দরজা খুলেই ছবি দেখল, আসিফ সাহেব আর তিনজন কঠোর চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে।

আসিফ ছবির দিকে একটা আঙুলের ইশারা করে বললেন, চলো।

ছবি একটুও ঘাবড়াল না। এসব দেখার অভ্যেস আছে তার।

সে সিঁড়ির দিকটা দেখবার চেষ্টা করল। কিন্তু লোকগুলো আড়াল করে আছে বলে কিছু দেখতে পেল না।

ছবি শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

আসিফ বললেন, আমি পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এই সময়টুকু তুমি কথা বলে নষ্ট করতে চাও, না তৈরি হয়ে নিতে চাও?

আমার অন্য কোথাও যাবার হুকুম নেই।

আমার হুকুম, তোমাকে যেতে হবে।

আসিফের সত্যিকারের জোর কতখানি ছবি তাই দেখে নিতে চায়। সেজন্য একটু সময় দরকার। ভরত গুপ্তর সতর্কতা ব্যবস্থা এত নিখুঁত যে তার মধ্যে আসিফ এসে এ-রকমভাবে কথা বলে কী করে? ভরত গুপ্ত প্রত্যাঘাত করতে কতটা সময় নেবেন?

ছবি বলল, আমাকে একবার বাথরুমে যেতে হবে।

আসিফ ঝকঝকে দাঁতে হাসলেন। এসব পুরোনো কায়দা মেয়েটা তার ওপর চালাবার চেষ্টা করছে। তিনি বললেন, আর চার মিনিট।

আসিফের সাম্রাজ্য আত্মারাম বা ভরত গুপ্তর থেকে কিছু কম নয়। কিন্তু তিনি ওদের মতন শুধু লোক মারফত সব কাজ চালান না। দুঃসাহসী বলে তাঁর নাম আছে। পুরোনো আমলের রাজাবাদশার মতন তিনি অনেক সময়ই বাহিনীর সম্মুখভাগে থাকেন। তিনি ছবির রং-করা মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।

আমাকে কোথায় যেতে হবে?

তোমার শাদি হবে।

জনাব, এই বাঁদীর তো আগেই শাদি হয়ে গেছে।

ক-বার? নিশ্চয়ই অনেকবার? আর একবার হতে দোষ কি?

ছবি বুঝল আর তর্ক করে লাভ নেই।

সে জিজ্ঞেস করল, সঙ্গে কিছু নিতে হবে?

তুমি এখানে আর কোনোদিন ফিরে আসতে নাও পার। সেই বুঝে নাও।

ছবি দরজার কাছ থেকে সরে ঘরের মধ্যে এল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা চারজনও ঢুকে এল ভেতরে।

ছবির মনের মধ্যে এখন সাংঘাতিক দ্বিধা। সে আর এখানে ফিরে আসবে না—সুতরাং তার সমস্ত দামি জিনিস সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু নিয়ে যাবে কাদের সঙ্গে? ওই গুণ্ডারা যেকোনো মুহূর্তে তার সব কিছু কেড়ে নিতে পারে। এদের চোখের সামনেই সব কিছু বার করতে হবে। তার চেয়ে না নিয়ে যাওয়া ভালো। কিন্তু ফেলে রেখে যাবেই-বা কার জন্য?

শেষপর্যন্ত, মেয়েলি দুর্বলতায় সে আলমারির লকার খুলে গয়নাগুলো সব বার করে নিল। এক-শো টাকার নোটগুলো একটা ছোট্ট থলিতে ভরে বেঁধে রাখল কোমরে। শাড়ির স্থূপ ও মূল্যবান বহু পোশাক পড়ে রইল। ছবির একটু একটু কান্না পায়, তবু সে সংযত হয়ে বলল, চলুন।

আসিফ ঘড়ি দেখে বললেন, আরও এক মিনিট সময় আছে। আর কিছু নেবার নেই!

না।

আসিফ তার সঙ্গীদের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তারা খুব নিপুণ হাতে অত্যন্ত দ্রুত ঘরের সব আলমারি ও ড্রয়ার খুলে পরীক্ষা করে দেখল। তাদের আগ্রহ জন্মাবার মতন কিছু নেই, শুধু স্কচের দু-টি বোতল ছাড়া। আসিফ তাদের সম্মতি দিলেন সে দু-টি নেবার জন্য। একটা বোতল তক্ষুনি খোলা হল এবং চারজনে চারটি বড়ো চুমুক লাগিয়ে দিল, নির্জলা।

আসিফ ছবির বাহু ধরে বললেন, চলো এবার।

সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছুটিয়েই নামালো ছবিকে। ছবি একটা ব্যাপারে খুব আশ্চর্য হল, বাড়ির ভেতরে শুধু নয়, বাড়ির বাইরেও ভরত গুপ্তর একজনও প্রহরী নেই। এ-রকম তো কখনো হয় না। তাঁর দাসী-পরিচারিকাদের না হয় একটা ঘরে বন্ধ করে রেখেছে, সে তো বোঝাই গেল, কিন্তু গেটের দারোয়ানরাই বা কোথায়? এ বাড়িতে যখন যা হয় ভরত গুপ্ত ঠিক খবর পেয়ে যান, আজ সমস্ত ব্যবস্থা বানচাল হয়ে গেছে?

একটা শিরশিরে ভয়ের স্রোত বয়ে গেল ছবির শরীর দিয়ে। তাহলে ভরত গুপ্ত কি ইচ্ছে করেই তাকে তুলে দিচ্ছেন আসিফের হাতে? পাগলা কুকুরের সামনে যেরকম একখন্ড মাংস ছুঁড়ে দেওয়া হয়?

ছবি আরও আশ্চর্য হয়ে গেল, যখন বাড়ির সামনে দাঁড় করানো একটা পুলিশভ্যানে তাকে তোলা হল। ভ্যানটির মধ্যে একজন সাব ইস্টপেক্টর ও দু-জন কনস্টেবল বসে আছে। এসব কী ব্যাপার হচ্ছে?

ছবি সেই গাড়িতে উঠে বসে আবার জিজ্ঞেস করল, আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

কেউ কোনো উত্তর দিল না। আসিফ সাহেব সিগারেট ধরিয়ে খুব আরামের সঙ্গে ধোঁয়া ছাড়লেন।

একটুবাদেই যখন পুলিশের লোক তিনটিও স্কচের বোতল থেকে চুমুক দিতে লাগল, তখন ছবি বুঝতে পারল, পুরো ব্যাপারটাই সাজানো। পুলিশের লোকও ডিউটির সময় মদ খেতে পারে কিন্তু কনস্টেবল ও সাব ইনস্পেকটর একই বোতল থেকে চুমুক দেবে না। কিংবা, কে জানে।

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। রাস্তাঘাট নিঝুম। ছবিকে বসানো হয়েছে সামনের সিটে, পাশেই আসিফ।

ছবি আসিফের গা ঘেঁষে বসল এবং তার স্তনের স্পর্শ লাগল আসিফের গায়ে।

আসিফ মুখ ফিরিয়ে একবার তাকাল শুধু, কোনো উচ্চবাচ্য করল না।

ছবি ফিসফিস করে বলল, আমি একটা সিগারেট খাব।

আসিফ কঠোরভাবে বলল, এখন না।

ছবি তবু আসিফের দিকে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে এসে আদুরে গলায় বলল, আমার শীত করছে।

আসিফ এবারও কোনো কথা বললেন না। ছবি জানে তার একমাত্র সম্পদ তার নিজের শরীর। সেই শরীরটা সে সম্পূর্ণ লেপ্টে দিল আসিফের গায়ের সঙ্গে। এ-রকম শরীরের স্পর্শে মুনিঋষিরও তপস্যা ভঙ্গ হয়, কিন্তু আসিফের কোনো চাঞ্চল্য দেখা গেল না। তিনি স্থিরভাবে বসে রইলেন।

গাড়িটা হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে খুব দ্রুতগতিতে চলে এল বালির দিকে। একটা বিরাট বাগান বাড়ির সামনে থামল। এবারেও আসিফ ছবির হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে অত্যন্ত জোরে ছুটে গেলেন বাড়িটার মধ্যে।

মস্ত বড়ো দরদালানের পর অনেকগুলো ঘর, সব কটাই অন্ধকার। আলো জ্বলছে শুধু তিনতলায়, সেখানে অনেক লোকের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলেও আসিফ ছবিকে যে ঘরে নিয়ে এলেন, সেটা একেবারে ফাঁকা।

একটা পুরোনো আমলের আরাম কেদারার ওপর ছবিকে ছুড়ে দিয়ে আসিফ বললেন, এখানে চুপ করে বসে থাকো।

এ-রকম টানা হ্যাঁচড়া করার জন্য ছবির একেবারে আঁতে ঘা লেগেছে। সে জানে, সে রূপসী, অধিকাংশ পুরুষই তার সামনে এসে কাদার তাল হয়ে যায়। কিন্তু এরা তার রূপের কোনো মূল্যই দিচ্ছে না।

ছবি সোজা হয়ে বসে বলল, আসিফ সাহেব, আপনি যদি ভেবে থাকেন, আমাকে ধরে এনে ভরত গুপ্তকে জব্দ করবেন, তাহলে আপনি খুব ভুল করেছেন। মেয়েছেলের কোনো মূল্যই নেই ভরত গুপ্তর কাছে। আমার মতন দশটা মেয়েছেলেকে তিনি যখন-তখন কিনে আনতে পারেন। সবাই ওঁর কাছে সমান।

আসিফ বললেন, তুমি যে বাথরুম যাবে বলেছিলে? যাও, ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম আছে।

আপনি আমাকে নিয়ে কী করবেন, আমি জানতে চাই।

আজ রাত্তিরে তোমার শাদি দেব।

ছবি একটা ঘৃণার মুখভঙ্গি করল।

আসিফ সাহেব উর্দুতে কী যেন বললেন। একটু বাদেই দু-জন লোক ধরাধরি করে নিয়ে এল শোভনকুমারকে। সে তখন চূড়চূড় মাতাল। ছবিকে দেখেই সে জড়িয়ে ধরবার জন্য ছুটে আসতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

এবার ছবির কাছে ব্যাপারটা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে এল। এই মূখ শোভনকুমারটা আসিফের সঙ্গে এসে হাত মিলিয়েছে এবং আসিফই একে টেনে এনেছে ভরত গুপ্তকে জব্দ করার জন্য। এইবারই প্রথম ছবি সত্যিকারের ভয় পেল। ভরত গুপ্তকে সে জানে, এদের কাছে তিনি কিছুতেই হেরে যাবার মানুষ নন। ভরত গুপ্ত যে কোনদিক দিয়ে কখন আঘাত করবেন, এরা তা টেরও পাবে না।

ছবি শোভনকুমারকে তুলে এনে চেয়ারে বসালো। তারপর দুই গালে চড় মেরে বলল, বেকুব, তোর মরণ সত্যিই ঘনিয়ে এসেছে।

শোভনকুমার লাল রঙের চোখ মেলে তাকাল। তারপর বলল ছবি, তুই বলেছিলি না, আমি চাচাজিকে খুন করলে তুই খুশি হবি। দেখ, এবার ওই বুড়ো শেয়ালটাকে আমি শেষ করে দেব।

ছবি বলল, তোর মুরোদ আমার জানা আছে। এর মধ্যে আমাকে টানছিস কেন?

এরপর সব বিজনেস আমার হবে। তুই আমার পাশে থাকবি। তোকে আমার রানি করব।

এই বাক্যটির মধ্যে এমন কী হাস্যরস আছে কে জানে, তবু আসিফ হোহো করে হেসে উঠলেন। রীতিমতন উপভোগের হাসি। তারপর ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পা দুটো ছড়িয়ে হাঁকলেন, দুনিয়া, দুনিয়া!

একটি চোদ্দো-পনেরো বছরের কিশোর হাতে একটা ট্রেতে হুইস্কির বোতল, গেলাস, সোডা নিয়ে ঘরে ঢুকল। সেটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে সে হাঁটু গেড়ে বসে আসিফের পায়ের জুতোর ফিতে খুলতে লাগল।

কিশোরটি অত্যন্ত রূপবান, নারীর মতো লাবণ্যমাখা মুখ, টানা টানা চোখ। সে পরে আছে সিল্কের চুস্ত আর পাঞ্জাবি। তার দিকে একবার তাকালে সহজে চোখ ফেরানো যায় না।

আসিফের পা থেকে জুতো-মোজা খুলে সে উঠে দাঁড়াল। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ছবির দিকে। সেই দৃষ্টিতে ঈর্ষা মেশানো।

আসিফ আরাম করে হুইস্কিতে চুমুক দিয়ে তারপর ছেলেটির কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে আনলেন। আদর করে বললেন, কেয়া রে দুনিয়া, তুমহারা হালচাল বাতাও!

ছবি এখন বুঝতে পারল, আসিফ সাহেবের কেন মেয়েদের সম্পর্কে কোনো আগ্রহ নেই। তার ঘৃণা আরও বেড়ে গেল। সে চঞ্চল চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগল, এখান থেকে বাঁচবার কোনো উপায় আছে কিনা।

শোভনকুমার জড়িত গলায় ডাকল, ছবি, এদিকে আয়।

আসিফ বললেন, রিল্যাক্স অ্যাণ্ড হাভ ফান।

শোভনকুমার হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছবিকে নিয়ে এল কোলের ওপরে। তারপর তার শরীর চটকাতে লাগল। ছবি কোনো বাধা দিল না। হাত বাড়িয়ে সে টেবিল থেকে একটা গেলাসে হুইস্কি ভরে নিয়ে এল। সেটা নিজের ঠোঁটের সামনে তুলতেই শোভনকুমার বলল, আমায় দে! আমায় দে!

ছবি এইটাই চাইছিল। সে খুব আদর করে শোভনকুমারের মুখের সামনে গেলাসটা দিয়ে বলল, তোমার জন্যই তো আনছিলাম।

শোভনকুমার এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করার পর ছবি জিজ্ঞেস করল, আর একটু?

সে চায় শোভনকুমারকে অবিলম্বে অজ্ঞান করে ফেলতে।

শোভনকুমার বলল দে, আরও দে! চাচাজির কাছ থেকে তোকে আমরা ছিনিয়ে নিয়ে এলাম, চাচাজি কিছু করতে পারল? এবার ওকে আমরা শেষ করে দেব।

আসিফ বললেন, কলকাতাটা আমার এরিয়া নয়, কিন্তু আমি ইচ্ছে করলে এখানেও যে অনেক কিছু করতে পারি সেটা ভরত গুপ্তকে বুঝিয়ে দিতে চাই।

ছবি কোনো কথা বলল না। সে স্পষ্ট জেনে গেছে এখন যেকোনো একটা গভীর মতলবে ভরত গুপ্ত ইচ্ছে করেই ছবিকে চলে যেতে দিয়েছেন। নইলে, ভরত গুপ্তর কোনো জিনিস, এত সহজে কেউ নিতে পারে না।

আসিফ বললেন, শোভনজি, মন দিয়ে আমার কথা শুনুন ভরত গুপ্তকে খতম করার ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই। তাতে অনেক ঝামেলা। আমি কী চাই, বলছি। কলকাতার ডক এরিয়ায় পুরো স্মাগলিং অপারেশন এতদিন আমরা কন্ট্রোল করেছি। মুম্বাই আমার সেন্টার হলেও সব পোর্টে একটা চেন না থাকলে কাজের অসুবিধে হয়। কলকাতার চেন সেইজন্য আমরা ভাঙতে পারি না। ভরত গুপ্ত এখন কলকাতা পোর্ট থেকে আমাদের হঠাতে চাইছে। এটা আমরা কিছুতেই হতে দেব না—এতে যত টাকা খরচ হয় হোক। এই ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করুন, আমি আপনাকে সাহায্য করব। আপনার পিতাজির যেসব কম্পানিগুলো উনি দখল করে আছেন, সেগুলো ছিনিয়ে আনার জন্য যা যা ব্যবস্থার দরকার হয় আমি করব।

শোভনকুমার চেঁচিয়ে উঠল, আমার হাতে বহুৎ ডকুমেন্ট আছে। আমি এবার শেষ করে দেব ওকে।

ঠিক আছে, এখুনি ভরত গুপ্তকে টেলিফোন করুন।

ছবি বলল, কোনো লাভ নেই। রাত্তিরে ভরত গুপ্ত কোনোদিন টেলিফোন ধরেন না।

ঠিক আছে, কাল ঠিক ছ-টার সময়–

উনি আটটার আগে কারুর সঙ্গে কথা বলেন না।

আসিফ সাহেব কাঁধ ঝাঁকানি দিয়ে বললেন, আজব চিড়িয়া! এইরকম লোক কলকাতা কন্ট্রোল করছে, মুম্বাইতে শুনলে সবাই হাসবে! যাই হোক, কালকের মধ্যেই আমাকে সব ব্যবস্থা করতে হবে। আমি পরশুদিন চলে যাব।

শোভনকুমার ছবির কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, এবার তুই আমাকে শাদি করবি তো?

ছবির উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আসিফ আগেই বললেন, করবে, করবে, নিশ্চয়ই করবে—আপনার মতন এমন খুবসুরত আদমি ও আর কোথায় পাবে?

ছবি মুচকি মুচকি হেসে হাতের হুইস্কির গেলাসটা শোভনকুমারের দিকে নিয়ে গিয়ে বলল, খাও! রাত তিনটে পর্যন্ত এই সব চলল। তারপর ছবি আর শোভনকুমারকে ওই ঘরে রেখে দলবল সমেত আসিফ চলে গেল অন্য ঘরে। ছবি দরজা বন্ধ করে দিল।

শোভনকুমারের তখনও পুরোপুরি জ্ঞান চলে যায়নি। দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই, কথা জড়িয়ে গেছে তবু ছবিকে টানাটানি করার চেষ্টা করছে।

ছবি বলল, হা রে, উল্লুক, তোর মরণ ঘনিয়ে এসেছে।

শোভনকুমার শুধু মরণ কথাটা শুনল। বলল, হাঁ, এবার চাচাজি মরবে। আসিফ সাহেব শের কা বাচ্চা, দেখলি তো! তুই কিন্তু ওর কাছে যাবি না। তুই শুধু আমার কাছে থাকবি। দাঁড়িয়ে আছিস কেন, শাড়িটা খোল না—

ছবির চোখ দুটো জ্বলছে তখন বাঘিনীর মতন। সে একটা সিগারেট ধরিয়ে সোজা সেটা দিয়ে ছ্যাঁকা দিল শোভনকুমারের বাহুতে। শোভনকুমার আঁ আঁ করে চেঁচিয়ে উঠল শুধু একবার, প্রতিরোধ করতে পারল না। ছবি সিগারেটটা ঠেসে ধরে রইল।

তারপর শোভনকুমারেরই পকেট থেকে রুমালটা বের করে গোল্লা পাকিয়ে সেটা পুরে দিল ওর মুখের মধ্যে। শোভনকুমার তখনও হাসবার চেষ্টা করছে। ছবি ওর ঘাড়টা নুইয়ে দুম করে মাথাটা ঠুকে দিল মাটিতে।

একবার দিয়েই ক্ষ্যান্ত হল না, দুম দুম করে অনেকবার ঠুকতে লাগল। মাথা ফেটে রক্ত বেরুতে লাগল শোভনকুমারের, একটু বাদেই সে অজ্ঞান হয়ে গেল।

একটুক্ষণ বসে হাঁপাতে লাগল ছবি। তারপর উঠে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে ভালো করে হাত দিয়ে চোখে-মুখে জলের ছিটে দিল। আবার ঘরে এসে ঝুঁকে দেখল, শোভনকুমারের জ্ঞান ফেরার কোনো লক্ষণ আছে কিনা। সে-ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে, গয়নার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সিঁড়ির কাছে দেয়ালে হেলান দিয়ে একজন লোক দাঁড়িয়েছিল। ছবি একটুও চমকাল না। সে জানতই। লোকটি কোনো কথা বলার আগেই ছবি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। অত্যন্ত নরম, ভীরু, কম্পিত গলায় বলল, আমার ভয় করছে, আমার ভীষণ ভয় করছে, আমি ওই লোকটার সঙ্গে এক ঘরে থাকতে পারছি না।

তারপর সে রক্ষীটিকে অত্যন্ত আবেগের সঙ্গে প্রগাঢ় চুম্বন করল। লোকটির যে টুকু দ্বিধা ছিল, ছবি নিজেই কাটিয়ে দিল তা। সে পুরুষটির হাত তুলে এনে নিজের বুকের ওপর রাখল। মিনতিমাখা গলায় বলল, আমাকে তোমরা মুম্বাই নিয়ে যাবে? আমাকে ওই লোকটার হাতে ছেড়ে দিও না! ও একেবারে বাঙালি ভেড়য়াদের মতন হয়ে গেছে।

দু-জনে নেমে এল দোতলার একটা অন্ধকার ঘরে।

ছবি লোকটিকে এত ক্লান্ত করে দিল যে কিছুক্ষণ পরে তার ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর রইল না। ছবি আদর করে তার মাথায় হাত দিয়ে ঘুম পাড়ালো। তার জামা প্যান্টগুলো ছুড়ে ফেলে দিল জানলা দিয়ে। লোকটির নাক ডাকার শব্দ হতেই ছবি সে-ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল দরজা।

তার গতিভঙ্গি এখন বেশ স্বচ্ছন্দ। সে একটি ব্যাপার খুব ভালোভাবেই জানে, অচেনা লোক কোনো রূপসী মেয়েকে সহজে খুন করে না। রূপসী মেয়েদের প্রধান বিপদ চেনা লোকেদের কাছ থেকে।

ছবি যখন এসে রাস্তায় দাঁড়াল, তখন সবে মাত্র ভোরের আলো ফুটেছে। একজন ঘুমন্ত রিকশাওয়ালাকে জাগিয়ে সে অনুনয় করে বলল, আমাকে একটু হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেবে? আমার বড়ো বিপদ।

হাওড়া স্টেশনের কাছে এসে রিকশা ধরার আগে ছবি দু-এক মিনিট দ্বিধা করল। অনায়াসেই এখন সে ট্রেনে চেপে অনেক দূরে হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? তার নিয়তিই হচ্ছে একজনের হাত ছাড়িয়ে আরেক জনের হাতে পড়া। আসিফ যদি বালক প্রেমিক না হত তাহলে সে আসিফের সঙ্গে নিশ্চিত মুম্বাই চলে যেত। আসিফের ওপরই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা হচ্ছে তার। এখন পর্যন্ত ভরত গুপ্তই সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য। বাঘ সিংহের সাহচর্যে থাকা তার অভ্যেস, সে তো আর শেয়াল-কুকুরের সঙ্গে ঘর করতে পারবে না। সে এখানেই থাকবে, ভরত গুপ্তর মৃত্যু দেখে তবে যাবে।

ছবি নিজের বাড়িতে ফিরে এসে দেখল, দারোয়ান, পরিচারিকারা যে যার নিজের জায়গায় ঠিক আছে। কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করল না। গিজারে জল গরম করতে দিয়ে ছবি বাথরুমে স্নান করতে ঢুকল।

ঠিক আটটার সময় সে টেলিফোন করল ভরত গুপ্তর বাড়িতে। ভরত গুপ্তকে সরাসরি টেলিফোনে পাওয়া যায় না কখননা। অনেক হাত ঘুরে নিজে যখন লাইনে এলেন, তখন তিনি ভালোভাবেই জানেন টেলিফোন এসেছে কার কাছ থেকে।

তবু ভরত গুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন, কে?

আমি ছবি।

ও, ছবি? তা হঠাৎ এই সকালবেলাতেই যে? শরীর-টরীর ভালো আছে তো?

আপনার মেহেরবানীতে আমি এখন ভালো আছি।

রাত্রে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

কাল রাত্রে এক ফোঁটাও ঘুমোইনি।

ও, তাই নাকি? বাঃ। তাহলে তো তোমাকে একটা কিছু পুরস্কার দিতে হবে। আমি তো তোমাকে খরচের খাতাতেই লিখে রেখেছিলাম।

আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না?

তুমি কি অবিশ্বাসের কিছু কাজ করেছ?

না।

তা হলে? যাই হোক, তুমি বালির বাগানবাড়ি থেকে এত সকালেই ফিরলে কী করে?

অ্যাঁ? আপনি তা-ও জানেন?

আমি অনেক কিছুই জানতে পারি।

তবু আপনি, আপনি আমাকে ওদের হাতে…

এবার বলো, কাল রাত্রে কী কী হল।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়