সে দিন ভূমিসূতা মার খেল।

সে যে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল, দিনের বেলা কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে ঢলাঢলি করেছে, তা জানাজানি হতে বাকি রইল না। দাসীদের খুব রাগ ভূমিসূতার ওপর। ভূমিসূতাও তো দাসীই, তবু সে পুরোপুরি দাসী হতে চায় না কেন?

খবরটা মণিভূষণের কানে গেল। তাঁর অবদমিত যৌন বাসনা রূপান্তরিত হল ক্ৰোধে। নিজের স্ত্রীর ভয়ে তিনি এখন আর ভূমিসূতার দিকে তাকান না। কিন্তু তিনি যাকে একদিন কামনা করেছিলেন, সে অন্য পুরুষের কাছে যাবে, সেটাই বা তার সহ্য হবে কেন?

কোনও রকম কৈফিয়ত না চেয়েই একটা চাবুক নিয়ে ভূমিসূতাকে পেটাতে শুরু করলেন। দাঁদাঁত চেপে বলতে লাগলেন, হারামজাদি, নষ্ট মাগী! বাইরে যেতে তোকে নিষেধ করা হয়েছে, তোর সব ছেনালি আজ ঘুচিয়ে দেব। দুধ-কলা দিয়ে কাল সাপ পুষছি বাড়িতে।

দু’তরফের গিন্নিরাই একটু দাড়িয়ে দেখছেন, প্রতিবাদ করার কোনও প্রশ্ন নেই। ভূমিসূতার অপরাধ যে। এই সুযোগে দাসীরা করে জানিয়ে দিতে লাগল যে প্রায়ই ভরতের ঘরে যায়। নিভৃতে সেখানে পিরীতের খেলা চলে। এই সংবাদ আরও ক্ৰোধের ইন্ধন জোগাল। ওই ভরত নামে ছোকরাকে এ বাড়িতে চাপিয়ে দিয়ে গেছে, সে কারুর সঙ্গে মেশে না, ভালো করে কথা বলে না। নেহাত শশিভূষণের জন্যই তাকে মেনে নেওয়া হয়েছে, তা বলে এ বাড়ির কোনও দাসীর সঙ্গে আশনাই করার অধিকার তার নেই।

মার খেতে খেতে মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে লাগল ভূমিসূতা। তার শাড়ি বিস্রস্ত হয়ে গেল, সারা শরীর থেকে ঝরতে লাগল রক্ত। ভূমিসূতা দু হাতে মুখটা চাপা দিয়ে আছে, সেই হাতের ওপর মণিভূষণ চাবুক চালাতে লাগলেন বারবার।

মৃতের মতন নিস্পন্দ অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ ভূমিসূতা পড়ে রইল বারান্দার এক কোণে। তারপর দু’জন দাসী ধরাধরি করে তাকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল। রাত্তিরে সে কিছুই খেতে পাবে না।

পরদিন সকালে মণিভূষণ আবার চাবুক হাতে নিয়ে তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, যদি বাঁচতে চাস, তা হলে আর কোনওদিন ওই ভরতের কাছে যাবি না। তার সঙ্গে কথা বলবি না। কোনও পুরুষের সঙ্গেই কথা বলা চলবে না। আবার যদি বাড়ির বাইরে যাবার চেষ্টা করিস, তা হলে তোকে ধরে গলায় কাপড় বেঁধে বুলিয়ে দেওয়া হবে।

বাতাসে তিনি দু’বার শপাং শপাং শব্দ করলেন চাবুকের। তারপর তিনি গেলেন ভরতের ঘরের দিকে, তখন অবশ্য চাবুকটা সঙ্গে নিলেন না।

ভূমিসূতা চারদিন ঘর থেকে বেরোতেই পারল না। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা, চাবুকের লম্বা লম্বা দাগ। দুহাতের আঙুলের চামড়া ছিঁড়ে দগদগে ঘা হয়েছে, কিন্তু মণিভূষণ তার মুখখানি বিকৃত করে দিতে পারেননি। এই ক’দিন কেউ তাকে কিছু খেতেও দেয়নি। শুয়ে শুয়ে সে অনবরত ভাবে, নয়নতারা নামের সেই বধূটির মতন সেও কি গায়ে আগুন দিয়ে সব জ্বালা জুড়োবে? এ জীবন আর রেখে লাভ কী?সারা জীবন তাকে এই বাড়িতে এক বন্দিনী দাসী হয়ে থাকতে হবে। একবার সে যখন এ বাড়ির গিনিদের কুনজরে পড়েছে, তখন লাথি-ঝাঁটা খেতে হবে অনবরত। নাঃ, এ ভাবে আর বাঁচতে চায় না সে। সে বাবা-মায়ের কাছে চলে যাবে। স্বর্গ থেকে কি বাবা আর মা দেখতে পাচ্ছেন তার কষ্ট?

তবু মরতে পারল না ভূমিসূতা। খিদের জ্বালাতেই তাকে ঘর থেকে বেরুতে হল।

ঠাকুরপঘরে ফুল আর পুজোর উপকরণ সাজাবার দায়িত্ব তার চলে গেছে। এক মধ্যবয়েসী বিধবা নিযুক্ত হয়েছে সে কাজে। ভূমিসূতা এখন ঘর-বারান্দা মুছবে, কাপড় কাচবে, বাসন মাজবে। তাই-ই সে করে যেতে লাগল মুখ বুজে। সে আর মার খেতে চায় না। বাবা-মা বেঁচে থাকতে সে কখনও মার খায়নি। বিকেলের দিকে সে খানিকটা সময় পায়। সন্ধের পর সকলের বিছানা ঠিক মতন পেতে দিলে তারপর আর বিশেষ কেউ তার খোঁজ খবর করে না। ভূমিসূতা মাঝে মাঝেই ছাদে চলে যায় খোলা আকাশের দিকে কিছুক্ষণ অন্তত না তাকালে সে বাঁচতে পারবে না।

ভরতের ঘরের দিকে সে আর যায়নি একবারও। সে জানে, অন্য দাসীরা নজর রাখে তার ওপর। দুই মহলের গিন্নিই ভরত সম্পর্কে নানান কটু-কাটব্য করে মাঝে মাঝে, ভূমিসূতা আড়াল থেকে শুনতে পায়। এর মধ্যে দু’তিনবার মণিভূষণের সঙ্গে ভরতের জোর কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। ভরত শশিভূষণের অংশের টাকা পয়সার হিসেব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

ভূমিসূতা ভরতের ঘরের কাছাকাছিও আর যায় না বটে। তবু ভরত তাকে টানে। সে এক সাঙ্ঘাতিক তীব্র টান। শুধু ভরতের জন্যই নয়, ভরতের ঘরের বইগুলির জন্যও। কপালকুণ্ডলা বইখানির সে অর্ধেক পড়েছে মাত্র। বাকি অর্ধেক আর পড়া হবে না। সমুদ্রের ধারে শুধু ফুলের বসন পরে ঘুরে বেড়াত যে কিশোরী, শেষ পর্যন্ত তার কী হল, তা আর জানা যাবে না কোনওদিন। এ বাড়িতে আর কেউ বই পড়ে না। ছাদের আলসে ধরে সে ভরতের ঘরের দিকে নিৰ্ণিমেষে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ভরত কেন প্রথম থেকেই অপছন্দ করল তাকে? কোনওদিন তার সঙ্গে একটুও ভালো করে কথা বলেনি। সে কি এতই খারাপ? তা হলে সেই দুই যমজ বদমাস ভাইয়ের অত্যাচার থেকে ভরত তাকে বাঁচাতে গিয়েছিল কেন?

ছাদ থেকে উঁকি ঝুঁকি মারে বটে, কিন্তু ভরতকে দেখলেই সে সরে যায়। ভরত তাকে লক্ষ করে না, তবু ভূমিসূতা নিজেই চলে যায় আড়ালে। দু এক পলক দেখাই যথেষ্ট। বেশিক্ষণ ভরতকে দেখলে তার বুক মোচড়ায়।

এর মধ্যে একদিন একটা বিপরীত ব্যাপার ঘটে গেল। বিকেলবেলা কলেজ থেকে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছে ভরত। শেষ ধাপে এসে হঠাৎ ছাদের পাঁচিলের এক অংশের দিকে তার দৃষ্টি গেল। একটা ছায়ার মতন সরে গেল ভূমিসূতা, ভরত তাকে দেখেছে ও চিনেছে, সে দাঁড়িয়ে রইল সিঁড়িতেই। কৌতূহল দমন করতে না পেরে, একটু পরে ভূমিসূতা আর একবার মুখ বাড়াতেই ভরতের সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। ভরত হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, এই, এদিকে শোনো! এখানে এসো একবার।

ভূমিসূতা এক ছুটে নেমে এল ছাদ থেকে। ভরতের ঘরের দিকে যেতে হলে দোতলার বারান্দা পেরিয়ে ওদিকের একটা দরজা খুলে যেতে হয়। যে-কেউ দেখে ফেলতে পারে। কিন্তু ভরত নিজে থেকে ডেকেছে, এখন ভূমিসূতা পৃথিবীর কোনও কিছুই গ্রাহ্য করে না।

ভরত একটা চুরুট ধরিয়ে পায়চারি শুরু করেছে। ভূমিসূতা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সিঁড়ির রেলিং ধরে মুখ নিচু করে দাঁড়াল।

ভরত চলতে চলতেই নীরস গলায় বলল, তোমার সঙ্গে স্পষ্টাস্পষ্টি কিছু কথা বলা দরকার। আমি তোমার সম্পর্কে মোটামুটি জানি। তুমি কোথা থেকে এসেছ, কী ভাবে এসেছ তা শুনেছি। তুমি কি আমার সম্পর্কে কিছু জান? আমারও মাবাবা নেই, এই দুনিয়ায় আমার কোনও সহায়-সম্বল নেই। দৈবাত আমি এ বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছি। কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। তুমি স্ত্রীলোক হয়ে জন্মেছ, তুমি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আমি এ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হলে পথের ভিখারি হব, লেখাপড়া চালাতে পারব না, কিন্তু আমাকে অন্তত গ্র্যাজুয়েট হতেই হবে।

একটু থেমে, ভূমিসূতার দিকে তাকিয়ে সে আবার বলল, তোমার সমস্যা বুঝি। কিন্তু তোমাকে সাহায্য করার সামর্থ্য আমার নেই। এই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লে তোমারও কোনও সুরাহা হবে না, আমিও বিপদে পড়ে যাব। মেজকর্তা মণিভূষণ আমাকে শাসিয়ে গেছে। তোমার নাম জড়িয়ে আমাকে অকথা-কুকথা বলেছে। এই ছুতোয় ওরা তোমার ওপরেও অত্যাচার করবে। সেই জন্যই আমি তোমাকে বলছি, তুমি কক্ষনও আর এদিকে আসবে না। ছাদে দাড়িয়ে উকি দেবে না। আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে তোমার ক্ষতি ছাড়া কোনও উপকার হবে না। আমি যা বলেছি, সব বুঝেছি?

ভূমিসূতা মাথাটা আর একটু নোয়াল।

ভরত আবার বলল, আমি তো তোমাকে কখনও আসতে বলিনি। তুমি নিজে থেকে আসবে কেন? তোমার স্থান অন্দরমহলে, এই বারমহলে তুমি আসবে কেন? বাড়ির কত্তাদের তো রাগ হতেই পারে। এটা তোমাকে মানায় না। আর কখনও আসবে না, মনে থাকবে?

ভূমিসূতা আবার তার মাথা নোয়াল।

ভরত চুরুটে দু’তিনটি টান দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আর একটা ব্যবস্থা হতে পারে। যদি তোমার সাহস থাকে,… তুমি সে ঝুঁকি নিতে পারবে কি না ভেবে দেখ। এরা তোমাকে উড়িষ্যা থেকে টাকা দিয়ে কিনে এনেছে, তবু সারাজীবন তোমাকে ক্রীতদাসী করে রাখতে পারে না। ব্রিটিশ রাজত্বে মানুষ কেনা-বেচা নিষিদ্ধ। তুমি যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারো। এরা বাধা দিতে চাইলে, কোতোয়ালিতে খবর দিলে তুমি পুলিশের সাহায্য পাবে। আমার এক বন্ধু, সেদিন সেও এসেছিল, তার নাম যাদুগোপাল, সে তোমার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। কলুটোলার এক ব্ৰাহ্মবাড়িতে কিছু অনাথ মহিলার জন্য একটা আশ্রমের মতন খোলা হয়েছে। সেখানে তাদের হাতের কাজ শেখানো হয়, বাড়ির মধ্যেই লেখাপড়া শেখাবারও ব্যবস্থা আছে। মন দিয়ে কাজ শিখলে নিজের পায়ে হয়তো দাঁড়াতে পারবে একদিন। সেখানে যাবে?

এই প্রস্তাব শুনতে শুনতেই ভূমিসূতা মুখ তুলেছে। তার সারা মুখে ঝলমল করছে আলো, চক্ষু দুটি বিস্ফারিত। ভরত কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, হ্যাঁ, যাব।

ভরত বলল, চিরকালের জন্য এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারবে?

ভূমিসূতা বলল, হ্যাঁ পারব।

ভরত বলল, যাদুগোপালের কাছে যতদূর শুনেছি, সেখানে গেলে তুমি ভালোই থাকবে। খাওয়া পরার চিন্তা করতে হবে না। কেউ মারধোর করবে না। ব্ৰাহ্মরা মেয়েদের গায়ে হাত তোলে না। এ বাড়ির লোকরা বোষ্টম, নিরামিষ খায়, অথচ একটা মেয়েকে চাবুক মারে। এরা ধাৰ্মিক না পাষণ্ড! ওই আশ্রমে গেলে তোমাকে বোধহয় ব্ৰাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নিতে হবে। ব্রাহ্ম ধর্ম কাকে বলে জানো?

ভূমিসূতা দু’দিকে মাথা নাড়ল।

ভরত বলল, ওখানে গেলে জেনে যাবে। ব্ৰাহ্মরা নারীশিক্ষার পক্ষপাতী। ওদের মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে বাইরে যায়। তা হলে তুমি রাজি?

ভূমিসূতা স্পষ্ট ভাবে বলল, হ্যাঁ, আমি যাব।

ভরত বলল, এদের অনুমতি নিতে গেলে ঝঞ্ঝাট হবে। যেতে হবে গোপনে। একবার তুমি চলে গেলে এরা আর জোর করে তোমায় ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তবে একটা কথা বলে রাখি, আমি শুধু সেখানে তোমাকে পৌঁছে দেব। তারপর আর আমার কোনও দায়িত্ব থাকবে না। আমার সঙ্গে তোমার আর দেখা হবে না।

এর দুদিন পরে সন্ধ্যার অন্ধকারে গৃহত্যাগ করল ভূমিসূতা। ভরত আগে থেকেই বেরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পথের মোড়ে। একটা ছোট পুঁটুলি সম্বল করে বাগানের পেছনের পাঁচিল দিয়ে বেরিয়ে এল ভূমিসূতা, ভরত তাকে নিয়ে দ্রুত পায়ে চলে এল ভাড়া গাড়ির আড়ায়। কালীঘাট মন্দিরের তীর্থযাত্রীরা এই পথ দিয়ে যায়। একটা কেরাঞ্চি গাড়িতে ওরা উঠে বসিল, আরও দু’জন যাত্রী নেবার পর চলতে শুরু করল সেই গাড়ি।

ভূমিসূতা একটা গোলাপি-ভুরে শাড়ি পরেছে, ইচ্ছে করে ঘোমটায় ঢেকে রেখেছে অনেকখানি মুখ। ভরত চুপ করে থাকলেও তার বক্ষ জুড়ে আছে উদ্বেগ। যাদুগোপালের পেড়াপিড়িতেই সে এই ঝুঁকি নিতে রাজি হয়েছে। যাদুগোপাল নারী-উদ্ধারের জন্য ব্যস্ত। ভূমিসূতাকে যখন খুঁজে পাওয়া যাবে না, তখন মণিভূষণদের সব সন্দেহ পড়বে ভরতের ওপর। একটা কিছু তুলকালাম কাণ্ড বাধাবে, নালিশ জানাবে শশিভূষণের কাছে? শশিভূষণের কাছে তার চরিত্রের বদনাম দেবে? শশিভূষণ কি বিশ্বাস করবেন যে এ পর্যন্ত ভরত এই মেয়েটির সামান্য অঙ্গ স্পর্শও করেনি?

কেরাঞ্চি গাড়িটা যাবে গঙ্গার ধারে ফেরিঘাট পর্যন্ত। ভরত রাস্তার দিকে লক্ষ রাখছে, তারা অত দূর পর্যন্ত যাবে না। একটা বেতো ঘোড়া টানছে গাড়ি, নড়বড় করে দুলছে। মাঝে মাঝে গাড়োয়ান রাস্তার লোকদের সরাবার জন্য চিৎকার করছে, হটো, হটো! গড়ের মাঠে এই সময় মাতাল গোরারা ঘুরে বেড়ায়, তারা যখন তখন গাড়ি থামিয়ে দিতে পারে, যাত্রীদের সোনা-দানা-ইজ্জত লুট করলেও তাদের শাস্তি দেবার কেউ নেই।

জানবাজারের মুখটায় এসে ভরত নেমে পড়ল।

কলুটোলার মোড়ে যাদুগোপাল দাড়িয়ে থাকবে। ভরত আশ্রম বাড়িটি চেনে না, তা ছাড়া যাদুগোপাল পরিচয় করিয়ে না দিলে তারা পাত্তাই বা দেবে কেন? যে-কোনও একটা পথের মেয়েকে তো ব্রাহ্মরা আশ্রয় দেবে না।

কলুটোলা পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। এদিকে পথে লোক চলাচল আছে বটে, কিন্তু পথ বড় অন্ধকার। আজ আকাশেও আলো নেই। ঘোমটায় মুখ ঢাকা অবস্থায় ভূমিসূতা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। ভরত বলল, সাবধানে হাঁটো। অতখানি ঘোমটা দেবার আর কী দরকার, এখানে তোমাকে কে চিনবে? পগারে পড়ে গেলে বিপদ আছে।

ভূমিসূতা কথা বলছে না একটাও। তার মনের মধ্যে কী ঝড় বইছে কে জানে! মাথার কাপড় একটু টেনে সে দেখছে কলকাতার রাস্তা। কিছুই প্রায় দেখা যায় না। অন্য লোকের পিছু পিছু হাটতে হয় আন্দাজে। মাঝে মাঝে হইহই শব্দ করে যাচ্ছে ঠেলা গাড়ি, জুড়ি গাড়ি। দু’ একটি দোকানে টিম টিম করে জ্বলছে সেজবাতি। দু’একটা:মাতাল- পড়ে আছে রাস্তার ধারে।

হঠাৎ হাড়কাটার গলি থেকে অট্ট চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এল একদল মানুষ তাদের কয়েক জনের হাতে মশাল, কয়েকজনের হাতে খোলা তলোয়ার। তারা কিছু লোককে তাড়া করে এসেছে, তলোয়ারের কোপ খেয়ে একজন মাটিতে পড়ে বিকট আৰ্তনাদ করতে লাগল।

এক দঙ্গল মানুষ ছুটে আসছে এদিকে। তাদের গতি দেখেই মনে হয়, তারা ঠেলে চলে যাবে। ভরত পেছন ফিরে ভূমিসূতাকে বলল, দৌড়াতে হবে, পারবে তো? উল্টো দিকে দৌড়াও!

কিন্তু ওরা বেশি দূর যেতে পারল না। মলঙ্গার গলির দিক থেকে আবার বেরিয়ে এল আর এক দঙ্গল মানুষ। এদেরও হাতে লাঠি-সোটা আর মশাল। সেই দঙ্গলটি তেড়ে আসছে এদিকে। এবার ওরা কোথায় যাবে? ভরত ভূমিসূতার হাত ধরে একদিকে সরে যাবে ভাবল, কিন্তু তার আগেই কয়েকজন লোক. এক ধাক্কায় তাকে ছিটকে ফেলে দিল। তার পিঠের ওপর দিয়ে চলে গেল কয়েকজন।

ভরত কোনোও ক্রমে আবার উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল। ভূমিসূতা কোথায়? এই হুড়োহুড়ির মধ্যে ভূমিসূতাকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। দুই পল্লীর লোকেরা উন্মত্তের মতন মারামারি শুরু করেছে, রাস্তার সাধারণ মানুষ ঢেউয়ের মতন ছুটছে এক একবার এক একদিকে। দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই, ভরতকেও দৌড়াতে হচ্ছে তাদের সঙ্গে।

এরই মধ্যে এসে গেল অশ্বারোহী পুলিশ। দুম দাম করে বন্দুকের শব্দ হতে লাগল। ভরত এক সময় টের পেল, সে বউবাজারের রাস্তা ধরে ছুটে যাচ্ছে শেয়ালদার দিকে। এ কোন দিকে যাচ্ছে সে? কোনও উপায়ও নেই, উল্টো দিকে ফিরতে গেলে মরতে হবে। ভূমিসূতা রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না। কিন্তু সে তো নির্বোধ নয়, বেশির ভাগ লোক যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই তার যাওয়া উচিত। ভরত অন্য লোকদের মুখ দেখার চেষ্টা করল। ভিড়ের মধ্যে দু’চারজন স্ত্রীলোকও আছে। ভদ্ৰ-গৃহস্থবাড়ির রমণীদের এ সময় রাস্তা দিয়ে হাঁটার প্রশ্নই ওঠে না। শিকার ধরার জন্য কিছু কিছু স্ত্রীলোক রাস্তায় ঘোরে। মেথরানি, দাসী জাতীয়াও রয়েছে কয়েকজন। তাদের মধ্যে ভূমিসূতাকে দেখা যাচ্ছে না।

পুলিশ এক পক্ষকে ঠেলে সরিয়ে দিলে অন্য পক্ষ তেড়ে আসে। পুলিশের ঘোড়ার মুখ সেদিকে ফিরলে পেছনের গলি দিয়ে বেরিয়ে আসে আগের দল। ক’জন মরল তা বোঝা না গেলেও আহত হয়ে কাতরাচ্ছে বেশ কয়েকজন এরকম কিছু ঘটলে মৃতদেহগুলি সারা রাত রাস্তাতেই পড়ে থাকে, সকালবেলা মুদ্দোফরাসরা এসে টেনে নিয়ে যায়।

প্রায় এক ঘণ্টা চলল এই তাণ্ডব। ঠিক যেখানে গোলমাল শুরু হয়েছিল, ভরত ফিরে এল সেখানে। ভূমিসূতার চিহ্নমাত্র নেই। ভরত যে মানুষের ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল, তা কি ভূমিসূতা দেখেনি? সে গেল কোথায়?

রণক্ষেত্রে নিহতদের কাছে গিয়ে আত্মীয় স্বজনেরা যেমন আপনজনের মুখ চেনার চেষ্টা করে, সেই রকম ভাবে ভরত রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষগুলোর কাছে গিয়ে দেখল। না, এদের মধ্যে কোনও স্ত্রীলোক নেই। অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি, পগারগুলো শুকনো। তাতে পড়ে গেলে বড় জোর হাত-পা ভাঙতে পারে, মরে তো যাবে না। ভরত চিৎকার করে কয়েকবার ভূমিসূতার নাম ধরে ডাকল।

পথ এখন শুনশান। মনে হয় যেন ঘোর রাত্রি। ভরতের বুক চিপ টিপ করছে। ভূমিসূতা হারিয়ে গেল? কাছেই পতিতাপল্লী, ভূমিসূতার মতন একটি মেয়েকে দেখে গুণ্ডারা সেখানে ধরে নিয়ে যেতে পারে। শেষপর্যন্ত ভূমিসূতার এই পরিণতি হবে? না, তা হতেই পারে না। কলুটোলা নামটা ভূমিসূতা অনেকবার শুনেছে,লোককে জিজ্ঞেস করে সে সেখানে গিয়ে-থাকতে পারে। ভরত প্রাণপণে ছুটল।

কলুটোলার মোড়ে যাদুগোপাল নেই। একে তো অনেক দেরি হয়ে গেছে, তা ছাড়া সে গোলমালের কথাও টের পেয়েছে নিশ্চয়ই, তাই ধরে নিয়েছে ভরতরা আজ আর আসবে না। ভূমিসূতা তা হলে কোথায় যেতে পারে? হারা-উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগল ভরত। সানকিভাঙা, কলাবাগান, ঠনঠনে পেরিয়ে পান্তির মাঠে পর্যন্ত দেখে এল সে, কোথাও কেউ নেই। পাগলের মতন ভরত একবার এদিকে যাচ্ছে, একবার অন্যদিকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ডাকছে, ভূমি, ভূমি, ভূমিসূতা!

আড়াল থেকে যেন একবার তাকে বলল, এই ছোঁড়া বাড়ি যা। আবার পুলিশ এসে তোকে ধরবে। কিন্তু ভূমিসূতাকে না নিয়ে ভরত একলা ফিরবে কী করে? মেয়েটাকে একবার পথে ফেলে গেলে সে চিরকালের মতন পথেই হারিয়ে যাবে।

অনেকক্ষণ দৌড়োবার পর হঠাৎ ভরতের মনে হল, কলুটোলার কাছেই একটা বন্ধ দোকানের ওপরের সিঁড়িতে কে যেন বসে আছে। মানুষ, না কুকুর। ভরত কাছে গিয়ে দেখল, দোকানের দরজায় ঠেস দিয়ে, সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছে একটি শাড়ি পরা মূর্তি। ডুরে শাড়িটা দেখেই সে চিনল। হ্যাঁ, ভূমিসূতা।

ভরতের সারা শরীর ঘর্মাক্ত। তবু স্নিগ্ধ হয়ে গেল শরীর। অদ্ভুত এক আনন্দের আবেগে ভরে গেল বুক। ভূমিসূতাকে সে ফিরে পেয়েছে।

খানিকটা দম নিয়ে সে বলল, ভূমি, ভূমি, তোমার কিছু হয়নি তো? ভূমিসূতা কোনও উত্তর দিল না। তার চক্ষুদুটো যেন জ্বলছে। সেই জ্বলন্ত চোখে সে স্থিরভাবে চেয়ে রইল ভরতের দিকে। ভরত বলল, তুমি, তুমি এখানে বসে আছ। আমি এই পথ দিয়ে কতবার গেলাম, তুমি আমায় দেখতে পাওনি। ভূমিসূতা। তবু কোনও উত্তর দিল না।

ভরত বলল, এসো, উঠে এসো।

ভূমিসূতা এবার তীব্র গলায় বলল, না!

ভরত হ’কচাকিয়ে গিয়ে বলল, না মানে? এখন যাবে না?

ভূমিসূতা বলল, কেন যাব? তুমি আমাকে বেড়াল-পার করতে চেয়েছিলে। যে-কোনও একটা জায়গায় ছেড়ে দিতে চেয়েছিলে! এবার তুমি বাড়ি যাও। আমি রাস্তাতেই থাকব।

ভরত যেন আহত হয়ে বলল, এ কী কথা বলছি, ভূমি? আমি তোমাকে ইচ্ছে করে ছেড়ে দিয়েছি? আমি পড়ে গিয়েছিলাম, তুমি দেখতে পাওনি?

ভূমিসূতা বলল, আমাকে নিয়ে আর তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ভিক্ষে করে খাব। আমার জন্য তোমার কত অসুবিধে হয়েছে, আমি আর কোনও দিন তোমাকে জ্বালাতন করব না। যাও, যাও, নিশ্চিন্তে চলে যাও!

ভরত বলল, তুমি বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে তোমায় ছেড়ে দিইনি। আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমায় খুঁজছি।

ভূমিসূতা বলল, কেন খুঁজছিলে? আমি মারি বা বাঁচি, তাতে তোমার কী আসে যায়! আমার কেউ নেই, আমি রাস্তাতেই থাকব।

হঠাৎ ভরতের বুকে একটা মোচড় লাগল, জ্বালা করে উঠল দু’চোখ। আমার কেউ নেই, এ যে তারও জীবন-বাক্য, ভূমিসূতা তো ঠিক তারই মতন। এ পর্যন্ত বরাবর সে সঙ্গে কঠোর বা নির্লিপ্ত ব্যবহার করেছে, কিন্তু এই যে এতক্ষণ সে ভূমি খোজে উন্মত্তের মতন দৌড়োদৌড়ি করছিল, তখন সে ভাবছিল, ভূমিসূতাকে শেষ পর্যন্ত না পেলে সেও আর বাড়ি ফিরবে না।

ভরত একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। একবার তার মনে হল, এই অবমানিতা মানবীর কাছে তার হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাওয়া উচিত। কিন্তু এখন এই রাস্তার ওপর তা করা যায় না। দূরে পুলিশের ঘোড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে বুকে পড়ে নরম গলায় বলল, ভূমি, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। এসো, আমার হাতটা ধরে।

এই প্ৰথম ভূমিসূতাকে স্পর্শ করল ভরত।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়