ভোরবেলাতেই রংলাল সদলে আসিয়া ডাকাডাকি শুরু করিল। অতি প্রত্যুষে উঠিয়া কাজ করার অভ্যাস মানদার চিরদিনের; সে কাজ করিতে করিতেই বিরক্ত হইয়া উত্তর দিল, কে গো তুমি? তুমি তো আচ্ছা নোক! এই ভোরবেলাতে কি ভদ্দর নোকে ওঠে নাকি? এ কি চাষার ঘর পেয়েছ নাকি?

রংলাল বিরক্ত হইয়া উঠিল, কণ্ঠস্বরের মধ্যে যথাসাধ্য গাম্ভীর্যের সঞ্চার করিয়া সে বলিল, ডেকে দাও, ছোটদাদাবাবুকে ডেকে দাও। জরুরী কাজ আছে।

কি, কাজ কি?

তুমি মেয়েছেলে নোক, তুমি সে বুঝবে না। জরুরী কাজ।

মানদার স্বর এবার রুক্ষ হইয়া উঠিল, সে বলিল, জরুরী কাজ আছে, তোমার আছে। আমার কি দায় পড়েছে যে, এই ভোরবেলাতে ঘুম ভাঙাতে গিয়ে বকুনি খাব? আর তুমি এমন করে চেঁচিও না বলছি, ঘুম ভেঙে গেলে আমাকে বকুনি খেতে হবে।

রংলাল বুঝিল, মানদা মিথ্যা কথা বলিতেছে, একটু মাতব্বরি করিবার চেষ্টা করিতেছে। অহীন্দ্রকে সে ভাল করিয়াই জানে, তিনি নিজেই তাহাকে ভোরবেলা ডাকিবার জন্য বলিয়া রাখিয়াছেন। মনে মনে সে একটু হাসিয়া সে কণ্ঠস্বর উচ্চ করিয়া ডাকিল, ছোটদাদাবাবু! ছোটদাদাবাবু! ছোটবাবু!

দোতলার উপর হইতে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং রুক্ষ স্বরে কে উত্তর দিল, কে? কে তুমি?

সে কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্যে ও রুক্ষতায় রংলাল চমকিয়া উঠিল, বুঝিল, কর্তা রামেশ্বর অকস্মাৎ জাগিয়া উঠিয়াছেন; ভয়ে সে শুকাইয়া গেল। তাহার সঙ্গে আরও যে কয়েকজন আসিয়াছিল, তাহারাও সভয়ে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বাড়ির ভিতরে উঠান হইতে উত্তর দিল মানদা, বলিল, আমি বার বার বারণ করলাম দাদাবাবু, তা কিছুতেই শুনলে না। বলে, তুমি মেয়েছেলে নোক, বুঝবে না, জরুরী কাজ।

এবার অহীন্দ্রের কণ্ঠস্বর বেশ বোঝা গেল, সে কণ্ঠস্বরে এখনও ঈষৎ অপ্রসন্নতার আভাস ছিল, অহীন্দ্র বলিল, ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। রংলাল বুঝি? হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই তো আসতে বলেছিলাম।

রংলাল বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া গিয়াছিল, সে তখনও ভাবিতেছিল, সে কণ্ঠস্বর ছোটদাদাবাবুর? অহীন্দ্রের এই পরিবর্তিত স্বাভাবিক কথার কোন উত্তর দিতে পারিল না।

অহীন্দ্র আবার বলিল,এই আমি এলাম বলে রংলাল। একটু অপেক্ষা কর।

কিছুক্ষণ পরেই হাসিমুখে সে ভিতর হইতে কাছারির দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া আসিল। বারান্দায় একা রংলাল নয়, তাহাদের পুরানো নগদী নবীন লোহার ও আরও দুই-তিনজন রংলালের অন্তরঙ্গ চাষী অপেক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। নবীনের হাতে হাত-চারেক লম্বা খান-চারেক বাখারি, রংলালের হাতে এক আঁটি বাবুইদড়ি, অন্য একজনের হাতে গোটাচারেক লাল কাপড়ের পতাকা।

অহীন্দ্র দলটিকে দেখিয়া হাসিমুখে বলিল, ওঃ, তোমরা তো খুব ভোরে এসেছ রংলাল? আমি আবার ভোরে উঠতে পারি না। কিন্তু, ও লাল পতাকা কি হবে নবীন?

রংলাল একটু আহত হইয়াছিল, সে কোন উত্তর দিল না। উত্তর দিল নবীন লোহার, তাহাদের পুরানো নগদী, আজ্ঞে, আজ আমাদের কায়েমী দখল হবে কিনা, তাই চার কোণে পুঁতে দিতে হবে।

কল্পনাটা অহীন্দ্রের খুব ভাল লাগিল, সে বলিল, বাঃ, সে বেশ হবে। চল এখন, বেলা হয়ে যাচ্ছে।

রংলাল ক্ষুণ্ণস্বরে বলিল, ঘুমটা আপনার এই সকালে ভাঙিয়ে দিলাম দাদাবাবু! ভারি ভুল হয়ে গেল মশাই, টুকচে পড়ে ডাকলেই হত।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, না না, সে ভালই হয়েছে রংলাল। হঠাৎ ঘুম ভাঙলেই আমার মেজাজ বড় খারাপ হয়ে যায়। তোমাদের কিছু বলি নি তো রংলাল?

রংলাল এইটুকুতেই যেন জল হইয়া গেল, বলিল, আজ্ঞে না। সে আমরা কিছু মনে করি নাই। এখন চলুন, রোদ উঠলে তখন আবার ভারি কষ্ট হবে আপনার।

ক্ষুদ্র বাহিনীটি বাহির হইয়া পড়িল। রংলাল কিন্তু উসখুস করিতেছিল, তাহার কয়েকটা কথা এখনও বলা হয় নাই। কাল হইতেই কথাটা বলিবার সঙ্কল্প তাহার ছিল, কিন্তু অহীন্দ্রের রুক্ষতায় আঘাতে সমস্তই কেমন উল্টাইয়া গেল। পথ চলিতে চলিতে অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া কথাটার ভূমিকা রূপেই সে হাসিয়া বলিল, বুঝলে লবীন এই যে কথায় বলে, বাঘের প্যাটে বাঘ হয়, সিংগীর প্যাটে সিংগী হয়, এ কিন্তু মিথ্যে লয়।

নবীন অর্থও বুঝিল না, উদ্দেশ্যও বুঝিল না, কিন্তু গম্ভীরভাবে কথাটাকে সমর্থন করিয়া বলিল, নিচ্চয়।

অহীন্দ্র কৌতুকে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

রংলাল বলিল, হাসবেন না দাদাবাবু, হাসির কথা লয়। আমার পিলুই বলে চমকে উঠেছিল! বুঝলে লবীন, দাদাবাবু হাঁকলেন, কে, কে তুমি? বললে না পেত্যয় যাবে ভাই, আমার ঠিক মনে হল কর্তাবাবু উঠে পড়েছেন- একেবারে অবিকল।

নবীন বলিল, ইটি তুমি ঠিক বলেছ মোড়ল, অবিকল। আমিও ভেবেছিলাম ঠিক তাই। রংলাল উৎসাহিত হইয়া বলিল, তাই তো বলছি হে, বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়। আমি এক এক সময় ভাবতাম, আঃ, দাদাবাবু কি করে আমাদের জমিদার সেজে বসবে? তা সে ভাবনা আজ আমার গেল।

অহীন্দ্র গম্ভীরভাবে মাথাটি অল্প নীচু করিয়া নীরবে চলিতেছিল, মনে মনে লজ্জা অনুভব না করিয়া সে পারিতেছিল না। তাহার মনে হইতেছিল দেশ-বিদেশের কত মহাপুরুষের কথা। তাঁহাদের আদর্শের তুলনায় জমিদার! ছিঃ!

রংলাল আবার বলিল, সাঁওতালদের জমি আমি দেখেছি, মোটমাট তা তোমার বিঘে পঞ্চাশেক, তার বেশি হবে না। আর ধর আমাদের পাঁচজনের দশ বিঘে করে পঞ্চাশ বিঘে, এই পঞ্চাশ বিঘে মাপতে আর কতক্ষণ লাগবে? পহরখানেক বেলা না হতেই হয়ে যাবে। অ্যাঁ, ও লবীন?

নবিন বলিল, তা বইকি। আমি তোমার চারখানা দাঁড়া নিয়ে এসেছি। চারজনাতে মাপলে কতক্ষণ?

রংলাল বলিল, বুঝলেন দাদাবাবু, আমরা পাঁচজনায় জমি নেবার খবর একবার ছড়ালে হয়; দেখবেন, গাঁয়ের যত চাষী সব একেবারে হত্যে দিয়ে পড়বে।

অহীন্দ্র বিস্মিত হইয়া বলিল, তোমরাও জমি নেবে নাকি? কই, সে কথা তো বল নি?

রংলাল বলিল, এই দেখেন, ইয়ের মধ্যে ভুলে গিয়েছেন দাদাবাবু? সেই দেখেন, পেথম দিনই কাছারিতে আপনার সঙ্গে দেখা, আপুনি নিয়ে গেলেন বাড়িতে, গিন্নীমায়ের কাছে। আমাদের চাষীরা সব রব তুলেছিল, জমি আমাদের, জমি আমাদের। আমিই তো আজ্ঞে বলে দিলাম, চক আফজলপুরের সঙ্গে লাগাড় হয়ে যখন চর উঠেছে, তখন আজ্ঞে, ও চর আপনাদের। ই আইন আমার বেশ ভাল করে জানা আছে। তবে হ্যাঁ, ধর্ম যদি ধরেন, ধরে না তো কেউ আজকাল, তা হলে অবশ্যি আমরাও পাই। গিন্নীমাও কথা দিয়েছিলেন, মনে করে দেখেন।

অহীন্দ্র অনেক কিছু ভাবিতেছিল। ইহারা যাহা বলিতেছে তাহা সত্য, এ সত্য সে অস্বীকার করিতেও চাহে নাই। সে বলিতে চাহিতেছিল, আজই যে সেই কথা অনুযায়ী বিলি-বন্দোবস্ত করা হইবে, এ কথা তো হয় নাই। ইহার মধ্যে অনেক কথা আছে যে-সেলামী, খাজনা, পাট্টা, কবুলতি, অনেক কথা। সাঁওতালদের কথা স্বতন্ত্র। আজ তাহারা বসিয়াছে, দশ বৎসর, পনেরো বৎসর বা বিশ বৎসর পরে হয়তো তাহারা চলিয়া যাইবে। তাহাদের জমি জমিদারের খাসে আসিবে। আর ইহাদের স্বত্ব, বংশানুক্রমে দান বিক্রয় সকল রকমের অধিকার ইহারা কায়েমী করিয়া লইবে। তা ছাড়া, সাঁওতালরাই ওই চরকে পরিস্কার করিয়া ফলপ্রসবিনী করিয়াছে। তাহাদের দাবির সহিত কাহারও দাবি সমান হইতে পারে না।

রংলাল বলিল, জুতো খুলতে হবে না দাদাবাবু, আসুন, কাঁধে করে আমি পার করে দিই।

কালীন্দির ঘাটে সকলে আসিয়া পড়িয়াছিল। অহীন্দ্র রংলালকে নিরস্ত করিয়া বলিল, থাক।–বলিয়া জুতা জোড়াটি খুলিয়া নিজেই তুলিয়া লইতেছিল।

কিন্তু তাহার পূর্বেই রংলাল খপ করিয়া তুলিয়া লইয়া একরূপ মাথার উপর ধরিয়া বলিল, বাবা রে, আমরা থাকতে আপনি জুতো বয়ে নিয়ে যাবেন! সর্বনাশ!

নদীর ওপারে চরের প্রবেশ-পথে সাঁওতালেরা দল বাঁধিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। তাহারাও সাগ্রহে প্রতীক্ষা করিয়া আছে। কিশোরবয়স্ক ছেলেগুলি পর্যন্ত আজ গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া চরাইতে যায় নাই।

রংলাল বলিল, ওঃ, ই যি ছা-ছামুড়ি পর্যন্ত হাজির রে সব। আজ তোদের ভারী ধূম, না কি রে মাঝি?

কমল মাঝি গম্ভীরভাবে বলিল, তা বেটে বৈকি গো। জমিগুলা আজ সব আমাদের হবে। রাজাকে সব খাজনা দিব, বোঙাকে পূজা দিব।

নবীন রংলালের দিকে চাহিয়া বলিল, দেখ, আমরা বলি সব বুনো বোঙার জাত। তা দেখ, বুদ্ধি দেখ। লক্ষণ-কল্যাণগুলি তো সব বোঝে ওরা!

মোড়ল মাঝি আবার বলিল, হুঁ, বুদ্ধি আছে বৈকি গো। লইলে ধরমটি আমাদের থাকবে কেনে? পাপ হবে যি।

নদীর জলে মুখ ধুইবার জন্য অহীন্দ্র একটু পিছাইয়া পড়িয়াছিল, সে আসিয়া উপস্থিত হইতেই আলোচনাটা বন্ধ হইয়া গেল, অহীন্দ্র ব্যস্ত হইয়া বলিল, তা হলে তাড়াতাড়ি কাজ আরম্ভ কর, নইলে রোদ্র হবে।

মোড়ল মাঝি আপন ভাষায় কি বলিল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই একটা ছেলে প্রকাণ্ড একটা ছাতা আনিয়া হাজির করিল। বাঁশের বাখারি ও শলা দিয়ে তৈয়ারি কাঠামোর উপরে নিপুণ করিয়া গাঁথা শালপাতার ছাউনি; ছাউনির উপরে কোন গাছের বল্কলের সুতায় আলপনার মত কারুকার্য; অহীন্দ্র ছাতাটি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গেল।

বলিল, বাঃ, ভারী সুন্দর ছাতা তো মাঝি। তোমরা তৈরী করেছ?

হু গো। আমরা সব করতে পারি গো বাবু। অ্যানে- ক পারি। ই ছাতাটি তুর করলে যেয়ে আমাদের মাঝিন। আমি খুব বড়মানুষ কিনা, তাথেও ইটিও করলে এ-ত বড়!

***

প্রথমেই নবীন চরের চারটি কোণ বাছিয়া চার কোণে লাল পতাকা চারিটা পুঁতিয়া দিয়া আসিল। তারপরই আরম্ভ হইল জরিপ। দেশীয় মতে চার হাত লম্বা বাঁশের দাঁড়া দিয়া মাপ আরম্ভ হইল।

রংলাল বলিল, মাঝি, তু নাম বলে যা; দাদাবাবু, আপুনি নিখে নিয়ে যান। শেষকালে যার যত হিসাব করে জমিজমা ঠিক করা যাবে।

কমল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, সি কেনে গো, ইয়ার নাম উয়ার নাম, সি তুরা লিখে কি করবি? একেবারে লিখে লে কেনে।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, তা হলে কাকে কত খাজনা লাগবে, কার কত জমি, সে সব কেমন করে ঠিক হবে মাঝি?

কমল বলিল, সি সব আবার আমরা ঠিক করে লিব গো। আপন আপন মেপে ঠিক করে লিব। তুদের হিসাব আমরা সি বুঝতে লারব।

রংলাল, নবীন ও তাহাদের সঙ্গীরা উৎসাহিত হইয়া উঠিল, কাজ তাহাদের অনেক সহজ হইয়া যাইবে, টুকরো টুকরো জমি মাপিবার প্রয়োজন হইবে না, একেবারে সাঁওতালদের অধিকৃত জায়গাটা মাপিয়া লইলেই খালাস। সে মাপ শেষ হইলেই তখন তাহারা আপন আপন জমি মাপিয়া ঠিক করিয়া লইতে পারিবে। এইটুকুর জন্য অকারণে তাহাদের মনে যে উদ্বেগ জমিয়া রহিয়াছে। রংলাল বলিল, সেই ভাল দাদাবাবু, ওদের ভাগ ওরা আপনারা আপনারা করে লেবে। আপনার ইস্টেটে থাকুক এক নামে একটা জমা হয়ে। সি আপনার ভাল হবে।

কাঠের পুতুল নাচের ওস্তাদ আসিয়া মোড়ল মাঝিকে কি বলিতেছিল। তাহার বক্তব্য শেষ হইতে না হইতেই কমল মাঝি যেন ফুলিয়া আয়তনে বড় হইয়া উঠিল, দেহচর্মে বার্ধক্য জনিত যে ঈষৎ কুঞ্চন দেখা দিয়াছিল, দেহ-স্ফীতির আকর্ষণে সে কুঞ্চন যেন মিলাইয়া গেল। ওস্তাদের কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই কমল তাহার গালে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় বসাইয়া দিল। মুখে বলিল, সামান্য দুইটি কথা, সে কথা দুইটার মধ্যেও দুর্দান্ত ক্রোধের সূর রনরন করিতেছিল। লোকটা চড় খাইয়া বসিয়া পড়িল, সমবেত সাঁওতালদের মুখ দেখিয়া মনে হইল, ভীষণ ভয়ে তাহারা সঙ্কুচিত স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। কমল মাঝি তখনও ক্রোধে ফুলিতেছিল। আকস্মিক এমন পরিণতিতে স্তম্ভিত হইয়া অহীন্দ্র নীরবেই কারণ অনুসন্ধানের জন্য চারিদিক একবার চাহিয়া দেখিল, কিন্তু কমল মাঝির ভয়ঙ্কর রূপ আর চারিদিকে সকলের মুখে ভয়ের সুস্পষ্ট ছাপ ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাইল না। রংলাল, নবীন ও তাহাদের সঙ্গের লোকগুলি পর্যন্ত ভয় পাইয়াছে। অহীন্দ্র কমল মাঝির দিকেই চাহিয়া প্রশ্ন করিল, কি কমল, হল কি? ওকে মারলে কেন?

এই মূর্তিতেও কমল যথাসাধ্য বিনয় প্রকাশ করিয়া বলিল, আজ্ঞে রাজাবাবু, মানুষটা দুষ্টু করছে। বুললে, আমি মোড়ল-টোড়ল মানি না।

সবিস্ময়ে অহীন্দ্র বলিল, কেন?

এবার প্রহৃত ওস্তাদ হাতজোড় করিয়া করুণ কণ্ঠে সভয়ে বলিল, আজ্ঞে রাজাবাবু, দোষ আমার হইছে, দোষটি আমার হইছে। আমি বুললাম, জমি সব আলাদা আলাদা করে দিতে। আমরা সব চ্যাঁকলিব্ব্যাধি আলাদা আলাদা করে লিব বুললাম। তাথেই আমি মোড়লের মনটি খারাপ করলাম। দোষটি আমার হল।

কমল আপন ভাষায় গজগজ করিয়া অনেক কথা বলিয়া গেল, সুরে বোঝা গেল সে ঐ ওস্তাদকে তিরস্কার করিতেছে। কিন্তু তবুও সে দুর্দান্ত কমল আর নাই। কমলের কথা শেষ হইতেই চারিপাশের মেয়ের দল কলকল করিয়া বকিতে আরম্ভ করিল, সেও ঐ লোকটিকে তিরস্কার করিয়া, মোড়লকে সমর্থন করিয়া।

অহীন্দ্র বলিল, তা হলে তোমাদের সমস্ত জমি একসঙ্গে জরিপ হবে তো?

হুঁ, আমার নামে লিখে লে কাগজে, টিপছাপ লিয়ে লে আগে। বুলে দে, খাজনা কত হবে, আমরা সব মিটায়ে দিব। তবে ঐ যে আপনার কি বুলিস গো, সালামী না কি উ আমরা লারব দিতে। আমি সব ইয়াদের কাছে আদায় করে খাজনা আপনার কাছারিতে দিয়ে আসব।

নবীন এতক্ষণে সাহস পাইয়া হাসিয়া বলিল, তু তা হলে এদের জমিদার হলি, তোর আবার জমিদার হল আমাদের দাদাবাবু–না কি?

উঁ-হুঁ। আমি মোড়ল হলাম, রাজা বেটে-জমিদার বেটে আমাদের রাঙাবাবু।

মাপ আরম্ভ হইল, রাম দুই তিন চার-আড়ে হল গা একশ চল্লিশ দাঁড়া।

নবীন ও রংলাল দুইজনে মিলিয়া জমিটার কালি করিয়া পরিমাণ খাড়া করিল, চল্লিশ বিঘা কয়েক কাঠা হইল। অহীন্দ্র বিশেষ মনযোগ দিয়া হিসাবের পদ্ধতিটা দেখিতেছিল। ছেলেবেলায় পাঠশালায় পড়া বিঘাকালি আর্যার সুরটাই যেন অস্পষ্টভাবে কানে বাজিয়া উঠিল, ‘কুড়বা কুড়বা কুড়বা লিজ্যে, কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিজ্যে।’

রংলাল বলিল, তা হলে তোদের এখন এই জমি হল মাঝি, চল্লিশ বিঘে, ক কাঠা না হয় ছেড়েই দিলাম। লে, এখন দাদাবাবুর সঙ্গে খাজনা ঠিক করে লে।

কমল অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, হাঁ রাঙাবাবু, আপুনি এবার হিসাব জুড়ে দেখ।

 অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, ঠিক আছে মাঝি।

না, আপুনি একবার দেখ।

দেখেছি।

না, আপনি একবার নিজে দেখ।

অগত্যা অহীন্দ্রকে কাগজ কলম লইয়া বসিতে হইল। তাহার চারিপাশে সাঁওতালরা গম্ভীর হইয়া বসিল, সকলের উগ্রীব দৃষ্টি অহীন্দ্রের উপর। ছেলেমেয়েরা কথা বলিতেছিল, মোড়ল মাঝি গম্ভীরভাবে আপন ভাষায় আদেশ করিল, চুপ, চুপ সব, চুপ। রাঙাবাবু হিসাব করিতেছেন, মাটির হিসাব, জরিপের হিসাব।

পাড়ার মধ্যে কয়েকটি তরুণী আঙিনায় বসিয়া মৃদুস্বরে গুনগুন করিয়া গান করিতেছিল

চেতন দিস্ মরণ আমি বাবু
লতার দিশমরে আড়গুএনা,
জমি-কিন্ সংইদা
জমা কিন্ চাপাওইদা
গরিব হড় ও কারে অ্যাম-আঃ।

অর্থাৎ পাহাড়ের উপর হইতে আমিনবাবু আসিয়াছেন, জমি মাপ করিতেছেন, জমা বাড়াইয়া দিতেছেন, কিন্তু আমরা গরিব লোক, আমরা কোথায় পাইব?

একটি মেয়ে বলিল, ই গান বুলতে হবে রাঙাবাবুকে।

 কমলের নাতনী বলিল, হু বুলব। বেশী করে খাজনা লিবে কেনে রাঙাবাবু? যাব আমরা উয়ার কাছে

এখুনি?

উঁ-হুঁ, মোড়ল মাঝি ক্ষেপে যাবে। বাবা রে!

তবে?

বিকালে আমরা ডাকব বাবুকে। হাঁড়িয়া জম করব, লাচব। উয়াকে ডেকে আনব।

নিতান্ত আকস্মিকভাবেই একটা মেয়ে বিস্ময়মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, কেমন বরন বল্ দেখি রাঙাবাবুর? রাঙা লালা ঝক ঝক করছে!

কমলের নাতনী বলিল, আগুনে-র পারা! রাঙাঠাকুরের লাতি, উ ঠাকুর বেটে।

একটি মেয়ে কি উত্তর দিবার জন্য উদ্যত হইয়াছিল, কিন্তু আবার মোড়ল মাঝির ক্রুদ্ধ চীৎকারে তাহারা চমকিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজনের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

এবার বচসা হইতেছিল কমল মাঝির সহিত রংলাল এবং নবীনের দলের। সাঁওতালদের জমির পরই পূর্ব দিকে প্রায় বিঘা পঞ্চাশেক চর পড়িয়া আছে, সেই জমিটা পছন্দ করিয়া রংলাল এবং নবীন মাপিতে উদ্যত হইল। কমল মাঝি বলিল, উ জমি তুরা লিবি না মোড়ল, উ আমি দিব না।

রংলাল বিরক্তির সহিত বলিল, দিবি না? কেন?

আমরা তবে আর জমি কুথাকে পাব? আমাদের ছেলেগুলা কি করবে?

তাদের আবার ছেলে হবে, তাদের ছেলে হবে, তাই বলে গোটা চরটাই তোরা আগলে থাকবি নাকি? মাপ হে, মাপ নবীন, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?

নবীন মাপিতে উদ্যত হইবামাত্র কমল তাহার হাতের দাঁড়া চাপিয়া ধরিয়া ক্রুদ্ধ উচ্চ চীৎকারে চীৎকারে বলিয়া উঠিল না, দিব না।

রংলালও এবার যেন ক্ষেপিয়া উঠিল। এই পূর্ব দিকের চরের মাটি সকল দিকের মাটি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, ভাঙিলে ভুরার মত গুঁড়া হইয়া যায়, ভিতরের বালির ভাগ ময়দার মত মিহি, আলু ও আখের উপযোগী এমন মাটি আর বুঝি হয় না। সে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, এই দেখ মাঝি, ফাটাফাটি হয়ে যাবে বলছি! খবরদার তুই দাঁড়া ধরিস না, বললাম।

একটা ভয়াল হিংস্র হাসি হাসিয়া কমল বলিল, তুকে ধরে আমি মাটিতে পুঁতে দিব।

বার বার এমন অবাঞ্ছনীয় ঘটনার উদ্ভব হওয়ার জন্য অহীন্দ্রের মনে আর বিরক্তির সীমা রহিল না। সে তাহার কিশোর কণ্ঠের তীক্ষ্ণ কঠিন স্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল, ছাড়, ছাড় বলছি, ছাড়।

কমল এবং রংলাল দুইজনেই এবার সরিয়া দাঁড়াইল।

অহীন্দ্র বলিল, অন্যদিকে জমি পছন্দ করে মেপে নাও নবীন। এ জমি তোমরাও পাবে না, সাঁওতালরাও পাবে না। এদিকটা আমাদের খাসে থাকবে। খাসে চাষ হবে আমার।

জমির মাপ-জোক শেষ করিয়া অহীন্দ্র ফিরিবার সময় বলিল, দেখো, আর যেন ঝগড়া করো না।

একজন মাঝি ছাতাটা লইয়া তাহার সঙ্গে গেল, জৈষ্ঠের রৌদ্রে তখন আগুন ঝরিতে শুরু করিয়াছে। সেই রৌদ্রের মধ্যেই রংলাল, নবীন এবং তাহার সঙ্গী কয়েকজন আপন আপন সীমানা চিহ্নিত করিয়া চারি কোণে চারিটা মাটির ঢিপি বাঁধিতে শুরু করিয়া দিল। সাঁওতালেরা আবার দল বাঁধিয়া আপনাদের হিসাবমত জমি ভাগ করিতে আরম্ভ করিল।

প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করিয়া জলহীন কঠিন মাটিতে কোপ মারিতে মারিতে রংলাল বলিল, থাক শালারা, কদিন তোরা এখানে থাকিস, সেও তো আমি দেখছি!

.

১২.

সেই দিনই অপরাহ্নে সাঁওতালেরা খাজনার টাকা পাই পাই পয়সা হিসাব করিয়া মিটাইয়া দিল। কিন্তু গোল বাধাইল রংলাল-নবীনের দল। তাহারাও ধরিয়া বসিল, খাজনা ছাড়া সেলামি তাহারা দিতে পারিবে না। সাঁওতালদের চেয়েও কি তাহারা চক্রবর্তী-বাড়ির পর? অহীন্দ্র চুপ করিয়া রহিল, কোন উত্তর দিতে পারিল না। রংলাল-নবীনের যুক্তি খণ্ডন করিবার মত বিপরীত যুক্তি খুঁজিয়া সে সারা হইয়া গেল। অনেকক্ষণ নীরবে উত্তরের অপেক্ষা করিয়া রংলাল বলিল, দাদাবাবু, তাহলে হুকুমটা করে দিন আজ্ঞে।

অহীন্দ্র কিন্তু সে হুকুমও দিতে পারিল না। বিঘা পিছ পাঁচ টাকা সেলামি আদায় হইলেও পঞ্চাশ বিঘার আড়াই শত টাকা আদায় হইবে। তাহাদের সংসারের বর্তমান অবস্থা সে শুধু চোখেই দেখিতেছে না, মর্মে মর্মে অনুভব করিতেছে। তাহার মা যখন রান্নাশালে বসিয়া আগুনের উত্তাপ ভোগ করেন, তখন সেও গিয়া উনানের কাছে বসিয়া উনানে কাঠ ঠেলিয়া দেয়। সে যে কি উত্তাপ, সে তো তাহার অজানা নয়। উত্তাপ ও কষ্টের কথা ছাড়িয়া দিয়াও তাহার মাকে নিজে-হাতে রান্না করিতে হয়-ইহারই মধ্যে কোথাও আছে অসহনীয় অপরিসীম লজ্জা, যাহার ভয়ে তাহার মাথা হেঁট হইয়া পড়ে, তাহার চোখ ফাটিয়া জল আসে। তাহার মা অবশ্য বলেন, যখন যেমন তখন তেমন না পারলে হবে কেন? অম্লান হাসিমুখেই তিনি বলেন। কিন্তু তাহার মনে পড়ে কালিন্দী নদীর বানের জল আটক দিবার জন্য ঘাসের চাপড়া-বাঁধা বাঁধটার কথা; বাঁধটার ও-পারে থাকে অথই জল, আর এ-পারে বাঁধের গায়ে সবুজ ঘাস তেমনই তাহার মায়ের মুখে সুশ্যাম হাসির ও-পারে আছে অথই দুঃখের বন্যা; কালিন্দীর বন্যায় ভাটা পড়ে; বর্ষার শেষে সে শুকাইয়া যায়, কিন্তু মায়ের বুকের দুঃখের বন্যা শুকায় না, ও যেন শুকাইবার নয়! এ ক্ষেত্রে কেমন করিয়া সে এতগুলি টাকা ছাড়িয়ে দিবে?

নবীন বলিল, তা পাঁচ টাকা করে জনাহি লজর কিন্তুক দিতে হবে মোড়ল। তা লইলে সেটা ধর আমাদেরও অপমান। সাঁওতালরা না হয় দেয় নাই, ওরা ছোট জাত। আমাদিগে তো রাজার সম্মান একটা করতে হয়।

রংলাল বার বার ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইয়া বলিল, এ তুমি একটা কথার মত কথা বলেছ লবীন। লেন, লেন তাই হল দাদাবাবু, পঞ্চাশ বিঘের খাজনা আপনার এক শ টাকা, আর পাঁচ টাকা করে পাঁচজনের লজর পঁচিশ টাকা, এক শ পঁচিশই আমরা দিচ্ছি। সেও আপনার এক খাবল টাকা গো।

অহীন্দ্রের মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিল, ইহাদের কথার ভঙ্গীতে সে যেন একটি ধারাবাহিক গোপন ষড়যন্ত্রের সূত্র দেখিতে পাইল, ইহারা তাহাকে ঠকাইবার জন্যই আসিয়াছে। তাহার উপর শেষের কয়টি কথা- ‘একখাবল টাকা’ অর্থাৎ দুই হাতের মুঠিভরা টাকা-এই কথা কয়টির মধ্যে তাহাকে প্রলোভন দেখানোর সুর সুস্পষ্ট। তার ক্রোধ ও বিরক্তির আর সীমা রহিল না। সে দৃঢ় কঠোর স্বরে বলিল, জমি বন্দোবস্ত এখন হবে না, আমি বাবাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করতে পারব না।

রংলাল কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, বেশ তা হলে আমরা এখন ভেঙেচুরে জমি তৈরি করি, তারপর লেবেন খাজনা আপনারা।

তার মানে?

কথাটার মানে অত্যন্ত স্পষ্ট, বন্দোবস্ত করা হউক বা না হউক, জমি তাহারা দখল করিবেই। অকারণে খানিকটা মাথা চুলকাইয়া লইয়া রংলাল বলিল, ওই যে বললাম গো, আমরা জমি-জেরাত হাসিল করি তারপর লেবেন খাজনা। আর এখন যদি লেবেন, তো তাও লেন, আমরা তো দিতেই রাজী রয়েছি।

অত্যন্ত ক্রোধে অহীন্দ্রের মাথাটা কেমন করিয়া উঠিল, কিন্তু প্রাণপণে সে-ক্রোধ মনের মধ্যে অবরুদ্ধ করিয়া সে বসিয়া রহিল।

রংলাল একটি প্রণাম করিয়া বলিল, তা হলে আমরা চল্লাম দাদাবাবু। যখুনি ডাকবেন তখুনি আমরা খাজনার টাকা এনে হাজির করে দেব। চল হে, চল সব। সন্ধ্যে হয়ে এল, চল।

অহীন্দ্র কথা বলিল না, হাত নাড়িয়া ইঙ্গিতেই জানাইয়া দিল, যাও, তোমরা চলিয়া যাও। ইহাদের উপস্থিতিও সে যেন আর সহ্য করিতে পারিতেছিল না। রংলাল ও নবীনের দল একে একে প্রণাম সারিয়া চলিয়া গেল, অহীন্দ্র একাই নির্জন স্তব্ধ কাছারি-বাড়ির দাওয়ায় তক্তপোশের উপর দেওয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া রহিল। কার্নিশের মাথায় কড়িকাঠের উপরে বসিয়া সারি সারি পায়রার দল গুঞ্জন করিতেছে। সামনের খোলা মাঠটার সারিবদ্ধ নারিকেলের গাছ, তাহারই কোন একটার মাথায় আত্মগোপন করিয়া একটা পেঁচা আসন্ন সন্ধ্যার আনন্দে কুক কুক করিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। ঘরের ভিতর হইতে অন্ধকার নিঃশব্দে বাহির হইয়া আসিতেছে শোকাচ্ছন্ন বিধবার মত। এত বড় বাড়িটার কোথাও এক কণা আলোকের চিহ্ন নাই, কথাও একটা মানুষের সাড়া নাই, শুধু সিঁড়ির পাশে দুই দিকে দুইটা সুদীর্ঘ-শীর্ষ ঝাউগাছ অবিরাম শন শন শব্দ করিতেছে। সে শব্দ শুনিয়া মনে হয়, যেন এই অনাথা বাড়িটাই বুকফাটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিতেছে। অথচ একদিন নাকি হাসিতে কোলাহলে আলোকে গাম্ভীর্যে বাড়িখানা অহরহ গমগম করিত। মাথা হেঁট করিয়া প্রজারা সভয়ে অপেক্ষা করিয়া থাকিত এ বাড়ির মালিকের মুখের একটি কথার জন্য। আর আজ একজন চাষী প্রজা বলিয়া গেল, সম্মতি দেওয়া হউক বা না হউক, জোর করিয়া তাহারা জমি দখল করিবেই। অহীন্দ্র একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল, তারপর তক্তপোশটার উপরে নিতান্ত অবসন্নের মত শুইয়া পড়িল। তাহার মাথা ধরিয়া উঠিয়াছে।

কিছুক্ষণ পর মানদা এক হাতে ধূপদানি ও প্রদীপ, অন্য হাতে একটি জলের ঘটি লইয়া কাছারি বাড়িতে প্রবেশ করিল। দুয়ারে চৌকাঠে চৌকাঠে জল ছিটাইয়া দিয়া ধূপ ও প্রদীপের আলো দেখাইতে দেখাইতে সে দেখিল, অহীন্দ্র ছেঁড়া শতরঞ্চি ঢাকা তক্তপোশটার উপর চোখ বুজিয়া নিস্তব্ধ হইয়া আছে। দেখিয়া তাহার বিস্ময়ের সীমা রহিল না। এমন নির্জন কাছারির বারান্দায়, ওই ময়লা ছেঁড়া শতরঞ্চির উপর, এই অসময়ে ছোটদাদাবাবু ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন! সঙ্গে সঙ্গে তাহার চিন্তাও হইল, কোন অসুখ-বিসুখ করে নাই তো? গায়ে হাত দিয়া দেখিতে সাহস হইল না। কি জানি, যদি ঘুম ভাঙিয়া যায় অনর্থ হইবে, হয়ত চীৎকার করিয়া উঠিবেন। ভাবিয়া-চিন্তিয়া সে ত্রস্ত গতিতে বাড়িতে গিয়ে ডাকিল, মা!

সুনীতি কাপড় কাচিয়া রামেশ্বরের ঘরে আলো জ্বালিয়া দিবার জন্য উপরে যাইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। মানদার ডাকে বাধা পাইয়া বিরক্তির সহিতই বলিলেন, যখন-তখন কেন পেছনে ডাকিস মানদা? জানিস, আমি এবার ওপরে আলো জ্বালতে যাব।

মানদা বলিল, ডাকি কি আর সাধ করে মা? ছোটদাদাবাবু এই ভরসন্ধ্যেবেলায় কাছারির বারান্দায় সেই ছেঁড়া শতরঞ্চির ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে, অসুখ করেছে।

অসুখ করেছে?

করবে না? ওই দুধের ছেলে। এই জষ্টি মাসের আগুনের হল্কা রোদ, এই রোদে চর মাপতে গেল। তার ওপর এই সাঁওতালরা আসছে, এই তোমার সদগোপরা আসছে, কিচির-মিচির চেঁচামেচি। যান বাপু, আপনি গিয়ে উঠিয়ে নিয়ে আসুন। আমি বাপু ডাকতে পারলাম না ভয়ে।

সুনীতি বলিলেন, তুই আমার সঙ্গে আয়। আমি একলা কেমন করে কাছারি-বাড়িতে যাব?

তুলসীর মন্দিরের উপর প্রদীপ ও ধূপদানি রাখিয়া দিয়া মানদা বলিল, ঘরের ভিতর দিয়ে চলুন, বাইরের রাস্তায় কি জানি যদি কেউ থাকে!

অহীন্দ্রের কপালে হাত দিয়া আশ্বস্ত হইয়া সুনীতি বলিলেন, কই না, জ্বর তো হয় নি।

অহীন্দ্র স্পর্শেই বুঝিয়াছিল, এ তাহার মায়ের হাত। সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া বলিল, মা! কি মা?

কিছু নয় অহি। এ সময়ে এখানে শুয়ে কেন বাবা?

এমনি মাথা একটু ধরেছে, কেমন মনটাও একটু খারাপ হয়ে গেল। তাই একটু শুয়ে ছিলাম।

সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইয়া উৎকণ্ঠিত স্বরে সুনীতি বলিলেন, কেন মাথা ধরল রে, মনই বা খারাপ কেন হল?

সত্য গোপন করিয়া অহীন্দ্র বলিল, কি জানি! তারপর সে আবার বলিল, এই সন্ধ্যের অন্ধকার, কেউ কোথাও নেই, এত বড় বাড়ি-মনটা খারাপ হয়ে গেল মা। অথচ, গল্প শুনেছি, রাত্রি বারোটা পর্যন্ত এখানে লোক গিসগিস করত।

সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, নীরবে তিনিও একবার অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িখানার চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। মানদা তাড়াতাড়ি বলিল, আমি আলো আনছি দাদাবাবু, আপনি আলো নিয়ে কাছারিতে বসুন কেনে। দু চারজনা বন্ধু-টন্ধু নিয়ে দিব্যি গল্প-গুজব করুন। তাস-টাস খেলুন।

অহীন্দ্র হাসিল, কিন্তু কথার কোন উত্তর দিল না। সুনীতি বলিলেন, এই বাড়ির মানমর্যাদা এখন সবই তোর উপর নির্ভর করছে বাবা। ভাল করে লেখাপড়া শিখে তুই মানুষ হলে তবে এই দুঃখ ঘুচবে অহি।

মানদা সেই ভোরবেলা হইতেই আজ রংলাল-নবীনের দলের উপর বিরক্ত হইয়া ছিল। সে বলিল, হ্যাঁ বাপু। তখন এই ভোর বেলাতে কই সব চাষার দল এসে ডাকুক দেখি, দেখব। গরম কত সব! ডাকছ কেনে গো, না, সে তুমি বুঝবে না। আমি আজ বলে বিশ বছর জমিদারের ঘরে চাকরি করছি, আমি বুঝব না? ওই ভোরে উঠেই আপনার মাথা ধরেছে, তার উপর এই রোদ আর ঝলা।

সুনীতি বলিলেন, একটুখানি নদীর বাতাসে বেড়িয়ে আয় বরং। আকাশে চাঁদ উঠেছে মনটাও ভাল হবে, খোলা বাতাসে মাথাও অনেক হালকা হবে। আমি যাই, বাবুর ঘরে আলো দেওয়া হয় নি। মানদা, উনোনে আগুন দিয়ে দে মা।

অহীন্দ্রের মনের ভার অনেকটা হাল্কা হইয়াছিল, মায়ের ওই কথা কয়টিতে সে মনের মধ্যে একটা উৎসাহ অনুভব করিল, সে মানুষ হইলে তবে এই দুঃখ ঘুচিবে। সেই কথা ভাবিতে ভাবিতেই সে পথে বাহির হইয়া পড়িল। তাহার দাদার কথা মনে পড়িল, তাহাকে এম.এ. পর্যন্ত যেন পড়ানো হয়। যেমন-তেমন ভাবে এম.এ. পাস করিলে তো হইবে না, খুব ভালভাবে পাস করিতে হইবে। ফার্স্ট হইতে পারিলে কেমন হয়-ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।

নদীর ধারে আসিয়া মাদলের শব্দে ও সাঁওতাল-মেয়েদের গানের সুরে তাহার চিন্তার একটানা ধারাটা ভাঙিয়া গেল। ও-পারের চরে আজ প্রবল সমারোহে উৎসব চলিয়াছে। আজ তাহারা জমিদারকে খাজনা দিয়া রসিদ পাইয়াছে, জমি তাহাদের নিজের হইয়াছে, আজিকার দিন তাহাদের একটি পরমকাম্য শুভদিন, তাহাদের দেবতাকে তাহারা পূজা দিয়াছে। পাঁচটি লাল রঙের মুরগী, একটি লাল রঙের ছাগল বলি দিয়া নাকি পূজা হইয়াছে, তাহার পর আকণ্ঠ পচুই মদ খাইয়া গান-বাজনা আরম্ভ করিয়াছে। অদ্ভুত জাত!

আকাশে শুক্লাসপ্তমীর আধখানা চাঁদ কালিন্দীর ক্ষীণ স্রোতের মধ্যে এক অপরূপ খেলা খেলিতেছে। দূরে কালিন্দীর ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় চাঁদ যেন জলে গলিয়া গিয়াছে, ঝিকমিক করিয়া নাচিতেছে চাঁদ গলানো জলের ঢেউ। দূরে এ-পাশে কালিন্দীর জল, যেন একখানা অখণ্ড রূপার পাত। সম্মুখেই পায়ের কাছে চাঁদ কালিন্দীর স্রোতের তলে ছেঁড়া একগাছি চাঁদমালার মত আঁকিয়া-বাঁকিয়া লম্বা হইয়া ভাসিয়া চলিয়াছে। সাদা সাদা টিট্টিভ পাখীগুলি জলস্রোতের ও-পারে বালির উপর ছুটিয়া ছুটিয়া বেড়াইতেছে, কখনও কখনও একটা অন্যের তাড়ায় খানিকটা উড়িয়া আবার দূরে গিয়া বসিতেছে। দূর আকাশে একটা উড়িয়া চলিয়াছে আর ডাকিতেছে, হট্টি-টি– হট্টি-টি। নদীর বালুগর্ভের উপর অবাধ শূন্যতল স্বচ্ছ কুয়াশার ন্যায় জ্যোৎস্নায় মোহগ্রস্থের মত স্থির নিস্পন্দ। অহীন্দ্র নদীস্রোতের কিনারায় চুপ করিয়া বসিল। সহসা তাহার মনে হইল, কোথায় কাহারা যেন কথা কহিতেছে! স্বর ভাসিয়া আসিতেছে, ভাষার শব্দ ঠিক ধরা যায় না। সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়া বেশ সাড়া দিয়াই প্রশ্ন করিল, কে? উত্তর কেহ দিল না, উপরন্তু কথার শব্দও নিস্তব্ধ হইয়া গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই তাহার নজরে পড়িল স্রোতের ও-পারে বালির উপর দুইটি মূর্তি। কিছুক্ষণ পরেই আবার কথার শব্দ আরম্ভ হইল।

অহীন্দ্র কৌতূহল সম্বরণ করিতে পারিল না, অগভীর জলস্রোত পার হইয়া এ-পারে বালির উপর উঠিয়া আসিয়া উঠিল। বলিতে বলিতে খানিকটা আগাইয়া আসিয়া সে কথার ভাষা বুঝিতে পারিল, সাঁওতালদের ভাষা; এবং গলার স্বরে বুঝিল, তাহারা দুজনেই স্ত্রীলোক; সুরে মনে হইল, কোন একটা বচসা চলিয়াছে। সে ডাকিল, কে?

যাহারা কথা কহিতেছিল, তাহারা দুজনেই ঈষৎ চকিত হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল। একজন সবিস্ময়ে আপনাদের ভাষায় কি বলিয়া উঠিল, তাহার মধ্যে একটি কথা অহীন্দ্র বুঝিতে পারিল, রাঙাবাবু! তাহাকে চিনিতেও অহীন্দ্রের বিলম্ব হইল না, তাহার দীর্ঘ দেহখানিই তাহাকে চিনাইয়া দিল। সে কমল মাঝির নাতনী। অপর জন তাহার দিকে আগাইয়া আসিতেই তাহাকেও অহীন্দ্র চিনিল, সে বৃদ্ধ সর্দার কমল মাঝির স্ত্রী। বৃদ্ধা অহীন্দ্রকে দেখিয়া যেন কতক আশ্বস্ত হইয়া ভাঙা বাংলায় একটানা সুরে বলিল, দে রাঙাবাবু দে। মেয়েটা আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া পালাইয়া আসিয়াছে। আবার বলিতেছে, এ-ঠাঁই ছাড়িয়া ও চলিয়া যাইবে।

তরুণী নাতনী ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, কেনে ঝগড়া করবে না কেনে? চলে যাবে না কেনে? তু বাবু বিচার করে দে। বুড়া-বুড়ীর করণ দেখ।

হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, কি, হল কি তোদের? ছি, মাঝিন, বুড়ী দিদিমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আছে?

বুড়ী খুব খুশি হইয়া উঠিল, দেখ বাবু, আপুনি দেখ।

অহীন্দ্র বলিল, যা মাঝিন, বাড়ি যা; নাচ হচ্ছে, গান হচ্ছে পাড়াতে, যা, নাচ-গান করগে।

কেনে গান করবে? কেনে নাচ করবে? উয়ারা বুড়া-বুড়ীতে নাচ-গান করবে। উয়ারা জমি পেলে, উয়ারা নাচবে। আমাদিগে দিলে না কেনে?

অহীন্দ্র বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করিল, কি হল কি মাঝিন, তুই বল তো শুনি?

বৃদ্ধা যাহা বলিল, তাহা এই।–এই মেয়েটির শীঘ্রই বিবাহ হইবে। সর্দার বলিতেছে, তোমরা আমাদের কাছে থাক, খাট, খাও, আমি তোমাদের ভরণপোষণ করিব। কিন্তু মেয়েটি সে-কথা কোনমতেই শুনিবে না। সে স্বতন্ত্র ঘর বাঁধিতে চায়, নিজস্ব জমি চায়। সেই জমিই না পাইয়া সে এমন করিয়া রাগ করিয়াছে। ঝগড়া করিতেছে।

তরুণী নাতনীটি এইবার হাত নাড়িয়া অঙ্গভঙ্গি করিয়া বলিয়া উঠিল, তুরা জমি লিবি, তুদের ধান হবে, কোলাই হবে, ভুট্টা হবে, তুরা সব ঘরে ভরবি। আমরা কি করব তবে? আমাদের ঘর হবে না, বেটা-বেটি হবে না? উয়ারা কি খাবে তবে? কেনে আমরা তুদের জমিতে খাটব?

অহীন্দ্রের হাসি পাইল, আবার বেশ ভালও লাগিল; এই তরুণী কিশোরী মেয়ে, এখনও বিবাহ হয় নাই, হইবে এই প্রত্যাশায় ঘর-দুয়ার সন্তান-সন্ততি সম্পত্তির আয়োজনে মত্ত হইয়া উঠিয়াছে! মৃদু হাসিয়া সে বলিল, ওঃ, মাঝিন আমাদের পাকা গিন্নী হবে দেখছি! এখন থেকেই ঘরকন্নার ভাবনায় পাগল হয়ে উঠেছিস্।

বৃদ্ধা অহীন্দ্রের সুরে সুর মিলাইয়া বলিল, হ্যাঁ, তাই দেখ কেনে আপুনি। উয়ার একেবারে শরম নাই।

তরুণী এবার আরও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল, তড়বড় করিয়া এক রাশ কথা বলিয়া গেল। অহীন্দ্র অনেক কষ্টে তাহার মর্মার্থ বুঝিল; সে বলিতেছিল, শরম তোদের নাই বুড়া-বুড়ী, তোরা সকলকে জমি না দিয়া নিজেরা অধিক অংশ আত্মসাৎ করিয়া লইয়াছিস! অহীন্দ্র একটু বিস্ময় অনুভব করিল, কমল মাঝির নিজের নামে জমি লওয়ার মধ্যে এমন মতলবের কথা সে কল্পনাও করিতে পারে নাই। সে বৃদ্ধার স্ত্রীকে বলিল, না, না। ছি ছি, এমন কেন করলি তোরা মাঝিন?

বৃদ্ধা সবিনয়ে বলিল, জমি সকল বয়স্ক মাঝিকেই দেওয়া হইয়াছে, শুধু এই কজন তরুণ-বয়স্কদের দেওয়া হয় নাই। উহারা এখন জমি লইয়া কি করিবে? উহাদের জোয়ান বয়স-এখন খাটিয়া পয়সা উপার্জনের সময়। পরে উহারা সেই পয়সায় জমি কিনিবে, বুড়োরা মরিয়া গেলে পাইবে, এই তো নিয়ম। তাহারা বুড়া বুড়ী কিছু জমি বেশি লইয়াছে, ইহাও সত্য। কিন্তু রাঙাবাবু, তাহারা যে মোড়ল-সর্দার, সকলের অপেক্ষা বেশি না পাইলে চলিবে কেন তাহাদের? সম্মান থাকিবে কেন? আর রাঙাবাবু যে অনেকটা জমি নিজের জন্য রাখিয়া দিলেন, নহিলে সকলকেই তাহারা দিত। এই সামান্য জমির ভাগ কেমন করিয়া এতগুলি লোককে দেওয়া যায়?

তবু মেয়েটির এই গিন্নীপনার আগ্রহ অহীন্দ্রের বড় ভাল লাগিয়াছিল, সে একটু চিন্তা করিয়া বলিল, এক কাজ কর মাঝিন। তোর হবু বরকে পাঠিয়ে দিস, আমি যে-জমিটা নিজের জন্যে রেখেছি, তারই খানিকটা তাকে ভাগে বিলি করে দেব। আরও যে যে চায়, দেব। তারপর হাসিয়া বলিল, কেমন, এইবার তোদের ঝগড়া মিটল তো?

বৃদ্ধা বলিল, হু বাবু, মিটল। সব মাঝি ভারি খুশি হবে। কাল সব যাবে আপনার কাছে। উয়াদিগে আপুনি জমি ভাগে দিবি, নাম লিখে লিবি।

তরুণীটি বলিল, আমাদিগে ভাগীদারের সদ্দার করে দিবি বাবু। উ মরদটা তুর সব দেখে দিবে, আমি তুদের ঘরে পাট-কাম করে দিব। হোক!

মেয়েটির আনন্দের আগ্রহে অহীন্দ্র খুশি হইয়া উঠিল, বলিল, তাই করে দেব।

আনন্দে কলরব করিয়া মেয়েটি এবার হাসিয়া উঠিল। অহীন্দ্র বলিল, যা, এইবার ঘরে যা, নাচ-গান কর গিয়ে।

আপুনি যাবিন না বাবু?

 না অনেকটা রাত্রি হয়ে গেল, আমি বাড়ি চললাম।

অহীন্দ্র জলের স্রোতটা পার হইয়া এ-পারে উঠিয়াছে, এমন সময় আবার পিছন থেকে কে ডাকিল, বাবু! রাঙাবাবু! অহীন্দ্র ফিরিয়া দাঁড়াইল, দেখিল একটি মূর্তি ছুটিয়া তাহার দিকেই আসিতেছে। সে মেয়েটিই ছুটিয়া আসিতেছে।

ফুল লিয়ে যা বাবু, তুর লেগে ফুল আনলম। এক আঁচল কুরচির ফুল লইয়া মেয়েটি তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল।

সরল অশিক্ষিত জাতির তরুনীটির কৃতজ্ঞতায় অহীন্দ্রের মন আনন্দে ভরিয়া উঠিল, সে দুই হাত পাতিয়া বলিল, দে। মেয়েটি আঁচল উজাড় করিয়া ফুল ঢালিয়া দিল, অহীন্দ্রের হাতের অঞ্জলিতে এত ফুল ধরিবার স্থান ছিল না, অঞ্জলি উপচিয়া ফুল বালির উপর পড়িয়া গেল।

মেয়েটি বলিল, ইগুলা পড়ে গেল যি?

অহীন্দ্র বলিল, ওগুলা তুই নিয়ে যা। খোঁপায় পরবি!

মেয়েটি নিঃসঙ্কোচে মাথায় কয়েকটা গুচ্ছ গুঁজিয়া নাচিতে নাচিতে জোৎস্নাস্নাত বালুচরের উপর দিয়া চলিয়া গেল। পাখীর দল মেয়েটির দিকেই চাহিয়া রহিল। এতক্ষণে তাহার মনের সকল গ্লানি কাটিয়া গিয়াছে। অপরাহ্নে ক্ষোভের বিমর্ষতায় তাহার অন্তর-বাহির ভাঁটা-পড়া নদীর মত শীর্ণ নিস্তরঙ্গ হইয়া উঠিয়াছিল, অকস্মাৎ যেন সেই শীর্ণতা ও নিস্তরঙ্গতাকে প্লাবণে আবৃত করিয়া একটা আনন্দের ভাললাগার জোয়ার আসিয়া গেল।

মেয়েটা অদ্ভুত! সাঁওতালদেরই তাঁতে বোনা মোটা দুধের মত সাদা কাপড়ে কি চমৎকারই না মানাইয়াছে! লাল কস্তায় রেলিঙের মত নকশাটা পাড়াটিও সুন্দরভাবে কাখড়খানাতে খাপ খাইয়াছে, বেণী রচনা না করিয়া সাদাসাপটা এলো খোঁপাতেই উহাদের ভাল মানায়। সরল বর্বর জাতি, স্বার্থকে গোপন করিতে জানে না, স্বার্থহানিতে পরম আপন জনের সঙ্গেও কলহ করিতে দ্বিধা করে না। কুমারী মেয়েটির স্বামী-সন্তান সম্পদের কামনা দ্বন্দ করিয়া উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করিতে একটুকু কুণ্ঠা নাই। অদ্ভুত!

বালুচরের উপরে দূরে, মেয়েটিকে ওই এখনও দেখা যাইতেছে; মানুষ বলিয়া চেনা যায় না, উহার দুধে-ধোয়া কাপড়খানা জ্যোৎস্নার সঙ্গে মিশিয়া এক হইয়া গিয়েছে। শুধু অনাবৃত হাত, পিঠের খানিকটা, মাথার কালো চুল, পাতলা সাদা চাদরের মত জ্যোৎস্নার মধ্য দিয়া খানিকটা কালো রঙের মত,- না, খানিকটা কালো রূপের মত ছুটিয়া চলিয়াছে।

.

১৩.

জৈষ্ঠের শেষে কয়েক পসলা বৃষ্টি হইয়া মাটি ভিজিয়া সরস হইয়া উঠিল। কয়েক দিনের মধ্যেই চরটা হইয়া উঠিল ঘন সবুজ।

চাষীর দল হাল-গরু লইয়া মাঠে গিয়া পড়িল। ধানচাষের সময় একেবারে মাথার উপর আসিয়া পড়িয়াছে। কাজেই নবীন ও রংলাল ধানের জমি লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িল, চরটার দিকে আর মনযোগ দিতে পারিল না। ধানের বীজ বুনিবার জন্য হাফরের জমিতে আগে হইতেই চাষ দেওয়া ছিল, এখন আবার তাহাতে দুই বার লাঙল দিয়া তাহার উপর মই চালাইয়া জমিগুলির মাটি ভুরার মত গুঁড়া করিয়া বীজ বুনিয়া দিল। অন্য জমি হইতে বীজের জমিগুলোকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করিয়া রাখিবার জন্য একখানা করিয়া তালপাতা কাটিয়া তাহাতে পুঁতিয়া রাখিল। ওই চিহ্ন দেখিয়াই রাখালেরা সাবধান হইবে, এই জমিগুলিতে গরুবাছুর নামিতে দিবে না।

আষাঢ়ের মাঝামাঝি আবার এক পসলা জোর বৃষ্টি নামিল; ফলে মাটি অতিরিক্ত নরম হওয়ায় চাষ বন্ধ হইয়া গেল। নবীন আসিয়া বলিল, মোড়ল, এইবারে চরের ওপর একবার জোটপাট করে চল। এখন একবার চষে-খুঁড়ে না রাখতে পারলে আশ্বিন-কার্তিক মাসে কি আর ওখানে ঢোকা যাবে? একেই তো বেনার মুড়োতে আদাড় হয়ে আছে।

রংলাল বসিয়া তামাক খাইতেছিল, সে বলিল, এই বসে বসে আমিও ওই কথাই ভাবছিলাম লোহার। ওখানে তো একা একা কাজ সুবিধে হবে না, উ তোমার ‘গাতো’ করে কাজ করতে হবে। একেবারে পাঁচজনার হাল-আমার দুখানা, তোমার দুখানা, আর উ তিনজনার তিনখানা-এই সাতখানা হাল নিয়ে একেবারে গিয়ে পড়তে হবে! ওদের জমিতে একদিন করে, আর আমাদের দুখানা করে হাল আমরা দুদিন করে লোব।–বলিয়া সে হুঁকা হইতে কল্কে খসাইয়া নবীনকে দিয়া বলিল, লও, খাও!

কল্কেতে টান মারিয়াই নবীন কাশিয়া সারা হইয়া গেল, কাশিতে কাশিতে বলিল, বাবা রে, এ যে বিষ! বেজায় চড়া হয়ে গিয়েছে হে।

হাসিয়া রংলাল বলিল, হুঁ হুঁ, বর্ষার জন্যে তৈরী করে রাখলাম। জলে ভিজে হালুনি যখন লাগবে, তখন তোমার একটান টানলেই গরম হয়ে যাবে শরীর।

তা বটে। এখন কিন্তু এ তোমার বিষ হয়ে উঠেছে।– বলিয়া সে কল্কেটি আবার রংলালকে ফিরাইয়া দিল।

রংলাল বলিল, তা হলে কালই চল সব জোটপাট করে। মাঠানে তো এখন তোমার চার-পাঁচ দিন হাল লাগবে না।

তাতেই তো এলাম গো তোমার কাছে। বলি, মোড়লের ঘুম ভাঙিয়ে আসি একবার। এই নরম মাটিতে বেনা কাশ বেবাক উঠে যাবে তোমার। কিন্তু একটা কথা ভাবছি হে,- ভাবছি, চক্কত্তি-বাড়ি থেকে যদি হাঙ্গামাহুজ্জৎ করে তো কি হবে? জমি তো বন্দোবস্ত করে দেয় নাই।

ক্ষেপেছ তুমি! হাঙ্গামা করবে কে হে বাপু? কত্তা তো ক্ষেপে গিয়েছে। আবার নাকি শুনছি, বড় রোগ হয়েছে হাতে। বড় ছেলে তো কালাপানি, ছোটজনা তো পড়তে গিয়েছে কদিন হল। মজুমদারের জবাব হয়ে গিয়েছে। আর মজুমদারই তো তোমার হাঁ করে আছে, আবার একবার বাগে পেলে হয়। থাকবার মধ্যে গিন্নীমা আর মানদা ঝি। হুকুম দেবে গিন্নীমা আর লড়বে তোমার মানদা ঝি, না কি?–বলিয়া রংলাল হি-হি করিয়া হাসিয়া সারা হইল!

নবীন আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, উঁহু। ছোটজনা ভারি হুঁশিয়ার ছেলে হে, সে ভারী এক চাল চেলে গিয়েছে। সেই যি পঞ্চাশ বিঘে জমি, আমাদিগেও দিলে না, সাঁওতালদিগেও দিলে না, সেই জমিটা ভাগে বন্দোবস্ত করে দিয়েছে যত ছোকরা মাঝিদিগে! এখন যা হয়েছে, তাতে গিন্নী ঠাকরুন হুকুম দিলে গোটা সাঁওতাল-পাড়া হয়তো ভেঙে আসবে।

এবার রংলাল বেশ একটু চিন্তিত হইয়া পড়িল, নীরবে বসিয়া মাথার চুলের মধ্যে আঙুল চালাইয়া মুঠায় ধরিয়া চুল টানিতে আরম্ভ করিল। নবীন আপনার পায়ের বুড়ো-আঙুলের নখ টিপিতেছিল; কিছুক্ষণ পর সে ডাকিল, মোড়ল!

উ!

তা হলে?

 সেই ভাবছি।

আমি বলছিলাম কি, গিন্নীঠাকরুনের কাছে গিয়ে বন্দোবস্তের হাঙ্গামা মিটিয়ে ফেলাই ভাল; কাজ কি বাপু লোকের ন্যায্য পাওনা ফাঁকি দিয়ে? তার ওপর ধর, জমিদার-ব্রাহ্মণ।

উঁহু, সে হবে না। যখন বলেছি, সেলামী দেব না, তখন দেব না!

 তা হলে?

তা হলে আর কি হবে; হাল-গরু নিয়ে চল তো কাল, তারপর যা হয় হবে।

উঠিয়ে দিলে তো মান থাকবে না, সে কথাটা ভাব।

রংলাল খানিকটা মুচকি হাসিল, তারপর বলিল, তখন মেজেস্টারিতে দরখাস্ত দেব যে, আমাদের জমি থেকে জোর করে জমিদার তুলে দিয়েছে।

নবীন চক্রবর্তী-বাড়ির অনেক দিনের চাকর, উপস্থিত চাকরি না থাকিলেও এই পুরাতন মনিব-বাড়ির জন্য সে খানিকটা মমতা অনুভব করে। সেই প্রভুবংশের সহিত এই ধারায় বিরোধ করিতে তাহার মন সায় দিল না। সে মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল।

রংলাল বলিল, কি হল, চুপ করে রইলে যে? চলই তো জোট-পাট করে, দেখাই যাক না, কি হয়?

নবীন এবার বলিল, সে ভাই আমি পারব না। লোকে কি বলবে একবার ভাব দেখি।

রংলাল হাসিল, তারপর দুই হাতের বুড়ো আঙুল দুইটি একত্র করিয়া নবীনের মুখের কাছে ধরিয়া বলিল, কচু। লোকে বলবে কচু। তুমি ঘরে তুলবে আলু গম কলাই গুড়, আর লোকে বলবে কচু।

নবীন তবুও চুপ করিয়া রহিল। রংলাল এবার তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল, চল, একবার ঘুরে ফিরে ভাবগতিকটা বুঝে আসি। সাঁওতাল বেটাদের কি রকম হুকুম-টুকুম দেওয়া আছে, গেলেই জানা যাবে। আর ধর গা জমিটার অবস্থাও দেখা হবে। চল, চল।

নবীন ইহাতে আপত্তি করিল না, উঠিল।

কালি নদীতে ইহারই মধ্যে জল খানিকটা বাড়িয়েছে, এখন হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়া যায়। কয়েকদিন আগে জল অনেকটা বাড়িয়া উঠিয়াছিল, উপরের বালুচর পর্যন্ত ছিলছিলে রাঙা জলে ডুবিয়া গিয়াছিল। জল এখন নামিয়া গিয়াছে। বালির উপরে পাতলা এক স্তর লাল মাটি জমিয়া আছে। রৌদ্রের উত্তাপে এখন সে স্তরটি ফাটিয়া টুকরা টুকরা হয়ে গিয়াছে, পা দিলেই মুড়মুড় করিয়া ভাঙিয়া বালির সহিত মিশিয়া যায়। তবুও এই লক্ষ টুকরায় বিভক্ত পাতলা মাটির স্তরের উপর এখনও কত বিচিত্র ছবি জাগিয়া আছে।–কাঁচা মাটির উপর পাখীরা পায়ের দাগ রাখিয়া গিয়াছে, আঁকাবাঁকা সারিতে নকশা-আঁকা কাপড়ের চেয়েও বিচিত্র ছক সাজাইয়া তুলিয়াছে যেন। তাহারই মধ্যে প্রচণ্ড চওড়া মানুষের দুইটি পায়ের ছাপ চলিয়া গিয়েছে, এ বোধ করি ওই কমল মাঝির পায়ের দাগ! একটা প্রকাণ্ড সাপ চলিয়া যাওয়ার মসৃন বঙ্কিম রেখা একেবারে চরের কোল পর্যন্ত বিস্তৃত আছে। ভিতরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখিলে দেখা যায়, অতি সুক্ষ্ম বিচিত্র রেখায় লক্ষ লক্ষ পতঙ্গের পাদচিহ্ন।

বেনা ও কাশের গুল্মে ইহারই মধ্যে সতেজ সবুজ পাতা বাহির হইয়া বেশ জমাট বাঁধিয়া উঠিয়াছে, বন্য লতাগুলিতে নূতন ডগা দেখা দিয়াছে, ভিতরে ভিতরে শিকড় হইতে কত নূতন গাছ গজাইয়া উঠিয়াছে, সাঁওতালদের পরিস্কার করা পথের উপরেও ঘাস জন্মিয়াছে, কুশের অঙ্কুরে কন্টকিত হইয়া উঠিয়াছে।

তীক্ষাগ্ৰ কুশের উপর চলিতে চলিতে বিব্রত হইয়া রংলাল বলিল, ঐ বেটারাও বাবু হয়ে গিয়েছে নবীন, রাস্তাটা কি করে রেখেছে দেখ দেখি।

নবীন বলিল, ওদের পা আমাদের চেয়ে শক্ত হে।

পল্লীর প্রান্তে সাঁওতালদের জমির কাছে আসিয়া তাহারা কিন্তু অবাক হইয়া গেল। ইহার মধ্যে প্রায় সমস্ত জমি সবুজ ফসলে ভরিয়া উঠিয়াছে। চষিয়া খুঁড়িয়া নিড়ান দিয়া তাহারা ভুট্টা, শন, অড়হর বুনিয়া শেষ করিয়া ফেলিয়াছে; জমির ধারে সারিবন্দী চারা, তাহাতে শিম, বরবটি, খেঁড়ো, কাঁকুড়ের অঙ্কুর বাহির হইয়া পড়িয়াছে। ধানের জমিগুলি চাষ দিয়া সার ছড়াইয়া একেবারে প্রস্তুত করিয়া ফেলিয়াছে। বাড়িঘরের চালে নূতন খড় চাপানো হইয়া গিয়াছে, কাঁচা সোনার রঙের নূতন খড়ের বিছানি অপরাহ্নের রৌদ্রে ঝকঝক করিতেছে। ইহাদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ সত্ত্বেও রংলাল এবং নবীন মুগ্ধ হইয়া গেল। রংলাল বলিল, বা বা বা! বেটারা এরই মধ্যে করে ফেলেছে কি হে, অ্যাঁ! ঘাস-টাস ঘুচিয়ে বিশ বছরের চষা জমির মত সব তকতক করছে!

নবীন হেঁট হইয়া ফসলের অঙ্কুরগুলিকে পরীক্ষা করিয়া দেখিতেছিল। সে বলিল, অড়লের কেমন জাত দেখ দেখি। একটা বীজও বাদ যায় নাই হে! তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আর আমাদের জমিতে হয়তো ঢাকতেই পারা যাবে না। দেখলে তো, বেনা আর কাশ কি রকম বেড়ে উঠেছে।

আরও খানিকটা অগ্রসর হইয়া অহীন্দ্র যে জমিটা খাসে রাখিয়াছে, সেই অংশটার ভিতর তাহারা আসিয়া পড়িল। তখনও সেখানে কয়জন জোয়ান সাঁওতাল মাটি কোপাইয়া বেনা ও কাশের শিকড় তুলিয়া ফেলিতেছিল। এ অংশটার অনেকটা তাহারা সাফ করিয়া ফেলিয়াছে, তবুও নতুন বলিয়া এখানে ওখানে দুই চারিটা পরিত্যক্ত শিকড় হইতে ঘাস গজাইয়া উঠিতেছে, এখনও জমির আকারও ধরিয়া উঠে নাই, এখানে ওখানে উঁচু নীচু অসমতল ভাবও সমান হয় নাই। তবুও উহারই মধ্যে যে অংশটা অপেক্ষাকৃত পরিস্কার হইয়াছে, তাহারই উপর ভুট্টা বুনিয়া ফেলিয়াছে। সে-জমিটা অতিক্রম করিয়া আপনাদের জমির কাছে আসিয়া তাহারা থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল। সত্যই বেনা ঘাসে কাশের গুল্মে নানা আগাছায় সে যেন দুর্ভেদ্য হইয়া উঠিয়াছে। বেনা ও কাশ ইহারই মধ্যে এমন বাড়িয়া গিয়াছে যে, মানুষের বুক পর্যন্ত ডুবিয়া যায়। এই জঙ্গলের মধ্যে লাঙল চষিবে কেমন করিয়া? নবীন বলিল, ঘাস কেটে না ফেললে আর উপায় নেই মোড়ল!

রংলাল চিন্তিত মুখেই বলিল, তাই দেখছি।

নবীন বলিল এক কাজ করলে হয় না মোড়ল? সাঁওতালদিগেই এ বছরের মত ভাগে দিলে হয় না? এবার ওরা কেটে কুটে সাফ করুক, চষে খুঁড়ে ঠিক করুক, তারপর আসছে বছর থেকে আমরা নিজেরা লাগব।

যুক্তিটা রংলালের মন্দ লাগিল না। সে বলিল, তাই চল, দেখি বেটাদের বলে।

সেই পরামর্শ করিয়া তাহারা আসিয়া সাঁওতালদের পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করিল, ঝকঝকে তকতকে পল্লী, পথে বা ঘরের আঙিনায় কোথাও এতটুকু আবর্জনা নাই। পল্লীর আশেপাশে তখনও গরু মহিষ ছাগল চরিয়া বেড়াইতেছে। সারের গাদার উপর মুরগীর দল খুঁটিয়া খুঁটিয়া আহার সংগ্রহে ব্যস্ত। আঙিনার পাশে পাশে মাচার উপর কাঠশিম, লাউ, কুমড়ার লতা বাসুকির মত সহস্র ফণা বিস্তার করিয়া বাড়িয়া চলিয়াছে যেন। বাড়িগুলির বাহিরে চারিদিক ঘিরিয়া সরলরেখার মত সোজা লম্বা বাঁধ তৈয়ারী করিয়াছে, তাহারই উপর সারবন্দী জাফরি বসানো। ভিতরে আম কাঁঠাল মহুয়ার গাছ পুঁতিয়া ফেলিয়াছে, মধ্যে মধ্যে সজিনার ডাল এবং মূল সমেত বাঁশের কলম লাগাইয়া চারিপাশে কাঁটা দিয়া ঘিরিয়া দিয়াছে। রংলাল বলিল, বাকি আর কিছু রাখে নাই বেটারা, ফল ফুল শজনে বাঁশ-একেবারে ইন্দ্র ভুবন করে ফেলেছে হে! জাত বটে বাবা!

প্রথমেই পুতুলনাচের ওস্তাদ চূড়া মাঝির ঘর; মাঝি ছুতারের যন্ত্রপাতি লইয়া উঠানে বসিয়া লাঙল তৈয়ারি করিতেছিল। একটি অল্পবয়সী ছেলে তাহার সাহায্য করিতেছে। একখানা প্রায়-সমাপ্ত লাঙলের উপর হাল্কাভাবে যন্ত্র চালাইতে চালাইতে মাঝি গুনগুন করিয়া গান করিতেছিল। নবীন লাঙলখানার দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল, দেখেছ কেমন পাতলা আর কতটা লম্বা?

রংলাল দেখিয়া মুখ বাঁকাইয়া বলিল, বাজে! এত সরুতে পাশের মাটি ধরবে কেন? ওর চেয়ে আমাদের ভাল। যাকগে। এখন তো আমাদের কাজের কথা। এই মাঝি, মোড়ল কোথা রে তোদের?

ওস্তাদ কথার কোন উত্তর দিল না, আপন মনেই কাজ করিতে লাগিল। রংলাল বিরক্ত হইয়া বলিল, এ-ই শুনছিস?

মুখ না তুলিয়াই এবার চূড়া বলিল, কি?

 তোদের মোড়ল কোথা?

মোড়ল?

হ্যাঁ।

মোড়ল?

হ্যাঁ হ্যাঁ।

চূড়া এবার হাতের যন্ত্রটা রাখিয়া দিয়া কোন কিছুর জন্য আপনার টাক হইতে কাপড়ের খুঁট পর্যন্ত খুঁজিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু সে বস্তুটা না পাইয়া অত্যন্ত হতাশভাবে বলিল, পেলাম না গো।

রংলাল সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, ওই! বেটা বলছে কি হে!

চূড়া সকরুণ মুখে বলিল, রেখেছিলাম তো বেঁধে। পড়ে গেঁইছে কোথা।

রংলাল অত্যন্ত চটিয়া উঠিয়া বলিল, দেখ দেখি বেটার আস্পর্ধা, ঠাট্টা-মস্করা আরম্ভ করেছে!

চূড়া এবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল, মানুষ আপনার ঘরকে থাকে। তুরা তার ঘরকে যা। আমাকে শুধালি কেনে?

রংলাল কোন কথা বলিল না, নবীনের হাত ধরিয়া টানিয়া ক্রুদ্ধ পদক্ষেপেই অগ্রসর হইল। চূড়া পেছন হইতে অতি মিষ্ট স্বরে ডাকিল, মোড়ল! ও মোড়ল!

রংলাল বুঝিল, লোকটা অনুতপ্ত হইয়াছে, সে ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল, কি?

চূড়া কোন কথা বলিল না, তাহার সমস্ত শরীরের কোন একটি পেশি নড়িল না, শুধু বড় বড় কাঁচা পাকা গোঁফ জোড়াটি অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচিয়া উঠিল। গোঁফের সে নৃত্যভঙ্গিমা যেমন হাস্যকর, তেমনই অদ্ভুত। তাহা দেখিয়া রংলালও হাসিয়া ফেলিল, বেটা আমার রসিক রে!

চূড়া এবার বলিল, বুলছি, রাগ করিস না গো।

মোড়ল মাঝির উঠানে খাটিয়ার উপর একটি আধা-ভদ্রলোক বসিয়া ছিল। কমল মাটির উপর উবু হইয়া বসিয়া কথা বলিতেছিল। লোকটির গায়ে একখানি চাদর, পায়ে একজোড়া চটিজুতো, হাতে মোটা বাঁশের ছড়ি, চোখে পুরু একজোড়া চশমা-সূতা দিয়া মাথা বেড়িয়া বাঁধা। চশমাশুদ্ধ চোখ একরূপ আকাশে তুলিয়া রংলাল ও নবীনকে দেখিয়া লোকটা বলিল, ওই, পাল মশায় যে? লোহারও সঙ্গে? কি মনে করে গো?

রংলাল ঈষৎ হাসিয়া বলিল, বলি, আপুনি কি মনে করে গো?

লোকটি বলিল, আর বল কেন ভাই, এরা ধরেছে বর্ষার সময় ধান দিতে হবে। তাই একবার দেখতে শুনতে এলাম। তা এরা করেছে বেশ, এরই মধ্যে গেরামখানিকে বেশ করে ফেলেছে হে! তারপর, শুনলাম, আপনারাও জমি নিয়েছেন? তা আমাদিগে বললে কি আর আপনাদের জমি আমরা কেড়ে নিতাম? আমরাও খানিক আধেক নিতাম আর কি!

নবীন বলিল, বেশ, পাল মশায় বলেন ভাল! আমদিগেই কি আর দেয় জমি! কোন রকম করে হাতে পায়ে ধরে তবে আমরা পেলাম। তার উপর কে চন্দ রাজা, কে চন্দ মন্ত্রী-কোন হদিস নাই।

লোকটি হাসিয়া বলিল, তা দেখছি। চার কোণে চার কোপ দিয়ে গেলেই হল। বাস্, জমি দখল হয়ে গেল। কই, এখনও তো কিছু করতে পারে নাই দেখলাম। এবার আর ওতে হাত দিতেও পারবেন না। এদিকে আবার ধানচাষ এসে পড়ল হু-হু করে।

রংলাল বলিল, এবার ভাবছি সাঁওতালদিগেই ভাগে দিয়ে দেব, ওরাই চাষ-খোঁড় করুক, যা পারে লাগাক, যা খুশি হয় আমাদের দেবে, তাই এলাম একবার মোড়লের কাছে। শুনছিস মোড়ল?

কমল মাঝি দুই হাতে মাথা ধরিয়া বসিয়া ছিল, সে বলিল, তা তো শুনলাম গো।

তা কি বলছিস?

উঁ-হুঁ, সে আমরা লারব। তুরা তো আবার কেড়ে লিবি। আমরা তবে কেনে তুদের জমি ঠিক করে দিব? আমাদিগে পয়সা দিয়ে খাটায়ে লে কেনে।

কেন, গরজ বুঝছিস নাকি?

তুরাই তো দেখাইছিস গো সিটি। আমরা খাটব, জমি করব, আর তুরা তখন জমিটা কেড়ে লিবি।

নূতন লোকটা এবার বলিল, আমি উঠছি মাঝি। তা হলে ওই কথাই ঠিক রইল।

মাঝি বলিল, হুঁ, সেই হল। আপুনি আসবি তো ঠিক?

ঠিক আসব আমি। তারপর রংলাল ও নবীনকে বলিল, বেশ, তা হলে কথাবার্তা বলুন আপনারা, আমি চললাম।

লোকটি চলিয়া গেলে রংলাল বলিল, হ্যাঁ মাঝি, তোরা ওর কাছে ধান লিবি? তোদের গলা কেটে ফেলবে। খবরদার খবরদার। এক মণ ধানে শ্রীবাস আধ মন সুদ লেয়, খবরদার।

মাঝি ঘাড় নাড়িয়া বলিল, উঁহু উ সুদ লিব না বুললে। উ আমাদের পাড়াতে দুকান করছে। একটি খামার করছে। আমদিগে জমি দিলে ভাগে। আমরা উয়ার জমি কেটে চষে ঠিক করে দেব।

রংলাল বিস্মিত হইয়া বলিল, পাল এখানে জমি নিয়েছে নাকি?

হুঁ গো। ওই তো, তুদের জমিটাই উ লিলে। বাবুদিগে টাকা দিলে, দলিল করে লিলে, চেক লিলে। কাল সব পাড়াসুদ্ধ ওই জমিতে লাগব। উনি আসবেন লোকজন লিয়ে।

রংলাল নবীন উভয়েই বিস্ময়ের আঘাতে স্তম্ভিত হইয়া মাটির পুতুলের মত দাঁড়াইয়া রহিল।

কমল পাড়ার এক প্রান্তে প্রকাণ্ড একটা খড়ের চাল দেখাইয়া বলিল, উই দেখ কেনে-উ দুকান করেছে উইখানে। উয়ার কাছে যা কেনে তুরে।

রংলাল নবীন উভয়েই হতাশায় ক্রোধে অস্থির চিত্তে দোকানের দিকে অগ্রসর হইল। লোকটি সোজা লোক নয়। এখানে সদগোপদের মধ্যে শ্রীবাস পাল বর্ধিষ্ণু লোক। বিস্তৃত চাষ তো আছেই, তাহার উপর নগদ টাকা এবং ধানের মহাজনিও করিয়া থাকে। বড় ছেলে একটা মনিহারীর দোকান খুলিয়াছে।

সাঁওতালপল্লীর এক প্রান্তে বেশ বড় একখানি চালা তুলিয়া তাহার চারিপাশে ঘিরিয়া ছিটা-বেড়ার দেওয়াল দিয়া কয় দিনের মধ্যেই শ্রীবাস দোকান খুলিয়া ফেলিয়াছে। এক পাশে নটকোনার দোকান, মধ্যে একটা তক্তপোশের উপর দস্তার গহনা, কার, পুঁতির মালা, রঙিন নকল রেশমের গুছি, কাঠের চিরুনি, আয়না-এই সব লইয়া কিছু মনিহারী সাজানো রহিয়াছে, এ দিকের এক কোণে তেলেভাজা খাবার বিক্রয় হইতেছে। পল্লীর মেয়েরা ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া জিনিস কিনিতেছিল।

রংলাল আসিয়া ডাকিল, পাল মশায়।

পালের ছোট ছেলে মুখ তুলিয়া তাহাদিগকে দেখিয়া বলিল, বাবা তো বাড়ি চলে গিয়েছেন।

রংলাল সঙ্গে সঙ্গে ফিরিল, পথ বাছিল না, জঙ্গল ভাঙিয়াই গ্রামের মুখে ফিরিল। পালের ছেলে বলিল, এই রাস্তায় রাস্তায় যান গো, বরাবর নদীর ঘাট পর্যন্ত রাস্তা পড়ে গিয়েছে।

সত্যই সবুজ ঘাসের উপর একটি গাড়ির চাকার দাগ-চিহ্নিত পথের রেশ বেশ পরিস্কার ফুটিয়া উঠিয়াছে ইহারই মধ্যে, কিছু জঙ্গল কাটিয়াও ফেলা হইয়েছে। পথ বাছিয়া চলিবার মত মনের অবস্থা তখন রংলালের নয়, সে জঙ্গল ভাঙিয়াই গ্রামের দিকে অগ্রসর হইল।

.

১৪.

রংলাল মনের ক্ষোভে রক্তচক্ষু হইয়াই শ্রীবাসের বাড়িতে হাজির হইল। শ্রীবাস তখন পাশের গ্রামের জন কয়েক মুসলমানের সঙ্গে কথা বলিতেছিল। ইহারা এ অঞ্চলের দুর্দান্ত লোক, কিন্তু শ্রীবাসের খাতক। বর্ষায় ধান, হঠাৎ প্রয়োজনে দুই-চারিটা টাকা শ্রীবাস ইহাদের ধার দেয়, সুদ অবশ্য লয় না, কারণ মুসলমানদের ধর্মশাস্ত্রে সুদ লওয়া মহাপাতক।

কেহ কেহ হাসিয়া শ্রীবাসকে বলে, ঘরে তো টিন দিয়েছেন পাল মশায়, আর ও বেটাদের সুদ ছাড়েন কেন?

শ্রীবাস উত্তর দেয়, কিন্তু দরজা যে কাঠের রে ভাই, রাত্রে ভেঙে ঢুকলে রক্ষা করবে কে? তা ছাড়া ও রকম দু-দশটা লোক অনুগত থাকা ভাল। ডাকতে-হাঁকতে অনেক উপকার মেলে হে।

রংলালের মূর্তি দেখিয়া শ্রীবাস হাসিল, কিন্তু এতটুকু অবজ্ঞা বা বিরক্তি প্রকাশ করিল না। মিষ্টি হাসিমুখে আহ্বান জানাইয়া বলিল, আসুন আসুন। কই দরকার ছিল তো ওখানে কই কোন কথা বললেন না? ওরে তামাক সাজ, তামাক সাজ, দেখি।

বিনা ভনিতায় রংলাল কথা প্রকাশ করিয়া প্রশ্ন করিল, এর মানে কি পাল মশায়?

শ্রীবাস একেবারে যেন আকাশ হইতে পড়িল, বলিল, সে কি, ওই জমিটাই আপনারা নেবার জন্যে কোপ মেরে রেখেছেন নাকি? কিন্তু আমার বন্দোবস্ত যে আপনাদের অনেক আগে পাল মশায়! আপনারাই তা হলে আমার জমি নিতে গিয়েছিলেন বলুন?

রংলাল সবিস্ময়ে বলিল, মানে? আমরা ছোট দাদাবাবুর সামনে সেদিন–

বাঁধা দিয়া শ্রীবাস বলিল, আমার বন্দোবস্ত বড় দাদাবাবুর কাছে পাল মশায়। ননী যেদিন বিকেলে খুন হল, সেই দিন সকালে আমি বন্দোবস্ত নিয়েছি। কেবল, বুঝলেন কিনা- এই ঝগড়া-মারামারির জন্যেই ওতে আমি হাত দিই নাই।

রংলাল উত্তেজিত হইয়া উঠিল, এ কি ছেলে ভোলাচ্ছেন পাল, না পাগল বোঝাচ্ছেন? আমি ছেলেমানুষ, না পাগল? বড় দাদাবাবু আপনাকে জমি বন্দোবস্ত করে গিয়েছেন?

শ্রীবাস শান্তভাবে বলিল, বসুন। বলি, পড়তে শুনতে তো জানেন আপনি। কই, দেখুন দেখি এই চেকরসিদ খানা। তারিখ দেখুন, সন সাল দেখুন, তার উলটো পিঠে জমির চৌহদ্দি দেখুন; সে সময়ের লায়েব আমাদের মজুমদার মশায়ের সই দেখুন। তারপর, তিনিও আপনার বেঁচে রয়েছেন, তাঁর কাছে চলুন। তিনি কি বলেন শুনুন-, বলিয়া শ্রীবাস একখানি জমিদারী সেরেস্তার রসিদ বাহির করিয়া রংলালের সম্মুখে ধরিল।

শ্রীবাসের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য, অন্তত রসিদখানা সেই প্রমাণই দিল। কিন্তু রংলাল বলিল, আমরাও ধানচালের ভাত খাই পাল, এ আপনি মজুমদারের সঙ্গে ষড় করে করেছেন। এ আপনার জাল রসিদ। আমরা ও-জমি ছাড়ব না, এ আপনাকে আমরা বলে দিলাম।

শ্রীবাস হাসিয়া বলিল, বলে না দিলেও সে আমি জানি পাল মশাই। বেশ, তা হলে কালই যাবেন চরের ওপর, কাল ঘাস কেটে জমি সাফ করতে আমার লোক লাগবে, পারেন উঠিয়ে দেবেন! তারপর তাহার অনুগত মুসলমান কয়েকজনকে সম্বোধন করিয়া বলিল, এই শুনলে তো মাসুদ, তা হলে খুব ভোরেই কিন্তু তোমরা এস। বুঝেছ তো, তোমরাই আমার ভরসা।

মাসুদ শ্রীবাসকে কোন উত্তর না দিয়া রংলালকে বলিল, তা হলে তাই আসব পাল। ভয় নাই, পুরু ঘাসের ওপর পড়লে পরে দরদ লাগবে না গায়ে।– বলিয়া সে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

রংলাল নির্বাক হইয়া রহিল, কিন্তু নবীন এবার হাসিল।

***

নবীন সমস্তক্ষণ নির্বাক হইয়া রংলালের অনুসরণ করিতেছিল। শ্রীবাসের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া সে বলিল, পাল, আমি তোমার এই সবের মধ্যে নাই কিন্তু।

রংলালের বুকের ভিতরে অবরুদ্ধ ক্রোধ হুহু করিতেছিল, শ্রীবাস ও মজুমদারের প্রবঞ্চনার ক্ষোভ, সঙ্গে সঙ্গে চরের উর্বর মৃত্তিকার প্রতি অপরিমেয় লোভ, এই দুইয়ের তাড়নায় সে যেন দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হইয়া উঠিয়াছিল। সে মুখ বিকৃতি করিয়া ভেঙাইয়া বলিয়া উঠিল, হ্যাঁ-হ্যাঁ, সে জানি। যা যা, বেটা বাগদী, ঘরে পরিবারের আঁচল ধরে বসে থাকগে যা।

নবীন জাতে বাগদী, আজ তিন পুরুষ তাহারা জমিদারের নগদীগিরিতে লাঠি হাতেই কাল কাটাইয়া আসিয়াছে, কথাটা তাহার গায়ে যেন তীরের মত গিয়া বিঁধিল। সে রূঢ় দৃষ্টিতে রংলালের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আমি পরিবারের আঁচল ধরে বসে থাকি আর যাই করি, তুমি যেন যেও। চরের ওপরেই আমার সঙ্গে দেখা হবে, বুঝলে? শুধু আমি লয়, গোটা বাগদীপাড়াকেই ওই চরের ওপর পাবে। বলিয়া সে হনহন করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল।

কথাটা রংলাল রাগের মুখে বলিয়া ফেলিয়াই নিজের অন্যায়টা বুঝিয়াছিল। এ-ক্ষেত্রে বাহুবলের একমাত্র ভরসাস্থল নবীন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে হইলে বাগদীদের দলে না লইলে উপায়ন্তর নাই। নবীন সমস্ত বাগদীপাড়াটার মাথা। তাহার কথায় তাহারা সব করিতে পারে। মুহর্তে রংলাল আপনা হতেই যেন পাল্টাইয়া গেল, একেবারে সুর পাল্টাইয়া সে ডাকিল, নবীন! নবীন! শোন হে, শোন।

ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া নবীন ফিরিয়া দাঁড়াইল বলিল, বল।

রসিকতা করিয়া অবস্থাটাকে সহজ করিয়া লইবার অভিপ্রায়েই রংলাল বলিল, ওই, রাগের চোটে যে পথই ভুলে গেলে হে! ও দিকে কোথা যাবে?

যাব আমার মনিব-বাড়ি। অনেক নুন আমি খেয়েছি, তাদের অপমান লোকসান আমি দেখতে পারব না। আমি হুকুম আনতে চললাম, তোমাদিগেও জমি চষতে দোব না, ও শ্রীবাসকেও না, গোটা বাগদীপাড়া আমরা কাল মনিবের হয়ে যাব। এ তোমরা জেনে রাখ।

রংলাল একটু চিন্তা করিয়া বলিল, চল, আমিও যাব। টাকা দিয়েই বন্দোবস্ত আমরা করে নেব। তা হলে তো হবে?

নবীন খুশি হইয়া বলিল, সে আমি কতদিন থেকে বলছি বল দেখি?

নবীন চক্রবর্তী বাড়ির পুরানো চাকর। শুধু সে নিজেই নয়, তাহার ঠাকুরদাদা হইতে তিন পুরুষ চক্রবর্তী-বাড়ির কাজ করিয়া আসিয়াছে। এ জমির বন্দোবস্তের গোড়া হইতেই মনে মনে সে একটা দ্বিধা অনুভব করিয়া আসিতেছিল। সেলামী না দিয়া জমি বন্দোবস্ত পাইবার আবেদনের মধ্যে তাহার একটা দাবি ছিল, কিন্তু অহীন্দ্র তাহাতে অসম্মতি জানাইলে রংলাল যখন আইনের ফাঁকে ফাঁকি দিবার সঙ্কল্প করিল, তখন মনে মনে একটা অপরাধ সে অনুভব করিয়াছিল। কিন্তু সে কথাটা জোর করিয়া সে প্রকাশ করিতে পারে নাই দলের ভয়ে। রংলাল এবং অন্য চাষী কয়জন যখন এই সঙ্কল্প করিয়া বসিল, তখন সে একা অন্য অভিমত প্রকাশ করিতে কেমন সঙ্কোচ অনুভব করিয়াছিল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে ছিল খানিকটা লোভ। অন্যকে ফাঁকি দেওয়ার আনন্দ না হইলেও, তাহাদিগকে খাতির বা স্নেহ করিয়া এমনি দিয়াছেন, ইহার মধ্যে একটা আত্মপ্রসাদ আছে, তাহার প্রতি একটা আসক্তি তাহার অপরাধবোধকে আরও খানিকটা সঙ্কুচিত করিয়া দিয়াছিল। সর্বশেষ রংলাল যখন বলিল, ওই সাঁওতালদের চেয়েও কি আমরা চক্রবর্তী-বাড়ির পর?– তখন মনে মনে সে একটা ক্রুদ্ধ অভিমান অনুভব করিল, যাহার চাপে ওই সঙ্কোচ বা দ্বিধাবোধ একেবারেই যেন বিলুপ্ত হইয়া গেল। যাহার জন্য অসঙ্কোচে রংলালদের দলে মিশিয়া সে, উচ্চকণ্ঠে না হইলেও প্রকাশ্যভাবেই, বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া উঠিয়া আসিল। কিন্তু ধীরে ধীরে আবার সেই দ্বিধা তাহার মনে জাগিয়া উঠিয়াছে। সেইজন্য মামলা-মোকদ্দমায় সম্মতি সে দিতে পারে নাই। তারপর শ্রীবাসের এই ষড়যন্ত্রের কথা অকস্মাৎ প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, চারিদিক হইতে চক্রবর্তী বাড়িকেই ফাঁকি দিবার আয়োজন চলিতেছে। তাহারা, শ্রীবাস, মজুমদার, সকলেই ফাঁকি দিতে চায় ঐ সহায়হীন চক্রবর্তী-বাড়িকে, তাহারই পুরানো মনিবকে। এক মুহূর্তে তাহার মনের দ্বন্দ্বের মীমাংসা হইয়া গেল, তিন পুরুষের মনিবের পক্ষ হইয়া সমগ্র বাগদীবাহিনী লইয়া লড়াই দিবার জন্য তাহার লাঠিয়াল-জীবন মাথা চাড়া দিয়া উঠিল।

চক্রবর্তী-বাড়ির পুরাতন চাকর হিসাবে অন্দরে যাতায়াতের বাধা তাহার ছিল না, সে একেবারে সুনীতির কাছে আসিয়া অকপটেই সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিয়া মাথা নীচু করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। হৃদয়াবেগের প্রাবল্যে তাহার ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। রংলাল দাঁড়াইয়া ছিল দরজার বাহিরে রাস্তাঘরে।

সমস্ত শুনিয়া সুনীতি কাঠের পুতুলের মত দাঁড়াইয়া রহিলেন, একটি কথাও বলিতে পারিলেন না। কথা বলিল মানদা, সে তীক্ষ্মস্বরে বলিয়া উঠিল, ছি লগদী, ছি! গলায় একগাছা দড়ি দাও গিয়ে।

সুনীতি এবার বলিল, না না, মানদা, দোষ একা নবীনের নয়, দোষ অহিরও। সাঁওতালদের যখন বিনা সেলামীতে জমি দিয়েছে, তখন নবীনকেও দেওয়া উচিত ছিল। সত্যিই তো, নবীন কি আমাদের কাছে সাঁওতালদের চেয়েও পর?

নবীন এবার ছোট্ট ছেলের মত কাঁদিয়া ফেলিল। দুয়ারের ওপাশ হইতে রংলাল বেশ আবেগভরেই বলিল, বলুন মা, আপনিই বলুন। আমাদের অভিমান হয় কি না হয়, আপনিই বলুন। মনে করে দেখুন, আমিই বলেছিলাম সর্বপ্রথম যে, এ-চর আপনাদের ষোলআনা। তবে ধম্মের কথা যদি ধরেন, তবে আমরা পেতে পারি। আপুনি বলেছিলেন, ধম্মকে বাদ দিয়ে কি কিছু করা যায় বাবা, তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। তাতেই মা, সেই দাবিতে আমরা আবদার করে বলেছিলাম, আমরা দিতে পারব না সেলামী।

সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, সবই বুঝলাম বাবা, কিন্তু এখন আমি কি করব, বল?

নবীন বলিল, আমাকে হুকুম দেন মা আমি কাউকেই জমি চষতে দেব না। গোটা বাগদীপাড়া লাঠি হাতে গিয়ে দাঁড়াব। থাকুক জমিই এখন খাসদখলে।

রংলাল বাহির হইতে গভীর ব্যাগ্রতা-ব্যাকুল স্বরে বলিয়া উঠিল, এখুনি আমি আড়াই শ টাকা এনে হাজির করছি নবীন, জমি আমাদিগে বন্দোবস্ত করে দেন রাণীমা।

নবীন বলিল, সেই ভাল মা, ঝঞ্জাট পোয়াতে হয় আমরাই পোয়াব, আপনাদের কিছু ভাবতে হবে না।

সুনীতি অনেক কিছু ভাবিতেছিলেন। তাহার মধ্যে যে কথাটা তাঁহাকে সর্বাপেক্ষা পীড়িত করিতেছিল, সেটা নবীন ও রংলালের কথা। নিজের স্বার্থের জন্য কেমন করিয়া এই গরীব চাষীদের এমন রক্তাক্ত বিরোধের মুখে ঠেলিয়া দিবেন? তাহার মনের বিচারে-স্বার্থটা ষোলআনা যে একা তাঁহারই।

মানদা কিন্তু হাসিয়া বলিল, সস্তায় কিস্তি মেরে ঝঞ্জাট পোয়াতে গায়ে লাগে না, না কি গো লগদী? আমিও কিন্তু বিঘে পাঁচেক জমি নেব মা। আমারও তো শেষকাল আছে। আমিও টাকা দেব। লগদী যা দেবে তাই দেব। লগদীর চেয়ে তো আমি পর নই মা।

মানদার কথার ধরনটা শুধু ধারালোই নয়, বাঁকাও খানিকটা বটে। নবীন অসহিষ্ণু হইয়া পড়িল, দুয়ারের ও-পাশে রংলাল দাঁতে দাঁতে টিপিয়া নিরালা অন্ধকারের মধ্যেই নীরব ভঙ্গিতে তাহাকে শাসাইয়া উঠিল। সুনীতি কি বলিতে গেলেন কিন্তু তাহার পূর্বেই বাহিরের সদর দরজার ওপাশে কে গলার সাড়া দিয়া আপনার আগমনবার্তা জানাইয়া দিল। গলার সাড়া সকলেরই অত্যন্ত পরিচিত। সুনীতি চঞ্চল হইয়া উঠিলেন, মানদা সবিস্ময়ে বলিল, ওমা লায়েববাবু যে।

পরমুহর্তেই শান্ত বিনীত কণ্ঠস্বরে মজুমদার বাহির হইতে ডাকিলেন, বউঠাকরুন আছেন নাকি?

নবীন খানিকটা দুর্বলতা অনুভব করিয়া চঞ্চল হইয়া পড়িল, দরজার আড়ালে রংলালের মুখ শুকাইয়া গেল। মানদা মৃদুস্বরে সুনীতিকে প্রশ্ন করিল, মা?

সুনীতি মৃদুস্বরেই বলিলেন, আসতে বল।

মানদা ডাকিল, আসুন, ভেতরে আসুন।

 সুনীতি বলিলেন, একখানা আসন পেতে দে মানদা।

প্রশান্ত হাসিমুখে যোগেশ মজুমদার ভিতরে আসিয়া সবিনয়ে বলিল, ভাল আছেন বউঠাকরুন? কর্তা ভাল আছেন?

অবগুণ্ঠন অল্প বাড়াইয়া দিয়া সুনীতি বলিলেন, উনি আছেন সেই রকমই। মাথার গোলমাল দিন দিন যেন বাড়ছে ঠাকুরপো।

মজুমদার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আহা-হা। কণ্ঠস্বরে, ভঙ্গিতে যতখানি সমবেদনার আভাস প্রকাশ পাইতে পারে, ততখানিই প্রকাশ পাইল। তারপর মজুমদার বলিল, একবার বৈদ্যপারুলিয়ার কবিরাজদের দেখালে হত না? চর্মরোগে, বিশেষত কুণ্ঠ ইত্যাদিতে ওরা ধন্বন্তরি।

সুনীতির মুখ মুহূর্তে বিবর্ণ হইয়া গেল। সমস্ত শরীর যেন ঝিমঝিম করিয়া উঠিল, মজুমদারের কথায় তিনি মর্মান্তিক আঘাত অনুভব করিলেন। তিনি কোনরূপে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, না না ঠাকুরপো, সে তো সত্যি নয়। সে কেবল ওর মাথার ভুল।

উত্তরে মজুমদার কিছু বলিবার পূর্বেই মানদা ঠক করিয়া একটা প্রণাম করিয়া বলিল, তবু ভাল, লায়েববাবুকে দেখতে পেলাম। আমি বলি-মথুরাতে রাজা হয়ে নন্দের বাদার কথা বুঝি ভুলেই গেলেন। তা লয় বাপু, পুরনো মনিবের ওপর টান খুব।

মজুমদারের মুখ চোখ রাঙা হইয়া উঠিল, সে বার দুই অস্বাভাবিক গম্ভীরভাবে গলা ঝাড়িয়া লইল; মানদা বলিয়াই গেল, লায়েববাবু আমাদের ভোলেন নি বাপু। কত্তাবাবুর খবরটবর রাখেন।

সুনীতি লজ্জায় যেন মরিয়া গেলেন, মুখরা মানদা এ বলিতেছে কি? কিন্তু তাহাকেই বা কেমন করিয়া তিনি নিরস্ত করিবেন? মুখের দিকেও একবার চাহে না যে, ইঙ্গিত করিয়া বারণ করেন। মজুমদার নিজেই ব্যাপারটাকে ঘুরাইয়া লইল, আরও একবার গলা পরিষ্কার করিয়া লইয়া বলিল, বিশেষ একটা জরুরী কথা বলতে এসেছিলাম বউঠাকরুন!

সুনীতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া হাসিমুখে বলিলেন, বলুন।

বলছিলাম ওই চরটার কথা। ওই চরের ওপর এক শ বিঘে জায়গা মহীবাবু শ্রীবাস পালকে বন্দোবস্ত করেছেন। আমিই চেক কেটে দিয়েছি মহীবাবুর হকুম মত। টাকা অবিশ্যি তিনিই নিয়েছিলেন। ছ শ টাকা। পাঁচ শ টাকা সেলামী, এক শ টাকা খাজনা।

সুনীতি মৃদুস্বরে কুণ্ঠিতভাবে বলিলেন, আমি তো সে কথা জানি নে ঠাকুরপো।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মজুমদার বলিল, জানবেন কি করে বলুন, এ কি আপনার জানবার কথা? তা ছাড়া, সেই দিনই বেলা তিনটের সময় ননী পাল খুন হয়ে গেল। বলবার আর অবসর হল কই, বলুন? এখন শ্রীবাসের সেই জমি থেকে পঞ্চাশ বিঘে জমি রংলাল নবীন– এরা দখল করতে চাচ্ছে। ওদের অবশ্যি জবরদস্তি। সেলামীর টাকা পর্যন্ত দেয় নি।

সুনীতি বলিলেন, না না ঠাকুরপো, ওদের আমি জমি দেব বলেছিলাম।

 বেশ তো। চরে তো আরও জমি রয়েছে, তার থেকে ওরা নিতে পারে।

অকস্মাৎ মানদা আক্ষেপ করিয়া বলিয়া উঠিল, আঃ হায় হায় গো! ছ-ছ শ টাকা চিলে ছোঁ দিয়ে নিয়ে গেল গো! আমার মনে পড়ছে লায়েববাবু, দাদাবাবু হাতটা পর্যন্ত ছ’ড়ে গিয়েছিল নখে। সেই টাকাই তো?

মুহূর্তের জন্য মজুমদার স্তব্ধ হইয়া গেল, কিন্তু পরমুহতেই হাসিয়া বলিল, টাকাটা আমাকেই দিয়েছিলেন মহী; সেটা মামলাতেই খরচ হয়েছে। বুঝলেন বউঠাকরুণ, জমাখরচের খাতায়– খসড়া রোকড় খেতিয়ান তিন জায়গাতেই তার জমা আছে। দেখলেই দেখতে পাবেন। তা ছাড়া চেক-রসিদও তাকে দেওয়া হয়েছে। আমি নিজে হাতে লিখে দিয়েছি। শ্রীবাস এসেছে, সেই চেক নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ-বছরের খাজনাও সে দিতে চায়।

সঙ্গে সঙ্গে বাহির হইতে শ্রীবাসের সাড়া পাওয়া গেল, খাজনার টাকা আমি নিয়ে এসেছি মজুমদার মশায়, এক শ টাকা আমি এক্ষুণি দিয়ে যাব।–বলিয়া সে ভিতর-দরজা পার হইয়া একেবারে অন্দরে আসিয়া দেখা দিয়া দাঁড়াইল।

মাথার ঘোমটা আরও খানিকটা বাড়াইয়া দিয়াও সুনীতি নিজেকে বিব্রত বোধ করিলেন; শুধু তাই নয়, হঠাৎ তাঁহার চোখে জল আসিয়া গেল। এমন ভাবে কেহ যে স্বেচ্ছায় আসিয়া এই অন্দরে প্রবেশ করিতে পারে, এ ধারণা মুহূর্ত-পূর্বেও তিনি কল্পনাতে আনিতে পারেন নাই। শ্রীবাসের এমন অন্দর-প্রবেশ যেমন অতর্কিত, তেমন ওই এক শ টাকার উষ্ণতায় উত্তপ্ত। তিনি আর সহ্য করিতে পারিলেন না, একমাত্র আশ্রয়স্থলের কথা তাঁহার মনে পড়িয়া গেল, অতি দ্রুতপদে উপরে স্বামীর ঘরের উদ্দেশ্যে চলিয়া গেলেন।

কিছুক্ষণের জন্য সকলেই ঘটনাবর্তের এমন আকস্মিক জটিলতায় হতবাক হইয়া গেল। মানদা ফুলিয়া উঠিল ক্রুদ্ধ ক্রুর সাপিনীর মত। তাহার পূর্বেই মজুমদার নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বলিল, বউঠাকরুন চলে গেলেন যে!

মানদা দংশনের সুযোগ পাইয়া উল্লসিত হইয়া উঠিল, বলিল, আমি তো রয়েছি, বলুন না কি বলছেন?

 হাসিয়া মজুমদার বলিল, তুমি আর শুনে কি করবে বল?

কেন হুকুম যা দেবার আমিই দেব। অন্দরই যখন কাছারি হয়ে উঠল, তখন আমার লায়েব ম্যানেজার হতে ক্ষেতিটা কি বলুন?

মজুমদারের মুখের হাসি তবু মিলাইয়া গেল না, সে বলিল, মানদার দাঁতগুলি যেমন চকচকে, তেমনি কি পাতলা ধারালো! তুমি শিলে শান দিয়ে দাঁত পরিষ্কার কর বুঝি?

মানদা হাসিয়া বলিল, এই দেখুন লায়েববাবু কি বলছেন দেখুন! বেঁজির দাঁতের কি শিল লাগে না শান লাগে? সাপ কাটবার মত ধার ভগবানই যে তার বজায় রাখেন গো। সে আরও কি বলিতে যাইতেছিল কিন্তু ঠিক এই সময়েই উপরের বারান্দা হইতে সুনীতি ডাকিলেন, মানদা।

মানদার রূপ পাল্টাইয়া গেল, সম্ভ্রমভরা মমতাসিক্ত স্বরে বলিল, কি মা?

সুনীতি বলিলেন, মজুমদার-ঠাকুরপোকে কালকের দিনটা অপেক্ষা করতে বল। কাল ছোটবাড়ির দাদার কাছে এর বিচার হবে; যা হয় তিনিই করে দেবেন।

মজুমদার উঠিয়া পড়িল।  মানদা বলিল, শুনলেন তো? এখন কি বলছেন, বলুন?

 মজুমদার বলিল, তোমাদের প্রজা শ্রীবাসকে বল মানদা। যা হয় সে-ই উত্তর দেবে।

মানদা বলিল, উকিলের বুদ্ধি নিয়েই তো মক্কেল উত্তর দেবে লায়েববাবু। তাতেই একবারে খোদ উকিলকেই জিজ্ঞেসা করছি।

শ্রীবাস কিন্তু বিনা পরামর্শেই উত্তর দিল, বলিল, অপেক্ষা আমি করতে পারব না, সে তুমি গিন্নীমাকে বল। তাতে খুনখারাপি হয়, হবে।

বারান্দার রেলিঙে মাথা রাখিয়া সুনীতি দাঁড়াইয়া রহিলেন। একটা গভীর অবসন্নতা তিনি অনুভব করিতেছিলেন, আর যেন সহ্য করিতে পারিতেছেন না। আগামী প্রভাতের চরের ছবি তাঁহার চোখের উপর যেন নাচিতেছে। চরটা রক্তে ভাসিয়া গিয়াছে, তাহারই উপর পড়িয়া আছে রংলাল, নবীন, শ্রীবাস আরও কত মানুষ। ঝরঝর করিয়া তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন, তাঁহার মনে হইল, সমস্ত কিছুর জন্য অদৃশ্য লোকের হিসাব নিকাশ দায়িত্ব পড়িতেছে তাঁহারই স্বামীর উপর, সন্তানদের উপর। অস্থির হইয়া গিয়া তিনি স্বামীর ঘরে গিয়া প্রবেশ করিলেন।

স্তব্ধ রামেশ্বর খাটের উপর বসিয়া আছেন পাথরের মূর্তির মত, খোলা জানালার মধ্য দিয়া রাত্রির আকাশের দিকে তাঁহার দৃষ্টি নিবদ্ধ। সুনীতি কঠিন চেষ্টায় আত্মসম্বরণ করিয়া নিরুচ্ছ্বসিতভাবেই বলিলেন, দেখ, একটা কথা বলছিলাম, না বলে যে আমি আর পারছি না।

রামেশ্বর ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফিরাইয়া সুনীতির মুখের দিকে চাহিলেন, যেন কোন অজ্ঞাতলোক হইতে তিনি এই বাস্তব পরিবেষ্টনীর মধ্যে ফিরিয়া আসিলেন। তারপর অতি মিষ্ট স্বরে বলিলেন, বল, কি বলছ, বল?

খুব ভাল করিয়া গুছাইয়া, একটি একটি করিয়া সমস্ত কথা বলিয়া সুনীতি বলিলেন, তুমি একবার মজুমদারকে ডেকে একটু বল। তোমার অনুরোধ তিনি কখনই ঠেলতে পারবেন না।

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া রামেশ্বর ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া বলিলেন, না।

সুনীতি আর অনুরোধ করিতে পারিলেন না, শুধু একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। রামেশ্বর অভ্যাসমত মৃদুস্বরে বলিলেন, ‘যাচ্ঞা মোঘা বরমধিগুণে,–নাধমে লব্ধকামা।’ সুনীতি, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে প্রার্থনা করিয়া যদি ব্যর্থ হও সেও ভাল, তবু অধমের কাছে ভিক্ষে করে লব্ধকাম হওয়া উচিত নয়।

তিনি নীরব হইলেন; প্রদীপের আলোকে মৃদু আলোকিত ঘরখানা অস্বাভাবিকরূপে স্তব্ধ হইয়া রহিল। তাহারই মধ্যে স্বামী ও স্ত্রী মাটির পুতুলের মত একজন বসিয়া, অপর জন দাঁড়াইয়া রহিল। আবার কিছুক্ষণ পরে রামেশ্বর বলিলেন, সুনীতি, আমার মাথায় একটু বাতাস করবে? আর একটু জল।

সুনীতি ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, তাড়াতাড়ি জল আনিয়া গ্লাসটি রামেশ্বরের হাতে দিয়া বলিলেন, শরীর কি কিছু খারাপ বোধ হচ্ছে?

 চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িয়া রামেশ্বর বলিলেন, মাথায় যেন আগুন জ্বলছে সুনীতি!

জল দিয়ে মাথা ধুয়ে দেব?

দাও।

সুনীতি সযত্নে মাথায় জল দিয়া ধুইয়া আপনার আঁচল দিয়া মুছিয়া দিলেন, তারপর জোরে জোরে বাতাস দিতে আরম্ভ করিলেন। উৎকণ্ঠার আর তাঁহার সীমা ছিল না। উন্মাদ পাগল হইয়া গেলে তিনি কি করিবেন।

সহসা রামেশ্বর বলিয়া উঠিল, শ্রীবাস পাল অন্দরের মধ্যে চলে এল সুনীতি!

তিনি আবার উঠিয়া বসিলেন।

না না, দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল।

 দরজার মুখে?

আবার কিছুক্ষণ পর তিনি বলিলেন, সন্ধ্যের পর আমি একটু করে বাইরে বেরুব। দিনে পারব না। আলো চোখে সহ্য করতে পারি না। তা ছাড়া হাতে এই কদর্য ব্যাধি, লোক দেখবে। সন্ধ্যার পর আমি বরং একটু করে কাজকর্ম দেখব–হ্যাঁ দেখব।

সুনীতির চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল, অতি সন্তর্পণে বাঁ হাতে আঁচল তুলিয়া সে জল তিনি মুছিয়া ফেলিলেন।

***

সমস্ত রাত্রি কিন্তু সুনীতির ঘুম হইল না। তাঁহার চিত্তলোকের কোমলতা অথবা দুর্বলতা এতই ব্যাপক এবং সূক্ষ্ম যে, নিতান্ত নিঃসম্পর্কীয় দূরান্তরের বহু মানুষের দুঃখের তরঙ্গ আসিয়া তাহাতে কম্পন তোলে, তাহাদের জন্য উদ্বেগে তিনি আকুল হইয়া উঠেন। আপনার দুঃখে তিনি পাথরের মত নিস্পন্দ, কিন্তু পরের জন্য না কাঁদিয়া তিনি পারেন না। আজ আগামী কালের ভয়াবহ দাঙ্গার কথা ভাবিয়া তাঁহার উদ্বেগের আর অবধি ছিল না। ভোর হইতেই তিনি ছাদে গিয়া উঠিলেন। ছাদ হইতে চরটা বেশ দেখা যায়। তিনি চাহিয়া দেখিলেন; কিন্তু ঘন ঘাসের জঙ্গলের একটানা গাঢ় সবুজ বেশ, আর তাহারই মধ্যে সাঁওতালপল্লীর ঘরের ছাউনির নূতন খড়ের হলুদ রঙের চালাগুলি ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। উদ্বিগ্ন হৃদয়ে তিনি দৃষ্টি যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। পূর্বদিগন্ত হইতে সোনালী আলো ছড়াইয়া পড়িয়া চরখানাকে মুহর্তে মুহর্তে অপরূপ করিয়া তুলিতেছে। মৃদু বাতাসে ঘাসের মাথা নাচিয়া নাচিয়া উঠিতেছে।

সহসা মনে হইল, একটা ক্রুদ্ধ বাদানুবাদের উচ্চধ্বনি তিনি শুনিতে পাইতেছেন। সামান্য ক্ষণের মধ্যেই একটা কলরব ধ্বনিত হইয়া উঠিল। তাঁহার বুক কাঁপিয়া উঠিল, চোখে জল আসিল। চোখের জল মুছিয়া আবার তিনি চাহিলেন, এবার দেখিলেন, কাশের বন যেন একটা দুরন্ত ঘূর্ণিতে আলোড়িত হইতেছে। চরের ভিতর হইতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী ত্রস্ত কলরব করিয়া আকাশে উড়িয়া গেল কতকগুলি চতুস্পদ…কয়েকটা শিয়াল, আরও কতকগুলো অজানা জানোয়ার ঘাসের বন হইতে বাহির হইয়া নদীর বালিতে ছুটিয়া পলাইতেছে। সুনীতি বাড়ির ভিতর দিকের আলিসার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া মানদাকে ডাকিয়া বলিলেন, একটু খবর নে না মানদা, চরের ওপর বোধ হয় ভীষণ দাঙ্গা বেঁধেছে!

মানদাও ছুটিয়া বাহির হইল। কিন্তু সংবাদ কিছু পাইল না, লোকে ছুটিয়া চলিয়াছে নদীর দিকে, চরে দাঙ্গা বাঁধিয়াছে। তাহার অধিক কেহ কিছু জানে না। দুয়ারের উপর মানদা উৎকণ্ঠিত ঔৎসুক্য লইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আরও কিছুক্ষণ পর একটি শীর্ণকায় মানুষকে তারস্বরে চীৎকার করিতে করিতে ফিরিয়া আসিতে দেখিয়া মানদা আরও একটু আগাইয়া পথের ধারে আসিয়া দাঁড়াইল।

লোকটি অচিন্ত্যবাবু। প্রাণপণে দ্রুত বেগে পালাইয়া বাড়ি চলিয়াছেন, শ্বাস-প্রশ্বাসে ভদ্রলোক ভীষণভাবেই হাঁপাইতেছেন, আর মুখ বলিতেছে, উঃ! বাপ রে! বাপ রে! ভীষণ কাণ্ড!

মানদাকে দেখিয়া তাঁহার কথার মাত্রা বাড়িয়া গেল, তিনি এবার বলিলেন, ভীষণ কাণ্ড! ভয়ঙ্কর দাঙ্গা! রক্তাক্ত ব্যাপার! খুন, খুন! একজন মুসলমান খুন হয়ে গেল। নবীন লোহার দুর্দান্ত লাঠিয়াল, মাথাটা দু টুকরো করে দিয়াছে। তাঁহার কথা শেষ হইতে না হইতেই তিনি মানদাকে পিছনে ফেলিয়া অনেকটা চলিয়া গেলেন।

উপর হইতে সুনীতি নিজেই সব শুনিলেন, হু হু করিয়া চোখের জল ঝরিয়া তাঁহার মুখ-বুক ভাসিয়া গেল। ওই অজানা হতভাগ্যের জন্য তাঁহার বেদনার আর সীমা ছিল না।

.

১৫.

সর্বনাশা চর।

উহার বুকের মধ্যে কোথাও যেন লুকাইয়া আছে রক্তবিপ্লবের বীজ। দাঙ্গায় খুন হইয়া গেল একটা; তাহার উপর জখমের সংখ্যাও অনেক। চরের ঘাস বাহিয়া রক্তের ধারা মাটির বুকে গড়াইয়া পড়িল।

সুনীতি যেন দিশাহারার মত ভাঙিয়া পড়িলেন। রক্তাক্ত চরের কথা ভাবিতে গেলেই আরও খানিকটা রক্তাক্ত ভূমির কথা তাঁহার মনে জাগিয়া উঠে। চক্রবর্তী-বাড়ির কাছারির রক্তাক্ত প্রাঙ্গণ। হতভাগ্য ননী পাল। উঃ সে কি রক্ত! সেই রক্তের ধার কি ওপারের চরের দিকে গড়াইয়া চলিয়াছে? চরের রক্তের স্রোতের সঙ্গে কি ননীর রক্তের ধারা মিশিয়া গেল? নিরাশ্রয় দৃষ্টি মেলিয়া তিনি শূন্যলোকের নীলাভ মায়ার পরপারের আশ্রয় খুঁজিয়া ফেরেন।

ওদিকে ইহার পরে মামলা-মকদ্দমা আরম্ভ হইয়া গেল।

প্রথমে অবশ্য চালান গেল উভয় পক্ষই; শ্রীবাস ও তাহার পক্ষীয় কয়েকজন লাঠিয়াল এবং এ-পক্ষের রংলাল, নবীন ও আরও চার-পাঁচজন। কিন্তু মজুমদারের তদ্বীরে, শ্রীবাসের অর্থের প্রাচুর্য্যে, শ্রীবাসের পক্ষই আইনের চক্ষে নির্দোষ বলিয়া প্রতিপন্ন হইল। শ্রীবাসের ন্যায্য অধিকারের উপর চড়াও হইয়া নবীনের দল দাঙ্গা করিয়াছে, যাহার ফলে নরহত্যা পর্যন্ত হইয়া গিয়াছে-এই অপরাধে তাহারা দায়রা-সোপর্দ হইয়া গেল। রংলাল অনেকদিন পর্যন্ত দৃঢ় ছিল, কিন্তু শেষের দিকে সে ভাঙিয়া পড়িল। রাজসাক্ষীরূপে শ্রীবাসের ন্যায্য অধিকার স্বীকার করিয়া সে নবীনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিল। তবু ঘরে মুখ লুকাইয়া সে কাঁদিত, বার বার ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিত, ভগবান নবীনকে বাঁচাইয়া দাও। শ্রীবাসের অন্যায় তুমি প্রকাশ করিয়া দাও। কিন্তু ভগবান হয় বধির, নয় মূক।

সংবাদ শুনিয়া সুনীতি কাঁদিলেন। নবীনের জন্য তাঁহার মর্মান্তিক দুঃখ হইল। এই বাড়ির তিন পুরুষের চাকর এই নবীনের বংশ তাঁহাদের ছাড়ে নাই। নবীনই ছিল এ-বাড়ির শেষ বাহুবল। সেও চলিয়া যাইবে। নবীনকে যে যাইতে হইবে, তাহাতে তাঁহার সংশয় নাই। তাঁহার মন বার বার সেই কথা বলিতেছে। সর্বনাশা চর!

চরটার কথা ভাবিতে বসিয়া সুনীতি এক-এক সময় শিহরিয়া উঠেন। মনশ্চক্ষে তিনি যেন একটা নিষ্ঠুর চক্রান্তের ক্রুর চক্রবেগ চরখানাকে এই বাড়িটাকে কেন্দ্র করিয়া আবর্তিত হইতে দেখিতে পান। এ আবর্ত হইতে সরিয়া যাইবার যেন পথ নাই। মহীকে বলি দিয়াও সরিয়া যাওয়া গেল না। প্রাণপণ শক্তিতে সরিয়া যাইবার চেষ্টা করিলেও সরিয়া যাওয়া যায় না। সঙ্গে সঙ্গে যেন চক্রান্তের চক্ৰ-পরিধি বিস্তৃত হইয়া যায়, বাড়ির সংশ্লিষ্ট জনকে আবর্তে ফেলিয়া সেই নিমজ্জমান জনের সহিত বন্ধনসূত্রের আকর্ষণে আবার টানিয়া এ-বাড়ির আবর্তের মধ্যে ফেলিয়া দেয়। নবীনের মামলায় সেটা সুনীতি প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইতেছেন। দায়রার মামলায় তাঁহাকে পর্যন্ত টানিয়া প্রকাশ্য আদালতের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াইতে হইবে। অহীন্দ্রকেও সাক্ষ্য দিতে হইয়াছে। রামেশ্বরের অবস্থা সেই দিন হইতে অতি শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে, এখন তিনি প্রায় বদ্ধ পাগল। ভাবিতে ভাবিতে সুনীতি আর কূল কিনারা দেখিতে পান না, তাঁহার অন্তরাত্মা থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠে। ভবিষ্যতের একটা করাল ছায়া যেন ওই কল্পিত আবর্তের ভিতর হইতে সমুদ্রমন্থনের শেষ ফল গরল বাষ্পের মত কুণ্ডলী পাকাইয়া পাকাইয়া উঠিতে থাকে। সে বিষবাষ্পের উগ্র তিক্ত গন্ধের আভাস যেন তিনি প্রত্যক্ষ অনুভব করিতেছেন।

জীবনে তাহার স্মৃতির ভাণ্ডার-অক্ষয় ভাণ্ডার, কোনটি ভুলিবার উপায় নাই।

আদালতের পিয়ন একেবারে অন্দরে দরজার মুখে আসিয়া সমন জারি করিয়া গেল। মানদা দারুন ক্রোধে অগ্রসর হইয়া গিয়া সরকারী চাপরাসযুক্ত লোক দেখিয়া নির্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, এত বড় মুখরার মুখেও কথা সরিল না। পিয়নটাই বলিল, দায়রা-মামলার সাক্ষী মানা হয়েছে সুনীতি দেবীকে। সাত দিন পরে আঠারই আষাঢ় দিন আছে! হাজির না হলে ওয়ারেন্ট হবে।

লোকটা চলিয়া গেল। মানদা কয়েক মুহূর্ত পরেই আত্মসম্বরণ করিয়া দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল। তাহার অনুমান সত্য। বাড়ির ফটকের বাহিরে তখন লোকটি আরও দুইটি লোকের সহিত মিলিত হইয়া চলিয়া যাইতেছে। তাহাদের একজন যোগেশ মজুমদার, অপর জন শ্রীবাস। সে প্রতিহিংসাপরায়ণা সাপিনীর মতই প্রতিপক্ষকে দংশন করিবার জন্য অন্ধকার রাত্রের মত একটি সুযোগ কামনা করিতে করিতে ফিরিল।

সাক্ষীর সমন পাইয়া সুনীতি বিহ্বল হইয়া পড়িলেন। তাঁহার অবস্থা হইল দুর্যোগভরা অন্ধকার রাত্রে দিগভ্রান্ত পথিকের মত! এ কি করিবেন তিনি? কেমন করিয়া প্রকাশ্য আদালতে শত চক্ষুর সম্মুখে তিনি দাঁড়াইবেন? আপন অদৃষ্টের উপরে তাঁহার ধিক্কার জন্মিয়া গেল। এ যে লঙ্ঘন করিবার উপায় নাই। দায়রা আদালতের সমন অগ্রাহ্য করিলে ওয়ারেন্ট হইবে; গ্রেপ্তার করিয়া হাজির করাই সেক্ষেত্রে বিধি। আদালতের পিয়নের কথা তাঁহার কানে যেন এখনও বাজিতেছে।

ছি ছি ছি! আপন অদৃষ্টের কথা ভাবিয়া তিনি ছি-ছি করিয়া সারা হইয়া গেলেন। ছিল, পথ ছিল–একমাত্র পথ। কিন্তু সেও তাঁহার পক্ষে রুদ্ধ। মরিয়া নিস্কৃতি পাইবারও যে উপায় তাঁহার নাই। অন্ধকার ঘরে আবদ্ধ অসহায় স্বামীর কথা মনে করিয়া প্রতিদিন দেবতার সম্মুখে তাঁহাকে যে কামনা করিতে হয়, ঠাকুর, এ পোড়া অদৃষ্টে যেন বৈধব্যের বিধানই তুমি ক’রো। সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে কঙ্কণ নিয়ে মৃত্যুভাগ্য আমি চাই না, চাই না, চাই না। সে দুর্ভাগ্যের ভাগ্যই তাঁহার জীবনের যে একমাত্র কামনা।

মানদা ক্রোধে ক্রুর হইয়া ফিরিয়া আসিতেই তিনি দিশেহারার মত বলিলেন, আমি কি করব মানদা?

মানদা উত্তর দিতে পারিল না। মর্মান্তিক দুঃখ, অসহ্য রাগে সে ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া ফেলিল। কিছুক্ষণ পরে সে চোখের জল মুছিয়া উপর দিকে মুখ তুলিয়া বলিল, মাথার পরে তুমি বজ্জাঘাত কর। নিব্বংশ কর। তবেই বুঝব তোমার বিচার; নইলে তুমি কানা-কানা-কানা।

সুনীতি এত দুঃখের মধ্যেও শিহরিয়া উঠিলেন, বলিলেন, ছি মা, আমার অদৃষ্ট। কেন পরকে মিথ্যে শাপ-শাপান্ত করছিস?

মিথ্যে? আমি তো আমার চোখের মাথা খাই নাই মা, মুখপোড়া ভগবানের মত। আমি যে নিজের চোখে দেখে এলাম!

কি? কার কথা বলছিস?

 মজুমদার আর শ্রীবাস চাষা। দুজনে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল গো। এ যে তাদের কীর্তি গো।

 মজুমদার ঠাকুরপো! না না, এতখানি ছোট কি মানুষ হতে পারে?

মানদা ক্রোধে আত্মবিস্মৃত হইয়া গেল, সে দুই হাত নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, নাও, দু হাত তুলে আশীর্বাদ মজুমদারকে-কর। সে আবার অকস্মাৎ ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

সুনীতি মূর্তিমতি হতাশার মত উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলেন। সর্বনাশা চর!

অকস্মাৎ তাঁহার মনে হইল, ওদিকে ঠাকুরবাড়ির দরজায় কে যেন আঘাত করিয়া ইঙ্গিতে আগমনের সাড়া জানাইতেছে। কোন মেয়েছেলে নিশ্চয়। এদিকের দুয়ার দিয়া যাওয়া-আসার অধিকার কেবল মহিলাদেরই। তিনি বলিলেন, দেখ তো মানদা, কে ডাকছেন।

মানদা শুনিয়াছিল, সে কিন্তু বেশ বুঝিয়াছিল, আসিয়াছেন রায়-বাড়ির কোন বন্ধু বা কন্যা। আজিকার ঘটনা লইয়া লজ্জা দিতে আসিয়াছেন। বলিল, ডাকবে আবার কে? রায়গুষ্টির কেউ এসেছে। তোমাকে বলতে এসেছে, ছি ছি ছি! তোমাকে আদালতে সাক্ষী মেনেছে! কি ঘেন্নার কথা! খুলব না আমি দরজা, চুপ করে থাক তুমি।

উত্তেজনায় মানদা এমন জ্ঞান হারাইয়াছিল যে, সুনীতিকে সে বার কয়েক ‘তুমি’ বলিয়া সম্ভাষণ করিয়া ফেলিল।

সুনীতি বলিলেন, না, দরজা খুলে দেখ, কে এসেছেন। খবরদার, কোন কড়া কথা বলিস না যেন।

গজগজ করিতে করিতে গিয়া দরজা খুলিয়াই মানদা বিস্ময়ে সম্ভ্রমে সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িল। এই স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে তাহাদের দুয়ারে দাঁড়াইয়া ছোট রায়-বাড়ির গিন্নী হেমাঙ্গিনী, সঙ্গে তাঁহার বারো-তেরো বৎসরের মেয়ে উমা।

মানদা প্রসন্ন হইতে পারিল না। সুনীতি কিন্তু পরম আশ্বাসে আশ্বস্ত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, দিদি! মনে মনে যেন আপনাকেই আমি খুঁজছিলাম দিদি।

হেমাঙ্গিনী সুন্দর হাসি হাসিয়া বলিলেন, আমি কিন্তু কিছু জানতে পারি নি ভাই। দেবতা-টেবতা বলো না যেন। আজ আমি তোমার দাদার দূত হয়ে এসেছি। তিনিই পাঠালেন আমাকে।

সুনীতি ঈষৎ শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, কেন দিদি?

বলছি। আরে উমা গেল কোথায়? উমা! উমা!

উমা ততক্ষণে বাড়ির এদিক ওদিক সব দেখিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। কোথায় এক কোণ হইতে সে উত্তর দিল, কি?

হেমাঙ্গিনী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, করছিস কি? এখানে এসে বস।

উত্তর আসিল, আমি সব দেখছি।

 সুনীতি হাসিয়া বলিলেন, অ-উমা-মা, এখানে এস না, তোমায় একবার দেখি।

 উমা আসিয়া দরজায় দুই হাত রাখিয়া দাঁড়াইল, বলিল, আমাকে ডাকছেন?

সুনীতি বলিলেন, বাঃ, উমা যে বড় চমৎকার দেখতে হয়েছে, অনেকটা বড় হয়ে গেছে এর মধ্যে! ওকে কলকাতায় আপনার বাপের বাড়িতে রেখেছেন, নয় দিদি?

হ্যাঁ ভাই, এখানকার শিক্ষা-দীক্ষার ওপর আমার মোটেই শ্রদ্ধা নেই। ছেলেকে অনেক দিন থেকেই সেখানে রেখেছি, মেয়েকেও পাঠিয়ে দিয়েছি এক বছরের ওপর। তারপর মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, উনি কিন্তু ভারী চঞ্চল আর ভারী আদুরে। সেখানে গিয়ে কেবল বাড়ি আসবার জন্যে ঝোঁক ধরেন। অমল কিন্তু আমার খুব ভাল ছেলে, সে এখানে আসতেই চায় না। বলে, ভাল লাগে না এখানে।

উমা ঘাড় নাড়িয়া নাড়িয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, তা লাগবে কেন তার? দিনরাত্রি সে কলকাতায় ঘুরছেই-ঘুরছেই। বন্ধু কত তার সেখানে। আর আমাকে একা মুখটি বন্ধ করে থাকতে হয়। সে বুঝি কারও ভাল লাগে?

সুনীতি হাসিলেন, বলিলেন, আপনি ভারী কঠিন দিদি, এই সব ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে দিয়ে থাকেন কেমন করে? ছেলেকে অবশ্য পাঠাতেই হয়, কিন্তু এই দুধের মেয়ে, একেও পাঠিয়ে দিয়েছেন?

হেমাঙ্গিনী কোন উত্তর দিলেন না, শুধু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। মেয়েকে বলিলেন, যা তুই, দেখে আয়, এদের বাড়িটা ভারী সুন্দর, কিন্তু কাল দুপুরের মত বাইরে গিয়ে পড়িস নে যেন।

উমা চলিয়া গেল। হেমাঙ্গিনী এতক্ষণে সুনীতিকে বলিলেন, জান সুনীতি, এই বাড়ির কথাই আমার মনে অহরহ জাগে। আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না, ঠাকুরজামাইয়ের এই অবস্থার কারণ, এ-বাড়ির এই দুর্দশার একমাত্র কারণ হল রাধারাণী-ছোট রায় বংশের মেয়ে। এত বড় দাম্ভিক মুখরার বংশ আর আমি দেখি নি ভাই। আমার ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে মেয়েকে আমি এর হাত থেকে বাঁচতে চাই। রাধারাণীর অদৃষ্টের কথা ভাবি আর আমি শিউরে উঠি।

সুনীতি চুপ করিয়া রহিলেন, হেমাঙ্গিনী একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, তোমার দাদাই আমাকে পাঠালেন, তোমার কাছেই পাঠালেন।

সুনীতি ইন্দ্র রায়ের বক্তব্য শুনিবার জন্য উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, হেমাঙ্গিনী বলিলেন, দায়রা মামলায় মজুমদারের চক্রান্তে যে তোমাকে সাক্ষী মানা হয়েছে, সে তিনি শুনেছেন।

মুহূর্তে সুনীতি কাঁদিয়া ফেলিলেন, সে কান্নায় কোন আক্ষেপ ছিল না, শুধু দুইটি চোখের কোণ বাহিয়া দুটি অশ্রুধারা গড়াইয়া পড়িল। হেমাঙ্গিনী সস্নেহে আপনার অঞ্চল দিয়া সুনীতির মুখ মুছাইয়া দিয়া বলিলেন, কাঁদছ কেন? সেই কথাই তো তোমার দাদা বলে পাঠালেন তোমাকে, সুনীতি যেন ভয় না পায়, কোন লজ্জা সঙ্কোচ না করে। রাজার দরবারে ডাক পড়েছে, যেতে হবে, কিসের লজ্জা এতে?

আবার সুনীতির চোখের জলে মুখ ভাসিয়া গেল, তিনি নিজেই এবার আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, কিন্তু ওঁকে কার কাছে রেখে যাব দিদি? সেই যে আমার সকলের চেয়ে বড় ভাবনা। তারপর আমিই বা কার সঙ্গে সদরে যাব?

হেমাঙ্গিনী চিন্তাকুল মুখে বলিলেন, প্রথম কথাটাই আমরা ভাবি নি সুনীতি। শেষটার জন্যে তো আটকাচ্ছে না। সে তোমার ছেলেকে আসতে লিখলেই হবে, অহীনই তোমার সঙ্গে যাবে। কিন্তু

সুনীতি বলিলেন, আরও কি ভাবছি জানেন? ওঁর ওই মাথার গোলমালের ওপর এই খবরটা কানে গেলে যে কি হবে, সেই আমার সকলের চেয়ে বড় ভাবনা। এই দাঙ্গার আগের দিন, মজুমদার ঠাকুরপো ওই শ্রীবাস পালকে সঙ্গে করে একেবারে বাড়ির মধ্যে চলে এলেন। আমি কি করব ভেবে না পেয়ে ছুটে গেলাম ওঁর কাছে। কথাটা বলেও ফেলেছিলাম। সেই শুনে কেমন যেন হয়ে গেলেন, বললেন, আমার একটু জল দিতে পার সুনীতি? আমি বুঝলাম, বুঝে মাথা ধুয়ে দিলাম, বাতাস করলাম; কিন্তু তবুও সমস্ত রাত্রি ঘুমোলেন না। তাই ভাবছি, এই কথা কানে গেলে উনি কি তা সহ্য করতে পারবেন?

হেমাঙ্গিনী চুপ করিয়া রহিলেন, তিনি উপায় অনুসন্ধান করিতেছিলেন। কিছুক্ষন পর বলিলেন, তুমি বলে রাখ এখন থেকে, তুমি ব্রত করেছ, তোমায় গঙ্গাস্নানে যেতে হবে। ঠাকুরজামাইয়ের সেবাযত্নের ভার আমার ওপর নিশ্চিন্ত হয়ে দিতে পারবে তো তুমি?

সুনীতি বিস্ময়ে আনন্দে হতবাক হইয়া হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, আবার অজস্র ধারায় তাঁহার চোখ বাহিয়া জল ঝরিতে আরম্ভ করিল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, অহীনকে আসতে চিঠি লেখ। রাত্রে সে ওঁর কাছে থাকবে; আমি তা হলে এ-বাড়ি ও-বাড়ি দু বাড়িই দেখতে পারব। আর তোমার সঙ্গে আমার অমলকে পাঠিয়ে দেব। কেমন?

সুনীতির চোখে আবার অশ্রুধারা-প্রবাহের বিরাম ছিল না। হেমাঙ্গিনী আবার তাঁহার চোখ-মুখ সযত্নে মুছাইয়া দিয়া বলিলেন, কেঁদো না সুনীতি। আমিও যে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না। আরও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হেমাঙ্গিনী ডাকিলেন, উমা! উমা!

উমার সাড়া কিন্তু কোথাও মিলিল না। হেমাঙ্গিনী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, বংশের স্বভাব কখনও যায়। মুখপুড়ী কলকাতা থেকে এসে এমন বেড়াতে ধরেছে! বলে, দেখব না, কলকাতায় এমন মাঠ আছে? আকাশে মেঘ উঠেছে, এখুনি বৃষ্টি নামবে– মেয়ের সে খেয়াল নেই।

সুনীতি ডাকিলেন, মানদা! উমা-মা কোথায় গেল রে? দেখ তো। মানদারও সাড়া পাওয়া গেল না, সুনীতি ঘর হইতে বারান্দায় বাহির হইয়া আসিয়া দেখিলেন দিবানিদ্রার পরম আরামে মানদার নাক ডাকিতেছে। অকস্মাৎ তাঁহার মনে হইল, উপরে কোথায় যেন কলকণ্ঠে কেহ গান বা আবৃত্তি করিতেছে। হেমাঙ্গিনীও বাহির হইয়া আসিলেন, তাঁহারও কানে সুরটা প্রবেশ করিল, তিনি বলিলেন, ওই তো!

সুনীতি বলিলেন, ওঁর ঘরে।

সন্তর্পণে উভয়ে রামেশ্বরের ঘরে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, উমা গম্ভীর একাগ্রতার সহিত ছন্দলীলায়িত ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়া সুমধুর কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করিতেছে

নয়নে আমার সজল মেঘের
 নীল অঞ্জন লেগেছে
নয়নে লেগেছে।
নবতৃণদলে ঘনবনছায়ে
হরষ আমার দিয়েছি বিছায়ে,
পুলকিত নীপ-নিকুঞ্জে আজি
বিকশিত প্রাণ জেগেছে
নয়নে সজল স্নিগ্ধ মেঘের
নীল অঞ্জন লেগেছে।।

সম্মুখে রামেশ্বর বিস্ফারিত বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে আবৃত্তিরতা স্বচ্ছন্দভঙ্গী উমার দিকে চাহিয়া আছেন। হেমাঙ্গিনী ও সুনীতি ঘরে প্রবেশ করিলেন; তিনি তাহা জানিতেও পারিলেন না। বালিকার কলকণ্ঠের ঝঙ্কারে, নিপুণ আবৃত্তির শব্দার্থে সৃজিত রূপস্বপ্নে, কবিতার ছন্দের অন্তর্নিহিত সঙ্গীত-মাধুর্যে, একটি অপূর্ব আনন্দময় ভাবাবেশে ঘরখানি বর্ষার সজল মেঘময় আকাশতলের শ্যামলস্নিগ্ধ ছায়াছন্ন কৃষিক্ষেত্রের মত পরিপূর্ণ হইয়া ভরিয়া উঠিয়াছে। তাঁহারাও নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিলেন। শ্লোকে শ্লোকে আবৃত্তি করিয়া উমা শেষ শ্লোক আবৃত্তি করিল।

হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ূরের মত নাচে রে
হৃদয় নাচে রে।
ঝরে ঘনধারা নব পল্লবে,
কাঁপিছে কানন ঝিল্লীর রবে,
তীর ছাপি’ নদী কল-কল্লোলে
এল পল্লীর কাছে রে।
হৃদয় আমার নাচে রে
ময়ূরের মত নাচে রে
হৃদয় নাচে রে।।

 আবৃত্তি শেষ হইয়া গেল। ঘরের মধ্যে সেই আনন্দময় আবেশ তখনও যেন নীরবতার মধ্যে ছন্দে ছন্দে অনুভূত হইতেছিল। রামেশ্বর আপন মনেই বলিলেন, নাচে-নাচে-হৃদয় সত্যিই ময়ূরের মত নাচে!

হেমাঙ্গিনী এবার প্রীতিপূর্ণ কণ্ঠে বলিলেন, ভাল আছেন চক্রবর্তী মশায়?

কে? স্বপ্নোত্থিতের মত রামেশ্বর বলিলেন, কে? তারপর ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন, রায়-গিন্নী! আসুন আসুন, কি ভাগ্য আমার!

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ও রকম করে বললে যে লজ্জা পাই চক্রবর্তী মশায়। আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। তারপর কন্যাকে বলিলেন, তুমি প্রণাম করেছ উমা? নিশ্চয় কর নি! তোমার পিসেমশায়।

সবিস্ময়ে রামেশ্বর প্রশ্ন করিলেন, আপনার মেয়ে?

হ্যাঁ।

সাক্ষাৎ সরস্বতী। আহা, ময়ূরের মত নাচে রে হৃদয় নাচে রে। কি মধুর!

উমা এই ফাঁকে টুপ করিয়া রামেশ্বরের পায়ে হাত দিয়া প্রণাম করিয়া লইল। পায়ে স্পর্শ অনুভব করিয়া দৃষ্টি ফিরাইয়া উমাকে প্রণাম করিতে দেখিয়া রামেশ্বর চমকিয়া উঠিলেন, আর্তস্বরে বলিলেন, না না, আমাকে প্রণাম করতে নেই। আমার হাত

হেমাঙ্গিনী বাধা দিয়া সকরুণ মিনতিতে বলিয়া উঠিলেন, চক্রবর্তী মশায়, না না।

রামেশ্বর স্তব্ধ হইয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর ম্লান হাসিয়া বলিলেন, জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, আকাশে মেঘ করেছে-দিক্‌হস্তীর মত কালো বিক্রমশালী জলভরা মেঘ। মহাকবি কালিদাসকে মনে পড়ে গেল। আপনার মনেই শ্লোক আবৃত্তি করছিলাম মেঘদূতের। এমন সময় আপনার মেয়ে এসে ঘরে ঢুকল। আমার মনে হল কি জানেন? মনে হল চক্রবর্তী-বাড়ির লক্ষ্মী বুঝি চিরদিনের মত পরিত্যাগ করে যাবার আগে আমাকে একবার দেখা দিতে এসেছেন। আমি আবৃত্তি বন্ধ করলাম। আপনার মেয়ে–কি নাম বললেন?

হেমাঙ্গিনী উত্তর দিবার পূর্বে উমাই উত্তর দিল, উমা দেবী।

উমা দেবী। হ্যাঁ, তুমি উমাও বটে দেবীও বটে। উমা আমায় বললে, কিসের মন্ত্র বলছিলেন আপনি? আর একবার বলুন না। আমি বললুম মন্ত্র নয়, শ্লোক, সংস্কৃত কবিতা। কবি কালিদাস মেঘদূতে বর্ষার বর্ণনা করেছেন, তাই আবৃত্তি করছিলাম। উমা আমার বললে, আপনি বাংলা কবিতা জানেন না? কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি কি পুরস্কার পেয়েছেন! তাঁর খুব ভাল কবিতা আছে। আমি বললাম, তুমি জান? ও আমায় কবিতা শোনালে। বড় সুন্দর কবিতা, বড় সুন্দর। বাংলায় এমন কাব্য রচিত হয়েছে! ভাগ্য, আমার ভাগ্য পৃথিবীতে বঞ্চনাই আমার ভাগ্য। বাঃ, ‘নীল অঞ্জন লেগেছে নয়নে লেগেছে’!

সকলেই স্তব্ধ হইয়া রহিল। উমা কিন্তু চঞ্চল হইয়া উঠিতেছিল, কয়েক মুহূর্ত কোনরূপে আত্মসম্বরণ করিয়া সে বলিল, আপনি কিন্তু সংস্কৃত শ্লোক আমায় শোনাবেন বলেছে!

রামেশ্বর হাসিয়া বলিলেন, তোমার মত সুন্দর করে কি বলতে আমি পারব মা?

উমা হাসিয়া বলিল, ওটা আমি আবৃত্তি-প্রতিযোগিতার জন্যে শিখেছিলাম কিনা। কিন্তু আপনিও তো খুব ভাল বলছিলেন, বলুন আপনি।

রামেশ্বর কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করিয়া লইয়া বলিলেন, বলি শোন–

তাং পার্বতীত্যাভিজনেন নাম্না বন্ধুপ্রিয়াং বন্ধুজনো জুহাব।
 উমেতি মাত্রা তপসো নিষিদ্ধা পশ্চাদুমাখ্যাং সুমুখী জগাম।।
মহীভূতঃ পুত্রবতোহপি দৃষ্টান্তস্মিন্নপত্যে ন জগাম তৃপ্তিম্।
অনন্ত পুস্পস্য মধ্যোহিঁ চুতে দ্বিরেফমালা সবিশেষসঙ্গা।।

 এর মানে জান মা? পর্বতরাজ হিমালয়ের এক কন্যা হল, গোত্র ও উপাধি অনুসারে আত্মীয়বর্গ, বন্ধুজন প্রিয় সেই কন্যার নাম রেখেছিল পার্বতী। পরে হিমাদ্রী-গৃহিণী সেই কন্যাকে তপস্যপরায়ণা দেখে বললেন, উমা! অর্থাৎ-বৎসে, করো না, তপস্যা করো না। সেই থেকে সুমুখী কন্যার নাম হল উমা। তারপর কবি বলেছেন, পর্বতরাজের পুত্র-কন্যা আরও অনেকেই ছিল, কিন্তু বসন্তকালে অসংখ্যবিধ পুস্পের মধ্যে ভ্রমর যেমন সহকারপুস্পেই অনুরক্ত হয়, তেমনি পর্বতরাজের চোখ দুটি উমার মুখের পরেই আকৃষ্ট হত বেশি, সেইখানেই ছিল যেন পূর্ণ পরিতৃপ্তি। তুমি আমাদের সেই উমা। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি, তুমি প্রচুর বিদ্যাবতী হবে। আজ যা তুমি শোনালে-আহা! সেই উমারই মত বিদ্যা তোমার আপনি আয়ত্ত হবে।

তাং হংসমালাঃ শরদীব গঙ্গাং মহোষধিং নক্তমিবাত্মভাসঃ।
স্থিরোপদেশামুপদেশকালে প্রপেদিরে প্রাক্তনজন্মবিদ্যাঃ।

হেমাঙ্গিনী ও সুনীতির চোখ জলে ভরিয়া উঠিয়াছিল। এই এক মানুষ, আবার এই মানুষই ক্ষণপরে এমন অসহায় আত্মবিস্মৃত হইয়া পড়িবেন, নিজের প্রতি নিজেরই অহেতুক ঘৃণায় এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করিবেন যে, অন্যের ইচ্ছা হইবে আত্মহত্যা করিতে।

উমা বলিল, আমায় সংস্কৃত কবিতা শেখাবেন আপনি? এখানে যে কদিন আছি আমি রোজ আপনার কাছে আসব?

আসবে? তুমি আসবে মা?

হ্যাঁ। কিন্তু এমন করে ঘরের মধ্যে দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকেন কেন আপনি? ওগুলো খুলে দিতে হবে কিন্তু।

মুহর্তে রামেশ্বরের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, তিনি থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিলেন, বহুকষ্টে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, রায়-গিন্নী, আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না?

<

Tarasankar Bandyopadhyay ।। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়