অনিমেষ

একটু সন্ধে হয়ে এসেছিল, তাই মাঠের মধ্য দিয়েই জিপ চালিয়ে দিয়েছিলাম। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, রণছোড়, তোমার ফিরে যাবার তেল আছে তো? কথাটা জিজ্ঞেস করার পরই আমার লজ্জা হল। প্রায়ই আমি ভুলে যাই যে, ও বোবা। রণছোড় ওর বিশাল দুটো চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল। বুঝলাম, আছে। বোবা বলেই কি রণছোড়ের চোখদুটো এত বড়? ওর চোখ সব কথার উত্তর দিতে পারে, কোনও মেয়ের চোখও এত পারে না। তাছাড়া ওর চোখের ভাষাও খুব সরল, শিশুরাও বুঝতে পারে। কিন্তু মেয়েদের চোখে ভাষা পড়তে হলে আলাদা বিদ্যে লাগে, আমার তা নেই।

দূর থেকে আমার বাড়িটা দেখতে পেলাম। সব ঘরে আলো জ্বালা। গায়ত্রী সব ঘরে আলো জ্বেলে রাখতে ভালবাসে। একটা জানলায় ও বসে আছে। ও কী আমার জন্য বসে আছে, নাকি আলো জ্বালা ঘরে বসে দূরের অন্ধকার দেখতে ভাল লাগে। একটা কুকুর ডেকে উঠল প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ করে। ডাকটা খুব মানিয়ে গেল। দূরে আলো জ্বালা বাড়ি, মাঠে অন্ধকার, অন্য মনস্ক নীল আকাশ–এর মধ্যে একটা কুকুরের ডাকনা থাকলে মানাচ্ছিল না।

আজ সকালে অবিনাশ একটা চিঠি লিখেছে। কতবার বলেছি, অফিসের ঠিকানায় চিঠি দিতে, বাড়িতে নয়, ওর খেয়াল থাকেনা। গায়ত্রীর একটা খারাপ স্বভাব আছে, চিঠি খুলে পড়া। কলকাতার মেয়েরা এসব করেনা, স্বামীর চিঠিও খোলে না। কাশীর মেয়েদের ও-শিক্ষা নেই। আমার বন্ধুবান্ধবদের চিঠি গায়ত্রীর পক্ষে হজম করা একটু শক্ত। গায়ত্রী বলেছিল, কী অসভ্য আর কাঠখোট্টা তোমার বন্ধুগুলো লিখেছে, মল্লিকাটা মারা গেছে। একটা মেয়ে, তা-ও মারা গেছে, তার সম্বন্ধে ‘মল্লিকাটা’ কী? কী ভাগ্য আমার, মল্লিকা সম্বন্ধে বিস্তারিত লেখেনি, তাই আমি বললাম, মল্লিকা হল শেখরের ছোট বোন। খুব বাচ্চা তো, অবিনাশ ওকে খুব ভালবাসত, ওদের বাড়ি গেলেই খেলা করত তাই। মল্লিকা মারা গেছে, সে-খবর আমাকে জানাবার দরকারই-বা কী ছিল মল্লিকার কাছে আমি কখনও যাইনি, ওদের মুখেই নাম শুনেছিলাম, তাপস খুব বলত, তাপসের বোধহয় ওই বেশ্যাটির উপর সত্যিই খুব টান ছিল। আর অবিনাশের তো সবাইকেই ভাল লাগে। মেয়েটা নাকি কোন বিখ্যাত অভিনেতার বে-আইনি মেয়ে।

অবিনাশ লিখেছে, পরীক্ষিৎ ভাল আছে। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে। ওঃ, সে-দিনের রাত্রের কথা ভাবলেও ভয় হয়। পরীক্ষিতের ও-রকম মদ খাওয়া নিয়ে হইচই করা আমি মোটেই পছন্দ করি না এই জন্য। আর মদ খেয়ে ব্রিজের রেলিঙে বসা কেন? অপঘাতে মৃত্যুই পরীক্ষিতের নিয়তি। হঠাৎ একটা আর্তস্বর, তার পরেই নিচের নদীতে শব্দ। গায়ত্রী মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিল, ফিরে এসে ব্রিজের কোণে দাঁড়িয়ে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। আমি কাছে যেতেই বলল, আমার আজ কেন জানি না ভাল লাগছে না, বোধহয় শরীরটা খারাপ, না এলেই ভাল হত মনে হচ্ছে। এই সময় ওই কাণ্ড। হা-হা-হা করে চারপাশের দোকান-জঙ্গল-মন্দির থেকে নিমেষে কয়েকশো লোক ছুটে এল। আমরা দুজনে দৌড়ে এলাম। আমি ছুটে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরে বললুম, কী হয়েছে? পরীক্ষিৎ পড়ে গেছে হাত ছাড়ুন, ওকে খুঁজে আনি। কথাটা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। পরীক্ষিৎ পড়ে গেছে, আর অবিনাশ এখান থেকে লাফিয়ে পড়বে তাকে বাঁচাবার জন্য? কোনটা বেশি ভয়ঙ্কর, পরীক্ষিতের পড়ে যাওয়া, না অবিনাশের এখান থেকে লাফিয়ে ওকে খোঁজা? আমি এক মুহূর্তে বুঝতে পারলাম না। এখান থেকে লাফালে কেউ বাঁচে? পরীক্ষিতের এতক্ষণে কী হয়েছে কে জানে। এর নাম বন্ধুত্ব, অবিনাশের মতো ও-রকম অকপট দুঃসাহসী আমি আগে কখনও দেখিনি। আমি আর গায়ত্রী দু’জনে ওর হাত চেপে ধরলাম প্রাণপণে। অবিনাশ হ্যাঁচকা টান মারতে মারতে বলল, ছাড়ুন না, আমার কিছু হবে না। দেখি ওকে বাঁচানো যায় কিনা। শেষ পর্যন্ত চা-ওয়ালা বিষ্ণু ওকে জোর করে পাজাকোলা করে নামিয়ে এনে বলল, পাগল হয়েছেন আপনি মশাই, চলুন ব্রিজের নিচে যাই। আমি এক ফাঁকে তাকিয়ে দেখলাম, ব্রিজের নিচে অন্ধকার, ভাঙা ভাঙা চাঁদের আলো, আর কিছু নেই। পরীক্ষিৎকে দেখা যাচ্ছেনা। আমাদের সামনে সকলের আগে ছুটে গেল অবিনাশ, জামাকাপড় খুলে সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

আমি এ-সব উত্তেজনা সইতে পারি না, এমন ছুটোছুটি চিৎকার। পরীক্ষিৎ মরে গেছে, এ-কথা ভেবে আমার বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম করে শব্দ হচ্ছিল। আমি জলে ঝাঁপিয়ে পড়িনি, পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, তার কারণ আমি সাঁতার জানি না। ওরা কি কেউ ভাবল, আমি শীতের ভয়ে জলে নামলাম না? বা প্রাণের ভয়ে? আমি সাঁতার জানি না, এ-কথা গায়ত্রীও হয়তো জানে না। ওর সামনে কখনও নদীতে বা পুকুরে স্নান করেছি বলে মনে পড়ে না। আমি ছেলেবেলায় একবার জলে ডুবে গিয়েছিলাম, সেই স্মৃতি আমি কখনও ভুলি না। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, পরীক্ষিৎ জলের নিচের নীল অন্ধকারে কী যেন খুঁজছে। বাতাস–এইমাত্র ওর বুক থেকে যে শেষ বাতাসও বার করে দিয়েছে সেটুকু আবার ফিরিয়ে আনা যায় কিনা প্রাণপণে খুঁজছে। ওর জন্য বুকভর্তি বাতাস নিয়ে অবিনাশ গেছে, পরীক্ষিতের মুখের মধ্যে ফুঁ দিয়ে অবিনাশ বাতাস ঢুকিয়ে দেবে। আমিও বুক ভর্তি বাতাস নিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি, আমি জলে নেমে পড়ার সাহস পেলাম না।

পরীক্ষিৎ মরার ছেলে নয়, এক সময় ও দেশবন্ধু পাকে ছেলেদের সাঁতার শেখাত। যখন খুব পয়সার দরকার, পরীক্ষিৎ তখন দেশবন্ধু পার্কের পুকুরের ছোট দ্বীপটায় মাথায় একটা তোয়ালে বেঁধে দাঁড়িয়ে চেঁচাত কে কে সাঁতার শিখবে, দু’আনা, দু’আনা, ছুটে এসে ছেলেরা, দু’আনা দু’আনা। সাত দিনে পুকুর পার করা শিখিয়ে দেব, দু’আনা, সাতদিনে পুকুর পার করা শিখিয়ে দেব, দু’আনা, দু’আনা। তখন পুকুরটা এ-রকম বাঁধানো ছিল না, ভাঙাচোরা। গরমের দিনে ছেলেরা বিকেলে এসে দাপাদাপি করত, মন্দ আয় হত না পরীক্ষিতের। দিনে বারো-চোদ্দো আনা। মাঝে মাঝে এক ডুবে পুকুরের মধ্য থেকে মাটি ভোলার খেলা দেখাত। সুতরাং, জলে ডুবে মরা পরীক্ষিতের পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু আচমকা অত উঁচু থেকে পড়ে যাওয়া, তাছাড়া এসব পাহাড়ি নদীতে আগাগোড়া পাথর ছড়ানো, মাথায় আঘাত লাগলেই আর বাঁচবার আশা নেই।

অবিনাশ জলে ঝাঁপিয়ে খানিকটা খোঁজাখুঁজি করতেই আমি চেঁচিয়ে বললাম, ওই যে, ওই যে। ব্রিজের একটা থাম ধরে পরীক্ষিৎ জলে ভেসে ছিল, অন্ধকার মুখে একটাও শব্দ নেই। চা-ওয়ালা বিষ্ণু আর অবিনাশ ওকে ধরে নিয়ে এল পাড়ে। রক্তে জল ভেসে যাচ্ছে, পরীক্ষিতের তখনও জ্ঞান ছিল, বলল, আর বেশিক্ষণ থাকতে পারতুম না, মাথায় খুব লেগেছে। হাসপাতালে পৌঁছুবার আগেই ও অজ্ঞান হয়ে পড়ল, ভয়ঙ্করভাবেওর মাথা ফেটে গেছে। অবিনাশ ওর মাথাটা চেপে ধরে আছে, চুঁইয়ে চুঁইয়ে তবু পড়ছে রক্ত। ডাক্তারের সামনে গিয়ে যখন অবিনাশ হাতটা তুলল, ওর দুই হাতের পাঞ্জা টকটকে লাল। আঙুল বিস্ফারিত করে অবিনাশওর ডান হাতের লাল পাঞ্জা আমার চোখের সামনে তুলে ধরল। মুখে কোনও বিকার নেই। আমার মাথা ঝিম ঝিম করে উঠেছিল।

খাওয়া শেষ করে একটা পাইপ ধরিয়ে জানলার পাশে বসলাম। পাইপ খাওয়া নতুন শিখেছি, বেশ চমৎকার লাগে একা একা। গায়ত্রী টুকিটাকি কাজ শেষ করছে। অনেক দিন কিছু লিখিনি। লেখার কথা ভাবলেই বুকের মধ্যে কী-রকম যেন একটা শব্দ হয়। সিনেমার থিম মিউজিকের মতো। বেশ তো ঘুরছি ফিরছি, গায়ত্রীকে আদর করছি, বন্ধু-বান্ধবের কথা ভাবছি, নদী দেখলেই পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছি–তবু মনে হয় কত দিন একটা কবিতা লিখিনি, অমনি বুকের মধ্যে ওই থিম মিউজিকটা ফিরে আসে। সুরটা দুঃখের নয়, রাগের, যে যে জিনিসকে ভাল লেগেছিল, তাদের উপর অসম্ভব রাগ হয়। মনে হয়, তোমাদের ভাল লেগেছিল? তোমাদের তবে কবিতায় আনতে পারলাম না কেন? কেন আমার ভাষা গরিবহয়ে যায়? মনে হয় হেরে গেলুম। কার কাছে? ঈশ্বরের কাছে। এই গাছপালা, পাহাড়, নদী, আকাশ যে ঈশ্বরের ভাষা, তার কাছে। তখন মনে হয়, গাছের ছাল ছাড়িয়ে দেখি, ফুলের সমস্ত পাপড়ি খুলে ফেলি। গায়ত্রীর সঙ্গে রাতের কাণ্ড করি আমি আলো জ্বেলে, ওর সমস্ত কাপড় জামা খুলেও ওই স্ত্রী-শরীরের দিকে তাকাতে আমার ইচ্ছে করে না, ইচ্ছে করে ওর ছাল-চামড়া ছাড়িয়ে নিই, বুকটা ফাঁক করে দেখি, কেন ওই বুকে মুখ রাখতে আমার ভাল লেগেছিল।

কেন, কেন, কেন-এর উত্তর খুঁজতেই সময় কেটে যায়। কেন এটা সুন্দর, কেন ওটা কুৎসিত এ প্রশ্ন নয়, কেন এটা আমার ভাল লাগল, কেন ওটা আমার ভাল লাগেনি এই অসঙ্গত প্রশ্ন। ভাল লাগে, তবে বিশেষ কিছুই আজকাল নতুন লাগে না। সবই মনে হয় আগে দেখেছি। যে-কোনও দৃশ্য, যে-কোনও মানুষ দেখলেই মনে হয়, আগে ওদের দেখেছি। যদি কখনও বিলেত-আমেরিকায় যাই, তাহলেও আমার নিশ্চিত ধারণা, সেখানকার সব কিছু দেখেই আমার ধারণা হবে, এ-সব আমি দেখেছি অনেক আগে। বহু আগেই এসব আমার দেখা। তবে কী যারা অ্যাটম বোম বানাচ্ছে– তারা কবিদের চেয়েও বড় প্রজাতি? তারা ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ধ্বংস করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছে, ওরাও সৃষ্টি করছে– ধ্বংসের দৃশ্য, দৃশ্য হিসেবে তা-ও নতুন, স্নায়ু আর মাথার ধুসর কম্পনে মানুষ অনেক ধারণা, রসের স্বাদ পেয়েছে। কিন্তু অ্যাটম বোমওয়ালারা একটা নতুন রসের সন্ধান দিয়েছে, সামগ্রিক মৃত্যুচিন্তা। এত দিন মানুষ শুধু নিজের মৃত্যু বা প্রিয়জনের মৃত্যুর কথা ভেবেছে, সাহিত্যেও ওইসব মৃত্যুর কথা। কিন্তু একটা মহাদেশ বা সমস্ত মানুষ জাতটার জন্য মৃত্যুভয় আমি একা একা ভোগ করছি এখন। সাহিত্য এর ধাক্কা সামলাতে পারছে না। প্রথম অ্যাটম বোমা ফাটার পরীক্ষার সময় ওপেনহাইমার বিড় বিড় করে ভগবদ্গীতা আউড়েছিল। আমি তো গীতা পড়ে ভাল বুঝতে পারিনি।

পরীক্ষিতের কবিতার বইটা উলটে-পালটে দেখছিলাম আর একবার। অন্ধের মতো, নির্বোধের মতো লিখেছে, তাই ওর প্রত্যেকটির লাইন এমন জোরালো, এমন বিস্ফোরণের মতো। ওর শব্দ সম্বন্ধে কোনওই জ্ঞান নেই। শব্দ নিয়ে ভাবেনা, তাই ওর প্রতিটি শব্দঅব্যর্থ। ওর চোখ ওর মাথার চারপাশে ঘোরে, যে-কোনও একটা জিনিসওকেহঠাৎ আকর্ষণ করে। আকর্ষণ? না, পরীক্ষিৎ আকর্ষণ কথাটা ব্যবহার করত না। ও বলত, ডাক দেয়। ওর ভাব খুব কম। মেয়েরাও ওকে ডাকে, ফুলও ডাকে, ভালবাসাও ডাকে। অবিনাশ লিখত, এ্যাচকা টান মেরে। ভালবাসারহ্যাচকা টানে ঢুকে গেলাম গর্তে, মৃত্যু বলে ভেবেছিলাম, কিন্তু পরিবর্তে, পেলাম আধঘণ্টা ক্লান্তি। অবিনাশের সেই বিখ্যাত পদ্য যা কলেজের ছেলেরা এক সময় খুব আওড়াত। পরীক্ষিৎকে চ্যালেঞ্জ করে অবিনাশ এক সময় গুটি আষ্টেক কবিতা লিখেছিল, প্রত্যেকটি বিখ্যাত হয়েছিল। তারপর হঠাৎ কবিতা লেখা ছেড়ে দিল। গল্পও লিখেছিল গোটা কয়েক, তা নিয়ে হই হই কাণ্ড। কী বিকট, কী অশ্লীল, সেইসব লেখা, এই রব উঠল সাহিত্যের বাজারে। অবিনাশ বলেছিল তখন, একটা উপন্যাস লিখে দেশটা কাপিয়ে দেব, বারোটা বাজিয়ে দেব সাহিত্যের। বোধহয় দুতিন পাতা লিখেছিলও, তারপরহঠাৎ একদিন সকালবেলা পরীক্ষিৎকে গিয়ে বলল, ভাই, মাফ কর, ও-সব আমার দ্বারা হবে না, বড় ঝামেলা। আমি শান্তিতে পুরোপুরি রকম বাঁচতে চাই। কদিন ধরে উপন্যাসের কথা ভাবতে ভাবতে এমন মজে গেছি যে, কাল সন্ধেবেলায় রাস্তায় একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে আমার উত্তেজনা হল না, এ কী? নিজের জীবনটা নষ্ট করে গল্পের নায়ক-নায়িকাকে বাঁচিয়ে তোলা আমার দ্বারা হবে না। নিজের জীবনের এমন চমৎকার সময়গুলো নষ্ট করে, খামোকা গল্প-উপন্যাস লিখে লাভ কী? আমি ভাই ভালভাবে খেয়ে-পরে বাঁচতে চাই। সাহিত্য-ফাহিত্য করে যত বোকার দল। পরীক্ষিৎ বলেছিল, মেরে তোর দাঁত খুলে নেব। জানোয়ার নাকি তুই যে, খালি খাব আর –।

অবিনাশ জানে, নির্বোধ ছাড়া কেউ অমরত্বের কথা ভাবেনা। যত দিন বাঁচা সম্ভব, যে-রকম ইচ্ছে বাঁচব, লিখে বা না লিখে। পরীক্ষিৎকে চিনতে ভুল হয় না ওই রকম মদ খাওয়া, পাগলামি, হই হই– পৃথিবীর বহু কবির জীবনীতে এ-সব দেখা গেছে। পরীক্ষিৎকে দেখলেই মনে পড়ে আমার হফম্যানের সেই গল্পের নায়কের কথা, যে নিজের ছায়াটাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। পরীক্ষিৎ সাহিত্য করার জন্য ওর ছায়াটা বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু অবিনাশকে চেনা যায় না। তবে আত্মাটা বিশাল অবিনাশের, বিমলেন্দু ছাড়া ও-রকম ক্ষমতাবান লেখক আমাদের মধ্যে কেউ নেই, আমার মনে হয়। বিমলেন্দু না তাপস? পরীক্ষিত্রা বলে, তাপসই সত্যিকারের জাত লেখক, বিমলটা কমার্শিয়াল। আমার তাপসের লেখা ভাল লাগে না। ও আমার ছেলেবেলার বন্ধু কিন্তু ওর ওই অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা, কবিত্বহীনতা আমার সহ্য হয় না। তাপসকে আমি বিশ্বাস করি, ও লেখে, না কলম দিয়ে থুতু ছেটায়, আমি বুঝতে পারি না। মানুষ হিসেবেও তাপস অবিশ্বাসযোগ্য।

বিমলেন্দুকে ওরা পছন্দ করে না, কারণ ও ছন্নছাড়া, ওর মুখ দিয়ে শিল্প সম্বন্ধে কোনও কথা বেরোয় না। আসলে বিমলেন্দু সব চেয়ে নতুন কথা লেখে। একথা আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি, সাহিত্য সৃষ্টির সঙ্গে ওসব মদ খাওয়া কিংবা হই-হুল্লোড়ের কোনও সম্পর্ক নেই। মানুষের মধ্যেও যেমন একদল মদ খায় না, একদল খেতে ভালবাসে, লেখকদের মধ্যেও তাই। আলাদা আর কোনও জাত-বিচার নেই। আমিও তো মদ-টদ খেতে ভালবাসি না, বিমলেন্দু তো একেবারেই খায় না। ওর সঙ্গে আমার আলাপ অদ্ভুত ভাবে। ও তখন অরুণোদয় কাগজেসহ সম্পাদকের চাকরি করে। হস্টেলে থাকি, আমি তখন কবিতা লিখতাম না। ওর কাগজে একটা গল্প পাঠিয়েছিলাম, গল্পটা এক জন মুমূর্ষ কবিকে নিয়ে। সেই গল্পের মধ্যে সেই কবির রচনা হিসেবে কয়েক লাইন কবিতাও ছিল। হঠাৎ এক দিন বিমলেন্দু দেখা করতে এল হস্টেলে, জিজ্ঞেস করল, অনিমেষ মিত্র কার নাম? আমরা তখন কমন রুমে টেবিল টেনিস খেলছিলাম। পরীক্ষিৎ বলল ফিসফিস করে, ওই ভদ্রলোক বিমলেন্দু মুখার্জি। পরীক্ষিৎ তখন বিমলেন্দুকে খুব ঈর্ষা করে।

কবি বিমলেন্দু মুখার্জি আমাকে খুঁজছেন? আমি প্রায় শিউরে উঠেছিলাম। বিমলেন্দু তখন থেকেই বেশ নাম করা। তাড়াতাড়ি আমার ঘরে ডেকে নিয়ে গেলাম। ধুতির সঙ্গে ফুলশার্ট পরা, ফর্সা, শান্ত ধরনের চেহারা, কিন্তু গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয়, খুব আত্মবিশ্বাস আছে। বিমলেন্দুকে প্রথম দিন দেখেই আমার ভাল লেগেছিল। ও মেয়ে হলে বলা যেত, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। পরীক্ষিতের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল বিমলেন্দু। বেশি ভূমিকা করল না। পকেট থেকে সিগারেট বার করে টানতে টানতে বলল, আপনি অরুণোদয়ে যে-গল্পটা পাঠিয়েছেন, সেটা ভাল হয়নি।

আমি অবাক। গল্প ভাল হলেও পাত্তা পাওয়া যায় না, আর খারাপ গল্পের জন্য সম্পাদক বাড়ি বয়ে এসেছে সমালোচনা করতে? আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। পরীক্ষিৎ এক কোণে দাঁড়িয়ে আয়নায় চুল আঁচড়াবার ভান করছিল। হঠাৎ বলল, আমি পরীক্ষিৎ ব্যানার্জি বলছি, গল্পটা ভালই, আমি ওটা পড়েছি।

মোটেই না, ওটা যাচ্ছেতাই হয়েছে, বিমলেন্দু বলল, ওটা গল্পই হয়নি, গল্প।

পরীক্ষিৎ প্রায় মারমুখী হয়ে এগিয়ে এল।

তবে, ওর মধ্যে যে ছোট্ট কবিতাটা আছে, সেটা আমি আলাদা কবিতা হিসাবে ছাপাতে চাই। বিমলেন্দু বলল, কবিতাটা চমৎকার হয়েছে, এত ভাল কবিতা পরীক্ষিৎ ব্যানার্জি ছাড়া অন্য কারুর লেখা ইদানীং পড়িনি।

বুঝলাম, আসলে পরীক্ষিতের সঙ্গে আলাপ করবার জন্য এসেছিল বিমলেন্দু। আমাকে ছেড়ে ও তখন পরীক্ষিতেরসঙ্গেই কথা বলতে লাগল। তবুবিমলেন্দুকে সেই প্রথম দিনই আমার ভাল লেগেছিল।

শনিবার। আজ হাটে হরিণের মাংস উঠেছিল হঠাৎ, রণছোড়কে দিয়ে খানিকটা বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। তারপর অনেকক্ষণ ধরে বাজারের সব দোকান ঘুরে জাফরান কিনতে ইচ্ছা হল। নেই। মধ্যপ্রদেশের এই শহরগুলিতে জাফরান মেলে না। ঘি আর রসুন হাজার দিলেও জাফরান ছাড়া হরিণের মাংস জমে না। গায়ত্রী আবার হরিণের মাংস রান্না করতে জানে কিনা, কে জানে! ওর বাবা ছিলেন কাশীর সংস্কৃত অধ্যাপক। কী জানি, হরিণের মাংস খেতেন কি না। আমার বাবা রাকা মাইনসে অনেক দিন ছিলেন, হরিণের মাংস খেতে বড় ভালবাসতেন। হাজারিবাগ গেলেই কিনে আনতেন। লালচে রঙের পচানো হরিণের মাংসের গরম ঝোল রাত্রে বসে খেতাম ছেলেবেলায়, স্পষ্ট মনে পড়ে।

হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারির হৃদয়কে ছিঁড়ে –জীবনানন্দের এই লাইনটা হঠাৎ অকারণেই মনে পড়ল। হরিণের মাংস খাব ভাবতে ভাবতে এ কী একটা উলটো রকমের কবিতার লাইন মনে পড়ল। বিষম গোলমেলে এই লাইনটা তারপর আধঘণ্টা আমার মাথা জুড়ে রইল। আমি হরিণটাকে খাব, না হরিণটা আমাকে খাবে? আমি হরিণের মাংস খাব আর হরিণটা আমাকে খাবে? আমি হরিণের মাংস খাব আর হরিণটা খাবে আমার হৃদয়। কী স্পষ্ট সেই ছবি। আমি রান্নার তারিফ করতে করতে আরামে চিবিয়ে চুষেহরিণের মাংস খাচ্ছি, আরহরিণটা খুব গোপনে আমার হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। যদিও আমি শিকারী নই, তবু ভেবে আমার বুক শিউরে উঠল। অসম্ভব। দরকার নেই আমার হরিণ। হরিণ! কথাটা ভেবে একটু হাসিও পাচ্ছে যদিও। এসব ভাবলে তো কোনও মাংসই খাওয়া যায় না। যখন মুরগির মাংস খাই, তখন মরার আগে সেই মুরগিও কী আমাদের হৃদয়ের একটা অংশ খেয়ে যায় না? এসব ভেবেকি আমি গান্ধীবাদী নিরামিষাশী হয়ে যাবনাকি? তা নয়, কবিতার মধ্যে আছে বলেই এ ব্যাপারটা এত মর্মান্তিক লাগছে। শিল্পের সত্য বড় ভয়াবহ। আজ অন্তত হরিণের মাংস খেতে পারব না। খালি একটা হরিণের জ্যান্ত চেহারা আর ছলছলে চোখের কথা মনে পড়ছে। হে ঈশ্বর, আজ যদি গায়ত্রী রাগ করে বলে, হরিণ-টরিণের মাংস আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি না, তবে খুব ভাল হয়। আমিও তাহলে একটু রাগ করে রঘুনন্দনের বউকে অনায়াসে ওটা দিয়ে দিতে পারি। হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারির হৃদয়কে ছিঁড়ে…। রঘুনন্দনের বউয়ের হৃদয় নেই। ও যখন বাসন মাজে উঠোনে বসে, ওর সম্পূর্ণ বুক আলগা থাকে। ঘুরতে ফিরতে আমার চোখে পড়ে, ওর কোনও হুঁশ নেই। বুকের নিচে যে-স্ত্রীলোকের হৃদয় থাকে, সে কখনও অপর পুরুষের সামনে অবহেলা ভরে নিজের বুক খুলে রাখে না। স্ত্রীলোকর হৃদয় গোপন রাখার জন্যই বুক গোপন রাখতে হয়। আসলে ও নিজের বুকের ওই দুই চূড়ার মানে জানে না। ভাবে বুঝি কাচ্চা বাচ্চার জন্য দু’খানা দুধ জমাবার ঘটি। গায়ত্রীরও একটা খারাপ অভ্যেস আছে, রাত্রে শোবার আগে বডিস পরে দুই বগলে স্নো মাখে। মুখে, গালে, বুকে মাখতে পারে, কিন্তু বগলে কেন? গোড়ার দিকে খাটে শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানতে টানতে ওগুলো দেখতে আমার খুব লোভীর মতো ভাল লাগত, মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতাম। এখন চোখ জিনিসটাকে মনে হয় শরীর থেকে আলাদা। শরীর এক জিনিস চায়, চোখ তা চায় না। গায়ত্রীর শরীর আমার শরীরকে চুম্বকের মতো টানে, অথচ চোখ তখনও চায় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে, অথচ –।

না, আলো নিভিও না।

হ্যাঁ, এখন ওঠো, কাল আবার ভোরে উঠতে হবে না?

না, আর একটু বসি, তুমি শোও।

 কিছু তো লিখছ না, শুধু শুধু তো বসে আছ। তার চে ।

না, লেখা নয়, আমার বসে থাকতেই ভাল লাগে এ-রকম। আজ আমার খুব মন খারাপ লাগছে।

কেন?

গায়ত্রী আমার কাছে এসে দাঁড়াল। এবার ও কাঁধে হাত রাখবে আর তার পরেই কান ধরে টানতে আরম্ভ করবে। এই ওর এক অদ্ভুত আদর। কান টানা। আমি যে ওর পূজনীয় পতিদেবতা, ওর খেয়াল থাকে না। দুই কান ধরে এত জোরে টানে যে, আমার কান জ্বালা করে। আমি রাগ করে ওর নাকটা ধরে টেনে দিই। কিন্তু ওর ফর্সা মুখে নাকটা এত লাল হয়ে ওঠে যে, আমার মায়া হয়।

গায়ত্রী আমাকে একা রেখে দরজাটা ভেজিয়ে চলে গেল। আজ আমার মন খারাপ লাগছে একথাটা হঠাৎ বললাম গায়ত্রীকে, কিছু না ভেবে। নিজের স্ত্রীর কাছে, আজ আমার শরীর খারাপ লাগছে, বলার চেয়ে, মন খারাপ লাগছে, একথাটা বলা অত্যন্ত নিরাপদ। শরীর খারাপ লাগছে, শুনলেই কী-রকম লাগছে, কোথায় শরীরের উপসর্গ কী কী, ওষুধ এ-রকম হাজার কথা। কিন্তু মন খারাপ লাগছে বললে অন্তত সভ্য স্ত্রীলোকেরা আর সে সম্পর্কে বেশি প্রশ্ন করে না। আসলে আমার শরীর খারাপ লাগছে না মন খারাপ লাগছে, আমি জানি না। এ সম্পর্কে তাপসের থিয়োরি ভারি চমৎকার। তাপস বলে, শরীর খারাপআর মন খারাপ, এর সীমারেখাটা কোথায় একথাকজন বোঝ? আমার তো সন্ধের দিকে যদি বিষম মন খারাপ লাগে, যদি মনে হয় হেরে গেছি, পৃথিবীতে আমি একা–তাহলেই বুঝতে পারি, দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। তখন দুখানা কচুরি, খানিকটা তরকারিফাউআরচার পয়সার দই খেলেই বিষম চাঙ্গা লাগে। আবার মনে হয়, বিশ্ববিজয়ী। নিজেকে যখন ব্যর্থ প্রেমিক মনে হবে, তখন বুঝবি জুতোর পেরেক উঠেছে, হাঁটবার সময় পায়ে ফুটছে, কিন্তু টের পাচ্ছিস না। জীবনে কিছুই করা হল না এই ধরনের উটকো মন খারাপ হলে বুঝবি, নিশ্চিত হজমের গণ্ডগোল হয়েছে। তাপসের এ কথাগুলো যে সম্পূর্ণ আজগুবিনয়, তা আমি মানি। তবু ধরনের গদ্যময় কথা পুরো মানতেও ইচ্ছে করে না। অবিনাশের কতগুলো নিজস্ব কথা আছে। অবিনাশের একটা প্রিয় কথা হল, প্রায়ই বলে রেগে গেলে, যাঃ শালা, শ্মশানের পাশে বসে ব্যবসা কর! এ-কথাটার মানে আমি বুঝতে পারিনি বহু দিন। এখনও হয়তো অবিনাশকী-ভাবে বলে, আমি জানি না। তবে বছর পাঁচেক আগে আমরা দলবল মিলে শ্মশানে বেড়াতে যেতাম। পাঁচ রকম লোককে দেখতেও ভাল লাগে, তাছাড়া বড় কারণ এই, যখন মদ খাবার জন্য জায়গার অভাব হত, তখন বোতল কিনে নিয়ে শ্মশানে চলে যেতুম। ওখানে, আশ্চৰ্য্য, কোনও বাধানিষধে নেই। গঙ্গার পাড়ে বা শ্মশান-বন্ধুদের ঘরে বসে খেতুম, কেউ দেখলেও গ্রাহ্য করত না, এমন স্বাভাবিক।

গগনেন্দ্র, পরীক্ষিৎ, শেখর, অরুণ ওরা আবার সাধুদের দলে বসে গাঁজা খেত। বাঃ, বিনে পয়সায় কী ফাসক্লাস নেশা, এই বলে গগনেন্দ্র ট্রপিক্যালের প্যান্টপরা অবস্থাতেই ধুলোর ওপর বসে পড়ত। অয়েল পেইন্টিং? চলবে? চলুক না এক রাউন্ড। এই বলে গগনেন্দ্র তেলেভাজাওয়ালাকে ডেকে মাঠসুদ্ধ লোককে খাওয়াত। অম্লানটা ছেলেমানুষ, মাঝে মাঝে কাঁদত গোপনে। একটা মড়া পোড়ানো শেষ হয়ে গেছে, মৃতের জ্যেষ্ঠ সন্তান একটা মাটির খুরিতে করে শেষ অস্থিটুকু কাদামাটি চাপা দিয়ে গঙ্গায় ফেলে দিতে যাচ্ছে। আমি চুপিচুপি অম্লানকে বললাম, আচ্ছা মানুষের সব পুড়ে যায়, ওটা কি পোড়ে না রে? কপাল না নাভি? ওটা কি স্টোন দিয়ে তৈরি? অম্লান বলল, শোন–। তারপর আর কিছু বলে না। আমি দেখলাম অন্নানের চোখে জল চিকচিক করছে। বলল, আমার বাবাকে পোড়াবার পর ওটা পাইনি, জানিস।

কোনটা?

ওই যে ওই অস্থি। আমি তখন অন্য পাশে বসে ছিলাম, হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে। ডোমটা বাঁশ দিয়ে অস্থি খোঁজাখুঁজি করছে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছেনা। তখন রাত তিনটে চিতা প্রায় নিভে এসেছে, এখানে সেখানে একটু আগুন। ডোমটা খুঁজছে তো খুঁজছেই। বলল, অস্থি-র আগুন দেখলেই চেনা যায়, অস্থিরওপরে লাল রঙের আগুন জ্বলে, একটু ঠাহর করলেই দেখতে পাবেন। আমার তখন, জানিস অনিমেষ, বিষম পায়খানা পেয়েছিল, থাকতে পারছিলাম না। ও-রকম মারাত্মক পায়খানা আমার সারা জীবনে পায়নি। আমি ভাবছিলাম, কোনও রকমে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে স্নান করার সঙ্গে সঙ্গে ওকাজটা সেরে নেব, কারণ ও-রকম সময়, বাবার শেষচিহ্নটা খোঁজা হচ্ছে আর আমি বলব, আমার পায়খানা পেয়েছে। ভেবে দেখ, এ অসম্ভব। কিন্তু ডোমটা বহু খুঁজেও অস্থিটা পাচ্ছে না, অথচ অস্থি পুড়ে যেতেও পারে না। আমি আর থাকতে না পেরে, এই যে পেয়েছি, বলেই একটুকরো কাঠকয়লা তুলে মাটি চাপা দিয়ে ছুটে গঙ্গায় চলে গেলাম। অনিমেষ জানিস, আমার বাবার আসল অস্থি বোধহয় শেষ পর্যন্ত কুকুর-বেড়াল খেয়েছে। এই বলে অম্লান হঠাৎ রুমাল বার করে চোখ মুছতে লাগল। ওর এই গল্পটার সঙ্গে কান্নার কী সম্পর্ক আছে ভেবে আমি তো হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলাম। হায়, হায়, আমি যে আগাগোড়াই গল্পটা হাসির গল্প ভেবে মুখখানা হাসি-হাসি করে রেখেছিলাম। পায়খানা পাবার গল্প আবারগন্নারহয় নাকি? সেইদিনইঅবশ্য বুঝতে পেরেছি, অম্লান কমার্শিয়াল সাকসেসফুল লেখক হবে। কারণ, ও এখনও জানে যে, শ্মশানে এলে দুঃখিত হতে হয়। অম্লান ইতিমধ্যেই পাঁচখানা উপন্যাসের প্রণেতা।

অবিনাশ এক দিন একটা অদ্ভুত কাজ করেছিল। শ্মশানে। সেদিনও আমরা একটা গাঁজার দলে বসে গিয়েছিলাম। পরীক্ষিৎ আর শেখর হু-হু করে লম্বা টান মেরে বুকের মধ্যে ধোঁয়া আটকে রাখছে। তারপর পাঁচ মিনিট বাদে দুই নাকের ফুটো দিয়ে মোষের শিঙয়ের মতো সেই ধোঁয়া বার করেছে। আমি দু-একবার টেনেই কাশতে লাগলাম। আমি রাউন্ড থেকে সরে বসলাম। অবিনাশও এ-সবে নেশা পায় না। ও একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ আমাকে আর তাপসকে ডেকে বলল, চল, একটু ঘুরে আসি। খানিকটা হেঁটে পাটগুদামের পাশ দিয়ে একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, বাংলা আছে?

বাংলা পান?

না, ছিপি-আটা।

সাড়ে তিন টাকা পাঁইট লাগবে।

 এক নম্বর তো? তিনটে ভাঁড় দিও।

আমি অল্প অল্প নিচ্ছিলাম, বাংলা আমার সহ্য হয় না, অবিনাশ ঢক ঢক করে খেতে লাগল, তাপস খুব গম্ভীর। তাপসের বিখ্যাত অন্য মনস্কতা। মাঝে মাঝে ওর হয়, তখন ও উৎকট রকমের চুপ করে থাকে। হিউমার শুনলে হাসে না, তখন বোধহয় কোনও লেখার কথা ভাবে। অবিনাশ জিজ্ঞেস করল, তোর নভেলটা শেষ হয়েছে তাপস? তাপস ঘাড় নেড়ে জানাল, না। অবিনাশ অপর দিকে ফিরে বলল, ও-সব গাঁজা-ফাঁজা টানতে আমার ভাল লাগে না, বঝলেন? ওই পরীক্ষিা টানছে কেন জানেন? কবিতার মশলা খুঁজছে। গাঁজায় নাকি নানা রকমের ইমেজ দেখা যায়। এই ভিখিরির মতো ইমেজ খোঁজা কেন?

আপনার এ-কথা বলা মানায় না, অবিনাশ। আমি বললাম।

কেন?

আপনি তো লেখেন না। আপনার ইমেজের দরকার কী?

ওঃ! অবিনাশ একটু বিব্রত হল। অরুণও তো লেখে না। জীবনে কখনও লেখেনি। ও খায় কেন? আসলে স্বপ্ন দেখার নেশা, দুঃস্বপ্ন দেখার নেশা, স্মৃতি নিয়ে নড়াচাড়া করার নেশা থাকে অনেকের।

আপনার নেই?

না, আমি আর ও-সব ঝঞ্ঝাটের মধ্যে থাকতে চাই না।

 আমি হেসে উঠলাম। এ বাসনা আপনার কত দিনের?

 আমি তো সরল জীবনই কাটাচ্ছি। কী রে তাপস?

 হয়তো। তাপস বলল।

একটা লম্বা চুমুকে বাকিটা শেষ করে অবিনাশ বলল, আমি কলকাতার বাইরে একটা চাকরি খুঁজছি। তাছাড়া আমি যে লিখি না, তা নয়, আমি একটা বড় গল্প লিখেছি।

তাপস সচকিত হয়ে বলল, করে?

আজ, একটু আগে। গঙ্গার পাড়ে রেলিঙে ভর করে দাঁড়িয়ে। সম্পূর্ণ গল্প, প্রায় পঞ্চাশ পাতার হবে। আশ্চর্য হু-হু করে যেন ট্রেনের মতো গল্পটা আমার চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। এই দেখাটাই তো যথেষ্ট। লিখে আর কী লাভ পাছে ভুলে যাই, তাই মদ খেয়ে মনের মধ্যে গেঁথে নিলাম।

ভাগ শালা, চালাকির আর জায়গা পাসনি!

বিশ্বাস কর, পুরো গল্পটা কয়েক নিমেষে দেখতে পেলাম।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা শ্মশানের পারে চলে এলাম। আবার সিগারেট আছে? নেই! অবিনাশ একটা দোকানে গিয়ে বলল, দেখি এক প্যাকেট সাদা বিড়ি!

লোকটা সিগারেট দিতে দিতে অকারণে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের মড়া চিতায় চেপেছে?

 কী?

আপনাদের মড়া চিতায় চেপেছে?

আমাদের মড়া? অবিনাশ গাঁ-গাঁ করে হেসে উঠল। আমাদের মড়া কোথায় রে, অ্যাঁ?

বুঝলাম অবিনাশের নেশা হয়েছে। অবিনাশ বলল, চল, আমাদের মড়া খুঁজে আসি।

আমরা শ্মশানের মধ্যে ঢুকলাম। চারটে চিতা জ্বলছে সমানে ধক ধক করে। অবিনাশ খুশি মনে বলল, আজ বাজার ভাল। গগন থাকলে বলত, আজ অনেক লোক পড়েছে। লোকনা টোক। জয় মা কালী বল, লোকে বলে বলবে পাগল হল।

আমরা শ্মশানবন্ধুদের জন্য পাথর বাঁধানো ঘরে ঢুকলাম। একদল লোকসদ্য পোড়ানো শেষ করে আলকাতরা দিয়ে মৃতের নাম লিখছিল দেওয়ালে —

বাবু শিবপ্রসাদ সাঁতরা
বয়স ৭২। মৃত্যু :সাতুই জানুয়ারি
 রিটায়ার্ড চৌকিদার
গ্রাম : ঘোলা। পো :ইত্যাদি।

অবিনাশ ওদের পাশে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে ওদের লেখা দেখল। তারপর শেষ হলে, কাঁদো কাদো মুখে বলল, দাদা, একটু আলকাতরা দেবেন, আমাদের মড়ার নামটাও লিখব।

নিশ্চয়, নিশ্চয় লিন না। এক জন মুরুব্বি সহানুভূতির সঙ্গে দিল। অবিনাশ গোটা গোটা অক্ষরে লিখল, সাদা পাথরের দেয়ালে–

বাবু অবিনাশ মিত্র। নিবাস জানা নাই।
জন্মকাল– জানা নাই। বয়স– জানা নাই
মৃত্যু তারিখ জানা নাই।

তাপস বলল, আরও লেখ, বাপের নাম জানা নাই।

আমি মুখ ফিরিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অবিনাশকে এত সেন্টিমেন্টাল হতে আমি আগে দেখিনি।

.

শ্মশানের কথা মনে পড়লেই সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে।

সেই ইটালিয়ান ধরনের সুন্দরী পাগলিটার কথা। রোগা, তরুণী, রেনেসাঁস নাক, নীল চোখ। একটা হাফ শায়া আর লাল সাটিনের ব্লাউজ পরে নিবন্ত চিতার পাশে বসে আগুন পোহাত। মেয়েটা এতই রোগা যে, ওরশরীরেরস কতখানি আছে বোঝা যায় না, সেই জন্যেই বোধহয় রাতের বাঘ-ভাল্লুকেরা ওর দিকে তেমন নজর দেয়নি। কিন্তু অমন রূপসী আমি খুব কম দেখেছি অথবা শ্মশানে, নিভন্ত চিতার পাশে ছাড়া কোথাও বসতে দেখিনি। কোনও দিন শুনিনি ওর মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ বার করতে। গগনেন্দ্র বড় ভালবাসত মেয়েটাকে। সোয়েটারের দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে গগনেন্দ্র সোজা তাকিয়ে থাকত মেয়েটার দিকে। আর বিড় বিড় করে বলত, হে শ্মশানের ঈশ্বর, ওই মেয়েটাকে অন্তত এক ঘন্টার জন্য আমাকে দাও। তাপস পাশে দাঁড়িয়ে হাসত, তখন গগনেন্দ্র বলত, যান না, দেখুন, অন্তত একবার, যত টাকা খরচ হোক।

নিভন্ত চিতার আশেপাশেও লোক থাকত। গেঁজেল, রিকশাওয়ালা, সাধু হয়ে যাওয়া সিফিলিসের রোগী, রাতকানা ভিখিরি। তাপস গিয়ে মেয়েটার পাশ ঘেঁষে বসে গাঁজারটান মারতে লাগল। আমরা দূর থেকে লক্ষ্য করতাম। মেয়েটার ভ্রূক্ষেপ নেই। দুই হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে মেয়েটা কাঠি দিয়ে ছাই নাড়ছে। এমন সময় হুড়মুড় করে বৃষ্টি এসে গেল। শীতকালের মারাত্মক অকালবৃষ্টি, আমরা তখনই ছুটে বসবার ঘরগুলোয় ঢুকে পড়লাম, সব চেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল ঝানু গাঁজাখোররা, যারা এক ফোঁটা জল শরীরে সহ্য করতে পারে না। মেয়েটা চুপ করে ভিজতে লাগল। কী অদ্ভুত ওর চুপ করে বসে থাকা। সেই রকম হাঁটু মুড়ে থুতনি ভর দিয়ে কাঠি দিয়ে ছাই খুঁটতে লাগল, লাল সাটিনের ব্লাউজ আর হাফ শায়া, সেই মেয়েটা, নীল ঝকঝকে চোখ, এখনও চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পাই। তাপস বলল, না, পারলাম না, মাপ করুন, মেয়েটার অসম্ভব দাম্ভিকতাকে ছুঁতে পারলাম না। আমার বন্ধুদের অনেক রকম এলেম ছিল, কিন্তু একটা পাগল মেয়েকে অ্যাপ্রোচ করার ভাষা কারোর জানা ছিল না। গগনেন্দ্র বলল, কে কে মল্লিকার কাছে যাবেন চলুন, আমি এই মেয়েটার মুখ মনে করে মল্লিকার কাছে যাব।

.

আমি কলকাতা ছেড়েছি চার বছর। জানি না, ওরা এখনও শ্মশানে বেড়াতে যায় কিনা। গগনেন্দ্র চাকরি করে বম্বেতে, অরুণ বিলেতে গেছে। আমি ক্লান্ত হয়ে জব্বলপুরে রাত্রে বসে আছি। আমার মন খারাপ লাগছে। মন খারাপ না শরীর খারাপ, জানি না। গায়ত্রী বোধহয় খুব সুন্দর দেখতে। অন্তত আমার তো মনে হয়। অবশ্য বউয়ের রূপ সম্বন্ধে স্বামীদের মন্তব্য গ্রাহ্য হয় না। পরীক্ষিৎ আমাকে বলেছিল, বউ বেশি সুন্দরী হওয়া ভাল নয়। পাগল পরীক্ষিৎক্টা কি আমাকে ছেলেমানুষ ভাবে, যে বউয়ের রূপে ভুলে থাকব? বা কেরানিবাবুদের মতে, বউয়ের দিকে কে কুনজর দিল সেই নিয়ে। আচ্ছা, গায়ত্রী বোধহয় কখনও ভালবাসা পায়নি, তাই আমাকে এতটা অবলম্বন করতে চায়। ও আমাকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখতে চায। ওর শরীরে খিদে একটু বেশি, নবীন যুবতীর কামুকতা যে এমন ভয়ঙ্কর আমার জানা ছিল না, আমার বন্ধুদের মতো মেয়েদের সম্পর্কে আমার বেশি অভিজ্ঞতা ছিল না। তবু মনে হয়, গায়ত্রী বোধহয় আমাকে পেয়ে খুশিই হয়েছে। একটা মেয়েকে খুশি করা কম নয়, বহু কবিতা লেখার চেয়ে বড়।

শ্মশানের পাগলিটার চেয়েও বোধহয় গায়ত্রী রূপসী। সেই মেয়েটাকে এই বিছানায় মানাত না। গায়ত্রীকে এই খাটে কী চমৎকার মানিয়েছে, ছেলেবেলায় পড়া রূপকথার বইয়ের ছবির মতো। আমি ওর কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে গিয়েও হাত তুলে নিলাম। তুমি আর একটু ঘুমোও গায়ত্রী। আমি ইতিমধ্যে দাড়িটা কামিয়ে নিই। কাল ভোরবেলা বেরুতে হবে, তখন দাড়ি কামানো যাবে না। তাছাড়া, রাত্রে দাড়ি কামাতে ভালই লাগে। একটু গরম জল পেলে ভাল হত। যাক। আমি সেফটি রেজার, ব্রাশ, সাবান খুঁজতে লাগলাম।

এ কী গায়ত্রী, তুমি উঠে এলে কেন?

আমি তো জেগেই ছিলাম।

না, তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও, পরে তোমাকে জাগাব।

যাঃ, দাঁড়াও, আমি গরম জল করে আনি।

গায়ত্রী আমার গালে ওর গালটা ঘষে দিয়ে বলল, কী খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বাবাঃ।

অবিনাশের চিঠিটা রাখলাম, দাড়ি কামিয়ে সাবান মুছবার জন্য। এখন রাত ঠিক বারোটা, মাইকা মাইনস-এর সাইরেন বেজে উঠল। একটা মুরগিও ডেকে উঠল প্রচণ্ড আওয়াজে। মুরগিরা কি রাত্রে ডাকে? কখনও শুনিনি বা লক্ষ্য করিনি। ভোরবেলা দেখেছি, একটা উঁচু জায়গা বেছে নিয়ে সূর্যকে ডাকে। পৃথিবীর লোককে সূর্য ওঠার খবর জানাবার ভার মুরগিগুলোর ওপর কে দিয়েছে, কী জানি! যে-মুরগিটা এইমাত্র জেগে উঠল সেটা বোধহয় চাঁদের খবর জানাতে চায়। ওই মুরগিটা বোধহয় মুরগি সমাজের মধ্যে বিদ্রোহী আধুনিক, সূর্যের বদলে চাঁদ কিংবা অন্ধকার ঘোষণা করতে চায়। ভেবেই আমার হাসি পেল। ওই মুরগিটা বেছে নিয়ে কাল রোস্ট খেলে কেমন হয়?

এ কী, এর মধ্যে গরম জল হয়ে গেল?

দাঁড়াও, তুমি চুপ করে বোসো, আমি তোমার দাড়ি কামিয়ে দিই।

তা হয় না, পাগল নাকি?

বাঃ, কেন হবে না?

সেফটি রেজার দিয়ে অপরে কামাতে পারে না। পারবে না, পারবে না, আমার উঁচু-নিচু গাল কেটে যাবে। তোমাদের অমন নরম তুলতুলে গাল হলে কাটা যেত অনায়াসে। তুমি বরং গালে সাবান মাখিয়ে দাও।

রাত্তিরবেলা গরম জলে ব্রাশ ডুবিয়ে গালে সাবান মাখতে সত্যিই বেশ আরাম লাগে। গায়ত্রী আমার দুপায়ের ফাঁকের মধ্যে দাঁড়িয়ে খুব যত্ন করে সাবান ঘষতে লাগল। আমি চেয়ারে বসে এক হাতে ওর কোমর ধরে। এই অসভ্যতা করবে না! বলেই গায়ত্রী আমার চোখে সাবান লাগিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে আমাকে দুহাতে চোখ ঢাকতে হল। গায়ত্রী হেসে দূরে সরে গেল। আমি ওকে উঠে ধরতে গিয়ে পারলাম না। দাড়ি কামাতে গিয়ে আমার থুতনিটা খানিকটা কেটে গেল।

অন্তত বারো বছর ধরে তো দাড়ি কামাচ্ছ, এখনও শিখলে না, আনাড়ি! গায়ত্রী হাসতে হাসতে বলল।

তোমাদের তো এটা শিখতে হয় না, জানবে কী করে কী বিরক্তিকর কাজ।

আমি সেফটি রেজার দিয়ে কাটতে জানি। তোমার হয়ে গেলে আমাকে দিও, আমার একটু লাগবে।

তুমি কী করবে?

আমার দরকার আছে।

 ওঃ, আচ্ছা, তোমারটা আমি কেটে দিচ্ছি।

না, আমিই পারব।

 হাতের নিচের চুল কাটবে তো? বাঁ-হাতেরটা তুমি পারলেও, ডান হাতের নিচে পারবে কী করে?

খুব পারব, বাঁ-হাত দিয়ে।

 না, এসো না লক্ষ্মী, দেখো আমি কী সুন্দর করে দিচ্ছি।

 গায়ত্রীকে ধরে এনে দাঁড় করালাম। ও ভিনাস ডি মেলোর ভঙ্গিতে দু’হাত উঁচু করে দাঁড়াল। আমি সাবান মাখিয়ে খুব যত্ন করে সাবধানে ওকে কামিয়ে দিলাম।

লাগছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হুঁ, খুব দুষ্টুমি করে গায়ত্রী।

আমার শেখরের কথা মনে পড়ল। শেখর হস্টেলে থাকতে সাবান খেত। নতুন চকচকে সাবানের কেক দেখলে শেখর লোভীর মতো এক কামড়ে আধখানা খেয়ে ফেলত কচ কচ করে, আমরা অবাক হয়ে দেখতাম। শেখরের মতো অভ্যেস যদি থাকত, তবে আমি গায়ত্রীর বগলের সাবান ধুয়ে না দিয়ে চেটে নিতাম। তার বদলে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়ে আমি ওর বুকে মুখ গুঁজলাম।

গায়ত্রী, আমার বিষম ইচ্ছে করে শিশুর মতো স্তন্যপান করতে। তোমার বুকে দুধ নেই কেন?

বাঃ, তুমি যে বিয়ের পর প্রথম প্রথম বলতে, আমার বুকে অমৃত আছে। আমরা দুজনে হো-হো। করে হেসে উঠলাম।

তুমি বুঝি তখন আমার কথা বিশ্বাস করতে না? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

তুমিই বুঝি বিশ্বাস করে বলতে? গায়ত্রী বলল, ও-সব বিয়ের পর কিছুদিন বলতে হয়, শুনতেও ভাল লাগে।

না সত্যিই, বুকের দুধ খেতে আমার বিষম ইচ্ছে করে।

আচ্ছা, আমার একটা ছেলে হোক, তখন খেও।

কবে তোমার ছেলে হবে?

বাঃ, তার আমি কী জানি! সেটা কি আমার হাত। ও-সব আজেবাজে ব্যবহার করতে কেন?

 ও-সব জানি না, করে তোমার একটা ছেলে হবে বলো না?

বাঃ রে, সেটা তো তুমিই জানো।

সন্তান বুঝি বাবার, মায়ের নয়?

বাবা না দিলে মায়ের কী করে হবে?

ও-সব বৈজ্ঞানিক ধাপ্পা। তোমার পেটের মধ্যে জন্মাবে, তোমার রক্ত শুষে বড় হবে, তোমার শরীর ছুঁড়ে বেরুবে, আর তার জন্য দায়ী হব আমি। সারা দিন গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াব কি বিদেশে থাকব— ও-সব বাজে কথা, সন্তান আসলে মেয়েদেরই হয়। তুমি আমাকে একটা ছেলে দাও গায়ত্রী। গায়ত্রী আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাকে একটা ছেলে দেব?

হ্যাঁ।

আচ্ছা দেব, আর আট মাস বাদে।

তার মানে? আমি গায়ত্রীকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।

 শত্তুর আমার পেটে এসে গেছে।

সত্যি, তুমি জানো?

হ্যাঁ, জানি, মেয়েদের ও-সব জানতে ভুল হয় না।

গায়ত্রী, গায়ত্রী, গায়ত্রী! আমি ওকে দু’হাতে তুলে একটা ঘুরপাক খেলাম।

আঃ, ছাড়ো ছাড়ো–

না না না, তুমি সত্যি বলছ? বুঝতে তোমার ভুল হয়নি তো? আমাকে ঠকাচ্ছ না?

না গো, ঠকাচ্ছিনা, সত্যিই।

গায়ত্রী! উঃ, গায়ত্রী, আমার এত আনন্দ হচ্ছে– ।

ছাড়ো, লাগছে। ছেলের জন্য তোমার এত কাঙালপনা কেন?

এত দিনে আমি পূর্ণ মানুষ হলাম। আমি গৃহস্থ, আমি পদস্থ চাকুরে, আমি সন্তানের পিতা। আমি কোথা থেকে জীবন শুরু করেছিলাম তুমি জানো? না, জানো না। আমার বাবা নেই, মা নেই, একটাও আত্মীয়ের মুখ আজ মনে পড়ে না। তেরো বছর বয়স থেকেই আমি একা। বাবার এক বড়লোক বন্ধু দয়া করে আমাকে মানুষ করেছেন। কলেজে যখন থার্ড ইয়ারে পড়তাম, সেই সময় হঠাৎ তিনিও মারা গেলেন। তখন থেকে বিজ্ঞাপনের এজেন্ট সেজে, প্রুফ দেখে, তিনবেলা টুইশনি করেহস্টেলে থেকেছি। এই জন্যই তাপস পরীক্ষিৎদের মতো বাউণ্ডুলে হয়ে যাইনি। আমার ঘর-সংসার ছিল না, তাই ঘর-সংসার পাতবার বিষম লোভ ছিল আমার। করে এক দিন সুস্থ, সাধারণ, দায়িত্বশীল মানুষ হব, সেই ছিল আমার বাসনা। ভাগ্যিস আমি তোমাকে পেয়েছিলাম।

হয়েছে, হয়েছে, এখন শোবে চলো। আমার ঘুম পেয়েছে সত্যি।

চলো, এখন থেকে খুব সাবধানে থেকো কিন্তু।

যদি বাচ্চা হবার সময় আমি মরে যাই?

পাগল নাকি? তোমার বয়েস তেইশ, এই তো বাচ্চা হবার ঠিক সময়।

খুব যন্ত্রণা হবে তখন, না?

তা হবে, যত যন্ত্রণা পাবে আমার শিশুর প্রতি তত ভালবাসা হবে।

 সন্তান কিন্তু সম্পূর্ণ আমার, তুমি বলেছ।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমার। আমার সব কিছুই তো তোমার।

আবার পাগলামি করছ? তুমি না আধুনিক লেখক। আধুনিকরা এ-সব বলে নাকি?

ওঃ, হো-হো, তুমিও এ-সব জেনে গেছ!

চলো, শুয়ে পড়ি, আর না। দাঁড়াও, জানলা বন্ধ করে দিয়ে আসি।

 কেন, জানলা খোলা থাক না! ঠাণ্ডা লাগবে?

 ঠাণ্ডা না। চাঁদের আলো আমার চোখে পড়লে ঘুম আসে না।

ওঃ, আচ্ছা অন্ধকার করে দাও।

 গায়ত্ৰী সব অন্ধকার করে দিল। এতক্ষণ বুঝতে পারিনি, আমার কপালের দু’পাশের শিরা দপদপ করছে। এবং হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারির হৃদয়কে ছিঁড়ে –এই লাইনটাও মাঝে মাঝে মনে পড়ছিল। মাথা ধরার সঙ্গে এই লাইনটির কোনও যোগ আছে কিনা জানি না। অথবা এই দুটোই আলাদা ভাবে আমাকে আক্রমণ করেছে, গায়ত্রীর সঙ্গে এই আনন্দের সময়ে। আঃ, গায়ত্রী, তোমাকে আমি বিষম ভালবাসি।

তা বুঝি আমি জানি না? গায়ত্রী হাসির শব্দ করল।

 অন্ধকারে ওর হাসি দেখা গেল না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়