শশিভূষণের পাঠশালাটি বড় বিচিত্র। মাস্টার ঠিক আছে, কিন্তু ছাত্রদের কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। প্রতিদিন দোকান খোলার মতন তিনি একটি টেবিলে বইপত্র, দোয়াত-কলম সাজিয়ে বসে থাকেন সকালবেলা, প্রায় দিনই কোনও ছাত্রই আসে না। তিনি রাজকুমারদের শিক্ষক, শুধুমাত্র রাজকুমারগণ ছাড়া অন্য কারুর এ পাঠশালায় প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু পড়াশুনোর কোনও গরজ নেই, কেউ তাদের তাড়না করে পাঠায়ও না।

কমলদিঘির ধারে একটি ছোট কিন্তু সুন্দর বাড়ি দেওয়া হয়েছে শশিভূষণকে। তিনি অকৃতদার, দোতলায় একা থাকেন। নীচের তলায় একটি হলঘর, সেখানে টেবিলের চার পাশে গোটা দশেক কৌচ রয়েছে, তা শূন্যই পড়ে থাকে, যদিও রাজপরিবারের কুমারদের সংখ্যা উনিশ। এই সব কুমারদের বয়েসের তারতম্যও বিস্তর। জ্যেষ্ঠ রাজকুমার রাধাকিশোর, সদ্য যিনি যুবরাজ হিসেবে ঘোষিত হয়েছেন, তিনি শশিভূষণের চেয়ে খুব বেশি ছোট নন।

ছাত্র আসে না, তবু প্রতিদিন শশিভূষণকে নিয়ম করে সকাল দশটা থেকে বসতে হয়। তার কারণ, এক একদিন মাস্টারমশাইকে অবাক করে দিয়ে স্বয়ং মহারাজ বীরচন্দ্র এসে উপস্থিত হন। মহারাজ যে অতর্কিতে তাঁর সন্তানদের শিক্ষার উন্নতি বিষয়ে খোজ নিতে আসেন, তা নয়, তিনি নিজেই আসেন ছাত্র হয়ে। কোনও ইংরেজি শব্দের অর্থ জানতে চান অথবা ঔৎসুক্য প্রকাশ করেন কোনও বাংলা গ্ৰন্থকার সম্পর্কে। মহারাজ বীরচন্দ্রের তেমন প্রথাগত শিক্ষা নেই, কিন্তু অভিজ্ঞতায় অনেক কিছু শিখেছেন। দু’চারটি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বাক্য বেশ চালিয়ে দিতে পারেন, বাংলা বইও বেশ কিছু পড়া আছে।

রাজকুমারদের গৃহশিক্ষকের বেতন তো ভদ্রগোছের বটেই, পদমর্যাদাও গুরুত্বপূর্ণ। স্বয়ং মহারাজ ছাড়া তিনি আর কারুর অধীনে নন। যে রাধারমণ ঘোষমশাই এখন মহারাজের একান্ত সচিব, যার পরামর্শ ছাড়া মহারাজ এক পাও চলেন না, সেই তিনিও রাজপরিবারের শিক্ষক হিসেবেই প্রথম এসেছিলেন। এখন তার স্থান মন্ত্রীরও ওপরে। রাধারমণের রাজনৈতিক জ্ঞান তীক্ষ্ণ, আবার তিনি বৈষ্ণব সাহিত্যেও সুপণ্ডিত। তাঁর প্রভাবেই মহারাজ বৈষ্ণব পদাবলিতে আসক্ত হয়েছেন। এখন তিনি স্বয়ং কবিতা ও গীত রচনা করেন, যদিও তার বাংলা বানানের বাপ-মা নেই। শশিভূষণ সেই সব বানান শুদ্ধ করে দেন অনেক সময়।

শশিভূষণের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই, শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি রাজকাৰ্যে মাথা গলাতে চান না। ছাত্র নেই। অথচ শিক্ষক হিসেবে মাসে মাসে বেতন নিয়ে যাচ্ছেন, এ জন্য তার বিবেকদংশন হয়। এ বিষয়ে তিনি মহারাজের কাছে অনুযোগ করেছিলেন, পদত্যাগ করে ফিরে যেতেও চেয়েছিলেন, মহারাজ সেসব কথা হেসে উড়িয়ে দেন।

মহারাজ বলেন, ছাত্র নেই বলে তুমি ব্যস্ত হচ্ছে কেন, মাস্টার! আমিই তো তোমার একজন ছাত্র। আমাকে পড়াবে। রাজকুমারগুলো অকম্মার ঢেঁকি। ওগুলোকে কি গলায় দড়ি বেঁধে টেনে আনা যায়! তুমি বরং পর্বত হও, মাস্টার, পর্বত হও।

এ কথার ঠিক অৰ্থ বুঝতে না পেরে শশিভূষণ নীরবে তাকিয়ে থাকেন। মহারাজ উচ্চহাস্য করে বলেন, বুঝলে না কথাটা? মহম্মদ যদি পর্বতের কাছে না যান, তা হলে পর্বতই আসবে মহম্মদের কাছে। তাই না? ছোঁড়াগুলো এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, তুমি এখানে বসে না থেকে ওদের এক একটাকে ধরবে, তারপর গল্প-গুজব করার ছলে তাদের একটু আধটু সটুকে শেখাবে, কোনও শুদ্ধ কথার বানান জিজ্ঞেস করবে। আর কিছু না হোক, তোমার মুখে ওই কলকাত্তাই ভাষা শুনলেও ওদের অনেকটা জ্ঞান হবে।

কথাটা শশিভূষণের মনঃপূত হয় না। ছেলে-ধরার মতন যেখানে সেখানে ছোটাছুটি করে ছাত্র পাকড়াও করার প্রবৃত্তি নেই তাঁর। শশিভূষণ বলেছিলেন, মহারাজ, আপনি সময় পান না, কিন্তু আপনি যদি রানীদের বলে দেন যে, অন্তত দুঘণ্টার জন্য ছেলেদের পাঠান আমার কাছে।

তাঁকে থামিয়ে দিয়ে মহারাজ বলেছিলেন, রানীরা পাঠাবে? রাজবাড়ির অন্দরমহল সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা নেই বোঝাই যাচ্ছে। রানীদের সঙ্গে তাদের ছেলেদের দেখা হয় ভেবেছ? কক্ষনও না। খোকাগুলো যেই দামড়া হয়, অমনি তারা ছটকে যায়। তারপর ঠাকুরদের সঙ্গে ঘোঁট পাকাতে শুরু করে। রাজবাড়ির ছেলেদের প্রধান খেলাই হল ষড়যন্ত্র। কে কাকে হটিয়ে সিংহাসনের দিকে এগোবে। বারো-তেরো বছর বয়েস থেকেই এই খেলা শুরু করে দেয়। রানীরাও তাতেই খুশি।

ছাত্র যে একেবারেই আসে না, তা নয়। কুমার সমরেন্দ্ৰচন্দ্র আসে মাঝে মাঝে। কিশোর বয়েসী এই রাজকুমার প্রধানা মহিষীর সন্তান এবং মহারাজের বিশেষ প্রিয় তা জানেন শশিভূষণ। সুশ্ৰী এই কিশোরটি বেশ মেধাসম্পন্ন, এই বয়েসে তার ফটোগ্রাফির দিকে ঝোঁক, নিজস্ব দুটি ক্যামেরা আছে। লেখাপড়া করার বদলে সে মাস্টারমশাইয়ের কাছে ছবি তোলা বিষয়েই অনেক কিছু জানতে আসে, বিদেশি ক্যামেরা কোম্পানির লিটারেচার এনে অর্থ জানতে চায়। তার বৈমাত্রেয় ভাই উপন্দ্রেও আসে এক একদিন অঙ্কের হিসেব বুঝে নিতে, কার সঙ্গে যেন সে তুলোর ব্যবসা করে। রাজবাড়ির অনেকেই বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

উপেন্দ্ৰ যেদিন আসে, তার সঙ্গে থাকে আরও তিন চারজন কুমার, তারা শুধু সঙ্গেই আসে, শশিভূষণের কাছ থেকে কোনোরকম পাঠ নিতে তারা সরাসরি অস্বীকার করে। আবার দৈবাৎ যদি একই সমরেন্দ্ৰচন্দ্র ও উপেন্দ্র এসে পড়ে, তখন বোঝা যায়। ওদের মধ্যে বাক্যালাপ নেই, দু’জনে ঘাড় গোঁজ করে চেয়ে থাকে দু’ দিকে। একদিন শুধু দুই ভাই একত্রে গলা মিলিয়ে এক বিষয়ে প্রতিবাদ করেছিল।

এখানকার একটি কিশোরকে শশিভূষণের বিশেষ পছন্দ। চীনেবাদামের মতন গায়ের রং, সুঠাম চেহারা, চক্ষুদুটি যেন কাজল টানা, এই ছেলেটির নাম ভরত। প্রথম প্রথম এসে শশিভূষণ দেখতেন, এই ছেলেটি তাঁর কাছাকাছি ঘুরঘুর করে। দীনহীনের মতন বেশবাস দেখে শশিভূষণ ভেবেছিলেন, ছেলেটি বুঝি বাগানের মালী।একদিন জানাল দিয়ে লক্ষ করলেন, ছেলেটির হাতে একটি বই, সে একটা কাঁঠাল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে কী যেন পড়ছে।

একটি ছাত্র পাবার সম্ভাবনায় পুলকিত হয়ে শশিভূষণ হাতছানি দিয়ে তাকে কাছে ডাকলেন। ছেলেটি জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। শশিভূষণ বললেন, তুমি পড়াশুনা কর। ভেতরে এসো, ভেতরে চলে এসো।

ছেলেটি করুণভাবে বলল, না গো মাস্টারবাবু, বিধান নেই। আমি কুমার নয় গো।

শশিভূষণ তবু জোর করে তাকে কক্ষের মধ্যে আনতে যাচ্ছিলেন, তখন মনে পড়ল, তাকে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে যে, রাজকুমার ছাড়া অন্য কারুর এখানে প্রবেশ নিষেধ। সাধারণ ছাত্রদের জন্য আগরতলার নয়া হাভেলিতে একটা ইস্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে।

শশিভূষণ নিজেই বাইরে বেরিয়ে এলেন। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার হাতে ওটা কী বই, দেখি?

সেখানা হাতে নিয়ে শশিভূষণ চমৎকৃত হলেন। মলিন, ছিন্নদশা সেই বইটি আসলে বঙ্গদর্শন পত্রিকার একটি পূর্ণ সংখ্যা। সামান্য একটা হেঁটো ধুতি পরা, খালি গায়ের এই কিশোরটি বঙ্গদর্শনের পাঠক? এও কি সম্ভব? রাজকুমারেরা প্রায় কেউই যুক্তাক্ষর ঠিক মতন পড়তে পারে না।

তিনি বললেন, কী হে, এ বই নিয়ে তুমি কী করছ? তুমি অ-আ-ক-খ পড়তে জান?

পত্রিকা রইল শশিভূষণের হাতে, ছেলেটি চক্ষু বুজে। মুখস্থ বলতে লাগল, “ভারতবর্ষে তাহাদের ঐশ্বৰ্য অতুল। অদ্যাপিও তাহার তুল্য বিভব তারতে কাহারও নাই। এক্ষণে ভারতবর্ষে এমন বণিক কে আছে যে কথায় কথায় কোটি মুদ্রার দর্শনী হুণ্ডীর টাকা নগদ ফেলিয়া দেন? যখন মীরহবিব মুর্শিদাবাদ লুঠ করিয়াছিল, তখন সে জগত শেঠের ঘর হইতে দুই কোটি কেবল ‘আরকাটি’ টাকা লইয়া গিয়াছিল- দেশী টাকার কথায় কাজ কী? সেই দুই কোটি টাকা তাহাদিগের তৃণ বলিয়া বোধ হয় নাই – তাহারা পূর্ববৎ নবাবকে এক একবারে কোটি মুদ্রা দর্শনী দিতে লাগিলেন…”

শশিভূষণের বিস্ময়ের অবধি রইল না। পদ্যও নয়, বঙ্কিমের চন্দ্ৰশেখর উপন্যাস থেকে সঠিক মুখস্থ বলছে ছেলেটি। শশিভূষণর এমন কখনো দেখেননি। বইপত্রের অভাব বলে এই একটি পত্রিকাই ছেলেটি বার বার পড়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে শশিভূষণের অল্পস্বল্প পরিচয় আছে। তিনি তৎক্ষণাৎ ঠিক করলেন, বঙ্কিমবাবুকে এই ঘটনাটা চিঠি লিখে জানাবেন। বঙ্কিমবাবু নিশ্চয়ই কল্পনাই করতে পারেন না যে, এই সুদূর পাণ্ডববর্জিত দুৰ্গম পাহাড়-জঙ্গলের দেশে তাঁর এমন এক নিবিষ্ট পাঠক আছে, যে দাঁড়ি-কমা সমেত তাঁর ভাষা কণ্ঠস্থ করেছে। এরকম পাঠক পাওয়া যে কোনও লেখকের পক্ষেই ভাগ্যের কথা।

শশিভূষণর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার কাছে পড়তে শিখলে?

ছেলেটি নতমুখে লাজুক স্বরে বলল, নিজে নিজে শিখেছি। ভালো পারি না। অনেক কথা বুঝি না। ‘আরকটি’ টাকা মাস্টারবাবু?

শশিভূষণ ঠিক করলেন, রাজকুমার নয় বলে এই কিশোরটি তাঁর পাঠশালায় প্রবেশের অধিকার পাবে না বটে, কিন্তু বাইরে গাছতলায় বসে একে পড়াতে তো কোনও বাধা নেই!

সত্যিকারের আগ্ৰহী ছাত্র পেলে সব শিক্ষকই খুশি হন। পর পর কয়েকদিন ছেলেটির সঙ্গে গাছতলায় বসে। শশিভূষণ বুঝতে পারলেন, এ ছেলেটি মেধাবী তো বটেই, আগরতলার এই ছোট গণ্ডির বাইরে যে বিপুল বিশ্ব, সে সম্পর্কেও তার অশেষ কৌতূহল। মাত্র দু’তিনখানি বই মুখস্থ করে সে বাংলা লেখাপড়া শিখেছে, কিন্তু সেই বইয়েরই কিছু কিছু শব্দের সূত্র ধরে সে ইতিহাস-ভূগোল সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে।

ছেলেটির সঙ্গে মিশে শশিভূষণ উপলব্ধি করলেন, মানুষের জীবনের গতি-প্রকৃতি কী দুর্বোধ্য। রাজকুমারদের শিক্ষার জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে, তবু তাদের পড়াশুনোয় মন নেই, পাঠশালাটি রোজ খুলে রাখা পরিহাসের মতন মনে হয়। অথচ, অজ্ঞাতকুলশীল, অন্নদাস, এক ভৃত্যের আশ্রয়ে থাকা এই ছেলেটির এত জ্ঞানের স্পৃহা হয় কী করে! অনাদৃত, স্নেহমমতা বঞ্চিত, রুদ্ধশ্বাস জীবন থেকে মুক্তির স্বাদ পাবার এই একটিই উপায়। কিন্তু আরও তো কত বালক এরকম জীবন কুটায়, তারা তো বইয়ের পৃষ্ঠায় মুক্তি খোঁজে না। ভরত অবশ্য নিজের সম্পর্কে বলতে চায় না কিছুই। নানা প্রশ্ন করে শশিভূষণ শুধু এইটুকু জেনেছেন যে, রাজবাড়ির পিছনে ভৃত্যমহলে সে থাকে, এক বৃদ্ধ ভৃত্য তাকে খেতে পরতে দেয়, তার বাবা-মা নেই।

গত বছর শীতকালে শশিভূষণ। এই ছেলেটিকে শিক্ষাদান শুরু করেছিলেন, তারপর এসে গেল ঝড়-বৃষ্টির দিন। তখন আর গাছতলায় বসা যায় না। এদিকে দিনের পর দিন পাঠশালা ঘর থাকে শূন্য। এই উৎকট ব্যবস্থা সহ্য করতে না পেরে একদিন শশিভূষণ জোর করে ছেলেটিকে ভেতরে নিয়ে এলেন। এই কয়েক মাসেই সে ইংরেজি বর্ণমালা লিখতে শিখে গেছে। সূর্য-চন্দ্র ও অন্যান্য গ্ৰহ নক্ষত্রের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ক বুঝেছে। শশিভূষণ তাঁকে নিজের সংগ্রহের বইপত্র পড়তে দেন, সে যখন জোরে জোরে কোনও কবিতা পাঠ করে, শশিভূষণ মুগ্ধ হয়ে যান। তাঁর শিক্ষকতার এমন প্রত্যক্ষ সার্থকতার নিদর্শন আর হয় না। এখানকার সকলেরই উচ্চারণে কুমিল্লা অঞ্চলের বাঙালি টান আছে, রাজকুমাররা কেউ তালব্য শ বলতেই পারে না, তারা “শোভা’-কে বলে “হোবা’, কিন্তু এই ছেলেটির উচ্চারণ একেবারে নিখুঁত।

শশিভূষণ তাকে সংস্কৃত ভাষায় দীক্ষা দিলেন। বিদ্যাসাগরমশাই সরল সংস্কৃত ব্যাকরণ প্রকাশ করেছেন, এখন দেবনাগরী না জেনেও সংস্কৃত শিক্ষা শুরু করা যায়।

একদিন শশিভূষণ পাঠশালায় মন দিয়ে ছেলেটিকে পড়াচ্ছিলেন, এমন সময় দৈবাৎ সেখানে রাজকুমার সমরেন্দ্ৰচন্দ্র উপস্থিত হল। সমরেন্দ্রর সঙ্গে রয়েছে সুখচন্দ্র, সে তার খুল্লতাত পুত্র, সেই সুবাদে সেও রাজকুমার। সুখচন্দ্ৰ শশিভূষণের প্রিয় ছাত্রটিকে দেখেই বলল, এই ভরত, তুই এখানে কী করছিস ; যা, বাইরে যা।

ভরত সঙ্গে সঙ্গে বইখাতা গুছিয়ে উঠে যাচ্ছিল, কিন্তু শশিভূষণ বাধা দিয়ে বললেন, থাক না। ও থাকলে তোমাদের অসুবিধের কী আছে!

একটু পরেই সদলবলে এলো উপেন্দ্র। সে আসন গ্ৰহণ না করেই ভ্ৰকুঞ্চিত করে ঘৃণার সঙ্গে বলল, ভরতকে কে এখানে আসতে দিয়েছে! এই ভরত, দূর হয়ে যা। মাস্টারবাবু, ভরত এখানে থাকলে আমি বসব না।

সমরেন্দ্ৰচন্দ্ৰ উঠে দাঁড়িয়ে রাগত স্বরে বলল, আমি ভরতকে এখানে আসতে বলিনি। ভরত থাকলে আমিও পড়ব না।

শশিভূষণ যথেষ্ট বিরক্ত হলেও শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ও তো তোমাদের কোনও বিঘ্ন সৃষ্টি করেনি। তোমরা এত উত্তেজিত হচ্ছে কেন!

উপেন্দ্ৰ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, কাছুয়ার ছেলে। ও ব্যাটার এত সাহস হল কী করে। আমাদের সামনে ওর বসে থাকার হুকুম নেই।

শশিভূষণ আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না, ভরত এর মধ্যেই এক ছুটে বেরিয়ে গেছে।

কাছুয়ার ছেলে! অর্থাৎ ভরতের মা ছিলেন রাজার রক্ষিতা, কিন্তু রাজার ঔরসে তার জন্ম তো বটে, তা হলে সেও রাজকুমার। বিয়ের মন্ত্র পড়া হয়নি বলেই তার জন্মটা অশুদ্ধ হয়ে গেল! শশিভূষণ শুনেছেন যে, ত্রিপুরায় কাইজাগনানী, হিকনানানী, শান্তি — ইত্যাদি নানা রকম বিবাহের প্রথা আছে। এর মধ্যে কোনও কোনও বিয়েতে মন্ত্রও লাগে না, মালা বদল করলেই হয়। মহারাজ বীরচন্দ্র ভরতের অকালমৃতা মাকে যখন ধন্য করেছিলেন, তখন কি একদিনও তাঁর গলায় একটা মালাও পরিয়ে দেননি!

অন্য কুমারদের ভরতের প্রতি রাগের কারণও তিনি বুঝলেন। সিংহাসনের দাবিদার বৃদ্ধির প্রশ্ন তো আছেই, তা ছাড়াও যে সব রাজকুমার সিংহাসন পায় না, ক্রম অনুসারে তাদের রাজকোষ থেকে মাসহারা দেবার ব্যবস্থা হয়। অনেকে মিলে ভাগ বসালে সেই মাসহারাও কমে যায়। কাছুয়ার সন্তান তাই অপাংক্তেয়।

একটি আকস্মিক মিল খুঁজে পেয়ে শশিভূষণ বেশ কৌতুক বোধ করলেন। শকুন্তলার সঙ্গে রাজা দুষ্মন্তেরও তো মন্ত্র পড়ে বিবাহ হয়নি, মিলন হয়েছিল গান্ধৰ্ব মতে। কিন্তু শকুন্তলার সন্তান ভরতকে তো কেউ জারজ বলে না। সেই ভরত প্রেমের সন্তান। এই ভরতই বা রাজকুমারের স্বীকৃতি পাবে না কেন?

পরদিন থেকে ভরত পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, শশিভূষণ তাকে ধরে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভরত দারুণ ভিতুর মতন প্রবলভাবে মাথা নাড়ে। তার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা আছে, আরও অল্প বয়েসে সে রাজকুমারদের কাছে অনেক চড়-চাপড় খেয়েছে। তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে বহুদিন আগে, মাকে তার মনেই নেই, মহারাজও তাকে চেনেন না। ভৃত্যমহলে ঠাই না পেলে তাকে পথের ভিখারি হতে হতো। তার ধারণা, সে এখন পিতৃপরিচয় দিতে গেলে রাজকুমারদের চ্যালা-চামুণ্ডারা তাকে খুনই করে ফেলবে।

শশিভূষণ বললেন, তুমি স্বয়ং মহারাজকে গিয়ে ধরো। আর কিছু চাইতে হবে না, তুমি শুধু এই পাঠশালায় এসে শিক্ষা নেবার অধিকার চাও। তুমি রাজকুমার, তোমার সে অধিকার থাকবে না কেন? মহারাজ অনুমতি দিলে আর কেউ তোমাকে ঘাটাতে সাহস পাবে না।

এক প্রবল বর্ষার সকালে মহারাজ বীরচন্দ্র এসেছিলেন এই পাঠশালায়। তিনি ইচ্ছে করলেই যখন তখন শশিভূষণকে তলব করতে পারেন, তবু খামখেয়ালি মহারাজ বৃষ্টি ভিজে একা চলে এসেছেন। আগের রাত্রি তিনি একটা গান রচনা করেছেন, সেটা শশিভূষণকে দেখাতে চান। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর মহারাজ যখন আবার চলে যাচ্ছেন, তখন দ্বারের বাইরে তাঁর পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল ভরত।

মহারাজ চমকিত হয়ে বললেন, আরে, এটা কে? এটা কে?

শশিভূষণের শেখানো মত ভরত দীন নয়নে চেয়ে বলল, মহারাজ আমি আপনার অধম পুত্র, আমার নাম ভরত। আমি আপনাকে প্ৰণাম করারও সুযোগ পাই না, দেওতা!

ভরতের মুখ মহারাজের অপরিচিত। তবু সে তাঁর আত্মজ শুনেও তিনি তেমন অবাক হলেন না। স্মিতমুখে সুদৰ্শন কিশোরটির দিকে চেয়ে থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোর মায়ের নাম কী রে?

ভরত যুক্ত হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, আমার মা স্বর্গে গেছেন। তার নাম ছিল কিরণবালা, দেওতা।

মহারাজ ঊর্ধনেত্র হয়ে ক্ষণকাল চিন্তা করলেন। এ ছেলেটির মা খুব সম্ভবত আসামের কন্যা। আসামের সন্তানেরা পিতাকে দেবতা বলে সম্বোধন করে। কিরণবালা, কিরণবালা। নামটা একবারে অপরিচিত নয়, একটা অস্পষ্ট মুখও মনে পড়ছে, কেন মনে পড়ছে, অনেককাল আগে হারিয়ে যাওয়া এক নারী, সে রানীও ছিল না, তবু যেন মনে পড়ে, সে হি হি করে খুব হাসত, মনে আছে সেই হাসির জন্যই। হ্যাঁ, সেই কিরণবালা একটি সন্তানের জন্ম দিয়েই মারা গিয়েছিল বটে।

অবৈধ সন্তানের প্রতিও মহারাজের কিছুটা-দুর্বলতা আছে। এরা তার পৌরুষের জীবন্ত প্ৰমাণ। ভরতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ওঠ। তুই কী চাস আমার কাছে?

ভরত চুপ করে রইল।

তখন অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে শশিভূষণ বললেন, মহারাজ, এ ছেলেটি পাঠে বড় মনোযোগী। এর মধ্যেই যথেষ্ট লেখাপড়া শিখেছে। সুযোগ পেলে অনেক উন্নতি করতে পারে।

মহারাজ হেসে বললেন, শালুকের মধ্যে পদ্মফুল নাকি? তা লেখাপড়া শিখতে চায় শিখুক। মাস্টার, যদি পার তো শুধুমাত্র ইংরেজি পড়িয়ে দাও। পলিটিকাল এজেন্টের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে যদি সক্ষম হয়, ওকে আমি চাকরি দেব।

মহারাজের অনুমতি পাবার পর ভরতের অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটে গেল। পাঠশালায় বসার অধিকার তো সে পেলই, তা ছাড়া ভৃত্যমহল থেকে সরিয়ে এনে তাকে দেওয়া হল সচিব মহোদয়ের বাড়ির একটি ঘর। রাধারমণ ঘোষ এই ছেলেটির কথা জানতে পেরে তাকে এক জোড়া পরিধেয় বস্ত্ৰ কিনে দিলেন এবং মাসিক দুশ টাকা বৃত্তিরও ব্যবস্থা হয়ে গেল। বিদ্যোৎসাহী রাধারমণ নিজে একদিন ভরতকে পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে উপহার দিলেন দু’খনি বাংলা বই।

ভরত এখন শশিভূষণের পাঠশালার নিয়মিত ছাত্র হলেও সে অন্য রাজকুমারদের সঙ্গে বসতে চায় না। বাল্যকাল থেকেই তার মনে ভয় বাসা বেঁধে আছে। সে উদ্ধত, দুঃশীল রাজকুমারদের মুখোমুখি হতে সাহস পায় না, তাদের এড়িয়ে চলে। শশিভূষণও অন্যদের অনুপস্থিতিতেই ভরতের সঙ্গে সময় কাটাতে আনন্দ পান।

শুধু বিদ্যাদানই নয়, শশিভূষণ ভরতের মনোজগতে যে কী বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছেন তা তিনি নিজেও জানেন না। হঠাৎ যেন এই পৃথিবীটা দারুণ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছে তার কাছে। এক এক সময় অকারণেই তার গা ছমছম করে। তার বিশ্বাস ও ধ্যান ধারণায় প্রবল নাড়া লেগেছে। শশিভূষণ তো শুধু বই পড়ান না, আরও অনেক কথা বলেন। এই পৃথিবীর নীচে পাতাল কিংবা নরক নেই, আকাশেও কোথাও নেই স্বর্গ। নরক আর স্বৰ্গ আছে শুধু মানুষের মনে। মানুষই ইচ্ছে করলে নিজের মনটাকে নরক থেকে স্বর্গে রূপান্তরিত করতে পারে। ভরত জিজ্ঞেস করেছিল, স্বর্গ তা হলে কোথায়? ঠাকুর-দেবতারা কোথায় থাকেন? তা শুনে শশিভূষণ হেসেছিলেন। যখনই ঠাকুর-দেবতার প্রসঙ্গ ওঠে হেসে ওঠেন শশিভূষণ, শুধু একদিন মা কালীর কথা শুনে রেগে উঠলেন। তারপর উচ্চারণ করলেন একটি সাঙ্ঘাতিক কথা।

এখানকার কালীবাড়িতে এক রাত্রে চোর এসেছিল। সোনার গয়না খুলে নেবার জন্য যেই সে চাের মায়ের মূর্তির গায়ে হাত দিয়েছে অমনি মায়ের চোখ থেকে আগুন জ্বলে উঠল। আর্ত চিৎকার করে সেই চোর ছিটকে গিয়ে পড়ল। মন্দিরের বাইরে, ধড়ফড় করতে করতে সেখানেই সে মারা গেল। কয়েকদিন ধরে রাজধানীতে এই কাহিনীই বলাবলি করছে সবাই। কট্টর ব্রাহ্ম শশিভূষণ এই সব গালগল্প সহ্য করতে পারেন না। ভরত মহা উৎসাহে এই ঘটনাটা শশিভূষণকে শোনাতে যেতেই তিনি তীব্র ভৎসনার সুরে বলেছিলেন, ওসব কথা আমার সামনে কক্ষনও উচ্চারণ করবে না। লেখাপড়া শিখছ, নিজে চিন্তা করতে শেখে। মাটির মূর্তির চোখে কখনও আগুন জ্বলতে পারে? পুরুতরা মিথ্যে কথা ছড়িয়েছে। শুধু এই পর্যন্তই নয়, শশিভূষণ আরও বলেছেন যে কালী, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর মূর্তিগুলি শুধু পুতুল। ঠাকুর-দেবতা বলেই কিছু নেই। এই বিশ্বের স্রষ্টা শুধু ঈশ্বর, তিনি নিরাকার, তার বউ, ছেলে-মেয়ে থাকতে পারে না।

পড়াশুনোর সময় ছাড়া অন্য সময় ভরত কমলদিঘির ধারে ঝোপঝাড়ের মধ্যে একা একা শুয়ে বসে থাকে। তার কোনও বন্ধু নেই। ভৃত্যমহলে তবু আগে দু’চারজনের সঙ্গে তার ভাব ছিল, এখন আধা-রাজকুমার পদে উন্নীত হওয়ায় তারা আর তার সঙ্গে কথা বলতে চায় না, পুরো-রাজকুমাররাও তার সঙ্গে মেশে না। ঝোপের মধ্যে শুয়ে ভরত এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। এতদিন জানত যে, আকাশের ওই নীল যবনিকার ওপরে আছে স্বৰ্গ, সেখানে কোথাও রয়েছেন তার দুঃখিনী মা। কিন্তু মাস্টারমশাই বলেছেন, স্বর্গ বলেই কিছু নেই, তা হলে মা কোথায়? মা কালী বলেও কেউ নেই? মাস্টারমশাই অত বিদ্বান, তিনি কি মিথ্যে কথা বলবেন? অথচ, মা কালী নেই, একথা ভাবলেই ভয় হয়। যেন অলক্ষ্যে কোথাও থেকে মা কালী ভরতকে দেখছেন, তিনি যদি রাগ করেন…। কোথায় থাকেন নিরাকার ঈশ্বর? কোনও দিন চোখে দেখা না গেলে মানুষ তাঁকে ডাকে কেন?

হঠাৎ কার পায়ের আওয়াজ পেয়ে চমকে পেছনে তাকাল ভরত। তার বুক ধক ধিক করছে। মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনেও তার বিশ্বাস কিংবা আতঙ্ক যায়নি। এবার বুঝি সত্যিই মা কালী আসছেন তাকে শাস্তি দিতে। সে দেখতে পেল একটি কিশোরীকে। তাতেও তার শঙ্কা গেল না, কারণ সে জানে যে ঠাকুর দেবতারা ইচ্ছে করলেই নানা রকম রূপ ধরতে পারেন। আর একটু কাছে আসার পর দেখা গেল বারো-তেরো বছরের একটি মেয়ে, কোনও কমে গায়ে একটা শাড়ি জড়িয়ে আছে, আলুথালু, চোখ দুটিতে ঝিকঝিকে দুৰ্গতি, ওষ্ঠে ভিজে ভিজে হাসি মাখানো।

বিস্ফারিত নয়নে চেয়ে রইল ভরত। মেয়েটি কাছে এসে বলল, অ্যাই, তুই কে রে? এখানে কী করছিস?

ভরত কোনও উত্তর দিতে পারল না। দেবী না মানবী, এখনও সে যেন ঠিক বুঝতে পারছে না। এখন দ্বিপ্রহর, চতুর্দিক সুনসান। রাজবাড়ির এলাকার বাইরে কেউ হুট করে আসতে পারে না, রাজবাড়ির কোনও কিশোরীর এরকম প্রকাশ্যে বাইরে আসার প্রশ্নই ওঠে না।

উত্তর না পেয়ে মেয়েটি আবার বলল, ও বুঝেছি। তুই সেই নতুন রাজকুমার হয়েছিস, তাই না? আগে দাসীর ছেলে ছিলি। হি-হি-হি-হি। লব কাত্তিক। রাজকুমার হয়েছিস তো চুল আঁচড়াসনি কেন?

ভরত এবার আড়ষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কিশোরী অনেকখানি জিভ বার করে বলল, তোর ইয়ে। তুই আমাকে চিনিস না? আমি খুমন। না, না, আমার আর একটা ভালো নাম আছে। মনোমোহিনী। তুই গাছে উঠে জামরুল পাড়তে পারিস?

মহাদেবী ভানুমতীর ভগিনী-কন্যা মনোমোহিনীকে আগে দেখেনি ভরত। রানীদের মহলে সে যায়নি কোনোদিন। প্রাসাদের বাইরে ঘোরাফেরা করা নারীদের নিষিদ্ধ। কিন্তু মনোমোহিনী মণিপুরের কন্যা। মণিপুরের মেয়েরা পুরুষদের মতনই স্বাধীনতা পায়, প্রকাশ্য রাস্তায় পুরুষদের সঙ্গে কথা বলাতেও কোনও বাধা নেই। বরং পুরুষদের সঙ্গে রঙ্গ রসিকতা করার জন্য মণিপুরের কন্যারা বিখ্যাত। আগরতলায় এসে এত নিষেধের ঘেরাটোপের মধ্যে পড়ে মনোমোহিনী ছটফট করে। কখনও কখনও সে বেরিয়ে পড়ে খাঁচা খোলা পাখির মতন। মুক্ত বাতাসে তার শরীরে তরঙ্গ জাগে।

কাছেই একটা বড় জামরুল গাছ। ফুল ঝরে সবে মাত্র গুটি এসেছে, ফল এখনও খাওয়ার উপযোগী হয়নি। মনোমোহিনী সেই গাছতলায় দাঁড়িয়ে বলল, এই লব। কাত্তিক, আমায় ক’টা জামরুল পেড়ে দে না।

ভরত-দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, আমি গাছে উঠতে পারি না।

মনোমোহিনী চোখ ঘুরিয়ে বলল, তা হলে তুই কী পারিস? পাখি শিকার করতে জানিস।

ভরত এবারও দু’দিকে মাথা দোলাল। সে বুঝতে পেরেছে যে, এ মেয়ে মানবীই বটে, তবু এর সংসর্গ তার পক্ষে বিপজ্জনক। এমন নির্জন দুপুরে বাগানের মধ্যে কোনও বালিকার সঙ্গে কথা বলার তো রীতি নেই। কেউ যদি দেখে ফেলে, তবে তাকেই দোষ দেবে।

মনোমোহিনী বলল, আয়, গাছে চড়া শিখবি? আমি শিখিয়ে দেব।

ভরত চঞ্চলভাবে তার দিকে চেয়ে রইল।

শাড়িটা ভালো করে জড়িয়ে গাছকোমর করে বেঁধে নিল মনোমোহিনী। একটা পা হাঁটু পর্যন্ত রইল, সেদিকে তার খেয়াল নেই, পিঠ একেবারে নগ্ন। সে বেশ সাবলীলভাবে জামরুল গাছ বেয়ে উঠতে লাগল, খানিকটা উঠে বলল, এবার আয়, আমার হাত ধর…

নির্নিমেষে সে দিকে চেয়ে রইল। ভরত। যেন একটা ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে বাস্তবতা। সে যেন এখানে আর উপস্থিত নেই, সে দেখতে পাচ্ছে বইয়ের পৃষ্ঠার কোনও কাহিনী। এই মনোমোহিনী যেন বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের কোনও নারী। শৈবলিনী? কিন্তু সে তো প্ৰতাপ নয়, সে ভরত, তার বুকের মধ্যে দুম দুম শব্দ হচ্ছে, জ্বালা করছে তার কান দুটি। এই দৃশ্যটিতে সে অনুপযুক্ত।

সে উঠে অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করল।

মনোমোহিনী নির্দ্বিধায় চেঁচিয়ে উঠল, এই, এই, কোথায় যাচ্ছিস। এই লব কাত্তিক, পালাচ্ছিস কেন? আয়, শিগগির আয়, নইলে আমি নেমে গিয়ে তোর কাছা খুলে দেব।

এবারে জোরে ছুটি দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে গেল ভরত।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়