নরেনের রূপান্তর এবং আমেরিকার এই ধৰ্ম মহাসম্মিলনে উপস্থিতির পশ্চাৎপট অনেকটা রূপকথার মতন অবিশ্বাস্য শোনায় তো বটেই, প্রায় যেন অলৌকিকত্বের ধার ঘেঁষে যায়।

সেই নরেন, আর এই নরেন! বরানগর মঠের সেই ছিন্নক পরিহিত ভিক্ষাজীবী এক বাউণ্ডুলে যুবক, আর আমেরিকার এই মহতী জনসভায় সম্মানিত অতিথি।

বরানগরের সেই জীর্ণ পোড়ো বাড়ি, সাপখোপ, শেয়ালের উৎপাত আর প্রতিবেশীদের তর্জনগর্জন। শ্রীরামকৃষ্ণ নেই, মাসের পর মাস দশ-বারোজন ভক্ত তবু কায়ক্লেশে জড়ামড়ি করে এখানে পড়ে আছে। আত্মীয়-স্বজনরা বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য টানাটানি করে মাঝে মাঝে, তবু তারা মঠ ছেড়ে যায় না, যদিও তারা নিজেরাও জানে না যে তাদের ভবিষ্যৎ কী? এখানে তারা নানান শাস্ত্র পাঠ করে, কখনও ঘণ্টার পর ঘন্টা কীর্তন গানে মেতে থাকে। রাত জেগে হইহুল্লোড় কবে, কিন্তু এইভাবেই কি দিন কাটবে?

গৃহী ভবা অর্থসাহায্য করে, আবার সংসারের নানা কাজের ব্যস্ততায় মাঝে মাঝে ভুলেও যায়। তখন এ ভিক্ষে করতে বাধ্য হয়। সেই ভিক্ষা পাক হয় বটে কিন্তু থালা বাসন কিছু নেই। একদিন কলাপাতা কাটতে যাওয়ায় বাগানের মালির কাছে গালাগালি খেতে হয়েছিল বলে এখন ভেঙে আনে বড় বড় মানকচু পাতা, সেই পাতায় ঢালা হয় সবটা ভাত, তার সঙ্গে শুধু লঙ্কার ঝোল, সবাই একসঙ্গে গোল হয়ে বসে সেই ভাত আর ঝোল তুলে তুলে খায়।

এতে কৃচ্ছ্রসাধনা হচ্ছে বটে, কিন্তু এর পরিণাম কী? শরীরগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, এর পর রোগব্যাধি, তারপর মৃত্যু! সবাই বলাবলি করছে, এই ছেলের দল নিতান্ত পাগলামিতে মেতেছে, বরানগরের এই মঠ টিকিয়ে রাখার আর দরকার নেই, যে যার ঘরে ফিরে যাক না।

ক্রমে দল ভাঙতে লাগল, নৈরাশ্যে নয়, গৃহীদের উপদেশে নয়, আত্মীয়-স্বজনের অনুরোধ-কান্নাকার্টিতে, আহার-শয়নের কষ্টের জন্যও নয়, নিছক একঘেয়েমির কারণে। এক একজন মঠ ছেড়ে চলে যেতে লাগল, বাড়ি ফিরল না, বেরিয়ে পড়ল তীর্থযাত্রায়। নরেনের পারিবারিক সঙ্কট খুব তীব্র, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মামলামোকদ্দমা চলেছে তো চলছেই, মাঝে মাঝে সে দিনের বেলা বাড়ি যায়, মামলা তদারকি করে, রাত্তিরে মঠে ফিরে আসে। মায়ের কষ্ট সে দেখতে পাবে না। মাকে সে সবরকম সাহায্য করতে চায়, কিন্তু এ কথাও সে জানিয়ে দিয়েছে যে সে আর কখনও গৃহী হবে না, ঘর তার জনা নয়। সাপ আর সন্ন্যাসীর কোনও নিজস্ব বাসা থাকে না। নিক্ষিপ্ত তীর আর ফোবে না।

এক সন্ধেবেলা নরেন কলকাতা থেকে বনগরেব মঠে ফিরে এসে শুনল যে এক গুরুভাই সারদা গোপনে মঠ ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে। শুনেই খুব উতলা বোধ করল নরেন। সারদার বয়েস বেশ কম। প্রায় বালক বলা যায়, সে একা একা কোথায় যাবে, কী বিপদে পড়বে কে জানে। কিছুক্ষণ পরে সারদার একটা চিঠি পাওয়া গেল নরেনকে লেখা। সে লিখেছে যে, পায়ে হেঁটে বৃন্দাবন যাবার অভিপ্রায়ে সে বেরিয়ে পড়েছে। ইদানীং সে স্বপ্ন দেখে ভয় পাচ্ছিল। স্বপ্নে সে মা বাবা আর বাড়ির লোকজনদের দেখতে পায়, তারা যেন হাতছানি দেয়। এ তো মায়ার হাতছানি। এর মধ্যে দু’বার সে বাড়িতে ছুটে চলেও গিয়েছিল। তারপর সে ঠিক করেছে, এই মায়াপাশ কাটাতেই হবে। একবার সন্ন্যাসী হয়ে আবার সে গৃহী হতে পারবে না। তাই সে চলে যাচ্ছে বহু দূরে।

কয়েক দিন নরেন খুব চিন্তিত হয়ে রইল। সারদার ঘটনাটা তার মনে একটা জোর ধাক্কা দিয়েছে। সারদা চলে গেছে শুনে সে এত বিচলিত হয়ে পড়েছিল কেন, সারদা তার কে? সন্ন্যাসীর আবার কোনও বন্ধন থাকে নাকি? নিজের সংসার ছেড়ে এসে সে কি এই মঠের সংসার চালাচ্ছে? এখানে অনেক সমস্যার সমাধান করতে হয় তাকেই।

সন্ন্যাসীর পক্ষে এক জায়গায় বেশি দিন থাকা মানায় না। বহতা জল আর রমতা সাধু, এরাই পবিত্র থাকে। এবার নরেনকেও বেরিয়ে পড়তে হবে। সে এ দেশটাকে চিনতে চায়।

কারুকে কিছু না জানিয়ে নরেন একদিন মঠ ছেড়ে চলে গেল।

তারপর শুরু হল তার পরিব্রাজক জীবন। পিছুটান নেই, সামনেও নির্দিষ্ট কোনও অভীষ্ট নেই। শুধু চলা, কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও ট্রেনে। অঙ্গে গেরুয়া কৌপীন, হাতে একটি লম্বা লাঠি আর কমণ্ডলু, আর একটা পুঁটলিতে খানকতক বই। পড়ার নেশা সে ছাড়তে পারে না। পড়ার ব্যাপারে তার বাছবিচার নেই, সে যেন বেদান্ত পড়ে, তেমনি জুল ভার্ন-এর রোমাঞ্চকর উপন্যাসও পড়ে। কোথাও কেউ ভাল ভাল খাবার দিলে সে বিনা দ্বিধায় পেট পুরে খায়, আবার কোনওদিন একমুঠো ছাতু জুটলে তাই সই। পয়সার কোনও বালাই নেই, কেউ ট্রেনের টিকিট কেটে দিলে সে ট্রেনে চাপে, সেরকম কেউ না দিলে সে হাঁটে। কিছুর জন্য ব্যস্ততা তো নেই তার।

নরেন কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির যেমন দেখতে যায়, তেমনি সে আগ্রার তাজমহলও দেখতে যায়। গাজীপুরের পওহারি বাবার মতন তপঃক্লিষ্ট সাধুর কাছে যেমন সে গিয়ে পড়ে থাকে, তেমনি বারাণসীতে পণ্ডিতপ্রবর ভূদের মুখখাপাধ্যায়ের সঙ্গেও তর্কে মাতে। ভক্তির জন্য সে জ্ঞানকে ছাড়েনি, আবার জ্ঞানের জন্য সে সৌন্দর্যবোধও বিসর্জন দেয়নি।

বেশ কিছুকাল ঘোরাঘুরির পর এক জায়গায় অসুস্থ হয়ে পড়ল নরেন। শরীরের ওপরে নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল, এবার শরীর বুঝি যায় যায়। এক নবলব্ধ শিষ্য পরিবার তাকে পৌঁছে দেয় কলকাতায়। বরানগরের মঠে শশী, রাখাল, বাবুরাম, লাটুদের সেবায় সাহচর্যে সুস্থ হয়ে উঠল সে, কিছুদিন আনন্দে কাটল, কিন্তু পথ যাকে একবার টেনেছে, সে আর ঘরে থাকবে কী করে?

বাঙালিরা ছড়িয়ে আছে সারা ভারতে। ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিক, স্কুল মাস্টার, রেলের স্টেশন মাস্টার অধিকাংশই বাঙালি। বাঙালিরা আগে ইংরিজি শিখেছে, তাই এই সব জীবিকায় তারা অগ্রণী। অনেক জায়গাতেই নরেনের থাকার জায়গা জুটে যায়। কোথাও কোথাও হঠাৎ হঠাৎ নরেনের প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধুরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তারা সব প্রতিষ্ঠিত, উচ্চ চাকুরে, আর নরেনের ধূলিধূসরিত খালি পা, ময়লা চিটচিটে গেরুয়া বসন, কোটরে বসা দুই চোখ, মাথার চুলে জট। নরেনের কলেজি বন্ধুরা নরেনকে চিনতে পেরে স্তব্ধবাক হয়ে যায়।

এক স্থানে আশ্রয় পেলে সেই আশ্রয়দাতাই পরবর্তী কোনও স্থানের পরিচিত ব্যক্তির ঠিকানা দিয়ে দেয়। ক্রমে নরেনের পরিচিতের সংখ্যা বাড়ে। রাস্তার ধারে মুচি কিংবা উচ্চপদস্থ রাজপুরুষও বন্ধু হয় তার। ট্রেনে যাওয়ার সময় নরেনের চেহারা দেখে ও দু’একটি কথা শুনেই আকৃষ্ট হয় সহযাত্রীরা। নরেন গৌরবর্ণ সুপুরুষ, তার মুখে কখনও দীন ভাব ফোটে না, সে নিঃস্ব হলেও কারুর কৃপাপ্রার্থী নয়। তা ছাড়া নরেনের ইংরিজি পরিষ্কার, ওজস্বিনী। ইংরিজি বলা সাধু এ দেশে কেউ আগে দেখেনি। এ সাধু শুধু ইংরিজি বলে না, প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান এবং চিন্তা-ভাবনায় আধুনিক। ট্রেনের কামরাতেই একবার নরেনের সঙ্গে মহারাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ জননেতা বালগঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিলক রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম শোনেননি, নরেন সম্পর্কে কিছুই জানেন না, শুধু তার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে নিজের বাড়িতে ডেকে এনে স্থান দিলেন কয়েক দিনের জন্য।

ক্রমে এই শিক্ষিত, তরুণ, সুদর্শন সন্ন্যাসীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে উচ্চ মহলে। রাজস্থান ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজপরিবার তাকে অতিথি হিসেবে পেয়ে ধনা হয়। আলোয়ার, কোটা, খেতড়ি, রামনাদের রাজা, হায়দারাবাদের নিষ্ক্রাম, এমী ভারতীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে যিনি প্রধান হিসেবে গণ্য, সেই মহীশুরের রাজার সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব হয়। প্রত্যেকেই নরেনের বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় পেয়ে বিস্মিত। তারা বুঝতেই পারে না, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কৃতী পুরুষ এরকম পাগলের মতন ঘুরে বেড়ায় কেন? আলোয়ার রাজ্যের মহারাজ একদিন তো জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, স্বামীজ্জি, আমি তো শুনেছি আপনি বিদ্বান ও মহাপণ্ডিত। ইচ্ছে করলেই প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারেন। তবু আপনি ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে ঘুরছেন কেন?

নরেন সহাস্যে বলল, আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো। আপনি রাজকার্যে অবহেলা করে প্রায়ই জঙ্গলে গিয়ে সাহেবদের মন জন্তু-জানোয়ার শিকার ইত্যাদি আমোদ-প্রমোদে সময় কাটান কেন?

মহারাজ থতমত খেয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওসব করি বটে, তবে কেন করি তা বলতে পারি না। ভাল লাগে, ভাল যে লাগে তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি।

নরেন বলল, আমারও ভাল লাগে বলেই আমি ফকির সেজে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই।

আর একজন নরেনকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি গেরুয়া পরেন কেন? গেরুয়া কাপড়ের কী বৈশিষ্ট্য আছে?

নরেন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, সাধারণ লোকের মতন জামা-কাপড় পরলে আমি খুব বিপদে পড়তাম। দেশে তো ভিখারির অভাব নেই। পথের ভিখারিরা আমাকে ভদ্দরলোক মনে করে ভিক্ষা চাইত। কিন্তু আমি তো নিজেই একজন ভিক্ষুক, আমার হাতে একটা পয়সাও থাকে না। আবার কোনও প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিতেও কষ্ট হয়। তাই গেরুয়া পরি। আমাকেও ভিক্ষুক মনে করে অনী ভিখাবিরা পয়সা চায় না।

কোনও কোনও রাজা নরেনের সঙ্গে দু’চারদিন আলাপ-আলোচনা করে এতই মুগ্ধ হয় যে তারা নরেনকে বাজগুরু পদে বরণ করে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু নরেন যে রমতা সাধু, তার শিকড় গাড়তে নেই। সূব অনুরোধ-উপরোধ অগ্রাহ্য করে, রাজভোগ ছেড়ে সে আবার নেমে পড়ে পথে। আজ সে রাজার অতিথিসদনে রাত কাটাচ্ছে, পরদিন কোনও গাছতলায়।

কেউ কিছু উপহার দিলেও সে নেয় না। অনেকে জোর করে পকেটে টাকা গুজে দিতে চায়, নরেন প্রত্যাখ্যান করে, খুব পীড়াপীড়ি শুনলে বলে, আপনি বরং পরবর্তী গন্তব্যের জন্য আমার একটা ট্রেনের টিকিট কেটে দিন। মহীশুরের মহারাজ বহু মুলাবান সোনা রুপোর দ্রব্য দিতে চেয়েছিলেন, একেবারে কিছু না গ্রহণ করলে অশিষ্টতা প্রকাশ পায়, কোনও ধাতু দ্রব্যই সে নিতে পারে না, শেষ পর্যন্ত সে শুধু একটা চন্দন কাঠের ছোট হুঁকো নিয়ে পুঁটুলিতে রাখল। আর সব ছাড়লেও তামাকের নেশা নরেন কিছুতেই ছাড়তে পারেনি। আমেরিকাতে এসেও একটা চুরুটের দাম আট আনা দেখে সে আঁতকে উঠেছিল। দিনে সাত-আটখানা চুরুট তো তার লাগেই।

আমেরিকায় পাড়ি দেবার ইচ্ছেটা তার মনে একটু একটু করে দানা বাঁধছিল, মনঃস্থির করতে অনেক সময় লেগেছে।

হরিদ্বার-হৃষিকেশ থেকে দ্বারকা, ত্রিবাম থেকে সেতুবন্ধ রামেশ্বর, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী, সারা ভারতবর্ষ এফোঁড় ওফোঁড় করে ঘুরে বেড়াল নরেন। পর্যটনে শুধু তো প্রকৃতির রূপ দেখা হয় না, মানুষই প্রধান দ্রষ্টব্য। মানুষ, মানুষ, অসংখ্য মানুষ। রাজা-মহারাজা আর ক’জন? সচ্ছল চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ীই বা কত? অধিকাংশই তো দরিদ্র, নিপীড়িত জনসাধারণ। দুবেলা আহার জোটে না, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। দারিদ্র্যের এমনই কুম্ভীপাক যে কেউ বিদ্যা শিক্ষার সুযোগ পায় না, শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে মাথা ঘামায় না, ধর্মের মর্মও বোঝে না। যে মহান ভারতের ঐতিহা নিয়ে আমরা গর্ব করি, তার অবস্থা এখন এত নিম্নস্তরে এসে পৌঁছেছে।

তিরিশ কোটি মানুষ, তার মধ্যে শতকরা একজন মাত্র ইংরেজি শিক্ষিত। ইদানীং সেই শিক্ষিতদের মধ্যেও বেকারের সংখ্যা প্রচুর। তারা কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে বিচ্ছি, আবার ইংরিজি শিখেও জীবিকার সংস্থান করতে পারে না। ইংরেজের শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য শোষণ, ভারতীয়দের নিজস্ব সম্পদ বলতে আর কিছু নেই।

এইরকম অবস্থায় ধর্মেরও অধঃপতন হয়। জ্ঞান মার্গ, ভক্তি মার্গ, যুক্তি মার্গ সব চুলোয় গেছে, এখন শুধু ছুঁৎ মার্গ! জাত-পাতের হাজার বিভেদ। হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তর নেই, অন্য দেশে তারা ধর্ম প্রচার করতে যায়নি, অন্য ধর্মের মানুষদের হিন্দু ধর্মের আশ্রয়ে টেনে আনেনি কখনও, বরং নিজেদের ধর্মের মানুষদেরই জাতিচ্যুত করেছে। অপমান করে দূরে ঠেলে দিয়েছে।

এক এক সময় নরেনের মনে হয়েছে, চুলোয় যাক ধর্ম! যে ধর্ম মানুষের অপমান করে, তা আবার ধর্ম নাকি! দেশের দারিদ্র্য দূর করা, অসহায় মানুষদের সেবা করাই তো এখন প্রকৃত ধর্ম।

বরানগর মঠ ছাড়বার চার বছর পর নরেন সারা ভারত পরিভ্রমণ করে কন্যাকুমারীর এক শিলাতটে বসল। সামনে বিশাল নীল জলধি, পিছনে সমগ্র ভারতবর্ষ। সে একা একা বসে কাঁদল কিছুক্ষণ। এর পর সে কী করবে? বেদাস্ত চা আর জপতপ করে কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন? তার মনে পড়ছে অগণিত ক্ষুধার্ত মানুষের মুখ। সারা দেশ রসাতলে যাক, শুধু নিজের আত্মিক উন্নতি হলেই হল, এই তো ভেবে এসেছে এতকাল সন্ন্যাসীরা। কিন্তু এই ধর্মচর্যা তো নিতান্ত স্বার্থপরতারই নামান্তর। তার গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসও বারবার বলেছেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের বন্দোবস্তু চাই।

সমুদ্রে নেমে সাঁতার দিতে লাগল নরেন। অদূরে একটা পাথরের টিবি জেগে আছে সমুদ্রের বুকে। সেই পাথরে উঠে নরেন মহাসমুদ্রের দিকে পেছন ফিরে যেন দেখতে পেল ভারতের মহা জনসমষ্টি। অভুক্ত, অর্ধনগ্ন। এদের উদ্ধার করতে না পারলে ধর্মপ্রচার নিতান্ত অপপ্রয়াস। কীভাবে এদের উন্নতি করা সম্ভব? বিজ্ঞান ছাড়া গতি নেই। বৈজ্ঞানিক কারিগরি ও যন্ত্রপাতি নির্মাণে পশ্চিম দেশগুলি অনেক এগিয়ে গেছে। সেই কারিগরি নিয়ে আসতে হবে ভারতে। কিন্তু তারা দেবে কেন? ইংরেজরা তো কিছুতেই দেবে না। অন্য দেশগুলির কাছেও ভিক্ষুকের মতন হাত পাতালে তারা ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করবে। ভিক্ষুককে কেউ রেয়াত করে না। চাই বিনিময়। ওদের কাছ থেকে কিছু নিতে হলে ওদেরও কিছু দিতে হবে। এই রিক্ত, হীনবল ভারতের দেবার মতন কী আছে? স্বর্ণ নেই, শস্য নেই, শুধু এখনও রয়ে গেছে কিছু আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও দর্শন। পশ্চিমের মানুষ এখন আধ্যাত্মিক ব্যাপারে নানান দ্বিধা, সংশয় ও নৈরাশ্যে ভুগছে। তাদের কাছে গিয়ে বলা যেতে পারে, তোমরা আমাদের উদরের অন্ন দাও, আমরা তোমাদের মানসিক খাদ দেব।

পশ্চিম দেশে গিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এ কথা বলা যাবে না। শিকাগোতে যে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন হচ্ছে, সেই মঞ্চই প্রকৃষ্ট স্থান, সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই বক্তব্য পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে অনেকের কাছে।

এর আগে বিভিন্ন স্থানে যখন বিদেশ যাত্রার প্রসঙ্গ উঠেছে, তখন অনেক রাজা-মহারাজা নরেনকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু নরেন ঠিক করল, যদি ভারতের প্রতিনিধি হয়েই তাকে যেতে হয়, তা হলে ভারতের মানুষই তাকে চাঁদা করে পাঠাবে। সাধারণ মানুষের চাঁদা দেওয়ার সঙ্গতি নেই, টাকা তুলতে হবে মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে। মাদ্রাজে কিছু শিক্ষিত তরুণ যুবক তার খুব অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল, এদের মধ্যে পেরুমল আলাসিঙ্গা নামের যুবকটি তার বিশেষ ভক্ত।

মাদ্রাজে ফিরে এসে নরেন আলাসিঙ্গাকে তার অভিপ্রায়ের কথা জানাতেই সে খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল। মাদ্রাজের এই যুবকদের নরেন সম্পর্কে বদ্ধমূল ধারণা জমে গেছে যে এই তেজস্বী তরুণ সন্ন্যাসী অসাধারণ কিছু কীর্তি রেখে যাবে। বাংলার কেউ কিছু জান না, গুরুভাইদের সঙ্গেও নরেনের অনেক দিন যোগাযোগ নেই, দক্ষিণ ভারতে চাঁদা তোলা হতে লাগল তার জন্য। শেষ পর্যন্ত অবশ্য টাকা উঠল না, জাহাজ ভাঙা ও আনুষঙ্গিক খরচ আছে, আমেরিকায় কতদিন থাকতে হবে তারও ঠিক নেই, বাধ্য হয়েই সাহায্য নিতে হল রাজাদের কাছ থেকে। অনেকেই কিছু কিছু সাহায্য করলেন, সবচেয়ে উদার হস্ত প্রসারিত করে দিলেন খেতরি রাজা অজিত সিং। এই অজিত সিং তো নরেনের প্রায় শিষ্য ও সখা বনে গেছে। বহুকাল ধরে সে অপুত্রক ছিল, নরেনের আশীর্বাদে তার একটি উত্তরাধিকারী গেছে, এ জন্য তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

অজিত সিং-ই নরেনের পোশাকের পরিকল্পনা করে দিলেন। দরিদ্র সন্ন্যাসীর বেশে গেলে পশ্চিমে কেউ গ্রাহ্য করবে না, পরিদের ঔফল্যে আগে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা চাই। এবং সন্ন্যাসী নরেনের নাম কী হবে?

বরানগরের মঠে বিরজা হোমের পর রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস নিয়েছিল। নরেনই গুরুভাইদের এক একজনকে এক একটি নতুন নাম দিয়েছিল, রাখালের নাম হল ব্রহ্মানন্দ, বাবুরামের নাম প্রেমানন্দ, কালী প্রসাদ হল অভেদানন্দ, লাটু হল অদ্ভুতানন্দ…। নরেনের ইচ্ছে ছিল সে নাম নেবে রামকৃষ্ণানন্দ, কিন্তু আগেভাগেই শশী ওই নামটা চেয়ে বসল। তখন নরেন নিজের নাম নিল বিবিদিষানন্দ।

যেমন বিদঘুটে নাম, মানে বোঝা যায় না, উচ্চারণ করার তেমনই অসুবিধে। ভ্রমণের সময় সেটা বদলে সে সচ্চিদানন্দ করে নিল, কখনও-সখনও চিঠিতে লিখত বিবেকানন্দ। খেতড়ির রাজা অজিত সিং শেষ নামটাই পছন্দ করলেন। স্বামী বিবেকানন্দ।

খেতড়ির রাজা আর একটি দারুণ উপকার করেছিলেন। নরেন সন্ন্যাসী হোক বা নাই হোক, সে কখনও মাকে ভুলতে পারবে না, মায়ের কষ্টও সহ্য করতে পারবে না। সমুদ্র পাড়ি দেবার পর সে আবার কবে ফিরতে পারবে না পারবে তার ঠিক নেই, বিদেশে বেঘোরে প্রাণটাও যেতে পারে, তখন মায়ের কী হবে? খেতড়ির রাজা নরেনের এই দুশ্চিন্তা টের পেয়ে তার মায়ের জন্য মাসোহারা আর তার ছোট ভাইদের শিক্ষার ব্যবস্থার জন্য নির্দিষ্ট সাহায্য পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

মাদ্রাজি ভক্তরা জাহাজের দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট কেটে দিয়েছিল, খেতড়ির রাজা সেটাকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করে দিয়েছেন। দীন হীনের মতন নেটিভের পোশাকে এই শ্রেণীতে যাওয়া যায় না, নরেন গেরুয়া ছেড়ে ট্রাউজার ও লম্বা কোট পরেছে, পায়ে মোজা ও বুট জুতো। যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন তাকে বিদায় জানাতে এসেছিল, তারা সবিস্ময়ে দেখল, খালি পায়ে যে সারা ভারত ঘুরেছে, সেই সন্ন্যাসী এই পোশাকেও বেশ অভ্যস্ত।

বিদায়ের ক্ষণে নরেন বিশেষ কোনও কথা বলতে পারল না। গম্ভীরভাবে পায়চারি করতে লাগল শুধু। গুরুভাইরা কিছু জানে না, সারা ভারতেও বিশেষ কেউ জানে না, কোনও সংবাদপত্রেই তাঁর নাম উল্লেখ নেই, তবু তাঁর কাঁধে এক বিশাল দায়িত্ব। কয়েকজন শুভার্থী অনেক ভরসা নিয়ে তাকে পাঠাচ্ছে, সেই জড়বাদী, ভোগবাদীদের দেশে গিয়ে এ দায়িত্ব সে পালন করতে পারবে তো?

সমুদ্রযাত্রা নিয়ে কয়েকজন আপত্তি জানিয়েছিল, নরেন তাদের কথা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। মাদ্রাজি ব্রাহ্মণদের সে দাপটের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল, কোন শাস্ত্রে সমুদ্রযাত্রার নিষেধ আছে, আমাকে দেখান তো? তরুণ ভক্তদের সে বলেছে, কোনও শাস্ত্রে যদি এমন কথা থাকেও তো সে শাস্ত্র বদলাতে হবে। যে সমস্ত সামাজিক লোকাচার এ যুগের উপযুক্ত নয়, সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেবে। পুৰুতদের কথা একদম মানবে না।

সমুদ্র নরেনের ভাল লাগে। যে জলরাশির পরপর দেখা যায় না, তার যেন এক অজানা রহস্যের হাতছানি আছে। এতকাল হিন্দুরা সেই হাতছানি উপেক্ষা করে রইল কীভাবে? তাতেই তো অন্য জাতিগুলি এত এগিয়ে গেল!

নরেনের জাহাজ এসে পৌঁছল কানাডার ভ্যাঙ্কুভার বন্দরে। সেখান থেকে ট্রেনে শিকাগোয় আসতে তিন দিন লেগে গেল। টাকা পয়সা হু হু করে খরচ হয়ে যাচ্ছে, নতুন দেশে যে পাচ্ছে সে-ই ঠকাচ্ছে, স্টেশনের কুলিরা পর্যন্ত। জাহাজে ওঠার সময় নরেনের সম্বল ছিল প্রায় হাজার তিনেক টাকা মাত্র, এখন সন্ন্যাসী হয়েও তাকে টাকার হিসেব রাখতে হচ্ছে, ব্যয় করতে হচ্ছে টিপে টিপে।

শিকাগো পৌঁছবার পর নরেন বুঝতে পারল, কী আহাম্মকির কাজই না সে করেছে! আমেরিকায় একটা ধর্ম সম্মেলন হচ্ছে শুনেই হুট করে সেখানে চলে আসা যায়? এ যেন, উঠল বাই তো কটক যাই! আগে থেকে কিছু যোগাযোেগ করা হয়নি, কোনও আমন্ত্রণপত্র নেই, এমনকী কোনও পরিচয়পত্র পর্যন্ত নেই। কোনও ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতে গেলে তার প্রমাণ দিতে হবে না? সমগ্র হিন্দু সমাজের মুখপাত্র হিসেবে নরেনকে কে নির্বাচন করল? সে কি গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল! আমেরিকায় সব কিছু নিয়ম মেনে চলে, তাকে এখানে পাত্তাই দেবে না কেউ! যে-সব শুভার্থীরা তাকে এখানে পাঠাল, তাদেরও কারুর মাথায় এসব কথা আসেনি?

আরও ভয়ংকর ব্যাপার, নরেন শিকাগোয় এসে জানল, সম্মেলন শুরু হতে এখনও এক মাস দেরি আছে। আর কোনও দেশের প্রতিনিধি এখনও এসে পৌঁছয়নি, তারা আসবে সম্মেলনের তিনদিন আগে। এই এক মাস নরেন থাকবে কোথায়, খাবে কী? ভিক্ষে করতে গেলেই এখানে জেলে পুরে দবে। সম্মেলনে আবেদনপত্র জমা দেবার শেষ তারিখও পার হয়ে গেছে, উদ্যোক্তাদের আতিথ্যও সে কোনওক্রমে পাবে না।

শিকাগোর সাউথ ওয়াশ এভিনিউতে দাঁড়িয়ে নরেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শীতে কাঁপছে। এ দেশের আবহাওয়া সম্পর্কেও কোনও খোঁজখবর নিয়ে আসেনি সে। বাংলায় ছটি ঋতু, পশ্চিমের লোকেরা তার মধ্যে দুটি ঋতুর নামই জানে না। এ দেশে একটি ঋতুই প্রধান, তার নাম শীত। এই শীতের ধারপাশ ঘেঁষে কখনও গ্রীষ্ম, কখনও বসন্ত, কখনও শরৎ উঁকি মেরে যায়। কিন্তু ওইসব ঋতুতেও যদি হঠাৎ জাঁকিয়ে বৃষ্টি নামে, থামোমিটারের পারাও অনেক বেশি নেমে যায়, হু হু করে ছুটে আসে হিমেল হাওয়া। নরেন কোনও গরম জামাকাপড়ই আনেনি।

অচেনা দেশ, একটি মানুষও চেনা নেই। সঙ্গে যা টাকা আছে তাতে দেশে ফেরার জাহাজ ভাড়াও কুলোবে না, অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে তিরিশ বৎসর বয়স্ক এক যুবক। রাস্তার লোক ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। তারা কেউই আগে কোনও ভারতীয় দেখেনি, এই কিম্ভুতকিমাকার পোশাক পৱা মানুষটি যেন অন্য গ্রহের প্রাণী।

আস্তে আস্তে তাকে ঘিরে জুটে গেল একদল বালক ও কিশোর। তারা অদ্ভুত স্বরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী বলছে তা বোঝা যায় না। চারদিকে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিয়ে নাচতে লাগল তারা। তাতেও নরেনের কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না দেখে তারা রাস্তা থেকে ইট কুড়িয়ে কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারতে লাগল।

এই হয়েছে আর এক জ্বালা! রাজা অজিত সিং খুব ভালবেসে নরেনের জন্য এই গাঢ় কমলা রঙের রেশমি পোশাক তৈরি করে দিয়েছে, যাতে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। জাহাজ থেকে নামার পর নরেন ট্রাউজার্স-কোট বদল করে এই ভারতীয় পোশাক পারে নিয়েছিল। দৃষ্টি আকৃষ্ট হচ্ছে ঠিকই। ফলটা হচ্ছে বিপরীত। বয়স্ক লোকেরা শুধু বক্র দৃষ্টিতে তাকায়, বাচ্চারা সহ্য করতেই পারে না, ঢিল মারে।

মালপত্র তুলে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল নরেন, বাচ্চারা পেছন পেছন তাড়া করে এল! যেন পাগল তাড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ছুটতে হল নরেনকে। ছুটতে ছুটতে সে একটা হোটেলের দরজায় পৌঁছে গেল।

এ দেশে পয়সা থাকলেই হোটেলে আশ্রয় পাওয়া যায় না। সভ্যতার অগ্রগতির মধ্যেও অদ্ভুত একটা পরিহাস আছে। যে-সমাজ এক দিকে খুব উদার, সেই সমাজই অন্য দিকে গোড়া। এক দিকে যুক্তিবাদী, অন্য দিকে অন্ধ। যারা মানবতার নামে জয়ধ্বনি দেয়, তারাই আবার ধর্মের তফাত কিংবা গায়ের সাদা কালো রঙের তফাত ভুলতে পারে না।

নিজের দেশে নরেন একজন গৌরবর্ণ পুরুষ, পশ্চিমিদের চোখে সে কালো। আমরা ক্যাটক্যাটে সাদ ও কুচকুচে কালোর মাঝখানে অনেকগুলি রং দেখতে পাই, সাহেবরা পারে না। তাদের চোখের দোষ আছে। কালো লোকদের জন্য হোটেলে জায়গা নেই। কেউ ভদ্র ভাষায় প্রত্যাখ্যান করে, কেউ মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়। কেউ বা নরেনের পোশাক দেখে বিকট মুখভঙ্গি করে, যেন চোখের সামনে রয়েছে এক অদ্ভুত জানোয়ার।

নরেন দারুণ বিষয়, ক্লান্ত ও শীতার্ত, মাথা গোঁজার জন্য একটা ঘর পেতেই হবে, না হলে সে হয়তো মরেই যাবে। একটা রেল স্টেশনের স্নানঘরে ঢুকে নরেন পোশাক বদলে আবার প্যান্ট-কোট পরে নিল। তারপর সস্তার হোটেলের বদলে গেল একটা বড় হোটেলে। এখানে বিভিন্ন দেশের মানুষ আসে, ঘর ছাড়া খুব বেশি। যত টাকাই লাগুক, তাকে তো বাঁচতে হবে আগে।

দুতিনদিন সেই হোটেলে থেকে নরেন কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নিল। বোঝার চেষ্টা করল দেশটাকে। চুরুটের দাম আট আনা, সব জিনিসেরই দাম এখানে অত্যন্ত বেশি। এখানকার ধনীরা বিপুল ধনান, মধ্যবিত্তদের সংখ্যাই সবধিক, গরিবও আছে বটে, কিন্তু তারা কেউ অনাহারে থাকে

, কিছু না-কিছু কাজ সবাই পায়। নরেনের যা সম্বন্স তাতে সে এখানে দিন পনেরোর বেশি টিকতে পারবে না। সে সন্ন্যাসী, তার চাকরি খোঁজার প্রশ্নই ওঠে না, তা হলে সে কীসের ভরসায় এ দেশে এসেছে?

অনেকেই এই অবস্থায় ভেঙে পড়ে। প্রথম প্রথম ঘোর বিদেশে এসে অনেকেরই দেশের জন্য খুব মন কেমন করে, ইচ্ছে করে তখনই ফিরে যেতে। সহায়-সম্বল না থাকলে অন্য যে-কেউ যে-কোনও উপায়ে ফেরার জন্য জাহাজঘাটায় ধরনা দিত। কিন্তু নরেন যে সে ধাতুতে গড়া নয়। তার প্রধান সম্বল আত্মবিশ্বাস, জেদ, গোঁয়ার্তুমি। এত দূর এসে সে পরাজিত হয়ে ফিরে যাবে? ধর্ম সম্মেলনে জায়গা পাওয়া যাবে না তাতে কী হয়েছে, অন্যভাবেও তো আমেরিকানদের কাছে তার বক্তব্য পৌঁছে দেবার চেষ্টা করা যায়। কোনওক্রমে দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক মাস এখানে টিকে থাকতে পারলে একটা কিছু উপায় বার করা যাবেই। আলাসিঙ্গাকে চিঠি লিখলে সে আরও কিছু টাকা চাঁদা তুলে পাঠাতে পারবে না? অজিত সিংকেও অগত্যা লিখতেই হবে।

নরেন একা একা ঘুরে বেড়ায়। বিশ্ব শিল্পমেলার প্রদর্শনী এক এলাহি ব্যাপার, দশ দিনেও দেখে শেষ করা যাবে না। আমেরিকায় সব কিছুই বিরাট বিরাট, রাস্তাগুলি অত্যন্ত চওড়া, মস্ত মস্ত সব বাড়ি, শিল্পমেলাও তো বিশাল হবেই। কিন্তু এসব দেখেও নরেন খুব একটা হতচকিত হয় না, আমেরিকায় এসে সে সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছে নারীদের দেখে।

বস্তুত এ দেশে এসেই যেন প্রথম নারীদের দেখল নরেন। দেশে থাকতে সে জননী, ভগিনী বা মাসি-পিসিদের দেখেছে, কিন্তু নারী কোথায়? ভারতের নারীরা তো সব অন্তঃপুরে থাকে। সে হতভাগ্য দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যাই তো গৃহবন্দিনী। আর এ দেশে পথে-ঘাটে সর্বত্র নারী। স্বাস্থ্যবতী, সপ্রতিভ মহিলারা দোকানপাট করছে, ব্যবসা চালাচ্ছে, কোনও কাজেই তারা পিছিয়ে নেই। আগে কত শোনা গিয়েছিল এই ধনবানদের দেশে সব সময় বিলাসের স্রোত বয়ে যায়, নারীরা এ দেশে শুধু ভোগের সামগ্রী। কিন্তু ভোগ-বিলাসের স্রোতে সব সময় ভেসে থাকলে এ দেশটার এত উন্নতি হল কী করে? কিছু কিছু লাস্যময়ী রমণী যে নেই তা নয়, কিন্তু অধিকাংশ নারীই স্বাবলম্বিনী, নম্র, ভদ্র, যে-কোনও দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। এই বিশাল নারী বাহিনীই যেন দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এ দৃশ্য অভূতপূর্ব, এ অভিজ্ঞতা অপার বিস্ময়কর।

সেইরকম একজন নারীই নরেনের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিল।

কয়েক দিন পর হোটেল ছেড়ে দিয়ে নরেন চেপে বসল বস্টনগামী ট্রেনে। সে শুনেছে শিকাগোর তুলনায় বস্টনে থাকার খরচ কম। লালুভাই নামে এক ভারতীয় তার সহযাত্রী, তার সঙ্গে গল্পগুজব করছে, এক কোণ থেকে একজন মাঝবয়েসী মহিলা উঠে এসে সামনে দাঁড়ালেন। ভুক্ত তুলে জিজ্ঞেস করলেন, মাপ করবেন, ভদ্রমহোদয়রা, আপনারা কোন দেশের লোক?

নরেন বলল, আমরা ভারতীয়।

মহিলাটি আরও অবাক হয়ে বললেন, ভারতীয়রা ইংরিজিতে কথা বলে? তারা এত ভাল ইংরিজ্জি জানে?

প্রবাসে বিভিন্ন প্রদেশের ভারতীয় পরস্পরের সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলতেই বাধ্য হয়, তা ছাড়া উপায় নেই। নরেন হেসে বলল, আমরা সংস্কৃত ভাষাতেও কথা বলতে পারি, কিন্তু তা তো আপনি বুঝবেন না। সংস্কৃত ভাষার নাম শুনেছেন। সংস্কৃত ভাষা কিন্তু ইংরিজি ভাষার মাসি কিংবা দিদিমার মতম এক আত্মীয়া।

মহিলার নাম ক্যাথরিন এবট স্যানবন, তিনি বেশ ধনবতী আবার ভালমতন লেখাপড়াও জানেন। কথায় কথায় তাঁর সঙ্গে ভাব জমে গেল। বস্টনে নামবার সময় তিনি নরেনকে বললেন, আপনি এখানে হোটেল খুঁজবেন কেন, আমার সঙ্গে চলুন না, আমার একটা ফার্ম হাউস আছে, সেখানে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবেন। আমার বন্ধু-বান্ধবরা কেউ কখনও ভারতীয় দেখেনি, আপনার সঙ্গে আলাপ করলে খুশি হবে।

নরেনের আপত্তি করার কোনও প্রশ্ন নেই, তার তো হোটেল খরচ বেঁচে গেল। টাকা বাঁচানোই তার প্রধান চিন্তা। ক্যাথরিনের গোলাবাড়িটি যেমন খুব বড় তার পরিচিতদের সংখ্যাও অনেক। তারা দলে দলে ছুটে আসে এক ভারতীয়কে দেখতে। ক্যাথরিনের অনুরোধে নরেনকে মাথায় পাগড়ি ও আলখাল্লা পরে বসতে হয়, স্থানীয় আমেরিকানদের চোখে সে যেন এক চিড়িয়াখানার প্রাণী। বিনা পয়সায় খাওয়া থাকা, নরেন মেনে নেয়। কিন্তু এই প্রাণীটি আবার কথা বলে, তাও ইংরিজিতে, এবং সে মিনমিন করে ভিক্ষেও চায় না। অনেক মজার কথা বলে, এক এক সময় আমেরিকানদের সম্পর্কে কড়া কথা বলতেও ছাড়ে না। ক্যাথরিমের বন্ধুরা অবশ্য সবাই নিচ্ছুক অজ্ঞ কৌতূহলী নয়, তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষিত ব্যক্তিও আছে। তারা দেখল এই অদ্ভুত লোকটা বাইবেল পাড়েছে, অনেক বই পড়েছে, তাদের কারুর কারুর চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী।

ক্রমে নরেনের ভূমিকা বদল হয়, কৌতূহলের বদলে সে অনেকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। তখন বিভিন্ন জায়গায় তার বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়। মহিলারাই বেশি উৎসাহী, বিভিন্ন মহিলা ক্লাব থেকে তার ডাক পড়ে। কিছু কিছু খ্যাতি ছড়াতে থাকে এই “ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী”র।

এই সূত্রেই পবিচয় হয় হেনরি রাইটের সঙ্গে। তিনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক ভাষার অধ্যাপক, প্রাচ্য দর্শন বিষয়ে আগ্রহী, তিনিও নরেনকে নিয়ে গিয়ে নিজের বাড়িতে রাখলেন কয়েক দিন এবং নরেনের বিদ্যাবত্তার পরিচয় পেয়ে দারুণ শ্রদ্ধান্বিত হয়ে পড়লেন। আচার-ব্যবহারেও এই সন্ন্যাসী সম্পূর্ণরূপে সংস্কারমুক্ত, সকলের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খানাপিনা করেন, এমনকী গো মাংস ভক্ষণেও আপত্তি নেই। ধর্ম মহাসভায় যোগদান বিষয়ে নরেন সম্পূর্ণ আশা ত্যাগ করেছিল, অধ্যাপক হেনরি রাইটই তাকে আবার উদ্দীপিত করলেন। উৎসব কমিটির সেক্রেটারির সঙ্গে হেনরি রাইটের পরিচয় ছিল, তিনি সেই সেক্রেটারিকে একটা চিঠিতে লিখলেন, এই সন্ন্যাসীকে অবশ্যই বক্তৃতার সুযোগ দেওয়া উচিত, ইনি এমনই একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি, আমাদের এখানকার সব কটি অধ্যাপককে একত্র করলেও এর সমকক্ষ হবে না।

প্রায় অলৌকিক যোগাযোগ বলতে গেলে। অধ্যাপক হেনরি রাইট নরেনের পরিচয়পত্র লিখে দিলেন, শিকাগোয় যাতে থাকার ব্যবস্থা হয় সে চিঠি দিলেন সঙ্গে, এমনকী শিকাগো যাবার ট্রেনের টিকিট কিনে দিলেন পর্যন্ত।

এত সুযোগ পেয়েও নরেন একটা গণ্ডগোল করে ফেলল। শিকাগোতে ট্রেন থেকে নেমে পকেটে হাত দিয়ে দেখল পকেটে তিনখানা চিঠির মধ্যে রয়েছে মাত্র একখানা। শুধু তার পরিচয়পত্রটি রয়েছে, কিন্তু বারোজ নামে যে ব্যক্তিটি তার থাকার ব্যাবস্থা করে দেবে, তাঁর নামে চিঠিটিও উধাও, তার ঠিকানাও নরেন জানে না। মহাসভার অফিসের ঠিকানাও গেছে হরিয়ে। এখন এই গোলোকধাঁধার মতন শহরে সে কোথায় যাবে? বৃষ্টি পড়ছে খুব, নরেন স্টেশনের বাইরে এসে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সম্মেলন সমাস বলে এ শহরে বহু অতিথি এসে গেছে, বড় বড় সব হোটেল ভর্তি। একটু বাদে বৃষ্টির মধ্যে খুঁজতে বেরিয়ে নরেন কোনও হোটেলেই জায়গা পেল না কিংবা প্রত্যাখ্যাত হল। উপায়ান্তর না দেখে সে ফিরে এল রেল স্টেশনে, শীত থেকে বাঁচবার জন্য সে ঢুকে পড়ল একটা খালি কাঠের বাক্সের মধ্যে।

সেই বাক্সের মধ্যে কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে রইল নরেন। এ দেশের দরিদ্রতম ব্যক্তিও এমনভাবে রাত কাটায় না। নরেনের বুকটা খুব দমে গেছে। তীরে এসে তরী ডুববে? এতটা সুযোগ পেয়েও সে সব হারাল? এখন আর হাভার্ডে ফিরে গিয়ে অধ্যাপক রাইটের কাছ থেকে নতুন করে পরিচয়পত্র লিখিয়ে আনার সময় নেই, সম্মেলন শুরু হয়ে যাবে এক দিন পরেই।

কিন্তু হাল ছাড়লে তো চলবে না। পর দিন সকালেই সে বেরিয়ে পড়ল, যেমনভাবেই হোক ধর্মসভার কার্যালয়ে পৌঁছাতেই হবে তাকে। সে এক একটা বাড়ির দরজায় ঘা দিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ধর্ম মহাসভার অফিসটা কোথায় আমাকে একটু বলে দেবেন? বিরাট লেক মিসিগানের তীরবর্তী এই বাড়িগুলিতে ধনীদের বাস। অনেকে ধর্ম মহাসভা সম্পর্কে কিছু জানে না। অনেকে ধারণা হল এই লোকটি পাগল। একটা কালা আদমি, ময়লা পোশাক, দাড়ি না কামানো মুখ, সে বিড়বিড় করে কী বলছে। অবাঞ্ছিত বেড়াল কুকুরের মতন ভূতারা দুর দুর করে তাকে তাড়িয়ে দিতে লাগল।

অনেকক্ষণ এ রকম চেষ্টা করার পর বিফল মনোরথ হয়ে নরেন বসে পড়ল রাস্তায়।

এর পরেই স্বর্গ থেকে দেবদূতীর আগমন। বিপদ ভঞ্জনে এগিয়ে এল আর এক নারী।

এক প্রাসাদের তিনতলার জানলায় দাঁড়িয়ে এক অপরূপা রমণী অনেকক্ষণ ধরে নরেনকে লক্ষ করছিলেন। এক সময় তিনি নীচে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন রাজপথে। নরেনের সামনে এসে তিনি সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটি করলেন, মহাশয় আপনি কি ধৰ্ম মহাসভার একঞ্জন প্রতিনিধি?

এই মহিলার নাম শ্রীমতী হেল। এর নজরে পড়ায় আর কোনও সমস্যাই রইল না। ইনি নরেনকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে নিয়ে এলেন ধর্ম মহাসভার অফিসে। অধ্যাপক রাইটের ডাকে পাঠানো চিঠির ফলে সব ব্যবস্থাই হয়ে ছিল, সে প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি পেল, তার থাকার ব্যবস্থাও নির্দিষ্ট হল।

এখন নরেন সেই মহা সম্মেলনের মঞ্চে উপবিষ্ট। দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়ে গেছে অপরাহ্নে। একে একে প্রতিনিধিরা বক্তৃতা শেষ করছেন। আর তো উপায় নেই, এবার নরেনকে দাঁড়াতেই হবে এই বিশাল জনসমষ্টির সম্মুখে।

চারজন বক্তার ভাষণ শেষ হবার পর নাম ঘোষিত হল হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধির। নরেনের বুকের কাঁপুনি এখন দ্বিগুণ। গুরুর নাম কিংবা মা কালীর কথা তার মনে পড়ল না। সে একবার মঞ্চের পেছন দিকে তাকাল। সেখানে দু’জন গ্রিক দার্শনিকের পাথরের মূর্তি সাজানো রয়েছে, আর একটু দূরে একটি নারীমূর্তি, আকারে বেশ বড়, একটি হাত আশীবাদের ভঙ্গিতে তোলা, হয়তো কোনও গ্রিক বা রোমান দেবীর প্রতিমূর্তি। কিন্তু অনেকটা হিন্দুদের দেবী সরস্বতীর সঙ্গে মিল আছে। সে দিকে চেয়ে নরেন মনে মনে বলল, হে মা সরস্বতী, দয়া করো, আমার জিহ্বাগ্রে তোমার একটুখানি স্পর্শ দাও মা!

ধীর পায়ে সে গিয়ে দাঁড়াল রোষ্ট্রামে। শ্রোতাদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। কত বিভিন্ন বর্ণের পোশাক। হলে তিল ধারণের স্থান নেই, পেছন দিকে দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। অন্য সবাই প্রথম সম্বোধন করেছে, ‘ভদ্রমহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ। এটাই বিলিতি সভ্যতার রীতি, নরেন বলল, হে আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ…।

সঙ্গে সঙ্গে হাততালি, প্রবল হাততালি, সমস্ত প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে হাততালি এবং সে হাততালি যেন থামতেই চায় না। এ তো ঠিক ভদ্রতার হাততালি নয়। নরেন নিজেই বেশ বিস্মিত হল। ভারতে অনাত্মীয় মহিলাদের মা কিংবা বোন বলে সম্বোধন করার রীতি আছে, এ দেশে নিজের মা-বোন হাড়া অনাদের এইভাবে ডাকাটা ন্যাকামির পর্যায়ে পড়ে। ভারতে পুরুষে পুরুষে ভাই সম্বোধন খুবই স্বাভাবিক, আর এদেশে পারিবারিক বন্ধন শিথিল, নিজের ভাই-বোনেরই অনেকে খবর রাখে না, পরিবারের বাইরে ভাই শব্দটার প্রায় ব্যবহারই নেই বলতে গেলে, ইয়ার্কির ছলে গুড়া। ভারতীয় সম্বোধন এদের এত পছন্দ হয়ে গেল?

এত হাততালিতে অনেকখানি ভরসা পেল নরেন। এর পর সে জোরাল গলায় বলতে লাগল, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন সন্ন্যাসী সমাজের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে এসেছি… আমরা শুধু সকল ধর্মকেই সহ্য করি না, সকল ধর্মকেই সত্য বলে মনে করি… বিভিন্ন নদীর বিভিন্ন উৎস, কিন্তু সব নদীই সাগরে মেশে, তেমনি যত ধর্মমত, যত রকম বিশ্বাস, সকলের মূলে একই ভগবান,.. আজ এই সম্মেলনের শুরুতে যে ঘটাধ্বনি হয়েছিল, তাতেই যেন একই সঙ্গের দিকে অগ্রগামী বিভিন্ন মতবাদের রেষারেষির অবসান ঘঘাষিত হল।

সময় নির্দিষ্ট, নরেন বক্তৃতা দীর্ঘ করল না। শেষ হতে না হতেই সে কি তুমুল হানি! যেন মহা সমুদ্রের কলরোল। মঞ্চে উপবিষ্ট অন্যান্য বক্তাদের মুখ ধূসর হয়ে গেল, এত অভিনন্দন তো আর কারুর ভাগ্যে জোটেনি। নরেনের বক্তৃতার ভাষা বা বিষয়বস্তু খুব যে অভিনব বা চমকপ্রদ, তা কিন্তু নয়। ব্যবহারিকভাবে

মানলেও প্রত্যেক ধর্মের প্রবক্তারাই এক এক সময় উদার ভাব দেখিয়ে অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার কথা ঘোষণা করেন। সকাল থেকে প্রত্যেক বস্তার কণ্ঠেই বিশ্ব প্রাতৃত্বের কথা ধ্বনিত হয়েছে। তা হলে নরেন এমন নতুন কী বলল? নরেনের চেহারা বা পেশাকের ঔজ্জ্বল্য দেখেই সবাই মুগ্ধ হয়েছে, আমেরিকান শ্রোতাদের এতটা ছেলেমানুষ মনে করাও ভুল। অন্য বক্তারা পাঠ করেছেন লিখিত বক্তৃতা, তা কিছুটা ক্লান্তিকর হয়, ভাষার কারিকুরিতে সব বোঝা যায় না, বক্তার মুখ দেখা যায় না। নরেন যে আগে থেকে লিখেটিখে তৈরি হয়ে আসেনি, সেটাই যেন তার পক্ষে শাপে বর হয়েছে। সে সোজাসুজি শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে তার বিশ্বাসের কথা উচ্চারণ করেছে সরল, আন্তরিক ভাষায়। তার বক্তব্যের আড়ালেও এমন কিছু ছিল, যা স্পর্শ করেছে সকলের মন। যেন এই তেজস্বী যুবকটি নিছক তত্ত্বকথা শোনাতে আসেনি, মানুষে মানুষে মিলন ঘটানোর দায়িত্ব সে নিজেই নিয়েছে, তার বিশ্বাসের জোরেই ভালবাসার প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। যেন সে এক নতুন অবতার।

নরেন জয়ী হয়েছে। এতগুলি মানুষের হৃদয় হরণ করেছে সে। এই মুহূর্ত থেকে নরেন মুছে গেল, সে এখন স্বামী বিবেকানন্দ, এই নামেই বিশ্বের বহু লোক তাকে চিনবে।

শুধু হর্ষধ্বনিতেই শেষ হল না, শত শত শ্রোতা চেয়ার-বেঞ্চি টপকিয়ে ছুটে এল তার দিকে। মহিলারাই অগ্রবর্তী হয়ে স্বামী বিবেকানন্দকে ঘিরে ধরল, তাঁকে একটু স্পর্শ করার জন্য।

উৎসবের একজন কর্তাব্যক্তি সেদিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, ও বলেছে খুবই ভাল। কিন্তু এর পরেও যদি ছোকবা মাথার ঠিক রাখতে পারে, তা হলে বুঝব ওর এলেম!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়