পূর্ব-পশ্চিম – উপন্যাস – প্রথম খণ্ড
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একটা ঘোড়ার গাড়ি ডাকা হয়েছে। লোকজন আর মালপত্র তো কম নয়, এক গাড়িতে আঁটানো মুশকিল। বেডিংটাই তো বিরাট। সতরঞ্চি মুড়ে সেটাকে বাঁধবার সময় প্রতাপ আর কানু দু’দিক দিয়ে দড়ি টেনেছে আর পিকলু বসে থেকেছে তার ওপর, তবু আয়তন বিশেষ কমেনি। এ ছাড়া একটা সুটকেস, একটা ট্রাংক আর বইপত্রের একটা মস্ত বড় পুঁটুলি। দুই টিফিন কেরিয়ার ভর্তি পরোটা আর আলুর দম।

মালপত্র সব চাপানো হলো ঘোড়ার গাড়ির ছাদে। বাবলুর ইচ্ছে সেও ছাদে বসে যাবে, কিন্তু প্রতাপ সে প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। মালপত্র সামলাবার জন্য একজনকে ওপরে থাকতে হবে ঠিকই, সে দায়িত্ব দেওয়া হলো কানুকে। এত বড় বেডিংটা প্রতাপ, কানু আর গাড়ির কোচওয়ান মিলে ওপরে তুলতেই হিমসিম খেয়ে গেল।

রাত সাড়ে নটায় ট্রেন, সন্ধে ছটা থেকেই প্রতাপ বেরিয়ে পড়বার জন্য তাড়া দিচ্ছেন। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছাতে ঘণ্টা দেড়েক লাগবে, আগে ভাগে গিয়ে ট্রেনে জায়গা দখল করতে হবে। কিন্তু মমতার আর খুঁটিনাটি কিছুতেই শেষ হয় না। রান্নাঘরের জানলাটা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না, সেটা তো আর খোলা রেখে যাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত কানু একটা নারকোল দড়ি দিয়ে জানলার পাল্লা দুটো বেঁধে দিল লোহার সিকের সঙ্গে। টেনে বাঁধতে গিয়ে হাত ছড়ে গেল কানুর, তবু সে হাসিমুখে বললো, বৌদি, তোমার আর কী সমস্যা আছে বলো!

মমতা বাবলুকে বললেন, তুই টিয়া পাখির খাঁচাটা ওপরে রাধুর কাছে দিয়ে আয়। আর এই আটআনা পয়সা দিবি, ও ছোলা কিনে দেবে।

বাবলু পাখির খাঁচাটা নিয়ে উঠে গেল তিনতলায়। টিয়া পাখিটা একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাবলুর দিকে। যেন অভিযোগ করছে, আমায় তোমরা ফেলে চলে যাচ্ছো, বাঃ, বেশ! বাবলুর অবশ্য পাখিটার ওপর কোনো মায়া নেই। অতি পাজি পাখি! একদিন বাবলুর আঙুল কামড়ে দিয়েছিল।

রাধু এখন নেই, ওপরের মাসিমা বললেন, তোদের যাওয়ার সময় হয়ে গেল; আমার জন্য কী আনবি রে, বাবলু? তোর মাকে আমার নামে পুজো দিতে বলেছি, মনে করিয়ে দিস,? যা, খাঁচাটা বারান্দায় টাঙিয়ে দিয়ে যা। আমি চান করে এসেছি, আমি এখন ছোঁবো না!

ওপরের মাসিমাদের অনেকগুলো পাখি। একপাশে বাবলু তার খাঁচাটা ঝুলিয়ে দিল। তারপর উঁকি দিয়ে দেখলো নিচের দিকে। মালপত্র সব তোলা হয়ে গেছে, এখন বাঁধাবাঁধি চলছে। ঘোড়াটার মুখে একটা কাপড়ের থলি, তার মধ্যেই ঘাস রয়েছে, মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সে ঘাস খাচ্ছে। চেকলুঙ্গি আর গেঞ্জি-পরা কোচওয়ানটি খুব রোগা, এত রোগা যে পিঠটা কুঁজো হয়ে গেছে। তার সঙ্গে আছে একটা বাচ্চা ছেলে, বাবলুর থেকেও ঘোট, সে গাড়ির পেছনে দাঁড়ায়। ঐ জায়গাটার প্রতি বাবলুর বরাবর লোভ। আজ সে ওখানে দু’বার তিনবার বসে নিয়েছে। এটা তাদের নিজেদের ভাড়া করা গাড়ি, সে যতবার খুশী বসতে পারে। তাদের পাড়ার লালু প্রায়ই চলন্ত ঘোড়ার গাড়ির পেছনে বসে অনেকখানি যায়। তার দেখাদেখি বাবলু একদিন বসতে গিয়েছিল আর সেই গাড়ির কোচোয়ান পেছন দিকে ছপটি মেরেছিল।

গাড়ির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পিকলু ডাকছে, মা এসো। সাড়ে ছ’টা বেজে গেল। বাবলুটা আবার গেল কোথায়?

পিকলু ফুল প্যান্ট পরেছে, তার ওপরে একটা চেন লাগানো গেঞ্জি। পিকলু হঠাৎ লম্বা হতে শুরু করেছে, কিছুদিন আগেও সে আর বাবলু প্রায় সমান সমান ছিল। একদিন চুল উল্টে আঁচড়েছিল পিকলু, তা দেখে মমতা বলেছিলেন, ছিঃ, ওকী করেছিস, একদম বখাটে ছেলেদের মতন দেখাচ্ছে! তোর বাবা দেখলে মাথা ন্যাড়া করে দেবে!

যাত্রা শুরু হলো পৌনে সাতটায়। বাগবাজার থেকে মণীন্দ্র কলেজের পাশ দিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ। মমতার পাশে বাবলু আর মমতার কোলে মুন্নি। উল্টোদিকে প্রতাপ আর পিকলু। বাবলু ছটফটে ছেলে, এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকতে পারে না, বারবার সে বাইরে উঁকিঝুঁকি মারছে। মাড়োয়ারিদের একটা বিয়ের মিছিল যাচ্ছে, প্রচুর আলো আর বাজনা, ঘোড়ার পিঠে বসে আছে জরির পোশাক পরা বর, তার কোমরে তলোয়ার, বাবলু অনেকখানি। মুখ ঝুঁকিয়ে দিতেই মমতা সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, এই, কী করছিস, মাথায় ধাক্কা খাবি তবে বুঝবি! দ্যাখ তো, দাদা কেমন চুপ করে বসে আছে।

পিকলু বললো, বাবলু, তুই আমার জায়গায় আসবি? এখানে বসে ভালো দেখা যাচ্ছে।

বাবলু তাতে রাজি নয়। মায়ের পাশ ছেড়ে সে বাবার পাশে যেতে চায় না। সেইজন্যই তো সে আগে থেকে গাড়িতে উঠে এই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে।

প্রতাপ কোনো কথা বলছেন না, থুতনিটা উঁচু করে আছেন। তার মুখোনি গম্ভীর, বিষণ্ণ। যদিও সপরিবারে তিনি বেড়াতে যাচ্ছেন, তবু তার এখন মনে পড়ছে অন্য কথা।

প্রতাপ সজাগ হলেন হাওড়া ব্রিজের ওপর এসে। সাংঘাতিক ট্র্যাফিক জ্যাম। দশ মিনিটে এ গাড়ির ঘোড়া এক পা-ও এগোলো না। ওপর থেকে কানু বললো, সেজদা, সামনে একেবারে সলিড হয়ে আছে। কিছুই নড়ছে না।

প্রতাপ পাঞ্জাবির ঘড়ি-পকেট থেকে গোল ঘড়ি বার করে দেখলেন। যথেষ্ট সময় আছে এখনো। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এত মালপত্র নিয়ে তো গাড়ি ছেড়ে হাঁটা যাবে না! তিনি বললেন, কানু, তুই আর পিলু বরং আগে চলে যা। ট্রেন ইন করলে উঠে জায়গা রাখবি।

পিকলু তড়াক করে নেমে পড়তেই বাবলু বললো, বাবা, আমিও যাবো!

প্রতাপ মাথা নেড়ে বললেন, না!

পিকলু আর কানু টিকিট আর দু-একটা ছোটখাটো মালপত্র নিয়ে দৌড়ে চলে গেল। একটু পরেই বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো বাবলুর। যদি তারা শেষ পর্যন্ত পৌঁছোতে না পারে? দাদা আর কাকা চলে যাবে, না ফিরে আসবে? ওরা টিকিট নিয়ে গেছে, ওরা নিশ্চয়ই ট্রেন থেকে আর নামবে না।

প্রতাপ শান্ত ভাব বজায় রেখে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন, কিন্তু মমতা একেবারে অধৈর্য হয়ে উঠলেন। তাঁর ফর্সা মুখোনিতে সবরকম অভিব্যক্তি স্পষ্ট বোঝা যায়। বরং কখনো যেন বেশি বেশিই লাগে। একটা সিল্কের লাল পাড় শাড়ি পরেছেন মমতা, ঘোমটা নেমে গেছে, মুখের ওপর কয়েকটি চূর্ণ অলক। ব্রিজের ওপর নানারকম গাড়ি ঘোড়ার ভেঁপু ও মানুষের চিৎকারে। একটা বিচিত্র কলরোল।

মমতা আতঙ্কিতভাবে স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হবে? আমরা এইরকম চুপ করে বসে থাকবো?

প্রতাপ বললেন, কী করবো? এত মোটঘাট নিয়ে…অতবড় বেডিং নিতে আমি বারণ করেছিলাম না?

মমতা বললেন, শীতের জায়গায় যাচ্ছি, লেপ নিতে হবে না? তুমি কুলি ডাকো।

শেষ পর্যন্ত তাই-ই হলো। জ্যাম গলবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। কুলিরা মওকা বুঝে স্টেশন ছেড়ে ব্রিজের ওপর এসেসব গাড়িতে মাথা গলাচ্ছে। আট আনা রেট, এখন তারা দেড় টাকার কমে যাবে না। তিনটি কুলির মাথায় চাপানো হলো সব কিছু। ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ানটি কোনো দরাদরি করলো না, প্রতাপ তাকে একটি পাঁচ টাকার নোট দিতে সে লম্বা সেলাম দিয়ে বললো, যান বাবু, ভালো করে ঘুরে আসুন। কাশীর গাড়ি তো, পেয়ে যাবেন, চিন্তা নেই।

বাবলু ছুট লাগাতে যাচ্ছিল, প্রতাপ তাকে ধমক দিয়ে হাত চেপে ধরলেন। অতি দুরন্ত ছেলে, ভিড়ের মধ্যে একবার হারিয়ে গেলেই হয়েছে আর কি! কুলিদের ওপরেও নজর রাখতে হবে, ওরা মাথায় মোট নিয়েই বড্ড জোরে দৌড়োয়।

শীতের সময়টায় অনেকেই পশ্চিমে বেড়াতে যায়, তাই হাওড়া স্টেশনে প্রচুর জনসমাগম। মোগলসরাই প্যাসেঞ্জার প্ল্যাটফর্মে লেগে গেছে, কিন্তু চতুর্দিকে এত মানুষের মাথা যে কানু বা পিকলুকে দেখা যাচ্ছে না। কোন্ কামরায় উঠলো ওরা? ফার্স্ট ক্লাস, সেকেণ্ড ক্লাস, ইন্টার ক্লাস, থার্ড ক্লাস। এর মধ্যে থার্ড ক্লাসেই কোনো আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই, তার ফলে কুমড়ো গাদাগাদি অবস্থা। কোনো দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকবার উপায় নেই। প্রত্যেকটা থার্ড। ক্লাস কম্পার্টমেন্টের কাছে গিয়ে প্রতাপ বেশ জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন, কানু! পিকলু!

শেষ পর্যন্ত একটা কামরার জানলা দিয়ে বেরিয়ে এলো পিকলুর হাত। সেটা যে-কোনো কিশোরের হাত হতে পারতো, কিন্তু মমতা দেখেই চিনলেন। নানারকম উৎকণ্ঠার মধ্যেও বাবলুর একটু ক্ষোভ হলো। দাদাটা বড়দের দলে চলে যাচ্ছে। তাকে ফেলে। এরপর কানুকাকার মতন দাদাও সিগারেট খেতে শিখবে।

বাবলু আর মুন্নিকে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো জানলা দিয়ে। তারপর শুরু হলো কুলিদের দাপট, দরজার কাছে এক তিল জায়গা নেই মনে হয়েছিল, তবু একটার পর একটা মালপত্র ঢুকে যেতে লাগলো, প্রকাণ্ড বেডিং-এর ধাক্কাতেই অনেকখানি ফাঁকা হয়ে যেতে প্রতাপ আর মমতা উঠে পড়লেন সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে।।

কানু ওপরের একটি বাঙ্কে শুয়ে পড়েছে, আর নিচের বেঞ্চে এক কোনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে সামনে পা ছড়িয়ে বসে আছে পিকলু। তার অধিকৃত জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে আসছে ক্রমশ। কোনোরকম প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়ে বাবলু বললো, আমি ওপরে ছাড়া কিছুতেই বসবো! আমি ওপরে যাবো!

সে চলে গেল ওপরে। মমতার নিজস্ব ছোট বাক্সটি রাখা হলো কানুর হেফাজতে। নিচের জায়গাটুকুতে মমতা আর প্রতাপ বসলেন কোনোক্রমে। এই নভেম্বর মাসেও কপালে ঘাম জমে গেছে। সামনে মানুষের দেয়াল, বিকিরিত হচ্ছে মানুষের শরীরের উত্তাপ। গাড়ি ছাড়তে দেরি আছে এখনও।

প্রতাপের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি দেহাতী স্ত্রীলোক, বুকের কাছে একটি বাচ্চা। বছর খানেক বয়েস হবে বাচ্চাটির, বেশ মোটকা সোটকা। স্ত্রীলোকটির শাড়ীটি মাটি বর্ণ, খুব সম্ভবত কলকাতা শহরে এরা মাটি বিক্রি করতে আসে। এই শ্রেণীর যাত্রীরা কখনো ট্রেনের টিকিট কাটে না। দৈবাৎ চেকার এলে এক টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দেয়।

প্রতাপ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সেই স্ত্রীলোকটিকে বললো, আপনি বসুন!

মমতা অবাক হলেও কিছু বললেন না। তিনি জানেন, তাঁর স্বামীর এই ধরনের উটকো ইচ্ছের প্রতিবাদ জানিয়ে কোনো লাভ নেই। এই শ্রেণীর স্ত্রীলোকদের দাঁড়িয়ে যাওয়ার অভ্যেস আছে। সারা রাত ঠায় দাঁড়িয়ে যেতে প্রতাপেরই কষ্ট হবে খুব।

স্ত্রীলোকটিও ব্যাপারটি বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়েই রইলো। প্রতাপ আবার আদেশের সুরে গম্ভীরভাবে বললেন, আপ বৈঠিয়ে!

মমতার পাশের লোকটি এই সুযোগে কয়েক ইঞ্চি সরে আসছিল, প্রতাপ চোখ গরম করে তাকালেন তার দিকে।

দেহাতী স্ত্রীলোকটি তাতেও বসছিল না, মমতাকেই তখন তাঁর স্বামীর ইচ্ছা পূরণে সাহায্য করতে হলো। তিনি ঐ স্ত্রীলোকটির হাত ধরে টেনে নরম করে বললেন, তুম বৈঠো, বাবু ছোড়। দিয়া, তুমারা সাথমে বাচ্চা হ্যায়।

পিকলু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, বাবা, আপনি এখানে আসুন!

প্রতাপ উদাসীনভাবে বললেন, না, তুই বোস।

মমতা পিকলুকে চোখের ইঙ্গিতে বসতে বলে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রতাপের মনের অবস্থাটা তিনি অনেকটা বুঝতে পারছেন। পাঁচ-সাত বছর আগেও প্রতাপ ফাস্ট ক্লাস ছাড়া ট্রেনে চাপতেন না। গত পুজোর আগের পুজোয় খুলনা যাওয়া হয়েছিল সেকেণ্ড ক্লাসে। এবারেই প্রথম সপরিবারে তাঁর থার্ড ক্লাসে ওঠার অভিজ্ঞতা। এবারে দেওঘর যাওয়ার প্রস্তাব উঠতেই মমতা বলেছিলেন, থার্ড ক্লাসে যেতে তাঁর একটুও কষ্ট হবে না। ছেলে মেয়েদের কষ্ট? ওদেরও তো সব রকম অবস্থা সইয়ে নিতে হবে। এখন থেকেই শিখুক, তা হলে ভবিষ্যতে সব কিছু সহ্য করতে পারবে। ভবিষ্যৎটা যেন ক্রমশ পাতালের দিকেই নেমে যাচ্ছে।

প্রতাপের আত্মাভিমান প্রবল। তিনি বিলাসী নন, কষ্টসহিষ্ণু। প্রবল রোদের মধ্যেও তিনি। মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে পারেন। নুন দেওয়া ফেন ভাত আর আলু সেদ্ধ খেলেও তাঁর তৃপ্তি হয়। কিন্তু নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে তিনি তেমন আরাম-সম্ভোগ দিতে পারছেন না, যেমন তিনি নিজের বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন, এই চিন্তা তাঁকে পীড়া দেয়। মমতাও সচ্ছল পরিবার থেকে এসেছেন, তাঁর কৃচ্ছুতার পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই, তবু তিনি বেশ মানিয়ে নিতে পারছেন। প্রতাপ অসহিষ্ণু।

জসিডি পৌঁছোতে রাত ভোর হয়ে যাবে। প্রতাপ দাঁড়িয়ে থাকলে মমতার চোখেও ঘুম। আসবে না।

বাবাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে বাবলুও অবাক হয়ে গেছে। তার এখন যা বয়েস তাতে আরও দাও, আরও চাই, এই ভাবটাই বেশি থাকে, কারু জন্য কিছু ছেড়ে দেবার কথা মানে আসে না। সে ফিস ফিস করে কানুকে জিজ্ঞেস করলো, ছোটকা, বাবা কি ওপরে আসবে?

কানুও তার সেজদাকে খানিকটা চেনে। সে জানে যে এখন কিছু বলতে গেলেই ধমক খাবে। ঐ বিহারী মেয়েলোকটির কোলে যে বাচ্চাটা, তার একটা পা ঝুলছিল, সেই পা বোধহয় একবার সেজদার মুখে লেগেছে, তাই সেজদা জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ঐটুকু বাচ্চার ওপর তো রাগ করতে পারে না। কানুর শুধু একটাই মুশকিল হলো, সেজদা দাঁড়িয়ে থেকে ওপরটা দেখতে পাচ্ছে। এই অবস্থায় সে সিগারেট টানতে পারবে না।

কানু প্রতাপের বৈমাত্রেয় ভাই। অনেকদিন পর্যন্ত সে তার মামাদের কাছেই ছিল। বড় মামার মৃত্যু হবার পর তাকে প্রতাপের কাছেই আশ্রয় নিতে হয়েছে। আই এ পরীক্ষায় একবার ফেল করার পর তার আর পড়াশুনো হয় নি, তারপর থেকে সে একটানা চাকরি খুঁজে যাচ্ছিল। পরীক্ষায় পাশ না করতে পারলেও কানুর এক ধরনের বুদ্ধি বেশ তীক্ষ্ণ। সে জানে, বেশিদিন বেকার থাকলে তার পথের কুকুরের মতন অবস্থা হবে। স্বাধীনতার পর শুধু ছাঁটাই আর ছাঁটাইয়ের রবই শোনা গেছে, নতুন চাকরি একটাও তৈরি হয় নি। তার পাড়ার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলে, শ্মশান ঘাটে গিয়ে বসে থাক, দ্যাখ, রিটায়ার করার আগে কে কে মলো। সেই সেই অফিসে ছুটে যাবি। কানু নিজস্ব উপায় বার করে মাঝে মাঝেই পঁচিশ-তিরিশ টাকা উপার্জন করে আনতে লাগলো। লম্বা, পাতলা চেহারা তার, চোখ দুটি ঝকঝকে। প্রতাপের মতন তার মুখে ব্যক্তিত্বের ছাপ নেই, তাতে তার সুবিধেই হয়েছে, সে অনায়াসে ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকতে পারে।

উপার্জনের টাকাটা সে প্রতাপ কিংবা মমতার হাতে দিতে সাহস পায় না। সংসারের সুরাহার জন্য সে মাঝে মাঝে কয়লা, আটা কিংবা মাছ কিনে আনে। প্রতাপ অনেকদিন পর্যন্ত তাঁর এই ছোট ভাইটির উপার্জনের ব্যাপারটা টের পাননি, একদিন জানতে পেরে চেপে ধরলেন। চাকরি করে না, টিউশানি করে না, তবু কানু টাকা পায় কোথা থেকে? চুরি বা জোচ্চুরি ছাড়া তো কলকাতা শহরে এমনি এমনি টাকা পাওয়া যায় না।

কানুর উপার্জনের পথটি পুরোপুরি অবৈধ নয়। বরং বলা যেতে পারে এক ধরনের ব্যবসায়ের উদ্যোগ। সে কন্ট্রোলের শাড়ী কিনে এনে বাজারের সামনের ফুটপাথের দোকানে বেচে দেয়। কানুর সময়ের অভাব নেই। কন্ট্রোলের শাড়ীর দোকানের সামনে লম্বা লম্বা লাইন পড়ে, কানু সারা দিন সেই লাইনে দাঁড়ায়। প্রতি শাড়ীতে দু’টাকা তিন টাকা মুনাফা।

শাড়ী যখন সহজে পাওয়া যেতে লাগলো, তখন কানু চলে এলো কয়লায়। কয়লারও রেশন। এখন দেশে প্রায়ই কোনো না কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। সরকার তখন সেগুলি কন্ট্রোল দরে দেবার চেষ্টা করে। সেটা একটা নিয়ম রক্ষা মাত্র, অতি অল্প লোকেই তা পায়। যারা পায়, তাদের মধ্যেও আবার কানুর মতন মানুষই বেশি।

প্রতাপ এই বৃত্তান্তটি শুনে তার বাইশ বছর বয়েসী ভাইয়ের গালে ঠাস ঠাস করে দুটি থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন, হারামজাদা, তোর লজ্জা করে না? তুই কোন বংশের ছেলে তা তোর খেয়াল নেই? ফের যদি এরকম নোংরা কথা শুনি তা হলে আমার বাড়িতে তোর স্থান হবে না। বস্তিতে গিয়ে থাকবি!

সেই ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায় কানু নিজের গালে একবার হাত বোলালো। দাদার ওপর তার রাগ নেই, বরং একটা করুণার ভাব আছে। সেজদা সব সময় সতোর গর্ব করে, অশেষ দুঃখ আছে সেজদার কপালে। এই যুগটাই যে অন্যরকম।

গত বছরের গোড়ার দিকে প্রতাপ অবশ্য বহু চেষ্টা করে কানুর জন্য একটা চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। সাধারণ চাকরি, তবু যা হোক, সরকারি, বাঁধা মাইনে। চাকরিটা কানুর খুব পছন্দ। কারণ এরই মধ্যে সে ঐ সাধারণ চাকরির দেয়াল ফুটো করে উপরি রোজগারের পথ খুঁজে পেয়েছে।

চলতে শুরু করেছে ট্রেন। বাতাস চলাচল করতেই আর আগের মতন অত ভিড় বোধ হয় না। চলন্ত ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কিছুটা জায়গা বেরিয়ে আসে। দাঁড়ানো মানুষগুলো কেউ কেউ এদিক সেদিকে একটুখানি করে নিতম্ব ছোঁয়ানোর ব্যবস্থা করে নেয়।

প্রতাপ দাঁড়িয়েই রইলেন। তাঁর মুখোনি বিমর্ষ, তিনি কারু দিকে চেয়ে নেই, শূন্য দৃষ্টি। তার হাতে একটি সিগারেট, কিন্তু আগুন জ্বালানো হয় নি, সেটাই মাঝে মাঝে ঠোঁটে ছোঁয়াচ্ছেন।

বাবলু এখনও বুঝতে পারছে না, বাঙ্কের ওপরে বসা আর নীচে বসার মধ্যে কোনটা বেশী। ভালো। সে ভেবেছিল, ওপরে বসার মধ্যে একটা বড় বড় ভাব আছে। তা ছাড়া বাবা যখন তখন বকুনি দেন বলে সে বাবার কাছাকাছি থাকতে চায় নি। কিন্তু দাদাটা মায়ের পাশে বসেছে, জানলা দিয়ে বাইরের কত কিছু দেখছে। ওপর থেকে শুধু মানুষ ছাড়া আর কিছুই। দেখা যায় না। ট্রেন ছাড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝিমোতে শুরু করেছে অনেকে।

কানু ফিসফিস করে বললো, দেখছিস বাবলু, তোর বাবার খুব মন খারাপ। আমরা এত কষ্ট করে ট্রেনে জায়গা করলুম, তবু জায়গা ছেড়ে দিলেন। কেন বল তো?

বাবলু মন খারাপ-টারাপ তেমন বোঝে না। সে শেষ প্রশ্নটির জের টেনে পাল্টা প্রশ্ন করলো, কেন? কিসের জন্য মন খারাপ!

কানু মুচকি হেসে বললো, আমরা উল্টো দিকে যাচ্ছি যে!

বাবলু তবু বুঝতে পারলো না। তবে কি তারা দেওঘরে ঠাম্মার কাছে যাচ্ছে না, রেলগাড়িটা ভুল দিকে ছুটে যাচ্ছে?

কানু আবার বললো, এই দিকে তো আমাদের দেশ নয়। আমাদের দেশ ছিল অন্যদিকে।

দরজার কাছে দু চারজন ছাড়া কামরার মধ্যে প্রতাপ ছাড়া প্রায় আর কেউই দাঁড়িয়ে নেই। এখন কিছুটা চাপাচাপি করে প্রতাপ কোনোক্রমে বসতে পারেন, কিন্তু মমতার দু’ তিনবার অনুরোধেও প্রতাপ রাজি হননি। অচেনা মানুষদের সঙ্গে গায়ে গা সেঁটে ঘাম বিনিময় করতে তাঁর ঘৃণা হয়। প্রতাপ অবশ্য একদিকের দেয়ালে হেলান দেবার সুযোগ পেয়েছেন, হাত দুখানি বিবেকানন্দের ভঙ্গিতে বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা। তাঁর মতন। একজন বলিষ্ঠ, দীর্ঘকায় মানুষকে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখতে অন্যদের অস্বস্তি হচ্ছে, সাধারণত এই ধরনের মানুষরাই অনেকখানি জায়গা অধিকার করে বসে। অন্যদের বিস্মিত দৃষ্টি এড়াবার জন্য প্রতাপ চোখ বুজে রইলেন। কিন্তু তাঁর মুখের অভিমানের রেখা গোপন করতে পারলেন না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়