গায়ক বাজনাদাররা ঘুমে ঢুলে পড়েছেন, শ্ৰোতা আছেন জেগে। এসরাজি আর তবলিয়ারা ক্লান্ত, কিন্তু শ্রোতাটির ক্লান্তি নেই। রাত্রি ভোর হয়ে এসেছে, পুব দিগন্ত রাঙা, ছোট ছোট পাখিরা বেঁচে আছি, বেঁচে আছি রবে বিস্ময়ের কিচির মিচির শুরু করেছে। মহারাজ বীরচন্দ্ৰ বলে উঠলেন, এ কী, খাঁ সাব, লয় খামতি হচ্ছে কেন?

ওস্তাদ নিসার হোসেন বীণা যন্ত্রটি মেঝেতে নামিয়ে রেখে সেলাম জানিয়ে বললেন, মাফি মাঙছি, মহারাজ, আঁখ বুজে আসছে আমার।

মহারাজ বীরচন্দ্রের অসাধারণ জীবনীশক্তি, টানা দু’তিন দিন ও রাত একটুও না ঘুমিয়ে তিনি তাজা থাকতে পারেন। গান বাজনা শোনার নেশা যখন তাঁর জাগে, তখন একটানা সুর চলতেই থাকবে, ওস্তাদদের তিনি থামতে দিতে চান না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা হার মেনে যান। বীরচন্দ্রের এই জেগে থাকার ক্ষমতার একটি কারণ, তিনি মদ্যপান করেন না। সঙ্গীতশিল্পীদের প্রায় সকলেরই পান-অভ্যেস আছে, সঙ্গীতের আসরে স্বয়ং মহারাজ হাতে গেলাস ধরেন না বলে অন্য কেউ তাঁর সামনে সুরাপান করতে সাহস পান না, কিন্তু সবাই মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে আড়ালে কয়েক চুমুক দিয়ে আসেন। ক্রমে চুমুক ঘন ঘন হয় ও মাত্রা বাড়ে। মহারাজ তা বুঝেও না জানার ভান করেন, হাসেন মিটি মিটি, ওস্তাদের নেশা যত গাঢ় হয়, তিনি তাঁদের বেশি তারিফ করে আরও গাইতে বা বাজাতে বলেন। সুরার নেশায় প্রথম দিকে চাঙ্গা হয় সবাই, কয়েক ঘণ্টা পরে শিথিল হয়ে আসে স্নায়ু। মহারাজের নেশা ধূমপান, তিনি যখন যেদিকে মুখ ফেরান হুঁকো-বরাদর তৎক্ষণাৎ সেইদিকে নলটি বাড়িয়ে দেয়, তামাকের ধোঁয়ায় তাঁর চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে যায়।

প্রভাতের রাগ-রাগিণী আর শোনা হল না, শিল্পীরা সবাই ঢলে পড়েছে।

বীরচন্দ্র মজলিশ কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন, পূর্ব দিকের অলিন্দ্ৰে দাঁড়িয়ে প্ৰণাম করলেন জবাকুসুমসঙ্কাশ সূর্যকে। মন্ত্র উচ্চারণ করলেন না, গুনগুনিয়ে একটা গান ধরলেন ভৈরবী রাগিণীতে। তিনি সারা রাত জেগে আছেন, রাজপ্রাসাদে মহারানী ভানুমতীও জেগে ছিলেন তাঁর অপেক্ষায়। সে কথা মনে পড়তেই বীরচন্দ্রের গান থেমে গেল। তিনি অলিন্দের রেলিং ধরে ঝুঁকে রক্ষীদের উদ্দেশ্য বললেন, ওরে কে আছিস দেউড়ি বন্ধ করে রাখবি, কেউ যেন ভেতরে না আসে, আজ সারা দিন আমার সঙ্গে কারুর দেখা হবে না!

বীরচন্দ্ৰ জানেন, তেজস্বিনী ভানুমতী নীরবে সহ্য করবেন না, একটু পর থেকেই ঘন ঘন দূত পাঠাবেন। এ রাজ্যে একমাত্র রানী ভানুমতীই এত্তেলা দিতে পারেন মহারাজকে।

প্রাসাদ থেকে খানিকটা দূরে এই বাগানবাড়িটি মহারাজের বিশেষ প্রিয়। মাঝে মাঝে দরবারে না গিয়েও তিনি দিনের পর দিন এখানে কাটান। গান-বাজনা শোনা, ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি এবং নিজের লেখালেখির কাজ, সবই এ বাড়িতে। যখন তিনি নিজের কোনও শখে নিমগ্ন থাকেন, তখন দু’তিনজন ঘনিষ্ঠ বয়স্য মাত্র থাকে তার কাছাকাছি, এ ছাড়া শত জরুরি কাজ থাকলেও কেউ তাঁর সঙ্গে সে সময় দেখা করতে পারে না। লোকের মুখে মুখে এই বাগানবাড়িটির নাম ‘মানা-ঘর’। এই নামকরণের অবশ্য আর একটি কারণও আছে।

দোতলার কয়েকখানি ঘরে যে কত রকম জিনিস ছড়িয়ে আছে, তার ইয়ত্তা নেই। সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যায় না, কারণ কোনও জিনিসেই মহারাজ অন্য কারুকে হাত দিতে দেন না। একটি ঘরে রয়েছে গান-বাজার যন্ত্রপাতি, রুপোর বাঁয়া-তবলা, সোনার কাজ করা পাখোয়াজ, আলমারিতে প্রচুর কাচের গেলাসের সঙ্গে সোনা-রুপোর প্লেট, এক দেওয়ালের পাশে একটি টেলিস্কোপ। অন্য একটি ঘরের দেওয়ালে নানা রকম বন্দুক ও তলোয়ার, একটি সম্পূর্ণ হাতির দাঁতের চেয়ার, একটা পুরনো মেহগনির টেবিলের ওপর রাখা একটি সদ্য নতুন মাইক্রোস্কোপ, মেঝেতে ছড়ানো কয়েকটি অপেরা গ্লাস, দামি দামি কার্পেট এখানে সেখানে গুটিয়ে রাখা, বারান্দায় পড়ে আছে একটি পিয়ানো, কয়েকটি ঝাড় লণ্ঠন খুলে একদিন পরিষ্কার করা হয়েছিল, আর ওপরে লাগানো হয়নি, কোথাও ইজেলে একটা ক্যানভাস চড়ানো, তার তলায় প্রচুর রঙের কৌটা, একটা নড়বড়ে টুলের ওপর বসানো আছে একটি অত্যাধুনিক সুইস ঘড়ি।

এই মানা-ঘরের পেছন দিকে ঘন অরণ্য। পাখিদের জীবনযাত্রা শুরু হয়ে গেছে পুরোপুরি, কয়েকটা ধূসর রঙের খরগোশ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এদিকে চলে আসে, এক একদিন সকালে চিত্রল হরিণের পালও দেখা যায়। বীরচন্দ্ৰ কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে রইলেন জঙ্গলের দিকে, তিনি গাছপালার শোভা দেখছেন না, বিশেষ কিছুই দেখছেন না, চেয়ে আছেন শুধু।

কাল রাতে যারা ভোজ খেতে এসেছিল, এখন তারা ফিরতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দল যাবে বিভিন্ন দিকে, কোনও দলের দু’একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এক এক জায়গায় শুরু হয়েছে কোলাহল। কিন্তু সেই সব আওয়াজ এই বাগানবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছোয় না।

বীরচন্দ্ৰ এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন প্রায় আধঘণ্টা, তারপর দু’হাত তুলে আড়মোড়া ভেঙে বললেন, আঃ!

ঠিক যেন প্রতিধ্বনির মতন একটু দূরে সেই রকম আঃ শব্দ শোনা গেল। বীরচন্দ্ৰ চমকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন।

বারান্দার এক কোণে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল এক ব্যক্তি। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল একটা কাপড়ের পুঁটুলি। সেই লোকটিও উঠে বসে আলস্য কাটাচ্ছে। হাড়-পাঁজরা সর্বত লম্বা-সিড়িঙ্গে চেহারা, খাড়া নাক, মাথায় কোঁকড়া বাবরি চুল, এই লোকটির নাম পঞ্চানন্দ। সে হাত তুলে মুখের সামনে তুড়ি দিতে বলল, হরি হে, দীনবন্ধু, পার করে এই ভবসিন্ধু!

পঞ্চানন্দকে বারান্দায় এমনভাবে রাত্রি যাপন করতে দেখে মহারাজ বিস্মিত হলেন না। পঞ্চানন্দের পক্ষে সবই সম্ভব। রাত্রিবেলা গানের আসরে তাকে দেখা গিয়েছিল বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকার ধৈর্য তার নেই। নেশার পরিমাণটি তার কিঞ্চিৎ বেশিই হয়েছিল মনে হয়। শুধু জলপথেরই নয়, স্থলপথেও নানান নেশায় সে আসক্ত। পঞ্চানন্দের ব্যবহার অনেকের কাছেই বেয়াদবি মনে হতে পারে, কিন্তু এই লোকটির প্রতি মহারাজের বেশ প্রশ্রয়ের ভাব আছে। সাধারণ পাঁচপেঁচি ধরনের গেরস্থ মানুষদের বিচিত্র প্রকৃতির ব্যক্তিই মহারাজকে আকর্ষণ করে বেশি।

মহারাজ সহাস্যে বললেন, কী হে, ভবসিন্ধু পার হবার জন্য এত ব্যস্ততা কিসের?

তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পঞ্চানন্দ মহারাজের প্রতি কুর্নিশের ভঙ্গি করে বলল, ব্যস্ত হব না? ভবসিন্ধুর ওপারেই তো স্বৰ্গ, সেখানে অপ্সরা-কিন্নরীরা ফুরফুরিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মিনি মাগনায় সোমরস, খালি খাও দাও আর ফূর্তি করো। শুধুশুধু আর এখানে পড়ে থেকে কী লাভ?

মহারাজ বললেন, এখানেও তোমার ওসব ফুর্তির খুব অভাব হয় বলে তো শুনিনি!

মুখ বিকৃত করে পঞ্চানন্দ বলল, মধুর অভাবে গুড়, বুঝলেন মহারাজ, এখানে সব এখো গুড়!

মহারাজ বললেন, গুড়ের কথা জানি না, শুনতে পাই তুমি ঋণ করে প্রচুর ঘি খাচ্ছো?

সঙ্গে সঙ্গে মুখের রেখা বদলে গেল, এবারে পঞ্চানন্দ এক গাল হেসে বলল, ঋণ করা টাকায় ঘি খাওয়ার স্বাদই আলাদা। সে সুখ আপনি কখনও পাবেন না, মহারাজ!

মহারাজ বললেন, আমার এ রাজ্যে ঋণ করলে কিন্তু শোধ দিতে হয়। নইলে যদি বিপদে পড়, আমি বাচাতে যাব না!

পঞ্চানন্দ বলল, বাঘ কি আর গায়ের চাকা বদলাতে পারে? গোটা জীবনটাই আমার চলছে বাটপাড়ি করে। দিব্যি চলেও যাচ্ছে।

পঞ্চানন্দ খাঁটি কলকাতার মানুষ। বছর কয়েক আগে হঠাৎ ত্রিপুরায় এসে উপস্থিত, কেউ তাকে আমন্ত্রণ করেনি, তবু সে এখানে দিব্যি মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসেছে, রাজ দরবারেও প্রবেশ অধিকার পেয়েছে। লোকে বলে, কলকাতায় বহু লোককে প্রতারিত করে, বহু টাকা ঋণ নিয়ে সে পালিয়ে এসেছে এখানে। স্বাধীন ত্রিপুরায় ব্রিটিশ আইন খাটে না, তার মহাজনরা এখানে টাকা উদ্ধার করতে পারবে না। পঞ্চানন্দের সঙ্গে একটি সুন্দরী স্ত্রীলোকও আছে, অনেকের মতে সে একজন পরস্ত্রী, তাকে নিয়ে এখানে ভোগে এসে সে ইংরেজের আইন ফাঁকি দিয়েছে।

মহারাজ বীরচন্দ্র অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। লোকটির বুদ্ধির প্রাখৰ্য আছে, কথাবার্তা চিত্তাকর্ষক, সেই জন্যই মহারাজ পঞ্চানন্দকে পছন্দ করেন। কিছু কিছু রাজকার্যেও তার পরামর্শ কাজে লাগে।

পঞ্চানন্দ জিজ্ঞেস করল, মহারাজের চা-পান হয়ে গেছে? এঃ হে, বড় দেরি হয়ে গেল!

বীরচন্দ্র বললেন, আমার হয়ে গেলেও ক্ষতি কী? তুমি চাইলে কি আবার দেবে না? সব ভৃত্যরাই তো দেখি তোমার খুব বশ!

পঞ্চানন্দ বলল, সে চা আর আপনার চা? আপনার দা-দাসীদের কারসাজি জানেন না? আপনার জন্য অতি উত্তম দামি চা। আর আমরা চাইলে অতি নিরেশ কালিকুষ্ঠি ট্যাসটেসে চা। সেইজন্যই তো বলছিলুম, আপনার সঙ্গে খেলে ভালো জিনিসটার সোয়াদ নিতে পারি!

মহারাজ বললেন, পলিটিকাল এজেন্ট সাহেবের সাকরেদ উমাকান্তবাবু যে আমার প্যালেসের চায়ের খুব সুখ্যাত করলেন।

পঞ্চানন্দ চোখ মুখ ঘুরিয়ে যাত্রা দলের সঙের ভঙ্গিতে বলল, কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা দিলেন, মহারাজ! চাঁদে আর গোদা বাঁদরের পোঁদে? উমাবাবু যে মইয়ে চড়ছেন! তাঁকে তো এখন মুখ-মিষ্টি থাকতেই হবে। সেই কলসিটির কথা শোনেন নি, যার ভেতরে বিষ, কানার কাছে পায়েস মাখানো?

মহারাজ বললেন, তা শুনেছি। কিন্তু মইয়ে চড়ছেন মানে কী?

পঞ্চানন্দ বলল, সোসিয়াল ল্যাডার ক্লাইম্ব করছেন। এই আমি বলে রাখলুম, পাঁচু মিত্তিরের কথা মনে রাখবেন, ওই পেটমোটা উমাকান্ত একদিন আপনার ঘাড়ে চাপবে।

মহারাজ একটুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গোঁফে তা দিতে লাগলেন। ইংরেজ সরকারের পলিটিকাল এজেন্ট এবং তাঁর দেশীয় সহকারি উমাকান্ত কিছুদিন যাবৎ জ্বালাতন শুরু করেছেন নানান ছুতোয়। স্বাধীন ত্রিপুরার অধিপতি হিসেবে তিনি ইংরেজ সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য নন, আবার ইংরেজদের সঙ্গে শক্রতাও করা চলে না। তাহলে তাঁর অবস্থাও অযোধ্যার নবাব ওয়াজির আলি শাহ’র মতন হয়ে যেতে কতক্ষণ। গায়ের জোরে ইংরেজরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।

যাক, সকালবেলাতেই এসব কটু কথা চিন্তা করে লাভ নেই।

মহারাজ ভৃত্যদের উদ্দেশ্যে হাঁক দিয়ে চায়ের কথা বলে দিলেন। তারপর ভেতরের একটি ঘরে ঢুকে বসলেন মহার্ঘ হাতির দাঁতের কেদারাটিতে। পঞ্চানন্দ হাঁটু গেড়ে বসল মেঝেতে জাজিমের ওপর।

মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, উমাকান্তের ওপর তোমার খুবই রাগ দেখছি। কলকেতায় তোমার প্রতিবেশী ছিল নাকি?

পঞ্চানন্দ বলল, না, না, আমি অনেকদিন কলকাতাছাড়া। মাঝখানে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছি ফরাসডাঙ্গায়। আসল কথা জানেন কি, মহারাজ, ইংরেজদের তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু ইংরেজের তল্পিদার কিছু কিছু দিশি বাবুদের ঢলনেপনা অসহ্য। ওদের চাটুকারিতার শেষ নেই। ইংরেজদের পক্ষে ওকালতি করে ওরা স্বদেশীয় একটা রাজ্যের ক্ষতি করতে চায় কোন আক্কেলে?

মহারাজ বললেন, কিছু মনে করো না পঞ্চানন্দ, আমার আদিবাসী প্রজাদের মধ্যে যতটা আত্মসম্মান জ্ঞান আছে, তোমাদের অনেক বাঙালীবাবুদের তা নেই। কুকি, লুসাই, ত্রিপুরা জাতের লোকেরা সাহেব দেখলেও মাথা নিচু করে না, কিন্তু বাঙালীবাবুরা ঘাড় হেঁট করে হাত কচলায় আর হেঁ হেঁ করে।

পঞ্চানন্দ বলল, তা যথার্থ বলেছেন। তবে ব্যতিক্রম আছে।

মহারাজ বললেন, ব্যতিক্রম আছে বই কি! যেমন আমার সচিব ঘোষমশাই।

পঞ্চানন্দ নিজের বুক চাপড়ে বলল, আর একটি ব্যতিক্রম এই আমি! এক ব্যাটা লালমুখো টুপিওয়ালাকেও সোনা বলে পিতল বেচে চুপকি দিয়েছি।

মহারাজ বললেন, তুমি খুশি হবে শুনে যে, একদিন উমাকান্ত বেশ জব্দ হয়েছে। দরবারে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিল। আমার সেক্রেটারি বলল, ঠিক আছে, আসতে পারো। কিন্তু খালি পায়ে আসতে হবে। প্রথমে তো সে হ্যাট ম্যাট করে উঠল, বলল, অ্যাঁ, আমি ইংরেজ সরকারের কর্মচারী, পলিটিকাল এজেন্টের প্রতিনিধি! আমি যাব খালি পায়ে? ঘোষমশাই বলল, ইংরেজের কর্মচারী বলেই তো এক স্বাধীন হিন্দু রাজার দরবারে খালি পায়ে যেতে বাধ্য! তখন আর মুখে বাক্য নেই!

পঞ্চানন্দ বলল, বা, বা, বা, বেশ হয়েছে। বেশ হয়েছে! হামাগুড়ি দেওয়ালেন না কেন? ইংরেজগুলো যখন আসে, তখন কী করে? জুতো খোলে?

মহারাজ বললেন, খালি পায়ে কি সাহেব লোক এক পাও হাঁটতে পারে? ওদের সঙ্গে আমি দরবারে দেখা করি না। প্রাইভেট অডিয়েন্স হয়। সেখানে জুতো খোলার প্রশ্ন নেই।

পঞ্চানন্দ বলল, ঘোষমশাইয়ের এলেম আছে তো! উমাকান্তকে খালি পায়ে হাঁটিয়েয়ে। মাইকেল মধুসূদনের মতন সেও নাকি ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখে। বুট জুতো পরে বাহ্যে যায়। ধরাকে সারা জ্ঞান করে। হে-হে-হে-হে! আমি থাকলে বলতুম, মহারাজের দরবারে নাকে খৎ দিতে হয়!

মহারাজও হাসলেন। গোঁফে হাত বুলিয়ে আবার বললেন, তুমি ওকে ভালোই চেনো দেখছি। তোমার সঙ্গে কখনও সাক্ষাৎ বিরোধ হয়েছে নাকি?

পঞ্চানন্দ বলল, তেমন কিছু না। একবার মাত্র পনেরোটি টাকা হাওলাত চেয়েছিলুম, তাও ওই চশমখোরটা দেয়নি।

মহারাজ বললেন, হুঁ, টাকা ধার না দেওয়াটা খুবই অন্যায়। কিন্তু দেখো বাপু, আমার কাছে আবার ধারটার চেয়ে বসো না!

দু’জন ভৃত্য বড় একটা কাঠের পরাতে টি পট ও পেয়ালা-পিরিচ দিয়ে গেল। কোনও রকম খাদ্যদ্রব্য নেই, একটি রূপের জাগ ভর্তি বেলের পানার শরবত রয়েছে। চায়ের আগে তিনি প্রতিদিন প্রায় দু’গেলাস ওই শরবত পান করেন। পঞ্চানন্দ অবশ্য বেলের পানা ছুঁল না, তার মতে এতে নিরিমিষ্যি গন্ধ আছে।

চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এখন বাড়ি যাবে নাকি হে?

পঞ্চানন্দ একটা ছোট্ট হাই গোপন করে বলল, কাল যদুভট্ট মশাইয়ের আধখানা গান শুনতে শুনতে নিদ এসে গেল। আমার খুব জোরে নাসিকা গর্জন হয় বলে ঘর ছেড়ে চলে এসেছিলুম বারান্দায়। ‘ফিরায়ে দিতে এলে শেষে সঁপিলে নিজেরে’… আহা বন্দেশটি খাসা, শেষটুকুন না শুনে আজ আর যাচ্ছিনে।

মহারাজ বললেন, দরবারি কানাড়া, এই ফটফটে দিনের আলোয় তো সে গান শোনা যাবে না। রাত পর্যন্ত এখানেই থেকে যাবে? বাড়িতে একাকিনী বিরহিণী তোমার পথ চেয়ে আছে না?

পঞ্চানন্দ ঠোঁটের এক কোণে হেসে বলল, মাঝে মাঝে বিরহিণীকে অপেক্ষায় অপেক্ষায় উতলা করে রাখলে রসটা মজে ভালো।

মহারাজ ভুরু তুলে বললেন, বটে!

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি প্ৰাতঃকৃত্য সারতে যাব। তুমি যদি থেকেই যাও পঞ্চানন্দ, তা হলে এক কাজ করো। ছবির ঘরে গিয়ে রং গুলো রাখো। আজ পেইন্টিং করার সাধ হচ্ছে।

পঞ্চানন্দ বলল, আমাকেও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেতে হবে একবার। তবে রাজকীয় প্রাতঃকৃত্যে অনেক সময় লাগে, আমাদের মতন চুনোপুঁটির পাঁচ মিনিটেই হয়ে যায়।

ফটোগ্রাফির মতন চিত্র অঙ্কনেও মহারাজ বীরচন্দ্রের বেশ দক্ষতা আছে। রং-তুলি সব আসে কলকাতা থেকে। তিনি স্বয়ং কলকাতায় গিয়ে সাহেবপাড়ার নিলাম ঘর থেকে বিলাতি চিত্র কিনে আনেন। ক্যামেরার ব্যবহার বিষয়ে তিনি যেমন কুমারদের গৃহশিক্ষক শশিভূষণের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করেন, সেই রকম তেল-জল রঙে ছবি আঁকার সময় তিনি পঞ্চানন্দের সাহায্য পান। চপলমতি পঞ্চানন্দ যেন খেলাচ্ছলে অতি দ্রুত ফুটিয়ে তুলতে পারে মানুষ ও পশুপক্ষীর নিখুঁত রেখাচিত্র। মহারাজের তা দেখে মনে হয়, এ যেন ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা। একজন মানুষকে দেখে হুবহু তার অবয়ব কাগজে তুলতে ক’জন পারে? বাক্য-ছলনায় মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঋণ গ্ৰহণ করার বদলে চিত্র অঙ্কন করে পঞ্চানন্দ অনায়াসে জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। পিতা-মাতা কিংবা নিজেদের প্রতিকৃতি আঁকবার জন্য বড়মানুষেরা কত পয়সা খরচ করে। কিন্তু পঞ্চানন্দের সেদিকে কোনও মন নেই। সাধারণ কাগজের ওপর সে ইচ্ছে হলে ছবি আঁকে, সেগুলিকে ফেলে-ছড়িয়ে দেয়। বেশি মানুষকে নিজের অঙ্কনকৃতিত্ব দেখিয়ে তারিফ নেবার কোনও বাসনাও তার নেই। সে রকম প্রসঙ্গ উঠলেই সে ওষ্ঠ উল্টে বলে, না, না, এ সব দেখবার মতন কিছু নয়। তারপরই খ্যাস খ্যাস করে ছিঁড়ে ফেলে সদ্য আকা কোনও ছবি!

মহারাজ বীরচন্দ্রও অবশ্য নিজের আঁকা ছবি কিংবা ক্যানভাসের বড় পেইন্টিং অন্যদের দেখাবার ব্যাপারে কুণ্ঠিত। তাঁর রং-তুলি চালনা বিশুদ্ধ শখের ব্যাপার। নিষ্কলঙ্ক পটে একটি চিত্ৰ ফুটিয়ে তোলার আনন্দেই তিনি মশগুল। আস্তে আস্তে একটা ছবি তৈরি হওয়ার বিস্ময়টাই তিনি উপভোগ করেন। কখনও তাঁর এই বাগানবাড়িতে যদি সাহেব সুবোরা কিংবা বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আসে, তখন মহারাজের নির্দেশে ক্যানভাসগুলো সরিয়ে রাখা হয়, তিনি বাইরের লোকদের তাঁর শিল্পকীর্তি দেখাতে চান না।

বীরচন্দ্রের ছবির রেখা পঞ্চানন্দের মতন সাবলীল নয়। তাঁর পেইন্টিং ও উচ্চাঙ্গের শিল্প হিসেবে বাহবা পাবে না। কিন্তু নিজের আনন্দের জন্য যদি কেউ অপটু হাতেও ছবি আঁকে, তাতেই বা দোষ কী! যার কণ্ঠস্বর সুরেলা নয়, সে কি নিজের আনন্দের জন্যও গান গাইবে না? সব খেলায় সবাই জয়ী হয় না। কিন্তু হেরোরা যদি খেলতে না চায়, তাহলে তো কোনও খেলাই হবে না। মহারাজ তাঁর অন্য গুণপনাও জাহির করতে চান না পাঁচজনের কাছে। তিনি কবিতা রচনা করেন, কিন্তু সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা পাবার কোনও বাসনা নেই তার, শুধু ঘনিষ্ঠ দু’পাঁচ জনই সেই কবিতা পাঠ করে। তাঁর কণ্ঠস্বর প্রকৃত গায়কের মতন, কিন্তু অন্তরঙ্গদের কাছেও তিনি দু’এক পদ গান গেয়ে থেমে যান। একমাত্র মহারানী ভানুমতীকে তাঁর কক্ষের নিভৃতে কখনও কখনও পুরো গান শুনিয়েছেন।

স্লান সেরে ছবির ঘরে এসে বীরচন্দ্ৰ দেখলেন পঞ্চানন্দ অনেক প্রকার রং তৈরি করে রেখেছে। ক্যানভাসে অসমাপ্ত একটি ছবি, প্রায় মাসখানেক আগে মহারাজ এই ছবিটি প্রায় শেষ করে এনেছিলেন, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়েন অন্য কাজে। একটি ল্যান্ডস্কেপ, এই বাড়ির পেছন দিকের জঙ্গলের দৃশ্য। পঞ্চানন্দ একটি তুলি হাতে নিয়ে সেই ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, যেন সে এখনই এক পোঁচ রং দেবে।

মহারাজ একটা কৃত্রিম হুংকার দিয়ে বললেন, ওহে, তুমি আমার ছবির ওপর খোদকারি করছ নাকি?

পঞ্চানন্দ পেছন জিভ কেটে বলল, সে কি, মহারাজ! আমার চোদ্দপুরুষে কেউ এমন বেয়াদবি করেনি। খোদার ওপরে খোদকারি করব, আমার সাধ্য কী! তবে ইচ্ছে একটু হয়েছিল, তা ঠিকই!

মহারাজ প্রশ্ন করলেন, কী ইচ্ছে হয়েছিল?

পঞ্চানন্দ বলল, থাক। সে এমন কিছু না।

-এ চিত্ৰখানা কেমন হয়েছে, ঠিক করে বল তো!

-ভয়ে বলব, না নিৰ্ভয়ে বলব?

—তুমি আবার মনের কথা বলতে ভয় পাও কবে?

—এটা একটা কথার লবজ। রাজা-মহারাজাদের সামনে এমন বলতে হয়। রূপকথায় পড়েছি। তা হলে আপনি আমাকে অভয় দিচ্ছেন?

—বিলক্ষণ! মন খোলসা করে বলো!

—মহারাজ, মহাকবি কালিদাসের নাম শুনেছেন?

–তা শুনব না? তুমি আমাকে এমন গণ্ডমূর্খ ভাব?

—আজ্ঞে না। আপনি সুপণ্ডিত। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নামে একটি দৃশ্যনাট্য আছে, পড়েছেন নিশ্চয়?

—তা পড়িনি। আমি সংস্কৃত জানি না।

—আপনাকে জানতে হবে কেন? রাজাদের সহস্ৰ কান, সহস্ৰ বাহু। রাজারা যুদ্ধ জয় করেন অন্যের বাহুবলে। অন্যের জ্ঞান আহরণ করেন কানে শুনে। আপনার দরবারে নবরত্ব সভা সাজিয়ে রেখেছেন, বেতনভোগী সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নেই? তারা আপনাকে শোনায়নি?

—আ মোলো যা! জিজ্ঞেস করছি। ছবির কথা, তুমি টেনে আনলে সংস্কৃত টমস্কৃত।

—বলছি এই জন্য যে, ভূ-ভারতে আপনিই প্রথম নৃপতি নন, যিনি ছবি আঁকেন। রাজা দুষ্মন্তও ছবি আঁকতেন। শকুন্তলার আলেখ্য এঁকে সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। দুষ্মন্তের ছবির জ্ঞান তেমন ভালো ছিল না। রাজা দুষ্মন্তের ছবি সম্পর্কে কালিদাস যে সমালোচনা করেছিলেন, আমিও সে কথাই বলতে চাই।

-অর্থাৎ?

-ছবিতে বড় বেশি বেশি জিনিস এসে গেছে। এত গাছ কেন? একটুও ফাকা নেই। মাঝখানে যে হরিণটাকে এঁকেছেন, গাদাগাদি গাছের চাপে সে বেচারার যেন দমবন্ধ অবস্থা। ছবিতে শুধু বিষয় আঁকলেই চলে না। ছবিতে শূন্যতারও বিশেষ মূল্য আছে।

-পেছনের বারাণ্ডায় গিয়ে দেখা গে, জঙ্গলটা এরকমই দেখায়।

-ছবি আঁকার সময় শুধু খালি চোখে দেখলেই চলে না, মনশ্চক্ষেও দেখতে হয়। জঙ্গল তো অনেকখানি, মন ঠিক ছবির উপযোগী স্থানটি বেছে নেয়। আর একটা ব্যাপার দেখুন, মহারাজ। ক্যানভাসের একেবারে ডান দিকে আপনি একটি শিমুল বৃক্ষ এঁকেছেন, তাতে উজ্জ্বল লাল ফুল। ছবিতে আর কোথাও লাল রং নেই। ছবির এক কোণে এরকম গাঢ় রং দিলে সেদিকেই চোখ টেনে নেয়, পুরো ছবিটা মার খায়। বিশেষত লাল রং অতি বিশ্বাসঘাতক। আপনি নিজে দেখুন, প্রথমেই আপনার দৃষ্টি ওই ডান দিকে চলে যাচ্ছে কিনা!

—তা ঠিক। এবার বলো তো, হাতে তুলি নিয়ে তুমি কী চিন্তা করছিলে? শীঘ্ৰ বলো, নচেৎ তোমার গর্দান যাবে!

—আমার ইচ্ছা করছিল, মহারাজ, সত্বর ওই লাল ফুলগুলি মুছে দিই!

—একবার লাল রং দিয়ে আকা হয়ে গেলে তা কি আর মোছা যায়?

—কেন যাবে না? সেই জন্যই তো সাদা রং গুলেছি। একেবারে না মুছে অস্পষ্টও করে দেওয়া যায়!

—পঞ্চানন্দ, তুমি তো পাখোয়াজ চাঁটাও আর তবলা পেটাও, তুমি ছবি সম্পর্কে এত সব কোথা থেকে শিখলে বলো তো? কোনও সাহেবের কাছে পাঠ নিয়েছিলে?

—কস্মিনকালেও না! কোনও ছবি আমার চক্ষুকে পীড়া দেয়, কোনও কোনও ছবিতে শুধু চক্ষু নয়, মনেরও আরাম হয়। সেই ভাবে আমি ছবির ভালো মন্দ বুঝি!

বীরচন্দ্ৰ এবার সাদা রঙের পাত্ৰে তুলি ডুবিয়ে বললেন, সকলের চক্ষু এরকম হয় না। আরও কিছু আছে, তুমি খোলসা করে বলছ না! আমি এই ছবিটা সংশোধন করছি, তুমি দেখ তো!

কিছুক্ষণ মহারাজ ছবিটি নিয়ে কাজ করলেন। কিন্তু ঠিক তৃপ্তি পাচ্ছেন না, ঠিক যেন মগ্নতা আসছে না। মন চঞ্চল হয়ে আছে। একেবারে মগ্ন না হতে পারলে সুকুমার শিল্প প্রার্থিত রূপ পায় না।

তুলি বোলাতে বোলাতে বীরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, পঞ্চানন্দ, তুমি আমার বড় ছেলে রাধাকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনেছ?

পঞ্চানন্দ বলল, যুবরাজ রাধাকিশোর? অবশ্যই চিনি। তিনি অনেক গুণে গুণী। মহারাজ, আপনি যোগ্য পুত্ৰকেই যুবরাজ পদে বরণ করেছেন।

মহারাজ বললেন, আমার মন-রাখা কথা শুনতে চাইনি। তোমার সঠিক বিচার বল!

পঞ্চানন্দ বলল, মহারাজ, আপনি আপনার সন্তানদের কতখানি চেনেন? রাজা-রাজড়ারা নিজের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটান না। বাৎসল্যের মতন দুর্বলতা বাধ্য হয় তাঁদের থাকতে নেই। যুবরাজ রাধাকিশোর লাজুক প্রকৃতির, একা একা থাকতে ভালোবাসেন, তাঁর বিশেষ বন্ধু নেই, কিন্তু আমি কথা বলে দেখেছি, তাঁর চরিত্রের গভীরতা আছে। তিনি নিজে নিজে অনেক পড়াশুনোও করেছেন।

মহারাজ বললেন, আর কুমার সমরেন্দ্র সম্পর্কে তোমার কী মনে হয়?

পঞ্চানন্দ বলল, রাজকুমারদের নিন্দ করা আমার পক্ষে শোভা পায় না। কুমার সমরেন্দ্ৰচন্দ্রেরও অনেক গুণ আছে নিঃসন্দেহে।

বলতে বলতে পঞ্চানন্দ হাস্য সংবরণ করতে পারল না।

মহারাজ মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হাসলে কেন হে?

পঞ্চানন্দ বলল, এই যুবরাজ নিয়ে আপনার অন্দরমহলে এবার একটা দারুণ কোন্দল হবে। কী করে সেটা সামলান আপনি, সেটাই দেখার বিষয়!

তুলিটা ফেলে দিয়ে মহারাজও হাসলেন। ক্ষণে ক্ষণেই মহারানী ভানুমতীর মুখখানা তাঁর মনে পড়ছে। অন্দরমহলের একটি কক্ষে যে কী ঘটছে, তা অন্য কেউ ধারণাও করতে পারবে না। অন্য কোনও রানীকে নিয়ে সমস্যা নেই। মহারানী ভানুমতীর কাছে গেলেই তিনি রাগ, কান্না, অভিমানে হুলুস্থুল কাণ্ড করবেন, এমনকি মহারাজকে আঁচড়ে-কামড়ে দিতেও দ্বিধা করবেন না। এখন অন্তত দিন সাতেক ভানুমতীর ধারে কাছে যাওয়া নেই!

মহারাজ বললেন, নাঃ, এ ছবিটা আমার আর ভালোই লাগছে না!

পঞ্চানন্দ বলল, ল্যান্ডস্কেপ আমারও তেমন পছন্দ নয়। মানুষের ছবিই আসল ছবি। প্রণয়ের কথা ছাড়া যেমন গান জমে না।

মহারাজ সেখান থেকে সরে গিয়ে অন্য একটি ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, মানুষের ছবি আঁকা এত শক্ত কেন বল তো! মুখ তবু আঁকা যায়, কিন্তু ফুল ফিগার দাঁড় করাতে গেলে কিছুতেই সামঞ্জস্য হয় না! সেই ক্যানভাসে একটি অস্পষ্ট নারীমূর্তি রয়েছে, সে নারী স্থলিতবসনা। শরীর সংস্থান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুবই দুর্বল। সেদিক তাকিয়ে মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন, সাহেব শিল্পীরা কত হাজারে হাজারে বিবসনা নগ্ন নারীদের আঁকে। এ দেশে কেউ কি পারে?

পঞ্চানন্দ বলল, সাহেবরা হুবহু নর-নারীর শরীর আঁকতে পারে, তার কারণ তারা যে মডেল নেয়।

মহারাজ বললেন, তার মানে?

পঞ্চানন্দ বলল, জীবন্ত কোনও স্ত্রীলোক কিংবা ব্যাটাছেলেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখের সামনে রেখে শিল্পীরা তাদের অ্যানাটমি নকল করে।

মহারাজ অবিশ্বাসের সুরে বললেন, যাঃ, কী যে বল! কোনও ভদ্রঘরের মেয়েছেলে সব কিছু খুলে-টুলে শিল্পীর সামনে দাঁড়াতে রাজি হবে নাকি? রাজ্যের হেজিপোঁজি লোক আঁকা ছবিতে তাদের শরীর দেখবে? ওদের সমাজ এমন উচ্ছন্নে গেলে ওরা এত দেশ জয় করে কীভাবে?

পঞ্চানন্দ বলল, মহারাজ, পশ্চিম দেশে মানুষের নগ্ন শরীর নিয়ে চিত্র অঙ্কন কিংবা মূর্তি গড়া নিন্দনীয় নয়। তাকে ওরা বলে আর্ট। আমাদের এই ভারতেও হিন্দু আমলে উলঙ্গ মূর্তি গড়া হয়েছে, এমন কত শ্লোক লেখা হয়েছে। পশ্চিম দেশে মডেল ব্যবহার করার বেশ চল আছে, তাতে সামাজিক বাধা নেই। তবে হ্যাঁ, আপনি যে বললেন ভদ্রঘরের মেয়েদের কথা, সব সময় ভদ্রঘরের মেয়েরা সবটা খোলাখুলি করতে রাজি হয় না, তখন তারা বাজার থেকে মাগী ভাড়া করে আনে।

মহারাজ দু’ চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, ভাড়া পাওয়া যায়? এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি। এ কি চড়কের মেলায় হাতি-ঘোড়া ভাড়া করা নাকি?

পঞ্চানন্দ বলল, আমি তো কিছুদিন চন্দননগরে ছিলাম। ফরাসিদের কাছে ওদের ছবি আঁকার কথা শুনেছি। সে দেশ ছবির জন্য খুব সুখ্যাত জানেন তো! প্যারিস নগরীতে দলে দলে যুবকেরা ছবি আঁকা শেখে। আঁকার ইস্কুল আছে। সেখানে বারবনিতা কিংবা কোনও চাকরানীকে রোজ হিসেবে টাকা দেয়, মাস্টারের নির্দেশে সেই মাগীরা কখনও কাপড় খুলে শুয়ে থাকে, কখনও দাঁড়ায়, কখনও দেয়ালে হেলান দেয়, ছাত্ররা একসঙ্গে সেই সব ভঙ্গি আঁকা শেখে। এর মধ্যে দোষের কিছু নেই।

মহারাজ বললেন, ওঃ! এ দেশে তো তা সম্ভব নয়।

পঞ্চানন্দ বলল, কেন সম্ভব নয়?

মহারাজ বললেন, আমি কি বাজার থেকে মেয়েছেলে ধরে আনব নাকি?

পঞ্চানন্দ বলল, আপনি ধরে আনবেন কেন? আপনার মুখের কথা কিংবা একটু ইঙ্গিতই তো যথেষ্ট। রাজপুরীতে কি দাসী-চাকরানীর অভাব আছে? মহারাজ, আমি একটি দাসীকে দেখেছি, তার নাম শ্যামা। কী অপূর্ব তার শরীরে গড়ন। নিটোল দুটি বক্ষ যেন কচি বাতাবী লেবু, সিংহিনীর মতন সরু কোমর, তম্বুরার মতন গুরু নিতম্ব, যখন হাঁটে, যেন চলহু কামিনী, গজহু গামিনী। তাকে দেখে আমার অনেকবার মনে হয়েছে।

মহারাজ, ধমক দিয়ে বললেন, চোপ। রাজবাড়ির কোনও দাসীর প্রতি যদি কুদৃষ্টি দাও, তা হলে তোমার গর্দান যাবে! ঘরে তোমার রূপসী বামা রয়েছে, তবু তুমি অন্য নারীর প্রতি লোভ কর, তুমি তো বড় মন্দ লোক হে!

দু’হাত জোড় করে, ভয়ে কাঁপার ভান নিয়ে পঞ্চানন্দ বলল, মহারাজ, এই নিয়ে দু’বার আপনি আমার গর্দান নেবার কথা বললেন। তবে তো আমার সত্যিই খুব বিপদ। এই গর্দানটা আরও কিছুদিন টিকিয়ে রাখার সাধ আছে আমার। যদি অনুগ্রহ করেন তো, আমি এই মুহূর্তেই ত্রিপুরা ছেড়ে চম্পট দিই! তবে, আর একটু শুধু বলি। লোভের দৃষ্টির প্রশ্ন তো আসে না, শিল্পীকে হ্যাংলা হতে নেই। আমি বলেছিলাম, শ্যামা নামের চাকরানিটিকে ছবি আঁকার মডেল হিসেবে ভালো ব্যবহার করা যায়। আর…ইয়ে… মহারাজ, ঘরে অর্ধাঙ্গিনী থাকলেও পুরুষমানুষ অন্য রমণীর রূপসুধা পান করতে পারবে না, এমন কথা কোনও শাস্ত্রে লেখা আছে কি? যদি বা থাকে, স্বয়ং মহারাজ কি তা মানেন?

মহারাজ এবার হেসে ফেলে বললেন, ওহে বাগীশ্বর, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না!

তারপর হাঁক দিয়ে বললেন, ওরে কে আছিস, মহাদেবীর খাসদাসী শ্যামাকে এখানে ডেকে আন তো এখনই!

শ্যামাকে বিশেষ খোঁজাখুঁজি করতে হল না। সে এই বাগানবাড়ির সামনেই দু’জন প্রহরীর সঙ্গে ফচকেমি করছিল তখন। রাজার আদেশ নিয়ে এলো এক ভৃত্য, সঙ্গে সঙ্গে প্রহরী দুজন তাকে টানতে টানতে ওপরে নিয়ে পৌঁছে দিল ছবিঘরে।

তারপর সে ঘরের দ্বার বন্ধ হয়ে গেল।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়