সোহাগবালার ব্যাধিটি বড় বিচিত্র। মানুষের স্থূলত্বেরও তো একটা সীমা আছে, কিন্তু সোহাগবালার ক্ষেত্রে সব কিছুই সীমা ছাড়িয়ে গেল। প্রত্যেকদিনই সে বেশী মোটা হচ্ছে। যৌবনে সোহাগবালা অসুন্দরী ছিল না, বরং ফর্সা, চোখ, নাক, ঠোঁট সবই গোল গোল, কিন্তু তার স্বামীর প্রতিপত্তি বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন তার শরীর স্থূল হতে লাগলো। একটা বয়েসের পর মানুষ আর দৈর্ঘ্যে বাড়ে না, কিন্তু সোহাগবালার প্রস্থ বাড়তে লাগলো অস্বাভাবিকভাবে। তার এক একখানি হাতই যেন একজন মানুষের শরীরের সমান, বক্ষের ওপর দুটি দোদুল্যমান অলাবু। তার পা দেখে এক সময় মনে হতো ভীমের গদা, এখন মনে হয়, ভীমও বুঝি এত বড় গদা তুলতে পারতেন না। মোটা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশী ফর্সাও হচ্ছে সে, রং একেবারে ফেটে পড়ছে।

দুখানি শাড়ি একসঙ্গে জোড়া দিয়েও তার শরীরের ঘের পায় না। তার নিতম্ব এতই বড় যে হস্তিনী বললেও কম বলা হয়। শরীরে বস্ত্ৰও সে রাখতে পারে না, সব সময় তার অসম্ভব গরম বোধ হয়, এক এক সময় জ্বলে গেল, অঙ্গ জ্বলে গেল গো, বলে চেঁচায়। দিবাকর তার স্ত্রীর চিকিৎসার কম চেষ্টা করেনি, কিন্তু ডাক্তার বদ্যি কেউ তার রোগ ধরতে পারলে না। নিরাময় করা তো দূরস্থান।

কিছুদিন আগেও সোহাগবালাকে দুজন দাসী দুদিক থেকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে দরদালানে একটি জলচৌকির ওপর বসিয়ে দিত। সেখানে বসে বসে সোহাগবালা চালাতো তার রাজ্যপাট, এ গৃহের সব দাস-সাদীই তার অধীনে। ঘি-তেল, চাল-ডাল থেকে শুরু করে মাছের মুড়োর হিসেব পর্যন্ত তার নখদর্পণে।

তারপর এক সময় সোহাগবালার চলৎশক্তিও নষ্ট হয়ে গেল। তার উরুদ্বয়ের মধ্যে আর ব্যবধান রইলো না, হাঁটতে গেলেই উরুতে উরুতে ঘর্ষণ হয়, চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে যায় পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত সোহাগবালাকে স্থায়ীভাবে শয্যা নিতে হলো। পালঙ্কের ওপর শুয়ে থাকে যেন একটি জীবন্ত মাংসের পাহাড়।

সব দাস-দাসীরাই পালা করে সোহাগবালার সেবা করে, তাদের মধ্যে থাকোমণির স্থান একটু বিশেষ ধরনের। থাকোমণি আসে রাত্রে এবং তাকে সেবা করতে হয় সোহাগবালা আর দিবাকর, দুজনকেই।

দিবাকরের বয়েস এখন ষাট পেরিয়ে গেছে। তবু তার শরীরের ক্ষুধা একটুও মরেনি। চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে সোহাগবালা এখন যেন শিশুর মতন অবুঝ হয়ে গেছে। দিবাকরকে সে সব সময় চোখে চোখে রাখতে চায়। তাই এখন আর চক্ষুলজ্জার বালাই নেই, ঐ এক পালঙ্কেই দিবাকর আর সোহাগবালার মাঝখানে থাকোমণিকে মাঝে মাঝে শুতে হয়। দিবাকর যখন থাকোমণিকে সবলে আঁকড়ে ধরে তখন সোহাগবালা তার বিরাট চক্ষু দুটি মেলে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে। থাকোমণি যথোচিতভাবে দিবাকরের সেবা করার পর উঠে যাবার সময় সোহাগবালা তাকে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ, লা, ঠিক মতোন যত্ন করিচিস তো? আগে চান করে এয়েচিস? গায়ে পা-টা ঠেকে গ্যাচে, নে, বাবুর পায়ের ধুলো নে, তারপর যা, আবার চান করে আয়।

তারপর সে ব্যাকুলভাবে স্বামীকে প্রশ্ন করে, হ্যাগা, তোমার শরীল গতিক ভালো আচে? মাতার ধাতু ঠাণ্ডা হয়েচে? তোমার সুক হয়েচে, বলো না? তোমার সুকের জন্য তুমি যা চাও–আহা, সিঁথের সিঁদুর নিয়ে যেন আমি যেতে পারি, তোমার মতন পতি পেয়িচি, আমার কতবড় ভাগ্যি…

বলতে বলতেই সোহাগবালা কাঁদতে শুরু করে।

সোহাগবালার মৃত্যুর পর চারজনে তার খাট বয়ে নিয়ে যেতে পারলো না, বড় খাট বানিয়ে তার তলার দিকে বাঁশ বেঁধে দশজন শববাহককে কাঁধ দিতে হলো। বড় সুখের ভাগ্য নিয়েই মরলো সোহাগবালা, তার মুমূর্ষুদশার খবর পেয়ে এ বাড়ির কর্ত্রী স্বয়ং বিম্ববতী এসেছিলেন তাকে দেখতে। গত আট-দশ বছরের মধ্যে ওপরতলার বাবুদের কেউ ভৃত্য মহলে আসেননি। বিম্ববতী তার ঠোঁটে কয়েক ফোঁটা গঙ্গাজল দিয়ে বলেছিলেন, আহা সতী লক্ষ্মী, ও ঠিক স্বগ্যে যাবে!

তিনি নিজের একটি বহুমূল্য গরদের শাড়ি দিলেন মৃতদেহ ঢেকে নিয়ে যাবার জন্য।

সোহাগবালার মৃত্যুর পর দরদালানের শূন্য চৌকিতে থাকোমণি বসতে লাগলো। এ ব্যাপারে কেউ কোনো প্রশ্ন পর্যন্ত তুললো না। সোহাগবালার স্থান যে থাকোমণি গ্রহণ করবে, এ যেন স্বতঃসিদ্ধ। থাকোমণি শুধু যে দিবাকরের নেকনজরে আছে, তাই তো নয়, তার ছেলে দুলালচন্দ্র এ বাড়ির ছোটবাবুর পেয়ারের ভৃত্য। না, ভৃত্য বলা ভুল হলো, দুলালচন্দ্রের স্থান ভৃত্যের চেয়ে কিছুটা উঁচুতে, সে ছোটবাবুর সর্বক্ষণের সঙ্গী। সে কিছুটা লেখাপড়াও জানে এবং সে ভৃত্য মহলে থাকে না।

থাকোমণির যৌবনও এখন পশ্চিমগগনে হেলতে শুরু করেছে, শরীর কিছুটা ভার-ভাত্তিক হয়েছে। কোন শেকর-বাকড় বেটে খেলে গর্ভনাশ হয় কিংবা কোনো মূর্খ্য দাসী পাঁচ মাসের পোয়াতী হয়ে গেলে কোন দেয়াসিনীর কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য ওষুধ আনাতে হয়, তাও সে সব জানে। কোনো অল্প বয়সিনী সোমখ দাসী কাজে ভর্তি হলে তাকেও সে দু-একবার দিবাকরের কাছে পাঠায় সেবার জন্য।

তিন বৎসর আগে থাকোমণি দুলালচন্দ্রের বিবাহ দিয়েছে। কিন্তু ছেলে-বউ নিয়ে ঘর করার সুখ তার কপালে নেই। ইদানীং দুলালচন্দ্র তার মাকে আর গ্রাহ্য করে না। মায়ের দিকে সে ঘৃণার চক্ষে তাকায় এবং তার মা যে একজন সামান্য দাসী, এই পরিচয় দিতে সে লজ্জা পায়। নবীনকুমারকে যখন একজন সাহেব শিক্ষক পড়াতো, তখন সাহেবকে যাতে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে না হয় সেইজন্য বাগানে একটি পাকা, সুদৃশ্য পড়ার ঘর নির্মিত হয়েছিল। সেই ঘরটি এখন দুলালচন্দ্ৰকে দেওয়া হয়েছে, সেখানে সে সস্ত্রীক থাকে। আর দুলালচন্দ্রের বউটিও বড় আদুরী, শাশুড়ির যত্ন করার কথা সে একবার মনেও ভাবে না, সব সময় সেজোগুঁজে পটের বিবিটি হয়ে বাগানে নেচে বেড়ায়। সম্প্রতি তার একটি পুত্ৰ সন্তান হয়েছে।

থাকোমণি ছেলের ব্যবহারে আঘাত পায়, কখনো একলা থাকলে সে আপন মনে গজগজ করে। অবজ্ঞায় ওষ্ঠ উল্টে সে বাতাসকে শুনিয়ে বলে, ছেলে আমায় না দোকলে তো বয়েই গেল! ও ছেলে আমায় খাওয়াবে, না পরাবে? ভারী আমি তার তোয়াক্কা করি! আমার নিজের পায়ে ডাঁড়াবার ক্ষ্যামতা আছে, আমি কারুর হাত তোলা নই! কতায় বলে, কড়ি ফটকা চিঁড়ে দই, বন্ধু নহি কড়ি বই, কড়িতে বাঘের দুগ্ধ মেলে।

তা হাতে এখন বেশ কিছু টাকা কড়ি জমেছে থাকোমণির। মাস মাইনে তিন টাকা থেকে ছ টাকায় উঠেছে, সে টাকার তো এক পাইও খরচা হয় না। তাছাড়া, সোহাগবালার স্থান গ্ৰহণ করায় এখন উপরি রোজগারও যথেষ্ট। না চাইলেও অনেকে তাকে দস্তুরি দেয়। যে-রাখালটা দুধ দেয়, সে কিছুটা দুধ গোপনে বাইরে বিক্রি করে, তার কিছুটা হিস্যা সে থাকোমণিকে দিয়ে যায়। নকুড় বাজার সরকার, সে প্রতিদিন থাকোমণিকে দেয় এক সিকি। এমনকি দুটি জুড়ি গাড়ির চারটি ঘোড়ার ছোলা-দানাও যায়। এখানকার ভাঁড়ার থেকে। সহিসরা সেই ছোলা-দানাও কিছুটা বাইরে বিক্রি করে এবং তারও কিছুটা ভাগ স্বেচ্ছায় তারা দেয় থাকে।মণিকে। ঘি, তেল, মশলা সবই ফেরিওয়ালারা দিয়ে যায় বাড়িতে, আগে ওদের কাছ থেকে বাখরা আদায় করতো দিবাকর। আজকাল আর সে এই সব ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না, ওসবও এখন থাকোমণির ভাগে।

নকুড় ছিল বেশ কিছুদিন থাকোমণির আরেক নাগর। কিন্তু সে লোকটি এমনই অলপ্লেয়ে যে মিছে কথা বলায় তার জুড়ি নেই। নকুড়ের দেশ-ঘরে বিয়ে করা বউ ও ছেলে-মেয়ে আছে। মাঝে মাঝে সে ছুটি নিয়ে সেখানে যায়। এবার সে ঘুরে এসে বলেছিল, তার বউয়ের ক্ষয়কাশ হয়েছে, আর বেশীদিন আয়ু নেই। সেই বউটা মরলে নকুড় থাকে।মণিকেই বউ সাজিয়ে তার দেশের বাড়িতে রেখে আসবে। সেখানে নকুড়ের বড় সংসার, দেখাশুনোর জন্য থাকোমণির মতন একজন মানুষ চাই, নকুড় তো আর এখানকার এত রোজগার ছেড়ে সারা বছর দেশে পড়ে থাকতে পারবে না।

তা সে বউটাও মরলো, নকুড়ও সব কিছু ভুলে গিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইলো। এখন সে দিবাকরের আরেক উচ্ছিষ্ট কচি বয়েসের দাসীকে নিয়ে মেতে আছে। তা থাক, তাতে থাকোমণির এখন আর কিছু যায় আসে না। তার যৌবন চলে যেতে বসেছে, এখন পুরুষ মানুষরা তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবেই, এটা সে জেনে গেছে। তবে নকুড় যদি তাকে দু-একদিন সিকি দিতে ভুলে যায়, অমনি সে ক্যাঁক করে চেপে ধরে।

গলা খরখারিয়ে সে বলে, অ্যাই নেকড়ো, আজ কত মাছ এনিচিস দেকি? এই তোর দশ সেরা? কাকে বুজোচ্চিস, আমি কানা? দেকি, পাল্লায় চাপা, পাল্লায় চাপা হারামজাদা মিন্সে। কতায় বলে, অতি বাড় বেড়োনাকো ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি ঝাড় হয়ো নাকে ছাগলে মুড়োবে! বেশী নোলা হয়েচে, তাই না?

সোহাগবালার কাছ থেকে অবিকল এই সব কথাগুলি মুখস্থ করে রেখেছে থাকোমণি, যথাস্থানে ব্যবহার করে।

এই সব কথাতেও কাজ না হলে থাকোমণি চোখ রাঙিয়ে বলে, দ্যাক নেকড়ো, ফের যদি আমার সঙ্গে ফেরেববাজি কত্তে আসবি তো ছোটবাবুর কানে কতা তুলে দেবো!

চোখ রাঙিয়ে পীরিত আদায় করা যায় না, কিন্তু চুরির ভাগ আদায় করা যায়।

তাছাড়া, থাকোমণির হাতে আছে। এই তুরুপের তাশ। সকলে জানে যে থাকোমণি ইচ্ছে করলেই দিবাকরকে এড়িয়ে তার পুত্র মারফত এ বাড়ির ছোট কতরি কাছে নালিশ জানাতে পারে। আর ছোট কতা তো দুলালের কথায় ওঠেন বসেন। আর কিছুদিনের মধ্যে দুলালই যে দিবাকরের জায়গা দখল করে নেবে, তাতে কারুর কোনো সন্দেহ নেই। থাকোমণির ছেলে তার মাকে ভক্তি ছেদা করে কি না, সে খবর তো সবাই রাখে না।

স্বগ্রামে দিবাকরের বিশেষ প্রতিষ্ঠা আছে। এতকাল সিংহবাড়িতে গোমস্তাগিরি করে সেই টাকায় সে নিজে বাড়ি বানিয়েছে, জমি কিনেছে, পুকুর কাটিয়েছে, মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। এখন চাকরি গেলেও তার কিছু যায় আসে না, কলকাতা ছেড়ে নিজের বাড়িতে গিয়ে বুড়ো বয়েসটায় বহাল তবিয়তে পায়ের ওপর পা তুলে থাকবে। দিবাকর চাঁছাছোলা ধরনের মানুষ। থাকোমণিকে সে কখনো কোনো মিথ্যে আশ্বাস দেয়নি, এমন কি শয্যাসঙ্গিনীকে সে কখনো কোনো নরম আদরের বাক্যও বলে না। থাকোমণি তার সেবাদাসী, ব্যস, সেইটুকুই তার পরিচয়। যখন দিবাকরের কোনো প্রয়োজন থাকবে না, তখন থাকে।মণির আর কোনো স্থান নেই তার জীবনে। থাকোমণি একদিন মাত্র ভীরু কণ্ঠে দাবি জানিয়েছিল যে দিবাকর যখন দেশের বাড়িতে যায়, তখন একবার কি সে থাকোমণিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারে না? এর উত্তরে সে প্রচণ্ড দাবড়ি খেয়েছিল দিবাকরের কাছ থেকে।

থাকোমণির টাকা-কড়ি সব তার বিছানার নীচে। মাঝে মাঝে সে রাত্তিরবেলা পিদিম জ্বেলে গুনতে বসে। বারবার গুনেও আশ মেটে না। এক সময় সে গুনতেই জানতো না, স্বামী ও পুত্ৰ-কন্যার হাত ধরে যখন সে এই শহরে আসে তখন দুই আর দুইয়ে কত হয়, সে ধারণাও ছিল না। তার। সে সব কতকাল আগেকার কথা। সে সব দিনের কথা আর থাকোমণির মনেই পড়ে না প্ৰায়, কেমন যেন আবছা স্বপ্নের মতন। দুপাশে দুটি তাল গাছের মাঝখানে ছিল তাদের মাটি লেপা, খড়ের চালে ছাওয়া বাড়ি, একদিন জমিদারের নায়েব এসে সে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিল। স্বপ্নের মধ্যে সেই আগুনও এখন নিবে গেছে।

এখন থাকোমণি গোনাগুনতিতে চৌকোশ। গোনে আর ভাবে, এত টাকা! এই টাকা তাকে যক্ষের মতন আগলাতে হবে।

টাকার ওপর শুয়ে শুয়ে থাকোমণি আজকাল একটি নতুন স্বপ্ন দেখে।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় দিবাকর যেখানে বাড়ি বানিয়েছে, পুকুর কেটেছে, ঠিক সেই গ্রামে কিংবা তার পাশের গ্রামে থাকোমণিও একটা বাড়ি বানাতে পারে না? বাড়ি, পুকুর, চাষের জমি-! যদিও এখনো পুরোপুরি দেয়নি, কিন্তু থাকোমণি জানে, আর কিছুদিন পর দিবাকর তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। সে নিজে থেকে গায়ে-পড়া হতে গেলেও সে তাকে ছুঁতে চাইবে না। এ বাড়ির বয়স্ক দাসীদের কী অবস্থা হয় তা তো এই কবছরে থাকোমণি কম দেখেনি। গতরের জোর কমে গেলেই যেন একটা যাই যাই রব উঠে যায়। আর সকলে নানা ছুতোয় গলাধাক্কা দিতে শুরু করে, অন্যে জিনিস ভাঙলেও দোষ হয় তার। অন্য কেউ চুরি করলেও তাকেই চোর অপবাদ নিতে হয়। তারপর একদিন কাঁদতে কাঁদতে বিদায় গ্রহণ। বাড়ির কর্তাদের কাছে করুণা ভিক্ষা করেও কোনো লাভ নেই, তাদের কাছে পৌঁছোনোই যায় না, তা ছাড়া দাস-দাসীদের নিয়োগ বা বিতাড়নের ভার সম্পূর্ণত দিবাকরের ওপর। কর্তারা এ নিয়ে মাথা ঘামান না, কেউ কখনো কিছু বলতে গেলে বিরক্ত হন। ঠিক মতন কাজ না পেলে কর্তারা দিবাকরের কাছেই জবাবদিহি চাইবেন।

অনেক বৃদ্ধা দাসীকে ছেড়া কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে নিঃসম্বল অবস্থায় চলে যেতে দেখেছে থাকোমণি। কোথায় যায়। তারা? গো-ভাগাড়ের মতন কোথাও কি মানুষ-ভাগাড় আছে!

থাকোমণি নিঃসম্বল নয়, তার যথেষ্ট টাকা আছে, কিন্তু একলা মেয়েমানুষ হয়ে সে এই টাকা নিয়েই বা কী করবে? একটু হাত-আলগা দিলেই লুটপুটে খাবে পাঁচ ভূতে। কিছুদিন আগেও তার সব সাধ-আহ্লাদ ছিল ছেলেকে ঘিরে। সেই ছেলে এখন পর হয়ে গেছে, সে এখন কত ব্যস্ত। তবু তন্দ্রার মধ্যে থাকোমণি মনশ্চক্ষে সেই অদেখা জায়গার অনির্মিত নতুন বাড়িটির ছবি তৈরি করে নেয়। নিকোনো অঙ্গন ছোট বাড়ি, বার্তাবি লেবুর গাছ, সেখানে ছোট বয়েসী দুলাল ধুলো মেখে খেলা করছে…

গঙ্গানারায়ণ নিরুদ্দিষ্ট হবার পর বেশ কিছুদিন এ গৃহ নিঝুম হয়ে ছিল। এখন আবার সরগরম। নবীনকুমারের দ্বিতীয় বিবাহের পর তার পত্নীর পিত্ৰালয়ের লোকজন সর্বক্ষণ আসে। তা ছাড়া প্রতি শনিবার অপরাহ্নে বিদ্বজন সমাগম হয়। সিংহ সদনের সামনে সার বেঁধে দাঁড়ায় জুড়িগড়ি, হুম হাম করে পালকি বেহারারা অনবরত এসে পালকি নামায়। মজলিশ কক্ষ গমগম করে। দেশোন্নিতি ও সমাজ সংস্কার বিষয়ে কত ভাবগৰ্ভ বক্তৃত হয়। তার সামান্যতম ঢেউও এসে পৌঁছোয় না ভৃত্য মহলে। তারা শুধু জানে, প্রতি শনিবার ছোটবাবুর কাছে তাঁর ইয়ারবক্সীরা আসেন, তাঁদের জন্য প্রচুর খাবার পাঠাতে হবে। বাড়িতে বেশী জনসমাগম হলে দাস-দাসীরা খুশী হয়। বেশী মানুষ মানেই বেশী খাবার। আর তার থেকে রাই কুড়োতে কুড়োতে বেল হয়ে যায়।

 

দুপুরের দিকে যখন হাতে বিশেষ কাজ থাকে না, তখন থাকোমণি এক পা এক পা করে বাগানের মধ্যে তার ছেলের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অধিকাংশ দিনই দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকে।  থাকোমণি তখন ডাকে, আ বউমা, আমার বাপধন ঘুমিয়ে আছে নাকি? অ বউমা! একবার দুয়োরটা খোলো, আ বউমা!

দুলালচন্দ্রের পত্নী সুবালা অনিচ্ছার সঙ্গে দরজা খোলে। দুপুরের নিদ্রাটি তার বড় প্ৰিয়। রাতে তাকে বারবার জগতে হয়, ছেলে কখন কেঁদে ওঠে কিংবা বিছানা নোংরা করে, তার ঠিক নেই, আবার দুপুরের ঘুমটাও যদি শাশুড়ি এসে ভেঙে দেয়, তাহলে কি মেজাজ ঠিক থাকে। বউ যদি জেনে যায় যে তার স্বামীই তার মাকে তাচ্ছিল্য করে, তবে সে তো আরও বেশী করে করবেই।

শাশুড়িকে ভেতরে আহ্বান না জানিয়ে দরজার দুপাশে হাত রেখে সে বলে, কী? খোকা তো এখুন ঘুমুচ্চে! এই অনেক কষ্টে ঘুম পাড়ালুম।

—তবু একবার চোকে দেকে যাই। বাপধনকে একবার না দেকালে শান্তি হয় না।

—আপনি অন্য সময় আসতে পারেন না? খোকা এতক্ষণ খেলছেল।

—সকাল থেকে কি আমার চোকের পাতা ফেলার সময় থাকে। এই তো বিকেল পড়তে না পড়তেই মশলা বাটা শুরু হবে। আবার, বাতিগুনোয় তেল ঢালতে হবে, লুচির ময়দা মেপে দিতে হবে।

দুলালচন্দ্র এই সময় প্রায় কোনোদিন থাকে না জেনেও থাকোমণি জিজ্ঞেস করে, দুলাল কোথায়?

—ছোটবাবুর সঙ্গে বেরিয়েচে।

এমনও হয়, পর পর তিন চার দিন দুলালকে এক পলকও দেখতে পায় না থাকোমণি, তবু এখানে এসে একবার ছেলের খোঁজ নিয়ে যাওয়া চাই।

থাকোমণি সুবালার মুখের দিকেও আজকাল অবাক হয়ে তাকায়। সুবালার বয়েস চোদ্দ, তার বাপ একজন ছুতোর মিস্তিরি। বিয়ের সময় নাকে নোলক পরা ভীতু ভীতু মুখ বউটি হয়ে সে এসেছিল। এখন তার নোলক নেই। সে নিয়মিত শরীর মাজা-ঘষা করে আর এমনভাবে ফেরত দিয়ে শাড়ি পরে যে তাকে ঠিক বাবুদের ঘরের মেয়েমানুষদের মতন দেখায়। এই থাকোমণির পুত্রবধূ, একে যে তারই সমীহ করতে ইচ্ছে করে।

সুবালা দরজার পাল্লা থেকে একটা হাত সরালে থাকোমণি ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঘুমন্ত নাতির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন যেন মুগ্ধতা ঝরে পড়ে তার চোখ মুখ দিয়ে। সে বলে, আহা হা, আমার বাপধন, কী সোন্দর, ঠিক চাঁদের পারা মুখখানি, চোখ দুটো দেকেচো বউমা, ঠিক দুলালের মতন…।

মনের ভুলে নাতিকে সেই সময় কোলে তুলে নিতে গেলে সুবালা হা-হ করে ওঠে। ও মা, ও কী কচ্চেন! এক্ষুনি জেগে যাবে, আর অমনি চাঁচাবে! কাঁচা ঘুম ভাঙলেই এমন চাঁচায়!

অপরাধীর মতন মুখ করে হাত সরিয়ে নেয় থাকোমণি। ঘুম ভেঙে গেলে সে বুঝি আবার ঘুম পাড়াতে জানে না? সে বুঝি ছেলেমেয়ে মানুষ করেনি? যত আদিখ্যেতা!

একটু গম্ভীরভাবে সে বলে, বুকের ওপর হাত দিয়ে আচে, হাত দুটো পাশে নামিয়ে দাও, বউমা। ব্যাটাছেলেমানুষের বুকে হাত দিয়ে ঘুমুতে নেই, তাতে ইছলি বিছলি স্বপ্ন দেকার অভ্যেস হয়।

পুত্রবধুর সন্তান হবার সময় থাকোমণি বড় আশা করে ছিল রাত্রে সে তার নাতিকে কোলের কাছে নিয়ে ঘুমোবে। সে আশা তার বৃথা গেছে। সুবালা এক মুহূর্তের জন্য ছেলেকে কাছছাড়া করতে চায় না।

দৈবাৎ দু-একটা দুপুরে দুলালচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় থাকোমণির। মায়ের সঙ্গে দেখা হলেই দুলাল মুখখানায় রাগ রাগ ভাব ফুটিয়ে থাকে, ভালো করে কথাই বলতে চায় না। থাকোমণির যেন বুক ফেটে যায়। তার খুব ইচ্ছে করে, দুলালের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুই কেমন আচিস, দুলে? ওরে, তোর জন্যে যে আমার মন পোড়ে, তুই বুঝিস না?

কিন্তু এসব বলা হয় না। মাকে দেখলেই দুলাল সটান গিয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বোজে। মনে হয় যেন ইচ্ছে করে নাক ডাকে।

থাকোমণি মনে মনে কাতরভাবে বলে, ওরে, আমার ওপর তোর এত রাগ কেন? আমি কী দোষ করিচি তোর কাচে? যদি কিছু পাপ করে থাকি, সে তো তোরই জন্যে। তুই যখন ছোটটি ছিলিস, তখন তুই যাতে ভালো থাকিস, তুই যাতে ভালো করে খেতে পরতে পাস, সেই জন্যই তো আমি…।

একদিন থাকোমণি দুপুরে দুলালকে সদ্য বাড়ি ঢুকতে দেখে তার মুখোমুখি গিয়ে বললে, অ দুলে, তোর সঙ্গে আমার কটা কতা আচে।

দুলাল অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে গম্ভীরভাবে বললো, কী?

—বলচি কী, ভালো করে বোস না, আ বউমা, তুমিও এসো, তুমিও শোনো।

দুলাল মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, কী বলবে, জলদি বলে। আমায় একটু বাদেই আবার ছোটবাবুর সঙ্গে বেরুতে হবে।

থাকোমণি খুশীর সংবাদ দেবার মতন উদ্ভাসিত মুখে বললো, বলচি কী, আমার হাতে বেশ কিচু ট্যাক জমেচে। সেই ট্যাক দিয়ে কোনো গাঁয়ে গিয়ে একটা ছোটখাটো বাড়ি কিনলে হয় না?

দুলাল বললো, গাঁয়ে বাড়ি কিনবে? কেন, কী হবে?

—বাঃ, আমাদের একটা নিজের বাড়ি থাকবে না? সারা জেবন পরের বাড়ি কাটাবো?

–গাঁয়ের বাড়ি কিনবে, সেখানে থাকবে কে?

—কেন, আমরাই সবাই মিলে থাকবো!

—গাঁয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকবো? আর খাবোটা কী? লবডংকা?

—বলচি, বলচি, একটু মন দিয়ে শোন! আমার যা ট্যাকা আচে, তা দিয়ে একটা ছোট বাড়ি আর কয়েক বিঘে ধান জমিও কেনা যায়। আর একটা পুকুর। জমিতে চাষবাস করলেই তো আমাদের খাওয়া পরা চলে যাবে। সেই ভালো না? কতকাল আর পরের বাড়িতে খেটে খেটে মরবো। আমাদের কেনা নিজের বাড়ি হবে, আমি আর বউমা বাড়ির কাজ দেকবো সব, আর তুই জমিতে…।

দু, চোখে দারুণ বিরক্তি ফুটিয়ে এবং ধমক দিয়ে দুলাল বললো, আমি মাঠে গিয়ে হাল ঠেলবো? তোমার মাতা একদম খারাপ হয়ে গ্যাচে নাকি? এখেনে আমরা কী কষ্টে আচি যে গাঁয়ে গিয়ে চাষাভুষো সাজতে হবে? আমায় ছাড়া ছোটবাবুর এক পা চলে না… হেঃ! পাগলের মতন কতা। কলকাতা শহর ছেড়ে গাঁয়ে যাবো হেদিয়ে মত্তে! তোমার ইচ্ছে হয়, তুমি যাও!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়