শোনা যায় নবীনকুমারের যখন মাত্ৰ পাঁচ মাস বয়েস, সেই সময়েই সে একটি বিস্ময়কর কাণ্ড করেছিল। একদিন সে খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে যায় মাটিতে। বিম্ববতী সেদিন পাল্কি চেপে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন, পুত্রের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন অতি বিশ্বস্ত চিন্তামণি দাসীর ওপর। শিশুকে ঘুমন্ত ভেবে চিন্তামণি সবেমাত্র একবার ঘরের বার হয়েছে, অমনি শিশু সেই শয্যা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল ভুঁয়ে।

শব্দ পেয়েই চিন্তামণি ছুটে এলো হাঁকুপাঁকু করে। এসে, ঐটুকু ছেলের কাণ্ড দেখে তার চোখ কপালে উঠলো। অতি উঁচু থেকে পড়ে গিয়েও নবীনকুমার কাঁদেনি, বরং হামাগুড়ি দিয়ে সে পালঙ্কের নীচে লুকোবার চেষ্টা করলো যেন। হামাগুড়ি। ভয়ে বুক টিপচিপ করতে লাগল চিন্তামণির। পাঁচ মাসের শিশুকে হামাগুড়ি দিতে দেখেছে। কেউ কখনো? পালঙ্কের নীচে হাত বাড়িয়ে চিন্তামণি ব্যাকুলভাবে ডাকতে লাগলো, অ ছোটবাবু! ছোটবাবু!

চিন্তামণি নবীনকুমারকে ধরে তুলতে সাহস পাচ্ছিল না। তার ধারণা হলো, এ ছেলের ওপর অপদেবতার দৃষ্টি পড়েছে নিশ্চিত। চাঁচামেচি করে বাড়িশুদ্ধ লোককে সে ডেকে জড়ো করলো সেখানে।

নবীনকুমার গুটিসুটি মেরে বসে আছে পালঙ্কের নীচে। মুখ দেখলে মনে হয়, ঠিক যেন দুষ্টুমী করে হাসছে সে। তার কপালের বাঁদিক কেটে গেছে। সরু। ধারায় রক্ত গড়াচ্ছে সেখান থেকে। পাঁচ মাসের শিশু হামাগুড়ি দেয় এবং কপাল কেটে রক্ত বেরুলেও না কেঁদে হাসে। এ দৃশ্য প্রায় অলৌকিকেরই মতন।

আট মাস বয়েসে নবীনকুমার একদিন আপনি আপনিই উঠে দাঁড়ায়। এবং দিব্যি গুড়গুড়িয়ে হেঁটে একলা একলা ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এসে আবার চমকে দেয় সকলকে।

নবীনকুমারের পরবর্তী কীর্তিটি আরও চমকপ্ৰদ।

বিম্ববতীর পাখি পোষার শখ। বাড়িতে অনেকগুলি ময়না, চন্দনা, হিরামন ও কোকিল আছে। তিন দিকের বারান্দায় সার দিয়ে সেই সব পাখির দাঁড়গুলি সাজানো। অন্দর মহলের মধ্যখানে উঠোন। তিন মহলা বাড়ি। একতলার ঘরগুলি আশ্রিত-পোষ্য ও কর্মচারীদের জন্য বরাদ। এছাড়া বাড়ির সংলগ্ন কয়েকটি গোলপাতার ঘরও আছে, সেখানে থাকে দাস-দাসীরা। দোতলার বারান্দাটির নীচের অর্ধেক রেলিং-এ ঘেরা, বাকি অর্ধেক অংশে গ্ৰীষ্মকালে খসখসের পদ ফেলা থাকে। বিম্ববতী এই বারান্দায় দাঁড়িয়েই দাস-দাসীদের প্রয়োজন মতন নির্দেশ দেন। সব দাস-দাসীর ওপরে আসার হুকুম নেই।

পাখিগুলির দাঁড়ে বসানো বাটিতে রোজ সকালে ছোলা আর জল দেন বিম্ববতী নিজে। পাখিগুলি নানা রকম সুরে ডাকে। কিন্তু কোনো পাখির মুখে বোল ফোটেনি, বিম্ববতীর শুধু এই একটা দুঃখ। তিনি প্রতিদিন তাঁর ঘরের সামনের ময়নাটির কাছে দাঁড়িয়ে পাখি পড়ান : ময়না, বল র্যাধেকৃষ্ণ! বল রাধেকৃষ্ণ! রাধেকৃষ্ণ!

বিম্ববতীর কণ্ঠস্বর অতি সুমিষ্ট। তাঁর মুখনিঃসৃত রাধাকৃষ্ণ নামে যেন এ বাড়ি পবিত্র হয়ে যায়। কিন্তু বোকা ময়নাটা কিছু বোঝে না। ঘাড় ঘুরিয়ে লাল লাল চোখ মেলে সে শুধু দেখে বিম্ববতীকে।

শিশু নবীনকুমারও মায়ের আচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সেই সময়। পাছে দুরন্তাপনা করে সে কোনো পাখিকে ধরতে যায় কিংবা কোনো পাখি হঠাৎঠকরে দেয় তাকে, তাই বিম্ববতী এক হাত দিয়ে ছেলের মাথা ঢেকে রাখেন।

ময়না বুলি শিখলো না। তার আগেই নবীনকুমার একদিন বলে উঠলো, রাধেকৃষ্ণ!

প্রায় পরিষ্কার উচ্চারণ। মায়ের দিকে সকৌতুকে তাকিয়ে সে বারবার বলতে লাগলো। ঐ কথা। মা বললো না, দুধ বললো না, যাই বললো না, শিশুর মুখের প্রথম কথাই হলো রাধেকৃষ্ণ। তখন ঠিক আট মাস সতেরো দিন বয়েস। বিম্ববতীর সবঙ্গে এক দারুণ শিহরন হলো। চিন্তামণির কথা শুনে তাঁরও মনে মনে একটু আশঙ্কা ছিল যে ছেলের ওপর অপদেবতার নজর পড়েছে হয়তো। অকালে ভূমিষ্ঠ সন্তানকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা থাকেই। কিন্তু সেদিন তিনি আনন্দে কাঁপতে লাগলেন। রাধাকৃষ্ণ নাম উচ্চারণ করেছে যে শিশু, কোন অপদেবতার সাধ্য তার ধার ঘেঁষে।

ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বিম্ববতী দৌড়োলেন তাঁর স্বামীর ঘরের দিকে।

রামকমল সিংহের ঘুম ভাঙে বেশ বেলায়। চোখ মেলে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। বিম্ববতীর প্রায় পাগলিনীর মতন অবস্থা। হেসে কেঁদে তিনি একেবারে অস্থির। চুমোয় চুমোয় বালকের গাল সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়েছেন। বিম্ববতী যে স্বামীকে কী বলতে ছুটে এসেছেন, তা প্রথমে বুঝতেই পারলেন না রামকমল।

ছেলেই বুঝিয়ে দিল বাবাকে। সে আবার বললো, রাদে কিসস-ও! ঠিক যেন যন্ত্র পুতুলের মতন আওয়াজ।

ক্ৰমে ক্ৰমে বহু জায়গায় রটে গেল যে, যোড়াসাঁকোর সিংহ বাড়িতে এক ক্ষণজন্ম শিশুর আবির্ভাব হয়েছে। এক বছর বয়েসেই সে নাচে, গায়, ছড়া বলে। বাড়িতে অতিথিরা এলে তাঁরা গোল হয়ে ঘিরে বসেন মজলিশ কক্ষে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে নবীনকুমার হাত পা নেড়ে, চোখ উল্টে নানা রকম কৌতুক দেখায়। সকলেই যে এ দৃশ্য উপভোগ করে, তা নয়। কেউ কেউ অস্বস্তিতে মুখ ফিরিয়ে রাখে। এ শিশুর কিছুই যেন স্বাভাবিক নয়। হাত-পায়ের গড়ন যেন কাঠ কাঠ, ঠোঁটে নাকে তীক্ষ্ণতা আছে কিন্তু লালিত্যের বেশ অভাব। তার চোখ দুটি বেশী উজ্জ্বল। তার ব্যবহারে এতখানি অকালপক্কতা দেখলে গা ছমছম করে। মনে হয়, এ শিশু বেশীদিন বাঁচবে না। প্রকৃতির খেয়ালে এ রকম একটি দুটি শিশু জন্মায় আবার হঠাৎ চলে যায়।

শ্রীরামপুরের মার্শম্যান সাহেবের সাপ্তাহিক পত্রিকা সমাচার দর্পণে ছাপাও হয়েছিল। এই শিশুর খবর।। যুগল সেতু নিবাসী প্রসিদ্ধ বাবু রামকমল সিংহের বহু সুকৃতির ফলে পরিপক্ক বয়সে এক পুত্রসস্তান লাভ হইয়াছে। ঐ পুত্রের নাম নবীনকুমার। সে তাহারদের গৃহ উজ্জ্বল করতঃ মাতা পিতাকে সুখসাগরে নিমজ্জিত রাখিয়াছে। বিশেষ কথা এই যে ঐ পুত্র অতি ভক্তিমান। দেব-দেবীর মূর্তি দেখিলেই সে দর ২ ধারে অশ্রুবর্ষণ করে ও গীত গাহে। বালকের বয়ঃক্রম এক বৎসর দুই মাস মাত্র।

 

এদিকে গঙ্গানারায়ণ দিন দিন আরও নিভৃতচারী হয়ে উঠছে। এমনিতেই সে লাজুক, বাড়িতে আত্মীয় সমাগম হলে সে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়, হাঁটাচলা করে নিঃশব্দে। এখন তাকে আরও দেখতে পাওয়া যায় না। নিজেকে প্ৰায় সব সময় আবদ্ধ করে রাখে নিজের কক্ষে। বছরখানেক আগে সে ফিরিঙ্গি পাঠশালা ছেড়ে ভর্তি হয়েছে হিন্দু কলেজে। তার মনে এসেছে নতুন জোয়ার। চোখের সামনে খুলে গেছে কল্পনার এক অপরাপ জগৎ।

একা ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে সে আবৃত্তি করে :

নট ম্যাড, বাট বাউণ্ড মোর দ্যান আ ম্যাডম্যান ইজ;
শাট আপ ইন প্রিজন, কেপ্ট উইদাউট মাই ফুড
হুইপড অ্যাণ্ড টরমেন্টেড…

রোমিওর সংলাপ উচ্চারণ করতে করতেও সে শুনতে পায় ক্যাপটেন রিচার্ডসনের কণ্ঠস্বর। ক্যাপটেন সাহেব কাব্যকে একেবারে জীবন্ত করে তোলেন। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে কখনো তিনি সিংহের মতন গজািন আবার কখনো বাঁশীর মতন মধুর সুরেলা স্বর বার করেন। রোমিওর কথা বলতে বলতে তিনি নিজেই রোমিওভাবে ভাবিত হয়ে যান। আবার তিনিই ক্যাপিউলেট, তিনিই মারকুশিও, এমনকি জুলিয়েট পর্যন্ত। জুলিয়েটের কথা চোখ বুজে শুনলে মনে হবে, ক্লাসের মধ্যে সত্যিই বুঝি কোনো নারী এসে উপস্থিত হয়েছে।

রিচার্ডসনের ক্লাসে একটি পিনের শব্দ পড়লেও শোনা যায়। এমনকি মধুর মতন অত দুরন্ত ছেলেও সে সময় তন্ময় হয়ে থাকে।

গঙ্গানারায়ণের বিবাহের কথাবাত চলছে। রামকমল চান খুব শীঘ্রই গঙ্গাকে বিষয়-কর্মে লাগিয়ে। দিতে। অনেক পাত্রী দেখার পর বাগবাজারের গোকুল বসুর কন্যা লীলাবতীকে মোটামুটি পছন্দ করা হয়েছে। লীলাবতীর বয়েস সাত। গঙ্গানারায়ণের এখন বিবাহের এতটুকুও ইচ্ছে নেই। কিন্তু সে কথাও সে মুখ ফুটে বলতে পারে না। কারুকে। অতটুকু একটা মেয়ের সঙ্গে সে কী কথা বলবে? তা ছাড়া, বিবাহের চিন্তাতেই গঙ্গানারায়ণের কৰ্ণমূল আরক্ত হয়। ঐ ব্যাপারটির মধ্যে কী যেন একটা রহস্য আছে, তা সে এখনো ঠিক বোঝে না। ইদানীং ঐ কথা তুলে বিন্দুবাসিনী প্রায়ই খুব রঙ্গ করে।

বিন্দুবাসিনী বিধুশেখরের তৃতীয়া মেয়ে। গঙ্গানারায়ণ বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে যায় ঐ বাড়িতে। আগে প্ৰায় প্রত্যহই যেত, এখন বিশেষ করে শনিবার ও রবিবার সে যেতে ভোলে না।

বিধুশেখরের বাড়ির আশ্রিতদের মধ্যে একজন হচ্ছেন শিবরাম আচাৰ্য, তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত সংস্কৃত ও বাংলার পাঠ নিতে যেত গঙ্গানারায়ণ। কিছুদিন হলো আচাৰ্যৰ্মশাই মার্শম্যান সাহেবের কাগজে পণ্ডিতের চাকুরি নিয়েছেন। সারা সপ্তাহ শ্ৰীরামপুরে থেকে শনিবার কলকাতায় আসেন।

বিন্দুবাসিনীও পাঠ নেয়। ঐ আচার্যের কাছে। বিন্দুবাসিনীর পড়াশুনায় বড় আগ্রহ, সেখানেই তার রোনারায়ণের মিল। বিধবা হয়ে পিয়ালয়ে ফিরে এসে বিন্দুবাসিনী পড়াশুনায় বেশী করে মন

বিধুশেখরের কন্যার সংখ্যা পাঁচ, তিনি অপুত্ৰক। পুত্রসন্তান নেই বলেই বিধুশেখরের বাড়িতে গঙ্গানারায়ণের বেশী আদর। বিধুশেখরের পঞ্চম কন্যাটির বয়েস আট, তারও বিবাহ এই সামনের অগ্রহায়ণে। সেই কন্যার সঙ্গে গঙ্গানারায়ণের বিবাহ হলে ব্যাপারটি সবঙ্গিসুন্দর হতে পারতো, কিন্তু তা হবার নয়। বিধুশেখররা ব্ৰাহ্মণ।

বৈদিক কুলীন বলে ঐ পরিবারের মেয়েদের বিবাহ হয় কুল সম্বন্ধ করে। কন্যাসন্তান জন্মাবার দু-এক মাসের মধ্যেই স্বজাতের মধ্যে কোনো পাত্র নিবাচন করে তার সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক করে রাখতে হয়। তারপর যথাসময়ে সেই নির্দিষ্ট পাত্রের সঙ্গেই বিবাহ।

বাল্য থেকেই বিন্দুবাসিনীর কপাল পোড়া। কৃষ্ণনগরের যে ছেলেটির সঙ্গে তার কুলসম্বন্ধ করা ছিল, বিন্দুবাসিনীর বয়েস সাত না পুরতেই মরে গেল সেই ছেলেটি। ফলে বিন্দুবাসিনী অন্যপূর্ব হয়ে গেল, তার আর কুলীন ঘরে বিবাহ সম্ভব নয়। এক মৌলিক ঘরের পাত্র ঠিক করা হলো তার জন্য। বিন্দুবাসিনী প্ৰায় গঙ্গানারায়ণের সমবয়সী। গঙ্গানারায়ণের মনে আছে বিন্দুবাসিনীর বিবাহের দিনটির কথা। সেদিন আকাশের রঙ ছিল রক্তবর্ণ। পাথুরিয়াঘাটায় সাংঘাতিক আগুন লেগেছিল, পুরো দুদিন ধরে জ্বলেছিল সেই আগুন। সেই লাল আকাশের নীচ দিয়ে খেলাঘর ও পুতুলের সংসার ছেড়ে আট বছরের বালিকা বিন্দুবাসিনী চলে গেল শ্বশুরালয়ে। সেদিন সে গিয়েছিল কাঁদতে কাঁদতে, আবার সেই রকমই কাঁদতে কাঁদতে ঠিক দেড় বছরের মাথায় সে ফিরে এলো সিঁথির সিঁদুর মুছে।

পুত্রসন্তান না থাকলেও বন্ধুর মতন দত্তক নেননি বিধুশেখর। পঞ্চম কন্যা সুহাসিনীর সঙ্গে যার বিবাহ ঠিক করেছেন, তাকে তিনি ঘরজামাই করে রাখবেন। সদর দেওয়ানি আদালতে ওকালতি করে প্রচুর অর্থ উপাৰ্জন করেছেন বিধুশেখর, উকিল হিসেবে তাঁর প্রতিপত্তি প্ৰায় রাজনারায়ণ দত্তের সমান সমান। সুহাসিনীর কুলসম্বন্ধ ছিল যার সঙ্গে, সে ইতিমধ্যেই আরও দুটি বিবাহ করায় ক্রুদ্ধ বিধুশেখর সেই পাত্রের সঙ্গে নিজ কন্যার সম্বন্ধ ছিন্ন করেছেন। এর ফলে সমাজে কিছু গুঞ্জন উঠেছিল, কিন্তু বিধুশেখর অর্থের জোরে সমাজের মুখ চাপা দেবেন। সংস্কৃত কলেজ থেকে একটি দরিদ্র মেধাবী মুক্ত তিনি সুহাসিনীর বর হিসেবে ঠিক করেছেন, এই ছেলেটিও খাটি দক্ষিণাত্য বৈদিক কুলীন বংশায়।

বিধবা হয়ে ফিরে আসার পর বিন্দুবাসিনী আর পুতুল খেলায় মন দেয়নি। যথা নিয়মে অবশ্য তাকে প্রথমে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল আরও বৃহৎ একটি পুতুল খেলার ঘরে। আবেগকম্পিত গলায় বিধুশেখর বলেছিলেন, মা, আর কাঁদিস নে, আজ থেকে গৃহদেবতার সেবার সব ভারতের ওপরেই দিলাম। মনে করিস, স্বয়ং জনাৰ্দনই তোর স্বামী। আমরা সকলে তোর সন্তান।

কিন্তু সাড়ে ন বছরের একটি বালিকার সর্বক্ষণ ঠাকুরঘরে মন বসবে কেন? গোড়ায় কিছুদিন সে একটা সাদা থান আলুথালুভাবে শরীরে জড়িয়ে ঠাকুরঘরে গিয়ে গভীরভাবে চোখ বুজে বসে থাকতো। কখনো কখনো তার মা গিয়ে দেখেছেন যে মেয়ে কুশের আসনের ওপরই কাৎ হয়ে ঘুমিয়ে আছে।

এখন বিন্দুবাসিনী দুবেলা নমো নমো করে কোনোক্রমে পুজো সেরে আসে, আর বাকি সময় পড়ে। সংস্কৃত ও বাংলায় তার যথেষ্ট বুৎপত্তি জন্মেছে। কূট প্রশ্নে সে গঙ্গানারায়ণকেও হারিয়ে দেয়। বিন্দুবাসিনী প্রশ্ন করে, বল তো গঙ্গা, বিজ্ঞানাৰ্থং মনুষ্যানাং মনঃ পূর্বং প্রবর্ততে-এর মানে কী?

গঙ্গানারায়ণ কোনক্রমে উত্তর দেয়, মানুষের মন সব কিছু জানিবার জন্য ব্যস্ত।

বিন্দুবাসিনী মাথা দুলিয়ে হাসে আর বলে, হলো না, হলো না! অত কী সহজ। মানুষের মন প্রথমে বস্তুর স্বরূপ জানবার জন্য প্রবৃত্ত হয়। তারপর মানুষের মন এর ওপরে উঠে যায়, আর সেই বস্তুকে অনুভব করার সংকল্প করে—আর তাতে বাধা পেলে চটে যায় ৷-তৎ প্ৰাপ্য কামং ভজতে রোষঞ্চ দ্বিজসত্তম!

বিন্দুবাসিনীর মুখে এত বড় বড় কথা শুনে গঙ্গানারায়ণেরও হাসি পায়। সে বলে, এ তো কাব্য নয়। এ সব শুকনো দর্শন আর আমার ভালো লাগে না।

বিন্দুবাসিনী ফোঁস করে ওঠে।

—এ সব শুকনো দর্শন? তুই বুজিস ছাই! দুপাতা ইংরেজি পড়েই তুই সব বুজে গিয়েচিস। তাই না?

সংস্কৃত সম্পর্কে গঙ্গানারায়ণের আগ্রহ সত্যিই অনেক কমে গেছে। আর বাংলায় তো পড়বার মতন একখানাও বই নেই।

—তুই তো ইংরাজি পড়লি না বিন্দু! তুই বুঝবি কী করে যে কত সুন্দর রসের কাব্য ওরা লিকেচে। মেকলে সাহেব কী বলেচেন, জানিস? আমাদের দেশের যে কটা ভালো বই, তা আঙুলে গোনা যায়। ইওরোপীয় লাইব্রেরির একখানা তাকও ভরবে না। আর ওদের সাহিত্যের কী বিরাট ভাণ্ডার!

—তোর সেই মাকালু সাহেবকে জিজ্ঞেস করিস তো, শুধু গোটা মহাভারতখানা রাখতেই কটা তাক লাগে।

—তুই যে এত সংস্কৃত পড়াশুনো করিস, এতে তোর কী লাভ, বিন্দু? তুই তো আর টোল খুলবি না।

—আমি পড়ি আমার নিজের আনন্দের জন্য।

শিবরাম আচার্য অত্যন্ত শীর্ণকায়, কথা বলার সময় সব সময় হাঁটু দুটো নাড়তে থাকেন আর তাঁর হাতের ইকোয় মটমট শব্দ হয়। একতলায় তাঁর ঘরখানি দিনের বেলাতেও বেশ অন্ধকার, চতুদিকে ডাই করা পুঁথিপত্র। ঐ রকম রোগা চেহারা হলেও তাঁর গলাখানা বাজখাই। একখানা পুঁথি খুলে তার ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে পাঠ উদ্ধার করেন। পড়াতে ভালোবাসেন তিনি, গঙ্গানারায়ণ ও বিন্দুবাসিনীর মতন দুটি মনোযোগী ছাত্ৰ-ছাত্রী পেয়ে তিনি বেশ উৎসাহের সঙ্গেই পড়ান। বিন্দুবাসিনীর অন্য বোনেদের কখনো পড়াশুনোয় এমন আগ্রহ দেখা যায়নি। তবে সকলেই বাংলা লিখতে ও পড়তে জানে। গঙ্গানারায়ণ লক্ষ্য করেছে যে ব্ৰাহ্মণবাড়ির মেয়েরা মোটামুটি লিখতে পড়তে সবাই শিখে যায়। তার মা বিম্ববতীর অক্ষর জ্ঞান নেই। ছোটভাইটি জন্মাবার আগে পর্যন্ত সে প্রত্যেকদিন মাকে বই পড়ে শুনিয়েছে।

শনিবার শ্ৰীরামপুর থেকে একটু আগে ফিরেছেন শিবরাম আচার্য। হাত-পা ধুয়ে জপ সেরে নিলেন। চোখ খুলেই দেখেন দুই ছাত্ৰ-ছাত্রী উপস্থিত। প্রথমেই তিনি গঙ্গানারায়ণের কাছ থেকে তার বাড়ির কুশল সংবাদ জানলেন। বিশেষত গঙ্গার কনিষ্ঠ ভাইটি সম্পর্কে তাঁর বেশী আগ্রহ।

তারপর তিনি ইকো ধরিয়ে টানতে লাগলেন আরাম করে, পুঁথি খুললেন না।

বললো, পণ্ডিতমশাই, আপনি আজ আমাদের কালিদাস পড়াবেন বলেচিলেন,

শিবরাম আচাৰ্য বললেন, মেঘদূতম্‌…হুঁ।

চিন্তিতভাবে জোরে জোরে খানিকক্ষণ হাঁটু নাচালেন তিনি। তারপর বললেন, মা বিন্দু, কিছুদিন ধরিয়াই তোমাকে একটি কথা বলিব বলিব করিয়াছি, কিন্তু বলা হইয়া উঠে না। আমার নিকট তুমি যথেষ্ট শিখিয়াছ, আর কিছু তোমার শিখিবার প্রয়োজন দেখি না।

বিন্দু অবাক হয়ে বললো, আর কিছু শোকার নেই? আপনিই তো বলেচেন, মানুষের শিক্ষার কখনো শেষ হয় না। তাছাড়া, আমি তো এখনো কিছুই শিকিনি।

শিবরাম বললেন, যাহা শিখিয়াছ, তাহাই যথেষ্ট। আর প্রয়োজন নাই। স্ত্রীলোকের পক্ষে যতখানি শিক্ষা করা উচিত, তুমি তাহা অপেক্ষা বেশীই পড়িয়াছ।

—না পণ্ডিতমশাই। ও কথা আমি শুনবো না। পড়াশুনো না করলে আমি সময় কাটাবো কেমন করে?

—বেশ তো, যদি পাঠাভ্যাস রাখিতে চাও, নিজে নিজেই তাহা পরিবে। আমার সাহায্য লাগিবে না।

—নিজে নিজে পড়বো? আপনি তো মুগ্ধবোধ শেষ করেননি। সংস্কৃত ব্যাকরণ আমি এখনো সব বুজতে পারি না। গঙ্গা বলচিল, ওর দর্শন ভালো লাগে না, কাব্য ভালো লাগে। ইংরেজিতে নাকি ভালো কাব্য আচে। মেঘদূতের চেয়েও কি ভালো কাব্য ইংরেজিতে আচে? আপনি আমাদের মেঘদূত পডান।

—শুন, মা বিন্দু, মেঘদূতম স্ত্রীলোকের পাঠ করা উচিত হয় না।

কথাটা বলে ফেলে শিবরাম আচার্য নিজেই যেন লজ্জা পেলেন, মুখটা নীচু করলেন মাটির দিকে। বিন্দুবাসিনীর মুখখানা এবার বিবৰ্ণ হয়ে গেল। সে অস্পষ্টভাবে জানে যে কোথাও কোথাও একটা কিছু সীমারেখা আছে, যা সে লঙঘন করতে পারবে না।

গঙ্গানারায়ণ চুপ করে বসে ছিল। শিক্ষাদানের ব্যাপারে অত্যুৎসাহী পণ্ডিতের হঠাৎ এই মন পরিবর্তনের কারণটা সে ঠিক বুঝতে পারলো না। বিন্দু কেন আর পড়বে না?

সে জিজ্ঞেস করলো, পণ্ডিতমশাই, আপনি আমাকেও আর পড়াবেন না?

পণ্ডিত বললো, তোমাকে কেন না পড়াইব? তোমার যখন ইচ্ছা আসিও।

—তা হলে বিন্দু কী দোষ করলো?

—স্ত্রীলোকদিগের শিক্ষা দিবার অধিকার আমাদের নাই। ইহা লোকচারসম্মত নহে। বিন্দু যাহা শিখিয়াছে তাহাতেই সে নিজে ধর্মগ্রন্থাদি যথেষ্ট পড়িতে পরিবে। বিশেষত মেঘদূতম, পাঠ স্ত্রীগণের পক্ষে অতি গহিত।

—ঠিক আছে, মেঘদূত না হয় থাক। আপনি মহাভারত পড়াচ্চিলেন, সেটিও তো এখনো শেষ হয়নি।

—শুন, তাহা হইলে সত্য কথাটি বলি। শুন, বিন্দু। তোমার পিতা মহাশয় আমাকে বলিয়াছেন যে, কন্যার পাঠ্য যথেষ্ট হইল। আর অধিক কী! সে এখন পঞ্চদশবর্ষীয়া হইয়াছে।

বিন্দু রাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি তাহলে আমাকে আর পড়াবেন না?

—তোমার পিতার অনিচ্ছা, আমি কী করি বলো!

সমস্ত মুখখানা কুঁকড়ে গেছে বিন্দুর। ঠোঁট চেপে সে কান্না সামলাচ্ছে। এই আকস্মিক আঘাতে তার সরল অন্তঃকরণখনি যেন তছনছ হয়ে গেছে। বিনা দোষে শাস্তি পেলেই মানুষের মনে বেশী আঘাত লাগে। বিন্দু আর একটি কথাও বললো না। হঠাৎ দৌড়ে বেরিয়ে চলে গেল ঘর থেকে।

অপরাধীর মতন চুপ করে বসে রইলো গঙ্গানারায়ণ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবরাম আচার্য বললেন, এ গৃহ হইতে আমার এবার বুঝি পাট উঠিল। আমারও আর এত দূর যাতায়াত পোষায় না। শ্ৰীরামপুরেই বাসা ভাড়া লইব মনস্থ করিয়াছি।

গঙ্গানারায়ণের মন খারাপ লাগলো। বিধুশেখর হঠাৎ এ রকম নির্দেশ দিলেন কেন? বিন্দু বলেছিল, সে পড়াশুনো করে নিজের আনন্দের জন্য, তার বাবা কেন সে আনন্দন্টুকু কেড়ে নিতে চান? সারল্যে ভরা হাসিখুশী স্বভাবের মেয়ে বিন্দু, তাকে দুঃখ দিয়ে কী লাভ! শিবরাম আচার্যের জন্যও একটু কষ্ট হলো তার। উনি চলে গেলে গঙ্গানারায়ণের খারাপ লাগবে। মানুষটি মৃতদার এবং ছন্নছাড়া স্বভাবের, সংসারে নাকি ওঁর কেউ নেই। তিনবার বিবাহ করেছিলেন, তিন স্ত্রীই অকাল মৃতা, তাই নিজেকে অপয়া মনে করে উনি আর বিবাহ করবেন না ঠিক করেছেন। নিজেই উনি ওঁর বিবাহের গল্প করেছেন বিন্দু আর গঙ্গানারায়ণের কাছে। মানুষটির মনটি খুব ফর্সা।

—তোমার কি আজ পাঠের মন আছে?

গঙ্গানারায়ণ বললো, আপনি চলে যাবেন, আমারও তো আর পড়া হবে না।

—তুমি কলেজে পড়িতেছ, তোমার চিন্তা কী! সংস্কৃতের যুগ ফুরাইয়াছে। আমি আর কিছুদিন থাকিলে তোমার নিকট হইতে গোটা দুই-চারি ইংরাজি শব্দ শিক্ষা করিতাম। ম্লেচ্ছভাষার এখন জয়জয়কার। ইংরাজি না শিখিলে আর কোনোদিকেই কোনো সুবিধা নাই। আচ্ছ বলো তো, নর শব্দের প্রথমার একবচনের ইংরাজি কী হইবে?

একটু পরে গঙ্গানারায়ণ পণ্ডিতমশাইয়ের পায়ের ধুলো নিয়ে উঠে পড়লো।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, এখন তার বাড়ি ফিরে যাবার কথা। সন্ধ্যের পর পথঘাট দিয়ে এক একা চলা নিরাপদ নয়। অবশ্য বাড়ি কাছেই, গঙ্গানারায়ণ এক ছুটে চলে যেতে পারে।

কিন্তু যাবার আগে একবার বিন্দুর সঙ্গে দেখা করে যেতে ইচ্ছে হলো তার। বিন্দুর অভিমান বড় তীব্র। তাকে পড়তে নিষেধ করা হয়েছে, এই অভিমানে সে হয়তো বই-খাতাপত্ৰ সব ছিঁড়ে ফেলে দেবে। আর কোনোদিন কোনো বই স্পর্শ করবে না। তাহলে বিন্দু কী নিয়ে থাকবে? গঙ্গানারায়ণ এইটুকু বোঝে যে বিন্দুর সামনে এক সুদীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবন পড়ে আছে। স্ত্রীলোকের মেঘদূত পড়া নিষেধ। কী আছে মেঘদূতে? গঙ্গানারায়ণকে পড়ে দেখতেই হবে।

সুহাসিনী দোতলার বারান্দায় দাসীর কোলে বসে দুখভাত খাচ্ছে। সুহাসিনী নিজে কিছুই খেতে চায় না, তাকে জোর করে খাইয়ে দিতে হয়। সেইজন্য বিধুশেখর সুহাসিনীর জন্য একটি আলাদা ব্ৰাহ্মণী দাসী রেখেছেন।

—এই, বিন্দু কোথায় রে?

সুহাসিনী বললো, কী জানি! দেখিনি তো!

দাসীটি বললো, ঠাকুরঘরের দিকে যেতে দেকলুম তো একবার।

গঙ্গানারায়ণ সেদিকে এগোলো। সুহাসিনী তার সরু রিনারিনে গলায় জিজ্ঞেস করলো, গঙ্গাদাদা, তোমার আগে বিয়ে হবে, না আমার আগে বিয়ে হবে?

দাসীটি বললো, মেয়ে একেবারে বিয়ের জন্য পাগল!

গঙ্গানারায়ণ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, দাঁড়া, তোর বরকে আমি বলে দেবো, তুই দুধভাত খেতে দেরি করিস। তাহলে সে গুম গুম করে তোর পিঠে কিল মারবে।

সুহাসিনী তার ছোট্ট মুঠি তুলে বললো, আমিও তাকে মারবো।

ঠাকুরঘরের ভেতরে ঢুকবে না। গঙ্গানারায়ণ। দরজার কাছে গড় হয়ে আগে প্ৰণাম করলো, তারপর ডাকিলো, বিন্দু, বিন্দু!

কোনো সাড়া নেই। গঙ্গানারায়ণ একটু মুখ কুঁকিয়ে উঁকি মেরে দেখলো বিন্দু নেই। এখানে। বিন্দু তার নিজের ঘরেও নেই। হয়তো মায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকতে পারে। কিন্তু কান্নার সময় বিন্দু একা থাকতে চায়, গঙ্গানারায়ণ আগে দেখেছে। গঙ্গানারায়ণ ছাদে খুঁজতে গেল।

পশ্চিম দিকের আলসের কাছে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বিন্দু। আকাশে তখনও বর্ণ পরিবর্তনের পর্ব শেষ হয়নি। একদিকের আকাশ তখন প্ৰায় অন্ধকার, মাঝে মাঝে রয়ে গেছে কয়েকটি রূপালি রেখা। অন্যদিকের আকাশে ঝালকাচ্ছে সোনার রঙ, কোথাও কোথাও তা সিঁদুরের মতন লাল। বিন্দু তাকিয়ে আছে সেই সূৰ্য্যস্তের সমারোহের দিকে। শুভ্ৰবসনা বিন্দুকে সেই লাল রঙের পটভূমিকায় দেখে গঙ্গানারায়ণের মনে হলো, এ রকম রক্তিম আকাশের সঙ্গে বিন্দুর জীবনের যেন কোনো যোগ আছে।

গঙ্গানারায়ণ ভাবলো, পিছন থেকে চুপি চুপি গিয়ে ৰিন্দুর পিঠে হাত রেখে চমকে দেবে। বিন্দুর চোখে যদি এখনো জল থাকে, তাহলে সে তাকে বলবে, তুই কাঁদিস নি, বিন্দু। এখন থেকে আমি তোকে পড়াবো। আমি কলেজ থেকে যা শিখে আসবো, সে সব আবার শোনাবো তোকে। খুব কাছে গিয়ে হাত তুলেও থেমে গেল গঙ্গানারায়ণ। তার মনে হলো, সব কিছু আর আগেকার মতন নেই। এক একটা কথায় অনেক কিছু ভেঙে যায়। পণ্ডিতমশাই আজ বারবার বিন্দুকে বলছিলেন স্ত্রীলোক। বিন্দু ঠিক কবে থেকে স্ত্রীলোক হয়ে গেল? এই তো কাল পর্যন্তও সে ছিল একটি কিশোরী, গঙ্গানারায়ণের সঙ্গে কত কৌতুক করেছে। আজ যদি সে স্ত্রীলোক হয়ে যায়, তাহলে তার পিঠে হাত রাখা কি ঠিক হবে?

গঙ্গানারায়ণ উদ্যত হাতটা ফিরিয়ে নিল।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়