খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ব্যাপারে ভদ্রলোকের চুক্তি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী কলকাতায় ফিরে অতি-দ্রুত থামিয়ে দিয়েছেন দাঙ্গা-হাঙ্গামা। উপদ্রুত এলাকায় গিয়ে তিনি জিপ গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে জনগণের সহযোগিতা চেয়েছেন। মিসায় গ্রেপ্তার হয়েছে তিন হাজার। তেল, ডাল, চিনি, কেরোসিন, পাঁউরুটি বাজারে ফিরে এসেছে, কিছু বর্ধিত দামে। এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে একটা বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানানোর জন্য ধার্য হয়েছে দেড় সপ্তাহ পরের একটি তারিখ। কলকাতা আপাতত কয়েকদিন শান্ত।

বিকেল বেলা বাড়িতে থাকলে দীপুকে নিজেকেই চা বানিয়ে খেতে হয়। তার ছোড়দি আর জামাইবাবু দু-জনেই চাকরি করেন, ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে যায় বেশ।

ঠিকে ঝি ক-দিন ধরে আসছে না। সল্টলেকের খালধার থেকে তুলে আনা কী এক রকমের বুনো শাক খেয়ে তাদের বাড়ির সকলের গায়ে নাকি গরল বেরিয়েছে।

দুপুর বেলা শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়তে পড়তে বিকেলের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল দীপু। ঘুম যখন ভাঙল তখন সাড়ে পাঁচটা, একটু একটু অন্ধকার হয়ে এসেছে। ধড়মড় করে উঠে বসল দীপু। দরজা-টরজা সব খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, এদিকে চোরের উপদ্রব খুব বেড়েছে।

একটু চা না খেলে চলে না। রান্নাঘরে এসে দীপু বেশ অসুবিধেয় পড়ল। গ্যাসের উনুন আছে, কিন্তু গ্যাস নেই। খবর দিলেও দশ-বারো দিনের আগে পাওয়া যায় না। কেরোসিনের স্টোভ আছে, কেরোসিন নেই। কোন দোকানে যেন সকালে লাইন দিয়ে দাঁড়ালে কেরোসিন পাওয়া যায়—কিন্তু কে আনবে? জামাইবাবু শৌখিন লোক, উনি জীবনে কখনো বাজারেই ঢোকেননি—লাইনে দাঁড়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। উনি বলে দিয়েছেন, বাড়িতে রান্না না হলে আমি না খেয়ে থাকব, তবু ও সব কাজ আমার দ্বারা হবে না। আর ছোড়দি কিছুতেই দীপুকে এসব কাজে পাঠাবে না কখনো। অপর্ণার বড়ো আদরের ভাই। তা ছাড়া, দীপু আর ছোড়দির বাড়িতে থাকে বলেই ছোড়দি অত্যন্ত সাবধানী, যাতে দীপু কখনো না মনে করে যে তাকে দিয়ে খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। দীপুর নিজে থেকে কিছু করা উচিত, কিন্তু খেয়ালই থাকে না। এইসব সাংসারিক ব্যাপারে তো সে কখনো মাথা ঘামায়নি। দীপু ঠিক করল, কাল সকাল বেলা কারুকে কিছু না বলে সে কেরোসিন এনে ছোড়দিকে চমকে দেবে।

সুইচ টিপে দেখল, আলো জ্বলছে। যাক, আজ লোডশেডিং-এর দিন নয়। একটা ছোটো ইলেকট্রিক হিটারে দীপু এক কেটলি জল বসিয়ে দিল। খালি বাড়িতে থাকলে মনটা কীরকম চঞ্চল হয়ে যায়। শান্তার কথা বারবার মনে পড়ে। এইরকম একটা ফ্ল্যাট তাকেও ভাড়া নিতে হবে। সেখানেও গ্যাস, কেরোসিন, চিনি, চাল এইসব জোগাড় করার সমস্যা থাকবে। যাক, শান্তা খুব কাজের মেয়ে, ও সব ম্যানেজ করতে পারবে। কিন্তু চাকরিই জুটল না এখন পর্যন্ত। দীপু মনে মনে হাসল।

এক কেটলি গরম জলে তিন কাপ চা হল, সবটাই খেয়ে ফেলল দীপু। তারপর জামাকাপড় বদলে বেরুবে। তার শার্টের পকেটে মাত্র এক টাকা বারো আনা আছে। সুটকেসে আর একটাও টাকা নেই। টাকাপয়সা জোগাড় করার একটা ব্যবস্থা না করলে আর চলছে না। একটা কিছু এবার করতেই হবে। সে যাক গে, এখন তো এত কম পয়সা পকেটে নিয়ে বেরুনো যায় না।

ক-দিন ধরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রায়ই দীপুর পকেট মারা যাচ্ছে। তার পকেটে দু-তিন টাকার বেশি থাকে না, তবু পকেট মাররা তার পকেটের দিকেই নজর দেয়। কী বোকা রে বাবা! পর পর দু-দিন এরকমভাবে দীপুর পকেট কাটা গেছে। একদিন তো এমন অবস্থা, শান্তার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। অথচ দীপুর বাস ভাড়া পর্যন্ত নেই। হেঁটেই যেতে হল তিন মাইল। শান্তা চলে যায় নি, দাঁড়িয়েছিল ঠিক। তারপর শান্তার কাছ থেকে দীপুকে পয়সা চাইতে হল।

ছোড়দির ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার ঘেঁটে তিনটে টাকা পেয়ে গেল। ছোড়দির ভুলো মন, যেখানে-সেখানে টাকাপয়সা রাখে, এই একটা সুবিধে। সেই স্কুলে পড়ার সময় দীপু ছোড়দির ড্রয়ার থেকে টাকা নেয়, সেই অভ্যেস এখনো যায়নি। এই টাকা তিনটের কথা ছোড়দির মনে না থাকলেই ভালো। ছোড়দি যদি বুঝতে পারে দীপু নিয়েছে, তাহলে ছোড়দি আবার জোর করে তাকে দশ টাকা কুড়ি টাকা দেবার চেষ্টা করবে।

ফ্ল্যাটের দরজায় তালা লাগিয়ে দীপু চাবিটা দিতে গেল একতলায়। এই রকমই বন্দোবস্ত। একতলার ফ্ল্যাটের চিন্ময়বাবু আর তাঁর স্ত্রী সেই সময় খুব ঝগড়া করছিলেন। হঠাৎ দীপু এসে পড়ায় তাঁরা অপ্রস্তুত হয়ে থেমে গেলেন। চিন্ময়বাবুর মুখে তখনো রাগ-রাগ ভাব, সেই অবস্থাতেই তিনি দীপুকে বললেন, আসুন-না, ভেতরে একটু বসবেন, চা খেয়ে যান।

দীপুর পেটে তখন তিন কাপ চা। সে হেসে বলল, এখন চা খাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। চলি!

চিন্ময়বাবু আর ঊষা বউদির বিয়ে হয়েছে মাত্র এক বছর আগে, তবু ওঁরা প্রায়ই ঝগড়া করেন। ছোড়দি আর জামাইবাবুকে এ-রকম ভাবে চেঁচিয়ে ঝগড়া করতে কখনো দেখেনি দীপু, কিন্তু মাঝে মাঝে ওঁদের শোবার ঘরে চাপা রাগের কথাবার্তা হয়, দীপু টের পেয়েছে।

দীপু যখন থাকে না, তখনও কি এ-রকম ঝগড়া হয়? বিয়ে করলেই কি স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া করতেই হবে? দীপুর একটু ভয় ভয় করে।

বাইরে বেরুবার পরই এক ঝলক টাটকা হাওয়া মুখে এসে লাগায় দীপুর মন ভালো হয়ে গেল। সে সহজেই খুশি হতে জানে। ফুলবাগানের মোড় পর্যন্ত সে হেঁটেই যাবে ঠিক করল।

তার অনুসরণকারী আজ একটা গাড়ি নিয়ে এসেছে। দীপু হাঁটতে শুরু করায় বেশ অসুবিধে হল লোকটির। গাড়িতে আজ তার অন্য দু-জন সঙ্গীও আছে।

ফুলবাগানের মোড় থেকে দীপু একটা টেলিফোন করল শান্তার বাড়িতে। রিসিভারটা তুলে ডায়াল ঘোরাবার আগেই দীপুর মনে হল, শান্তা এখন বাড়িতে থাকবে না। সে মনশ্চক্ষে দেখতে পেল শান্তাদের বাড়ি, বিভিন্ন ঘর, বারান্দায় চেয়ারগুলো ঠিক কীভাবে ছড়ানো, শান্তার বাড়ির আর সবাই আছে শুধু শান্তা নেই। দীপু মাঝে মাঝে এ-রকম দেখতে পায়।

তবু তিরিশ পয়সা খরচ করে টেলিফোন করতেই হল। শান্তার মা বললেন, শান্তার ফিরতে দেরি হবে, ওদের কলেজের সোশ্যাল ফাংশান আছে!

শান্তাকে না পেয়ে দীপু ঠিক দুঃখিত বোধ করল না, আগে থেকে যা মনে হয়, সেটা মিলে গেলে সে একটু সুখও পায়।

এবার সে কোথায় যাবে? একলা কোনো একজন মানুষ সন্ধ্যে বেলা কোথায় যায়? দীপুর কোনো যাবার জায়গা নেই। তাহলে সে অরূপের এগজিবিশনেই যাবে।

তার বন্ধু অরূপের ছবির একক প্রদর্শনী হচ্ছে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে। দীপু সেখানে দু-তিন দিন গেছে। তবু ওখানে গেলে সময় কাটবে। বাসে উঠে দীপু ময়দানে পৌঁছে। গেল। ছবির ক্যাটালগের দাম এক টাকা, দীপু সেগুলো বিক্রির ভার নিয়ে বসল।

প্রদর্শনীতে ভিড় খুবই কম! অরূপের ছবির ভাললা সমালোচনা বেরিয়েছে সব কাগজে, কিন্তু একটাও বিক্রি হয়নি। ক্যাটালগ বিক্রি হল মাত্র সাত টাকার—দীপু সেই টাকাটা অরূপকে বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সাড়ে আটটার সময়। এখুনি বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। সে কিছুক্ষণ একলাই হাঁটতে লাগল ময়দানের মধ্যে দিয়ে। অন্ধকারে একলা হাঁটতে তার খারাপ লাগে না। তার নিজের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস আছে, সুতরাং সঙ্গীর অভাব হয় না।

শান্তা কি বাড়ি ফিরেছে? এখন কি শান্তার বাড়িতে যাওয়া যায়? দীপু চোখ বন্ধ করে শান্তাকে খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু সব কিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে। অনেক লোকের ভিড়ে শান্তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। দীপু অস্ফুট গলায় বলল, শান্তা, আমি তোমাকে এক্ষুনি চাই।

একটু বাদে একজন পেছন থেকে তার নাম ধরে ডাকল, দীপাঞ্জনবাবু।

দীপু থমকে দাঁড়াল। লোকটি দ্রুত এগিয়ে এসে বলল, দীপাঞ্জনবাবু, আপনার সঙ্গে জরুরি দরকার আছে।

দীপু বিস্মিতভাবে বলল, আপনি, মানে, আমি তো ঠিক–

লোকটিকে দেখলে অবাঙালি বলে মনে হয়, কিন্তু কথা বলছে পরিষ্কার বাংলায়। দীপু জীবনে একে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না।

লোকটি বলল, আপনি তো রতনবাবুকে চেনেন, আমি তাঁর বিশেষ বন্ধু। আপনার দাদার নাম নীলাঞ্জন, তিনিও আমাকে চেনেন।

দাদার নাম শুনে দীপু একটু কেঁপে উঠল। দাদা রাজনীতি নিয়ে খুব জড়িত। অনেকদিন দাদার খোঁজ নেওয়া হয়নি।

লোকটি বলল, খুব একটা বিপদ হয়ে গেছে, আপনাকে এখুনি একবার আসতে হবে আমার সঙ্গে।

কোথায়? কার বিপদ?

এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় নেই। গাড়িতে উঠুন, যেতে যেতে সব বলছি।

হতভম্ব দীপুর হাত ধরে প্রায় জোর করেই লোকটি পাশে দাঁড়ানো একটা গাড়িতে তুলল।

দীপুর জ্ঞান ফিরল পরদিন সকাল দশটায়। চোখ মেলে প্রথমটায় সে ভাবল, এটা একটা স্বপ্ন-টপ্ন নাকি? এক মুহূর্তেই বোঝা যায়, স্বপ্ন নয়। তার ডান হাতে ব্যথা, কেউ তাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছিল, তবে আবছাভাবে মনে পড়ছে। মাথাটা এখনো পরিষ্কার হয়নি।

সে শুয়ে আছে একটা অচেনা ঘরে। ঘরটি বেশ বড়ো, কিন্তু খাট আর একটা টেবিল ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। হালকা নীল দেওয়ালের রং। দীপু উঠে প্রথমেই দরজাটা টেনে দেখল। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ।

দীপু ভীতু প্রকৃতির ছেলে নয়। সে বুঝতে পারল, কেউ তাকে জোর করে ধরে এনেছে এখানে। এ ব্যাপারে ভয় পাবার বদলে সে মাথা ঠাণ্ডা করে চিন্তা করতে বসল। তাকে কে ধরে আনবে? এ ব্যাপারে কার, কী স্বার্থ থাকতে পারে?

দীপু কোনো উত্তর পেল না। যাই হোক, দেখা যাক। ঘর সংলগ্ন একটি বাথরুম আছে, সেখানে নতুন ভোয়ালে, টুথপেস্ট, ব্রাশ, দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম। দীপু সেখান থেকে প্রাতঃকৃত্য সেরে এল।

একটু পরেই দরজা খুলে একজন লোক এক ট্রে ভরতি খাবার নিয়ে এসে ঢুকল। তাতে দুধ, কর্নফ্লেকস, টোস্ট, কলা, আপেল ইত্যাদি রয়েছে। ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রেখে লোকটি জিজ্ঞেস করল, চা না কফি?

দীপু ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

চা না কফি?

সে কথা পরে হবে। এখানে কী ব্যাপার চলছে? এটা হোটেল না কারুর বাড়ি?

বাড়ি। খেয়ে নিন, বড়োবাবু একটু পরে আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।

বড়োবাবু মানে কোন বাবু?

চা না কফি?

কফিই নিয়ে এসো তাহলে। তুমি সিগারেট আনতে পারবে? চায়ের পর আমি সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারি না।

ভরত গুপ্তর কাছে দীপুকে নিয়ে যাওয়া হল ঠিক বারোটার সময়। দোতলার ডাইনিং রুমে বিশাল টেবিলে এক প্রান্তে ভরত গুপ্ত একা বসেছিলেন। দু-জন লোক দীপুকে সঙ্গে নিয়ে সেই ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে দাঁড়াল।

ভরত গুপ্ত দীপুর আপাদমস্তক ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন, বোসো।

ভরত গুপ্তর ব্যক্তিত্ব এবং আড়ম্বরের সামনে দীপু একটু আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিল। সে বুঝতে পারল, এটা তাকে কাটাতে হবে।

এরপর প্রায় এক মিনিট ভরত গুপ্ত কোনো কথাই বললেন না, শুধু তাকিয়ে রইলেন দীপুর দিকে। এটা একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। দীপুও প্রথমে কী কথা দিয়ে শুরু করবে বুঝতে পারছে না।

ভরত গুপ্ত একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ! তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তোমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে, তুমি জান?

না।

আমার একটা বিশেষ শখ মেটাবার জন্য।

কিন্তু আমাকে জোর করে আনা হয়েছে। এটা অন্যায়।

তোমার ওপর এখন থেকে আর কোনো অন্যায় করা হবে না। ও-সব পুরোনো কথা ভুলে যাও।

দীপু তাকিয়ে দেখল, যে লোক দু-টি তাকে এ ঘরে নিয়ে এসেছিল, তারা তখনও দরজার কাছে প্রহরীর মতন দাঁড়িয়ে আছে। আর টেবিলের ওপাশের লোকটি গম্ভীর গলায় ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাকে কাবু করার চেষ্টা করছে।

দীপু সোজা হয়ে উঠে বসে বলল, আমাকে কোনো অচেনা লোক তুমি বলে কথা বলে না। এখানে এসব কী হচ্ছে আমি জানতে চাই।

আমার নাম ভরত গুপ্ত।

এ নাম আমি আগে কখনো শুনিনি।

তোমার পক্ষে না শোনারই কথা। তোমাকে এখন থেকে এই বাড়িতে থাকতে হবে।

কেন?

তোমার কোনোরকম অসুবিধে হবে না। তুমি যা চাও তাই পাবে।

কিন্তু অন্য কারুর বাড়িতে আমি থাকতে যাব কেন?

দীপু নিজের ব্যক্তিত্ব ফোটাবার জন্য খানিকটা হালকা গলায় বলল, ব্যাপারটা কী বলুন তো? আপনি কি ডাকাত-টাকাত নাকি?

ভরত গুপ্তও হেসে জবাব দিলেন, না, আমাকে ডাকাত কেউ বলে না। চুরি-ডাকাতি আমি পছন্দ করি না।

তাহলে আপনার পেশা কী?

স্পেকুলেশান বলতে পার।

তার মানে কী? শেয়ার মার্কেট? সে যাই হোক, আপনি কি আমাকে নিয়েও ফাটকা খেলতে চান নাকি? আমাকে ধরে এনেছেন কেন?

এটা আমার একটা শখ। আমি চাই, তুমি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে। দেখি, তুমি আমাকে হারাতে পার কিনা।

যুদ্ধ? আপনার সঙ্গে আমি কী যুদ্ধ করব?

তলোয়ার বন্দুকের যুদ্ধের কথা বলছি না। অন্যরকম। আমি সারাজীবনে অনেকের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি, পুলিশ, ব্যবসায়ী, পলিটিশিয়ান, আত্মীয়স্বজন। কিন্তু সত্যিকারের কোনো সৎ এবং নির্লোভ মানুষ আজ পর্যন্ত দেখিনি। আমি সেইরকম একজন মানুষের সঙ্গে এবার একবার যুদ্ধ করতে চাই। অনেক খুঁজে খুঁজে তোমাকে আনানো হয়েছে।

দীপু হেসে বলল, আমি সৎ লোক? আপনার লোক নিশ্চয়ই ভুল করেছে। আমার অনেক রকম লোভও আছে, দুর্বলতাও আছে। আমি নিজেকে খুব ভালোরকম জানি।

ভরত গুপ্তও এবার হাসলেন। তারপর বললেন, গত দেড় মাস ধরে সবসময় তোমার পেছনে একজন লোক ঘুরছে। তোমার গতিবিধি সমস্ত কিছু আমার জানা। সারাকলকাতায় অনেকের পেছনে এ-রকম লোক লাগানো হয়েছিল। তাদের ভেতর থেকে হেঁকে তোলা হয়েছে তোমাকে। তোমাকে দিয়েই আমার কাজ চলে যাবে।

দীপু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই।

ভরত গুপ্ত হুকুম করলেন, বোসো!

দীপু পেছন দিকে তাকাল। দরজার বাইরে দু-জন রক্ষী তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ক্রমশ সে আরও বেশি বিস্মিত হয়ে পড়ছে। সে সত্যিই একটা অচেনা বাড়িতে বন্দি? কিছুতেই যেন বিশ্বাস হতে চায় না। তার মতন একটা ছেলেকে এ-রকমভাবে বন্দি করে রেখে এদের কী লাভ? কাল সে বাড়ি ফেরেনি, ছোড়দি আর জামাইবাবু এতক্ষণ কী ভাবছে কে জানে!

আমি চলে যেতে চাইলে কি জোর করে আমাকে আটকে রাখা হবে?

আমি জোরজারি করা পছন্দ করি না। কিন্তু তোমার জন্য অনেকটা সময় এবং অনেক টাকা খরচ করা হয়েছে। তোমাকে এখনই চট করে যেতে দেওয়া যায় না। তুমি যেতে চাইছ কেন? তোমার বাবা-মা নেই আমি জানি! সংসারের কোনো দায়-দায়িত্ব তোমার নেই। এখানে তুমি সব কিছু পাবে।

আপনার এ-রকম অদ্ভুত শখের মানে কী?

লোকে আমাকে অসৎ লোক ভাবে।

লোকে আপনার সম্পর্কে যা খুশি ভাবুক, তাতে আমার কী আসে যায়?

তুমি সৎ আমি অসৎ, তোমার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্বযুদ্ধ হবে। তুমি যদি জিততে পার, সেটা হবে একটা অদ্ভুত ঘটনা। পৃথিবীতে আজকাল আর এ-রকম ঘটনা ঘটে না। তা ছাড়া আমার একটা অদ্ভুত অসুখ আছে। অনেক চিকিৎসা করেও সেটা সারাতে পারিনি। আমার ধারণা, তোমার মতন কারুর কাছে আমি যদি হেরে যাই, তাহলেই আমার সেই অসুখটা সেরে যাবে।

কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। আপনি অসৎ, তার মানে কী? আমি নিজে জানি আমি কতখানি সৎ, আপনি বলুন তো, আপনি কত অসৎ।

অন্য অসৎ লোকদের জব্দ করার জন্য আমাকে আরও বেশি অসৎ হতে হয়। আমি চুপচাপ থাকলেই তারা আরও বড়ো হয়ে যাবে। আমার ঠাকুরদার বাবা কলকাতা শহরে এসেছিলেন লোটাকম্বল আর তেইশটা টাকা সম্বল করে। এখন আমি কলকাতা শহরের অনেকখানি অংশের মালিক। শুধু কলকাতা কেন, আরও অনেক কিছুই আমার। এখানকার লোকেরা কখন, কী খাবে কিংবা খাবে না, সেটা আমার ইচ্ছের ওপর নির্ভর।

ও, আপনি সেই ব্যবসায়ী কালোবাজারি, যাদের কথা কাগজে পড়ি?

না, কোনো কাগজে কখনো আমার নাম বেরোয় না। সেসব চুনোপুটিদের ব্যাপার। আর কালোবাজারি বললে আমাকে ছোটো করে দেখা হয়!

তাহলে আপনি কী?

আমাকে রাজা বলতে পার। আমাকে কেউ চেনে না, আমাকে কেউ দেখতে পায় না, কিন্তু আমি একটু আঙুল হেলালেই বিপর্যয় কান্ড বাধাতে পারি।

কথাগুলো কীরকম যেন নাটক নাটক মনে হচ্ছে।

এটা নাটক নয় দীপাঞ্জন বসু। এই জীবনের কথা তোমরা কেউ জান না।

ভরত গুপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এসো আমার সঙ্গে।

দীপু কৌতূহলী হয়ে তাঁকে অনুসরণ করল।

যে দু-টি ঘরে ভরত গুপ্ত নিজে ছাড়া আর কারুকে কখনো ঢুকতে দেন না, এক এক করে দীপুকে সেই ঘর দু-টিতে নিয়ে গেলেন।

একটি ঘরের চার দেয়ালে চারটি সিন্দুক। প্রায় মন্ত্র পড়ার মতন অঙ্ক কষে চাকা ঘুরিয়ে সেইসব সিন্দুক খুলতে হয়। ভরত গুপ্ত একটা একটা করে খুলে বললেন, এই দেখো! এ সবই আমার।

দীপু দেখল, ভরত গুপ্ত ব্যাংক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন না। তাঁর আলমারিতে থরে থরে টাকা সাজানো। একটাতে শুধু সোনার বাট। আর একটিতে হীরে জহরৎ। আর একটি জিনিস দীপু দেখে চিনতেই পারল না, সেটি প্ল্যাটিনাম।

ঐশ্বর্যের একটা দীপ্তি আছে। চারটে সিন্দুক ভরা সম্পর্কে যেন ঝকমক করছে ঘরটা। দীপুর চোখ ধাঁধিয়ে গেল একবার। তারপর আবার মনে হল, এগুলো সত্যি নয়, সব নকল।

ভরত গুপ্ত দেয়ালের কতকগুলি ছবির দিকে আঙুল তুলে বললেন, কলকাতায় সাতাশখানা বাড়ি আমার। বড়ো দুটো হোটেল আমার। স্টিল আর সিমেন্টের ব্যাপারে আমি যেকোনো সময় শেয়ারের বাজারে আগুন লাগিয়ে দিতে পারি। তুমি আমার এই বাড়ি এখনো ভালো করে দেখোনি—এমন কোনো আরামের কথা চিন্তা করতে পার না, যা এখানে পাবে না। এ ছাড়া দার্জিলিং-এ, রাঁচিতে, পুরীতে, এলাহাবাদে, জয়পুরে, দিল্লিতে

ভরত গুপ্ত এগিয়ে এসে দীপুর হাত চেপে ধরে বললেন, এর সব কিছুরই ভাগ তুমি পাবে। তুমি যা চাও–

দীপু স্থিরভাবে লোকটির মুখের দিকে চেয়ে রইল। অনেকদিন আগে সে বাইবেল পড়েছিল। শয়তান যিশুকে পৃথিবীর যাবতীয় ঐশ্বর্য আর ভোগ-বাসনার লোভ দেখাচ্ছে। পাহাড় চূড়ায় উঠে। ঠিক যেন সেইরকম শোনাচ্ছে।

পরক্ষণে দীপু লজ্জা পেল। এই লোকটিকে অমায়িক শয়তান ভাবতে গেলে নিজেকে যিশুর মতন মনে করতে হয়। কিন্তু সে তো যিশুখ্রিস্টের পায়ের নখেরও যোগ্য নয়।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনার কিছুই চাই না।

ভরত গুপ্ত উঁচু গলায় হেসে বললেন, আমি জানতাম, সৎ লোকেদের সামলানো এত সহজ নয়! আস্তে আস্তে হবে।

ওরা আবার চলে এল খাবার ঘরে। ভরত গুপ্ত চেঁচিয়ে আদেশ করলেন, খাবার দাও, আমাদের দুজনের।

দীপুর দিকে ফিরে তিনি বললেন, তুমি রোজ আমার সঙ্গে খাবে। আমি অবশ্য নিরামিষ পছন্দ করি, তুমি ইচ্ছে করলে মাছ মাংসও খেতে পার। আমাদের লড়াইটা কীরকম হবে জান? তুমি তোমার মতন থাকবে, আমি আমার মতন। আমি সবসময় চেষ্টা করব তোমাকে নষ্ট করতে। দেখি আমিই সেটা পারি, না তুমি আমাকে তোমার দলে টেনে ভালো করে দিতে পার। তুমি যাতে নিরস্ত্র বোধ না কর, সেইজন্যই তুমি এ বাড়ির যা খুশি জিনিস ব্যবহার করতে পার।

দীপু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল, এসব কী বলেছেন, যার কোনো মাথা-মুন্ডু নেই! ভালো করার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? আপনি অন্যায় করেছেন, পুলিশ আপনাকে জেলে দেবে।

ভরত গুপ্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, সব জেলখানাই আমার তুলনায় ছোটো। আমাদের মতন কয়েকজনকে ভরে রাখার মতন জেলখানা ভারত সরকার তৈরি করেননি।

কথাটা ভরত গুপ্ত এমন গাঢ় স্বরে বললেন যে, দীপু কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার রাগ হচ্ছে। দীপুর হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল এবার। সে আঘাত করার জন্য তৈরি হল। সরকার কিংবা দেশের নেতারা যদি এদের শাস্তি দিতে না পারে, সে একাই শাস্তি দেবে। তার হাতে এখন একটা স্টেনগান থাকার দরকার ছিল।

আবার তার মনে হল, রতনদারা কাদের বিরুদ্ধে লড়তে চাইছিলেন, এদের বিরুদ্ধে? সে সম্পর্কে কিছুই তো করলেন না, শুধু নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনি—

তিন-চারজন লোক সারিবদ্ধ হয়ে এসে খাবার রেখে গেল টেবিলের ওপরে। এত খাবার দু-জন কেন দশজন মানুষও খেতে পারে না।

ভরত গুপ্ত বললেন এসো, আগে খেয়ে নেওয়া যাক।

দীপু বলল, না।

দীপাঞ্জন, কেন এ-রকম অবাধ্যপনা করছ। আমি তোমাকে যা যা বললাম, একটাও তোমার পছন্দ হল না? তুমি কি সন্ন্যাসী, তোমার কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই?

আমি সন্ন্যাসী নই, আমার অনেক কিছুই চাইবার আছে। কিন্তু আপনার বাড়িতে আমি কিছুই ছোঁব না আর।

কেন?

আমার ঘেন্না হচ্ছে। এত লোক না-খেয়ে আছে, আর আপনার বাড়িতে এত টাকাপয়সা জমিয়ে রেখেছেন, আপনার লজ্জা হয় না?

শস্তা সেন্টিমেন্টাল কথা বোলো না! পৃথিবীতে চিরকালই বহুলোক খেতে পায়নি। সবসময়েই কেউ-না-কেউ অনেক বেশি পায়। এইসব বাজে কথা নিয়ে চেঁচাবে, ওই যারা পলিটকস করে, যারা বেশি কিছু চায়। তুমি যুবক, তোমাকে আমি যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের কথা বললাম, সেই চ্যালেঞ্জটা নেবার সাহস হচ্ছে না তোমার?

দীপু কড়া চোখে ভরত গুপ্তর চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, এই যুদ্ধের ফলাফল তো আমি আগে থেকেই জানি।

কী?

আপনি হেরে গেছেন।

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

এর মধ্যে হাসির কিছুই নেই। অন্যায় কখনো শেষপর্যন্ত জেতে না। তা ছাড়া, আমি ভবিষ্যত দেখতে পাই। আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনি হেরে গেছেন, আমার কাছে না হলেও অন্য কারুর কাছে আপনি শেষপর্যন্ত হেরে গেছেন। লোকে আমাকে ঠিক বিশ্বাস করে না, কিন্তু আমি অনেক সময়ই ভবিষ্যতের ছবি নিজের চোখের সামনে দেখি। আমি আপনার কপাল দেখেই বুঝতে পারছি, আপনি হেরে যাওয়া মানুষ, আপনি ধুলোয় লুটোচ্ছেন।

তাই নাকি? তাই নাকি? আমি কতখানি হারব? সব সমেত হারব? এটা তো আমাকে দেখতেই হচ্ছে। তা হলে আমিই চ্যালেঞ্জ নিলাম, তোমাকে কিছুতেই আর ছাড়া হবে না। খেতে বিেসসা, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

আমি আপনার বাড়িতে আর কিছুই খাব না। আমি এখনি চলে যাব।

ভরত গুপ্ত বিরাট এক ধমক দিয়ে বললেন, বলেছি, বোসো!

আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? জোর করে খাওয়াবেন!

হ্যাঁ।

দু-জন প্রতিহারী এসে দীপুকে জোর করে চেয়ারে বসাতে গেল।

দীপু ধস্তাধস্তি করে ছাড়াবার চেষ্টা করল নিজেকে। ওদের সঙ্গে গায়ের জোরে পারে না।

ওরা দীপুকে খাবার টেবিলে বসিয়ে শক্ত করে ধরে রইল কাঁধের কাছে। ভরত গুপ্ত মিটিমিটি হাসছেন।

দীপু খাবারের রূপোর থালাটা তুলে ছুড়ে ফেলল মাটিতে। আলোয় একটা রূপোলি ঝলক উঠে ঝনঝন করে শব্দ উঠল।

ভরত গুপ্ত মৃদু গলায় বললেন, ওকে ওর ঘরে বন্ধ করে রাখো। মারধোর কোরো না।

সারাদুপুর বিভিন্ন ধরনের লোক দীপুর ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে গেল একবার করে। তার মধ্যে দু-একটি মেয়েও আছে। সকলের চোখেই প্রথম দিকে কৌতূহল, তারপর অবজ্ঞা।

সারাদুপুরটা দীপু শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করল। তার সবচেয়ে বেশি অবাক লাগছে এইজন্য যে, সে এমন কি করেছে, যার জন্য এই লোকটা তাকে সৎ বলছে? সে তো অন্যদের চেয়ে আলাদা কিছু নয়।

বিকেলের দিকে দীপুর অসহ্য বোধ হল। সে চেঁচামেচি করে দরজা ধাক্কা দিতে লাগল। কেউ এল না। দুম দুম করে লাথি মারতে লাগল দরজায়। তবু কেউ আসে না। এই দরজা সে ভেঙে ফেলতে পারবে না।

দীপু অশ্রান্তভাবে চিৎকার করতে লাগল, দরজা খুলে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও! আমাকে যেতে দাও! আমার ঘেন্না করছে!

কেউ কোনো সাড়া দিল না। রাত্তিরে একজন খাবার নিয়ে এল তার জন্য। দীপু সেটাও ছুড়ে ফেলে দিল। না খেয়ে শুয়ে রইল। ঘুমিয়েও পড়ল একসময়।

পরদিন সন্ধ্যের সময় আবার দু-জন লোক দরজা খুলে দীপুকে বলল, আসুন!

দীপু বলল, আমি বাইরে যাব। আমি আর এখানে এক মুহূর্ত থাকব না।

লোক দু-টি তবু দীপুর হাত ধরে নিয়ে এল দোতলায়। দু-দিন কিছু না খেয়ে দীপুর শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। তবু সে রাগে জ্বলছে। তাকে আনা হল আবার সেই খাবার ঘরে। টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম ও কুড়ি-পঁচিশ রকমের কেক ও কুকি। এখন ভরত গুপ্ত একা নন। একটি যুবতী মেয়ে তাঁর চা হেঁকে দিচ্ছে।

ভরত গুপ্ত দীপুকে বললেন, বোসো। এখনো তোমার খিদে পায়নি?

দীপু বলল, আপনাকে তো বলেইছি, আপনার বাড়ির কোনো কিছুই আমি খাব না। আমাকে আটকে রেখেছেন কেন?

ভরত গুপ্ত সহাস্যে বললেন, এই খাবারগুলো আমার বাড়ির নয়, দোকানের। আমার মেয়ে নিয়ে এসেছে। এই আমার মেয়ে উজ্জয়িনী।

উজ্জয়িনী মুখ ফেরালো দীপুর দিকে। দীপু দেখল, মেয়েটি সুন্দরী। মেজাজ খারাপ থাকলেও সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকাতে তার ভালো লাগে।

দীপু মেয়েটির দিকে দু-এক পলক তাকিয়ে থাকতেই একটা ম্যাজিক ঘটে গেল। দীপু দেখল মেয়েটির জায়গায় শান্তা দাঁড়িয়ে আছে। তারপরেই দেখল শান্তা তার ছোড়দির বাড়িতে, ছোড়দি আর শান্তা কথা বলছে, দু-জনেই চিন্তিত। দীপু স্পষ্ট শুনতে পেল, শান্তা বললে, ও তো মাঝে মাঝেই এ-রকম দুমদাম করে চলে যায়। ঠিক ফিরে আসবে।

দীপু নিশ্চিন্ত হল। শান্তা আছে। সে উজ্জয়িনীর সঙ্গে কোনো কথা বলল না।

উজ্জয়িনী দু-পেয়ালা চা ছেকে দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ভরত গুপ্ত বললেন, উজ্জয়িনীর এখনো বিয়ে দিইনি। ওর যাকে পছন্দ তাকেই বিয়ে করবে। তবে, তাকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে।

দীপু বলল, আমি এখুনি চলে যেতে চাই।

ভরত গুপ্ত গলার আওয়াজ যতদূর সম্ভব মোলায়েম করে বললেন, তুমি এত ছটফট করছ কেন? আর দু-তিনদিন এমনিই থেকে দেখোনা, তারপর না হয় যুদ্ধ শুরু করা যাবে?

আপনাকে তো আমি বলেইছি, যুদ্ধে আপনি হেরে গেছেন। আমি দেখতে পাচ্ছি, এই বাড়িতে একদিন লাইব্রেরি হবে।

আমার জীবদ্দশায় আমি হারব না। সেইটাই তো চ্যালেঞ্জ। তোমার সাহস হচ্ছে না?

আপনার বাড়ির মধ্যে আমাকে আটকে রেখে তারপর বলছেন যুদ্ধের কথা? আপনার লজ্জা করে না?

না। জীবনে আমি কখনো লজ্জা পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। আমার ধারণা ওটা মেয়েদেরই ব্যাপার।

এই সময় গণেশলাল এসে দাঁড়াল দরজার কাছে।

ভরত গুপ্ত ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই! তোমাকে তো ডাকিনি।

না ডাকতেও এসে পড়ার জন্য গণেশলালের যতখানি সংকুচিত হয়ে থাকা উচিত ছিল, তার ভাবভঙ্গি মোটেই সেরকম নয়। সে স্পষ্ট গলায় বলল, স্যার, একটা কথা বলতে এলাম, আজ এইসব থাক-না।

কী সব থাকবে?

এই যে বাবুটির সঙ্গে আপনি যেসব কথাবার্তা বলছেন, আজ বন্ধ রাখুন। আমরা বাবুটিকে নীচের ঘরে আটকে রাখছি, তারপর কাল যা হয় হবে।

তোমার এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবার দরকার নেই।

আজ অনেকগুলো জরুরি কাজের কথা ছিল।

কোনটা জরুরি, তা আমি ভালোই বুঝি, তুমি এখন যাও!

স্যার, আজকের দিনটায় এসব বাদ দিলেই ভালো হত-না?

গণেশলাল, তোমাকে আমি যেতে বলেছি।

…স্যার, আত্মারামজি সাংঘাতিক সব কান্ড শুরু করেছেন। চাল-ডাল-চিনির কারবার ছেড়ে উনি এখন সিমেন্ট আর লোহা নিয়ে পড়েছেন। খবর আছে কী উনি বাজার থেকে সব সিমেন্ট তুলে নেবেন।

জাহান্নামে যাক আত্মারাম। সে যা-খুশি করুক। আমার কোনো ক্ষতি সে করতে পারবে না।

কানপুরে আমাদের একজন এজেণ্ট খুন হয়েছে। বোধহয় আসিফ সাহেবের লোকই—

এসব কাল শুনব। তুমি এখন যাও, এখুনি যাও।

গণেশলাল তবু একটু ইতস্তত করে, দীপুর দিকে একবার ক্রোধের দৃষ্টি হেনে অনিচ্ছার সঙ্গে বেরিয়ে গেল।

ভরত গুপ্ত বললেন, ওরা ভাবে, এটা আমার একটা আজে-বাজে খেলা। কিন্তু আমি আমার অসুখ সারাতে চাই।

দীপু বলল, আমি যদি এখান থেকে জোর করে বেরিয়ে যেতে চাই, আপনার লোকজন কি আমাকে বাধা দেবে?

তাই তো মনে হয়। এখানে কারুর ঢোকা যেমন শক্ত, বেরুনোও তেমনি শক্ত।

কিন্তু একজন মানুষকে জোর করে আটকে রাখা যায়। দেশে কি পুলিশ বা আইনকানুন কিছু নেই।

আইনকানুনের কথা থাক। আমার যুদ্ধপ্রণালী বুঝি তোমার পছন্দ নয়? শোনো দীপাঞ্জন, তোমাকে একটা কথা বলি, তোমাকে আমার ক্রমশই বেশি পছন্দ হয়ে যাচ্ছে। যত বেশি পছন্দ হচ্ছে, ততই আমি তোমাকে ছেড়ে দেবার কথা ভাবতে পারছি না।

দীপু কঠোরভাবে বলল, আপনাকে আমার একটুও পছন্দ হয়নি।

ভরত গুপ্ত তার উত্তরে খুব নরমভাবে বলল, তাই তো ভালো।

দু-জন সম্পূর্ণ বিপরীত রুচির লোকেই তো যুদ্ধ জমে।

এটা যুদ্ধ নয়, ন্যাকামি। যুদ্ধ করতে চান, আমার সঙ্গে রাস্তায় এসে দাঁড়ান।

রাস্তায়-ঘাটে তো ছোটোলোকরা যুদ্ধ করে। শারীরিক যুদ্ধ। সৎ-অসতের দ্বন্দ্ব রাস্তায় হয় না।

আমি যদি এখন আপনাকে খুন করি। তারপর যা হয় হোক—

দীপাঞ্জন, তুমি আমাকে এখনো ঠিক চিনতে পারনি মনে হচ্ছে। আমাকে খুন করা যায় না।

দীপু ভরত গুপ্তর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার টুটি চেপে ধরবে ভাবছিল, কিন্তু শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালো।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উজ্জয়িনী ডাকল, পিতাজি।

কী রে?

আপনাকে মা ওপরে ডাকছেন।

ভরত গুপ্ত বিস্মিতভাবে বললেন, তোমার মা ডাকছেন? কোনো দিন তো ডাকেন না। তাঁকে বলো, আমার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়।

উজ্জয়িনী দৌড়ে এসে ভরত গুপ্তর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, একবার চলো। আজ একবার চলো।

ভরত গুপ্ত তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এ-রকম পাগলামি করে না।

বাইরে কোনো একটা বড়ো ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বাজল। তখন স্বরূপা দেবীকে দেখা গেল দরজার কাছে। বহু বছরের মধ্যে তিনি এই সময় দোতলায় স্বামীর কাছে আসেননি। স্বরূপা দেবী বললেন, আমি এসেছি, আপনি রাগ করবেন না। এই ছেলেটিকে নিয়ে আপনি কী করছেন? এতে আমাদের অমঙ্গল হবে।

ভরত গুপ্ত বললেন, উজ্জয়িনীর মা, তুমি ওপরে যাও। আর কখনো তুমি আমার কাজে নাক গলাতে এসো না।

এটা কোনো কাজের ব্যাপার নয়। আপনি আগে কখনো কোনো বাইরের লোককে এ বাড়ির মধ্যে নিয়ে আসেননি। তার জন্য অন্য বাড়ি আছে।

তোমার কি পাকাপাকি কাশীতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে?

স্বরূপা দেবীর মুখখানা রাগে টকটকে হয়ে গেল। তিনি দৃপ্তভাবে বললেন, আমি মরার আগে এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না। দীপু পর্যায়ক্রমে উজ্জয়িনী আর স্বরূপা দেবীর দিকে তাকাল। সে বুঝতে পারল, ওদের দুজনের মুখেই রীতিমতন আশঙ্কার ছায়া। ওরা কি তাকেই এত ভয় পাচ্ছে?

দীপু বলল, আপনারা আমাকে এখানে ধরে রেখেছেন কেন? এই ভরত গুপ্ত নামের লোকটি কি পাগল?

স্বরূপা দেবী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ভরত গুপ্ত হুংকার দিয়ে উঠলেন, চুপ! আমার ইচ্ছেতে কেউ কখনো বাধা দিতে পারে না। স্বরূপা আর কখনো এ সময় নীচে আসবে না।

উজ্জয়িনী তখন প্রেমিকার মতন ভরত গুপ্তর বুকে মাথা ঘসে তাঁকে ভোলাতে চাইছে। ভরত গুপ্ত স্ত্রীকে কোনো একটা কঠিন কথা বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগে স্বরূপা দেবী নিষ্ঠুরের মতন বললেন, আজ শুক্রবার।

সঙ্গে সঙ্গে ভরত গুপ্তর মুখখানা বদলে গেল। ঘুরতে লাগল চোখ দুটো। চিৎকার করে বললেন, আমি আজও ভুলে গিয়েছিলাম! আজও ভুলে গিয়েছিলাম! যেদিন থেকে আমি এইরকম একটা লোককে খুঁজছি, সেদিন থেকে আমি ভুলে যাচ্ছি। সর্বনাশিনী, তুই কেন মনে করিয়ে দিলি?

বেশ করেছি।

ভরত গুপ্ত ঝটকা দিয়ে মেয়েকে সরিয়ে দিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে দীপুর দিকে ছুটে আসতে আসতে চিৎকার করতে লাগলেন, একে আমার চাই। একে আমার চাই।

ভরত গুপ্তর হঠাৎ এই পরিবর্তনে এতক্ষণ বাদে ভয় পেয়ে গেল দীপু। পাগল দেখলে সকলেরই ভয় হয়। ভরত গুপ্ত তার শরীর স্পর্শ করতেই সে এক ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়োল।

পেছনে পেছনে তাড়া করে এলেন ভরত গুপ্ত। গর্জন করতে লাগলেন, আমি একে ছাড়ব না, কিছুতেই ছাড়ব না। এ আমাকে বাঁচাবে। এ আমাকে শুক্রবারের কথা ভুলিয়ে দেবে। আমি ঠিকই বুঝেছিলাম। যেদিন থেকে আমি একে খুঁজেছি, সেদিন থেকেই ভুলে যাচ্ছি।

দীপু দৌড়ে এসে দেখল বারান্দার কোণে কোলাপসিবল গেট বন্ধ। ভরত গুপ্ত প্রায় তার পেছনে এসে পড়েছে। দীপু চট করে ঘুরে গিয়ে ভরত গুপ্তকে একটা ধাক্কা দিয়ে অন্যদিকে ফিরল। কোনোদিকেই বেরুবার পথ নেই, তবু ভরত গুপ্ত অনেক চেষ্টা করেও দীপুকে ধরতে পারলেন না। পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে তিনি গেট ধরে ঝাঁকানি দিতে দিতে বললেন, দরজা খোললা। দরজা খোলো।

কেউ দরজা খুলল না। ভরত গুপ্ত আর্তনাদ করতে লাগলেন মা, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল, মা, তুমি কোথায়? মা, তুমি কোথায়? টলতে টলতে তিনি নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসতে লাগল সেই আর্তনাদ। আর দেয়ালে দুম দুম করে মাথা ঠোকার শব্দ।

দীপু দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে উজ্জয়িনী আর তার মা। চোখের দিকে চোখ।

স্বরূপা দেবী বললেন, বেটা, তুমি চলে যাও।

দীপু অন্যদিকে তাকিয়ে দেখল, একজন প্রহরী এসে গেটের তালা খুলছে। দীপু ছুটে এল সেদিকে। উত্তেজিতভাবে বলল, আমি বাইরে যাব।

প্রহরীটি গেট খুলে সরে দাঁড়াল। দীপু বাইরে পা দিতেই সে দীপুর ঘাড়ে এক ধাক্কা দিয়ে বলল, অভি নিকালো।

দীপু হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কয়েকটা সিঁড়ি। নিছক স্নায়বিক প্রতিক্রিয়ায় সে ঘুরে দাঁড়ালো লোকটিকে প্রতি আক্রমণ করা জন্য। পরক্ষণেই মনে পড়ল, তাকে বাইরে যেতে হবে। সে আবার তরতর করে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে।

নীচের ধাপেও আবার লোহার গেট, সেখানেও আর একজন প্রহরী। সে একইভাবে দীপুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, অ্যাভি নিকালো!

কোথা থেকে গণেশলাল ছুটে এসে দীপুর গালে দারুণ জোরে এক চড় কষিয়ে বলল, বেরিয়ে যা, দূর হয়ে যা!

অন্যান্য কর্মচারীরা প্রত্যেকেই ক্রুদ্ধ। যেন প্রত্যেকেই মনে করেছিল, দীপুর জন্য এই প্রাসাদ ভেঙে পড়বে। তারা সকলেই দীপুকে মারতে মারতে বলতে লাগল, আভি নিকালো, আভি নিকালো, দূর হয়ে যা আপদ।

আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধের চেষ্টায় দীপুও হাত চালাতে লাগল অন্ধের মতন। ছুটল বাগানের গেটের দিকে। সেখানে দু-জন প্রহরী তাকে দুটো লাথি দিয়ে ছুড়ে ফেলল রাস্তায়।

ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে দীপু উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল সামনের দিকে। সে মুক্তি পেয়েছে, তার পায়ে এখন অনেক জোর এসে গেছে। খানিকটা দূর গিয়ে দীপু আবার থমকে দাঁড়াল।দীপু আবার ফিরে এল সেই বাড়ির কাছে। বুক ভরতি নিশ্বাস নিয়ে সে খুঃ করে থুতু ফেলল সেই বাড়ির গেটে। তারপর অস্ফুট গলায় বলল, তোমরা হেরে যাবে। তোমরা ঠিক হেরে যাবে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়