বৈদ্যনাথধাম স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বনাথ গুহ। গুণ গুণ করে আশাবরী রাগে সুর ভাঁজছেন। ভালো করে এখনো ভোর হয়নি, এখানে-সেখানে ঝুলছে অন্ধকার। এরই মধ্যে প্ল্যাটফর্মে অনেক মানুষ-জন, অধিকাংশই পাণ্ডা ও মুটে, আরও কেউ কেউ ভোরের দিকে স্টেশনে বেড়াতে আসে, নতুন মুখ দেখবার জন্য।

সদ্য শীত পড়তে শুরু করেছে, বিশ্বনাথের গায়ে একটা নস্যি রঙের চাঁদর, ধুতিটা মোটা খদ্দরের, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি। মুখ ভর্তি দাড়ি, মাথায় বাবড়ি চুল, হাতে মোটা চুরুট। রাত্রে শোবার সময় তিনি যে চুরুটটা নিভিয়ে রাখেন, ঘুম থেকে উঠেই তাঁর প্রথম কাজ সেই চুরুটটাকে ধরানো। অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় কেউ তাঁকে চুরুট ছাড়া দেখেনি।

ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি আপন মনে গুণগুনিয়ে যেতে পারেন, অন্য কোনোদিকে তাঁর খেয়াল থাকে না। সহকারি স্টেশন মাস্টার রামরতন মিশ্র তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তিনি দেখতে পেলেন না; তিনি তখন টোড়িতে চলে গেছেন।

–রাম রাম গুহাজী! এত বিহানে চলে এসেছেন! কেউ আসবে নাকি? গান থামিয়ে বিশ্বনাথ রেল বাবুটির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তারপর যেন সহসা চিনতে পেরে বললেন, রাম রাম মিশ্রজী! আপনার কথা মনেই ছিল না। তা হলে এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে আপনার ঘরে চা খেতে যেতাম।

মিশ্রজী বললেন, চলেন তো, এখন চলেন, চায়ের ব্যবস্থা হোয়ে যাবে। কিংবা, এখানেই খান?

অদূরে এক চা-গারা ছোঁকরাকে দেখতে পেয়ে মিশ্রজী হাঁকলেন, আরে এ লেড়কে, ইধার চায়ে লা!

চা-ওয়ালাটি এর আগে বিশ্বনাথের আশপাশ দিয়ে দু তিনবার হেঁকে গেছে, বিশ্বনাথের হুঁসই হয়নি, অথচ তাঁর চায়ের তেষ্টা পেয়েছে বেশ।

ভাঁড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে বিশ্বনাথ জিজ্ঞেস করলেন, গাড়ি লেট আছে নাকি?

–না, জসিডি পঁহুছে গেছে। এই তো এই মাহিনা থেকে চেঞ্জারদের ভিড় শুরু হলো, সব জিনিসপত্তর মাংগা হোবে। দুধ তো মিলবেই না।

–মন্দিরের কাছে আপনার শালার প্যাঁড়ার দোকান আছে না? চেঞ্জাররা এলে তারও তো বিক্রি বাড়বে? সব দোকান এই সময়টার জন্যই হাঁ করে থাকে।

–আমার শালার নাফা হবে, তাতে আমার কী? সে শালা কী আমাকে ভাগ দিবে? আপনার কেউ আসছে নাকি?

–হ্যাঁ। আসছে, শ্বশুরবাড়ির লোকজন।

–তবে তো গুহাজী আপনার বেশ গাঁট গচ্ছা যাবে! ভালো চাউল এখন পঙ্গুরো টাকা মন, আউর বাড়বে!

বিশ্বনাথ চুরুটে টান দিতে লাগলেন। সকালবেলাতেই টাকা পয়সার কথা তাঁর একেবারে পছন্দ হয় না। টাকা যখন থাকে না, তখনই তো টাকার চিন্তা করা দরকার। অথচ, আশ্চর্য, দুনিয়ায় যাদের টাকা আছে, তারাই টাকা পয়সা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়।

দূরে ট্রেনের শব্দ পাওয়া যেতেই মিশ্রজী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ভিড়ের মধ্যে আরও কয়েকটি চেনা মুখ চোখে পড়লো বিশ্বনাথের। তিনি আবার সর-গ-ম ধরলেন। ট্রেনের হুইলে ঠিক যেন কড়ি মধ্যম লাগে।

কয়লার ধোঁয়ায় প্ল্যাটফর্মটি ভরিয়ে দিয়ে ইঞ্জিনটি এসে থামলো ঠিক বিশ্বনাথের সামনেই। পাণ্ডা আর মুটেরা হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিল। বিশ্বনাথ ব্যস্ত হলেন না, একটু দূরে সরে গেলেন, পাণ্ডাদের গায়ে বড় গন্ধ হয়!

প্রথমে নামলো কানু, সে এদিক ওদিক তাকিয়ে বিশ্বনাথকে একবার দেখেও চিনতে পারলো না। কয়েকজন পাণ্ডা তাকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, পিতার নাম কী? পিতামহর নাম কী? আদি নিবাস কোথায়?

পিকলুই প্রথম চেঁচিয়ে উঠলো, পিসেমশাই! তারপর সে দৌড়ে এসে বিশ্বনাথকে প্রণাম করলো।

বিশ্বনাথ তার থুতনি ছুঁয়ে আদর করে বললেন, কত বড় হয়ে গেছিস রে! গোঁফ উঠে গেছে দেখছি! হ্যাঁরে, রাস্তায় কোনো কষ্ট হয়নি তো?

কানু মালপত্রের তদারকি করতে লাগলো, প্রতাপ এগিয়ে এসে বললেন, ওস্তাদজী! আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনি আপনাকে। দাড়ি রাখলেন কবে থেকে?

শালা এবং জামাইবাবু কেউ কারুর নাম ধরে ডাকেন না। প্রতাপ যেমন ওস্তাদজী বলেন, বিশ্বনাথও তেমনি প্রতাপকে বলেন ব্রাদার। দু’জনের বয়েসের তফাৎ প্রায় দশ বছর। বিশ্বনাথের চুল কালো হলেও দাড়িতে বেশ পাক ধরেছে।

পুজোর পরে দেখা, তাই আগে কোলাকুলি সেরে নেওয়া হলো। বিশ্বনাথ বললেন, পিকলু কিন্তু এক নজর দেখেই আমাকে চিনেছে। মেরিটোরিয়াস ছেলে। হ্যাঁ, গতবছর থেকে দাড়ি রাখছি, জীবনে আর কোনোদিন দাড়ি কামাবো না ঠিক করেছি। একটা অকারণ পরিশ্রম বাদ গেল, বুঝলে না!

মমতাকে দেখে বিশ্বনাথ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এত রোগা হয়েছো কেন, মুমি? এখানে কিছুদিন থাকো, তোমার শরীর একেবারে নবদুর্গার মতন করে ছাড়বো। আর সব কই? বড়দিরা এলেন না?

প্রতাপ নিচু গলায় বললেন, না, ওঁদের আসা হলো না। বড় জামাইবাবুর অসুখ।

–কী অসুখ? খবর পাইনি তো কিছু!

প্রতাপ কথা ঘুরিয়ে নিলেন। বড় জামাইবাবুর অসুখ সাজান। আসল ব্যাপার হলো, হঠাৎ তাঁর চাকরি গেছে। পরিবারের সকলের ট্রেন ভাড়া সংগ্রহ করে তাঁর পক্ষে বেড়াতে আসা সম্ভব নয়। প্রতাপ অবশ্য ওঁদের টিকিট কাটতে চেয়েছিলেন, বড় জামাইবাবু রাজি হননি।

কয়েকটি নাছোড়বান্দা পাণ্ডা তখনও ওদের ঘিরে চিলুবিলু করছে, বিশ্বনাথ দু’হাত তুলে তাদের বাধা দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, দেখিয়ে জী, ম্যায় তো খুদ-ই এক পাণ্ডা হ্যায়। ইয়ে সব লোক হামারা যজমান।

কানু মুটেদের মাথায় মালপত্র চাপাচ্ছে, মমতা হঠাৎ আর্ত স্বরে বললেন, বাবলু কোথায়?

প্ল্যাটফর্ম অনেকখানি ফাঁকা হয়ে এসেছে, চতুর্দিকে চেয়ে বাবলুর চিহ্নমাত্র চোখে পড়লো না। তাকে কেউ ট্রেন থেকে নামতেও দেখেনি। কানু আর পিকলু বাবলুর নাম ধরে ডেকে ছোটাছুটি শুরু করে দিল।

ছোট্ট মেয়ে মুন্নি এখনও সুযোগ পেলেই মুখে আঙুল পুরে দেয়। মমতা দেখতে পেলেই বার করে দেন, বকুনি দিয়ে বলেন, তুই কি খেতে পাস না যে সবসময় নিজের আঙুল খাস! চার বছরের মুন্নি বেশ চটাস চটাস কথা বলে। পিকলুকে সে দাদা বললেও বাবলুকে সে নাম ধরে ডাকবেই। সে মুখ থেকে লালাসিক্ত আঙুল বার করে গেটের দিকে দেখিয়ে বললো, বাবলুটা ভীষণ পাজি! ঐদিক দিয়ে একা একা চলে গেল!

কলকাতায় ঘোড়ার গাড়ি, দেওঘরে টাঙ্গা। স্টেশনের বাইরে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। টিকিট চেকারের পাশ দিয়ে গলে বেরিয়ে এসে বাবলু একটা টাঙ্গার একেবারে ওপরে উঠে বসে আছে গাড়োয়ানের পাশে। নীল রঙের হাফ প্যান্ট আর নীল হাফ শার্ট গায়। তার বেশ শীত করছে। ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়ার পর মা তার গায়ে একটা চাঁদর চাপা দিয়েছিল, সেটা সে ট্রেনেই রেখে এসেছে। কলকাতায় শীত নেই, অথচ এখানে ঠাণ্ডা। বাবলুর ভারি আশ্চর্য লাগে। ইস্কুলের ভূগোল বইয়ের জ্ঞান তার মনে পড়ে না। কাল ছিল গরম দেশে, আজ চলে এলো শীতের দেশে।

গাড়োয়ানকে সে তাড়া দিয়ে বললো, চলো, যাবে না? আমাদের বাড়ি চলো? আমি আগে আগে যাবো। ঠাকুমা পয়সা দিয়ে দেবে!

সদলবলে বাইরে এসে প্রতাপ বাবলুকে ঐ অবস্থায় আবিষ্কার করে ক্রুদ্ধ হলেন। আঙুল তুলে তিনি পিকলুকে আদেশ করলেন, যা তো, পাজীটার কান ধরে টেনে নিয়ে আয় এখানে।

পিকলু একপলক মায়ের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেল।

মমতার বুক ধড়াস ধড়াস করছিল। বাবলু যা ছেলে, মাঝরাত্তিরে কোনো স্টেশনে নেমে যাওয়া তার পক্ষে বিচিত্র কিছু নয়। ভোর রাতে অনেকক্ষণ জসিডিতে ট্রেন থেমেছিল, তখন ঘুমে চোখ টেনে এসেছিল মমতার। তারপর থেকে তিনি আর বাবলুকে দেখেন নি। এখন বাবলুকে দেখতে পেয়ে তিনি একটা স্নিগ্ধ শিহরন বোধ করলেন। দেওঘরের বাতাস তাঁকে শান্তি দিল।

অন্য লোকজনের সামনে মমতা তাঁর স্বামীর কথার প্রতিবাদ করেন না। আবার প্রতাপের সব মতামত তিনি মেনেও নেন না। প্রতাপের চোখে চোখ রেখে তিনি নিঃশব্দে জানিয়ে দিলেন, এখন বাবলুকে কোনো শাস্তি দেবার দরকার নেই।

পিকলু অতি শান্ত ও নম্র ছেলে। সদ্য সে স্কুল ফাঁইনালে চতুর্থ স্থান অধিকার করে জলপানি পেয়েছে। সে তার ছোট ভাইয়ের ঠিক বিপরীত। বাবলু যেমন পড়াশুনোয় অমনোযোগী, সেইরকমই কথার অবাধ্য। সব সময় তার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি ঘোরে। এই জন্য শাস্তিও পায় যথেষ্ট, তবু তার গ্রাহ্য নেই। পিকলু ছোটভাইকে আড়াল করার চেষ্টা করে যথাসাধ্য।

পিকলু বুঝতে পারলো, নতুন জায়গায় বেড়াতে এসেই বাবলু মার খাবে বাবার হাতে। প্রতাপ জেদ করে সারা রাত প্রায় দাঁড়িয়ে এসেছেন, তা ছাড়া অন্য কারণেও তাঁর মেজাজ ভালো নেই। তিনি প্রত্যেক বছর পূজোর সময় দেশের বাড়িতে যেতে ভালোবাসতেন। গত দু’বছর যাওয়া হয়নি।

পিকলু কাছে এসে কিছু বলবার আগেই বাবলু বললো, দাদা, পাহাড় কোথায় রে? পাহাড় তো দেখতে পাচ্ছি না?

–বাবলু, নেমে আয়।

–না, আমি এইখানে বসবো।

পিকলু ওপরে উঠে এসে ফিসফিস করে বললো, বাবার কাছে মার খাবি তুই! শিগগির গিয়ে পিসেমশাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়া। পিসেমশাই বাঁচিয়ে দেবেন।

বাবলু তবু গোঁজ হয়ে বসে রইলো।

সেই টাঙ্গার গাড়োয়ান সুযোগ বুঝে তড়াক করে নেমে গিয়ে মালপত্র ধরে টানাটানি করতে লাগলো। অর্থাৎ তার টাঙ্গা তো ঠিক হয়ে গেছেই, দরদামের আর প্রশ্ন নেই।

বাবলু জেদ ছাড়েনি, ওপর থেকে নামলোই না কিছুতেই। বিশ্বনাথ বললেন, বাঃ, বেশ মানিয়েছে, বাবলু, তোকে ঠিক গাড়োয়ানের অ্যাসিস্টেন্টের মতন দেখাচ্ছে।

প্রতাপ এমনভাবে তাকালেন, যার অর্থ, আচ্ছা, পরে তোমার হবে!

বিশ্বনাথ আবার বললেন, আমি টাঙ্গা চালাতে পারি। জানো, ব্রাদার, আগ্রায় থাকতে আমি বেশ কিছুদিন টাঙ্গা চালিয়ে রুজি-রোজগার করেছি। কী, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যিই।

বিশ্বনাথ সম্পর্কে কিছুই অবিশ্বাস্য নয়। জীবনের অনেকগুলি বছর তিনি বাউণ্ডুলেপনা করে কাটিয়েছেন। গ্রাম থেকে কলকাতার কলেজে পড়তে এসে তাঁর গানের নেশা চাপে। পাথুরেঘাটার ঘোষ বাড়িতে টিউশানি করতেন, সেই সূত্রে অনেক বড় বড় ওস্তাদ কলাকারদের সামনাসামনি দেখার সুযোগ পান। ক্রমে তাঁর ঝোঁক চাপলো তিনি মার্গ সঙ্গীতের সম্রাট ফৈয়াজ খাঁর কাছে নাড়া বাঁধবেন। বি এ পরীক্ষা না দিয়ে, অভিভাবকদের কিছু না জানিয়ে চলে গেলেন আগ্রায়। ফৈয়াজ খাঁ প্রথমে তাঁকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হননি। বলেছিলেন, বেটা, দু ঠোঁটের মাঝখানে একটা সূচ বসিয়ে তিন বচ্ছর শুধু সা সেধে যা, তারপর আমার কাছে আসবি!

তাতেও দমে যাননি বিশ্বনাথ, বাড়ি ফিরে আসেননি, বাড়ি থেকে টাকা পয়সাও চাননি। ঐ সব অঞ্চলেই ঘুর ঘুর করেছেন। পরে প্রতাপ যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঐ সময় আপনার চলতো কী করে, ওস্তাদজী? উত্তরে বিশ্বনাথ হাসতে হাসতে শঙ্করাচার্যের মোহমুদগর থেকে আবৃত্তি করতেন একটি স্রোত্র :

সুরমন্দির-তরুমূল-নিবাসঃ
শয্যা ভূতলমজিনং বাসঃ।
সর্ব পরিগ্রহ–ভোগত্যাগঃ
কস্য সুখং ন করোতি বিরাগঃ ৷৷

আগ্রা, পুণা, এলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ, দিল্লি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একসময় মায়ের অসুখের খবর শুনে বিশ্বনাথ দেশের বাড়িতে ফেরেন। মাকে তিনি ভালোবাসতেন অনেকটা অন্ধের মতন, শিশুর মতন, সাধকের মতন। প্রায় মৃত্যু শয্যাশায়ী মায়ের অনুরোধে তিনি বিয়ে করলেন, সংসারী হবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর অবশ্য সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার দায় আর রইলো না, আবার শুরু হলো ছন্নছাড়া জীবন।

প্রতাপের দুই দিদি, তার মধ্যে শান্তি আর তিনি প্রায় পিঠোপিঠি। এই শান্তির সঙ্গে যখন বিশ্বনাথের বিয়ে হয়, তখন প্রতাপ তাঁর এই জামাইবাবুটিকে বেশ পছন্দ করেছিলেন। রূপবান, হাসিখুশী, দিলদরিয়া মানুষ, স্বভাবে কোনো মালিন্য নেই। বিয়ের পর মাত্র কিছুদিন বিশ্বনাথ ব্যবসায়ে নেমে অর্থ উপার্জন করতে চেয়েছিলেন, রঙের কারবার, ছ’ সাত মাসের মধ্যেই সে কারবার লাটে ওঠে। আবার বিবাগী।

বিশ্বনাথ গান শিখতে গিয়েছিলেন শেখার আনন্দেই, গানকে পেশা করতে পারেননি। এরকম মানুষ থাকে, যারা নিজেদের চারপাশটা গুছিয়ে নিতে জানে না। কোনো কিছু জমিয়ে রাখার চেয়ে বিলিয়ে দিতেই যাদের বেশি আনন্দ। বেঁচে থাকার মধ্যে আনন্দটাই তো সবচেয়ে বড় যে যাতে আনন্দ পায়।

বিশ্বনাথের গান শুনে তারিফ করে কেউ কেউ যখন জিজ্ঞেস করতো, আপনি কোনো জলসায় গান করেন না কেন? রেকর্ড করান না কেন? উত্তরে বিশ্বনাথ বরাবর বলে এসেছেন, আমার গুরুর নিষেধ আছে। ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ কিছুদিন তালিম দেবার পর নাকি এই বাঙালী শিষ্যটিকে বলেছিলেন, বেটা, তোকে আমি যা জিনিস দিচ্ছি, তুই গলায় তুলে যা, কিন্তু আমি হুকুমনামা না দিলে তুই কোনোদিন পাবলিক ফাংশানে গান করবি না! ব্যস, এরপর খাঁ সাহেব বিশ্বনাথকে হুকুমনামা দিতে ভুলে গেছেন, বিশ্বনাথও কোনোদিন নিজে থেকে মুখ ফুটে অনুমতি চাননি। তারপর তো ফৈয়াজ খাঁ মারাই গেলেন, বিশ্বনাথেরও পাদপ্রদীপের সামনে যাওয়া হলো না।

কে জানে একথাটা সত্যি কি না! তবে বিশ্বনাথ খুব সন্তোষের সঙ্গেই এই কাহিনীটা বলতে ভালোবাসেন।

বেশ দিন কাটছিল, মাঝে মাঝে বিশ্বনাথ দেশে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আবার উধাও হয়ে যেতেন। তাঁর বিপদ ঘটলো ভারত স্বাধীন হবার পর। স্বাধীনতা মানেই দেশ ভাগ। কানপুরে বসে বিশ্বনাথ শুনলেন বরিশাল জেলায় তাঁর পৈতৃক বাড়িটি এখন অন্য দেশ হয়ে গেছে। তাঁকে ঠিক করতে হবে, তিনি এখন কোন্ দেশের নাগরিক হবেন। কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলো না, কেউ তাঁর মতামত নিল না, অথচ তাঁর বাড়িটা অন্যদেশে চলে গেল? বিশ্বনাথ মাথা ঘামালেন না, ফিরলেন না, কালক্রমে বে-দখল হয়ে গেল সেই বাড়ি।

অল্প কিছুদিন মাত্র শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন শান্তি, তারপর থেকে নিজের মায়ের কাছেই। বিক্রমপুরের মালখানগরে প্রতাপদের পরিবার বেশ সচ্ছল ছিল। মেয়ের বিয়ের পর সেই মেয়ের বাপের বাড়িতেই থেকে যাওয়াটা পূর্ববঙ্গে তেমন কিছু অস্বাভাবিক ছিল না।

প্রতাপের বাবা ভবদেব মজুমদার ঘোরতর বিষয়ী এবং আশাবাদী মানুষ ছিলেন। দেশ বিভাগ তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি।

হিন্দুস্থান-পাকিস্তান তাঁর কাছে অবাস্তব মনে হতো। এতকালের সব চেনা মানুষ কখনো হঠাৎ শত্রু হয়ে যেতে পারে? পিতৃপুরুষের ভূমি কেউ ছেড়ে চলে যায়? তিনি শ্রীঅরবিন্দের ভক্ত ছিলেন। শ্রীঅরবিন্দ নাকি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে,দশ বছরের মধ্যেই দুই খণ্ড আবার মিলিত হয়ে যাবে। ১৭৫৭-তে পলাশীর যুদ্ধ, ১৮৫৭-তে সিপাহী যুদ্ধ, ১৯৫৭-তে ভারত-পাকিস্তান এক হয়ে শুরু হবে নতুন ইতিহাস। ভবদেব সরকারও এই তত্ত্বে প্রবলভাবে বিশ্বাসী।

মালখানগর ছেড়ে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা সবাই চলে আসছেন পশ্চিমবাংলায়। প্রতাপ কলকাতা থেকে বারবার চিঠি লিখছেন বাবা-মাকে চলে আসবার জন্য, কিন্তু ভবদেব সরকার অটল। তিনি বরং একটি অদ্ভুত কাজ করতে লাগলেন। যে-সব হিন্দুরা বাড়ি ঘর ছেড়ে চলে আসছে, তিনি তাদের সম্পত্তি কিনে রাখতে লাগলেন জলের দামে। সবাইকে আশ্বাস দিলেন, ১৯৫৭র পর তারা যদি ফিরে আসে, তিনি ঐ দামেই তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবেন।

ভবদেব মজুমদারের হিসেবে একটি ভুল ছিল। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি নিজে বাঁচবেন কি না সে কথা চিন্তা করেননি। ওদেশে তিনি কোনো শত্রুতার সম্মুখীন হননি বটে কিন্তু অকস্মাৎ হৃদরোগ তাকে হরণ করে নিয়ে গেল। দরদালান, আমবাগান, কয়েকটি দীঘি, ধানজমি এইসবের ওপর দিয়ে উড়ে গেল অতৃপ্ত ভবদেব সরকারের শেষ নিশ্বাস। মৃত্যুকালে শান্তি ছাড়া অন্য সন্তানদের মুখ-দর্শনও হলো না।

পিতৃশ্রাদ্ধ করতে প্রতাপ শেষবার গিয়েছিলেন মালখানগরে। প্রতাপ শক্ত চরিত্রের মানুষ, সবাই তাকে তেজস্বী পুরুষ হিসেবে মানে, কিন্তু সেবার তিনি খুব কান্নাকাটি করেছিলেন। বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল, মাটি থেকে উপড়ে তোলা হলো এক বর্ধিষ্ণু বৃক্ষের শিকড়। পূর্ববাংলার এই নদীময় প্রান্তর, এই মিষ্টি বাতাস, খেজুর রসের স্বাদের মতন ভোর, ঠাকুমার গল্পের আমেজমাখা সন্ধ্যা, এসব আর দেখা হবে না। এরপর থেকে কলকাতায় ভাড়াটে বাড়ির অন্ধকার ঘুপচি ঘরে চির নির্বাসন।

দেশ বিভাগের পরেও প্রত্যেক বছর পূজোর সময় একমাস সপরিবারে প্রতাপ কাটিয়ে যেতেন মালখানগরে। সেই একমাসেই যেন তিনি সারা বছরের এনার্জি সঞ্চয় করে নিতেন। নিজেদের পুকুরের মাছের স্বাদই আলাদা। বাড়ির গরু, বাড়ির কলাগাছ, এমনকি চিড়ে-মুড়কিও নিজেদের খেতের। তা ছাড়া যে-মাটিতে পিতৃপুরুষেরা পদস্পর্শ রেখে গেছেন, সেই মাটি। পূজোর সময় প্রতাপ কাশ্মীর-গোয়ায় ভ্রমণের আহ্বান পেলেও প্রত্যাখ্যান করতেন।

ভবদেব প্রত্যেকবারই প্রতাপকে বলতেন, তোকে না হয় কলকাতায় চাকরি করতেই হবে, তুই আর বৌমা কলকাতায় থাক, ছেলে মেয়েদের এখানে রেখে যা! ওরা খাঁটি দুধ-ঘি খেয়ে শরীরটা মজবুত করুক। কলকাতায় কি ওসব পাওয়া যায়? কলকাতায় না আছে খেলার মাঠ, না আছে বাগান, না আছে পুকুর!

প্রতাপ বলতেন, তা কি হয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া আছে না?

ভবদেব বলতেন, কেন, এখানে লেখাপড়া হয় না? ভালো ইস্কুল আছে। তোরা তো এই ইস্কুলেই লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়েছিস। এই ইস্কুলের কত ছেলে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে!

তবু দিনকাল যে বদলে গেছে তা বাবাকে বোঝানো যায় না। দাঙ্গা-হাঙ্গামা না থাকলেও সবসময় একটা টেনশান রয়েছে, এইরকম অবস্থায় পূর্ব-পশ্চিমবাংলায় বিভক্ত পরিবার মানসিক শান্তিতে থাকতে পারে না।

বড় নাতি পিকলু ছিল ভবদেবের সবচেয়ে প্রিয়। একবার তো তিনি পিকলুকে প্রায় জোর করেই ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। সেবার পিকলু টাইফয়েডে ভুগে খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। ভবদেব চেয়েছিলেন, একটা বছর দেশে থেকে পিকলু শরীরটা সারিয়ে নিক। একটা বছর না হয় ওর পড়াশুনো বন্ধ থাক। প্রতাপ রাজি হতে পারেননি। পিকলু প্রত্যেক বছর পরীক্ষায় ফাস্ট হয়, সে একটা বছর নষ্ট করবে কেন? সহপাঠীদের তুলনায় পিছিয়ে গিয়ে পিকলু তো পরে বাবা-মায়ের ওপরেই দোষ দেবে।

বাবলুকে নিয়ে প্রত্যেকবারই বেশ সমস্যা হতো। তার তো পড়াশুনোয় মন নেই। কলকাতার তুলনায় দেশের বাড়িই তার বেশি পছন্দ। প্রায় সারাদিনই তো সে পড়ে থাকতো আমবাগানে। ওখানে বকুনি দেবার কেউ নেই, ঠাকুমা আর পিসিদের অগাধ প্রশ্রয় আর আদর, ঐসব ছেড়ে সে আসতে চাইবে কেন? প্রতিবছরই ফেরার দিন বাবলুকে খুঁজে পাওয়া যেত না। শেষ বছরে তাকে টেনে হিঁচড়ে আনা হয় গোয়ালঘরের পেছনের আদাড় থেকে, যেখানে দিনেরবেলাতেও কেউ ভয়ে যায় না। বাবলুর সেকি হেঁচকি তুলে কান্না!

পিতৃশ্রাদ্ধ করতে গিয়ে প্রতাপ বুঝতে পেরেছিলেন, এবার চিরকালের মতন মালখানগরের পাট তুলতে হবে। আর কোনো পুরুষ মানুষ নেই, মা আর শান্তিকে এখানে রেখে যাওয়া যায় না। বিষয় সম্পত্তি সবই এমনি এমনি পড়ে রইলো। ভবদেব সরকার যে-সব নতুন নতুন বাড়ি জমি কিনেছিলেন সে-সব তো ছাড়তে হলোই, তাঁদের নিজস্ব বসতবাড়ি ও পুকুর বাগানের জন্যও খদ্দের পাওয়া গেল না। যা কিছুদিন পর এমনিই পাওয়া যাবে তা আর কে সাধ করে পয়সা দিয়ে কিনতে চাইবে। চাচাস্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ মুসলমান প্রতিবেশী প্রতাপকে পরামর্শ দিলেন, একেবারে খালি বাড়ি ফেলে যেও না, একজন কারুকে অন্তত রেখে যাও! প্রতাপ হতাশভাবে মাথা নেড়েছিলেন। কে থাকবে? গ্রামের একটি ছেলের ওপর দেখাশুনোর ভার দিয়ে প্রতাপ চলে এলেন এবং কিছুদিন পরেই খবর পেলেন যে তাঁদের বাড়িটি সরকার অধিগ্রহণ করে কী একটা অফিস বসিয়েছে।

বিশ্বনাথ গুহও প্রতাপের সঙ্গে গিয়েছিলেন শ্বশুরের শ্রাদ্ধে। সেবারে তিনি বুঝলেন, তাঁকে সংসারের মায়ায় বাঁধা পড়তেই হবে এবার। স্ত্রী এবং শিশু কন্যাটিকে তিনি প্রতাপের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারেন না। ভবদেব সরকার মাসে মাসে বেশ কিছু টাকা হুণ্ডি মারফৎ কলকাতায় পাঠাতেন ছেলের কাছে। এবার থেকে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতাপ বেশ অসুবিধেয় পড়বেন, শুধু মাইনের টাকায় তিনি এতবড় সংসার চালাবেন কী করে?

বিশ্বনাথের যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, এই বয়েসে তিনি নতুন করে চাকরি খোঁজাখুঁজি করতে পারবেন না, অন্য কোনো যোগ্যতাও নেই, তাই তিনি স্ত্রী-কন্যাকে সঙ্গে এনে দেওঘরে একটা গানের ইস্কুল খুলেছেন।

কাশী-আগ্রা-লক্ষৌ-পুনার মতন দেওঘরের সঙ্গীত-কেন্দ্র হিসেবে কোনো খ্যাতি নেই। তবু এখানে আসতে হলো একটিই কারণে। ভবদেব সরকার অনেকদিন আগে দেওঘরে একটি ছোট একতলা বাড়ি কিনে রেখেছিলেন স্ত্রীর নামে। একসময়ে পশ্চিমে হাওয়া বদলাতে যাওয়ার– একটা রেওয়াজ ছিল। পরিপূর্ণ সুখের দিনে ভবদেব সরকারও তাঁর সমগ্র পরিবার নিয়ে দু’তিনবার এসেছেন দেওঘরের এই বাড়িতে। তারপর বছর দশেক আর কেউ আসেনি, এমনি এমনি তালাবন্ধ পড়ে ছিল। মাথা গোঁজার একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় তো অন্তত পাওয়া যাবে, এই হিসেবে সেই বাড়ি সাফ-সুতরো করে বিশ্বনাথ সংসার পাতলেন।

প্রতাপের মা দিনকতক রইলেন কলকাতায় ছেলের বাড়িতে। কিন্তু কলকাতায় তাঁর মন টেকে না, তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। স্বামীর মৃত্যু তিনি অনেকটা সহ্য করে নিতে পেরেছিলেন, কিন্তু উন্মুক্ত প্রকৃতি থেকে বিচ্যুতি তিনি মানতে পারলেন না। তিনিও দেওঘরে এসে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। শান্তি আর তিনি অনেকদিন একসঙ্গে ছিলেন, শান্তির মেয়েটি তাঁরই কোলে শুয়ে বড় হয়েছে, ওদের ছেড়ে থাকতেও তাঁর কষ্ট হচ্ছিল।

বিধবা মা ছেলের কাছেই থাকবেন, মেয়ে-জামাইয়ের সংসারে আশ্রয় নিলে দেশাচারে বাধে, নিন্দে হয়। কিন্তু সুহাসিনী তো মেয়ে-জামাইয়ের সংসারে যাচ্ছেন না, দেওঘরের বাড়িটি তাঁর নিজের নামে, তিনি নিজের বাড়িতে থাকবেন, এতে কোনো দোষ নেই।

প্রতাপদের টাঙ্গা সেই সুহাসিনীধামের সামনে এসে থামলো।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়