সূর্য পড়াশুনোতে ভালোই ছিল। কিন্তু পাদরি স্কুলের কড়া শাসন সত্ত্বেও সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষার আগের দু’ বছর সে বেশি অমনোযোগী হয়ে ওঠে। স্কুল থেকে বড়বাবুর কাছে মাঝে মাঝে অভিযোগের চিঠি আসতে লাগল। যে বুড়ো পাদরি বড়বাবুর সঙ্গে দেখা হলেই তার ছেলের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন, তিনিই চিঠি লিখে জানালেন যে, সূর্য এমন অবাধ্য হয়ে উঠছে যে তাকে আর স্কুলে রাখা সম্ভব হবে না। সূর্যর মতন শান্ত, ভদ্র ছেলের নামে অবাধ্যপনার অভিযোগ কল্পনাই করা যায় না। চিঠি পেয়ে বড়বাবু অবিলম্বে চলে গেলেন হাজারিবাগে। কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফিরে এলেন। সূর্যর পরীক্ষার তখন আট মাস বাকি।

ফিরে আসার পর বড়বাবুকে বেশ চিন্তিত দেখা গেল। তার প্রশান্ত সুন্দর কপালে। প্রায়ই সিঁড়ি দেখা যায়। স্থির চোখে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়েন। এতখানি বয়স হলেও বড়বাবুর চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই, শরীরে নেই এক ছিটে মেদ, টকটকে গায়ের রং, কয়েকগাছি পাকাচুল এমনি ভাবে লুকিয়ে আছে। যে খুঁজে পাওয়া যায় না।

বড়বাবু একদিন চিররঞ্জনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, চিরু, ছেলেটাকে নিয়ে কী করা যায় বলো তো?

চিররঞ্জন কিছুই খবর রাখতেন না। বললেন, সূয্যি? কেন, তাকে নিয়ে চিন্তার কী হল?

বড়বাবু বললেন, এই ছেলেটাই আমার বন্ধন। ও যদি না থাকত, আমি যেমন খুশি জীবন কাটাতে পারতাম। যা টাকাকড়ি আছে তা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম দেশ-বিদেশে। কিংবা কোনও যাত্রাদলে ভিড়ে গিয়ে ক্লারিওনেট বাজাতাম। কিন্তু এই ছেলেটার কথা ভেবে কিছুই পারি না। ছেলেটা ওর মায়ের সঙ্গ পায়নি, আমার কাছেই বা কতটুকু থেকেছে! অথচ ওরও তো জীবনে কিছু পাওয়া দরকার!

ছেলেটাকে কোনও একটা লাইনে দিয়ে দিন, তারপর নিজের পায়ে নিজেই দাঁড়াবে। কী পড়াবেন ঠিক করছেন?

সেটাই তো ঠিক করতে পারছি না। দেখো, এ-দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ তাদের ছেলেমেয়েদের কোনও রকম শিক্ষা দেবারই সুযোগ পায় না। আমার সব রকম সুযোগ আছে। আমি ওকে ডাক্তারি পড়াতে পারি, এঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে পারি, ব্যারিস্টারি পড়াবার জন্য বিলেত পাঠাতে পারি, কিংবা আই সি এস–কিন্তু বুঝতে পারি না কোন শিক্ষায় ও সত্যিকারের মানুষের মতন মানুষ হবে। দেখো চিরু, আমার এতখানি জীবনে আমি ভারতবর্ষের বহু জায়গায় ঘুরেছি–এমন কয়েক জন মানুষ দেখেছি যাঁরা একবর্ণ লেখাপড়া শেখেননি, কিন্তু তারা দেবতুল্য মানুষ। তাদের মতো উদারতা, তাদের মতো চরিত্রবল তো বহু শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও দেখি না। বিহারে রামপ্রসাদ পাণ্ডে, লক্ষৌয়ে হরিশ মজুমদার, ইমাম বক্স, হরিদ্বারের স্বামী অঘোরানন্দ।

শিক্ষিত লোকের মধ্যেও মহৎ মানুষের অভাব নেই। যেমন আশু মুখুজ্যের কথাই ধরুন না।

তুমি তো দেখছি খুব আশু মুখুজ্যের ভক্ত! ভদ্দরলোক কি তোমায় জামাই করতে চেয়েছিলেন নাকি?

আমাকে? আর তোক খুঁজে পেলেন না?

একবার ভেবেছিলাম, ছেলেটাকে আই সি এস-এর জন্য পাঠাব বিলেতে। কিন্তু মনস্থির করতে পারি না। আই সি এস হয়ে তো ইংরেজদের গোলামি করবে। আজ না হোক, দশ পনেরো কি কুড়ি বছর বাদে তো এ-দেশ স্বাধীন হবেই। তখন কি দেশের মানুষ ইংরেজদের এই গোলামগুলোকে সহ্য করবে? এইসব আই সি এস-দের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে না? দেখো অরবিন্দ ঘোষ, সুভাষবাবু এঁরা আই সি এস পাশ করেও শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিলেন।

কুড়ি বছরের মধ্যে এ-দেশ স্বাধীন হবে? বড়বাবু, আপনি কি স্বপ্ন দেখছেন? দেশ স্বাধীন করবে কে, ওই গান্ধী? না বোমা-ছোঁড়া ছেলেগুলো? সূর্য সেন টেনকে যেমন ফাঁসিতে ঝোলাল, তেমনি গান্ধী-সুভাষ বোসকেও ইংরেজ যে দেওয়ালে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেনি, সেটা ইংরেজদের দয়া। লালা লাজপত রায়ের মতন মানুষকে লাঠিপেটা করে মেরে ফেলল, কী হল তাতে?

সারা পৃথিবীতে একটা ওলটপালট আসছে। আমাদের দেশটাও বাদ পড়বে না। জার্মানিতে দেখছ, হিটলার কী রকম শক্তিশালী হয়ে উঠছে? একটা সামান্য কর্পোরাল আজ সে-দেশের সর্বময় কর্তা। অস্ট্রিয়াকে গ্রাস করেছে, এবার অন্য দিকে হাত বাড়াবে। তোমার মনে আছে নাইনটিন ফোরটিনের কথা? যতীন মুখুজ্যে আর তার দলবল জার্মানি থেকে অস্ত্র আনিয়ে দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবার তাল করেছিল। সেবার পারেনি, পরিকল্পনা ফাস হয়ে গিয়েছিল। আবার কি কেউ সে রকম চেষ্টা করবে না ভাবছ? জার্মানরা ইংরেজদের ল্যাজে আগুন লাগাবার জন্য ভারতে গণ্ডগোল পাকাবার সুযোগ। ছাড়বে না। রাশিয়ার লেনিন সাহেবও তো প্রথমে জার্মানির সাহায্য নিয়েছিলেন। তারপর ধাঁ ধাঁ করে দেশটাকে কী করে ফেললেন!

বড়বাবু আপনি সূয্যিকে ডাক্তারি পড়ান। আমার বাবার খুব শখ ছিল, আমার ভাইদের মধ্যে কেউ ডাক্তার হোক। তা তো আর হল না। সূয্যিকে ডাক্তারি পড়ান, সেটাই সব। দিক থেকে ভালো হবে। বুড়ো বয়সে আপনাকে দেখতে পারবে।

বুড়ো বয়সে আমার ছেলে আমাকে দেখবে, সে প্রত্যাশা আমি করি না। বুনো জন্তুরা কী করে জানো তো, তারা যখন মৃত্যুর সময়টা টের পায়–তখন সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়ে নির্জন কোনও জায়গায় গিয়ে মরে। আমিও সবার চোখের আড়ালে গিয়ে মরব। দেখো, আমার জন্মরাত্রে আমার মা মারা যান, আমার বাবা আমাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। আমার কোনও মাতৃঋণ কিংবা পিতৃঋণ নেই। সূয্যির কপাল ভালো যে আমি ওকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিইনি কিংবা অনাথ আশ্রমে ভরতি করে দিইনি। জীবনে যাদের কাছ থেকে আমি স্নেহমমতা পেয়েছি–তাদের ঋণ শোধ করার জন্যই আমি সূয্যিকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি। অবশ্য সূয্যির কিছু টাকাকড়ি আছে আমার কাছে ওর মায়ের অনেক মোহর ছিল–যে-দিন চাইবে, সেদিনই দিয়ে দেব।

বড়বাবু, আপনি আবার একটা বিয়ে করুন।

চিররঞ্জনের এই কথা শুনে বড়বাবু একটু চমকে উঠলেন। তারপর বললেন, হঠাৎ এই বদবুদ্ধি দিচ্ছ কেন আমাকে?

আপনার কথাবার্তা একটু যেন কেমন কেমন শোনাচ্ছে। আপনার একটা কিছু টান থাকা দরকার! আপনার বয়সে তো কত লোক আবার বিয়ে করছে।

পাত্রী টাত্রি আছে নাকি তোমার হাতে?

একবার খবর ছড়িয়ে দিলে দেখবেন কত ঘটক এসে চিলুবিলু করবে আপনাকে নিয়ে।

তাই বলো। আমি ভাবলাম, তুমি নিজেই বুঝি ঘটকালির পেশা ধরলে। একটা বয়স এসে গেলে সবকিছু সম্পর্কেই টান কমে যায়। লালসা যাদের বেশি তারা বুড়ো বয়সেও মেয়েদের নিয়ে মজে থাকে। যেমন পেটুকরা বুড়ো বয়সেও বেশি খায়। এই বয়সে ধর্মকর্ম নিয়েও অনেকে মেতে থাকে, আমি তো সেদিকেও তেমন মন বসাতে পারলাম না। কেউ কেউ দেশ উদ্ধার করার জন্যও মাতে। আমার ইচ্ছে করে কী জানো, সারা দিন চুপ করে বসে থাকি–সারা জীবনের সব ঘটনার কথা ভাবি–খুঁজে দেখি, কোথায় আমার ভুল হল। প্রবৃত্তিবেগ মানুষকে যেখানে নিয়ে যায় সেখানে সে যাবেই। মেয়েদের নিয়ে একসময় খুব মেতে ছিলুম, শরীরে যতখানি আগুন জ্বলে সব জ্বলিয়েছি–তৃষ্ণা এখনও মেটেনি, প্রবৃত্তিবেগ তেমন প্রবল নয় বলে বিয়ে করতে চাই না বা রক্ষিতা রাখতে চাই না। যৌবনবতী রূপসি মেয়েছেলে দেখলে চোখ জুড়োয়–কিন্তু মনে মনে ভাবি, এরা আর আমার নয়, এদের জন্য আমার ছেলের বয়সি ছেলেরা বড় হচ্ছে। আমি পয়সা দিয়ে ও রকম দুটো-একটা মেয়েকে কিনতে পারি, কিন্তু ওরা আর আমার হবে না। বুড়োর জন্য একটা বুড়ি দরকার–তা বলে কি আমি বুড়ি বিয়ে করব?

আপনি বুড়ো হননি! তা হলে আমরা তো থুত্থুড়ে—

ও-সব কথা বাদ দাও। তুমি তোমার ছেলেকে কী পড়াচ্ছ?

বাদল? ও তো মাত্তর ক্লাস ফাঁইভে পড়ে। এখন কী ভাবব?

এখন থেকেই ভেবে রাখা ভালো। কম বয়স থেকেই ছেলেদের মধ্যে একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঢুকিয়ে দিতে হয়।

আমি ওকে কিছুই পোব না। ম্যাট্রিক পর্যন্ত চালাব–তখন যদি ওর কিছু জ্ঞানগম্যি হয়, তা হলে নিজেই নিজের লাইন বেছে নেবে। আমার ছোটভাই রঞ্জুর খুব শখ ছিল আর্ট স্কুলে পড়ার–আমার বাবা তাতে রাজি হয়নি–ছেলেটা সেই রাগে অভিমানে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আমি আমার ছেলেকে বাধা দেব না, তার যা খুশি পড়বে। পড়ার খরচও নিজেকেই চালাতে হবে–আমি ততদিন বাঁচব কি না ঠিক নেই।

কেন, তোমার ছেলেকেই ডাক্তারি পড়িয়ে।

ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে হলে আমাকে টাকাপয়সা রোজগার করা শুরু করতে হবে। তা কি আর আমি পারব?

.

স্বল্পভাষী সূর্যকুমার স্কুলের ছেলেদের সঙ্গেও বেশি মিশত না। নিঃশব্দে স্বাবলম্বী জীবন যাপন করাই ছিল তার স্বভাব। কিন্তু স্কুলজীবনের শেষ দিকে সে কিছু বকাটে ছেলের পাল্লায় পড়ে।

তার স্কুলে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরাই বেশি পড়তে আসত। যে-সব সরকারি অফিসারের বদলির চাকরি, তাদের ছেলেরাও যেমন ছিল, তেমনই ছিল বিহারের নানা ছোটখাটো জমিদারের ছেলেরা। এদের মধ্যে অনেকের বংশেই প্রথম লেখাপড়ার প্রচলন। বংশের প্রথম কেউ স্কুলে পড়তে এলে দু’রকম ফল দেখা যায়। হয় সে-ছাত্র তাদের পরিবারের সকলের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত মেধা একা তার মাথায় নিয়ে পড়তে এসে দারুণ ব্রিলিয়ান্ট হয়, অথবা তার মাথায় সমস্ত জ্ঞানের কথাই ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। যেমন, ক্রিশ্চান মিশন বা অনাথ আশ্রমের কয়েকটি ছেলে, তাদের মধ্যে দু-তিন জন সাঁওতাল-পড়াশুনোয় চমকপ্রদ ফল করেছে–আবার কয়েকটি জমিদারের ছেলে একেবারে মগজে কিছু ঢোকায়নি–কোনওক্রমে ইংরেজিতে কথা বলতে শেখাই তাদের একমাত্র লাভ।

সেই রকম কয়েকটি ছেলে কড়া নিষেধ সত্ত্বেও হস্টেল থেকে রাত্তিরবেলা বাইরে বেরিয়ে যেত। তারা সূর্যকুমারকেও প্রলুব্ধ করে। সূর্যকুমার শুধুমাত্র আকৃষ্ট হয়েছিল তাদের দুঃসাহসিকতায়। হস্টেলের প্রধান দরজা দিয়ে সন্ধ্যাবেলা বেরোবার কোনও উপায় নেই। কম্পাউন্ডের চার পাশে উঁচু দেওয়াল। তিনটি ছেলে অন্ধকার হয়ে গেলে উঠে পড়ত পাঁচিলের পাশে একটা আমগাছে। সেই গাছের একটি ডাল ধরে ঝুলে পড়লে পাঁচিলের ওপর পা রাখা যায়। পাঁচিলের ওপর থেকে লাফ দিলে পা ভাঙা সুনিশ্চিত। সেই পাঁচিল ধরে বাইরের দিকে ঝুলে পড়ে শেষ পর্যন্ত ধুপ করে নেমে পড়া। তারপরই ছুট। ফেরার সময় ব্যাপারটা আরও কঠিন। তখন একজনের কাঁধে একজনকে উঠে দাঁড়াতে হয়–শেষ জনকে তুলতে হয় হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে। প্রথম প্রথম এই নৈশ অভিযানের লক্ষ ছিল বাজারের দোকানগুলিতে গিয়ে পুরী-মেঠাই খাওয়া আর সিনেমা হলে গিয়ে চঁচামেচি করা। ক্রমে ক্রমে অন্য ব্যাপারও এসে যায়।

অ্যাডভেঞ্চারের লোভেই সূর্যকুমার ওদের দলে ভিড়ে গেল। পাঁচিল টপকে নেমেই ছুটতে ছুটতে ওরা এল বড়রাস্তায়। কাঁচারি পেরিয়ে, ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে গিয়ে ওরা। হাজির হত একটা একতলা বাড়িতে। সে বাড়িতে ভেতরের ঘরে হ্যারিকেন জ্বেলে কয়েকটি লোক জুয়া খেলে। হরতন-চিড়িতন-রুহিতন-ইস্কাবন আঁকা একটা বোর্ডের ওপর মস্ত বড় একটা ছক্কা উলটে ফেলে জুয়া।

সূর্যকুমারের কিশোর মন এই অনিশ্চিত খেলাটায় বেশ আকর্ষণ পেয়ে গেল। বড়বাবু তাঁর ছেলেকে টাকা পাঠাবার ব্যাপারে অনুদার ছিলেন না সূর্যকুমারের হাতে যথেষ্ট টাকা থাকত। গভীর মনোযোগে সে বসে যেত জুয়া খেলতে। প্রতি রাত্রে সব টাকা। হারত।

জুয়ার পরবর্তী ধাপ নারী। সূর্যকুমারের দুর্দান্ত প্রকৃতির বন্ধুরা মেয়েদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের। যতরকম নাম আছে এবং নারী-পুরুষের যত রকম ক্রিয়াকলাপ আছে সেসব আলোচনায় খুবই আনন্দ পেত। পিউবার্টি আসার পর পরই এই ঝোঁকটা বেশি থাকে। এইসব আলোচনা হিন্দিতেই বেশি হত–সূর্যকুমারের বুঝতে অসুবিধে হত না। কারণ ছেলেবেলা থেকেই সে উর্দু জানে। অন্যদের তুলনায় এইসব আলোচনায় সূর্যকুমারের। ওপর প্রতিক্রিয়া হত অন্য রকম। শৈশব থেকেই তার কোনও পারিবারিক জীবন নেই, মা-কে মনে নেই, কোনও নারীকেই কাছাকাছি দেখেনি কখনও, সুতরাং এই বিষয়টি তার অচেনা। শিশু যেমন আগুন জল, খাদ্য এবং লাল, নীল প্রভৃতি রং ক্রমশ আলাদা আলাদা করে চেনে–সূর্যকুমারও তেমনি ভাবে মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কথা শুনতে। লাগল ঘোর বিস্ময় নিয়ে।

সহপাঠীদের এইসব কথাবার্তা সূর্যকুমারের মনের মধ্যে ছাপ ফেলেছিল। কেন না, সেবারই কলকাতায় এসে সে শ্রীলেখার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তখনও সেই গম্ভীর স্বভাব থাকলেও মাঝে মাঝে সে শ্রীলেখার বুকের দিকে চেয়ে থাকত একদৃষ্টে। যেন একটা চুম্বক তাকে টানছে। বাদল একদিন দেখেছিল, সূর্যকুমার তার বড়দির কোমর ধরে উঁচু করে তুলেছে। শ্রীলেখা ছটফট করতে করতে বলছে, এই কী হচ্ছে, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, মা এসে পড়বে। সূর্যকুমার শ্রীলেখাকে মাটিতে নামিয়ে জোর করে তার ঠোঁট চুষতে শুরু করে। শ্রীলেখা তখন ধরা-পড়া পাখির মতন ছটফট করছিল। শ্রীলেখা তখন ক্লাস নাইনে পড়ে–তার বিয়ের জন্য পাত্র দেখা চলছিল। পরে অবশ্য ব্যাপারটা আরও অনেক দূর গড়ায়।

জুয়া খেলার দলবল একদিন একটি মেয়েকে এনে হাজির করে। জরির চুমকি বসানো কাঁচুলি ও ঘাঘরা-পরা সেই মেয়েটি যারপরনাই নির্লজ্জ। তার পেশা নাচ দেখানো, আসল উদ্দেশ্য হস্টেলে-থাকা এইসব বড়লোকের ছেলেদের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব টাকাপয়সা খিচে নেওয়া। সূর্যকুমারের সহপাঠীদের মধ্যে দু’-এক জন বেশ বয়স্ক, দামড়া ধরনের ছেলে, আদিরসে যথেষ্ট অভিজ্ঞ, নাচনেওয়ালির সঙ্গে সাক্ষাতের দিন কানে আতরমাখা তুলো খুঁজে আসতেও জানে।

হ্যারিকেনের বদলে সে-দিন হ্যাঁজাক জ্বালানো হয়েছিল। নাচ শুরু করার আগে মেয়েটি পায়ের ঘুঙুর ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করে আর টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো তীক্ষ্ণ চোখে সকলের দিকে তাকায়। একজন লোক একটা বোতল থেকে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে, আর হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে তবলা বাঁধছে। তারপর ‘বানাওরে বাতিয়াঁ বলো কাহেকা ঝুঁটি’ ধরনের গানের সঙ্গে নাচ শুরু হয়।

অনিন্দ্যকান্তি কিশোর সূর্যকুমার উদগ্র কৌতূহল নিয়ে বসে থাকে। নাচের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘাঘরা উড়তে থাকে, হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়–ফরসা মেয়েটির পা দুখানি পারস্য দেশের বাঁকা ছুরির মতন ঝলসায়। মেয়েটি তার দৃষ্টিতে চতুর্দিকে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। সূর্যকুমারের বুক কাঁপছে, রক্ত চলাচল অসম্ভব দ্রুত, শরীরের মধ্যে কী যেন একটা ছটফট করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মেয়েটির ঘাঘরাকে মনে হচ্ছে। একটা রহস্যের যবনিকা–আরও অনেক অনেক রহস্য চাপা রয়েছে, সময় দুলছে, ঘর দুলছে, যেন পরের মুহূর্তেই পৃথিবীতে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটবে। সূর্যকুমারের মুখখানা সাদা কাগজের মতন ফ্যাকাশে। যেন সমস্ত অন্তরীক্ষ সাগ্রহে লক্ষ করছে এই কিশোরের সুশিক্ষার দৃশ্য।

সে-দিন ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। সেদিনই ধরা পড়ল সূর্যকুমার। অন্য সঙ্গীরা পালাতে পেরেছিল, কিন্তু সূর্যকুমার সে-দিন এক গেলাস সিদ্ধি পান করার ফলে সুস্থ ছিল না।

তিন জন ফাদার সারা রাত ধরে সূর্যকুমারকে জেরা করেন। কে কে তার সঙ্গে গিয়েছিল? কোথায় গিয়েছিল? সূর্যকুমার একটিও কথা খুলে বলেনি। প্রত্যেক বার বলেছিল, সে একা দোষী, সে যেখানে গিয়েছিল সেখানকার ঠিকানা বলবে না।

পাদরিরা মারধর করেন না। মিষ্টি কথায় অনেক শেখাবার চেষ্টা করছিলেন, পাপের ভয় দেখিয়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সূর্যকুমারের আত্মা পরিশুদ্ধ করার জন্যে পুরো এক দিন অনাহারে এবং তিন দিন তিন রাত একতলার একটি নির্জন ঘরে যিশুর মূর্তির সামনে প্রার্থনা করতে হয়। তারপর প্রধান পাদরি সূর্যকুমারকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি এ রকম কাজ আর কখনও করবে?

সূর্যকুমার মাথা হেলিয়ে বলেছিল, না।

পাদরিদের নজর একটু শ্লথ হতেই প্রথম রাত্তিরে সুযোগ পেয়েই সূর্যকুমার পাঁচিল টপকে আবার সেখানে চলে যায়।

ওই জুয়া খেলার সঙ্গীদের সঙ্গে মেশার সময়েই এমন একটা ঘটনা ঘটে যাতে সূর্যকুমারের জীবনটা বদলে যায়।

একদিন ওই জুয়ার আড্ডায় পুলিশের হামলা হল। পুলিশ সম্পর্কে এমনিতেই তখন ভীতি ছিল যথেষ্ট, তার ওপর হস্টেলের ছাত্রদের পক্ষে পুলিশের হাতে ধরা পড়াই ছিল চরম সর্বনাশের ব্যাপার। পাদরিদের অভিযোগ অভিভাবকরা বিশ্বাস না-ও করতে পারে–কিন্তু পুলিশের সংসর্গে এলে আর রক্ষে নেই।

ছাত্ররা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটল। যে-দিকেই যায়, পুলিশের হুইসেলের আওয়াজ শুনতে পায়। মাঠঘাট পেরিয়ে ওরা ছুটছে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে।

হাজারিবাগে ধনী ব্যক্তিদের অনেকগুলো বাড়ি আছে–সারা বছর সেগুলি প্রায় ফাঁকাই পড়ে থাকে। সে রকম একটি বাড়ির বাগানে সূর্য আর একটি ছেলে ঢুকে পড়ল। এবং বাড়ির প্রধান দরজা খোলা দেখে আর কোনও কিছু না ভেবে ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল।

গোটা বাড়িটা অন্ধকারই ছিল। হঠাৎ টর্চ জ্বলে উঠল। সূর্যকুমার আর তার সঙ্গী দেখল, সিঁড়ির ওপর মালকোঁচা মেরে ধুতি-পরা, গেঞ্জি গায়ে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার বাঁ হাতে টর্চ, ডান হাতে রিভলভার। লোকটি কর্কশ গলায় বললে, হাত তোলো।

ক্রমশ ওপর থেকে চার-পাঁচ জন লোক নেমে এল। প্রত্যেকেই সবলকান্তি যুবাপুরুষ। ভদ্রলোক বলেই মনে হয়, ঠিক ডাকাতের মতন চেহারা নয়। দু’জনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। যার চেহারা দলপতির মতন, সে বাংলাতেই জিজ্ঞেস করল, কী চাও এখানে?

সূর্যকুমারের সঙ্গী হাউমাউ করে হিন্দিতে বলল, আমাদের বাঁচান। আমাদের পুলিশ তাড়া করেছে।

পুলিশের নাম শুনেই লোকগুলোর মুখ অন্য রকম হয়ে গেল। দু’জন চলে গেল বাইরে লক্ষ করতে। আর ক’জন ওদের জেরা করতে লাগল। প্রথমত ওদের বিশ্বাসই করানো যায় না যে, সদর দরজাটা খোলা ছিল। ওদের প্রত্যেকেরই দৃঢ় ধারণা, দরজা বন্ধ ছিলই। জুয়ার আড্ডার কাহিনী শেষ পর্যন্ত বলে ফেলায় শেষ পর্যন্ত ওদের খানিকটা যেন বিশ্বাস হল। পুলিশের হুইসেল আর শোনা যাচ্ছে না।

দলপতি তখন অন্য লোকদের বললেন, এরা সাধারণ বকাটে ছেলে। এদের ছেড়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ওরা ফিরে গিয়ে গল্প করবে। এসব ছেলেকে তো চিনি!

সূর্যকুমার কোনও কথা বলেনি। তার সঙ্গীই সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। এবার সে বলল, কিসিকো নেহি বোলুঙ্গা। ম্যায় কসম খা রাহা।

দলপতি তখন বললেন, কারোকে যদি এ বাড়ির কথা বলিস, তোদের গলা কেটে নেব। কোনও দিন আর আসবি না, যাঃ!

ওই দলের একজন লোক সূর্যকুমারকে তীক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ করছিল। এবার সে বলল, হরদা, এই ছেলেটিকে কি ছাড়া ঠিক হবে? এ তো মনে হচ্ছে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। ওদের বিশ্বাস নেই।

সূর্যকুমারের মুখখানা টকটকে লাল হয়ে গেছে। ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, আই অ্যাম নো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান! মাই ফাদার ইজ বেঙ্গলি ব্রামিন!

সেই লোকটি এগিয়ে এসে সূর্যকুমারের গালে এক চড় মেরে বলল, হারামজাদা, বাঙালি বামুনের ছেলে যদি হও–তা হলে বাংলা বলতেও শেখোনি?

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়