এরপর প্রত্যেক দিন আমি নিলয়দার কাছে গিয়ে দুতিন ঘণ্টা করে সময় কাটাচ্ছি। চতুর্থ দিনে নিলয়দা জিজ্ঞেস করল, এবার কী-রকম বুঝছিস, নীলু? সবাই যাদের নর্মাল ভাবে, সেই রকম অনেক লোকের মধ্যেও তো এ-রকম একটু আধটু অস্বাভাবিক ব্যাপার থাকেই। থাকে না?

আমি বললাম, তা ঠিক।

অনেক আর্টিস্ট কিংবা কবিও তো আধপাগলা হয়!

ভোলানাথ সত্যিই অনেকটা বদলে গেছে। এখন ওকে আর ভয় পাবার কিছু নেই।

ও তো এখন একটা শিশু! একটু ধমক দিলেই কাঁদে। ওই যে মাঝে মাঝে মাধুরী মাধুরী বলে ওঠেনা? আমার মনে হয় মাধুরী নামের কোনও মেয়ের জন্যই ওর এই রকম অবস্থা হয়েছে। সেই মাধুরীকে যদি পাওয়া যেত! কাগজে তো বিজ্ঞাপন দিলাম, কেউ সাড়া দিল না।

বসবার ঘরের সোফাতেই কাৎ হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে ভোলানাথ। এখন তাকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয় না। সে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে। ভোলানাথের একটা গুণ আছে অন্তত, সে কোনও জিনিসপত্র ভাঙে না।

এই ক’দিন ভোলানাথ একেবারে গুম হয়ে আছে। কথা প্রায় বলেই না। নিলয়দা ওকে বেশিক্ষণ ধরে কিছু বোঝবার চেষ্টা করলে ও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। অত বড় একটা জোয়ান পুরুষমানুষের কান্না দেখলে যেন কেমন কেমন লাগে। আমি কোথায় যেন পড়েছিলাম, পাগলদের সব সময় চোখ শুকনো থাকে, কান্না জিনিসটা তো তীব্র অনুভূতির ব্যাপার। তবে কি ভোলানাথ সুস্থ হয়েই গেল?

নিলয়দা এক জন নামকরা সাইকিয়াট্রিস্টকে ডেকে এনেছিলেন দু’দিন। তার নাম ড. জগন্নাথ ভড়। ভদ্রলোক বেশ সহানুভূতিশীল, দ্বিতীয় দিন তিনি নিলয়দার কাছ থেকে টাকা নিতে চাননি। ড. ভড় বলেছেন যে, এই ধরনের পাগলরা মাঝে মাঝে দু’চার দিনের জন্য খানিকটা স্বাভাবিক হলেও আবার হঠাৎ এই রোগ রিলাপস করে। দীর্ঘস্থায়ী ট্রিটমেন্টে কোনও ফল পাওয়া যেতে পারে। নিলয়দার পক্ষে বাড়িতে রেখে এ-ভাবে ওর চিকিৎসা চালিয়ে যাবার কোনও মানেই হয় না।

ড. ভড় দু’টি পরামর্শ দিলেন। পুরুলিয়ার কোনও এক সেবা কেন্দ্রে এক জন ডেনিশ চিকিৎসক আছেন। তিনি এই ধরনের রোগের চিকিৎসার জন্য জগৎবিখ্যাত। এখন প্র্যাকটিস ছেড়ে তিনি সন্ন্যাসী হয়ে পুরুলিয়ার গরিবদের জন্য কাজ করছেন। তার কাছে নিয়ে গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

আর একটি হল, পুলিশের ওপরমহলে যদি জানাশুনো থাকে তবে সে-রকম এক জনকে ধরে পুলিশের হাতে ভোলানাথকে তুলে দেওয়াই সব চেয়ে ভাল। কোনও কোনও জেলখানায় পাগলদের রাখার ব্যবস্থা আছে। পুলিশের ওপরমহলে আমাদের কোনও চেনাশুনো নেই। সেকথা শুনে ড. ভড় বলেছিলেন যে, এক জন ডিআইজি তার বিশেষ বন্ধু। তিনি নিজেই সেই ডিআইজি-কে অনুরোধ করে দু’এক দিনের মধ্যেই ওকে সরাবার ব্যবস্থা করে দেবেন।

পুলিশের কোনও লোক এখনও আসেনি। নিলয়দা পুরুলিয়ার সেই ডেনিশ ডাক্তারের কাছে চিঠি লিখেছেন। তার অবশ্য উত্তর আসবার সময় হয়নি, কিন্তু আজ চতুর্থ দিন।

এর মধ্যে একদিন আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে নিলয়দা রূপাবউদির সঙ্গে দেখা করে এসেছে। ওদের অনেকটা মিটমাট হয়ে গেছে, কিন্তু রূপাবউদি জেদ থেকে টলেনি, এই পাগল যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ সে এ বাড়িতে ফিরবে না। আর নিলয়দা যে তিন চার দিন সময় চেয়েছিল স্বর্ণর কাছে, সেই কথা তাকে রাখতে হবে।

নিলয়দা বলল, তুই একটা কাজ করতে পারবি, নীলু? তুই রূপাদের বাড়ি চলে যা। রূপাকে একটু বুঝিয়ে বল যে, ভোলানাথ সত্যিই প্রায় ভাল হয়ে গেছে। কাল আমি ওকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম, হেঁটে হেঁটে ঘুরে এলাম গিরিশ পার্ক পর্যন্ত, একবারও একটুও গণ্ডগোল করেনি!

নিলয়দা, এ-সবকথা রূপাবউদিকে বলে কোনও লাভ হবে না। তার থেকে আমি যা বলেছিলাম, সেটাই করো।

আমার আর দু’দিন অফিস ছুটি আছে। এ দুদিন রেখে যদি আর একটু চেষ্টা করতে পারি…।

রূপাবউদির কাছ থেকে তুমি চার দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলে– ।

ড. ভড় যে বলেছিলেন তার কোনও এক ডিআইজি বন্ধুকে বলে পুলিশ পাঠাবেন।

পাঠালেন না, তা তো দেখাই যাচ্ছে। নিলয়দা অনেক রকম ভাবে তো চেষ্টা করা হল। এখন দু’চার দিন রূপাবউদিকে শান্ত করাই তোমার পক্ষে বেশি দরকার। ভোলানাথকে আমি নিয়ে যাচ্ছি, ও সেখানে ভালই থাকবে।

নিলয়দা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, চল তা হলে, আর দেরি করে লাভ নেই!

ভোলানাথকে জাগিয়ে নিলয়দা বলল, চলো ভোলানাথ, আমরা এক জায়গায় যাব। জামাটা পরে নাও!

অত্যন্ত বাধ্য ছেলের মতো ভোলনাথ পাশের ঘরে গিয়ে জামা পরে এল।

নিলয়দা ওপর থেকে নিয়ে এল একটা ছোট সুটকেস। নিজেরই আর দুটো পাজামা আর পাঞ্জাবি আর গেঞ্জি-টেঞ্জি ভরে এনেছে। বাথরুম থেকে নিয়ে এল তোয়ালে আর সাবান। সব গুছিয়ে টুছিয়ে বলল, রাস্তা থেকে টুথপেস্ট আর টুথব্রাশ কিনে নিতে হবে।

ভোলানাথকে বলল, আমার এই চটি পরে নাও, আর চুলটা একটু আঁচড়ে এসো তো।

 ভোলানাথ চটি পরল না, একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল নিলয়দার দিকে।

নিলয়দা আবার মিষ্টি করে বলল, পরে নাও চটি! বাইরে বেরুবার সময় একটু সেজেগুজে বেরুতে হয়। আমি তোমার চুল আঁচড়ে দিচ্ছি, শিখে নাও, এইভাবে রোজ চুল আঁচড়াবে।

ভোলানাথ যদিও নিলয়দার চেয়ে বয়েসে বড়, তবু নিলয়দা এমন যত্ন করে তার চুল আঁচড়ে দিলেন যেন নিজের ছেলে পাপুনকে বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য সাজিয়ে দিচ্ছেন।

ট্যাক্সি নিয়ে আমরা চলে এলাম কালীঘাট। মলয়া বোর্ডিংহাউসের মালিক হরিবাবুর সঙ্গে আমার আগেই কথা বলা ছিল। ঘরটাও আমি সকালে এসে দেখে গেছি। তিন তলার এক কোণে ছোট সিঙ্গল সিটেড রুম। ভাড়া দৈনিক হিসেবে আঠারো টাকা। মাসিক হিসেবে সাড়ে তিনশো।

হরিবাবুর কাছে আমি সত্য গোপন করিনি। আমি তাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছি যে, যাকে এখানে আমরা রাখব, তার একটু মাথার গোলমাল আছে। তবে নিরীহ পাগল, কারও কোনও ক্ষতি করবে না, বোর্ডিং হাউসে মেয়েরা আসে না, বাইরে নোটিশ দেওয়া আছে যে, বোর্ডাররা কেউ নিজেদের ঘরে কোনও আত্মীয়াকেও নিয়ে যেতে পারবে না, সেই জন্যই আমি ও-কথা বলেছি। হরিবাবু রাজি হয়েছেন। হেসে আমাকে বলেছিলেন, আরে ভাই হোটেলের ব্যবসা খুলেছি, যত পাগলদের নিয়েই তো আমার কারবার। টাকাটা অ্যাডভান্স দিয়ে যাবেন।

হরিবাবু সমেত আমরা উঠে এলাম তিন তলায়। হরিবাবু ভোলানাথকে বেশ কয়েক বার দেখে নিয়ে আমার দিকে চোখ বুজে একটা ভুরুর ইঙ্গিত করলেন। অর্থাৎ চলে যাবে।

নিলয়দা বলল, আপনি কারুকে দিয়ে ওর ঘরে খাবার পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারবেন? ও ঘরেই থাকবে, বাইরে বেরুতে বিশেষ পছন্দ করে না।

আমি বললাম, যদি বাইরে বেরুতে চায়, তাহলে বাধা দেবার দরকার নেই।

হবিবাবু বললেন, সে-সব আমি দেখব। আপনারা ছেড়ে দিন না আমার ওপর। কোনও চিন্তা করবেন না। সব ঠিকঠাক থাকবে।

হরিবাবুর কাছ থেকে এ-রকম সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে নিলয়দা বেশ নিশ্চিন্ত হল। এতক্ষণ ওর মুখখানা বিষণ্ণ ছিল, এবারে হাসি ফুটল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘরটা একটু ছোট হলেও বেশ খোলামেলা।

হরিবাবু বললেন, দক্ষিণ খোলা, সেই জন্য এ-ঘরের রেট বেশি। কিন্তু আপনাদের কাছ থেকে বেশি নিইনি!

নিচ থেকে কেউ হরিবাবুকে ডাকতেই তিনি যাবার জন্য উদ্যত হয়ে আমাকে বললে, তাহলে সব ঠিকআছে? যদি বেগড়বাঁই করে, ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেব। এসব কেসে যত ঘুম পাড়িয়ে রাখবেন, ততই উবগার!

ভোলানাথ এ পর্যন্ত একটিও কথা বলেনি। তবে, পর্যায়ক্রমে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনছে। নিলয়দা তাকে কাঁধে হাত দিয়ে বলল, ভোলানাথ, তোমাকে কয়েকটা দিন এখানে থাকতে হবে, বুঝলে? তারপর আমরা পুরুলিয়ায় বেড়াতে যাব। কেমন?

ভোলনাথ নিঃশব্দে চেয়ে রইল শুধু। যেন সে কথা বলতে ভুলে গেছে।

আমি বললাম, চলো, তোমাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিই। খুব সুবিধে আছে, পাশেই বাথরুম। যদি হাওয়া খাওয়ার ইচ্ছে হয় ছাদে ঘুরে বেড়াতে পারো। কাল সকালেই তো আমরা আসছি। যদি কিছু দরকার হয় তো বলবে!

ভোলানাথ কোনও কথা বলবে না ঠিক করেছে। আমার সঙ্গে উঠে গিয়ে বাথরুম দেখল, ছাদে ঘুরে এল কিন্তু মুখে টুঁ শব্দটি নেই।

নিলয়দা ওর বিছানাটা ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে দিল। সুটকেস খুলে পাজামা-পাঞ্জাবি বার করে ঝুলিয়ে দিল আলনায়। ঘরটা দেখে আমারই লোভ হল বেশ। এ-রকম একটা ছোট্ট ঘরে একলা থাকতে পারলে আমি বর্তে যেতাম।

বিদায় নেবার সময় নিলয়দা বলল, তাহলে যাই? লক্ষ্মী হয়ে থাকবে কিন্তু? অ্যাঁ? কয়েক দিন পরেই আমরা পুরুলিয়া বেড়াতে যাব।

ভোলানাথের দু’চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তা দেখে নিলয়দাও কেঁদে ফেলতে যাচ্ছিল, আমি ওর হাত ধরে তাড়াতাড়ি টেনে নিয়ে এলাম ঘরের বাইরে।

বাস স্টপে দাঁড়িয়ে নিলয়দা বলল, ও আমার ওপর অভিমান করেছে।

আমি বললাম, যদি ওর অভিমান হয়, যদি ও সব বুঝতে পারে, তবে তার চেয়ে আনন্দের কথা তো আর নেই!

ও তো সুস্থই হয়ে গেছে রে!

আমার মনে হয়, নিলয়দা, ওকে এবারে মনে আঘাত দিয়ে দিয়ে কিছু কথা বলা উচিত আমাদের। ও যদি কাঁদে, চোখের জলের চেয়ে ভাল চিকিৎসা আর নেই। বাস এসে গেছে, তুমি উঠে পড়ো।

তুই আমার সঙ্গে যাবিনা? চল, ট্যাক্সি নিচ্ছি, রূপাদের তুলে নিই, তারপর বসে বাড়িতে আড্ডা দেওয়া যাবে।

না নিলয়দা, রূপাবউদির সঙ্গে অনেক দিন বাদে তুমি এক সঙ্গে থাকবে, এই সময় স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির থাকা উচিত নয়। এখন তোমাদের নিজস্ব অনেক কথা আছে।

আসলে কি জানিস, রূপা যদি আমায় বেশি বকুনি দেয়, সেই ভয় পাচ্ছি। তবু, তুই থাকলে– অবশ্য তোকেও রূপা বকতে ছাড়ে না।

আজ তুমি একলাই রূপাবউদির বকুনি খাও!

নিলয়দা ঘাড় ঘুড়িয়ে মলয়া বোর্ডিং হাউসের দিকে তাকাল। এখান থেকে ভোলানাথের ঘরটা দেখা যায় না। তবে ছাদের পাঁচিল ধরে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, ভোলানাথ হতেও পারে।

 আমি জিজ্ঞেস করলাম, নিলয়দা, তুমি সাত্যকি বসুমল্লিক বলে কারুকে চেনো?

না তো! সে কে? কী করে?

খুব বড়লোক।

খুব বড়লোক? আর কিছু, মানে কীসে তিনি বিখ্যাত?

সে-রকম কিছু জানি না।

শুধু এক জন বড়লোক, তাকে আমি চিনতে যাব কেন? হঠাৎ এর কথা তুই জিজ্ঞেস করলি যে?

আমার মনে হয়, ওই সাত্যকি বসুমল্লিক একটা বদ্ধ পাগল, কিন্তু সে-কথা কেউ জানে না, সুস্থ সেজে বহু লোকের মাথার পর কেবল ছড়ি ঘোরাচ্ছে!

.

০৬.

শিয়ালদার কাছে প্রচুর সস্তার হোটেল-বোর্ডিং থাকলেও অনেক ভেবেচিন্তেই ভোলানাথকে সেখানে রাখা হয়নি। শিয়ালদা থেকে নিলয়দার বাড়ি বেশি দূর নয়। কালীঘাট থেকে ভোলানাথের পক্ষে রাস্তা চিনে নিলয়দার বাড়ি যাওয়া শক্ত হবে। স্বর্ণর কথা শুনে আমি বুঝেছিলাম, এখন কিছুদিন ভোলানাথকে দূরে সরিয়ে রাখা বিশেষ দরকার। নইলে নিলয়দার দাম্পত্যজীবন নষ্ট হয়ে যাবে একেবারে।

মলয়া বোর্ডিং আমার বাড়ি থেকে কাছেই, সেই জন্য আমি নিলয়দাকে বলেছিলাম সকালে এসে আমিই খোঁজখবর নেব, নিলয়দাকে আসতে হবে না।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম বৃষ্টি হচ্ছে। আমি বৃষ্টি-প্রেমিক। মনটা ভাল হয়ে গেল। চোখ-মুখ না ধুয়েই জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। বৃষ্টির সময় প্রত্যেকটা বাড়িকেই ঠিক গাছের মতো গভীর দেখায়। তবে গাছের সঙ্গে তফাৎ হচ্ছে এই, প্রত্যেকটি বাড়িরই একটা গল্প আছে।

আমার খবরের কাগজ পড়ার নেশা নেই, অন্য দিন যাও-বা একটু উলটে-পালটে দেখা আজ আর ছুঁলামই না। মায়ের কাছে আবদার করে দ্বিতীয় কাপ চা আদায় করে ফিরে এলাম বিছানায়। বৃষ্টি থামবার লক্ষণ নেই।

এখন শুয়ে শুয়ে একটা কবিতার বই পড়লে কেমন হয়? কিন্তু মনে মনে দায়িত্বটা খচ্‌ খচ্‌ করছে। সত্যি কথা বলতে কি, এই রকম একটা সকাল এক জন পাগলের সঙ্গে কাটাতে আমরা একটুও ইচ্ছে করছে না। না গেলে কী হয়? বৃষ্টি যদি আর বাড়ে, রাস্তায় জল জমে ট্রাফিক বন্ধ হয়ে যায়, তবুও যেতে হবে? যা ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, তাতে ভোলানাথ ভালই থাকবে।

কিন্তু আমি তো আর সাত্যকি বসুমল্লিক হয়ে জন্মাইনি যে ইচ্ছেমতো যে-কোনও সকাল বিছানায় গড়িয়ে কাটিয়ে দিতে পারব! একটু বাদেই মা এসে জিজ্ঞেস করল, কী রে তুই এখনো শুয়ে আছিস যে, বাজারে যাবি না?

বাড়ির বেকার ছেলে হিসেবে বাজার করার ভারটা আমারই ওপর। ইদানীং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আমাদের বাড়িতে এক দিন অন্তর বাজার হয়। তাতে আমার খানিকটা ক্ষতিই হয়েছে, কারণ বাজারের পয়সা থেকেই আমার হাত-খরচ তুলতে হয়।

বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছি, দাদা বলল, দাঁড়া, আগে আমি যাব।

 তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দাদা কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো, এই নীলু, তুই আমার ব্লেড নিয়েছিস?

 আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললাম, তোমার ব্লেড? কবে?

আমার একটাই মাত্র ব্লেড ছিল, তুই না নিলে আর কে নেবে? সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে দেখি আমার ব্লেড নেই, এমন বিরক্ত লাগে!

গলা একটু নরম করে দাদা আবার বলল, না বলে নিস কেন? চাইলেই পারিস? চাইলে কি আমি দিইনা?

দাদা বিদেশি ব্লেড ব্যবহার করে। এই ব্লেডের ব্যাপারে দাদা খুব কৃপণ।

আমি ব্লেড চাইলে দাদা একটা আধুলি দিয়ে বলে, তোর ব্লেড কিনে নিস! নিজেরটা কিছুতেই দেবে না। কেন, আমার বুঝি কখনও বিদেশি ব্লেডে মসৃণ ভাবে দাড়ি কামাতে ইচ্ছে হতে পারে না?

ছাতা আর থলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। দাদার কথায় মনটা খিঁচড়ে গেছে, আজ বাজারের পয়সা বেশি করে সরাতে হবে। সাত্যকি বসুমল্লিক বলেছিলেন, আমরা মতো একটা ছেলেকেই তিনি খুঁজছেন। কী কাজ তিনি দিতে চেয়েছিলেন আমাকে?

হঠাৎ মনে হল, আমি যদি পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম, আর নিলয়দার মতো এক জন লোক আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মলয়া বোর্ডিং হাউজের তিন তলার ছোট ঘরটায় রেখে দিত, তাহলে অপূর্ব আনন্দে আমি দিন কাটাতে পারতাম। সারা দিন বই পড়তাম শুয়ে শুয়ে, মাঝে মাঝে বেসুরো গান গাইতাম, আপন মনে হাসতাম কিংবা কাঁদতাম, এর থেকে আর বেশি কী চাই।

কিন্তু নিলয়দার মতো লোক একটাই হয়। ভোলানাথ যে সুযোগ পেয়েছে, সে-সুযোগ আর কেউ পাবেনা।

সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখ গেল রাস্তার মাঝখানে ট্রামলাইনের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক পাগলি। একে আমি আগেও মাঝে মাঝে দেখেছি। মোটাসোটা চেহারা, মাঝবয়সী। কোমরে একটা ছেঁড়া গামছা জড়ানো, কিন্তু তাতে কিছুই লজ্জা নিবারণ হয়নি, উলঙ্গই বলা চলে কিন্তু তার শরীরের চর্বির পরতে পরতে জমে আছে ময়লা, মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা, কেউ বোধহয় তাকে জোর করে একবার ন্যাড়া করে দিয়েছিল। পাগলি একটু অদ্ভুত ভাবে বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা অ্যালুমিনিয়ামের সাকি, সেটা সে এমন ভাবে উঁচিয়ে ধরে আছে, যেন যে-কোনও মুহূর্তে কারুর দিকে ছুঁড়ে মারবে।

আগে রাস্তা-ঘাটে পাগল-টাগল দেখলেই আমি অনেক দূরে সরে যেতাম। আজ একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম পাগলিকে। এরা কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়? কে এদের ছেড়ে দেয় শহরের রাজপথে?

বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে, রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে অনেক মানুষ, অফিসযাত্রীদের ভিড় শুরু হয়ে গেছে। গাড়ি, ট্যাক্সি, রিক্সা, ট্রাম, বাস সব ভর্তি। এই যে এত মানুষ যাচ্ছে, এরা নিশ্চয়ই ভারতীয় ঐতিহ্য, বাংলার সংস্কৃতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, অপসংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক অধিকার, শ্রেণীহীন সমাজ, মানবতা, বিশ্বমানবতা, বিশ্বশান্তি, নারী-পুরুষের সমান অধিকার ইত্যাদি নিয়ে কিছু না-কিছু চিন্তা করে। কিন্তু সকালবেলা প্রকাশ্য রাস্তায় প্রায় উলঙ্গ এক জন রমণীকে দেখে, কেউ কোনও ভ্রূক্ষেপও করছে না।

আমিও এই পাগলির জন্য কিছুই করতে পারব না। কিন্তু আমি যদি নিলয়দাকে সাহায্য না করি, তাহলে মানুষ হিসেবে আমি খুবই ছোট হয়ে যাব। তাড়াতাড়ি বাজারটা সেরেই আমি ছুটলাম কালীঘাটের দিকে।

আগে এক তলার অফিস ঘরে ঢুকে হরিবাবুর কাছে খোঁজ নেব ভেবেছিলাম, কিন্তু তিনি নেই। সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম ওপরে।

ভোলানাথের ঘরের দরজাটার এক পাল্লা খোলা, জানালার ধারে বাইরের দিকে চেয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঘরের মধ্যে ঢুকে এলেও সে মুখ ফেরাল না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ, ভোলনাথ? রাত্তিরে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

 ভোলানাথ আমার চেয়ে বয়েসে অনেক বড় হলেও আমি তাকে তুমি বলতে শুরু করেছি। পাগল মানেই তো শিশু।

ভোলানাথ মুখ ফিরিয়ে আমার আপাদমস্তক দেখল। তারপর জল-মেশানো পাতলা গলায় বললে, মেঘ করলে আমার কষ্ট হয়, মাথায় ব্যথা করে, খুব ব্যথা করে! আকাশে এত মেঘ!

যে-কেউ এখন শুনলে ভাববে ভোলানাথ সুস্থ লোকের মতো কথা বলছে। গত চার দিন সে একটাও কথা বলেনি। তবু ভোলানাথের এই স্বাভাবিকতাতেও আমার একটু গা ছম ছম করে।

খাট ছাড়া ঘরে একটি মাত্র চেয়ার আছে। তাতে বসে আমি বললাম, বৃষ্টি শুরু হয়েছে তো, মেঘ এবারে কেটে যাবে।

ভোলানাথ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, সিগারেট?

আমি একটা সিগারেট আর দেশলাই এগিয়ে দিলাম ওর দিকে। নিলয়দার মতো ওর সিগারেট জ্বালিয়ে দিলাম না। দেখা গেল ভোলানাথ ইচ্ছে করলে দিব্যি নিজের সিগারেট ধরাতে পারে। পোড়া কাঠিটা তার হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল, সেটা তুলে নিয়ে সে ফেলে দিল জানলা দিয়ে।

তোমার খাওয়া-দাওয়ার কোনও অসুবিধে হয়নি তো? রাত্তিরে খেয়েছ ভাল করে? সকালে চা দিয়েছে?

ভোলানাথ সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললে, একটা বাড়ি আগুনে পুড়ে গেল, কেউ দেখেনি, তবু পুড়ে গেল, সেই বাড়ির মানুষ যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল, তবু কেউ কারুকে কিছু বলে না। প্রত্যেকেই মনে মনে অন্যকে দোষ দেয়। আমি বললাম, আগুন-লাগা বাড়িতে থাকতে নেই, কেউ শুনল না।

আমি সচকিত হয়ে বললাম, আগুন লেগেছিল? কার বাড়িতে? তোমার বাড়িতে?

অনেক বাড়িতে আগুন লাগে, কেউ দেখে না।

তোমার বাড়ি কোথায় ছিল, ভোলানাথ?

হাত পোড়ে না, পা পোড়ে না, তবু আগুন জ্বলতেই থাকে! জ্বলতেই থাকে।

আমি আগেও এটা লক্ষ্য করেছি যে, ভোলানাথ যখন অনেকটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে, তখনও সে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেয় না। নিজের কথাটাই শুধু বলে। তবু আমার মনে হল, ভোলানাথ যেন স্মৃতিচারণ করতে শুরু করেছে। মানুষের স্মৃতি যে কত দামি তা কোনও পাগলের সংস্পর্শে এলেই ভাল করে বোঝা যায়। স্মৃতির অভাবেই তো ওদের এত কষ্ট।

কোনক্রমে যদি ওর পূর্ব পরিচয় কিংবা বাড়ি-টাড়ির সন্ধান পাওয়া যায় সেই জন্য আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ভোলানাথ, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল? মনে পড়ছে? আগুন লেগেছিল সেই বাড়িতে? কে কে ছিল তোমার?

ভোলানাথ বলল, বাদলা পোকা। বাদলা পোকা!

কী বলছ?

বাদলা পাকা যেমন আগুনে ঝাঁপ দেয়, অনেক মানুষও ইচ্ছে করে আগুনে ঝাঁপ দেয়। নিজেরা কিন্তু কিছুই জানে না। কী যে পুড়ে যাচ্ছে তা-ও জানে না! হাঃ হাঃ হাঃ!

আমি চুপ করে গেলাম। এ তো অন্য রকম আগুনের কথা বলছে। পাগল হবার আগে ভোলানাথ বোধহয় খুব একটা সাধারণ মানুষ ছিল না। এক ধরনের উপলব্ধি না থাকলে তো মানুষ এ-রকম কথা বলতে পারে না।

হাতের সিগারেটটা চোখের সামনে ধরে ভোলানাথ আবার বলল, এই যে সিগারেটটা নিজে নিজে পুড়ছে, মানুষও এই ভাবে নিজে নিজে পোড়ে। কিন্তু বোঝা যায় না। বাইরে থেকে দেখো, সব ঠিক আছে, চেহারা ঠিক আছে, বুকের লোম ঠিক আছে, ধুৎ!

জুলন্ত সিগারেটটা সে প্রচণ্ড জোরে ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে। তারপর আমার দিকে চেয়ে লাজুকের মতো হাসল।

আমি জুতো দিয়ে ওর সিগারেটের আগুনটা নিভিয়ে দিলাম। এক জন মানুষ আমার সামনে বসে সুস্থ লোকের মতো কথা বলে যাচ্ছে, অথচ আমার কোনও প্রশ্নের সে উত্তর দেবে না। আমার সঙ্গে কোনও রকম মানসিক সংযোগ হবে না। এটা যে কত কষ্টকর তা যার অভিজ্ঞতা নেই সে বুঝবে না। পাগলের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বোধহয় স্পেশাল কিছু ট্রেনিং লাগে। আমার তা নেই, সুতরাং আমি চুপ করে থাকাই ঠিক করলাম।

ভোলানাথ বললে, নদী নেই একটাও! কোথায় নদী? মানুষ নদীতে স্নান করে, পুকুরে স্নান করে, পাতকুয়োয়, না, পাতকুয়োয় না খালে, আর সমুদ্রে, আর নদীতে স্নান করে, খুবস্নান করে, ডুব দিয়ে দিয়ে স্নান করে, নাক টিপেজলের মধ্যে ডুব দেয়, কিনারা ছেড়ে মাঝখানে চলে যায়, সবসময় বুকটা জ্বলে যাচ্ছে কিনা! জুড়োতে হবে তো! তারপর ধরো তোমার…ইয়ে…ধরো তালগাছ। তালগাছ লম্বা হয় বলে কি তুমিও তার সমান লম্বা হতে পারবে? পারবে না! তবু শুধুমুদু যাওয়া কেন? তারপর ধরো ঘড়ি। এই ইয়ে তোমার ঘড়ি প্রত্যেক ঘণ্টায় বাজে বলে তুমিও ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাজবে? অ্যাঁ? ঘড়িতে দম দিতে হয় বলে তুমিও নিজে দম দিচ্ছ, মোচড় মোচড় করে দম দিচ্ছ। আরে বাবা, দম দিলেই কি সব জিনিস বাজে? অত সহজ নয়, অ্যাঁ? তারপর ধরো, সিঁড়ি! ওদের বাড়ির সিঁড়িটা ভেঙে গেল বলে তুমিও তোমার নিজের বাড়ির সিঁড়ি ইচ্ছে করে ভেঙে ফেলবে? অ্যাঁ?

আমি আর না থাকতে পেরে বলে উঠলাম, কার বাড়ি ভোলানাথ? কোন বাড়ির সিঁড়ি ভেঙে গেছে?

ভোলানাথ চেঁচিয়ে উঠলো, কে?

দরজা ঠেলে ঢুকল নিলয়দা। আমার ওপর ভরসা করতে পারেনি। সকালেই চলে এসেছে। আমাকে দেখে একটু লজ্জা পেয়ে বলল, সকাল থেকেই এত বৃষ্টি, ভাবলাম তুই আসতে পারবি না। সাউথে এতটা নয় দেখছি, নর্থে তো সাঙ্ঘাতিক বৃষ্টি হচ্ছে! কেমন আছ, ভোলানাথ।

ভোলানাথ বলল, হ্যাঁ, বৃষ্টি হলে মেঘ কেটে যায়! মেঘ ভাল না বৃষ্টি ভাল।

নিলয়দার হাতে এক প্যাকেট সন্দেশ। বেশ উৎফুল্ল গলায় বলল, কোনও গণ্ডগোল হয়নি, সব ঠিকঠাকই তো আছে, না রে নীলু? আমি রাত্তিরে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখলাম।

প্যাকেটটা খুলে ভোলানাথের দিকে এগিয়ে সস্নেহে নিলয়দা বলল, খাও। আমাকে প্রায়ই ট্যুরে যেতে হয়। হোটেলে কী যে খাবার দেয়, আমি তো জানি! নীলু নে, তুই-ও নে।

ভোলানাথ এক সঙ্গে দুটো সন্দেশ নিয়ে মুখে ভরে দিল। তার ঠোঁট মাখামাখি হয়ে গেল সন্দেশের গুড়োয়। নিলয়দা পকেট থেকে রুমাল বার করে বলল, আরে, ও-ভাবে খায় না, একটা একটা করে খেতে হয়।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, নিলয়দা, তুমি যখন এসে গেছ, আমি তাহলে চলি! সব পারফেকটলি নর্মাল। ভোলানাথ এতক্ষণ আমাকে অনেক ভাল ভাল কথা শোনাচ্ছিল। একটা টেপ রেকর্ডার থাকলে বেশ হত!

রাস্তায় বেরিয়ে আমি উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে লাগলাম। ঝুরু ঝুরু বৃষ্টি পড়েই চলেছে। কিন্তু জলে জমেনি। এখন কোথাও গেলে হয়। কিন্তু কোথায় যাব, কার কাছে যাব? রানিদের বাড়িতে এই সময় যাওয়া যায় না। শুক্কুরবার সকাল দশটায় অন্য বন্ধুদেরও ব্যস্ত থাকে। এখন কফি হাউসে কেউ আসবেনা।

হঠাৎ আমার মনে হল, অনেক দিন সমুদ্রের ধারে যাইনি। গত এক বছরে কোথায় কোথায় গেছি? নেতারহাট, আগরতলা, দুবরাজপুর, মগমা, বাঁকুড়া থেকে মুকুটমণিপুর, কিন্তু সমুদ্রের দিকে তো যাওয়া হয়নি।

সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখা…এক্ষুনি যাওয়া যায় না? ময়দান থেকে বাসে দিঘা যাওয়া যায় তিন ঘণ্টায়। কিংবা ফ্রেজারগঞ্জ হয়ে বকখালি, সেখান থেকে জেলে ডিঙি নিয়ে…। যদি আর একজন কারুকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যেত!

রাজপথে অন্য সকলেই এখন নানা রকম কাজে ব্যস্ত হয়ে চলেছে, কোথায় যেন লোহার দামে সোনা নিলাম হয়ে যাচ্ছে, সেই দিকে ছুটছে সবাই।

শুধু আমারই কোনও উদ্দেশ্য নেই। ইলশেগুড়ি বৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমি হাঁটছি, আমার যেন শরীর নেই, শুধু একটা আত্মা, আমাকে কেউ চিনতে পারছে না, একটা লোকও আমার সঙ্গে ডেকে কথা বলছে না।

কালীঘাট ব্রিজ পেরিয়ে আমি যেতে লাগলাম জেলখানার পাশ দিয়ে। এদিকে কেন, কোন কারণ নেই। জেলখানার উঁচু দেয়াল আগে ভাল করে লক্ষ্য করে দেখিনি। বেশ পুরু ব্যবস্থা। এই মুহূর্তে যদি কযেকটা কয়েদি পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাবার চেষ্টা করত, বেজে উঠত পাগলা ঘণ্টা, দুমদাম গুলির শব্দ, বেশ একটা সিনেমা-সিনেমা ব্যাপার, দারুণ হত তাহলে। আমি পলাতকদের বলতাম, চলো, চলো, আমি তোমাদের সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।

জেলখানার দেয়ালের ধার ঘেঁষে ঘেঁষেই আমি ঘুরে গেলাম বেকার রোডে। এই রাস্তা ধরে সোজা ময়দানে পড়া যায়। ময়দানে গিয়ে একটা গাছের নিচেও শুয়ে থাকা যায় কিছুক্ষণ, যতক্ষণ না খিদে পায় খুব।

ন্যাশানাল লাইব্রেরির ছোট গেটটার সামনে দিয়ে যেতে যেতে মনে হল, ঢুকব নাকি? অনেক দিন যাইনি। কিন্তু আমার কার্ড নেই। পরীক্ষা পাশেরও গরজ নেই, বিদ্বান হবারও শখ নেই, তাহলে যাব কেন? অবশ্য এই গেটটা দিয়ে ঢুকে চিড়িয়াখানার দিকের বড় গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়, তাতে শর্ট কাট হবে।

ভেতরে ঢোকার পর মনে হল, আমার নিয়তিই যেন আমাকে এখানে টেনে এনেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, স্বর্ণর সঙ্গে সম্প্রতি পরিচয় হবার আগে ওকে তো আমি কোথাও দেখিনি। ওর মতো মেয়েকে দেখলে নিশ্চয়ই মনে থাকত। অথচ এখন কফিহাউসে, রাস্তায় প্রায়ই স্বর্ণর সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। আজও কি আকস্মিক দেখা? স্বর্ণ যে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে নিয়মিত আসে, সেটা কি আমি জানতাম? অবচেতনে কোথাও ছিল, সেই জন্যই আমি এ-দিকে এসেছি?

স্বর্ণর মাথায় একটা টুকটুকে লাল রঙের ছাতা, আর একটি লম্বা চেহারার যুবক তার পাশাপাশি হাঁটছে, তার মাথা কিন্তু ছাতার বাইরে। ওরা লাইব্রেরির সিঁড়ি দিকে না গিয়ে যাচ্ছে বড় গেটের দিকে।

স্বর্ণকে দেখে আমার বুকটা ধক্ করে উঠল কেন? ভয়ে? হায় নীললোহিত, তোমার এই অবস্থা, সুন্দরী মেয়েদের দেখেও তুমি ভয় পাচ্ছ! ভয় ছাড়া আর কী, প্রেম তো নয়। স্বর্ণ দেখা হলেই বকুনির সুরে কথা বলে। স্বর্ণর পাশে যে হাঁটছে, তার নাম জয়দীপ না জয়নন্দন কী যেন, একটা ওয়াটারপ্রুফ কোম্পানির মালিকের ছেলে, এটুকু আমি জানি। আমার কফি হাউসের বন্ধুরা স্বর্ণ সম্পর্কে অনেক খবর রাখে। প্রত্যেক বছরেই আড্ডাধারীরা একটি কোনও নিয়মিত তরুণীকে মিস কফি হাউস আখ্যা দেয় মনে মনে। এ বছর স্বর্ণ সেই মুকুট পেয়েছে।

আমি উলটো দিকে ফিরে আবার ছোট গেট দিয়েই বেরিয়ে গেলাম। স্বর্ণর চোখে পড়তে চাই না। ফট করে হয়তো জেরা করে বসবে, আমি ন্যাশনাল লাইব্রেরির কাছে ঘুর ঘুর করছি কেন? আমি রিসার্চ স্কলার নই, অমুক নই, তমুক নই। মূল রাস্তা দিয়ে ঘুরে এসে আমি চিড়িয়াখানার গেটের সামনে দাঁড়ালাম। সিগারেট কিনতে হবে। অবশ্য চিড়িয়াখানার ভেরতটায় একবার ঘুরে আসা যায়।

সিগারেট ধরিয়ে মুখ ফিরিয়েই দেখলাম, স্বর্ণ প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছে, একা। ছাতাটা গুটিয়ে নিয়েছে, কাঁধে একটা বইয়ের ঝোলা। একটা থ্রি বি বাস দাঁড়িযে, স্বর্ণ সেটাই ধরতে চায়, কিন্তু এসে পৌঁছোবার আগেই বাসটা ছেড়ে গেল। এই বর্ষার দিনেও স্বৰ্ণর মুখটা রাগে গনগনে হয়ে আছে। দূরে, বড় গেটের মাঝখানে বিবেকানন্দর ভঙ্গিতে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রেমিক।

আমি দেওয়ালের সঙ্গে একেবারে মিশে রইলাম। দেখাই যাক না নাটকটা কোন দিকে গড়ায়। স্বর্ণ এ-দিক ও-দিক মুখ ঘুরিয়ে ট্যাক্সি খুঁজছে।

জয়দীপ বা জয়নন্দন কিন্তু দূরেই দাঁড়িয়ে রইল। আচ্ছা বোকা ছেলে তোর মেয়েরা রেগে গেলে দূরে থাকতে নেই, কাছে এসে তাদের আরও রাগিয়ে দিতে হয়, তা-ও জানে না।

যাত্রী-বোঝাই একটা ট্যাক্সি এসে থামতেই স্বর্ণ ছুটে গেল সে-দিকে। যাত্রীরা সবাই নেবে যাবার পর স্বর্ণ উঠতে যেতেই, ড্রাইভার বলল, যাবে না, এ গাড়ি আর যাবে না! স্বর্ণ দরজা খুলে তবু জোর করে উঠে পড়বার চেষ্টা করছে, ড্রাইভারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হাত বাড়িয়ে বাধা দিচ্ছে তাকে। আজকাল ট্যাক্সিচালকদের একটুও শিভালরি নেই!

স্বর্ণ ট্যাক্সির দরজার হাতল শক্ত করে ধরে আছে, কিছুতেই ছাড়বেনা। এবারে ট্যাক্সিওয়ালা ওকে অপমান করবে। এই অবস্থা দেখেও নির্বিকারে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তার প্রেমিক এখনও দাঁড়িয়ে দেখছে। ব্যাপারটা ঠিক যেন একটা ত্রিভুজের মতো। ট্যাক্সির কাছে স্বর্ণ, খানিকটা দূরে এক কোণে আমি, আর এক কোণে তার প্রেমিক। ওই ইডিয়টটা এখনও চুপ করে আছে কেন?

ট্যাক্সিচালক জোরে কর্কশ গলায় কিছু একটা কথা বলতেই আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, কী ব্যাপার, যেতে চাইছে না? ট্যাক্সিওয়ালাদের জব্দ করার সব চেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে ট্যাক্সিতে না চড়া।

ড্রাইভার বলল, ওনাকে বলছি, গাড়ি খারাপ আছে, গ্যারেজে যেতে হবে!

আমি তাকে পোকা-মাকড়ের মতো অগ্রাহ্য করে স্বর্ণকে আবার বললাম, কাছেই একবালপুরের মোড়ে মিনিবাসের স্ট্যান্ড আছে, চলুন আমি আপনাকে সেই পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছি।

স্বর্ণ গাড়ির হাতল ছেড়ে দিল। তারপর টানা টানা সুন্দর চোখ দুটিতে অগ্নিবর্ষণ করে সে জিজ্ঞেস করল, আপনি, এই সময়…এখানে কী করছেন?

জানতাম, এ মেয়ে প্রথমে এই কথাই বলবে। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ঢোকার যোগ্যতা আমার না থাকতে পারে, কিন্তু শখ করে আমি কি চিড়িয়াখানাতেও যেতে পারি না?

আমি বললাম, নতুন একটা সিংহ এসেছে চিড়িয়াখানায়, দেখতে যাবেন?

নাঃ! আপনি ট্যাক্সিটাকে ছেড়ে দিলেন কেন, আমি ঠিক উঠতাম।

 পর পর দু’জনের সঙ্গে ঝগড়া করতে নেই!

স্বর্ণ এর উত্তরে কিছু বলবার আগেই আমি বড় গেটের দিকে হাতছানি দিয়ে ওর প্রেমিককে ডাকলাম। ওয়াটারপ্রুফ কোম্পানির মালিকের ছেলেটি তো খুব গোঁয়ার দেখছি, হন হন করে চলে যাচ্ছে লাইব্রেরির দিকে।

স্বর্ণ আমাকে ধমক দিয়ে বলল, ওকে ডাকছেন কেন? আপনি… আপনাকে কে এখানে মাথা গলাতে বলেছে। আপনি যেখানে যাচ্ছিলেন, সেখানে যান।

আমি তো কোথাও যাচ্ছি না!

এই যে বললেন, সিংহ দেখতে যাবেন।

একলা একলা কেউ সিংহ দেখতে যায়? আসলে কি জানেন, একটু আগে আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সমুদ্রের ধারে যাওয়ার, তার বদলে চিড়িয়াখানায় চলে এলাম।

স্বর্ণ সোজাসুজি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ কয়েক মুহূর্ত সময় নিল। তারপর নীরস গলায় বললো, দেখুন, আপনার এ-সব ন্যাকামির কথাবার্তা শুনতে আমার একটুও ভাল লাগছে না। প্লিজ, লিভ মি অ্যালোন! আমাকে বিরক্ত করার কোনও অধিকার নেই আপনার।

এ-রকম কথা শুনে আমার অপমানিত বোধ করা উচিত ছিল, কিন্তু বোঝাই তো যাচ্ছে, এসব স্বর্ণর অতিরিক্ত রাগের কথা! রাগ হলে এক-এক জনের আর কোনও জ্ঞান থাকে না, মুখের ভাষাও খুব খারাপ হয়ে যায়। স্বর্ণকে বিরক্ত করাও আমার অভিপ্রায় নয়, কিন্তু এক ক্রুদ্ধ সুন্দরী যুবতীকে কলকাতার ট্যাক্সিচালকদের হাতে সমর্পণ করাও তো যায় না!

আমি বললাম, ওই যে একটা মিনিবাস আসছে, খুব বেশি ভিড় নেই।

না, আমি ট্যাক্সিতেই যাব।

 ঠিক আছে। আপনার ট্যাক্সিতে আমাকে একটু লিফট দেবেন?

স্বর্ণ রীতিমতো চেঁচিয়ে বলে উঠল, আই হেইট ইউ! আই হেইট ইউ অল! আপনারা সবাই সমান! আপনারা সবাই স্বার্থপর! শুধু নিজেদের জেদটাই আপনারা বজায় রাখতে চান।

অন্যের হয়ে গালাগালি খেতে আমার খারাপ লাগেনা, কিন্তু স্বৰ্ণর চোখ দুটি বড় বেশি উজ্জ্বল, বেশ অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সমস্ত পুরুষ জাতির প্রতি ঘৃণা। এ লক্ষণ তো ভাল নয়। উইমেন্স লিব এর সমর্থক নিশ্চয়ই স্বর্ণ, তাহলেও এত ঘৃণা কীসের! যারা মেল শোভেনিস্ট তারা কিন্তু মেয়েদের প্রতি ভালবাসা জানাবার ব্যাপারে অকৃপণ।

এইসময় ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেল। স্বর্ণ ছাতাটা খুলে ফেলল ফটাস করে। আমি চিড়িয়াখানার গেটের দিকে দৌড়ে যাব ভেবেছিলাম, পরক্ষণেই মত বদলে ফেলে স্বর্ণর কাছ ঘেঁষে চলে এলাম ছাতার তলায়। স্বর্ণ সঙ্গে সঙ্গে সরে গলে কয়েক পা। মুখ ফিরিয়ে বলল, ঘেন্না করি। আপনাদের সবাইকে আমি ঘেন্না করি।

ঝট করে আমার মনে হল, স্বর্ণর মাথাতেও পাগলামির লক্ষণ নেই তো? কয়েক দিন আগেও আমার সঙ্গে বেশ স্বাভাবিক ব্যবহার করেছে। কিংবা রাগে-দুঃখে স্বর্ণ এখনই পাগল হয়ে যাচ্ছে। এই সময় আমার কী করা উচিত? ওয়াটারপ্রুফের বাড়ির ছেলেটি কী বলেছে স্বর্ণকে? কাপুরুষ! একটা মেয়েকে রাগিয়ে দিয়ে তার পরে পালিয়ে যায়!

আর একটা ট্যাক্সি এসে থামতেই আমি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার সামনে। এই ড্রাইভার এক কথাতেই যেতে রাজি। আমি স্বৰ্ণর কাছে এসে খুব মিনতি ভরা গলায় বললাম, প্লিজ, আসুন, আমিও আপনাদের বাড়ির দিকে যাব।

উত্তর না দিয়ে স্বর্ণ চলে এল ট্যাক্সির কাছে। ছাতাটা না গুটিয়েই সে উঠতে যাচ্ছিল, আমি ওর হাত থেকে নিয়ে সেটা বন্ধ করে ফেললাম। তারপর মাঝখানে অনেকটা জায়গা ফাঁক রেখে দু’জানলার পাশে বসলাম দুজনে।

ট্যাক্সিটা চলতে শুরু করার পর পেছনের কাচ দিয়ে দেখলাম ওয়াটারপ্রুফের বাচ্চা আবার গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে আর ভিজছে বৃষ্টিতে। ভিজুক!

খালটা পার হবার পর আমি খুব কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে, স্বর্ণ? হঠাৎ এত রেগে গেলেন?

কোনও উত্তর নেই।

আমি কি আপনার কাছে কোনও অন্যায় করেছি?

স্বর্ণ মুখ ফেরাল রাস্তার দিকে! আমি তবুও ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি, আমি আপনার সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠেছি বলে কি আপনি খুবই অপছন্দ করছেন? আমি নেমে যেতে পারি এখানে।

এবার স্বর্ণ কান্নায় ভেঙে পড়ল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি, কিন্তু স্বৰ্ণর কান্না একেবারে পাহাড়ি ঢলের মতো। দু’হাতে মুখ ঢেকে সে তার হৃদয়টাকে যেন সহস্র টুকরো করে ফেলছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। ট্যাক্সি ড্রাইভার অবাক ভাবে পেছন ফিরে দেখতে লাগল।

আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলাম এবার। স্বর্ণর মতো তেজি মেয়ে যে এ-রকম অসহায় ভাবে কখনও কাঁদতে পারে, তা আমি কখনও ভাবিনি। স্বর্ণর গায়ে হাত দিয়ে তাকে সান্ত্বনা জানাবার সাহস আমার নেই। কারুর কান্না দেখে এ-রকম খুশি আমি হইনি আগে কোনও দিন। আমি একটা সিগারেট ধরালাম।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়