কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চারশো বছর পূর্তি উপলক্ষে শিকাগোতে এক বিরাট বিশ্বমেলার আয়োজন করা হয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশের শিল্পসম্ভার, বাণিজ্যসম্ভার, বস্ত্র ও ধাতুদ্ৰব্য, সব মিলিয়ে এক মহা প্রদর্শনী, তার সঙ্গে রয়েছে বহুবিধ আমোদপ্রমোদের ব্যবস্থা।

এই বিশ্বামেলারই এক অংশে এক ধর্ম সম্মেলন আহুত হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের প্রতিনিধিরা সেখানে এক মঞ্চে বসে মত বিনিময় করবেন। বিশ্বমেলার চেয়েও এই ধর্মসভা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ধর্ম মানেই রেষারেষি, ধর্ম মানেই পরমত অসহিষ্ণুতা। যদিও সব ধর্মেই আছে এক পরমেশ্বরের কথা এবং মানুষ মাত্রেই সেই পরমেশ্বরের সন্তান, কিন্তু তা হলে যে আলাদা আলাদা ধর্মের অস্তিত্ব বজায় রাখাটাই অর্থহীন, তা ধর্মীয় নেতাদের মাথায় ঢোকে না। পৃথক পৃথক ধর্মের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে একটি মাত্র মানবধর্ম প্রচার করলে যে এতগুলি ধর্মগুরুর গুরুগিরি মুছে যায়। তাই প্রকৃতপক্ষে ছোট-বড় মিলিয়ে পৃথিবীতে এখন অনেকগুলি ধর্মমত, তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর, সেই পরমেশ্বরের সন্তান-সন্ততিদের সংখ্যা নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত। এক সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুরা অন্য ধর্মগুলিকে নস্যাৎ করার জন্য কাল্পনিক অভিযোগ, অসত্য এমনকী কুৎসিত, কদর্য, হিংস্র ভাষা প্রয়োগ করতেও দ্বিধা করে না।

প্রধান ধর্মগুলির উৎস ও বিস্তার প্রাচ্য ভূমিতে। আবার ধর্মের বহু রকম ব্যভিচার এবং ধর্মের নামে বহুবার মনুষ্য হত্যার রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হয়েছে এই প্রাচ্য ভূমিতেই।

প্রথম দিকে সব ধর্মই ছিল টোটেম বা মূর্তিপূজক। গ্রিস, রোম, ভারতের এই মুর্তিপূজা শিল্পকলার চরম উৎকর্ষে পৌঁছয়। গৌতম বুদ্ধ এসে সমস্ত মূর্তির কল্পনা ধূলিসাৎ করলেন, তিনি মানুষের আত্মিক উন্নতির এমন এক উচ্চমার্গের দার্শনিক ভাবনার প্রচার করলেন, যাতে ঈশ্বরেরও কোনও স্থান নেই। কিন্তু এত উচ্চমার্গের চিন্তা সাধারণ মানুষ গ্রহণ করতে পারবে কেন? বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধ ধর্ম আস্তে আস্তে ভাগ হতে লাগল, তার মধ্যে ঢুকে পড়ল তন্ত্রমন্ত্র এবং বকলমে মূর্তিপূজা। ভারতে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে আধিপত্যের লড়াই চলল কিছুকাল, তারপর বৌদ্ধরা পাড়ি দিল দূর প্রাচ্যে, চিন-জাপানে। আর হিন্দুরা ভারতকেই মনে করে মহাভারত তথা নিজস্ব ভুবন, তার বাইরে কোথায় কী ঘটছে সে খবরও রাখে না। প্রথম তারা রূঢ় আঘাত পেল, যখন আরব দেশ থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে তলোয়ার উঁচিয়ে ভারতভূমিতে ঢুকে পড়ল মুসলমানেরা।

রাজশক্তির সমর্থন না থাকলে ধর্ম টেকে না। সাধারণ মানুষের ধর্মের প্রতি ভক্তির চেয়ে ভয়ই বেশি থাকে। সব ধর্মেরই প্রধান পতাকা হচ্ছে তলোয়ার কিংবা বন্দুক। মুসলমানদের কাছে হিন্দ রাজারা পদানত হবার পর থেকেই হিন্দু ধর্মের অবনতি হতে থাকে। হিন্দু ধর্ম এমনই হীনবল হয়ে পড়ে যে শেষপর্যন্ত আশ্রয় নেয় রান্নাঘরে। অসুস্থ লোক যেমন এটা খাব না, ওটা খাব না বলে, তেমনি হিন্দু ধর্মের নেতাদের মুখে শুধু শোনা যায়, এর হাতের ছোঁয়া খাব না, ওর হাতের ছোঁয়া খাব! আমিষ কিংবা পেঁয়াজ খেলেই ধর্ম গেল!

গতিবেগ ও বারুদের জোরে মুসলমানেরা অধিকাংশ প্রাচ্য দেশ তো বটেই, ইওরোপকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। মহা শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্য বিস্তৃত হল এ দিকে স্পেন, ও দিকে বাশিয়ায়। তাদের অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারে না কেউ, অস্ত্রধারীদের পিছে পিছে আসে মোশ্লাতন্ত্র, প্রথমে লুণ্ঠন, তারপর ধর্মপ্রচার।

রোমান সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে যাবার ফলে খ্রিস্টানরা পিছিয়ে পড়ছিল ক্রমশ, নিজেদের গণ্ডি ছেড়ে বেরোতে পারেনি, মধ্যযুগ পার হবার পর তারা আবার জাহাজ সাজাল। বাণিজ্যতরীর সঙ্গে সঙ্গে রণতরী। মুসলমানরা স্থলপথে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, নৌযুদ্ধের দিকে তারা মনোযোগ দেয়নি বিশেষ। জল বনাম স্কুলের যুদ্ধে ক্রমশ বিজয়ী হয়ে উঠতে লাগল খ্রিস্টানরা। শুধু যুদ্ধ নয়, বড় বড় জাহাজ অকুল সমুদ্রে ভাসিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল অজানার অভিযানে, আবিষ্কৃত হল বিশাল বিশাল মহাদেশ, যেখানে স্বর্ণ ও শস্যের সম্ভাবনা অফুরন্তু। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমানেরা সে সব মহাদেশের অস্তিত্বের কথা কল্পনাও করেনি।

বাণিজ্যে ও যুদ্ধে একাধিপত্য বিস্তার করার পর খ্রিস্টানরা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে লাগল খ্রিস্ট ধর্মের বাণী। মুসলমানদেরই মতন তারা ক্রীতদাসদেরও নিজেদের ধর্মে দীক্ষা দিতে দ্বিধা করে না। বর্তমান শতাব্দীতে মুসলমানরা দিকে দিকে পরাজিত হয়ে মাথা নিচু করে আছে, আর খ্রিস্টানদের কামানের গোলার সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে বাইবেল হাতে পাদ্রিরা। রাজশক্তির ওপর সওয়ার হয়ে তারা জোর গলায় বলে বেড়াচ্ছে, জগতে খ্রিস্টানদের ধর্মই শ্রেষ্ঠ, আর সব ধর্মের লোকেরা পাপী ও অধঃপতিত।

এই রকম অবস্থায় শিকাগোর সর্ব ধর্ম সম্মেলন অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। একই মঞ্চে খ্রিস্টধর্মের গুরুদেব পাশে অন্য ধর্মের প্রবক্তাদের স্থান দেওয়ার অর্থ তো সেই সব ধর্মের গুরুত্বও স্বীকার করে নেওয়া। নিজেরা পয়সা খরচ করে খ্রিস্টানরা তা করতে যাবে কেন? ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ তো এই প্রস্তাব শুনেই বলে উঠেছিলেন, না, না, আমি যাব না। ওই সব নেটিভরা, হিদেনরা, ওরা আমাদের চাকর বাকরের মতন, ওদের সঙ্গে এক জায়গায় বসলেই তো স্বীকার করে নেওয়া হবে যে, ওরা আমাদের সমান।

আমেরিকায় এই গোঁড়ামি কিছুটা শিথিল হবার বেশ কয়েকটি কারণ আছে। এই উনবিংশ শতাব্দীতে এ দেশের মানুষ ধন-ঐশ্বর্যে সব জাতকে ছাড়িয়ে যেতে বসেছে। বিজ্ঞানের নিত্য-নতুন উদ্ভাবনেও এরা অগ্রণী। এত বড় একটা দেশে বসতি স্থাপন করতে এসে চাষবাস, খনি খোঁড়া, দূরপাল্লার যাতায়াতের ব্যাপারে যখনই তারা কোনও অসুবিধের সম্মুখীন হয়েছে, তখনই চরম

অধ্যবসায়ে তারা কিছু না-কিছু যন্ত্রপাতি তৈরি করে ফেলছে। তারপর সেই সব যন্ত্রপাতির পেটেন্ট নিয়ে বিক্রি করছে অন্য দেশে। টমাস আলভা এডিসন নামে একটা মুখচোরা লোক যেন জাদুকর, এর মধ্যে কত কী যে আবিষ্কার করেছে তার ইয়ত্তা নেই। একটা অতি পাতলা কাচের গোলাকার জিনিস, তার মধ্যে সরু সরু তার, সেই জিনিসটায় এমন আলো জ্বলে ওঠে যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আগুন নেই, অথচ আলো? বিদ্যৎ! যারা দেখে, তারাই হতবাক হয়ে যায়। আকাশের বিদ্যুৎ বন্দি হয়েছে ওইটুকু একটা ভঙ্গর কাচের গোলাকার জিনিসের প্রমিথিউসের আগুন চরি করে আনার চেয়েও এ যেন আরও বড় কৃতিত্ব। এই আলো বহু ঘরের কোণের অন্ধকার দূর করে দিয়েছে।

হঠাৎ এত অর্থ ও ঐশ্বর্যে বলীয়ান হবার ফলে অধিকাংশ আমেরিকান হয়ে উঠেছে ভোগবাদী। ধর্মের অত কড়াকড়ি নিয়ে মাথা ঘামাতে তাদের ভাল লাগে না। মাজিক, ভূত-প্রেত, ডাকিনী নৃত্য, মৃতের পুনরুত্থান, পূর্বজন্ম, পরজন্ম এই সব এখন অনেককে আকৃষ্ট করেছে। শিক্ষিত সমাজ, যারা নানা বিষয় নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেছে, তারা ধর্মের অনুশাসনের বদলে দর্শনের দিকটা সম্পর্কে বেশি আগ্রহী, তারা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ, বিশেষত বৌদ্ধদের শাস্ত্র পড়ে বিস্মিত হয়ে ভাবতে শুরু করেছে। যে এত উচ্চমার্গের চিন্তা অন্য ধর্মে থাকতে পারে? ডারউইন ও তার অনুগামীরাও শিক্ষিত খ্রিস্টানদের মনে একটা জোর আঘাত দিয়েছে। বাইবেল অভ্রান্ত নয়, মনুষ্য সৃষ্টির সঙ্গে ঈশ্বরের কোনও সম্পর্ক নেই, এটা যে প্রমাণসিদ্ধ। তা হলে দেখা যাক, অন্য ধর্মে কী বলে!

আমেরিকানদের উন্নতির মূলে অন্য দেশে সৈন্যসামন্ত প্রেরণ নয়, বাণিজ্য। তাই ধর্ম নিয়ে বাণিজ্য করার কাজেও লেগে আছে এ দেশের বহু মানুষ। নানা রকম সঙঘ প্রতিষ্ঠা করে তারা চাঁদা তোলে বিদেশে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে। ধনী আমেরিকানরা মনে করে, নিয়মিত গিজায় যাবার বদলে এই সব প্রতিষ্ঠানকে মোটা চাঁদা দিয়ে দিলেই তো বেশ ধর্মের কাজ হল! এ ব্যাপারে মহিলাদের উৎসাহ বেশি। বিবাহ সম্পর্ক ছাড়াও পুরুষ সংসর্গে যদি কোনও পাপ হয়, ধর্মপ্রচারের জন্য অনেক টাকা দিলে সে পাপ কেটে যাবে। এই ধর্ম ব্যবসায়ীরাও পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে যে কোনও প্রকারে গরিব, অসহায়, নির্যাতিত মানুষদের খ্রিস্ট ধর্মের আলো পৌঁছে দেয়। যদি এক হাজারটা অন্ধকারাচ্ছন্ন এ রকম মানুষকে খ্রিস্টান করা যায়, তা হলে পরের বছর তা দেখিয়ে চাঁদা তোলা যাবে অনেক বেশি। সেই টাকায় ধর্ম ব্যবসায়ীদের নিজেদের আরাম-বিলাসের উপকরণ জুটবে ঢের। এই ধরনের ধর্ম ব্যবসায়ীরাও শিকাগোর সর্বধর্ম সম্মেলন সমর্থন করেছে। বিশেষ মতলবে। দূর দুর দেশ থেকে অন্য ধর্মের কালো-খয়েরি-হলদে মানুষগুলি এখানে এসে ইংরিজি ভাষায় কী এমন মহৎ কথা শোনাতে পারবে? বরং এই মঞ্চেই আবার প্রমাণিত হবে, খ্রিস্ট ধর্মই সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। খ্রিস্ট ধর্মের জয়-জয়কার পড়ে যাবে। তাতে আমেরিকান মিশনারিদেরই চাঁদার পরিমাণ বাড়বে।

আহ্বান জানানো হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত উল্লেখযোগা ধর্মের প্রতিনিধিদের। ইহুদি, মুসলমান, বৌদ্ধ, তাও, কনফুসিয়ান, শিন্টো, পারস্যের অগ্নি উপাসকদের ধর্ম, ক্যাথলিক, গ্রিক চার্চ, প্রটেস্টান্ট ইত্যাদি। এমনকী থিয়োসফিস্ট ও ব্রাহ্মদেরও ডাকা হয়েছে। শুধু হিন্দু ধর্ম বাদ। হিন্দু ধর্মটা আবার কী? এ দেশের লোক কিছুই জানে না, শুধু কিছু কিছু বমন উদ্রেককারী গল্প শুনেছে। হিন্দু মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে জ্বলন্ত চিতায় পুড়ে মরে, মায়েরা নিজের সন্তানদের নদীতে কুমিরের মুখে জুড়ে দেয়, হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ নামে এক বিচিত্র প্রাণী আছে, অন্য কেউ তাদের ছুঁয়ে দিলেই তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে, সেই লোকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, জগন্নাথের রথের চাকায় হাজার হাজার লোক চাপা পড়ে…। এই কোনও গল্পই পুরোপুরি মিথ্যে নয়। কিন্তু এর বাইরেও যে হিন্দু ধর্মে মহৎ কোনও চিন্তা বা আদর্শ আছে, তা হিন্দুরাই ভুলে গেছে। হিন্দুদের নাকি বেদ’ নামে একটি ধর্মগ্রন্থ আছে, তা হিন্দুরাই পড়ে না, পড়লেও বুঝতে পারত না অবশ্য, সেই বই পাওয়াই যায় না বলতে গেলে। মহা জলধিতে বেদ একবার সুপ্ত হয়েছিল, এখনও প্রায় সেই অবস্থা।

কোনও হিন্দু প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। জানালেই বা কে আসত? হিন্দুদের মধ্যে অসংখ্য দলাদলি, তাদের মুখপাত্র কে হবে? সে রকম কেউ নেই। অন্যান্য প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে তাঁদের নিজ ব্যয়ে জাহাজে আসতে হবে। শিকাগো শহরে পৌঁছবার পর তাঁদের আহার ও আশ্রয়ের দায়িত্ব নেবে সম্মেলন কর্তৃপক্ষ। কোনও হিন্দুকে আমন্ত্রণ জানাবার প্রশ্নই ওঠে না আরও এই কারণে যে, কোনও নিষ্ঠাবান হিন্দু তো জাহাজেই চাপবে না। সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া তাদের ধর্মে নিষিদ্ধ! বহু শতাব্দী ধরে হিন্দুরা কুপমণ্ডুক, তারা সমুদ্রকে ভয় পায়, সমুদ্র চিনল না বলে তারা পৃথিবীকেও চিনল না। তারা শুধু ঘরে শুয়ে শুয়ে প্রাচীন কালের মহিমা নিয়ে জাবর কাটতে পারে।

আমন্ত্রিত বক্তা-অতিথি ছাড়াও শ্রোতা এবং দর্শক হিসেবেও নিজেদের উদ্যোগে এসেছে বহু দেশের মানুষ। ভারত থেকে এ রকম একটা দল আসবার একটা কথা উঠেছিল বটে। বোম্বাইয়ের মেসার্স কারসেটজি সোরাবজি অ্যান্ড কোম্পানি নামে এক জাহাজ কোম্পানির পারসি মালিকরা একটা ‘হিন্দু জাহাজ’ ছাড়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। এ জাহাজে পুরোপুরি হিন্দুয়ানি বজায় রাখবার জন্য হিন্দু ব্রাহ্মণ রাঁধুনি, হিন্দু মোদক, হিন্দু পরিচারক, হিন্দু তত্ত্বাবধায়ক আর অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের বদলে হিন্দু কবিরাজ রাখা হবে। পুরো যাত্রাপথে খাদ্যদ্রব্যে মাছ-মাংসের ছোঁয়া থাকবে না, সব নিরামিষ, চাল-ডাল-আলু বেগুনও নিয়ে যাওয়া হবে দেশ থেকে, আর থাকবে অনেকগুলি জালা ভর্তি গজল। যাওয়া-আসাও আমেরিকায় বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ সমেত মোট চার মাসের জন্য ব্যয়ও এমন কিছু বেশি নয়, প্রথম শ্রেণীর তিন হাজার টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর আড়াই হাজার ও পরিচারকদের জনা দেড় হাজার মাত্র। কিছু রাজা-মহারাজা-জমিদার এ পরিকল্পনা সমর্থন করেছিলেন, বাংলার মহারাজকুমার বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর, মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন, রায়বাহাদুর কৈলাসচন্দ্র মুখার্জি প্রমুখ কয়েকজন উৎসাহী ছিলেন যাওয়ার ব্যাপারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট যাত্রী পাওয়া গেল, জাহাজ কোম্পানি পরিত্যাগ করলেন পরিকল্পনাটি।

এগারোই সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল দশটায় বিশ্বমেলার হল অফ কলম্বাসে এই ধর্মসভার উদ্বোধন। আমন্ত্রিতরা বাইরে থেকে সারবদ্ধ হয়ে একশো ফুট লম্বা মঞ্চের ওপর এসে দাঁড়ালেন, নেপথ্যে ঘণ্টাধ্বনি হতে লাগল। মঞ্চের ঠিক মাঝখানে একটি লোহার সিংহাসন, তাতে বসবেন আমেরিকার ক্যাথলিকদের সর্বপ্রধান ধর্মর্যাজ কার্ডিনাল গিবস। তাঁর দু পাশে তিন সারিতে তিরিশটি করে কাঠের চেয়ার অন্যদের জন্য। খ্রিস্টানদের কার্ডিনাল বলে কথা, তাঁকে তো সিংহাসন দিতেই হবে।

বক্তাদের মধ্যে ভারতীয় আছেন বেশ কয়েকজন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি ধর্মপাল, জৈন ধর্মের বীরচাঁদ গান্ধী, থিওসফিস্ট জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও অ্যানি বেশান্ট, ব্রাহ্ম সমাজের বি বি নাগরকর ও প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। প্রতাপচন্দ্র মজুমদার দশ বছর আগে একবার আমেরিকা ঘুরে গেছেন, তিনি সুবক্তা ও সুপুরুষ। কেশব-শিষ্য প্রতাপচন্দ্র একেশ্বর ব্রাহ্ম ধর্মের সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্মকে মেশাতে পারেন চমৎকারভাবে, তাই তিনি এ দেশে আগে থেকেই কিছুটা জনপ্রিয়।

এখানে ঢোকার সময়েই প্রতাপচন্দ্র দেখলেন, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আসছে বিচিত্র পোশাক পরা এক ক্তি। অন্য সকলেই মা, বা খয়েরি ধরনের চাপা রঙের পোশাক পরে এসেছেন, আর এই লোকটার গায়ে একটা ক্যাটকেটে কমলা রঙের হাঁটু পর্যন্ত ঢোলা আলখালা, কোমরে কোমরবন্ধ, মাথায় ওই রঙেরই এক বিরাট পাগড়ি। প্রতাপচন্দ্র ভুরু কুঁচকিয়ে ভাবতে লাগলেন, এ মূর্তিমানটি আবার কে? কোন দেশের। মুখখানা কচি, বয়েস বেশি নয়, সকলের মধ্যে বয়ঃকনিষ্ঠ, এ আবার কোন ধর্মের লোক।

অন্য ভারতীয়রাও এই অচেনা ব্যক্তিটিকে লক্ষ করেছেন। ধর্মপাল ফিসফিস করে প্রতাপচন্দ্রকে বললেন, হিন্দু, হিন্দু। শেষ মুহূর্তে নাকি একজন হিন্দু এসে ঢুকেছে।

কৌতূহলে প্রতাপচন্দ্রর ভুরু কুঁচকে গেল। হিন্দু? দেশে থাকতে তিনি কোনও হিন্দু প্রতিনিধির কথা ঘুণাক্ষরেও শোনেননি। হিন্দুদের পক্ষ নিয়ে কেউ যাবে না, এ রকমই বরং শুনে এসেছেন। এ লোকটা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল? এর গায়ের আলখাল্লাটা ঠিক গেরুয়া নয়, হিন্দু সন্ন্যাসী কখনও সিল্কের চকচকে কমলা রঙের পোশাক পরে? সাধুরা আবার এত বড় পাগড়ি পরতে শুরু করল কবে থেকে? পাগড়িটা দেখলে মনে হয় কোনও রাজসভার দেওয়ান।

প্রতাপচন্দ্র নিচু গলায় ধর্মপালকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথাকার হিন্দু, নেপালের নাকি? ধর্মপাল বললেন, না, না, শুনেছি তো মাদ্রাজ, নাকি কলকাতার! কলকাতার? সেখানে এমন কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতা থাকতে পারে, যাকে প্রতাপচন্দ্র চেনেন না? হতেই পারে না। এ কোনও জালিয়াত নাকি?

পাগড়িধারী যুবকটির সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতেই সে ফিক করে হাসল।

প্রতাপচন্দ্র মনের মধ্যে হাতড়াতে লাগলেন। না, একে আগে কখনও দেখেছেন বলে তো মনে পড়ে না। অথচ এ ছোকরাটি তাঁকে চেনার ভান করে হাসছে। পুরো ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে, ধর্ম সম্মেলন জালিয়াতির জায়গা নয়, এ যদি সে রকম কিছু হয় তা হলে সেটা ফাঁস করে দেওয়া তাঁর অবশ্যকর্তব্য। বলে কি না কলকাতা থেকে এসেছে? ও বোধ হয় জানে না, কলকাতা তথা বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি তিনি, তাঁকে এখানকার অনেকেই আগে থেকে চেনে, তিনি কর্মসমিতির অন্যতম সদস্য, তিনি কিছু টের পেলেন না, আর কলকাতা থেকে একজন হিন্দু প্রতিনিধি হঠাৎ এখানে এসে উদয় হল?

আমন্ত্রিত অতিথিরা কয়েক দিন আগে থেকেই উপস্থিত হলেও তাঁদের খাওয়া থাকার ব্যবস্থা এক জায়গায় হয়নি। কোনও হোটেলেও নয়। উদ্যোক্তাদের মধ্যেই এক একজন নিজের নিজের বাড়িতে এক একজনকে রেখেছেন। তাই পরব মেলামেশার সুযোগ হয়নি। প্রতাপচন্দ্রও পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করায় ব্যস্ত ছিলেন।

মস্ত বড় হলঘরটিতে শ্রোতার সংখ্যা প্রায় ছয়-সাত হাজার। অন্য সব বক্তাদের মাটমেটে পোশাক, কিন্তু ওই তরুণটির গাঢ় রঙের সিল্কের পোশাক যেন ঝলমল করছে তার মধ্যে। সকলের দৃষ্টি তার দিকে। বিচিত্র পোশাক ছাড়াও তার তারুণ্যমণ্ডিত মুখমণ্ডল, টানা টানা দুটি চক্ষু খুব উজ্জ্বল, যেন ঠিকরে পড়ছে তেজ। সে সোজা হয়ে বসে আছে।

বাইরে থেকে তাকে যতই তেজস্বী দেখাক, ভেতরে ভেতরে কিন্তু ওই তরুণটি এখন খুব দুর্বল। ভয়ে সে কাঁপছে প্রায়, বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ শব্দ হচ্ছে। এই বিপুল জনসমষ্টির সামনে তাকে বক্তৃতা দিতে হবে! এর আগে দু-চারটে ছোটখাটো আসরে সে কিছু বললেও বড় কোনও জনসভায় বক্তৃতা দেবার অভিজ্ঞতা তার একেবারেই নেই। অন্যান্য বক্তারা তাঁদের বক্তব্য আগে থেকে গুছিয়ে লিখে এনে সেটা পাঠ করছেন, তাতে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা, অনেক মহাপুরুষ ও বিখ্যাত গ্রন্থের উদ্ধৃতি। সে যে একেবারেই তৈরি হয়ে আসেনি। কেন কিছু লিখে আনেনি, এই ভেবে আফশোসে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে তার। সবাই গভীর মনোেযোগ দিয়ে শুনছে, এখানে ফাঁকিবাজি চলবে না।

দর্শকরা যে এই কমলা রঙের পোশাক পরিহিত অতিথিটির মুখের কথা শোনার জন্য আগ্রহে অধীর হয়ে আছে, তা উদ্যোক্তারা টের পেয়ে গেছেন। অন্য সকলে একরকম, আর এ ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ আলাদা, সুতরাং কৌতূহল তো হবেই। পরিচালকদের একজন এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করছেন, এর পরের বার আপনি বলবেন তো? যুবকটি অমনি দুটফটিয়ে উঠে বলছে, না, না, আর একটু পরে। আর একটু পরে।

এ রকম দু-তিনবার হল। দুর থেকে সব লক্ষ করছেন প্রতাপচন্দ্র। মুখ খুললেই ছোকরাটির বিদ্যেবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যেত, কিন্তু ও বারবার এড়িয়ে যাচ্ছে, তাতেই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।

অনুষ্ঠান পরিচালক ডক্তর ব্যারোজ প্রতাপচন্দ্রের বন্ধুস্থানীয়। একবার তিনি প্রতাপচন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন, মজুমদার, এর পরে আপনার পালা। আপনি তো খুব সুবক্তা, আপনি ফাটাবেন জানি।

প্রতাপচন্দ্র নিজের কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ওই যে পাগড়ি পরা যুবকটিকে দেখছি, উনি কে?

ডক্তর ব্যারোজ বললেন, উনি ভো আপনারই দেশের লোক। আপনি ওঁকে চেনেন না?

দু দিকে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে প্রতাপচন্দ্র বললেন, না, আমি ওঁকে আগে কখনও দেখিনি। কী নাম?

ডক্তর ব্যারোজ বললেন, কী নাম, কী নাম, দাঁড়ান দেখছি, এই যে, বেশ শক্ত উচ্চারণ করা, সোয়া… সোওযামী ভিড় কান!

প্রতাপচন্দ্র ভুরু উত্তোলন করে বইলেন। সোওয়ামী না হয় বোঝা গেল যে স্বামী। কিন্তু ভিভ কান? এ রকম নাম তিনি সাত জন্মে শোনেননি। বাঙালির আবার এ রকম উদ্ভট নাম হয় নাকি?

ধর্মপালের কাজকর্ম কলকাতা কেন্দ্রিক হলেও তিনি কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত নন। আর জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বাঙালি বটে কিন্তু এলাহাবাদের অধিবাসী। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসেছেন মঞ্চের অন্য দিকে, কাছাকাছি থাকালে তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা যেত।

প্রতাপচন্দ্রের নাম ঘোষিত হতেই তিনি উঠে চলে গেলেন বক্তাদের জন্য নির্দিষ্ট রোস্ট্রামের দিকে। পরিশীলিত উচ্চারণে, বহু অপ্রচলিত ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করে তিনি যে চোস্ত বক্তৃতাটি দিলেন, তাতে বাইবেল ও উপনিষদের অপূর্ব সমাহার ঘটেছে। লিখিত অংশ পাঠ করা ছাড়াও মাঝে মাঝে তিনি মুখ তুলে বাইবেলের অংশবিশেষ মুখস্থ বলতে লাগলেন অনলভাবে। প্রচুর হাততালিতে শ্রোতারা তাঁকে অভিনন্দন জানাল।

হাততালি অবশ্য কোনও বক্তাই কম পাচ্ছেন না। এ দেশে একটা হাততালির ভদ্রতা আছে। বক্তৃতা চলাকালীন যারা ঘুমোয়, বক্তৃতা শেষ হলে হঠাৎ জেগে উঠে তারাও চটাপট শব্দে হাততালি দিতে শুরু করে। একটু আগে চিনের প্রতিনিধি বলে গেলেন, তাঁর ইংরিজি উচ্চারণ কিছুই প্রায় বোঝা গেল না, তিনিও হাততালি পেয়েছেন যথেষ্ট।

পাগড়ি পরা যুবকটি বারবার এড়িয়ে গেল, সকালের অধিবেশনে সে বক্তৃতা দিলই না। এর পর মধ্যাহ্নভোজের বিবতি। দু ঘণ্টা পরে আবার শুরু হবে দ্বিতীয় অধিবেশন।

খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে আর একটি বিশাল হলঘরে। লম্বা লম্বা টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো বহু বকম খাদ্যদ্রব্য, নিরামিষেরও পৃথক ব্যবস্থা আছে। বক্তাবা ছাড়াও অন্য নিমন্ত্রিতদের সংখ্যাও চার-পাঁচশো’র কম নয়, বসবার জায়গা দূরে থাক, দাঁড়াবার জায়গা পাওয়াই দুষ্কর। হাতে প্লেট ধবে খাবার তুলে নিতে হচ্ছে লাইন দিয়ে।

প্রতাপচন্দ্র সেই ভিড়ের মধ্যে জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, প্রতাপদা, ভাল আছেন?

আমূল চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেলেন সেই পাগড়ি পরা যুবকটিকে। তার সারা মুখে হাসি ছড়ানো। বাংলায় কথা বলছে, সত্যি সত্যি বাঙালি? পাগড়ি পরা বাঙালি সন্ন্যাসী?

প্রতাপচন্দ্র আমতা আমতা করে বললেন, আপনি… মানে তুমি কে? ঠিক চিনতে পারলুম না তো!

যুবকটি সুকৌতুকে বল, এরকম জবরজং ধড়াচড়ো পাবে আছি তাই ধরতে পারছেন না। আপনি আমাকে চেনেন, আগে অনেকবার দেখেছেন।

প্রতাপচন্দ্র বললেন, আগে দেখেছি? তোমার নাম কী?

যুবকটি বলল, আমি এখন সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসীর তো পূবাশ্রমের নাম উচ্চারণ করতে নেই। আপনার ঠিক মনে পড়বে, আমি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য। আপনাদের নববিধানেও এক সময়ে আমি অনেকবার গেছি!

প্রতাপচন্দ্র বললেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস, তাঁকে তো আমি বিলক্ষণ চিনতাম। আমাদের কেশববাবুই তাঁকে কলকাতার গণমান্য সমাজে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস কি কারুক সন্ন্যাসে দীক্ষা দিতেন? শুনিনি তো! তিনি বড় কষ্ট পেয়ে দেহত্যাগ করলেন, তারপর তার কথা আর বিশেষ শোনা-টোনা যায় না, কোনও খবরও সংবাদপত্রে চোখে পড়েনি।

যুবকটি বলল, আমরা গুটিকয় চেলা এখনও ঠাকুরকে অবলম্বন করে আছি। তিনিই আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছেন।

প্রতাপচন্দ্র বললেন, তুমি যে এখানে এলে, কাদের পক্ষ থেকে এলে? কোন সম্প্রদায় তোমাকে পাঠাল?

যুবকটি বলল, ঠিক কোনও সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে আসিনি। এমনকী দেশে থাকতে কোনও আমন্ত্রণও পাইনি। তবু কী করে যেন পাকেচক্রে আসা হল, এমনকী মঞ্চে আপনাদের পাশে বসার সৌভাগ্যও জুটে গেল।

প্রতাপচন্দ্র বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, মনে পড়েছে। তুমি তো নরেন? সিমলের দত্ত বাড়ির ছেলে? গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট ছিলে, খুব ভাল গান গাইতে, তাই না?

নরেন মাথা নিচু করে বলল, চিনতে পেরেছেন তা হলে?

প্রতাপচন্দ্রের মনোভাব সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল। এই যুবকটি সম্পর্কে এতক্ষণ যে বিরূপ ধারণা গড়ে উঠেছিল, তা অপসূত হয়ে গেল এক নিমেষে। এই যুবকটি তো কলকাতার তাঁদের নিজস্ব বৃত্তেরই একজন, রামকৃষ্ণ পরমহংসের চেলাদের সঙ্গে তাঁদের কোনও দ্বন্দ্ব নেই। এত দূরদেশে একজন পরিচিত মানুষকে দেখলে আপনাআপনি একটা আত্মীয়তার বন্ধন তৈরি হয়ে যায়।

তিনি বললেন, তোমার পিতৃবিয়োগের পর তুমি খুব অসুবিধেয় পড়েছিলে, এই পর্যন্ত জানি, তারপর আর কিছু শুনিনি। তুমি কবেই বা সন্ন্যাসী হলে আর কী করেই বা এখানে এলে! তোমাকে দেখে বড় খুশি হলুম গো নরেন!

নরেন বিনীতভাবে বলল, ইচ্ছে আছে হিন্দু ধর্মের হয়ে দু’চার কথা বলব এখানে। কিন্তু প্রতাপদা, আপনারা কী চমৎকার ভাষণ দিলেন। ভাষার কী অপুর্ব বাঁধুনি। আমি কি পারব? কখনও এত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলিনি।

প্রতাপচন্দ্র তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, পারবে না কেন, নিশ্চয়ই পারবে! ঘাবড়াবার কী আছে? গুরুর নাম স্মরণ করে বসে যাবে!

এই সময় জ্ঞানেন্দ্রনাথ কাছে এসে দাঁড়ালেন। প্রতাপচন্দ্র তাঁর সঙ্গে নরেনের আলাপ করিয়ে দেবার জন্য সোৎসাহে বললেন, জ্ঞানবাবু, এই ছেলেটিকে চেনেন? এ আমাদের কলকাতা থেকে এসেছে।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ বললেন, হ্যাঁ, কয়েক দিন ধরে এঁর কথা শুনছি। এঁর নামই তো বিবেকানন্দ, তাই না?

প্রতাপচন্দ্র বললেন, বিবেকানন্দ, তাই বল। তখন ডক্তর ব্যারোজ কী একটা বিদঘুটে উচ্চারণ করল, বুঝতেই পারিনি। বাঃ বেশ নাম। বঙ্কিমবাবুর আনন্দমঠে সত্যানন্দ, জীবানন্দ, ধীরানন্দ, এই সব আনন্দের দল ছিল, তুমিও সেই রকম এক আনন্দ। তা নরেন, তুমি কী করে আমেরিকায় এসে পৌঁছলে, টাকাপয়সা কে দিল, আমন্ত্রণপত্রই বা কীভাবে জোগাড় করলে, এসব জানতে খুব কৌতূহল হচ্ছে।

নরেন বলল, সে এক লম্বা গল্প। শুনলে আপনারা হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবেন না। প্রতাপদা, এখন তো বেশি সময় নেই। পরে একদিন আপনাদের সব বলব।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়