স্বর্ণ মেয়েটি কিন্তু বেশ কাজের। পাপুনের স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে চটপট করে তৈরি করে দিল তাকে। রান্নার লোকটি অনুপস্থিত বলে রূপাবউদি দিশেহারা হয়ে পড়েছিল, স্বর্ণ বলল, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। নিলয়দা আর দেরি করতে পারছেন না, তাকে এক্ষুণি অফিসে যেতে হবে, সেখানেই দুপুরে কিছু খেয়ে নেবেন বলেছিলেন, স্বর্ণ বলল, দশ মিনিট বসুন না! একটু কিছু খেয়ে যাবেন, লুচি ভেজে দিচ্ছি। দিদি, তুই আলুভাজা কর, আমি ময়দা মেখে দিচ্ছি।

খেতে বসে নিলয়দা বলল, রূপা আজ অফিসে যাচ্ছনা তাহলে? তোমার তো ছুটি পাওনা আছে। নীলু রইল বাড়িতে, চিন্তার কিছু নেই।

রূপাবউদি বলল, পাগলটা যদি ঘর থেকে বেরুতে চায়, নীলু একাকী করবে? ও গায়ের জোরে পারবে?

একটা পাগলের সঙ্গে গায়ের জোরের প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, এটা ভেবেই আমি শিউরে উঠলাম। নিলয়দা আমাকে এ কীরকম প্যাঁচে ফেলে দিল। কাল রাত্তিরে আমার বিপদের সময় নিলয়দা সাহায্য করেছে, আমার মুখ থেকে বমি মুছে দিয়েছে, সুতরাং এখন আমি অকৃতজ্ঞের মতো পালিয়ে যেতেও পারি না।

স্বর্ণ জিজ্ঞেস করল, নিলয়দা, তোমার হঠাৎ পাগল পোষার শখ হল কেন?

 নিলয়দা বলল, ওকে একটু সারিয়ে সুরিয়ে তোর সঙ্গে বিয়ে দেব। তুই যেমন পাগলি, তোর সঙ্গে মানাবে!

না নিলয়দা, সিরিয়াসলি, তুমি রাস্তা থেকে পাগল ধরে আনলে কেন?

আমি বললাম, আমারও সেটা জানতে ইচ্ছে করছে। নিলয়দা, তুমি কিছু এক্সপেরিমেন্ট করতে চাও?

নিলয়দা মুখ তুলে অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, এক্সপেরিমেন্ট মানে? একটা লোককে রাস্তার ছেলেরা পিটিয়ে মেরে ফেলছিল, আমি চোখের সামনে সেটা দেখব? তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করবনা?

রাস্তার ছেলেরা ওকে মারছিল কেন?

তা আমি জানি না। আজকাল তো যেখানে সেখানে একদল লোক মিলে এক জন দুজন লোককে পিটিয়ে মেরে ফেলে। কাগজে পড়ো না? চোর, ডাকাত কিংবা ছেলেধরা বলে সন্দেহ হল, অমনি ব্যাস, কোনও কথা শোনার আগেই সবাই মারতে শুরু করল। এই লোকটি নাকি রাস্তার কোনও এক জন ভদ্রমহিলাকে তাড়া করেছিল। সত্যি-মিথ্যে জানি না।

তুমি গিয়ে আটকালে?

আর একটু দেরি হলে নির্ঘাৎ মেরেই ফেলত। রামমোহন লাইব্রেরির সামনে, তখন সন্ধে ছ’টা, রাস্তায় কত লোকজন, বাস-ট্রাম যাচ্ছে, তার মধ্যে এক দঙ্গল ছেলে মিলে একটি পাগলকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে, কেউ আটকাচ্ছে না। অনেকে দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। একেবারে লিঞ্চিং-এর দৃশ্য, এই টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতেও! আমি গিয়ে বাধা দিতেই সবাই হই হই করে উঠল। যেন আমাকেও মেরে বসবে আর কি!

রূপাবউদি বলল, মারতেও পারত। এই সব ব্যাপারে যে বাধা দিতে যায়, তাকেও লোকেরা ছাড়ে না।

নিলয়দা বলল, কয়েক জন আমাকে ধাক্কাধাক্কি করেছিল। বলে যে, ছেড়ে দিন, ওকে শেষ করে দেব! শালা, মেয়েছেলের গায়ে হাত তুলেছে। মেয়েদের কিছু ব্যাপার হলেই পাড়ার সব ছেলেরা একেবারে বীরপুরুষ হয়ে ওঠে। তা-ও আবার কী, একটা মেয়ে না খেতে পেয়ে ভিক্ষে করুক, তার কোলের ছেলেটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদুক, কেউ ফিরেও তাকাবেনা। কিন্তু ভিখিরি মেয়েটার আঁচল ধরে যদি কেউ টান দেয়, অমনি পাড়ার নীতি-রক্ষকরা হই হই করে উঠবে।

স্বর্ণ বলল, এ তো জানিই। সব জায়গাতেই এই অবস্থা। কিন্তু… তা বলে তুমি একটা পাগলকে বাড়িতে নিয়ে আসবে? দিদি কী করে সামলাবে?

খাওয়া বন্ধ রেখে আহত ভাবে নিলয়দা বলল, তোমরা বলতে চাও, একটা লোককে সবাই মেরে ফেলছে, চোখের সামনে তা দেখেও আমি লোকটাকে সেখানে ফেলে রেখে চলে আসব? যারা এরকম করে, তারা কি মানুষ?

অনেক সরল প্রশ্নেরই কোনও উত্তর হয় না। এ-দেশে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। লক্ষ মানুষ এসব দেখেও কোনও প্রতিবাদ করে না। আমি নিজেও তাদের মধ্যে একজন। এই সব লক্ষ লক্ষ লোককে মানুষ না বলে কী বলব? যারা মারে তারাও মানুষ, যারা দূর থেকে দেখে তারাও মানুষ, যে মরে সে-ও মানুষ!

হঠাৎ নিলয়দা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, একটু সামলে নিয়ে বলল, ওই ছেলেগুলো আমাকে বলল, আপনি যে ওকে গার্ড দিচ্ছেন, আপনি ওর দায়িত্ব নেবেন? ও যদি আবার মেয়েছেলেদের তাড়া করে। আমি বললাম, দেখো, ও লোকটা তো অসুস্থ, ও তো সজ্ঞানে কিছু করে না। তা-ও ছেলেগুলো আমাকে তেড়ে তেড়ে বলতে লাগল, আপনি ওর দায়িত্ব নেবেন? বড্ড যে বড়ফট্টাই করছেন! তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি ওর দায়িত্ব নেব। আমি ওকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।

লোকটা আসতে রাজি হল তোমার সঙ্গে?

দেখো, পাগলেরও কিছুটা কিছুটা জ্ঞান তো থাকে! লোকটা মার খেয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল, আর কয়েকটা লাঠির ঘা খেলে আর উঠতেই পারত না। আমি ওকে তুলে দাঁড় করিয়ে বললাম, চলুন, আপনি আমার সঙ্গে চলুন। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত জড়িয়ে ধরে এমন ব্যাকুল ভাবে আমার মুখের দিকে তাকাল, সেই চাউনিতে কী যে ছিল তোমাদের কী করে বোঝাব? আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। মানুষের ও-রকম চরম অসহায় দৃষ্টি আমি কখনও দেখিনি! ওকে নিয়ে একটা রিকশায় উঠলাম। ও সারাক্ষণ আমার হাতটা চেপে ধরে রইল।

ও নিজের নাম-টাম কিছু বলতে পারে না?

ও নিজে থেকে মাঝে মাঝে কথা বলে ওঠে। কিন্তু কোনও প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না। কথা শুনলে মনে হয়, লেখাপড়া জানত। কালকে বাড়িতে আসার পর প্রথম ঘণ্টা দু’এক কিন্তু বেশ শান্ত ছিল। তাই না রূপা?

রূপাবউদি বলল, আমার এই হাতটা ধরে টপ করে মুখে পুরে দিল। যদি আঙুলগুলো কামড়ে ছিঁড়ে নিত?

নিলয়দা বলল, সেই একটা আনফরচুনেট ব্যাপার। ওর গায়ের অনেকগুলো ইনজুরি হয়েছিল, রক্ত পড়ছিল, সব ধুয়ে-টুয়ে পরিষ্কার করে দিলাম। রূপাও আমাকে সাহায্য করছিল, হঠাৎ এক সময় রূপাকে কামড়ে দিতে গেল! তার পরেও দু’বার দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে গেছে। আমার মনে হয় মেয়েদের ব্যাপারে ওর কিছু গণ্ডগোল আছে। পাপুনকে কিন্তু কিছু বলেনি!

স্বর্ণ জিজ্ঞেস করল, এখন ওকে নিয়ে কী করবে?

 নিলয়দা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সেটা চিন্তা করে দেখছি। আজকের দিনটা যাক। নীলু রইল, তোমাদের কোনও ভয় নেই!

আমি বললাম, ইয়ে, মানে, নিলয়দা, বউদিরা বোধহয় আমার সম্পর্কে খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না। ধরো যদি লোকটা দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে চায়, তখন কী করব?

দরজা তো বাইরে থেকে বন্ধ আছে।

যদি বেরুতে চায়? দরজা ধাক্কাধাক্কি করে? দরজা তো ভেঙে ফেলতেও পারে?

আরে না, সে-রকম ভায়োলেন্ট পাগল নয়। ধমক দিলে কথা শোনে। আমার তো মনে হয়, ও তোমার কথাও শুনবে।

নিলয়দা, আমার ব্যক্তিত্বের ওপর তোমার অগাধ বিশ্বাস থাকতে পারে, কিন্তু আমার নিজেরই সে-রকম বিশ্বাস নেই। ধরো ওর যদি বাথরুম পায়, কিংবা রাস্তায় বেরিয়ে যেতে চায়।

সকালবেলা আমি ওকে বাথরুম দেখিয়ে দিয়েছি। ও নিজেই বাথরুমে গেছে। সেটুকু সেন্স আছে।

 রূপাবউদি বলল, আমি আর কোনও দিন ওই নিচের বাথরুমে ঢুকছি না।

নিলয়দা বলল, জমাদার এসে পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। আচ্ছা, একটা পরীক্ষা করা যাক। আমি থাকতে থাকতেই নীলু, তুই একবার ওর ঘরে গিয়ে ঢোক, ওর সঙ্গে দু’একটা কথা বলে আয়। দেখ কী করে!

আমি? ওর ঘরে ঢুকব?

 তুই একটা জলের জাগ রেখে আয় ওর ঘরে। ওর তো জলতেষ্টা পেতে পারে। আমি পাউরুটি আর জ্যাম রেখে এসেছি ওর ঘরে, খিদে পেলে তাই খাবে। চল না, ভয় কী, আমি তো আছি!

স্বর্ণ খুব মজা পেয়ে আমার দিকে ঠোঁট টিপে হাসছে। নিলয়দা যখন ধরেছে, তখন যেতেই হবে, তর্ক করে লাভ নেই। শরীরটা যদি ভাল থাকতো, অনেক বেশি সাহস দেখাতে পারতাম।

একটা প্লাস্টিকের জাগে জল নিয়ে আমি পাগলের ঘরের হুড়কোটা খুললাম। লোকটি খাটের ওপর হাঁটু গেড়ে ঠিক একই ভঙ্গিতে বসে আছে। আমি ঘরের মধ্যে ঢোকার পর সে ফিরেও তাকাল না। দেয়াল-ঘেঁষা একটা ছোট টেবিলের ওপর খাবার রয়েছে। আমি জাগটা সেখানে নামিয়ে রাখলাম।

তারপর বললাম, এই যে, খাবার জল রইল।

আমার গলা কাঁপেনি বটে, কিন্তু বুকের মধ্যে এমন ঢিপ ঢিপ করছে যে, সে শব্দ যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছি। পাগলকে এত ভয় পাবার কী আছে? প্রত্যেক মানুষেরই ব্যবহার সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা করে নিই, পাগল সম্পর্কে সেই ধারণাটা করা যায় না বলেই ভয়?

আমার কথা শুনেও লোকটি ফিরে তাকাল না।

নিলয়দা এবারে ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, এই যে, শুনছেন? এর নাম হচ্ছে নীলু। আমার ছোট ভাইয়ের মতো, এ আপনার দেখাশুনো করবে। কোনও দরকার হলে একে ডাকবেন।

লোকটি তবু ফিরে তাকাল না। সে এক মনে দেয়াল দেখছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিলয়দা হাসিমুখে বলল, দেখলি? ভয়ের কিছু নেই, এমনিতে খুব শান্ত। আসলে কী জানিস, একবার যাদের একটু মাথার গোলমাল হয়, অন্যলোক তাদের এত ডিসটার্ব করে যে তাতে তাদের আরও মাথা খারাপ হয়ে যায়।

ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নিলয়দা বলল, ঠিক আছে। আমি চললাম। পাঁচটা পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই ফিরে আসব। নীলু, তোর বাড়িতে খবর দিয়ে দেব।

বাড়িতে এখন এক পাগল আর দুই যুবতী, মাঝখানে আমি। অবস্থাটা মোটেই সুখকর নয়। স্বর্ণ যে প্রথমে এ বাড়িতে এসে আমাকেই পাগল ভেবেছিল, সেজন্য মনে একটা জ্বালা ধরে আছে। ওর দিকে ভাল করে তাকাতেই ইচ্ছে করছে না। পৃথিবীতে একমাত্র নিলয়দা ছাড়া আর কারুর অনুরোধেই পাগল-পাহারা দেবার কাজ নিতে রাজি হতাম না আমি।

বসবার ঘরে এসে রূপাবউদি বলল, এবারে একটু ভাল করে চা খাওয়া যাক। আমি জল বসিয়ে দিয়ে আসছি। দুপুরে, খাওয়া-দাওযা নিয়ে বেশি ঝঞ্ঝাট করার দরকার নেই। বেশি করে ময়দা মাখা আছে, লুচি আর ডিম ভাজা খেয়ে নিলেই হবে।

একটু থেমে গিয়ে রূপাবউদি বলল, কিন্তু নীলু, তুমি কী খাবে? তোমার কি লুচি সহ্য হবে।

 আমি আজকের দিনটা উপোস দেব।

সেটা কিন্তু খারাপ নয়। আজ স্টমাককে রেস্ট দেওয়াই উচিত। বিকেলের দিকে যদি খিদে পায়, তখন চিড়ে ভিজিয়ে দেব!

রূপাবউদি ঘর ছেড়ে চলে যেতেই আমি খবরের কাগজ টেনে নিলাম। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা পত্রপত্রিকাগুলো গুছোচ্ছে স্বর্ণ। ঘরের মধ্যে শুধু একটি ছেলে আর একটি মেয়ে উপস্থিত থাকলে ছেলেটিকেই প্রথম কথা শুরু করতে হয়। আমার সেরকম কোনও উৎসাহ নেই।

কিন্তু স্বর্ণ এসব নিয়ম মানেনা। সে একটু পরেই জিজ্ঞেস করল, আপনার বুঝি লুচি সহ্য হয় না? এরকম আমি কক্ষনও শুনিনি।

আমি শুধু মুখ তুলে তাকালাম একবার। কোনও উত্তর দিলাম না।

আপনি কাল আমার দিদির গায়ে বমি করে দিয়েছিলেন কেন? খুব মদ খেয়ে এসেছিলেন?

এবারে আমাকে একটা কড়া চাহনি দিতেই হল। তারপর বললাম, আমি ড্রিঙ্ক করলেও কোনও দিন বমি করি না। কাল আমার ফুড পয়জনিং হয়েছিল, আর খুব জ্বর, জ্ঞান ছিল না।

ফুড পয়জনিং হলে বুঝি নিজের বাড়ি না ফিরে বমি করার জন্য অন্য লোকের বাড়িতে যেতে হয়?

আমার কাল বাড়ি ফেরার উপায় ছিল না। আপনি বোধহয় নিলয়দার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক তা জানেন না।

ফট করে আলো জ্বলে ওঠার মতো স্বর্ণর মুখটা ঝলমলে হাসিতে ভরে গেল। মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে হাসতে হাসতে স্বর্ণ বলল, আপনার ভাগ্যিস গোঁফ নেই, থাকলে গোঁফগুলো এখন সব খাড়া খাড়া হয়ে উঠত! বাবাঃ কী রাগ, রেগে গেছেন! ছেলেদের রাগাতে আমার খুব ভাল লাগে। ছেলেরা ভাবে মেয়েরা সব সময় মিষ্টি মিষ্টি নরম নরম কথা বলবে! একুট অন্য রকম বললেই তাদের রাগ হয়ে যায়।

এবারে আমি একটা অবজ্ঞার হাসি দিলাম। স্বর্ণর সঙ্গে আমি ছেলেখেলা করতে চাই না।

পাশের ঘরের পাগলটি আবার যেন কী বলে উঠল। বোঝা গেল না ঠিক।

স্বর্ণ একটা চেয়ার টেনে ঠিক আমার মুখোমুখি বসল। আমি সোজা ওর চোখের দিকে তাকালাম। এমএসসি পাশ করার পর অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক বা ওই ধরনের কোনও বিষয় নিয়ে রিসার্চ করছে স্বর্ণ। শুনেছি ভাল সাঁতারও কাটে। মুখে একটু কঠোর ভাব থাকলেও শরীরের গড়নটি বেশ সুন্দর, রূপাবউদির মতোই লম্বা। এই ধরনের মেয়েদের সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টাই আমি করি না। বিদেশি বাতাস এদের উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। আর দু’চার বছরের মধ্যে বিলেত বা আমেরিকার কোনও বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারের ঘরণী হয়ে স্বর্ণ অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস ভুলে যাবে। ছেলেপুলে মানুষ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। চোখের দিকে তাকিয়ে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি স্বর্ণর ভবিষ্যৎ জীবন।

স্বর্ণ জিজ্ঞেস করল, আপনি কোন ইয়ারে পাশ করেছেন?

কী পাশ করার কথা বলছেন? আমি কিছুই পাশ করিনি।

আপনি ইউনিভার্সিটিতে পড়েননি?

না।

কিন্তু আপনাকে আমি কলেজস্ট্রিট কফি হাউসে দেখেছি।

ফেল করা ছাত্রদের কি ওখানে যাওয়ার কোনও নিষেধ আছে?

স্বর্ণ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নারী-সুলভ কোনও সঙ্কোচ নেই। একবারে চোখ দু’টি একটু কুঁচকে গেল। তারপর অনেকটা আপন মনে বলল, আমি আপনাকে স্টাডি করার চেষ্টা করছি কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না। আপনি কেশ এলিউসিভ ক্যারেকটার।

ধন্যবাদ।

কীসের জন্য?

আমার সম্পর্কে আপনি এতটা আগ্রহ প্রকাশ করছেন বলে। কোনও সুন্দরী মেয়ে আমাকে স্টাডি করতে চাইছে, এ-রকম সৌভাগ্য আমার ঘটে না।

নিলয়দা আপনাকে দুপুরটা এখানে থাকতে বলল, আপনি থেকে গেলেন। কাল রাত্তিরে বাড়ি ফেরেননি। আপনি বুঝি প্রায়ই এ-রকম যেখানে সেখানে থেকে যান?

সবাই থাকতে দেয় না, কেউ কেউ তাড়িয়েও দেয়।

নিলয়দাকে আপনি কত দিন ধরে চেনেন?

 এই চার-পাঁচ বছর।

নিলয়দা একটা পাগল ধরে এনেছে, আপনি জানেন, নিলয়দা নিজেও একটা পাগল?

রূপাবউদি চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকে বললেন, কী হয়েছে? ঝগড়া করছিস নাকি?

স্বর্ণ বলল, না, আমি বলছিলাম যে নিলয়দা নিজেও একটা পাগল।

ঠিক বলেছিস! মাঝে মাঝে যা কাণ্ড করে… শোনো নীলু, তোমার সঙ্গে পরামর্শ আছে। এই পাগলটাকে নিয়ে কী করা যায়, তা আমাদেরই ঠিক করতে হবে, তোমার নিলয়দার কথা শুনলে চলবে না।

স্বর্ণ বলল, নিলয়দা ওকে নিয়ে কী করবে, আমি জানি। নিলয়দা ওর চিকিৎসা করবে, ডাক্তার ডেকে নয়, নিজে নিজে।

রূপাবউদি বলল, সে ওর যা ইচ্ছে হয় করুক। কিন্তু ওকে এ বাড়িতে রাখা চলবেনা। সবসময়ে নিজের বাড়িতে ভয়ে ভয়ে থাকব নাকি আমি? ওকে কোনও একটা পাগলা গারদে ভর্তি করার ব্যবস্থা করো।

রাঁচিতে পাঠিয়ে দিলেই হয়!

কলকাতাতেও কী একটা উন্মাদ আশ্ৰম আছে না? রাস্তার লোকেরা একটা পাগলকে মারছিল, সে-জন্য পুলিশে খবর দিলেই তো হয়? পুলিশ যা ব্যবস্থা করার করবে। বাড়িতে নিয়ে আসার কোনও মানে হয়!

 এবারে আমি খানিকটা সন্দেহ জানিয়ে বললাম, বউদি, পুলিশে কি পাগল ধরে? তাহলে রাস্তায় প্রায়ই পাগল ঘুরে বেড়াতে দেখি কেন?

রূপাবউদি বলল, এটা তো পুলিশেরই কাজ।

পাশের ঘরের দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা পড়তেই আমরা সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। ধাক্কার শব্দ থামল না।

আমাকে উঠতেই হল। পাগলটা দরজায় জোরে জোরে লাথি মারছে।

আমি কাছে গিয়ে কড়া গলায় ধমকে বললাম, কী হয়েছে? এত জোরে ধাক্কা দিচ্ছেন কেন?

পাগলটি সরাসরি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, কোনও দরজা আমাকে চায় না, আমিও কোনও দরজা চাইনা! সোজা কথা।

দরজা খুলে দেব?

কোন শালা ষাঁড়ের ল্যাজ মুচড়ে দিয়েছিল, অ্যাঁ? কোন শালা।

এত জোরে সে লাথি মারছে দরজায় যে, এই আওয়াজে এবার পাড়া-প্রতিবেশিরা ছুটে আসবে। আমি হুড়কোটা খুলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে রূপাবউদি ভয় পেয়ে বসার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।

পাগলটি বেরিয়ে এসে দাঁড়াল উঠোনের মাঝখানে। তার মাথার এক পাশের চুলে রক্তচাপ বেঁধে আছে। পাঞ্জাবির পিঠের কাছেও লেগে আছে রক্তের ছাপ। নিলয়দা না আটকালে একেকাল রাস্তার লোকে মেরেই ফেলত, কোনও সন্দেহ নেই। আজকাল কেউই দু’চার ঘা থাপ্পড় দিয়ে কারুকে ছাড়ে না।

পাগলটি অস্থির পায়ে উঠোনের এ-দিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে লাগল। কী যেন খুঁজছে। তারপর হঠাৎ চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে চেয়ে রইল আকাশের দিকে।

আমার মনে হল, ওর তো রাস্তায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখা অভ্যেস, তাই অনেকক্ষণ আকাশ না দেখে ও বোধহয় অস্বস্তি বোধ করছিল।

শুয়ে শুয়ে ও বলতে লাগল, আমিও ষাঁড়ের ল্যাজ মুচড়ে দিইনি, তুমিও ষাঁড়ের ল্যাজ মুচড়ে দাওনি, তাহলে কে দিল? শুধু শুধু ষাঁড়টা খেপে গেল? অ্যাঁ, এই তো অবস্থা! আমি যদি সব সত্যি কথা বলে দিই, তুমি যদি সব সত্যি কথা বলে দাও, তবে চন্দ্র-সূর্য পর্যন্ত লজ্জা পেয়ে যাবে। কিন্তু তুমিও লজ্জা পাবে না, আমিও লজ্জা পাব না। মানুষ লজ্জা পায় না। অ্যাঁ? এই তো অবস্থা!

লোকটির গলার আওয়াজ গমগমে, উচ্চারণও স্পষ্ট। এখন পাগল বলে মনেই হয় না। এই সব কথাগুলো কি কোনও নাটক বা যাত্রার সংলাপ? আমার ভয় ভয় ভাবটা কিছুতেই কাটছেনা। নেহাৎ দু’জন মহিলা উপস্থিত আছে বলে আমাকে সাহসী হতেই হবে। কাছে এগিয়ে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম কী?

লোকটি বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি প্রথমে নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বললাম, আমার নাম নীলু!

 তারপর ওর বুকের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললাম, আপনার নাম কী?

লোকটি বলল, কুত্তার বাচ্চা! আমাকে লাঠি দিয়ে মারছিল।

 আপনাকে মারছিল? কেন? কী হয়েছিল?

আমাকে কেউ চেনে না, আমিও কারুকে চিনি না, ব্যাস! সোজা কথা। লোকটি আবার ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতেই আমি সরে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালাম।

লোকটি আবার বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগল। মাঝে মাঝে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালটাকে ঠেলবার চেষ্টা করে, তার লম্বা লম্বা আঙুলগুলো দেয়ালের গায়ে যেন চেপে বসে যাবে। এক জায়গার দেয়াল ছেড়ে আবার অন্য জায়গার দেয়ালের কাছে যায়। একজন মানুষ দেয়াল ঠেলে সরাবার চেষ্টা করছে, এই দৃশ্য দেখলে গা ছম ছম করে। এর মধ্যে যেন পৌরাণিক আভাস আছে। লোকটিকে এখন অন্ধ মনে হয়।

একবার সে বসবার ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। ভেতরে একটা হুড়োহুড়ির শব্দ পেলাম। বউদিরা নিশ্চয়ই কোনও ফাঁক-ফোকর দিয়ে লক্ষ্য রাখছিল।

লোকটি কিন্তু দরজাটা ধাক্কাল না। দরজার গায়ে গাল ঠেকিয়ে আঁ আঁ করে একটা কাতর শব্দ করতে লাগল, আমার দিকে তার চোখ। ওর ভেতরে একটা কিছু প্রবল কষ্ট হচ্ছে যেন। কিন্তু ভাষা দিয়ে তো ওর মনের কথা জানার উপায় নেই।

হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে সদর দরজার কলিং বেলটা বেজে উঠল ঝন ঝন করে। দু’বার বেলটা বাজল। আমি দৌড়ে গিয়ে খুলে দিলাম দরজাটা। দু’জন অচেনা মহিলা দাঁড়িয়ে, এক জন মিহি গলায় বলল, আমরা মার্কেটিং রিসার্চের ব্যাপারে এসেছি, আপনারা কী টুথপেস্ট ব্যবহার করেন।

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, বেলের আওয়াজ শুনে পাগলটিও চমকে উঠেছিল, সে-ও এই দিকে এসেছে, আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই পাগলটা মেয়েদের দেখলেই হিংস্র হয়ে ওঠে, আমার দরজা খোলাই ভুল হয়েছে।

আমি বললাম, এখন সময় নেই, পরে আসবেন।

অন্য মহিলাটি আরও মিহি গলায় বলল, দেখুন আমরা মাত্র সাত মিনিট সময় নেব, আমাদের একটা কোয়েশ্চেনেয়ার আছে।

বললাম তো এখন সময় নেই!

দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম ওদের মুখের ওপর। ওরা বোধহয় আমাকেই পাগল ভাবল।

পাগলটির নিশ্বাসের আঁচ যেন লাগল আমার গায়ে। আমি শিউরে উঠে সরে গেলাম। পাগলটি সত্যিই আমার গা ঘেঁষে এসেছে, আমি তাড়াতাড়ি চলে এলাম উঠোনের দিকে। এক জন মানুষের সান্নিধ্যে কখনও এ-রকম ঘিনঘিনে ভাব হয়নি। লোকটির গায়ে একটা উৎকট গন্ধও আছে বটে।

সদর দরজার ছিটকিনিটা বন্ধ করা হয়নি। পাগলটা যদি বাইরে বেরিয়ে যায়? যায় তো যাবে, আমার বাধা দেবার কোনও মানে হয় না। কারুর ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমি হস্তক্ষেপ করতে চাইনা। ও এখানে থাকবে না যাবে, তা ও নিজেই ঠিক করুক।

কিন্তু ও গেল না। হয়তো সব দরজাই ও বন্ধ মনে করে। দরজাটার গায়ে একটা কিল মেরে ও ফিরে এল উঠোনে। ফিস ফিস করে বলল, ষাঁড়ের ল্যাজ কে মুচড়ে দিয়েছে? তুমিও দাওনি, আমিও দিইনি! এই তো ব্যাপার। হায় মাধুরী!

তারপর আমার দিকে একটা ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে আফিংখাওয়ানো জন্তু যেমন ভাবে আবার খাঁচার মধ্যে ফিরে যায়, সেইভাবে ঢুকে গেল নিজের ঘরে। নিজেই দরজাটা বন্ধ করল। আমি হুড়কো টেনে দিলাম। আমি রীতিমতো ঘেমে গেছি। নিলয়দা বড্ড কঠিন দায়িত্ব দিয়ে গেছে আমার ওপরে। এরই মধ্যে আমি অবসন্ন বোধ করছি। এই পাগল এ-রকম ভাবে কতবার ঘর থেকে বেরুবে কে জানে!

বসবার ঘরের দরজাটা আবার খুলে গেল। গনগনে রাগী মুখে রূপাবউদি বলল, তুমিই বলল, এ-ভাবে বাড়িতে থাকা যায়?

স্বর্ণ বলল, আমার কিন্তু লোকটাকে ভাল করে দেখতে ইচ্ছে করে। কীরকম পাগল? কোনও আশা নেই?

রূপাবউদি বলল, থাক, আর দেখতে হবে না। চল আমরা ওপরে যাই। ওপরের সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। নীলু, তুমি নিচে থাকো।

আমি বসবার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে দিলাম।

আস্তে আস্তে খিদে পাচ্ছে। কাল বিকেলের পর কিছুই খাইনি, বমি করেছি প্রচুর। খিদেটাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। রূপাবউদি দুপুর খেতে দেবেন না বলেছেন। দেখা যাক।

সাত্যকি বসুমল্লিকের কথা মনে পড়ে গেল আবার। তিনি এখন কী করছেন? এখন এগারোটা সাড়ে এগারোটা বাজে। সাত্যকি বসুমল্লিকের মতো বনেদী পরিবারের লোকেরা আগে এই রকম সময়ে ঘুম থেকে উঠত। কিন্তু সেসব দিন আর নেই, তাছাড়া ইনি কর্মিষ্ঠ পুরুষ, ভাবভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়। সাত্যকি বসুমল্লিকের তিন-চারটে ব্যবসা, তারই কোনও একটা অফিসে তিনি এখন বসে আছেন নিশ্চয়ই। মস্ত বড় একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল। যার যত বড় টেবিল তার তত বেশি ব্যক্তিত্ব। তুচ্ছ একটা কাঠের টেবিল, কিন্তু তার এ-পাশে আর ও-পাশে বসবার মধ্যেই অনেক কিছুই বদলে যায়। আমাদের স্কুলে অঙ্কের টিচার ছিলেন অম্বিকাবাবু, তার মেজাজের কাছে আমরা কাঁচুমাচু হয়ে থাকতাম। তিনিই আবার হেড মাস্টারের টেবিলের উলটো দিকে বসলে মিন মিন করে কথা বলতেন। অম্বিকাবাবুর ছেলে নকশাল হয়েছিল, সেই কারণে তাকে একবার যেতে হয়েছিল থানায়, সেখানে দারোগার টেবিলের উলটো দিকে বসে তিনি একেবারে কেঁচো হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ কত হবু দারোগা কিংবা হবু-জজ-ম্যাজিসট্রেট অম্বিকাবাবুর দাঁতখিচুনি খেয়ে গেছে!

সাত্যকি বসুমল্লিকের নিখুঁত ভাবে দাড়ি কামানো ফর্সা মুখে নীলচে আভা। টেবিলের ওপর তিনখানা টেলিফোন। একটা কালো, একটা সাদা, একটা গোলাপি। সবুজ টেলিফোন হয়, হলদেও হয়, টুকটুকে লালও হয়। তাহলে সাত্যকি বসুমল্লিকের ঠিক কী কী রঙের টেলিফোন আছে, এটা যেন জানা আমার বিষম দরকার। অফিসে নিশ্চয়ই ধুতি-পাঞ্জাবি পরে যান না। স্যুট না ক্যাজুয়াল? কোনও দিন এই ধরনের মানুষের মাথার চুল কপালে এসে পড়ে না। উনি ধূমপান করেন না, আমি লক্ষ্য করেছি, ভিজিটারদের সঙ্গে কথা বলার সময় হাতের কলমটা কামড়ে ধরাও ওঁর পক্ষে অসম্ভব।

নেতারহাট বাংলোতে হঠাৎ দেখা হয়েছিল, তবু উনি বলেছিলেন, ঠিক আমার মতো একটি ছেলেকেই উনি খুঁজছেন, আমাকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেছিলেন ওঁর সঙ্গে কলকাতায় দেখা করবার জন্য। আমি ওঁর কাছে চাকরি চাইনি, কোনও রকম দৈন্য প্রকাশ করিনি, তবু আমাকে এ-রকম প্রস্তাব দেবার মানে কী? একে স্পর্ধা বলে না? কলেজ জীবনে আমরা এই ধরনের লোকদের বলতাম অমায়িক খচ্চর!

আমি এখন পাগলের পাহারাদার হয়ে বসে আছি, আর সাত্যকি বসুমল্লিক হাসি মুখে একদল মানুষের ওপর দয়ালু-প্রভুত্ব করে যাচ্ছেন। আমি ওঁর সঙ্গে জায়গা বদলাবদলি করতে চাইনা, কিন্তু কোনও এক দিন সাত্যকি বসুমল্লিককে রাস্তার কোনও পাগলের মুখোমুখি দেখতে চাই। সাত্যকি বসুমল্লিক পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে আমি বলব, তুমি নিলয়দার পা ধোয়া জল খাও।

পাগলটা আবার কী যেন চেঁচিয়ে উঠল। আমার উঠতে ইচ্ছে করল না। দরজায় তো লাথি মারেনি।

পাগলটার নামটা পর্যন্ত জানা গেল না। একজন মানুষকে আমি দেখাশুনো করছি, অথচ তার নাম জানি না, এর কোনও মানে হয়? খানিকক্ষণ ধরে আমি ভাবতে লাগলাম, ওর কী একটা নাম দেওয়া যায়। প্রথমে মনে এল দিগম্বর। তারপর ভাবলাম, এক জন লম্বা-চওড়া, মোটামুটি সুশ্রী মানুষের ওপর এরকম একটা বিদঘুটে নাম চাপিয়ে দেওয়া কি উচিত? না, এটা অন্যায়। তারপর মনে পড়ল, ভোলানাথ। হ্যাঁ, এইনামটাই ওকে মানাবে।

.

০৪.

নিলয়দা ভোলানাথের ছবি তুলে দুটি খবরের কাগজে সেই ছবি ছাপিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। এর মধ্যে দিন চারেক কেটে গেছে আমি আর ওদিক ঘেঁষিনি। খবর পেয়েছি নিলয়দা ভোলানাথকে এখনও বাড়ি থেকে সরায়নি, সুতরাং নিলয়দার স্ত্রী ও শ্যালিকা, এই দুই তলোয়ারের মতো জিভওয়ালা নারী যে প্রতি মুহূর্তে নিলয়দাকে কচুকাটা করছে, তা বোঝাই যায়। ওর মধ্যে আমি সাধ করে কেন যেতে যাব। তাছাড়া আমার কি নিজস্ব ব্যাপারস্যাপার নেই?

নিলয়দা ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। বাড়ির টেলিফোন খারাপ, সুতরাং আমাকে ডাকাডাকিও করতে পারছে না। আমিও পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। পাগলটির থেকেও এখন স্বর্ণকেই আমার বেশিভয়। সে আবার আমার চরিত্র স্টাডি করতে চায়।

দূরে দূরে থেকেও আমি নিলয়দাকে খানিকটা সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলাম। কলকাতার মধ্যে কিংবা কাছাকাছি কোথাও পাগলদের রাখবার ব্যবস্থা আছে কিনা তা জানবার জন্য আমি গিয়েছিলাম পার্থদার কাছে। পার্থদা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেলথ ডিপার্টমেন্টের খুব বড় অফিসার, উনি সব হাসপাতালের খবর নিশ্চয়ই জানবেন। পার্থদা আমাকে নিয়ে গেলেন ড. এ আর দত্তগুপ্তর কাছে। ড. দত্তগুপ্ত হলেন ডিএইচএস, অর্থাৎ ডাইরেক্টর অফ হেলথ সার্ভিসেস। ইনি আবার নাম করা নিউরোলজিস্ট।

ড. দত্তগুপ্তকে আমি সবকথা খুলে বললাম। শুনে-টুনে তিনি যা দুখানা মতামত দিলেন, তা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। আর মনটা একেবারে সেঁধিয়ে গেল পাতালে।

ড. দত্তগুপ্ত বললেন, পাগলকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া সহজ, কিন্তু তাকে বাড়ি থেকে তাড়ানো অতি কঠিন। দয়া-মায়া এ-সব হল অতি পুরনো ইনসটিংক্ট, এমনকী বিকৃত মস্তিষ্ক মানুষের মনেও এর স্পর্শ একবার লাগলে সহজে মুছে যায় না। রাস্তার যে-পাগল মার খায়, সে যদি হঠাৎ এক জন মানুষের কাছ থেকে দয়া পায়, তবে তাকে আর সে কিছুতেই ছাড়তে চাইবে না। ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেও ফিরে আসবে। এমনকী কোনও নার্সিং হোম বা পাগলা গারদে ভর্তি করে দিলেও সেখান থেকে পালিয়ে ঠিক চলে আসবে রাস্তা চিনে। নিজের ইচ্ছেতে যদি ও চলে না যায়, তাহলে ওকে বিদায় করার সম্ভাবনা খুবই কম।

দ্বিতীয়ত, ওকে রাখা হবে কোথায়? সরকারের অধীনে যে দু’একটা মানসিক চিকিৎসার হাসপাতাল আছে, সেখানে বিন্দুমাত্র ঠাঁই নেই। দেশের সমস্ত বেওয়ারিশ পাগলের চিকিৎসারভার যদি সরকারকে নিতে হয়, তাহলে পশ্চিমবাংলাতেই অন্তত একশোটা আরও এ-রকম হাসপাতাল খোলা দরকার। নানা রকম টেনশান বেড়েছে বলে দেশে পাগলের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। আর্থিক সঙ্গতি না থাকলে তাদের চিকিৎসা করবার কোনও সুযোগ নেই।

তাছাড়া, ড. দত্তগুপ্ত বললেন, ধরুন যদি কোনও হাসপাতালে জায়গা করা যায়, তাহলেও ওই পাগলটিকে ভর্তি করার দায়িত্ব কে নেবে? অতি নিকট আত্মীয় ছাড়া কোনও মানুষকে কেউ পাগল বলে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারে না। এটাই আইন। পয়সা খরচ করে যদি রাঁচিতেও পাঠাতে চান, তাহলেও সার্টিফাই করতে হবে যে, রোগী আপনার কে হয়। মিথ্যে পরিচয় দিলে জেল হয়ে যাবে। কেন বুঝলেন তো? মনে করুন, কারুর ওপরে আপনার রাগ আছে। আপনি তাকে পাগল সাজিয়ে জোরজার করে কোনও পাগলা গারদে ভর্তি করে দিতে তো পারেন!

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কি কোনও উপায় নেই?

ড. দত্তগুপ্ত বললেন, গভর্নমেন্টের ভ্যাগরান্সি কন্ট্রোল বলে একটা ডিপার্টমেন্ট আছে। পাগলটাকে কোনও রকমে রাস্তায় বার করে দিন। ভ্যাগরান্সি কন্ট্রোলের লোকদের আগে থেকেই খবর দিয়ে রাখবেন, তারা যদি ধরে নিয়ে গিয়ে কিছু ব্যবস্থা করতে পারে।

ড. দত্তগুপ্ত আমাকে পাঠালেন ভ্যাগরান্সি কন্ট্রোল অফিসার ইনচার্জ সি.আরদাশের কাছে। সি.আর দাশ কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশ নয়। ইনি হলেন ছবিরানি দাশ।

আমার মনে হয়েছিল ডিএইচএস ড. দত্তগুপ্ত যেন আমার আগ্রহের প্রতি তেমন কোনও গুরুত্ব দেননি। নিলয়দার কাহিনি শুনে তাঁর মনে হয়েছিল, এটা এক জন লোকের উদ্ভট খেয়াল, এখন সে বুঝুক ঠ্যালা! এক জন অসহায় উন্মাদকে কী করে বাঁচানো যায়, সে সম্পর্কে তার কোনও মাথাব্যথা নেই। তিনি অনেক বড় বড় সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত।

শ্রীমতী সি আর দাশের কাছে এসে সেই প্রমাণই পেলাম। ভদ্রমহিলা এই বিভাগে এক জনের বদলিতে কাজ করছেন, যে-কোনও দিন ট্রান্সফার অর্ডারের অপেক্ষায় আছেন। সব শুনে তিনি ভুরু তুলে বললেন, অ্যাঁ? ডিএইচএস আপনাকে পাঠিয়েছেন আমার কাছে? তিনি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করেছেন আপনার সঙ্গে। ভ্যাগরান্সি কন্ট্রোল ব্যাপারটা কী জানেন? এটা খোলা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, শহরের রাস্তায় ভবঘুরে ছেলে-মেয়ে দেখলে তাদের আটকে রাখবার জন্য। এখন এই দফতরটা কেন আছে কেউ জানে না। কলকাতার রাস্তায় এখন পঞ্চাশ-ষাট হাজার মানুষ রাত্তিরে ঘুমোয়, তাদের ক’জনকে আমরা ধরে আনব? অ্যাঁ? বলুন আপনি? আমরা এক জনকেও ধরি না। আমাদের যা বাজেট, ডিপার্টমেন্টের সব ক’জন কর্মচারীর মাইনে দিতেই কুলোয় না। সুতরাং ডিপার্টমেন্ট আছে, কিন্তু প্রায় কোনও কাজই নেই। হাওড়ার আব্দুল রোডে একটা নতুন ভ্যাগরান্ট হোম তৈরি হবার কথা, কবে সেটা শেষ হবে জানি না। এখন একটা পুরনো লঝঝরে বাড়িতে কিছু ছেলেকে আটকে রাখা হয়েছে। তাদেরই খাওয়া জোটে না, এর পরেও আমরা রাস্তার পাগল ধরে আনব?

আমি বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে রাস্তার পাগল ধরার কোনও ডিপার্টমেন্ট নেই? ছবিরানি দাশ এক জন মধ্যবয়স্কা মহিলা। মুখে ক্লান্তি ও তিক্ততার ছাপ। বিদ্রুপের সঙ্গে বললেন, কে জানে! আপনি জানেন কি, ব্রিটিশ আমলের গোড়ার দিকে কলকাতার রাস্তায় কেউ ভিক্ষে করলে তাকে ফাইন দিতে হত কিংবা তার জেল হত। খুঁজে দেখুন গিয়ে, এই ভিখিরির শহর কলকাতায় এখনও হয়তো সরকারের কোনও ভিখিরদমন ডিপার্টমেন্ট আছে। আপনি বরং কলকাতা করপোরেশানে গিয়ে খোঁজ করুন, রাস্তার পাগলা কুকুর ধরা যেমন ওদের কাজ, সেই রকম রাস্তার পাগলও…।

আমি অবশ্য আর করপোরেশন অফিসে যাইনি।

 নিলয়দার কথা ভেবে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে রইল, কিন্তু ওদের বাড়িতে গিয়ে যে প্রত্যক্ষ ভাবে নিলয়দাকে কিছু সাহায্য করব, সে-সাহস হল না।

পৃথিবীর আহ্নিক গতি অনুযায়ী এক-একটা দিন কেটে যেতে লাগল, আকাশের রঙ বদলাল, অন্যান্য বছরের তুলনায় একটু আগেই চলে এল বর্ষা। আমার বান্ধবী রানির সঙ্গে আমার মন কষাকষি মিটে গেল। গঙ্গায় এক দিন নৌকো করে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ পড়লাম ঝড়ের মুখে, নৌকো প্রায় উলটে যায় আর কী, আর তাই নিয়ে এমন মজা হল যে বেশ কয়েক দিন সাত্যকি বসুমল্লিকের কথাও আমার মনে পড়েনি।

তবু এরই মধ্যে এক দিন ভুল করে চলে গেলাম কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে। কারুর আহ্বানে নয়, কারুর খোঁজে নয়, এমনিই।

কফি হাউসে আমাদের নিজস্ব দু’তিনটে টেবিল থাকে, বন্ধু-বান্ধবরা সেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। তার বাইরে অন্যান্য টেবিলে কী হয় না হয় আমরা লক্ষ্য করি না। তিনতলার জানলার পাশে একটা টেবিলে যে স্বর্ণ আর তার বন্ধু-বান্ধবীরা নিয়মিত আড্ডা দেয় তা আমি জানতাম না। আমরা বসি দো-তলায়।

তিন তলা থেকে স্বর্ণ আমাকে দেখতে পেয়ে দো-তলায় নেমে এসে আমার টেবিলের কাছে দাঁড়াল। প্রায় মহারানির ভঙ্গিতে আদেশের সুরে বলল, একটু উঠে আসুন, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।

অনুগত ক্রীতদাসের মতো আমি উঠে দাঁড়ালাম। যারা স্বর্ণকে চেনে না, তারা স্বর্ণর শুধু দেহশ্রী দেখে মুগ্ধ হবেই। আমরা বন্ধুরা সবাই হঠাৎ কথা থামিয়ে স্বর্ণকে দেখতে লাগল। ওরা নিশ্চয়ই আমার সৌভাগ্যকে ঈর্ষা করছে। হায় রে!

স্বর্ণ আমাকে নিয়ে এল দরজার কাছে। আমার চোখে চোখ রেখে ভৎর্সনার সুরে বলল, আপনাকে খানিকটা দেখে আমার যা মনে হয়েছিল, তাতে আমি ভাবতে পারিনি আপনি এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হবেন!

ইয়ার্কি করার সুযোগ পেলে আমি ছাড়ি না। স্বর্ণর ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে আমি বললাম, তা হলেই বোঝা যাচ্ছে, মনুষ্য চরিত্র সম্পর্কে আপনার জ্ঞান খুবই কম।

আপনি সেই যে সেদিন বিকেলবেলা পালিয়ে এলেন…।

বলে কয়ে বিদায় নিয়ে আসাকে বুঝি পালিয়ে আসা বলে?

আপনি আবার আসব বলেছিলেন।

 হ্যাঁ, আবার আসব বলেছিলাম, কিন্তু ঠিক কবে, কখন যাব তা বলিনি।

আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে স্বর্ণর মুখখানা হঠাৎ বিষাদে ছেয়ে গেল। মাটির দিকে চোখ নামিয়ে সে বলল, আপনাদের সেই পাগলকে নিলয়দা এখনও বাড়িতে রেখে দিয়েছে। এর মধ্যে কী কী হয়ে গেছে আপনি জানেন?

আপনাদের বলতে স্বর্ণ পাগল ভোলানাথের অভিভাবকদের দলে আমাকেও ফেলে দিয়েছে। নেহাৎ শরীর খারাপ হয়েছিল বলে আমি সেদিন নিলয়দার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলাম। নইলে ওই পাগলের ব্যাপারে কি কোনও দায়িত্ব আছে?

কিন্তু স্বর্ণকে আর খোঁচা না দিয়ে আমি কিছুটা সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে এর মধ্যে?

স্বর্ণ বলল, আপনি যে চলে এলেন, সে-দিনই সন্ধেবেলা ওই পাগলটা আমার হাতের আঙুল কামড়ে ধরেছিল। আমি ওকে সেবা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ও আমাকে..।

হঠাৎ থেমে গিয়ে স্বর্ণ দেয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। না, প্রকাশ্য জায়গায় কেঁদে ফেলার মতো মেয়ে নয় স্বর্ণ। তবে মুখখানি শ্রাবণের মেঘ।

পাগলটা আপনাকে কামড়ে দিল? আপনি ওর কাছে গেলেন কেন? আমি যতক্ষণ ছিলাম, পাহারা দিয়েছি।

নিলয়দা বলল, মেয়েদের ওপর ওর অত রাগ, নিশ্চয়ই কোনও মেয়ে ওর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। তোমরা ভয় পেয়ে দূরে সরে গিয়ে ওর সঙ্গে একটু ভাল ব্যবহার করো। সেই জন্য আমি ওকে খাবার দিতে গেলাম… দিদিকে যেমন ভাবে কামড়ে দিয়েছিল, আমাকেও ঠিক সেইভাবে, এই হাতখানা টেনে মুখের মধ্যে ভরে দিল! উঃ, ভাবলেও এখনও আমার…।

তারপর কী করে ছাড়ানো হল!

দিদি ওর মাথায় একটা গেলাস দিয়ে ঠুকে ঠুকে মারতে মারতে তারপর… এই দেখুন, দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল।

স্বর্ণ তার বাঁ-হাতটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। ওর হাতটা ধরে পরীক্ষা করা উচিত কি না সে-সম্পর্কে আমি মনস্থির করতে পারলাম না। সত্যিই স্বর্ণর স্বর্ণাভ আঙুলে একটা ছোট ক্ষত রয়েছে।

একটু সময় নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, নিলয়দা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, কোনও উত্তর আসেনি?

না! কে ওর খোঁজ নিতে আসবে? ও তো মানুষ নেই, একটা হিংস্র পশু হয়ে গেছে।

দশ-বারো দিন হয়ে গেল।

দিদি পাপুনকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে। এই ক’দিনের মধ্যে নিলয়দা একবারও দিদির সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। ও-বাড়িতে রান্নার লোক আজও ফেরেনি, ঠিকে ঝি পাগলের ভয়ে কাজ ছেড়ে দিয়েছে। নিলয়দা একা রান্না করে খায়, আর সর্বক্ষণ ওই পাগলকে নিয়ে মেতে আছে।

সত্যি নিলয়দা বড্ড বাড়াবাড়ি করছে।

দিদি ডিভোর্সের কথা ভাবছে। পাপুন বাবাকে দেখার জন্য কান্নাকাটি করে। দিদি ওকে কিছুতেই ওবাড়িতে যেতে দেবেনা।

ব্যাপারটা যে এতখানি গড়িয়েছে, তা আমি জানতাম না।

রাস্তার একটা পাগলকে যতখানি সাধ্য সাহায্য করা উচিত, তা না হয় মানলাম, কিন্তু আমার দিদি আর পাপুনের জীবনটা যে নষ্ট হতে চলেছে, সেটা বুঝি কিছু নয়? নিলয়দা যা করছেন, সেটাও তো একটা চুড়ান্ত পাগলামি। আপনারা তাতে বাধা দেবেন না?

আচ্ছা, আমি নিলয়দার সঙ্গে দেখা করতে যাব। ওকে বুঝিয়ে বলব!

কখন যাবেন?

 কাল, কালকে বিকেলের দিকে!

দপকরে জ্বলে উঠে স্বর্ণ বলল, কাল বিকেলে! এই সব কথা শোনার পরও আপনি এখন আড্ডা দিতে যাবেন? আপনার মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই? শুনুন, একটা কথা আপনাদের জানিয়ে রাখছি। আমার দাদার রিভলবার আছে। আমি ঠিক এবার গিয়ে ওই পাগলটাকে গুলি করে ফেলব! ওর বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই।

আমি আজই, এক্ষুনি যাচ্ছি।

সত্যি যাবেন?

হ্যাঁ, বললাম তো, এক্ষুনি!

চলুন, আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে।

আপনি যাবেন? না না, তার কোনও দরকার নেই। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই এক্ষুনি যাব।

আমি আপনার সঙ্গে গেলে কোনও আপত্তি আছে?

না, মানে, যদি আবার আপনার কোনও বিপদ হয়!

আমি ভয় পাই না। নিলয়দাকে আমি কয়েকটা কথা বলব।

 তাহলে আপনি নিচে নামুন, আমি সিগারেটের প্যাকেটটা ফেলে এসেছি, নিয়ে আসছি।

টেবিলে ফিরে এসেই আমি বন্ধুদের সকলের সামনে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললাম, টাকা দে, টাকা দে, যার যার কাছে স্পেয়ারেবল এক টাকা দুটাকা আছে, শিগগির দে!

দু’তিনজন স্বেচ্ছায় হাসতে হাসতে দিয়ে দিল, দু’এক জন একটু গাঁইগুই করছিল, কিন্তু আমি ওদের বেশি সময় দিলাম না, দশ-বারোটা টাকা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে, টেবিলের ওপর থেকে অন্য এক জনের সিগারেটের প্যাকেট তুলে দৌড় দিলাম সিঁড়ির দিকে।

কে যে কখন কীভাবে ঠকে তা অনেক সময় তারা নিজেরাই জানে না। বন্ধুরা ভাবল, আমি একটি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে মজা করতে যাচ্ছি বলে ওরা চাঁদা দিয়েছে। এই নিয়ে এখন খানিকটা রঙ্গ রসিকতা চলবে। ওরা যদি জানত, আমি কী বিপদসমুদ্রে ঝাঁপ দিতে চলেছি…।

অতিশয় কৃতিত্ব দেখিয়ে আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা ট্যাক্সি ধরে ফেললাম। একটুখানি যাবার পরেই শুরু হল দুর্দান্ত বৃষ্টি। জানলার কাচ তুলে দিতে হল। বৃষ্টির তোড়ে কাচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমি স্বৰ্ণর মুখের দিকে তাকাতেই সে বলল, আমার দাদা এক জন ডাক্তার নিয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছেন, ওই পাগলটা চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে। অনেক দিন ধরে টানা শক থেরাপি করলে কিছুটা উন্নতি হতে পারে, সে-ও খুব খরচসাধ্য ব্যাপার।

বৃষ্টির মধ্যে কাচ তোলা ট্যাক্সির রোমান্টিক পরিবেশে স্বর্ণ আমাকে শুধু পাগল, ডাক্তার, চিকিৎসা ইত্যাদির কথা বলে যেতে লাগল। আমিও শুনে গেলাম মুখ শুকনো করে।

নিলয়দার বাড়িতে এসে পৌঁছোবার আগেই বৃষ্টি ধরে এল। বর্গির মতো বৃষ্টি। কলিং বেলে হাত দেওয়ার সময় আমার হাত কাঁপছিল। নিলয়দার সঙ্গে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো এক জিনিস আর বাড়ির মধ্যে একটা হিংস্র পাগলের সঙ্গে সময় কাটানো…

দরজা খুলে দিল নিলয়দা। তার ডান হাতে পাঞ্জাজোড়া একটা ব্যান্ডেজ। এক মুখ হেসে নিলয়দা বললেন, আরে নীলু, আয় আয়, তোর আর পাত্তাই নেই! আমি ভাবলাম অসুখে ভুগছিস, খবর নিতে পারিনি এর মধ্যে।

স্বর্ণ দাঁড়িয়ে ছিল একটু দূরে। নিলয়দা ওকে দেখতে পাননি। আমি বললাম, স্বর্ণ এসেছে।

 নিলয়দা বলল, স্বর্ণ? কোথায়? স্বর্ণ, আমি তোমার ওপর খুব রেগে গেছি। এর মধ্যে একবারও আসোনি? তোমার দিদিরই-বা কী ব্যাপার বলো তো, সেই যে রাগ করে চলে গেল, তারপর আর একবারও আমার খবর নিল না? এ কী-রকম রাগ? আমি মরলাম কি বাঁচলাম, সে খবরও নেবেনা?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, নিলয়দা, তোমার হাতে কী হয়েছে?

ও, এটা? রাঁধতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছি! আরে, আমার কি রান্নার অভ্যেস আছে? তবে বিশেষ কিছু হয়নি।

আমি আড় চোখে স্বৰ্ণর দিকে তাকালাম। আমাদের দু’জনেরই ধারণা হয়েছিল, পাগলটা নিলয়দাকেও কামড়ে দিয়েছে। কী জানি, নিলয়দা সত্যি কথা বলছে কি না!

স্বর্ণ বলল, নিলয়দা, তুমিও তো আমাদের খবর নাওনি একবারও?

আরে, আমি তো ব্যস্ত ছিলাম। তাছাড়া খালি বাড়ি ছেড়ে যাই কী করে? এসো, ভেতরে এসো, তোমাদের আজ দারুণ সারপ্রাইজ দেব!

স্বর্ণ ব্যগ্রভাবে বলল, সে চলে গেছে?

না, যাবে কেন? যাকে দেখবে, সে একেবারে অন্য মানুষ। বেশি কিছু লাগে না, বুঝলে, একটু সহানুভূতি, একটু সেবা, একটু স্নেহের কথা…।

আমরা এগিয়ে এলাম উঠোনের দিকে। তারপরের দৃশ্য দেখে আমার চক্ষুস্থির।

পাগলের ঘরের দরজা খোলা। বারান্দায় একটা চেয়ারে সে বসে আছে, পরিষ্কার পাজামা আর গেঞ্জি পরা, কোলের ওপর একটা বই।

স্বর্ণ আমার একটা হাত চেপে ধরল। এই প্রথম আমি তার স্পর্শ পেলাম, সঙ্গে সঙ্গে খুবই সাহসী হয়ে উঠলাম আমি। পাগলটা যদি স্বর্ণকে আবার কামড়ে দিতে আসে, আমিও ওর ঘাড় ভেঙে দেব। স্বর্ণর কাছে স্টিলের ছাতা আছে, ওটাই ব্যবহার করতে হবে।

নিলয়দা দারুণ উৎফুল্ল ভাবে বলল, জানিস নীলু, তুই যে ওকে ভোলানাথ নাম দিয়েছিলি, সেই নামে ডাকলে ও দিব্যি সাড়া দেয়। মানুষ চিনতে পারে। দেখবি? এই যে ভোলানাথ, দেখো কারা এসেছে। নীলুকে চিনতে পারছ তো? নীলু, সেই যে দেখেছিলে, অনেক দিন পরে আবার এল!

ভোলানাথ জ্বল জ্বলে চোখে, ঠোঁট বাঁকিয়ে এক ধরনের হাসি দিয়ে বলল, এই যে নীলুবাবু, অনেক দিন আসেননি? কেমন আছেন, হাঃ হাঃ হাঃ। কেমন আছেন? আঃ? হাঃ হাঃ হাঃ!

ভোলানাথের গলার আওয়াজ ছিল ভরাট, গমগমে। এখন সেই আওয়াজ যেন জল মিশিয়ে কেউ পাতলা করে দিয়েছে। হাসিটাও অদ্ভুত রকমের নিষ্প্রাণ।

গর্বিত ভাবে নিলয়দা বলল, দেখলি তো? একদম নর্মাল! ভোলানাথ, স্বর্ণকে চিনতে পারছ তো, স্বর্ণ? আমার শ্যালিকা, ওকে নমস্কার করো।

স্বর্ণকে দেখে যেন খুবই লজ্জা পেয়ে গেল ভোলানাথ, মুখটা নিচু করে মেয়েলি গলায় বলল, নমস্কার।

দেখলি? দেখলি? ডাক্তাররা কিছু পারেনি, কোনও ডাক্তার ভরসা দেয়নি, শুধু আমার নিজের চেষ্টায় স্বর্ণ, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বসো!

আমি আরও চেয়ার আনছি। আমরা বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিলাম।

আরও দুটি চেয়ার এনে নিলয়দা জিজ্ঞেস করল, নীলু, তোর কাছে সিগারেট আছে? দে তো! ভোলানাথ, তুমি সিগারেট খাবে?

ভোলানাথ বলল, সিগারেট? অ্যাঁ? হ্যাঁ, সিগারেট! খাব! সিগারেট খাব! পান খাব।

 এখন তো পান নেই। শুধু সিগারেটই খাও।

একটা সিগারেট নিলয়দা ভোলানাথের ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে অতি সম্মানিত অতিথির মতো তিনটি দেশলাই কাঠি জ্বেলে সেটা ধরিয়ে দিল। তারপর বলল, ভোলানাথ বই-ও পড়তে পারে। শুনবি? ভোলানাথ এঁদের একটু বই পড়ে শোনাও তো।

ভোলানাথের ঠোঁটে সেই অদ্ভুত হাসিটা লেগেই আছে। সেইটা দুহাতে ধরে বলল, হ্যাঁ, পড়ব। বই পড়ব। হাঃ হাঃ হাঃ! আমি বই পড়তে জানি। হাঃ হাঃ হাঃ! এই যে রামায়ণ, আমি পড়ব, রাম বলিলেন, পম্পা সরোবরের কী আশ্চর্য শোভা, দেখো লক্ষ্মণ, এই যে বিশাল বনরাজি, যেন একের সঙ্গে একটা, বৃষ্টি পড়িতেছে, টুপটাপ টাপুর টাপুর টুপটাপ, পাঁচুবাবু ছাতা মাথায় দিয়ে চলে যাচ্ছেন। পাঁচুবাবুর একটা বাছুর আছে, সীতা সেই বাছুরটা ধরতে যাচ্ছে, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, আর বাছুরটা কাদার মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটেছে, দেখো লক্ষ্মণ, পম্পা সরোবরের তীবে এখন সেই বাছুরটা–।

আমি হাসব না কাদব বুঝতে পারছি না। স্বর্ণ আঁচলে মুখ চাপা দিয়েছে, ফুলে ফুলে উঠছে তার শরীর।

নিলয়দা মুগ্ধভাবে তাকিয়ে আছে ভোলানাথের দিকে। ভোলানাথ হঠাৎ থেমে যেতেই সে বলল, হবে, হবে, আস্তে আস্তে। আজ তো অনেকটা ঠিক বলেছে, প্রথম সেন্টেন্স দুটো –।

বইটা সশব্দে বন্ধ করে মাটিতে ফেলে দিল ভোলানাথ। তারপর উঠে দাঁড়াল। সিগারেটটা ডান হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে গাঁজার মতো টানতে টানতে, ঈষৎ টলতে টলতে সে চলে গেল বাথরুমের দিকে।

এবারে আমি স্বস্তির সঙ্গে আমার সিগারেটে টান দিলাম।

নিলয়দা আমার পিঠে একটা চাঁটি দিয়ে বলল, কী রে, মিরাকুলাস ইম্প্রুভমেন্ট না? বল?

 আমি ফ্যাকাসে ভাবে বললাম, হ্যাঁ, অনেকটা উন্নতি হয়েছে।

ও এখন নিজে নিজে পোশাক বদলাতে পারে, খিদে পেলে খাবার চায়। বই পড়া অভ্যেস করছে। আমার ধারণা কি জানিস, কেউ ওর মনে দারুণ কোনও আঘাত দিয়েছে, সেই জন্য মাথাটা একেবারে বিগড়ে গিয়েছিল। বাই নেচার ও কিন্তু ভায়োলেন্ট নয় একেবারেই। পরশু দিন কী হয়েছে শুনবি?

বাথরুমের মধ্যে দু’বার প্রচণ্ড জোরে গলা খাঁকারির আওয়াজ শোনা গেল। আমরা চমকে উঠলাম।

নিলয়দা বললেন, ও কিছুনা ও। একটু বেশি গয়ের ওঠে। পরশু দিন কী হল শোন। আমি রান্না করছিলাম, বেরিয়ে এসে দেখি ভোলানাথ বাড়ির বাইরে চলে গেছে। আমি তো তক্ষুনি খুঁজতে বেরোলাম। ও অনেকটা ভাল হয়ে গেছে, এখন যদি রাস্তার লোক আবার মারধোর করে, তবে সব নষ্ট হয়ে যাবে! আমার মনের মধ্যে যে কী হচ্ছিল, তোদের কী করে বোঝাব! এক ঘণ্টা হেঁটে হেঁটে গোটা তল্লাটটা খুঁজে এলাম। তারপর ক্লান্ত হয়ে যখন ফিরেছি তখন দেখি যে বাইরের দরজার পাশে ভোলানাথ বসে আছে। ঠিক বাড়ি চিনে ফিরে এসেছে। কতটা মায়া পড়ে গেছে তাহলে বোঝ।

আমার মনে পড়ে গেল ড. দত্তগুপ্তর কথা। উনিও এই রকমই হবে বলেছিলেন। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম।

স্বর্ণ জিজ্ঞেস করল, নিলয়দা, তুমি কি ওকে এখানেই রাখবে ঠিক করেছ?

একটু ইতস্তত করে নিলয়দা বলল, এখানে না রেখে ওকে কোথায় পাঠাব? কোনও হাসপাতালে তো নিতে চাইছে না। অনেক খোঁজখবর করলাম। হাসপাতালে ভর্তি করতে হলে নিকট আত্মীয়ের সই লাগে। মহা মুশকিল। তাছাড়া, আমি নিজে ওকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি। আমি নিজেই যদি ওকে পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে পারি, তাহলে কী বিরাট একটা কাজ হবে বলে? অনেকটা এগিয়ে আমি এখন থেমে যেতে চাই না।

স্বর্ণ আবার বলল, নিলয়দা, তুমি আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখেছ? চোখের নিচে কালি, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে, তুমি কতটা রোগা হয়ে গেছে জানো? তুমি ভাল করে ঘুমোও না নিশ্চয়ই।

এবারে আমিও তাকিয়ে দেখলাম, এই দু’সপ্তাহে নিলয়দা চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে, ওকে বেশ রুগ্ন দেখাচ্ছে। মেয়েরাই এটা লক্ষ্য করে আগে।

নিলয়দা একটু ক্লান্ত ভাবে হেসে বললেন, হ্যাঁ, আমার শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে ক’দিন। নিজের হাতে রেঁধে খাওয়া কি আমার পোষায়? এ-রকম ভাবে কত দিন চালাতে পারব! তোমার দিদিকে বলো, এত রাগ কীসের, আজই চলে আসুক। পাপুনের পড়াশুনোর ক্ষতি হচ্ছে।

দিদি বলে দিয়েছে, ওই লোকটা থাকলে দিদি কিছুতেই আর এ বাড়িতে আসবে না। তুমি তো জানো, দিদির জেদ কীরকম?

কিন্তু রূপা না এলে আমার চলবে কী করে? রূপাকে ছাড়া কি আমি জীবন কাটাতে পারি? সত্যি কথা বলছি তোমাকে স্বর্ণ, আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। রূপা আর পাপুনের কথা চিন্তা করেই রাত্তিরে আমার ঘুম আসে না।

প্রচণ্ড জোরে মেঘ ডেকে উঠল। আবার বৃষ্টি আসছে। তার আগেই উঠে পড়া উচিত। নিলয়দা একেবারে অবুঝের মতো কথা বলছে। রূপাবউদির দিকটা নিশ্চয়ই চিন্তা করা উচিত।

আমি বললাম, নিলয়দা, তুমি অফিস ছুটি নিয়ে ক’দিন এভাবে চালাবে। এই সব চিকিৎসা তো দু’এক মাসের ব্যাপার নয়। বউদিই-বা কত দিন বাইরে থাকবে?

তুই ঠিকই বলেছিস রে নীলু, সেকথাটাও ভাবতে হবে!

স্বর্ণ বলল, এক কাজ করো না, ওই লোকটাকে মাদার টেরিজার কাছে পাঠিয়ে দাও। মাদার টেরিজা তো নানা রকম অসুস্থ লোকদের আশ্রয় দেন।

হঠাৎ রেগে গেল নিলয়দা। গলা চড়িয়ে বলল, মাদার টেরেসার কাছে পাঠাব? কেন? কথাটা বলতে তোমার লজ্জা করল না? কলকাতা শহরের যত অসহায় রুগীদের দায়িত্ব মাদার টেরেসা একলা নেবেন, আর আমাদের কোনও দায়িত্ব নেই? মাদার টেরেসার ঘাড়ে সবাইকে চাপিয়ে দিয়ে আমরা হাত ধুয়ে ফেলে মজা দেখব?

স্বর্ণ বলল, তা বলছি না। মাদার টেরেজার একটা বড় প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে ভাল ব্যবস্থা হতে পারে। তুমি একলার চেষ্টায় কতটা পারবে! মনে করো রাস্তায় তুমি আর একদিন দেখলে আর একটা পাগলকে লোকে মারছে, তাকেও তুমি বাড়িতে নিয়ে আসবে?

দেখো স্বর্ণ, আলোচনার মধ্যে সব চেয়ে কুযুক্তি হল হাইপথেটিক্যাল একটা উদাহরণ দেওয়া!

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বাথরুমের দিকে তাকালাম। ভোলানাথ এত দেরি করছে কেন?

ঠিক তখুনি জোরে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল ভোলানাথ। তার গায়ে শুধু গেঞ্জি, পাজামাটা সে আর পরেনি। তার সেই মূর্তি দেখে আমরা তিন জনেই কয়েক মুহূর্ত চুপ। পর্যায়ক্রমে তিন জনের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমি তোমাকে চিনি না, তুমি আমাকে চেনো না। কেউ কারুকে চেনে না। এই হল সোজা কথা, ব্যাস।

নিলয়দা ত্বরিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্বর্ণ, তুমি বাড়ি চলে যাও। নীলু স্বর্ণকে নিয়ে যা, একটু বাড়ি পৌঁছে দে, যা, দেরি করিস না।

ভোলানাথের দিকে চোখ রেখে আমরা এক পা এক পা করে এগোতে লাগলাম সদর দরজার দিকে। আমি আর নিলয়দা স্বর্ণকে আড়াল করে আছি। ভোলানাথ কটমট করে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু এগিয়ে এল না। মাথাটা একটু একটু করে দোলাচ্ছে। হঠাৎ যে-কোনও মুহূর্তে যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

সদর দরজার বাইরে পৌঁছে যাবার পর স্বর্ণ শুধু আর্ত গলায় ‘নিলয়দা’ বলেই থেমে গেল। নিলয়দা স্বর্ণর একটা হাত চেপে ধরে ব্যাকুল ভাবে বলল, স্বর্ণ, প্লিজ, তোমরা আমাকে আর দু’তিন দিন সময় দাও! ও ভাল হয়ে যাবে, নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবে। যদি না হয়, তবে অন্য ব্যবস্থা করব কথা দিচ্ছি। তার আগে আর একটু সময় দাও আমাকে, আর তিন-চার দিন।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়