এক শনিবারের দ্বিপ্রহরে নবীনকুমারের ঘুম ভেঙ্গে গেল কিছু নারীকণ্ঠের কল-কোলাহলে। প্রতি শনিবার বিকেলের দিকে তাকে গুরুতর কর্মে ব্যাপৃত থাকতে হয়, তাই আহারাদির পর সে খানিকটা নিদ্রা-সাধনা করে নেয়।

হিন্দু কলেজের পাঠ সাঙ্গ করার আগেই কলেজ ছেড়ে দিয়েছে নবীনকুমার। ক্লাসে শান্ত হয়ে বসে থাকা কিংবা শিক্ষকদের শাসন মান্য করা তার ধাতে সয় না। সে অতি মেধাবী এবং তার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর। অন্য ছাত্ররা যা সাতদিনে শেখে তা নবীনকুমার একদিনেই রপ্ত করে নেয়, সুতরাং বাকি দিনগুলি যে সে ক্লাসের মধ্যে দুষ্টামী করবে, তাতে আশ্চর্য হবার কী আছে।

কলেজ ছেড়ে দিয়ে সে বাড়িতে একটি ক্লাব স্থাপন করেছে, তার নাম বিদ্যোৎসাহিনী সভা। বিশিষ্ট জ্ঞানী, গুণী ও চিন্তাবিদরা এখানে এসে দেশ, কাল, সমাজ ও সাহিত্য সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। কলেজী শিক্ষকদের বাঁধা-ধরা লেকচারের চেয়ে তা অনেক বেশী ভাবগর্ভ ও শিক্ষাপ্রদ। নবীনকুমার নিজেও দু-এক শনিবার কয়েকটি স্বলিখিত প্ৰবন্ধ পাঠ করে শ্রোতাদের বিষম চমকে দিয়েছে। চতুর্দশ বর্ষীয় এক কিশোরের মুখ থেকে এমন সুচিন্তিত কথাবার্তা কেউ আগে কখনো শোনেনি। সকলে নবীনকুমারকে ধন্য ধন্য করে, তাতে তাঁর আত্মাভিমানে সুড়সুড়ি লাগে, তার ললাটে গর্বিত আলো ঝলসায়। বিদ্যোৎসাহিনী সভা এখন নবীনকুমারের ধ্যান-জ্ঞান। বৎসরাধিক কাল ধরে সভা নিয়মিত চলছে।

নারীকণ্ঠের সুরেলা গোলমাল শুনে নবীনকুমার বেরিয়ে এলো নিজ কক্ষ থেকে। দুই বৎসর আগে নিরুদ্দিষ্ট গঙ্গানারায়ণকে মৃত বলে ধরে নেওয়ায় তার শয়ন ঘরটিও এখন নবীনকুমার ব্যবহার করে, শব্দ আসছে সেখান থেকে। সেখানে উঁকি দিয়ে নবীনকুমার এক বিচিত্র দৃশ্য দেখলো।

কৃষ্ণভামিনীর মৃত্যুর দেড় বৎসর পর নবীনকুমার দ্বিতীয়বার দার-পরিগ্রহ করেছে। এ সময়ে তার বিবাহে মতি ছিল না, বিদ্যাৎসাহিনী সভা নিয়েই সে মত্ত হয়ে ছিল। কিন্তু বিধুশেখরের প্ররোচনায় জননী বিম্ববতী তাকে নিয়মিত পীড়াপীড়ি করছিলেন, তাই শেষ পর্যন্ত নবীনকুমার বিবাহে সম্মতি দিয়েছে এক সময়। কৃষ্ণভমিণীরই এক সম্পৰ্কীয়া ভগিনী অপর এক বসু পরিবারের কন্যা সরোজিনী এ বাড়িতে এসেছে নববধূ হয়ে।

প্রথম বিবাহের পর, বালকদশা থেকে সদ্য কৈশোরে উত্তীর্ণ নবীনকুমার যেমন স্ত্রীকে নিয়ে মেতে উঠেছিল, দ্বিতীয় বিবাহের পর সে রকম কিছুই হয়নি। তখন বাড়ির বাইরের জগতের সঙ্গে নবীনকুমারের বিশেষ পরিচয় ছিল না, তাই এক নতুন বালিকাকে সে খেলার সঙ্গিনী পেয়ে খুশী হয়েছিল।

এখন শহরের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গেই নবীনকুমারের পরিচয় হয়েছে, তার বয়স এত কম হলেও আচরণের ভরিক্কীপনায় সে নিজেও একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য। বিদ্যোৎসাহিনী সভার বিশেষ

SOSRO

 

সুনাম হয়েছে, দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে এ সভার বিবরণ প্রকাশিত হয়।

এখন বাড়ির চেয়ে বাইরের টানই বেশী, তাই দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে নবীনকুমারের ভালো করে পরিচয়ই হয়নি। মাতৃ-সনির্বন্ধে বিবাহ করতে হয়েছে, করেছে, আর যেন তার কোনো দায় নেই। স্ত্রী থাকে অন্দরমহলে। তার মায়ের কাছে। দুপুরে নবীনকুমার যখন খেতে বসে তখন বিম্ববতীর আজ্ঞায় বালিকা সরোজিনী একটি ঝালর বসানো পাখা দিয়ে স্বামীকে হাওয়া দেয়। সেই সময়টিতেই যা নবীনকুমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার দ্বিতীয়াপত্নীর। কৃষ্ণভামিনীকে নবীনকুমার জোর করে রাত্রে নিজ শয্যাতে নিয়ে শুতি, যদিও কোনো প্রকার যৌন চেতনা তার তখন জাগেনি, খেলার সঙ্গিনীকে সে যেন নিদ্রার মধ্যেও ছাড়তে চাইতো না। সরোজিনী সম্পর্কে তার সে আগ্রহ নেই, বিম্ববতীও অল্পবয়েসী। বধূকে রাত্রে ছেলের কাছে পাঠান না।

নবীনকুমার দেখলো, পাঁচ-ছট বালিকাকে নিয়ে সরোজিনী সেই দুপুরে পুতুল খেলায় মেতেছে। সরোজিনী সমেত আর সব কটি বালিকারই বয়েস নয়-দশ বৎসরের মধ্যে, শুধু একজন একটু বড়, সে বোধ হয় দ্বাদশ বর্ষীয়া হবে।

প্রথমেই নবীনকুমারের বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো। তার মনে পড়ে গেল কৃষ্ণভামিনীর কথা। কৃষ্ণভামিনীর মৃত্যুর পর প্রথম কয়েক দিন নবীনকুমার খুব কান্নাকাটি করেছিল, তারপর আর অনেক দিন তার কথা মনেই পড়েনি।

ঠিক যেন একই দৃশ্য। এই বাড়িতে কৃষ্ণভামিনী তার সখীদের সঙ্গে দুপুরবেল পুতুল খেলতে বসতো। কয়েকবার নবীনকুমারও যোগ দিয়েছে সেই খেলায়। এখনও বালিকারা সেই রকম পুতুল নিয়ে বিয়ে বিয়ে খেলছে। শুধু এর মধ্যে কৃষ্ণভামিনী নামে সেই চঞ্চলা, মুখরা বালিকাটি নেই, সে হারিয়ে গেছে কোন মহাশূন্যে।

নবীনকুমার সে ঘরে প্রবেশ করতেই সব মেয়েরা আড়ষ্ট হয়ে গেল। খেলা বন্ধ করে সবাই এমনভাবে মাটির দিকে মুখ নীচু করে রইলো যেন নবীনকুমার এক মহামান্য গুরুজন, তার সামনে তারা কোনো গুরুতর দোষের কাজ করে ফেলেছে।

পৃথিবীটা সম্পূর্ণভাবে পুরুষের দখলে হলেও সংসারে, অন্দরমহলে নারীদের একটা সাবলীল অধিকারবোধ থাকে।

সরোজিনী তার সখীদের ভয় ভাঙবার জন্য বলে উঠলো, আমরা পুতুল খেলচিালুম, দরোজা বন্ধ করে দিচ্চি, তাহলে আর গোলমাল হবে না।

নবীনকুমার তাদের অভয় দান করে বললো, না, তোমরা খ্যালো না! আমি দেখতে এলুম।

নবীনকুমারের হঠাৎ ইচ্ছে হলো দু বৎসর আগেকার দিনগুলিতে ফিরে যেতে। ওদের সঙ্গে বসে সেও কি পুতুল খেলতে পারে না? সন্ধ্যাকালে জ্ঞানীগুণীর আসরে যাকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ দিতে হবে, তার পক্ষে দুপুরবেলা বালিকাদের সঙ্গে পুতুল খেলা কি দোষের?

যে বালিকাটির বয়েস কিছু বেশী, সে বসে ছিল খানিকটা দূরে একটি মোড়ার ওপর। অন্যরা সবাই গালিচার ওপর অনেকগুলি পুতুল ছড়িয়ে বসেছে। সুন্দর সুন্দর সব কাচকড়ার পুতুল, তাতে আবার উত্তম সিল্কের পোশাক পরানো।

মোড়ার ওপর বসা বালিকাটি সব দিক থেকেই অন্যদের চেয়ে পৃথক, তার গায়ের রঙ গোলাপ বৰ্ণ, তার চোখের মণি দুটি নীল।

তার দিকে দু-এক পলক তাকিয়ে নবীনকুমারের কেমন যেন চেনা চেনা মনে হলো। কিন্তু আগে কোথায় কখন দেখেছে, ঠিক স্মরণে এলো না। সে মেয়েটি অন্যদের মতন ভয় পায়নি, সরাসরি চোখ ফেলেছে নবীনকুমারের দিকে।

নবীনকুমার সরোজিনীর পাশে বসে পড়ে বললো, আমাকে তোমার খেলায় নেবে? ছেলেমেয়ের বে হয়ে গ্যাচে? আমি ভালো ঘটকালি কত্তে পারি!

সরোজিনী বললো, ওমা, ব্যাটাছেলেরা আবার এ খেলা খেলে নাকি? এ তো আমাদের খেলা। ছেলেমেয়ের বে নয়, আমরা সাবিত্তিারি-সত্যবান খেলচি!

মোড়ার ওপর বসা হলুদ-রেশমী শাড়ি পরা মেয়েটি এবার বললো, ওলো সরোজিনী, তোর বর মেয়েও সাজতে পারে! বল না, এক্ষুনি শাড়ি পরে সাজবে!

নবীনকুমার চমকিত হয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো, এবং সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল। এই মেয়েটি ছিল কৃষ্ণভামিনীর মিতেনী। এ প্রায়ই কৃষ্ণভামিনীর সঙ্গে পুতুল খেলতে আসতো। একদিন সত্যিই নবীনকুমার শাড়ি জড়িয়ে নারী সেজে কৌতুক করে ওদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিয়েছিল। কী যেন নাম মেয়েটির!

স্মৃতি ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে নবীনকুমারের মনে খানিকটা ক্রোধেরও উদ্রেক হলো। এই মেয়েটির শ্বশুরালয়ে গিয়ে একদিন অপমানিত হতে হয়েছিল নবীনকুমারকে। সে এক হতচ্ছাড়াদের বাড়ি। কেউ কোনো সহবৎ জানে না, এমন কি ভৃত্যগুলো পর্যন্ত অতি বদ। এই মেয়েটি আবার এ বাড়িতে এসেছে কোন সুবাদে?

নবীনকুমার তাকে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলো, তোমায় তো আগে দেকিচি, তোমার নাম কী য্যানো?

মেয়েটি তার ওষ্ঠে অস্পষ্ট হাসির রেখা এঁকে সামান্য কৌতুক সামান্য বিদ্রুপ মিশিয়ে উত্তর দিল, মনে নেই? এরই মধ্যে ভুলে গ্যাচেন! আমার নাম বনজ্যোৎসা।

অন্য মেয়েরা সকলেই বিস্মিতভাবে তাকালো ঐ মেয়েটির দিকে একজন বললো, ওমা, কুসোমদিদি, তোমার আবার ঐ নাম হলো কবে থেকে?

কৃষ্ণভামিনীর সখী কুসুমকুমারী স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নবীনকুমারের দিকে। নবীনকুমারের একথাও মনে পড়লো যে কুসুমকুমারীর নাম বনজ্যোৎস্না সে-ই রেখেছিল। এর মধ্যে মেয়েটি বেশ বড় হয়ে গেছে। তবু এই বালিকার প্রতি তার মন প্ৰসন্ন হলো না।

সরোজিনী ফিক করে হেসে ফেলে বললো, কুসুম দিদি, তুমি কী করে জানলে আমার বর মেয়ে সাজতে পারেন? সত্যি পারেন কিন্তু, আমি নুকিয়ে নুকিয়ে দেকিচি।

কুসুমকুমারী বললো, ওমা, সে কী কথা! তোর বর মেয়ে সাজেন, আর তুই নুকিয়ে দেকিস? এমন তো কখুনো শুনিনি।

অন্য বালিকারা একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়লো।

সরোজিনী বললো, হাঁগো, উনি বেনারসী শাড়ি পরেন। মায়ের কাছ থেকে সোনার জরি বসানো একটা লাল বেনারসী চেয়ে নিয়েচেন।

অন্য বালিকারা তেমনি হাসতেই লাগলো, আর কুসুমকুমারী হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁ গো মিতেনীর বড় বর, এ সব কী শুনচি? আপনি রোজ লাল বেনারসী পরেন?

কয়েকটি নারী, হোক তারা বালিকা, যদি একজন পুরুষকে ঘিরে ধরে কৌতুক করতে শুরু করে তখন সেই পুরুষের অবস্থা বড়ই শোচনীয় হয়। বহু যুদ্ধে জয়ী বীর পুরুষরাও এ রকম অবস্থায় কাবু হয়ে পড়েন।

নবীনকুমার আফসোস করতে লাগলো, কেন সে এ ঘরে এই সময় এলো। যদি বা এলো, কেনই বা এদের সঙ্গে পুতুল খেলায় যোগ দিতে চাইলো। তার একবার ইচ্ছে হলো, লাথি মেরে সব পুতুলগুলে তছনছ করে দেয়। কিন্তু এই দুষ্ট মেয়েগুলো বুঝি তাতেও হাসবে।

সে রোষকশায়িত নেত্ৰে নিজের স্ত্রী সরোজিনীর দিকে চাইলো। কিন্তু সরোজিনীর এদিকে দৃষ্টিই নেই। ঐ ছোট্ট লাজুক মেয়েটি যে এত কথা বলতে পারে, তাও তো নবীনকুমারের জানা ছিল না।

সরোজিনী বললো, আমাদের বাড়িতে যে থ্যাটার হবে গো। রোজ মওলা হয়। আমি অমনি চুপটি করে দরজার ফাঁক দিয়ে দেকিচি; মা বারণ করিচিলেন, তবু আমি নুকিয়ে নুকিয়ে দোকতে আসি।

একটি মেয়ে সরলভাবে জিজ্ঞেস করলে, থ্যাটার কী ভাই?

সরোজিনী বললো, ঐ যে রামলীলে, কেষ্ট যাত্রা হয়, সেই রকম। তবে পান্তির মাঠ কিংবা ধোপার মাঠে হবে না, আমাদের ঠাকুর দালানে হবে। ম্যারোপ বাঁধা হবে!

কুসুমকুমারী বললে, সাহেবদের যাত্রাকে বলে থিয়েটার! আপনারা বুঝি ইংরজি যাত্রাপালা করবেন?

নবীনকুমার এবার এই সব অবোধ, অশিক্ষিতা বালিকাদের জ্ঞান দান করার জন্য কণ্ঠস্বর গাঢ় করে বললো, শুধু সাহেবরা কেন, আগেকার কালে আমাদের রাজা-মহারাজাদের আমলেও নাটকের অভিনয় হতো। সংস্কৃত নাটক। আমরা সেই রকম নাটকের অভিনয় কচ্চি, তবে বাংলায়। সাহেব-সুবোরাও দেকাতে আসবে।

—পালার নাম কী?

—বেণী সংহার।

—আপনি সে পালায় কী সাজবেন?

এবার নবীনকুমারের বদলে সরোজিনীই বলে দিল, উনি সাজবেন রাজকুমারী ভানুমতী। তাই তো আমন দামী বেনারসী পরে…।

কুসুমকুমারী বললো, সরোজ, তোর বরকে রাজকুমারী সাজলে বেশ ভালোই মানাবে! তা সে নাটক দেকা তো আমাদের কপালে জুটবে না। পুরুষ মানুষরাই দেকবে!

সরোজিনী বললো, না গো দিদি, চিকের আড়ালে বসবে মেয়েরা। মা বলেচেন, আমরা সবাই দেকবো। তোমায় গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে আসবো।

সে কথায় খুব একটা মূল্য না দিয়ে কুসুমকুমারী বললো, দূর, আমার ভাগ্যে ও হবে না।

নবীনকুমার উঠে ঘর ছেড়ে চলে যাবার জন্য উদ্যত হলে কুসুমকুমারী তাকে ডেকে বললো, ও মিতেনীর বর, শুনুন। আপনি ভাবলেন তো, আমি আবার কী করে এলুম? কেউ ডাকেনি। হাংলার মতন এয়েচি! আপনি আমার মিতেনীর খুড়তুতো বোন সরোজকে বিবাহ করেচেন। আমার বোনেরা আবার এই সরোজের মিতেনী। ওরা আসতে চাইলো, তাই আমি নিয়ে এলাম সঙ্গে করে। আপনি তো আমাদের খোঁজ খবর ন্যাননি।

নবীনকুমারের মুখে উত্তর এসে গিয়েছিল যে তোমার লক্ষ্মীছাড়া শ্বশুবাড়িতে কে তোমার খোঁজ নেবে? মাতাল লম্পটদের আখড়া একটা। কৃষ্ণভামিনী বেঁচে থাকলেও নবীনকুমার আর কক্ষনো তাকে ও বাড়িতে যেতে দিত না।

কিন্তু নবীনকুমার চুপ করে রইলো। কুসুমকুমারী বললো, আমার মেয়ের সঙ্গে আপনাদের ছেলের বে হয়েছিল, মনে আচে? তা মেয়ে-জামাইকে তো আমার বাড়িতেই ফেলে রাকলেন, আনবার আর নামটিও করেন না, আমার মিতেনীও চলে গেল।

নবীনকুমার শুষ্কভাবে বললো, আর কী হবে!

কুসুমকুমারী বললো, কেন, এখুন সরোজ এয়েচে, ওর কাচেই পাঠিয়ে দেবো মেয়ে-জামাইকে। আমার মেয়ে এখেনেই সুখে থাকবে। আমিও আর পুতুল খেলি না।

নবীনকুমার কিছু বললো না।

কুসুমকুমারী বললো, আর একটা কতা বলবো? আপনি নাটুকে পালায় রাজকুমারী সাজবেন, আপনাকে মানাবে ভালো। কিন্তু দেকবেন, হাঁটার সময় যেন খেয়াল থাকে।

নবীনকুমার ঠিক বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে গেল। হাঁটার সময় কী খেয়াল থাকবে? তার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কুসুমকুমারী বললো, আমাদের বাড়ির পাশে প্রায়ই কেষ্টযাত্রা হয়। একবার বিদ্যেসুন্দর পালাও হয়েছেল। একটা পানওয়ালা ছোঁড়া রাধা সাজে, আবার বিদ্যেসুন্দরে সে-ই বিদ্যে, কী সুন্দর মানায় তাকে, মাতায় ঘোমটা দিয়ে নাকের নোলক নেড়ে সে যখন গান গায়, তখন কে বলবে যে সে মেয়ে নয়কে, ছেলে। কিন্তু যেই হাঁটে, অমনি কেমন যেন বুক ফুলিয়ে গ্যাট ম্যাট করে, হি-হি-হি, তাই আপনাকেও বলে দিচ্চি…।

নবনীকুমার গম্ভীর।

—আপনি রাগ করলেন? আপনি আমার মিতেনীর বর, আপনার সঙ্গে একটু রঙ্গ করেও কতা বলতে পারবো না?

–মেয়েরা কেমন করে হাঁটে, একটু দেকিয়ে দাও তো!

—সরোজিনীর কাছ থেকে জেনে নেবেন।

—ও তো ছোট, তুমি দেকিয়ে দাও।

—এই মরেচে, বলে বিপদ হলো দেকচি। না, না, আমি পারবো না। নবীনকুমার খপ করে তার হাতটা চেপে ধরে বললো, পারবে না মানে? পারতেই হবে। কুসুমকুমারী বললো, ওমা, এ কি লোক গো! আমায় নিয়ে জোর করে হাঁটাবেন আপনি! রক্ষে করো।

নবীনকুমার বললো, আর ছাড়চি না। মেয়েরা কেমন আলাদা হাঁটে দেকি!

—জোর করে হাঁটালে বুজি কোনো লাভ হবে? রাজকুমারী ভানুমতীকে কি কেউ জোর করে হাঁটাবে?

সরোজিনী উঠে এসে স্বামীকে বললো, আপনি কুসুম দিদিকে ধরে রেকেচেন কেন? ছেড়ে দিন।

নবীনকুমার বললো, এই মেয়েটিকে আগে দেকিচি, মুখ দিয়ে কথাই ফুটতো না। এখুন দিব্যি টরটরিয়ে কতা বলে। কেষ্টযাত্রায় কোন পানিওলা রাধা সাজে, তার সঙ্গে আমার তুলনা!

কুসুমকুমারী অমনি বললো, যদি কিচু অপরাধ করে থাকি, যদি আকতা-কুকতা বলে থাকি, মাপ করবেন। আর কখুনো বলবো না, আর কোনোদিন আসবো না।

নবীনকুমার ধমক দিয়ে বললো, হ্যাঁ, আসতে হবে। আমি নেমন্তন্নর কার্ড পাঠাবো, তোমার স্বামীকে নিয়ে আমাদের প্লে দেকতে আসবে।

—না, নেমুন্তন্ন পাঠাবার দরকার নেই। আমাদের আসা হবে না। আমার বর কোথাও যান না।

—কেন, কোথাও যান না কেন? তিনি কী এমন নবাবপুত্তুর? তোমাদের বাড়ি আমি যেদিন গোসলাম, সেদিনও তিনি আমার সঙ্গে দেকা করেননি।

—তিনি কারুর সঙ্গে দেকা করেন না। তাঁর সঙ্গেই অন্যদের দেকা করতে হয়।

—ও, তাই? তোমার পতি দেবতাটি দেকচি সত্যিই দেবতা।

গভীর সমুদ্রের নির্মল নীল জলের মতন দুটি চক্ষুতারকা নবীনকুমারের দু চোখের ওপর ন্যস্ত করে কুসুমকুমারী বললো, ফের একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে, তাঁকে দেকে যাবেন। তাঁকে লোহার শিকলি দিয়ে বেঁধে রাকতে হয় তো, সেইজন্য তিনি কোতাও যেতে পারেন না।

একটু থেমে নিষ্কম্প অম্লান কণ্ঠে কুসুমকুমারী আবার বললো, তিনি এখন বদ্ধ উন্মাদ, কেউ কাচে গেলে মারেন।

নবীনকুমার থমকে গেল। এমন কিছু শুনতে হবে সে আশা করেনি। এই রকম একটা ফুটফুটে বালিকার স্বামী উন্মাদ! সে রোগের যে চিকিৎসা নেই। হ্যাঁ, এরকম একটা কথা নবীনকুমার আগেও শুনেছিল বটে।

কিছু তো একটা বলতে হবে, তাই অন্য কিছু আর খুঁজে না পেয়ে নবীনকুমার বললো, আহা, তোমার তো খুব দুঃখ!

—বলতে পারেন, জগতে সুখী কে?

 

সেদিন বিদ্যোৎসাহিনী সভায় নবীনকুমার বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগলো। এই সভায় তার অনেক দায়িত্ব। সে সম্পাদক, উদ্বোধনী ভাষণ তাকেই দিতে হয়, সেদিনকার বক্তার পরিচয় এবং বক্তৃতার বিষয়ের সারমর্ম ঘোষণা করাও তার দায়িত্ব। প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ সিকদার প্রমুখ খ্যাতনামা ব্যক্তিরা যেমন এই সভায় আসেন তেমনি আসে কৃষ্ণকমল ভটাচাষ, হরীশ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল ইত্যাদি প্রকৃত উৎসাহী নব্য যুবকেরা। ইংরেজ পণ্ডিত ও শিক্ষকরাও আসেন। সভায় উপস্থিত অভ্যাগত বৃন্দের জন্য ভূরিভোজেরও ব্যবস্থা থাকে, সে দায়িত্ব দুলালের ওপর, নবীনকুমারকেও সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়।

তবু আজ নবীনকুমারের মন ক্ষণে ক্ষণে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কুসুমকুমারীর মুখ। এক সময় নবীনকুমার কিছু না ভেবেই মেয়েটির একটি নাম দিয়েছিল বনজ্যোৎস্না। তখন নবীনকুমার ধারাবাহিকভাবে কালিদাসের নাটক ও কাব্যগুলি পাঠ করছিল, শকুন্তলা নাট্যের ঐ নামটি তার বড় পছন্দ হয়েছিল। কুসুমকুমারীর নীল রঙের চোখের দৃষ্টিতে সত্যিই যেন অরণ্য-জ্যোৎস্নার আভা আছে।

ঐটুকু মেয়ে কেমন শান্ত নিরুত্তাপভাবে বললো, বলতে পারেন, জগতে সুখী কে? এই বয়সেই কুসুমকুমারী দুঃখকে চিনেছে। তার স্বামী বদ্ধ উন্মাদ, তার সামনে পড়ে আছে অনন্ত দুঃখময় জীবন।

সেদিন সভায় কার্ক প্যাট্রিক সাহেব সমাজনীতি ও বিবেকের যুক্তি এই শিরোনামায় একটি ইংরেজি সন্দর্ভ পাঠ করলেন। সেটি নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনার পর প্ৰিয়মাধব বসু নামে আর একজন ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিধবাদের বিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্যে যে আন্দোলন করছেন, তার সমর্থনে বাংলায় বক্তৃতা করতে লাগলেন। নবীনকুমার আজ কথাবার্তাও বিশেষ বলছে না। শেষোক্ত আলোচনা শুনতে শুনতে তার মনে হলো, বিধবাদের পুনর্বিবাহ তো চালু হওয়া উচিত বটেই, কিন্তু কুসুমকুমারীর কী হবে? বদ্ধ উন্মাদরা আর সুস্থ হয় না কোনো ব্যক্তির স্ত্রী যদি বদ্ধ উন্মদিনী হয়, সে ব্যক্তি স্বচ্ছন্দে আর একটি বিবাহ করতে পারে। তাহলে কুসুমকুমারী পারবে না কেন!

নবীনকুমার নিজে এক সময় সচেতন হলো। এ সব কী উৎকট চিন্তা তার মাথায় ঢুকছে। বিদ্যাসাগর পণ্ডিত বিধবাদের মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করতে চাইছেন বলে কি দেশটা একেবারে বিলাত হয়ে যাবে নাকি! উন্মাদ হোক আর কুষ্ঠরোগগ্ৰস্ত হোক, হিন্দু নারীর স্বামীই একমাত্র অবলম্বন। পরাশরের নষ্টে মৃতে প্ৰব্ৰজিতে ইত্যাদি শ্লোকের মধ্যে উন্মাদ বিষয়ে কিছু নেই। কুসুমকুমারীকে সারাজীবন ঐ উন্মাদ স্বামীর সঙ্গেই থাকতে হবে। তবু তার ঐ কথাটা কানে বাজে, বলতে পারেন, জগতে সুখী কে?

সভা যখন শেষ হয়ে এসেছে, সেই সময় নবীনকুমার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মান্যবরগণ, আমি একটি নিবেদন রাখিতে চাই।

সকলে উৎকৰ্ণ হলো। নবীনকুমারের প্রস্তাবটি এই যে, বাংলাভাষার উন্নতিকল্পে বিদ্যাৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে জনসাধারণের মধ্যে প্ৰবন্ধ প্ৰতিযোগিতার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? কোন একটি বিষয় ঘোষণা করে দেওয়া হবে। সেই বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ প্ৰবন্ধ লেখককে পুরস্কার দেওয়া হবে কিছু টাকা। এর ফলে শিক্ষিত লোকে বাংলাভাষায় লিখতে আগ্রহী হবে।

সকলেই এ প্ৰস্তাব সমর্থন করলেন। নবীনকুমার জানালো যে তবে আজই একটি প্রতিযোগিতা ঘোষণা করা হোক। শ্রেষ্ঠ প্ৰবন্ধ লেখককে সে নিজে দুই শত টাকা পুরস্কার দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

প্ৰবন্ধ প্ৰতিযোগিতার বিষয়টি কী হবে?

এক মুহুৰ্তও চিন্তা না করে নবীনকুমার বললো, বিষয়টি হোক, এ জগতে সুখী কে?

সভার শেষ প্রান্ত থেকে দীর্ঘকায়, খড়্গনাশা এক প্রৌঢ় উঠে দাঁড়িয়ে বললো, সাধু! সাধু! এ অতি উত্তম প্রস্তাব। আর বিষয়টিও বড় উপযুক্ত। এ জগতে সুখী কে? এ বড় গূঢ় কতা।

এই ব্যক্তিটি রাইমোহন। তার চেহারা ও বেশবাসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর সে কুঁচোনো ধুতির কোঁচার ডগার মুখটি হাতে ধরে থাকে না, গায়ে দেয় না এণ্ডির বেনিয়ান, চোখে নেই সুর্মা, হাতে নেই গোড়ের মালা। তাকে দেখলে আর সেই আগেকার বেশ্যাবাড়ির নিশাচর বলে চেনা যায় না। তার চেহারা ও পোশাক এখন বিদ্বজন সমাগমে যোগ দেবার উপযুক্ত, মাথার বাবরি চুল ছোট তেল চুকচুক করে আচড়ানো, কাঁধে চাদর।

গুরুগভীর বক্তৃতা শোনার জন্য রাইমোহন এখন নিয়মিত এসে বসে থাকে। তাছাড়া সে এখানে তার উপস্থিতির কিছুটা গুরুত্বও আদায় করে নিয়েছে। বিদ্যোৎসাহী সমিতি থেকে যে নাটক অভিনয়ের মহলা চলছে, সেই বেণীসংহার নাটকে কয়েকটি গীত সংযোজন করার কথা উঠেছিল। রাইমোহনই সেজন্য তিনটি গান রচনা করে সুরও দিয়েছে। সে গান প্ৰশংসা পেয়েছে সকলের।

রাইমোহন এগিয়ে এসে নবীনকুমারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, বড় উত্তম প্রস্তাব দিয়েছেন আপনি! আপনার দ্বারা এ দেশের মহদোপকার হবে। দুশো টাকা পুরস্কার! এ আপনার স্বৰ্গত পিতার উপযুক্ত পুত্রের মতনই হয়েচে বটে! সাধু সাধু!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়