ত্রিপুরা সরকারের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন শশিভূষণ, কিন্তু তাঁর যে সঙ্কল্প ছিল ইংরেজের রাজত্বে বসবাস করবেন না তাও বজায় রেখেছেন, তিনি থাকেন চন্দননগরে। ফরাসিরা ইংরেজদের চেয়ে উন্নততর শাসক নয়, কিন্তু ইংরেজদের সম্পর্কে শশিভূষণের জাতক্রোধ জমে আছে। ফরাসিরা স্থানীয় মানুষজনদের সঙ্গে প্রায় মেশেই না, ভারত সম্পর্কে তাদের আগ্রহ চলে যাচ্ছে, এখন তারা আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপনে বেশি মন দিয়েছে। কঙ্গোতে তারা সম্প্রতি এত বড় একটা ফললানি পেয়ে গেছে, যার আয়তন ফ্রান্সের চেয়েও বড়।

বাড়িটি দোতলা, ঠিক নদীর ধারে না হলেও ওপরের বারান্দা থেকে নদী দেখা যায়। গঙ্গা আর বাড়ির মাঝখানে রয়েছে এক প্রাচীন দুর্গের ভগ্নপ। শাসকদের ঔদাসীন্যে এ রকম ভন্ন প্রাসাদ আরও দেখা যায়। মোরান সাহেবের বিখ্যাত বাগানবাড়িটিতে অনেকদিন ভাড়াটে জোটেনি, এখন পরিত্যক্ত, তাতে আগাছা গজিয়ে গেছে। সুন্দর বাগানটির অস্তিত্বই আর নেই, তবে কিছু কিছু গাছপালার আড়ালে দেখা যায় একটি দোলনা, সেটি রয়ে গেছে কোনওক্রমে, কেউ সেটা ব্যবহার করে না। মাঝে মাঝে হাওয়ায় আপনা আপনি একটু একটু দোলে।

প্রতিদিন সকালে শশিভূষণ নিজেই একটি নৌকা চালিয়ে চলে যান ওপারে। নৈটিতে তাঁর উদ্যোগেই একটি মুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে তিনি পড়াতে যান। শিক্ষকতার নেশা তাঁর যায়নি। যদিও এই শিক্ষকতা তাঁর জীবিকা নয়। তিনি বেতন নেন মাত্র এক টাকা। কলকাতায় পারিবারিক সম্পত্তির নিজস্ব অংশ বিক্রি করে ভাইদের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছেন শশিভূষণ। লক্ষাধিক টাকায় এক পাট কোম্পানির অংশীদার হয়েছেন, সেখান থেকে মাসে মাসে যে টাকা পান, তাতে তাঁর স্বচ্ছন্দে চলে যায়।’

পূর্বে কখনও জলের ধারে বাস করেননি বলে শশিভূষণ নৌকো চালাতে জানতেন না। এমনকী সাঁতারেও পারদর্শী ছিলেন না। প্রথম প্রথম এখানে এসে নদী পারাপার করতেন ফেরি নৌকোয়। তখন বিকেলে ফেরার সময় দেখতেন, ওপারের ঘাটে একটি নৌকায় বসে থাকত একা একটি তরুণী, তার হাতে বৈঠা। বহু লোকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকাত তরুণীটির দিকে, কিন্তু সে নির্বিকার। এক সময় হাতে একটি গ্যাডস্টোন ব্যাগ নিয়ে উপস্থিত হত একটি যুবক। নৌকোয় চেপে সে দাঁড়ে বসত। তারপর দুজনে জল ছপছপিয়ে চলে যেত চন্দননগরে।

মাঝিদের সাহায্য না নিয়ে ভদ্ৰশ্রেণীর এক নারী-পুরুষ যুগলকে প্রতিদিন নৌকো বাইতে দেখলে তো কৌতূহল হবেই। শশিভূষণ নিজে থেকেই যুবকটির সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। তার নাম জগদীশচন্দ্র বসু, প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্স পড়ায়, নৈহাটি দিয়ে ট্রেনে কলকাতায় যাতায়াত করতে তার সুবিধে হয়। তার স্ত্রীর নাম অবলা হলেও সে অতি সপ্রতিভ মহিলা এবং বেশ সরলা, তরণী-চালনায় সেই বেশি পারদর্শিনী, চন্দননগর থেকে সে একা আসে। জগদীশের অনুরোধে শশিভূষণ মাঝে মাঝে ওদের নৌকোতেই ফিরতেন। জগদীশের সঙ্গে থাকত একটি বক্স ক্যামেরা, ফটোগ্রাফি বিষয়ে দুজনের আলোচনা জমে উঠত।

অবলাই একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি রোয়িং করতে জানেন না?

শশিভূষণ লজ্জা পেয়েছিলেন। রোয়িং একটা সাহেবি ক্রীড়া, লর্ড পরিবারের ছেলেরাও অংশগ্রহণ করে, শশিভূষণ অনেক ছবি দেখেছেন, কিন্তু দিশি নৌকো বাওয়া যেন পেশাদার মাঝিদেরই কাজ। আসলে তো ব্যাপারটা একই। শশিভূষণের হাতে অবলা একটা বৈঠা দিয়ে বলেছিলেন, চেষ্টা করুন না। কয়েকদিনের মধ্যেই সড়গড় হয়ে যাবে।

কোনও নারীর কাছ থেকে পুরুষ একটা কিছু শিখছে, তাও নৌকা চালাবার মতন অত কাজ, কিছুদিন আগেও এ একেবারে অকল্পনীয়, অভূতপূর্ব ব্যাপার ছিল। এটাও একটা প্রমাণ যে যুগ বদলাচ্ছে।

সেই বসু-দম্পতির সঙ্গে শশিভূষণের বন্ধুত্ব হয়েছিল, কারণ তাদের তাঁর সঙ্গে চিন্তার সাযুজ্য ছিল। এখন তারা চন্দননগর ছেড়ে চলে গেছে, শশিভূষণের আর বিশেষ বন্ধু নেই এখানে। বেশি লোকের সঙ্গে তিনি মন খুলে মিশতে পারেন না। পরিচিতের সংখ্যা বেশি হলে পড়াশুনোর ক্ষতি হয়। বই নিয়ে সময় কাটাতেই শশিভূষণ বেশি আনন্দ পান। প্রতিদিন কয়েকঘণ্টা স্কুলে পড়িয়ে আসেন, বাকি সময় থাকেন বাড়িতেই, কলকাতার সঙ্গে তাঁর প্রায় যোগাযোগ নেই ই বলতে গেলে। মাসে একবার শুধু তাঁর কোম্পানির বোর্ড মিটিং-এ যোগ দিতে কলকাতায় যেতে হয়। তাঁর স্ত্রী মাঝে মাঝে পিত্রালয়ে যান, সেখানকার লোকই নিয়ে যায়, পৌঁছে দেয়।

সেইজন্যই এক ছুটির দিনের অপরাহ্বে ভৃত্যের মুখে যখন শুনলেন যে বেশ বড় জুড়িগাড়ি করে একজন দর্শনার্থী এসেছে তাঁর কাছে, তিনি বেশ অবাক হলেন। এখানে কে আসবে তাঁর কাছে। শশিভূষণ সদ্য দিবানিদ্রা দিয়ে উঠেছেন, এ রকম তার স্বভাব নয়, কিন্তু আজ দুপুরে বেশ গুরুভোজন হয়ে গেছে। একটি জেলে বঙ-একটি ইলিশ মাছ গছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে গঙ্গায় এত ইলিশ ওঠে যে ক্রেতা পাওয়া যায় না। আগে শশিভূষণের ইলিশ মাছে বিশেষ রুচি ছিল না। এত তৈলাক্ত মাছ তাঁর পছন্দ নয়। কিন্তু গঙ্গার ধারে বাস করে ইলিশ মাছ না খেলে কি চলে?

গায়ে বেনিয়ান চাপিয়ে, চটি ফটফটিয়ে দোতলা থেকে নেমে এসে বসবার ঘরে আগন্তুককে দেখে শশিভূষণ আরও অবাক হলেন। ফিনফিনে কাঁচি ধুতি পরা, গায়ে মুগার চাদর জড়ানো, পায়ের ওপর পা তুলে একটা সোফায় বসে আছেন ত্রিপুরার মহারাজার সচিব রাধারমণ ঘোষ। মাথার চুলে পাউডারের ছোপ লেগেছে, চোখে এখন সোনালি ফ্রেমের চশমা, এ ছাড়া তাঁর আর কোনও পরিবর্তন হয়নি।

শশিভূষণকে দেখে দু হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, নমস্কার, নমস্কার, ৩ অপরাহ্ন, সিংহমশাই। আমার এ রকম বিনা নোটিসে আগমনে দোষ নেবেন না। বৌদ্ধ শাস্ত্রমতে বিদ্বান, জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য যারা হিতোপদেশ দেয় আর যারা ভ্রামমাণ পথিক, এই তিনজনকে অতিথি বলে। বিদ্বান আমি মোটেই নই, তেমন কিছু ভ্রমণও করি না, তবে হিতোপদেশ দিতে আমার কার্পণ্য নেই, সেই হিসাবে আমাকে অতিথি বলা যায় নিশ্চয়ই? তোমার শাস্তির ব্যাঘাত ঘটালাম নাকি?

শশিভূষণ ঈষৎ আড়ষ্ট গলায় বললেন, না, আপনি দয়া করে আমাকে স্মরণ করেছেন, এতেই আমি ধন্য হয়েছি। কিন্তু আপনি কি আমাকে হিতোপদেশ দিতে এসেছেন নাকি?

রাধারমণ বললেন, দিলেই যে তুমি শুনবে, তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? ভান্স ভাল উপদেশের এই এক সুবিধে, কেউ গ্রহণ করুক বা না করুক, যত্রতত্র বিলিয়ে দেওয়া যায়, পয়সা তো খরচ হয় না! তা তোমার কী সংবাদ বলো। শুনলাম, কলকাতা ছেড়ে তুমি এই ফরাসডাঙায় নির্বাসনে আছ?

শশিভূষণ বললেন, চন্দননগর একটি জনবহুল শহর, এখানে কি কেউ নির্বাসনে থাকতে পারে?

রাধারমণ বললেন, নির্বাসন কাকে বলে? নির পূর্বক বস প্লাস ণিচ্ প্লাস অনট ভাব। অর্থাৎ কোনও অপরাধের জন্য কারুকে দেশান্তরিত করা হয়েছে, তারপর সে কোনও নগরেও থাকতে পারে, জঙ্গলেও থাকতে পারে।

শশিভূষণ শ্লেষের সঙ্গে বললেন, ঘোষমশাই, আপনি দেখছি এক চলন্ত অভিধান! কোনও অপরাধের জন্যই আমাকে কেউ বহিষ্কার করেনি। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি!

রাধারমণ এ বার সজোরে হেসে উঠে বললেন, আরে চটছ কেন, চটছ কেন? তুমি বলেছিলে তুমি ইংরেজ রাজত্বে থাকে না, তাই ত্রিপুরা গিয়েছিলে, তা কি আমার মনে নেই? তবে নির্বাসন অনেক সময় স্বেচ্ছা নির্বাসন হতে পারে। কেউ অভিযুক্ত করেনি, নিজের মনে একটা অপরাধ বোধ থেকেও কেউ দেশ ছেড়ে চলে যায়।

শশিভূষণ বললেন, আমার মনে কোনও অপরাধবোধও নেই। কী অপরাধ করেছি আমি?

রাধারমণ বললেন, তুমি দুম করে মহারাজের চাকরি ছেড়ে দিলে, মহারাজকে একবার মুখের কথাটাও জানালে না, সার্কুলার রোডের বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে গেলে, এটাকে কি ছোটখাটো অপরাধ বলা যায় না?

শশিভূষণ বললেন, কীসের অপরাধ? আমার চাকরির কোনও শর্ত ছিল না। মহারাজ ইচ্ছে করলে, তাঁর মেজাজ খারাপ হলে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও কর্মচারীকে তাড়িয়ে দিতে পারেন। সেইরকম আমরাও যে কোনও মুহূর্তে ছেড়ে চলে আসতে পারি। তাঁর সঙ্গে দেখা করিনি বটে, চিঠি লিখে জানিয়ে এসেছি। রাজবাড়ির কোনও জিনিস আমি সঙ্গে আনিনি, বরং উল্টে বলা যায়, আমি এক মাসের বেতনও নিইনি।

রাধারমণ বললেন, সেটাও একটা অপরাধ। কেন মাইনেটা নাওনি? মহারাজকে তুমি ঋণী রাখতে চাও? তোমার টাকাটা কোথায় পাঠানো হবে, তাও আমরা বুঝতে পারিনি। যাক গে, যাক সে কথা! মহারাজ এখনও তোমার কথা মনে রেখেছেন। প্রায়ই তোমার কথা বলেন। তিনি তোমাকে প্রকৃতই স্নেহ করতেন। আচ্ছা শশী, তুমি হঠাৎ অমন ভাবে চাকরি ছেড়ে পালালে কেন বলো তো।

শশিভূষণ বললেন, আপনি জানেন না? এক সময় মহারাজের সঙ্গে কোনও ব্যাপারে আমার মনে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব এসেছিল। তিনি ছিলেন আমার প্রতিপক্ষ। এই রকম অবস্থায় আনুগত্য থাকে না। তখন চাকরি করে যাওয়াটাই অন্যায়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, অর্থের প্রয়োজনে আমি চাকরি করতে যাইনি।

রাধারমণ বললেন, তুমি অতি আহাম্মক। ব্রিপুরায় অতদিন ছিলে। রাজা-রাজড়াদের স্বভাব বোঝনি? সেই চুড়িটাকে তুমি সার্কুলার রোডের বাড়িতে এনে রেখেছিলে কোন বুদ্ধিতে? যদি রূপের একটু চমক থাকে, তার ওপর যদি গান গাইতে পারে, মহারাজের নজরে সে পড়লে তাকে মহারাজ ছাড়বেন কেন? তোমার যদি মেয়েটার ওপর আসক্তি জন্মে থাকত, তাকে অন্য কোথাও রাখতে পারতে না? তা হলেই ল্যাঠা চুকে যেত।

শশিভূষণ একটা প্রগাঢ় নিশ্বাস ফেলে বললেন, সে অনেক জটিল ব্যাপার। প্রথমে কিছু বোঝা যায়নি।

রাধারমণ বললেন, মহারাজ কিন্তু আজও তাকে ভুলতে পারেননি! এখনও হঠাৎ হঠাৎ সেই গান জানা মেয়েটির প্রসঙ্গ ওঠে, আর তখন মহারাজের চোখে ক্রোধের বিদ্যুৎ খেলে যায়।

শশিভূষণ বললেন, এতদিন পরেও? মহারাজের জীবনে কি নারীর অভাব আছে?

রাধারমণ বললেন, বাঘ যখন কোনও শিকার ধরে, তাকে তো হজম করে ফেলে, তারপর আর তার কথা মনে রাখে না। কিন্তু যে শিকার হাতছাড়া হয়ে যায়, থাবা উদ্যত করলেও সরে পড়ে, সে বাঘের অহমিকায় দারুণ আঘাত দিয়ে যায়। বাঘ তাকে ভুলতে পারে না। মনে মনে হলেও তাকে সারাজীবন তাড়া করে ফেরে। সে মেয়েটা এখন কোথায়?

শশিভূষণ হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠে বললেন, কেন? আপনি দেখতে এসেছেন তাকে আমার এখানে লুকিয়ে রেখেছি কি না? সেই মতলবেই আপনার আগমন?

রাধারমণ হাত তুলে বললেন, আহা-হা-হা, তা নয়, তা নয়। তুমি এখনও ওই ব্যাপারে খুব সেনসিটিভ হয়ে আছ দেখছি! সে মেয়েটা যে তোমার বাড়িতে নেই, তা আমি ভাল করেই জানি! এমনিই অলস কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম, সে কোথায়!

শশিভূষণ বললেন, আমি জানি না। আর জানতেও চাই না! হয় সে কোনও ক্লেদাক্ত মরকে তলিয়ে গেছে, অথবা অপঘাতে মরেছে।

বাধাবমণ বললেন, হবিণে নিজের গায়ের মাংস আর মেয়েদের রূপ-গুণ, এই-ই তাদের শত্রু! একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন দু’জনে।

পাশের বাবান্দা দিয়ে একজন দাসী একটি ফুটফুটে শিশুর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাইরের উদ্যানে খেলা করার জন্য অধীরতায় লাফাচ্ছে শিশুটি।

সেদিকে চেয়ে বাধারমণ জিজ্ঞেস করলেন, এই বুঝি তোমার বড় ছেলে?

শশিভূষণের আবার ভুরু উঁচুতে উঠে গেল। সবিস্ময়ে বললেন, আপনি জানলেন কী করে যে আমার একাধিক সন্তান? ঘোষমশাই, আপনি কি দৈবজ্ঞ?

রাধারমণ গোঁফের ফাঁকে হেসে বললেন, জানি, জানি, সব জানি। দৈবজ্ঞ বৈ কিছু না। ভোমার পেছনে আগাগোড়া চর লাগানো ছিল, তুমি জানতে না? তোমার বিবাহ হয় ইংরাজি সাতাশি সালে, ছাতুবাবুদের বাড়ির এক কনার সঙ্গে। বিবাহ বাসর বসেছিল শোভাবাজারে। সেখানে নিমন্ত্রিতদের ভিড়ের মধ্যে মিশেছিল আমাদের দুটি চর। তুমি সেই ভূমিতা নামের ঘুড়িটাকেই বিয়ে করছ কিনা, মহারাজ তা জানতে চেয়েছিলেন। তোমরা বনেদি কায়েত, বিয়ের পরেও একটি রক্ষিতা পোষণ কবা তোমাদের প্রথার মধ্যেই পড়ে বলতে গেলে। সেইজন্য পরেও কিছুদিন নজর রাখা হয়েছিল তোমাদের গতিবিিধর ওপর। বিবাহের পরের বছরই তোমার একটি পুত্র সন্তান জন্মায়, আর একটি মেয়ে হয়েছে বছর দেড়েক আগে, ঠিক কিনা?

শশিভূষণ উত্তেজিতভাবে বললেন, তার মানে কি এখনও আমি নজরবন্দি? এ অন্যায়, ঘোর অন্যায়! আমি পুলিশে খবর দেব!

রাধারমণ বললেন, নাঃ এখন আর কেউ নেই। গতবছর থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। শশী, এত বছর তো মহারাজের সঙ্গে রইলাম, মানুষটা কিন্তু অন্যরকম। বাঘের সঙ্গে ওঁর তুলনা দিয়েছি বটে, কিন্তু ওঁর মধ্যে দয়া-মায়া-করুণাও যথেষ্টই আছে। ওই মেয়েটি মহারাজের অঙ্কশায়িনী হতে চায়নি, ভয় পেয়েছিল, তো ঠিক আছে, সে যদি মহারাজের সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইত, মহারাজ নিশ্চয়ই তাকে নিষ্কৃতি দিতেন। এ আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। তা হলে আর কোনও ঝামেলাই হত না, মেয়েটাও বেঁচে যেত।

শশিভুষণ বললেন, ওসব কথা আর এখন বলে কী হবে? আমি আর ওসব এখানে ভাবতে চাই না।

রাধারমণ বললেন, তবে এবার উঠি। তোমার বাড়িতে বুঝি চায়ের পাট নেই? অতিথি সৎকারের কোনও ব্যবস্থাও রাখনি বোঝা যাচ্ছে।

শশিভূষণ লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে বললেন, আরে ছি ছি ছি ছি। আপনাকে দেখে আমি এমন অবাক হয়েছিলাম যে চা-জলখাবারের কথা মনেই পড়েনি। আরে বসুন, বসুন। চা-তো খাবেনই, আমিও বিকেলের চা খাইনি। আর আপনার যদি ফেরার তাড়া না-থাকে, তা হলে রাতটা অনুগ্রহ করে এই গরিবের বাড়িতে থেকেও যেতে পারেন।

উঠোনে গিয়ে চায়ের কথা হাঁক দিয়ে জানিয়ে এসে আবার ফিরে এসে বললেন, ঘোষ মশাই, একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে খচখচ করছে। বলি? আপনার মতন মানী লোক এতদূর উজিয়ে এসে আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিলেন, ঠিক কী জন্য, তা এখনও বুঝলাম না!

রাধারমণ বললেন, উদ্দেশ্য তো কিছু নেই। তোমার সঙ্গে অনেকদিনের পরিচয়, একসময় অনেক সুখ-দুঃখের কথা হত, তাই ভাবলাম, একবার খোঁজ নিয়ে আসি।

শশিভূষণ বললেন, আপনি ব্যস্ত মানুষ, রাজকার্যের কত রকম ভার আপনার মাথার ওপ, শুধু এই জনই এসেছেন, তা ঠিক বিশ্বাস হয় না। সাত বছরের মধ্যে আর কখনও মনে পড়েনি, হঠাৎ এবারেই মনে পড়ল?

রাধারমণ নিজের থুতনিতে হাত বুলোত বুলাতে কয়েক মুহূর্ত স্থির চক্ষে চেয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, শশী, ঈশ্বরের কৃপায় তুমি রক্ষা পেয়েছ। ওই অলক্ষ্মী মেয়েটাকে বিয়ে করলে তুমি হয়তো কোনও সময় খুন হয়ে যেতে! বা সে রকম কিছু না ঘটলেও সারাজীবন তোমার অশান্তি লেগে থাকতই। নৃত্য-গীত পটীয়সী মেয়েরা অন্তঃপুরে মানায় না, সেইজন্যই পুরাকালে তাদের বারবনিতা বানিয়ে দেওয়া হত। সে গেছে, আপদ গেছে। এখন তুমি পাল্টি ঘরে বিয়ে করেছ, দুটি ফুটফুটে সন্তান হয়েছে, এই তো বেশ ভাল। সংসারে মন বসেছে। আমি কলকাতায় এসেছি, কিছু কাজ নিয়ে তো বটেই, তা ছাড়া মহারাষ্ট্র শীঘ্রই কলকাতায় আসবেন, তার একটা প্রস্তুতি দরকার। মহারাজের শরীর ভাল নয়, জানো। প্রায়ই রোণে ভুগছেন। এদিকে রাধাকিশোর আর সমরেন্দ্র এই দুই কুমারের মধ্যে আকছু-আকছি লেগে গেছে, কুমার সমরেন্দ্র সিংহাসনের ওপর তার পুরনো দাবি এখনও ছাড়েনি। মহারাজ কী করে দুদিক সামাল দেবেন জানি না।

শশিভূষণ বললেন, আমি যতটা দেখেছি, ওখানে প্রাসা-যড়যন্ত্র চলতেই থাকবে।

রাধারমণ বললেন, হুঁ। এদিকে তো ইংরেজরা থাবা বাড়িয়ে আছেই। মহারাজ যদি হঠাৎ চোখ বোজেন, সিংহাসন নিয়ে কুমারদের মধ্যে লড়াই লেগে যায়, তা হলে ইংরেজ সেই ছুতোয় ঠিক ত্রিপুরা রাজ্য গ্রাস করে নেবে। মহারাজের রাজকার্যে বিশেষ মন নেই, ফোটোগ্রাফি আর কবিতা লেখা নিয়ে মেতে আছো, এ সময় উপযুক্ত বিশ্বাসী লোকদের বিভিন্ন দিকে হাল ধরা দরকার। সে রকম লোক পাওয়া যায় কোথায়? তাই বলছিলাম কী শশী, তুমি আবার ফিরে এস না কেন। মহারাজের তোমার ওপর কোনও রাগ নেই, ফোটোগ্রাফির প্রসঙ্গ উঠলেই বলেন, ছবি তোলা ভাল বুঝত বটে সেই একটি লোক, শশী মাস্টার। তুমি আসবে।

শশিভূষণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, এই কথা? নাঃ ঘোষ মশাই, কোনও চাকরিতেই আমি আর ফিরে যাব না!

রাধারমণ বললেন, তুমি সচিবের পদ পাবে। তুমি ইচ্ছে করলে ত্রিপুরা বা কলকাতায় যেখানে ইচ্ছে থাকতে পারো…

শশিভূষণ বললেন, প্রশ্নই ওঠে না। যাক ওসব কথা। আমি বেশ আছি। এই নিরিবিলিতেই আমি থাকতে চাই।

রাধারমণ বলেন, বেশ! তুমি ত্রিপুরা রাজ্যের পক্ষে কোনও কাজ করতে চাও না, ত্রিপুরার বিপক্ষেও কিছু করবে না আশা করি?

শশিভূষণ বলেন, সে প্রশ্ন উঠছে কী করে? রাধারমণ বললেন, কৈলাস সিংহের সঙ্গে তোমার দেখা হয়। সে এ বাড়িতেও এসেছে দুবার। কৈলাস আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে।

শশিভূষণ বললেন, তবে যে বললেন, আমার পেছনে এখন আর চর নেই? আমার বাড়িতে কে আসে না-আসে, তা নিয়ে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? এখানকার ব্রাহ্মদের সভায় কৈলাসবাবু এসেছিলেন, আমার সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে বাড়িতে ডাকব না? এটা তো সামাজিক ভদ্রতা! এ কথা জেনে রাখুন, কৈলাসচন্দ্র মোটেই ত্রিপুরার শত্রু নন। তিনি বর্তমান মহারাজকে পছন্দ করেন না। কিন্তু তাঁর মন-প্রাণ পড়ে আছে ত্রিপুরায়।

রাধারমণ এবার কঠিন গলায় বললেন, শশী, তোমার হিতের জন্যই বলছি, কৈলাসের সঙ্গে সংব রেখো না! সে রাজকুমারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধাবার তালে আছে। তা আমরা সহা করব না।

শশিভূষণও তীব্র কণ্ঠে বললেন, এটাই বুঝি আপনার হিতোপদেশ?

রাধারমণ চলে যাবার পর শশিভূষণ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। কৈলাসচন্দ্র সিংহকে নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। রাজকুমারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগুক বা না লাগুক তাতে শশিভূষণের কী আসে। যায়? কিন্তু রাধারমণ ভূমিসূতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন!

শশিভূষণ তো তাকে ভুলেই গিয়েছিলেন। সে হারামজাদি এক বিষকনা, শশিভূষণের জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছিল প্রায়। তাকে তিনি মন থেকে মুছে ফেলেছিলেন। কিন্তু মনের দর্পণের ছায়া কি ইচ্ছে করলেই মোছা যায়? কোন অতল ভীরে রয়ে যায়। না হলে বুকটা এত তোলপাড় কছে কেন?

ভূমিসূতার অন্তর্ধানের পর শশিভূষণের মাথায় প্রবল যন্ত্রণা হতে শুরু করেছিল। তার সেই পুবনো রাগ। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার পর্যন্ত ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত কাহিনী জেনে তিনি বলেছিলেন, শুধু ওষুধে কোনও কাজ হবে না, তুমি অবিলম্বে বিয়ে করো। তোমার এখন শবীর ভবা খিদে, সে খিদে না-মেটালে এ লোগ সারবে না। হাতের কাছে তোমার লোভের জিনিস সন্দেশ যদি না পাও, যদি আম থাকে তা হলে আমই খাও! কিছু একটা ধাও!

ডাক্তার সবাই যোগাযোগ করিয়ে দিলেন, এক মাসের মধ্যে শশিভূষণের বিবাহ হয়ে গেল। মনোরমা ছিলেন বালবিধবা! মহেন্দ্রলাল ও আরও অনেকের মত এই যে কোনও বিপত্নীক দ্বিতীশবার পর পবিগ্রহ করলে কোনও বিধবাকেই গ্রহণ করা উচিত। শশিভূষণের তাতে কোনও আপত্তি ছিল না, কিন্তু বিধবা-বিবাহকে কোনও বীরত্বের ব্যাপার মনে করা কিংবা তাই নিয়ে ঢাক-ঢোল পেটানো তাঁর পছন্দ নয়, বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে বিনা আড়ম্বরে।

দশ বছর বয়েসে বিধবা হয়েছিল মনোরমা, পুনর্বিবাহ হল একুশ বছর বয়েসে। এতদিন সে বাপের বাড়িতে থেকে সব রকম নিয়ম-নিষ্ঠা পালন করে এসেছে ‘ আবার তার বিয়ে হল বটে, কিন্তু। বৈধব্যে খালাস ছেড়ে সে যেন আর বেরিয়ে আসতে পারে না। সে অন্তঃপুরে সুগৃহিণী, স্বামীর নাম সঙ্গিনী সে হতে পাবে না। কাব্যপ্রিয়, রোমান্টিক শশিভূষণ পূর্ণিমা রাতে স্ত্রীকে নিয়ে গঙ্গায় নৌকা-বিহার করতে চান, মনোরমা তাতে রাজি নয়। গান জানে তবু উচ্চকণ্ঠে গান করে না মনোরমা। পড়তে জা, বই পড়ায় উৎসাহ নেই।

ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে শশিভূষণ পরিতৃপ্ত। মেয়েটি খুবই ছোট, এনও কথা বলতে শেখেনি। ছেলের নাম অভিমন্যু, সে এখন সাড়ে পাঁচ বছরের ছটফটে বালক। শশিভূষণ তার এই আজকে মনের মতন করে গড়তে চান। শুধু লেখাপড়া শেখা নয়, তাকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হবে।

কোনও কোনও দিন খুব ভোরে কিংবা বিকালের দিকে শশিভূষণ ছোলর হাত ধরে বেড়াতে বেরোন। নদী, আকাশ, গাছপালা, পশু-পাখি, মানুষ চিনতে শেখান শকে। নিজে খুব যে উপদেশ বা শশ্ন দেন তা নয়, অভিমন্যর কৌতূহল জাগ্রত করে তোলেন, সে নানা রকম প্রশ্ন করে, তিনি উত্তর দেন। মায়ের চেয়ে বাবার সঙ্গেই বেশি ভাব অভিমন্যুর, বেড়াতে বেরুলে সে আর বাড়ি ফিরতে চায় না সহজে।

একদিন অভিমনুকে নিয়ে শশিভূষণ বেড়াতে বেড়াতে হলে এলোরান সাহেবের বাগানবাড়ির দিকে। এই অঞ্চলটি বেশ নির্জন, অনেক পাখি দেখা যায়। শশিভূষণ নিজেও সব পাখি চেনেন না। ছেলের কাছে তা অকপটে স্বীকার করতে লজ্জা নেই। একটা ইষ্টিকুটুম পাখি দেখে অভিমন্য জিজ্ঞেস করল, বাবা ওটা কী পাখি? শশিভূষণ বললেন, নামটা তো জানি না। দু’একবার আগে দেখেছি বটে, দ্যাখ কী সুন্দর পালকের রং, কতখানি লাজ, অবাক-অবাক চোখ, অন্য পাখিরাও বোধহয় এই পাখিটাকে চেনে না—

ঘাটের সিঁড়িগুলো ভাঙা, সেখানে একটা নৌকা বাঁধা। শশিভূষণ ভুরু কুঞ্চিত করে তাকালেন। এক অতি রূপবান যুবা-পুরুষ আগাছা ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে বাগানের দিকে। সাপ-খোপর ভয়ে এখানে সহসা কেউ আসে না। শশিভূষণের অবশ্য সে ভয় নেই, কিন্তু এই অচেনা আগন্তুক কে? সুদীর্ঘ, সুগঠিত শরীর, পায়ে মোজা ও বুট জুতো, প্যান্টান, ওয়েস্ট কোট ও জ্যাকেট পরা, গ্রিক ভাস্কর্যের মতন কাটা কাটা নাক-চোখ-ওষ্ঠাধর, গৌরবর্ণ উজ্জ্বল ললাট, সারা মুখে ভ্রমরকৃষ্ণ সরু দাড়ি, মাথার চুল লুটিয়ে পড়েছে ঘাড় পর্যন্ত। আর একটু কাছে গিয়ে শশিভূষণ চিনতে পারলেন। এ তো কবীন্দ্র রবীন্দ্রবাবু। উঁচড়োর কাছে গঙ্গাবক্ষে এক বজরায় থাকেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর পুত্ৰ-জামাতাগণ প্রায়ই দেখা করতে আসে। শশিভুষণের মনে পড়ল অনেক বছর আগে কবিবর রবীন্দ্রবাবুকে এ বাড়িতেই তিনি প্রথম দেখেছিলেন। সে দিন আর আজ কত তফাৎ!

রবীন্দ্র শশিভুষণের উপস্থিতি টের পায়নি। সে উদাসীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল এদিক-ওদিক। এক-একটা গাছ স্পর্শ করে। একটু থমকে দাঁড়ায়। একটা কদমগাছের তলায় গিয়ে ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর দোলনাটার কাছে গিয়ে দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে রইল নিস্পন্দের মতন। তার চক্ষু দিয়ে জল গড়াচ্ছে।

শশিভূষণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রবীন্দ্রবাবু কোন স্মৃতিভারে আপ্লুত তা তিনি জানেন না। কিন্তু তাঁর নিজেরই যেন এক পলকের জন্য মনে হল, এমনকী দেখতে পেলেন, ওই দোলনায় বসে আছে এক নারী। অবিকল ভূমিসূতার মতন।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়