ছায়া

ছেলেবেলায় বাবা বলতেন, ছায়া, তোকে আমি আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দেব, তুই খুব নামকরা শিল্পী হবি। বাবা আমাকে রঙের বাক্স কিনে দিয়েছিলেন। তাই দিয়ে আমি হরপার্বতী, গাছের মাথায় চাঁদ আঁকতাম। বাবা আমার লেখাপড়া সম্বন্ধেও খুব যত্ন নিতেন। আমার জন্য মাস্টার রেখে দিয়েছিলেন। আমি ছেলেবেলায় খুব অসুখে ভুগতাম, বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়তাম শুধু। বাবা আমার জন্য লাইব্রেরি থেকে রোজ বই এনে দিতেন। বলতেন, লেখাপড়া শিখে বড় হবি, নিজের পায়ে দাঁড়াবি, পৃথিবীর কাউকে গ্রাহ্য করবিনা। আজকাল মেয়েরা পুরুষের ওপর নির্ভর না করেও বাঁচতে পারে। পরে বুঝেছিলাম, বাবার অতসব কথা বলার মানে, আমার ঠোঁটের নিচে, কানের পাশে সাদা দাগ। শ্বেতি। তাপসই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। তাপস বলত, দেখবি, ক্রমশ তোর সারা মুখ, হাত-পা সাদা হয়ে যাবে। তোর আর বিয়ে হবে না।

তাপস আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত –সেই তমলুকে, উনিশশো বেয়াল্লিশে, চুয়াল্লিশে। ওর বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার, আমার বাবা দারোগা। আমাদের কোয়ার্টারের সামনে আমি আর মায়া ফুলের বাগান করেছিলাম। মা সিঁড়ির ওপর বসে বসে দেখতেন। মায়ের হাঁপানি ছিল বিষম, হাঁটা চলা করতে পারতেন না। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলতেন, তোদর দুজনের এক জনও যদি ছেলে হতিস, আমার কোনও ভাবনা থাকত না। আমরা আসলে পূর্ববঙ্গর লোক বলে বাঙাল বাঙাল’ বলত অনেকে, দারোগার মেয়ে বলে ভয়ও করত। তাপসরা খুলনার, কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করত না। তাপসের মা বলত, খুকি বাড়ি যাও, ঝড় আসতিছে, পরে আর যাতি পারবা না।

তাপসরা হাতে লেখা পত্রিকা বার করত আমাকে দিত তার ছবি আঁকতে। আমি সুন্দর করে নানা রঙের ফুল লতাপাতা এঁকে দিতাম। আমি একবার বলেছিলাম, তাপস, আমার একটা পদ্য ছাপাবি এবারের বইটাতে? তাপস বলেছিল, ভাগ, তুই আবার কবিতা লিখবি কী রে? মেয়েদের দ্বারা কবিতা হয় না। মেয়েদের নিয়েই তো কবিতা লিখতে হয়।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই কোন মেয়েকে নিয়ে লিখিস রে?

সুরঞ্জনাকে নিয়ে। অম্লানবদনে ও বলেছিল। চৌধুরী বাড়ির মেয়ে সুরঞ্জনা। তাপসের কথা শুনে আমার রাগহলেও খুব বেশিহয়নি, কারণ সুরঞ্জনা ছিল রাজকন্যার মতো রূপসী। আমি বলেছিলাম, যা যা, সুরঞ্জনা তোর দিকে কোনও দিন ফিরেও তাকাবে না। তাপস আর আমার দু’জনেরই বয়েস তখন তেরো। মায়ার আট।

তাপস ছিল ছেলেবেলা থেকেই একটু বখাটে ধরনের। স্কুলে পড়তে পড়তেই বিড়ি-সিগারেট খেত। দুপুরবেলা বাবা থানায় চলে যাবার পর তাপস আমাদের বাড়িতে আসত। মা ঘুমিয়ে পড়লে ও দিব্যি সিগারেট ধরাত, দেশলাই জ্বালাবার সময় খুক করে একবার কেশে শব্দটা চাপা দিত। নাক দিয়ে ধোঁয়া বার করত, রিং করত, আমাকে বলত, খাবি? খা-না। মায়া এক-এক দিন ওকে ভয় দেখাত, বাবাকে বলে দেব। তাপস বাবাকে খুব ভয় করত। তখন থেকেই তাপস অসম্ভব নিষ্ঠুর আর নির্লিপ্ত হয়ে উঠেছিল। তাপসরা আজকাল নিজেদের বলে আধুনিক সাহিত্যিক। আধুনিকতা মানে বুঝি নিষ্ঠুরতা!

ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় টেস্টের পর আমরা দুজনে এক সঙ্গে পড়াশুনো করতাম। তখনও বাবা মারা যাননি। আমাদের বাড়ির পিছন দিকটার ছোটঘরে বই-খাতা ছড়িয়ে বসতাম। তাপস অধিকাংশ সময়ই চিৎহয়ে শুয়ে সিগারেট টানতে টানতে বলত, তুই থিয়োরেমগুলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মুখস্থ কর তোর পড়া ধরব। আমারটা শুনে শুনেই তাপসের মুখস্থ হয়ে যেত। এমনিতে বদমায়েশি-বখামি করলেও পড়াশুনোয় ও ভাল ছেলে ছিল। নিজের সম্বন্ধে বিষম অহঙ্কার ছিল তখন থেকেই। বলত, দেখবি এক কালে তোদের ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষার সময় আমার গল্প-কবিতার ব্যাখ্যা মুখস্থ করবে। দু’জন উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে দুপুর কাটাতাম, কিন্তু কখনও কোনও অসভ্যতা করেনি তাপস। আমিই বরং মাঝে মাঝে ওর একটা হাত অনেকক্ষণ ধরে থাকতাম। তাপসের কোনও ভাবান্তর ছিল না। কখনও কখনও ও আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, তারপর আমার ঠোঁটে-মুখে কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলত, আমি ব্রাহ্মণের ছেলে, তোকে আশীর্বাদ করছি ছায়া, তোর ওই দাগ এক দিন মিলিয়ে যাবে। এমনিতে তোকে বেশ সুন্দর দেখতে। তাছাড়া দাগ না উঠলেও ক্ষতি নেই। ও দাগ ছোঁয়াচে নয়, ওতে কোনও দোষ হয় না। তাপসের সঙ্গে খুব ছেলেবেলা থেকে মিশেছি, ছোট ছেলে-মেয়েরা যে কতগুলো ঠিকে অসভ্যতা করে –আড়ালে চুমু খাওয়া, জড়াজড়ি, কি প্যান্ট-ফ্রক খুলে দেখাদেখি সে-সব কখনও না।

যখন আমি প্রথম বালিকা থেকে নারী হলাম, তখন কয়েক দিনের জন্য আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। সব সময় ছটফট করতাম, চুল বাঁধতে ইচ্ছে করত না, আয়নায় শরীর দেখতাম, নিজেই নিজের বাহুতে চুমু খেতাম। শুয়ে শুয়ে বা বাথরুমে আমি নানা ছেলের কথা ভাবতাম চোখ বুজে– যেন তারা আমাকে আদর করছে কিংবা পাশে শুয়ে আছে। কিন্তু কখনও তাপসের কথা ভাবিনি।

তাপস একবার মাত্র অদ্ভুত কাণ্ড করেছিল। সেদিন দুপুরে ঘোর বৃষ্টি। আমি খাওয়ার পর পড়ার ঘরে বই খুলে বসে আছি, তাপস এল অনেক দেরি করে, ভিজতে ভিজতে। পরীক্ষার মাত্র এক মাস দেরি। তাপস সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ রইল, কোনও কথা নেই, যেন কান পেতে কোনও শব্দ শুনছে। কোথাও কোনও শব্দ নেই, বৃষ্টির আওয়াজে সর্বত্র শব্দহীন। বাড়িতে কেউ জেগে নেই মায়া স্কুলে। জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, ভূতের মতো রইলি যে? আজ না গ্রাফের অঙ্ক কষার কথা ছিল। ভিজে জামাটা খুলে ফেল না!

শুকনো মুখে তাপস বলল, আজ সকালে একটা গল্প লিখতে আরম্ভ করেছিলাম। শেষ হল না। গল্পটা শেষ করতে না পারলে মন স্থির হচ্ছে না। তোকে একটা কথা বলব?

কী?

কিছু মনে করিস না, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হিসেবেও ধরতে পারিস। মনে কর, আমরা হাইজিন পড়ছি।

কী ব্যাপার কী?

 রাগ করা চলবে না কিন্তু। তোর শাড়ি-ব্লাউজগুলো সব একবার খুলে ফেলবি? আমি একবার তোকে দেখব।

শুনেই কী যে হল আমার, বৃষ্টির শব্দ ছাড়িয়েও বুকের মধ্যে অন্য একটা প্রচণ্ড শব্দ হল। বুঝতে পারলাম, শরীর হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আমি ঘরের কোণের দিকে সরে গেলাম।

না না, মানে জানিস, খারাপ কিছু না, আমি কোনও মেযের সম্পূর্ণ শরীর দেখিনি। একবার দেখতে চাই। শুধু দূর থেকে– ।

তাপস!

তোর ভয় নেই, গায়ে হাত দেব না, দুর থেকে একবার, কেউ তো নেই এ-দিকে।

 তাপস, তুই এতটা– ।

সত্যি, আমার খুব ইচ্ছে হয়। গল্পটা শেষ করতে পারছি না। গল্পে এ-রকম একটা ব্যাপার আছে। অথচ নিজে না দেখে, অভিজ্ঞতা ছাড়া…লুকিয়ে চুরিয়ে যে কখনও দেখিনি তা নয়, ছোটমাসিকে চান করার সময় বাথরুমের দরজার ফুটো দিয়ে দেখেছি, কিন্তু সামনা-সামনি স্পষ্ট দেখতে চাই। তোকে ছাড়া আর কাকে বলব?

আমার শরীর কাঁপছিল। বললাম, ইতর কোথাকার। এটুকুও জানিস না, এ-কথা কোনও মেয়েকে বলার আগে বলে নিতে হয়, আমি তোমাকে ভালবাসি।

তাপস হো-হো করে হেসে উঠল। তারপব বলল, ওঃ, তুইও বুঝি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুষ্কোণ পড়েছিস?

না, পড়িনি। তোকে আমার সহ্য হচ্ছে না, তুই চলে যা।

পড়িসনি? তাহলে সব মেয়েই বুঝি এই কথা বলে? আচ্ছা থাক।

তাপসের চেহারা খারাপ নয়, মাজা মাজা গায়ের রঙ, বড় বড় চোখ, মুখে একটা পাগলাটে ধরনের শ্রী ছিল। কিন্তু সেদিন আমার মনে হল ওর মধ্যে যেন শয়তান ভর করেছে। আমি বললাম, তুই এক্ষুনি চলে যা, আর আমাদের বাড়িতে আসিস না। তোকে বাদ দিয়েই আমি পাশ করতে পারব।

সেবার অবশ্য আমার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।

বছর আষ্টেক বাদে কলকাতায় শেষ পর্যন্ত তাপস আমার নিরাবরণ শরীব দেখেছিল। শেষ পর্যন্ত ওরই জিত হল। সেটা ছিল সম্পূর্ণ আমার দোষ। তখন তাপসরা তরুণ সাহিত্যিকদের দল আমাদের বাড়িতে আড্ডা দিতে শুরু করেছে। তখন আমি পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলাম। মাথার ওপর কোনও অভিভাবক ছিল না। এখন আমি নিজেই নিজের অভিভাবিকা হতে পেরেছি। আমার স্বাস্থ্য এমনিতেই ভাল, দু’বেলা খিদে পায়, মাঝরাত্তিরেও অন্য রকম খিদে পেত। কিন্তু ছেলেরা কেউ আমাকে দিদি বলত, কেউ বন্ধুর মতো। কিন্তু কেউ আমাকে আড়ালে ডাকেনি, আমাকে কেউ একা চায়নি। আমি সবার সঙ্গে হাসছি, কথা বলছি, কিন্তু কান্না পেত, কারুর বুকে আমি জীবনে মাথা রাখিনি। সেই রকমই এক বৃষ্টির দুপুরে তাপস এল। এসেই বলল, হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ল ছায়া। তাই এলাম। কথাটা শোনবার সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ অভিমানে আমার বুক ভরে গেল। কেউ আসে না হঠাৎ আমার কথা ভেবে, আমি জানি। ঠাণ্ডা গলায় বললাম, তাই নাকি? বোস।

তমলুক গিয়েছিলাম, আজই ফিরেছি। স্টেশন থেকে সোজা তোর এখানে এলাম। তোকে আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, হঠাৎ তমলুকে গিয়ে বিষম মনে পড়ল। তোদের কোয়ার্টারে অনেক লোক এসেছে। সামনের বাগানটায় ফুলের বদলে বেগুনের চারা লাগিয়েছে। বড় খারাপ লাগল। হঠাৎ এক ঝলক হাওয়া দিতেই মনে হল তোর মা যেন সিঁড়ির ওপর বসে আছেন আর তুই ফ্রক পরে জলের ঝারি হাতে ঘুরছিস। আমার ছেলেবেলাটাকে তুই বড় দখল করে আছিস। তখনই মনে হল, ফিরেই তোর কাছে যাব। বড় খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দিবি?

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল তখন, পিসিমা ঘুমোচ্ছেন।

কী খেতে দেব? দুধ-চিড়ে খাবি?

হ্যাঁ, তাই দে না, খিদেয় পেট জ্বলছে।

 তাপস সোজা আমার কাছে চলে এল, কী করে ওর এ-রকম দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, জানি না। আমার মুখটাকে জোর করে ধরে ঠিক আমার ঠোঁটের নিচে ও কানের পাশে –যেখানে সাদা দাগ, দীর্ঘ চুমু খেল। আমার চোখে কান্না এসেছিল, আমি দু’হাতে ওকে ঠেলে দিতে গেলাম। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। ও আমার ব্লাউজ, শাড়ি, শায়া সব খুলে ফেলল। আমি আর বাধা দিইনি। তাপস আমাকে বিছানায় শুইয়ে ফেলে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আমি ক্লিষ্ট গলায় বললাম, তুই কি কখনও কোনও মেয়ের শরীর দেখিসনি?

হ্যাঁ, দেখেছি অনেক। কিন্তু প্রত্যেকে অন্য রকম। ছায়া, আমি তোকে সম্পূর্ণ ভাবে না দেখলে তোকে কখনও চিনতে পারতাম না। তুই সত্যিই অসাধারণ।

আমার শরীরের অন্য কোনও জায়গায় আর সাদা ক্ষত ছিল না বলে আমি সেদিন খুশি হয়েছিলাম, নাহলে আমি চোর হয়ে যেতাম। আমি লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তাপস, তুই আমাকে বিয়ে করবি?

না।

কেন!

কারণ, তোর কথা কখনও আমি ভাবিনি।

তবে আজ কী জন্য এসেছিস? শরীর?

হ্যাঁ।

কেন?

কারণ, আমি তোকে ভালবাসি।

আমি উঠে বসে কাপড়টা জড়িয়ে বললাম, এর মানে কী?

 মানে হয় না বুঝি? তাহলে জানি না। যা মনে হল তাই বললাম।

 এ কী-রকম অদ্ভুত মনে হওয়া?

সত্যিই তা জানি না রে ছায়া! আমার যা মনে হয়, তাই বলি, তাই লিখি। বিচার-বিবেচনা করে অত দেখতে ইচ্ছে করে না। আজ যা বললাম, কাল হয়তো তা মনে হবে না। তাতে দোষ কী? আমি এ-রকম ভাবেই জীবন কাটাতে চাই।

আমি মুখ ফিরিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। আমার চোখের জল থামছিল না। সম্পূর্ণ বিচার বিবেচনাহীন চোখের জল। বুক থেকে ঠাণ্ডা একটা গভীর উদাসীনতা উঠে এল। তারপর তাপসের দিকে ফিরে খাটের ওপর খানিকটা জায়গা করে দিয়ে বললাম, আয়, দেখি, তোকেও দেখে সম্পূর্ণ চেনা যায় কিনা।

সেবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া হয়নি, কারণ পরীক্ষার সাত দিন আগে বাবা খুন হয়েছিলেন। বাবা গ্রামের দিকে গিয়েছিলেন ইন্সপেকশনে। রাত্রে ফিরলেন না। পরদিন তাকে নিয়ে আসা হল একটা গোরুর গাড়িতে, বরফের গুড়োয় সারা শরীর ঢেকে। মরা মানুষের চোখ যে কত বিশ্রী হয়, সেই প্রথম দেখলাম। সেই ঘটনায় মা কিছু দিন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।

আমার বাবা ছিলেন বেশ হাসি-খুশি মানুষ, খুব বড় চরিত্রের নয়। বাবা ঘুষ নিতেন, সন্ধের দিকে রোজ খানিকটা মদ খেতেন, আমরা জানতাম। চোর-ডাকাতদের দমন করার বদলে তাদের নিয়ে

শান্তিতে বসবাস করাই ছিল তাঁর নীতি। ঘুষের টাকা জমিয়েই তিনি কলকাতায় আমার নামে এই ছোট বাড়িটা কিনে ভাড়া দিয়েছিলেন। তবেমদ চোলাই-এর দলটাকে দমন করবার জন্য তিনি কেন উঠেপড়ে লেগেছিলেন জানি না, বোধহয় তারা বাবার মদেই ভেজাল দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ওটা টেররিস্টদের আড্ডা, আগস্ট আন্দোলনের রেশতখনও থামেনি।

বাবা মারা যাবার পর আমাদের কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হল। তারপরও কিছুদিন আমরা তমলুকে ছিলাম। অন্য একটা বাড়িভাড়া করে। কোয়ার্টার ছেড়ে দেবার সময় মায়া বলেছিল, দিদি, ফুলগাছগুলো তো আমাদের, ওগুলো নিয়ে যাব। আমি বলেছিলাম, থাক না। মায়া ছেলেবেলা থেকেই বিষম জেদি, যাবার সময় টেনে টেনে ফুলগাছগুলো তুলে নিল। যে-বাড়িটায় আমরা গেলাম, সামনে মাঠ নেই, ছোট, অন্ধকারমতো। মায়া একটুখানি জায়গার মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি করে গাছগুলোলাগাল, কিন্তু গোলাপ, ডালিয়া, যুঁই, ক্যানা একটাও বাঁচল না।

আমার পরীক্ষা দেওয়া হল না সেবার। বর্ধমান থেকে বড় পিসিমা এসে রইলেন কাছে, তাছাড়া বরদাউকিল বাবার বন্ধু ছিলেন, আমরা জেঠাবাবুবলতাম, তিনি আমাদের দেখাশনো করতে লাগলেন। বাবার টাকাকড়ির ব্যবস্থা করা, কলকাতার বাড়ি থেকে ভাড়াটে তোলা, সবই করেছিলেন। তাপস তত দিনে পাশ করে কলকাতার কলেজে গিয়ে ভর্তি হল। সেবারই পুজোর ছুটিতে ওরসঙ্গে ওর দুই বন্ধু এসেছিল বেড়াতে, পরীক্ষিৎ আর অনিমেষ। তিনটে ঝকঝকে টাটকা ছেলে, সন্ধের সময় রাস্তা দিয়ে চেঁচিয়ে গান গাইতে গাইতে যেত। আমার সঙ্গে একবার বন্ধুদের নিয়ে দেখা করতে এসেছিল তাপস। কিন্তু তখন ওর ওপর আমার রাগছিল, সেই জন্য ভালভাবে কারুর সঙ্গে কথা বলিনি। তখন আমি কবিতা লিখতে শুরু করেছি, মাঝে মাঝে ডাকে নানা পত্রিকায় পাঠাতাম। কোনও কোনও সময় তাপস, পরীক্ষিৎ আর আমার লেখা একই পত্রিকায় বেরুতো, কিন্তু আমি ওদের লেখা পড়ে বুঝতে পারতাম না।

কলকাতার বাড়িতে একতলায় নতুন ভাড়াটে বসিয়ে দোতলায় আমরা উঠে এলাম বছরখানেক বাদে। তমলুক সেই ছেড়ে আসা চিরকালের জন্য আমার ছেলেবেলার তমলুক। আসবার সময় মনে হয়েছিল, ওখানে আমরা বাবাকে ফেলে এলাম। কিন্তু মায়ের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আসা দরকার ছিল।

মা বিছানায় শুয়ে পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন। তখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। মায়া ক্রমে যুবতী হয়ে উঠেছে। রাত্তিরে খাবার সময় অনেকক্ষণ ধরে গল্প করতাম আমি, মায়া, পিসিমা, মা। মা বলতেন, কলকাতা শহরে থাকার এই সুবিধে, পুরুষমানুষ না থাকলেও চলে। মায়ার নানা রকম ছেলেমানুষি কাণ্ড নিয়ে আমরা রোজ রাত্রে খুব হাসাহাসি করতাম। মায়া কোনও কারণে রেগে গেলে সাতখানা-আটখানা করে কাচের গেলাসই ভাঙত। স্কুলে যাবার সময় ছেলে-ছোকরারা যদি কোনও মন্তব্য করত, মায়া সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উত্তর দিত। মোড়ের মাথায় একটা ছেলে ওর সামনে শিস দিয়েছিল বলে মায়া সোজা সেই ছেলেটার বাড়িতে গিয়ে কড়া নেড়ে তার বাবাকে বলে দেয়। সেই ভালেক পরে এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চেয়ে যান। মায়া একবার বায়না ধরেছিল, শীতকালে প্যান্ট-কোট পরে রাস্তায় বেরুবে। মা, পিসিমা কত ঠাট্টা করলেন, বিবিসাহেব, মসিবাবা কত কী বলে হাসাহাসি করা হল, কিন্তু মায়া অটল। এ যেসম্ভবনা, অ মায়াকে কিছুতেই বোঝানো গেল না। সেই নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাগারাগি শুরু হয়ে গেল। আমি মায়াকে কোনও দিন বকিনি, কিন্তু ওর বোকা গোঁয়ারতুমি দেখে চড় মারতে গিয়েছিলাম। কিন্তু মায়া ত বদলাবে না, রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দিল। মা শেষটায় বললেন, দে ছায়া, ওকে এক সেট বানিয়ে দে। বাড়িতে দর্জি ডেকে মাপ দেওয়া হল। যখন তৈরি হয়ে এল, সব পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ার কী হাসি। মা বিছানার ওপর উঠে বসেছেন, পিসিমা আর আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, মায়া বাবার শোলার টুপিটা পর্যন্ত মাথায় দিয়ে দুলে দুলে হেসে খুন হল। মা বললেন, আমার ছেলে ছিল না, এই তো একটা ছেলে হল!

মায়া সে-পোশাক পরে এক দিনও বেরোয়নি। কখনও খুব রেগে গেলে মায়াকে আমি সেই পোশাকের কথা তুলে ঠাট্টা করি।

মায়া এক দিন সন্ধেবেলা এ-বাড়িতে তাপস আর পরীক্ষিৎকে নিয়ে এসেছিল। পথে দেখা হবার পর তাপস মায়াকে চিনতে পারেনি। ওকে এত বড় হতে তো দেখেনি তাপস। মায়াই তাপসদা, তাপসদা বলে চেঁচিয়ে ডেকে উঠেছিল, তারপর টেনে এনেছিল বাড়িতে। ক্রমে ক্রমে এল ওর বন্ধুবান্ধবদের দল অবিনাশ, হেমকান্তি, অম্লান, অনিমেষ, শেখর, বিমলেন্দু। মা তখনও বেঁচে। বিমলেন্দুর দিদি আমার সঙ্গে বি.এ.-তে পড়ত, সেজন্য ও আমাকে ছায়াদি বলে। সেই শুনে শুনে শেখর, অনিমেষ ওরাও। কেউ আপনি বলে, কেউ তুমি, তুই। অবিনাশ বলে, মেয়েদের মধ্যে একমাত্র আমার কবিতাই নাকি পাঠযোগ্য। মেয়েদের মধ্যে আমিই প্রথম আধুনিক। শেখর একটা কবিতা পত্রিকার সম্পাদক, প্রতি সংখ্যায় ও আমার লেখা আগ্রহ করে ছাপে। আমি যদিও আমার গোপন দুঃখের কথা কিছুই এ পর্যন্ত লিখতে পারি না। মায়া অবশ্য আমার লেখা সম্পর্কে ঠোঁট ওলটায়। একবার পুজো সংখ্যার লেখার জন্য মানি অর্ডারে টাকা পেয়েছিলাম। মায়া বলেছিল, সে কী রে দিদি, ওই পদ্য লেখার জন্যও লোকে টাকা দেয়? কে পড়ে রে?

মায়ের মৃত্যুর সময় তাপসের বন্ধুবান্ধবরা খুব সাহায্য করেছিল। ওদের মধ্যে কেউ ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর, কেউ উদাসীন, কেউ লোভী, কিন্তু ওরা কেউই অসৎ নয়। মনে মনে ওরা প্রত্যেকেই সম্রাট কিংবা জলদস্যু, কেউই ছিচকে নয়, সেই জন্যই ওরা সাধারণ নয় কেউ, ওরা সাহিত্যিক, আমি জানি। এক-এক জন পাগল।

মায়ের মৃত্যুর কথা মনে হলেই এখনও আমি সামনে-পিছনে তাকাই। এত ভয়ঙ্করশান্ত মৃত্যু যে হয় আমি ভাবতে পারিনি। এখন যেটা বসবার ঘর করেছি, আগে ওই ঘরটায় একটা খাটে মায়ের দু’পাশে আমি আর মায়া শুতাম। সে-দিন ঘুমোত যাবার আগে মা আমাদের দু’জনের চুল বেঁধে দিলেন টান করে। সে-দিন মায়া ওর তিন জন মেয়ে-বন্ধুর সঙ্গে সিগারেট খেয়েছে, এই কথা মাকে বলল। মায়ার কোনও কিছুই গোপন ছিল না, আমাকে আর মাকে সব কথা বলে দিত। ছেলেরা কেন সিগারেট খায় শখ করে সেটা দেখবার জন্য খেয়েছিলাম, জানো মা। প্রত্যেকে তিনটে করে টেনে দেখলাম গীতালিদের ছাদের ঘরে, গীতালি তে কাশতে কাশতে বাঁচে না। আমার কোনও কষ্ট হয়নি, তবে অত আহ্লাদ করে খাবার কী আছে বুঝতে পারিনি।

মা এক হাতে মায়ার চুলের গোছা ধরে আরেক হাতে চিরুনি চালাচ্ছিলেন। আমি মায়ার মুখোমুখি বসে। আমি বললাম, ও এক দিন খেলে কিছুই বোঝা যায় না, পর পর কদিন খেলে রোজ খেতে ইচ্ছে করবে। সেই রোজ খাওয়ার ইচ্ছেটাই নেশা।

ওঃ, তুই এমনভাবে বলছিস, যেন তুই রোজ খেয়ে দেখেছিস!

মা হাসতে হাসতে বললেন, দিদি লেখে কিনা, তাই জানে। লেখক-লেখিকাদের সব জানতে হয়।

আমি রোজ খেয়ে দেখব মা? ছেলেরা পারে তো আমরা পারব না কেন? খাওয়ার জিনিসে আবার ছেলে-মেয়ে কী?

খেতে পারিস, তবে বিড়ি-সিগারেট খেলে ঠোঁট কালো হয়ে যায়। মেয়েদের কালো ঠোঁট দেখা তো কারুর অভ্যেস নেই, তাই খারাপ লাগবে।

তবে মেমসাহেবরা যে খায়?

মেমসাহেবরা ঠোঁট লাল করার জন্য লিপস্টিক মাখে। তুই মাখবি?

না না, লিপস্টিক বিচ্ছিরি।

আমি আর মা হেসে উঠলাম। কদিন ধরে মায়ের শরীর একটু ভাল ছিল। আরও কিছুক্ষণ গল্প করার পর আমরা আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। সেদিন সারা রাত আমার সুন্দর ঘুম হয়েছিল। এক ছিটে স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। সকালবেলা চোখ মেলে দেখলাম, মায়া উঠে বসে আছে, এক দৃষ্টে মায়ের দিকে তাকিয়ে। কোনও কথা নেই। মায়ের দু’ঠোঁট খোলা, পাশ দিয়ে রক্ত। মা মায়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। মা বেঁচে নেই। সারা রাত আমরা মায়ের পাশে শুয়ে ছিলাম। কোনও এক সময় মা আমাদের ঘুম না ভাঙিয়ে চলে গেছেন। সারা রাত আমরা মৃতদেহের পাশে। এ-কথা যখনই ভাবি, শরীরে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। এখনও মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, মায়া ও আমার মধ্যে মা শুয়ে আছেন। এমনকী অফিসে, ট্রামে, বাসেও মাঝে মাঝে আমার পাশে মায়ের মৃত শরীরের অস্তিত্বের কথা মনে পড়ে। এই অনুভূতির মধ্যে কোনও ভয় নেই, মায়ের চরিত্রের মতোই শান্ত স্নেহময়। কখনও কখনও মনে হয় এই স্নেহময় মৃত্যু আমার শরীরে ঢুকে গেছে। আমারও ইচ্ছে করে ও ওই শান্তভাবে মরে যেতে।

সারা দিন আমি কী করি? কিছুই না। মনে হয় চোখ বুজে কাটাচ্ছি। ভোরে ওঠা স্বভাব, উঠেই হিটারের প্লাগটা লাগিয়ে দিয়েই চায়ের কেটলিটা চাপিয়ে দিই। তারপরে বাথরুমে মুখ-হাত ধুয়ে স্নান করি। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে, আমি একা অনেকক্ষণ স্নানের ঘরে থাকি। মায়ার স্বভাবটা আদূরে ধরনের হয়েছে, বার বার ডাকাডাকি করলে ও উঠতে চায় না। বুনো ধরনের ঘুম ওর, কাপড়-চোপড় এলোমেলো করে দু’পা মুড়ে ঘুমোয়। স্নান করে বেরিয়ে এসে চায়ের কাপ ওর মাথার কাছে রাখি। বাবা মারা যাবার পর থেকেই আমি এমন সংসারী হয়েছি, খানিকটা বুড়োটে হয়ে গেছি আমি। সেই জন্যই মায়াকে ওর জলের মতো জীবন কাটাতে দিতে চাই। তাছাড়া ওকে কত সুন্দর দেখতে। আমি যদি মায়া হতাম, আমার এক-এক সময় মনে হয়। এক-এক দিন রাত্রে আমি যখন সংসার খরচের হিসাব লিখি, তখন হিসেব না মিললে আমার রাগ হয়, তার পরেই হাসি পায়, মনে হয় যদি আমিও মায়ার মতো এখন পাশের ঘরে বসে রেডিয়োর নব ঘুরিয়ে ট্যাঙ্গো নাচের বাজনা শুনতে পারতাম! কখনও কখনও নিচতলার ভাড়াটে ভুবনবাবু এসে বলেন, ছায়া দেবী, আমাদের নর্দমা দিয়ে জল সরছে না, একটা ব্যবস্থা করুন। তাছাড়া আপনাদের বারান্দা দিয়ে জল ঢাললে আমাদের রান্নাঘরের পাশে ছড় ছড় করে পড়ে। আমি তো বাড়িতে প্রায়ই থাকি না –হেঁ হেঁ, বুঝতেই পারছেন, কিন্তু আমার ওয়াইফ বললেন, যখন মাস মাস ভাড়া গুনে যাচ্ছি, তখন অসুবিধে ভোগকরব কেন? তুমি বাড়িউলিকে বলো! (বাড়িউলি শব্দটা উচ্চারণ করেই টুথব্রাশ-গোঁফওয়ালা ভদ্রলোক লজ্জা পান। আমার সম্পর্কে ওরা নিজেদের মধ্যে যে-ভাষা ব্যবহার করে তাই বেরিয়ে পড়েছে হঠাৎ। ছিপছিপে, চশমা-পরা, এমএ পাশ যুবতী যদি বাড়ির মালিক হয় তাহলে যে তাকে সামনাসামনি বড়িউলি বলা যায় না, এ বিশ্বাস ওর আছে মনে হল। ) তখন ইচ্ছে হয় উঠে গিয়ে ঠাস করে লোকটার গালে চড় মারি। তার বদলে আমি এ-দিক ওদিক তাকিয়ে দেখি মায়া আছে কি না। ও থাকলে চড় না মেরেও নিশ্চিত ঝগড়া বাধিয়ে দিত। আমি শান্তভাবে বলি, আপনি একটা লোক ডেকে ব্যবস্থা করুন, খরচ যা হয় ভাড়া থেকে কেটে নেবেন। লোকটা তখনও নড়তে চায় না, বুঝতে পারলাম, পর পর সাত দিন নাই ডিউটি দেবার পর আজ ওর ছুটি। ভাঁজ করা কাপড়ের লুঙ্গি-পরা লোকটা চেয়ারের দিকে গুটি গুটি এগোয়। আমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলি, একটা মিস্ত্রি পেলে আমাদের বারান্দাটাও সারিয়ে নেবেন।

আমার সব চেয়ে খারাপ লাগে ভিড়ের ট্রাম-বাস। হাজার-হাজার নিশ্বাসের গরমে আমার প্রাণ বেরিয়ে আসতে চায়। ইচ্ছে হয়, ডাকাত ডাকাত’ বলে চেঁচিয়ে উঠি। লোকগুলো আমাকে প্রাণে মারতে চাইছে। কিন্তু উপায় নেই, ঠিক দশটার সময় আমাকে অফিসে যেতে হয়। কাজ ভাল লাগে না। পাবলিসিটির ফার্মের কাজ। নানা লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়, লে আউট, ব্লক, কপি, ম্যাট, বিজ্ঞাপনের উমেদার, আর্টিস্ট। মাঝে মাঝে ছোটখাটো কাগজ থেকে ছেলেরা আসে। প্রথমে আমার কবিতা চায় একটা, তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিজ্ঞাপনের কথা বলে। রাগে আমার শরীর জ্বলে যায়, কিন্তু আমার এই-ই চাকরি, সুতরাং মিষ্টি করে হাসি, বলি, বিজ্ঞাপনের বাজেট তো শেষ হয়ে গেছে ভাই, এপ্রিলের আগে আর তো হবে না! কবিতা অবশ্য দিতে পারি– পনেরো পাতা, ছাপবেন? ছেলেগুলো কিন্তু কিন্তু করে হাসে, তারপর নেকস্ট উইকে আসছি বলে সরে পড়ে। তবুএ চাকরিটা এক দিকে থেকে ভাল, অন্য ঝামেলা নেই। ওপরের অফিসারদের মাঝে মাঝে গাড়ি করে পৌঁছে দেবার আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারলে ছুটির পর সত্যিইছুটি। কিছুদিন কলেজের প্রফেসারি করেছিলাম, হাজার প্রশ্ন সেখানে বাড়িতে পুরুষমানুষ নেই কেন, কার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করি, কারা সব বাড়িতে আসে? অসহ্য!

আমি তো তবু ইচ্ছে মতো চাকরি বদলাতে পারছি। আর তাপস? একটা স্কুলে চাকরি করত, ঝগড়া করে ছেড়ে দিয়েছে, তারপর আজ প্রায় দেড় বছর বেকার। ছি ছি, ছেলেদের এত দিন বেকার থাকা মোটেই মানায় না। কিন্তু তাপসের তো দোষ দিতেও পারি না, ও তো চেষ্টাও কম করছে না। তাপসের মাথা খুব ভাল ছিল, মন দিয়ে পড়াশুনো করলে ব্রিলিয়ান্ট স্কলার হতে পারত। তবু যাই হোক ইংরাজিতে অনার্স নিয়ে বিএ তো পাশ করেছিল। শরীরে কোনও রোগ নেই, শক্ত স্বাস্থ্য, বিএ পাশ এক জন ছেলে কোনও চাকরি পাবে না? ব্রিলিয়ান্ট স্কলার তো অন্য অনেকেই হয়, কারুকে কারুকে তো লেখকও হতে হবেই, কিন্তু সে কোনও জীবিকার সন্ধান পাবে না? স্কুলের চাকরিটা হারাবার ব্যাপারেও তাপসের কোনও দোষ নেই। পড়াবার সময় ও ক্লাসে বসে সিগারেট খেত, তাই নিয়ে হেডমাস্টারের সঙ্গে ওর ঝগড়া। অঙ্কের মাস্টার কিংবা পণ্ডিতরা ক্লাসে বসে নস্যি নেয়, তাতে কোনও দোষ নেই, আর ইংরিজির মাস্টার ক্লাসে বসে সিগারেট খেলেই দোষ? ছেলেরা দেখে দেখে শিখবে? ক্লাস থেকে বেরুলে ছেলেরা আর কারুকে সিগারেট খেতে দেখেনা? বাবাকে দাদাকে দেখে না? ছেলেরা অনেক কিছুনা দেখেও শেখে, শিখবেই। সে-সব নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার কী? স্কুলে এসে লেখাপড়াটা ঠিকমতো শিখছে কি না সেটুকু অন্তত দেখলেই যথেষ্ট। আসলে, শুধু সিগারেট খাওয়া নয়, তাপস যে হেডমাস্টারের কথা নতমস্তকে মেনে নেয়নি, সেইটাই আসল দোষ। প্রবীণ হেডমাস্টার যখন সিগরেট খাওয়া নিয়ে আপত্তি করেছিলেন, তখন তরুণ শিক্ষকের উচিত ছিল লাজুক মুখে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলা, ভুল হয়ে গেছে স্যার, আর করব না। প্রধান শিক্ষককে অন্য শিক্ষকরা শ্রদ্ধা করবে, এইটাই তো নিয়ম। কিন্তু শ্রদ্ধা করবেই-বা কী করে? হেডমাস্টার মশাই তাপসকে একটা চিঠি লিখেছিলেন বাংলায়, তাপস সেটা আমাদের দেখিয়েছিল হাসতে হাসতে, চোদ্দো লাইনের চিঠিতে পাঁচটা বানান ভুল, গোটা দশেক ইংরিজি শব্দ। হেডমাস্টার মশাইইতিহাসের লোক, তাই তার চিঠিতে বানান ভুল থাকরে? একটা গোটা বাংলা চিঠিও লিখতে জানবেন না? এদের হাতে শিক্ষার ভার, এরা প্রধান শিক্ষক, এদের লোকে শ্রদ্ধা করবে কী করে? নিজের বানান ভুল না শুধরে অন্যের সিগারেট খাওয়ার দোষ ধরতে এসেছে!

তাপস আর একটা ইন্টারভিউ’র গল্প বলেছিল, শুনে হাসতে হাসতে আমরা মরি। রেলওয়ের গুডস ডিপার্টমেন্টের একটা কেরানির চাকরি। কেরানির চাকরি, তারই ইন্টারভিউ নিচ্ছে পাঁচ জন জাঁদরেল অফিসার। তিন জন বাঙালি, এক জন পাঞ্জাবি, এক জন মাদ্রাজি। ইন্টারভিউতে ডাকা হয়েছে শ’খানেক ছেলেকে, তার মধ্যে এমএ পাশই জনাদশেক। তাপস ঢোকার পর সবাই নিবিষ্ট ভাবেওরঅ্যাপ্লিকেশনটা পড়তে লাগল। রেলের চাকরির অ্যাপ্লিকেশনে নাকি চোদ্দো পুরুষের ঠিকুজি কুষ্টি সব দিতে হয়, তবু ওদের এক জন তাপসকে আবার নাম, বয়স, কত দূর লেখাপড়া, এসব জিজ্ঞেস করল। তাপস কোনও গোলমাল না করে উত্তর দিয়েছে। গোঁফওয়ালা পাঞ্জাবিটা বলল, তোমার তো স্বাস্থ্য বেশ ভালই আছে, তুমি এ চাকরি করতে এসেছ কেন?

তাপস বলল, একটা কোনও চাকরি তো করতে হবে। আর কোনও চাকরি পাচ্ছি না।

তুমি এ কাজ পারবে?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি দায়িত্বের সঙ্গে সব কাজ করব এবং নিশ্চিত আশা করি, আমার কাজে আপনাদের খুশি করতে পারব।

অর্থাৎ তাপস বেশ বিনীত ভাবেই সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক জন আচমকা জিজ্ঞেস করল, তুমি জানো, আকবর কত সালে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন?

তাপস চমকে গিয়েছিল, তবু বিনীত ভাবে বলেছে, ঠিক মনে নেই। এ চাকরির পক্ষে এটা জানা খুব দরকারি কি?

এ-সব সাধারণ জ্ঞান। সমস্ত শিক্ষিত লোকেরই জানা উচিত।

না, আমি ঠিক জানি না।

পৃথিবীতে তুলোর চাষ সব চেয়ে বেশি কোথায় হয়?

এটাও আমি ঠিক জানি না। পরে জেনে নিতে পারি।

ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো। নেকস্ট।

এইবার তাপস জেগে উঠল। টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে বলল, স্যার আমার ইন্টারভিউ হয়ে গেল? আমার চাকরির খুবই দরকার, আমার ইংরিজি লেখার পরীক্ষা নিলেন না?

তোমার হয়ে গেছে, তুমি যেতে পারো।

না স্যার, অত সহজে আমি যাচ্ছি না। আমিও দু-একটা সাধারণ জ্ঞানের কথা আপনাদের কাছে জেনে যাব। বলুন তো, সিরাজদৌল্লার বাবার নাম কী? আমি এটা জানি। আপনি জানেন?

বলছি তো তুমি এখন যেতে পারো, বেয়ারা।

মাইরি আর কী, বেয়ারা ডাকলেই আমি যাচ্ছি! ওটা খুব শক্ত, না? আচ্ছা, বলুন তো, কোন সালে প্রথম বাষ্প এঞ্জিন চলেছিল? বলুন।

বেয়ারা, বাবুকো দরজা দেখা দেও।

ওসব বেয়ারা-ফেয়ারা ডেকে কোনও লাভ হবে না। একটা সাধারণ জ্ঞানের কথা আমি জেনে যাবই। তোমাদের মধ্যে কার ক্যান্ডিডেট ঠিক করা আছে আগে থেকে?

বেয়ারা, দরোওয়ানকো বোলাও।

আবার দরোওয়ান দেখানো হচ্ছে। ও-কথার জবাব না পেলে আমি এখানে ডিগবাজি খাব, কাপড় খুলে নাচব, তোমাদের থুতনিতে চুমু খাব। ইয়ার্কি পেয়েছ শালারা? তোমাদের গুষ্টির পিণ্ডি করব আজ।

শেষ পর্যন্ত দরোওয়ানরা এসেই ওকে টেনে-হিঁচড়ে বার করে দেয়। তাপস অনবরত আস্ফালন করতে থাকে, সেই ইন্টারভিউ বোর্ডের পাঁচ জনেরও সর্বনাশ করে দেবে।

কিন্তু কিছুই সর্বনাশ তাপস ওদের করতে পারেনি। ওরা মোটরগাড়িতে চেপে ঘোরাঘুরি করে। সাহেবপাড়ায় থাকে, ওদের সমাজ আলাদা, দুর্গের মতো সে-সমাজ সুরক্ষিত। তাপসরা সেখানে কিছুই করতে পারে না। তাপস অবশ্য এখনও শাসায়, ও আর সারা জীবনে রেলে চড়ার সময় টিকিট কাটবে না, সুযোগ পেলেই রেলের বাথরুমে আয়নার কাঁচ ভাঙবে, বা চুরি করবে। কিন্তু তাতে ওদের কী ক্ষতি হবে?

তাপস আজও চাকরি পেল না, আমার বড় মায়া লাগে, যখন তাপস বন্ধুদের কাছে গাড়ি ভাড়া চায়। যে-রকম সাংঘাতিক লেখক হিসেবে তাপসের নাম, ওইটুকু নামেই যে-কোনও ইংরেজ লেখক লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করত। এক-এক দিন তাপসের মুখখানা শুকনো দেখায়, বড় বেশি গম্ভীর থাকে। সেই সব দিনে ওকে দেখলে ভয় করে, মনে হয়, ও যেন কোনও ভয়ঙ্কর সর্বনাশের প্রতীক্ষায় আছে।

কিন্তু তাপসের কথা আমি ভাবছি কেন? তাপস নিষ্ঠুর, তাপস আমাকে গ্রাহ্য করে না। সেই এক দুপুরবেলা এসেছিল, তারপর থেকে আর আসেনি কখনও একা, ও আর আমাকে একা এসে দেখতে চায় না। আমিই কাঙালিনীর মতো ওর কাছে গিয়েছিলাম কয়েক বার, কী নির্লিপ্ত আর উদাসীন ওর ব্যবহার। একদিন শুধু সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আয় ছায়া, তোকে একটা চুমু খাই। বলার সঙ্গে সঙ্গেই, আমার অনুমতির অপেক্ষা না করেই ঝট করে এগিয়ে এসে আমাকে চুমু খেল, তারপর চলে গেল। যেন হঠাই ওর আমাকে চুমু খাওয়ার কথা মনে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে সেটা চুকিয়ে নিল, আবার পরমুহূর্তেই ভুলে গেল আমার কথা। এই মানুষকে কেউ সহ্য করতে পারে না। তাপস আমার কেউ না। এর চেয়ে বিমলেন্দু অনেক ভাল, বিমলেন্দু অনেক নির্ভরযোগ্য। ওর চোখের দৃষ্টিতে একটা সান্ত্বনা আছে।

কোনও কোনও দিন বিমলেন্দু খোঁজ করে অফিসে, ছায়াদি, আজ বিকেলে কী করছ? একটা ফিমে যাবে নাকি? বাইবেল হাউসের বারান্দার নিচে বুক-খোলা শার্ট গায়ে বিমলেন্দুদাঁড়িয়ে থাকে। একটু নার্ভাস ভাবে সিগারেট টানে। আমার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে ভাবলেই আমার গা শির শির করে, আমার শ্বেতির দাগ-ধরা ঠোঁট জ্বালা করে ওঠে যেন। দুর থেকে যখন হেঁটে আসি হাওয়ার বিপরীত দিক দিয়ে, শাড়ি উড়তে থাকে, বিমলেন্দুকে দেখে আমার লজ্জা করে, কেন লজ্জা করে ঠিক জানি না। সিনেমার অন্ধকারে বসে অন্য মনস্ক ভাবে বিমলেন্দু আমার বাঁ-দিকের বুকে চাপ দেয়। আমিও মাঝে মাঝে ওর হাত ধরে খেলা করি। এক-এক সময় ওর কোলের ওপর হাত রাখি। বোকা, অত্যন্ত বোকা ছেলেটা, বোকা– । আমি হাত সরিয়ে নিই না। আমার ভাল লাগে। বিমলেন্দুকে কোনও দিন চূড়ান্ত প্রশ্রয় দিইনি। কখনও ইশারাও জানাইনি। দেখতে চাই, ও কী করে। কোনও দিন হঠাৎ হুড়মুড় করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কি না। অথবা এমন হতে পারে, আমি বিমলেন্দুকে পছন্দ করি না, আসলে ওকে দু’চোখে দেখতে পারি না। ওর ওই নির্লিপ্ত, হাঁসের পালকের মতো মুখ কেন কোনও মেয়েকে দেখায়? কেন বিমলেন্দু আসে আমার কাছে, ওরকী আর কোনও মেয়ে-বন্ধু নেই,

ও আমাকে ভালবাসে? নাকিও আমাকে নিঃসঙ্গ মনে করে সঙ্গ দিতে আসে? বিমলেন্দু আমাদের মধ্যে সব চেয়ে বিখ্যাত, গল্প কবিতা দুটোই ভাল লেখে, প্রবন্ধ সমালোচনার দিকেও আছে, বড় কলেজের জনপ্রিয় অধ্যাপক। প্রবীণ লেখকরা আমাদের মধ্যে বিমলেন্দুকে দেখলেই সাগ্রহে চিনতে পারে-আমাকেও চেনে অনেকে, সেটা আমি মেয়ে বলে। কিন্তু বিমলেন্দুকে আমি বোধহয় চাইনা, আমি চাই একটা ছটফটে, দুর্দান্ত, কেয়ারলেস যুবক। কার মতো? কার মতো? অবিনাশের না, অম্লানের মতো, একটু আনন্দ হলেই যে কোমর থেকে বেস্টখানা খুলে বোঁ বোঁ করে ঘোরায়।

যে-সববিকেলে বিমলেন্দুআসেনা, সাধারণত কোনও কাগজের অফিসে যাই, অথবা বাড়ি ফিরে আসি। মায়া সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকেনা, দু’জনে বসে দাবা খেলি। পিসিমা চায়ের সঙ্গে গরম গরম ফুলকপি বা ওমলেট ভাজা দেন। রাত্রে খাওয়ার পর লিখতে বসি, অনেক লেখা পছন্দ হয় না, ছিঁড়ে ফেলি, কিন্তু প্রত্যেক দিন কিছু না-কিছু না লিখলে আমার ভাল লাগে না।

রাত্রে ঘুম আসেনা, সাধারণত ঘুমের কথা ভাবি। এক-এক রাত্রে আমার শয্যাকণ্টকী হয়, বিছানার কোনও জায়গায় শরীর ছোঁয়াতে ইচ্ছে করে না, অসহ্য বমি বমি লাগে। মনে হয়, মা আমার পাশে শুয়ে আছে। মায়ের জন্য কষ্ট হয়।

এইরকম আমার জীবনের দিন কাটে। কিন্তু কীভাবে কাটাতে চাই? আমার ইচ্ছে করেনা চাকরি করতে, ইচ্ছে হয় সকাল ন’টা পর্যন্ত ঘুমোই, ইচ্ছে হয়, প্রতি কথায় গালাগালি করি, রাস্তাঘাটের বখা ছেলেরা যে-রকম মুখ-খারাপ কুৎসিত কথা বলে, আমারও ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে সেই রকম বলি, দুরশালা, দুর — ছাপার অযোগ্য, তোমার ইয়েতে ইয়ে দিই। ইচ্ছে হয় খারাপ মেয়ের মতো কোমর দুলিয়ে হাঁটি। কখনও এ-সব বলতে বা করতে পারব না, তবু ইচ্ছে হয়। আয়নার সামনে এই রকম ভঙ্গি করে দেখি। ইচ্ছে করে, সারা দিন শুধু শায়া আর ব্লাউজ পরে থাকি। দুটো ষণ্ডামার্কা চাকর থাকরে, হুকুম মতো তারা আমার ফুটফরমাস খাটবে, ধমকালে কুঁকড়ে যাবে, সাহস করবে না চোখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে, গোপনে তাপসের বুকে ছুরি বসিয়ে দিই। কিংবা নিজের বুকে।

এ ছাড়া, একা একা কান্না পায়। মায়া না থাকলে আমি বাড়িতে শুয়ে কাঁদি। আসলে সারা দিন আমি কী করি, তা জানি না। আমি কী করতে চাই, তা জানি না। আমি খুবই শিগগির মরে যাব, জানি। আমার কান্না পায়। মা, তোমার জন্য আমার বিষম মন কেমন করে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়