একটা পরিচ্ছন্ন সুন্দর দিন। দুপুর বেলা ঝকঝক করছে রোদ, অথচ তেমন গরম নেই। আকাশ পরিষ্কার। ছুটির দিন নয়, কাজের দিন। কিন্তু কাজের দিন মানেই এই নয় যে, দুপুর বেলা সমস্ত সক্ষম লোক অফিসে কিংবা কলকারখানায় আবদ্ধ হয়ে থাকবে। পথে পথে অজস্র ভিড়, অসংখ্য গাড়ি, ট্রাম বাসে ঠাসাঠাসি। ম্যাটিনি শো হাউসফুল।

বেবী ফুডের জন্য বিরাট লম্বা লাইন। ময়দানে এই সময়েই দেখা যাবে তরুণ-তরুণীরা গাছের ছায়ায় বিখ্যাত ভঙ্গিতে বসে আছে। কিছু লোক এমনিই হাত-পা ছড়িয়ে মাঠে শুয়ে থাকে, এরা কোথা থেকে এসেছে কিংবা কোথায় যাবে, তা কিছুই বোঝা যায় না।

আবার, বহুলোক মিছিলে বেরিয়েছে, নানারকম সরকার-বিরোধী শ্লোগান এবং ফেস্টুন। এরই পাশ দিয়ে অস্বচ্ছ কাচে ঘেরা গাড়িতে কখনো ভরত গুপ্ত, কখনো আত্মারাম কিংবা আসিফ সাহেব চলে যান। এঁদের কেউ চেনে না, কোনো পত্রপত্রিকায় এঁদের ছবিও ছাপা হয় না। একজন ক্যামেরাম্যান আসিফ সাহেবের গাড়ির ঠিক পাশে দাঁড়িয়েই ছবি তুলছে ওই মিছিলের। সব মিছিলের দৃশ্য প্রায় একইরকম, তবু প্রত্যেকবার নতুন করে ছবি তুলতে হয়।

আর যাঁদের ছবি নিয়মিত ছাপা হয়, লোকে নাম শুনলেই চিনতে পারে, সেই সব মন্ত্রীরা রাইটার্স বিল্ডিংসে এখন দারুণ ব্যস্ত। বহু রকমের কৃপাপ্রার্থী, সাহায্যপ্রার্থী, ঘন ঘন টেলিফোন, পি এ এবং সি এ এবং অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি, আণ্ডার সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি—এর পরেও আছে মহান দেশের সমস্যা। গাদাগাদা ফাইল এবং মৌখিক উমেদারি। এঁদের প্রত্যেককেই বিকেলের পর কোনো-না-কোনো জনসভায় কিংবা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে হবে। পার্টি মিটিং। অথবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অথবা পুজোর ফাংশান অথবা উন্নয়ন সংক্রান্ত সেমিনার অথবা শ্রাদ্ধবাসর। একটুও নিশ্বাস ফেলার সময় নেই।

এর মধ্যে রেশনের দোকানের সামনে হইচই চলতে থাকে। বিভিন্ন পার্টি অফিসে একদল অপর দলের মুন্ডপাত করে। বিরাট হোটেলের সামনে কাঙালিরা সাহেব দেখলেই হেঁকে ধরে। সেই হোটেলেরই কোনো ঘরে দু-জন লোক একটা সুটকেশ ভরতি বিস্কুট আসিফ সাহেবের হাতে তুলে দেয়। বিস্কুটগুলি সবই সোনার তৈরি।

এই সময়েই অন্য কোথাও ছেলেরা কবিতা লেখে, মেয়েরা ঘন ঘন লেটার বক্সের দিকে নজর রাখে, রেডিয়োতে গান বাজে, বাসের পাঁচ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধি বিষয়ে লোকেরা তর্ক করে, হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে একজন দৌড়ে যায় ব্লাড ব্যাঙ্কের দিকে। পঞ্চান্ন হাজার শিশুর জন্ম হয়ে গেল।

অরণ্যে হিংস্র পশু থাকে, তাই মানুষ অরণ্যে প্রবেশ করার সময়েই সতর্ক হয়ে যায় কিংবা অস্ত্র সঙ্গে নেয়। এই শহরের মতন মানুষের অরণ্যে হিংস্র প্রাণীগুলিকে চেনা যায় না–মানুষের পাশে পাশেই মানুষের মতন চেহারায় বাঘ, কুমির, সাপেরা ঘুরে বেড়ায়।

বালির সেই বাগানবাড়ি থেকে শোভনকুমারকে সকাল বেলাই সরিয়ে আনা হয়েছিল। তার আঘাত গুরুতর নয়, তবে রক্তের মধ্যে মাদকের প্রভাব কাটতেই অনেক সময় লাগল। আসিফের নিযুক্ত করা দু-জন লোক তাকে সর্বক্ষণ পাহারা দিচ্ছে রয়েড স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। একজন নার্স সেবা করছে। জ্ঞান ফিরলেও শোভনকুমারের কথাবার্তা অসংলগ্ন। ছবির নাম করে সে কাঁদছে মাঝে মাঝে। ছবিকে তার চাই।

অন্য কোথাও একজন ব্যারিস্টারকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়েছে। শোভনকুমার একটু সমর্থ হলেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে সেই ব্যারিস্টারের কাছে। ভরত গুপ্ত সম্পর্কে যাবতীয় গোপন তথ্য সে জানাবে। তারপর সেই ব্যারিস্টার পরীক্ষা করে দেখবেন, ভরত গুপ্তকে কোন কোন দিক থেকে চাপ দেওয়া যায়। আসিফ সাহেবের এই এক প্রসিদ্ধ কৌশল শত্রুপক্ষ খুব প্রবল হলে সেই শত্রুর পরিবার থেকে একজন কুলাঙ্গার খুঁজে বার করে নিজের দলে আনা। এতে কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।

মাথার ক্ষতস্থানে স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো হয়েছে, শোভনকুমার সবেমাত্র এক কাপ গরম দুধে চুমুক দিচ্ছে, এমন সময় একজন এসে খবর দিল, বাইরে পুলিশের গাড়ি।

আসিফের সহকারী দু-জন কটমট করে তাকাল শোভনকুমারের দিকে। একজন জিজ্ঞেস করল, পুলিশ এসেছে কেন?

শোভনকুমার বলল, তোমরা কে? তোমরা কি খুনি?

ওদের একজন বলল, পুলিশ কাকে খুঁজতে এসেছে জানি না। যদি আমাদের ধরে, তোমাকে আমরা চিনি না। যদি তোমাকে ধরে, আমাদের তুমি চেনো না। আসিফ সাহেবের নাম যদি একবারও উচ্চারণ করো, তাহলে তোমার জিভ ছিড়ে নেওয়া হবে।

লোক দু-টি ঝট করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠে গেল ওপরের দিকে। বাড়িটা পাঁচতলা, অসংখ্য ভাড়াটে, অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান, অবাঙালি মুসলমান, পাঞ্জাবি প্রভৃতি নানা জাতের সংমিশ্রণ। ওরা দু-জনে আলাদা হয়ে ঢুকে গেল চারতলা ও পাঁচতলার দু-টি ফ্ল্যাটে।

নার্সটিও চলে গেছে ঘর থেকে। একা ঘরের মধ্যে বসে শোভনকুমার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে সত্যিকারের একটি পুলিশের গাড়ি। সত্যিকারের তিনজন ইন্সপেক্টর সোজা উঠে এল দোতালায়।

একজন ইন্সপেক্টর শোভনকুমারকে বলল, ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট।

তারপর সিঁড়িতে দাঁড়াননা কৌতূহলী জনতার মধ্য থেকে দু-তিনজনকে ডেকে বলল, আমরা একে, ডি আই আর এ অ্যারেস্ট করছি। এর ঘর থেকে আমরা যেসব জিনিসপত্র উদ্ধার করব, আপনারা তার সাক্ষী থাকুন।

শোভনকুমার হতভম্ভ হয়ে বলল, আমি কী করেছি? আমার নামে কী চার্জ আছে?

পুলিশ অফিসারটি মিষ্টি করে জবাব দিল, আপনার নামে কালোবাজারির অভিযোগ আছে। আপনি যে গোডাউনের ঠিকানা দিয়েছেন, তা সবই ভুয়ো।

এই অভিযোগের সমর্থনে বিস্তর কাগজপত্র বেরোলো সেই ঘর থেকে।

জনতার মধ্যে থেকে একজন বলল, কিন্তু একে তো আমরা কখনো এই বাড়িতে আগে দেখিনি! এটা তো পেরেরা সাহেবের ঘর।

পেরেরা সাহেবকেও আর কোনোদিন দেখতে পাবেন না। ইনিই অন্যের নামে এই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে রেখেছিলেন।

সব কাগজপত্রে শোভনকুমারের সই। শোভনকুমার দেখে নিজেই চিনতে পারছে, অস্বীকার করার উপায় নেই। অথচ এ ব্যাপারে সে বিন্দুবিসর্গও জানত না। ভরত গুপ্ত এই ছোট্ট ব্যাবসাটা ইচ্ছে করেই শোভনকুমারের নামে করিয়ে রেখেছিলেন, এইরকম জরুরি প্রয়োজনের কারণে। রাঁচিতে তাঁর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি বংশীলাল মাতাল অবস্থায় শোভনকুমারকে দিয়ে কাগজপত্র সই করিয়ে নিয়েছে নানা সময়ে।

বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে শোভনকুমারকে বন্দি করা হল। দড়ি বাঁধা হল তার কোমরে ও হাতে। পুলিশের গাড়িটা বেশ খানিকটা দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। বিরাট জনতার ভিড়ের মাঝখানে ওইটুকু রাস্তা হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। দু-জন প্রেস ফোটোগ্রাফার কোথা থেকে খবর পেয়ে হাজির হয়ে ছবি তুলতে লাগল দৌড়োদৌড়ি করে। কালো বাজারির কোমরে দড়ি—এই ক্যাপশান দিয়ে আগামী কালের কাগজে এই ছবি ছাপা হবে।

শোভনকুমার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আছে। তার চাচাজি তাকে এইভাবে জব্দ করল? ঠিক আছে, জেল থেকে বেরিয়ে সে নিজের হাতে চাচাজিকে খুন করবে। তারপর যা হয় তা-ই হবে।

কৌতূহলী জনতাকে ছাড়িয়ে গাড়িটা অন্য রাস্তায় পড়তেই সব কিছু অন্যরকম হয়ে গেল। এখানকার কেউ আর গাড়িটার দিকে তাকিয়েও দেখে না। এখানকার লোক ব্যস্ত আছে অন্য কাজে। একটা ষাঁড় হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে ছোটাছুটি করছে রাস্তার মাঝখানে। লোকজন ছুটে ছুটে পালাচ্ছে চারদিকে, খানিকটা ভয়ে, খানিকটা কৌতুকে।

শোভনকুমারের চোখে জল এসে গেল। সে আসলে অত্যন্ত দুর্বল ও ভীরু লোক। খুন-টুন তার ধাতে নেই। অজগরের দিকে আকৃষ্ট ছোটো পশুর মতন সে তার চাচাজি সম্পর্কে ঘোরতর টান অনুভব করে। চোখের জলের মধ্যে সে হঠাৎ বুঝতে পারল, তার চাচাজি কত দয়ালু। চাচাজি তাকে বাঁচিয়ে দিলেন। আসিফের দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তাকে ক্রমশই বেশি বিপদে পড়তে হত। দুই পক্ষের যুদ্ধের মাঝখানে সে হয়ে পড়ত অসহায় খুঁটি। সেইখান থেকে তাকে সরিয়ে আনার এর থেকে ভালো উপায় আর নেই। কয়েকদিন জেলে থাকতে হবে বটে কিন্তু একদিন-না-একদিন তাকে জামিনে খালাস দিতেই হবে। ভরত গুপ্তর নিযুক্ত সবচেয়ে মূল্যবান উকিল লড়বে তার হয়ে। তারপর যদি শাস্তিও হয়, বড়ো জোর দু-মাসের কারাবাস ও কয়েক হাজার টাকা ফাইন। ফাইনের টাকাটা তো নস্যি। তার হয়ে অন্য লোক জেল খেটে আসবে—তাকেও দু-আড়াই হাজার টাকা দিলেই হবে। শোভনকুমার চোখের জল মুছে ফেলল। আলিপুরের নিজের বাড়িতে আত্মারাম একটা টাকার স্কুপের সামনে বসে আছেন। সব এক-শো টাকার নোটের বাণ্ডিল। আত্মারামের চেহারাটি বিরাট, দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রস্থ বেশি। তাঁর ঘুম না হওয়ার অসুখ আছে বলে মুখখানা সবসময় চোপসানো মনে হয়।

আত্মারাম একটু আগে খেলার মাঠ থেকে ফিরেছেন। খেলা ভন্ডুল করার ব্যাপারে ভরত গুপ্তর পরিকল্পনাটি এমনই নিখুঁত যে সত্যিই তারিফ করতে হয়। কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। যে রেফারি ছিল, তার সম্পর্কে কেউ কোনোদিন বদনাম দিতে পারেনি, সেই লোক আজ গাধার মতন পর পর ভুল করতে লাগল কী করে? দর্শকদের মধ্যে ভরত গুপ্তর সাজানো কিছু লোক থাকলেও অনেক খাঁটি দর্শক সেই সঙ্গে নেমে এসেছে মাঠে। আর সেই নাকে ঘুষি মারার ব্যাপারটা? সকলের চোখের সামনে পরিষ্কার ছবির মতন–।

আত্মারাম দু-জন অনুচরকে ডেকে টাকাগুলো দেখিয়ে বললেন, এর থেকে দশ লাখ গুনে আলাদা করো।

লোক দু-টি হাঁটু গেড়ে বসে টাকা গুনতে লাগল। আত্মারাম তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন সে-দিকে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মধ্যে তাঁর কপালে ঘাম জমছে। রুমাল নেড়ে নেড়ে হাওয়া খেতে খেতে ভাবলেন, এত সহজে খেলা বন্ধ করা যায়, এটা তাঁর বোঝা উচিত ছিল। তিনি ভেবেই দেখেননি যে এই বিশেষ দিনে খেলাটা বন্ধ করার তাৎপর্য কতখানি। ভরত গুপ্ত এবার খুব জোর টেক্কা দিয়েছে। লোকটা প্রায়ই আজে বাজে বাজি ফেলে ইচ্ছে করে হারে, তার জন্যই প্রতিপক্ষকে বেশি চিন্তা করতে দেয় না। যাক, এরপর থেকে সাবধান হতে হবে।

লোক দু-টি টাকা গোনা শেষ করে বসে আছে চুপ করে। আত্মারাম বললেন, ঠিক হুয়া তো? ফির সে গুনো।

একজন বলল, দু-জনে আলাদা করে গুনেছি। বেশি হয়নি।

আত্মারাম ধমক দিয়ে বললেন, বেশি গেলে ক্ষতি নেই। কম না হয়। দেখো আর একবার!

আবার গোনা হল। তারপর সেগুলো ভরা হল একটা বালিশের মধ্যে। বালিশটাতে পরানো হল মখমলের ওয়াড়। আত্মারাম সেটা হাতে নিয়ে ওজন করে বললেন, বাঃ! আমার বাগান থেকে দশটা গোলাপ ফুলও এই বালিশের সঙ্গে পাঠিও।

একজন সহচরের দিকে আঙুল তুলে আত্মারাম বললেন, তুমি এটা পৌঁছে দাও। তুমি বলবে, শুধু তুমি ভরত গুপ্তর হাতেই দেবে। ভরত গুপ্ত অবশ্য নিজের হাতে নেবে না কিছুতেই, ওর অনেকরকম বাতিক আছে। কিন্তু অন্য কেউ নিলেও তুমি দেখবে যাতে ভরত গুপ্ত সেখানে উপস্থিত থাকেন। তুমি তাঁকে বলবে, আমি বলেছি, এই বালিশ মাথায় দিয়ে আপনার ভালো ঘুম হোক।

আত্মারাম অন্য সহচরটিকে বললেন, তুমি একটু দাঁড়াও।

বালিশটা নিয়ে প্রথম জন চলে যাবার পর আত্মারাম তাঁকে বললেন, বোসো। কলকাতা শহরে এখন চিনির স্টক কত?

দু-লক্ষ কুইন্টাল।

হুঁ। ডাল কত?

লোকটি যেন যন্ত্র। বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে উত্তর দেয়, তিন লক্ষ সাতাশি কুইন্টাল।

হু। চালের খুচরো দর কত যাচ্ছে?

চার টাকা তিরিশ পয়সা কেজি।

কাল থেকে বাজারের সব ডাল কিনে নেবে। আগামী সাতদিনের মধ্যে বাজারে একদানা চিনিও বার করবে না। ডালের দাম প্রতি কেজিতে আট আনা বাড়াবে। যার ইচ্ছে হয় নেবে, যার ইচ্ছে না হয় নেবে না। বড়বাজারে কেউ যদি কম দামে ডাল ছাড়তে চায়, তার কাছে আমার নাম করবে। যদি কথা না শোনে, তাদের নাম জানিয়ে দিও পুলিশের কাছে।

সব ঠিক হয়ে যাবে।

পাঁউরুটির কী করা যায়? কিছু করা যাবে?

যাবে।

বাঃ। সাতদিনে আমাকে টাকাটা তুলে নিতে হবে। তা ছাড়া, গভর্নমেন্টের লোকগুলো ভরত গুপ্তর আঙুলের খেলায় নাচছে, ওদের একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। এখন ডবল দাম দিলেও বেবি ফুড ছাড়বে না। ভরত গুপ্ত নাকি আজ তার নিজের ভাইপোকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে?

হ্যাঁ।

আত্মারাম তখন উচ্চকণ্ঠে হা-হা করে হেসে উঠলেন। প্রভু হাসলে ভৃত্যের গম্ভীর থাকা চলে না, তাই অন্য লোকটিও হাসতে শুরু করল।

ঠিক সেই সময়ে ডায়মণ্ড রোড ধরে ছুটে যাচ্ছে দু-টি সুদৃশ্য আমদানি করা গাড়ি। একটা গাড়িতে আত্মারামের ছেলে ব্রীজমোহন আর প্রখ্যাত মিশরীয় ক্যাবারে নর্তকী রিন টিন টিন। উভয়েরই হাতে বিয়ারের গেলাস। ব্রীজমোহনের অন্য হাত তার সঙ্গিনীর উরুর কাছে সদা ব্যস্ত। অন্য গাড়িতে ব্রীজমোহনের ইয়ার বকশির দল।

এমন সময় উলটোদিক থেকে ধেয়ে এল দৈত্যের মতন ট্রাক। ট্রাকটি খালি এবং ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই। চওড়া রাস্তা এবং প্রচুর জায়গা থাকা সত্ত্বেও ট্রাকটি অত্যন্ত কৌশলে ব্রীজমোহনের গাড়িটিকে পাস দেবার জন্য হাত দেখিয়েও ধাক্কা লাগালো পাশের দিকে। ব্রীজমোহনের গাড়িটি ছিটকে পড়ল পাশের ধানের খেতে। ট্রাকটি উর্ধ্বশ্বাসে পালাল।

অন্যরা যখন ব্রীজমোহনের কাছে গেল, তখনও ব্রীজমোহনের এক হাতে ধরা কাচের গেলাস, সেই গেলাসটা অনেকখানি ঢুকে গেছে তার গালের মধ্যে। হাতখানা কনুইয়ের কাছে ভেঙে সাদা হাড় বেরিয়ে এসেছে। রিন টিন টিন আহত হলেও জ্ঞান হারায়নি। সে দুর্বোধ্য ভাষায় গালাগালি দিয়ে কাঁদতে লাগল।

শোভনকুমারের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ আসিফ সাহেবের কাছে পৌঁছোল বিকেল চারটের সময়। তিনি বিনা মন্তব্যে খবরটা শুনলেন। একটা ঠাণ্ডা নিষ্ঠুরতার ভাব খেলে গেল তাঁর মুখে। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে তিনি দু-তিন মিনিট চিন্তা করলেন।

তারপর দুমুখকে জিজ্ঞেস করলেন, অন্য সব অবস্থা এখন কীরকম?

লোকটি সংক্ষেপে বলল, হট।

আসিফ সাহেব বললেন, আই উইল মেক ইট হটার। আমাকে যে কালই চলে যেতে হচ্ছে।

সিণ্ডিকেট বলছে, আপনার আজই চলে যাওয়া উচিত। ইভনিং ফ্লাইট বুক করে রেখেছি।

আজই? কেন?

রেণ্ডির বাচ্চা শোভনকুমারটা পুলিশের কাছে কী বলবে তার ঠিক নেই।

পুলিশ? ফুঁঃ!

কলকাতায় অপারেশানটা আমাদের পরে এসে ঠিক করতে হবে। লোকাল লোকদের ওপর ঠিক ভরসা করা যাচ্ছে না। খবর পেয়েছি, ডক এরিয়ায় আমাদের সব লোককে পুলিশ আজ ধরার চেষ্টা করবে। আমরা সবাইকে সরে যেতে বলেছি।

ব্লাডি ফুল, তারা সরে গেলেই অন্য লোক এসে ঢুকে পড়বে। ভরত গুপ্ত তো তাই-ই চায়। ঠিক আছে, ফ্লাইট ক-টায়?

দশটায়। জামশেদপুর থেকে।

আর আগে আমি আর একবার বেরুব।

আসিফ সাহেব আত্মারামকে টেলিফোনে ধরবার চেষ্টা করলেন। তিন-চার জায়গায় নম্বর চেয়েও পাওয়া গেল না। আসিফ তখন অসীম বিরক্তির সঙ্গে টেলিফোনটা ছুড়ে ফেললেন টেবিলের ওপর।

অবিলম্বে আসিফ বেরিয়ে এলেন হোটেল থেকে। তাঁর নিজের হাতে বিস্কুট ভরতি ছোটো সুটকেসটা। অন্য দু-জন লোকের হাতে আর দু-টি ব্যাগ। কাউন্টারে তাঁর দাম মিটিয়ে দিল সঙ্গীদের মধ্যে একজন।

তিনি বাইরে দাঁড়াতেই একটা গাড়ি চলে এল। সদলবলে গাড়িতে উঠে আসিফ বললেন, খিদিরপুর।

ঝকঝকে বিকেলের আলোর মধ্য দিয়ে গাড়িটা চলতে লাগল কলকাতার রাস্তা দিয়ে। রাস্তায় সেই একইরকম ভিড়। মিছিল, ভিখিরি, প্রেমিক-প্রেমিকা, অধ্যাপক, দালাল, ছাত্র, ব্যবসায়ী, কেরানি, বেকার, কবি, শিল্পী, বেশ্যা, জননেতা, বাঘ, কুমির, সাপ।

আসিফের গাড়িটা সাবলীল গতিতে এগিয়ে, গঙ্গার ধার ঘুরে এসে পড়ল ওয়াটগঞ্জে। একটা বস্তির কাছে থামল। আসিফের সঙ্গী দু-জন নেমে গিয়ে এমন কয়েকজন লোককে ডেকে আনল যাদের কোনোক্রমেই ওই বস্তিতে থাকার কথা নয়। ওয়াটগঞ্জের বস্তি কলকাতার দরিদ্রতম জনবসতির অন্যতম, আবার ওখানেই এমন কিছু লোক থাকে, যারা যেকোনো সময় এক লক্ষ টাকা বার করতে পারে।

আসিফ খুব চাপা উর্দুতে জিজ্ঞেস করলেন, স্ট্রাইক ভেঙেছে?

একজন লোক বলল, না।

বন্দরে ধর্মঘটের সময় সিকিউরিটি ব্যবস্থার অনেক কড়াকড়ি হয়। ভরত গুপ্ত ইউনিয়নগুলির মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্রের বীজ ছড়িয়ে ধর্মঘট লাগিয়ে দিয়েছে, তা আসিফ এখনো বুঝতে পারেননি। এইভাবে ভরত গুপ্ত ইউনিয়নগুলোকে অপ্রত্যক্ষভাবে হাত করে নিয়ে আসিফের চেনটা ভেঙে দিতে চাইছেন! হাতঘড়ির একটা বিরাট কনসাইনমেন্ট জাহাজে আটকা পড়ে আছে। আসিফের লোকজন কিছুতেই তা বার করতে পারছে না। মুখ্যমন্ত্রী কালিম্পং সফর শেষ করে না ফিরলে ধর্মঘট আর মিটবে না—এখন এটা রাজনৈতিক স্তরে চলে গেছে।

আসিফ বললেন, আমার হাতে বেশি সময় নেই। তোমরা ধর্মঘট ভাঙতে পারবে? আত্মারামের ওপর আমরা আর ভরসা করতে পারছি না। ওটা একটা গাধা।

লোকেরা বলল, তারা ধর্মঘট ভাঙতে পারবে না।

আসিফ বললেন, তাহলে আজ রাত্রেই একটা বড় রকমের দাঙ্গা লাগিয়ে দাও এখানে। বোমা ছুড়তে পারে এমন যতগুলো ছেলেকে পাও জোগাড় করো। রাজনীতির লোকেদের বেশি মারবে। তাহলেই দেখবে এমনিতেই আরও অনেক ছেলে জুটে যাবে। অন্তত দু তিনজন মন্ত্রীকে যেন এখানে ছুটে আসতে হয়। বিকেল থেকেই শুরু করবে, তাহলে দিল্লিতে ঠিক সময় খবর পৌঁছোবে।

আসিফ সহকারী দু-জনের দিকে ইঙ্গিত করতেই তারা হাতের ব্যাগ খুলল। আসিফ গোছা গোছা টাকা তুলে দিলেন ওদের হাতে। এবং চারটে রিভলবার। তারপর বললেন, কাজ ভালো হলে বোনাস পাবে।

আসিফ আর অপেক্ষা করলেন না। গাড়ি ছেড়ে দিল। একটু দূরে যেতেই মোড়ের কাছে একজন ট্রাফিক কনস্টেবল হাত দেখিয়ে গাড়িটা থামালো। তারপর সে এগিয়ে আসতে লাগল গাড়ির দিকে।

কনস্টেবলটির কি উদ্দেশ্য ছিল তা জানা গেল না। তার আগেই ঘৃণায় এবং বিরক্তিতে আসিফের মুখ কুঁচকে গেল। তিনি অনুচরদের দিকে তাকিয়ে হুকুম দিলেন, ফায়ার!

দু-জন সহচরই একসঙ্গে চালাল গুলি। কনস্টেবলটির লম্বা শরীর ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে। ছাপরা জেলার রামধারী সিং পাঁচটি সন্তানের জনক এবং বারোটি পোয্য সমেত এক পরিবারের অধিপতি মৃত্যুর আগে জানল না সে কেন মরছে।

আসিফের গাড়ি বেরিয়ে গেল হুস করে। চাঁদপাল ঘাটের কাছে আসিফ এবং তাঁর সঙ্গীরা নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে। একটা স্পিড বোটে চেপে অপরাহের গঙ্গায় সুবিদিত দৃশ্যের মধ্য দিয়ে চলে এলেন এপারে। হাওড়ায়। সেখানে নির্দিষ্ট জায়গায় আর একটি গাড়ি অপেক্ষা করছিল। সেই গাড়িতে ওরা ওঠার পর সেটা দুর্দান্ত গতিতে ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে ছুটল জামসেদপুরের দিকে। সঙ্গে বিস্কুটের সুটকেস থাকলে আসিফ কখনো কলকাতার এয়ার পোর্ট ব্যবহার করেন না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়