হাওড়া পেরিয়ে আমাদের জিপটা বম্বে রোডে পড়ল প্রায় বেলা এগারোটায়। নিলয়দা নিজেই জিপ চালাচ্ছে। অনেক ভেবেচিন্তেই আমরা ড্রাইভার নিইনি।

কাল অনেক রাত পর্যন্ত নিলয়দা আর আমি এই পরিকল্পনাটা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের ইচ্ছে ছিল খুব ভোরবেলা বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু জিপটা ভাড়া করার পর দেখা গেল গিয়ারে একটু গোলমাল আছে। এর চেয়ে ভাল জিপ পাওয়া গেল না, এটাকেই সারিয়ে, ট্রায়াল দিয়ে নিতে হল। নিলয়দা সকালে যতক্ষণ জিপটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল, সেই সময় আমাকে একবার যেতে হয়েছিল স্বর্ণদের বাড়িতে।

রূপাবৌদি কাল রাত্তিরে ও-বাড়িতে আসেনি। তার জন্য অবশ্য দুচিন্তার কিছু নেই। রূপাবউদি ছেলেমানুষ নয়, পাপুনকে নিয়ে যখন গেছে, তখন কোথাও হারিয়ে যাবে না। পাছে এ-বাড়িতে ওর খোঁজ করতে আসি, সেই জন্য অন্য কোনও বন্ধু-টন্ধুর বাড়িতে চলে গেছে নিশ্চয়ই। সকালেও রাগ পড়েনি। আমি স্বর্ণকে বাড়ির চাবি দিয়ে বললাম, আমরা দু’দিনের জন্য কলকাতার বাইরে যাচ্ছি, পুরুলিয়ার একটা হাসপাতালে ভোলানাথকে রেখে আসব। রূপাবউদিকে বোলো, ভোলানাথ আর কোনও দিন ওবাড়িতে আসবেনা। নিলয়দা এই শেষবারের মতো রূপাবউদিকে ক্ষমা করতে বলেছে।

আমরা গাড়িতে যাব শুনে স্বর্ণ আরদার ধরল, তাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। তাকে বোঝানো মহা মুশকিল। বাঘ, ছাগল আর পানের একটা ধাঁধা আছে না, যাতে কিছুতেই ওদের এক সঙ্গে এক নৌকোয় নিয়ে যাওয়া যায় না? স্বর্ণকে দেখলে ভোলানাথের ক্ষেপে ওঠার ব্যাপার তো আছেই, তাছাড়া স্বর্ণ যদি আমার পাশে বসে অবিরল ওয়াটারপ্রুফের বাড়ির ছেলেটির কথা বলে যায়, তাহলে আমিই বোধহয় পাগল হয়ে যাব।

স্বর্ণর কাছ থেকে প্রায় পালিয়েই আসতে হয়েছে আমাকে।

নিলয়দার পাশে বসেছি আমি। পেছনের লম্বা সিটে কাত হয়ে শুয়ে আছে ভোলানাথ। মাঝ মাঝে আপন মনে কথা বলছে। কাল ও সর্বক্ষণ বাবা, বাবা করছিল। আজ আবার মাঝে মাঝেই মাধুরী বলে কারুর নাম উচ্চারণ করছে, যেন তাকে উদ্দেশ করেই জানাচ্ছে অনেক অভিযোগ। সে ওর যা ইচ্ছে বলুক, আর ওর ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। ওর নিয়তি নির্দিষ্ট হয়ে গেছে।

নিলয়দা বলল, কোলাঘাটে একটা ভাল হোটেল আছে। সেখানে আমরা লাঞ্চ খেয়ে নেব। ওখানে ইলিশ মাছ পাওয়া যেতে পারে।

আমি বললাম, কোলাঘাটে থামতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। সন্ধের আগেই আমাদের পোঁছানো দরকার।

তা বলে দুপুরে কিছু খাব না?

টেনে চলো খড়্গপুর। ওখানে রাস্তার পাশেই একটা বড় ধাবা আছে, সেখান থেকে কিছু খাবার তুলে নেব। দেড়টার মধ্যে তোমার খড়্গপুর পৌঁছে যাওয়া উচিত।

 ঠিক আছে, তাই চল। ফ্লাস্কটা বার কর, একটু চা খেয়ে নিই।

খানিক দূর যাবার পর নিলয়দা জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁ রে নীলু, শেষ পর্যন্ত আমরা ভুল করছি না তো?

না, নিলয়দা। কাল রাত্তিরে তো আমরা অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম। তুমি যা ঠিক করেছ, সেইটেই ওর পক্ষে বেস্ট! ওকে আর কে নেবে বলো, প্রকৃতি ছাড়া?

পুলিশ ওকে নেবেনা। ওর আত্মীয়-স্বজন ওকে ত্যাগ করেছে। হাসপাতালে বে-ওয়ারিশ পাগল নেয় না। রাস্তায় ও কোনও গণ্ডগোল করলে লোকে ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে চায়। তাহলে ও কোথায় যাবে? একমাত্র ওকে প্রকৃতির কোলেই ফিরিয়ে দেওয়া যায়। বুঝলি নীলু, একদিন হয়তো আমাদের সবাইকে প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে হবে।

আমি তাতে রাজি আছি। কিন্তু তার আগে সমস্ত শহরগুলো ধ্বংস করে দেওয়া দরকার।

ও নিজের খাবার জোগাড় করতে পারবে?

কাল তুমি ওর ভুট্টা খাওয়া দেখলে না? আমরা শুধু দানাগুলো খেয়ে বাকি সবটা ফেলে দিই। ও সবটাই খেয়ে ফেলল কচ কচ করে খিদের মুখে। এখন পর্যন্ত ওর পেট খারাপ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। খিদে পেলে মানুষ সব খেতে পারে। যারা অসুখ নিয়ে চিন্তা করে না, তাদের সব কিছুই হজম হয়ে যায়। আদিম জংলি মানুষরা যে-রকম ভাবে বাঁচত, ভোলানাথও সেই ভাবেই বাঁচার চেষ্টা করবে।

আগে জঙ্গলে অনেক রকম ফল-টল পাওয়া যেত, শিকার করার মতো অনেক জন্তু ছিল। এখন তো কিছুই বলতে গেলে নেই।

জানো নিলয়দা। আমি একবার লোধাদের একটা বিয়ে দেখেছিলাম। খুব ইন্টারেস্টিং। একটা লোধা জোয়ান ছেলে একটা বড় শালগাছের তলা থেকে ছুটতে আরম্ভ করে একটা টিলার মাথায় উঠে গেল। আবার সেখান থেকে ফিরে এসে মেয়েপক্ষের লোকদের বলল, এই যে ছুটে গেলাম, এই এতখানি জঙ্গল আমার। তার মানে কিন্তু ওই ছেলেটো যে অতখানি জঙ্গলের মালিক, তা নয়। সে বলতে চায় যে, জঙ্গলের ওই অতটা এলাকা হল তার শিকার আর ফল-মূল ইত্যাদি শিকার সংগ্রহ করার সীমানা। জঙ্গলের কোনও প্রাণী, এমনকী ইঁদুর-বাদুড়ও ওরা বাদ দেয় না, বেশ আরাম করে খায়। ইংরেজিতে যাকে বলে মাসরুম, আমরা বলি ব্যাঙের ছাতা, তাকে ওরা বলে ছাতু, ওদের খুব প্রিয় খাদ্য। কাজেই বুঝতে পারছ, জঙ্গল থেকে অনেক মানুষ এখনও তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে আছে। তাদের স্বাস্থ্যও বেশ ভাল।

আমি সাঁওতালদের শালগাছের ফুল খেতে দেখেছি।

কুসুম ফল বলে এ-রকম ফল আছে জানো? অনেকে সেই ফলের নামই জানে না। যখনও দেখেওনি। এ-দিককার জঙ্গলে খুব পাওয়া যায়। সেই ফল খেয়ে অনেকে পেট ভরায়। গত বছর কাঁকড়াঝোড়ে এসে আমরা কত বুনো জাম গাছ দেখেছিলাম, মনে আছে?

সব চেয়ে বড় কথা, জঙ্গলে কোনও মেয়ে নেই। কয়েক মাস ও যদি একদম কোনও মেয়েকে দেখতে না পায়, তাহলে বোধহয় ও সুস্থ হয়েও যেতে পারে। ওইটাই তো ওর একমাত্র প্রবলেম।

নদীর ধারে শুয়ে থাকবে, চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে নীল আকাশ দেখবে, সবুজ বন ওর চোখ জুড়িয়ে দেবে, প্রকৃতির শুশ্রূষায় ও অনেক ভাল থাকবে।

ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক যদি ওকে দেখতে পায়?

ও তো আর কাঠ চুরি করবে না, ওর ভয় কী? জঙ্গলের মধ্যে কোনও মানুষের থাকা তো বারণ নয়। সরকারের সেরকম কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে বলে শুনিনি।

এক মাস বাদে আমরা আর একবার এসে ওর খোঁজ নিয়ে যাব। কী বল?

না নিলয়দা, তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ, আমরা ওকে প্রকৃতির কাছে সঁপে দিয়ে যাব, তারপর আর ওর সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক থাকবেনা।

নিলয়দা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ভোলানাথের দিকে। ও আমাদের কথা বুঝতে পারছে কি না কে জানে! অবশ্য ইঞ্জিনের শব্দে আমাদের আস্তে আস্তে কথা বলা ওর ঠিক শুনতে পাবার কথা নয়। ভোলানাথের চোখে-মুখে এখন আর একটুও হিংস্রতার ছাপ নেই। কেমন যেন ভাবের ঘোরে তন্ময় হয়ে আছে। কাল রাত্রে ড. ভড় এসে দুটো ইঞ্জেকশান দিয়ে যাওয়ায় ওর বেশ উপকার হয়েছে। ওষুধ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর ক্ষতগুলোতে। আশ্চর্য অত মার খেয়েও… পাগল ছাড়া অত মার আর কেউ সহ্য করতে পারে না।

নিলয়দার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ভোলানাথ বলল, মাধুরী মরে গেছে, আমিও মরে গেছি। আর কেউ বেঁচে নেই। এটাই হল সত্যি কথা, তাই না?

নিলয়দা জিজ্ঞেস করল, ভোলানাথ, কে মাধুরী? সে কোথায় থাকে? তোমার কিছু মনে পড়ছে?

ভোলানাথ বলল, তুমি আমাকে চেনো না, আমি তোমাকে চিনি না। কেউ কারুকে চেনে না, এই হল সোজা কথা, ব্যাস!

ভোলানাথের মুখে এই কথা আমি এতবার শুনেছি যে এখন একঘেয়ে লাগে। নিলয়দা কিন্তু আবেগের সঙ্গে বলল, সত্যিই ভোলনাথ, তোমাকে আমরা চিনতে পারলাম না শেষ পর্যন্ত।

রূপনারায়ণ নদীর ব্রিজ পার হবার সময় নিলয়দা বলল, কোলাঘাটে থামাব না? এখানে ভাল খাবার ছিল, ওকে শেষবার একটু ইলিশ মাছ খাইয়ে দিতাম।

আমি বললাম, অ্যাকসিলারেটারে একটু জোরে চাপ দাও, নিলয়দা। সন্ধের আগে না পৌঁছতে পারলে আমরা মহা মুশকিলে পড়ে যাব।

জীপের স্পিড বাড়িয়ে খড়্গপুরে আমরা পৌঁছে গেলাম দেড়টার মধ্যে। এবারে এখান থেকে কিছু খাবার নিয়ে নিতে হবে। বড় ধাবাটায় বেশ ভিড়। দু তিনখানা গাড়ি থেমে আছে। তিন জন মহিলা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাস্য পরিহাস করছে, অবাঙালি, খুব সম্ভবত পাঞ্জাবি।

নারীকণ্ঠ শুনেই উৎকর্ণ হয়ে উঠল ভোলানাথ। বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, মাধুরী, ওখানে কী করছে? মাধুরীর কপালে রক্ত! মাধুরী! মাধুরী।

নিলয়দা বলল, মাধুরী বলে কাকে ডাকছে। ওদের মধ্যে কারুকে চিনতে পেরেছে?

আমি বললাম, অধরা মাধুরী আর ছন্দ বন্ধনে ধরা দেবে না। ওর কথায় কান দিও না, নিলয়দা। ওর অতীত খোঁড়ার চেষ্টা করে আর কোনও লাভ নেই। আমরা পরের ধাবায় যাব, তুমি গাড়ি স্টার্ট দাও!

ভোলানাথ জীপ থেকে লাফিয়ে বাইরে নামার উপক্রম করেছিল, জিপটা আবার চলতে শুরু করতেই ও ঝাঁকুনিতে বসে পড়ল।

পরের ধাবাটি ছোট, এখানে শুধুট্রাক ড্রাইভাররা খাবার জন্য থামে। সম্পূর্ণ স্ত্রী-ভূমিকাবর্জিত। এখানে আমরা জীপ থেকে তিন জনেই নেমে একটা খাটিয়ায় বসলাম। গরম গরম মাংসের তরকা আর রুটি, সেইসঙ্গে পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা। অতি উপাদেয় খাদ্য।

আমি তরকাটাই বেশি খেলাম, রুটির ভক্ত নই বলে দু’খানা নিয়ে দেড়খানাতেই আহার সমাপ্ত করলাম। নিলয়দা খেল তিনখানা রুটি। ভোলানাথকে প্রথম যে তিনখানা রুটি দেওয়া হল তা সে চোখের নিমেষে শেষ করে ফেলল, তরকা-পেঁয়াজ ছুঁলই না। আবার তিনখানা দেওয়া হল, তারও সেই অবস্থা। নিলয়দা পরিবেশনকারীকে চোখের ইঙ্গিতে জানাল, দিয়ে যাও।

ফাঁসির আসামির খাওয়ার কথা শুনেছিলাম। ভোলানাথ কি বুঝতে পেরেছে যে ও নির্বাসনে যাচ্ছে? আমি গুনছিলাম, ঠিক সাতাশখানা রুটি ও উড়িয়ে দিল বিনা বাক্যব্যয়ে। তারপর সর্দারজি এসে বলল, আউর রোটি নেহি হ্যায়, পাকা দেঙ্গে জলদি?

আমি বললাম, থাক, যথেষ্ট হয়েছে। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়বে। ওহে ভোলানাথ, এবারে উঠে পড়ো, যেতে হবে।

মুখের কথা সে শুনল না, তার হাত ধরে টানতে হল। তখন সে প্লেটটা সুদ্ধুই এগোতে লাগল গাড়ির দিকে। প্লেটটা তার হাত থেকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করতেই সে সেটা মুখের সামনে নিয়ে গিয়ে তরকা চাটতে লাগল জিভ দিয়ে। তার দাড়িতে লেগে গেল অনেকটা। তার মুখ দেখে মনে হয়, এখন তার একটুও পেট ভরেনি। মানুষের এ-রকম অস্বাভাবিক ক্ষুধা দেখলে গা ছম ছম করে।

বাহারাগোড়া থেকে ঝাড়গ্রামের দিকে ঘুরে যাবার মুখটাতেই জিপটা গণ্ডগোল শুরু করল। মাঝে মাঝেই স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ তো আমরা প্লেন রাস্তায় এসেছি, এর পরে জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি রাস্তায় যদি গাড়ির গোলমাল হয়, তাহলে খুব বিপদে পড়ে যাব। বাহারাগোড়ার পাম্প থেকে আমরা পেট্রল ভরে নিয়েছি একটু আগে, আমি সেখানে ফিরে গিয়ে একজন মিস্ত্রিকে ধরে আনলাম।

মিস্ত্রিটি সব প্লাগগুলো খুলে পরীক্ষা করে দেখছে, আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি, একটা সাদা রঙের গাড়ি আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলঝা ড়গ্রামের দিকে। পেছনের সিটে জানলার পাশে বসে থাকা মানুষটিকে দেখে আমার শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। সাত্যকি বসুমল্লিক। আমার চিনতে কোনও ভুল হয়নি। সেই অহঙ্কারী, সুন্দর মুখ, ঠোঁটের রেখায় অবজ্ঞা মেশানো ভদ্রতা। লোকটা এ-দিকে কোথায় যাচ্ছে? আমাকে দেখতে পায়নি। দেখলেও কি থামত? একটা ডাকবাংলোয় কয়েকদিনের জন্য বাধ্যতামূলক পরিচয়। সাত্যকি বসুমল্লিকের মতো মানুষ এইসব ঘটনা মনে রাখে না। কিন্তু ও কেন বলেছিল, আমার মতো একটা ছেলেকেই ও খুঁজছে। নিছক কথার কথা?

আমি এমনই উত্তেজিত বোধ করলাম যে, মনে হল, এই কথাটা এক্ষুনি কারুকে জানানো দরকার। কিন্তু কাকে বলব? নিলয়দাকে বললে কিছুই বুঝবে না। কলকাতা থেকে কত লোকই তো ঝাড়গ্রামে যায়, অনেকের বাড়ি আছে ঝাড়গ্রামে, সাত্যকি বসুমল্লিকেরও বাড়ি থাকাটা কিছুই অস্বাভাবিক নয়।

মিস্ত্রিটি বেশ ভাল, কিছুক্ষণের মধ্যেই চাঙ্গা করে দিল আমাদের জিপটা। এবং এই কাজের জন্য সে নিজেই মাত্র দশ টাকা চাইল। এই রকম কাজ আমার ভাল লাগে, দরাদরি করতে হয় না, দু’পক্ষই খুশি।

ঝাড়গ্রামে আমার অনেক চেনা লোক। যদিও নিলয়দা আর আমি মনে মনে যে যুক্তি মেনে নিয়েছি তাতে কোনও খুঁত নেই, তবু আমরা ঠিক করেছি, যে কাজটা আমরা করতে বেরিয়েছি, সেটা গোপনে সেরে নেওয়াই ভাল। ঝাড়গ্রামে আমার চেনা কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেই মুশকিল, তারা নানা কথা জানতে চাইবে, দু’একজন হয়তো সঙ্গে যেতেও চাইবে। আমি মাথায় একটা রুমাল বেঁধে নিলয়দার সানগ্লাসটা পরেনিলাম, মুখটাও ফিরিয়ে রাখলাম ভেতরের দিকে। অবশ্য সাত্যকি বসুমল্লিকের সাদা গাড়িটা লক্ষ করার ইচ্ছে ছিল আমার, কিন্তু সেটা আর দেখা হলো না।

আমরা হাজারিবাগ, বেতলা, সিমলিপাল এইসব কাছাকাছি সবকটা জঙ্গলের কথাই পর্যালোচনা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঁকড়াঝোড় জঙ্গলটাই ঠিক করা হয়েছে। গতবারই এই জঙ্গলটা ঘুরে গেছি বলে এটার কথাই মনে পড়েছে সব চেয়ে আগে। তাছাড়া, এই জঙ্গলে বাঘ নেই, নেকড়ে যে নেই তাতেও আমরা নিঃসন্দেহ হয়েছি, অন্য কোনও হিংস্র জানোয়ারই নেই। হাতি আছে বটে, হাতি প্রায়ই আসে, কিন্তু হাতি তো চট করে মানুষকে আক্রমণ করে না। শহরে ক্ষুদ্ধ জনতার চেয়ে বুনো হাতির পাল অনেক বেশিভদ্র।

নিলয়দার তুলনায় আমি এ অঞ্চলে অনেক বেশিবার এসেছি, রাস্তাঘাট আমিই বেশি চিনি। যদিও বেলপাহাড়ি ছাড়বার পর জঙ্গলের পথ বেশ জটিল, মাঝে মাঝে যেমন খাড়াই-উৎরাই আছে তেমনই এক-এক জায়গায় পথ এমনভাবে ভাগ হয়ে গেছে যে কোন দিকে যেতে হবে তা ধরা মুশকিল। এই অঞ্চলের ড্রাইভাররাই সঠিক পথ জানে।

দহিজুড়ির মোড় একটা ছোট ঝঞ্ঝাট হল। সেখানে আজ হাটবার, জিপটা চলেছে আস্তে আস্তে, হঠাৎ ভোলানাথ একজায়গায় একটা লাফ দিল। ও পালাতে চেয়েছিল না হাটের কোনও মেয়েকে কামড়াবার শখ হয়েছিল তা ঠিক বোঝা গেল না। লাফিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার পর উঠে দাঁড়িয়ে চ্যাঁচাতে লাগল, মাধুরী মরে গেছে, আমি মরে গেছি, সবাই মরে গেছে। ওগো, আমরা সবাই মরে গেছি, তাইনা?

নিলয়দা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষতেই আমি বললাম, চুপ করে বসে থাকো, নিলয়দা, দেখো না কী হয়!

নিলয়দা বলল, হাটে অনেক মেয়ে, ও যদি কারুকে অ্যাটাক করে?

আমি আর কিছু বলবার আগেই ভোলানাথ জিপটার কাছে ফিরে এসে বলল, ওগো, আমরা সবাই মরে গেছি, তাই না? তোমরা গন্ধ পাচ্ছ না? সব মরা মানুষ!

আমি কঠোর ভাবে বললাম, ভোলানাথ, গাড়িতে উঠে এসো!

এই প্রথম ভোলানাথ আমার কথার সরাসরি উত্তর দিয়ে বলল, তুমি কে হে? ঠুটো জগন্নাথ? তোমার নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, তোমার কথা শুনব কেন?

এই সময় একটি মধ্যবয়সী আদিবাসী রমণী নিলয়দার পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ও বাবু, আন্ডা নেবে?

ভোলানাথ সেই মেয়েটির কাছে দৌড়ে আসবার আগেই আমি নেমে পড়ে তার পথ রোধ করে দাঁড়ালাম, সে তবু এগোবার চেষ্টা করতেই আমি লাগলাম তার বুকে এক ধাক্কা।

ভোলানাথ আমার তুলনায় অনেক বলশালী, সে যদি উলটে আমায় আক্রমণ করত তাহলে আমরা কী দশা হত কে জানে! কিন্তু ভোলানাথ সেরকম কিছু না করে কাঁদতে শুরু করে দিল। আমি তার কাঁধে হাত দিয়ে ঠাণ্ডাভাবে বললাম, ওঠো, গাড়িতে ওঠো! ভোলানাথ আর আপত্তি না করে সুড় সুড় করে উঠে এল।

বেলপাহাড়ি পৌঁছতেই সন্ধে হয়ে গেল আমাদের।

 জঙ্গলের পথ আমি চিনি না। একবার ভাবলাম, এখানকার ডাকবাংলোতে রাতটা কাটিয়ে যাব কি না। পরের মুহর্তেই মনে হল, আজ রাত্তিরের মধ্যেই যা হোক কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়া ভাল।

নিলয়দা জিজ্ঞেস করল, রাস্তা ভুল হয়ে যাবেনা তো রে?  

আমি বললাম, আস্তে আস্তে চালাও, আমাদের তো ভেতরের ফরেস্ট বাংলো পর্যন্ত যাবার দরকার নেই, একটা কোনও নিরিবিলি জায়গায় পৌঁছলেই হল।

অন্ধকার হয়ে এলেই জঙ্গলের চেহারা বদলে যায়। আকাশের আলো একেবারে মিলিয়ে যায়নি, কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা দেখা যায় না। হেডলাইটের আলোয় মনে হয় আমরা একটা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখন এ-রকম সুড়ঙ্গ সোজা একটাই, ডান দিকে, বাঁ-দিকে কিছু নেই। নানা রকম ঘরে-ফেরা পাখির ডাকে বেশ একটা ঐকতান শোনা যাচ্ছে। তারমধ্যে টিয়ার ডাকই অন্য পাখিদের ডাক ছাড়িয়ে যায়। এই বনে প্রত্যেক বারই অনেক টিয়া দেখেছি। দু’একটা পাখির ডাক চিনতে পারি না।

খানিকটা গেলেই একটা নদী পার হতে হবে মনে আছে। সেখানে রাস্তাটা অনেকখানি খাড়াই থেকে সোজা নদীতে নেমে যায়, ব্রিজ নেই, জলের ওপর দিয়েই পার হতে হয়। ওই জায়গাটা সাবধানে পার হতে হয়। আমি সামনের দিকে ভাল করে নজর রাখছি, কখন সেই নদীটা এসে পড়ে।

আচমকা পেছন থেকে আমার পিঠে এক কিল মেরে ভোলানাথ বলে উঠল, শোধ!

আমি এমন চমকে গিয়েছিলাম যে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। আত্মরক্ষার জন্য আমি তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে দু’হাত উঁচু করলাম।

ভোলানাথ হো-হো করে হেসে উঠল। নিলয়দাও হেসে ফেলে বলল, তুই যে ওর বুকে ধাক্কা মেরেছিলি, ও তার শোধ নিল!

আমি হাসতে পারলাম না। পেছন থেকে পিঠে কিল মেরে ঠাট্টা করতে পারে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, ভোলানাথকে আমি এখন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, আবার মারবে না তো?

ভোলানাথ একটানা হেসে যাচ্ছিল, হঠাৎ হাসি বন্ধ করে বলল, বেশ ভাল জায়গা, খুব ভাল জায়গা, ঠাণ্ডা-ঠাণ্ড!

নিলয়দা বলল, বাঃ, তোমার পছন্দ হয়েছে? আমরা এখানে থাকব।

ভোলানাথ বলল, কেউ থাকবে না, শুধু আমি থাকব। না না, আমিও থাকব না। শুধু জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গল থাকবে। গাছের মধ্যে গাছ থাকবে। মাটির মধ্যে মাটি থাকবে। নিলয়দা আমার দিকে তাকাল। আমি কোনও মন্তব্য করলাম না।

নিলয়দা জিজ্ঞেস করল, কেন ভোলানাথ, তোমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না? এমন শান্ত জায়গা, কেউ এসে জ্বালাতন করবে না!

মাধুরী হারিয়ে গেছে, আমিও হারিয়ে গেছি। আর কেউ নেই। কে যে কখন হারিয়ে যায়, টেরও পায় না, হে-হে-হে!

হঠাৎ জিপটা গড়াতে লাগল নিচের দিকে। আমি আঁতকে উঠলাম, এই তো সেই নদীর খাদ। নিলয়দা যদি তক্ষুনি ব্রেক কষত তাহলে আমরা উলটে যেতাম নির্ঘাৎ, কিন্তু নিলয়দা স্টিয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরে রইল অ্যাকসিলারেটর থেকে পা তুলে। আমরা হুড়মুড়িয়ে এসে পড়লাম নদীর জলে।

জল বেশি নয়, হাঁটুও ডুববে না, কিন্তু ছোট-বড় নানা রকম পাথর রয়েছে। চেনা ড্রাইভার এখান দিয়ে অবলীলাক্রমে নদী পার হয়ে যায় কিন্তু নিলয়দার হাতে ইঞ্জিন গোঁ গোঁ করতে লাগল, গাড়ি আর নড়েনা।

আমি বললাম, নেমে একটু ঠেলে দিচ্ছি। গাড়ি হালকা করা দরকার। নিজে নেমে দাঁড়িয়ে ভোলানাথকে হুকুম করলাম, নামো।

ভোলানাথ এ-সব কথা বোঝে। দিব্যি নেমে পড়ল টপ করে। আমি জিপটাকে ঠেলতে লাগলাম, কিন্তু ও হাত লাগাল না, জলের মধ্যে পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলা করতে লাগল।

খানিকটা ঠেলাঠেলির পর জিপটা গড়াতে শুরু করল, নদীর অন্য দিকের রাস্তাটা আরও বেশি খাড়াই। সেখান দিয়ে উঠতে নিলয়দা আর আমি গলদঘর্ম হয়ে গেলাম। ভোলানাথ নদীর জলে শুয়ে পড়ে গোটা গা ভিজিয়ে হা-হা-হা-হা করছে। ঠিক যেন একটা শিশু।

নিলয়দা ডাকল, ভোলানাথ, এসো, উঠে এসো!

জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে হা-হা করতে করতে ছুটে এল ভোলানাথ। দুপুরে ভরপেট খেয়েছে, ও বেশ মনের আনন্দেইে আছে।

আর একটু এগোবার পর দুটো রাস্তা দেখতে পেলাম। একটা ডান দিকে, আর একটা সোজা। আমার যতদূর মনে পড়ছে, সোজ রাস্তাটা গেছে ফরেস্ট বাংলোর দিকে, বাংলোর কাছাকাছি একটা ছোট গ্রামে খুব জনবসতি আছে। সুতরাংও-দিকে যাবার কোনও মানে হয় না। আমি বললাম, চলো ডান দিকে।

এরপর শুরু হয়ে গেল পথের নানা শাখা-প্রশাখা। প্রায়ই ডান দিকে বা বাঁ-দিকে একটা করে রাস্তা বেরিয়ে গেছে, ছোট ছোট রাস্তা, কোনওক্রমে একটা গাড়ি যেতে পারে। আমি আন্দাজে একবার ডান দিকে, একবার বাঁ-দিকে বলে যেতে লাগলাম। দু পাশের গাছের ডালের ঝাপটা লাগতে লাগল গায়ে। কখনও হেডলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে পথ জুড়ে রয়েছে একটা মাকড়সার জাল, মাঝখানে বসে আছে প্রায় টাকার সাইজের এক কালো মাকড়সা।

জঙ্গলের মধ্যে অচেনা রাস্তায় অন্ধকারের মধ্যে যাওয়ার একটা রোমাঞ্চ আছে। যদিও মনে মনে জানি, এই সব রাস্তা কোথাও না কোথাও পৌঁছে দেবে ঠিকই, তবু মনে হয় যেন দিক ভুলে আমরা নিরুদ্দেশ যাচ্ছি। সবসমুদ্রেরই তল আছে, তবু যেমন সমুদ্রের ওপর ভাসতে ভাসতে অতল কথাটা মনে পড়ে।

এখন জঙ্গলে আমাদের গাড়ির শব্দ ছাড়া কোনও শব্দ নেই, কোথাও প্রাণের চিহ্ন নেই। বড় বড় গাছগুলো যেন আমাদের ওপর ঝুঁকে আসছে।

নিলয়দা বলল, এ কোথায় এলাম রে, নীলু? হঠাৎ হাতির পাল সামনে এসে যায়, কী করব? গাড়ি ফেরাবার তো জায়গা নেই।

আমি বললাম, গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে বসে থাকবে, হাতিরা কিচ্ছু বলবে না, আমার আগে এরকম অভিজ্ঞতা আছে।

আর কত দূরে যাব?

রাস্তাটা আবার ঢালু হয়ে এসেছে, দূরে চিক চিক করছে জল। সেই পর্যন্ত এসে আমি বললাম, এখানেই থামা যাক।

নদী নয়, এখানে রয়েছে একটা সরু ঝরনা, কিন্তু স্রোতের তেজ আছে। দু’পাশে অনেকখানি কাঁকা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা। খানিকটা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে সেখানে। নিলয়দা জিপটা ঘুরিয়ে রেখে হেডলাইট নিভিয়ে দিতেই চাঁদের আলোয় সেই ঝরনা তীরবর্তী স্থানটি বড় মোহময় দেল।

নিলয়দা নেমে এসে বলল, পিকনিকের পক্ষে চমৎকার জায়গা। এলো ভোলানাথ, তোমার খিদে পায়নি?

ভোলানাথ জিপে বসেই গুন গুনকরে সুর ভাঁজছে। আমি বাঁদরকে কলার লোভ দেখাবার মতন একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে বললাম, সিগারেট খাবে? এসো, এসো।

সিগারেটের লোভেই ভোলানাথ নেমে এল। আমি ওকে নিয়ে চলে এলুম ঝরনার কাছে। জ্যোৎস্নায় রুপোলি দেখাচ্ছে ঝরনাটাকে। যেন বনবিবি তার ওড়নাটা ফেলে গেছে এখানে। আরও মনে হয়, একটু আগেই হরিণেরা জল পান করতে এসেছিল, আমাদের শব্দ পেয়ে চলে গেছে।

ঝরনার ধার দিয়ে দিয়ে আমরা দুজনে হাঁটতে লাগলাম ঢালুর দিকে। ফাঁকা জায়গাটা শেষ হয়ে আবার বড় বড় গাছ শুরু হলো, সেখানেই একটা গাছের তলায় আমি বসে পড়লাম। কেন যেন আমার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে।

ভোলানাথ ঝরনার জলে পা ডুবিয়ে বলল, ঠাণ্ডা! খুব ঠাণ্ডা জল, একেবারে পোকা পেঁপের মতো।

ভোলানাথের উপমা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। এ-রকম তাকে আগে বলতে শুনিনি। এমন যদি হত, আমরা তিন বন্ধু জঙ্গলের মধ্যে রাত্তির বেলা পিকনিক করতে এসেছি, তাহলে ব্যাপারটা কত আনন্দের হত। কিন্তু সে-রকম আর হবার নয়।

নিলয়দা দু’বগলে দুটো বেশ বড় পলিথিনের থলে বয়ে নিয়ে এল।

আমি হতবাক। নিলয়দা এসবকী এনেছে, এগুলো রেখেছিল কোথায়? নিশ্চয়ই সিটের নিচে।

নিলয়দা লাজুক ভাবে বলল, একটাতে আছে চিড়ে, আর এটাতে কাঁচা বাদাম। কয়েক দিন চলবে। প্রথম প্রথম খাবার খুঁজতে যেতে তো ইচ্ছে হবে না।

প্যান্টের দু’পকেট থেকে পাঁচ-ছ’প্যাকেট সিগারেট আর গোটা চারেক দেশলাই বার করে রাখল নিলয়দা। তারপর বলল, নীলু, তুই চায়ের ফ্লাস্ক আর বিস্কুটের টিনটা নিয়ে আয়।

আমাদের জিপটা বেশ ওপরে। আসলে একটা টিলার গা দিয়ে নেমে এসেছে ঝরনাটা। আমি দ্রুত এসে জিপটায় চড়ে একটুখানি বসে রইলাম। ভোলানাথের সঙ্গে নিলয়দার কিছু কথা থাকতে পারে, যা হয়তো আমার সঙ্গে বলতে লজ্জা পাবে। তাছাড়া আমার খানিকটা সময় কাটানো দরকার। পুরো একটা সিগারেট শেষ করার পর আমি চায়ের ফ্লাস্ক ও বিস্কুটের টিন নিয়ে রওনা দিলাম ধীরে ধীরে। একটুখানি গিয়ে মনে পড়ল প্লাস্টিকের গেলাস তিনটে আনা হয়নি। আবার ফিরে এসে নিয়ে গেলাম সেগুলো।

ঝরনাটাকে খুব পছন্দ হয়েছে ভোলানাথের। সে সেখানেই পা ডুবিয়ে বসেছে একটা পাথরের ওপর। আমি গেলাসে চা ঢেলে দিলাম ওকে। ভোলানাথ বিড় বিড় করে বলল, মাধুরী নেই, আমি নেই, নেই নেই।

আমি বললাম, বিস্কুট আছে। খাও!

বিস্কুটের টিনটা ওর পাশেই বসিয়ে দিলাম, ও একটার পর একটা খেয়ে যেতে লাগল। বুঝলাম যে, শেষ না হলে ও থাকবে না।

নিলয়দা আমায় জিজ্ঞেস করল, নীলু, গাড়িতে টর্চ আছে, আনিসনি?

আমি বললাম, এই রে ভুলে গেছি। তুমি একটু নিয়ে আসবে? টর্চ নিয়ে আমরা জঙ্গলের ভেতরটা একটু ঢুকে দেখতাম।

নিলয়দা উঠে দাঁড়িয়ে দু’পা গিয়ে থমকে দাঁড়াল। কম্পিত গলায় বলল, ভোলানাথ, তুমি থাকো, আমি আসছি।

ভোলানাথ একমনে বিস্কুট খেয়ে যেতে লাগল, নিলয়দার দিকে ফিরেও তাকাল না।

নিলয়দা আবার ডাকল, ভোলানাথ।

এবারেও ভোলানাথ গ্রাহ্য করল না তার ডাক। আমি তাড়া দিয়ে বললাম, যাও, টর্চটা নিয়ে এসে নিলয়দা!

এবার নিলয়দা চলে গেল জিপটার দিকে। আমি ঝরনার জলে গেলাসগুলো ধুয়ে ফেললাম। ফ্লাস্কে আর চা নেই, সেটাও ধোওয়া হল। দূরে তাকিয়ে দেখলাম, নিলয়দা অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেছে। ঝরনার জলের চাপা কুলুকুলুশব্দ আর ভোলানাথের বিস্কুট চিবোনোর শব্দ। আকাশের অল্প অল্প মেঘ আছে। সেই জন্য মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না মুছে যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তকে আমার মনে হচ্ছে অনন্তকাল।

এক সময় জিপ থেকে নিলয়দার গলা শুনতে পেলাম, কই রে নীলু, টর্চটা খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় রেখেছিস?

আমি চেঁচিয়ে বললাম, দেখো, বাঁ-দিকে গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে।

কই, সেখানে খুঁজে পাচ্ছি না তো?

আমি আসছি, দেখিয়ে দিচ্ছি।

ফ্লাস্কটা তুলে নিয়ে আমি বললাম, ভোলানাথ, বিস্কুট খাও, আমি টর্চটা খুঁজে দিয়ে আসছি।

 ভোলানাথ বলল, আমিও থাকবনা, তুমিও থাকবে না, কেউ থাকবে না।

আমি হন হন করে হেঁটে গেলাম টিলাটার দিকে। শেষের দিকে দৌড় দিয়ে এক লাফে এসে বসলাম জিপে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, চালাও! জিপটা ঘুরিয়েই রাখা ছিল। নিলয়দা সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট দিয়েই স্পিড তুলল। আমি মাথাটা বাইরে ঝুঁকিয়ে শোনবার ও দেখবার চেষ্টা করলাম কেউ চ্যাঁচাচ্ছে কিংবা ছুটে আসছে কিনা! না, সেরকম কিছুই হল না!

আমাদের পরিকল্পনা একেবারে নিখুঁত ভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। প্রতিটি সংলাপও আগে থেকে মুখস্থ করা। ঠিকই ছিল যে, শেষ গন্তব্যে পৌঁছে আমরা ভোলানাথের সঙ্গে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় কাটাবনা, শুধু একটুখানি চা খাব। বেশিক্ষণ থাকলেই মায়া কাটানো মুশকিল।

হয়তো এত নিখুঁত পরিকল্পনার দরকারই ছিল না, আমরা যা কবেছি, সেভাবে কোন সুস্থ মানুষকেও ঠকানো যেত। ভোলানাথের এত কিছু বোঝার ক্ষমতাই নেই। কিংবা যদি বুঝতে পেরে থাকে, তাতেই-বা কী করা যাবে!

ডান দিকে বাঁ-দিকে যে-কোনও রাস্তা পেলেই তা দিয়ে চলে যাচ্ছে নিলয়দা। এর মধ্যে আমরা অনেকটা দূরে চলে এসেছি। এখন ইচ্ছে করলেও আর চট করে রাস্তা খুঁজে ভোলানাথের কাছে ফিরে যাওয়া যাবেনা।

একটা বাঁকের মুখে এসে জোরে ঘোরাতে যেতেই স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে স্টিয়ারিং এর ওপর মাথা দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠল নিলয়দা।

আমি চুপ করে বসে রইলাম। এখন কোনও কথারই মূল্য নেই। কান্নাটা আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। নিলয়দা কাঁদছে অথচ আমার কান্না পাচ্ছে না কেন? নিলয়দার চেয়ে আমার হৃদয় কি কঠোর! মূল পরিকল্পনাটা তো নিলয়দারই। কাল সন্ধেবেলা নিলয়দা বলেছিল, গঙ্গার ধারে ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে দূরে কোনও জঙ্গলে ভোলানাথকে রেখে আসা অনেক ভাল। তাতে ও বাঁচার একটা সুযোগ পাবে, আমাদেরও বিবেক পরিষ্কার থাকবে। যে-মানুষকে সমাজ নেয় না, জঙ্গলই তো তার উপযুক্ত জায়গা।

নিলয়দা বেশ কেঁদে কেঁদে বুক খালি করে নিচ্ছে, নিলয়দাকে এখন হিংসে হচ্ছে আমার। আমি দারুণ পরিশ্রান্ত বোধ করছি, এক্ষুনি ইচ্ছে করছে চিত হয়ে শুয়ে পড়তে। কিন্তু আগে যে-কোনও উপায়ে এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার।

মিনিট পাঁচেক বাদে নিলয়দার পিঠে হাত রেখে আস্তে আস্তে বললাম, এবারে চলো।

মুখ তুলে নিলয়দা আকুল ভাবে বলল, কী করলাম রে নীলু! এ কী করলাম। এক জন মানুষকে এভাবে ফেলে যাওয়া যায়? আমি যখন শেষ বিদায় নিলাম, তখন ও অভিমান করে আমার সঙ্গে একটা কথাও বলল না! চল, ফিরে যাই।

আমি বললাম, নিলয়দা, তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে। কাল বলেছিলে, কিছুতেই এ প্রতিজ্ঞার নড়চড় হবে না। রূপাবউদির কথা ভাবো, পাপুনের কথা ভাবো।

নিলয়দা স্টিয়ারিঙের ওপর একটা কিল মেরে বলল, ধুত্তোরি তোর সংসারের নিকুচি করেছে। পরের মুহূর্তেই সামলে নিয়ে শান্তভাবে বলল, নাঃ! বাড়ি ফিরতে হবে।

আবার জিপটা চলতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ আমরা কেউ কোনও কথা বললাম না। কোন দিকে যে যাচ্ছি, তা কিছুই জানি না। এখন আর রাস্তা চেনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জঙ্গলটা যেন এখন একটা গোলোকধাঁধা। এর মধ্যে যদি সারা রাত আমাদের ঘুরে বেড়াতে হয়? জঙ্গলের মধ্যে অচেনা রাস্তা, হঠাৎ কোথাও আমরা খাদে পড়ে যেতে পারি, কোনও জায়গায় রাস্তা ভাঙা থাকতে পারে। এই রাস্তায় সপ্তাহে একটা দুটো গাড়ি যায়, তা-ও রাত্তিরবেলা কেউ যায় না। থাক গে, যা হয় হোক।

আধ ঘণ্টার বেশি গাড়িটা বিভিন্ন বাঁকে ঘোরবার পর নিলয়দা জিজ্ঞেস করল, সেই নদীটা কোথায় রে নীলু? মনে হচ্ছে, বার বার যেন একই রাস্তায় ফিরে আসছে।

আমি নিষ্প্রাণ ভাবে বললাম, আমিও কিছু বুঝতে পারছি না, নিলয়দা।

 নদীটা পার না হলে ফেরার রাস্তা পাব কী করে?

একটা রাস্তা ঘাটশিলার দিকে চলে গেছে আমি জানি, সেটা পেলেও তো হত।

এক কাজ কর, পেছনের সিটের তলায় আমি দেখেছি কয়েকটা পুরোনো খবরের কাগজ আছে, সেগুলো বার কর। এরপর কোনও মোড় ঘুরলেই সেখানে কয়েকটা কাগজ ছড়িয়ে দিবি। তারপর যদি সেখানে আবার ফিরে আসি, তাহলে কাগজগুলো দেখে বুঝতে পারব।

দুটো মোড়ে আমি এ-রকম খবরের কাগজ ছড়িয়ে দিলাম। তারপর তৃতীয় মোড়টায় বাঁক নিতেই একটা দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠলাম দুজনেই। রাস্তাটা সোজা চলে গেছে। দুতিনশো গজ দূরে রাস্তার মাঝখান দাঁড়িয়ে আছে এক জন মানুষ। কিংবা দাঁড়িয়ে নেই, দুহাত তুলে ছুটে আসছে আমাদেরই দিকে। যে আসছে, সে আর্ত কেউ নয়, যেন এক মূর্তিমান প্রতিশোধ।

ও কে? ভোলানাথ? জঙ্গলের কোনও আদিবাসী, অথবা কোনও প্রেতাত্মা? অথবা আমাদের

আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম সেই মুহূর্তে। খ্যাপাটে গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম, নিলয়দা, জিপ ঘোরাও! ব্যাক করো। ও যেন আমাদের ধরতে না পারে। ও ধরতে পারলে আমাদের মেরে ফেলবে। শিগগির, নিলয়দা শিগগির!

আমার সেই উত্তেজনা নিলয়দার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে গেল। দারুণ ঝুঁকি নিয়ে নিলয়দা জিপটা চালিয়ে দিল ব্যাক গিয়ারে। একটা মোড় পেয়ে সেই দিকে বেঁকে গিয়ে জোর স্পিড তুলে দিল, তারপর আর একটা মোড় ঘুরতেই আমাদের গাড়ি গড়িয়ে পড়ে গেল নদীতে।

.

১০.

 কলকাতায় ফেরার দু চার দিন পরেই নানা লোকের মুখ থেকে চাপা ভৎর্সনা শুনতে লাগলাম আমি আর নিলয়দা। কী করে যে লোকে সব কথা জেনে যায়। অনেকেরই ধারণা, যেমন ভাবে অবাঞ্ছিত বিড়াল বা কুকুরকে পার করে দেওয়া হয়, সেই রকম ভাবেই আমি আর নিলয়দা এক জন পাগলকে বাইরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে এসেছি। জঙ্গলে বা কোথায় রেখে এসেছি তা অবশ্য কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারে না। আমরা এত গোপনীয়তা নেওয়া সত্ত্বেও এই গল্প ছড়াল কী করে? স্বর্ণ বলেছে? জিপগাড়ির মালিক?

আমরা ধারণা সাত্যকি বসুমল্লিকেরই অপকীর্তি এটা। কিন্তু বাহারাগোড়ার মোড়ে সাত্যকি বসুমল্লিক কি আমাদের দেখতে পেয়েছিল? দেখলেও জানবে কী করে, কে কে ছিল আমাদের জীপে। সাত্যকি বসুমল্লিক তার গাড়ি থামায়নি, একবার ভ্রূক্ষেপও করেনি। তাহলেও হয়তো সাত্যকি বসুমল্লিকের স্পাই আছে চতুর্দিকে ছড়ানো।

ফিরে আসার দুদিন পরেই একজন পুলিশ অফিসার এসেছিলেন নিলয়দার বাড়িতে। কোন এক ডিআইজি তাকে পাঠিয়েছেন, একজন রাস্তার পাগলকে নাকি জেলে রাখার ব্যাপার আছে, অফিসারটি সেই পাগলকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন। নিলয়দা তাকে জানাল যে, তার আর দরকার নেই, পাগলটি সেখানে আর থাকে না। অফিসারটি যেন সেকথা শুনে নিশ্চিন্ত নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তবে তো আপদ চুকেই গেছে! ডিআইজি যদি খোঁজ করেন তো বলে দেবেন যে আমি এককোয়ারিতে এসেছিলাম।

কফি হাউসে আমার এক বন্ধুর এক বন্ধু অপ্রতিম আমাকে বলল, তোরা এটা কী করলি, নীলু? এক জন মানুষের দায়িত্ব নিয়েও পিছিয়ে গেলি? তাহলে প্রথমে সেই লোকটিকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে যেতে কে বলেছিল তোদের।

আমি বললাম, রাস্তার ছেলেরা এক জন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলছিল, তাকে সেই অবস্থা থেকে বাঁচানো অন্যায়? চোর-ডাকাত-ছেলেধরা সন্দেহ করে প্রায় প্রতিদিনই তো একটা দুটো লোককে ক্রুদ্ধ জনতা খুন করছে। যারা মরছে, তারা সত্যি সত্যি অপরাধী কি না, তা বিচার করে দেখার নেই। কিংবা ওদের থেকেও অনেক বড় বড় অপরাধীরা সসম্মানে ঘুরে বেড়ায়, সে-সম্পর্কে তোমরা নির্বিকার। এইসব বর্বরতার বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করো না। হঠাৎ এই এক জন পাগলকে নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?

অপ্রতিম এমন একটা উদার হাসি দিল, যেন আমার মতো একজন নির্বোধের সঙ্গে সে দয়া করে কথা বলছে। চওড়া হাসিটা ঠোঁটে এঁকে রেখে সে বলল, সে তো মব ভায়োলেন্সের ব্যাপার। একটা দেশে এইরকম ভায়োলেন্স কেন শুরু হয়। সেই কারণটার গভীরে যাওয়া দরকার। পুরো ব্যবস্থাটাই না পালটালে যে এই সব জিনিস বাড়তেই থাকবে, এটা যে বোঝে না, তার সঙ্গে এসব বিষয়ে আলোচনাই করা যায় না।

আমি উঠে পড়তে যাচ্ছিলাম, অপ্রতিম তবু ডেকে বলল, লোকটাকে কুকুর-বেড়ালের মতো খেদিয়ে দেওয়ার আগে একবার আমায় বললেই পারতিস। বহরমপুরে একটা ভ্যাগরান্সি হোমে আমার চেনা একজন কাজ করে। সেখানে ভর্তি করে দিতুম।

আমি বললাম, রাস্তায় তো এখনও আরও অনেক পাগল ঘুরে বেড়ায়, তাদের জন্য কিছু করো না!

সত্যি, এখন যেন পথে-ঘাটে আমি অনেক বেশি পাগল দেখতে পাই। আগে এদের লক্ষ করতাম না। হাওড়া স্টেশনে, রাইটার্স বিল্ডিংসের দক্ষিণ কোণে, বিড়লা প্ল্যানেটারিয়ামের পাশে যখন তখন এক জন পাগল বা পাগলিকে বসে থাকতে দেখি। আমাদের বাজারের সামনের সেই পাগলীকে অবশ্য কয়েকদিন আর দেখিনি। তবে পনেরোই আগস্ট তাকেই কিংবা তারই মতো আর একজনকে দেখলাম পার্ক স্ট্রিটে ঠিক রাত ন’টা পঁচিশমিনিটে। একটা সিনেমা দেখে ফিরছিলাম, দাদা-বউদিসঙ্গে ছিল বলে ট্যাক্সি নেওয়া হয়েছিল। পনেরোই আগস্টেও লোডশেডিং, অন্ধকারের মধ্যে গাড়ির আলোয় চোখে পড়ল এক নগ্ন নারী মূর্তি, অদ্ভুত ভাবে বেঁকে দাঁড়িয়ে সে যেন পৃথিবী ও আকাশকে অবজ্ঞা করছে। এর পরনে একটা গামছা পর্যন্ত নেই। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এ বছর স্বাধীনতা দিবসে এই কি ভারতমাতার মূর্তির প্রতিষ্ঠা হল?

ট্যাক্সিটা এগিয়ে যাবার পর দেখলাম পরের মোড়ের মাথায় দু’জন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে গল্প করছে ছুটির দিনের মেজাজে। আমি ট্যাক্সিটা থামতে বলে নেমে গেলাম। সেই দু’জনের কাছে গিয়ে বললাম, দেখিয়ে, উধার এক পাগলি জেনানা খাড়ে হুয়ে হ্যায়, একদম নাঙ্গা।

সেপাই দু’জন গল্প থামিয়ে অতিশয় অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। একজন বলল, হামলোগ কেয়া করে গা?

আমি বললাম, পার্ক স্ট্রিটমে কিতনা গাড়িচলতা, বাহার সে সাহেব লোগ আতা, হিয়া পর এক নাঙ্গা জেনানা–

অধিকতর অভিজ্ঞ সেপাইটি ডান হাতের পাঞ্জা নাড়িয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে বলল, যাইয়ে, যাইয়ে, আপ ঘর যাইয়ে।

আমি আবার ফিরে এলাম ট্যাক্সিতে। দাদা আমার বেশির ভাগ কীর্তি কাহিনিই জানে না। হঠাৎ ট্যাক্সি থামিয়ে নেমে গেছি বলে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? কোথায় গিয়েছিলি?

আমি বললাম, একটু আগে যে পাগলিটাকে দেখলে না, আমি এখানে দু’জন পুলিশকে দেখে বলতে গিয়েছিলাম যাতে ওরা কিছু ব্যবস্থা করে!

বউদি বললো, ছি ছি ছি, দেখলে এমন বিচ্ছিরি লাগেনা!

দাদা বলল, কেন যে এদের কলকাতা থেকে বার করে দেয় না। পুলিশও হয়েছে এমন। তুই আবার এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে যাস কেন? কেউ কিছু বলতে গেলে তাকেই ঝঞ্ঝাটে পড়তে হয়।

তখন আমার মনে হল, নিলয়দা রাস্তা থেকে ভোলানাথকে তুলে না নিয়ে যদি কোনও পাগলীকে নিয়ে যেত, তাহলে নিশ্চয়ই তার সতেরো রকম ব্যাখ্যা হত!

স্বর্ণর সঙ্গে জয়ের ভাব হয়ে গেছে এর মধ্যে। এখন স্বর্ণ আমার দিকে অদ্ভুত তির্যক ভাবে তাকায়। প্রথম দিন স্বর্ণ আমাকে নানাভাবে জেরা করে জানতে চেয়েছিল, ভোলানাথকে আমরা সত্যিই পুরুলিয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে এসেছি কি না! আমার সাক্ষ্য বোধহয় খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। স্বৰ্ণর ধারণা যে, নিলয়দা আর আমি ভোলানাথকে খুন করে কোথাও ফেলে দিয়ে এসে সমস্যার সমাধান করেছি। বাইরে নিয়ে গিয়ে হয় ওকে পাহাড়ের ওপর থেকে আচমকা নিচে ঠেলে ফেলে দিয়েছি, অথবা বিষ খাইয়ে কোনও নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছি। বলাই বাহুল্য, আসল খুনি আমিই, নিলয়দা এই সমাধানটা মেনে নিয়েছে মাত্র। খুনি মানেই ঘৃণ্য। জনতা যখন একজন মানুষকে পিটিয়ে মারে, তখন ব্যক্তিগত ভাবে কারুর হাতে পাপ লাগেনা। কিন্তু আমি পাপী। আমি যদি স্বর্ণকে মনে করিয়ে দিই যে, সে নিজেই একদিন তার দাদার সার্ভিস রিভলবার দিয়ে ভোলানাথকে খুন করতে চেয়েছিল, তাহলে নির্ঘাৎ স্বর্ণ হেসে বলবে, সে তো কথার কথা!

রূপাবউদি অবশ্য ব্যাপারটাকে এভাবে নেয়নি। রূপাবউদিকে নিলয়দা সব কথা খুলে বলেছে। রূপাবউদির ধারণা, নিলয়দা মিথ্যে কথা বলতে অপারগ, সুতরাং সে বিশ্বাস করেছে নিলয়দার সব কথা। একদিন রূপাবউদি আমাকে হাসতে হাসতে বলল, জানো নীলু, তোমাদের ওই ভোলানাথের পর্বটি বোধহয় এখনো শেষ হয়নি, আবার সে উপদ্রব করবে, আবার তার সঙ্গে তোমাদের দেখা হবে। জঙ্গলের মধ্যে পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে ওর মাথাটা একেবারে গুড়ো করে দিয়ে এলে না কেন? আমি যদি থাকতাম তো তাই দিতাম। মেয়েদের যে অপমান করে, মেয়েদের যে সহ্য করতে পারে না, এই পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই।

রূপাবউদি যে-দিন এই কথাগুলো বলল, সেই রাতেই আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। এই স্বপ্নে রূপাবউদি নেই, নিলয়দা নেই, ভোলানাথও নেই। শুধু সাত্যকি বসুমল্লিক আর আমি। সাত্যকি বসুমল্লিক একটা সাদা রঙের ডিজেল জিপ চালিয়ে চলেছে, পাশে বসে আছি আমি। আমার হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। সাত্যকি বসুমল্লিক মাঝে মাঝে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রহস্যময় ভাবে হাসছে। অন্ধকারে একটা গভীর জঙ্গলে ঢোকার পর এক জায়গায় সে গাড়ি থামিয়ে একটা লাথি মেরে আমাকে ফেলে দিল নিচে। তারপর গাড়িটা ঘুরিয়ে সে যখন আমার কাছে এল, তখন তার হাতে একটা বড় পাথর। উদার, অমায়িক ভাবে সে বলল, কেন তোমাকে আমি খুঁজছিলাম জানো? কেন বলেছিলাম তোমার মতো এক জনকেই আমার খুব দরকার? এই জন্য। তুমি জেনে ফেলেছিলে আমি একটা গুপ্ত পাগল, সে কথা তুমি সবাইকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলে, হাঃ হাঃ হাঃ! এখন এই পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে তোমাকে শেষ করব। তোমার মাথার ঘিলু বেরিয়ে পড়বে, পিঁপড়ে আর পোকা মাকড়রা এসে চেটে চেটে খাবে, আমি তাই দেখব! মানুষের মাথার ঘিলু বার করে দিতে আমার খুব ভাল লাগে!

এই বীভৎস স্বপ্ন দেখে আমি জেগে উঠলাম মাঝরাত্রে। দুঃস্বপ্নটা এমনই বিশ্বাসযোগ্য যে আমি ধড়মড় করে উঠে বসে আমার মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম, সত্যিই আমার ঘিলু গড়িয়ে পড়ছে কিনা। সাত্যকি বসুমল্লিক যে মিষ্টি হেসে বলেছিল, আপনার মতো একটি ছেলেকেই আমার দরকার, তার মানে সে আমার মস্তিষ্ক বার করে নিতে চায়।

একটু বাদে আমি বিলক্ষণ চটে গেলাম। কেন আমি দেখলাম এ-রকম দুঃস্বপ্ন? অবচেতন নামে সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের একটা নিজস্ব তালুক আছে। সেখানে বসে বসে সেই দাড়িওয়ালা বুড়ো আমাকে নিয়ে ইঁদুর-বেড়াল খেলাতে চায়? এর উলটো স্বপ্নই তো আমার দেখা উচিত ছিল। আমি গাড়ি চালাব। সাত্যকি বসুমল্লিক হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাশে পড়ে থাকবে। জঙ্গলের মধ্যে আমি এক সময় তাকে লাথি মেরে ফেলে দেব, তারপর একটা বড় পাথর নিয়ে– ।

চোখ বুজে আমি এই দ্বিতীয় স্বপ্নটা দেখার চেষ্টা করলুম। কিন্তু কিছুতেই জমল না। যখনই চোখ খুলি, বুঝতে পারি আমি জেগে আছি, বায়ুর ঊর্ধ্বচাপে আমি কল্পনার ওপর জোর খাটাবার চেষ্টা করছি মাত্র। মাঝে মাঝে কফি হাউসের সেই অপ্রতিম এসে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে আর বলছে, হয় গাঢ় স্বপ্নে অথবা কঠোর বাস্তবে সাত্যকি বসুমল্লিকের মুখোমুখি হতে হবে, বুঝলে নীলু, নিছক ইচ্ছাপূরণ কল্পনায় কোনওই কাজের কাজ হয় না!

বড় অসুখী অবস্থায় আমার সেই রাতটা কাটাল।

লোকে যাই বলুক, আমার ধারণা ভোলানাথ বেশ ভালই আছে। সাধুরা বলে, কামিনী কাঞ্চন পুরোপুরি ত্যাগ করতে পেরেছে। লোকে ভোলানাথকে পাগল ভাবে, আসলে সে হয়তো রয়েছে ভাবের ঘোরে। ভোলানাথ মাঝে মাঝে যে-সব কথা বলে, অনায়াসেই সেগুলোকে গভীর তত্ত্ব বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। ভোলানাথের সে-রকম কয়েক জন ভক্ত থাকলে এই সব বাণীই প্রচার করে, প্রচুর চ্যালা জুটিয়ে ফেলতে পারত। সাহেব মেমরা এসে তার পায়ে পড়ে কাঁদত। রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছিলেন, তোমার এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশঝরবে, ভোলানাথ কি সেই মাধুরীর কথা বলে? সেই মাধুরী হারিয়ে গেছে? এ তো বেশ নতুন রকমের চিন্তা। আমি বিদায় নেবার সময় ভোলানাথ ঝরনার জলে পা ডুবিয়ে রেখে খুব সহজভাবে বলেছিল, আমিও থাকবনা, তুমিও থাকবেনা। কেউ থাকবেনা। বেদ-উপনিষদেও তো এই টাইপের কথাই থাকে।

কল্পনায় দেখতে পাই, সেই ঝরনাটার পাশে শুয়ে আছে ভোলানাথ, আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে সিগারেট টানছে। তার অতীত নেই, তার ভবিষ্যতের চিন্তা নেই। হয়তো সেই পলিথিনের ব্যাগভর্তি চিড়ে আর বাদাম এরমধ্যেই ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু তার শরীরে রয়েছে অতি স্বাস্থ্যকর খিদে, যে-কোনও খাবার পেলেই তার শরীর সন্তুষ্ট হবে। গাছের পাতাই বা মন্দ কী। আমি ছেলেবেলায় তেঁতুল গাছের কচি কচি পাতা চিবিয়ে চিবিয়ে খেতুম, টক টক, বেশ সুন্দর খেতে।

যখনই কেউ অপমান করে, প্রয়োজনের জন্য কোথাও গিয়ে যখন ব্যর্থ হই, তখনই মনে হয়, ভোলানাথকে তো এসব কিছুই সহ্য করতে হয় না। ওর বদলে আমিই তো জঙ্গলে গেলে পারতাম। কিছুক্ষণ জঙ্গলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে অবশ্য বুঝতে পারি, ভোলানাথের তুলনায় আমি অনেকটাই অযোগ্য। কাঞ্চন সম্পর্কে আমার আসক্তি নেই, কিন্তু কল্পনাতেও তো কামিনীদের ত্যাগ করতে পারি না। বিজন অরণ্যে এক ঝরনার পাশে আমি যখন নিজেকে শুইয়ে রাখি, তখন ঝরনার অন্য পারে আরও এক জন কেউ শুয়ে থাকে, তাকে ঠিক চিনতে পারি না, সে যেন অভিমানে ফিরিয়ে আছে মুখ, তার চুলের ওপর ঝরে পড়ছে ফুলের রেণু।

আমাদের সেই অভিযানের ঠিক সতেরো দিন পর আর একটা ঘটনা ঘটল। পাপুনের জন্মদিন উপলক্ষে রূপাবউদি নেমন্তন্ন করেছে আমাকে। বেশি লোকজন নয়, নিজেদের মধ্যেই ব্যাপার, পাপুনের কিছু স্কুলের বন্ধু আর আমরা কয়েক জন। সন্ধেবেলা কেক-টেক কাটা হল, পাপুনের বন্ধুরা খেয়ে দেয়ে চলে গেল বাড়িতে, পাপুনও ঘুমিয়ে পড়ল, স্বর্ণ আর জয় এখন এসে পৌঁছোয়নি বলে আমরা অপেক্ষা করছি। ওরা একটা থিয়েটার দেখে আসবে। বসবার ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি নিলয়দা, রূপাবউদি আর আমি। রূপাবউদির আজ মেজাজ খুব ভাল, ওর অফিসের এক জন সহকর্মীকে নিয়ে দারুণ মজার গল্প বলছিল, এই সময় কলিং বেল বেজে উঠল। স্বর্ণরা এসেছে ভেবে রূপাবৌদি চেঁচিয়ে বলল –জীবন, দরজাটা খুলে দে।

রান্নার ঠাকুর এসে বলল, একজন ভদ্রমহিলা দাদাবাবুকে ডাকছেন।

নিলয়দা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কে?

 জীবন বলল, চিনি না! সঙ্গে একটি আট-দশ বছরের ছেলে রয়েছে।

 রাত সাড়ে ন’টা বাজে, এখন কোন অচেনা মহিলা এসেছে দেখা করতে?

 নিলয়দা উঠতে যাচ্ছিল, রূপাবউদি জীবনকে বলল, এখানে ডেকে নিয়ে আয়।

মহিলাটিকে দেখেই আমার মনে পড়ে গেল ভোলানাথের কথা। আমার এ-রকম হয়, আমি বুঝতে পারি। কী করে পারি তা জানি না। সঙ্গের ছেলেটির মুখের সঙ্গে ভোলানাথের কোনও মিল নেই, কিন্তু এ যে ভোলানাথেরই সন্তান তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। এত দিনে ভোলানাথের অতীত আমাদের কাছে সশরীরে উপস্থিত হয়েছে।

মহিলাটির বয়েস বছর তিরিশেক হবে, সাদামাটা চেহারা, তবে মুখে কোনও অলঙ্কার নেই, শুধু সিঁথিতে সিঁদূরের রেখা।

প্রথমে এক-দেড় মিনিট মহিলাটি কোনও কথাই বলতে পারলেন না। মুখ নিচু করে রইলেন। ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেয়ালের ছবিগুলো দেখছে।

নিলয়দা তৃতীয় বার জিজ্ঞেস করল, আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, কী ব্যাপার, বলুন?

মহিলাটি মাথা তুললেন, ঠোঁট কাঁপছে। আস্তে আস্তে বললেন, আমাদের পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল… ট্রেন খুব লেট… অনেক অসুবিধে করলাম আপনাদের।

রূপাবউদি বলল, না না, অসুবিধে কিছু নেই, আপনি কী বলতে এসেছেন, বলুন?

মহিলাটি হাতব্যাগ খুলে তার মধ্য থেকে একটা পুরোনো কাগজের কাটিং বার করে বললেন, ইনি আমার স্বামী।

সব চেয়ে বেশি অবাক হল রূপাবউদি। আমি তো আগে থেকেই জানি, নিলয়দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, যেন তার নামে কেউ চুরির অপবাদ দিয়েছে এইমাত্র।

রপাবউদি কাগজের কাটিংটা দেখে বলল, আপনার স্বামী? এই বিজ্ঞাপন তো আমরা দিয়েছিলাম একমাস আগে, কিংবা তারও বেশি হবে। এত দিন আসেননি কেন?

মহিলা বললেন, আমরা অনেক দূরে থাকি, সেখানে খবরের কাগজ যায় না। আমরা থাকি চাসনালায়, ঝরিয়া থেকে অনেকটা যেতে হয়।

চাসনালা নামটা আমার চেনা। কয়েক বছর আগে সেখানকার খনিতে এক সাংঘাতিক দুর্ঘটনা হয়েছিল, মারা গিয়েছিল প্রায় চারশো শ্রমিক।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, চাসনালা কয়লাখনিতে থাকেন?

মহিলা বললেন, হ্যাঁ। আমরা তো কাগজ পড়ি না। গতকাল একটা চিঠি এলে আমার নামে, চিঠি মানে আর কিছু লেখা ছিল না, খামের মধ্যে শুধু এই কাগজটা ছিল।

আপনাকে এত দিন বাদে কেউ এটা ডাকে পাঠিয়েছে? কে পাঠিয়েছে?

তা জানিনা। এটা দেখেই আপনাদের কাছে চলে এসেছি। সকালের ট্রেন ধরতে পারিনি, কলকাতা শহর ভাল চিনি না, অনেক খুঁজতে হয়েছে এই ঠিকানা।

কয়েক মুহূর্ত নিলয়দা রূপাবউদির সঙ্গে নির্বাক ভাবে দৃষ্টি বিনিময় করলাম। নিলয়দা বিমর্ষ হয়ে গেছে একেবারে।

মহিলা আমাদের বিশেষ কারুর দিকে না তাকিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কি ভাল আছেন? কাগজে ছবি বেরিয়েছে দেখে মনে হল, তাহলে নিশ্চয়ই ভাল হয়ে গেছেন।

আমাকে আর নিলয়দাকে চুপ করে থাকতে দেখে রূপাবউদিই বলল, না, উনি ভাল হননি এখনও। আপনারা ঝরিয়ায় থাকেন, উনি কলকাতায় এলেন কী করে?

তা তো জানি না। কলকাতায় যে এসেছেন, তা-ও জানতাম না। প্রায় দু’বছর ধরে ওঁর কোনও খোঁজ পাইনি। পুলিশে খবর দেয়া হয়েছিল। পুলিশ কিছু বলতে পারেনি।

এবারে আমি জিজ্ঞেস করলাম, উনি চাসনালাতেই থাকতেন? ওখানে কী করেন?

চাকরি করতেন।

ওঁর এই, ইয়ে… অসুখটা কবে থেকে হল?

 চাসনালায় সেই যেবার জল ঢুকে গেল, অনেক লোক ভেতরে আটকা পড়েছিল, সেই সময় থেকেই।

আপনার স্বামী কি সেই সময় খনির মধ্যে আটকা পড়েছিলেন?

না। উনি তো কাজ করতেন অফিসে। টাইমকিপারের কাজ করতেন। অনেক ডেডবডি তোলা হয়েছিল ওপরে, আগুন জ্বেলে পোড়ানো হয়েছিল, তখন খুব খাটতে হয়েছিল তো, লেবারারদের বউরা কমপেনসেশান পেল, তারা সবলাইন দিয়ে দাঁড়াত, উনি তাদের নাম লিখে টিপসই নিতেন। সেই সময়েই রোজ বাড়ি এসে বলতেন, আমার আর কাজ করতে ইচ্ছে করেনা।

টপটপ করে জলের ফোঁটা পড়তে লাগল মাটিতে। ভদ্রমহিলা চোখ মুছবার চেষ্টাও করলেন না। একই রকম গলায় বলে যেতে লাগলেন, অনেক লোক তখন টাকা চুরি করেছিল, ওই সব বিধবা মেয়েগুলোকে বিয়ে করবার জন্য অনেক লোক ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, আপনার সেসব জানেন বোধহয়? আমার স্বামী ভাল লোক ছিলেন, উনি এত সব সহ্য করতে পারলেন না, প্রথমে খুব মাথায় যন্ত্রণার কথা বলতেন। ঝরিয়া হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল।

নিলয়দা এতক্ষণ বাদে জিজ্ঞেস করল, ওঁর, মানে আপনার স্বামীর নাম কী?

মহিলা তাকালেন তার ছেলের দিকে। ছেলেটি বলল, আমার বাবার নাম অনুতোষ বড়াল।

 নাম শুনলেই একটা চেহারার ছবি চোখে ভেসে ওঠে। অনুতোষ শুনলে মনে হয়, রোগা, লম্বা, লাজুকমতো একজন মানুষ, আমাদের ভোলানাথের সঙ্গে মেলে না একেবারেই। শ্মশানবাসী, ছাই ভস্মমাখা শিবের নামেই ওকে মানায়।

ভদ্রমহিলা হাতব্যাগ খুলে একটা ফটোগ্রাফ বার করলেন। সাত-আট জনের একটা গ্রুপ ছবি। তার মধ্যে ডান পাশের লোকটির দিকে আঙুল দেখালেন ভদ্রমহিলা। তখন বেশ রোগাই ছিল, তবে এই লোকটিই যে আমাদের ভোলানাথ, তাতে কোনও সন্দেহই নেই।

রূপাবউদি বলল, আপনি বড্ড দেরি করে ফেললেন, উনি তো এখন এখানে থাকেন না। আবার কোথায় চলে গেছেন।

তার পরেই রূপাবউদি ছেলেটির দিকে ফিরে বললেন, তোমার নাম কী?

ছেলেটি বললো, সুখময় বড়াল।

রূপাবউদি বলল, সুখময়, তোমাকে তো দেখে মনে হচ্ছে খাওয়া হয়নি। এসো, খেয়ে নেবে এসো।

ছেলেটি লজ্জা পেয়ে মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল, রূপাবউদিতা র হাত ধরে নিয়ে গেলেন ভেতরে।

ভদ্রমহিলা নীরবে কাঁদতে লাগলেন, আমি আর নিলয়দা চুপ করে বসে রইলাম। নিলয়দার মুখ দেখেই বোঝা যায়, ওর মনের মধ্যে একটা ঝড় বইছে। আমার মনের মধ্যেও কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু সেটা ঝড় কি না জানি না।

নিস্তব্ধতা ভাঙলাম আমিই। কারণ আমার পুরো কাহিনিটি জানতে ইচ্ছে করছিল। চাসনালা কোলিয়ারির টাইমবাবু, ভয়াবহ একটা দূর্ঘটনার পর মৃতদেহ আর বিধবা মেয়েদের দেখে পাগল হয়ে গেল, তখন তাকে ভর্তি করা হল ঝরিয়া হাসপাতালে, তারপর?

আমার প্রশ্ন শুনে মহিলা বললেন, হাসপাতালের লোকেরা ওঁকে মারত। সবাই ভাবে মারলেই বুঝি পাগল ভাল হয়। মার খেয়ে খেয়ে উনি দু’বার পালিয়েছিলেন। দু’বারই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল অতিকষ্টে। তার পরের বার আর পাওয়া গেল না। আমি আর কত খুঁজব। আমার এক মামা ছাড়া কেউ নেই, ওঁরও বাবা নেই, ভাই-টাই নেই।

আপনি তার পরও চাসনালাইে থেকে গেলেন?

কোম্পানি আমাকে একটা ওখানে চাকরি দিয়েছে, আমি আর কোথায় যাব?

রূপাবউদি ফিরে এসে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কলকাতায় থাকবেন কোথায়? কেউ আছে?

মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যাঁ, ব্যারাকপুরে আমার মামা থাকেন। খোকাকে ডেকে দিন, এবার যাব।

এত রাত্রে ব্যারাকপুরে যাবেন? কী করে যাবেন?

সে কোনও অসুবিধে হবে না। শিয়ালদা থেকে ট্রেন যায়, আমি গেছি অনেকবার। বিয়ের আগে তো আমি ব্যারাকপুরেই থাকতুম।

আজ আর সেখানে যাবার দরকার নেই। আজ আমাদের এখানেই থাকুন। আজ আমার ছেলের জন্মদিন, আপনি এসে পড়েছেন, আজ আপনাকে যেতে দেব না।

নিলয়দা বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? মাধুরী কে? আপনার নাম কি মাধুরী?

ভদ্রমহিলা স্পষ্টতই কেঁপে উঠলেন। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল। নিলয়দার দিকে কয়েক মুহূর্ত সেইভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, মাধুরী? জানি না তো? আমার নাম পূর্ণিমা। হঠাৎ একথা জিজ্জেস করলেন?

ওই নামটা ওর মুখে অনেক বার শুনেছি।

আমি তো কখনও শুনিনি।

আমার মনে হল, ভদ্রমহিলা বোধহয় কিছু একটা গোপন করে যাচ্ছেন। মাধুরী নামটা কি সত্যিই উনি আগে শোনেননি? মাধুরী রক্ত-মাংসের কেউ নয়। কয়লা খনির এক টাইমবাবুর পক্ষে কি এতখানি বিমূর্ত কল্পনা সম্ভব? কিংবা যারা পাগল হয়, তারা সকলেই উচ্চমার্গের চিন্তা করে?

নিলয়দা বলল, মাথার গোলমাল হবার পর উনি আপনার ওপর কখনো, ইয়ে, মানে, রেগে মারতে-টারতে গিয়েছেন?

না, কক্ষনও না। উনি শান্ত মানুষ ছিলেন। কোনও দিন অফিস কামাই করতেন না। ঝড়-বৃষ্টি, অসুখ-বিসুখ হলেও অফিসে যাওয়া চাই-ই। সব সময় বলতেন, চাকরি গেলে তোমাদের অসুবিধে হবে।

বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়াল। জয় আর স্বর্ণ এসে গেছে। রূপাবউদি বলল, এসো আগে খেয়ে নেওয়া যাক।

নিলয়দা বলল, খাবার গরম করতে বলো, এক্ষুনি আসছি। নীলু, একটু শোন তো।

আমরা দুজনে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালাম। দুজনে দুটো সিগারেট ধরাবার পর একটু সময় নিয়ে নিলয়দা জিজ্ঞেস করল, এবার কী হবে?

নিরুত্তর। এর আগে আর কখনও আমি পরামর্শদাতার ভূমিকা নিইনি। নিলয়দার মানসিক সঙ্কটটা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি ওকে কোন বুদ্ধি দেব? আমার বুদ্ধির দৌড় শেষ।

নিলয়দা আবার বলল, ভদ্রমহিলা যখন জিজ্ঞেস করবেন যে, ওঁর স্বামী এখান থেকে কোথায় গেল, তখন কী উত্তর দেব?

আমি বললাম, রূপবউদি তো উত্তর দিয়েই দিয়েছে। সে এখান থেকে চলে গেছে। কথাটা মিথ্যেও নয়।

এখান থেকে চলে যায়নি, আমরা তাকে এক জায়গায় ছেড়ে দিয়ে এসেছি।

প্রায় একই কথা। সে নিজেই চলে যেতে পারত। পাগল মানুষ, যে-কোনও দিন সে আবার হারিয়ে যেতে পারত।

পারত, কিন্তু যায়নি। সে কোথায় আছে, আমরা জানি। সেটা গোপন করে যাওয়া অন্যায় নয়?

আমি প্রমাদ গুনলাম। অনুতোষ ওরফে ভোলানাথ ঠিক কোথায় আছে, তা কি সত্যি আমরা জানি? জঙ্গলের মধ্যে সেই জায়গাটা আমরা আবার খুঁজে বার করতে পারব? তাছাড়া তাকে জঙ্গলের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, সে কথা স্বীকার করা কি ঠিক হবে? কুকুর-বেড়াল তো নয়, মানুষ। হয়তো আমরা ঘোরতর বে-আইনি কাজ করেছি। মানুষের না খেতে পেয়ে মরা বে-আইনি নয়, কিন্তু একজন ক্ষুধার্ত মানুষ যদি অন্য কারুর কাছ থেকে জোর করে খাবার কেড়ে নেয় তবে তা বে-আইনি।

আমরা ঝোঁকের মাথায়, অনেকটা নিরুপায় হয়েই একটা কাজ করে ফেলেছি। এখন কি তার জন্য জেল খাটতে হবে? তা মন্দ কী। কিছু দিন জেলেই ঘুরে আসা যাক। সরকার ভোলানাথকে ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু ভোলানাথের প্রতি অবিচার করেছি বলে আমাদের জেলে দিতে নিশ্চয়ই সরকার দ্বিধা করবে না।

নিলয়দা বলল, তুই চুপ করে রইলি যে? ওকে ফিরিয়ে আনা এখন আমাদের ডিউটি।

ফিরিয়ে আনার পর? রাখবে কোথায়?

ভোলানাথ কোল ইন্ডিয়ার কর্মচারী ছিল, এখন বোধহয় ওর চাকরি আছে। কোল ইন্ডিয়া ওর চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে। ভোলানাথকে নিয়ে কী করা উচিত, তা ওর স্ত্রী বুঝবে! ইচ্ছে করলে এখন আমরাই তো ওকে যে-কোনও হাসপাতালে ভর্তি করে দিতে পারি, ওর স্ত্রী ফর্মে সই করবে।

কেন যেন আমার মনটা ভারি ভারি লাগছে, নিলয়দার কথায় কোনও উৎসাহ বোধ করলাম না। কিছু একটা বড় রকমের ভুল হয়ে যাচ্ছে, আমরা ধরতে পারছি না।

রূপাবউদির ডাক শুনে আমরা ভেতরে এলাম। স্বর্ণ আর জয় পূর্ণিমা বড়ালকে ঘিরে দাঁড়িয়ে নানা প্রশ্ন করছে। রূপাবউদি বলল, আমি এঁকে বলেছি, তোমরা এঁর স্বামীর সঙ্গে ঝাড়গ্রাম বেড়াতে গিয়েছিলে, তারপর উনি সেখানেই থেকে গেছেন। তোমরা তাকে ফিরিয়ে এনে দেবে।

ভোলানাথের ছেলে সুখময় তার বড় বড় টলটলে চোখ মেলে একবার তার মায়ের দিকে, আর একবার রূপাবউদির দিকে তাকাচ্ছে। স্বামীবঞ্চিতা এক রমণী আর একটি শিশু, এদের দেখার পরই পালটে গেছে সকলের মনের ভাব।

পূর্ণিমা আর তার ছেলে পরদিনও রয়ে গেল নিলয়দার বাড়িতে। মাত্র তিন দিনের ছুটি নিয়ে এসেছেন বলে পূর্ণিমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব নয়। নিলয়দা আর রূপাবউদি ওদের পৌঁছে দিয়ে এল হাওড়া স্টেশনে। রূপাবউদির সঙ্গে পূর্ণিমার এত ভাব হয়ে গেছে যে, রূপাবউদি কথা আদায় করে নিয়েছে, পূর্ণিমা এরপর কলকাতায় এলেই তাদের বাড়িতে উঠবে। নিলয়দাও কথা দিয়েছে, কয়েক দিনের মধ্যেই সে পুর্ণিমার স্বামীকে পৌঁছে দেবে চাসনালায়।

আমি কয়েক দিন আর যাইনিও বাড়িতে। শুক্রবার রাত্তিরে নিলয়দা এসে আমাকে ধরল। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ড. ভড়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এসেছে নিলয়দা। কোল ইন্ডিয়ার কর্মচারি হলে রাঁচির হাসপাতালে ভর্তি করতে কোনও অসুবিধেই হবে না। রাস্তার পাগল নয়, এখন ওর পরিচয় পাওয়া গেছে, মোটামুটি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়ে, এবার একটা ব্যবস্থা হবেই।

নিলয়দা বলল, কাল ভোরেই তো তাহলে রওনা হতে হয়। কাল শনিবার আছে, স্বর্ণ আর জয়ও সঙ্গে যাবে বলছে।

আমি কাচুমাচু ভাবে বললাম, নিলয়দা, কালকে যে আমার একটা চাকরির ইন্টাভিউ আছে। আমি তো যেতে পারছি না।

নিলয়দা বলল, শনিবার ইন্টারভিউ? কোন অফিসে?

আছে এক জায়গায়। এক জন লোক আমাকে দেখা করতে বলেছে, ঠিক আমার মত এক জনকেই খুঁজছে নাকি।

তুই আমার কাছে মিথ্যে কথা বলছিস নীলু? তোকে বাদ দিয়ে আমরা যাব কী করে?

ঝাড়গ্রাম থেকে এক জন ড্রাইভার নিতে পারো। ওরা সব রাস্তা চেনে।

তুই যাবিনা? এত দিন আমরা দু’জনে সব ব্যাপারে এক সঙ্গে ছিলাম, তুই কেন যেতে চাইছিস না বল তো?

আমার সত্যিকাজ আছে, নিলয়দা!

 নিলয়দা বেশি পেড়াপেড়ি করেনা কক্ষনও। বিষণ্ণ ভাবে বলল, তাহলে আর তোকে জোর করব না। আমি কালকেই বেরিয়ে পড়ছি, আর দেরি করা যায় না।

নিলয়দাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলাম, কিন্তু আর একটিও কথা হল না।

সারা রাত ঘুমোত পারলাম না ভাল করে। ছটফট করলাম বিছানায়। কীসের অস্বস্তি বুঝতে পারছি না। ঘুমের অসুবিধে আমার হয় না সাধারণত। কোনও দুঃস্বপ্নও দেখছি না। একটু তন্দ্রা আসছে, আবার ভেঙে যাচ্ছে।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমি এসে দাঁড়ালাম বারান্দায়। ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস আজ অনুপস্থিত, রাত্তিরেও খুব গরম ছিল। মনে পড়ল, অনেক দিন সমুদ্রের ধারে যাইনি। এখন যে কোনও সমুদ্রতীরে হাওয়ারা লুটোপুটি খাচ্ছে। এবার যেতে হবে।

দূর থেকে একটা জিপ গাড়ি এসে থামল আমাদের বাড়ির সামনে। স্বর্ণ, জয় আর নিলয়দা নামল গাড়ি থেকে স্বর্ণ হাতছানি দিয়ে আমাকে হুকুমের সুরে বলল, এই, নেমে এসো।

আমার খালি গা বলে আমি চট করে বারান্দা থেকে সরে এসে একটা জামা গলিয়ে নিয়ে নেমে এলাম। নিলয়দা বলল, আমি আসতে চাইনি রে, ওরা জোর করে এখানে টেনে আনল।

স্বর্ণবলল, খালি পা কেন? চটি পরে এসো। পাজামার সঙ্গে শার্ট? বিচ্ছিরি দেখায়! একটা পাঞ্জাবি পরে আসবে।

আমি তো যাচ্ছি না।

যাচ্ছ না মানে? বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলে কেন? তৈরি হয়ে নিতে পারোনি?

জয় বলল, চলুন, চলুন বেশি দেরি করলে হাওড়ায় জ্যাম হবে।

বেশিবার না না করলে মনে হয় দাম বাড়াচ্ছি। স্বর্ণ কোনও কথাই শুনবেনা। ঘুমন্ত মায়ের কানে বার্তাটি জানিয়ে ঠিক বারো মিনিটের মধ্যে আমি তৈরি হয়ে ফিরে এসে জিপে উঠলাম। আমি নিলয়দার পাশে, ওরা দুই প্রেমিক-প্রেমিকা পেছনে। জয়ের অনেক চেনাশুনো আছে, সে কাঁকড়াঝোড় বাংলোর রিজার্ভেশন করিয়ে ফেলেছে পর্যন্ত।

আগের বারের যাওয়ার এবারের যাওয়ায় অনেক তফাৎ। আমি কিছুতেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারিছনা মনের মধ্যে। যেন মেঘ জমাট হয়ে আছে, কোনও তরঙ্গ উঠছে না। জয় আর স্বর্ণর ঠিক পিকনিকের মেজাজ। মাঝে মাঝে গান গেয়ে উঠছে দুজনে। আমার প্রতি জয়ের ব্যবহার বেশ স্বচ্ছল। ও কি জানে, স্বর্ণ আমার সঙ্গে এক দিন গঙ্গায় নৌকো চড়ে বেড়াতে গিয়েছিল?

প্ল্যান ছিল একটানা গাড়ি চালিয়ে ঝাড়গ্রামে এসে বিশ্রাম নেওয়া হবে। কিন্ত লোধাশূলিতে একটা চাকা পাঙ্কচার হল, চাকা বদলাতে সময় চলে গেল কিছুটা। ঝাড়গ্রামে এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। তারপর আবার যাত্রা।

দহিজুড়িতে আজও হাট জমেছে। একটা মোষের গাড়ির পেছনে পড়ায় আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে নিলয়দা, একটি আদিবাসী রমণী আমাদের পাশে এসে বলল, ও বাবু, আন্ডা নেবে?

নিলয়দা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

জয় বলল, একটা বিচ্ছিরি গন্ধ পাচ্ছস্বর্ণ? এইসব হাটফাটের পাশ দিয়ে গেলেই এই রকম গন্ধ পাওয়া যায়। এরা পচাই আর তাড়ি-টাড়ি কী সব বিক্রি করে।

আমি অবাক হয়ে জয়ের দিকে তাকালাম। কোথায় বিচ্ছিরি গন্ধ? সতেজ তরিতরকারি, টাটকা বাতাস, এই গন্ধটা জয়ের খারাপ লাগল? মনে হচ্ছে যেন আজও একটা পাগলকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।

বেলপাহাড়ি ছাড়িয়ে জঙ্গলে ঢোকার মুখে আমি একবার বলে উঠলাম, নিলয়দা।

 মুখ ফিরিয়ে নিলয়দা বলল কী?

আমি ইতস্তত করে বললাম, কিছুনা।

স্বর্ণ জিজ্ঞেস করল, এই জঙ্গলে ময়ুর আছে? আমরা একবার বেতলা ফরেস্টে গিয়ে অনেক ময়ুর দেখেছিলাম, তোমার মনে আছে নিলয়দা? তোমাদের বিয়ের ঠিক পরেই।

নিলয়দা বলল, তুমি তখন ছোট ছিলে! এই জঙ্গলের কথা নীলু ভাল জানে! ওকে জিজ্ঞেস করো।

স্বর্ণ বলল, ও তো সারাক্ষণ গোমড়ামুখো হয়ে আছে। কথাই বলছে না। নীলকমল, তোমার কী হয়েছে বলো তো?

আমি ভদ্রতা করে হাসলাম। আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। একটা স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কষ্ট। ঝরনার পাশে শুয়ে আছে একটি মানুষ, মাথার ওপরে আকাশ, তার গায়ে লাগছে নাম-না-জানা গাছের স্নেহ বাতাস, পাখিরা তার দিকে অবাক চোখে দেখে। তার কোনও অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই, খিদে পেলে সে খাদ্যের সন্ধানে যাবে অথবা যাবেনা। কারুর তাড়না সহ্য করতে হবে না তাকে, সাত্যকি বসুমল্লিকের মতো কেউ দয়া দেখাতে আসবে না। তার সঙ্গী শুধু তার নিজের মন।

আমি এ-রকম পারিনি, কখনও পারব না। আর বেশি দিন চাকরি-বাকরি না পেলে আমায় শেষ পর্যন্ত সাত্যকি বসুমল্লিকের কাছেই যেতে হবে। গিয়ে বলব, এই যে এসেছি স্যার, মাথা পেতে দিচ্ছি, আপনি আমার ঘিলু বার করে নিন।

এক জন কেউ সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে পেরেছিল, তাকে আমরা ফিরিয়ে নিয়ে বন্দি করতে চাইছি। পাগলের চিকিৎসা মানে কী? একটা ছোট ঘরে আটকে রাখবে তাকে, হয়তো হাতে-পায়ে শিকল পরাবে, ইলেকট্রিক শক্ দেবে, সে একটু চ্যাঁচামেচি করলে ওয়ার্ডবয়রা এসে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরবে তার বুক। কয়লাখনির এক টাইমবাবু তার বাঁধা ধরা সময়ের সব জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল, সে দেখেছিল অকারণ নির্বোধ মৃত্যু, সে দেখেছিল টিপসই দিয়ে খেসারতের টাকা নিতে আসা স্ত্রীলোকদের হাত, এরই মধ্যে সে দেখেছিল লোভ ও রিরংসা, তাই সে তার পুরনো সবকিছু, এমনকী মনটাকেও বিসর্জন দিয়ে চলে এসেছিল। আবার তাকে আমরা সেইখানেই ফিরিয়ে দিতে চাইছি।

ওইসব আসুরিক চিকিৎসার পর ভোলানাথ যদি কোন দিন সুস্থ হয়ে ওঠে? আবার তাকে যেতে হবে তার অফিসের বড়বাবুর কাছে, সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে সে বলবে, এই যে, মাথা পেতে দিয়েছি, আমার ঘিলুটা বার করে নিন স্যার, আমাকে একটা যন্ত্র বানিয়ে ফেলুন।

অকস্মাৎ যেন ছায়াছবির মতো দেখতে পেলাম, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাইমবাবু বসে আছে অফিসে, কলে-কারখানায়। মাথা হেঁট করে সবাই ফিস ফিস করে বলছে, ঘিলু বার করে নিন, ঘিলু বার করে নিন, নইলে পাগল হয়ে যাব।

নদীটা পার হবার সময় আমাদের তিন জনকে নামতে হল গাড়ি থেকে। গাড়ি ঠেলার চেয়ে জল নিয়ে খেলা করাতেই জয় আর স্বর্ণর বেশি উৎসাহ। একবার আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে জয় তার জামা টামা ভিজিয়ে ফেলল। স্বর্ণর উচ্ছল হাসিতে কেঁপে উঠল বনভূমি।

নদীর ওপারে উঠে নিলয়দা নিজেই বলল, এবারে ডান দিকে না?

 দিনের আলোয় জঙ্গলে কোনও রোমাঞ্চ নেই। আজ এই জঙ্গলটাকে তেমন গভীরও মনে হচ্ছে না। নিস্তব্ধতারও কোনও প্রগাঢ় রূপ নেই। মেঘশূন্য আকাশে গনগনে রোদ। এই সবকিছুর মধ্যেও ভাল লাগাবার উপকরণ খুঁজে নেওয়া যায়, যদি মনটা সে-রকম উন্মুক্ত থাকে।

কয়েক বার রাস্তা ভুল করে আমার পেয়ে গেলাম সেই ঝরনাটা। ঝরনা কোথায়? এ তো একটা নালা! সেই রাত্রে কী অপরূপ মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন দেখছি বেশ ময়লা জল। জিপ থেকে নেমেই আমরা সবাই ছুটে গেলাম ঢালুর দিকে। ভোলানাথ সেখানে নেই।

পলিথিনের ব্যাগ দুটো পড়ে আছে গাছতলায়। একটা ব্যাগে কিছু বাদাম এখনও রয়ে গেছে। ব্যাগটা ফুটো ফুটো, বোধহয় পাখিরা ঠুকরে ঠুকরে বাদাম খাওয়ার চেষ্টা করেছে। দুটো সিগারেটের প্যাকেট পড়ে আছে না খোলা অবস্থায়। এক জায়গায় পাওয়া গেল বিস্কুটের টিনটা, এতেও কিছু বিস্কুট রয়ে গেছে। ভোলানাথের কোনও চিহ্ন নেই ধারেকাছে।

নিলয়দা চিৎকার করে ডাকল, ভোলানাথ! ভোলা-না-থা! অনু-তোষ!

যেন স্পষ্ট প্রতিধ্বনি, সেইডাক ঘুরতে লাগল বনের মধ্যে। আমার মনের মধ্যে বরফ গলছে, আমার মনে হচ্ছে ভোলানাথকে পাওয়া যাবেনা।

খানিকটা খোঁজাখুঁজি করতেই সেই নালাটার এক জায়গায় দেখা গেল একটা জামা আটকে আছে পাথরে। এটা নিলয়দারই পাঞ্জাবি, ভোলানাথের গায়ে ছিল। জামা সে ইচ্ছে করে খুলে ফেলতেই পারে। জঙ্গলে জামার তো কোনও দরকার নেই।

রাস্তার পাগলেরও একটা ছোটখাটো সংসার থাকে। সে-ও কিছু কিছু জিনিস জমায়। ছেঁড়া কম্বল, ভাঙা বা তোবড়ানো থালা, বাটি, আধপোড়া সিগারেট। এখানে সেরকম কোনও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এই কদিনে অনেকবার বৃষ্টি হয়েছে। গাছের ডালপালা ভেঙে ভোলানাথ একটা ঝুপড়ি বানিয়ে নিতে পারত, সেরকম কিছু চেষ্টাও সে করেনি।

দু’ঘণ্টা ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। বিকেল গাঢ় হয়ে আসছে, এরপর আর কিছুই দেখা যাবেনা। স্বর্ণ বলল, চলল আমরা ডাকবাংলোতে যাই।

সন্ধে হতে না-হতেই একটা মস্ত চাঁদ উঠল আকাশে। ডাকবাংলোর পেছন দিকে একটা ছোট টিলা, সেখানে চেয়ার পেতে দিয়েছে আমাদের। যারা বেড়াতে আসে, তারা সবাই এখানে এসে বসে। এখান থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। বাংলোর সামনে বেশ কিছু লোকজন জড়ো হয় সন্ধেবেলা, কাছেই আছে একটা মুদির দোকান। ফরেস্ট গার্ড আর চৌকিদারকে অনেক প্রশ্ন করেছে নিলয়দা। না, তারা কেউ জঙ্গলের মধ্যে কোনও নতুন মানুষকে দেখেনি। ফরেস্ট গার্ড জোর দিয়ে বলল, নতুন লোক এলে সে ঠিক জানতে পারত, সাইকেলে সে সারা বন টহল দিয়ে বেড়ায়।

নিলয়দা এখানে ওদের সঙ্গে কথা বলতেই ব্যস্ত। কাল সকালে আর একটা সার্চ-পার্টি বেরুবে। জয় আর স্বর্ণ হাত ধরাধরি করে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। আমি চুপচাপ একলা বসে রইলাম। চতুর্দিকে ঝিঁঝির ডাক, দূরে শোনা যাচ্ছে মাদলের শব্দ, শব্দটা সরে সরে যাচ্ছে, কোনও একটা দল মাদল বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে বনের পথ দিয়ে। এরই মাঝখানে যেন আমি আবার শুনতে পেলাম, নিলয়দার সেই ব্যাকুল ভাক, ভোলা না-থ। ভোলা-না-থ! অনু-তোষ!

কেউ সেই ডাকে সাড়া দেবে না। অনুতোষ নামে কেউ নেই। ভোলানাথ নামেও কেউ নেই। জঙ্গলের মধ্যে যাকে আমরা রেখে গিয়েছিলাম, সে একজন অন্য মানুষ। সে ইচ্ছে মতো চলে গেছে গভীর, গভীরতর বনে। সমুদ্র যেমন অতল সেই রকম সব অরণ্যই অসীম। ইচ্ছে করলেই হারিয়ে যাওয়া যায়।

শেষবার ভোলানাথ আমাকে বলেছিল, আমিও থাকব না, তুমিও থাকবেনা, কেউ থাকবে না। উপনিষদের ঋষিদের মতো অতি সরল অমোঘ কথা। ভোলানাথ নেই, আমরাও থাকবনা।

হঠাৎ যেন মনে হল, আজ থেকে কয়েক বছর বাদে, ঠিক এই জায়গাটাই, এই চেয়ারে আর এক জন মানুষ বসে আছে। অনেকটা আমারই মতো চেহারা, আমারই মতো হাতের মুঠোয় সিগারেট ধরে সে টানছে, কিন্তু সে আমি নয়। অন্য কেউ। আমি তখন কোথাও নেই। আর এক জন নিলয়দা আর একজন ভোলানাথকে ব্যাকুলভাবে ডাকবে। কিন্তু তাকেও পাবেনা। সেই আর একজন ভোলানাথ টাইমবাবু হতে অস্বীকার করে, জীবনের ধরাবাঁধা হিসেব অসমাপ্ত রেখে নিজের মনকে সঙ্গী করে কোথাও হারিয়ে যাবে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়