সিনেমা হলগুলিতে সন্ধ্যের শো শেষ হবার পর রাস্তায় থিক থিকে ভিড়। আড়াই ঘণ্টা অলীক সুন্দর জগতে কাটিয়ে আসার পর আবার রাস্তায়, ট্রাম-বাসে ওঠার জন্য ছোটাছুটি, ট্যাক্সির জন্য তিক্ততা। তবু খুব একটা ক্ষোভ নেই। বেশ তো সময় কাটল।

অধ্যাপক জয়ন্ত দাশগুপ্ত এ্যাণ্ড হোটেলের আর্কেডের নীচে দু-জন সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে ঘোরতর তর্কে প্রবৃত্ত। অনেকক্ষণ আগে তাঁর ইচ্ছে ছিল টু-বি বাস ধরে বাড়ি ফেরার, এখন তার সে ইচ্ছেটা উবে গেছে, দেশের অর্থনৈতিক অবনতির কারণগুলি দেখিয়ে জোরালো সব যুক্তিতে তিনি প্রতিপক্ষকে প্রায় ঘায়েল করে এনেছেন।

বয়েসে তরুণতর সাংবাদিকটি কাঁধ ঝাকুনি দিয়ে বলল, এই মিনিস্ট্রির দ্বারা কিস্যু হবে না।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত হুংকার দিয়ে বললেন, শুধু এই মিনিস্ট্রি কেন, এ-রকম চোদ্দোটা মিনিস্ট্রি দিয়েও কিস্যু হবে না। গোটা সিস্টেমটাকে যদি না পালটানো যায়—এখনো আপনারা চোখ

বুজে আছেন!

অপর সাংবাদিকটিও গলা চড়িয়ে বলল, কিন্তু প্রোডাকশান যে তাতে বাড়বে, তার গ্যারান্টি কোথায়? সেই তো গমের জন্য আমেরিকার কাছে হাত পাততে হয়। শ্রমিক শ্রমিক বলে চেঁচালেই হল! আমেরিকা কিংবা জাপানের শ্রমিকরা কমিউনিজমের নামও উচ্চারণ করে না কেন?

জয়ন্ত দাশগুপ্ত বললেন, আর কয়েকটা বছর সবুর করুন, আমেরিকার তো বারোটা বেজে এসেছে প্রায়।

এই সময় গ্র্যাণ্ড হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল একটি অতিশয় সুন্দরী তরুণী। প্রসাধনে সে আরও বেশি সুন্দরী হয়েছে। তার রূপ যেন জায়গাটাকে আরও বেশি আলোকিত করে দিল।

ওর নাম উজ্জয়িনী, ভরত গুপ্তর ছোটো মেয়ে। উজ্জয়িনী লোরেটো হাউসে পড়ে, বেশ ভালো ছাত্রী এবং ব্যবহারে যেন সরলতার প্রতিমূর্তি। সত্যিই সরল, ভান নয়। ঐশ্বর্য এক ধরনের সরলতা এনে দেয়।

উজ্জয়িনীর সঙ্গে আরও তিনটি যুবতী ও দু-টি যুবক রয়েছে। উজ্জয়িনী কখনো একা কোনো ছেলের সঙ্গে কোথাও যায় না। বাড়ির নিষেধ নয়, সে নিজেই পছন্দ করে না। অনেকের মাঝখানে একাধিক পুরুষ তার তোষামোদ করলে সে বেশি আনন্দ পায়।

উর্দি পরা ড্রাইভার উজ্জয়িনীর জন্য বিরাট পটটিয়ার্ক গাড়িটার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। উজ্জয়িনী ঝলমলে সিল্কের আঁচল সামলাতে গিয়ে একবার ডান দিকে তাকায়। অদূরে দাঁড়ানো জয়ন্ত দাশগুপ্তর সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত কথা বলবেন কি বলবেন না, তা বুঝতে পারলেন না। হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন, চোখের দৃষ্টি অন্যমনস্ক, যাতে মেয়েটি না ভাবে যে তিনি ওর দিকে অশোভন দৃষ্টিপাত করেছেন। মেয়েটিকে তিনি চেনেন, মেয়েটিও চেনে তাকে, একদিন ওদের বাড়ির গেট দিয়ে ঢোকার সময় মুখোমুখি দেখা হয়েছিল, জয়ন্ত দাশগুপ্ত চোখ নামিয়ে নিলেও উজ্জয়িনী তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা মাস্টারসাব, ফ্রাঁসোয়া জিলো কি শেষ সময়ে পিকাসোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল? কোন কাগজে নাকি বেরিয়েছে, আমার এক বন্ধু বলছিল।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত উত্তর দিতে পারেননি। ফ্রাঁসোয়া জিলোর নাম তিনি শোনেননি কখনো। কাগজে ওইরকম খবর কখনো বেরোলেও তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছে। তিনি ওবাড়িতে কাগজ পড়তে যান বলেই তাঁকে ওই প্রশ্নটা করা হয়েছিল।

উজ্জয়িনী অনেক খোলামেলা স্বভাবের মেয়ে। আজ এখানে জয়ন্ত দাশগুপ্তকে দেখতে পেয়ে সে নিজেই বলল, কি, ভালো?

একে তো সুন্দরী, তার ওপর অত বড়োললাকের মেয়ে যদি নিজে থেকে এ-রকমভাবে কথা বলে, তা হলে মন দুর্বল হবে না? জয়ন্ত দাশগুপ্তর মুখখানা গদগদ হয়ে গেল, বন্ধুদের ছেড়ে একটু এগিয়ে এসে অত্যন্ত ভদ্রভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, ভালো। আপনি ভালো তো?

আপনি কোনদিকে যাবেন? আপনাকে লিফট দিতে পারি।

না, না, তার দরকার নেই। আমি এখন এখানেই একটু…

গাড়িখানা বেরিয়ে যাবার পর জয়ন্ত দাশগুপ্ত আবার ফিরে এলেন তাঁর বন্ধুদের কাছে।

সাংবাদিকদের মধ্যে কারুর কারুর মুখ একটু আলগা হয়। নিজেদের পারিবারিক অবস্থার চেয়েও অনেক উঁচু সমাজের হোমরা-চোমরাদের সঙ্গে প্রায়ই মিশতে হয় বলে তাদের মুখে সবসময়ই একটা বিদ্রুপের হাসি লেগে থাকে।

সাংবাদিক দু-জনের মধ্যে রঘুনন্দন সেন বেশি অভিজ্ঞ ও পোড়খাওয়া। অন্যজন, সুগত চক্রবর্তী এখনো একবারও বিদেশে যায়নি বলে একটু মনমরা হয়ে আছে।

রঘুনন্দন বলল, মালটা কে?

জয়ন্ত দাশগুপ্ত অত্যন্ত সংকুচিতভাবে বললেন, এমনি চেনা–।

খুব বড়ো বড়ো সার্কেলে ঘুরছিস তো আজকাল?

সুগত কিছু একটা বলার জন্যই বলল, মনে হল ডানা দুটো কোথাও রেখে এসেছে। রঘুনন্দনদা এই মেয়েটাই ক্যালকাটা ক্লাবে প্রায়ই যায় না? খুব মাল খায়!

জয়ন্ত দাশগুপ্ত স্বতঃস্ফূর্ত উত্তেজনায় বললেন, মোটেই না। তা হতেই পারে না।

রঘুনন্দন সরু চোখে তাকালো জয়ন্ত দাশগুপ্তর দিকে। কিন্তু তার মুখে একটা হাসি হাসি ভাব। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কী রে, তোর আঁতে ঘা লেগেছে মনে হচ্ছে? ছেলেবেলায় হার্ট থ্রব ছিল নাকি?

না, সেসব কিছু না। মেয়েটিকে আমি অন্যভাবে চিনি। মোটেই বাজে মেয়ে নয়, অনেক লেখাপড়া করেছে।

রাখ রাখ, এ-রকম অনেক মাগি আমার দেখা আছে! রঘুনন্দন এর পরেও আরও এমন দু-একটি বাক্য বলল, যা প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করা গেলেও ছাপার অক্ষরে এখনো স্থান পায়নি।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত আহত বোধ করলেন। তাঁর সুরুচি বোধে ঘা লাগে। সব কিছুই এ-রকম তির্যকভাবে দেখা ঠিক নয়। তিনি বন্ধু দু-জনকে ছেড়ে চলে যেতে চান। সুগত তাঁর হাত ধরে আটকে রাখে।

রঘুনন্দন তবু ওকে খোঁচা দেওয়ার ঝোঁকে বললেন, তুই জানলি কী করে যে ওই মেয়েটা ক্যালকাটা ক্লাবে মাতলামি করে না? তুই কোনোদিন ঢুকেছিস ক্যালকাটা ক্লাবে কিংবা গ্র্যাণ্ড হোটেলে?

একথা ঠিক, রঘুনন্দন বছরে আট-দশবার ক্যালকাটা ক্লাব বা গ্র্যাণ্ড হোটেলে ঢুকে প্রচুর আহারাদি ও মদ্যপান করে। সেজন্য অবশ্য কখনো তার একটি পয়সাও খরচ হয় না। অনেক কোম্পানির বাতিক আছে ওই সব জায়গায় প্রেস কনফারেন্স ডাকা।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত বললেন, তোরা সবাইকেই চিপ ভাবিস। ও কার মেয়ে জানিস?

কার?

জয়ন্ত দাশগুপ্ত এবার একটু ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি অনুভব করলেন, তিনি একটা ভুল রাস্তায় পা বাড়াচ্ছেন। অনেক সময় সামান্য মুখের কথাও অনেক বিপজ্জনক হয়। তাঁর স্নায়ুসমূহ তাঁকে নির্দেশ করতে লাগল, এখানে ভরত গুপ্তর নাম উচ্চারণ কোরো না।

তিনি শান্ত হয়ে বললেন, এখানে ওর বাবাকে কেউ চিনবে না। ওর বাবা একজন বড়ো সায়েন্টিস্ট, অনেকদিন ধরে বিলেতে আছেন।

ইতিমধ্যে গ্র্যাণ্ড হোটেলের দরজায় আর একটি দ্রষ্টব্য বিষয়ের অবতারণা হয়েছে। এবার একটি পুরুষ।

পুরুষটির বয়েস ত্রিশ-বত্রিশ, অত্যন্ত দামি ও কুরুচিপূর্ণ জমকালো ঝকমকে রঙের প্যান্ট ও সেইরকম শার্ট, মাথার চুল ফাঁপাননা, চোখ দুটি লালচে! সে গ্র্যাণ্ড হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে নেমে এল, রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, গাড়ি? গাড়ি কাঁহা?

পুরুষটির পেছনে পেছনে হোটেলের একজন বেয়ারা চকচকে একটা কোট হাতে নিয়ে ছুটে এসে বলল, সাব, আপকা কোট–

কোটটা এক ঝটকায় টেনে নিয়ে পুরুষটি বলল, মেরা গাড়ি বোলাও, জলদি!

আরও তিন-চারজন পুরুষ, দেখলেই বোঝা যায় পূর্বোক্ত যুবকটির পারিষদ, হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে যুবকটির হাত চেপে ধরে বলে, এ ব্রীজমোহন, এ ব্রীজমোহন— আর সে চেঁচায়, মেরা গাড়ি বোলাও–

সব মিলিয়ে একটা নাটকের দৃশ্যের মতন তৈরি হয়। পথচারীরা ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। নীতিবিশারদ মধ্যবিত্ত কেরানিরা একটু বিরক্তির ভুরু কুঁচকোয়।

ওই যুবকটির নাম ব্রীজমোহন। যারা সন্ধান রাখে তারা জানে কলকাতার হোটেলগুলির নৈশ জীবনে ইদানীং ব্রীজমোহনই এক নম্বর বিলাসী পুরুষ। পকেটে খুচরো না থাকায় দু-জন বেয়ারাকে একবার একটা এক-শো টাকার নোট ছিড়ে অর্ধেক দিয়ে বলেছিল, এ লেও, তুম পচাশ, তুম পচাশ—এ গল্প শহরের প্রত্যেক বেয়ারা ও স্টুয়ার্ড জানে।

কোটিপতি আত্মারামের পুত্র এই ব্রীজমোহন। ব্যবসায়ী মহলের অনেকের ধারণা, আত্মারাম এক পুরুষে যা উপার্জন করেছে, ব্রীজমোহন তার অর্ধেক জীবনেই তা উড়িয়ে যেতে পারবে।

তবে, এত কম রাত্রে ব্রীজমোহনকে কেউ বেসামাল অবস্থায় দেখেনি কখনো। ব্রীজমোহন ভোগ করে এবং ভোগ করতে জানে। হলিউডের একজন নায়িকা কলকাতায় আসার পর যে কৌশলে তাকে ব্রজমোহনের সংরক্ষিত কামরায় আনা হয়েছিল, তার মধ্যে কোনো খুঁত ছিল না। দু-মাস বাদে সেই নায়িকার গর্ভপাতের সময় ব্রীজমোহন সুইস ব্যাঙ্কের চেকে ক্ষতিপূরণ পাঠিয়েছিল।

ব্রীজমোহন একমাত্র বিচলিত হয়ে পড়ে ভরত গুপ্তর কন্যা উজ্জয়িনীকে দেখলে। এমন আকুপাকু করে বুকের ভেতরটায় যে চট করে নেশা ধরে যায়, তখন আর মাথার ঠিক থাকে। তার বাবা একবার উজ্জয়িনীর সঙ্গে ব্রীজমোহনের বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন। উজ্জয়িনী তখন স্কুলের ছাত্রী, ভরত গুপ্ত সে প্রস্তাবে আমলই দেননি। রাগ করে ব্রীজমোহন অবিলম্বে বিয়ে করে একটি মোমের পুতুলকে, এক বছরের মধ্যে পুরোনো হয়ে যায় এবং ব্রীজমোহনকে নিরন্তর সুখসাগরে ভাসিয়ে রাখার জন্য সেই স্ত্রী তিন বছর বাদেই একটি পুত্রসন্তান প্রসব করে মারা যায়। বন্ধুরা ঈর্ষা করে ব্রীজমোহনের ভাগ্যকে, বাড়িতে পিছুটান বউ-ও রইল না, বংশধরও পাওয়া গেল, আবার বউয়ের সম্পত্তি ফালতু আশি লাখ এসে গেল হাতে।

উজ্জয়িনীকে দেখেই হোটেল থেকে ছুটে নেমে এসেছে ব্রীজমোহন। সে এখুনি গাড়ি নিয়ে তাড়া করতে চায়। বন্ধুরা তাকে নিবৃত্ত করছে, কারণ তারা জানে, ভরত গুপ্তর মেয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার মানে আগ্নেয়গিরিতে ঝাঁপ দেওয়া।

বন্ধুরা ওর হাত ধরে টানাটানি করছে আর ব্রজমোহন গাড়ির জন্য চেঁচাচ্ছে—এ্যাণ্ড হোটেলের বারান্দার নীচে, রাত সাড়ে আটটায় এই দৃশ্য! এর মধ্যে আবার একগাদা ভিখিরি ওদের ঘিরেধরে দৃশ্যটা ঘোলাটে করে দেয়।

অল্প দূরে দাঁড়িয়ে তিনজন বাঙালি বুদ্ধিজীবী এইসব দেখে। সুগত চক্রবর্তী ব্রীজমোহনের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা মর্কট! দেখুন দেখুন, ঠিক বাঁদরের মতন হাত-পা ছুড়ছে।

হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলল রঘুনন্দন। তার মুখে তখনও চাপা হাসি। সে বলল, এই মর্কটরাই দেশটা কিনে রেখেছে। ও কে জানিস?

আপনি চেনেন?

চিনি চিনি। একেও চিনি, আগে যে মেয়েটা গেল তাকেও চিনি। জয়ন্ত যতই গুল মারার চেষ্টা করুক।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত একটু কেঁপে উঠলেন। কথা ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, কোথায় যাবি বলছিলি, চল-না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না।

কেন, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তো অনেক কিছু দেখা যাচ্ছে। খারাপ লাগছে?

এখানে দাঁড়ালে মনে হয়, এ শহরটা আমাদের নয়।

নয়ই তো। কে বলল আমাদের?

সুগত বলল, একটা কিছু করা দরকার।

রঘুনন্দন হো হো করে হেসে উঠে বলল, রক্ত গরম হয়ে গেল বুঝি? চল, চল, মাল খাই!

ওরা তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে এল একটি বিলিতি ধরনের গুঁড়িখানার সামনে। কিন্তু সেটা বড়ো বেশি প্রকাশ্য জায়গায় বলে অধ্যাপক জয়ন্ত দাশগুপ্ত আপত্তি করলেন। তখন রঘুনন্দন ওদের নিয়ে এল আর এক জায়গায়, সেখানে ছাত্রদের যাওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ দাম একটু বেশি।

ভেতরে সব কটি টেবিলই ভরতি। এই সময়ে সাধারণত ভরতিই থাকে। সকালে মাঝে মাঝে হরিণঘাটার দুধ আসে না, কিন্তু মদের অভাবে কোনোদিন কোনো বার বন্ধ থাকেনি।

কোনো টেবিল খালি না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ওঠে রঘুনন্দন। আটটার পর থেকেই তার গলা শুকোয়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে একজন চেনা লোককে দেখতে পেয়ে বলল, চল, ওই টেবিলে বসা যাক।

তারপর সে জয়ন্ত দাশগুপ্তের কাঁধে টোকা দিয়ে সাবধান করে দিল, অন্য কারুকে অফার করতে যাসনি বোকার মতন।

সেই টেবিলের সামনে গিয়ে কোনো অনুমতি না নিয়েই বসে পড়ল রঘুনন্দন, অন্যদের বলল, চেয়ার টেনে বোস।

দ্রুত আলাপ-পরিচয় সম্পন্ন হল। সেই টেবিলে বসেছিলেন দু-জন লেখক। একজন খুবই জনপ্রিয়, অন্যজনও বেশ পরিচিত। ওঁরা দু-জন নিঃশব্দে মদ্যপান করছিলেন। জয়ন্ত দাশগুপ্ত লেখক দু-জনের নাম শুনে একটু চমকে উঠলেন। তিনি এঁদের অনেক লেখা পড়েছেন, কখনো চোখে দেখেননি। বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে আলাপ হলে একটু রোমাঞ্চ হয়ই। তিনি অবশ্য আশা করেননি এঁদের এইরকম জায়গায় দেখতে পাওয়ার।

তিনি মুখে কোনো উচ্ছাস প্রকাশ করলেন না। এমন ভাবও দেখালেন না যে, তিনি এঁদের কোনো বই পড়েছেন কিংবা নাম শুনেছেন! নমস্কার করলেন শুকনোভাবে।

জনপ্রিয় লেখকটি রঘুনন্দনকে প্রশ্ন করলেন, খবর-টবর কী? নতুন কিছু খবর আছে?

গলা শুকনো বলেই রঘুনন্দনের মেজাজ ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। সে বলল, রিপোর্টারদের দেখলেই বুঝি খবরের কথা মনে পড়ে? খবরে আপনাদের কি আসে-যায়? আপনারা তো বেশ আছেন!

বেশ আছি? বাঃ!

তা নয়তো কি? দু-হাতে লিখে যাচ্ছেন, আর টাকা পাছেন। দিন, বেয়ারাকে ডেকে একটা অর্ডার দিন।

অন্য লোকটি বেশি কথা বলেন না। তিনি চুপচাপ গেলাসে চুমুক দিয়ে যান।

প্রথম গেলাসটা খেয়েই রঘুনন্দনের মেজাজ বদলাতে শুরু করে। সে জনপ্রিয় সাহিত্যিকের উদ্দেশ্যে বলে যে, দাদা, গতবার পুজা সংখ্যায় যেটা লিখেছিলেন, সেটা একেবারে দুর্দান্ত। বাজারে দারুণ হিট করে গেছে। জয়ন্ত তুই পড়েছিস?

জয়ন্ত দাশগুপ্ত দ্ব্যর্থবোধকভাবে মাথা নাড়লেন। ওই লেখাটার বিষয়ে তাঁর কিছু বলার আছে, কিন্তু এখনো সময় হয়নি।

রঘুনন্দন অন্য লেখকটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার লেখাগুলো এখনো পড়া হয়নি, তবে শুনছি ছেলে-ছোকরারা খুব চেঁচামেচি করছে।

স্বল্পবাক লেখকটি ভদ্রতার আবরণে অবজ্ঞার হাসি হাসলেন।

রঘুনন্দন প্রথম সাহিত্যিকটির দিকে ফিরে আবার বলল, দাদা, একটা কথা বলব?

বলুন।

আপনারা এমন একটা কিছু লিখুন, যাতে সারা দেশে আগুন জ্বলে যায়। কী হচ্ছে দেশটার? কেউ কোনো প্রতিবাদ করবে না? আপনারা যদি মানুষকে পথ না দেখান–

জনপ্রিয় সাহিত্যিক জিজ্ঞেস করলেন, আগে কতটা খেয়েছ? এর মধ্যেই নেশা হয়ে গেল?

মোটেই নেশা হয়নি। আগে কিছু খাইনি। শুধু দুপুরে দু-বোতল বিয়ার খেয়েছিলাম। কিন্তু আমি কি বাজে কথা কিছু বলেছি?

মদের দোকানে এসে এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না।

আপনি কাজে ব্যস্ত থাকেন। আপনার দেখা আর কোথায় পাব?

তুমি যদি সাংবাদিক হিসেবে আমার ইন্টারভিউ নিতে চাও, তা হলে যেকোনোদিন আমার বাড়িতে আসতে পার।

রাগ করছেন কেন? হঠাৎ রাগ করছেন কেন?

সুগত হঠাৎ একটু ফাঁক পেয়ে বলল, সাংবাদিক নয়, মনে করুন, যদি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে কিছু জানতে চাই—মানে সাহিত্যিকদের কাছে আমাদের অনেক প্রশ্ন থাকে তো?

তিনি তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন সাংবাদিক দু-জনের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, সবাই এক-এক সময় সাধারণ মানুষ হয়ে যায়, শুধু সাহিত্যিকরাই হয় না। যে-যার নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে সাহিত্যিকদের কাঁধে সব দায়িত্ব চাপাও, এই তো?

জয়ন্ত দাশগুপ্ত গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক তা নয়। একথা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, আপনাদের লেখা পড়ে অনেক লোক ইনফ্লুয়েন্সড হয়। আপনারা যদি দেশের সমস্যাগুলোর অবজেক্টিভ দিকটা ঠিকঠাক দেখান–

জনপ্রিয় সাহিত্যিক আজ প্রথম থেকেই রেগে ছিলেন কোনো কারণে। তিনি কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন, আপনার পেশা কি? আপনিও কি সাংবাদিক?

না, আমি মাস্টার। একটা কলেজে অর্থনীতি পড়াই।

আশা করি আপনি অর্থনীতিটা বেশ ভালোই বোঝেন তা হলে। কিন্তু পরীক্ষার সময় প্রত্যেকবার কেন ছাত্ররা সব ভন্ডুল করছে এ প্রশ্ন করলে নিশ্চয়ই আপনি এ জন্য দেশের সরকার কিংবা শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করবেন?

না, তা কেন? আমাদের সকলেরই দায়িত্ব আছে।

এর দেড় ঘণ্টা পরে দেখা গেল ওই টেবিলের সকলেরই কমবেশি নেশা হয়েছে। তাঁরা অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠে চীন, রাশিয়া ও আমেরিকা বিষয়ে তর্ক করছেন, তলোয়ারের মতন ধারালো বাক্যের কাটাকুটি হচ্ছে পরস্পরের যুক্তি। স্বল্পবাক লেখকটিও বার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে খুব রাগারাগি করতে লাগল এবং দম্ভভরে বলতে লাগল, বেশ করব প্রেমের গল্প লিখব! পড়তে ইচ্ছে না হয় পোড়ো না!

জয়ন্ত দাশগুপ্ত তাঁর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, প্রেম প্রেম তো করছেন, কিন্তু আসল ব্যাপার তো অন্য। প্রেম অতিপবিত্র জিনিস হতে পারে, কিন্তু এইরকম সময়ে রোম্যান্টিক প্রেমের গল্প লেখা মানে হচ্ছে, সব সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা।

অন্য লেখকটি উত্তর দিলেন, তা হলে ক্রিকেট, ফুটবল খেলা, মিউজিক কনফারেন্স এগুলো কী? এসবও বন্ধ হয়ে যাক!

বেশি নেশা করলেই রঘুনন্দনের চোখে জল আসে। সম্প্রতি কয়েকটা জেলা কভার করতে গিয়ে কী ভয়াবহ দারিদ্র্য সে দেখে এসেছে, সেই কথা বলে কাঁদতে লাগল।অনুজ লেখকটির কথাবার্তা এখন সম্পূর্ণ অসংলগ্ন। সে ঘৃণার সঙ্গে বলল, এঃ, পুরুষ মানুষের কান্না দেখলে আমার বিচ্ছিরি লাগে! যাও, পেচ্ছাপখানায় গিয়ে কাঁদো! আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। বাঁচতে ইচ্ছেও করে না। সে অন্যদের কাঁধ ধরে বারবার ঝাঁকানি দিতে দিতে ওই একই কথা বলতে লাগল, আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। এদেশে বেঁচে থেকে লাভ কী!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়