পোস্ট অফিসের মধ্যে রেজিষ্ট্রি কাউন্টারের সামনের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে দীপু। আধঘণ্টা হয়ে গেছে। ঘড়ি দেখছে ঘন ঘন। একবার সে চেঁচিয়ে উঠল, ও দাদা একটু হাত চালান না!

তার আশেপাশের আরও কয়েকজন লোক অসহিষ্ণু মন্তব্য করে উঠল নানারকম। একজন বলল, আর আওয়াজ দেবেন না। যা-ও-বা হচ্ছে তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে। ওনাদের তো মেজাজের ঠিক নেই!

রেজিস্ট্রি কাউন্টারে যে কর্মটি নীরবে কাজ করছিল, সে একবার মাত্র মুখ তুলে দুঃখিতভাবে হাসল আপন মনে। যে-গতিতে সে কাজ করছে, তার চেয়ে দ্রুত ইংরেজি লেখা সম্ভব নয় তার পক্ষে। এক-একটা জায়গার নামে আবার যা খটোমটো বানান। তবে, পয়সা গুনতে সে ইচ্ছে করেই একটু বেশি সময় নেয়। প্রায় কারুর কাছেই খুচরো থাকে না, নানারকম উলটোপালটা হিসেব করে। গতকাল তার হিসেবে একটাকা ছ-আনা কম পড়েছে। নিজের পকেট থেকে দিতে হল। তিনদিন টিফিনে শুধু এক কাপ করে চা খাবে।

এবার দীপু এসে পৌঁছেছে কাউন্টারের সামনে। তার লম্বা খামটা বাড়িয়ে দিল। কেরানিটি সেটা ওজন করে বলল, দু-টাকা পঁচাত্তর।

দীপু বলল, এত লাগবে? আর একবার ওজন করুন তো।

কেরানিটি বলল, এইজন্যই তো দেরি হয়।

তবু সে আর একবার ওজন করল। ঠিকই আছে হিসেব। দীপু তার শার্টের বুক পকেট থেকে বার করে দিল একটা পাঁচ টাকার নোট। টাকাটা খরচ করতে তার বেশ গায়ে লাগছে। চাকরির দরখাস্ত। প্রতিটি দরখাস্ততেই সব সার্টিফিকেটের কপি দিতে হয়, ওজন বেড়ে যায়। তা ছাড়া মনে হচ্ছে, টাকাগুলো জলে যাচ্ছে।

পোস্ট অফিসের অন্য একটা কাউন্টার থেকে দীপুর একটি পরিচিত ছেলে ওকে দেখতে পেয়ে বলল, কী রে দীপাঞ্জন, কী করছিস?

দীপু বলল, দেখতেই তো পাচ্ছিস!

অত লম্বা লম্বা চিঠি লিখছিস কাকে?

আমি জেনারেল ম্যানেজার ছাড়া অন্য কারুকে লিখি না।

তুই একটা চাকরি পেয়েছিস তো শুনলাম?

ওরকম কত কী শোনা যায়।

রসিদ ও বাকি পয়সা নিয়ে দীপু সেখান থেকে সরে এল। বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে এল বাইরে। বন্ধুটি বলল, তুই এখন কোথায় আছিস রে? তোদের বাড়িটা তত বিক্রি হয়ে গেছে?

এখন দিদির ওখানে আছি। একটা ফ্ল্যাট-টলাট খুঁজছি।

কোথায় যাবি এখন? চল, একটু চা খাবি?

রে, আর একটা জায়গায় যেতে হবে, দেরি হয়ে গেছে।

নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দীপু বলল, আরে।

তারপর সে আবার পোস্ট অফিসের মধ্যে ঢুকে গেল। রেজিষ্ট্রি কাউন্টারের কাছে আসবার চেষ্টা করতেই অন্যরা চেঁচিয়ে উঠল, পেছনে, পেছনে, লাইনে দাঁড়ান।

দীপু তাদের কথায় কর্ণপাত না করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল। কাউন্টারের কেরানিটিকে জিজ্ঞেস করল, ও দাদা, আপনি আমাকে কত ফেরত দিয়েছেন?

কেরানিটি চমকে উঠে দীপুর দিকে তাকিয়ে বলল, কেন? কেন?

আমি আপনাকে পাঁচ টাকা দিয়েছিলাম। আপনি আমাকে কত ফেরত দেবেন?

ঠিকই দিয়েছি।

না, ঠিকই দেননি।

আপনার দেবার কথা দু-টাকা পঁচিশ, আপনি দিয়েছেন তিন টাকা পাঁচিশ। এক টাকা বেশি।

দীপুর হাতের তালুতে মেলে রাখা নোট ও খুচরো পয়সাগুলো গুনে দেখল কেরানিটি, তারপর তার থেকে একটা এক টাকার নোট তুলে নিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিল। একটা কথা না, একটা ধন্যবাদ না। যেন এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

আসলে খুব বেশি অভিভূত হয়ে গেলে মানুষ অনেক সময় কোনো কথা বলতে পারে না। এর আগে এক টাকা ছ-আনা গচ্চা দেবার জন্য যে লোক তিনদিন ধরে টিফিনের সময় চা ছাড়া আর কিছুই খাচ্ছে না, তার কাছে আরও একটা টাকার মূল্য অনেক।

কেরানিটির ধীরগতিতে কাজের জন্য লাইনের অনেকেই তার ওপর প্রসন্ন নয়। তারা দীপুর দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাল।

দীপু বাইরে বেরিয়ে এসে বাসে ওঠার চেষ্টা করল। দুপুর বেলাতেই খুব ভিড়। এখন সিনেমার সময়। দীপুর দেরি হয়ে গেছে।

পোস্ট অফিসের লাইনে একজন লম্বা মতন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, সে বেরিয়ে এল দীপুর পিছু পিছু। যে কাজে সে পোস্ট অফিসে ঢুকেছিল, সেকাজ হল না, এরপর থেকে সে দীপুকে গোপনে অনুসরণ করার কাজে নিযুক্ত হয়ে গেল।

দীপু কোনোরকমে একটা বাসে উঠে ঝুলতে লাগল পা-দানিতে। প্রত্যেক স্টপে নেমে দাঁড়াতে হয়। দু-তিনজন লোক নামে, তার চেয়ে বেশি লোক ওঠে। একবার নেমে দাঁড়াবার পর দীপু ফের ওঠার আগেই বাস ছেড়ে দিয়েছে। দীপু দৌড়োতে দৌড়োতে এসে ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার অনুসরণকারী লম্বা লোকটিই টেনে তুলল তাকে। দীপু লোকটাকে চেনে না।

বাসে ঝুলতে ঝুলতে যাবার সময় দীপু একবার ভাবল, পোস্ট অফিসের লোকটাকে ওই একটা টাকা ফেরত না দিলেও হত। অকৃতজ্ঞ কোথাকার! যেন লাটসাহেব, যেন একটা টাকার কোনো দামই নেই। ওই টাকাটা থাকলে দীপু ট্যাক্সিতে যেতে পারত।

পর মুহূর্তেই, এই ধরনের চিন্তার জন্য দীপু নিজেকে তিরস্কার করল।

দীপু এসে নামল বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে। এতক্ষণ সে আশঙ্কা করছিল, শান্তা বুঝি এসে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শান্তা আসেনি। তখন তার মনে হল, শান্তা যে আগে আসবে আমি জানতাম। মেয়েরা কখনো আগে আসে নাকি?

রাস্তায় শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। হাতে সিগারেট থাকলেও মনে হয়, একটা কিছু কাজ। দীপুর কাছে সিগারেট নেই। সিগারেটের দোকান বেশ দূরে। দীপু সে-দিকে সিগারেট কিনতে গিয়েও বারবার নজর রাখতে লাগল নির্দিষ্ট জায়গাটার দিকে। যদিও সে জানে, শান্তা এর মধ্যে এসে পড়বে না। সে জানতে পারে।

আবার দীপু লঘু পায়ে প্রায় দৌড়ে চলে এল সেখানে। দীপু জানে না, এইভাবে সে তার অনুসরণকারীকেও অযথা পরিশ্রম করাচ্ছে। লম্বা লোকটিও রাস্তার ওপারে আর এপারে দৌড়োদৌড়ি করছে দীপুর সঙ্গে সঙ্গে।

সিগারেট ধরিয়ে দীপু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ট্রাম, বাস, লোকজন এই শহরের দুপুরের দৃশ্য—এই সব কিছু থেকে সে কিছুক্ষণের জন্য আলাদা হয়ে যায়। সে স্বপ্নদর্শী যুবা, একা হয়ে গেলেই নানারকম স্বপ্নের মধ্যে মিশে যাওয়া তার স্বভাব।

সে যেন দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করল শান্তা এখন কোথায়। কিন্তু বার বার তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে একটা নদীর দৃশ্য। সেই নদীতে স্নান করছে শান্তা। নদীটা যেন এ পৃথিবীর নয়।

শান্তা এল ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি থেকে নেমে সে দীপুর কাছে এসে বলল, এই, তোমার কাছে খুচরো পয়সা আছে? তিরিশ পয়সা দাও!

দীপু ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এসে বলল, আর এ-রকমভাবে একা একা ট্যাক্সিতে আসবে না।

শান্তা বলল, আমার ঠিক পনেরো মিনিট দেরি হয়েছে। বাসে আসতে গেলে আরও অন্তত আধঘণ্টা লাগত।

নীলিমা দত্ত নিশ্চয়ই তোমাকে দেরি করিয়ে দিচ্ছিলেন?

তুমি কী করে জানলে?

আমি জানতে পারি!

এটা মেলেনি। নীলিমাদি আজ কলেজেই আসেননি।

দাঁড়াও, আমি বলছি। তুমি পেন হারিয়ে ফেলেছিলে।

না।

তুমি ভুলে গিয়েছিলে।

ঠিক। এটা ঠিক বলেছ।

দীপু সিগারেটটা ছুড়ে ফেলল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, হেরে গেলাম। জানি, ওটাও ঠিক বলিনি।

শান্তা জিজ্ঞেস করল, এবার আমি বলব আসল কারণটা?

থাক আর শুনতে চাই না।

আমরা কি আজ কোথাও গিয়ে কিছু খাব?

কী খাবার?

চীনে?

এই শহরে চীনে খাবারের দোকান আর ব্যাঙ্ক সমানভাবে বেড়ে যাচ্ছে দেখেছ?

হুঁ।

তার মানে, যারা ব্যাঙ্কে টাকা রাখে তারাই চীনে দোকানে খায়।

তার মানে খাওয়া হবে না। আমি কিছু খেতে চাই না বাবা। তুমি এ-রকম রাগী রাগী মুখ করে আছ কেন?

তার মানে, নিশ্চয়ই আমার রাগ হয়েছে।

কার ওপর?

ভেবে দেখি।

তাড়াতাড়ি ভাবো। আমরা কিন্তু এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াব না।

শান্তা তার চোখ থেকে সানগ্লাসটি খুলল। একটা রৌদ্রালোকিত প্রান্তর তার চোখে ঝলমল করে ওঠে। ওপরের গাছ থেকে একটা শুকনো পাতা খসে পড়ল তার গায়ে। একটা দমকা হাওয়ায় তার কুঁতে নীল রঙের শাড়ির আঁচলটা উড়তে লাগল পতাকার মতন। দীপু কখনো কখনো একে বলেছে স্বর্গের পতাকা। এখন সে এদিকে দেখছে না।

দীপু বলল, এই মাঠের মধ্যে রোদুরে রোদুরে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালে কেমন হয়?

শান্তা একটু দ্বিধা করে বলল, এই দুপুর বেলা?

রোদুরটাই তো আমার ভালো লাগছে।

শান্তা একটু লজ্জা পেয়েছে। পরবর্তী বাক্যটি বলতে তার দু-এক মুহূর্ত দেরি হল। সে বলল, কে দেখে ফেলবে।

দীপু বিস্ময়ে ভুরু উঁচু করতেই শান্তা তাড়াতাড়ি আবার যোগ করল, মানে, আমার ছাত্র ছাত্রীরা যদি আমাকে দেখে ফেলে, ওরাই লজ্জা পেয়ে যাবে। ওরাও তো একটু প্রেম করবে।

শান্তা মাত্র দু-মাস আগে একটা কলেজে লেকচারারের কাজ পেয়েছে। সেই ব্যাপারে ওর মুখে একটা খুশির ছাপ এখনো রয়ে গেছে। এখনো তাকে কোনো পরীক্ষায় গার্ড দিতে হয়নি, খাতা দেখতে হয়নি, অধ্যাপকদের মাইনে বাড়াবার দাবিতে রাস্তায় মিছিলে নামতে হয়নি। কাজটা তার ভালোই লাগছে।

দীপু বলল, এ তো কেলেঙ্কারির ব্যাপার। তুমি কলেজে চাকরি পেয়েছ বলে রাস্তায় আর ঘুরে বেড়ানো যাবে না? তাহলে যাব কোথায়?

আমাদের বাড়িতে চলো।

ইচ্ছে করছে না।

তা হলে চলো, হাওড়া স্টেশন থেকে কোনো লোকাল ট্রেনে চেপে কোথাও চলে যাই। তুমি বলেছিলে একদিন নিয়ে যাবে।

সেটা আজ নয়। আর একদিন। চাকরিতে জয়েনিং ডেটটা ঠিক হয়ে যাক। সেটা সেলিব্রেট করব।

তুমি চাকরি পেয়েছ? ঠিক হয়েছে কিছু?

হ্যাঁ, হয়েছে মোটামুটি।

শান্তার মুখের ভাব এতে খুব একটা বদলাল না। সানগ্লাসটা আবার চোখে দিয়ে পৃথিবীর রং ম্লান করে সে নির্লিপ্তভাবে প্রশ্ন করল, কী চাকরি?

দীপু বলল, সেই যে কোম্পানিটাতে চেষ্টা করছিলাম, সেখানেই একটা পোস্ট খালি হয়েছে সেলস-এ। প্রথমে আটশো সাড়ে আট-শশা দেবে। তা ছাড়া প্রায়ই ঘুরেবেড়াতে হবে, টি এ আছে।

শান্তা মুখ গম্ভীর করে বলল, চলো, মাঠে একটু বসি। তুমি ওই চাকরিটা নিয়ো না।

দীপু ময়দানের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, কেন?

 চাকরি করা তোমাকে মানায় না।

তা হলে আমি কী করব?

সবাইকেই কি চাকরি করতে হবে নাকি? তুমি ইচ্ছে মতন জীবন কাটাবে, বই পড়বে, ঘুরবে, যখন খুশি হবে তখন লিখবে।

দীপু শান্তার পিঠে আলতোভাবে একটা চাঁটি মেরে বলল, আহা-হা, তুমি চাকরি পেয়েছ বলে ট্যাক্সি করে আসবে, আর আমাকে আসতে হয় বাসে ঝুলতে ঝুলতে।

শান্তা তার ব্যাগটা দীপুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নাও। আমি তো চাকরি করছি, তোমার যখন যা দরকার হয় আমার কাছ থেকে নেবে।

দীপু ব্যাগটা নিয়ে শূন্যে লোফালুফি করতে লাগল। অনেকটা আপন মনে বলল, এর থেকে ভালো চাকরি আমার পক্ষে পাওয়া শক্ত। এটা ছেড়ে দিলে মুশকিল হবে।

তারপর শান্তার দিকে ফিরে বলল, এতদিন তো আমি চাকরি-টাকরির চেষ্টা করিনি। এখন একটা কিছু করতেই হবে। ছোড়দির বাড়িতে কি বরাবর থাকব নাকি?

কেন, ছোড়দির বাড়িতে ঘরের অসুবিধে হচ্ছে?

কিছুই অসুবিধে হচ্ছে না। তবু বেশিদিন থাকা যায় না।

পুকুরের পেছন দিকটায় অনেকগুলো বড়ো বড়ো গাছ। সেখানে বিভিন্ন আকৃতির ছায়া। দু-তিন জোড়া যুবক-যুবতী এখানে-ওখানে বসে অত্যন্ত মৃদু গলায় কথা বলছে। শান্তা একবার সাবধানে দেখে নিল, ওদের মধ্যে তার কেউ চেনা আছে কিনা।

ঘাসের ওপর দীপু চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ল। তার সাদা সার্ট, ময়লা হয়ে যাবে। সে বেশ লম্বা। লম্বা চেহারার পুরুষরা মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসার বদলে শুয়ে পড়তে চায়।

দীপু একটা সিগারেট ধরালো। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে আকাশকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি অত্যন্ত সুন্দর। তোমাকে দেখলে আমার কষ্ট হয়। তুমি আমাকে আর আগের মতন ভালোবাসো না।

শান্তা বলল, আস্তে।

দীপু সে-কথা গ্রাহ্য না করে বলল, জীবনটা তো শুধু এইরকম গাছের ছায়ায় বসে থাকা নয়। হঠাৎ যখন খুব ঝড় ওঠে কিংবা বৃষ্টি নামে।

ওহে দার্শনিক, আমার কিন্তু বেশ খিদে পেয়েছে। কলেজে ক্লাস করে আসছি।

অপেক্ষা করো, একটু বাদেই চীনেবাদামওয়ালা আসবে।

দীপু এবার পাশ ফিরে শান্তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে চাও না? তোমার ইচ্ছে করে না?

শান্তা খুব মৃদু গলায় বলল, করে।

দীপু এবার উৎসাহিত হয়ে কনুইতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে বলল, তা হলে? কোথায় থাকব, আমাদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। একসঙ্গে থাকতে হলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করতে হবে। যা শুনছি, আড়াই-শো-তিনশো টাকার কমে তো ফ্ল্যাট পাওয়া যায় না। তারপর রোজ দু-বেলা খাবার। মানুষকে দু-বেলাই পেট ভরে খেতে হয়, এই একটা বাজে নিয়ম। নিয়ম আছে, অথচ খাবার পাওয়া যায় না। যাই হোক, আমরা না হয় একটু কম-টম করে খাব। মাঝে মাঝে জামাকাপড় কিনতেই হবে। বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে চা-বিস্কুট না দিলে চলে না। এসব খরচ কোথা থেকে আসবে? চাকরি না করে চলে? ও, আরও তো একটা ব্যাপার আছে—একসঙ্গে থাকতে গেলে তার আগে বিয়ে করতে হবে—সেটাও তো একটা খরচের ব্যাপার।

শান্তা মুচকি হেসে বলল, তুমি খুব চিন্তায় পড়ে গেছ মনে হচ্ছে?

রীতিমতন চিন্তা, টাকার চিন্তা।

তোমাকে মানাচ্ছে না।

আমার চাকরি করা মানায় না, টাকার চিন্তা মানায় না, তা হলে আমাকে কি মানায়? শুধু প্রেম করা?

তুমি বড় জোরে কথা বলছ আজ! শোনো, আমি তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, এই চাকরিটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।

পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরি, জান না?

তা হলেও।

আরও কয়েকটা জায়গায় চেষ্টা করছি। তবে, এর থেকে ভালো পাওয়া আমার পক্ষে শক্ত। আমার একটা জিনিস ভালো লাগছে না। যার চাকরি করার একেবারে ইচ্ছে নেই, যে অন্য কিছু করতে চায়—তাকেও শুধু টাকার জন্য কেন একটা চাকরি করতে হবে।

শান্তা, তুমি এখনো ছেলেমানুষ। টাকার জন্যই তো সব কিছু হয়! টাকা যার থাকে না, সে খেতে পায় না। যে খেতে পায় না, সে মরে যায়। খুব সিমপল।

তোমার খাওয়ার চিন্তা নেই।

আমার চিন্তা তোমার জন্য। শোনো, খুব সিরিয়াসলি বলছি, এ-রকম রাস্তায় ঘাটে দেখাশুননা আর আমার ভালো লাগছে না। আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই। আমি তোমাকে চাই চাই চাই চাই চাই।

এই আস্তে, প্লিজ, কী হচ্ছে কী!

আমি চৌরঙ্গির মোড়ে গিয়ে চেঁচিয়ে এই কথা বলব?

যে কথাটা আমাকে শোনাবার জন্য, তা এত চেঁচিয়ে বলার দরকার কী?

তুমি তো শুনতে পাচ্ছ না কিছুতেই!

তুমি কিছু জান না!

এরপর দুই যুবক-যুবতী কিছুক্ষণ পরস্পরের চোখের দিকে স্থিরভাবে চেয়ে থাকে। প্রণয়ী ছাড়া অন্য কেউ এ-রকম দৃষ্টি জানে না। অনেক কিছু বিনিময় হয়ে যায়।

অদূরে একটি গাছের আড়ালে লম্বা মতন অনুসরণকারীটি অনবরত হাই তুলছে। সে তাদের সব কথাই শুনতে পাচ্ছিল মোটামুটি।

রাত আটটার সময় দীপু শান্তাকে বাড়ি পৌঁছে দিল। নিজে তখনও বাড়ি ফিরল না। একা হয়ে যাবার পরেই তার মুখে একটা অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠল।

হাঁটতে হাঁটতে সে চলে এল গ্রে-স্ট্রিট আর শশাভাবাজারের মুখটাতে।

একটা দোকানে অনেকদিন পর কোরোসিন এসেছে, তার সামনে বিরাট লাইন। চেঁচামেচি, ঠেলাঠেলি। রাস্তার পাশে নোংরার স্থূপ। বস্তির ছেলেরা খেলা করছে তার পাশেই। মোটরগাড়ির জ্যাম। উলঙ্গ ভিখিরি। বিরাট রাজনৈতিক পোস্টার। ভাঙা রাস্তা। এক-একটা ট্রাম থামছে আর ফুটো আলুর বস্তার মতন হুড়হুড় করে নামছে একগাদা নারী-পুরুষ, সকলেরই ভুরু কোঁচকানো মুখ।

এখানে কোনো সুন্দর দৃশ্য নেই। অথচ ফিনফিনে হাওয়া দিচ্ছে, আকাশ প্রায় পরিষ্কার, কয়েকটি তারা দেখা যায়, কিছু হালকা সাদা মেঘ সেখানে খেলা করে।

দীপু একটা গলির মধ্যে ঢুকবে। সেখানে চার-পাঁচ জন যুবক দাঁড়িয়ে জটলা করছিল। দীপু তাদের পাশ দিয়ে ঢুকতে যেতেই তারা কথা থামিয়ে ওকে ভালো ভাবে লক্ষ করল। দীপু কয়েক পা যেতেই তারা ডেকে জিজ্ঞেস করল, দাদা, কোথায় যাচ্ছেন?

দিনকাল অনেকটা বদলেছে, এখন আর তেমন ভয়ের কারণ নেই, তবু দীপুর শরীরে একটা শিহরন জাগে। বছর দু-এক আগে কেউ এইরকম সন্ধ্যের পর কোনো অচেনা পাড়াতে আসতেই সাহস করত না। এখনো অচেনা লোককে দেখলে লোকে প্রশ্ন করে।

দীপু আড়ষ্ট গলায় বলল, এ পাড়ায় আমার চেনা একজন লোক থাকেন, তার সঙ্গে দেখা করতে যাব।

কত নম্বর বাড়ি? কী নাম?

তেত্রিশ নম্বর বাড়ি। অরুণপ্রকাশ ঘোষের কাছে যাব, উনি আমার মাস্টারমশাই ছিলেন।

এর আগে এসেছেন এবাড়িতে?

না। এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন বলুন তো?

যুবকদের দল থেকে একজন এগিয়ে এসে বলল, কিছু না। এমনিই। চলে যান-না, ওই তো সামনেই তিনতলা বাড়ি। দাদা আপনার কাছে সিগারেট আছে? একটা দিয়ে যান তো।

দীপু বিনা বাক্যব্যয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে দিল। যুবকটি হেসে বলল, কিছু মনে করলেন না তো?

দীপুও হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলল, না।

সে জানে, ওদের কোনো কাজ নেই। কেউ কোনো কাজ দেবে না। শুধু দিনের পর দিন গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে একঘেয়ে লাগে। দুর্গাপুজো, কালীপুজোর অনেক দেরি। এদিক দিয়ে সন্ধ্যের পর সচরাচর কোনো সুন্দরী মেয়েও যায় না যে আওয়াজ দেওয়া যায়। সুতরাং কোনো ছুতোয় একটা ঝগড়া বা মারামারি লাগাতে পারলেই কিছুটা রোমাঞ্চ পাওয়া যায়।

তিনতলা বাড়িটা একটা ফ্ল্যাটবাড়ি। দীপু সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল ওপরে। সারা বাড়িতে একটা স্যাঁৎসেঁতে গন্ধ। তিনতলায় সিঁড়ির শেষে দু-দিকে দুটো ফ্ল্যাট। দীপু আন্দাজে একটার দরজায় ধাক্কা দিল।

একজন প্রৌঢ় মহিলা দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, কাকে চাই?

রতনদা আছেন?

আপনি কোথা থেকে আসছেন?

প্রৌঢ়ার মুখখানি অপ্রসন্ন। দীপুকে তিনি পছন্দ করেননি, তার কারণ দীপু বয়েসে যুবক। অচেনা যুবকদের দেখতে আজকাল আর ভাল লাগে না। বিশেষ করে দুঃখিনী মায়েদের।

দীপু বলল, আমি আগে আমহার্স্ট স্ট্রিটে থাকতাম—এখন থাকি সল্ট লেকে, রতনদার সঙ্গে আমার একটু দরকার ছিল।

মহিলার মুখ দেখেই বোঝা যায় তিনি মিথ্যে কথা বলতে অভ্যস্ত নন। তবু তিনি রুক্ষভাবে বললেন, না, সে বাড়ি নেই।

মাস্টারমশাই আছেন?

তাঁর কাছে কী দরকার? মাস্টারমশাই অনেকদিন আগে আমার প্রাইভেট টিউটর ছিলেন, এমনি দেখা করতে এসেছি।

মহিলা এবার দরজা খুলে দিয়ে বললেন, উনি এই সময় কখনো বাড়ি থাকেন না। রতনের শরীর খারাপ, শুয়ে আছে, তুমি ওই ঘরে যাও।

তিনি গলা চড়িয়ে ডাকলেন, রতন, রতন।

দীপু পর্দা সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, রতনদা, একটু আসব?

খাটের ওপর পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে রতন একটা বই পড়ছিল। তার গালে আট দশ দিনের দাড়ি, চুল উশকোখুশকো, চোখ দুটি জ্বলজ্বলে!

বইটা সরিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কে? ও, হ্যাঁ এসসা, বসো, ওই চেয়ারটা টেনে নাও। তোমার নামটা কী যেন, চেনা চেনা লাগছে–

আমার নাম দীপাঞ্জন!

বুঝেছি। দীপু তো! তুমি হঠাৎ?

রতন অসুস্থ হলেও তার গলায় দৃঢ়তা আছে। সে উঠে বসে দীপুর দিকে খরদৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

দীপু কীভাবে কথা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। সুতরাং কথার কথা হিসেবে বলল, আপনার শরীর খারাপ? জ্বর হয়েছে নাকি?

রতন প্রশ্নটাকে একেবারে গুরুত্ব না দিয়ে বলল, ও কিছু না। তারপর তোমার খবর-টবর কি?

আপনার কাছে একটা পরামর্শ নিতে এলাম।

আমার কাছে পরামর্শ? তুমি তো অন্য লাইনের ছেলে, আমি যতদূর জানি—

রতন হাত বাড়িয়ে দেয়ালের তাক থেকে একটা বিড়ি আর দেশলাই নিয়ে ধরালো। একটা টান দিয়েই কাশতে লাগল।

দীপুর মনে পড়ল, বছর চারেক আগেও রতনদা খুব সাহেবি কায়দার মানুষ ছিলেন। দামি কাপড়জামা পরতেন, দামি সিগারেট খেতেন। কথায় কথায় ইংরেজি। মানুষটা অনেক বদলে গেছে এর মধ্যে। কোনো কোনো মানুষ বোধ হয় নিজেকে নষ্ট করতেও ভালোবাসে।

দীপু বলল, আমি খবর পেয়েছিলাম, আপনি জেল থেকে মাস খানেক আগে বেরিয়েছেন।

রতন একটা অবজ্ঞার মুখভঙ্গি করে বলল, আবার কবে ধরে নিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। ধরুক। আমি অপেক্ষা করে বসে আছি।

না, না, আর ধরবে কেন? আপনার নামে তো কোনো চার্জ দিতে পারেনি।

চার্জ দেবার দরকার হয় না। যাক গে ওসব কথা। তোমার কী ব্যাপার বলো তো?

আপনি হঠাৎ চাকরিটা ছেড়ে দিলেন কেন?

নিজে তো ছাড়িনি। ওরা ছাড়িয়ে দিয়েছে।

দীপু বলল, তা হতেই পারে না। ওরা কি গ্রাউণ্ডে আপনাকে ছাড়াবে? আজকাল চাকরি এমনি ছাড়ালেই হল?

রতন কৌতূহলী হয়ে দীপুর মুখের দিকে তাকালো। তারপর ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কী? তুমি আমার চাকরির ব্যাপার নিয়ে এত চিন্তা করছ কেন?

দীপু একটু লজ্জা পেয়ে গেল হঠাৎ। আমতা আমতা করে বলল, না, মানে ওই অফিসে আমার একজন চেনা লোক আছেন—

কে?

শ্যামসুন্দর মিত্র।

হুঁ। বড়ো অফিসার। তাতে কী হয়েছে?

উনি বলেছিলেন যে, আপনি যতদিন জেলে ছিলেন, তখনও আপনার চাকরি যায়-নি— আপনার যা ছুটি ছিল তাতেই, কেননা কনভিকশান না হলে তো কিছুই করতে পারে না। আপনার পলিটিক্যাল ব্যাপার–

শোনো দীপু, এর মধ্যে অনেক মজার ব্যাপার আছে। চাকরি ওরা ছাড়ায়নি ঠিকই, আমি রেজিগনেশন দিয়েছি। আমি জেল থেকে ছাড়া পাওয়া মাত্রই কোম্পানি আমাকে চিঠি দিয়েছিল যে আমার সব ছুটি ফুরিয়ে গেছে, দশ দিন তারা সময় দিচ্ছে, এর মধ্যে জয়েন করতেই হবে। কোম্পানি আইনের দিক থেকে ঠিকই আছে। কিন্তু জয়েন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

কেন?

আমার এখন সব জায়গায় চলাফেরার স্বাধীনতা নেই। জেল থেকে ছাড়া পেলেও আমাকে লুকিয়ে থাকতে হয়। আমাদের পার্টি ভেঙে গেছে। এখন মগের মুল্লুক চলছে। আমাদের অফিস বেলেঘাটায়, ওই এলাকাটা এখন অন্য পার্টির হাতে। তারা আমাকে ওখানে ঢুকতে দেবে না।

ঢুকতে দেবে না মানে?

ওখানকার লোকাল লিডারের সঙ্গে আমি লোকমারফত যোগাযোগ করেছিলাম। উনি মহানুভব ব্যক্তি, উনি জানিয়েছেন, ওঁর পার্টি আমাকে ক্ষমা করতে রাজি আছে, কিন্তু আমি কোনোদিন আর বেলেঘাটায় ঢুকতে পারব না। অর্থাৎ, আমি বেলেঘাটায় গেলেই ওরা আমাকে খুন করবে।

রতনদা এ কখনো হয়?

এইরকমই তো হচ্ছে। কয়েকদিন আগে একজন ছেলেচোরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল আর. জি. কর হাসপাতালের সামনে, কাগজে পড়েছিস তো? ব্যাপারটা পুরোটাই সাজানো। ছেলে চুরির কোনো কেসই নয় এটা। ও হচ্ছে আমাদের সুদর্শন, আমারই মতন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে—আর জি কর হাসপাতালের থার্ড ইয়ারের ছাত্র ছিল, আবার পড়াশুনো করতে চেয়েছিল। সেখানেও ওই একই ব্যাপার, পাড়ার লিডার বলেছে, রাজনীতি ছেড়ে আবার ডাক্তারি পড়তে চান আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু বেলগাছিয়ায় বা শ্যামবাজারে ঢুকতে পারবেন না। বুঝে দেখো ঠ্যালা। ডাক্তারি পড়তে পড়তে ট্রান্সফার নিতে হলে মন্ত্রীর পারমিশন নিতে হয়—আমাদের দলের ছেলের কথা শুনবে কেন? সুদর্শন গোঁয়ারের মতন তবু গিয়েছিল শ্যামবাজার পেরিয়ে—সকলে মিলে ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। জেলে থাকতে থাকতেই সুদর্শনের একটু মাথার দোষ হয়েছিল, ওর ধারণা হয়েছিল, নিজে ডাক্তারি পাস করে নিজের চিকিৎসা করবে

দীপু বিবর্ণ মুখে গুম হয়ে বসে রইল। এসব কি শুনছে সে? কলকাতা শহরেই এই সব ঘটে যাচ্ছে?

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, রতনদা, আপনি ভালো চাকরি করতেন, আপনি

এসবের মধ্যে ঢুকতে গেলেন কেন?

রতন উত্তরটা এড়িয়ে গেল। নিভে যাওয়া বিড়িটা ধরবার জন্য সময় নিল একটুখানি। তারপর বলল, তুমি বিজনকে চিনতে? আমার মামাতো ভাই–

দেখেছি কয়েকবার। হায়ার সেকেণ্ডারিতে স্ট্যাণ্ড করেছিল যে, সেই বিজন তো?

হ্যাঁ। সে মারা গেছে, জান?

অ্যাঁ?

ময়দানে তার ডেডবডি পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ মেরেছে। সে কেন যোগ দিয়েছিল বলো তো? জেলখানায় এখনো হাজার হাজার ছেলে পচছে—কেউ তাদের সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করে না এখন, কিন্তু তারা কেউই গুণ্ডা বদমাস নয়, প্রত্যেকেই ভালো ছেলে, আদর্শবাদী-তারা সব ছেড়েছুড়ে গিয়েছিল, ওঃ, দীপু, তুমি জান না, কী অবস্থায় তাদের রেখেছে—ভাবতে গেলেই আমার রক্ত গরম হয়ে যায়, আমি জেলের বাইরে এসেছি বলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়, সারাগায়ে চুলকুনি, খেতে দেয় না, মাঝে মাঝেই একটা কিছু ছুতো তুলে লাঠি পেটা করে কয়েকজনকে মেরে ফেলে।

কথা বলতে বলতে রতন বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েই হঠাৎ থেমে যায়। দীপু ঘাড় হেঁট করে বসে থাকে। প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করল, তুমি চা খাবে? তা হলে মাকে বলতে পারি—জানি না বাড়িতে চিনি আছে কিনা।

না, চা খাব না।

দীপু, তোমার কখনো মনে হয়নি, সারাদেশজুড়ে এই যে অন্যায় চলছে, এ সম্পর্কে তোমারও কিছু করার আছে? কোনোদিন গ্রামে গিয়েছ? দেখেছ, সেখানে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে?

দীপু মুখ তুলে দুঃখিতভাবে তাকাল। তারপর বলল, আমি এই খুনোখুনির ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারি না। গ্রামের লোকেরা খেতে পাচ্ছে না বলে রাস্তায় ঘাটে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি–

রতন গম্ভীরভাবে বলল, কখনো কখনো লাইন অব অ্যাকশান ভুল হতে পারে, কিন্তু তাতে উদ্দেশ্যটা মিথ্যে হয়ে যায় না।

কিন্তু ভুল স্বীকার করলেই তো মৃত্যুগুলো মুছে যায় না। মাঝে মাঝে যুব কংগ্রেস, সি পি এম, নকশাল এইসব আলাদা আলাদা নাম দিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি খুনোখুনি হয় এতে মূলসমস্যার কী সমাধান হয় আমি বুঝি না! মায়ের সামনে ছেলেকে কিংবা ছাত্রদের সামনে মাস্টারমশাইকে খুন করে কতকগুলো মূল্যবোধও নষ্ট করে ফেলা হয়। রতনদা, চারদিকে তো শুধু ভুলই দেখতে পাচ্ছি।

রতন চেঁচিয়ে বলল, পরিষ্কার একটাই রাস্তা আছে—

এই সময় একটি তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে ঘরে ঢুকে বলল, দাদা, তোমাকে বেশি কথা বলতে বারণ করেছে।

মেয়েটির গায়ে একটা জীর্ণ ফ্রক। মুখে একটা রাগের ভাব। রতন বিরক্তভাবে হাত তুলে বলল, যা, ঠিক আছে। এই একটু চা করতে পারবি?

দীপু তাড়াতাড়ি বলল, রতনদা, আমি সত্যি চা খাব না।

রতন দীপুকে ধমক দিয়ে বলল, চুপ। যা দু-কাপ চা নিয়ে আয়।

মেয়েটি চলে যাবার পর রতন হেসে বলল, তুমি না খেলে আমাকেও চা দেবে না। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকি, মা সবসময় ভয় পান আমি বুঝি আবার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ব। একটা কিছু চাকরি-টাকরির ব্যবস্থা করতে হবে, যদিও ইচ্ছে করে না—

চাকরি পাওয়া তো খুব শক্ত। আপনার পুরোনো চাকরিটা এমনিভাবে হারাবেন? ওখানে অন্য কোনোভাবে চেষ্টা করা যায় না? অন্য কোনো ব্রাঞ্চে যদি ট্রান্সফার করে–

না। ওখানে আমি রেজিগনেশান দিয়ে দিয়েছি। ওরা অ্যাকসেপ্ট করেছে, আমার প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকাও পেয়ে গেছি।

দীপু খুব ইতস্তত করে বলল, ওখানে আমার যে একজন চেনা লোক আছেন, তিনি আমাকে ওই পোস্টটা দিতে চাইছেন।

রতন বলল, এতক্ষণে তোমার আসবার কারণটা বুঝতে পারলাম। আমার কাছে চাকরিটার ব্যাপারে জানতে এসেছ! নিয়ে নাও! কাজটা খুব শক্ত নয়—

না, আমি বলছিলাম—

তুমি নিজের মনে কাজ করে যাবে। ইউনিয়নের দলাদলির মধ্যে যেও না। সত্যেন তালুকদার বলে একজন লোক আছে, তাকে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলবে। একটা ডায়ারি বুক রাখবে সবসময়, টুরে গিয়ে–

দীপু ওকে বাধা দিয়ে বলল, রতনদা, আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, চাকরিটা আমার নেওয়া উচিত কিনা।

কেন?

যে চাকরি থেকে আপনাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটা কি আমার পক্ষে—

রতন এবার খোলা গলায় হো হো করে হাসল। হাসতে হাসতে তার কাশির দমক এল। রতন অসুস্থ এবং সবসময় ক্রুদ্ধ থাকে। সে স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এখন একটা উদারতা দেখানোর সুযোগ পেয়ে সে সত্যিই একটু খুশি হয়।

রতন সস্নেহে বলল, এইজন্য বুঝি তোমার বিবেকে কামড়াচ্ছে। দীপু, আমি তোমাকে খুব খোলা মনে বলছি, এ চাকরিটা নিয়ে তুমি আমার কোনো ক্ষতি করছ না। চাকরিটা আমার পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। ওপাড়ায় স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি চাকরি পেলে আমি খুশিই হব। কি, ঠিক আছে?

দীপু মিনমিন করে বলল, আপনি যদি বলেন…

আমি তো বলছিই। তাড়াতাড়ি জয়েন করো। তোমার বুঝি চাকরির খুব দরকার? এতদিন কোথাও চেষ্টা-টেষ্টা করনি?

এতদিন করিনি, এখন অবশ্য আরো কয়েক জায়গায় চেষ্টা করছি।

ঠিক আছে, লেগে যাও। তবে, জান তো, সব চাকরিতেই কিছু কিছু ঝামেলা থাকে। সবচেয়ে ভালো হয়, চাকরি না করে থাকতে পারলে।

আমারও সেইরকম ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসি, তার সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে চাই—তার জন্য তো টাকা দরকার।

বিয়ে করছ?

এখনো ঠিক, মানে—

অর্থাৎ চাকরি পেলে তারপর বিয়ে করবে! তোমার তো খুব জরুরি সমস্যা দেখছি। ঠিক আছে, ব্যবস্থা তো হয়েই গেল। ওদের মাইনেপত্র মোটামুটি ভালোই। অবশ্য ওরাও এক্সপ্লয়টার, বলাই বাহুল্য।

চাকরি ছেড়ে দিয়ে আপনার অসুবিধে হচ্ছে না?

আমি আরও অনেক কিছু ছাড়বার জন্য তৈরি হচ্ছি।

সেই কিশোরী মেয়েটি এই সময় চা নিয়ে এল। শুধু চা। একটা চুমুক দিয়েই দীপু বুঝল, এত খারাপ চা সে বহুদিন খায়নি। চায়ের কোনো মাথামুনুই নেই। রতন অবশ্য সেটাই বেশ আরাম করে খাচ্ছে, দীপুর মনে পড়ল একদিনের কথা। রতন যখন এম এ ক্লাসের ছাত্র, দীপু তখন সদ্য ফার্স্ট ইয়ারে ভরতি হয়েছে, একদিন কফি হাউসে গিয়ে দেখেছিল, রতন সেখানে দুটো টেবিল জোড়া দিয়ে দশ-বারোজন বন্ধুকে কফি খাওয়াচ্ছে। স্কলারশিপ পেত রতন, খুবই শৌখিন প্রকৃতির যুবা ছিল। সে সত্যিই অনেক কিছু ছাড়ছে।

চা খেয়ে দীপু উঠে পড়ল। রতন তাকে এগিয়ে দিল দরজা পর্যন্ত। রতনের মুখ এখন অনেক প্রশান্ত।

রতনের মা সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অন্য একজন মহিলার সঙ্গে নীচু গলায় কথা বলছিলেন। দীপুকে দেখে তিনি সরে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দীপুর মনে হল, উনি কাঁদছিলেন একটু আগেই। চোখ সেইরকম। মেয়েদের কান্নার অনেক কারণ থাকে।

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়, অন্ধকারে দীপু একটা সিগারেট ধরিয়েছিল, একজন প্রৌঢ় লোককে উঠে আসতে দেখে সে সিগারেটটা লুকোলো, মুখ ফিরিয়ে রইল দেয়ালের দিকে।

প্রৌঢ় তার আপাদমস্তক লক্ষ করে প্রশ্ন করলেন, কে?

দীপু সিগারেটটা নীচে ফেলে দিয়ে লজ্জিতভাবে বলল, স্যার আমি।

নীচু হয়ে প্রণাম করল দীপু। প্রৌঢ় তাকে চিনতে পারলেন না। আবার প্রশ্ন করলেন, কে?

স্যার, আমি দীপাঞ্জন।

দীপাঞ্জন? দীপাঞ্জন কী?

দীপাঞ্জন সরকার। সিক্সটি থ্রির ব্যাচ। আপনি আমাকে বাড়িতে পড়াতেন।

প্রৌঢ় মুখখানা অনেক কাছে নিয়ে এসে বললেন, ও, দীপু? তাই বলো, চিনতে পারিনি আজকাল চোখেও ভালো দেখি না। তুমি হঠাৎ, কী ব্যাপার?

দীপু কাচুমাচু হয়ে বলল, এদিকেই এসেছিলাম, তাই ভাবলাম একবার আপনার এখানে… রতনদার সঙ্গে গল্প করে গেলাম।

এসো, আবার উঠে এসো, একটু বসবে।

না, স্যার, আজ অনেকক্ষণ বসেছিলাম, রাত হয়ে গেছে।

বসবে না! আচ্ছা, আর একদিন এসো—রবিবার, এ ছাড়া অন্য কোনোদিন তো আমি সময়ই পাই না—দুপুরে স্কুলে, সকালে আর সন্ধ্যে বেলা তিনটে টিউশনি… তুমি এখন কী করছ যেন? তোমাদের তো নিজেদের বিজনেস–

না তো। আমি কিছুই করছি না। চাকরি-টাকরি খুঁজছি—

বাবা ভালো আছেন?

বাবা মারা গেছেন।

এরপর আর বেশি বাক্য বিনিময় হয় না। দীপু বিদায় নিয়ে তরতর করে নীচে নেমে এল। সিগারেটটা তখনও জ্বলছে, দীপু সেটা তুলে নিয়ে ফু দিয়ে ধুলো ঝেড়ে নিল, তারপর টানতে লাগল। একটা আস্ত সিগারেট প্রাণে ধরে ফেলে দেওয়া যায় না।

বাইরে এসে দেখল। গলির মোড়ে সেই ছেলেগুলো নেই এখন। বেশ হাওয়া দিচ্ছে।

রাস্তার উলটোদিকে তার অনুসরণকারী যে তখনও অপেক্ষা করে আছে, দীপু অবশ্য তা লক্ষ করল না।

দীপু এখন বাড়ির দিকে হাঁটছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে একটা অন্ধকার পাড়ায় এসে পড়ল। এখানে লোডশেডিং। অন্ধকারে হাঁটতে তার অসুবিধে হয় না। সে নিজের চিন্তায় মশগুল। কয়েক দিনের মধ্যেই তার জীবন অন্যরকম হয়ে যাবে। তাকে প্রত্যেকদিন অফিস যেতে হবে। তা হোক। শান্তাকে সে কাছে পাবে। শান্তা–

হঠাৎ দীপু থমকে দাঁড়াল। সে একজন স্বপ্ন-দেখা যুবক। অনেক সময়েই সে আপন মনে কথা বলে। যারা আপন মনে কথা বলে, তাদের স্থান-কাল জ্ঞান চলে যায়।

দীপু অনুচ্চ স্বরে বলল, না, আমি ওই চাকরিটা নেব না, কিছুতেই নেব না!

কথাটা বলার পর মুহূর্তেই তার কষ্ট হল। কষ্টের জন্য সে একটা সান্ত্বনা খুঁজতে চাইল। তখন তার ভেতর থেকে কেউ যেন বিষণ্ণভাবে বলল, কেন চাকরিটা নেবে না, দীপু? তুমি তো কোনো অন্যায় করছ না। তুমি রতনদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলে, তিনি তোমাকে খুশিমনেই অনুমতি দিয়েছেন।

দীপু দৃঢ়ভাবে জবাব দিল, তা হোক! এটা নেওয়া যায় না। মাস্টারমশাই যখন শুনবেন, তাঁর উপযুক্ত ছেলে ওইরকম একটা প্রতিষ্ঠিত চাকরি ছাড়তে বাধ্য হল, আর আমি সেটা নিয়ে নিচ্ছি, তখন তাঁর মুখের অবস্থা কীরকম হবে?

বাঃ, রতনদার চাকরি যাবার ব্যাপারে তো তোমার কোনো হাত নেই। রতনদা নিজেই দায়ী। তুমি ওই চাকরিটা না নিলে আর কেউ নেবে, তাতে রতনদার কোনো লাভ হবে?

ওসব জানি না। আমি নেব না, ব্যাস! আমি তো আরও অনেক জায়গায় দরখাস্ত পাঠাচ্ছি, আর একটা পেয়ে যাবই।

চাকরি পাওয়া কত শক্ত, তুমি জান! যদি এক বছর-দেড় বছরের মধ্যেও না পাও? শান্তা–

আঃ, কেন তর্ক করছ? আমি ওই চাকরি নিতে পারি না, কিছুতেই পারি না। আমার ভালো লাগছে না!

অন্ধকার রাস্তায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে অন্যদের অসুবিধে হয়। একজন পথচারীর সঙ্গে দীপুর ধাক্কা লাগল। সচেতন হয়ে সে হাঁটতে লাগল আবার।

অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একজন একলা যুবক। তার মুখ কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তার মুখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন। নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্বে সে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। সৎ থাকার ইচ্ছেটাই বড় কথা নয়। তার জন্য অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। অন্ধকারে তার মুখমন্ডলে সেই কষ্টের ছাপ পড়ছে, যা আর কেউ দেখবে না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়