চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পরই বাংলার তরুণ সমাজের এক অংশ কংগ্রেসের সংস্রব ছেড়ে আবার বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা চিন্তা করে। উনিশশো কুড়ি-একুশ সালের পর থেকে বিপ্লববাদ একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল। গান্ধীজির আগমনের পরই ভারতীয় রাজনীতিতে একটা নতুন রূপ এসেছিল। গান্ধীজি অক্লান্ত ভাবে সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়িয়ে বোঝাচ্ছিলেন অহিংসার শক্তির কথা। দু-চারটে বোমা-পিস্তলের চেয়ে দেশজোড়া গণআন্দোলন যে শাসক শক্তিকে বেশি ভয় পাইয়ে দিতে পারে, এটা তিনি প্রমাণ করেছিলেন। সমস্ত দেশকে তিনি করতে চেয়েছিলেন তার সংগ্রামের সাথী।

গান্ধীজিকে বিপ্লবীরা বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখেছে। এই মানুষটির ব্যক্তিগত সততা সমস্ত সন্দেহের উর্ধ্বে। এমন শান্ত ধরনের সাহসী মানুষ আগে কেউ দেখেনি। অথচ তিনি কী চান, তা সঠিক ভাবে বুঝতে পারেনি যুবসমাজ। তিনি কি চান ইংরেজের কাছ থেকে স্বাধীনতা নামক বস্তুটা ভিক্ষে হিসেবে পেতে? তা কেউ দেয়? ভারতের বিশাল ধনভাণ্ডার ইংরেজ এমনি এমনি ছেড়ে যাবে? সশস্ত্র প্রতিরোধ ছাড়া সিংহ কখনও পশ্চাদপসরণ করে? এর উত্তরে গান্ধীজি একবার বলেছিলেন,

“Had India sword, I would have asked her to draw it. But she had no sword–I ask her to adopt non-violent non-cooperation.”

অস্ত্র যখন নেই, তখন অহিংস সত্যাগ্রহই তো শ্রেষ্ঠ উপায়। বিপ্লবীদের তখন প্রধান সম্বল রডা কোম্পানির কাছ থেকে লুট করা পঞ্চাশটি মাউজার পিস্তল। গান্ধীজি বিপ্লববাদকে চাপা দিতে চেয়েছেন, নিন্দে করেছেন, কলকাতা করপোরেশান নিহত শহীদদের নামে শোক প্রস্তাব নিলে চটে গেছেন–অথচ জেলখানা থেকে বিপ্লবী বন্দিদের মুক্ত করার জন্যও চেষ্টা করেছেন।

উনিশশো কুড়ি-একুশ সালে বিপ্লববাদ একটু গা ঢাকা দেয়। অনবরত জেলে যেতে যেতে বিপ্লবী নেতারা ক্লান্ত। পুলিশের কাছে সবাই পরিচিত, কোথাও একটা অ্যাকশন হলেই সব্বাইকে ধরে জেলে পুরে দেয়। এই সময় চিত্তরঞ্জন সবাইকে আহ্বান জানালেন কংগ্রেসের আশ্রয়ে এসে সংগঠন জোরদার করতে। প্রবীণ বিপ্লবীদের কাছে মনে হল, এ ছাড়া আর উপায়ান্তর নেই তখন। পাঞ্জাব থেকে ভগৎ সিং ত্রৈলোক্য চক্রবর্তীর কাছে কয়েকটা বোমা ও পিস্তল চাইতে এলে তিনি বললেন, এখন মাথা গরম কোরো না। দলের সংগঠন সৎ না করে এখানে সেখানে এক-আধটা খুনজখম করলে পুলিশের অত্যাচারে আবার দল ভেঙে যাবে।

কিন্তু অতি তরুণরা এসব সাবধানী নীতি মানতে চায়নি। তারা ভেতরে ভেতরে ধূমায়িত হচ্ছিল। দেশের জন্য প্রাণ দেবার দুর্দান্ত নেশায় তারা চঞ্চল। ফাঁসিতে মৃত্যুর চেয়ে গর্বের আর কিছু নেই তাদের চোখে। ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসের পর বিপ্লবীরা আবার কংগ্রেস সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বেরিয়ে এল সারা দেশে তারা আবার আগুন জ্বালাল।

অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, আত্মোন্নতি সমিতি, মুক্তি সঙঘ (বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বা বি ভি নামে পরিচিত) প্রভৃতি দলের নবীন বিপ্লবীরা আবার অ্যাকশন শুরু করল। চট্টগ্রামে সূর্য সেন স্থাপন করলেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, লাহোরে শচীন সান্যালের নেতৃত্বে ভগৎ সিং, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ, বটুক দত্ত, যতীন দাসেরা প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দুস্থান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি।

দিল্লি অ্যাসেম্বলি হলের মধ্যে বোমা পড়ল, চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠিত, রাইটার্স বিল্ডিংয়ের বারান্দায় তিনটি ছেলে গুলির লড়াই চালিয়ে গেল। সারা দেশ এইসব সংবাদে সরগরম। উনিশশো পঁয়ত্রিশ পর্যন্ত এসে এইসব কর্মকাণ্ডে আবার একটু চাপ পড়ে। গান্ধী-আরউইন চুক্তি ভেঙে যাওয়ায় পুলিশ আবার সবাইকে জেলে ভরেছে– বিপ্লবীদের ফাঁসি দিতে দেরি করেনি।

এইসব কাণ্ডে দেশের স্বাধীনতা কতটা ত্বরান্বিত হয়েছে সে প্রশ্ন ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এইসব যুবাপুরুষদের অসম সাহসিকতা, নিষ্কলুষ আত্মত্যাগ ভারতবাসীর মনে একটা সম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে দিয়েছিল ঠিকই। এরা দেশকে মা বলে জানত, রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে মৃত্যু জয় করার সাহস পেয়েছিল, পরজন্মে তীব্র বিশ্বাস ছিল। সবাই বিশ্বাস করত যে, আবার ফিরে আসব। অনেক ক্ষেত্রেই এরা ইচ্ছে করে ধরা দিয়েছে, কারণ এদের ফাঁসির ঘটনা এবং শেষ বার্তা প্রচারিত হয়ে যেত সারা দেশে–তাতে নতুন ছেলেরা প্রেরণা পেত।

এ-সবই জানা ইতিহাস। তবু তখনকার ছেলেদের রোমান্টিক মনে এই সব মৃত্যুজিৎ যুবকদের জীবন ও কাজ কী রকম উদ্দীপনার সৃষ্টি করত সেটা বোঝাবার জন্য কয়েকটি দৃষ্টান্তের পুনরুল্লেখ করা দরকার।

সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাচ্ছিল লাহোরের মানুষ–পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠিপেটা করে হাত-পা ভেঙে দিল অসংখ্য মানুষের। লালা লাজপত রায় তো সেই মার খেয়ে মারাই গেলেন। এই অত্যাচারের নায়ক পুলিশ কমিশনার স্কট। হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি সিদ্ধান্ত নিল স্কটকে খুন করার। ত্রৈলোক্য চক্রবর্তীর কাছ থেকে ভগৎ সিং শেষ পর্যন্ত কিছু পিস্তল ও বোমা আদায় করেছিল। পুলিশ দপ্তরের সামনের রাস্তায় উনিশশো আঠাশের ডিসেম্বরের এক বিকেলে দাঁড়িয়ে রইল ভগৎ সিং, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ। সাহেব বেরিয়ে আসতেই তিন জন তিন দিক থেকে গুলি চালাল–রক্তাপ্লুত অত্যাচারীকে রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়ে গেল ওরা–কেউ ধরা পড়ল না। পরে অবশ্য জানা গিয়েছিল ওরা স্কটের বদলে স্যান্ডার্স নামে আর একজন অফিসারকে মেরেছিল।

পরের বছর দিল্লিতে অ্যাসেম্বলিতে হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে বোমা ফাটল, তারপরই সমস্ত হল ঘর ভরে উড়তে লাগল লাল ইস্তাহার। সেই ইস্তাহারের প্রথম বাক্য, বধিরকে শোনাবার জন্য এই রকম জোর আওয়াজ দরকার। পুলিশ ধরতে পারেনি, তবু ধরা দিলেন ভগৎ সিং এবং বটুক দত্ত। গান্ধীজির প্রচুর চেষ্টা সত্ত্বেও ফাঁসি হয়ে গেল ভগৎ সিং আর দু’জনের। অন্যদের দ্বীপান্তব।

লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার সময়েই সেখানকার জেলখানায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করলেন কলকাতার যতীন দাস। মানুষের প্রতি মানুষের যা ব্যবহার পাওয়া উচিত জেলখানায় তার চিহ্নমাত্র নেই বলে তেষট্টি দিন না খেয়ে রইলেন। হাজার চেষ্টা করেও তার প্রতিজ্ঞা ভাঙা যায়নি। যতীন দাসের চিতার সামনে দাঁড়িয়ে তার বৃদ্ধ পিতা হাত তুলে বললেন, ওঁ নারায়ণ। যে-দেশদ্রোহীরা মাতৃভূমিকে বিদেশির হাতে তুলে দিয়েছে, তাদের সকলের পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আমার আদরের যতীনকে তোমার পায়ে দিলাম।

১৯৩০ সালে ইস্টারের ছুটির দিনে শীর্ণকায় প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক সূর্য সেনের নেতৃত্বে একটি বাহিনী চট্টগ্রামে সাফল্যের সঙ্গে লুঠ করল অস্ত্রাগার। এই বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার হাতে পেয়েও তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার এঁরা করতে পারলেন না দু’-একটি সামান্য ভুলের জন্য।

অস্ত্রাগার আক্রমণের নিখুঁত পরিকল্পনা সত্ত্বেও বিপ্লবীরা আগে থেকে খবর রাখেননি যে অস্ত্র আর গোলাবারুদ এক জায়গায় রাখা হয় না। সুতরাং অস্ত্র দখল করেও নষ্ট করে দিতে হল, কারণ রসদ পাননি। তাঁরা আর একটি ভুল করেছিলেন, তারা জানতেন না যে ইস্টারের ছুটিতে সাহেবরা ক্লাবে যায় না বাড়িতে উৎসব করে। তাই ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেও কারোকে পাওয়া গেল না।

তবু সূর্য সেন চট্টগ্রামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। জালালাবাদের যুদ্ধে অন্তত একবার পরাজিত করেছিলেন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীকে। লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ প্রভৃতিকে সবাই মনে করল মহাকাব্যের বীর পুরুষদের মতন। এবং সূর্য সেন প্রবাদপ্রসিদ্ধ নায়ক।

ওই বছর অগাস্ট মাসে ঢাকার হাসপাতাল পরিদর্শনে গেছেন পুলিশের ইন্সপেক্টার লোম্যান এবং ঢাকা জেলার পুলিশসুপার হাডসন। মেডিক্যাল স্কুলের সুদর্শন ছাত্র বিনয়। বসু একলা রিভলভার নিয়ে আক্রমণ করল তাদের চোখের নিমেষে। সবাই দেখল, সব প্রহরীদের তুচ্ছ করে বেরিয়ে যাচ্ছে এক তরুণ যুবা। লোম্যান নিহত, হাডসন আহত, বিনয় পলাতক। চাষির ছদ্মবেশে কলকাতায় পালিয়ে এল সে। বিনয়ের এই চমকপ্রদ কীর্তিতে সারা দেশ স্তম্ভিত। বিনয়ের মাথার দাম তখন দশ হাজার টাকা। শরৎ বোস, আচার্য পি সি রায় গোপনে পরামর্শ দিলেন বিনয়কে স্মাগল করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া, হোক, না হলে তাকে বাঁচানো যাবে না। কিন্তু বিনয় বাঁচতে চায়নি। বাদল আর দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে সে আবার গেল রাইটার্স বিল্ডিংয়ে–ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ প্রিজনস কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করল। তারপর সারা রাইটার্স বিল্ডিং কাপিয়ে দিল বন্দেমাতরম ধ্বনিতে। বিনয়ের লক্ষ কখনও ব্যর্থ হয়নি, একমাত্র সে ব্যর্থ হয়েছিল আত্মহত্যা করতে গিয়ে। একই সঙ্গে সায়েনাইড খেয়ে মাথায় গুলি চালিয়েছিল ওরা তিন জন বাদল সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়-বিনয় এবং দীনেশ বিষ ও গুলির প্রতিক্রিয়া কাটিয়ে উঠেছিল। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর বিনয় মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে সেলাই ছিঁড়ে দেয়–সে জেলখানায় যাবে না প্রতিজ্ঞা করেছিল, যায়নি।

ফাঁসির আগে দীনেশ গুপ্ত তার বউদির কাছে চিঠিতে লিখেছিল, আমি অমর। আমাকে মারিবার সাধ্য কাহারও নাই। সে আবৃত্তি করত,

এ তো মালা নয় গো, এ যে
তোমার তরবারি।
জ্বলে ওঠে আগুন যেন
বজ্ৰ হেন ভারী–
এ যে তোমার তরবারি।

এই দেশেই সে আবার জন্মাবে, আবার সুখী স্বাধীন ভারতবর্ষে ফিরে আসবে–এ-সম্পর্কে তার কোনও সন্দেহই ছিল না, তার কারণ পরজন্ম তত্ত্বে তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। বউদিকে সে লিখেছিল, দেহের মৃত্যু হইলেই আমাদের সব শেষ হইয়া যায় না, এ-কথা স্বীকার করিতে হইবে। আমরা হিন্দু, হিন্দুধর্মে এ সম্বন্ধে কী বলিয়াছে, কিছু কিছু জানি। মুসলমান ধর্মও বলে, মানুষ যখন মরে, তখন খোদার ফেরেস্তা তার রু কবজ করিতে আসেন। মানুষের আত্মাকে ডাকিয়া বলেন, ‘অ্যায় রুহ্, নিকাল ইস কালিবসে চল খুদাকা জান্নৎমে।’ অর্থাৎ তুই দেহ ছাড়িয়া ভগবানের কাছে চল। তাহা হইলে বোঝা গেল মানুষ মরিলেই তার সব শেষ হইয়া যায় না; মুসলমান ধর্মের এই বিশ্বাস আছে। খ্রিস্টান ধর্ম বলে,

‘Very quickly there will be an end of thee here; consider what will become of thee in the next world.’

বোঝা গেল খ্রিস্টধর্মও বিশ্বাস করে মানুষের দেহের মৃত্যু হইলেও আত্মা মরে না।…গীতা বলিয়াছেন ‘শাস্ত্রসকল ইহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নিতে দহন করিতে পারে না, জলে ভিজাইতে পারে না, বায়ুতে শুষ্ক করিতে পারে না। এ-আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য, নিত্য, সর্বব্যাপী!’…এ তিন ধর্মের কোনও একটি মানিলেই আমাকে মানিয়া লইতে হইবে যে, আমার মৃত্যু নাই।’

কলকাতা থেকে বি এ পাশ করে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামে চলে এলেন পলাতক সূর্য সেনের খোঁজে। এত বড় ব্রিটিশ শক্তির চোখে ধুলো দিয়ে সূর্য সেন তখনও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং দল সংগঠন করে ছেলেদের অ্যাকশানে পাঠাচ্ছেন। প্রীতিলতা সূর্য সেনকে চোখে দেখার আগেই ব্রত নিয়েছিলেন, এই মানুষটির নির্দেশ অনুযায়ী তিনি দেশের জন্য কোনও একটা কাজ করে যাবেন। সূর্য সেন প্রীতিলতাকে পাঠালেন পাহাড়তলির ইয়োরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে–যে ইয়োরোপিয়ান ক্লাবের সদস্যরা অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরই চমকপ্রদ দ্রুত গতিতে এসে বিপ্লবীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই কঠিন কাজে সূর্য সেন প্রীতিলতাকে নেত্রী করে পাঠালেন একটি বিশেষ কারণে–যাতে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে যে বাঙালি মেয়েরাও বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যেহেতু ধরা না পড়লে প্রীতিলতার অংশগ্রহণের কথা কেউ জানবে না–তাই ইয়োরোপিয়ান ক্লাবে সার্থক আক্রমণ চালিয়েবহু জনকে রিভলভারের গুলিতে হতাহত করে–পালাবার পথ খোলা থাকলেও প্রীতিলতা বিষ খেলেন। তার শরীর তল্লাস করে পাওয়া গেল, তার নিজের লেখা ইংরেজি ঘোষণাপত্র। যার প্রথমেই আছে–’বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। আমি একজন সৈনিক। আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি।‘

এদিকে, পর পর তিন বছরে মেদিনীপুরের তিন জন ম্যাজিস্ট্রেট খুন হয়। ১৯৩১-এ পেডি, ১৯৩২-এ ডগলাস, ১৯৩৩-এ বার্জ। ডগলাসকে খুন করে প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য ও প্রভাংশু পাল–প্রভাংশু পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন কিন্তু পিস্তলের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় প্রদ্যোৎ ধরা পড়ে। তার ফাঁসি হয়। এরা কেউই গুন্ডা বা ডানপিটে ধরনের ছেলে ছিল না–এরা আদর্শব্রতী, স্বপ্ন-দেখা যুবক। প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য জেলখানা থেকে তার মা-কে লিখেছিল:

‘মা, তোমার প্রদ্যোৎ কি কখনও মরতে পারে? আজ চারি দিকে চেয়ে দেখো, লক্ষ লক্ষ ‘প্রদ্যোৎ’ তোমার দিকে চেয়ে হাসছে। আমি বেঁচেই রইলাম মা, অক্ষয় অমর হয়ে-বন্দেমাতরম!’

বার্জ হত্যা মামলায় ফাঁসি হয় রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এবং নির্মজীবন ঘোষের। ফাঁসির আগে ব্রজকিশোর চক্রবর্তী তাঁর মা-কে লিখেছিলেন, ‘এই সব পেয়েছির দেশ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছি, তথাপি আমি নিশ্চয় করে বলে যাচ্ছি, আপনার ঘর কখনও অন্ধকার হবে না।…মা, ফিরে আসবার যদি কোনও পথ থাকে, তবে এই সব পেয়েছির দেশে আবার ফিরে আসব–তখন চরণে স্থান দেবেন।’

কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে মেরে এল দুটি মেয়ে, শান্তি ঘোষ আর সুনীতি চৌধুরী। তখন অনেক মেয়েই অংশ নিয়েছে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে। কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, উজ্জ্বলা মজুমদার–এইসব বীরাঙ্গনার নাম ছড়িয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কেউ হারমোনিয়ামের মধ্যে রিভলভার লুকিয়ে নিয়ে যায়, কেউ কনভোকেশনের সময় সরাসরি গভর্নরকে গুলি করে।

১৯৩৪-এ দার্জিলিংয়ের রেসকোর্সে কয়েকটি ছেলে আর মেয়ে গুলি ছুঁড়ে মারতে গেল গভর্নর জন এন্ডারসনকে। সেই মামলায় ফঁসি হয় ভবানী ভট্টাচার্যের। সদ্য ম্যাট্রিক পাশ এই নবীন যুবকটি মৃত্যুর আগে তার ছোটভাইকে পোস্টকার্ড লিখেছিল:

‘অমাবস্যার শ্মশানে ভীরু ভয় পায় সাধক সেখানে সিদ্ধি লাভ করে। আজ আমি বেশি কথা লিখব না, শুধু ভাবব। মৃত্যু কত সুন্দর!’

সূর্য সেন ধরা পড়ার পর বিপ্লবীরা বেশ খানিকটা দমে গেল। এমন একটা প্রায় অলৌকিক বিশ্বাস লোকের মনে জন্মে যাচ্ছিল যে, সূর্য সেনকে ধরার ক্ষমতা কারও নেই। কিন্তু সূর্য সেনেরও ফাঁসি হয়ে গেল ১৯৩৪ সালে। এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট ও গভর্নর পর্যায়ে শারীরিক আক্রমণের ফলে পুলিশ খেপে উঠে সারা দেশ তছনছ করে ফেলল, গ্রামে গ্রামে পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল গুপ্তচর। বিপ্লবীরা অধিকাংশই জেলে বাকিরা আত্মগোপন করলেন। সমগ্র দেশে নেমে এল শ্মশানের শান্তি।

কিন্তু যুবকদের অদম্য প্রতিরোধ শক্তি আবার মাথা চাড়া দিয়েছিল। ফাঁসির আগে কারাগার থেকে সূর্য সেন পাঠালেন তার শেষ বাণী:

‘আমার শেষ বাণী–আদর্শ ও একতা।

ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে।…এই আনন্দময়, পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কী রেখে গেলাম? শুধু একটিমাত্র জিনিস, তা হল আমার স্বপ্ন। একটি সোনালি স্বপ্ন। এক শুভ মুহূর্তে আমি প্রথমে এই স্বপ্ন দেখেছিলাম। উৎসাহভরে সারা জীবন তার পেছনে উন্মত্তের মতো ছুটেছিলাম।…বন্ধুগণ, ওঠো, জাগো, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।…

বিদায়!

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! বন্দে মাতরম।’

সূর্য সেনের এই বাণী ব্যর্থ হয়নি। বস্তুত, প্রতিটি মৃত্যু, প্রতিটি আত্মদানইনতুন প্রেরণা দিয়েছে। কয়েক বছর একটু সুপ্ত থাকার পর সাম্রাজ্য-বিরোধী লড়াইতে আবার অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা শোনা যায়। আবার বুলেট, বিস্ফোরণ, রক্তপাত–এরই পরিণতি বিয়াল্লিশের অগাস্ট আন্দোলন।

১৯৩৮ সালের শেষ দিকে কয়েকটি যুবক হাজারিবাগের জেল ভেঙে বন্দিদের মুক্ত করার এক পরিকল্পনা নেয়। হাজারিবাগের দুটি বাগানবাড়িতে ছিল তাদের আস্তানা। তারা দিনেরবেলা কক্ষনও বাইরে বেরোত না, স্থানীয় লোকদের সঙ্গেও তারা বিশেষ যোগাযোগ রাখেনি।

সূর্যকুমার আর তার বন্ধু ছুটতে ছুটতে এদের গোপন আস্তানায় গিয়ে পড়ে হঠাৎ। ওই বাড়িতে ওঁদের উপস্থিতির কথা ফাঁস হয়ে যাবার আশঙ্কায় ওঁরা ছেলেদুটিকে নিয়ে খুব মুশকিলে পড়েছিলেন। সাহেবি স্কুলে পড়া এইসব বড়লোকের বাচ্চাদের ওঁরা বিশ্বাস করবেনই বা কী করে? শেষ পর্যন্ত সূর্যকুমারকে ওঁরা ভোররাত্রি পর্যন্ত আটকে রেখে জেরা করলেন–সূর্যকুমারের চেহারায় ও কথাবার্তা শুনে ওঁদের সন্দেহ হয়েছিল।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়