ঘুমের মধ্যে ভরতের হঠাৎ শ্বাসরোধ হয়ে গেল। ছটফটিয়ে জেগে উঠতেই অন্ধকারের মধ্যে সে অস্পষ্টভাবে দেখল একটা দৈত্য ঝুঁকে আছে তার মুখের কাছে। তার বিশাল থাবায় চেপে ধরেছে তার নাক মুখ।

তা হলে ভরত তুই মরলি। এই তোর শেষ! আতঙ্ক ও যন্ত্রণার মধ্যে এই কথাই মনে এলো তার। তার দৃঢ় বিশ্বাস হল, মাস্টারবাবুর কথা শুনে ইদানীং মা কালীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে তার মনে যে সন্দেহ জন্মেছিল, সেই পাপেই তাকে মরতে হচ্ছে, স্বয়ং মা কালীই যমদূত পাঠিয়েছেন।

একটি ঘ্যাড়ঘেড়ে কণ্ঠ বলল, চুপ করে থাক ছোড়া, একটু শব্দ করলেই অক্কা পাবি।

ভরতের ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যাবার মতন অবস্থা, চ্যাঁচাবার শক্তিই নেই।

যমদূত একটা গামছা দিয়ে শক্ত করে বাঁধল তার মুখ, তারপর চুল ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, চল!

ঘরের বাইরে ওই যমদূতের মতন চেহারার আর একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা বর্শা। নেংটি পরা, খালি গা, মুখ দিয়ে ভকভক করে বেরুচ্ছে ধেনোর গন্ধ।

আকাশ আজ মেঘলা। বাতাসে হিম হিম ভাব। রাজপুরীর দেউড়িতে মশাল জ্বলছে বটে, কিন্তু ঘরগুলির সব অন্ধকার। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, এখন কত রাত কে জানে। লোকদুটি ভরতকে ঠেলতে ঠেলতে খানিক দূর নিয়ে গেল, তারপর একটা ঘোড়ায় চড়িয়ে দিল। একজন বসল তার সঙ্গে।

ভরত মনে মনে বলল, ও ভরত, তোকে এরা গলা টিপে মারবে না, মা কালীর মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বলি দেবে। সেটা এক হিসেবে ভালই, গলা চলে মারলে অপঘাতে মৃত্যু, তাতে ভূত হয়। আর মায়ের মন্দিরে বলি দিলে আত্মা তখনই মুক্তি পেয়ে যায়।

ভরতের সাঙ্ঘাতিক ভূতের ভয়, সে নিজেও ভূত হয়ে কারুকে ভয় দেখাতে চায় না।

কয়েকদিন ধরেই ভরত অনুভব করছিল, তার খুব বিপদ ঘনিয়ে আসছে। একটা আশঙ্কা বেড়াজালের মতন ঘিরে ধরছে তাকে। বিপদটা যে এইভাবে আসবে, তা সে ঠিক ভাবেনি। কী কুক্ষণে সে মাস্টারবাবুর নজরে পড়েছিল! লেখাপড়া শিখতে তার ভালো লাগে, কিন্তু ঠাকুর-দেবতা সম্পর্কে এত সব অকথা-কুকথা তিনি বলেন কেন?

একদিন ভরত মাস্টারবাবুকে বলেছিল, স্যার আমাকে তারকদাদা বলেছে, ঠাকুর-দেবতার নামে দিব্যি কেটে যদি কেউ সে কথা না রাখে, তা হলে তার জিভ খসে পড়ে।

শশিভূষণ অনেকখানি জিভ বার করে বলেছিলেন, দেখ, আমার জিভ আস্তই আছে। শোন ভরত, তোকে একটা মজার গল্প বলি। কলকাতার ভবানীপুরে দুটি ভাই থাকত। ব্ৰাহ্মণের ছেলে, বড় ভাইটি খুব ভক্তিমান, সকালবেলা গায়ত্রী মন্ত্র জপ না করে সে জল পর্যন্ত খায় না, প্রত্যেকদিন পুজো-আচ্চা করে। অতিশয় সজ্জন আর ধাৰ্মিক। তার ভাইটির স্বভাব-চরিত্র একেবারে বিপরীত। সে খনিজ পদার্থ নিয়ে উচ্চ লেখাপড়ার জন্য বিলেত গিয়েছিল, ফিরে এসেছে একেবারে নাস্তিক হয়ে। গরু-শুয়োর খায়, রান্না ঘরে জুতো পরে যায়, অনেক রাত পর্যন্ত ইয়ার-বক্সিদের নিয়ে হৈ-হল্লা করে, ঠাকুর-দেবতার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার কোনও বালাই নেই। তার কথাবার্তা শুনে বড় ভাইটি কানে আঙুল দেয়, কিন্তু তাকে শাসনও করতে পারে না, কারণ সে অর্ধেক সম্পত্তির মালিক। একদিন হয়েছে, কি, মাঝরাত্তিরে মা কালী ওই বড় ভাইটিকে স্বপ্নে দেখা দিলেন। রাগে চোখ পাকিয়ে মা কালী বললেন, তোর ওই ছোট ভাইটিকে শিগগির এ বাড়ি থেকে তাড়া। ওকে দূর করে দে। যদি তুই তা না করিস, তা হলে তোর সর্বনাশ হয়ে যাবে। তোকে আমি ওলাউঠায় নির্বংশ করে দেব। বড় ভাইটি হাত জোড় করে বলল, মা, আমি তো কোনও দোষ করিনি, আমায় ভয় দেখাচ্ছে কেন? তুমি ওকে ভয় দেখাও! ওর সর্বনাশ করে দাও! অমনি মা কালীর মুখখানা কাঁচুমাচু হয়ে গেল। তিনি বললেন, ওকে আমি কী করে ভয় দেখাব? ও যে আমাকে মানেই না!

ইস, এই খারাপ গল্পটা মনে পড়ল কেন? মায়ের কাছে বলি হবার আগে মনটাকে শুদ্ধ করে নিতে হবে। মা, তুমি আমাকে চেয়েছ, আমি ধন্য। পরের জন্মে আমি প্রতিদিন তোমার পুজো করব।

এরা কোন মন্দিরে নিয়ে যাচ্ছে! পাশাপাশি দুটি ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। অন্ধকার ভেদ করে পথ চিনে যেতে ওদের কোনও অসুবিধেই হয় না। ভরত দেখতে পাচ্ছে না কিছুই। বিশ্ব চরাচর তার চোখে এখন নিকষ কালো।

খুব লাগবে! অবশ্য কয়েক মুহূর্তের তো ব্যাপার। মালু করাতী এক কোপে মোষ বলি দেয়। একদিন পর পর তিনটি মোষের গলা কাটার পর রক্তাক্ত খাড়া তুলে, গাঁজা খাওয়া লাল চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলেছিল, কেউ হাতি মানত করে না? আমি এক কোপে হাতিও…।

শুকনো পাতার শব্দে বোঝা যায় চারপাশে জঙ্গল। সেই জঙ্গলের গভীরে এসে এক জায়গায় ঘোড়া থামল। ধীরে সুস্থে নামাবার ধৈর্য নেই, সঙ্গীটি মাটিতে ঠেলে ফেলে দিল ভরতকে। তারপর নিজে নেমে ভরতের বুকের ওপর চেপে রাখল একটা পা। অন্যজন ঘোড়া দুটো বেঁধে বিড়ি ধরাল। বিড়ি টানতে টানতে কী যেন গল্প জুড়ে দিল দুজনে।

এখানে মন্দির কোথায়? ভরত ঘাড় ঘোরাতেও পারছে না। ভয়ে। যদি মুখে লাথি মারে। বলি হওয়ার আগে আর শুধু শুধু অতিরিক্ত শাস্তি ভোগ করা কেন?

মুখের গামছাটা আলগা হয়ে গেছে, এখন সে ইচ্ছে করলে কথা বলতে পারে, কিন্তু কথা বলার সাহস নেই ভরতের।

একটু পরে ওদের একজন শাবল দিয়ে খুঁড়তে লাগল মাটি।

চিত-শোওয়া অবস্থায় ভরত দেখতে পাচ্ছে আকাশ। এখানে তেমন মেঘ নেই। ঝিকঝিক করছে। কয়েকটা নক্ষত্র। পুণ্যবান মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়। চাঁদ নেই এদিকে। না, মাস্টারবাবুর কথা সে মানে না, আকাশেই দেবতারা থাকেন। কোনও দেবতা কি ভরতকে দেখছেন এখন? তার মা? কোনও কাছুয়া রমণীর যোগ্যতা নেই আকাশের তারা হবার, তাদের যে পাপের জীবন। পাপের মধ্যেই ভরতের জন্ম। এবার সে মুক্তি পাবে। মা কালী ভরতকে তাঁর চরণে আশ্ৰয় দেবেন।

মাস্টারবাবু তাকে মহাভারতের কর্ণের একটা উক্তি শিখিয়েছেন। দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম, মদায়ত্তং হি পৌরুষম! কোথায় তোমার জন্ম হল, তাতে তো তোমার হাত নেই, কিন্তু পৌরুষ নিজে আয়ত্ত করা যায়। মাস্টারবাবু বলেন, পুরুষ হও ভরত। নিজের বুদ্ধিতে সব কিছু বিচার করতে শেখো।

পৌরুষ মানে কী? কর্ণের মতন তীর-ধনুক চালনা শিখতে শুরু করেছিল ভরত। বিরুজ সর্দার বুড়ো হয়েছে বটে কিন্তু এখনও তার নজর ঠিক আছে। বেশ যত্ন করেই শেখাচ্ছিল তাকে, কিন্তু কুমার বীরচন্দ্র একদিন তার ধনুকটা কেড়ে নিয়ে গেল। ভরতের নিজস্ব সম্পত্তি নেই, তবু কখনও তার হাতে কোনও জিনিস থাকলেই কুমাররা কেউ না কেউ তা কেড়ে নিতে চায়। এখানে ভরত পৌরুষ দেখাবে কী করে। প্রত্যেক কুমারেরই নিজস্ব দলবল আছে, ভরতের কেউ নেই। সে একা।

একজন লোক মাটি খুঁড়েই চলেছে, অন্যজন তাকে তাড়া দিয়ে বলল, কী রে, রাত ভাের করে দিবি নাকি ; কতটা হল দেখি!

ভরতের বুকের ওপর থেকে পা সরিয়ে নিয়ে যে গর্তটা দেখতে গেল।

ভরত কোনও কিছু চিন্তা না করেই তাড়াক করে উঠে দাঁড়াল, তারপর সোজা দৌড় দিল একটা বুনো শুয়োরের মতন। তাকে ছুটে ওরা ধরতে পারবে না।

সঙ্গে সঙ্গে একজন যমদূত তার দিকে ছুড়ল বর্শা। নিখুঁত তার টিপ, সেই বর্শা গেঁথে গেল তার বাম উরুর পেছন দিকে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। লোকটি কাছে এসে হাসল। নিজের কৃতিত্বে সে মুগ্ধ। বর্শাটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে সে বলল, এ কাঠামো তোর শেষ রে! ভাগবি কোথায়!

একটিমাত্র কাতর শব্দ করেই থেমে গেছে ভরত। শরীরটা খুঁতে হয়ে গেল, আর সে বলির কাজে লাগবে না। অবশ্য গর্ত খোরা দেখেই সে বুঝেছিল, অপঘাতে মৃত্যুই তার ললাটলিখন। এ জন্মটা তো গোলই, পরজন্মেও কুকুর-বেড়াল হয়ে লাথি-ঝাঁটা খেতে হবে। চোখের সামনে সে যেন শশিভূষণ মাস্টারের মুখখানা দেখতে পেল, তাঁর উদ্দেশে বলল, পালাবার চেষ্টা তো করেছিলাম, একেবারে নির্জীবের মতন আত্মসমৰ্পণ করিনি। একেই পৌরুষ বলে বোধহয়, সব জায়গায় পৌরুষ দেখিয়েও তো কিছু লাভ হয় না।

যমদূতটি চুলের মুঠি ধরে হ্যাচড়াতে হ্যাচড়াতে তাকে নিয়ে এলো গর্তের কাছে। অন্যজনকে বলল, যথেষ্ট হয়েছে, ওতেই হবে। নে, এবার এটাকে ফেল।

গর্তের মধ্যে ভরা হল ভরতকে। গর্ত তেমন গভীর হয়নি, ওরা দুজনে ভরতের কাঁধ ধরে ঠেসে দিতে লাগল, যেমন ভাবে মাপে ছোট কোনও ওয়াড়ের মধ্যে ভরা হয় লম্বা পাশবালিশ, তলার দিকে পা দু’খানা বেঁকে গেল ভরতের। শুধু কাঁধের ওপর মুণ্ডুটা রইল গর্তের বাইরে। তারপর মাটি ভরাট হল।

এ রকম শাস্তির কথা ভরত শুনেছে। রাজপরিবারের কেউ ক্রুদ্ধ হলে বা কারুর সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত লাগলে সেই বেয়াদবকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়। নির্বাসন মানে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে দেওয়া নয়, তা হলে সে তো গোপনে আবার ফিরে আসতেই পারে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে তাকে এ রকম ভাবে পুঁতে রাখা হয়, তারপর তাকে বাঘ ভালুক খায় কিংবা এমনিই মরে যায়। এতে শাস্তিদাতার হাতে নরহত্যার পাপ লাগে না।

কিন্তু কী অপরাধ করেছে ভরত? সে তো কারুর বাড়াভাতে ছাই দেয়নি। রাজকুমারেরা কেউ তাকে পছন্দ করে না, অকারণে তাকে উৎপীড়ন করে, তবু ভরত কোনওদিন তাদের মুখের ওপর তেজ দেখায়নি, বিনা প্রতিবাদে সব সহ্য করেছে। শশিভূষণ তা দেখে বিরক্ত হয়েছেন, পাঠশালার বাইরে রাজকুমারদের শাসন করার কোনও অধিকার তাঁর নেই, ভরতকে তিনি বলেছেন, তুই রুখে দাঁড়াস না কেন? মাথা নিচু করে থাকলে মাথা নিচুর দিকেই চলে যায়। তুইও তো মহারাজের সন্তান!

ভরত তার অনুভূতি দিয়েই বুঝেছিল যে এখনও রাজকুমারদের সামনে মাথা তোলার সময় আসেনি। তাকে আরও বড় হতে হবে। তার বয়েস মাত্র ষোল বছর, আর দু তিন বছর পরই যথেষ্ট লেখাপড়া শিখে রাজপ্রাসাদ থেকে দূরে সরে যাবে। তখন সে স্বাধীন হতে পারবে। এর মধ্যে এত কঠিন শান্তি পাবার মতন কোনও কিছুই তো সে ঘটায়নি। কে নিয়োগ করেছে এই দুই যমদূতকে?

ওরা দুজন দু পা দিয়ে চেপে চেপে শক্ত করতে লাগল মাটি। ভরত জানে, কথা বলার বিপদ আছে। এরা হুকুম তামিল করতে এসেছে, কোনও রকম অনুরোধ-উপরোধে কৰ্ণপাত করবে না। দয়া-মায়ার প্রশ্ন নেই। এরা মিথ্যে কথা বলতে জানেই না, ফিরে গিয়ে ঠিক যা যা করে এসেছে, সেই বিবরণ দেবে ওদের নিয়োগকারীকে। তবু শেষ মুহূর্তে আর সামলাতে পারল না, হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে বলল, ওগো, কেন আমাকে মারছ? আমি কী দোষ করেছি? আমায় ফেলে যেও না!

লোক দুটি চমকে উঠল। ভরতের আকস্মিক আর্তনাদে খান খান হয়ে গেল নিস্তব্ধতা।

একজন বলল, এই হালা পুঙ্গির পুত কখন বাঁধনটা খুলে ফেলল?

অন্যজন মাটিতে বসে পড়ে প্রথমে ঠাস ঠাস করে দু’খানা চড় কসাল জোরে। তারপর বলল, হাঁ কর হারামজাদা, নইলে এখনি ঘেটি ভেঙে দেব!

মার খাবার ভয়ে ভরত হাঁ করতে বাধ্য হল। লোকটি তার মুখের মধ্যে ভরে দিল গামছার অর্ধেকটা। বাকি অর্ধেক দিয়ে ভালো করে আবার বাধল। ভরতের আর কোনও শব্দই বার করার উপায় রইল না।

এরপরেও সেই লোকটি একটি ক্ষুর বার করে চাঁছতে লাগল ভরতের মাথা। তার মাথা ভর্তি চুল ঘাড় পর্যন্ত নামা, এই রকম সময়ে লোকটি কেন তার চুল কাটতে শুরু করল তা বুঝতে পারল না ভরত।

কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে লোকটি বলল, কুত্তার আওলাদ, তুই লাইছবির সাথে আসনাই করতে গিয়েছিলি, তোর মরণ কে ঠেকাবে?

আর কোনও বাক্যব্যয় না করে তারা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল।

ঘোড়ার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর চতুর্দিকে যেন আরও বেশি নিঃশব্দ মনে হল। অন্ধকার একেবারে নিশ্চল নয়, মাঝেমাঝে পর্দার মতন যেন দোলে। কাছাকাছি কোনও বড় গাছ নেই, আততায়ীরা জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা বেছে নিয়েছে, যাতে হিংস্ৰ কোনও জানোয়ার এসে পড়লে সহজেই দেখতে পায় ভরতের মুণ্ডটা।

কতক্ষণ লাগবে মরতে? বাঘ ভাল্লুক এসে যদি খেয়ে নেয়, তা হলে তো চুকেই গেল। এই বনে নিশ্চিত বাঘ আছে। নীলধ্বজ নামে মহারাজের এক ভাই অনেক বাঘ শিকার করেছেন। রাজপ্রাসাদের বৈঠকখানা ঘরে ঝোলে কয়েকটা বাঘের চামড়া। এই তো সেদিন বিজয়া দশমীর ভোজে উপজাতীয়রা মহারাজকে উপহার দিয়েছে দুটো বাঘের বাচ্চা। কিন্তু এই জঙ্গলে বাঘের হাঁক-ডাক শোনা যাচ্ছে না তো এখনও। কোনও জন্তু-জানোয়ারেরই আওয়াজ নেই। যদি বাঘে না খায় তা হলেও তো মরতেই হবে। শশিভূষণ মাস্টার ভরতকে যিশু খ্রিস্টের জীবন কাহিনী শুনিয়েছেন। একটা ক্রুশে হাত-পা বিধিয়ে যিশু খ্রিষ্টকে বুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সকালে ঝোলানো হল, বিকেলেই তিনি প্রাণত্যাগ করলেন। মাটিতে পুতে রাখলে কত সময় লাগতে পারে?

বুক পর্যন্ত শরীরটা অদৃশ্য হয়ে গেছে, মাথাটা কোনোক্রমে নাড়তে পারে ভরত। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখতে লাগল বা দিকের অন্ধকার, ডান দিকের অন্ধকার, সামনের অন্ধকার। সব অন্ধকারেরই রূপ এক। শুধু মাথার ওপরে দেখা যায় কয়েকটি তারা।

যত উপায়েই মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হোক, মানুষের মন কিছুতেই নির্বাক হয় না। প্রতিটি জাগ্ৰত মুহূর্তেই মানুষের। মন কিছু না কিছু বলে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভরতের মন বলতে লাগল, টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার, হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর, আপ অ্যাবাভ দা ওয়ার্ল্ড সো হাই, লাইক আ ডায়মন্ড ইনদা স্কাই… হোয়াট ইউ আর, না হু ইউ আর? ডায়মন্ড বানান ডি আই ই এম ও এনো ডি, নাকি ডি আই এ…। ভাবতে ভাবতেই সে নিজেকে বলল, এ কি, আমি মুখস্থ আর বানান নিয়ে এখন ভাবছি কেন? আমি তো মরে যাচ্ছি। মুখস্থ ভুল হলেই বা কী আসে যায়। মাস্টার মশাই তো আর পড়া ধরবেন না, তিনি জানতেও পারবেন না ভরত কোথায় হারিয়ে গেছে!

লাইছবির সঙ্গে আসনাই? ঘোষ মশাইয়ের পরিচারক তারক-দাদাও একদিন তাকে বলেছিল, ওরে বাবু, লাইছাবির সঙ্গে নটোঘটো করতে যাস না, ওরা পুরুষ মানুষের মাথা আস্ত চিবিয়ে খায়। মণিপুরি কুমারী মেয়েদের বলে লাইছাবি, যেমন ওই মনোমোহিনী। তার সঙ্গে তো ভরত কিছু করেনি, এমনকি তার সঙ্গে ভাব করতেও চায়নি। এত লোক আছে রাজবাড়িতে, গণ্ডায় গণ্ডায় রাজকুমারেরা ঘুরে বেড়ায়, তবু তাদের ছেড়ে মনোমোহিনী শুধু ভরতকেই জ্বালাতন করে সুখ পায়। ভরতের চাল-চুলো নেই, পারিবারিক সম্পর্কের কোনও জোর নেই, সে যে কোনও উত্তর দিতে পারে না। বাগানে কিংবা কমলদিঘির ধারে নিরালায় কখনও ভরতকে দেখলেই সে ধরে। ভরত পালিয়ে যায়, তবু নিস্কৃতি নেই। সে ভরতের ঘরের জানলায় গিয়ে দাঁড়ায়। ওঃ কী সাঙ্ঘাতিক মেয়ে, কোনও কথাই তার মুখে আটকায় না। এই বয়েসেই সে কত কিছু শিখেছে, ভরতও জানে না সে সব। মনোমোহিনীর রঙ্গ রস শুনে লজ্জায় কৰ্ণমূল আরক্ত হয়ে যায় ভরতের। কিন্তু মনোমোহিনীকে সে কী ভাবে নিরস্ত করবে, তাকে তো জানলা থেকে ঠেলে সরানো যায় না।

তবে মনোমোহিনীকে সে কিছুতেই তার ঘরে ঢুকতে দেয়নি। সব সময় দরজায় আগল দিয়ে রাখে। তাতেও অবশ্য বিপদ কাটে না। অনেক দিন পুরনো কাঠের দরজা, মাঝখানে বেশ খানিকটা ফাঁক হয়ে গেছে। একটা কোনও শক্ত কঞ্চি সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে ওপরে দিকে চাড় দিলে খুলে ফেলা যায় সেই আগল। একদিন দুপুর বেলা ভরত ঘুমিয়ে ছিল, ওই দুষ্টবুদ্ধিধারিণী লাইছবি আগালটা খুলে ফেলেছিল প্রায়। শব্দ পেয়ে ভরত জেগে উঠে দৌড়ে গিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে খিলখিল করে হেসে ছিল। তারপরেও সে আরও কয়েকবার ওই দরজা খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।

এই সব দৃশ্য চোখে পড়েছে দু’একজনের। ভরত জানে, তার দিকে থেকে কোনও উৎসাহ না দেখালেও এই সম্পর্ক বিপজ্জনক। লোকে তো দেখছে যে বাগানের মধ্যে একটি কুমারী মেয়ে ভরতের হাত ধরে টানছে। লোকে দেখছে, ভরতের ঘরের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে এক মণিপুরি সুন্দরী। সে আবার মহারানীর আপনি বোনের মেয়ে।

উপায়ান্তর না দেখে সে শশিভূষণ মাস্টারকে তার এই বিপদের কথা জানিয়েছিল। শশিভূষণ ব্যাপারটাকে গুরুত্বই দেননি, হেসে বলেছিলেন, তোমার চেহারা যেমন দিন দিন সুশ্ৰী হচ্ছে সে, তাতে কুমারী মেয়েদের নজর তো তোমার দিকে পড়বেই। মহারানীর কাছে গিয়ে ওই মেয়ের পাণি প্রার্থনা করো না!

মাত্র গতকালই এই সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধান হয়েছিল। যথারীতি দুপুরবেলা জানলার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল ওই মেয়ে। হলুদ-লাল মিশ্রিত রঙের একটা পাছারা পরা, বক্ষবন্ধনীটি টকটকে রক্ত বর্ণ, মাথার চুলে কাঞ্চন ফুল গোজা, গলাতেও গাদা ফুলের মালা। জানলার গরাদে বুক চেপে, হাত দুটি ভেতরে সে বলছিল, আয় না রে জড়ভরত, একটি বার কাছে আয়, তোর নাক টিপে দুধ বার করি। তুই দুধ খেতে ভালোবাসিস, তোকে দুধু খাওয়াব-

এইসময় মহারাজ বীরচন্দ্র হন হন করে আসছিলেন সচিব মশাইয়ের কাছে। তাঁর এরকমই স্বভাব, তিনি আজ্ঞাবহ কর্মচারীদেরও সব সময় ডেকে না পাঠিয়ে নিজেই তাদের কারুর কারুর কাছে উপস্থিত হন। হঠাৎ কোনও কথা মনে পড়লে তার আর তর সয় না। কোনো কারণে বাগানবাড়ির দিক থেকে তিনি আসছিলেন পিছনের পথ ধরে, মনোমোহিনীকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। মনোমোহিনী মহারাজের উপস্থিতি টের পায়নি, ভরতের সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হল। মনোমোহিনী তখনও কথা বলে যাচ্ছে, ঘরের মধ্যে ভরতের আড়ষ্ট, বিশুষ্ক মুখ। কয়েক কোনও কথা না বলে মহারাজ পৰ্যায়ক্রমে দেখে গেলেন সেই প্ৰগলভা। কিশোরী ও সন্ত্রস্ত কিশোরটিকে। তিনি বহু-অভিজ্ঞ, বুঝে গেলেন সঠিক ব্যাপারটি। মনোমোহিনীকে ধমক দিয়ে বললেন, অ্যাই ছেমরি, তুই এখানে কী করছিস। এই ছেলেটা লেখাপড়া করে তা ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছিল। আর তো কারুর লেখাপড়ার পাট নেই

তারপর তর্জনী তুলে গরম চোখে বললেন, যা, ভেতরে যা! আর কখনও এখানে আসবি না। কোনওদিন যেন আর না শুনি-

মনোমোহিনী একবার মহারাজের দিকে চোখের ঝিলিক দিয়ে দৌড়ে চলে গেল প্রাসাদের দিকে। মহারাজ কণ্ঠ নামিয়ে ভরতকে বললেন, পড় তুই, মন দিয়ে লেখাপড়া কর।

মহারাজের এই সুবিচার কৃতজ্ঞতায় একেবারে অভিভূত হয়ে গেল ভরত। সে ছোটে গিয়ে মহারাজের পায়ে পড়ে পদধূলি নিলো।

মহারাজ ভরতের ওপর ক্রুদ্ধ হননি। যাবার সময় তিনি প্ৰসন্ন দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তা হলে ভরতকে এই মৃত্যুদণ্ড দিল কে? অন্য কোনও ঈর্ষা-কাতর রাজকুমার? দোষ করল মনোমোহিনী, আর শান্তি পাবে ভরত! জগতের বুঝি এইটাই নিয়ম? আকাশের দেব-দেবীরা কি বুঝতে পারছেন না সে নির্দোষ। হে মা কালী, হে ত্রিপুরেশ্বরী আমায় দয়া করো, আমায় দয়া করো। আমার মতন একটা সামান্য মানুষ বেঁচে থাকলে জগতের কী ক্ষতি হবে।

মাটির নীচে ভরতের পা দুটি দুমড়ে মুচড়ে আছে, তার এক উরুতে বর্ষার ক্ষত, তবু সেসৰ যন্ত্রণার বোধ তার নেই। আসন্ন মৃত্যু চিন্তায় ওসব তুচ্ছ হয়ে গেছে। আবার মৃত্যু চিন্তাও মুছে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। অতিশয় অবান্তর কিছু কথা এসে পড়ে। ওরা তার মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে গেল কেন? গর্তে পুঁতে দেওয়ার চেয়ে ওর মাথা ন্যাড়া করাটাই যেন বেশি ধন্ধের। ওরা দু’জন কত টাকা পাবে? কত টাকার বিনিময়ে একজন মানুষকে এমন বিনা দ্বিধায় জ্যান্ত কবর দেওয়া যায়। ভরতের মাসোহারার থেকে সাত টাকা দু’আন এখনও খরচ হয়নি, তার বালিশের তলায় রয়ে গেছে, কে নেবে সে টাকা। আচ্ছা, মনোমোহিনীই রাগ করে এই শাস্তি দেয়নি তো। মণিপুরিদের অনেক ক্ষমতা, মহারানীর ভাই বীরেন্দ্ৰ সিংহ এ রাজ্যে একজন অতিশয় শক্তিশালী ব্যক্তি, তার হুকুমে অনেকেই ভরতের মতন একটা চুনোপুঁটিকে খুন করতে রাজি হবে।

এ পর্যন্ত জঙ্গলে একটাও শব্দ শোনা যায়নি, কোনও নিশাচর প্রাণীকে দেখা যায়নি। কাছাকাছি। বাঘের সাক্ষাৎ। সহজে মেলে না, কিন্তু হাতি থাকে। যেখানে সেখানে। ত্রিপুরায় প্রচুর হাতি। বাঘ-ভালুকের দরকার নেই, একটা হাতি যদি এখান দিয়ে যেতে যেতে ভরতের মাথার ওপর আস্তে পা রাখে তাতেই তার দফা শেষ। মরার আগে মাথার খুলিটা ফেটে যাবে, তাতে বেশি ব্যথা লাগবে? কেন ওরা মায়ের মন্দিরে তাকে বলি দিল না? এরকম তো হয়। এই অবস্থাতেও ঘুম আসে মানুষের। মনকে নিবৃত্ত করার জন্যই ঘুমের দরকার ছিল। কিছুক্ষণ ঝিমাবার পর চোখ মেলেই সে দেখল সকাল হয়ে গেছে। ঊষার আবির্ভাব হয়ে গেছে অনেক আগেই, এখন রোদ বেশ চড়া। অরণ্যও এখন জীবন্ত, পাখির কাকলিতে মুখর, প্রায় এক লহমায় মিলিয়ে গেল তিনটি ছুটন্ত হরিণ।

ভরত মনে মনে বলল :

পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল

কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল…

মাস্টারবাবুর কাছে ডিকটেশান নেবার সময় সে কুসুম বানানটি বারবার ভুল করে। এক একটা সোজা বানানও কিছুতেই মনে থাকে না। কুসুমে কেন যেন তালব্য শ মনে হয়। মাস্টারবাবু বলেন, শুম্ভ নিশুম্ভ লেখার সময় তালব্য শ দেবে, কুসুম অতি নরম বস্তু, সে তালেবর হতে চায় না মনে রাখবে।

ধুৎ, এখন কি কবিতা ভাববার সময় নাকি? মরার আগে কেউ কি কবিতার পঙক্তি চিন্তা করে? অন্যদের মৃত্যুর আগে কী মনে হয়, তা ভরত জানবেই বা কী করে। নাঃ, সে এসব ভাববে না। পড়াশুনো করতে গিয়েই তো তার এই সর্বনাশ হল। যতদিন সে চাকর-বাকিরদের মহলে ছিল, ততদিন সে কারুর নজরে পড়েনি। ভরত নামে যে একটা ছেলে আছে, তা ক’জন জানত? ঘোষমশাই যে তার জন্য দশ টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, তাতেই তো চোখ টাটাচ্ছে অন্য রাজকুমারদের!

তাহলে অন্য কী কথা সে ভাববে? মাকে ডাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজের মাখে। যে সে চেনে না, মায়ের মুখখানা কেমন তাও সে জানে না। মায়ের কোন ছবিও নেই। একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে হারিয়ে গেছে তার মা। তার বাবাও তো থেকে নেই। মহারাজকে সে এখনও বাবা হিসেবে ভাবতে পারে না। যাকে দেখলেই ভয়ে তার শরীর কুঁকড়ে যায়, সে কী করে তার বাবা হবে? আজ অবধি নিজে থেকে কাছে ডেকে তার সঙ্গে একটাও তো কথা বলেননি। মহারাজ। আর কেউ নেই। একমাত্র মাস্টারবাবুই তাকে ভালবেসেছিলেন। কিন্তু তিনিও তো ভরতকে বাচাতে পারলেন না। বেলা গড়িয়ে দুপুর এলো, তারপর বিকেল হল, সন্ধ্যা, রাত ও মধ্যরাত। আবার ভোর, আবার সকাল। কোনও ঘটনাই ঘটল না। ভরতের ক্ষুধা বোধ নেই, যন্ত্রণা বোধ নেই, শুধু মাঝে মাঝে ঘুম ও জাগরণ। ভরতের চিন্তা শক্তি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, নানান মুখ তার মনে পড়ছে, তবে যখনই মনোমোহিনীর মুখখানা ভেসে উঠছে চোখে, সে চিৎকার করে বলতে চাইছে, না, না, না, ওকে দেখতে চাই না, চাই না। যতই সে প্রতিবাদ করছে ততই যেন মনোমোহিনীর মুখচ্ছবি ফিরে আসছে, তখন ভরত বলতে চাইছে কবিতার লাইন, কিন্তু ঠিকঠাক মনে করতে পারছে না, এক কবিতার সঙ্গে অন্য কবিতা মিশে যাচ্ছে বারবার। তার মাথার মধ্যে এখন দুর্বোধ্য কোলাহল।

মুণ্ডিত মস্তকে বড় একটি ব্যাঙের ছাতার মতন মাটির ওপর মুখখানা জাগিয়ে বেঁচে রইল। ভরত চারটি রাত ও তিনটি দিন। প্রথম দুদিন সে মাথা নাড়তে পারছিল, সে ক্ষমতাও কমে এলো, ভালো করে সে চোখ খুলে রাখতেও পারছে না। চতুর্থ দিন দুপুরের দিকে সে প্রথম শুনতে পেল মানুষের কণ্ঠস্বর। বেশ দূরে এবং অস্পষ্ট। এমনও হতে পারে, সেটা ভরতের মনের বিকার। কখনও মনে হচ্ছে, অনেক লোক কথা বলছে এক সঙ্গে, কখনও মনে হচ্ছে কারা যেন গান গাইছে দল বেধে। সেই ধ্বনি কাছে এলো না, বরং ক্রমেই যেন মৃদু থেকে মৃদুতর হতে লাগল। তা হলে নিশ্চিত শব্দ-মরীচিকা! উড়ে যাচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক পাখি। দুটো খরগোশ ভরতের মুণ্ডুর খুব কাছ থেকে ছুটে গেল। বাতাসও আজ প্রবল। সেই বাতাসে ভেসে আসছে। খিচুড়ির গন্ধ। কারা যেন লাইন বেঁধে খেতে বসেছে কোথাও। না, হয়তো এটাও ভরতের মনের ভুল। বুভুক্ষু মানুষ মৃত্যুর আগে এরকম স্বাদ দেখে।  সে দেখেনি, কোথায় মানুষ খিচুড়ি খেতে বসেছে। এ জীবনে ভরতের আর খিচুড়ি খাওয়া হবে না।

কিছুক্ষণ চোখ বুজে বুইল ভরত, আবার চোখ খুলতেই সে এক অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পেল। তার সামনে, খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুটি শিশু। পাঁচ-ছ বছরের বেশি বয়েস নয়, সম্পূর্ণ নগ্ন, চকচকে কালো রং। তারা এতই সুন্দর দেখতে যে ভরতের মনে হল, দুটি দেবশিশু যেন এই মাত্র নেমে এসেছে স্বর্গ থেকে। এবার ভরত মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে ভাববার চেষ্টা করল, এটাও কি সে চোখে ভুল দেখছে! এই জঙ্গলে দুটি এত ছোট বাচ্চা আসবে কী করে। না, সত্যিই তো শিশুদুটি দাড়িয়ে আছে, তাদের মুখে ঝকঝকে সাদা দাঁতের হাসি। স্বৰ্গ থেকেই এসেছে তাহলে? স্বর্গে কি কালো রঙের বাচ্চা থাকে। দেবতারা সবাই ফর্সা। তা হলে ভরতের মতন কালো মানুষেরা কখনও স্বর্গে যেতে পারে না। ওঃ, হো, মা কালী তো শ্রীকৃষ্ণও কালো। তাহলে স্বর্গে কালো মানুষদের স্থান আছে।

শিশু দুটি ভয় পায়নি, ধড়হীন মুণ্ডটির দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। ভরত হাসতে চাইল। কিন্তু মানুষের হাসি ফুটে ওঠে ওষ্ঠ ধরে, তার মুখ যে বাঁধা। সে কথা বলতে পারবে না, হাসতেও পারবে না। সে যে বেঁচে আছে তার প্রমাণ দেবার জন্য সে চোখ পিটপিট করতে লাগিল।

খিলখিল করে হেসে উঠল বাচ্চা দুটি। তারা পরস্পরের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলল, তা বোধগম্য হল না ভরতের।

সরল নিষ্পাপ দেবশিশুদেরও নিষ্ঠুর হতে বাধা নেই। তারা ধুলোবালি ও ছোট ছোট কাঠের টুকরো ছুড়ে মারতে লাগল ভরতের দিকে। ন্যাড়া মাথায় খুব লাগছে তার। বাচ্চা দুটিকে দেখে ভরতের স্তিমিত প্রাণশক্তি আবার খানিকটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে, সে ওই বাচ্চাদের অন্ত্র বর্ষণ এড়াবার জন্য মাথা ঘোরাতে লাগল। এদিক ওদিক। বাচ্চারা তাতে আরও মজা পেল, মুণ্ডুকাটা ছাগলের ধড়কে তারা ছটফট করতে দেখেছে, কিন্তু শুধু একটা জীবন্ত মানুষের মুণ্ডু নিয়ে খেলা করার সুযোগ তারা পায়নি কখনও। সে মুণ্ডুটা ধমক দিতেও পারে না।

ধুলোবালির পর তারা খুঁজতে লাগল ছোট ছোট পাথর। বেশ কয়েকটা ভরতের লেগেছে। সে ভাবল, এবার যদি ওরা দু’জনে ধরাধরি করে একটা বড় পাথর তোলে? বাচ্চাদের কোনও মজাই বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। হঠাৎ খেলা থামিয়ে তারা ছুট দিল জঙ্গলের দিকে। দারুণ নিরাশ হয়ে গেল ভরত। সে আকুল ভাবে চ্যাঁচ্যাঁতে চাইল, ওরে যাসনি, দাঁড়া দাঁড়া! হোক শিশু, তবু তো মানুষের সঙ্গ। অত বাচ্চাদুটি জঙ্গলে এসেছে, কাছাকাছি নিশ্চয়ই বড়োরাও আছে। এক সময় ওদের খুঁজতে বড়োরাও আসত। মারছিল মারুক, আরও মারুক, চলে যাবে কেন?

ওদের থামাতে পারল না ভরত। মুখ বাঁধা বলে সে হাসতেও পারে না। কিন্তু কাঁদতে পারে। শেষ ভরসাও মিলিয়ে গেল দেখে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল। তার চোখ দিয়ে। ঝাপসা হয়ে গেল এ জগৎ।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়