সকালবেলা বাগান থেকে ফুল তুলে এনে ছাদের ঠাকুরঘরে অনেকক্ষণ ধরে সেই ফুল সাজায় ভূমিসূতা। এই কাজটি তার সবচেয়ে মনের মতন। পুজোর ঘরে এক বিশেষ স্নিগ্ধতা আছে। ঘরটি শ্বেতপাথরের। লক্ষ্ণী-জর্নাদনের মূর্তি, জয়পুর থেকে আনা পাথরের মূর্তি, চক্ষুগুলি সোনার। ভূমিসূতা সারা ঘরখানিই ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখে, গুনগুন করে আপন মনে গাইতে গাইতে শ্বেত ও রক্তচন্দন তৈরি করে। বাড়ির কর্তা গিন্নিরা বিশেষ বিশেষ তিথি ছাড়া প্রায় দিনই কেউ এই ঘরে আসে না। একজন পুরতমশাই এসে পুজো সেরে যান। পুজোর সব মন্ত্র এবং অনুষ্ঠান ভূমিসূতার মুখস্থ, সে ঠিক ঠিক সময়ে পুরুতমশাইকে ঘণ্টা, কোষাকুষি, শাঁখ, গঙ্গাজল এগিয়ে দেয়। নারীদের পৌরোহিত্যের অধিকার নেই, থাকলে, ভূমিসূতা একাই পুরুতমশাইয়ের সব কাজ চালিয়ে দিতে পারত।

এই ঠাকুরঘরে ভূমিসূতা অনেকখানি সময় কাটায় বটে, কিন্তু তার দেবতা অন্য। এই ছাদের এক অংশ থেকে, এমনকি ঠাকুর ঘরের জানলা দিয়েও দেখা যায় ভরতের ঘরখানি, সংলগ্ন অলিন্দ এবং নীচের দিকে যাবার সিঁড়ির কয়েকটি ধাপ। দিনের বেলা ভরতের বকুনির ভয়ে সে কাছাকাছি যায় না, এখান থেকে তৃষিতের মতন তাকিয়ে থাকে। যদি এক পলকের জন্যও তাকে দেখা যায়। ভরত যখন ঘরের মধ্যে বসে পড়াশুনো করে, তখন তাকে দেখতে পারার উপায় নেই। কখনও কখনও সে বারান্দায় আসে, তার এক কোণে রান্নার উদ্যোগ করে, সেই সময় তার পিঠ কিংবা মুখের এক পাশ দেখতে পেলেই ভূমিসূতা ধন্য হয়। ভরত কিছুই টের পায় না। ইদানীং সে চুরুট টানা অভ্যেস করেছে, কলেজের ছাত্ররা প্রায় সকলেই তামাক খায়, ভরত অবশ্য নিজের বাড়িতে হুঁকো-তামাকের ব্যবস্থা রাখেনি, মাঝে মাঝে চুরুট ধরিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়, তখন সে পথের দৃশ্য দেখে, এদিকের ছাদ বা ঠাকুরঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করার কোনও প্রয়োজন তার ঘটে না।

ঠাকুরঘরে পুজোর সব ব্যবস্থা করা ছাড়াও ভূমিসূতার অন্য আরও কাজ আছে। বড় তরফের গিন্নি ও ছেলেমেয়েদের বিছানা তুলতে হয়, এরা দেরি করে ওঠে, পুজোর কাজ সেরে ভূমিসূতা তা এক ফাঁকে এসে বালিশের ওয়াড় বদলায়, সুজনি চাদর কাচতে নেয়, তোশক রোদ্দুরে দেয়। এ ছাড়া তাকে কাঁথা সেলাই করতে হয়, ভূমিসূতা সূচিশিল্প জানে, কাঁথার ওপর সে নানারকম নকশা ফুটিয়ে তোলে। পান সাজার দায়িত্বও অনেকটা তার। জাঁতি দিয়ে এত সরু সরু করে সুপুরি কাটতে তার মতন আর কেউ পারে না। দুপুরবেলা গিন্নিমা পানের বাটা সামনে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেন, ভূমিসূতা সুপুরি, চুন, খয়ের, লবঙ্গ, এলাচ সঠিক পরিমাণে সাজিয়ে দেয়, গিন্নিমা নিজের হাতে খিলি করেন। ভূমিসূতার এত সব গুণ পছন্দ করেন বড় তরফের গিন্নি, তা বলে কোনও বিশেষ প্রশংসা বা পুরস্কার সে পায় না। সে তো টাকা দিয়ে কিনে আনা একটি দাসী, তাকে যা যা হুকুম করা হবে, সব কিছুই পালন করতে সে বাধ্য। ভূমিসূতার ভবিষ্যৎ নিয়ে কারুর কোনও মাথাব্যথা নেই, সে যেমন আছে তেমনই থাকবে, চিরকাল এরকম কাজ করে যাবে, এটাই যেন স্বাভাবিক।

পান সাজার আসরে বড় গিন্নির সঙ্গে আরও দু’একজন মহিলা এসে যোগ দেয় মাঝে মাঝে। মুখরোচক পরনিন্দার সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম বিয়ের সম্বন্ধ নিয়েও আলোচনা হয়। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে কোন বাড়িতে বিয়ের যুগ্যি কন্যা আছে আর কোন বাড়ির ছেলে লায়েক হয়েছে, তাদের বিয়ের চিন্তায় এই সব মহিলাদের খুব মাথাব্যথা। রামাই দত্তদের বাড়ির একটি বারো বছরের মেয়ে এখনও অনুঢ়া, সে কি লজ্জার কথা! অমন ধিঙ্গি মেয়ের কপালে কি আর বর জুটবে এর পরে?

কাছেই বসে ভূমিসূতা এক মনে সুপুরি কাটে, তার বয়েস প্রায় ষোলো, তার শরীরে যৌবনের সব লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তার বিয়ের কথা কিন্তু এই মহিলাদের একবারও মনে পড়ে না। সে যে দাসী! কাছে একটা বিড়াল বসে থাকলে যেমন গোপন কথা বলতে বাধা নেই, এই মহিলারা সেরকম গ্রাহ্যই করে না ভূমিসূতার উপস্থিতি।

ভূমিসূতা কান খাড়া করে সব শোনে। তার ভারি আশ্চর্য লাগে, বড় গিন্নি এবং তাঁর সঙ্গিনীদের অধিকাংশ চটুল নিন্দেই অন্য মেয়েদের সম্পর্কে। মেয়েরাই যেন মেয়েদের প্রধান শত্রু। কৃষ্ণভামিনীর এক দিদির পুত্রবধূ, তার নাম নয়নতারা, সেই মেয়েটির প্রসঙ্গ ওঠে রোজ একবার। তারা থাকে জানবাজারে। সেই নয়নতারা নাকি শাশুড়ির মুখে মুখে কথা বলে, হাই হিল জুতো পরে মন্দিরে পুজো দিতে যায়, নাটক-নভেল পড়ে, স্বামী-শ্বশুরের সেবা না করে নিজেদের পল্লীর কতকগুলো হতভাগা ছেলেকে জুটিয়ে তাদের পড়াশুনো শেখায়, রান্নাঘরে মন নেই, এই রকম তার অনেক দোষ। এ বাড়ির এক বুড়ি পিসি ছড়া কেটে বলেন, ‘হলুদ জব্দ শিলে, বউ জব্দ কিলে, পাড়াপড়শী জব্দ হয় চোখে আঙুল দিলে’! হ্যাঁ লা, ভামিনী, তোর দিদি ওই বউটাকে ঝ্যাঁটা পেটা করে না কেন? অমন মেয়ের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিতে হয়। পড়ত যদি আমাদের হাতে…।

নয়নতারা নামের মেয়েটিকে কখনও দেখেনি ভূমিসূতা, তবু তার জন্য কষ্ট হয়।

একদিন জানা গেল, সেই নয়নতারা গায়ে আগুন দিয়ে তার সব জ্বালা জুড়িয়েছে। তাতে মহিলামহলের কী আনন্দ! যাক, আপদ বিদায় হয়েছে। “অভাগার ঘোড়া মরে, ভাগ্যবন্তের মাগ মরে!” বীরশ্বেরের আবার একটি ভালো দেখে বিয়ে দিতে হবে। পাত্রী তো তৈরি আছে, ওই রামাই দত্তের কন্যা। রামাই দত্তের নজর খুব উঁচু, এক একটি মেয়ের বিয়েতে লক্ষ টাকার সোনা-দানা দেয়।

এদের এই পরচর্চার আসর থেকে ভূমিসূতা যখন তখন সরে পড়তে পারে। অন্য সব কাজই সে করে। কিন্তু কোনও কাজেই তার মন নেই। যখন তখন সে চলে যায় ছাদে, ভরতের ঘরের দিকে ব্যাকুল নয়নে চেয়ে থাকে।

ভূমিসূতার এই দেবতাটিও পাথরের। কোনও সময়েই একটুও সাড়া দেয় না।

ভরত যখন কলেজে চলে যায়, তখন ভূমিসূতা অনেকটা স্বাধীনতা পায়। দরজার তালা দেয় না ভরত, শুধু শিকল তুলে চলে যায়, নীচের সদর দরজা তো বন্ধই থাকে। ভূমিসূতা নির্জন দুপুরে শিকল খুলে চোরের মতন নিঃশব্দে ভরতের ঘরে ঢোকে। ভরতের চেয়ারে বসে, ভরতের পাঠ্য বই চোখের সামনে খুলে ধরে। ভরতের খাটেও একবার শুয়ে নেয় চট করে। এই ভাবে সে ভরতের স্পর্শ পায়।

ভরতের ঘরের বই সে নিয়ে যেতে সাহস করে না, কিন্তু কোনও কোনও বই রোজ দুপুরে পড়ে যায় খানিকটা করে। এইভাবে সে বঙ্কিমচন্দ্রের বেশ কয়েকটি রচনা পড়ে ফেলেছে।

একদিন সকালবেলা ছাদ থেকে দেখল, এ বাড়ির বিপরীত দিকে, রাস্তার ওপারে যে খানিকটা জঙ্গলাকীর্ণ স্থান পড়ে আছে, সেখানে কী যেন করছে ভরত। সঙ্গে তার দু’জন বন্ধু। ভূমিসূতা কৌতূহলে ছটফট করতে লাগল। একটু বাদে সে দেখল, ইট দিয়ে একটা উনুন বানিয়েছে ওরা, তাতে কাঠ গুঁজে আগুন ধরাবার পর প্রথম কিছুক্ষণ গলগল করে ধোঁয়াই বেরোল শুধু, এক সময় জুলে উঠল একটা শিখা।

ওরা বন-ভোজন করবে!

একদিন ভূমিসূতা আড়াল থেকে শুনেছিল, ভরতের এক বন্ধু মুরগির মাংস খেতে চাওয়ায় ভরত বলেছিল যে, এটা বৈষ্ণববাড়ি, এ বাড়িতে মুরগি রান্না সম্ভব নয়। সেই জন্য ওরা জঙ্গলের মধ্যে রান্নার ব্যবস্থা করেছে। ভূমিসূতার ইচ্ছে করল, এক ছুটে ওদের কাছে চলে যেতে।

ভূমিসূতার মনে পড়ে, তার বাবা যখন জীবিত ছিলেন, তখন দু’তিনটি পরিবার মিলে একবার যাওয়া হয়েছিল উদয়গিরি। সেখানে ঘোর জঙ্গল, পাহাড়ের ওপর বহুকালের পুরনো মন্দির। সেই পাহাড়ে আবার অনেকগুলি গুহা আছে, ভেতরে অন্ধকার, উকি দিলেই গা ছমছম করে। বাবা তবু জোর করে তাদের ঠেলে দিয়েছিলেন একটা গুহার মধ্যে। একটা জ্বলন্ত চ্যালা কাঠ নিয়ে দেখিয়েছিলেন, সেই গুহার দেয়ালে কী সব ছবি আঁকা আছে। সব কথা মনে নেই, কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে সেদিন খিচুড়ি রান্না হয়েছিল, সেই আনন্দের কথা স্পষ্ট মনে আছে। আর কিছু না, শুধুই খিচুড়ি, তার মধ্যে আলু আর পেঁয়াজ। কে জানে কোথা থেকে জোগাড় হয়েছিল কলাপাতা, ভূমিসূতার বয়েসি ছেলেমেয়েরা আগে থেকেই পাত পেতে গোল হয়ে বসে গিয়েছিল মাটিতে, তখনও খিচুড়ি নামেনি উনুন থেকে, টগবগ করে ফুটছে, কী খিদে পেয়েছিল ওদের, আর ধৈর্য ধরতে পারছে না, কী দারুণ গন্ধ বেরুচ্ছে…। তারপরই সেই গরম গরম খিচুড়ি, আঃ কী অপূর্ব স্বাদ, যেন অমৃত!

সেবারের সেই বনভোজনে ভূমিসূতার এক মামাও গিয়েছিলেন। মা-বাবা দু’জনেই হঠাৎ কলেরায় মরে যাবার পর, সেই মামাই ভূমিসূতাকে বিক্রি করে দেয়।

ভূমিসূতার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে থাকে।

ভূমিসূতার ওপর কঠোর নির্দেশ আছে, বাড়ির বাইরে সে কক্ষনও এক পাও বাড়াতে পারবে না। একবার শুধু বড় গিন্নির সঙ্গে গঙ্গা স্নানে যাওয়া ছাড়া সে এই কলকাতা শহরের কিছুই দেখেনি। গিয়েছিল ঘোড়ার গাড়িতে, দু’পাশে পর্দা ফেলা, সেই পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা টুকরো টুকরো দৃশ্য। গঙ্গা নদী তার কাছে এমন কিছু আহামরি মনে হয়নি, সে সমুদ্র দেখেছে।

এতদূর থেকে স্পষ্ট দেখা যায় না। ওরা হাঁড়ি-কড়া-খুন্তি জোগাড় করল কোথা থেকে? ভরত তো ছোট্ট একটি ডেকচিতে ভাত রাঁধে। মশলা পাতি বাটবেই বা কেমন করে? ছাদের পাঁচিল ধরে ঝুঁকে ভূমিসূতা ছটফট করে। তার ইচ্ছে করে, পাখি হয়ে ওখানে উড়ে যেতে।

ভরত যদিও আজকের বন-ভোজনের ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু রান্নার ভার নিয়েছে দ্বারিকা। তেল-মশলা সে-ই জোগাড় করে এনেছে, ভোরবেলা তাদের মেসের ঠাকুরকে দিয়ে তিন-চার রকম মশলা বাটিয়েছে। দ্বারিকা আজ অভিনব কিছু পাকপ্ৰণালী দেখাবে। ভরত তার অন্য দুই বন্ধু যাদুগোপাল আর ইরফানকেও নেমন্তন্ন করেছে, সে আর ইরফান আলু কেটে, পেঁয়াজ কুচিয়ে সাহায্য করছে দ্বারিকাকে। যাদুগোপাল আগে থেকেই বলে দিয়েছে, সে কোনও কাজ করতে পারবে না। সে রান্না বান্নার কিছুই জানে না, শিখতেও চায় না।

ভরতের ঘর থেকে একটা মাদুর এনে পাতা হয়েছে ঘাসের ওপর। তার ওপর কাত হয়ে শুয়ে আছে যাদুগোপাল। যাদুগোপাল সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজের সদস্য, দ্বারিকা গোঁড়া হিন্দু আর ইরফান আলি সুন্নি মুসলমান, কিন্তু একটা ব্যাপারে এদের মিল আছে, খাদ্য সম্পর্কে এদের কোনও শুচিবাই বা বাছ-বিচার নেই। সব মানুষের মধ্যেই কিছু কিছু বৈপরীত্য থাকে, যাদুগোপাল নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্ম, কিন্তু সে পছন্দ করে রসের গান, তার গলাটিও বেশ সুরেলা। দ্বারিকা কট্টর হিন্দু হলেও সে খুব ভালোবাসে ইরফানকে। একদিন সে ইরফানকে বলেছিল, তুই শালা মোছলমানের ঘরে জন্মালি কেন? তুই হিন্দু হলে তোর সঙ্গে আমার বোনের বিয়ে দিতাম। ইরফান কথা বলে কম, তার মনের গঠনটাই এমন যে কোনও কিছু সম্পর্কেই তার তিক্ততা বোধ নেই, সে যে-কোনও ঘটনাই তার সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বিচার করে।

ইরানেরনের সঙ্গে ভরত নিজের অনেকটা মিল খুঁজে পায়। সে মুর্শিদাবাদের এক অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান, অল্প বয়েসেই পিতৃহীন। লেখাপড়া শেখার এত তীব্র টানেই সে এক নগণ্য গ্রাম থেকে কলকাতা শহরে এসে পৌঁছেছে। নবাব আব্দুল লতিফের এক কর্মচারির বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকে। নবাব আবদুল লতিফের পরিবারের দুটি ছেলে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। তারা ধনীর দুলাল, তারা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ইরফানকে তাদের মধ্যে মেশার উপযুক্ত মনে করে না। তবু ওদের প্রতিও ইরফানের কোনও অভিযোগ নেই।

যাদুগোপাল গুনগুনিয়ে একটা গান ধরল :

বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরিকাটার ঝনঝনি
খানা খাওয়ার মজা আমরা তার কী জানি?
জানেন ঠাকুর কোম্পানি…

দ্বারিকা উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে মাংস কষতে গিয়ে গায়ের জামা খুলে নিয়েছে। ধুতি পরা, খালি গা, কোমরে জড়িয়ে নিয়েছে, একটা গামছা, গলায় ঝোলানো পৈতে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, তাকে যজ্ঞিবাড়ির রান্নার ঠাকুরের মতনই দেখাচ্ছে অনেকটা। সে মুখ ফিরিয়ে বলল, এ আবার কী গান, কখনও শুনিনি তো!

যাদুগোপাল বলল, তুই তো আজ আমাদের খানা খাওয়াচ্ছিস, তাই মনে পড়ে গেল দ্বারিকানাথ ঠাকুরের কথা। বেলগাছিয়ায় দ্বারিকানাথের যে মস্তবড় বাগানবাড়ি ছিল, সেখানে প্রায়ই খুব খানাপিনা হতো। সে বেলগাছিয়া ভিলা অবশ্য এখন বিক্রি হয়ে গেছে। ঠাকুরদের আর নেই। সিংহীরা কিনে নিয়েছে।

দ্বারিকা বলল, তা জানি। দেবেন ঠাকুর যখন দেউলে হল, তখন ও সব বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তা ও গান কে বাঁধলে?

যাদুগোপাল বলল, বোধহয় রূপচাঁদ পক্ষী। এখনও বাগবাজারে মাঝে মাঝে শোনা যায়।

দ্বারিকা বলল, আর নেই? বাকিটা শোনা!

যাদুগোপাল আবার গাইল :

কী মজা আছে রে লাল জলে
জানেন ঠাকুর কোম্পানি
মদের গুণাগুন আমরা কী জানি
জানেন ঠাকুর কোম্পানি…

দ্বারিকা চোখ বড় বড় করে, জিভ কেটে বলল, এই রে, দারুণ ভুল হয়ে গেছে। লাল জলের তো ব্যবস্থা করা হয়নি! দু’পাত্তর না টানলে মাংস খাওয়া জমবে কী করে?

ভরত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, ভাই, ওসব এখানে চলবে না। কাছেই রাস্তা দিয়ে লোক যাওয়া-আসা করছে, বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।

যাদুগোপাল ভরতকেই সমর্থন করে সহাস্যে বলল, ওসব কি আর দিনের বেলা জমে। সূর্য ডুবুক আগে!

ইরফান বলল, আর একখানা গান শোনাও, যাদু!

যাদুগোপাল বলল, এই গানটা তোরা শুনেছিস?

আজব শহর কলকেতা
রাড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার
কী কেতা!
হেথা ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে, বলিহারি
ঐক্যতা
আজব শহর কলকেতা

যাদুগোপাল হঠাৎ থেমে যেতেই দ্বারিকা অট্টহাসি করে উঠল। খুন্তি হাতে নিয়ে নাচের ভঙ্গি করে বলল, থামলি কেন, থামলি কেন, পরের টুকু গা।

যাদুগোপাল বলল, পরের দিকে বড় অশ্লীল!

দ্বারিকা বলল, পরের লাইনে তোদের বেহ্মদের খোঁচা আছে, তা বুঝি জানি না? তাই চেপে যাচ্ছিস শালা।

যাদুগোপাল বলল, তোদের হিন্দুদেরও ছাড়েনি হুতোম প্যাঁচা।

ভরত বলল, আমরা আগে শুনিনি। শোনাও ভাই, সবটা শোনাও।

যাদুগোপাল গাইল : –

হেথা ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি
ঐক্যতা
যত বক বিড়ালে ব্ৰহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির
ফাঁদা পাতা।
পুঁটে তেলির আশা ছড়ি, গুঁড়ি সোনার
বেনের কড়ি
খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ি, ভদ্রভাগ্যে
গোলপাতা
হদ্দ হেরি হিন্দুয়ানি, ভিতর ভাঙা ভড়ং
খানি
পথে হেগে চোকরাঙ্গানি, লুকোচুরির
ফের গাঁতা…

ইরফান বলল, মোছলমানদের নিয়ে কিছু লেখেনি?

যাদুগোপাল বলল, হিন্দুরা মোছলমানদের ধর্ম নিয়ে খোঁচা মারতে ভয় পায়। তোদের মোছলমানদের মধ্যে কেউ নিজেদের ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে গান বাঁধেনি?

ইরফান বলল, ওই একটা ব্যাপার নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার সাহস কোনও মোছলমানের নেই। আমি অন্তত সেরকম কিছু কখনও শুনিনি।

যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে, তোদের মুসলমানদের মধ্যে নাস্তিক আছে?

দ্বারিকা বলল, মোছলমান আবার নাস্তিক? এ যে বাবা কাঁঠালের আমসত্ত্ব!

ভরত বলল, দ্বারিকা, আঁচ নিভে গেল যে!

দ্বারিকা আবার উনুন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। বসন্তের বাতাস। এমন বাতাসে খোলা জায়গায় উনুন জ্বলিয়ে রান্না করা খুবই কষ্টকর। মাঝে মাঝেই আঁচ কমে যাচ্ছে। এখনও মাংস সেদ্ধ হয়নি, ভাত-ডাল বাঁকি। মধ্যাহ্ন পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।

দ্বারিকা মাটিতে শুয়ে পড়ে ফু দেয়। নতুন কাঠ গোঁজে, তবু আঁচ চাঙ্গা হতে চায় না।

দ্বারিকার রন্ধনকুশলতা সম্পর্কে যাদুগোপালের কোনও ভরসা নেই। সে টিপ্পনি কেটে বলল, আজ কি খাওয়ার কোনও আশা আছে? পেটে যে ছুঁচোয় ডন মারছে।

দ্বারিকা বলল, হবে, হবে। গান গাইছিলি, গান গেয়ে যা।

যাদুগোপাল বলল, অন্নচিন্তা চমৎকারা, এই সময় আর গান-কবিতা আসে না।

দ্বারিকা নানা রকম চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু আগুন ক্রমশই ঝিমিয়ে আসছে।

ভরত বলল, একটা চাদর এনে এদিকটায় বুলিয়ে দেব। তাতে যদি বাতাস আটকায়।

যাদুগোপাল হাসতে হাসতে বলল, চাদর টাঙিয়ে কি আর বসন্তের বাতাস আটকানো যায়? আজ যা বুঝছি, দখিনা পবনেই পেট ভরাতে হবে।

এই সময় কাছেই একটা ঝোপে খচর মচর শব্দ হল।

সকলেই চমকে উঠে তাকাল সেদিকে। যাদুগোপাল বলল, ওখানে আবার কী, শেয়াল নাকি? এবার শেয়ালের পাল ধেয়ে এলেই সোনায় সোহাগা হবে।

আর একবার শব্দ হতেই ভরত এগিয়ে গেল ঝোপের দিকে।

তাকে দেখেও লুকোল না, ঝোপের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী। অনেকক্ষণ ধরেই সে এদের দেখছে।

ভরত ভুরু কুঞ্চিত করে বলল, তুমি? তুমি এখানে কেন এসেছ?

ভূমিসূতা এগিয়ে এল সামনের দিকে।

ভরত আবার ধমক দিয়ে বলল, তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে?

যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, কে এই মেয়েটি?

দাসী কথাটা উচ্চারণ করতে পারল না ভরত। সে বলল, আমি যে বাড়িতে থাকি, সেই বাড়িতেই ও থাকে।

ভূমিসূতা কোনও কথাবার্তা না বলে বসে পড়ল উনুনের সামনে।

যাদুগোপাল বলল, হ্যাঁ উনুনটা ধরিয়ে দাও তো বাছা। এসব কাজ ওরাই ভালো পারে, এ কি পুরুষ মানুষের কম্মো!

ভূমিসূতা ক্ষিপ্ৰ হাতে কয়েকটি চ্যালা বার করে নিল। দ্বারিকা বেশি বেশি কাঠ গুঁজেছিল। ভূমিসূতা চালাগুলি আবার সাজিয়ে নিজের আঁচল দিয়ে বাতাস করতে লাগল জোরে জোরে।

একটু পরেই ফিরে এল আগুন।

যাদুগোপাল বলল, বা বা বা বা! বলেছি না, ওরাই ভালো পারে।

ভূমিসূতা হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখছে, ভরত বলল, ঠিক আছে, এবার তুমি বাড়ি যাও!

যাদুগোপাল বলল, কেন, ও থাকুক না। দ্বারিকাকে সাহায্য করুক।

দারিকা বলল, এই সেই মেয়েটি, যে ভালো গান জানে? নাচ জানে?

যাদুগোপাল মহা বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, নাচ? এ মেয়ে নাচতে জানে?

ভরত বলল, ও ঠিক বাঙালি নয়। ওর বাড়ি ছিল উড়িষ্যায়। একটু আধটু লেখাপড়াও জানে। ওর কথা তোমাদের পরে বলব, এখন ওর এখানে থাকাটা ঠিক নয়।

যাদুগোপাল বলল, কেন? আমরা পিকনিক করছি, এ মেয়েটিও আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে ক্ষতি কী?

দ্বারিকা বলল, রাস্তা দিয়ে লোকজন হাঁটছে। এবার এদিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে।

যাদুগোপাল বলল, তা থাক না, তাতে আমাদের ভারি বয়েই গেল। দেখ ভাই, আমাদের সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজে পুরুষের সঙ্গে নারীদেরও সমান অধিকার। পুরুষরা যা পারে, নারীরাও তা পারে। অন্দরমহল থেকে মেয়েদের মুক্তি না দিয়ে আর কতদিন আমরা তাদের অন্ধকারে আটকে রাখব?

দ্বারিকা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, রাখো তোমার ওই সব বড় বড় কথা! তোমাদের ওই সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজের নীতি কি সারা হিন্দু সমাজ মেনে নিয়েছে? তোমাদের ক’জন মোটে ব্ৰাহ্মা! হিন্দু মেয়ে গৃহকর্ম শিখবে, ঘরে বসেই কিছু লেখাপড়া শিখবে, পতি-পুত্রের সেবা করবে, সংসারে শ্ৰী আনবে, এটাই হিন্দু নারীর চিরকালের আদর্শ!

ভূমিসূতা ঘাড় ঘুরিয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল যাদুগোপালের দিকে। এই লোকটি যা বলল, সেই রকম কথা বলতেন তার বাবা। এখানে এসে আর কোনও পুরুষের মুখে সে এ পর্যন্ত এমন কথা শোনেনি।

যাদুগোপাল বলল, চিরকালের আদর্শ না কচু! তুমি ইতিহাস কিছু পড়েনি।

কিন্তু ইতিহাসে কী আছে না আছে তা নিয়ে ক’জন মাথা ঘামায়! দ্বারিকার কথাই সত্য হল, রাস্তা দিয়ে একটি ঘোড়ার গাড়ি যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গেল। ভেতরের যাত্রীরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল এদিকে। তারা ভূমিসূতাকেই দেখছে। বিশেষ বিশেষ উৎসবের দিনে অনেকে পতিতাপল্লী থেকে মেয়ে ভাড়া করে গঙ্গার ওপর নৌকোয় ফুর্তি করে, সেটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ভদ্রপল্লীর মধ্যে দিনের বেলায় কয়েকটি ছোকরা একটি মেয়েকে নিয়ে বেলেল্লা করছে, এ কী হল দেশের অবস্থা! ক্ৰমে গুটি গুটি আরও কয়েকটি লোক দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে।

যাদুগোপাল বলল, দেখুক, ওরা যত ইচ্ছে দেখুক। আমরা গ্ৰাহ্য করব না। আমরা তো কিছু অন্যায় করছি না!

ভরত তবু আদেশের সুরে বলল, ভূমি, এক্ষনি বাড়ি চলে যাও!

ভূমিসূতা তৎক্ষণাৎ হাতের খুন্তিটা নামিয়ে রেখে এক ছুটে ঢুকে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। এই দিক দিয়ে তাদের বাড়ির বাগানে ঢোকার বুঝি একটা পথ আছে!

যাদুগোপাল বলল, তোরা এত ভিতু কেন? এই ভাবেই তো আস্তে আস্তে লোকের মন থেকে ভুল ধারণা কাটাতে হয়। লোকগুলো দেখত, আমরা এখানে মদ খেয়ে মাতালও হচ্ছি না, ওই মেয়েটির আঁচল ধরে টানাটানিও করছি না! শুধু এক সঙ্গে মিলে মিশে পিকনিক করছি, এতে দোষের কী আছে?

দ্বারিকা বলল, এই তো মাংস হয়ে এল। এবার ভাত চাপাব। আমি রান্না করে খাওয়াব বলেছি, এর মধ্যে আবার একটা মেয়েছেলেকে আনার কী দরকার?

যাদুগোপাল বলল, রোজ রোজ মেসের খাবার খাই, মাঝেসাঝে হোটেল-মোটেলে খাই, কতদিন কোনও মেয়ের হাতের পরিবেশন করা খাবার খাই না। মেয়েরা পরিবেশন করলে সে খাবারের স্বাদ অনেক ভালো হয়ে যায়।

দ্বারিকা বলল, পুজোর সময় দেশে যাবি, তখন মায়ের হাতে খাবি।

যাদুগোপাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পূজো ছুটির এখনও কত দেরি!

তারপর সে ইরফানের দিকে ফিরে বলল, কী রে, ইরফান, তুই কিছু বলছিস না যে!

ইরফান মুখ নিচু করে মাটি থেকে ঘাস ছিঁড়ছে। ভূমিসূতা-প্রসঙ্গে সে একটাও মন্তব্য করেনি। যাদুগোপাল জিজ্ঞেস করল, তুই যে পাড়ায় থাকিস, সেখানে যদি তোদের বাড়ির একটা মেয়ে এসে পিকনিকে যোগ দিত, তাহলেও কিছু গাড়ল হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকত?

দ্বারিকা বলল, ওদের বাড়ির কোনও মেয়ে এরকম হুট করে বাইরে আসত? তোর মাথা খারাপ হয়েছে?

ইরফান বলল, তা ঠিক। আজকাল তবু হিন্দু বাড়ির কিছু কিছু মেয়ে বাইরে বেরোয়, মুসলমান মেয়েরা এখনও সে স্বাধীনতা পায়নি। তোমাদের একটা গল্প বলি শোনো। জান তো, আমি নবাব আবদুল লতিফ সাহেবের বাড়িতে থাকি। মন্ত বড় তিন মহলা বাড়ি। আমি সে বাড়ির কেউ না, নোকর-খিদমতগারদের কোয়ার্টারের একটা ঘর পেয়েছি কোনও রকমে। ভেতর মহলে আমার যাওয়া নিষেধ, বাড়ির স্ত্রীলোকদের কখনও চোখেও দেখিনি। তবু ভিতর মহলের কিছু কিছু খবর কানে আসে। একদিন সে বাড়ির মহিলাদের একটা কান্নার রোল শুনেছিলাম। কারণটা কী জান? আন্দাজ করতে পারবে? পারবে না! ও বাড়ির একটি মেয়ে লোরেটা ইস্কুলে ভর্তি হতে চেয়েছিল। সেই জন্য কান্না।

ইরফানের বন্ধুরা হাসি সামলাতে পারল না। দ্বারিকা বলল, মুসলমান ছেলেরাই তো ইংরেজি ইস্কুলে পড়তে চায় না, হঠাৎ একটা মেয়ের ওই শখ হল কী করে?

ইরফান বলল, ও পাড়ায় খ্রিস্টানদের কয়েকটা বাড়ি আছে। সেই সব বাড়ির কয়েকটি বাচ্চা মেয়ে এ বাড়ির বাচ্চাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে খেলতে আসে। খ্রিস্টান মেয়েরা সবাই লোরেটো ইকুলে পড়ে। তাদের কাছে ইস্কুলের গল্প শুনে এ বাড়ির একটি মেয়েরও ইস্কুলে পড়ার সাধ হল।

যাদুগোপাল বলল, আহা রে! শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পেরেছে?

দ্বারিকা বলল, গল্পটা শোন না!

ইরফান বলল, মেয়েটির নাম ফাতিমা। আট ন বছর বয়েস। ফুটফুটে চেহারা। আমি তাকেও দেখিনি, ও বাড়িতে পর্দার খুব কড়াকড়ি, জুবেদা নামে এক বুড়ি নোকরানির কাছে সব শুনেছি। ফাতিমা বাড়ির সবার খুব আদরের। সেও শুরু করে দিল কান্না, খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ করে দিল। তার আবদার রক্ষা করাও যায় না, অথচ সে কিছু না খেলে সবার কষ্ট। তখন বাড়ির সব মহিলারা একটা আলোচনা সভা বসাল। সেখানে ডাকা হল একটি খ্রিস্টান মেয়েকে। তাকে জেরা করে সবাই জানতে চাইল সেই ইস্কুলের রীতি নীতি। আলোচনা সভার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন দাদিমা। তাঁর দারুণ ব্যক্তিত্ব, গোটা সংসার চলে তার হুকুমে। তিনি প্রথমেই জানতে চাইলেন, বোরখা পরে লোরেটো স্কুলে যাওয়া যায়।

খ্রিস্টান মেয়েটির নাম জেনিফার। সে মাথা নেড়ে বলল, না। বোরখা চলবে না। স্কার্ট পরতে হবে। অনেক হিন্দু ছাত্রী আছে, তারাও শাড়ি পরে না, স্কার্ট পরে স্কুলে আসে।

মহিলারা সবাই চোখ কপালে তুললেন। প্রবলভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, খানদানি বংশের মেয়ে বোরখা ছাড়া বাড়ির বাইরে যাবে, তা হতে পারে না, হতে পারে না, হতে পারে না!

ফাতিমা মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী। সে বলল, আমি বোরখা পরেই যাব। বাড়ির গাড়িতে যাব। একেবারে স্কুলের দরজার কাছে গিয়ে বোরখা খুলে রাখব গাড়িতে। তলায় থাকবে স্কুলের পোশাক।

দাদিমা তখন জিজ্ঞেস করলেন, ইকুলের দরজায় দারোয়ান থাকে। সে পুরুষ না? জেনিফার বলল, হ্যাঁ থাকে, দু’জন পুরুষ দারোয়ান!

মহিলার দল বলে উঠলেন, পুরুষ দারোয়ান এ বাড়ির মেয়ের মুখ দেখবে? তা হতে পারে না, হতে পারে না, হতে পারে না।

ফাতিমা বলল, আমি গাড়ির মধ্যে বসে থাকব। যখন দেখব। এক দঙ্গল মেয়ে এক সাথে ঢুকছে, তখন তাদের মধ্যে মিশে যাব। দারোয়ানরা আমাকে দেখতে পাবে না।

—ইস্কুলে কারা পড়ায়? পুরুষ মাস্টার, না দিদিমণি?

—সব দিদিমণি।

—ভেতরে একজনও পুরুষ থাকে না?

-অফিস ঘরে দু’জন থাকে। হিসেব পত্র রাখে। সেখানে না গেলেও চলে। অন্য মেয়েদের হাত দিয়ে মাইনে দেওয়া যায়।

—কোরান শরিফ পড়ানো হয়?

—না, বাইবেল। তবে ইচ্ছে করলে সে ক্লাসে না গেলেও পারে। অনেক হিন্দু মেয়ে পড়ে না।

—আর কী কী পড়ায়?

-আমি বলছি। প্রথমেই হয় প্রেয়ার। মানে প্রার্থনা। সেখানে সব মেয়েকেই যোগ দিতে হয়। তারপর

-কিসের প্রার্থনা?

—যিশুর নামগান।

আবার সব মহিলা বললেন, না, না, না, মুসলমানের মেয়ে যিশুর নামগান করবে? তা হতে পারে না, তা হতে পারে না, তা হতে পারে না।

ফাতিমা বলল, দাদিমা, আমি প্রার্থনার সময় শুধু ঠোঁট নাড়ব। মনে মনে কোরান শরিফ বলব। কোনওদিন যিশুর নাম উচ্চারণ করব না।

যাদুগোপাল বলল, বাঃ, মেয়েটির তো খুব বুদ্ধি? তা হলে পরীক্ষায় পাশ করে গেল! ভর্তি হয়েছে?

ইরফান দু’দিকে মাথা নাড়ল।

সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন, আর কিসের আপত্তি?

ইরফান বলল, সবাই যখন প্রায় রাজি হয়ে গেছে তখন জেনিফার অতি উৎসাহের সঙ্গে বোঝাতে লাগল তাদের স্কুল কত ভালো। স্কুল বাড়ির বর্ণনা দিতে দিতে বলে ফেলল, তাদের স্কুল বিল্ডিং-এর মধ্যে অনেক সুন্দর মূর্তি আছে। যিশু, মা মেরি, অনেক খ্রিস্টান সেইন্টের মূর্তি। অমনি মহিলাদের মধ্যে আবার কান্নার রোল পড়ে গেল। দাদিমারও প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার মতন অবস্থা। এতক্ষণ তিনি এ কথাটা শোনেননি, কী ভুল হতে যাচ্ছিল! মূর্তি! ফাতিমা তো স্কুলে সর্বক্ষণ চোখ বুজে থাকতে পারবে না। মুসলমান মেয়ে হয়ে সে মূর্তি দেখবে? সে যে অতি পাপ! না না না, তা হতেই পারে না, হতেই পারে না, হতেই পারে না!

ভরত জিজ্ঞেস করল, ফাতিমা তার পরেও কান্নাকাটি করে না?

ইরফান বলল, তাকে লখনৌ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যাদুগোপাল ইরফানের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, তোদের মুসলমানদের মধ্যে একজন বিদ্যাসাগর দরকার। ইরফান, তুই একটা আন্দোলন শুরু করে দে।

ইরফান বলল, বিদ্যাসাগর মশাই অতি মহান। কিন্তু ভাই, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তোমরা তাঁকে কতটুকু মানো? আমাদের মধ্যে বিধবা মেয়ের বিয়ের কোনও সমস্যা নেই। হিন্দু বিধবাদের দুঃখের জীবন দেখে বিদ্যাসাগর মশাই বিধবা বিয়ে চালু করার জন্য কত না কষ্ট সহ্য করলেন। তবু, এখনও কটা বিধবার বিয়ে হয়? বুকে হাত দিয়ে বলো তো, তোমাদের নিজেদের বাড়িতে কেউ কোনওদিন বিধবা বিয়ে করেছে? তোমরা নিজেরাও কি রাজি আছ?

দ্বারিকা বলল, এখন বাজে তর্ক শুরু করো না। আমার রান্না প্ৰায় শেষ। পাত পাতার ব্যবস্থা করো। লবণ-লেবু দাও!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়