্দনদা এবার আমার দিকে ফিরে বলল, নীলু, গাড়ি থেকে আমার ক্যামেরাটা নিয়ে আয়। এটা আবার কেউ মুছে ফেলার আগেই একটা ছবি তুলে রাখব। আর হ্যাঁ, আমি একশো টাকা পুরস্কার দেব বলেছিলাম। এই ছবি তার অনেক বেশি পাওয়ার যোগ্য। আমি দুশো টাকা দিচ্ছি।

পকেট থেকে পার্স বার করে চন্দনদা বলল, কোথায় ফুলমণি?

ভিড় ফাঁক হয়ে গেল, সবাই এ-দিক ওদিক তাকাচ্ছে। ফুলমণি নেই। কয়েক জন ডাকাডাকি করতে লাগল ওর নাম ধরে। চন্দনদা পিকাসোর লম্বা গল্প ফাঁদার সময় ফুলমণি সরে পড়েছে।

আমি বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, দূরে মাঠের মধ্য দিয়ে ছুটে ছুটে চলে যাচ্ছে ফুলমণি। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় তাকে দেখাচ্ছে ঠিক যেন, কীসের মতো? কীসের মতো? কীসের মতো? নাঃ, আমার তো শিল্পীর চোখ নেই, কোনও উপমাও আমার মনে এল না।

.

০৪.

পরদিন কাজে এল না ফুলমণি।

চন্দনদার দুশো টাকা বাসন্তীর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে সাঁওতালদের অবিশ্বাস করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বাসন্তী টাকাটা দিয়ে দিয়েছে, ফুলমণি নিতেও আপত্তি করেনি জানা গেল। চন্দনদার হাত থেকে নিতে ও লজ্জা পেয়েছিল। ওর এত লজ্জা আমি কখনও দেখিনি।

এরা পয়সা জমাতে জানে না। হাতে পয়সা থাকলে কাজ করতেও চায় না। ফুলমণির রোজ ছিল বাইশটাকা, একসঙ্গে দুশো টাকা পেয়েছে, এখন কত দিন কাজে আসবেনা কে জানে! পর পর তিন দিন পাত্তা পাওয়া গেল না তার।

চন্দনদাই ছটফট করছে বেশি।

চন্দনদা অন্য রকম একটা প্ল্যান করে রেখেছিল। এখানে অনেক ট্রেসিং পেপার লাগে, সেগুলো পাঠানো হয় শক্ত কাগজে মোড়া প্যাকেটে। সেই শক্ত কাগজগুলো কেটে কেটে ঠিকমতো সাইজের করা হল। দু’তিন রকম রঙও জোগাড় করেছে চন্দনদা। সেগুলো আমাকে দিয়ে বলেছিল, তুই ফুলমণিকে এই কাগজের ওপর রঙ দিয়ে ছবি আঁকতে বলবি। আঙুল দিয়ে হোক বা যে-ভাবেই আঁকুক। দেয়ালে চুন দিয়ে আঁকা ছবি কিংবা তার ফটোগ্রাফেরও বিশেষ কোনও মূল্য নেই। কাগজের ওপর আঁকা কয়েকখানা ছবি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে নাম করা দু’এক জন শিল্পীকে দেখানো যেতে পারে। তাদের মতামত শুনে বোঝা যাবে, সত্যিই মেয়েটার ছবি আঁকার ক্ষমতা কতখানি।

কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। কোথায় ফুলমণি? সে নিজে থেকে না এলে তো তাকে জোর করে ধরে আনা যায় না।

আমার ঘরে এসে সন্ধেবেলা চন্দনদা খাটে শুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটা আজও আসেনি?

আমি বললাম, নাঃ! ওর গ্রামের অন্য মেয়েদের জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতে পারে না। আদিবাসীরা কোনও প্রশ্নেরই সরাসরি উত্তর দেয় না। হয় হাসে, অথবা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলে। আমি বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলাম, ফুলমণি কেন আসছে না। তার উত্তরে ও প্রথমে খিল খিল করে হাসল। তারপর বলল, আমি যদি এক রোজ না আসি, তুই আমার কথা জিগাস কি ছোটবাবু? বোলো? এরপর কি ফুলমণি সম্পর্কে আর কৌতূহল দেখানো যায়?

চন্দনদা বলল, দেখ নীলু, আমি ছবি আঁকা কনটিনিউ করিনি বটে, কিন্তু ছবি আমি মোটামুটি বুঝি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও মেয়েটা একটা জিনিয়াস। আজকাল ছবির বাজার দারুণ ভাল। একটু নামকরা শিল্পীদের ছবি পনেরো, কুড়ি, তিরিশ, পঞ্চাশ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়। হুসেনের এক-একখানা ছবির দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিছুদিন আগে একটা গ্যালারিতে এক জন প্রায় নতুন শিল্পীর একজিবিশান দেখতে গেলাম। এক-একটা ওয়াটার কালার ছবির দাম ধরেছে পাঁচ হাজার টাকা। আমার ধারণা, এই মেয়েটাও ছবি এঁকে যথেষ্ট রোজগার করতে পারে। একটা গ্রামের অশিক্ষিত গরিব মেয়ে বলে সুযোগ পাবেনা, তার গুণের কদর হবে না, কেন?

একটা কথা জিজ্ঞেস করি, চন্দনদা। এইটাই আমার কাছে ধাঁধার মতো লাগে। সাধারণ গরিব মানুষ, যাদের খাওয়া-পরার চিন্তাতেই সারা দিন কেটে যায়, তাদের প্রায় কেউই ছবি-টবির ব্যাপার জানেই না, তবু হঠাৎ দু’একজন ছবি আঁকতে চায় কেন?

তুই আদিম গুহামানবদের আঁকা ছবি দেখিসনি? তারা কি ছবির বিষয় কিছু জানত? তাদেরও শুধু খাবার জোগাড়ের চিন্তায় দিন কাটত। তখন স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স ছিল সাঙ্ঘাতিক। তবু তো তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছবি এঁকেছে।

অনেকে যে বলে, খুব বৃষ্টির মধ্যে যখন ওরা গুহা থেকে বেরুতে পারত না, তখনই ওরা সময় কাটাবার জন্য দেয়ালের গায়ে ছবি এঁকেছে।

সময় কাটাবার জন্য অধিকাংশ মানুষই পড়ে পড়ে ঘুমোয়। কিংবা অন্যের সঙ্গে খুনসুটি করে কিংবা সেক্স-এর তালে থাকে। মাত্র দু’এক জনেই ছবি আঁকে। এটাই একটা রহস্য। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে হঠাৎ দু’এক জন গানের গলা পায়। দু’এক জন কিছু না শিখেও ছবি আঁকতে পারে, দু’এক জন কবি হয়। শিল্পের লাইনে উন্নতি করতে গেলে সবাইকেই শেষ পর্যন্ত শিখতে হয়, সাধনা করতে হয়। কিন্তু ভেতরে কিছু জিনিস না থাকলে তো হাজার ট্রেইনিঙে শিল্পী হওয়া যায় না। এক-এক জনের আবার এই ভেতরের জিনিসটা থাকলেও সুযোগের অভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

আমাদের দেশে এখন শহরের লোকেরা যত সুযোগ পায়, গ্রামের লোকেরা তার কিছুই পায় না।

শহরের লোকেরা..ইদানীং সব বড়লোকের ছেলে-মেয়েরাই ছবি আঁকা শিখতে যায়, যেখানে সেখানে গানের স্কুল আর কবি, কবিদের তো স্কুলও লাগেনা, হাজার হাজার কবি, সবাই ভাবে কবিতা লেখাটা খুব সহজ। রিটায়ার্ড জজ, ডকের মজুর, যাবতীয় স্কুলমাস্টার, যাবতীয় প্রেমিক দু’চারলাইন লিখেই ভাবে, এই তো কবিতা হয়ে গেল। আজকাল তো আবার ছন্দ মিলেরও ব্যাপার নেই। তুইও কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিস নাকি কখনও নীলু?

রক্ষে করো! দেখছ না আমার হাতের আঙুল, এই আঙুলে কখনও কবিতা বেরুতে পারে? আমি ভুলেও কখনও সে-চেষ্টা করিনি!

চন্দনদা উঠে বসে খানিকক্ষণ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই রকম মুখের ভাব দেখলেই বুঝতে পারি, চন্দনদার মাথায় আবার নতুন কোন প্ল্যান ঘুরছে।

চন্দনদা গাঢ় গলায় বলল, দেখনীলু, ওই ফুলমণি মেয়েটার সত্যিকারের প্রতিভা আছে। সেটাকে নষ্ট হতে দেওয়াটা বিরাট অন্যায়। আমাদের কিছু দায়িত্ব নেই? তাহলে আমরা কীসের মানুষ?

আমি আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু মেয়েটা যদি নিজে না চায়।

ওকে বোঝাতে হবে! ওকে দিয়ে আরও আঁকাতে হবে। আমি ওকে গোল্লায় যেতে দিতে কিছুতেই রাজি নই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, মুশকিল এই, আমি নিজে কিছু করতে পারব না ওর জন্য। আমি কোনও দায়িত্ব নিতে পারব না।

কেন?

তার কারণ, ও একটা মেয়ে।

তাতে কী হয়েছে?

আরে মেয়ে বলেই তো ঝামেলা। ওর কোনও উপকার করতে গেলেই তোর বউদি খেপে যাবে। সেবারে রোহিণীকে নিয়ে কী কাণ্ড হল মনে নেই? নীপার ধারণা, কোনও মেয়েকে আমি যদি কিছু সাহায্য করতে যাই, তার মানেই আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি।

যাঃ, কী বলছ চন্দনদা! ফুলমণি সম্পর্কে এ প্রশ্নই ওঠেনা। একটা রোগা হাড় জিরজিরে মেয়ে, সাত চড়ে রা কাড়ে না, কোনও কথাই বলে না, তার সঙ্গে আবার প্রেম হতে পারে নাকি।

তুই বুঝবিনা, মেয়েদের যে কীসে কখন ঈর্ষা হয়। তুই আর মেয়েদের সম্পর্কে কতটুকু জানিস। ওই ফুলমণিটা যদি একটা ছেলে হত, আমি নিজের টাকা খরচ করে ওকে কোনও আর্টিস্টের কাছে কিছুদিন রেখে দিতাম, ওর ছবির প্রদর্শনী নিয়ে সারা ভারতে ঘুরতাম! কিন্তু ওর বেলায় তা পারব না, তোকেই ভার নিতে হবে। তোকে তো আর কেউ প্রেমে পড়ার বদনাম দেবে না, আর বদনাম দিলেই বা তোর কী আসে যায়?

এই সময় হরিলাল হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে এসে খবর দিল, কলকাতা থেকে একটা গাড়ি এসেছে, গাড়ি ভর্তি লোক, তারা চন্দনদাকে খুঁজছে।

আমরা ওপর থেকেই উঁকি মেরে দেখলাম, লালুদার লাল রঙের মারুতি গাড়ি। ভেতরে নীপাবউদি, মুমু আর ওদের বাড়ির রান্নার লোকটি।

লালুদার ওইটুকু গাড়ি থেকে এত জিনিস বেরুতে লাগল যে, মনে হল যেন ম্যাজিক। দুতিন হাঁড়ি মিষ্টি, অনেক রকমের ফল, বাক্স বাক্স চিজ, বিস্কিট, মাখনের টিন, সার্ডিন মাছের টিন, পাঁউরুটি, জ্যাম, জেলি, আচার…।

এসেই লালুদা ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে দিল।

দারুণ ভাবে শুরু হল রান্নাবান্নার তোড়জোড়। রাত আটটা বেজে গেছে, এ সময় এখনও কোনও দোকান খোলা থাকে না, গ্রামে লোক পাঠিয়ে আনা হল মুরগি। লালুদা নিজে মদ খায় না, সিগারেট খায় না। অথচ সঙ্গে এনেছে হুইস্কি-ব্র্যান্ডির বোতল, দামি দামি সিগারেটের প্যাকেট। চন্দনদার বাংলোয় আড্ডা চলল রাত পৌনে তিনটে পর্যন্ত।

পরদিন সকাল থেকেই আবার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। লালুদা যেখানে থাকে, সেখানে অন্যদের কথাও বলতে দেয় না, পয়সাও খরচ করতে দেয় না। গ্যাস বিক্রির টাকা যেন অফুরন্ত।

আমাকে নটার সময় ঠিক কাজে যেতে হয়। লালুদা সেখানেও উপস্থিত। বাড়ির কনস্ট্রাকশান বিষয়ে আমাকে কত না উপদেশ দিল তার ঠিক নেই। ওটা যে আমার কাজ নয়, তা বলারও সুযোগ পেলাম না। লালুদাকে মহিমবাবুর সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে পারলে হত। মহিমবাবু এ-দিকে আসেননি।

পাঁচ দিন হয়ে গেল, ফুলমণিরও দেখা নেই।

সন্ধেবেলা চন্দনদা আমাকে চুপি চুপি খানিকটা ভর্ৎসনা করে বলল, নীলু তুই মেয়েটার একটা খবর নিলি না? যদি অসুখ-বিসুখ হয়ে থাকে? ওই তো রোগা চেহারা, যদি মরে যায়। কাল রবিবার, কাল তুই ওদের গ্রামে যেতে পারিস না?

আমি চুপ করে রইলাম।

ওই রকম একটা ইচ্ছে আমারও হয়েছিল, কিন্তু ঠিক সাহস পাচ্ছি না। আদিবাসীদের গ্রামে এখন আর চট করে যাওয়া যায় না, ওরা সন্দেহ করে। অবস্থা অনেক বদলে গেছে। অরণ্যের দিনরাত্রি ফাত্রি এখন আর চলে না। আমার মতো একটা ছোকরা গ্রামের মধ্যে ঢুকে একটা মেয়ের খোঁজ করলে ওর স্বামীটাই হয়তো আমাকে ধরে পেঁদিয়ে দেবে। আর যদি তীর-ধনুক দিয়ে…।

মাথায় অন্য একটা মতলব এসে গেল।

রাত্তিরে খাওয়ার টেবিলে যখন গল্প বেশ জমে উঠেছে, তখন আমি ফস করে বলে উঠলাম, মুমু কাল সকালে আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবি? একটা মস্ত বনতুলসীর ঝোপ আছে, সেটা পেরিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ের পাশে ঝরনা।

মুমু বলল, হ্যাঁ যাব, হ্যাঁ যাব।

লালুদা অমনি বলল, কোথায় যাবে নীলমণি? আমি গাড়ি করে নিয়ে যাব। সবাই মিলে যাব।

আমি বললাম, না, গাড়িতে গেলে হবে না। সবাই মিলে গেলেও হবে না। একবার শুধু মুমু আর আমি এই ছোটপাহাড়ীতে এসেছিলাম। তখন যেসব জায়গায় ঘুরেছি এখন আমরা দুজনে সেই সবজায়গা আর একবার দেখব।

লালুদ বলল, ও, সেই যেবার তুমি মুমুকে নিয়ে ইলোপ করেছিলে নীলকণ্ঠ?

 নীপা বউদি হেসে ফেলল।

আমি বললাম, দু’বছর আগে মুমু আরও ছোট ছিল। ওর বয়েস তখন এগারো। এগারো বছরের মেয়েকে নিয়ে কেউ কখনও ইলোপ করে?

মুমুটা অতি দুষ্টু। মিচকি হেসে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই তো। এই নীলুকাকা, তুমি সেবার কী সব মিথ্যে কথা বলে আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলে তো!

লালুদা বলল, তারপর তুমি মুমুকে অযোধ্যা পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেলে। নীলকমল, আমার সব মনে আছে।

চন্দনদা আমার দিকে তাকিয়ে সমর্থনের হাসি দিল।

মুমু আমার পাসপোর্ট। মুমুর মতো একটি কিশোরী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কোনও আদিবাসীদের গ্রামে গেলে কেউ ভাববেনা, আমি কোনও কুমতলবে এসেছি। ফুলমণির গ্রামের কয়েক জন আমাকে চেনে, ওরা আমার কাছে কাজ করে, ওদের মোটই উগ্র-হিংস্র বলে মনে হয় না, তবু সাবধানের মার নেই। মুমুর মুখখানায় সদ্য কৈশোরের লাবণ্য মাখা, ওকে দেখলেই পছন্দ করে সবাই।

পরদিন ভোরবেলা, লালুদা জাগবার আগেই বেরিয়ে পড়লাম আমি আর মুমু।

রাত্তিরে বেশ জোর কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে! ভোরের বাতাস রীতিমতো শিরশিরে। বৃষ্টির জলে এখানে কাদা হয় না, মাটিতে সোঁদা সোঁদা ভাব। গাছপালাগুলো সব যেন স্নান করে ফিটফাট সেজে আছে।

মুমু বলল, আগের বার তো আমরা পাহাড়ের দিকে যাইনি!

আমি বললাম, তুই তো চন্দনদার ওপর রাগ করে, অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়লি এক সময়। তারপর তো সন্ধেবেলায় আমরা ফিরে গেলাম কলকাতায়। দুপুরটাতে আমি একা একা এদিকে ঘুরে গেছি। একটা খুব সুন্দর ছোট্ট নদী আছে।

মুমু বলল, অ্যাই ব্লু, আমার যখন আঠেরো বছর বয়স হবে, তখন তুমি আমাকে নিয়ে সত্যি ইলোপ করবে? বেশ মজা হবে তাহলে!

আমি বললাম, তুই যা সুন্দর হচ্ছিস দিন দিন, আঠেরো বছরে তোর এত বন্ধু জুটে যাবে যে তখন আমাকে প্রায় পাত্তাই দিবিনা!

আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলে বুঝি অনেক বন্ধু হয়?

হ্যাঁ, তখনই তো জীবনের শুরু।

ইস, কবে যে আঠেরো বছর আসবে।

 আর পাঁচ বছর বাদেই।

এই শোনো, আঠেরো বছর বয়েসে যখন আমার অনেক বন্ধু হয়ে যাবে, তখন আমি যদি তোমাকে পাত্তা না দিই, তুমি কিন্তু তখনও আসবে আমার কাছে। তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না।

আহা-হা-হা, তুই অন্য বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবি, তবু আমি তোর কাছে আসব কেন রে?

হ্যাঁ, তোমাকে আসতেই হবে। আসতেই হবে। বলো আসবে?

সে আমি এখন কিছু বলতে পারছি না।

না, তুমি আসবে। প্রমিস করো। এক্ষুনি প্রমিস করো না হলে আমি যাব না।

মুমু একটা সোনাঝুরি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ল। হালকা সোনালি রঙের সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে আজ, রঙটার সঙ্গে ভোরের রোদ্দুরের মিল আছে। মাথার চুল উড়ছে একটু একটু। চোখের কোণে এখনও যেন ঘুম লেগে আছে একটু একটু। ছেলেমানুষিতে ভরা মুখখানাতে রাগরাগ ভাব।

মেয়েটা সত্যিই খুব রূপসী হবে। এর মধ্যেই লম্বা হয়েছে অনেকটা।

কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, পাগলী একটা! পাঁচ বছর আগেকার প্রতিজ্ঞার কি কোনও দাম আছে? পাঁচ বছরে কত কী বদলে যেতে পারে। পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমি ঠিক এক বছরের ফিলোজফি নিয়ে বেঁচে থাকি।

মুমু আমার হাত ছাড়িয়ে সরে গিয়ে বলল, এক বছরের ফিলোজফি? মানে কী আগে বলো!

 আমি বললাম, সেই গল্পটা জানিস না। এক জন বিদেশিকে এক রাজা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিল।

 মৃত্যুদণ্ড…মানে ডেথ সেনটেন্স?

হ্যাঁ। মৃত্যুদণ্ড মানে ডেথ সেনটেন্স। আজকাল অনেক বাংলা কথার ইংরিজিতে মানে বলে দিতে হয়। …রাজা মৃত্যুদণ্ড দেবার পর সেই বিদেশি বলল, মহারাজ, আমাকে যদি বাঁচিয়ে রাখেন, তাহলে আপনার সব চেয়ে যে প্রিয় ঘোড়াটা, সেটাকে আমি আকাশ দিয়ে ওড়া শিখিয়ে দিতে পারি, আপনি সেটায় চেপে আকাশে ঘুরবেন। মহারাজ শুনে হকচকিয়ে গিয়েও বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে আমি এক বছর সময় দিলাম। লোকটাকে জেলখানায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার পর অন্য এক জন কয়েদি বলল, তুমি কি পাগল নাকি? ওই কথা বললে! ঘোড়া কখনও আকাশে উড়তে পারে? বিদেশিটি বলল, শোনো, এই এক বছরের মধ্যে রাজা মরে যেতে পারেন, ঘোড়াটা মরে যেতে পারে, কিংবা এমন কিছু আবিষ্কার হতে পারে যাতে সত্যি সত্যি ঘোড়াকে আকাশে ওড়ানো যায়। এই সব কথা ভেবে ভেবে আরও অন্তত একটা বছর তো বেশ মজায় কাটানো যাবে!

মুমু খিল খিল করে হেসে বলল, আমি এর নাম দিলাম, নীললোহিত ফিলজফি।

এই রাগ, এই হাসি, এর নাম কৈশোর!

বনতুলসীর জঙ্গলটা পার হয়ে আমরা পৌঁছলাম নদীটার ধারে। এখন মোষেরা পার হচ্ছে না, বকেরাও নেই, তবু নদীটি ফুলমণির আঁকা ছবি হয়ে আছে।

আমি বললাম, তুই সাঁতার শিখেছিস, এখন তো জলে ভয় পাস না!

 মুমু ঠোঁট উলটে বলল, মোটে একটুখানি জল, এর মধ্যে সাঁতার কাটা যাবে নাকি?

হেঁটেই পার হতে হবে, তবে এক-এক জায়গায় গভীর আছে। মোষ ডুবে যায়। কিন্তু তোর সালোয়ার-কামিজ যে ভিজে যাবে।

তুমি আগে বললে না কেন? এর তলায় সুইমিং সুট পরে আসতাম।

এক কাজ করা যেতে পারে। আমি হব সিন্দবাদ নাবিক আর তুই হবি বুড়ো, শক্ত করে আমার গলাটা ধরে থাকবি, আমি তোকে পিঠে নিয়ে পার করে দেব।

আমার বুড়ো হতে বয়ে গেছে। ভিজুক গে সালোয়ার!

যে-কোনও নদী পার হতে গেলেই আমার দিকশূন্যপুরের কথা মনে পড়ে। সেখানকার নদী অবশ্য বেশ বড়, খানিকটা সাঁতার দিতেই হয়। সেখানকার বালি সোনার দানার মতো। এ নদীতে বালি নেই, শুধুপাথর।

অল্প জল হলেও স্রোতের টান আছে বেশ।

 ছুটির দিনে আমি পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আছি। পাজামা ঊরু পর্যন্ত গুটিয়ে নিতেও অসুবিধে নেই। চটিগুলো আস্তে ছুঁড়ে দিলাম অন্য পাড়ে। জল বেশ ঠাণ্ডা। মুমু আমার হাত ধরে এগোতে লাগল।

এই সকালবেলা মুমুর হাত ধরে একসঙ্গে নদী পার হবার মধ্যে যে ভাল লাগা, তা শুধু আজকের জন্য নয়, এক বছরের জন্যও নয়, তা চিরকালের।

মাঝখানটায় বেশ জল, মুমুর কোমর পর্যন্ত ডুবে গেল, আমি ওকে জোর করে তুলে নিলাম বুকে। মুমু হাত-পা ছুঁড়ে আপত্তি জানাতে লাগল, আমি প্রায় দৌড়ে চলে এলাম এ পাড়ে।

পোশাকের ওপরের অংশটা না ভিজলেই হল। তলার দিকটা ভিজলে তেমন ক্ষতি নেই, গায়ে ঠাণ্ডা বসে না।

এতক্ষণ একটাও মানুষজন দেখিনি, এবার দেখা গেল দুটো বাচ্চা ছেলেকে। ওরা কী একটা দুর্বোধ্য গান গাইছে। এক লাইন এক জন, আর এক লাইন অন্য জন।

ওদের ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, এই, পিঁজরাল গাঁওটা কোন দিকে রে?

উত্তর না দিয়ে ছেলে দু’টি পাহাড়ের তলা দিয়ে এক দিকে ছুটে গেল অনেকখানি। একটা বড় শিমুল গাছের তলায় থেমে হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকল। কাছে যেতে এক জন বলল, এই নিচা দিয়ে চলে যাও। হঁই দেখো পিঁজরাল গাঁও।

ওরা আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকেই নির্দেশনা দিয়ে যে এই পর্যন্ত ছুটে এল, সেটাই এ-দিককার মানুষের বিশেষত্ব। যদি বলতাম, আমাদের এই গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চল তো, তা-ও যেত অম্লানবদনে। আমি ছেলে দুটোর মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে আদর করে দিলাম।

মুমু জিজ্ঞেস করল, আমরা পাহাড়টার ওপরে উঠব না?

আগে চল পিঁজরাল গ্রামটা ঘুরে আসি।

সেখানে কী আছে?

সেখানে একটা মেয়ে আছে, ছবি আঁকে, তোর চেয়ে অনেক বড়, বোধহয় আমার বয়সী, তার সঙ্গে একটু দেখা করতে হবে।

ও, তুমি একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ। সেকথা আগে বলোনি!

চন্দনদা ঠিকই বলেছিল, মেয়েদের যে কখন, কেন ঈর্ষা জেগে ওঠে, তা বোঝা দুঃসাধ্য।

মুমু মুখ গোঁজ করে বলল, আমি এখন এই পাহাড়টার টপে উঠব!

আমি হেসে বললাম, তাহলে তোকে একা উঠতে হবে ভাই। আমি আগে গ্রামটায় যাব।

তুমি পাহাড়ে যাবে না আমার সঙ্গে?

তুই আমার সঙ্গে গ্রামে যাবি না! কে কার সঙ্গে কখন কোথায় যাবে সেটা আগে ঠিক করা যাক।

ব্লু, তুমি একটা অতি পাজি, মিথ্যেবাদী, গুড ফর নাথিং, বেবুন, ব্লিস্টারিং বার্নাকল, থান্ডারিং টাইফুনস।

এই, আমাকে গালাগালি দিবিনা বলছি মুমু। এখানে কেউ নেই, মেরে তোকে ঠাণ্ডা করে দেব।

ইস, মারো তো দেখি! দেখি তোমার গায়ে কত জোর। আমিও বুঝি মারতে জানি না?

 আমি খপ করে মুমুর একটা হাত চেপে ধরে কটমট করে ওর দিকে তাকালাম। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললাম, চল, আগে গ্রামটা ঘুরে আসি চট করে। বেশি বেলা হলে চড়া রোদ উঠে যাবে। বিকেলে পাহাড়ে উঠব।

মুমু এবার দৌড়তে লাগল আমার সঙ্গে। এ-সবই আমাদের খেলা।

পিঁজরাল গ্রামে পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না। এখানকার সব লোকই এর মধ্যে জেগে গেছে। একটা গোয়ালে গরুর দুধ দোয়াবার চ্যাঁ চোঁ শব্দ হচ্ছে। সরু রাস্তা দিয়ে ছোটাছুটি করছে মুরগি।

এক জন কালো পাথরের তৈরি মূর্তির মতো লোক একটা ছোট মোষের বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ও মাঝি, ফুলমণি কোন বাড়িতে থাকে?

লোকটি একটুও অবাক হল না, কোনও রকম কৌতূহলও প্রকাশ করল না। খানিকটা এগিয়ে একটা মেঠো পথ দেখিয়ে বলল, হুঁই যে তালগাছ, তার পাশে।

আমার আগের অভিজ্ঞতায় জানি, সাঁওতালরা খুবই অতিথিপরায়ণ হয়, মানুষকে সহজেই বন্ধু ভাবে নেয়। কোনও কারণে ওরা খেপে গেলেই মুশকিল। বাইরের কিছু লোক নানা ধরনের বাঁদরামি করে ওদের খেপে যাবার কারণও ঘটিয়েছে।

তালগাছটা পর্যন্ত যাবার আগেই একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বাসন্তী।

 সে হাসিমুখে বলল, আরে ছোটোবাবু, ফুলমণির খবর নিতে এসেছে বুঝি?

 নিজের ওপর পুরো দায়িত্ব না দিয়ে আমি বললাম, বড়বাবু পাঠালেন। ও আর কাজ করবে কিনা জানা দরকার। না হলে নতুন লোক নিতে হবে।

বাসন্তী মুমুর দিকে চেয়ে বলল, কী সোন্দর বিটিয়া। তোমার মেয়ে বুঝি?

 মুমু লাজুক ভাবে আমার দিকে তাকাল।

আমি বললুম, আমাকে এত বুঢঢা ভাবিস বুঝি? আমার এত বড় মেয়ে থাকবে কী করে? এ তো বড়বাবুর মেয়ে।

বাসন্তীকে নিয়ে আমরা ঢুকলুম ফুলমণির বাড়ির আঙিনায়।

কোন সাঁওতালের বাড়িই আমি অপরিচ্ছন্ন দেখিনি। যত গরিবই হোক, ওরা ঘর-দোর-উঠোন ঝকঝকে তকতকে করে রাখে। মাটির বাড়ির দেওয়ালেও এক ময়লা দাগ থাকে না।

এ বাড়ির উঠোনে একটা খাটিয়ার ওপর বসে আছে এক বৃদ্ধ। মাথার চুল ধপধপে সাদা, চোখে একটা নিকেলের ফ্রেমের চশমা, তার কাঁচ এত মোটা যে বৃদ্ধটি প্রায় চোখে দেখতে পায়ই না বলা যেতে পারে। বৃদ্ধটির হাতে একটা হুঁকো।

আমাদের পায়ের শব্দ পেতেই বৃদ্ধটি মুখ ফিরিয়ে বললেন, কউন?

আমি বললাম, নমস্কার।

বৃদ্ধটি এবার চোখ কুঁচকে আমাদের দেখার চেষ্টা করে পরিষ্কার বললেন, আপনারা কোথা থেকে আসছেন?

আমি বললাম, ছোটপাহাড়ি থেকে। এ বাড়ির ফুলমণি সেখানে কাজ করে। অনেক দিন যাচ্ছে না।

বাসন্তী বৃদ্ধের কাছে গিয়ে নিজেদের ভাষায় কী সব বোঝাল।

বৃদ্ধ দু’বার মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, হাঁ? বসুন, বসুন, এই বসবার জায়গা দে।

বাসন্তী একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে দুটো মাছিয়া নিয়ে এল। সে-দুটোতে আমি আর মুমু বসলাম একটা আতা গাছের নিচে।

বাড়ির পেছন দিক থেকে এবার এল ফুলমণি, তার দুহাতে মাটি লাগা। আমাদের দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

আমি বললাম, কী ফুলমণি, তুমি আর কাজে যাও না কেন?

ফুলমণি মৃদু গলায় বলল, যাব।

যাক, মেয়েটা তাহলে সত্যিই বোবা নয়। এই প্রথম ও আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলল। ওর গলার আওয়াজটা খসখসে ধরনের, ইংরিজিতে যাকে বলে হাসকি ভয়েস।

বৃদ্ধ বললেন, ঘরের ছাদটা ফুটো হয়ে গেছে। সেই ছাদটা সারাকে ক’দিন ধরে। আমি তো কোনও কাজ করতে পারি না।

তারপর ব্যস্ত হয়ে বাসন্তীকে বললেন, আরে বাবুদের জন্য চা নিয়ে আয়।

 আমি বললাম, না না, আমরা চা খাব না। আমরা এ-দিকে বেড়াতে এসেছিলাম, এক্ষুনি চলে যাব।

তাহলে লাড্ডু খান।

মুমু বলল, আমি এক গেলাস জল খাব।

ফুলমণি জল আনতে ভেতরে চলে গেল।

বাড়িটার মাটির দেওয়ালে নানা রকম ছবি আঁকা। রঙিন ছবি। কিন্তু এ ছবিগুলো এমন কিছু দর্শনীয় নয়। বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতা, বজরংবলী। গোদা গোদা ধরনের। একেবারে অপটু হাতের কাজ নয়, তবে ফুলমরি আঁকা যে-ছবি দুটো আগে দেখেছি, তার সঙ্গে মেলে না।

আমি বৃদ্ধকে বললাম, ফুলমণি তো ভাল ছবি আঁকে। কোথায় শিখল?

বাসন্তী বলল, এগুলো ফুলমণির শ্বশুর এঁকেছে গো!

বৃদ্ধ বললেন, হাঁ, আমি ছবি আঁকতাম। আগে মেলায় মেলায় গিয়ে অনেক ছবি বিক্রি করেছি। এখন চক্ষে দেখি না। ভগবান চোখের রোশনি কমিয়ে দিয়েছে।

যাক। তাহলে একটা পটভূমি আছে। ফুলমণি একেবারে আকাশ থেকে পড়ে ছবি আঁকতে বসেনি। বাড়িতে একটা ছবির কালচার আছে। শ্বশুরের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছে, কিছু শিখেছে। ওর ভেতরে ছবি আঁকার বীজ ছিল, সেটা জল-মাটি পেয়েছে। অনেক সময় শিষ্য ছাড়িয়ে যায় গুরুকে। তাই দেয়ালের এই গোদা গোদা ছবির চেয়ে ফুলমণির ছবির অনেক তফাৎ!

বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর মরদ কোথায়?

বাসভী ডান হাতটা দু’বার ঘোরাল। অর্থাৎ নেই। কিন্তু বিয়ে হয়নি, না মরদ ওকে পরিত্যাগ করেছে, না মরে গেছে, তা ওই একটা ইঙ্গিত থেকে বুঝব কী করে? তবে শ্বশুর যখন আছে তখন বিয়ে হয়েছিল নিশ্চয়ই।

ফুলমণি দুটো কাঁসার গেলাস, এক ঘটি জল ও একটা কলাই করা প্লেটে কয়েকটা তিলের নাড়ু নিয়ে এল। এরাও অতিথিকে শুধু জল দেয় না।

মুমু আমার দিকে বিপন্ন ভাবে তাকাল। অর্থাৎ সে নাড়ু খাবে না। লোরেটো স্কুলে পড়া মেয়ে তিলের নাড়ু খাবে, তিলের নাড়ুদের অত সৌভাগ্য আজও হয়নি।

আমিই একটা মুখে দিলাম। না, খেতে সত্যিই ভাল নয়। একবার একটা বাড়িতে তিলের নাড়ু গোপনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে আমাকে খুব জব্দ হতে হয়েছিল। এখানে ওসব চলবেনা।

জলটা খুব ঠাণ্ডা আর সুস্বাদু।

বৃদ্ধ বললেন, আমার আঁকা আরও ছবি দেখবেন? এই, ভিতর থেকে নিয়ে আয় না। আমি কলকাতাতেও গেছি বাবু। যামিনীবাবু ছিলেন না একজনা, যামিনীবাবু খুব বড় আর্টিস, তিনি আমার ছবি দেখেছিলেন। বাঁকুড়ায় তার বাড়িতে ডেকেছিলেন।

ফুলমণি ভেতর থেকে অনেকগুলো বড় বড় কাগজ নিয়ে এল। তাতে রঙিন ছবি আঁকা। তুলি দিয়ে আঁকা হয়েছে। একটু মলিন হয়ে গেছে ছবিগুলো।

আমরা মাছিয়া-দুটো এগিয়ে নিয়ে গেলাম বৃদ্ধের খাটিয়ার কাছে।

 বৃদ্ধা চশমা খুলে ঝুঁকে পড়ে বলল, এটা কোন ছবি রে?

বাসন্তী বলল, রাম-লছমন আর সীতাজি।

 বৃদ্ধ বললেন, হাঁ, এটা ভাল। হনুমানজি সমুন্দর পার হচ্ছে, সেটা দেখা?

ডিসেম্বর মাসে এসপ্লানেড় অঞ্চলে প্রচুর নতুন ক্যালেন্ডার দেখা যায়, তাতে এই ধরনের ছবি থাকে। কয়েকটা দেখার পরই একঘেয়ে লাগল। কিন্তু ভদ্রতা রক্ষার জন্য সবগুলো দেখতেই হবে। বৃদ্ধ দেখাচ্ছেনও খুব উৎসাহের সঙ্গে।

আমি একবার মুখ তুলে বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করলাম, ফুলমণির এ-রকম কাগজে আঁকা ছবি নেই?

বাসন্তী ফুলমণিকে বলল, নিয়ে আয় না! আছে তো! ফু

লমণি প্রবল ভাবে মাথা নাড়ল।

বাসন্তী বলল, আমি আনছি।

ফুলমণি তার হাত চেপে ধরল। বাসন্তী তবু জোর করে তার হাত ছাড়িয়ে চলে গেল ভেতরে। নিয়ে এল পাঁচখানা ছবি।

প্রথম ছবিটাই সাঙ্ঘাতিক। অনেকখানি ফাঁকা মাঠ, তার মাঝখানে একটা বাচ্চা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। মাথার ওপর আকাশ। মেয়েটা ছাড়া আর কিছুই নেই বলে মাঠের মধ্যে মেয়েটার একাকিত্ব খুব দারুণ ভাবে ফুটেছে। আকাশের রঙ লাল, বৃষ্টির ফোঁটাগুলো লাল, আর মেয়েটার রঙ মেরুন। রঙের এমন সাহসী ব্যবহার কদাচিৎ দেখা যায়। ফুলমণি কি পল গগ্যার ছবি দেখেছে নাকি?

বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোনটা? এটা কোনটা?

বাসন্তী বলল, সেই যে একটা ছোট মেয়ে গো। আমরা বলি, বড়কা মাঝির হারিয়ে যাওয়া মেযে।

বৃদ্ধ বললেন, হাঁ। আমার বহু তার ছবি ফিনিশ করে না। অর্ধেক এঁকে রেখে দেয়। এই ছবিতে চার পাঁচখানা গাছ আঁকা উচিত ছিল কিনা বলুন! বৃষ্টিতে গাছের পাতা খসে পড়ছে, দু-একটা ছাগল-গরু থাকতে পারে, মেয়েটা মাঠে চরাতে নিয়ে গেছে।

আমার কালিদাসের শকুন্তলা নাটকের একটা অংশ মনে পড়ল।

রাজা দুষ্মন্ত ছবি আঁকতে পারতেন। গর্ভবতী শকুন্তলাকে তিনি অন্যায় ভাবে তাড়িয়ে দিয়েছেন রাজসভা থেকে, তারপর ছ’বছর কেটে গেছে, হঠাৎ এক জেলের কাছ থেকে আংটিটা ফেরত পেয়ে রাজার সামনে পড়ে গেছে। তখন রাজা দুষ্মন্ত বিরহে হা-হুতাশ করছেন আর শকুন্তলার ছবি এঁকে সেই ছবির সঙ্গে কথা বলছেন। রাজার বিদূষক মাধব্য রাজাকে সান্ত্বনা দিতে আসেন! মাধব্য দেখলেন রাজার আঁকা ছবিটি। দুই সখীর মাঝখানে, আমগাছে হেলান দিয়ে বসে আছে শকুন্তলা। ছবিটার খুব প্রশংসা করতে লাগলেন মাধব্য। তাই শুনে রাজা বললেন, ছবিটা এখন সম্পূর্ণ হয়নি। পেছনে আঁকা হয়নি, মালিনী-নদী, দূরে একটা পাহাড়ও থাকা দরকার। ওখানে হরিণের পাল ঘুরে বেড়ায়, একটা বড় গাছের ডালে ঋষিদের পরিধেয় বল্কল ঝোলে, একটা কৃষ্ণমৃগ আর বাচ্চা হরিণ ওখানে খেলা করে, এই সবও ছবিটার মধ্যে দিতে হবে।

মাধব্য তখন মনে মনে বললেন, সর্বনাশ। এর পর লম্বা দাড়িওয়ালা বুড়ো বুড়ো ঋষিদের ভরিয়ে দিয়ে ইনি ছবিটা একেবারে নষ্ট করে ফেলবেন দেখছি।

মাধব্যের এই মন্তব্যেই বোঝা যায়, কালিদাস অতি উচ্চাঙ্গের আর্ট ক্রিটিক ছিলেন।

ফুলমণির এই ছবিটায় আর একটা দাগ টানলেই ছবিটি নষ্ট হয়ে যেত। ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মাঠের মধ্যে একলা হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির কান্নাও যেন শোনা যায়।

চন্দনদা ঠিকই ধরেছিলেন। ফুলমণি সত্যিকারের শিল্পী। ছাইচাপা আগুন। প্রত্যেকটা ছবিই ভাল, কল্পনা ও রঙের খেলায় অভিনব। পুরোপুরি বাস্তব বা ফটোগ্রাফিক করেও সে আঁকেনা, ছবির বিষয়টা প্রধান হয় না, গল্প বলার চেষ্টা নেই। রেখা, রঙ ও আয়তন মিলে কিছুটা রহস্যময়তা এসে যায়।

এরকম ছবি বোঝার সাধ্য ওর শ্বশুরের নেই। অশিক্ষিত, গ্রাম্য পরিবারের এই বধূটির ক্ষমতা খানিকটা যেন অলৌকিকের পর্যায়ে পড়ে।

আমি ফুলমণির দিকে তাকালাম।

শীর্ণ চেহারায় এই অসুন্দর মেয়েটির মুখে এখন এমন একটা তীব্রতা ঝলমল করছে, যাতে একটা আলাদা রূপ ফুটে উঠেছে। অন্যদের থেকে এ মেয়েটি একেবারেই আলাদা।

মুমু ফিস ফিস করে বলল, নীলুকাকা, এই ছবিগুলো একদিনের জন্য নিয়ে যেতে দেবে? বাবাকে দেখাতাম।

মুমু আমার ঠিক মনের কথাই বলল। আমি বৃদ্ধের উদ্দেশে জোরে বললাম, ছবিগুলো আমি নিয়ে যেতে পারি? পরে ফেরত দেব!

বৃদ্ধ বললেন, আগে এক জন বাবু এসেছিল। দু’বছর আগে। কখানা ছবি নিল। বলল, আবার আসবে। আর এল না।

ও, তাহলে ফুলমণির প্রতিভার আমরাই প্রথম আবিষ্কারক নই? আগেও কেউ দেখেছে। এবং সেই আগের কারণটি এদের কাছে অবিশ্বাসের কারণ ঘটিয়েছে। এই সব আগের লোকদের নিয়ে মহা জ্বালা হয়, আগের লোকদের জন্য পরের লোকদের ভুগতে হয়।

বললাম, আমি তো ছোটপাহাড়িতেই থাকি। ফুলমণি কাজ করতে যাবে, ওকে দিয়ে দেব।

বৃদ্ধ নিজের ছবিগুলো আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, নিয়ে যান। কেউ যদি বিশ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনতে চায় বেচে দেবেন! যা দাম পাওয়া যায়। একশোটা টাকা পেলে একটা বকরি কিনব। বকরির দুধ খেলে আমার তাগৎ হয়।

দু’জনের আঁকা ছবিই গুছিয়ে নিয়ে একটু বাদে আমরা উঠে দাঁড়ালাম। ফেরার পথে মুমু বলল, এই মেয়েটার যখন খুব মন খারাপ থাকে, তখন ও ছবি আঁকে, তাই না?

আমি চমকে গেলাম। মুমুর কাছ থেকে আমি এ-রকম কথা আশা করিনি। মুমু তো ছবি-টবির ধার ধারেনা। ফুলমণিদের বাড়িতে ঢোকার মুখে ও একবার বলেছিল, বড় গোবরের গন্ধ। এতক্ষণ ওকে বসিয়ে রেখে শাস্তিই দেওয়া হয়েছে।

আমি বললাম, তাই নাকি। কী করে তুই বুঝলি?

মুমু বলল, আমার মনে হল।

 হয়তো মুমু ঠিকই বুঝেছে। এই মনে হওয়াগুলোর কোনও ব্যাখ্যা করা যায় না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়