সেই বন্দোবস্তই হল।

অহীন্দ্র কলেজ কামাই করিয়াই আসিল। সুনীতি অহীন্দ্রকে লইয়া একটু শঙ্কিত ছিলেন। রামেশ্বরের সন্তান, মহীর ভাই সে। অহীন্দ্র কিন্তু হাসিয়া বলিল, এর জন্যে তুমি এমন লজ্জা পাচ্ছ কেন মা? এ-সংসারের সত্যকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করা প্রত্যেক মানুষের ধর্ম, এতে রাজা-প্রজা নেই, ধনী-দরিদ্র নেই। বিচারক মানুষ হলেও তিনি বিধাতার আসনে বসে থাকেন।

সুনীতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন, শুধু তাই নয়, বুকে যেন তিনি বল পাইলেন; সঙ্গে সঙ্গে বুকখানি পুত্রগৌরবেও ভরিয়া উঠিল। তিনি ছেলের মাথায় চুলগুলির ভিতর আঙুল চালাইতে চালাইতে বলিলেন, মুখ হাত ধুয়ে ফেল বাবা, আমি দুখানা গরম নিমকি ভেজে দিই। ময়দা আমার মাখাই আছে।

মানদা নীরবে দাঁড়াইয়া ছিল, সে একবার বলিয়া উঠিল, আপনি ভালই বললেন দাদাবাবু; কিন্তু আমার মন ঠাণ্ডা হল না। বড় দাদাবাবু হলে–। অকস্মাৎ ক্রোধে সে দাঁতে দাঁত ঘষিয়া বলিয়া উঠিল, বড়দাদাবাবু হলে ওই মজুমদার আর শ্রীবাসের মুণ্ডু দুটো নখে করে ছিঁড়ে নিয়ে আসতেন।

সুনীতি শঙ্কায় স্তব্ধ হইয়া গেলেন; অহীন্দ্র কিন্তু মৃদু হাসিল, বলিল, আমিও নিয়ে আসতাম রে মানদা, যদি মুণ্ডু দুটো আবার জোড়া দিতে পারতাম। না হলে ওরা বুঝবে কি করে যে, আমাদের মুণ্ডু ছিঁড়ে নিয়েছিল, আর এমন কাজ করব না!

সুনীতির চোখে এবার জল আসিল, অহীন্দ্র তাঁহার মর্মকে বুঝিয়াছে, সংসারে দুঃখ কি কাহাকেও দিতে আছে? আহা, মানুষের মুখ দেখিয়া মায়া হয় না?

মানদা কি উত্তর দিতে গেল, কিন্তু বাহিরে কাহার জুতোর দ্রুত শব্দে সে নিরস্ত হইয়া দুয়ারের দিকে চাহিয়া রহিল। একলা মানদাই নয়, সুনীতি অহীন্দ্র সকলেই। পরমুহর্তেই ষোল-সতেরো বৎসরের কিশোর একটি ছেলে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। স্নিগ্ধ গৌর দেহবর্ণ, পেশীসবল দেহ-সর্বাঙ্গে সর্বপরিচ্ছদে পরিচ্ছন্ন তারুণ্যের একটি উজ্জ্বল লাবণ্য যেন ঝলমল করিতেছে।

সুনীতি সাগ্রহে আহ্বান করিয়া বলিলেন, অমল! এস, এস।

 সুনীতির কথা শেষ হইবার পূর্বেই অমল অহীন্দ্রের হাত দুইটা ধরিয়া বলিল, অহীন?

অহীন্দ্র স্নিগ্ধ হাসি হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ অহীন। তুমি অমল?

অমল বলিল, উঃ, কতদিন পরে দেখা হল বল তো? সেই ছেলেবেলায় পাঠশালায়। কতদিন যে আমি তোমাকে চিঠি লিখব ভেবেছি! কিন্তু ইংলণ্ডের রাজা আর ফ্রান্সের রাজার যুদ্ধ হল, ফলে দুটো দেশের দেশবাসীরা অকারণে পরস্পরের শত্রু হতে বাধ্য হল। বলিয়া সে হাসিয়া উঠিল।

অহীন্দ্রও হাসিয়া বলিল, ইউ টক ভেরী নাইস!

অমল বলিল, ইউ লুক ভেরী নাইস। ব্রাইঁট ব্লেড অব এ শার্প সোর্ড-কাব্যের ভাষায় খাপখোলা সোজা তলোয়ার।

সুনীতি বিমুগ্ধদৃষ্টিতে দুইটি কিশোরের মিতালির লীলা দেখিতে ছিলেন। তিনি এইবার মানদাকে বলিলেন, মানদা, দে তো, একখানা ছোট সতরঞ্চি পেতে। বস বাবা তোমরা, আমি নিমকি ভাজব, খাবে দুজনে তোমরা। উমাকে আনলে না কেন বাবা অমল।

অমল বলিল, তার কথা আর বলবেন না পিসীমা। অকস্মাৎ সে কাব্য নিয়ে, যাকে বলে ভয়ানক মেতে ওঠা, সেই ভয়ানক মেতে উঠেছে। অনবরত রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ করেছে, আবৃত্তি করছে। আমায় তো জ্বালাতন করে খেলে।

সুনীতির সেই দিনের ছবি মনে পড়িয়া গেল। তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, আহা, তাঁহার যদি এমনি একটি কন্যা থাকিত, তবে এমনি কবিতা আবৃত্তি করিয়া তাঁহাকে ভুলাইয়া রাখিতে পারিত।

অমল বলিল, এই দেখুন পিসীমা, কাল তো আপনাকে নিয়ে আমি যাচ্ছি সদরে, কিন্তু ফিরে এলেই যে অহীন পালাবে, সে হবে না।

অহীন হাসিয়া বলিল, আমার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস কামাই হবে বলে ভাবনা কিনা

অমল বলিল, তুমি বুঝি সায়েন্স স্টুডেন্ট? আই সী!

.

সুনীতি কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া কাঁপিয়া উঠিলেন। আদালতটা লোকে গিসগিস করিতেছিল। অমল তাঁহার কাছেই দাঁড়াইয়া ছিল, সে বলিল, ভয় কি পিসীমা, কোন ভয় করবেন না। পরমুহূর্তে সে আত্মগতভাবে বলিয়া উঠিল, এ কি, বাবা এসে গেছেন দেখছি!

সুনীতি দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিলেন, ঘর্মাক্ত-পরিচ্ছদ, রুক্ষচুল, শুষ্কমুখ, অস্নাত, অভুক্ত ইন্দ্র রায় আদালতে প্রবেশ করিতেছেন, সঙ্গে একজন উকিল। উকিলটি আসিয়াই জজের কাছে প্রার্থনা করিল, মহামান্য বিচারকের দৃষ্টি আমি একটি বিশেষ বিষয়ে আকৃষ্ট করতে চাই। আদালতের সাক্ষীর কাঠগড়ায় এই যে সাক্ষী ইনি এই জেলায় একটি সম্ভান্ত প্রাচীন বংশের বধূ। উভয় পক্ষের উকিলবৃন্দ যেন তাঁর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও জেরা করেন। মহামান্য বিচারক সে ইঙ্গিত তাঁদের দিলে সাক্ষী এবং আমরা-শুধু আমরা কেন, সর্বসাধারণই চিরকৃতজ্ঞ থাকব।

ইন্দ্র রায় সুনীতির কাঠগড়ার নিকট আসিয়া বলিলেন, তোমার কোন ভয় নাই বোন, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম তোমার পেছনে।

সাক্ষ্য অল্পেই শেষ হইয়া গেল; বিচারক সুনীতির মুখের দিকে চাহিয়াই উকিলের আবেদনের সত্যতা বুঝিয়াছিলেন, তিনি অতি প্রয়োজনীয় দুই চারিটা প্রশ্ন ব্যতীত সকল প্রশ্নই আগ্রাহ্য করিয়া দিলেন। কাঠগড়া হইতে নামিয়া সুনীতি সেই প্রকাশ্য বিচারালয়ে সহস্র চক্ষুর সম্মুখে পায়ে হাত দিয়া ধূলা লইয়া ইন্দ্র রায়কে প্রণাম করিলেন। রায় রুদ্ধস্বরে বলিলেন, ওঠ বোন, ওঠ। তারপর অমলকে বলিলেন, অমল, নিয়ে এস পিসীমাকে। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছি, দেখি আমি সেটা।

দেখিবার কিন্তু প্রয়োজন ছিল। রায়ের কর্মচারী মিত্তির গাড়ি লইয়া বাহিরে অপেক্ষা করিয়াই দাঁড়াইয়া ছিল। সুনীতি ও অমলকে গাড়িতে উঠাইয়া দিয়া রায় অমলকে বলিলেন, তুমি পিসীমাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আমার কাজ রয়েছে সদরে, সেটা সেরে কাল আমি ফিরব।

সুনীতি লজ্জা করিলেন না, তিনি অসঙ্কোচে রায়ের সম্মুখে অর্ধ-অবগুণ্ঠিত মুখে বলিলেন, আমার অপরাধ কি ক্ষমা করা যায় না দাদা?

রায় স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, তারপর ঈষৎ কম্পিত কণ্ঠে বলিলেন, পৃথিবীতে সকল অপরাধই ক্ষমা করা যায় বোন, কিন্তু লজ্জা কোনরকমেই ভোলা যায় না।

পরামর্শ অনুযায়ী অতি যত্নে সংবাদটি রামেশ্বরের নিকটে গোপন রাখা হইয়াছিল। রচিত মিথ্যা কথাটি তাঁহাকে বলিয়াছিলেন হেমাঙ্গিনী। তিনি বলিয়াছিলেন, সুনীতি একটা ব্রত করছে, একবার গঙ্গাস্নানে যেতে হয়, কিন্তু আপনাকে রেখে কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। আমি বলছি যে, আমি আপনার সেবাযত্নের ভার নেব; ব্রত কি কখনও নষ্ট করে! আপনি ওকে বলুন চক্রবর্তী মশায়।

রামেশ্বর উত্তর দিয়াছিলেন, না না না। রায় গিন্নী ঠিক বলেছেন সুনীতি, ব্রত কি কখনও পণ্ড করে! আমি বেশ থাকব।

সন্ধ্যায় সুনীতি অমলের সঙ্গে রওনা হইয়া গেলেন। রাত্রির খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা সুনীতি নিজেই করিয়া গিয়াছিলেন। অহীন্দ্র রামেশ্বরের কাছে রহিল। পরদিন হেমাঙ্গিনী সমস্ত ব্যবস্থা করিলেন, দ্বিপ্রহরে খাবারের থালাখানি আনিয়া আসনের সম্মুখে নামাইয়া দিতেই রামেশ্বর স্মিতমুখে বলিলেন, সুনীতির ব্রত সার্থক হোক রায়-গিন্নী, তার গঙ্গাস্নানের পুণ্যেই বোধ করি আপনার হাতের অমৃত আজ আমার ভাগ্যে জুটল।

হেমাঙ্গিনী সকরুণ হাসি হাসিলেন। সত্যই সেকালে রামেশ্বর হেমাঙ্গিনীর হাতের রান্নার বড় তারিফ করিতেন। আজ রাধারাণী গিয়াছে বাইশ-তেইশ বৎসর-এই বাইশ-তেইশ বৎসর পরে আজ আবার তিনি রামেশ্বরকে রাঁধিয়া খাওয়াইলেন! খাওয়া হইয়া গেলে হেমাঙ্গিনী বাসন কয়খানি উঠাইয়া লইবার উপক্রম করিতেই রামেশ্বর হাত জোড় করিয়া বলিলেন, না না রায়গিন্নী না।

অহীন্দ্র বলিল, আমি মানদাকে ডেকে দিচ্ছি।

মানদা উচ্ছিষ্ট পাত্রগুলি লইয়া গেলে হেমাঙ্গিনী বলিলেন, তা হলে এইবার আমি যাই চক্রবর্তী মশায়।

রামেশ্বর সকরুণ হাসি হাসিয়া বলিলেন, চলেই তো গিয়েছিলেন রায়গিন্নী, এ বাড়িতে আর যে কখনও পায়ের ধুলো দেবেন, এ স্বপ্নেও ভাবি নি। আবার যখন দয়া করে এসেছেনই, তবে ‘যাই’ বলে যাচ্ছেন কেন, বলুন ‘আসি’। যদি আর নাও আসেন, তবু আশা করতে পারব, আসবেন–রায়গিন্নী একদিন না একদিন আসবেন।

কথাটা নিছক কৌতুক বলিয়া লঘু করিয়া লইবার অভিপ্রায়েই রায়গিন্নী বলিলেন, আপনার সঙ্গে মেয়েলি কথাতে কেউ পারবে না চক্রবর্তী মশায়। আচ্ছা তা-ই বলছি, আসি। কেমন, হল তো? তারপরে তিনি অহীন্দ্রকে বলিলেন, তুমি এইবার আমার সঙ্গে এস বাবা অহীন, খেয়ে আসবে।

উভয়ে নীচে আসিয়া দেখিলেন, উমা মানদার সঙ্গে গল্প জুড়িয়া দিয়াছে। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, চিনিস অহীনদাকে?

উমা বলিল, হ্যাঁ। অহীনদা যে ম্যাট্রিকে স্কলারশিপ পেয়েছেন।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, সেইজন্য চেন আমাকে? কিন্তু সে তো কপালে লেখা থাকে না?

 মৃদু হাসিয়া উমা বলিল, থাকে।

বল কি?

হ্যাঁ, সায়েবদের মত গায়ের রং আপনার। দেখলেই ঠিক চেনা যাবে যে, এই স্কলারশিপ পেয়েছে। সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

অহীন্দ্র এই প্রগলভা বালিকাটির কথায় লজ্জিত না হইয়া পারিল না। হেমাঙ্গিনী খাবারের থালা নামাইয়া দিয়া বলিলেন, ওর সঙ্গে কথায় তুমি পারবে না বাবা, তুমি খেতে বস। ও ওদের বংশের-। কথাটা বলিতে গিয়াও তিনি নীরব হইয়া গেলেন।

উমা বসিয়া থাকিতে থাকিতে সুট করিয়া উঠিয়া একেবারে রামেশ্বরের দরজাটি খুলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। তাহার এই আকস্মিক আবির্ভাবে রামেশ্বর পুলকিত হইয়া উঠিলেন, আপনার বিকৃতমস্তিষ্কপ্রসূত রোগকল্পনার কথাও সে আকস্মিকতায় ভুলিয়া গেলেন তিনি, বলিলেন, উমা? এস এস মা, এস।

উমা আসিয়া পরমাত্মীয়ের মত কাছে বসিয়া বলিল, সংস্কৃত কবিতা বলুন।

রামেশ্বর অল্প হাসিয়া বলিলেন, তুমি বল মা বাংলা কবিতা, আমি শুনি। সেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা একটি বল তো। তোমার মুখে, আহা, বড় সুন্দর লাগে। জান মা, মধুরভাষিণী গিরিরাজতনয়া যখন অমৃতস্রাবী কণ্ঠে কথা বলতেন, তখন কোকিলদের কণ্ঠস্বরও বিষমবিদ্ধা বীণার কর্কশধ্বনি বলেই মনে হত।

স্মরণে তস্যামমৃতশ্রুতেব প্রজল্পিতায়ামভিজাতবাচি।
অপানুপুষ্টা প্রতিকূলশব্দা শ্রোতুর্বিতল্পীরিব তাড্যমানা।

 তার চেয়ে তুমি বল, আমি শুনি।

উমাকে আর অনুরোধ করিতে হইল না, সে আজ কয়েক দিন ধরিয়া এই কারণেই শেখা কবিতাগুলি নূতন করিয়া অভ্যাস করিয়া রাখিয়াছে।

রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি
 এসেছে দুয়ার ভেদিয়া;
বক্ষে বেজেছে বিদ্যুৎ-বাণ
স্বপ্নের জাল ছেদিয়া।
—–
ভৈরব তুমি কি বেশে এসেছ,
ললাটে ফুঁসিছে নাগিনী;
রুদ্রবীণায় এই কি বাজিল
সু-প্রভাতের রাগিণী?
মুগ্ধ কোকিল কই ডাকে ডালে,
কই ফোটে ফুল বনের আড়ালে?
বহুকাল পরে হঠাৎ যেন রে
অমানিশা গেল ফাটিয়া
তোমার খড়গ আঁধার-মহিষে
দুখানা করিল কাটিয়া।

 রামেশ্বর বিস্ফারিত নেত্রে উমার মুখের দিকে চাহিয়া শুনিতেছিলেন। আবৃত্তি শেষ করিয়া উমা বলিল, কেমন লাগল, বলুন?

রামেশ্বর আবেশে তখন যেন আচ্ছন্ন হইয়া ছিলেন, তবু অস্ফুট কণ্ঠে বলিলেন, অপূর্ব অপূর্ব! ‘তোমার খড়গ আঁধার-মহিষে দুখানা করিল কাটিয়া’!– তিনি একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন।

উমা বলিল, আমি তবু বেশী জানি না, দু-চারটে শিখেছি কেবল। আমার দাদা খুব জানেন। রবীন্দ্রনাথ একেবারে কণ্ঠস্থ। আর ভারী সুন্দর আবৃত্তি করেন। আপনি তাঁকে দেখেন নি, না?

না, সে তো আসে নি, কেমন করে দেখব, বল?

দাঁড়ান, আসুন ফিরে পিসীমাকে নিয়ে। আমার পিসীমা কে জানেন তো?

তোমার পিসীমা! তুমি তো ইন্দ্রের মেয়ে। তোমার পিসীমা?

 হ্যা। অহিদার মা-ই যে আমাদের পিসীমা। হন তো পিসীমা, আমরা বলি।

ও ঠিক ঠিক, আমার মনে ছিল না।

আমার দাদাই তো তাঁকে নিয়ে সদরে গেছেন। আচ্ছা, পিসীমাকে কেন সাক্ষী মানলে, বলুন তো? কে কোথায় চরের ওপর দাঙ্গা করলে, উনি আর কি করবেন? ওই যে কে মজুমদার আছে, সে-ই খুব শয়তান লোক-ও-ই এ সব করছে। এ কি, আপনি এমন করছেন কেন? পিসেমশায়! পিসেমশায়!

রামেশ্বরের দৃষ্টি তখন বিস্ফারিত, সমস্ত শরীর থরথর করিয়া কম্পমান, দুই হাতের মুঠি দিয়া খাটের মাথাটা চাপিয়া ধরিয়া তিনি বলিলেন, একটু জল দিতে পার মা-একটু জল?

পরক্ষণেই তিনি দারুণ ক্রোধে জ্ঞান হারাইয়া মেঝের উপর পড়িয়া গেলেন। উমা ব্যস্ত বিব্রত হইয়া বারান্দায় ছুটিয়া গিয়া ডাকিল, মা! ও মা! পিসেমশায় যে পড়ে গেলেন মেঝেয় ওপর। অহিদা!

জ্ঞান হইলে রামেশ্বর হেমাঙ্গিনীর মুখের দিকে তিরস্কার-ভরা দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, আপনি আমায় মিথ্যে কথা বললেন রায়-গিন্নী?

হেমাঙ্গিনী কথাটা বুঝিতে পারিলেন না, রামেশ্বর নিজেই বলিলেন, মজুমদার সুনীতিকে দায়রা আদালতের কাঠগড়াতে দাঁড় করালে শেষ পর্যন্ত!

হেমাঙ্গিনী চমকিয়া উঠিলেন। তবু তিনি আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, না, কে বললে আপনাকে?

রামেশ্বর উমার দিকে চাহিলেন, উমার মুখ বিবর্ণ, পাংশু। তিনি চোখ দুইটি বন্ধ করিয়া যেন ভাবিয়া লইয়াই বলিলেন, এই দিকে নীচে কাছারির বারান্দায় কে বলেছিল, আমি শুনলাম।

হেমাঙ্গিনী স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। অহীন্দ্র পাখা দিয়া বাপের মাথায় বাতাস দিতেছিল, রামেশ্বর অকস্মাৎ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, দেখ তো অহি, আমার বন্দুকটা ঠিক আছে কিনা, দেখ তো।

অহীন্দ্র নীরবে বাতাস করিয়াই চলিল। রামেশ্বর আবার বলিলেন, দেখ অহি, দেখ।

 অহীন্দ্র মৃদুস্বরে বলিল, বন্দুক তো নেই।

কি হল? অকস্মাৎ যেন তাঁহার মনে পড়িয়া গেল। তিনি বলিলেন, মহী, মহী-হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক। জান তুমি অহি, মহী দ্বীপান্তর থেকে কবে ফিরবে, জান?

হেমাঙ্গিনী তাঁহাকে জোর করিয়া শোয়াইয়া দিয়া বলিলেন, একটু ঘুমোন দেখি আপনি। যা তো উমা, বাক্স থেকে ওডিকোলনের শিশিটা নিয়ে আয় তো।

শুশ্রূষায় রামেশ্বর শান্ত হইয়া ঘুমাইলেন। যখন উঠিলেন, তখন সুনীতি ফিরিয়াছেন।

সন্ধ্যা তখন উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। রামেশ্বর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুনীতির দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, তুমি রাধারাণী, না সুনীতি?

ঝরঝর-ধারার চোখের জলে সুনীতির মুখ ভাসিয়া গেল। রামেশ্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, তুমি সুনীতি, তুমি সুনীতি। সে এমন কাঁদত না, কাঁদতে জানত না।

অকস্মাৎ আবার বলিলেন, শোন শোন-খুব চুপি চুপি। জজ সাহেব কি আমার খোঁজ করছিলেন? আমাকে কি ধরে নিয়ে যাবেন?

সুনীতি কোন সান্তনা দিলেন না, কথায় কোন প্রতিবাদ পর্যন্ত করিলেন না, নীরবে জানলাটা খুলিয়া দিলেন।

আবছা অন্ধকারের মধ্যেও চরটা দেখা যায়। যাইবেই তো, চক্রান্তের চক্রবেগে সেটা এই বাড়িকেই বেষ্টন করিয়া ঘুরিতেছে।

.

১৭.

মামলার রায় বাহির হইল আরও আট মাস পর। দীর্ঘ দুই বৎসর ধরিয়া মকদ্দমা। দায়রা-আদালতের বিচারে দাঙ্গা ও নরহত্যার অপরাধে নবীন বাগদী ও তাহার সহচর দুইজন বাগদীর কঠিন সাজা হইয়া গেল। নবীনের প্রতি শাস্তিবিধান হইল ছয় বৎসর দ্বীপান্তর বাসের; আর তাহার সহচর দুইজনের প্রতি হইল দুই বৎসর করিয়া সশ্রম কারাবাসের আদেশ। দায়রা মকদ্দমা; সাক্ষীর সংখ্যা একশতের অধিক; তাহাদের বিবৃতি, জেরা এবং দীর্ঘ বিবৃতি ও জেরা বিশ্লেষণ করিয়া উভয় পক্ষের উকিলের সওয়াল-জবাবে শেষ হইতে দীর্ঘদিন লাগিয়া গেল। দাঙ্গা ঘটিবার দিন হইতে প্রায় দুই বৎসর।

রায় বাহির হইবার দিন গ্রামের অনেক লোকই সদরে গিয়া হাজির হইল। নবীন বাগদীর সংসারে উপযুক্ত পুরুষ কেহ ছিল না। তাহার উপযুক্ত পুত্র মারা গিয়েছে। থাকিবার মধ্যে আছে এক নাবালক পৌত্র, পুত্রবধু ও তাহার স্ত্রী মতি বাগদিনী। মতি নিজেই সেদিন পৌত্রকে কোলে করিয়া সদরে গিয়া হাজির হইল। রংলাল কিন্তু যাইতে পারিল না; অনেক দিন হইতেই সে গ্রামের বাহির হওয়া ছাড়িয়া দিয়াছে। অতি প্রয়োজনে বাহির যখন হয়, তখন সে মাথা হেঁট করিয়াই চলে; সদর-রাস্তা ছাড়িয়া জনবিরল পথ বাছিয়া চলে। আজ সে বাড়ির ভিতর দাওয়ার উপর গুম হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার স্ত্রী বলিল, হ্যাঁ গো, বলি সকালবেলা থেকে বসলে যে? আলুগুলো তুলে না ফেললে আর তুলবে কবে? কোন দিন জল হবে, হলে আলু আর একটিও থাকবে না, সব পচে যাবে।

রংলাল বলিল, হুঁ।

হুঁ তো বলছ, কিন্তু রইলে যে সেই বসেই রাজা-রুজিরের মত!–বলিয়া রংলালের স্ত্রী ঈষৎ না হাসিয়া পারিল না।

অকস্মাৎ রংলাল অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বলিয়া উঠিল, ভগমান! এত লোক মরছে, আমার মরণ হয় না কেনে, বল দেখি? সংসারের কচকচি আর আমি সইতে লারছি।–বলিতে বলিতে সে ঝরঝর কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার স্ত্রী অবাক হইয়া গেল, সে কি যে বলিবে, খুঁজিয়া পর্যন্ত পাইল না; বুঝিতেও সে পারিল না, অকস্মাৎ সংসার কোন যন্ত্রণায় এমন করিয়া রংলালকে অধীর করিয়া তুলিল। দুঃখ অভিমানে তাহারও চোখ ফাটিয়া জল আসিতেছিল।

রংলাল কপালের রগ দুইটা আঙুল দিয়া চাপিয়া ধরিয়া বলিল, মাথা আমার খসে গেল। আমি আজ খাব না কিছু।–বলিয়া সে ঘরে গিয়া উপুর হইয়া মেঝের উপুড় শুইয়া পড়িল।

আরও একজন অধীর উৎকণ্ঠায় উদ্বেগে ও অসহ্য মনঃপীড়ায় পীড়িত হইতেছিলেন। অতি কোমল হৃদয়ের স্বভাবধর্ম-অতি মমতায়, সুনীতি এখন হইতেই নবীন ও তাহার সহচর কয়জনের জন্য গভীর বেদনা অনুভব করিতেছিলেন। উৎকণ্ঠায় উদ্বেগে তাঁহার দেহমন যেন সকল শক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছে। উনানে একটা তরকারী চড়াইয়া সুনীতি ভাবিতেছিলেন ওই কথাই। সোরগোল তুলিয়া মানদা আসিয়া বলিল, পোড়া পোড়া গন্ধ উঠছে যে গো! আপনি বসে এইখানে, আর তরকারী পুড়ছে। আমি বলি, মা বুঝি ওপরে গিয়েছেন। নামান, নামান, নামান।

এতক্ষণে সচকিত হইয়া সুনীতি গন্ধের কটুত্ব অনুভব করিয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। চারিপাশে চাকিয়া দেখিয়া বলিলেন, ওই যা, সাঁড়াশিটা আবার আনি নি। আন তো মানদা।

মানদা অল্প বিরক্ত হইয়াই বলিল, ওই যে সাঁড়াশি-ওই যে গো বাঁ হাতের নীচেই যে গো।

সুনীতি এবার দেখিতে পাইলেন, সাঁড়াশিটার উপরেই বাঁ হাত রাখিয়া তিনি বসিয়া আছেন। তাড়াতাড়ি তিনি কড়াটা নামাইয়া ফেলিলেন, কিন্তু হাতেও যেন কেমন সহজ শক্তি নাই, হাতখানা থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। মানদার সতর্ক দৃষ্টিতে সেটুকু এড়াইয়া গেল না, সে এবার উৎকণ্ঠিত হইয়া বলিয়া উঠিল, কর্তাবাবু আজ কেমন আছেন মা?

ম্লান হাসিয়া সুনীতি বলিলেন, তেমনিই আছেন।

বাড়ে নাই তো কিছু, তাই জিজ্ঞাসা করছি।

না। কদিন থেকে বরং একটু শান্ত হয়েই আছেন।

তবে?-মানদা আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিল।

সুনীতিও এবার বিস্ময়ের সহিত বলিলেন, কি রে? কি বলছিস তুই?

 মানদা বলিল, এমন মাটির পিতিমের মত বসে রয়েছেন যে?

গভীর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সুনীতি বলিলেন, নবীনদের মামলায় আজ রায় বেরুবে মানদা। কি হবে বল তো ওদের? যদি সাজা হয়ে যায়-! আর তিনি বলিতে পারিলেন না, তাঁহার রক্তাভ পাতলা ঠোঁট দুইটি বিবর্ণ হইয়া থরথর করিয়া কাঁপিতে আরম্ভ করিল, কোমল দৃষ্টিতে চোখ দুইটি জলে ভাসিয়া বেদনায় যুগ্ম-সায়রের মত টলমল করিয়া উঠিল।

মানদাও একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস না ফেলিয়া পারিল না। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সে বলিল, সে আর আপনি-আমি কি করব বলুন? মানুষের আপন আপন অদেষ্ট; অদেষ্টর লেখন কি কেউ মুছতে পারে মা?

অসহায় মানুষের মামুলী সান্তনা ছাড়া আর মানদা খুঁজিয়া কিছু পাইল না; কিন্তু সুনীতির হৃদয়ের পরম অকৃত্রিম মমতা চিরদিনের মতই আজও তাহাতে প্রবোধ মানিল না। জলভরা চোখে উদাস দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে তিনি বলিলেন, মানুষ মরে যায়, বুঝতে পারি মানদা-তাতে মানুষের হাত নেই। কিন্তু এ কি দুঃখ বল তো? এক টুকরো জমির জন্যে মানুষে মানুষে খুন করে ফেললে, আর তারই জন্যে, যে খুন করলে তাকে রেখে দেবে খাঁচায় পুরে জানোয়ারের মত, কিম্বা হয়তো গলায় ফাঁসি লটকে-! কথা আর শেষ হইল না, চোখের জলের সমুদ্র সর্বহৃদয়ব্যাপী প্রগাঢ় বেদনায় অমাবস্যা-স্পর্শে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল-হু হু করিয়া চোখের জল ঝরিয়া মুখ-বুক ভাসাইয়া দিল।

মানদার চোখও শুষ্ক রহিল না, তাহারও চোখের কোণ ভিজিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, সে আক্রোশভরা কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, তুমি ভেবো না মা, ভগবান এর বিচার করবেনই করবেন। গায়ে আগুন লাগবে, নিব্বংশ হবে

বাধা দিয়া সুনীতি বলিলেন, না না মানদা, শাপ-শাপান্ত করিস নে মা। কত বার তোকে বারণ করেছি, বল তো?

মানদা এবার সুনীতির উপরেই রুষ্ট হইয়া উঠিল; সুনীতির এই কোমলতা সে কোনমতেই সহ্য করিতে পারে না। ক্রোধ নাই, আক্রোশ নাই, এ কি ধারার মানুষ। সে রুষ্ট হইয়াই সে স্থান হইতে অন্যত্র সরিয়া গেল।

সুনীতি বেদনাহত অন্তরেই আবার রান্নার কাজে ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। রামেশ্বরের স্নান-আহারের সময় হইয়া আসিয়াছে। সেই ঘটনার পর হইতে রামেশ্বর আরও স্তব্ধ হইয়া গিয়াছেন; পূর্বে আপন মনেই অন্ধকার ঘরে কাব্য আবৃত্তি করিতেন, ঘরের মধ্যে পায়চারিও করিতেন, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই স্তব্ধ হইয়া ওই খাটখানির উপর বসিয়া থাকেন, আর প্রদীপের আলোয় হাতের আঙুলগুলি ঘুরাইয়া দেখেন। কখনও কখনও সুনীতির সহিত কথার আনন্দের মধ্যে খাট হইতে নামিতে চাহেন, সুনীতি হাত ধরিয়া নামিতে সাহায্য করেন। অন্ধকার রাত্রে জানালার ধারে দাঁড়াইয়া অতি সন্তর্পণে মুক্ত পৃথিবীর সহিত অতি গোপন এবং ক্ষীণ একটি যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেন। আপনার দুর্ভাগ্যের কথা মনে করিয়া সুনীতি ম্লান হাসি হাসেন, তখন চোখে তাঁহার জল আসে না।

পিতলের ছোট একটা হাঁড়িতে মুঠাখানেক সুগন্ধি চাল চড়াইয়া দিয়া স্বামীর স্নানের উদ্যোগ করিতে সুনীতি উঠিয়া পড়িলেন। এই বিশেষ চালটি ছাড়া অন্য চাল রামেশ্বর খাইতে পারেন না।

অপরাহ্নের দিকে সুনীতির মনের উদ্বেগ ক্রমশ যেন বাড়িয়াই চলিয়াছিল; সংবাদ পাইবার জন্য তাঁহার মন অস্থির হইয়া উঠিল। অন্য দিন খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি স্বামীর নিকট বসিয়া গল্পগুজবে তাঁহার অস্বাভাবিক জীবনের মধ্যে সাময়িকভাবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনিবার চেষ্টা করেন; কোন কোন দিন রামায়ণ বা মহাভারত পড়িয়া শুনাইয়া থাকেন। আজ কিন্তু আর সেখানেও স্থির হইয়া বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। আজ তিনি বই লইয়াই বসিয়া ছিলেন, কিন্তু পাঠের মধ্যে পাঠকের অন্তরে যে তন্ময়যোগ থাকিলে শ্রোতার অন্তরকেও তন্ময়তায় বিভোর করিয়া আকর্ষণ করা যায়, আপন অন্তরের সেই তন্ময়যোগটিকে তিনি আজ আর কোনমতেই স্থাপন করিতে পারিলেন না।

একটা ছেদের মুখে আসিয়া সুনীতি থামিতেই রামেশ্বর বলিলেন, তুমি যদি সংস্কৃতটা শিখতে সুনীতি, তোমার মুখে মূল মহাকাব্য শুনতে পেতাম। অনুবাদ কিনা, এতে কাব্যের আনন্দটা পাওয়া যায় না।

সুনীতি অপরাধিনীর মত স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, আজ তা হলে এই পর্যন্তই থাক।

রামেশ্বর অভ্যাসমত মৃদুস্বরে বলিলেন, থাক। তারপর মাটির পুতুলের মত নিস্পলক দৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া রহিলেন। সুনীতি একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। রামেশ্বর সহসা বলিলেন, অহীন-অহীন কোথায় পড়ে, বল তো?

বহরমপুর মুরশিদাবাদে। এই যে কাল তুমি মুরশিদাবাদের গল্প করলে, বললে অহীন খুব ভাল জায়গায় আছে; আমাদের দেশের ইতিহাস মুরশিদাবাদ না দেখলে জানাই হয় না!

হ্যাঁ হ্যাঁ। রামেশ্বরের এবার মনে পড়িয়া গেল। সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। জান সুনীতি, এই

বল।

এই, মানুষের সকলের চেয়ে বড় অপরাধ হল মানুষকে হত্যা করার অপরাধ। এ অপরাধ কখনও ভগবান ক্ষমা করবেন না। মুরশিদাবাদের চারিদিকে সেই অপরাধের চিহ্ন। আর সেই হল তার পতনের কারণ। উঃ, ফৈজীকে নবাব দেওয়াল গেঁথে মেরেছিল। একটা ছোট অন্ধকূপের মত ঘরে পুরে দরজাটা তার গেঁথে দিয়েছিল। কী করেই ফৈজীকে মেরেছিল-উঃ! রামেশ্বর চঞ্চল হইয়া উঠিলেন- হে ভগবান! হে ভগবান!

সুনীতির চোখ সজল হইয়া উঠিল, নীরবে নতমুখে বসিয়া থাকার সুযোগে সে-জল চোখ হইতে মেঝের উপর ঝরিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। তাঁহার মনে পড়িতেছিল-ননী পালকে, হতভাগ্য হীন-তাঁহার মহীনকে, চরের দাঙ্গায় নিহত সেই অজানা অচেনা হতভাগ্যকে, হতভাগ্য মহীন ও তাহার সহচর কয়েকজনকে। তিনি গোপনে চোখ মুছিয়া ঘরের বাহিরে যাইবার জন্য উঠিলেন; একবার মানদাকে পাঠাইবেন সংবাদের জন্য।

রামেশ্বর ডাকিলেন, সুনীতি! কণ্ঠস্বর শুনিয়া সুনীতি চমকাইয়া উঠিলেন; রামেশ্বরের কণ্ঠস্বর বড় ম্লান, কাতরতার প্রকাশ তাহাতে সুস্পষ্ট।

সুনীতি উদ্বিগ্ন হইয়া ফিরিলেন, কি বলছ?

রামেশ্বর কাতর দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, দেখ। আমার-আমার শরীরটা-দেখ, আমাকে একটু শুইয়ে দেবে?

সযত্নে স্বামীকে শোয়াইয়া দিয়া সুনীতি উৎকণ্ঠিত চিত্তে বলিলেন, শরীর কি খারাপ বোধ হচ্ছে?

সে কথার জবাব না দিয়া রামেশ্বর বলিলেন, আমার গায়ে একখানা পাতলা চাদর টেনে দাও তো, আর ওই আলোটা, ওটাকে সরিয়ে দাও। বলিতে বলিতেই তিনি উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছিলেন, ঈষৎ উত্তেজিত সরেই এবার তিরস্কার করিয়া বলিলেন, তুমি জান আমার চোখে আলোর মধ্যে যন্ত্রণা হয়, তবু ওটা জ্বালিয়ে রাখবে দপদপ করে।

প্রতিবাদে ফল নাই, সুনীতি তাহা ভাল করিয়াই জানেন; তিনি নীরবে আলোটা কোণের দিকে সরাইয়া দিলেন, পাতলা একখানি চাদরে স্বামীর সর্বাঙ্গ ঢাকিয়া দিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। তাঁহার মন বার বার বাহিরের দিকে ছুটিয়া যাইতে চাহিতেছিল। ঘর হইতে বাহির হইয়া বারান্দায় দাঁড়াইয়া ডাকিলেন, মানদা!

মানদা দিবানিদ্রা শেষ করিয়া উঠোন ঝাঁট দিতেছিল, সে বলিল, কি মা?

একবার একটা কাজ করবি মা?

বলুন।

একবার পাড়ায় একটু বেরিয়ে জেনে আয় না মা, সদর থেকে খবর-টবর কিছু এসেছে কি না।

মানদা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, এর মধ্যে কোথায় কে ফিরবে গো, আর ফিরবেই বা কেমন করে? ফিরতে সেই রাত আটটা-নটা।

সে-কথা সুনীতি নিজেও জানেন, তবুও বলিলেন, ওরে বার্তা আসে বাতাসের আগে। লোক কেউ না আসুক, খবর হয়তো এসেছে, দেখ না একবার। মায়ের কথা শুনলে তো পুণ্যিই হয়।

 ঝাঁটাটা সেখানেই ফেলিয়া দিয়া মানদা বিরক্তিভরেই বাহির হইয়া গেল। সুনীতি স্তব্ধ হইয়া বারান্দায় দাঁড়াইয়া রহিলেন। সহসা তাঁহার মনে হইল, বাগদীপাড়ায় যদি কেহ কাঁদে, তবে সে কান্না তো ছাদের উপর হইতে শোনা যাইবে! কম্পিতপদে তিনি ছাদে উঠিয়া শূণ্য দৃষ্টিতে উৎকর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি স্বস্তির একটা গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন, নাঃ, কেহ কাঁদে না। এতক্ষণে তাঁহার দৃষ্টি সজাগ হইয়া উঠিল। আপনাদের কাছারির সম্মুখে খামার বাড়ির দিকেই তিনি তাকাইয়াছিলেন; একটা লোক ধানের গোলার কাছে দাঁড়াইয়া কি করিতেছে! লোকটা তাঁহাদেরই গরুর মাহিন্দার; ভাল করিয়া দেখিয়া বুঝিলেন, খড়ের পাকানো মোটা ‘বড়’ দিয়া তৈয়ারি মরাইটার ভিতর একটা লাঠি গুঁজিয়া ছিদ্র করিয়া ধান চুরি করিতেছে। তিনি লজ্জিত হইয়া পড়িলেন, উপরে চোখ তুলিলেই সে তাঁহাকে দেখিতে পাইবে। অতি সন্তর্পণে সেদিক হইতে সরিয়া ছাদের ও-পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন। গ্রামের ভাঙা তটভূমির কোলে কালীর বালুময় বুক চৈত্রের অপরাহ্নে উদাস হইয়া উঠিয়াছে। কালীর ও-পারে চর, সর্বনাশা চর! কিন্তু চরখানি আজ তাঁহার চোখ জুড়াইয়া দিল। চৈত্রের প্রারম্ভে কচি কচি বেনাঘাসের পাতা বাহির হইয়া চরটাকে যেন সবুজ মখমলের মত মুড়িয়া দিয়াছে। হালকা সবুজের মধ্যে সাঁওতালদের পল্লীটির গোবরে-মাটিতে নিকানো, খড়িমাটির আলপনা দেওয়া ঘরগুলি যেন ছবির মত সুন্দর। উঃ, পল্লীটি ইহার মধ্যে কত বড় হইয়া উঠিয়াছে! সম্পূর্ণ একখানি গ্রাম। পল্লীর মধ্য দিয়া বেশ একটি সুন্দর পথ; সবুজের মধ্যে শুভ্র একটি আঁকা-বাঁকা রেখা, নদীর কূল হইতে সাঁওতাল পল্লী পার হইয়া প্রান্তরের মধ্য দিয়া ও-পারের গ্রামের ঘর বনরেখার মধ্যে মিশিয়া গিয়াছে। সাঁওতালদের পল্লীর আশেপাশে কতকগুলি কিশোর গাছে নূতন পাতা দেখা দিয়াছে। চোখ যেন তাহার জুড়াইয়া গেল। তবুও তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস না ফেলিয়া পারিলেন না। এমন সুন্দর চর, এমন কোমল-এখান হইতেই সে কোমলতা তিনি যেন অনুভব করিতেছেন-তাহাকে লইয়া এমন হানাহানি কেন করে মানুষ? আর, কোথায়-চরটায় কোন্ অন্তস্তলে লুকাইয়া আছে এমন সর্বনাশা চক্রান্ত?

নীচ হইতে মানদা ডাকিতেছিল, সুনীতি ত্রস্ত হইয়া দোতালার বারান্দায় নামিয়া আসিলেন। নীচের উঠান হইতে মানদা বলিল, এক-এক সময় আপনি ছেলেমানুষের মত অবুঝ হয়ে পড়েন মা। বললাম, রাত আটটা-নটার আগে কেউ ফিরবে না আর না ফিরলে খবর আসবে না। টেলিগিরাপ তো নাই মা আপনার শ্বশুরের গাঁয়ে যে, তারে তারে খবর আসবে!

সুনীতি!-ঘরের ভিতর হইতে রামেশ্বর ডাকিতেছিলেন। শান্ত মনেই সুনীতি ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, রামেশ্বর বালিসে ঠেস দিয়া অর্ধশায়িতের মত বসিয়া আছেন, সুনীতিকে দেখিয়া স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠেই বলিলেন, অহীনকে লিখে দাও তো, রবীন্দ্রনাথ বলে যে বাংলা ভাষার কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থ যেন সে নিয়ে আসে। তা হলে তুমি পড়বে, তাতে কাব্যের রস পুরোটাই পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, আর যদি কাদম্বরীর অনুবাদ থাকে, বুঝলে?

সংবাদ যথাসময়ে আসিল এবং শ্রীবাস ও মজুমদারের কল্যানে উচ্চরবেই তাহা তৎক্ষণাৎ রীতিমত ঘোষিত হইয়া প্রচারিত হইয়া গেল। সেই রাত্রেই সর্বরক্ষা-দেবীর স্থানে পূজা দিবার অছিলায় গ্রামের পথে পথে তাহারা ঢাক ঢোল লইয়া বাহির হইল। ইন্দ্র রায়ের কাছারিতে রায় গম্ভীর মুখে দাঁড়াইয়া ছিলেন। তাঁহার কাছারির সম্মুখে শোভাযাত্রাটি আসিবামাত্র তিনি হাসিমুখে অগ্রসর হইয়া আসিয়া পথের উপরেই দাঁড়াইলেন।

শোভাযাত্রাটির গতি স্তব্ধ হইয়া গেল।

রায় বলিলেন, এ আমি জানতাম মজুমদার! তারপর, নবেনটাকে দিলে লটকে?

মজুমদার বিনীত হাসি হাসিয়া বলিল, আজ্ঞে না, নবীনের ছ বছর দ্বীপান্তর হল, আর দুজনের দু বছর করে জেল।

রায় হাসিয়া বলিলেন, তবে আর করলে কি হে? এস এস একবার ভেতরেই এস, শুনি বিবরণ; কই শ্রীবাস কই? এস পাল, এস।

কৃত্রিম শ্রদ্ধার সমাদরের আহ্বানে শ্রীবাস ও মজুমদার উভয়েই শুকাইয়া গেল। সভয়ে মজুমদার বলিল, আজ্ঞে, আজ মাপ করুন, পুজো দিতে যাচ্ছি।

ঢাক বাজিয়ে পুজা দিতে যাচ্ছ, কিন্তু বলি কই হে? চরে বলি হয়ে গেল, আর মা সৰ্বরক্ষার ওখানে বলি দেবে না? মায়ের জিভ যে লকলক করছে, আমি দিব্যচক্ষে দেখছি।

মজুমদার ও শ্রীবাসের মুখ মুহর্তে বিবর্ণ হইয়া গেল। সমস্ত বাজনাদার ও অনুচরের দল সভয়ে শ্বাসরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। রায় আর দাঁড়াইলেন না, তিনি আবার একবার মৃদু হাসিয়া ছোট একটি ‘আচ্ছা’ বলিয়া কাছারির ফটকের মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

কিছুক্ষণ পর স্তব্ধ শ্রীবাস ও যোগেশ মজুমদার অনুভব করিল, আলো যেন কমিয়া আসিতেছে। পিছনে ফিরিয়া মজুমদার দেখিল, শ্রীবাসের হাতের আলোটি ছাড়া আর একটিও আলো নাই, বাজনদার অনুচর সকলেই কখন নিঃশব্দে চলিয়া গিয়াছে।

ওদিকে চক্রবর্তী-বাড়িতে সুনীতি স্তব্ধ হইয়া দাওয়ার উপর বসিয়াছিলেন, চোখ দিয়া জল ঝরিতেছিল অন্ধকারের আবরণের মধ্যে। তাঁহার সম্মুখে নাতিকে কোলে করিয়া দাঁড়াইয়া নবীনের স্ত্রী। সেও নিঃশব্দে কাঁদিতেছিল। বহুক্ষণ পরে সে বলিল, সদরে সব বললে হাইকোর্টে দরখাস্ত দিতে।

সুনীতি কোনমতে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, দরখাস্ত নয়, আপীল।

খালাস যদি না হয় রাণীমা, তবে আপনকারা ছাড়া আমরা তো কাউকে জানি না।

কিন্তু খরচ যে অনেক মা; সে কি তোরা যোগাড় করতে পারবি?

নবীনের স্ত্রী চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সুনীতি খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, তাও পরামর্শ করে দেখব বাগদী-বউ; অহীন আসুক, আর পাঁচ-সাত দিনেই তার পরীক্ষা শেষ হবে, হলেই সে আসবে

মতি বাগদিনী ভূমিষ্ট হইয়া প্রণাম করিয়া বলিল, আপনকারা তাকে কাজে জবাব দিয়েছিলেন; কিন্তু আমাকে যে আপুনি না রাখলে কেউ রাখবার নাই রাণীমা।

***

অহীন্দ্র বাড়ি আসিতেই সুনীতি তাহাকে ইন্দ্র রায়ের নিকট পাঠাইলেন। মনে গোপন সঙ্কল্প ছিল, চল্লিশ পঞ্চাশ টাকায় হইলে আপনার অবশিষ্ট অলঙ্কার হইতেও কিছু বিক্রয় করিয়া খরচ সংস্থান করিয়া দিবেন। কিন্তু রায় নিষেধ করিলেন, বলিলেন, খরচ অনেক, শতকের মধ্যেও কুলোবে না বাবা। তা ছাড়া, অকস্মাৎ তিনি হাসিয়া বলিলেন, তোমরা আজকালকার, কি বলে, ইয়ংমেন, তোমরা ভাববে, আমরা প্রাচীন কালের দানব সব; কিন্তু আমরা বলি কি, জান? ছ বছর জেল খাটতে নবীনের মত লাঠিয়ালের কোন কষ্টই হবে না। বংশানুক্রমে ওদের এ-সব অভ্যাস আছে।

অহীন্দ্র চুপ করিয়া রহিল। রায় হাসিয়া বলিলেন, তুমি তো চুপ করে রইলে। কিন্তু অমল হলে একচোট বক্তৃতাই দিয়ে দিত আমাকে। এখন একজামিন কেমন দিলে, বল?

এবার স্মিতমুখে অহীন্দ্র বলিল, ভালই দিয়েছি আপনার আশীর্বাদে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া রায় বলিলেন, আশীর্বাদ তোমাকে বার বার করি অহীন্দ্র। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়

অহীন্দ্র কথাটা সমাপ্তির জন্য প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। রায় বলিলেন, তোমার বাবাকে এবার কেমন দেখলে বলো তো?

ম্লান কণ্ঠে অহীন্দ্র বলিল, আমি তো দেখছি, মাথার গোলমাল বেড়েছে।

রায় কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, যাও, বাড়ির ভেতর যাও, তোমার- মানে, অমলের মা এরই মধ্যে চার-পাঁচ দিন তোমার নাম করেছেন।

অহীন্দ্রকে বাড়ির মধ্যে দেখিয়া হেমাঙ্গিনী আনন্দে যেন অধীর হইয়া উঠিলেন। অহীন্দ্র প্রণাম করিতেই উজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করিলেন, পরীক্ষা কেমন দিলে বাবা?

ভালই দিয়েছি মামীমা, আপনার আশীর্বাদে।

 অমল কি লিখেছে জান? সে লিখেছে অহীনের এবার ফার্স্ট হওয়া উচিত।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, সে আমাকেও লিখেছে। সে তো এবার ছুটিতে আসছে না লিখেছে।

না। সে এক ধন্যি ছেলে হয়েছে বাবা। তাদের কলেজের ছেলেরা দল বেঁধে কোথায় বেড়াতে যাবে, তিনি সেই হুজুগে মেতেছেন। তার জন্য উমার এবার আসা হল না।

.

কিন্তু অকস্মাৎ একদিন অমল আসিয়া হাজির হইল। আষাঢ়ের প্রথমেই ঘনঘটাচ্ছন্ন মেঘ করিয়া বর্ষা নামিয়াছিল, সেই বর্ষা মাথায় করিয়া গভীর রাত্রে স্টেশন হইতে গরুর গাড়ি করিয়া একেবারে অহীন্দ্রদের দরজায় আসিয়া সে ডাক দিল, অহীন! অহীন!

ঝড় ও বর্ষণের সেদিন সে এক অদ্ভুত গোঙানি! সন্ধ্যার পর হইতেই এই গোঙানিটা শোনা যাইতেছে। অহীন্দ্র ঘুম ভাঙিয়া কান পাতিয়া শুনিল, সত্যই কে তাহাকে ডাকিতেছে!

সে জানলা খুলিয়া প্রশ্ন করিল, কে?

 আমি অমল। ভিজে মরে গেলাম, আর তুমি বেশ আরামে ঘুমোচ্ছ? বাঃ, বেশ!

তাড়াতাড়ি দরজা খুলিয়া সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, তুমি এমনভাবে?

অমল অহীন্দ্রের হাতে ঝাঁকুনি দিয়া বলিল, কনগ্রাচুলেশন্স! তুমি ফোর্থ হয়েছ।

অহীন্দ্র সর্বাঙ্গসিক্ত অমলকে আনন্দে কৃতজ্ঞতায় বুকে জড়াইয়া ধরিল। শব্দ শুনিয়া সুনীতি উঠিয়া বাহিরে আসিলেন, সমস্ত শুনিয়া নির্বাক হইয়া তিনি দাঁড়াইয়া রহিলেন। চোখ তাঁহার জলে ভরিয়া উঠিয়াছে। চোখ যেন তাঁহার সমুদ্র, আনন্দের পুর্ণিমায়, বেদনার আমবস্যায় সমানই উথলিয়া উঠে।

অহীন্দ্র বলিল, অমলকে খেতে দাও মা।

সুনীতি ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। কিন্তু অমল বলিল, না পিসীমা, স্টেশনে এক পেট খেয়েছি। এখন যদি আবার খাওয়ান তবে সেটা সাজা দেওয়া হবে। বরং চা এক পেয়ালা করে দিন। আয় অহীন, আলোটা আন তো, ব্যাগ থেকে কাপড়-জামা বের করে পালটে ফেলি। বাড়ি আর যাব না রাত্রে, কাল সকালে যাব।

চা করিয়া খাওয়াইয়া অহীন্দ্র ও অমলকে শোয়াইয়া আনন্দ-অধীর চিত্তে সুনীতি স্বামীর ঘরে প্রবেশ করিলেন। রামেশ্বর খোলা জানলায় দাঁড়াইয়া বাহিরের দুর্যোগের দিকে চাহিলেন, ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিতেছে, কিন্তু সে তীব্র আলোকের মধ্যেও নিস্পলক দৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন। বিদ্যুৎ-চমকের আলোকে সুনীতি দেখিলেন, গ্রামের প্রান্তে প্রান্তে কালীর বুক জুড়িয়া বিপুলবিস্তার একখানা সাদা চাদর কে যেন বিছাইয়া দিয়াছে। ঝড় ও বর্ষণের মধ্যে যে অদ্ভুত গোঙানি শোনা যাইতেছে, সেটা ঝড়ের নয়, বর্ষণের নয়, কালীর ক্রুদ্ধ গর্জন। কালীর বুকে বন্যা আসিয়াছে।

.

১৮.

আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহে আবার কালীন্দির বুকে বান আসিয়া পড়িল।

এক দিকে রায়হাট, অন্য দিকে সাঁওতালদের ‘রাঙাঠাকুরের চর’-এই উভয়ের মাঝে রাঙা জলের ফেনিল আবর্ত ফুলিয়া ফুলিয়া খরস্রোতে ছুটিয়া চলিয়াছে। আবর্তের মধ্যে কলকল শব্দ শুনিয়া মনে হয়, সত্য সত্যই কালী যেন খলখল করিয়া হাসিতেছে কালী এবার ভয়ঙ্করী হইয়া উঠিয়াছে।

গত কয়েক বৎসর কালীন্দির বন্যা তেমন প্রবল কিছু হয় নাই,এবার আষাঢ়ের প্রথমেই ভীষণ বন্যায় কালী ফাঁপিয়া ফুলিয়া রাক্ষসীর মত হইয়া উঠিল। বর্ষাও নামিয়াছে এবার আষাঢ়ের প্রথমেই। জৈষ্ঠ-সংক্রান্তির দিনই আকাশে ভ্রাম্যমাণ মেঘপুঞ্জ ঘোরঘটা করিয়া আকাশ জুড়িয়া বসিল। বর্ষণ আরম্ভ হইল অপরাহ্ন হইতেই। পরদিন সকাল-অর্থাৎ পয়লা আষাঢ়ের প্রাতঃকালে দেখা গেল, মাঠঘাট জলে থৈ-থৈ করিতেছে। ধান চাষের ‘কাড়ান’ লাগিয়া গিয়াছে। ইহাতেই কিন্তু মেঘ ক্ষান্ত হইল না, তিন-চার দিন ধরিয়া প্রায় বিরামহীন বর্ষণ করিয়া গেল। কখনও প্রবল ধারায়, কখনও রিমিঝিমি, কখনও মৃদু ফিনকির মত বৃষ্টির ধারাগুলি বাতাসের বেগে কুয়াশার বিন্দুর মত ভাসিয়া যাইতেছিল। অনেককালের লোকও বলিল, এমন সৃষ্টিছাড়া বর্ষা তাহারা জীবনে দেখে নাই। এ বর্ষাটির না আছে সময়জ্ঞান, না আছে মাত্ৰাজ্ঞান।

দেখিতে দেখিতে কালীর বুকেও বন্যা আসিয়া গেল দুর্দান্ত ঝড়ো হাওয়ার মত। এবেলা ওবেলা বান বাড়িতে বাড়িতে রায়হাটের তালগাছপ্রমাণ উঁচু, ভাঙা কূলের কানায় কানায় হইয়া উঠিল; ভাঙা তটের কোলে কোলে কালির লাল জল সূর্যের আলোয় রক্তাক্ত ছুরির মত ঝিলিক হানিয়া তীরের গতিতে ছুটিয়া চলিয়াছে। মধ্যে মধ্যে খানিকটা করিয়া রায়হাটের কূল কাটিয়া ঝুপঝুপ শব্দে খসিয়া পড়িতেছে।

রায়হাটের চাষীরা বলে, কালী জিভ চাটছে রাক্ষসীর মত, ভাগ্যে আমাদের কাঁকুড়ে মাটি!

সত্য কথা। রায়হাটের ভাগ্য ভাল যে, রায়হাটের বুক সাঁওতাল পরগণার মত কঠিন রাঙা মাটি ও কাঁকড় দিয়ে গড়া। নরম পলিমাটিতে গঠিত হইলে কালীর শাণিত জিহ্বার লেহনে কোমল মাটির তটভূমি হইতে বিস্তৃত ধস, কোমল দেহের মাংসপিণ্ডের মত খসিয়া পড়িত। রায়হাট ইহারই মধ্যে কঙ্কালসার হইয়া উঠিত। দুই-তিন বৎসরে কালী মাত্র হাত-পাঁচেক পরিমিত কূল রায়হাটের কোলে কোলে খসাইয়াছে। এবার কিন্তু বন্যাতেই ইহার মধ্যে হাত দুয়েক খাইয়া ফেলিয়াছে, এখনও পূর্ণ ক্ষুধায় লেহন করিয়া চলিয়াছে। ওপারে চরটাও এবার প্রায় চারদিক বন্যায় ডুবিয়া ছোট একটি দ্বীপের মত কোনমতে জাগিয়া আছে। চরের উপরেই এখন কালীনদীর ও-পারের খেয়ার ঘাট, ঘাট হইতে একটা কাঁচা পথ চলিয়া গিয়াছে চরের ও-দিকের গ্রাম পর্যন্ত। সেই পথটা মাত্র ও-দিকে একটা যোজকের মত জাগিয়া আছে।

চরের ওপর শ্রীবাস পাল যে দোকানটা করিয়াছে, সেই দোকানের দাওয়ায় সাঁওতালদের কয়েকজন মাতব্বর বসিয়া অলস দৃষ্টিতে এই দুর্যোগের আকাশের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল। কমল মাঝি, সেই রহস্যপ্রবণ কাঠের মিস্ত্রী চূড়াও বসিয়া আছে। আরও জন দুয়েক নীরবে ‘চুটি’ টানিতেছিল। শালপাতা জড়ানো কড়া তামাকের বিড়ি উহারা নিজেরাই তৈয়ারি করে, তাহার নাম ‘চুটি’। কড়া তামাকের কটু গন্ধে জলসিক্ত ভারী বাতাস আরও ভারী হইয়া উঠিয়াছে। মধ্যে মধ্যে দুই চারিজন রাহী খেয়াঘাটে যাইতেছে বা খেয়াঘাট হইতে আসিতেছে।

দোকানের তক্তপোশের উপর শ্রীবাস নিজে একখানা খাতা খুলিয়া গম্ভীরভাবে বসিয়া আছে। ও-পাশে শ্রীবাসের ছোট ছেলে একখানা চাটাই বিছাইয়া দোকান পাতিয়া বসিয়াছে, তাহার কোলের কাছে একটা কাঠের বাক্স, একপাশে একটা তরাজু, ওজনের বাটখারাগুলি-সেরের উপর আধসের, তাহার উপর একপোয়া-এমনি ভাবে আধ-ছটাকটি চূড়ায় রাখিয়া মন্দিরের আকারে সাজাইয়া রাখিয়াছে। সহসা এই নীরবতা ভঙ্গ করিয়া শ্রীবাস বলিল, কি রে, সবাই যে তোরা থম্ভ মেরে গেলি! কি বলছিস বল, আমার কথার জবাব দে!

কমল নির্লিপ্তের মত উত্তর দিল, কি বুলব গো? আপুনি যি যা-তা বুলছিস!

শ্রীবাসের কপাল একেবারে প্রশস্ত টাকের প্রান্তদেশ পর্যন্ত কুচকাইয়া উঠিল; বিস্ময়ের সুরে বলিয়া উঠিল, আমি যা-তা বলছি! আপনার পাওনাগণ্ডা চাইলেই সংসারে যা-তা বলাই হয় যে, তার আর তোদের দোষ কি, বল্?

সাঁওতালদের কেহ কোন উত্তর দিল না, শ্রীবাসই আবার বলিল, বাকি তো এক বছরের নয়, বাকি ধর গা যেঁয়ে-তোর তিন বছরের। যে বছর দাঙ্গা হল সেই বছর থেকে তোরা ধান নিতে লেগেছিস। দেখ কেনে হিসেব করে। দাঙ্গা হল, মামলা হল, মামলাই চলেছে দু বছর, তারপর লবীনের ধর গা যেঁয়ে-এক বছর করে জেল খাটা হয়ে গেল। বটে কি না?

কমল সে কথা অস্বীকার করিল না, বলিল, হুঁ, সি তো বটে গো-ধান তো তিনটে হল, ইবার তুর চারটে হবে।

তবে?

মাঝি এ ‘তবে’র উত্তর খুঁজিয়া পাইল না। আবার চুপ করিয়া ভাবিতে বসিল। সাঁওতালদের সহিত শ্রীবাসের একটা গোল বাঁধিয়া উঠিয়াছে। দাঙ্গার বৎসর হইতে শ্রীবাস সাঁওতালদের ধান্য-ঋণ দাদন আরম্ভ করিয়াছে। বর্ষার সময় যখন তাহারা জমিতে চাষের কাজে লিপ্ত থাকে, তখন তাহাদের দিনমজুরির উপার্জন থাকে না। সেই সময় তাহারা স্থানীয় ধানের মহাজনের নিকট সুদে ধান লইয়া থাকে এবং মাঘ-ফাল্গুনে ধান মাড়াই করিয়া সুদে আসলে ঋণ শোধ দিয়া আসে। এবার অকস্মাৎ এই বর্ষা নামিয়া পড়ায় ইহারই মধ্যে সাঁওতালদের অনটন আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। অন্য দিক দিয়া চাষও আসন্ন হইয়া আসিয়াছে। তাহারা শ্রীবাসের কাছে ধান ধার করিতে আসিয়াছে। কিন্তু শ্রীবাস বলিতেছে, তাহাদের পূর্বের ধার শোধ হয় নাই। সেই ধারের একটা ব্যবস্থা আগে না করিয়া দিলে আবার নূতন ঋণ সে কেমন করিয়া দিবে? কিন্তু কথাটা তাহারা বেশ বুঝিতে পারিতেছে না, অস্বীকারও করিতে পারিতেছে না। তাহারা চুপ করিয়া বসিয়া শুধু ভাবিতেছে।

কতকগুলি দশ-বারো বছরের উলঙ্গ ছেলে কলরব করিতে করিতে ছুটিয়া আসিল-মারাং গাডো, মারাং গাডো। খিকড়ী! অর্থাৎ বড় ইঁদুর, বড় ইঁদুর, খেঁকশিয়াল! কথা বলিতে বলিতে উত্তেজনায় আনন্দে তাহাদের চোখ বিস্ফারিত হইয়া উঠিতেছে; কালো কালো মূর্তিগুলির বিস্ফারিত চোখের সাদা ক্ষেতের মধ্যে ছোট ছোট কালো তারাগুলি উত্তেজনায় থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।

কাঠের ওস্তাদ সর্বাগ্রে ব্যগ্রতায় চঞ্চল হইয়া উঠিল, সে বলিল, ও-কারে? কুথাকে?

 বনের জঙ্গলের ধারে গো! ভুঁয়ের ভিতর থেকে গুল গুল করে বার হছে গো।

দুই-তিনজন কলরব করিয়া উঠিল, গোড়া ভুগ্যারে-কো চোঁ-চোঁয়াতে। অর্থাৎ গর্তের ভিতর সব চোঁ চোঁ করছে।

এইবার সকলেই আপানাদের ভাষায় কমলের সহিত কি বলা-কওয়া করিয়া উঠিয়া পড়িল। শ্রীবাস রুষ্ট হইয়া বলিল, লাফিয়ে উঠলি যে ইঁদুরের নাম শুনে? আমার ধানের কি করবি, করে যা।

ওস্তাদ বলিল, আমরা কি বুলব গো? উই মোড়ল বুলবে আমাদের। আর যাব না তো খাব কি আমরা? তু ধান দিবি না বুলছিস। ঘরে চাল নাই, ছেলেপিলে সব খাবে কি? ওইগুলা সব পুঁড়ায়ে খাব।

পাড়ার ভিতর হইতে তখন সার বাঁধিয়া জোয়ান ছেলে ও তরুণীর দল বর্ষণ মাথায় করিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছে-ইঁদুর-খেঁকশিয়ালের সন্ধানে। ছেলের দল আরও চঞ্চল হইয়া উঠিল, সমস্বরেই বলিয়া উঠিল, দেলা দেলা! চল চল!

বুড়ার দলও ছেলেদের পিছনে পিছনে তাহাদেরই মত নাচিতে নাচিতে চলিয়া গেল।

শ্রীবাস অকস্মাৎ লোলুপ হইয়া উঠিল; সে কমলকে বলিল, মোড়ল বল্ কেনে ওদের, খরগোশ পেলে আমাকে যেন একটা দেয়।

আসল ব্যাপারটা খুবই সোজা, সাঁওতালেরা সেটা বেশ বুঝতে পারে; কিন্তু আসল সত্যের উপরে জাল বুনিয়া শ্রীবাস যে আবরণ রচনা করিয়াছে, সেটা খুবই জটিল–তাহার জট ছাড়াইতে উহারা কিছুতেই পারিতেছে না। শ্রীবাস চায় সাঁওতালদের প্রাণান্তকর পরিশ্রমে গড়িয়া তোলা জমিগুলি। সে কথা তাহারা মনে মনে বেশ অনুভব করিতেছে; কিন্তু ঋণ ও সুদের হিসাবের আদি-অন্ত তাহারা কোনমতেই খুঁজিয়া পাইতেছে না। তিন বৎসরের মধ্যেই তাহাদের জমিগুলিকে প্রথম শ্রেণীর জমিতে তাহারা পরিণত করিয়া তুলিয়াছে। জমির ক্ষেত্র সুসমতল করিয়াছে, চারিদিকের আইল সুগঠিত করিয়া কালীর পলিমাটিতে গড়া জমিকে চষিয়া খুঁড়িয়া সার দিয়া তাহাকে করিয়া তুলিয়াছে স্বর্ণপ্রসবিনী। চরের প্রান্তভাগ যে-জমিটা চক্রবর্তী-বাড়ি খাসে রাখিয়া তাহাদের ভাগে বিলি করিয়াছে, সেগুলিকে পর্যন্ত পরিপূর্ণ জমির আকার দিয়া গড়িয়া ফেলিয়াছে। শ্রীবাসের জমি তাহারাই ভাগে করিতেছে, সে-জমিও প্রায় তৈয়ারী হইয়া আসিল। বে বন্দোবস্তী বাকী চরটার জঙ্গল হইতে তাহারা জ্বালানির জন্য আগাছা ও ঘর ছাওয়াইবার উদ্দেশ্যে বেনা-ঘাস কাটিয়া প্রায় পরিষ্কার করিয়া ফেলিয়াছে। তাহাদের নিজেদের পল্লীর পাশে পাশে আম কাঁঠাল মহুয়া প্রভৃতি চারাগুলি মানুষের মাথা ছাড়াইয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে, শজিনাডালের কলমগুলিতে তো গত বৎসর হইতেই ফুল দেখা দিয়াছে। বাঁশের ঝাড়গুলিতে চার পাঁচটি করিয়া বাঁশ গজাইয়াছে, শ্রীবাস হিসাব করিয়াছে, এক-একটি বাঁশ হইতে যদি তিনটি করিয়াও নূতন বাঁশ গজায় তবে এই বর্ষাতেই প্রত্যেক ঝড়ে পনেরো-কুড়িটি করিয়া নূতন বাঁশ হইবে।

জায়গাটিও আর পূর্বের মত দুর্গম নয়, শ্রীবাসের দোকানের সম্মুখ দিয়া যে রাস্তাটা গাড়ির দাগে দাগে চিহ্নিত হইয়াছিল, সেটি এখনও সুগঠিত পরিচ্ছন্ন একটি সাধারণের ব্যবহার্য রাস্তায় পরিণত হইয়াছে। রাস্তাটা সোজা সাঁওতাল-পল্লীর ভিতর দিয়া নদীর বুকে যেখানে নামিয়াছে, সেইখানেই এখন খেয়ার নৌকা ভিড়িয়া থাকে, এইটাই এখন এ-পারের খেয়াঘাট। খেয়ার যাত্রীদের দল এখন এইদিকেই যায় আসে। গাড়িগুলিও এই পথে চলে। রাস্তায় এ-প্রান্তটা সেই গাড়ির চাকার দাগে দাগে একেবারে এ-পাড়ের চক আফজলপুরের পাকা সড়কের সঙ্গে গিয়া মিশিয়াছে। ওই পাকা সড়কে যাইতে যাইতে মুরশিদাবাদের ব্যাপারীদের কলাই, লঙ্কা প্রভৃতির গাড়ি এখানে আসিতে শুরু করিয়াছে। তাহারা কলাই, লঙ্কা বিক্রয় করে ধানের বিনিময়ে। এখানে কলাই, লঙ্কা বেচিবার সুবিধা করিতে পারে না, তবে সাঁওতালদের অল্প দর দিয়া ধান কিছু কিছু কিনিয়া লইয়া যায়। গরু-ছাগল কিনিবার জন্য মুসলমান পাইকারদের তো আসা-যাওয়ার বিরাম নাই। দুই-চারি ঘর গৃহস্থেরও এ-পারে আসিয়া বাস করিবার সঙ্কল্পের কথা শ্রীবাসের কানে আসিতেছে। সে-বন্দোবস্তি ও-দিকের ওই চরটার উপর তাহাদের দৃষ্টি পড়িয়াছে। ঘাস ও কাঠ কাটিয়া সাঁওতালরাই ও-দিকটাকে এমন চোখে পড়িবার মত করিয়া তুলিল। আবার ইহাদের গরুর পায়ে পায়ে এবং ঘাস ও কাঠবাহী গাড়ির চলাচলে ওই জঙ্গলের মধ্যেও একটা পথ গড়িয়া উঠিতে আর দেরি নাই। নবীন ও রংলালের সহিত দাঙ্গা করার জন্য শ্রীবাস এখন মনে মনে আফসোস করে। এত টাকা খরচ করিয়া একশত বিঘা জমি লইয়া তাহার আর কি লাভ হইয়াছে? লাভের তুলনায় ক্ষতিই হইয়াছে বেশি। আজ চক্রবর্তী বাড়িতে গিয়া জমি বন্দোবস্ত লইবার পথ চিরদিনের মত রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। মামলার খরচে তাহার সঞ্চয় ব্যয়িত হইয়া অবশেষে মজুমদারের ঋণ তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। মামলা না করিয়া বাকি চরটা সে যদি বন্দোবস্ত লইত, তবে সে কেমন হইত? আর গোপনে দখল করিবারও উপায় নাই, ছোট রায়-ইন্দ্র রায়ের শ্যেনদৃষ্টি এখন এখানে নিবদ্ধ হইয়া আছে। রায় এখন চক্রবর্তীদের বিষয়-বন্দোবস্তের কর্তা। সে দৃষ্টি, সে নখরের আঘাতের সম্মুখিন হইতে শ্রীবাসের সাহস হয় নাই। সেদিনের সেই সর্বক্ষাতলার বলির কথা মনে করিয়া বুক এখনও হিম হইয়া যায়। এখন একমাত্র পথ আছে, ওই সাঁওতালদের উঠাইয়া ওই দিকে ঠেলিয়া দিয়া এদিকটা যদি কোনরূপে গ্রাস করতে পারা যায়। জমি-বাগান-বাঁশ লইয়া এ দিকটা পরিমাণে কম হইলেও এটুকু নিখাদ সোনা।

ভাবিয়া চিন্তিয়া শ্রীবাস জাল রচনা করিয়াছে। মাকড়সা যেমন জাল রচনা করে, তেমনি ভাবেই হিসাবের খাতায় কলমের ডগার কালির সূত্র টানিয়া যোগ দিয়া গুণ দিয়া জালখানিকে সে সম্পূর্ণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাই সে বলিতেছে, আমার খাতায় টিপছাপ দিয়ে বকেয়ার একটি আধার করে দে। তারপর আবার ধান লে কেনে?

একা বসিয়া অনেক ভাবিয়া কমল বলিল, হা পাল মশায়, ইটী কি করে হল গো? আমরা বছর বছর ধান দিলম যি! তুর ছেলে লিলে!

হাসিয়া পাল বলিল, দিস নাই এমন কথা বলেছি আমি?

তবে? বাকিটো তবে কি করে বুলছিস গো?

এই দেখ, বোঙাজাতকে কি করে সমঝাই, বল দেখি? আচ্ছা শোন্, ভাল করে বুঝে দেখ। যে ধানটো তোরা নিলি, এই তোর হিসেবই খুলছি আমি। এই দে পহিল সালে তু নিলি তিন বিশ ধান। তিন বিশের বাড়ি, মানে সুদ ধর গা যেঁয়ে-দেড় বিশ। হল গা যেঁয়ে-সাড়ে চার বিশ! বটে তো?

কমল হিসেব নিকাশের মধ্যে ভাল ঠাওর পাইল না, বলিল, হুঁ, সি তো হল।

পাল আবার আরম্ভ করিল, তারপর তু দিলি সে বছর তিন বিশ আটি আড়ি পাঁচ সের। বাকি থাকল বাইশ আড়ি পাঁচ সের-মানে, এক বিশ দু আড়ি পাঁচ সের। তার ফিরে বছর তুই নিয়েছিস তিন বিশ চোদ্দ আড়ি। আর গত বছরের বাকি এক বিশ দু আড়ি পাঁচ সের। আর সুদ ধর দু বিশ তিন আড়ি আড়াই সের।

কমল দিশা হারাইয়া বলিল, হুঁ।

 পাল হাসিয়া বলিল, তবে? তবে যে বলছিস, কি করে হল গো? ন্যাকা সাজছিস্?

কমল চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। শ্রীবাস ছেলেকে বলিল, সাজ তো বাবা, কড়া দেখে এক কল্কে তামুক। বাদলে-বাতাসে শীত ধরে গেল। কি বলে রে মাঝি, শীত-শীত করছে, তোদের কথায় কি বলে?

কমল কোন উত্তর দিল না, পালের ছেলে তামাক সাজিতে সাজিতে হাসিয়া বলিল, রবাং হো রাবঃ কানা, নয় রে মাঝি?

পাল কৃত্রিম আনন্দিত-বিস্ময়ের ভঙ্গীতে বলিল, তুই শিখেছিস নাকি রে? শিখিস শিখিস। বুঝলি মোড়ল, ওকে শিখিয়ে দিস তোদের ভাষা।

কিন্তু কমল ইহাতে খুশি হইল না। সে গভীর চিন্তায় নীরব হইয়া বসিয়া রহিল। পালের ছেলে তামাক সাজিয়া একটু আড়ালে নিজে কয়েক টান টানিয়া হুঁকাটি বাপের হাতে দিল; পাল দেওয়ালে ঠেস দিয়া ফড়াৎ ফড়াৎ শব্দে হুঁকায় টান দিতে আরম্ভ করিল। দূরে চরের প্রান্তভাগে বন্যার কিনারায় কিনারায় উত্তেজনায় আত্মহারা সাঁওতালদের আনন্দন্মত্ত কোলাহল উঠিতেছে। সে কোলাহলের মধ্যে নদীর ডাকও ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে। আকাশে সীসার আস্তরণের মত দিগন্ত বিস্তৃত মেঘের কোলে কোলে ছিন্ন ছিন্ন খণ্ড কালো মেঘ অতিকায় পাখীর মত দল বাঁধিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। শ্রীবাস বাহ্য উদাসীনতার আবরণের মধ্যে থাকিয়া উৎকণ্ঠিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কমলের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল। কমলকে আপ্যায়িত করিবার নানা কৌশল একটার পর একটা আবিষ্কার করিয়া আবার সেটাকে নাকচ করিতেছিল, পাছে কমল তাহার দুর্বলতা ধরিয়া ফেলে। সহসা সে একটা কৌশল আবিষ্কার করিয়া খুশী হইয়া উঠিল এবং কৃত্রিম ক্রোধে ছেলেকে ধমকাইয়া উঠিল, বলি গনেশ, তোর আক্কেলটা কেমন, বল দেখি? মোড়ল মাঝি বসে রয়েছে কখন থেকে, বর্ষা-বাদলের দিন, এইটুকু তামাকের পাতা, একটু চুন তো দিতে হয়! সাঁওতাল হলেও মোড়ল হল মান্যের লোক।

গনেশ ব্যস্ত হইয়া তামাকের পাতা ও একটা কাঠের চামচে করিয়া চুন আনিয়া মোড়লের কাছে নামাইয়া দিল। মোড়ল চুন ও তামাকপাতা লইয়া খইনি তৈয়ার করিতে আরম্ভ করিল। এতক্ষণে সে যেন খানিকটা চেতন ফিরিয়া পাইল, বলিল, ধান যখন নিলম আপনার ঠেঞে, তখন সিটি দিব না, কি করে বুলব গো মোড়ল?

পাল হাসিয়া বলিল, এই! মাঝি, সব বেচে মানুষ খায়, কিন্তু ধরম বেচে খেতে নাই। তোরা দিবি না এ ভাবনা আমার এক দিনও হয় নাই। তোর সঙ্গে কারবার করছি এতদিন, তোকে আমি খুব জানি। তবে কি জানিস, এই মামলা-মোকদ্দমায় পড়ে আমি নিজে কিছু দেখতে পারলাম না। ছেলেগুলো সব বোকা, ছেলেমানুষ তো। বছর বছর হিসেব করে যদি বলে দিত যে, মাঝি এই তোদের সব বাকি থাকল, তবে তো এই গোলটি হত না। আমি এবার খাতা খুলে দেখে তো একেবারে অবাক!

কমল খানিকটা খইনি ঠোঁটের ফাঁকে পুরিয়া বলিল, হুঁ, আমরাও তো তাই হলাম গো।।

শ্রীবাস ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বলিয়া উঠিল, তার জন্য ছেলেগুলোকে আমি মারতে শুধু বাকি রেখেছি। আবার ক্ষণিক নীরবতার পর বলিল, এবার থেকে সূক্ষ্ম হিসাব করে আমি নিজে বসে তোদের ঝঞ্জাট মেরে দোব, কিছু ভাবিস না তোরা।

কমল বলিল, হুঁ, সেইটি তু করে দিবি মোড়ল।

নিশ্চয়। এখন এক কাজ ক, তোরা বাপু খাতাতে যে বাকি আছে, সেই বাকির হিসেবে একটা টিপছাপ দে। আর কার কি ধান চাই বল, আমি জুড়ে দেখি, কত ধান লাগবে মোটমাট। তারপর লে কেনে ধান কালই।

কমল টিপছাপের নামে আবার চুপ করিয়া গেল। টিপসহিকে উহাদের বড় ভয়। ওই অজানা কালো কালো দাগের মধ্যে যেন নিয়তির দুর্বার শক্তি তাহারা অনুভব করে। খত শোধ করিতে না পারিলে শুধু তো এখানেই শাস্তি হইয়া শেষ হইবে না! আরও, খত কেমন করিয়া সর্বস্ব গ্রাস করে, সে তো এই বয়েসে কত বার দেখিয়াছে। কালো দাগগুলো যেন কালো ঘোড়ার মত ছুটিয়া চলে।

শ্রীবাস বলিল, তোদের তো আবার পুজো-আচ্চা আছে, ধান পোঁতার আগে সেই সব পুজোটুজো না করে তো চাষে লাগতে পারবি না?

আবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কমল বলিল, হুঁ।

কি পরব বলে রে একে, নাম কি পরবের?

নাম বটে ‘বাতুলি’ পরব। আবার ‘কদলেতা’ পরবও বুলছে। ‘রোওয়া’ পরবও বলে। ‘বাইন’ পরবও বুলছে। যারা যেমন মনে করে, বুলে।

পরব কি হবে তুদের?

কমল এবার খানিকটা উৎসাহিত হইয়া উঠিল, ‘জাহর সারনে আমাদের দেবতার থানে গো, পূজা হবে। ‘এডিয়াসিম’-আমাদের মোরগাকে বলে ‘এডিয়াসিম’, ওই মোরগা কাটা হবে, পচুই মদ দিব দেবতাকে, শাক দিব দু-তিন রকম। তারপর রাঁধা-বাড়া হবে উই দেবতা থানে, লিয়ে খেয়ে-দেয়ে সব লাচগান করব।

তবে তো অনেক ব্যাপার রে! তা আমাদিগে নেমন্তন্ন করবি না?

কমল বড় বড় দাঁত মেলিয়া হাসিতে আরম্ভ করিল, কৌতুক করিয়া বলিল, আপুনি আমাদের হাঁড়ি মদ খাবি মোড়ল?

শ্রীবাস বলিল, তা আমাকে না হয় দোকান থেকে ‘পাকিমদ’ এনে দিবি!

কমল পশ্চাদপদ হইল না, বলিল হুঁ, তা দিব।

 হা-হা করিয়া হাসিয়া শ্রীবাস বলিল, না না, ও আমি ঠাট্টা করছিলাম।

কমল মাথা নাড়িয়া বলিল, উঁ-হুঁ, সি হবে না। আমি যখুন নেওতা দিলম, তখুন তুকে উটি লিতে হবে।

বেশ, তা দিস্। সে হবে কবে তোদের?

জল তো হয়েই গেল গো। এই ধানটি হলেই পুজো করব। তারপরে চাষে লেগে যাব। তা আপুনি ধান দিবি তবে তো হবে।

বেশ। সবাইকে নিয়ে আয়, এসে টিপছাপ দিয়ে দে, পরশু নিয়ে নে ধান। ধান তো আমার এখানেই আছে।

কমল স্লানমুখে বলিল, তাই দিবে সব কাল।

গনেশ বলিল, মোড়ল ধান নিতে দোকানে সব সকালে সকালে পাঠিয়ে দিস একটু। আজ তো আবার তোদের অনেক কিছু চাই রে; ইঁদুর, খরগোশ খেঁকশিয়াল মারলি, মসলাপাতি চাই তো?

কমল হাসিয়া বলিল, হুঁ। বলিতে বলিতে অকস্মাৎ যেন একটা অতি প্রয়োজনীয় কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল, বলিল, ‘ডিবিয়া সুনুম’ এনেছিস গো? করঙ্গা সুনুম জ্বলছে না ভাল বাতাসে।

হ্যাঁ, এক টিন কেরোসিন তেল এনেছি, বলে দিস সব ডিবিয়াও এনেছি। তোর নাতনীর হাতে একটা লণ্ঠন দেখেছিলাম মাঝি, ওটা কোথা কিনলি রে?

কমল বলিল, উ উয়াকে রাঙাবাবুর মা দিয়েছে। ভাগে জমি করেছে জামাইটো, মেয়েটা উনিদের পাটকাম করছে কিনা।

শ্রীবাসের হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, বলিল, আচ্ছা, তোর নাত-জামাই তো কই ধান নেয় না মোড়ল? আবার তোর সঙ্গে পৃথকও তো বটে।

কমল একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বিয়া দিলেই বেটী পর হয়ে যায় গো! আর জামাইটো হল পরের ছেলে। আমরা বুলছি কি জানিস, এটাঃ হপন বীর, সিম বাকো আপনারোয়াঃ-মানে বুলছে জামাইটো পরের ছেলে, বনের মুরগীর মত উপোষ মানে না।

ও দিক হইতে কলরব করিতে করিতে শিকার সমাধা করিয়া সাঁওতালদের দল ফিরিতেছিল। পুরুষ নারী ছেলে-বাদ বড় কেহ ছিল না। অধিকাংশের হাতেই ছোট লাঠি, জন-কয়েকের কাঁধে ধনুক, হাতে তীর, খালি হাত যাহাদের তাহারাও রাশীকৃত মরা ইঁদুর, গোটাকয়েক খেকশিয়াল, গোটা-চারেক বুনো খরগোশ লেজে দড়ি ঝুলাইয়া লইয়া চলিয়াছে। সেই দীর্ঘাঙ্গী তরুণীটির হাতে ছিল দুইটা খরগোশ, সে অভ্যাসমত দর্পিত উচ্ছল ভঙ্গীতে আসিয়া কমলকে আপনাদের ভাষায় বলিল, এ-দুটা রাঙাবাবুকে দিতে হইবে। তুমি বল ইহাদের, ইহারা বলিতেছে, দিসে না। রাঙাবাবু ও-পারের ঘাটে বসিয়া আছে, আমি তাকে দেখিয়াছি।

দলের তরুণীগুলি সকলেই সমস্বরে সায় দিয়া উঠিল, হ্যাঁ হ্যাঁ। হুই লদীর উ পারে বসে রইছে। আমরা দেখলাম। আমাদের রাঙাবাবু।

শ্রীবাসের খরগোশ মাংসের উপর প্রলোভন ছিল, সে তাড়াতাড়ি বলিল, হ্যাঁ মাঝি, আমি যে বললাম একটা খরগোশের জন্য, আমাকে একটা দে।

কমলের নাতনীই শ্রীবাসকে জবাব দিল। কেহ কিছু বলিবার পূর্বেই সে বলিল, কেনে, তুকে দিব কেনে? তুকে দিব তো আমরা কি খাব?

শ্রীবাস ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, এ তো আচ্ছা মেয়ে রে বাবা। ওই তো তোরা দিতে যাচ্ছিস রাঙাবাবুকে। তা আমাকে দিবি না কেনে?

কমলের নাতনী পরম বিস্ময়ের সহিত একটা আঙুল শ্রীবাসের দিকে দেখাইয়া আপনাদের ভাষায় বলিয়া উঠিল, এ লোকটা পাগল, না খ্যাপা?

মেয়ের দল খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। শ্রীবাসের ছেলে গনেশ সাঁওতালী ভাষা বুঝিতে পারে; তাহার মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিল, সে কঠিন স্বরেই বলিয়া উঠিল, এই সারী, যা-তা বলিস না বলছি।

কমলের ওই নাতনীর নাম সারী; শুকসারীর সারী নয়-উহাদের ভাষায় সারীর অর্থ উত্তম ভাল। সারী বলিল, কেনে বুলবে না? ই কথা উ বলছে কেনে? রাঙাবাবুর সাথে সাথ করছে কেনে? উ আমাদের জমিদার, আমাদিগে জমি দিলে, আমাদিকে ধান দেয়; তুদের মত সুদ লেয় না।

সারীর কথার ভঙ্গিতে কমলও এবার লজ্জিত হল, সে যথাসম্ভব মোলায়েম করিয়া বলিল, উনিকে সবাই খুব ভালবাসে মোড়ল, উনি আমাদের রাঙাঠাকুরের লাতি।

মেয়েগুলো মুগ্ধ বিস্ময়ের সুরে বলিয়া উঠিল আপনাদের ভাষায়, তিমুনি আগুনের পারা রং!-আঃ য় গো! বিস্ময়সূচক ‘আয়-গো’ শব্দটির দীর্ঘায়িত ধ্বনির সুর তাহাদের কণ্ঠে সঙ্গীতধ্বনির মতই বাজিয়া উঠিল।

.

১৯.

 একা অহীন্দ্র নয়, অমল এবং অহীন্দ্র দুইজনেই প্রাতঃকালে কালিন্দীর ঘাটে আসিয়া বসিয়াছিল। বর্ষার জলে ভিজিবার জন্যে দুইজনে বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছিল। নদীর ঘাটে আসিয়া কালীর বন্যা দেখিয়া সেইখানে তাহারা বসিয়া পড়িল। খেয়াঘাটের উপরে পথের পাশেই এক বৃদ্ধ বট; বটগাছটির শাখাপল্লব এত ঘন এবং পরিধিতে এমন বিস্তৃত যে, বৃষ্টির জলধারা তাহার তলদেশের মাটিকে স্পর্শ করিতে পারে না, গাছের পাতা ঝরা জল স্থানে স্থানে ঝরিয়া পড়ে মাত্র। গাছের গোড়ায় মোটা মোটা শিকড়গুলি আঁকিয়া বাঁকিয়া চারিপাশের মাটির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে; কিন্তু তাহাদের উপর খানিকটা অংশ অজগরের পিঠের মত মাটির উপরে জাগিয়া আছে, সেই শিকড়ের উপর বসিয়া তাহারা দুইজনে কালীর খরস্রোতের মধ্যে ঢিল ছুঁড়িতে ঘুড়িতে কথা বলিতেছিল। গাছটারই তলায় তাহাদের হইতে কিছু দূরে, খান-দুই গরুর গাড়ি খেয়ানৌকার অপেক্ষা করিয়া রহিয়াছে। বর্ষার বাতাসে গরুগুলির সর্বাঙ্গের লোম খাড়া হইয়া উঠিয়াছে, গাড়োয়ান দুইজন এবং আর জন কয়েক খেয়ার যাত্রী ভিজা কাঠের আগুনের ধোঁয়ার সম্মুখে উবু হইয়া বসিয়া তামাক টানিয়া কাশিতেছে, গল্প করিতেছে।

বহুদিনের প্রাচীন বট, গাছের তলায় বহু বৎসর হইতেই পথের রাহীরা এমনই করিয়া আশ্রয় গ্রহণ করে। গাছটার নামই ‘আঁটের বটতলা’। পথের মধ্যে অপরিচিত পথিকেরা জোট বাঁধিয়া এই স্থানে আশ্রয় লইয়া থাকে-এই আশ্রয় লওয়াকে এ-দেশে বলে আঁট দেওয়া। গাছের তলাতেই একটা গরুর গাড়ির টাপর বা ছই পাতিয়া তাহারই আশ্রয়ের তলে উবু হইয়া বসিয়া খেয়াঘাটের ঠিকাদারও তামাক টানিতেছিল।

আপনার বক্তব্যের উপর জোর দিয়াই অমল কথা বলিতেছিল। সে এবার ধরিয়াছে, অহীন্দ্রকে কলকাতায় পড়িতে হইবে। অহীন্দ্রের কোন অজুহাতই সে শুনিতে চায় না; সে বার বার বলিতেছে, তোমার মত স্টুডেন্টের পক্ষে মফঃস্বল কখনও উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে না।

কৌতুকভরে অহীন্দ্র বলিল, বল কি?

 নিশ্চয়। অন্তত তিন ধাপ যে খাটো, সেটা তো প্রামাণিত হয়েই গেছে তোমার রেজাল্টে?

মানে?

ভেরি ইজি। কলকাতায় থাকলে তোমার নাম থাকত সর্বাগ্রে-এ আমি নিঃসংশয়ে বলতে পারি। ক্ষেত্রের উর্বরতা-অনুর্বরতা তোমার সায়েন্সের স্বীকৃত সত্য, বীজের অদৃষ্টের ঘাড়ে দোষ চাপানোর মত। অবৈজ্ঞানিক মতবাদ নিশ্চয় তুমি পোষণ করতে পার না।

এবার অহীন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তুমি সবটা বুঝতে পারছ না অমল। তবে তোমাকে বলতে আমার বাধা নেই। আমাকে মাসে মাসে এবার থেকে মাকে কিছু করে না পাঠালে চলবে না। নিয়মিত আদায়পত্র তো হয় না, টাকার অভাবে মা অনেক সময় বিব্রত হয়ে পড়েন। আর মাকে আমার রান্না করতে হয়, মানদা ঝি বিনা মাইনেতে কাজ করে, অন্ততঃ এ দুটো খরচ আমাকে পাঠাতেই হবে।

অমল চুপ করিয়া গেল। কথাগুলির মধ্যে যে একটা বেদনাদায়ক সঙ্কোচ লুকাইয়া আছে, সেই সঙ্কোচে সে সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। প্রাণঢালা অন্তরঙ্গতায় সে অহীন্দ্রের অন্তরঙ্গ, তবুও তাহার মনে হইল, এ কথাটা জোর করিয়া অহীন্দ্রের কাছে শুনিয়া সে অনধিকার চর্চা করিয়াছে। এদিকে ও-পার হইতে নৌকাখানা আসিয়া পড়ায় খেয়াঘাট কলরবে মুখরিত হইয়া উঠিল। গাছতলায় গাড়ি লইয়া গাড়োয়ানেরা ব্যস্ত হইয়া পড়িল। শীতার্ত গরু কয়টাকে গাড়িতে জুড়িবার পূর্ব হইতেই ঠ্যাঙাইতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে, চীৎকার শুরু করিয়া দিয়াছে। যাত্রী যাহারা নামিতেছে তাহারা চীৎকার করিতেছে কম নয়।

ঘাটের ঠিকাদার গরুর গাড়ির টাপরের ভিতর বসিয়াই পারের পয়সা আদায় করিতে করিতে একজনের সঙ্গে বিতণ্ডা জুড়িয়া দিয়াছে, একটি ছেলের পারানির পয়সা লইয়া। লোকটি বলিতেছে, কোম্পানির র‍্যালে ছেলের জন্যে হাফ-টিকিট, আর তোমার লৌকাতে নাই বললে চলবে কেনে হে বাপু? মগের মুলুক পেয়েছ লেকিনি তুমি?

গরুর গাড়ির গাড়োয়ান অত্যন্ত সাবধানতার সহিত গরুগুলিকে চালনা করিতে করিতে চেঁচাইতেছিল, অ-ই–হ-হ! ইদিগেই

নিতান্ত প্রয়োজনীয় সময়ে এমনি কলরবমূর্খর একটি বিষয়ান্তরে সুযোগ পাইয়া অমল অহীন্দ্র দুইজনেই যেন বাঁচিয়া গেল। হাফটিকিট-যুক্তিবাদী লোকটির কথায় অকস্মাৎ প্রচুর কৌতুক অনুভব করিয়া অমল বেশ খানিকটা হাসিয়া লইয়া বলিল, ফাইন আর্গুমেন্ট কিন্তু।

যাত্রী গাড়ি বোঝাই করিয়া খেয়ানৌকা আবার ও-পারের দিকে রওনা হইল। খেয়ার মাঝি লগির একটা খোঁচা দিয়া নৌকাখানাকে তটভূমির সংস্পর্শ হইতে ঠেলিয়া জলে ভাসাইয়া উচ্চকণ্ঠে বলিল, হরিহরি বল সব। মিঞাসাহেবরা আল্ল-আল্লা বল।

হিন্দুর সংখ্যাই বেশি ছিল অথবা সবাই বোধ হয় হিন্দু ছিল, সমবেত কণ্ঠের একটা উচ্চ কলরোল উঠিল, হরি-বোল।

আবার ঘাট নিস্তব্ধ হইয়া গেল। শুধু নদীর আবর্তের কুটিল নিম্ন কলকল শব্দ একই ভঙ্গিতে একটানা ধ্বনিত হইয়া চলিল। সে মৃদু ধ্বনি উঠিলেও জনবিরল খেয়াঘাটের উপর যে দুই তিনটি মানুষ বসিয়া ছিল, তাহাদের অন্তরের স্তব্ধতা সে-ধ্বনিতে ক্ষুণ্ণ হইল না; জনবিরল খেয়াঘাটের শান্ত উদাসীনতার মধ্যে নদীর নিম্নস্বর সুশোভনরূপে অঙ্গীভূত হইয়া গিয়াছিল। কানে বাজিলেও মনে ধরা পড়িবার মত ধ্বনি সে নয়।

অমল ও অহীন্দ্রের মনের বহিদ্বারে অকস্মাৎ-আসিয়া পড়া কৌতুক ফুরাইয়া গিয়াছে; আবার তাহারা দুজনেই গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছে। একটি কাঠি দিয়া অমল বালির উপর আঁকিতেছে একটা অর্থহীন চিত্র। অহীন্দ্র স্থিরদৃষ্টি নদীর বুকের উপর। অমল সহসা বলিল, আচ্ছা, আমি যদি একটা টুইশানি যোগাড় করে দিই? এক ঘন্টা দেড় ঘন্টা পড়াবে, পনেরো টাকা কি কুড়ি টাকা তাঁরা দেবেন। তা হলে তো তোমার আপত্তি থাকতে পারে না?

অমলের মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া অহীন্দ্র বলিল, আরও পরিষ্কার করে বল। তুমি কি উমাকে পড়াবার কথা বলছ?

অমলও অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিল, তাই যদি বলি?

পারব না।-দৃঢ়স্বরেই অহীন্দ্র জবাব দিয়া বসিল।

এবারও অমল হাসিল, বলিল, জানি। তবু কথাটা ভাল করেই জেনে নিলাম। যাক, সে কথা নয়; আমি বলছি আমার মামাতো ভাইকে পড়াবার কথা। ছেলেটা থার্ড ক্লাসে পড়ছে, তাকে পড়াবার জন্যে তাঁরা মাস্টার খুঁজছেন।

কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া লইয়া বলিল, ভাল রাজী হলাম। তারপর অল্প হাসিয়া বলিল, চল, দেখি তোমার কলকাতা কেমন। মফঃস্বলের চেয়ে কতখানি ওপরে অবস্থান করছেন, পরখ করে দেখা যাক।

অমল হাসিয়া বলিল, অনেক-অনেক অনেক ওপরে অহি, তিন ধাপ নয়, আরও বেশী ওপরে। দেখছো না, প্রাইভেট টুইশানির কথা বলতেই তুমি ধরে নিলে উমাকে পড়াবার কথা। অর্থাৎ মনে করে নিলে উমাকে পড়াবার ভানে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই। যে দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলে, তাতে পুরাকাল হলে আমার ভস্ম হয়ে যাবার কথা। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, কেন? ধর, যদি তাই হত তাতেই বা ক্ষতি কি ছিল? শ্রমবিনিময়ে মূল্য নেবে, তাতে মর্যাদার হানিটা কোথায়? এই হল তোমার মফঃস্বল-মেন্টালিটি।

অহীন্দ্র রাগ করিল না, হাসিয়াই বলিল, এ কথায় কিন্তু কলকাতার লোকেরই হার হল অমল। মূল্য অপেক্ষা অমূল্য বস্তুর দাম বেশি এবং মূল্য না নিলে তবেই সংসারে অমূল্য বস্তু মেলে– এ সত্য কলকাতার লোক জানে না, মফঃস্বলের লোকেরাই জানে প্রমাণ হচ্ছে।

অমল হাসিয়া বলিল, বিজ্ঞানের ছাত্রের অযোগ্য কথা বললে অহীন। বৈজ্ঞানিকের কাছে অমূল্য শব্দের অ অক্ষরটা অঙ্কের পূর্ববর্তী শূণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। যতই উচ্চ মূল্যের বস্তু হোক, একটা মূল্য সে নির্ধারিত করবেই করবে। সেইটাই তার জ্ঞানের বৈশিষ্ট্যের পরিচয়।

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, আমার মূল্য তোমার কাছে তা হলে কত তুমি বলতে পার?

অমল বলিল, তোমার কাছে আমার যত মূল্য, সেইটে ইনটু টেন।

আমার কাছে তুমি তো অমূল্য। অমূল্য ইনটু টেনের ভ্যালু কত, বল তো?

তুমি একটা বোগাস, যত কুটবুদ্ধি তোমার।–অমূল্য হাসিয়া এবার পরাজয় মানিয়া লইল।

এতক্ষণ তাহারা সহজ স্বছন্দ হইয়া উঠিল, বাহির এতক্ষণে অন্তরে প্রবেশ করিল।

নদীর বন্যা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, স্রোতের নিম্ন কলস্বর, বাতাসের শব্দস্পর্শ, ভিজামাটির গন্ধ এতক্ষণে তাহারা স্পষ্ট করিয়া অনুভব করিল। আবর্তকুটিল, গৈরিকবর্ণের বিশাল জলস্রোতের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া অমল বলিল, কালিন্দী আমাদের অদ্ভুত, বহরূপা রহস্যময়ী! অনেক দিন আগে, ছেলেমানুষ ছিলাম, তখন দেখেছি কালিন্দীর বান। আর এই দেখছি।

অহীন্দ্র বলিল, এখানকার প্রবাদ কি জান? এখানকার লোক বলে, উনি নাকি যমের সহোদরা; অর্থাৎ যমুনার কাহিনীটা এঁর ওপর আরোপ করতে চায়। কালিন্দী নাকি যে বস্তুটিকে গ্রাস করতে বদন ব্যাদান করেন, তার রক্ষা কিছুতেই নেই। যম এসে সেখানে দোসর হয়ে ভগ্নীর পাশে দাঁড়ান। এক চাষী, তার নাম রংলাল, সেই আমাকে বলেছিল। অদ্ভুত বিশ্বাস, বললে, উনি যে-কালে হাত বাড়িয়েছেন, সে-কালে রায়হাটের আর রক্ষা নেই।

কালীর তটভূমির ভাঙনের দিকে চাহিয়া অমল বলিল, ওদের সংস্কারের কথা বাদ দিয়েও কথাটা সত্যি, ভাঙনের দিকে চেয়ে দেখ দেখি।

মৃদু হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, এদিকে ভাঙছে ও-দিকে গড়ছে। ও-পারের চরটা বছর বছর পরিধিতে অল্প অল্প করে বেড়ে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সঙ্গে মানুষের কলহ বাড়ছে। গোড়া থেকেই ব্যাপারটা আমি জানি। আমি হলপ করে বলতে পারি অমল, যে, এ গ্রামে শুধু এ গ্রামে কেন, আশেপাশে এমন লোক নেই, যার লোভ নেই ওই চরটার মাটির ওপর।

চরটার দিকে চাহিয়া অমল বলিল, চরটি কিন্তু সত্যি লোভনীয় হয়ে উঠেছে, তা ছাড়া মাটিও বোধ হয় খুব উর্বর।

খুব উর্বর। রংলাল বলছিল, ও মাটিতে সোনা ফলে

চল একদিন দেখে আসি। কাল চল।…আরে আরে, অত সব চেঁচামেচি করছে কেন? আরে বাপ রে, দল বেঁধে চাপে যে! নৌকাখানা ডুবে যাবে!

ও-পারের চরের পার-ঘাটে দল বাঁধিয়া সাঁওতালদের মেয়েরা নৌকায় চড়িতে চড়িতে কলরব করিতেছে। নৌকায় উঠিয়া মেয়েরা দল বাঁধিয়া বাসিয়াছে, সেই ভারে এবং চাঞ্চল্যে নৌকাটা টলমল করিতেছে, তাহাতেই তাহারা সভয় কৌতুকে কলরব করিতেছে। এ-পার হইতে ঘাটের ঠিকাদারও শঙ্কিত হইয়া চীৎকার আরম্ভ করিয়া দিল, অই, অই, এরা করছে কিরে বাপু? হে-ই! হেই!

কিন্তু তাহার কণ্ঠধ্বনি নদীর কল্লোল ভেদ করিয়া ও-পারের দলবদ্ধ সাঁওতালদের কলরবের মধ্যে আত্মঘোষণা করা দূরের কথা, বোধহয় পৌঁছিতেই পারিল না। শেষ পর্যন্ত বেচারা কাশিয়া সারা হইল। কাশিতে কাশিতেই সে বলিল, মর, তবে মর তোরা ডুবে, নিক, নিক, কালী নিক তোদিগে। অসীম বৈরাগ্যের সহিত সে নদীর দিকে পিছন ফিরিয়া বসিয়া নূতন করিয়া তামাক সাজিতে শুরু করিল।

অহীন্দ্রের মুখে একটি পুলকিত হাসির রেশ ফুটিয়া উঠিল, সে নৌকাভরা সাঁওতাল মেয়েদের দিকে চাহিয়া বলিল, একটা মজা দেখবে দাঁড়াও।

হঠাৎ মজাটা কোত্থেকে আসবে?

ওই নৌকায় চড়ে আসছে।

বল কি? ব্যাপারটা কি?

আমার পূজারিণীর দল আসছে। আমি ওদের রাঙাবাবু।

অমল মুগ্ধ হইয়া গেল, বলিল, বিউটিফুল। চমৎকার নাম দিয়েছ তো। কিন্তু এ যে একটা রোমান্স হে!

অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, রোমান্সই বটে। আবার চরটার নাম দিয়েছে রাঙাঠাকুরের চর। আমার ঠাকুরদার সাঁওতাল হাঙ্গামায় যোগ দেওয়ার কথা জান তো? তাঁর প্রতি ওদের প্রগাঢ় ভক্তি। তাঁকে বলত ওরা রাঙাঠাকুর। আমি নাকি সেই রকম দেখতে। চোখগুলো খুব বড় বড় করে বলে, তেমনি আগুনের পারা রং।

ঘাটের ঠিকাদারটি তামাক সাজিতে সাজিতে অহীন্দ্র ও অমলের কথাবার্তা সবই কান পাতিয়া শুনিতেছিল, সে আর থাকিতে পারিল না, বলিয়া উঠিল, তা আজ্ঞে, ওরা ঠিক কথাই বলে, বাবুমশায়। আমাদের চক্কবর্তী-বাবুদের বাড়ির মত রং এ চাকলায় নাই, তার ওপর আপনার রং ঠিক আগুনের পারাই বটে।

অমল ফিসফিস করিয়া বলিল, মাই গড! লোকটা আমাদের কথা সব শুনেছে নাকি?

 হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, অসম্ভব নয়। চুরি করে পরের কথা শোনায় মানুষ চুরির আনন্দ পায়।

ঠিকাদারটা এবার বাহির হইয়া আসিয়া অহীন্দ্র ও অমলের সম্মুখে সবিনয় ভঙ্গিতে উবু হইয়া বসিয়া বলিল, বাবুমশায়!

অহীন্দ্র বলিল, বল।

আজ্ঞে। বলিয়াই সে একবার সঙ্কোচভরে মাথা চুলকাইয়া লইল, তারপর আবার বলিল, আজ্ঞে, বাদলের দিন, আমার কাছে সিগারেট তো নাই। তামুকও খুব কড়া, তা বিড়ি ইচ্ছে করুন কেনে।

অমল খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, অহীন্দ্র ঈষৎ হাসিল, হাসিয়া সে বলিল, না, আমরা বিড়ি সিগরেট তামাক-এইসব খাই নে, ওসব কিছু দরকার নেই আমাদের।

লোকটি অপ্রস্তুত হইয়া অপ্রতিভভাবে হাসিয়া বলিল, আমি বলি-। কিছুক্ষণ অপ্রতিভর হাসি হাসিয়া সে আবার বলিল, আমি আজ্ঞে একটা কথা নিবেদন করছিলাম।

অমল হাসিয়া ইংরেজীতে বলিল, হোয়াট নেক্সট? এ প্লাস অব ওয়াইন?

 লোকটি কিছু বুঝিতে না পারিয়া সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, আজ্ঞে?

গম্ভীরভাবে অহীন্দ্র বলিল, কিছু না, ও উনি আমাকে বলছেন। তুমি কি বলছ, বল?

হাত দুইটি জোড় করিয়া এবার লোকটি বলিল, আজ্ঞে, ওই চরের ওপর খানিক জমির জন্যে বলছিলাম।

একটি মৃদু হাসি অহীন্দ্রের মুখে ফুটিয়া উঠিল, বলিল, জমি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বেশী আমার দরকার নেই, এই বিঘে দশ-পনেরো।

 এ-কথার জবাব তো আমি দিতে পারব না বাপু। আমার মুরুব্বীরা রয়েছেন, তাঁরা যা করেন তাই হবে।

আজ্ঞে আমার বিঘে পাঁচেক হলেও হবে।- লোকটি কাকুতি করিয়া এবার বলিয়া উঠিল, আমি একটি দোকান ও-পারে করব মনে করছি।

দোকান? দোকান তো একটা আছে ও-পারে। শ্রীবাস মোড়ল করেছে।

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমারও ইচ্ছে, একখানা দোকান করি। লোকও তো ক্রেমে ক্রেমে বাড়ছে। আর চিবাস আপনার গলা কেটে লাভ করে। দরে তো চড়া পাবান না, মারে ওজনে। সেরকরা আধপো ওজন কম। দু রকম বাটখারা রাখে আজ্ঞে। ধান-চাল নেয় যে বাটখাড়ায় সেটা আবার সের-করা আধপো বেশী।

অমল এবার বলিল, সেই মতলবে তুমিও দোকান করতে চাও, কেমন?

আজ্ঞে না। এই আপনাদের চরণে হাত দিয়ে আমি বলতে পারি আজ্ঞে। ও-রকম পয়সা আমার গোরক্ত ব্রহ্মরক্তের সমান। আমি আপনার ষোল-আনার ওজন দেব, ষোলআনা পয়সা নেব-বলিয়া সে বুড়ো আঙুলটি একত্র করিয়া ওজন করিবার ভঙ্গিতে ডান হাতখানি তুলিয়া ধরিল যেন সে এখনই ওজন করিতেছে। অমল অহীন্দ্র উভয়েই সে ভঙ্গি দেখাইয়া হাসিয়া ফেলিল।

ও-দিকে সাঁওতাল মেয়েগুলির কলরবের ভাষা স্পষ্ট শোনা যাইতেছে, কিন্তু এখনও বুঝা যাইতেছে না। একে একে কথা কহিতে উহারা জানে না। একসঙ্গে পাখীর ঝাঁকের মত কলরব করে। অহীন্দ্র ঠিকাদারকে বলিল, যাও যাও, তোমার নৌকা এসে পড়ল।

পিছন ফিরিয়া নৌকাখানার দিকে চাহিয়া ঠিকাদার বলিল, সব মাঝিন, একজনও যাত্রী নাই। খেয়াটাই লোকসান। বলিতে বলিতে সে অকস্মাৎ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, জ্বালালে রে বাবা, ঘাট দুটো কেটে, ঝুড়ি কতক মাটি ফেলে দিয়ে মনে করছে মাথা কিনেছে সব। এই মেঝেন এই। তোরা কি ভেবেছিস বল তো? এমন করে দল বেঁধে আসবার তোদের কথা ছিল নাকি?

ঘাটে নামিয়াই সারি ঠিকাদারের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া বাঁধাইয়া তুলিল। সে বলিল, আসবো না কেনে। আমরা যি পাড়াসুদ্ধ তিন দিন খেটে দিলম; ই-দিগের ঘাট, উ-পারের ঘাট ভাল করে দিলম। সারীর পিছনে দলসুদ্ধ মেয়েরা তাহাদের আপনাদের ভাষায় কলরব করিয়া সারীকে সমর্থন করিতে লাগিল।

ঠিকাদার বলিল, তাই বলে একসঙ্গে দল বেঁধে আসবি নাকি? এ-খেয়াতে একটা পয়সা নাই। কি, কাজ কি তোদের? এত ঝাঁটা-ঝুড়ি নিয়ে যাবি কোথা সব?

বেঁচতে যাব। ডাওর করল, ঘরকে ধান নাই, চাল নাই, খাব কি আমরা?

প্রত্যেকের হাতেই ঝাঁটা ও ঝুড়ির বোঝা। নানান ধরনের ঝাঁটা, ছোট বড় নানা ধরণের। ঝাঁটাগুলি বাঁধনের ছাঁদও বিচিত্র। ঝুড়িগুলিও সুন্দর এবং নানা আকারের।

ঠিকাদার এবার ঝগড়ার সুর ছাড়িয়া মোলায়েম সুরে বলিল, বেশ, কই, আমাকে খান কয়েক ঝাঁটা দিয়ে যা দেখি।

পোয়সা, পোয়সা দে। সারী হাত পাতিয়া দাঁড়াইল।

ঠিকাদার কিছুক্ষণ বিচিত্র ভঙ্গিতে নীরবে বর্বর মেয়েগুলির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, তার পর বলিল, আচ্ছা, যা। তারপর আবার পার কেমন করে হোস, তা দেখব আমি। বলে সেই, লায়ে পেরিয়ে লায়েকে বলে শালা, সেই বিত্তান্ত।

সারী তাহার এই ভীতিপ্রদর্শনকে গ্রাহ্যও করিল না। ঘাট হইতে উঠিয়া একেবারে অহীন্দ্র ও অমলের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার পিছনে পিছনে মেয়ের দল। আর তাহাদের মুখে কলরব নাই, চোখে মুগ্ধ বিস্ময়ভরা দৃষ্টি, মুখে স্মিত সলজ্জ হাসি। পরস্পরের গলায় হাত রাখিয়া ঈষৎ বঙ্কিম ভঙ্গিতে সারি বাঁধিয়া দাঁড়াইয়াছে, এমনি ভঙ্গিতেই দাঁড়ানো উহাদের অভ্যাস। পথ চলে, তাও এমনি ভাবে এ উহার গলা ধরিয়া বঙ্কিম ছন্দে হেলিয়া দুলিয়া চলে।

অমল মুগ্ধ হইয়া গেল, বলিল, বিউটিফুল! মনে হচ্ছে অজন্তা অথবা কোন প্রাচীনযুগের গুহার প্রাচীরচিত্র যেন মূর্তি ধরিয়া বেরিয়ে এল।

মৃদু হাসিয়া বলিল, কি রে, কোথায় যাবি সব দল বেঁধে?

সারী বলিল-আপোনার কাছে এলাম গো। আমরা আজ সব শিকার করলম, তাই আনলম দুটো সুসুরে উই যি, তোরা কি বুলিস গো?

পিছন হইতে তিন চার জন কলরব করিয়া উঠিল, খোরগোশ, খোরগোশ।

রক্তাক্ত খরগোশ দুইটা অহীন্দ্র ও অমলের সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া সারী বলিল, হুঁ, খোরগোশ আনলাম আপনার লেগে গো।

একটা খরগোশের মাথা স্কুল-ফলা তীরের আঘাতে একেবারে ভাঙিয়া দুইখানা হইয়া গিয়াছে, অন্যটার বুকে একটা গভীর ক্ষত, সে ক্ষত হইতে এখনও অল্প অল্প রক্ত ঝরিয়া পড়িতেছে।

অহীন্দ্র একটা অদ্ভুত স্থিরদৃষ্টিতে রক্তাক্ত পশু দুইটির দিকে চাহিয়া রহিল। এমন রক্তাক্ত দৃশ্যের আবির্ভাবের আকস্মিকতায় সে যেন স্তব্ধ হইয়া গেল। অমল একটা খরগোশের লেজ ধরিয়া তুলিয়া বলিল, এত বড় খরগোশ এখানে পাওয়া যায়?

হেঁ গো, অনেক রইয়েছে আমাদের চরে। ভারী খারাপ করছে সব। ভুট্টা বরবটি গাছপালার ডালগুলি কেটে কেটে খেয়ে নিচ্ছে।–একা সারী নয়, পাঁচ-ছয়জনে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল। নিজ হইতে বলিবার মত কথা উহারা ভাবিয়া পায় না, প্রশ্নের উত্তরে কথা বলিবার সুযোগ পাইলেই সকলেই কথা বলিবার জন্য কলরব করিয়া উঠে।

অমল উৎসাহিত হইয়া উঠিল, সে অহীন্দ্রকে ঠেলা দিয়া বলিল, চল, কাল চরে শিকার করে আসি। বলিতে বলিতে অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া বিস্মিত হইয়া গেল; অহীন্দ্রের উজ্জ্বল গৌরবর্ণের মুখ কাগজের মত সাদা হইয়া গিয়াছে, চোখ জলে ভরিয়া উঠিয়াছে, স্বচ্ছ অশ্রুজলতলে পিঙ্গল তারা দুইটি আসন্নমৃত্যু প্রাবাল-কীটের মত থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। অমল শঙ্কিত হইয়া বলিল, এ কি, কি হল তোমার?

অহীন্দ্রের ঠোঁট দুইটি কাঁপিয়া উঠিল, সে বলিল, ও দুটো সরাও ভাই সামনে থেকে। ও বীভৎস দৃশ্য আমি সইতে পারি না।

অমল খরগোশ দুইটা তুলিয়া লইতে ইঙ্গিত করিয়া বলিল, বাবুর বাড়িতে দিগে যা।

অহীন্দ্র শিহরিয়া উঠিল, না না না। মা দেখলে সমস্ত দিন ধরে কাঁদবেন।

অমল নির্বাক হইয়া গেল, এমন ধারার কথা সে যেন কখনও শোনে নাই। সম্মুখে সমবেত কালো মেয়েগুলির মুখের স্মিত হাসিও মিলাইয়া গেল, অপরাধীর মত সঙ্কুচিত শুষ্কমুখে নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কিছুক্ষণ পর সারী কুণ্ঠিতভাবে বলিল, হাঁ বাবু, খাবি না তবে খোরগোশ? আমরা আনলাম আপনার লেগে।

অহীন্দ্র খানিকটা আত্মসম্বরণ করিয়া লইয়াছিল, এতক্ষণে সে ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, বাবুর বাড়িতে দিগে যা। জানিস তো ছোট রায় মহাশয়ের বাড়ি? ইনি ছোট রায় মহাশয়ের ছেলে।

মেয়েগুলি আপনাদের ভাষায় মৃদুস্বরে কলরব করিয়া অমলকে লইয়া আলোচনা জুড়িয়া দিল। অমল অহীন্দ্রের কথায় প্রতিবাদ করিয়া বলিল, না, না, ওরা ওদুটো নিয়ে যাক।

অহীন্দ্র বলিল, না, তাতে ওরা দুঃখ পাবে। তোমাদের বাড়িতেই দিয়ে যাক।

বেশ, তা হলে তোমাকেও আমাদের ওখানে খেতে হবে।

খাব।

হাসিয়া অমল বলিল, তা হলে তুমি জাপানী বৌদ্ধ।

অহীন্দ্র এবার অল্প একটু হাসিল, হাসিয়া বলিল, দিনে না রাত্রে খাব কিন্তু; দিনে রান্না করতেও দেরিও হবে। আর মায়ের রান্নাবান্না বোধহয় হয়েই গেছে।

মেয়েগুলি কথা না বুঝিয়াও এতক্ষণে অকারণে হাসিয়া উৎফুল্ল এবং সহজ হইয়া উঠিল। সারী বলিল, তাই দিব তবে রায় মহাশয়ের বাড়িতে রাঙাবাবু?

হ্যাঁ।

মেয়ের দল কলরব করিতে করিতে চলিয়া গেল। অমল বলিল, চল তা হলে আমরাও যাই।

ঘাটের ঠিকাদার ঠিক সময়ে কখন আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে জোড়হাত করিয়া বলিল, বাবু তা হলে আমার আরজির কথাটা মনে রাখবেন।

.

২০.

সেদিন অপরাহ্নে দুর্যোগটা সম্পূর্ণ না কাটিলেও স্তিমিত হইয়া আসিল। বর্ষণ ক্ষান্ত হইয়াছে, পশ্চিমের বাতাস স্তব্ধ হইয়া দক্ষিণ দিক হইতে মৃদু বাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। সেই বাতাস আকাশের মেঘগুলির দিক্‌পরিবর্তন করিয়া উত্তর দিকে চলিয়াছে।

ইন্দ্র রায় কাছারির সামনের বারান্দায় মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া এ-প্রান্ত হইতে ও-প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরিতেছিলেন; হাত দুইটি পিছনের দিকে পরস্পরের সঙ্গে আবদ্ধ। একটা কলরব তুলিয়া অচিন্ত্যবাবু বাগানের ফটক খুলিয়া প্রবেশ করিলেন, গেল, এবার পাষণ্ড মেঘ গেল। বাপ রে, বাপ রে, বাপ রে। আজ ছদিন ধরে বিরাম নেই জলের। আর কি বাতাস! উঃ, ঠাণ্ডায় বাত ধরে গেল মশায়! তিনি আকাশের মেঘের দিকে মুখ তুলিয়া বলিলেন, এইবার? এইবার কি করবে বাছাধন? যেতে তো হল। ‘বামুন বাদল বান, দক্ষিণে পেলেই যান’-দক্ষিণে বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে, যাও, এইবার যাও কোথায় যাবে।

রায় ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, কি ব্যাপার? অনেক কাল পরে যে।

অচিন্ত্যবাবু সপ্রতিভভাবে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, অনেক দিন পরেই বটে। শরীর সুস্থ না থাকলে কি করি বলুন? অবশেষে কলকাতায় গিয়ে-। অকস্মাৎ অকারণে হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, বলুন তো কি ব্যাপার?

হাসিতে হাসিতেই অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, দেখুন ভাল করে দেখুন, দেখে বলুন। হেঁ হেঁ, পারলেন না তো?-বলিয়া আপনার দাঁতের উপর আঙুল রাখিয়া বলিলেন, দাঁত-দাঁত। পার্ল-লাইক টীথ, এই রকম মুক্তোর পাঁতির মত দাঁত ছিল আমার? পোকাখেকো কালো কালো দাঁত, মনে আছে?

এইবার ইন্দ্র রায়ের মন কৌতুকবোধে সচেতন হইয়া উঠিল। তিনি হাসিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন, তাই তো মশায়, সত্যিই এ যে মুক্তোর পাঁতির মত দাঁত!

সগর্বে অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, তুলিয়ে ফেললাম। ডাক্তার বললে কি জানেন? বললে, ওই দাঁতই তোমার ডিসপেপসিয়ার কারণ। এখন আপনার পাথর খেলে হজম হয়ে যাবে।

বলেন কি?

নিশ্চয়। দেখুন না, ছ মাসের মধ্যে কি রকম বিশালকায় হয়ে উঠি। একেবারে যাকে বলে-ইয়ংম্যান। পরমুহর্তে অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি জানেন? খাবারদাবার, মানে যাকে বলে পুষ্টিকর খাদ্য, সে তো এখানে পাওয়া যাচ্ছে না।

রায় বলিলেন, এটা আপনি অযথা নিন্দে করছেন আমাদের দেশের। দুধ-ঘি এসব তো প্রচুর পাওয়া যায় আমাদের এখানে।

বিষম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে দুধ ও ঘিকে তুচ্ছ করিয়া দিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, আরে মশায়, কি যে বলেন আপনি, বিশেষ করে নিজে তান্ত্রিক হয়ে, তার ঠিক নেই। দুধ-ঘিই যদি পুষ্টিকর খাদ্য হত, তবে গরুই হত পশুরাজ। মাংস–মাংস খেতে হবে, তবে দেহে বল হবে। দুধ-ঘি খেয়ে বড় জোর চর্বিতে ফুলে ষণ্ড হওয়া চলে, বুঝলেন?

রায় হাসিয়া বলিলেন, তা বটে, দুধ-ঘি খেয়ে ষণ্ড হওয়া চলে, পাষণ্ড হওয়া চলে না, এটা আপনি ঠিক বলেছেন।

অচিন্ত্যবাবু একটু অপ্রস্তুত হইয়া গেলেন। অপ্রতিভভাবে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বিরক্তিভাবে বলিলেন, আমিই বোকামি করলাম, আরও কিছুদিন কলকাতায় থাকলেই হত। তা একটা সাহেব কোম্পানির তাড়ায় এলাম চলে। ভাবলাম সাঁওতালদের একটা দুটো পয়সা দিয়ে একটা করে হরিয়াল, কি তিতির, নিদেন ঘুঘু মারার ব্যবস্থা করে নেব। তা ছাড়া এখানে বন্য শশকও তো প্রচুর পাওয়া যায়, সে পেলে না হয় দু গণ্ডা তিন গণ্ডা পয়সাই দেওয়া যাবে। শশক-মাংস নাকি অতি উপাদেয় অতি পুষ্টিকর। মানে, ওরা খায় যে একেবারে ফার্স্টক্লাস ভিটামিন-ছোলা, মসুর, এই সবের ডগা খেয়েই তো ওদের দেহ তৈরী।

রায় বলিলেন, আজ আমি আপনাকে শশক-মাংস খাওয়াব, আমার এখানেই রাত্রে খাবেন, নেমন্তন্ন করলাম। চরের সাঁওতালরা আজ দুটো খরগোশ দিয়ে গেছে।

অচিন্ত্যবাবু হাসিয়া বলিলেন, সে আমি শুনেছি মশায়, বাড়িতে বসেই তার গন্ধ পেয়েছি।

রায় হাসিয়া উত্তর দিলেন, তা হলে সিংহ ব্যাঘ্র না হতে পারলেও ইতিমধ্যেই আপনি অন্তত শৃগাল হয়ে উঠেছেন দেখছি। ঘ্রাণশক্তি অনেকটা বেড়েছে।

অচিন্ত্যবাবু অপ্রস্তুত হইয়া ঠোঁটের উপর খানিকটা হাসি টানিয়া বসিয়া রহিলেন। রায় বলিলেন, আসবেন তা হলে রাত্রে!

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, বেশ। আবার এখন এই ভিজে মাটিতে ট্যাংট্যাং করে যাচ্ছে কে, তাই আসব! সেই একেবারে খেয়ে-দেয়ে যাব। অম্বল ভাল হল তো সর্দি টেনে আনব নাকি? তা ছাড়া আসল কথাই তো আপনাকে এখনো বলা হয় নি। এক্ষুনি বললাম না, সায়েব কোম্পানির কথা? এবার যা একটা ব্যবসার কথা কয়ে এসেছি, কি বলব আপনাকে, একেবারে তিনশ পারসেন্ট লাভ, দুশ পয়েন্টের আর মার নেই।

সকৌতুক ঐ দুইটি ঈষৎ টানিয়া তুলিয়া রায় বলিলেন, বলেন কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। খসখস চালান দিতে হবে, খসখস বোঝেন তো?

তা বুঝি, বেনাঘাসের মূল।

অচিন্ত্যবাবু পরম সন্তুষ্ট হইয়া দীর্ঘস্বরে বলিলেন, হ্যাঁ। সাঁওতাল ব্যাটারা চর থেকে তুলে ফেলে দেয়, সেইগুলো নিয়ে আমরা সাপ্লাই করব। দেখুন হিসেব করে, লাভ কত হয়।

রায় জবাব দিলেন না, খানিকট্য হাসিলেন মাত্র। অন্দরের ভিতর হইতে শাঁখ বাজিয়া উঠিল, ঈষৎ চকিত হইয়া রায় চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিয়াছে, পশ্চিমদিগন্তে অল্পমাত্রায় রক্তসন্ধ্যার আভাস থাকায় অন্ধকার তেমন ঘন হইয়া উঠিতে পারে নাই। গভীরস্বরে তিনি ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করিলেন, তারা তারা! তারপর অচিন্ত্যবাবুকে বলিলেন, তা হলে আপনি একটু নায়েবের সঙ্গে বসে গল্প করুন, আমি সান্ধ্যকৃত্য শেষ করে নিই।

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, একটি গোপন কথা বলে নিই। মানে মাংস হলেও একটুও দুধের ব্যবস্থা আমার চাই কিন্তু, ব্যাপারটা হয়েছে কি জানেন, দাঁত তুলে দিয়ে ডাক্তারেরা বলেন বটে, আর হজমের গোলমাল হবে না, আমি কিন্তু মশায়, অধিকন্তু না দোষায় ভেবে আফিং খানিকটা করে আরম্ভ করেছি। বুঝলেন, তাতেই হয়েছে কি, ওই গব্যরস একটু না হলে আবার ঘুম আসছে না।

রায় মৃদু হাসিয়া অন্দরের দিকে চলিয়া গেলেন। একজন চাকর প্রদীপ ও প্রধুমিত ধূপদানি লইয়া কাছারির দুয়ারে দুয়ারে সন্ধ্যা দেখাইয়া ফিরিতেছিল, অন্য একজন চাকর দুই-তিনটা লণ্ঠন আনিয়া ঘরে বাহিরে ছোট ছোট তেপেয়াগুলির উপর রাখিয়া দিল।

সমৃদ্ধ রায় বংশের ইতিহাস আরম্ভ হইয়াছে অন্ততঃ দুইশ বৎসর পূর্বে, হয়তো দশ-বিশ বৎসর বেশীই হইবে, কম হইবে না। তাহার পূর্বকাল হইতেই রায়েরা তান্ত্রিক দীক্ষায় পুরুষানুক্রমে দীক্ষিত হইয়া আসিতেছেন। ছোট রায়ের প্রপিতামহ অবধি তন্ত্রের একটা মোহময় প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন; আজও গল্প শোনা যায়, আমাবস্যা অষ্টমী প্রভৃতি পঞ্চ পর্বে তাঁহারা শ্মশানে গিয়া জপতপ করিতেন। তাহারাও পুর্বে কেহ একজন নাকি লতাসাধনে সিদ্ধ হইয়া ছিলেন। যুগের প্রভাবে তন্ত্রের সেই মোহময় প্রভাব এখন আর নাই। কিন্তু তবুও তন্ত্রকে একেবারে তাঁহারা পরিত্যাগ করিতে করেন নাই। ইন্দ্র রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় তন্ত্রমতে সায়ং সন্ধ্যায় বসেন, তখন গলায় থাকে রুদ্রাক্ষের মালা, কাঁধের উপর থাকে কালী-নামাবলী, সম্মুখে থাকে নারিকেলের খোলায় একটি পাত্র আর থাকে মদের বোতল ও কিছু খাদ্য-মৎস্য বা মাংস। এক-একবার নারিকেলের মালার পাত্রটি পরিপূৰ্ণ করিয়া জপতপ ও নানা মদাভঙ্গিতে তাহা শোধন করিয়া লইয়া পান করেন, করেন ধ্যান ও জপ; একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক জপ শেষ করিয়া আবার দ্বিতীয় বার পাত্র পূরণ করিয়া ওই ক্রিয়ারই পুনরাবৃত্তি করেন। এমনি ভাবে তিন বারে তৃতীয় পাত্র শেষ করিয়া তিনি সান্ধ্যকৃত্য শেষ করেন, কিন্তু ইহাতেও তাঁহার দেড় ঘন্টা হইতে দুই ঘন্টা কাটিয়া যায়, তিন পাত্রের অধিক তিনি সাধারণত পান করেন না।

হেমাঙ্গিনী স্বামীর সান্ধ্যকৃত্যের আয়োজন করিয়াই রাখিয়াছিলেন, ইন্দ্র রায় কাপড় বদলাইয়া আসন গ্রহণ করিতেই তিনি গৃহদেবী কালীমায়ের প্রসাদী কিছু মাছ আনিয়া নামাইয়া দিলেন। রায় বলিলেন, দেখ, অচিন্ত্যবাবুকে আজ নেমন্তন্ন করেছি, তার দুধ একটু ঘন করেই জ্বাল দিয়ে রেখো। ভদ্রলোক আফিং ধরেছেন, ঘন দুধ না হলে তৃপ্তি হবে না।

হাসিয়া হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বেশ। কিন্তু আর কাউকে নেমন্তন্ন কর নি তো? তোমার তো আবার নারদের নেমন্তন্ন!

না! রায় একটু হাসিলেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, আজ তুমি কি এত ভাবছ বল তো?

নাঃ, ভাবি নি কিছু।

রায়ের কথার সুরের মধ্যে একটা ক্ষীণ ক্লান্তির আভাস ফুটিয়া উঠিল বলিয়া হেমাঙ্গিনীর মনে হইল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কুণ্ঠিতভাবে হেমাঙ্গিনী বলিলেন, অমল ছেলেমানুষ, সে কাজটা ছেলেমানুষি করেই করেছে, সেটা

এইভাবে বাধা দিয়ে রায় বলিলেন, ও-কথা উচ্চারণ করো না হেম; তুমি কি আমাকে এমন সঙ্কীর্ণ ভাব? এই সন্ধ্যা করবার আসনে বসেই বলছি হেম, সত্যিই আমার আর কোন বিদ্বেষ নেই রামেশ্বর বা তার ছেলেদের ওপর। সুনীতির বড়ছেলে রাধারাণীর মর্যাদা রাখতে যা করেছে, তাতে রাধুর গর্ভের সন্তানের সঙ্গে তাদের কোন পার্থক্য আর থাকতে দেয় নি।

হেমাঙ্গিনী চুপ করিয়া রহিলেন, কোন উত্তর দিতে মন যেন তাঁহার সায় দিল না। রায় হাসিয়া বলিলেন, তা হলে আমি সন্ধ্যাটা সেরে নিই, তুমি নিজে দাঁড়িয়ে রান্নাবান্নাটা দেখে দাও বরং ততক্ষণ।

হেমাঙ্গিনী চলিয়া গেলেন।

রায় একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ইষ্টদেবীকে পরম আন্তরিকতার সহিত স্মরণ করিয়া ডাকিয়া উঠিলেন, তারা, তারা। সবই তোমার ইচ্ছা মা। তারপর তিনি শাস্ত্রবিধান-অনুযায়ী ভঙ্গিতে আসন করিয়া সান্ধ্যকৃত্য আরম্ভ করিলেন।

হেমাঙ্গিনীর ভুল হইবার কথা নয়। দুর্দান্ত কৌশলী হইলেও ইন্দ্র রায় হেমাঙ্গিনীর নিকট ছিলেন শান্ত সরল উদার। একবিন্দু কপটতার ছায়া কোনদিন তাঁহার মনোতল ছায়াবৃত করিয়া হেমাঙ্গিনীর দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত বা প্রতারিত করে নাই। অমল অহীন্দ্রকে নিমন্ত্রণ করিয়াছে, এ সংবাদ শুনিবামাত্র রায়ের ঐ ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিয়া সামাজিক নিমন্ত্রণ ব্যবহার বন্ধ না হইলেও, ছোট রায়-বাড়ি ও চক্রবর্তী-বাড়ির মধ্যে আহার-ব্যবহারটা রাধারাণীর নিরুদ্দেশের পর হইতে প্রকৃতপক্ষে বন্ধই ছিল। সামাজিক ক্রিয়াকলাপে দুই বাড়িই ব্রাহ্মণ কর্মচারী বা আপন আপন পূজক ব্রাহ্মণ পাঠাইয়া সামাজিক দায়িত্ব রক্ষা করিতেন।

তাহার পর অকস্মাৎ যেদিন ইন্দ্র রায়েরই নিয়োজিত ননী পাল চক্রবর্তীদের অপমান করিতে গিয়া রায় বংশেরই কন্যার অপমান করিয়া বসিল এবং সে অপমানের প্রতিশোধে চক্রবর্তী-বংশের সন্তান মহীন্দ্র তাহাকে হত্যা করিয়া ফাঁসী বরণ করিয়া লইতে প্রস্তুত হইল, সেদিন হইতে ইন্দ্র রায় যা-কিছু করিয়া আসিতেছেন, সে সমস্ত দানের প্রতিদান হিসাবেই করিয়া আসিতেছেন, অন্তত তাহার মনে সেই ধারনাই ছিল। অহীন্দ্র এখানে আসিলে জল খাইয়া যাইত বা অমল অহীন্দ্রের বাড়িতে কিছু খাইয়া আসিত, তাহার অতি অল্পই তিনি জানিতেন, বেশির ভাগই ছিল তাহার অজ্ঞাত। যেটুকু জানিতেন, সেইটুকুকে শুষ্ক শিষ্টাচার বলিয়াই গন্য করিতেন। দানের প্রতিদানে, তাহার দিকের প্রতিদানের ওজনটাই ভারী করিবার ব্যগ্রতায় তিনি চলিয়াছিলেন। আজ যে তিনি সহসা অনুভব করিলেন যে, এই চলার বেগটা তাঁহার স্বেচ্ছা-আরোপিত বেগ নয়, নিজের ইচ্ছায় নিজের বেগেই তিনি চলিতেছেন না। অপরের চালনায় তিনি চালিত হইয়া চলিয়াছেন। আপনার সমস্ত চৈতন্যকে সতর্ক করিয়া রায় চারিটি দিক চাহিয়া দেখিলেন, তারপর চাহিয়া দেখিলেন সম্মুখের দিকে। অদৃষ্টবাদী হিন্দুর মন তাঁহার, তিনি চারিদিকে কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না, কিন্তু কিছু যেন অনুভব করিলেন এবং সম্মুখের সমস্ত পথটা দেখিলেন এক রহস্যময় অন্ধকারের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য। তিনি পিছন ফিরিয়া পশ্চাতের পথের আকৃতি দেখিয়া সম্মুখের এই অন্ধকারাবৃত পথের প্রকৃতি অনুমান করিতে গিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। চক্রবর্তী-বাড়ির জীবন-পথ যেখানেই রায়-বাড়ির জীবন-পথের সহিত মিলিত হইতে আসিয়াছে, সেইখানেই একটা করিয়া ভাঙনের অন্ধকারময় খাত অতল অন্ধকূপের মত জাগিয়া রহিয়াছে।

কিন্তু উপায় কোথায়? দিক পরিবর্তন করিয়া চলিবার কথা মনে হইয়াছে; কিন্তু সেও পরম লজ্জার কথা। মনের ওজনে দান-প্রতিদানের পাল্লার দিকে চাহিয়া তিনি যে স্পষ্ট দেখিতেছেন, চক্রবর্তী-বাড়ির দানের পাল্লা এখনও মাটির উপর অনড় হইয়া বসিয়া রহিয়াছে, সন্তান সম্পদ সব যে চক্রবর্তী-বাড়ির পাল্লাটার উপর চাপাইয়াছে। সুনীতি অহীন্দ্র গভীর বিশ্বাসের সহিত সকরুণ দৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিয়া আছে তাহাদের পাওনা পাইবার প্রত্যাশায়।

জপ করিয়া শোধন-করা সূরাপূর্ণ পানপাত্র তুলিয়া পান করিয়া রায় গভীরস্বরে আবার ডাকিলেন, কালী! কালী! মা! তারপর আবার তিনি জপে বসিলেন। কিন্তু কাছারিবাড়ি হইতে অচিন্ত্যবাবুর চিলের মত তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর আসিতেছে; লোকটা কাহারও সহিত চীৎকার করিয়া ঝগড়া বা তর্ক করিতেছে। তাঁহার ভ্রূ-কুঞ্চিত  হইয়া উঠিল, পরক্ষণেই আপনাকে সংযত করিয়া প্রগাঢ়তর নিষ্ঠার সহিত সকল ইন্দ্রিয়কে রুদ্ধ করিয়া তিনি ইষ্টদেবীকে স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন।

অচিন্ত্যবাবু ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন অমল ও অহীন্দ্রের উপর। সন্ধ্যার পর তাহারা দুইজনে বেড়াইয়া আসিয়া চা পান করিতে করিতে পলিটিক্‌সের আলোচনা করিতেছিল। অচিন্ত্যবাবু নায়েবের কাছে বসিয়া অনর্গল বকিতেছিলেন, সহসা চায়ের পেয়ালা পিরিচের ঠুং ঠাং শব্দ শুনিবামাত্র তিনি সে-ঘর হইতে উঠিয়া অমলদের আসরে জাঁকিয়া বসিলেন। অমল তীব্রভাবে ইংরেজ-রাজত্বের শোষণ-নীতির সমালোচনা করিতেছিল।

অহীন্দ্র বলিল, পরাধীন জাতির এই অদৃষ্ট অমল, পরাধীনতা থেকে মুক্ত না হলে এ শোষণ থেকে অব্যাহতির উপায় নেই।

পুতুলনাচের পুতুলের মত অচিন্ত্যবাবুর মুখ চায়ের কাপ হইতে অহীন্দ্রের দিকে ফিরিয়া গেল, সবিস্ময়ে অহীন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া তিনি বলিলেন, কি? ইংরেজ-রাজত্ব তুমি উলটে দিতে চাও?

ঈষৎ হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, চাইলেও সে ক্ষমতা আমার নেই, তবে অন্তরে অন্তরে সকলেই স্বাধীনতা চায়, এটা সার্বজনীন সত্য।

তক্তপোশের উপর একটা চাপড় মারিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, নো, নো, নো-। বলিতে বলিতে উত্তেজনার চাঞ্চল্যে খানিকটা গরম চা তাঁহার কাপড়ে পড়িয়া গেল, ফলে তাঁহার বক্তব্য আর শেষ হইল না, চায়ের কাপ সামলাইতে তিনি ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন।

অমল বলিল, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন!

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, উত্তেজিত হব না? সাহেবদের তাড়িয়ে কি রাজত্ব করবে তোমরা বাপু? বলে, হেলে ধরতে পারে না, কেউটে ধরতে চায়। এমন বিচার করবার তোমাদের ক্ষমতা আছে? তোমরা আজ চাকর রাখবে, কাল তাড়াবে কুকুরের মত। কই, গভর্নমেন্টের একটা পিওনের চাকরি সহজে যাক তো দেখি! তারপর বুড়ো হলো তো পেনশান। আছে এ বিবেচনা তোমাদের?

অমল ও অহীন্দ্র এবার হাসিয়া ফেলিল।

অচিন্ত্যবাবু চটিয়া উঠিলেন, বলিলেন, হেসো না, বুঝলে, হেসো না। এই হল তোমাদের জাতের স্বভাব–বড়কে ছোট করে হাসা আর ভায়ে ভায়ে লাঠালাঠি করা। ইংরেজ হল আমাদের ভাই, তাদের লাঠি মেরে তাড়িয়ে নিজেরা রাজত্ব করবে? বাঃ, বেশ!

অমল ও অহীন্দ্র উভয়েই হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। অচিন্ত্যবাবু এবার অত্যন্ত চটিয়া উঠিয়া বলিলেন, তোমরা তো অত্যন্ত ফাজিল ছেলে হে! বলি, এমন ফ্যাকফ্যাক করে হাসছ কেন শুনি?

অমল বলিল, ইংরেজ আমাদের ভাই?

তক্তপোশের উপর প্রাণপণ শক্তিতে আবার একটা চাপড় মারিয়া অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, নিশ্চয়, সার্টেলি। ইংরেজ আমাদের ভাই, জ্ঞাতি, এক বংশ। পড়নি ইতিহাস! ওরাও আর্য, আমরাও আর্য। আরও প্রমাণ চাও? ভাষার কথা ভেবে দেখ। আমরা বাবাকে প্রাচীন ভাষায় বলি, পিতা পিত, ওরা বলে ফাদার। মার্ত মাদার, বাবা, পাপা। ভ্রাতা ব্রাদার। তফাত কোনখানে হে বাবু? আমরা ভয় পেলে বলি হরি-বোল হরি বোল, ওরা বলে হরি বল্ হরি বল্। চামড়ার তফাতটা তো বাইরের তফাত হে, সেটা কেবল দেশভেদে, জলবাতাস ভেদে হয়েছে।

তর্কটা আর অগ্রসর হইতে পারিল না, নায়েব আসিয়া বাধা দিল। বলিল, অচিন্ত্যবাবু আপনি একটি থামুন মশায়, একটি বাইরের ভদ্রলোক এসেছেন, ধনী মহাজন লোক; কি ভাববেন বলুন তো?

অচিন্ত্যবাবু মুহর্তে তর্ক থামাইয়া দিয়া ভদ্রলোক সম্বন্ধে উৎসুক হইয়া উঠিলেন, এ-ঘর ছাড়িয়া ও-ঘরে ভদ্রলোকটির সম্মুখে গিয়া চাপিয়া বসিয়া বলিলেন, নমস্কার, মহাশয়ের নিবাসটি জানতে পারি কি?

প্রতি নমস্কার করিয়া ভদ্রলোক বলিলেন, আমার বাড়ি অবশ্য কলকাতায়, তবে কর্মস্থল আমার এখন এই জেলাতেই। সদর থেকেই আমি এসেছি।

এখানে-মানে, কি উদ্দেশ্যে-যদি অবশ্য

আমি এখানে একটা চিনির কল করতে চাই। শুনেছি নদীর ওপারে একটা চর উঠেছে, সেখানে আখের চাষ ভাল হতে পারে, তাই দেখতে এসেছি জায়গাটা।

অচিন্ত্যবাবু গম্ভীর হইয়া উঠিলেন। তাঁহার বেনার মূলের ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতা অনুভব করিয়া নীরবে গম্ভীর মুখে বসিয়া রহিলেন। নায়েব বলিল, আপনি বসুন একটু, আমি দেখি, কর্তাবাবুর সন্ধ্যা শেষ হয়েছে কিনা।

নায়েব বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া ডাকিলেন, মা!

হেমাঙ্গিনী মাথার ঘোমটা অল্প বাড়াইয়া দিয়া ঘর হইতে বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, কিছু বলছেন?

আজ্ঞে, কর্তাবাবুর সন্ধ্যা শেষ হয়েছে?

তা হয়ে থাকবে বৈকি। কোনও দরকার আছে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, একটি ভদ্রলোক এসেছেন, চক্রবর্তী-বাড়ির ওই চরটা দেখবেন। তিনি একটা চিনির কল বসাবেন। আমাদের এখানে এসে উঠেছেন।

ও। আচ্ছা, আমি খবর দিচ্ছি, আপনি যান। চা জলখাবারও পাঠিয়ে দিচ্ছি।

নায়েব চলিয়া গেল। হেমাঙ্গিনী চায়ের জল বসাইয়া দিতে বলিয়া উপরে উঠিয়া গেলেন। অর্ধেকটা সিঁড়ি উঠিয়াই তিনি শুনিতে পাইলেন মৃদুস্বরে রায় আজ গান গাহিতেছেন- সকলই তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি। তিনি একটু বিস্মিত হইয়া গেলেন, গান তো রায় বড় একটা গান না। অভ্যাসমত তিন পাত্র ‘কারণ’ পান করিলে তিনি কখনও এতটুকু অস্বাভাবিক হন না। পর্ব বা বিশেষ কারণে তিন পাত্রের অধিক পান করিলে কখনও কখনও গান গাহিয়া থাকেন। হেমাঙ্গিনী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, সম্মুখে সুরাপূর্ণ পাত্র রাখিয়া রায় মৃদুস্বরে গান গাহিতেছেন। তিনি বেশ বুঝিলেন, সন্ধ্যা শেষ হইয়া গিয়াছে, রায় আজ নিয়মের অতিরিক্ত পান করিতেছেন। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, এ কি? সন্ধ্যে তো হয়ে গেছে, তবে যে আবার নিয়ে বসেছ?

মত্ততার আবেশমাখা মৃদু হাসি হাসিয়া রায় হাত দিয়া পাশেই স্থান নির্দেশ করিয়া দিয়া বলিলেন, বস বস। মাকে ডাকছি আমার। আমার সদানন্দময়ী মা। তিনি আবার পূর্ণপাত্র তুলিয়া লইলেন।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ওই শেষ কর। আর খেতে পাবে না।

রায় বলিলেন, আজ আনন্দের দিন। চক্রবর্তী-বাড়ি আর রায়-বাড়ির বিরোধের শেষ কাঁটাও আজ মা তুলে দিলেন। আনন্দ করব না? পাঁচ হয়েছে সাত শেষ করব হেম, সাত-পাঁচ ভাবা আজ শেষ করে দিলাম।

বলিয়া হেমাঙ্গিনীর মুখের সম্মুখে হাত নাড়িয়া আবার গান ধরিলেন, সকলই তোমার ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি।

<

Tarasankar Bandyopadhyay ।। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়