পুরুলিয়ার সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে চিঠির উত্তর এসেছে। সেই ডেনিশ ডাক্তারটির মৃত্যু হয়েছে এক মাস আগে। সেখানে পাগলের চিকিৎসা করার কোনও ব্যবস্থা নেই, সুতরাং আমাদের আর পুরুলিয়া যাওয়ার কোনও মানে হয় না। অবশ্য যাওয়ার কোনও প্রয়োজনও হবে না মনে হচ্ছে। ভোলানাথের উন্নতি ও পরিবর্তন সত্যিই বিস্ময়কর।

একটা সপ্তাহ কেটে গেছে, ভোলানাথ কোনও গণ্ডগোল করেনি। সারা দিন সে নিজের ঘরেই বসে থাকে, খাবার এলে চেটেপুটে খায়, নিজে নিজে স্নান করে, এমনকী নিজের জামা কাপড় পর্যন্ত কাচতে শুরু করেছে। চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার। বেশ বড় বড় দাড়ি হয়েছে ভোলানাথের, এখন তাকে অনেকটা সাধু সাধু দেখায়। সে কথাবার্তাও বলে প্রায় সাধুদের মতো। কিংবা দার্শনিকদের মতে, যদিও এমন কিছু দার্শনিকতা নেই তার মধ্যে।

নিলয়দা তো ভোলানাথকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। যেন এটা তার নিজেরই বিশাল জয়। স্বর্ণ এক দিন আমাকে বলেছিল, উপকারেরও একটা নেশা আছে, নিলয়দা সেই নেশায় মেতে আছে। ভোলানাথ নামে পাগলটিকে বাঁচাবার চেষ্টার মধ্যে নিলয়দার একটা গোপন অহঙ্কারও রয়ে গেছে। স্বর্ণ অতি বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে ধরেছে ঠিকই। এ-রকম হয়। তবে অহঙ্কার কিংবা নেশার জন্যও যদি কেউ অন্য মানুষের কিছু সাহায্য করে, সেটাও তো কম নয়।

আমি চিন্তিত অন্য কারণে। ভোলানাথকে কত দিন রাখা হবে ওই বোর্ডিং হাউসে? এর খরচ কে দেবে? নিলয়দা চাকরি ভালই করেন, কিন্তু সেরকম কিছু অবস্থাপন্ন নন। বাড়ির ট্যাক্সি নিয়ে কী একটা ঝামেলা হবার পর বকেয়া পঁয়তিরিশ হাজার টাকা ইনস্টলমেন্টে শোধ দিতে হচ্ছে। হোটেলে একটা উটকো মানুষ পুষতে গেলে মাসে অন্তত ছ’শো সাতশো টাকা লাগবেই। রূপাবউদি মাসের পর মাস এটা সহ্য করবেন কেন?

দ্বিতীয় কথা হল, ধরা যাক, ভোলানাথ একেবারে সুস্থ হয়ে গেল! তারপর কী হবে? এখনও সে তার নাম কিংবা পূর্ব পরিচয় মনে করতে পারছে না, কিংবা মনে পড়লেও বলছে না। পুরো সুস্থ হলে তা তো জানা যাবেই। হয়তো তার স্ত্রী আছে, ছেলে-মেয়ে আছে কোথাও, কত বছর আগে তাদের ফেলে চলে এসেছে কে জানে! আবার ভোলানাথ সেখানে ফিরে গিয়ে তাদের দায়িত্ব নেবে? নিতে পারবে? যদি ফিরে যেতে না চায়? অতীত একেবারে মুছে ফেলে সম্পূর্ণ নতুন জীবন শুরু করা সম্ভব? আমি এসব প্রশ্নের উত্তর জানি না।

রবিবার সকালে আমি যাইনি, নিলয়দা এগারোটা আন্দাজ আমার বাড়িতে এসে দারুণ উত্তেজনার সঙ্গে বললেন, জানিস, ভোলানাথ গান গাইতে পারে। চমৎকার গলা। আজ আমাকে দু’খানা গান শোনালো, নিখুঁত একেবারে, একটাও কথা ভুল করেনি!

আমিও এর মধ্যে ভোলানাথকে দু’একদিন গুন গুন করতে শুনেছি। শ্যামাসঙ্গীত ধরনের গান। সে-রকম একটা কিছু উঁচুদরের গলা বলে মনে হয়নি।

নিলয়দা বললেন, ও এক জন শিল্পী।

আমি নিলয়দাকে নিরুদ্যম করতে চাইলাম না। কৃত্রিম উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, সত্যি ভাল গান গায়। ইস, একটা প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।

তুই ভেবে দেখ নীলু, এক জন গায়ক, তার একটু মাথার গোলমাল আছে বলে রাস্তার লোকেরা তাকে মেরে ফেলবে? বড় বড় ডাক্তার দেখালাম, সবাই বললেন, ও চিকিৎসার অতীত। অথচ আমি নিজের চেষ্টায়, তুইও সাহায্য করেছিস অনেক, ওকে ভাল করে তুললাম তো।

নিলয়দা, সত্যি, তুমি যা করেছ, তার তুলনা নেই।

 নিলয়দার মুখে লজ্জা লজ্জা হাসি ফুটে উঠল। বললেন, আমার যেটুকু সাধ্য… এ-রকম তো সকলেরই করা উচিত… তোর সাহায্য না পেলে আমি আরও অনেক অসুবিধেয় পড়তাম। তুই আজ বিকেলে আয়, ভোলানাথের গান শোনাব। হরিবাবু শুনেছে। হরিবাবু কি বলল জানিস? বলল, আপনারা একে পাগল বলেছিলেন কেন মশাই? এর তো সব ঠিকঠাক আছে, এর চেয়ে ঢের বেশি পাগলকে আমি অফিস-টফিসে চাকরি করতে দেখেছি। এবার ওকে একটা কাজে লাগিয়ে দিন। হরিবাবুর কথাটা আমার মনে লেগেছে। ভোলানাথকে শুধু সুস্থ করে তুললেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হবে না, ওকে আবার জীবনে প্রতিষ্ঠিত করিয়ে দিতে হবে। ওর জন্য কাজ জোগাড় করতে হবে।

ভোলানাথ কী কাজ করবে?

আমি কি ভাবছি জানিস, ভোলানাথকে দিয়ে একটা গানের ফাংশান করব। রেডিও, টিভি, খবরে কাগজের লোকদের ডেকে শোনাব। তুই আজ বিকেলে আয়, তখন বসে প্ল্যান করা যাবে।

নিলয়দা, আজ বিকেলে আমি যেতে পারছি না।

তুই আজ আসবি না?

না, আমার একটা কাজ আছে।

কী কাজ?

 যেতে হবে এক জায়গায়।

নিলয়দাকে এগিয়ে দিতে এলাম বড় রাস্তা পর্যন্ত। শেষের দিকটায় বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম। আজ বিকেলবেলা স্বর্ণর সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, কিন্তু সে কথা নিলয়দাকে জানানো উচিত কি না বুঝতে পারলাম না। স্বর্ণ আমার সঙ্গে একলা দেখা করতে চেয়েছে এক জায়গায়, নিলয়দা সেকথা শুনলে ভাবতেন কি যে আমি তার শ্যালিকার সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করছি? কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম কিছুই নয়।

কান্নায় দূরত্ব মুছে যায়। মেয়েরা যার সামনে একবার বুক ভাসিয়ে কাঁদে, তাকে আর সহজে ছাড়তে চায় না। জয়নন্দনের সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে, সে কথা স্বর্ণ আমাকে এখনও বলেনি, কিন্তু সেই ছেলেটি সাংঘাতিক কোনও কঠিন কথা নিশ্চয়ই বলেছে ওকে। সেই দিন থেকে স্বর্ণর জীবনটাই নাকি পালটে গেছে। আমি সেদিন ওইভাবে সাহায্য না করলে ও নাকি পাগলই হয়ে যেত! এখন স্বর্ণ আমাকে ওর কাছাকাছি পেতে চায়, আমাকে অনেক কথা বলতে চায়।

কিন্তু এটা প্রেম নয়। আমার কাছে এসে স্বর্ণ তো সবসময় জয়নন্দনের কথাই বলে। জয়নন্দনকে কেন ওর পছন্দ হয়েছিল, জননন্দন যে এতটা খারাপ মানুষ, ও বুঝতে পারেনি ইত্যাদি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, স্বর্ণর মন এখনও জয়নন্দনের কাছেই বাঁধা দেওয়া আছে, তার কাছেই ফিরে যাবে। মাঝখানে কিছুদিন মান-অভিমানের পালা চলছে। এ-রকমভাবে অপরের প্রেমের প্রক্সি দিতে আমার একটুও ভাল লাগে না। এক দিন আমে-দুধে আবার মিশে যাবে, আমি আঁটির মতো বাইরে পড়ে থাকব।

অথচ একটি যুবতী কন্যা নিরালায় দেখা করতে চাইলে তা প্রত্যাখ্যানই-বা করা যায় কীভাবে? আমি তো আর বলতে পারি না, আমি কাজে ব্যস্ত। আমার ব্যস্ততার কথা শুনলেই সবাই হাসে।

সাড়ে পাঁচটার সময় রেডিও স্টেশনের সামনে দেখা করবার কথা, আমারই পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেল। নির্ধারিত জায়গায় পুরুষদেরই আগে পোঁছনো উচিত, মেয়েদের দাঁড় করিয়ে রাখা অন্যায়। কিন্তু স্বর্ণ রাগ করল না। আমি কাচুমাচু হয়ে ক্ষমা চাইতেই ও হেসে ফেলে বলল, আমারই তো দোষ, আমার উচিত ছিল দশ মিনিট দেরি করে আসা। তুমি সাঁতার জানো?

প্রশ্নটা একটু অপ্রত্যাশিত। আমি বিস্ময় গোপন করে বললাম, হ্যাঁ, জানি। অনেক দিন অভ্যেস নেই অবশ্য। কেন বলো তো?

সাঁতার জানো, তাহলে তুমি নিশ্চয়ই নৌকোয় উঠতে ভয় পাবেনা! জয় খুব জলকে ভয় পায়। ওর জন্য আমার কোনও দিন নৌকোয় বেড়ানো হয়নি।

সাঁতার শিখতে আর কদিন লাগে? শিখে নিলেই পারে।

ও সাঁতার শিখুক না-শিখুক, তাতে এখন আর কিছু যায় আসে না। আমি জয়ের চেহারাটাও ভুলে গেছি। তুমি যদি সে-দিন ট্যাক্সিতে না উঠতে, তাহলে আমি কোনও দিন পুরুষ জাতটাকেই ক্ষমা করতে পারতাম না! আজ যে শাড়িটা পরেছি, আমাকে মানিয়েছে?

তোমাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। যে-কোনও রঙই তোমাকে মানায়, তবু এই আকাশি নীল রঙটা যেন আরও সুন্দর।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর তুমি বললে, জয়ের একটা গুণ আছে, ও রঙটা খুব ভাল বোঝে। এটা আকাশি নীল নয়, এটা টারকয়েজ ব্লু!

হ্যাঁ, আমি রঙটা ভাল বুঝি না। নৌকোয় বেড়াবে, চলো তাহলে আউট্রাম ঘাটের দিকে যাই।

নীল রঙ কত রকম হয় জানো?

 স্বর্ণ, আমি শুধু জানি মানুষের দুঃখের রঙ নীল।

তুমি দুঃখের কী জানো? তোমার তো সব সময় ইয়ার্কি ইয়ার্কি ভাব।

 হাঃ হাঃ হাঃ।

 হাসছ কেন, এটা কি হাসির কথা? জয়েরও এই এক দোষ, যখন তখন, কোনও মানে নেই, তবু হেসে ওঠে। এক দিন হয়েছে কী —

চলো, স্বর্ণ, রাস্তাটা পার হয়ে যাই।

আমার হাত ধরতে হবে না। আমি কি কচি মেয়ে নাকি?

 শুধু কচি মেয়েদেরই বুঝি হাত ধরতে হয়?

তুমি কি জয়কে চেনো? তোমার সঙ্গে আলাপ আছে?

ও-রকম খারাপ ছেলেদের সঙ্গে আমি আলাপ করি না। যারা মেয়েদের মনে আঘাত দেয়, বৃষ্টির মধ্যে বান্ধবীর সঙ্গে সামান্য ঝগড়া করে যারা একা ছেড়ে দেয় ।

স্বর্ণ আমার দিকে গাঢ়ভাবে তাকিয়ে বিষণ্ণ ভাবে বলল, নীলকমল, তুমি আমার সামনে আর জয়ের নাম উচ্চারণও করবে না। আমি ওকে আমার জীবন থেকে মুছে ফেলেছি।

আমার নাম নীলকমল নয়। অনেকে আমাকে নীলু বলে ডাকে।

আমি তোমাকে নীলকমল বলেই ডাকব। নীলু কী একটা বাজে নাম! ছেলেদের ছোট নাম আমার পছন্দ নয়।

তুমি তো জয়নন্দনকে ছোট করে জয় বলে ডাকো।

বললাম না, ওই নাম তুমি আমার সামনে কখনও উচ্চারণ করবে না।

স্বর্ণ, ফুচকা খাবে?

 ফুচকা? তুমি আমাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই সব খেতে বলছ?

হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে? ফুচকা, আলু চটপটি এগুলো চমৎকার জিনিস। গঙ্গার ধারে… এখানে তোমাকে কে দেখতে পাবে?

জয়ের বাবা রোজ এখানে ইভনিং ওয়াক করতে আসে। হ্যাঁ, ফুচকা খাব। দেখুকনা, জয়ের বাবা দেখলে আমার বয়ে গেল! ওদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

তবু ফুচকা খেতে খেতে স্বর্ণ বার বার এ-দিক ও-দিক চেয়ে দেখতে লাগল, যেন কারুকে খুঁজছে। ও ফুচকা খেতেই জানে না। তেঁতুলজলটা ফেলে দিচ্ছে আগে, অথচ ওটাই তো আসল।

নৌকো খুঁজতে খুঁজতে আমরা গঙ্গার ধার ধরে হেঁটে এলাম অনেকটা। স্বর্ণ অনবরত জয়ের কথা বলে যেতে লাগল। জয়ের সঙ্গেও এ-দিকটায় প্রায়ই বেড়াতে আসত, তা বোঝা গেল। দোতলা রেস্তোরাঁটার দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই যে কোণের দিকে জানলার ধারের টেবিলটা, ওটা ছিল আমাদের জন্য বাঁধা, আমরা প্রত্যেক শনিবার ওখানে এসে বসতাম। জয় তো নৌকোয় চড়ে না, ওখানে বসে বসেই আমরা নৌকো দেখতাম। আগের মাসে সেই যে একদিন দারুণ ঝড় উঠেছিল।

জয় কোনও জায়গা থেকে লুকিয়ে এখন আমাদের লক্ষ্য করছে না তো? তোমার সঙ্গে আমাকে দেখলে জয় নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবে। সুতরাং, আমি বলছিলাম কী –।

নীলকমল, তোমাকে বলেছি না, তুমি আমার সামনে জয়ের নাম উচ্চারণ করবে না? চলো। নৌকোয় চাপব!

আমি আবার অকারণে হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলাম। নিলয়দা যদি কোনও দিন জিজ্ঞেস করে যে তুই কেন আমার শ্যালিকাকে নিয়ে গঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়েছিলি? তাহলে আমি বলব, তোমার শ্যালিকা পাগল হয়ে যাচ্ছিল, আমি তার চিকিৎসা করছিলাম।

বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হল। ফিরেই মায়ের কাছে শুনলাম, নিলয়দা এর মধ্যে দু’বার এসে আমার খোঁজ করে গেছে। খুব জরুরি দরকার, আজ রাত্তিরেই ফোন করতে বলেছে।

আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী দরকার কিছু বলেনি?

মা বলল, না, কিছু বলল না, বসতেও চাইল না। খুব রেগে আছে মনে হল।

 নিলয়দা এর মধ্যেই জেনে গেছে স্বর্ণর ব্যাপরাটা? গঙ্গায় আমাদের দু’জনকে কেউ নৌকোয় বেড়াতে দেখে সোজা নিলয়দার কাছে গিয়ে রিপোর্ট করেছে? কিন্তু স্বৰ্ণর সঙ্গে যদি আমার সত্যিই একটু ভাব-ভালবাসা হত, তাতেই-বা নিলয়দা আপত্তি করবে কেন? আমি কি এতটাই অযোগ্য?

এত রাতে পাশের ফ্ল্যাট থেকে ফোন করা যায় না। সামনের মোড়ে একটা ওষুধের দোকান অনেকক্ষণ খোলা থাকে, সেখান থেকে ফোন করা যেতে পারে। জামাটা গলিয়ে আবার বেবিয়ে পড়লাম।

ওষুধের দোকান পর্যন্ত যেতে হল না, তার আগেই দেখলাম নিলয়দা হন হন করে হেঁটে আসছে। উদভ্রান্তের মতো চেহারা।

কাছে এসে আমার হাত চেপে ধরে ব্যাকুল ভাবে জিজ্ঞেস করল কোথায় ছিলি নীলু। তোকে আমি সারা কলকাতা খুঁজছি, কফি হাউসেও গিয়েছিলাম।

প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে নিলয়দা?

সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে রে! সব নষ্ট হয়ে গেল! এত দিনের পরিশ্রম, এত চেষ্টা, ছি ছি ছি!

ভোলানাথের কিছু হয়েছে?

কী সুন্দর প্রোগ্রেস করছিল, আর কয়েকটা দিন, লোকে যদি একটু সাহায্য করত– ।

 কী হয়েছে, বলো না!

 ও বেঁচে আছে না মরে গেছে, তাই জানি না।

অ্যাঁ? সেকী। মরে গেছে মানে? বোর্ডিংহাউস ছেড়ে চলে গেছে? পালিয়ে গেছে?

ওকে থানায় ধরে নিয়ে রেখেছে।

 থানায়… আবার কারুকে মেরেছে?

সকালে তোকে বললাম তো, কী সুন্দর গান শোনাল? আমার সঙ্গে অনেক কথা বলল, চমৎকার ব্যবহার, কিছুই বোঝা যায়নি।

বিকেলে ওখানে গিয়ে দেখি হই হই কাণ্ড। আমি পৌঁছবার একটু আগেই ঘটনাটা ঘটে গেছে। ইস, একটু আগে যদি যেতাম।

নিলয়দা একটা বাড়ির দেয়ালে হেলান দিয়ে মাথায় হাত দিল। যেন নিলয়দার একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেছে। গুরুতর শোকগ্রস্ত মানুষ আমি বিশেষ দেখিনি, তবে এর চেয়ে বেশি আর কী হতে পারে। নিলয়দা একেবারে বিধ্বস্ত! এটা শোক, না পরাজয়?

আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, কাকে কামড়াল, এবার কোনো পুরুষকেই?

 মাথা থেকে হাত নামিয়ে নিলয়দা বললেন, ওরা তো বলছে, তিন জনকে। এক তলার হোটেলে এক জন ঝি ছিল, সে ছাদে উঠেছিল কাপড় শুকোতে দিতে প্রথমে… ভোলানাথ তাকে কামড়ে দেয়, সেই ঝি কোনওক্রমে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, ভোলানাথ তাকে তাড়া করে যায়, তারপর রাস্তার আর দুটি মেয়েকে কামড়ে দিয়েছে। তার মধ্যে একটা মেয়ের বয়েস তেরো-চোদ্দ বছর, তবে কারুরই বেশি কিছু ক্ষতি হয়নি শুনলাম। রাস্তার লোকেরা তখন ভোলানাথকে মারতে মারতে মাটিতে শুইয়ে ফেলে! একেবারে মেরেই ফেলত, হরিবাবু দৌড়ে গিয়ে একটা পুলিশ ডেকে আনে। সেই পুলিশ তখন ওকে টানতে টানতে থানায় নিয়ে যায়। হবিবাবু বলল, ভোলানাথ যা মার খেয়েছে, তাতে ওর পক্ষে এখন বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্য।

কোন থানায় নিয়ে গেছে?

ভবানীপুর থানায়। সেখানে আমি গিয়েছিলাম। কিছুতেই জামিনে ছাড়তে রাজি হলনা। ভোলানাথের সঙ্গে আমাকে একবার দেখা করতেও দিল না। সেই জন্যই তো সন্দেহ হচ্ছে… অবশ্য বলল যে কাল কোর্টে কেস উঠবে, সেই সময় দেখা করতে!

ভোলানাথের জন্য আমার একটু একটু কষ্ট হল, কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি কষ্ট হল নিলয়দার জন্য। নিলয়দার মুখে একটু আলো নেই, চোখ দুটো ঘষা কাচ।

ভাঙা ভাঙা গলায় নিলয়দা বলল, এত চেষ্টা করলাম, কিছুই হল না। সবনষ্ট হয়ে গেল! সব ব্যর্থ হল!

.

০৮.

নখী, শৃঙ্গী, পুলিশ ও উকিলদের থেকে শত হস্ত দূরে থাকার উপদেশ দিয়েছেন শাস্ত্রকারগণ। এত দিন আমি শুধু গল্প-উপন্যাসেই কোর্টের বর্ণনা পড়েছি। এবারে সেখানে যেতে হল নিলয়দার সঙ্গে।

আমি আর নিলয়দা সাড়ে দশটার মধ্যেই ব্যাঙ্কশাল কোর্টে হাজির, কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল আমাদের কেস উঠবে দুটোর পর। গেট দিয়ে ঢোকার মুখেই কয়েক জন দালাল আমাদের ছেঁকে ধরেছিল সস্তায় ভাল উকিল ঠিক করে দেবে বলে, কিন্তু আমরা কোনও উকিল নিইনি। দো-তলা তিন তলায় গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম দুজনে। কোনও কোনও ঘরে কেস চলছে। কোনও কোনও ঘর খালি। ঘরগুলো বেশি বড় নয়। হিন্দিসিনেমার আদালত-দৃশ্যে যেসব বিরাট বিরাট ঘর দেখানো হয়, সেগুলো বোধহয় হাইকোর্টের। এখানে যে-সব লোকজনদের দেখছি, প্রত্যেকেরই কী-রকম দাগি দাগি চেহারা। কে জানে, অন্যরাও আমাদের দেখে সেই রকম ভাবছে কিনা।

আমরা একটাও বাক্য বিনিময় করছি না। আসলে সকালবেলাতেই নিলয়দার সঙ্গে আমার একটু মন কষাকষি হয়ে গেছে। আমার দোষের মধ্যে এই যে, আমি বলেছিলাম, নিলয়দা, কোর্ট-ফোর্টে যাবার দরকার কী? ভোলানাথকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, এখন ওকে নিয়ে কী করা উচিত তা পুলিশই বুঝবে, আমাদের তো আর কোনও দায়িত্ব নেই।

নিলয়দা আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়েছিল, যেন আমি একটা জঘন্য পাপী! এ-রকম খারাপ কথা সে জীবনে শোনেনি। দারুণ আহত ভাবে বলেছিল, আমরা কোর্টে যাব না? তুই.. তুই কী বলছিল নীলু? আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ভোলানাথ এ-দিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজবে.. তার কোনও আত্মীয়-স্বজন, চেনা কারুকে দেখতে পাবে না, তখন তার মনের অবস্থা কীরকম হবে বল তো?

ভোলানাথের মনের অবস্থা নিয়ে চর্চা করার সাধ্য আমার আর নেই। মেয়েদের দেখলেই একটা লোক কামড়াতে যাবে, এ কী ধরনের পাগলামি! ওর জন্য কি পৃথিবীটা নারী-বর্জিত করে দিতে হবে?

কিন্তু নিলয়দা, আমরা তো ওকে পুলিশের হাতেই তুলে দিতে চেয়েছিলাম?

সে তো অন্য কথা! পুলিশকে সব বুঝিয়ে বলতাম, তারপর পুলিশ যদি ওকে কোনও হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থা করত, আমরা মাঝে মাঝে ওকে দেখতে যেতাম… কিন্তু এখন পুলিশ ওকে ক্রিমিনাল চার্জে অ্যারেস্ট করেছে, থানায় জেরা করার নামে আরও কত অত্যাচার করেছে কে জানে… জজের কাছে মিথ্যে চার্জ দিয়ে দেবে, আমরা যদি কেস ডিফেন্ড না করি, জজ যদি ওর ফাঁসির হুকুম দিয়ে দেন?

ফাঁসি? আজকাল কারুর ফাঁসি হয় নাকি? ফাঁসি তো উঠে গেছে।

ফাঁসি উঠে গেছে? কে বলল তোকে?

 রিসেন্টলি কোনও ফাঁসির ঘটনা তুমি শুনেছ? কিংবা কাগজে পড়েছ?

হ্যাঁ, ইয়ে, অনেক তো হয়… এই তো ভুট্টোর ফাঁসি হল!

 সে তো পাকিস্তানে! ইন্ডিয়াতে আর ফাঁসি হয় না!

হ্যাঁ, হয়! কাগজে পড়েছি.. মনে পড়েছে, বিল্লা-রঙ্গা? ওদের কী হল?

ওদের ফাঁসি হয়েছে? কী জানি! কিন্তু ভোলানাথ তো খুন-টুন করেনি, মাত্র তিনটে মেয়েকে কামড়ে দিয়েছে!

যে তিন জন মেয়েকে কামড়েছে, মনে কর, তাদের কারুর সেপটিক হয়ে গেল, তারপর তাতেই মরে গেল, সেটাও তো খুন!

বউদিকে আর স্বর্ণকেও তো কামড়ে দিয়েছিল, ওদের তো সেপটিক হয়নি!

কী বাজে কথা বলছিস, নীলু? ওদের হয়নি বলে অন্য কারুর হতে পারে না? ওদের আস্তে কামড়েছিল।

যাই বলল নিলয়দা, ফাঁসিটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। ওর যাবজ্জীবন জেল হতে পারে, সেইটাই সব চেয়ে ভাল হবে। জেলের মধ্যে হাসপাতাল থাকে, আমি অনেক বইতে পড়েছি, সেখানে ভোলানাথের চিকিৎসা হবে।

তার আগে ওকে পাগল বলে প্রমাণ করতে হবে না? আমরা যদি ওকে ডিফেন্ড না করি, কে ওকে পাগল বলে বুঝবে? চোর-ডাকাত-খুনেদের সঙ্গে যদি ওকে রেখে দেয়, তারা ওকে জ্বালাতন করে মারবে। মানুষ হিসেবে ভোলানাথ যে অনেক উচ্চস্তরের।

কিন্তু নিলয়দা, জেলখানাই একমাত্র জায়গা, যেখানে কোনও মেয়ে থাকে না। একমাত্র জেলখানাতেই ভোলানাথ সুস্থ থাকবে!

জেলেও ফিমেল ওয়ার্ড থাকে। মেয়েরা বুঝি ক্রিমিনাল হয় না?

ফিমেল ওয়ার্ড নিশ্চয় আলাদা জায়গায়। জেলের মধ্যে কখনও ফ্রিমিক্সিং থাকতে পারে? তাহলে তো অনেকেই জেলে যেতে চাইত?

আমি তোর সঙ্গে তর্ক করতে চাই না, নীলু? তুই যেতে না চাস, ওয়েল অ্যান্ড গুড, আমাকে যেতেই হবে! আমি এত কষ্ট করলাম ওর জন্য, এখন ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব। আমি ওর কেস ডিফেন্ড করব।

তুমি ওকে ছাড়িয়ে আনতে চাও? ছাড়িয়ে এনে এবারে কোথায় রাখবে?

না, ছাড়িয়ে আনতে চাই না। জজ সাহেবকে বোঝাব যে ও ঠিক কীরকম মানুষ। ওকে জেলেই রাখা হোক, কিন্তু ওর সঙ্গে যেন ভাল ব্যবহার করা হয়, ওকে গান গাইবার সুযোগ দেওয়া হয়।

কিন্তু ডিফেন্ড করা মানে কী? তার মানে তো ওর বিরুদ্ধে যা অভিযোগ তা খারিজ করা। ওকে নির্দোষ প্রমাণ করা।

ও তো নির্দোষই বলতে গেলে! সজ্ঞানে, বুঝে শুনে তো ও মেয়েদের কামড়াতে যায় না!

নির্দেষ প্রমাণ করলে জজ ওকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন!

না না, ওকে এক্ষুনি ছেড়ে দেওয়া হোক, তা আমরা চাই না। কোর্টে গিয়ে এক জন উকিল ঠিক করব।

উকিলকে বলব যে, আমরা মশাই আমাদের কেসে জিততে চাই না। আমাদের মক্কেল জেলেই থাকুক, সেটাই আমরা চাই। তবে কিনা, জেলের মধ্যে কে যেন বেশ আদর-যত্ন করা হয়।

এ কথা শুনলে উকিলবাবু আমাদেরই পাগল ভাববেন না?

আহা-হা, ব্যাপারটা সে-রকম নয়।

 নিলয়দা, আমার মতে, আমাদের এখন ক্লিন চেপে যাওয়াই ভাল। তুমি ভোলানাথের জন্য অনেক চেষ্টা করেছ, দেখলে তো, তাতে কোনও লাভ হলো না। কোর্টে গেলেই তুমি আবার ওই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়বে। তার চেয়ে বরং রূপাবউদি আর পাপুনকে নিয়ে পুরী কিংবা দার্জিলিং বেড়িয়ে এস কয়েক দিন।

নিলু, আমি কোনও দায়িত্ব নিলে মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাই না। ভোলানাথ এক জন মানুষ, কোনও জন্তু-জানোয়ার তো নয় যে যখন তখন ত্যাগ করা যায়! তুই আমি চেষ্টা করেও ওকে পুরোপুরি সাহয্য করতে পারিনি। এক-আধ জনের চেষ্টায় কিছু হয় না, রাষ্ট্রের উচিত ওর দায়িত্ব নেওয়া। অমাদের ওয়েলফেয়ার স্টেট না? সেই কথাই অমি আদালতকে বোঝাব!

নিলয়দা, তুমি যা বলছ, তা নিয়ে খবরের কাগজে প্রবন্ধ লেখো। কোর্টে যাবার দরকার কী?

 তোকে যেতে হবে না, নীলু। আমি একলাই যাব!

সুতরাং আমাকে আসতেই হয়েছে। নিলয়দা অবশ্য এখনও আমার সঙ্গে ভাল করে কথাই বলছে না, মুখখানা উদাসীন করে আছে। ভোলানাথ জেল খাটবে, এই ব্যাপারটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না নিলয়দা।

দুটো পর্যন্ত সময় কাটাতে হবে, তাই আমরা একটা কোর্ট রুমে ঢুকে বসে পড়লাম। খাঁচার মতো একটা জায়গায় তিন জন মহিলা আর দু’জন লোককে ভরে রাখা হয়েছে, এক জন উকিল দাঁড়িয়ে একটানা কী সব বলে যাচ্ছে। মামলাটা যে কীসের তা আমরা বেশ কিছুক্ষণ বুঝতেই পারলাম না। কাগজের আইন-আদালতের বিবরণ পড়ে আমার ধারণা ছিল, কোর্ট রুম বুঝি সব সময় সরগরম থাকে! কিন্তু এখানে তো কোনও রকম কথা কাটাকাটি, উত্তেজনা কিছুই নেই। জজের মাথায় পরচুল নেই। পাকানো গোঁফ নেই, নিছকই সাধারণ চেহারার এক জন মাঝবয়সী ভদ্রলোক! খানিক বাদে বুঝতে পারলাম, এটা একটা গৃহবধু হত্যার মামলা। রূপালি রায় নামে একজন শৌখিন অভিনেত্রীর আগুনে পুড়ে মৃত্যুর খবর কয়েক দিন আগেই পড়েছি। কিন্তু রোমাঞ্চকর কোনও তথ্যই জানা গেল না, উকিলবাবুটি শুধু একঘেয়ে ভাবে রূপালি রায়ের স্বামীর অ্যাকাউন্টের বিভিন্ন দিনের হিসেব পড়ে শোনাতে লাগলেন।

এক জন মহিলাকে দেখে বেশ চমকে উঠলাম। আমি জানতাম যে মেয়ে-উকিল শুধু হিন্দি সিনেমাতেই দেখা যায়, ওঁদের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এখানে সামনের সারিতে কালো গাউন পরে এক জন মহিলা বসে আছেন, তিনি দাঁড়ানো উকিলটির হাতে মাঝে মাঝে দু’একটা কাগজপত্র তুলে দিচ্ছেন। ভদ্রমহিলা খুবই সুন্দরী। অনেক সিনেমার নায়িকাই ওঁর কাছে হার মেনে যাবে।

আমি নিলয়দাকে ফিস ফিস করে বললাম, ওই মেয়ে-উকিলটিকে দেখেছ? দারুণ না?

রমণীর রূপ চর্চা করার মতো মনের অবস্থা নয় এখন নিলয়দার। আমার দিকে একটা রূঢ় দৃষ্টি দিয়ে বলল, চল, এখানে আর ভাল লাগছে না।

আর একটু বস না, যদি ওই মহিলা উঠে কিছু বলেন, সেটা শুনে যাই।

 তুই বোস তাহলে! আমি বাইরে আছি।

অগত্যা আমাকেও উঠতে হল। বেরিয়ে এসে করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, নিলয়দা, আমি যদি কখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়ি, তুমি আমার জন্য ওই ভদ্রমহিলা-উকিলকে ঠিক কোরো।

নীলু, তোর এ-সব ইয়ার্কি এখন আমার ভাল লাগছে না।

নিলয়দা, তুমি দিন দিন বড় শুকনো সমাজসেবী হয়ে যাচ্ছ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন রসে-বশে থাকতে! সুন্দরী মহিলা দেখলেই আমার শ্রীরামকৃষ্ণের এই কথাটা মনে পড়ে যায়।

আরও দু’তিনটি আদলত কক্ষে আমরা উঁকি দিয়ে দেখলাম। কোথাও মজার ব্যাপার কিছু নেই। মাত্র সাড়ে এগারোটা বাজে, দুটো বাজতে অনেক দেরি, সময় যেন আর কাটছেই না।

ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে বেরিয়ে আমরা লালদিঘিতে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর একটা দোকানে ঢুকে মোগলাই পরোটা আর মাংসর লাঞ্চ খেলাম। তারপর পৌনে দুটো বাজতে না বাজতেই চলে এলুম ন’নম্বর কোর্ট রুমে।

খাঁচার মধ্যে ছ’সাত জন আসামিকে ভরে রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে দেখতে পেলাম ভোলানাথকে। গায়ের জামাটি ছিন্নভিন্ন, মুখে ময়লা মাখা, কপালে ব্যান্ডেজ। একেবারে চেনাই যায় না!

ভোলানাথ নিলয়দাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, বাবা! বাবা!

পাশে দাঁড়ানো এক জন সেপাই বলল, চোপ! কথা বলার কানুন নেই!

ভোলানাথ লোহার গরাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তবু বলল, বাবা! ও বাবা!

সেপাইটি একটা রুল দিয়ে গরাদের ওপর মেরে বলল, চোপ! চোপ!

এক জন আসামি ভোলানাথের হাত ধরে টেনে ঠেলে দিন ভেতরের দিকে।

নিলয়দা বিমূঢ় ভাবে তাকাল আমার দিকে। ভোলানাথের এ কী নতুন পরিবর্তন, হঠাৎ বাবা বলে ডাকছে! আগে তার মুখে কোনও রকম ডাকই শোনা যায়নি। নিলয়দা কিংবা আমার নাম সে মনে রাখতে পারে না।

হাকিম এখনও আসেননি। পাশের ছোট টেবিলে পেশকার বসে আছেন, তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোর্ট-ইনসপেকটর। ছ’সাত জন উকিল বসে আছেন সামনের দিকে, আমরা দুজন ছাড়া বাইরের লোক আর কেউ নেই।

এক জন উকিলবাবু পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের ল-ইয়ার কে? কী কেস?

 নিলয়দা উত্তর দেবার আগেই আমি বললাম, আমাদের কোনও ল-ইয়ার নেই। আমরা এমনি দেখতে এসেছি।

ওই আসামি বাবা বলে কাকে ডাকল?

 তা জানি না।

 নিলয়দার চেয়ে ভোলানাথ বয়সে অন্তত সাত-আট বছর বড়। সে হঠাৎ নিলয়দাকে বাবা বলে ডাকতে গেল কেন কে জানে!

কোর্ট-ইনসপেকটরের মুখখানা দেখলে বেশ সরল, ভালমানুষ মনে হয়। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু’একবার মুখ তুলে আমাদের দেখছেন। ভোলানাথ আর দু’বার বাবা বলে চেঁচিয়ে উঠল। আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা অজানা ভয়ের উত্তেজনার সঞ্চার হচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে, এখান থেকে এক্ষুনি চলে গেলে ভাল হয়।

কোট-ইনসপেকটর হাতছানি দিয়ে নিলয়দাকে ডাকলেন। আমিও উঠে গেলাম নিলয়দার সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কোন কেস?

নিলয়দা বললেন, ওই যে ভেতরে রয়েছে, কাল কালীঘাটে তিন জন মেয়েকে… মানে, অনেকটা ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার।

আমি জোর দিয়ে বললাম, তিন জন মেয়েকে কামড়ে দিয়েছে। একটি মেয়ের বয়েস তেরো চোদ্দ বছর!

নিলয়দা বিরক্ত ভাবে তাকাল আমার দিকে। আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কোর্ট-ইনসপেকটর একটা খাতা উলটে বললেন, হ্যাঁ, কালীঘাটে, মলয়া বোর্ডিং হাউসের সামনে… পেটি কেস! ও-পক্ষের কেউ ডায়েরি করেনি! আসামি আপনাদের কে হয়!

আমি বললাম, কেউ না!

আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিলয়দা বলল, আমাদের বিশেষ পরিচিত। দেখুন, ও মানুষটি অতি ভাল, একটু মাথার গোলমাল আছে, বেশির ভাগ সময়ই ঠিক থাকে, মাঝে মাঝে হঠাৎ!

কী বললেন, মাথার গোলমাল আছে!

হ্যাঁ স্যার। তবে ওকে দেখাশুনো করার কেউ নেই তেমন… আপনারা ওকে জেলেই রাখুন, জেলে যদি ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন–

ঠিক আছে, বসুন গিয়ে।

নিলয়দা তবু অনুনয় করে বলল, একটু কনসিডার করবেন। সাধারণ পাগলের মতো ওকে ট্রিট করবেন না। আপনাকে স্পেশালি রিকোয়েস্ট করছি।

এই সময় হাকিম এসে ঢুকতেই সকলে উঠে দাঁড়ালেন। আমরা নিজেদের জায়গায় ফিরে এলাম। এরপর মিনিট পনেরো কিছুই হল না। পেশকারের সঙ্গে হাকিম কী সব কথা বলতে লাগলেন।

প্রথমে অন্য এক জন আসামির নামে হাঁক পড়ল। সওয়াল-জবাব কিছুই হল না। একজন উকিল উঠে দাঁড়িয়ে এক মাস বাদের ডেট চাইলেন, হাকিম তা মঞ্জুর করে দিলেন। দ্বিতীয় আসামির ক্ষেত্রেও সাক্ষী আসেনি, তার উকিল মেডিক্যাল সার্টিফিকেট পড়ে শোনাতে যাচ্ছিলেন, হাকিম বললেন, ঠিক আছে। আপনি কবে তারিখ চান?

ভোলানাথের নামটি আমার দেওয়া, কিন্তু ও নিজে সে নাম বলতে পারে না। পুলিশ কী করে জানল? হরিবাবুর কাছ থেকে শুনেছে? পুলিশ আবার তার সঙ্গে একটা দাস বসিয়ে দিয়েছে। হাঁক পড়ল, ভোলানাথ দাস!

ভোলানাথকে খাঁচা থেকে বার করে এনে দাঁড় করানো হলে কাঠগড়ায়। কোর্ট-ইনসপেকটর বিড় বিড় করে হাকিমকে কী যেন বোঝালেন। হাকিম খস খস করে সই করে দিলেন একটা কাগজে। কোর্ট-ইনসপেকটর মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, খালাস! আপনাদের লোক নিয়ে যান।

ব্যাপারটা যেন চোখের নিমেষে ঘটে গেল। বিচারের এই নমুনা। আমি উত্তেজনা দমন করতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললাম, স্যার, আমরা ওর খালাস চাই না! ও পাগল। গভর্নমেন্টের উচিত ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

হাকিম মুখ তুলে ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন আমার দিকে। কোর্ট-ইনসপেকটর কঠিন মুখ করে বললেন, ডিসটার্ব করবেন না, বাইরে যান। এক জন উকিল আমাকে বললেন, কী করছেন, ভাই? কনটেমট অফ কোর্ট হয়ে যাবে। বাইরে চলে যান! খালাস পেয়ে গেছেন তো।

ভোলানাথকে ছেড়ে দিতেই সে ছুটে এসে নিলয়দাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে বলতে লাগল, বাবা বাবাগো, আমার খিদে পেয়েছে। আমাকে ওরা মেরেছে! বাবা, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।

রুল উঁচিয়ে সেপাই বলল, বাহার যাও! বাহার যাও! হল্লা মাৎ করো। যাও, নিকালো।

কারা যেন প্রায় ঠেলতে ঠেলতেই বার করে দিল আমাদের তিন জনকে। নিলয়দার চোখে জল চিকি চিক করছে। ভোলানাথ ঠিক একটা বাচ্চা ছেলের মতো নিলয়দাকে জড়িয়ে ধরে মাথা ঘষছে তার বুকে।

নিলয়দা ফ্যাকাসে গলায় বলল, কী হয়ে গেল বল তো, নীলু? ভাবতেই পারিনি যে এ-রকম হবে।

নিলয়দার ওপর আমার এমন রাগ হচ্ছে যে, ওর দিকে আমার আর তাকাতেই ইচ্ছে করছে না। নিলয়দারই তো সব দোষ! কোর্ট-ইনসপেকটরের সঙ্গে ও-রকমভাবে কথা বলতে গেল কেন? চেনা লোককে জেল খাটানোর জন্য কেউ কাকুতি মিনতি করে? সরকার একটা পাগল ক্রিমিনালের দায়িত্ব নিতে চায় না, সে-দায়িত্ব চাপিয়ে দিল নিলয়দার ঘাড়ে। এখন ভোলানাথকে আমরা কোথায় নিয়ে যাব?

কোর্টের বাইরে বেরিয়ে আমরা কেন যে ডান দিকে না গিয়ে বাঁ-দিকে হাঁটতে লাগলাম তা আমরা কেউই জানি না। ভোলানাথ নিলয়দার হাত জড়িয়ে ধরে অনবরত বক বক করে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ অসম্বন্ধ প্রলাপ। রাস্তার লোকেরা আমাদের এ-দিকে ফিরে ফিরে দেখছে।

একজায়গায় ভোলানাথ থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে এ-এ-এ-এ আওয়াজ করতে লাগল। মুখটা ফাঁক, তার জিভটা বেরিয়ে এসেছে, চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। দুটি মেয়ে রাস্তা পার হয়ে আসছে আমাদের দিকে, ভোলানাথের চোখ সেই দিকে।

আমি মেয়ে দুটিকে আড়াল করে ভোলানাথের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। ভোলনাথকে বুকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললাম, ফের যদি তুমি কোনও মেয়ের দিকে তাকাও, আমি তোমার সবকটা দাঁত ভেঙে দেব।

আগে পাগল দেখলেই আমি সাঙ্ঘাতিক ভয় পেতাম, অথচ আজ আমার এতখানি সাহস হল কী করে? মরীয়া হয়ে উঠলে বোধহয় সব মানুষই সাহসী হয়।

আমার শাসানি শুনে ভোলনাথ নিলয়দাকে চেপে ধরে বলল, বাবা, আমাকে মারবে। আমাকে মেরো না। আমার খিদে পেয়েছে।

এতক্ষণ নিলয়দার সঙ্গে কথা বলিনি, তবু এবার বলতেই হল, নিলয়দা এই ভাবে ওকে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। দুপুরবেলা ডালহৌসিতে অনেক মেয়ে।

নিলয়দা বলল, ওই তো একটা ট্যাক্সি আসছে। ওটা ধরা যাক। কিন্তু যে খিদে পেয়েছে বলছে?

 নিলয়দা ভোলানাথকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল, আমি রাস্তার ধারে একটা লোক ভুট্টা পোড়াচ্ছিল, তার কাছ থেকে দুটো ভুট্টা কিনে আনলাম। ভোলানাথ সেই ভুট্টা দুটো নিয়ে ডাটা-ফাটাসুদ্ধ চিবিয়ে খেতে শুরু করে দিল।

ট্যাক্সিওয়ালা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?

 নিলয়দা আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকাল। আমি কঠিন মুখ করে বললাম, গঙ্গার ধারে।

গতকাল সন্ধ্যায় যেখানে স্বর্ণরসঙ্গে নৌকোয় চেপেছিলাম, ঠিক সেই জায়গার কাছাকাছি আসতেই আমি ট্যাক্সি থামাতে বললাম। নিলয়দাকে বললাম, এখানে নামো। ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, আপনি একটু অপেক্ষা করুন ভাই।

যেন আমিই বয়েসে বড়, নিলয়দা আমার কথা শুনতে বাধ্য। ছেলের মতো নেমে পড়ল। ভোলানাথও নামল। প্রথম ভুট্টাটা শেষ করে সে এখন দ্বিতীয়টা খাচ্ছে কচরকচর করে। গোটা একটা আস্ত ভুট্টা যদি কেউ খায়, তা কি তাকিয়ে দেখা যায়? আমি ওর দিকে চোখই ফেলছি না। ও কিন্তু নিলয়দার একটা হাত চেপে ধরে আছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, হোয়্যার ডু ইউ ইনটেড টু টেক হিম নাউ, নিলয়দা?

কোথায় যাওয়া যায় বল তো! হরিবাবুর কাছে তো যাওয়া আর সম্ভব নয়। ও-পাড়াতেই ঢোকা যাবেনা।

লেট মি টেল ইউ ফ্র্যাংকলি, নিলয়দা। আই থিঙ্ক উই শুড ড্রপ দিস লুনাটিক হিয়ার, অ্যান্ড রান অ্যাওয়ে! দেয়ার ইজ নো আদার অলটারনেটিভ!

আমার কথাগুলো যেন বুলেটের মতো নিলয়দার বুকে বিঁধল। বর্ণহীন হয়ে গেল মুখখানা। খাওয়া থামিয়ে ভোলানাথ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল এক দৃষ্টে। ও কি তাহলে ইংরিজি বোঝে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিলয়দা বলল, তুই ঠিকই বলেছিস। সেটাই করা উচিত, কিন্তু আমি তা পারব না।

কেন পারবে না? এই গঙ্গার ধারে কত সাধু-সন্ন্যাসী, যোগী, পাগল থাকে। এদের মধ্যে ওর জায়গা হয়ে যাবে।

ওর এখন যা অবস্থা, যে-কোনও মুহূর্তে ভায়োলেন্ট হয়ে যেতে পারে। গঙ্গার ধারে অনেক ছেলে-মেয়ে বেড়াতে আসে। এখানে কোনও মেয়েকে অ্যাটাক করলে ও লিনচড হয়ে যাবে। লোকে মেরে ওকে গঙ্গার জলে ফেলে দেবে! আমার হাতটা ও কীভাবে চেপে ধরে আছে দেখ, কী করে ছাড়িয়ে নেব? যদি জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে পালিয়ে যাই, তারপর বাকি জীবনটা আমার কীভাবে কাটবে? এক দিনের জন্যও কি শান্তি পাব? সবসময় মনে হবে না যে আমি একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী?

নিলয়দার দু’চোখ দিয়ে নেমে এল জলের ফোঁটা। পকেট থেকে রুমাল বার করে নিলয়দা মুখটা ফিরিয়ে নিল।

আমি কয়েক পা সরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আমার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। স্বর্ণ আর জয় এখানে বেড়াতে এসেছে, হঠাৎ ভোলানাথ পেছন থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বর্ণর ওপর। জয় তখন কী করবে? ভয় পেয়ে পালাবে না বীরবিক্রমে ভোলানাথকে মারতে শুরু করবে? আমহার্স্ট স্ট্রিটে গিয়ে স্বর্ণ নিলয়দাকে বলছে, নিলয়দা, তোমার সেই পোষা পাগলটিকে আমার হৃদয়শ্বর আজ খুন করেছে। আজ থেকে দিদির আর কোনও চিন্তা নেই।

আজকের ঘটনা শুনে স্বর্ণ নিশ্চয়ই ভাববে, আমি আর নিলয়দা যুক্তি করে কোর্টে গিয়ে, ভাল উকিল লাগিয়ে ভোলানাথকে ছাড়িয়ে এনেছি। নিলয়দা গলা পরিষ্কার করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোনও নার্সিং হোমে ওকে ভর্তি করা যায় না? মেন্টাল পেসেন্টদের জন্য নিশ্চয়ই নার্সিংহোম আছে।

কিন্তু নিকট আত্মীয় না হলে যে ভর্তি করানো যায় না?

আমি নিকট আত্মীয় বলে পরিচয় দেব। বলব, আমার দাদা। কেউ কি আমার নামে অভিযোগ করতে যাবে? কে অভিযোগ করবে?

নার্সিংহোমেও কত দিন থাকবে?

যে ক’টা দিন আমি চালাতে পারি।

 নিলয়দা, এ বিষয়ে আমার কোনও মতামত নেই।

সে যাই হোক, এক্ষুনি তো ভর্তি করা যাচ্ছে না। সে-রকম নার্সিং হোম খুঁজে বার করতে হবে। আজকের দিনটা ওকে বাড়িতে রাখা ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখছি না।

কার বাড়িতে? তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে?

অতি দুঃখীর মতো হেসে নিলয়দা বলল, আর কার বাড়িতে জায়গা পাব, বল? চল, এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।

নিলয়দা, তুমি যাও। আমি এখন এখানেই একটু থাকব একলা একলা!

রূপার বকুনির ভয় পাচ্ছিস, না? সেই ভাল, তোর আর যাবার দরকার নেই। তুই কেন শুধু শুধু বকুনি খেতে যাবি। আমি একলাই ঠিক ম্যানেজ করে নেব।

নিলয়দার ওপর এর পরেও কি রাগ করে থাকা যায়? দুরু দুরু বুকে আমাকে যেতে হল সঙ্গে।

রূপাবউদি অফিসে গেছে, ফিরবে সাড়ে পাঁচটায়। পাপুন ফিরে এসেছে স্কুল থেকে। একটা আইসক্রিম চুষতে চুষতে আহ্লাদিত মুখে পাপুন বলল, পাগলটা আবার এসেছে? বেশ মজা হবে! মা আসুক না!

ভোলানাথ আজ খুবই অশান্ত। হা-হা করে হাসছে, কখন কেঁদে ফেলছে, ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে রাখলেও দুম দুম করে ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়। আজ যদি একটু চুপচাপ ভদ্র হয়ে থাকত।

নিলয়দা বলল, নীলু, তুই ডাক্তার ভড়কে একটা ফোন কর। ইঞ্জেকশন দিয়ে একে ঘুম পাড়ানো দরকার। রূপা আসবার আগেই যদি ঘুম পাড়িয়ে ফেলা যায়।

ডাক্তার ভড়কে আমি ফোন করে পেলাম না। ওঁর চেম্বার থেকে জানাল যে, উনি সাতটার সময় সেখানে আসবেন, তার আগে তাকে পাবার কোনও উপায় নেই।

ভোলানাথ এত জোর দরজা ধাক্কা দিচ্ছে যে, খুলে না দিয়ে উপায় নেই। মাথার ব্যান্ডেজটা সে খুলে ফেলেছে, কপালের ওপরতার দগদগে ক্ষত। নিলয়দা বলল, ভোলানাথ, আজ গণ্ডগোল করো না। ভেতরে গিয়ে বসো, আমি তোমার কপালে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি!

ভোলানাথ গর্জন করে বলল, আমি ভাত খাব। আর দই খাব।

 ঠিক সেই সময় ফিরে এল রূপাবউদি। সদর দরজা খোলা ছিল, উঠোনে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াল, মুখখানা বদলে গেল চোখের নিমেষে। বেশ হাসিমুখে মেজাজেই বাড়িতে এসেছিল, সেই হাসিটা মুছে গিয়ে যা ফুটে উঠল, তা ভয় নয়, ঘৃণা। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে অস্ফুট গলায় বলল, ওকে আবার নিয়ে এসেছ, তুমি যে কথা দিয়েছিলে…।

নিলয়দা ভোলানাথকে জোর করে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর ব্যাকুল ভাবে বলল, শোনো রূপা, আমি বুঝিয়ে বলছি।

তীক্ষ্ণ গলায় রূপাবউদি চেঁচিয়ে উঠল, পাপুন, তুই চলে আয় আমার সঙ্গে।

রূপা, শোনো-।

রূপাবউদি আর পাপনের অপেক্ষা করল না। পেছন ফিরেই দৌড়াতে শুরু করল।

আমি বললাম, নিলয়দা, তুমি যাও, বউদিকে ধরো।

অবসন্ন ভাবে নিলয়দা বলল, তুই যা নীলু, তোর কথা শুনবে। আমি আর পারছি না।

আমি বাইরে এসে দেখি রূপাবউদি বেশ জোরে ছুটছে। রাস্তার লোক হাঁ করে দেখছে তাকে। মেঘলা আকাশে ঘনিয়ে এসেছে অকালসন্ধ্যা। বিবেকানন্দ রোডদিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছে, কালোয়ারদের দোকানে কীসের যেন চ্যাঁচামেচি, কয়েকটা বাচ্চা ছেলে মাঝরাস্তায় ছোটাছুটি করছে একটা ঘুড়ি ধরার জন্য, এই সব কিছুর মধ্য দিয়ে আমি দৌড়োত লাগলাম। রূপাবউদির যখন মেজাজ ভাল থাকে, তখন অনেক রকম মজা করে, কিন্তু রাগলে একেবারে গণ্ডারের মতো একমুখী। তখন আর কোনও কথা মনে থাকে না! শহরের রাস্তা দিয়ে কোনো ভদ্রমহিলা কি এ-রকম ছোটে?

পেছন থেকে ডেকে কোনও লাভ নেই, আমি একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হাত জোড় করে বললাম, বউদি, শোনো-।

আমাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে রূপাবউদি ছুট দিল। এবারে আমি রূপাবউদির হাত চেপে ধরে বললাম, শোনো, কী করছ।

ছেড়ে দাও আমাকে। আমি ও-বাড়িতে আর কোনও দিন যাবনা!

ঠিক আছে, আমি তোমাকে বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি, এ-রকম ভাবে ছুটছ কেন?

আমাকে পৌঁছে দেবে… কেন? আমি নিজে যেতে পারি না। আমি বাপের বাড়িতে যাব না, আমার যেখানে ইচ্ছে চলে যাব। ছাড়ো আমাকে ইতর কোথাকার! একটা পাগলা কুকুর, যে মেয়েদের দেখলেই কামড়ে দেয়, তাকে তোমরা বাড়িতে নিয়ে আসবে। কেন, আমি জানি! আমাদের অপমান করবার জন্য।

এবার ওকে ইচ্ছে করে আনা হয়নি।

ছাড়ো আমাকে!

 কী করছ, রূপাবউদি? লোকে ভাববে, আমি তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।

ছাড়ো, নইলে আমি চ্যাঁচামেচি করব। আমি তোমাদের সবাইকে ঘেন্না করি।

সময় পাপুন এসে হাজির হয়ে বলল, মা!

রূপাবউদি বলল, চল পাপুন, আমরা চলে যাই!

এতক্ষণ রূপাবউদি রাগে ঠকঠক করে কাঁপছিল, এবারে হঠাৎ খুব শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল, নীলু, আমাদের আটকাবার চেষ্টা কোরো না।

দু’চার জন কৌতূহলী লোক জমে গেছে আশেপাশে। এখন আর জোর করা যুক্তিযুক্ত নয়। আমি চুপ করে গেলাম। একটা রিকশা ডেকে রূপাবউদি পাপুনকে নিয়ে উঠে পড়ল। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত অবস্থায়, এক কাপ চা-ও না খেয়ে রূপাবউদি চলে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে, এই অপমান সে কোনও দিন ভুলবে?

ফিরে এসে দেখলাম, নিলয়দা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঝাঁঝালো ভাবে বললাম, আমাকে পাঠাবার কোনও মানে হয়! তোমার নিজের যাওয়া উচিত ছিল, রূপাবউদি কোথায় চলে গেল কে জানে!

নিলয়দা হাত বাড়িয়ে ধীর গলায় বলল, একটা সিগারেট দে। আমি মন ঠিক করে ফেলেছি। কালকেই সব ব্যবস্থা করে ফেলব। ভোলানাথের জন্য আর কারুকে ভাবতে হবে না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়