গঙ্গানারায়ণ পদব্ৰজেই রোজ কলেজ যায়। তার সহপাঠীরা অনেকেই আসে পালকিতে কিংবা ভাড়া করা কেরাঞ্চি গাড়িতে, জমিদারপুত্র হিসেবে তার জুড়িগাড়িতেই আসা উচিত, কিন্তু গঙ্গানারায়ণ হাঁটতেই ভালোবাসে। তাদের বাড়ি থেকে পটলডাঙা খুব বেশী দূর নয়। পথের দৃশ্য দেখতে দেখতে সে আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যায় কলেজে।

সেদিন সে পটলডাঙার মোড়ে পৌঁছে দেখলো কলেজের সামনে থেকে অনেক ছেলে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে গোলদীঘির দিকে। সেখানে এক কোণে রীতিমতন একটা জটলা। কৌতূহলী হয়ে গঙ্গানারায়ণও সেই দিকে ধাবিত হলো।

গোলদীঘির উল্টোদিকে মাধব দত্তের বাজারে মাঝে মাঝে চোর ধরা পড়ে, তখন শুধু দোকানদাররা নয়, পথচারীরাও সেই চোরকে উত্তম মধ্যম ঠ্যাঙায়। চোর ছাড়াও আছে নানারকম লুটেরা। কাবাবের দোকান থেকে কোনো মাতাল হয়তো এক থাবা কাবাব তুলে নিয়ে পালালো। গাঁজার দোকানের আশেপাশে গেজেলারা থাকে তক্কে তক্কে, দোকানদার জলত্যাগ করার কারণে বা অন্য কিছুর জন্য একটু দোকানের বার হলেই কোনো ঘুঘু গেজেল সুট করে ঢুকে পড়ে দোকান তছনছ করতে। কখনো কখনো এই সব ঘটনায় কলেজের কোনো ছাত্রও ধরা পড়ে, তখন বাজারের লোকদের সঙ্গে কলেজের ছেলেদের কাজিয়া বেঁধে যায়। হেয়ার সাহেব গাঁজার দোকানদারদের নিষেধ করে দিয়েছেন যেন কোনো কলেজের ছাত্রকে তারা গাঁজা না বেচে, তাই তাদের দোকানেই হামলা হয় বেশী।

দোকানদাররা উত্ত্যক্ত হয়ে একদিন একটি গাঁজা-চোর কলেজের ছাত্রকে হাতেনাতে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল হেয়ার সাহেবের কাছে। হেয়ার সাহেব এমনিতে আলাভোলা নরম মানুষ হলে কী হবে, তাঁর নির্দেশের ব্যত্যয় হলে এক একদিন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন সাঙ্ঘাতিক। দোকানীর অভিযোগ শুনে তিনি হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, কাশী, চাবুক লাও! কাশী মালি চাবুক এনে দিল, তিনি উগ্ৰ মূর্তি ধরে দশ-বারো ঘা চাবুক কষলেন। ছেলেটিকে।

গঙ্গানারায়ণেরই সহপাঠী বন্ধু দত্তকে এরকমভাবে আর একদিন চাবুক মেরেছিলেন হেয়ার সাহেব। বন্ধু অবশ্য গাঁজা চুরি করেনি, সে মীর্জাপুর মিশনে সেণ্ডিস সাহেবের কাছে বাইবেল পাঠ শোনবার জন্য যাতায়াত শুরু করেছিল। সে খবর পেয়ে হেয়ার সাহেব একদিন বন্ধুকে নিজের কামরায় ডেকে পাঠালেন। সেদিনও তাঁর হাতে চাবুক মজুত। মুখের চেহারা বিকট। মেরে বন্ধুর পিঠে রক্ত বার করে দেবার পর হেয়ার সাহেব নিজেই কাঁদতে শুরু করেছিলেন, গরম জলে বন্ধুর ক্ষতস্থান ধুয়ে দিতে দিতে কোমল ইংরাজিতে বলেছিলেন, বাবা সকল, এখন পাঠে মন দাও। ধর্ম নিয়ে এখন মস্তক না। ঘামাইলেও চলিবে!

ডিরোজিও সাহেব বরখাস্ত হবার পর থেকে হেয়ার সাহেব সাবধান হয়ে গেছেন। কলেজের ছাত্রদের মধ্যে খৃষ্টানী প্রভাব ছড়াতে দেখলেই অভিভাবকরা ক্ষেপে উঠবেন আবার। ইতিমধ্যেই কিছু কিছু ভালো পরিবারের ছেলে হিন্দু কলেজ ছেড়ে গৌর আঢ্যির ইস্কুল ওরিয়েণ্টাল সেমিনারিতে ভর্তি হচ্ছে।

আজ আবার নতুন কী মামলা তা দেখবার জন্য ছুটে গেল গঙ্গানারায়ণ। ভিড়ের মধ্যে তার অনেক সহপাঠীও রয়েছে। ভোলানাথ, বেণী, বন্ধু, ভূদেব দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি, তাদের মুখে দারুণ উদ্বেগের ছাপ।

গঙ্গানারায়ণ তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিসের গোলযোগ রে?

বেণী বললো, আজ আবার মধু ক্ষেপেছে!

মধু!

স্বচক্ষে দেখবার জন্য গঙ্গানারায়ণ নিজে ভিড় ঠেলে উঁকি মারলো। গোল জনতার মাঝখানে ঘাসের ওপরে বসে আছে মধু। তার হাতে সুরার বোতল, জড়িত গলায় সে চাঁচাচ্ছে, আই অ্যাম লাইক দা আর্থ, রিভলভিং এভার রাউণ্ড দা সেলফ-সেইম সান, বয়—

গঙ্গানারায়ণ শিউরে উঠলো। কিছুদিন ধরে মধু খুবই বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। আগে সে সন্ধ্যের পর সুরাপান করতো, এখন দিনের বেলাতেও বাদ থাকে না। ক্লাসেও তার মুখ দিয়ে প্রায়ই ভকভক করে দুৰ্গন্ধ বেরোয়, কথা বলার সময় জিভ এলিয়ে যায়। কয়েকদিন আগে কলেজের অধ্যক্ষ কার সাহেব এজন্য খুব ধমক দিয়েছেন মধুকে।

অদূরে রাস্তায় মধুর বাড়ির পালকি দাঁড় করানো। মধুর সঙ্গে সব সময় দুজন গৃহভৃত্য আসে। তারা অসহায়ভাবে দুপাশে দাঁড়িয়ে। মধুর হাত ধরে টেনে তোলার সাধ্য এদের নেই। যখন তখন মধু ওদের লাথি ঘুষি মারে আবার মুঠো-মুঠো পয়সা দেয়।

মধুর গায়ে ইংরাজি কোট। দারুণ গ্ৰীষ্মেও সে এই কেট খোলে না। কিছুদিন আগে সে বুট-পায়জামা ও আচকান ছেড়ে হঠাৎ এই কোট ধরেছে, তারপর থেকে তার সুরাপানের মাত্ৰাও বেড়েছে। গঙ্গানারায়ণকে দেখতে পেয়ে সে বা চোখ কুঁচকে বললো, কি রে গঙ্গা, তুই এখনো রয়িচিস? ভূদেব, বন্ধুরা সব পালিয়েচে বুঝি? সীজনস, বোথ অব জয় অ্যাণ্ড সরো, আই হ্যাভ, লাইক হার, অ্যাজ আই রান, বয়—

ভিড় ঠেলে এসে বেণী বললো, মধু, এসব কী করতেছিস! শিক্ষক মহাশয়রা এ পথ দিয়ে যাতায়াত করেন, তোকে এ অবস্থায় দোকলে—

মধু ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, দেখলে তো আমার ভারী পাঁচ পুরুষ উদ্ধার হয়ে গেল। সিলি, বেণী-লাইক টক!

হাতের বোতলটি দেখিয়ে ইঙ্গিত করে বললো, কাম হিদার, ইফ ইউ হ্যাভ ক্যারেজ, হ্যাভ এ সিপ!

তারপর নিজেই সে নির্জলা ব্র্যাণ্ডি খানিকটা ঢকঢ়ক করে ঢেলে দিল গলায়।

ভূদেব বললো, এখুনি এ খবর কার সাহেবের কানে গিয়ে পহুছাবে! কার সাহেব কড়া ধাতুর লোক, হয়তো এমন ব্যবস্থা লবেন…

তাকে থামিয়ে দিয়ে মধু হুঙ্কার দিয়ে বললো, আই হেইট দা ড্যামনড় ফেলো কার! দিস উইল ড়ুমী নো হার্মা! নান হোয়াট এভার!

বেণী বললো, চুপা! চুপ! কাণ্ডাকাণ্ডি জ্ঞান একেবারে গ্যাচে দেকচি! স্যারের নামে ও-কথা বলতে আচে!

বঙ্কু বললো, মধু ওঠ! কলেজ যাবি না?

মধু ফরাসী কায়দায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, নো-ও-ও!

বঙ্কু বললো, গত এক হগুপ্ত তুই আসিস নাই, তুই কি আর পড়বি না?

ভূদেব বললো, কেন পড়বে না? চল মধু, আমাদিগের সঙ্গে চল।

মধু বললো, তোরা যা! ইউ গুডি গুডি বয়িজ, ইউ গো টু দ্য ক্লাস! আমি আর যাবো না।

ভোলানাথ ফিসফিস করে বললো, এই চুপ, চুপ! রীজ সাহেব যাচ্ছেন।

অন্যরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, তাদের কলেজের অঙ্ক শিক্ষক রীজ সাহেব গোলদীঘির রেলিং-এর পাশ দিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ধীর পায়ে। চোখ দুটি চিন্তামগ্ন।

মধু বললো, ও, দ্যাট ফেলো! ভয়ের কী আছে? আমি আর ভয় পাই না।

রীজ সাহেব দূরে চলে যাবার পর ভূদেব হাসতে হাসতে বললো, যতই মুখে সাহস দেখা, মধু, রীজ সাহেবকে তুই ভয় পাস ঠিকই!

ভয় যে পায় না সেটা দেখাবার জন্যই মধু আবার ব্র্যাণ্ডির বোতলে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর তার সরু চিবুকে চাপড় মারতে মারতে বললো, আমি মধুসূদন দত্ত এস্কোয়ার, আমি কাহাকেও ভয় পাই না!

ভোলানাথ বললো, স্যারকে ডাকবো? রীজ সাহেব সম্রাট নেপোলিয়ানের সৈন্যবাহিনীতে থেকে লড়াই দিয়েচেন, এখুনি এসে তোকে চ্যাংদোলা করে লয়ে যাবেন!

মধু বললো, ডাক, ডাক দেখি!

ভূদেব বললো, ওরকম করিসনি মধু। তুই ক্লাসে না গেলে আমাদিগেরও ভালো লাগে না।

মধু চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, কেন, তোরাই তো সব এক একটা স্টার রইচিস।

বঙ্কু বললো, আমরা স্টার হতে পারি, কিন্তু মধু, তুই হচ্ছিস জুপিটার।

ভূদেব বললো, আবার অ্যাসে কমপিটিশন হতেছে, এবারেও মধু তুই প্রাইজ পেতে পারিস।

মধু বললো, এ ফিগ ফর ইওর স্কলাস্টিক ফেম।

—তুই সত্যিই আর কলেজে যাবি না?

—নো! আই হেইট কলেজ! আই হেইট কার।

—কলেজের ওপর তোর এত রাগ হলো কেন? তুই অপরাধ করিচিলি, তাই কার সাহেব তোকে ধমক দিয়েচেন।

—ডি আল আর না এলে ও কলেজে। আর আমি যাবো না! আমাকে পড়বার মতন বিদ্যাবুদ্ধি আর কারো নাই!

—রিচার্ডসন সাহেব তো আবার ফিরে আসচেন। তিনি না আসা পর্যন্ত তুই পড়াশুনা বন্ধ রাখবি?

—ইয়েস!

—ওঠ মধু, আমার কথা শোন।

–ইউ বী ড্যাম্‌ন্‌ড!

গঙ্গানারায়ণ এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। এবার সে ভূদেবের কানে কানে বললো, গৌরকে ডেকে আনবো? ও নিশ্চয়ই গৌরের কথা শুনবে।

ভূদেব বললো, ঠিক বলিছিস। দ্যাখ তো সে এসেচে কি না?

গঙ্গানারায়ণ কলেজের দিকে ছুটে চলে গেল। গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল গৌর, সংস্কৃত, কলেজের দুটি ছেলের সঙ্গে কথা বলছিল। গঙ্গানারায়ণ তাকে ডেকে একটু দূরে এনে বার্তাটি জানালো।

গৌর উদাসীনভাবে বললো, আমি গিয়ে কী করবো? গৌরের ফস ছিপছিপে চেহারা, টানা টানা চোখ, যুগ্ম ভুরু, ঠোঁটের রেখা ও থুতনিতে নারীসুলভ কমনীয়তা রয়েছে। ভিড়ের মধ্যে থাকলেও সে সকলের দৃষ্টি কেড়ে নেয়।

গঙ্গনারায়ণ গৌরের আপত্তি শুনলো না, জোর করে টেনে নিয়ে এলো। জনতা ভেদ করে মাঝখানে এসে গৌর বিষণ্ণ গলায় বললো, মধু, তুই ফের ব্র্যাণ্ডির বোতল নিয়ে কলেজে এসিচিস?

তাকে দেখেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো মধু। দুহাতে জাপটে ধরে দু গালে ফটফট করে। দুখানা চুমো দিয়ে বললো, গৌর, গৌর, কতদিন তোকে দেখি নাই! তোর জন্যই আমি এসিচি। মেকানিকাল ইনস্টিটিউশ্যানে যাই, সেখানেও তোকে দেখি না। তোকে পর পর সাতখানা লম্বা লম্বা লেটার লিকালুম, তুই উত্তরে মাত্র একখানা পিগমি লেটার পাট্যেচিস। কেন, গৌর, কেন?

গৌর বিব্রতভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু মধু কিছুতেই ছাড়বে না। মধু গৌরের চেয়ে একটু লম্বা, রোগা চেহারা হলেও তার গায়ে বেশ জোর আছে, গৌরকে সে বুকে চেপে আছে মাতালের ভীম আলিঙ্গনে।

গৌর বললো, তুই আবার দিনের বেলা মদ খেয়িচিস?

—বেশ করিচি। কেন খাবো না? রিচার্ডসন মদ খান না? তিনি মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করেন না? সেইজন্যই তো তিনি পেয়েট্রি এত ভালোবাসতে পারেন। সেইজন্যই তাঁর কাছে পৃথিবী এত সুন্দর! তিনি কী বলিছিলেন, মনে নেই! টু কোন্ড অ্যাণ্ড ভালগার মাইণ্ডস হাউ লার্জ আ পোরশান অব দিস বিউটিফুল ওয়ার্লড ইজ আ ড্রিয়ারি ব্ল্যাঙ্ক! গৌর, কবিতা ছাড়া আমার আর কিছুই ভালো লাগে না। পোয়েট্রি ওয়াইডেনস দা স্ফিয়ার অব আওয়ার পিওরেস্ট অ্যাণ্ড মোস্ট পামানেণ্ট এনজয়মেণ্টস। দেখিস, একদিন আমি কত বড় হবো! বায়ারণ, বায়রণের সমান, তোরা তখন আমার জীবনী লিকবি।

গৌর বললো, বেশ তো, বড় কবি হবি। কিন্তু তুই আমাকে কথা দিয়িছিলি, মদ খেয়ে কলেজ পানে আসবি না।

—কথা! আমি কোনো কথা রাখতে পারি না। ইট ইজ ট্র, গৌর, আমি কথা রাখতে পারি না। ভূদেব পারে, বন্ধু পারে, গঙ্গা পারে। রাজনারায়ণ পারে, আমি পারি না! তা বলে তুই আমার ওপর রাগ করবি? তোর বিহনে যে আমি বাঁচতে পারিনে! তুই তো কথা রাখিস গৌর, তবু কেন তুই আমার বাড়িতে আসবি বলেও আসিস নে!

ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন চেঁচিয়ে বললো, এ যে কেষ্ট রাধার মান অভিমান!

ভূদেব বললো, লোকে সঙ দেখছে। গৌর, মধুকে এখান থেকে নিয়ে চল।

মধু কোনোদিকেই ভ্রূক্ষেপ করছে না। গৌরের মুখের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে থেকে বললো, শুধু একটা প্রমিজ আমি রাখবোই! আই উইলগে টু ইংল্যাণ্ড। আই উইল! আই উইল। আই সাই ফর অ্যালবিয়ানস ডিসট্যাণ্ট শোর…

গৌর ধীর স্বরে বললো, আমাকে এবার ছাড়, মধু। আমি কবি হবে না, তাই আমি এখন কলেজে যাবো।

মধু অবিকল রিচার্ডসন সাহেবের গলা নকল করে কাতরভাবে গর্জন করে উঠলো, ওহ নো! আই বিসীচ ইউ! লো, রেইজড আপান দিস ভাস্ট এরিয়াল হাইট, দিস রিয়েলম অব এয়ার-আজ কেউ কলেজে যাবে না। না, আজ তোরা আমার সঙ্গে চল, ভূদেব, বেণী, বন্ধু, গঙ্গা চল, সবাই চল।

এক হাতে গৌরকে ধরে রেখে অন্য হাতে সে অন্য বন্ধুদের ধরবার চেষ্টা করলো। ভিড় ক্রমশ বাড়ছে এবং আমোদ গেড়ে লোকেরা নানারকম টিটকিরি শুরু করেছে। ভিড়ের মধ্যে সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররাও রয়েছে।

সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু কলেজ সন্নিহিত বাড়িতে বসলেও দু দল ছাত্রের মধ্যে রেষারেষি আছে। হেয়ার সাহেবের সুপারিশের কিছু ফ্রি ছাত্র ছাড়া হিন্দু কলেজের অধিকাংশ ছাত্রই আসে বিশিষ্ট ধনী পরিবার থেকে। সেই তুলনায় সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের গেয়ে গেয়ে চেহারা। তারা এখনো জামা পরতে শেখেনি, উড়ুনি গায়ে জড়িয়ে আসে। কিন্তু তাদের জিভগুলি ক্ষুরধার, হুল ফোঁটানো মন্তব্য করতে তারা ওস্তাদ। মধুর গায়ের রঙ কালো আর গৌর খুবই ফর্সা বলে তারা নানারকম উপমা মিশিয়ে কটুকাটব্য করছে।

ভূদেব এসব পছন্দ করে না। মধুর পাল্লা থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে না বুঝে সে দ্রুত ভিড় ছাড়িয়ে এসে উঠে বসলো মধুর পালকিতে।

গৌরদাসকে মধু তখনো ছাড়েনি। এক হাতে ব্র্যাণ্ডির বোতল, অন্য হাতে গৌরের কজিটা শক্ত করে চেপে ধরে সেও টলতে টলতে বেরিয়ে এলো ভিড় ছেড়ে। এক পালকিতে সব বন্ধুদের জায়গা হবে না বলে মধু খুব জোরে শিস দিয়ে উঠলো দুবার। জিভের তলায় আঙ্গুল দিয়ে ফিরিঙ্গিদের মতন সে চমৎকার শিস দিতে শিখেছে।

পটলডাঙ্গার মোড়ে পালকি বেহারাদের আডা। দুখানি পাল্কি ছুটে এলো তৎক্ষণাৎ। সবাই মখুকে চেনে আর খাতিরও করে খুব। এই ছোঁকরা বাবু পাল্কি নিলে আশাতীত বখশিশ পাওয়া যায়।

বন্ধুবান্ধব সবাইকে তুলে মধু বললো, চালাও খিদিরপুর।

মধুদের বিশাল বাড়িতে অধিবাসীর সংখ্যা যৎসামান্য। মধুর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত অত্যন্ত বিলাসী পুরুষ। বাড়িতে তিনি আত্মীয়-স্বজনের ভিড় পছন্দ করেন না। তাঁর গাঁ সাগরদাঁড়ির জন্য দুয়েক স্ত্রীলোক আছে তাঁর পত্নী জাহ্নবী দেবীর সেবার জন্য। এ ছাড়া অন্য দুঃস্থ আত্মীয়-স্বজন আশ্রয়প্রার্থী হয়ে এলে তাদের জন্য আলাদা বাড়ি ভাড়া করে দেওয়া হয়। রাজনারায়ণ এ বাড়ি শখ করে বানিয়েছেন এবং এ বাড়ির আদবাকায়দার কথা তিনি পাঁচ কান করতে চান না।

বাড়িতে দাসদাসীর সংখ্যা চোদ্দটি। রাজনারায়ণ দত্ত রীতিমতন খাদ্যরসিক, প্রত্যেকদিন তাঁর নতুন স্বাদের খাদ্য চাই। সেইজন্য তিনি সাহেববাড়ি থেকে বাবুচি খানসামাদের বেশী বেতন দিয়ে ভাঙিয়ে আনেন। কোনো রান্না তাঁর পছন্দ না হলে তিনি পাত্ৰসমেত ছুঁড়ে ফেলে দেন। এ বাড়ির পাঠার মাংসের পোলাউ যে একবার খেয়েছে, সে জীবনে আর সে স্বাদ ভুলতে পারবে না। মধুর বন্ধুরা এ বাড়িতে এসে প্রায়ই নানান সুস্বাদু দ্রব্য খেয়ে যায়। কিন্তু সেই পাঠার পোলাউয়ের প্রসঙ্গে উঠলেই তারা বলে, রাজাদের মধ্যে যেমন রাশিয়ার জার, তেমনি খাদ্যের মধ্যে এই পোলাউ!

মধুর আর কোনো ভাই বোন নেই। বাড়িতে তার অপরিমিত প্রশ্ৰয়। মধুর যে-কোনো হুকুম তামিল করার জন্য পাঁচ-সাতজন ভৃত্য সব সময় মুখিয়ে থাকে। জাহ্নবী দেবীর কড়া নির্দেশ, আর যে কোন কাজই থাক, মধু কোনো জিনিস চাইলে, মুখ থেকে কথাটি খসানো মাত্ৰ যেন তা পায়।

রাজনারায়ণ দত্তও পুত্ৰ-স্নেহে অন্ধ। বেঙ্গল স্পেকটেটর, ক্যালকাটা লিটারারি গেজেট, কমেট প্রভৃতি কাগজে তাঁর সতেরো আঠারো বছরের ছেলের পদ্য ছাপা হচ্ছে, সেজন্য তাঁর গর্বের অন্ত নেই। আদালতে তাঁর সহকমী বিধুশেখর একদিন বলেছিলেন, তোমার ছেলে যা দারুণ ইংরেজি শিখেচে দুদিন বাদে তো সাহেবদের মাতায় হাগবে! একথা শুনে পরম পরিতৃপ্তি পেয়েছিলেন রাজনারায়ণ। সাহেবরা দেখুক, নেটবরা তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম যায় না। বাড়িতে কৌচে বসে তামাক টানতে টানতে তিনি অনেক সময় আদর করে ছেলের হাতে বাড়িয়ে দেন আলবোলার নল। আবগারির দোকান থেকে মধুর জন্য মদের বোতল আসে, রাজনারায়ণ বিনা বাক্যব্যয়ে বিল মিটিয়ে দেন। এ ছাড়াও আরও কত দোকান থেকে যে মধু ধারে জিনিস আনে তা সে নিজেই মনে রাখতে পারে না, রাজনারায়ণকেই তার খোঁজ রাখতে হয়। হ্যামিল্টন সাহেবের দোকানে তাঁর বলা আছে যে বিলেত থেকে প্রত্যেকবার জাহাজ এলে যে-সব নতুন নতুন সুগন্ধ প্রসাধন দ্রব্য আসবে, সেগুলি যেন প্রত্যেকটি এক বোতল করে মধুর নামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বাড়ির লোকদের জব্দ করার জন্য মধুরও বাতিকের শেষ নেই। প্রায়ই নতুন নতুন জিনিসের জন্য বায়না ধরে সে নিজের ঘরে বসে মিটমিটি হাসে। রাজনারায়ণ বিভিন্ন দিকে লোক পাঠান সেই জিনিসের সন্ধানে। টাকার কোনো পরোয়া নেই, জিনিসটি চাই যে-কোনো উপায়ে। সংগ্ৰহ করা হলে রাজনারায়ণ নিজে সেটি মধুর কাছে নিয়ে এসে হাসতে হাসতে বলেন, এবার আরও কিছু বল দেখি!

এইভাবে বাপ ছেলেতে খেলা চলে। অবশ্য, মধুর প্রধান নেশা বই কেনা।

বন্ধুদেরও মধু নানারকমে তাক লাগিয়ে দেয় প্রায়ই। নিজের ঘরে বসিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করে, কে কোন খাবার খেতে চাস বল চোখ মুদে। যে-কোনো জিনিসের নাম কর। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোদের জন্য তা এনে দেব! গরম গরম।

সত্যি সে তা পারে। মুগী, মটন, ছানার ডালনা, ডিমের হালুয়া, যে-কোনো কিছুর নাম করলেই হলো। সঙ্গে সঙ্গে হাজির। এবং গরম। মধুর জন্য নাকি প্রত্যেকদিন চার পাঁচটি উনুনে অনেক রকম খাবার সব সময় তৈরি থাকে। তার যেটা ইচ্ছে খাবে, যেটা ইচ্ছে হবে না, খাবে না। কোনদিন তার কোনটি খেতে ইচ্ছে হবে, তা আগের থেকে জানিবার উপায় নেই।

অবশ্য এমন দিনও যায়, মধু কিছুই খায় না। পাশে সুরার পাত্র ও চোখের সামনে বই খুলে সে কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তখন কেউ তার ঘরে ঢুকবে না। এক সময় নেশাচ্ছন্ন অবস্থায় সে তার বিছানায় মুছিত হয়ে পড়ে। সেইভাবে সারারাত কেটে যায়।

বাড়ির সামনে পালকি থেকে সদলবলে নামলো মধু, তারপর সাড়ম্বরে ভেতরে ঢুকলো। চার-পাঁচজন ভৃত্য সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দ্বারের কাছে। মধু কোটের পকেট থেকে এক মুঠো টাকা বার করে একজন ভূত্যের হাতে দিয়ে বললো, ওদের মিটিয়ে দে!

তারপর সে দুহাত ছড়িয়ে চিৎকার করলো, হেই হো! হেই হো! যেন সে জানান দিচ্ছে যে সে বাড়িতে ফিরেছে। অথচ উল্লাসভরা গলার স্বরটি এমন যেন নতুন কোনো দ্বীপে পদার্পণ করছে কোনো দুঃসাহসী রাজকুমার।

প্রশস্ত চত্বরের চার পাশে ঘেরা বারান্দা। একদিক দিয়ে উঠে গেছে মর্মর প্রস্তরের সিড়ি। সেই সিঁড়িতে পা দিয়ে মধু একটু থমকে দাঁড়ালো। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে বললো, ইফ ইউ মীট মাই ফাদার

বন্ধুরা অন্য কথায় মগ্ন ছিল তাই মধুর কথা শুনলো না। মধু এবার বেশ চেঁচিয়ে বললো, ইফ ইউ মীট মাই ফাদার, পে নো অ্যাটেনশন টু হিমা!

বন্ধুরা অবাক হয়ে গেল। মধু এরকম কথা বলছে কেন? রাজনারায়ণ দত্তের সঙ্গে বন্ধুদের দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। রাশভারী রাজনারায়ণ ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে বেশ প্রসন্ন ব্যবহার করেন। প্ৰত্যেকের বাড়ির খবর নেন। গঙ্গানারায়ণের বাবাকে তো তিনি বিশেষভাবে চেনেন, তাই গঙ্গাকে দেখলে স্নেহভরে অনেক কথা বলেন। মধুরও তো বাবার সঙ্গে বেশ মাই-ডিয়ারি আছে।

মধু চোয়াল কঠিন করে বললো, বাবার সঙ্গে দেখা হলে তোরা কথা বলবিনি। তোরা বুঝিয়ে দিবি যে তোরা আমার দলে।

বনখু জিজ্ঞেস করলো, বাবার সঙ্গে তোর কী হয়েচে রে, মধু?

—অনেক কিছু!

রাজনারায়ণ দত্ত এই সময় আদালতে থাকেন, সুতরাং তাঁর সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। তবু বন্ধুরা সবাই বিস্মিত হয়ে রইলো।

ওপরে উঠে এসে মধু নিজের ঘরের ভেজানো দরজায় এক লাথি কষালো। দাঁড়াম করে খুলে গোল দরজাটা। ভেতরে ঢুকে মধু বললো, বোস।

সঙ্গে সঙ্গে সে আলমারি খুলে বার করলো কয়েকটি বিলিতি কাচের গেলাস। সেগুলিতে ব্র্যাণ্ডি ঢেলে বললো, নে। নিজে একটি গেলাস তুলে নিয়ে এক চুমুকে শেষ করলো।

অন্যরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কেউ গেলাস ছুঁলো না। গৌর দুঃখিত গলায় বললো, তুই আরও খাবি, মধু?

মধু বললো, কেন খাবো না! আজি আমার আনন্দ, খুব আনন্দ হচ্ছে, তোরা এয়িচিস। বঙ্কু নে,

ভোলা নে, গঙ্গা নিবি না?

ভূদেব শেষ পর্যন্ত আসেনি, কৌশল করে মাঝ রাস্তায় নেমে গেছে। ভূদেব অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সে প্রায়ই বলে, আমি গরীব বামুনের ছেলে, এত বড় মানুষদের সঙ্গে বেশী মেলামেশা আমার সহ্য হবে না। এর আগে যে কয়েকদিন গঙ্গানারায়ণ এবাড়িতে এসেছে, কোনোদিনই ভূদেবকে দেখেনি। যদিও ভূদেব মধুকে খুব ভালোবাসে। বাড়িতে নিয়ে এলেই মধু মদ্যপানের জন্য সবাইকে জোরাজুরি করে। ভূদেব এই সব সময়ে মধুর সঙ্গ বর্জন করে।

মধু জোর করে গঙ্গানারায়ণের হাতে একটি গেলাস ধরিয়ে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা কেঁপে উঠলো গঙ্গানারায়ণের। তার মনে পড়ে গেল বিন্দুবাসিনীর কথা।

 

বিন্দুবাসিনী একদিন গঙ্গানারায়ণকে জিজ্ঞেস করেছিল, হিন্দু কলেজের তো সব ছেলেই মদ খায়। তুই-ও খাবি নিশ্চয়ই? গঙ্গানারায়ণ বলেছিল, না, কিছুতেই না। বিন্দু বলেছিল, রাস্তায় মাতালদের দেখি আর আমার ঘেন্না করে। কলেজের শিক্ষিত ছেলেরাও এমন মাতাল হয়! ছিঃ! মদ খেলে তুই আর আমার কাছে আসিস না গঙ্গা! গঙ্গানারায়ণ বলেছিল, বললাম তো, আমি কোনোদিন সুরা পান করবো না। তুই দেখে নিস। বিন্দু বলেছিল, তুই আমার হাত ছুঁয়ে শপথ নে!

আজ কি গঙ্গানারায়ণ শপথ রাখতে পারবে? গৌর একটি গেলাস তুলে ওষ্ঠে সামান্য স্পর্শ করে বললো, বাবার সঙ্গে তোর কী গোল হয়েচে রে মধু? সত্যি করে বলা!

মধু বললো, আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে। কোথাকার একটা আট-ন বছরের খুঁকি মেয়ে, তাকে আমি বিয়ে করবো? নেভার! রাজনারায়ণ দত্তের সাধ্য নেই!

বেণী, বন্ধু আর ভোলানাথের বিয়ে হয়ে গেছে। এর মধ্যেই। গৌরেরও যেন কার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। ওরা মধুর কথায় গুরুত্ব দিল না।

বেণী বললো, বিয়ে করতে বলচেন, চোখ বুজে বিয়ে করে ফেলবি! এতে আর কথা কী আচে।

মধু বললো, আট-ন বছরের মেয়েকে? ইমপসিবল! সে আমার কোনো কথা বুঝবে? নাক নিয়ে সিকনি গড়াবে আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে।

ভোলানাথ বললো, এর চেয়ে বড় মেয়ে আর তুই পাবি কোথায়? কায়স্থ ঘরে কি সোমত্থ মেয়ে কুমারী থাকে? সারা দেশ খুঁজলেও পাবি না। এখন বিয়ে করে ফেলে রাখ, দু-চার বছরের মধ্যেই সে মেয়ে লায়েক হয়ে যাবে!

— বাপ মায়ের পছন্দ করা মেয়ে আমি বিয়েই করবো না! না! না, না, না। এলাস!—দে নো নট দ্যাট আই ডাই অব পেইনস্‌ দ্যাট নান ক্যান হিল।

গঙ্গানারায়ণ হঠাৎ খুব বিমর্ষ বোধ করলো, মধুর মতন তারও ঠিক একই অবস্থা। সেও কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না এখন। কিন্তু মধুর মতন সে তো এত দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করতে পারে না। তাকে নিয়তি মেনে নিতেই হবে।

বেণী বললো, সব ছেলেই বিয়ের আগে মধুর মতন একটু চেঁচামেচি করে, তারপর মেনে নেয়। মধুও মেনে নেবে। বংশরক্ষার জন্য আমরা সবাই বিয়ে করতে বাধ্য।

মধু হুঙ্কার দিয়ে বললো, বাধ্য! আচ্ছা তোরা দেখিস!

—তোর বাবা জোর করলে, তুই কী করবি? কতদিন এড়িয়ে থাকবি!

মধু আবার ব্র্যাণ্ডির বোতল হাতে তুলে নিয়ে বললো, রাজনারায়ণ দত্ত আমার ওপর জোর করবেন? বেশী জোর করলে রাজনারায়ণ দত্তকে আমি এমন পানিশমেন্ট দেবো যে তা তিনি জীবনেও ভুলতে পারবেন না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়