চিনির কল ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটির নাম বিমলবাবু। বিমলবাবু পরদিন সকালে গিয়া চর দেখিয়া আসিলেন। রাত্রের মধ্যে বান অনেক কমিয়াছে, তবুও চরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখনও জলমগ্ন; সেই অবস্থাতেই তিনি চরটি দেখিয়া খুশি হইয়া উঠিলেন। সকলের চেয়ে বেশী খুশি হইলেন তিনি সাঁওতালদের দেখিয়া। ছোট রায় বাড়ির নায়েব মিত্তির ছিল তাঁহার সঙ্গে, বিমলবাবু মিত্তিরকে বলিলেন, অদ্ভুত জাত মশায় এরা, যেমন স্বাস্থ্য, তেমনি কি খাটে! আমাদের দেশী লোকের মত নয়, ফাঁকি দেয় না।

মিত্তির মৃদু হাসিয়া বিমলবাবু অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞতার পরিচয় দিয়া বলিল, তাও অনেক ফাঁকি দিতে শিখেছে মশায়, আজকাল। ধীরে ধীরে শিখছে, বুঝলেন না? যখন ওরা প্রথম এল এখানে, তখন একটা লোকে যা কাজ করত, এখন সেই কাজ করে দুটো লোকে; দেড়টা লোক তো লাগেই।

বিমলবাবু ব্যবসায়ী লোক, কয়েকটি কলের মালিক, শ্রমিক মজুরদের সম্বন্ধে তাঁহার অভিজ্ঞতা প্রচুর। তাহার উপর তিনি উচ্চশিক্ষিত বৈজ্ঞানিক; মিত্তিরের কথা শুনিয়া তিনি একটু হাসিলেন, বলিলেন, কিন্তু এখনও ওরা একজন যা করে, সে-কাজ করতে আমাদের দেশী লোক অন্তত দেড়টা লাগে। দুটোই বলতাম, তা আপনার ভয়ে দেড়টাই বলছি।

মিত্তির আবার সন্তোষের হাসি হাসিল। বিমলবাবু তাহাকে ভয় করিয়া কথা বলিতেছেন, এইটুকু তার বেশ ভালই লাগিল। হাসিয়া বিমলবাবুর কথা মানিয়া লইয়া সে এবার বলিল, তা বটে।

বিমলবাবু বলিলেন, চলুন, একবার ওদের পাড়ার মধ্যে যাওয়া যাক। একটু আলাপ করে রাখা যাক। কল চালাতে হলে ওদের না হলে তো চলবে না।

শ্রীবাসের দোকানের সম্মুখ দিয়াই পথ, দোকানের সম্মুখে আসিয়াই মিত্তির বলিল, ওরে বাপ রে। এখানেই যে সব ভিড় লাগিয়ে রয়েছিস মাঝিরা! কি করছিস সব এখানে?

শ্রীবাসের দোকানে বসিয়া মাঝিরা বাকির খাতায় টিপ-সহি দিতেছিল। শ্রীবাস একটি হুঁকা হাতে বসিয়া সমস্ত দেখিয়া লইতেছিল। মিত্তির ও অপরিচিত বিমলবাবুকে দেখিয়া সে শঙ্কিত হইয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি হুঁকাটি রাখিয়া উঠানের পথে নামিয়া আসিল, অর্ধনত হইয়া একটি নমস্কার করিয়া বলিল, পেনাম। তারপর, মিত্তির মশায়, কোন দিকে? এই বনের মধ্যে? আর এই বাবুটি?

মিত্তির হাসিয়া বলিল, ইনি হলেন কলকাতার লোক, এসেছেন চর দেখতে। এখানে একটা চিনির কল করবেন। তাই এসেছিলাম ওঁকে সঙ্গে নিয়ে। তারপর তোমার এখানে এত ভিড় কিসের?

চিনির কল করবেন? বিস্ময়ে শ্রীবাসের চোখ দুইটা বিস্ফারিত হইয়া উঠিল।

চিনির কলও হবে, সঙ্গে সঙ্গে আখের চাষও হবে। কিন্তু আপনার নামটা কি? দোকানটি আপনার? বিমলবাবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শ্রীবাসের মুখের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন।

শ্রীবাসের মুখ কঠিন অসন্তোষে শুষ্ক হইয়া উঠিল, সে বলিল, কল কি এখানে চলবে আপনার? এত আখ পাবেন কোথা?

বিমলবাবু হাসিয়া বলিলেন, কল হলেই চারিদিকে আখের চাষ বেড়ে উঠবে। দোকান আপনার খুব ভাল চলবে দেখবেন। তার ওপর জমিও বোধ হয় আছে আপনার এখানে, তাতেও আরম্ভ করুন আখের চাষ। কল আপনাদের অনিষ্ট করবে না, ভালই করবে। ভাল কথা, এখানে এবারেই আমার পনেরো লাখ ইঁট হবে। আপনার তো দোকান এই চরের ওপরেই? আমার অনেক কুলী আসবে শহর থেকে ইঁট তৈরী করবার জন্যে, দু মাসের মধ্যেই এসে পড়বে, দোকান আপনি বাড়িয়ে ফেলুন।

শ্রীবাসের মুখ ধীরে ধীরে কোমল ও উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, সে এবার বলিল, তা আপনাদের মত ধনী যেখানে আসবে, সেখানে তো দশের অবস্থা ভালই হবে। দোকান আমি হুকুম হলেই বাড়াব। আর দেখতে শুনতে যা-হয় আমিই সব দেখে-শুনে দেব। এই দেখুন এইসব সাঁওতাল বেবাক আমার তাঁবে। আমার কাছেই ধান খায় বছর বছর। এক নেয়, এক দেয়। ওদের সঙ্গে খুব সুখ আমার। লোকজন যা দরকার হবে, সব আমি ঠিক করে দেব।

মিত্তির বলিল, আজকে এত ভিড় কিসের হে?

আজ্ঞে আজ ওদের ‘রোয়া’ পরব। মানে, চাষের জল তো লেগে গেল, তা ধান রুইবার আগে ওরা পুজো-টুজো দেবে। তারপর চাষে লাগবে। তাই সব জিনিসপত্তর নিচ্ছে, আর খোরাকির ধানও নিচ্ছে।

বিমলবাবু বলিলেন, তাই নাকি, আজ ওদের পর্ব? তা হলে বড় ভাল দিনে এসে পড়েছি। বাঃ! কই ওদের সর্দার কই?

সাঁওতালদের সমস্ত দলটি নীরবে বসিয়া এক বিচিত্র দৃষ্টিতে বিমলবাবুকে দেখিতেছিল, বিস্ময়, ভয়, শ্রদ্ধা, সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছু সে দৃষ্টির মধ্যে প্রকাশ পাইতেছিল। বিমলবাবুর আহ্বানেও কমল সাড়া দিল না, তাহার প্রকাণ্ড দেহ লইয়া সে বিমলবাবুকে দেখিয়া খানিকটা নড়িয়া চড়িয়া বসিল মাত্র, শ্রীবাস ব্যস্ত হইয়া উঠিল, সম্ভ্রম ও সাঁওতালদের উপর আধিপত্য দুইই একসঙ্গে দেখাইয়া বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠস্বরে বলিল, কমল মাঝি, কানে তোর ঢুকছে না, না কি? এইদিকে আয়। কত বড়লোক ডাকছেন, দেখছিস না?

কমল এবার উঠিয়া ধীরে ধীরে আসিয়া নত হইয়া প্রণাম জানাইয়া বলিল, কি বলছিস আপুনি?

 হাসিয়া বিমলবাবু পরিষ্কার সাঁওতালী ভাষায় বলিলেন, তুমি এখানকার সর্দার?

উপবিষ্ট সাঁওতালদের বিস্ময়ের সীমা রহিল না, তাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠিল, এই, এই, বাবু আমাদের কথা বুলছে, আমাদের কথা বুলছে! উ বাবা রে!

বিমলবাবু সাঁওতালীতেই বলিলেন, হ্যাঁ, তোমাদের ভাষাতেই কথা বলছি আমি।

কমল ভাঙা ভাঙা বাংলাতেই প্রশ্ন করিল, আমাদের ভাষা আপুনি কি করে জানলিন বাবু?

 আমার কাছে অনেক সাঁওতাল কাজ করে। আমার তিনটে কল আছে। কল বুঝিস তো?

হঁ হঁ। আপুনি চলে, খুব ধুঁয়া উঠে হিসহিস করে। একটো এই মোটা, এই বড় লোহার চোঙা থেকে ধুঁয়া উঠে, গুমগুম শব্দ উঠে। বয়লা চলে, রিঞ্জি চলে

হ্যাঁ। বয়লার-এঞ্জিনে কাজ হয় কলে। এখানেও একটা কল করব আমি। তোরা সব কাজ করবি। তারপর, আজ তোদের রোয়া পরব বটে, নয়?

কমলের বড় বড় হলুদ রঙের দাঁতগুলি বাহির হইয়া পড়িল, বলিল, তাই তো করছি গো। জল তো অনেক হয়ে গেল। বীজ চারা-গুলান বড় হইছে, আর বসে থেকে কি হবে?

ঠিক ঠিক। তা, চিত কোপে জম গ্রুয়া? আজ কি খাওয়া দাওয়া হবে রে, অ্যাঁ?

 হাসিয়া কমল এবার নিজের ভাষাতেই বলিল, জেল, দাকা, হাণ্ডি।

ওঃ তা হলে তো আজ ভোজ রে তোদের। মাংস, ভাত, পচুই-অনেক ব্যাপার যে! কত হাণ্ডি করেছিস?

সলজ্জভাবে কমল বলিল, করলম, তা মেলাই হবে গো। মেয়েগুলো খাবে, আমরা খাব, তবে তো আমোদ হবে।

ঠিক ঠিক। তা বেশ! এই নে, আজ তোদের পরবের দিন, খাওয়া-দাওয়া করবি।– বলিয়া মানিব্যাগ বাহির করিয়া ব্যাগ হইতে একখানি নোট বাহির করিয়া কমলের হাতে দিলেন। কমল সন্তর্পণে নোটখানির দুই প্রান্ত দুই হাতের আঙুল দিয়া ধরিয়া সবিস্ময়ে নোট খানার ছাপের দিকে চাহিয়া রহিল।

বিমলবাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, ‘গেল টাকা, দশ টাকা পাবি ওটা দিলে।

সমস্ত দলটি সবিস্ময়ে কলরব করিয়া উঠিল।

বিমলবাবু হাসিয়া মিত্তিরকে বলিলেন, চলুন তাহলে এবার। আসি এখন দোকানী মশায়। চললাম রে মাঝি।

কমল বলিল, হঁ হঁ, আসুন গা আপনি। খাটব, আপোনার কলে আমরা খাটব।

সাঁওতাল পল্লীর মাঝখান দিয়া পরিচ্ছন্ন মেটে পথটি এই কয় দিনের প্রচণ্ড বর্ষণে ধুইয়া মুছিয়া পরিষ্কার হইয়াই ছিল; তাহার উপর পর্ব উপলক্ষে মেয়েরা পথের উপর ঝাঁটা বুলাইয়েছে। প্রত্যেক বাড়ির দুয়ারে মুখে মুখে একটি করিয়া মাডুলি দিয়াছে। আপনাদের উঠানে মেয়েগুলি আজ খুব ব্যস্ত। তৎপরতার সহিত কাজ করিয়া ফিরিতেছে। ছোট ছোট মেয়েগুলি আঁচলে ভরিয়া শাক সংগ্রহ করিয়া বেড়াইতেছে। আজিকার পর্বে শাক একটা প্রধান উপকরণ।

চলিতে চলিতে মিত্তির বিকৃত মুখে বার বার জোরে জোরে নিঃশ্বাস টানিতে টানিতে বলিল, উঃ, মদে আজ ব্যাটারা বান ডাকিয়ে দেবে। পচুঁইয়ের গন্ধ উঠছে দেখুন দেখি।

বিমলবাবু বলিলেন, প্রত্যেক বাড়িতে মদ তৈরি হচ্ছে আজ। পরব কিনা। পরবে ওরা কখনও দোকানের মদ কিনে খায় না; দোকানের মদ হল অপবিত্র। আর তা ছাড়া পয়সাও লাগবে বেশি। মদের কথা বলিতে বলিতেই বিমলবাবুর যেন একটা জরুরী কথা মনে পড়িয়া গেল। কথার স্বরে ও ভঙ্গিমায় গুরুত্ব আরোপ করিয়া তিনি বলিলেন, ভাল কথা, এখানে পচুঁইয়ের দোকান সবচেয়ে কাছে কোথায় বলুন তো?

মিত্তির বিস্ময় বোধ করিয়াও না হাসিয়া পারিল না। হাসিয়া বলিল, হঠাৎ পচুঁইয়ের দোকানের খোঁজ?–বলিয়াই হঠাৎ মিত্তির বিমলবাবুর মতলবটা অনুমান করিয়া লইল, বলিল, বুঝেছি, মেয়া চাই। মাছধরার বাতিক কি কলকাতার বাবুদেরই সবারই মশায়? তা আমার বাবুর পুকুরে খুব বড় বড় মাছ, এক-একটা আঠারো সের, বিশ সের, বাইশ সের।

বিমলবাবু বলিলেন, না, মাছ ধরবার জন্য নয়। আমার কুলী আসবে এখানে। পগমিল, বক্স মোল্ডিঙের লোক তো এখানে মিলবে না। অন্তত ষাট-সত্তরজন কুলী আসবে। পচুঁইয়ের দোকান কাছে না থাকলে তো অসুবিধা হবে।

বার বার ঘাড় নাড়িয়া ব্যাপারটা উপলব্ধি করিয়া মিত্তির বলিল, অ্যাই দেখুন, এই নইলে কি পাকা ব্যবসাদার হওয়া যায়? বটে, মশায় বটে! দৃষ্টি রাখতে হবে চারিদিকে। তা, পচুঁইয়ের দোকান একটু দূরেই হবে। ক্রোশ দুয়ের কম নয়।

বিমলবাবু পকেট হইতে নোটবই বাহির করিয়া সেইখানে দাঁড়াইয়াই কথাটি নোট করিয়া লইলেন এবং তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, একটা দোকান স্যাংশন করিয়ে নেব এইখানেই। কল হলে তো চাই-ই। তা, আগে থেকেই ব্যবস্থা করে নেব।

পথের ধারেই একটি ঘনপল্লব কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায় কতকগুলি সাঁওতালদের মেয়ে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। গাছটির গোড়ায় সুন্দর একটা মাটির বেদী ও বেদীর চারিপাশে খানিকটা জায়গা গোবর ও মাটি দিয়া অপূর্ব পরিচ্ছন্নতার সহিত নিকানো; বেদীটির চারিদিক খড়িমাটির আলপনা দিয়া চিত্রিত করিয়া তোলা। মেয়েগুলো তখনও সমুখের নিকানো জায়গাটির উপর খড়িমাটির গোলা দিয়ে আলপনার ছবি আঁকিতেছিল পাখী ও পশুর ছবি, তাহার পাশে পাশে খেজুরগাছের ডালপালা, ধানগাছের ছবি; একটি মেয়ে আলপনার সাদা রেখার মধ্যে মধ্যে সিঁদুরের লাল টোপা দিতেছিল। দিতে দিতে মৃদুস্বরে সকলে মিলিয়া পর্বের কল্যাণী-গান গাহিতেছিল

ঠাকুরাহি সিরিজিলা ইনা পিরথিমা হো,
ঠাকুরাহি সিরিজিলা গাইয়া জো ইয়ারে,
পুরুবাহি ডাহারালি গাইয়া জো ইয়ারে,
পুরুবাহি ডাহারালি-গাইয়া জো

 বিমলবাবু মৃদু হাসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন; তাহাদের আলোচনা বন্ধ হইয়া গেল। মেয়েদের দলও সবিস্ময়ে তাহাদের দিকে চাহিয়া রহিল, তাহাদেরও গান মৃদু হইতে মৃদুতর হইয়া আসিয়া ছিল। বেশির ভাগ মেয়েরাই গান বন্ধ করিয়া দিয়াছিল, গাহিতেছিল কেবল দুই-একজন প্রবীণা। মাঙ্গলিক গান তাহারা বন্ধ করিবে কি করিয়া?

মিত্তির বলিল, চলুন, চলুন।

মেয়েদের দল হইতে সেই দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি, কমল মাঝির নাতনী সারী, আগাইয়া আসিয়া বলিল, একটি ধার দিয়ে যা গো বাবুরা। ই-ঠিনে আমাদের পুজো হবে।

কতকগুলো ছেলে মাথায় ফুলওয়ালা। গোটাকয়েক লালরঙের মোরগের পায়ে দড়ি বাঁধিয়া ধরিয়া বসিয়া আছে। মহা উৎসাহ তাহাদের; আপনাদের ভাষায় অতিমাত্রায় মুখর পাখীর মত একসঙ্গে পাখীর মত কলরব করিয়া বকিয়া চলিয়াছে। মিত্তির বলিল, ওরে বাপ রে। এতগুলো মুরগী আজ তোরা খাবি নাকি?

সারী বলিল, কেনে, উ কথা বুলছিস কেনে? তুর লোভ হচ্ছে নাকি?

মিত্তির বৈষ্ণব মানুষ, সে ঘৃণায় থুথু ফেলিয়া বলিয়া উঠিল, রাম রাম রাম। অ্যাঁ, ই হারামজাদা মেয়ে বলে কি গো?

সারী বলিল, তবে তু খাবার কথা বুলছিস কেনে? উ আমরা দেবতাকে দিব। কাটব এই দেবতা-থানে। তারপর কুটিকুটি করে একটি মাটিতে পুঁতব, আর সবগুলা বাঁধব। আগে থেকে খাবার কথা তু বুলছিস কেনে?

মিত্তির মুখ বিকৃত করিয়া বলিল, চলুন মশায়, চলুন, আমার গা ঘিনঘিন করছে।

বিমলবাবু দেখিতেছিলেন সারীকে। চলিবার জন্য পা বাড়াইয়া তিনি বলিলেন, বাঃ, মেয়েটির দেহখানি চমৎকার, tall, graceful,–youth personified.

সারী ভ্রূ-কুঞ্চিত করিয়া বলিল, কি বুলছিস তু উ-সব?

মৃদু হাসিয়া বিমলবাবু অগ্রসর হইয়া গেলেন, কথার কোন উত্তর দিলেন না। নদীর পারঘাটের পাশেই অপেক্ষাকৃত বড় বড় সাঁওতাল ছেলেগুলি গরু-মহিষগুলিকে পরিপাটি করিয়া স্নান করাইতেছিল কয়টা ছেলে আজও লম্বা লাঠি লইয়া জলের ধারের গর্তগুলিতে খোঁচা দিয়া শিকারের সন্ধান করিয়া ফিরিতেছে।

***

মিত্তির ও বিমলবাবু চলিয়া যাইতেই শ্রীবাস গম্ভীর চিন্তান্বিত মুখে দোকানের সামনে ঘুরিতে আরম্ভ করিল। এখানে চিনির কল হইবে। চরখানা বাড়িঘর লোকজনে ভরিয়া যাইবে। হ্যাঁ, দোকানটা বড় করিতেই হইবে। বর্ষার শেষেই একখানা লম্বা তিনকুঠারী ঘর আরম্ভ করিয়া দেওয়া চাইই। ঘরের বনিয়াদ ও মেঝেটা পাকা করিলেই ভাল হয়। যে ইঁদুরের উপদ্রব! ওই বাবুর ইঁট তো অনেক হইবে, পনেরো লাখ। তাহা হইতে ভাঙা চোরা যাহা পড়িয়া থাকিবে, তাহাতেই তো একটা প্রকাণ্ড দালান তৈয়ারি হইতে পারিবে। আর লোকজনের সঙ্গে একটু যাহাকে বলে সুখ, সেই সুখ থাকিলে- সঙ্গে সঙ্গে শ্রীবাসের ঠোঁটের ডগায় অতি মৃদু। একটি হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিল। পরমুহর্তেই আবার সে গম্ভীর হইয়া পড়িল। আঃ, আরও খানিকটা জমি যদি সে দখল করিয়া রাখিত! জমির দাম হু-হু করিয়া বাড়িয়া যাইবে। দুই শ আড়াই শ টাকা বিঘে তো কথাই নাই!

সাঁওতালদের দল শ্রীবাসের অপেক্ষাতেই বসিয়াছিল, তাহাদের কাজ-কর্ম বন্ধ হইয়া রহিয়াছে। হিসাবের খাতায় টিপছাপ দিবার পর ধান মাপা হইবে। ওদিকে ‘রোয়া’ পর্বের সমারোহ তাহাদের বর্বর মনকে মুহুর্মুহু আকর্ষণ করিতেছে। তাহারা ক্রমাগত নড়িয়া চড়িয়া বসিতেছিল, আর ব্যাগ্রদৃষ্টিতে শ্রীবাসকে লক্ষ্য করিতেছিল। তাহার উপর এই আকস্মিক টাকা প্রাপ্তিতে পর্বটা আরও রঙিন হইয়া উঠিয়াছে। চূড়া, সেই কাঠের পুতুলের ওস্তাদ রসিক সাঁওতালটি, দেখিয়া শুনিয়া বলিয়া উঠিল, এ বাবা গো! মোড়লের আমাদের হল কি? ডাঁশ কামড়াচ্ছে নাকি গো? এমন করে ঘুরছে কেনে? ও সর্দার! তোমার মুখ কি কেউ সেলাই করে দিলে নাকি?

কমল এবার ডাকিল, মোড়ল মশায় গো!

শ্রীবাস ঈষৎ চকিত হইয়া বলিল, কি? ও যাই। সে ফিরিয়া তক্তপোশের উপর বসিল। কমল বলিল, লেন গো, টিপছাপগুলা লিয়ে লেন গো! ইয়ার বাদে আবার ধান মাপতে হবে।

হুঁ। হিসাবের খাতাটা কোলের কাছে টানিয়াই শ্রীবাসের মাথার মধ্যে একটা কথা বিদ্যুৎ চমকের মত খেলিয়া গেল। জমির দাম বাড়িবে। টিপছাপ খাতায় না লইয়া একেবারে বন্ধকী দলিল করিয়া লইলে;– কিন্তু বর্বরের দল বড় সন্দিগ্ধ। আবার একটা গোঁ ধরিয়া অবুঝের মত বলিবে, কেনে গো, উটিতে ছাপ কেনে দিব গো? তু যে বুললি, খাতাতে ছাপ দিতে হবে। পরমুহূর্তেই সে দোয়াতটা খাতার উপর উলটাইয়া ফেলিল এবং আঁতকাইয়া বলিয়া উঠিল, যা সর্বনাশ হল।

সাঁওতালদের দলও অপরিসীম উদ্বিগ্ন হইয়া বলিয়া উঠিল, যাঃ।

শ্রীবাসের ছেলে বাপকে তিরস্কার করিয়া বলিল, কি করলে বল তো? হল তো! যাক্, ও পাতাখানা বাদ

বাধা দিয়া শ্রীবাস অত্যন্ত দুঃখিত ভঙ্গিতে বলিল, উঁহু। এক কাজ কর, বোঁ করে ও-পারে ভেণ্ডারের কাছ থেকে ডেমি নিয়ে আয় খান-পঁচিশেক। তারপর খাতা বেঁধে নিলেই হবে।

শ্রীবাসের ছেলে গনেশ এবার ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল, বলিল, তুমি ক্ষেপেছ নাকি? ডেমিতে কে কোনকালে খাতা করে, শুনি?

দুরন্ত ক্রোধে অদ্ভুত দৃষ্টিতে বিকৃত মুখে শ্রীবাস গণেশের দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল, তোকে যা করতে বলছি, তাই কর। যা, এখুনি যা, যাবি আর আসবি।–বলিয়া বাক্স খুলিয়া টাকা বাহির করিয়া ফেলিয়া দিল।

সাঁওতালেরা বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া শ্রীবাসের মুখের দিকে চাহিয়া ছিল, শ্রীবাস গম্ভীরমুখে উঠিয়া বলিল, টিপছাপ পরে হবে মাঝি, গণেশ কাগজ নিয়ে আসুক। ততক্ষণে তোরা আয়, বাখার ভেঙে ধানটা মেপে ঠিক করে রাখ। তোদের সব আজ আবার পরব আছে।

সাঁওতালেরা এ কথায় খুশি হইয়া উঠিল। কমল বলিল, নাঃ, মোড়ল বড় ভাল লোক, বিবেচনা আছে মোড়লের।

চূড়া মাঝি ভ্রূ নাচাইয়া বলিল, কিন্তু ভারি বেকুব হয়ে গিয়েছে মোড়ল কালিটা ফেলে। ছেলের উপর রাগ দেখলি না।

চূড়ার ব্যাখ্যায় সকলেই ব্যাপারটা সকৌতুকে উপভোগ করিয়া খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। সত্যিই মোড়ল বড় বেকুব হইয়া গিয়াছে।

দেখিতে দেখিতে খড়ের তৈয়ারী মোটা দড়া জড়াইয়া বাঁধা বাখারটা ভাঙিয়া স্তুপাকার করিয়া ধান ঢালা হইল। হুস-হাস করিয়া টিন-ভর্তি ধান মাপিয়া মাপিয়া ফেলা হইতে লাগিল। শ্রীবাস ধানের মাপের সঙ্গে হাঁকিতে আরম্ভ করিল- রাম-রাম, রাম-রাম, রাম-রামে দুই-দুই, দুই-রামে-তিন তিন।

চূড়া এক পাশে বসিয়া একটা কাঠি লইয়া মাপের সঙ্গে সঙ্গে একটা করিয়া দাগ দিয়া সাঁওতালদের তরফ হইতে হিসাব করিয়া যাইতেছিল।

.

২২.

এ দিকে গ্রামের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড জটলা পাকাইয়া উঠিল। সকাল হইতে না হইতে গ্রামের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত রটিয়া গেল, ও-পারের চরের উপর চিনির কল বসিতেছে। খাস কলিকাতা হইতে এক ধনী মহাজন আসিয়াছেন, তিনি সঙ্গে আনিয়াছেন প্রচুর টাকা-ছোট একটি ছালায় পরিপূর্ণ এক ছালা টাকা। সঙ্গে সঙ্গে রায়বংশের অন্য সমস্ত শরিকেরা একেবারে লোলুপ রসনায় গ্রাস বিস্তার করিয়া জাগিয়া উঠিল। অপরদিকে উর্বর-জমি-লোলুপ চাষীর দল বাঘের গোপন পার্শ্বচর শৃগালের মত জিভ চাটিতে চাটিতে চঞ্চল হইয়া উঠিল। সর্বপ্রথম নবীন বাগদীর স্ত্রী মতি বাগদিনী শিশু পৌত্রকে কোলে করিয়া চক্রবর্তী-বাড়ির অন্দরের উঠানে আসিয়া দাঁড়াইয়া চোখ মুছিতে আরম্ভ করিল।

সংবাদটা শুনিয়া রংলাল বাড়ি ফিরিয়া অকারণ স্ত্রীর সহিত কলহ করিয়া প্রচণ্ড ক্রোধে লাঠির আঘাতে রান্নার হাঁড়ি ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দিল। তারপর স্তব্ধ হইয়া মাটির মূর্তির মত বসিয়া রহিল।

মনের আক্ষেপে অচিন্ত্যবাবুর সমস্ত রাত্রি ভাল করিয়া ঘুম হয় নাই। ফলে-অতিপুষ্টিকর শশক-মাংস বদহজম হেতু নানা গোলমালের সৃষ্টি করিয়াছিল। ভদ্রলোক অন্ধকার থাকিতে থাকিতে বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া ঢক ঢক করিয়া এক গ্লাস জল ও খানিকটা সোডা খাইয়া মর্নিং ওয়াকের জন্য বাহির হইয়া পড়িলেন। খুব জোরে খানিকটা হাঁটিয়া তিনি সম্মুখে ভরা কালিন্দীর বাধা পাইয়া দাঁড়াইয়া গেলেন। ও-পারের চরটা অন্ধকারের ভিতর হইতে বর্ণে বৈচিত্রে সম্পদে অপরূপ হইয়া প্রকাশ পাইতে আরম্ভ করিয়াছে; গভীর তমিস্রাময়ী কালী যেন কমলা রূপে রূপান্তরিত হইতেছেন।

অচিন্ত্যবাবু লক্ষ্য করিতেছিলেন, বেনাঘাসের গাঢ় সবুজ ঘন জঙ্গল চরের এ-প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। উঃ, রাশি রাশি খসখস ওই ঘন সবুজ আস্তরনের নীচে লুকাইয়া আছে। খেয়াঘাটের ঠিকাদার ঠিক এই সময়েই ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইল। অচিন্ত্যবাবুকে দেখিয়া সে একটি প্রণাম করিয়া বলিল, আজ আজ্ঞে, ভাগ্যি আমার ভাল পেভাতেই ব্রাহ্মণদর্শন হল। এই ঘাট নিয়ে বুঝলেন কিনা, কত যে জাত-অজাতের মুখ সকালে দেখতে হয়! এ কাজ আপনার অতি পাজী কাজ মশায়। তবে দুটো পয়সা আসে, তাই বলি

অসমাপ্ত কথা সে আকর্ণ-বিস্তার হাসিয়া সমাপ্ত করিল

অচিন্ত্যবাবু আবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন লাভ এবার তোমার ভালই হবে, বুঝলে কিনা ও-পাররের চরে কল বসছে, চিনির কল। লোকজনের আনাগোনা দেখতে দেখতে বেড়ে যাবে তোমার।

ঠিকাদার সবিস্ময়ে অচিন্ত্যবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কল? চিনির কল?

হ্যাঁ, চিনির কল। কাল কলকাতা থেকে মস্ত এক মহাজন এসেছে, সঙ্গে একটি ছালা টাকা। আমি নিজের চোখে দেখেছি। কাল আমার ছোট রায়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল কিনা।

ঠিকাদার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, ই টাকা কে পাবে? চরটা তো চক্কবর্তী-বাড়িরই সবাই বলছে; তা ছোট রায় মশায়ের বাড়িতে

ছোট রায় মশায়ই আজকাল ওদের কর্তা। উনি সব দেখাশোনা করছেন যে।

বার বার ঘাড় নাড়িয়া ঠিকাদার বলিল, বটে, আজ্ঞে বটে। তা দেখলাম কাল, এইখানেই চক্কবর্তী বাড়ির ছোটকা আর রায় মশায়ের ছেলে বসে ছিল অ্যানেকক্ষণ; খুব ভাব দেখলাম দুজনায়। অ্যানেক কথা হল দুজনায়।

হুঁ। অচিন্ত্যবাবু খুব গম্ভীর হইয়া বলিলেন, হুঁ। আচ্ছা, কি কথা দুজনায় হচ্ছিল বল তো? কথা? স্বদেশীর কথা? মানে, সায়েবদের তাড়াতে হবে, বন্দেমাতরম্‌, মহাত্মা গান্ধীকি জয়, এই সব কথা হচ্ছিল?

আজ্ঞে না। আমি তো দূরে বসে ছিলাম। খুব খানিক কান বাজিয়ে শুনলাম; কাল কথা হচ্ছিল আজ্ঞে, আমি আঁচে বুঝলাম, কথা হচ্ছিল আপনার, আচ্ছা উমা কার নাম বলেন তো? এই ছোট রায়ের ঝিউড়ী মেয়ে লয়?

হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি তাকে পড়াতাম যে! বলিতে বলিতেই অচিন্ত্যবাবুর ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, বলিলেন, মেয়েটাকে কলকাতায় পাঠিয়ে ধিঙ্গী করে তুললে। ছোট রায় বাইরে বাঘ, আর ভেতরে একেবারে শেয়াল বুঝলে কিনা, গিন্নীর কাছে একেবারে কেঁচো। মেয়েকে যে ভয় করে, তাকে আমি ঘেন্না করি, বুঝলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। তা, কাল আপনার ছোট রায়ের ছেলে চক্কবর্তী-বাড়ির ছোটকাকে ধরেছিল, বলে, তোমাকে তাকে বিয়ে করতে হবে।

বল কি?-অচিন্ত্যবাবু একেবারে তীরের মতো সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন। উপলব্ধি করার ভঙ্গিতে বার বার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ঠিক কথা। ইন্দ্র রায়ের মতলব এতদিন ঠাওর করতে পারছিলাম না। হুঁ। অহীন্দ্র ছেলেটি যে হীরের টুকরো ছেলে। এবারেও তোমার ফোর্থ হয়েছে ইউনিভার্সিটিতে। বটে! ঠিক শুনেছ তুমি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বয়সও হে অ্যানেকটা হল। মানুষ হাঁ করলেই বুঝতে পারি, কি বলবে। তা ছাড়া আপনার, রায় মশায়ের বুন। কুলের খুঁত ধরতে তো লোকে রায় মশায়েরই ধরবে।

ওরে বাপ রে বাপ রে! এই দেখ, কথাটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। তুমি তো ভয়ানক বুদ্ধিমান লোক। দেখ, তুমি ব্যবসা কর, তোমার নিশ্চয় উন্নতি হবে! আমার কাছে যাবে তুমি, তোমাকে আমি সঙ্গে নেব। বলো না যেন কাউকে, এই খসখসের ব্যবসা। খসখস বোঝ তো? খসখস হল বেনার মূল।

বেনার মূল?

হ্যাঁ। চুপ কর, সেজ রায়-বাড়ির হরিশ আসছে।

হরিশ রায় সেজ-রায়-বাড়ির একজন অংশীদার। সমস্ত রায় বংশের সিকি অংশের অধিকারী হইল সেজ তরফ, সেজ তরফের এক আনা অংশের অর্থাৎ ষোল আনা সম্পত্তির এক পয়সা রকমের মালিক হইলেন হরিশ রায়, এই এক পয়সা পরিমাণ জমিদারির অংশ লইয়া ভদ্রলোক অহরহই ব্যস্ত এবং কাজ লইয়া তাহার মাথা তুলিবারও অবসর থাকে না। কাগজের পর কাগজ তিনি তৈয়ারি করিয়া চলিয়াছেন। জমিদারির এককণা জমি যদি কেহ আত্মসাতের চেষ্টা করে, তবে তাহার আয়নার মত কাগজে তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতিবিম্ব পড়িবেই।

কানে পৈতে জড়াইয়া গাড়ু হাতে হরিশ রায় একটা দাঁতন-কাঠি চিবাইতে চিবাইতে নদীর ঘাটে আসিয়া নামিলেন। অচিন্ত্যবাবুকে দেখিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন, কি রকম, আজ যে এদিকে?

উদাসভাবে অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, এলাম,

না, মানে এদিকে তো দেখি না বড়।

হ্যাঁ। বলিয়াই হঠাৎ যেন তিনি আসিবার কারণটা আবিস্কার করিয়া ফেলিলেন; বলিলেন, চরের উপর কল বসছে কিনা, চিনির কল-সুগার মিল। তাই ভাবলাম, দেখে আসি ব্যাপারটা কি রকম হবে।

কল? চিনির কল?-হরিশ রায়ের বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। চিনির কল করবে কে মশায়? এত টাকা কার আছে?

কাল রাত্রে কলকাতা থেকে এক মস্ত মহাজন এসেছে, সঙ্গে আপনার একটি বস্তা টাকা। আমি নিজে চোখে দেখেছি-ওন আইজ। ইন্দ্র রায় মহাশয়ের ওখানে কাল আমার নেমন্তন্ন ছিল কিনা।

ইন্দ্র? তা, ইন্দ্র চর বন্দোবস্ত করছে নাকি?

হ্যাঁ। উনিই তো এখন চক্রবর্তী বাড়ির সব দেখাশুনা করছেন। তিনি ভুরু নাচাইয়া মুচকি হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, হুঁ, কোন খোঁজই রাখেন না আপনারা?

হরিশ রায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়া ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, এই দেখুন, এমন খোঁজ নাই যা হরিশ রায়ের কাগজে নাই। বুঝলেন, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমল থেকে ‘থাক’, নক্সা, জমাবন্দী, জরিপী, খতিয়ান, জমাওয়াশীল-বাকি সব আমার কাছে। কি বলব, পয়সা তেমন নাই হাতে, তা নইলে ‘চাকচান্দী’ লাগিয়ে দিতাম আমি। আর অন্যায় অধর্মও করতে চাই না আমি! যদি একটা কলম আমি খুঁচি, সব ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়বে। দেখি না, হোক না বন্দোবস্ত। আমরা এতদিন চুপ করেই ছিলাম, বলি চক্কবর্তীরা আমাদেরই দৌহিত্র, তা খাচ্ছে খাক। কিন্তু এ তো হবে না মশায়। উঁহু!

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, সে আপনারা যা করবেন করুন গে মশাই। চর তো আজই বন্দোবস্ত হচ্ছে।

হাসিয়া হরিশ বলিলেন, দেখুন না, বেবাক কাগজ আজ বার করছি। একেবারে কড়া ক্রান্তি, মায় ধুল পর্যন্ত মিলিয়ে দেখিয়ে দেব চর কার।

অচিন্ত্যবাবু এত সব শুনিতে ভাল লাগিতেছিল না। তাঁহার মন তখন ভীষণ উত্তেজনার ভরিয়া উঠিয়াছে। উঃ, ভিতরে ভিতরে ইন্দ্র রায় কন্যাদায়ের ব্যবস্থা করিয়া বসিয়া আছে! হরিশ রায়কে এড়াইয়া চলিয়া যাইবার জন্য হঠাৎ কথা বন্ধ করিয়া ঠিকাদারকে বলিলেন, তা হলে, তুমি কখন যাবে বল তো সন্ধ্যেবেলা কেমন?

হরিশ জলের কুলকুচা ফেলিতে ফেলিতে আপন মনেই বলিলেন, কি আর বলব ইন্দ্রকে। লজ্জার ঘাটে আর মুখ ধোয় নাই। ছি ছি ছি! এতবড় কাণ্ডটার পরেও আবার রামেশ্বর চক্রবর্তীর সম্পত্তির দেখাশোনা করছে! ছি!

অচিন্ত্যবাবু যাইতে যাইতে ফিরিলেন, মৃদু হাসিয়া বলিলেন, সেই তো বলছিলাম মশায়, কি খবর রাখেন, আপনি? মাটির খবর নিয়েই মেতে আছেন আপনি, মানুষের মনের খবর কিছু রাখেন? ইন্দ্র রায় পাকা ছেলে। লজ্জার ঘাটে মুখ ধুয়ে বসে থাকলে ইন্দ্র রায়ের কন্যাদায় উদ্ধার হবে? বলতে পারেন? রায় ওই রামেশ্বর চক্রবর্তীর ছোট ছেলের সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দেবে।

বলেন কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই আমি বলি। চক্রবর্তী-বাড়িকে ইন্দ্র রায় বাঁধছে। রূপে গুণে এমন পাত্র পাবে কোথায় মশায়?

আরে মশায় ওদের আর আছে কি?

নাই, তাই মেয়ে-জামাইয়ের জন্যে রায় নগর বসাচ্ছেন চরে।

হুঁ। কিন্তু রামেশ্বরের যে কুষ্ট হয়েছে শোনা যায়।

আজ্ঞে না। সে সব ওরা রক্ত পরীক্ষা করিয়ে দেখেছেন। ওটা হল রামেশ্বরবাবুর পাগলামি। আচ্ছা, চলি আমি। অচিন্ত্যবাবু কথা কয়টা বলিয়া খুশি হইয়া উঠিলেন।

দাঁড়ান দাঁড়ান, আমিও যাব। দন্ত-মার্জনা অর্ধসমাপ্তভাবেই শেষ করিয়া হরিশ রায় উঠিয়া পড়িলেন। অচিন্ত্যবাবুর সঙ্গ ধরিয়া চলিতে চলিতে বলিলেন, দেখুন না, আমি কি করি! তামাম কাগজ আমি এক্ষুনি গিয়ে বের করে ফেলব। সব শরিককে ডাকব। সকলে মিলে বলব, ইন্দ্রকেও বলব, মহাজনকে বলব। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেব। শোনে ভাল, না শোনে কালই সদরে গিয়ে দেব এক নম্বর ঠুকে, আর সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জাংশান। করুক না, কি করে কল করবে। কল বসাবে, নগর বসাবে!

অচিন্ত্যবাবু বলিলেন, কল বসলে সর্বনাশ হবে মশায়। রাজ্যের লোক এসে জুটবে-কুলী-কামিন-গুণ্ডা বদমায়েশ, চুরি-ডাকাতি-রোগ, সে এক বিশ্রী ব্যাপার হবে মশায়। তা ছাড়া সমস্ত জিনিস হয়ে যাবে অগ্নিমূল্য, গেরস্ত লোকেরই হবে বিপদ। তার চেয়ে অন্য উপায়ে উন্নতি কর না নিজের! কত ব্যবসা রয়েছে। এই ধরুন গাছগাছড়া চালান দাও, খসখস-। অচিন্ত্যবাবু সহসা চুপ করিয়া গেলেন।

হরিশ রায় তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন, আসুন আপনি, আপনাকেই দেখাব আমি কাগজ। আপনি ইন্দ্রের বন্ধুলোক, কই, আপনিই বলুন তো ন্যায্য কথা। আয়নার মত কাগজ, এক নজরে বুঝতে পারবেন। ইন্দ্র না হয় বড়লোক, আমাদের না হয় পয়সা নাই। তাই বলে এই অধর্ম করতে হবে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই হরিশ রায়ের বাড়িতে রায়-বংশের প্রায় সকল শরিকই আসিয়া জুটিয়া গেল। আস্ফালন ও কটুক্তিতে প্রসন্ন প্রভাত কদর্য তিক্ত হইয়া উঠিল। সঙ্গতিহীন এক নাবালক-পক্ষের অভিভাবিকা নাগিনীর মতই বিষোদ্গার করিয়া কেবলই অভিসম্পাত বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল, ধ্বংস হবে। ভোগ করতে পাবে না। অনাথা ছেলেকে আমার যে ফাঁকি দেবে, তার মেয়ে বাসরে বিধবা হবে। নিব্বংশ হবে। এই আমি বলে রাখলাম। রাঙা বর! রাঙা বর! রাঙা বর বাসরে মরবে।

***

ইন্দ্র রায় ইহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। রায়-গোষ্ঠী দল বাঁধিয়া আসিয়া অধঃপতিত আভিজাত্যের স্বভাব-ধর্ম অনুযায়ী যে কদর্য দম্ভ ও কুটিল মনোবৃত্তির পরিচয় দিল, তাহাতে তিনি স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। বিশেষ করিয়া রায়বংশের এক শরিক-শূলপাণি যখন ক্রোধে আত্মহারা হইয়া কদর্য ভঙ্গিতে হাত-পা নাড়িয়া বলিল, অ্যা:, বাবু আমার ‘লগর’ বসাবেন মেয়ে-জামায়ের লেগে! আর আমরা সব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখবো না কি?

ইন্দ্র রায় বলিলেন, শূলপাণি শূলপাণি, কি বলছ তুমি?

রায়ের মুখের কাছে দুই হাত নাড়িয়া শূলপাণি বলিল, আহা-হা, ন্যাকা আমার রে, ন্যাকা! বলি আমরা কিছু বুঝি না, না কি? রামেশ্বরের বেটার সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দেবার কথা আমরা বুঝি না বুঝি?

ইন্দ্র রায় স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাঁহার মনে হইল, পায়ের তলায় পৃথিবী বুঝি থরথর করিয়া কাঁপিতেছে! সভয়ে তিনি চোখ বুজিলেন, তাঁহার চোখের সম্মুখে ফুটিয়া উঠিল-গত সন্ধ্যায় উপাসনার সময়ে মনশ্চক্ষে দেখা দৃশ্য। চক্রবর্তী-বাড়ি ও রায়-বাড়ির জীবন-পথের সংযোগস্থলে ভাঙনের অতল অন্ধকূপ।

শূলপাণি কদর্য ভাষায় আপন মনে বকিতেছিল; অন্যান্য রায়েরা আপনাদের মধ্যে উত্তেজিতভাবে আলোচনা করিতেছিল। হরিশ রায় বেশ বুঝাইয়া বলিবার ভঙ্গিতে বলিলেন, বেশ তো পাঁচজনে একসঙ্গে মজলিস করে বসো; আমি ফেলে দিই তামাম কাগজপত্র একটি একটি করে, একেবারে রুদ্রাক্ষের মালার মত গাঁথা! দেখ, বিচার করে দেখ, যদি সকলের হয় সকলে নেবে। চক্রবর্তীদের একার হয়, একাই নেবে চক্রবর্তীরা। একা তোমার হয় তুমি নাও, তারপর তুমি দান কর মেয়ে-জামাইকে, নিজে রাখ, যা হয় কর। তখন বলতে আসি কান দুটো ধরে মলে দিও।

ইন্দ্র রায়ের কানে ইহার একটা কথাও প্রবেশ করিল না। ধীরে ধীরে তিনি আত্মসম্বরণ করিয়া এতক্ষণে একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তারা তারা মা! তারপর তিনি ডাকিলেন, গোবিন্দ! ওরে গোবিন্দ

গোবিন্দ-রায়ের চাকর। চাকরের সাড়া না পাইয়া তিনি ডাকিলেন, ঘরের মধ্যে কে রয়েছে?

ঘরের মধ্যে ছিল অমল ও অহীন্দ্র। অহীন্দ্র বিস্ফারিত দৃষ্টিতে স্তম্ভিতের মত বসিয়া ছিল। আর অমল হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতে ছিল, বলিতেছিল, কুরুকুল চীৎকার করছে পাণ্ডব-যাদবদের মিতালি দেখে। মাই গড।

পিতার স্বর শুনিয়া সে হাসি থামাইয়া বাহিরে আসিতেই রায় বলিলেন, গোবিন্দ কোথায়? এদের তামাক দিতে বল তো।

শূলপাণি বলিল, তামাক আমরা ঢের খেয়েছি, তামাক খেতে আমরা আসি নাই। আগে আমাদের কথার জবাব চাই।

কথার জবাব? সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধে রায়ের মাথা উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। বিপুল ধৈর্যের সহিত আত্মসম্বরণ করিয়া কিছুক্ষণ পর বলিলেন, জবাব আমি এখনই দিতে পারলাম না। ও-বেলায় দু-একজন আসবেন, তখন জবাব দেব আমি!

শূলপাণি আবার লাফ দিয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু হরিশ তাহাকে থামাইয়া দিয়া বলিলেন, থাম শূলপাণি। ইন্দ্র হল আমাদের রায়গুষ্টির প্রধান লোক, তার সঙ্গে এমন করে কথা কইতে নাই। আমি বলছি।

শূলপাণি সঙ্গে সঙ্গে হরিশের উপরেই ক্রোধে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল। বলিল, যা যা যাঃ, তোষামুদে কোথাকার। তোষামুদি করতে হয়, তুই করগে যা। আমি করব না। আচ্ছা আচ্ছা, কে যায় চরের ওপর দেখা যাবে।–বলিয়া সে হনহন করিয়া কাছারির বারান্দা হইতে নামিয়া চলিয়া গেল।

হরিশ বলিলেন, তা হলে মামলা-মকদ্দমাই স্থির ইন্দ্র?

ইন্দ্র রায় বলিলেন, আপনারা আগে আগে গেলে আমাকে রামেশ্বরের হয়ে পেছনে পেছনে যেতে হবে বৈকি।

হরিশ বলিলেন, তুমি ঠকবে ইন্দ্র, আমার কাছে এমন কাগজ আছে-একেবারে ব্রহ্মাস্ত্র।

ইন্দ্র রায় হাসিলেন, কোন উত্তর দিলেন না। আবার একবার আস্ফালন করিয়া রায়েরা চলিয়া গেল। শূলপাণি কিন্তু তখনও চলিয়া যায় নাই; সে ইন্দ্র রায়ের দারোয়ানের নিকট হইতে খইনি লইয়া খাইতেছিল।

রায় আজ অসময়ে অন্দরে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, হেম, আমার আহ্নিকের জায়গা কর তো।

অন্দর হইতে হেমাঙ্গিনী সমস্ত শুনিতেছিলেন, তিনিও আজ দিগ্ভ্রান্তের মত বিহ্বল হইয়া পড়িয়াছেন। উমা-তাঁহার বড় আদরের উমা। অহীন্দ্রও সোনার অহীন্দ্র। কিন্তু এ তো তিনি কোনদিন কল্পনা করেন নাই।

স্নান-আহ্নিক শেষে রায় আহারে বসিলেন, হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ওদের কথায় তুমি কান দিও না। কুৎসা করা ওদের স্বভাব।

রায় মৃদু হাসিলেন, বলিলেন আমি বিচলিত হই নি হেম।

***

সন্ধ্যায় তিনি বিমলবাবুকে লইয়া বসিলেন। বাধা-বিঘ্নের সম্ভাবনার কথা সমস্ত বলিয়া রায় বলিলেন, বাধা-বিঘ্ন হবে- এ আমি বিশ্বাস করি না। ওদের আমি জানি। তবে সমস্ত কথা আপনাকে আমার বলা দরকার, তাই বললাম। আপনি কাগজপত্র দেখুন, দেখলে সত্যিকারের আইনের দিকটাও দেখতে পাবেন।

বিমলবাবু কাগজগুলি গভীর মনঃসংযোগ করিয়া দেখিলেন, তারপর বলিলেন, আমার দিক থেকে কোন আপত্তি নাই, আজই দলিল হয়ে যাক।

টাকাকড়ির কথাবার্তা শেষ করিয়া তিনি অমলকে পাঠাইলেন সুনীতির নিকট। সুনীতির অনুমোদন লওয়া আবশ্যক। কিছুক্ষণ পর অমল ও অহীন্দ্র ফিরিয়া আসিল। অহীন্দ্র বলিল, মা বললেন, আপনি যা করবেন, তাই তাঁর শিরোধার্য। তবে একটা কথা তিনি বলছেন

রায় বলিলেন, কি, বল?

নবীন বাগদীর স্ত্রী তার কাছে এসেছিল। অন্য বাগদীরাও এসেছিল সঙ্গে। তারা আমাদের পুরানো চাকর। তারা কিছু জমি চায়।

রায় একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, ভাল, তাদের জন্য পঁচিশ বিঘে জমি রেখেই বন্দোবস্ত হবে। কিন্তু চরটা তাহলে মাপ করা দরকার। আজ দলিলের খসড়া হয়ে থাক, কাল মাপ করে দলিলে লেখা হবে, কি বলেন, বিমলবাবু?

বিমলবাবু বলিলেন, তাই হবে।

তা হলে আমি সন্ধ্যা সেরে আসি।

রায় উঠিলেন, কিন্তু যাওয়া হইল না। বারান্দার বাহির হইতে দেখিলেন, যোগেশ মজুমদার বাগানের। রাস্তা দিয়া কাছারির দিকে আসিতেছে। আজ মজুমদারের সঙ্গে একজন চাপরাসী। মজুমদার এখন চক্রবর্তী বাড়ির বিক্রীত সম্পত্তির মালিক, রায়েদের শরিক জমিদার। ইন্দ্র রায় ঈষৎ হাসিলেন, হাসিয়া সম্ভাষণ করিলেন, এস এস, মজুমদার এস। কি ব্যাপার? হঠাৎ?

স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের হাসি হাসিয়া মজুমদার বলিল, এলাম আপনার শ্রীচরণ দর্শন করতে।

রায় বলিলেন, শ্রী এখন বিগত হয়েছে মজুমদার, এখন শুধু চরণই অবশিষ্ট। সুতরাং কথাটা তোমার বিনয় বলেই ধরে নিলাম। এখন আসল কথাটা কি, বলো তো? সংক্ষিপ্ত হলে এখনই বলতে পার; সময়ের দরকার হলে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমার সন্ধ্যার সময় চলে যাচ্ছে।

মজুমদার বলিল, কথা অল্পই। মানে আপনি তো জানেন, চক্রবর্তী-বাড়ির সেই ঋণটা-সেটা বেনামীতে আমারই দেওয়া। নিলামে সম্পত্তি ডাকলাম, এখনও বাকি অনেক। আজ শুনছি চরটাও বন্দোবস্ত হয়ে যাচ্ছে। তা আমার কি ব্যবস্থা হবে?

রায় অদ্ভুত হাসি হাসিয়া মজুমদারের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, কথাটার উত্তর কি আমারই কাছে শুনবে মজুমদার? চক্রবর্তী বাড়ি তো তোমার অচেনা নয়।

কথাটার সুরের মধ্যে সূচের মত তীক্ষ্ণতা ছিল, মজুমদার সে তীক্ষ্ণতার আঘাতে একেবারে হিংস্র হইয়া উঠিল, বলিল, আপনিই যে এখন ও বাড়ির মালিক রায় মশায়। চক্রবর্তীর সম্বন্ধী, আবার হবু বেয়াই

রায় গম্ভীরভাবে নিঃশ্বাস টানিয়া অজগরের মত ফুলিয়া উঠিলেন, বলিলেন, হ্যাঁ, রামেশ্বরের সম্বন্ধী আমি বটে, আর বেয়াই হবার কথাটাও ভাবছি। এখন উত্তরটাও আমার শোন, চাকরের কাছে ধার, সে আমার টাকা চুরি করেই আমাকে ধার বলে দিয়েছে, কিন্তু সে যখন ধার বলেই নিয়েছি-তখন আমার ভগ্নীপতি, কি আমার হবু বেয়াই, কখনও ‘দেবে না’ বলবেন না।

মজুমদার মুহূর্তে এতটুকু হইয়া গেল। রায় বলিলেন, কাল সকালে এস তোমার হ্যাণ্ডনোট নিয়ে। তারপর কণ্ঠস্বর মৃদু ও মিষ্ট করিয়া বলিলেন, বস, তামাক খাও। গোবিন্দ! মজুমদার মশায়কে তামাক দাও।

তিনি অন্দরে চলিয়া গেলেন; চলিতে চলিতেই গম্ভীরস্বরে তিনি ডাকিলেন, তারা, তারা, মা!

.

২৩.

মাস ছয়েক পর।

শীত-জর্জর শেষ-হেমন্তের প্রভাতটি কুয়াশা ও ধোঁয়ায় অস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। চরটার কিছুই দেখা যায় না। শেষরাত্রি হইতেই গাঢ় কুয়াশা নামিয়াছে। তাহার উপর লক্ষ লক্ষ ইঁট পুড়িতেছে, সেই সব ভাঁটায় ধোঁয়া ঘন বায়ুস্তরের চাপে অবনমিত হইয়া সাদা কুয়াশার মধ্যে কালো কুণ্ডলী পাকাইয়া নিথর হইয়া ভাসিতেছে। বিপুলবিস্তার দুধে-খোয়া পাতলা একখানি চাদরের উপরে কে যেন খানিকটা কালি ফেলিয়া দিয়াছে। হিমশীতল কুয়াশার কণাগুলি মানুষের মুখে চোখের পাতায়, চুলের উপর আসিয়া লাগিতেছে, তাহার অঙ্গে অতি সূক্ষ্ম বালির মত কয়লার কুচি। কয়লার ধোঁয়ার গন্ধে ভিজা বাতাস আরও যেন ভারী বোধ হইতেছে।

ইহার মধ্যেই বিমলবাবু, কলিকাতার কলওয়ালা মহাজন, চরের উপর একটি বাংলো তৈয়ারি করিয়া বাসা গাড়িয়া বসিয়াছেন। কল তৈয়ারি আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। কাজ খুব দ্রুতবেগে চলিতেছে। এখানকার লোকে কাজের গতি দেখিয়া বিস্ময়ে হতবাক হইয়া পড়িয়াছে। এমন দ্রুতগতিতে যে কাজ হইতে পারে-এ ধারনাই তাহারা করিতে পারে না; এ যেন বিশ্বকর্মার কাণ্ড, এক রাত্রে প্রান্তরের উপর প্রকাণ্ড নগর গড়িয়া উঠার মত ব্যাপার।

বিমলবাবু বাংলোর বারান্দায় একখানা ইজি-চেয়ারের উপর বসিয়া চা পান করিতেছিলেন এবং কুয়াশার দিকে চাহিয়া ছিলেন। কুয়াশার মধ্যে কোথা হইতে বাষ্পের জোরে বাজানো বয়লারের বাঁশী ভোঁ-ভোঁ শব্দে বাজিয়া উঠিল। একটি ভাটিকাল বয়লারও ইহার মধ্যেই বসানো হইয়াছে; বয়লারের জোরে নদীর গর্ভে একাটা পাম্প চলিতেছে। সেই পাম্পে ইঁট তৈয়ারির কাজে প্রয়োজনমত জল সরবরাহ হইতেছে। জলের পাইপ বিমলবাবুর বাংলোয় চলিয়া আসিয়াছে এবং প্রয়োজনমত এখানে কলের মুখ লাগাইয়া যখন যেখানে ইচ্ছা জল লইবার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। বাংলোর সম্মুখেই একটা পাকা ইঁদারাও হইয়া গিয়াছে। ইঁদারাটার চারিপাশে বাগানের নানা রকমের মরসুমী ফুল ও তরিতরকারির গাছ। বারান্দায় ধারেই একটা জলের কলের মুখ, সেখানে একটি প্রশস্ত সান-বাঁধানো চাতাল ও একটি চৌবাচ্চা। সেই চাতালে বসিয়া সারী, সাঁওতালদের সেই দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি, বাসন মাজিতেছে। বিমলবাবুর বাসায় সারী এখন ঝিয়ের কাজ করে। কুয়াশা এত ঘন যে, বিমলবাবু সারীকেও স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছেন না। সাদা কাপড় পরিহিত সারীকে দেখিয়া মনে হয়, কুয়াশার একটা পুঞ্জ মেঘ ওখানে জমিয়া আছে। এই কুয়াশার মধ্যে কোথাও শূণ্যমার্গে অবিরাম কর্ণিকের ও ইঁটের টুং ঠুং শব্দ উঠিতেছে। আর উঠিতেছে লোহার উপর লোহার প্রচণ্ড আঘাতের শব্দ, চারিদিকের মুক্ত প্রান্তর। বাহিয়া শব্দটা শনশন শব্দে ছুটিয়া চলিয়া দিগন্তে বিপুল শব্দে প্রতিধ্বনিত হইয়া আবার ফিরিয়া আসিতেছে।

বেলা বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটিতেছিল। কয়লার ধোঁয়া মাটির বুক হইতে শূন্যমণ্ডলে উপরে উঠিতে আরম্ভ করিল। বিমলবাবু সারীর দিকে চাহিয়া ঈষৎ হাসিলেন, সারীর মাথায় মরসুমী ফুলের সারি, ইহারই মধ্যে সে কখন ফুল তুলিয়া চুলে পরিয়াছে। বিমলবাবু রাগের ছলনা করিয়া বলিলেন, আবার তুই ফুল তুলেছিস!

সারী শঙ্কিত মুখে বিমলবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সারীর মত উজ্জ্বল চঞ্চল বর্বররাও বিমলবাবুকে ভয় করে, অজগরের মুখের অদূরবর্তী জীবের মত যেন অসাড় হইয়া যায়। এই চর ব্যাপিয়া বিপূল এবং অতিকায় কর্মসমাবেশের সমগ্রটাই যেন বিমলবাবুর কায়ার মত, মানুষের দেহ লইয়া তিনি যেন তাহার জীবাত্মা। তাঁহার সম্পদ, কর্মদক্ষতা, গাম্ভীর্য, তৎপরতা সব লইয়া বিমলবাবুর একটা ভয়াল রূপ তাহারা মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করে এবং ভয়ে স্তব্ধ হইয়া যায়।

সারীর ভয় দেখিয়া বিমলবাবু একটু হাসিলেন, তারপর পাশের টিপয়ের উপর ফুলদানি হইতে এক গোছা মরসুমী ফুল লইয়া সারীকে ছুঁড়িয়া মারিলেন, বলিলেন, এই নে।

সারী ফুলের গোছাটি কুড়াইয়া লইয়া শঙ্কার সহিত একটু হাসিল, তারপর বলিল, সেই কাপড়টা তুমি কিনে দিবি না?

দেব, দেব।

কোবে দিবি গো?

আচ্ছা, আজই দেব। তুই এখন ভেতরে গিয়ে সব পরিস্কার করে ফেল, ওই সরকারবাবু আসছে।

কুয়াশা এখন প্রায় কাটিয়া আসিয়াছে; বাংলোর মুখ হইতে সোজা একটা পাকা প্রশস্ত রাস্তা কারখানার দিকে সোজা চলিয়া গিয়াছে, সেই রাস্তা ধরিয়া আসিতেছিল শূলপাণি রায়, রায়-বংশের সেই গঞ্জিকাসেবী উগ্রমেজাজী লোকটি। শূলপাণির সঙ্গে জনকয়েক চাপরাসী। শূলপাণি আস্ফালন করিতেছিল প্রচুর। শূলপাণিই বিমলবাবুর সরকার। তাহার উগ্র মেজাজ ও বিক্রম দেখিয়া তিনি তাহাকে ‘লেবার-সুপারভাইজার’- বাংলা মতে কুলী-সরকার নিযুক্ত করিয়াছেন। শূলপাণি কুলিদের হাজরি রাখে, তাহাদের খাটায়, শাসন করে; মাসিক বেতন বারো টাকা।

শুধু শূলপাণিই নয়, রায়হাটের অনেকেই এখানে চাকরি পাইয়াছেন। ইন্দ্র রায় বিমলবাবুর কৌশল দেখিয়া হাসিয়াছিলেন, মুগ্ধ হইয়া হাসিয়াছিলেন। মামলা-মকর্দমার সমস্ত সম্ভাবনা চাকরির খাঁচায় বন্ধ করিয়া ফেলিলেন, এই বিচক্ষণ ব্যবসায়ীটি। মজুমদার এখন বিমলবাবুর ম্যানেজার, অচিন্ত্যবাবু অ্যাকাউন্ট্যান্ট, হরিশ রায় গোমস্তা। আরও কয়েকজন রায়-বংশীয় এখানে কাজ পাইয়াছে। ইন্দ্র রায়ের নায়েব মিত্তিরের ছেলেও এখানে কাজ করিতেছিল, ইন্দ্র রায় নিজেই তাহার জন্য অনুরোধ জানাইয়াছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি বিমলবাবু দুঃখের সহিত তাহাকে নোটিশ দিয়াছেন, কাজ তাহার সন্তোষজনক হইতেছে না।

শূলপাণি চিৎকার করিতে করিতেই আসিতেছিল, হারামজাদা বেটারা সব শূয়ারকি বাচ্ছা

 বিমলবাবুর কপালে বিরক্তির রেখা ফুটিয়া উঠিল, বলিলেন, আস্তে। তারা তো এখানে কেউ নাই।

শূলপাণি অর্ধদমিত হইয়া বলিল, আজ্ঞে না। ওই বেটা সাঁওতালরা

হ্যাঁ, বেটারা হারামজাদাই বটে। কিন্তু হয়েছে কি! ব্যাপারটা কি, আস্তে আস্তে বল!

 শূলপাণি এবার সম্পূর্ণ দমিয়া গিয়া অনুযোগের সুরে বলিল, আজ্ঞে, আজ কেউ আসে নাই।

আসে নি?

আজ্ঞে না।

হুঁ। বিমলবাবুর ভ্রূযুগল ও কপাল আবার কুঞ্চিত হইয়া উঠিল।

 শূলপাণি উৎসাহিত হইয়া বলিয়া উঠিল, হুকুম দেন, গলায় গামছা দিয়ে ধরে আনুক সব।

বিমলবাবু ব্যাঙ্গের হাসি হাসিয়া বলিলেন, রায় সাহেব, এটা তোমার পৈতৃক জমিদারী নয়, এটা হল ব্যবসা। এতে গলায় গামছা চলবে না। না এসেছে, নেই। কাজ আজ বন্ধ থাক। বিকেলবেলা সবাইকে ডাকবে এখানে-আমার কাছে। একবার শ্রীবাস দোকানীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে, জরুরী দরকার। আর হ্যাঁ, কাল রাত্রে লোহাগুলি সব এসে পৌঁছেছে?

আজ্ঞে না। এখনও দু বার লরি যাবে, তবে শেষ হবে। লরি তো জোরে যেতে পারছে না। ইস্টিশানের রাস্তায় ধূলো হয়েছে একহাঁটু আর মাঝে মাঝে এমন গর্ত

মেরামত করাও নিজেদের লোক দিয়ে, জলদি মেরামত করিয়ে নাও। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের মুখ চেয়ে থাকলে চলবে না। তাদের সেই বছরে একবার মেরামত, তাও হরির লুঠের মত মাটি কাঁকর ছিটিয়ে দিয়ে। লরি যখন স্টেশনে যাবে, তখন ইঁটের কুচি বোঝাই দিয়ে দাও। যেখানে যেখানে গচকা পড়েছে ঢেলে দিক সেখানে। তারপর কয়েক লরি কাঁকর দিয়ে মেরামত করাই। বুঝলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আচ্ছা যাও তুমি এখন।

শূলপাণি একটি নমস্কার করিয়া শান্তশিষ্ট ব্যক্তির মতই চলিয়া গেল। তাহার মত গঞ্জিকাসেবীর আজন্ম-অভ্যস্ত উগ্র মেজাজের কড়া তারও কেমন করিয়া বিমলবাবুর সম্মুখে শিথিল মৃদু হইয়া যায়। আসে সে আস্ফালন করিতে করিতে, কিন্তু যায় যেন দম-দেওয়া যান্ত্রিক পুতুল-মানুষের মত।

বিমলবাবু ডাকিলেন, সারী!

সারী আসিয়া নীরবে চকিত দৃষ্টি তুলিয়া দাঁড়াইল। পরিপূর্ণ আলোকে দেখা যায়, সারীর নিটোল স্বাস্থ্যভরা দীর্ঘ দেহখানি আর সে তৈলাক্ত অতি মসৃনতায় প্রসাধিত নয়, রুক্ষ প্রসাধনের একটি ধূসর দীপ্তি সর্বাঙ্গে সুপরিস্ফুট। পরনে তাহার সাঁওতালী মোটা শাড়ি নাই, একখানা ফুলপাড় মিলের শাড়ি সে পরিয়া আছে। বর্ষার আদিম জাতির দেহে অপরিচ্ছন্নতার একটা অরণ্য কটু গন্ধ থাকে, কিন্তু সারী আসিয়া নিকটে দাঁড়াইলে সে গন্ধ আর পাওয়া গেল না।

বিমলবাবু বলিলেন, আবার সব তোদের পাড়ার লোক গোলমাল করছে নাকি?

সারী শঙ্কিত হইয়া উঠিল, বলিল, আমি সি জানি না গো। উয়ারা তো বললে না আমাকে।

তবে সব খাটতে এল না যে?

সারীর মুখে এবার সঙ্কুচিত একটি হাসি ফুটিয়া উঠিল, আশ্বস্ত কণ্ঠে সে বলিল, কাল আমাদের জমিদারবাবু, উই যে রাঙাবাবু, উয়ার শ্বশুর হবে যি ওই রায়বাবু, সিপাই পাঠালে যি। বুললে, জমিগুলা চষতে হবে, কলাই বুনবে, সরষা বুনবে, আলু লাগাবে, আর ধানগুলা কাটতে হবে।

বিমলবাবুর ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, আপন মনেই তিনি বলিয়া উঠিলেন, ড্রোন্স অব কানট্রি! ইডিয়টস! দিজ জমিন্ডার্স।

সারী শঙ্কিত হইয়া উঠিল, তাহার কালো মুখে সাদা চোখ দুইটিতে শঙ্কার ছায়া ঘনাইয়া আসিল, রাত্রির আকাশের চাঁদের উপর পৃথিবীর ছায়ার মত। বিমলবাবু কি বলিলেন, সে যে তাহা বুঝিতে পারিতেছে না! তবু ভাল যে সম্মুখে এখন ‘হাড়িয়া’র বোতলটা নাই।

বিমলবাবু বলিলেন, সকলে তো চাষ করে না, তারা এল না কেন?

উয়াদিকে ধান কাটতে লাগালে। সারীর কণ্ঠস্বর ভীত শিশুর মত।

ধান কাটতে লাগালে? পয়সা দেবে, না, দেবে না?

না, বেগার লিলে। উয়ারা যে জমিদার বটে, রাজা বটে।

হুঁ। বিমলবাবু গম্ভীর হইয়া গেলেন। কিছুক্ষণ পর উঠিয়া মোটা চেষ্টাফিল্ড কোটটা গায়ে দিয়া বলিলেন, ছড়িটা নিয়ে আয়।

সারী তাড়াতাড়ি ছড়িটা আনিয়া বিমলবাবুর হাতে দিল, বিমলবাবু এবার প্রসন্ন হাসি হাসিয়া সারীর কপালে আঙুলের একটা টোকা দিয়া ক্ষিপ্রপদে রাস্তায় উপর নামিয়া পড়িলেন।

কুয়াশা কাটিয়া এখন রৌদ্র ফুটিয়া উঠিয়াছে। চরখানাকে এখন স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। সর্বাগ্রে চোখে পড়িল আকাশলোকের দিকে উদ্ধত ভঙ্গিমায় উদ্যত একটা অর্ধসমাপ্ত ইঁটের গড়া চিমনি। সেইখানে কর্নিকের ঠুংঠাং শব্দ উঠিতেছে। ও-দিকে আরও একখানা সুসমাপ্ত বাংলো। ওটা আপিস-ঘর। পাশে একটা লোহার ফ্রেমে-গড়া আচ্ছাদনহীন শেড।

এতক্ষণে সারীর মুখখানি ঈষৎ দীপ্ত হইয়া উঠিল; বিমলবাবু খানিকটা অগ্রসর হইয়া গেলে সে স্বচ্ছন্দে সহজ হইয়া গ্রীষ্ম-সন্ধ্যার জলসিক্ত অঙ্কুরের মত জাগিয়া উঠিল। কাজ করিতে করিতে সে এবার গুন গুন করিয়া গান আরম্ভ করিল, নিজেদের ভাষায় গান

 উঃ বাবা গো, এই জঙ্গলের ভিতর কি আঁধার আর কত গাছ। এখানে সাপও চলিতে পারে না। এই জঙ্গলের পরেই নাকি ‘রামচারের’, সে সূর্যঠাকুরের শোবার ঘর পর্যন্ত লম্বা ডাঙা, সেখানে বসতি নাই, পাখী নাই। তুমি আমাকে এখানে ফেলিয়া যাইও না, ওগো ভালবাসার লোক!

সারী এখন বিমলবাবুর বাংলোয় কাজ করে, এখানেই সে বাসও করিতেছে। কয়টা মাসের মধ্যে ঘটিয়া গিয়াছে অনেক।

বিমলবাবু এখানে আসার কিছু দিনের মধ্যেই সারী অনুভব করিল, অজগরের সম্মুখস্থ শিকারের সর্বাঙ্গ যেমন অবশ হইয়া যায়, সেও যেন তেমনি অবশ হইয়া পড়িতেছে। চীৎকার করিয়া আপন জনকে ডাকিয়া সাহায্য চাহিবার শক্তি পর্যন্ত তাহার হইল না, সম্পদ গাম্ভীর্য কর্মক্ষমতা, প্রভুত্ববিস্তারের শক্তি, তৎপরতা প্রভৃতিতে বিচিত্র সুদীর্ঘকায় অজগরের মতই ভয়াল দৃষ্টির সম্মুখে কাহারও প্রতিবাদ করিবার সাহসও হইল না। আরও একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটিয়া গেল, সাঁওতাল-পল্লীর সকলেই এক দিক হইয়া সর্দার কমল মাঝি ও সারীর স্বামীকে একঘরে করিল; অথচ তাহারাই রহিল বিমলবাবুর একান্ত অনুগত। কিছুদিনের মধ্যেই সারীই নিজে পঞ্চজনের কাছে ‘সামকচারী’র অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদের প্রার্থনা করিল। সামাজিক আইনমত তাহারই জরিমানা দিবার নিয়ম; চাহিবার পূর্বেই সে একশত টাকা ‘পঞ্চে’র সম্মুখে নামাইয়া দিল।

কয়েক দিনের মধ্যেই একদিন সকালে দেখা গেল, বুড়া কমল মাঝি, তাহার বৃদ্ধা স্ত্রী এবং সারীর স্বামী রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে।

সাঁওতাল পাড়ার সর্দার এখন চূড়া মাঝি, সেই কাঠের পুতুলের ওস্তাদ। সর্দার মাঝির জমি শ্রীবাস পাল দখল করিয়া লইল, তাহার নাকি বন্ধকী দলিল আছে।

সারী এখন বিমলবাবুর বাংলোয় কাজ করে, বাংলোর সীমানার মধ্যেই আউট-হাউসে থাকে। তাহার বেশভূষার প্রাচুর্য দেখিয়া সারীর সখীরা বিস্মিত হইয়া যায়।

এক একদিন দেখা যায় গভীর রাত্রে সারী ভয়ত্ৰস্তা হরিণীর মত ছুটিয়া পালাইতেছে, তাহার পিছনে ছুটিয়াছেন বিমলবাবু, হাতে একটা হান্টার।

গান গাহিতে গাহিতে সারী কাজ করিতেছিল; ঘরের দেওয়ালের গায়ে টাঙানো প্রকাণ্ড আয়নার কাছে আসিয়া সে কাজ বন্ধ করিয়া দাঁড়াইল, চুলটা একবার ঠিক করিয়া লইল, একবার হাসিল, তারপর দেহখানি দোলাইয়া হিল্লোল তুলিয়া সে নাচিতে আরম্ভ করিল। জঙ্গলের ভিতর আঁধার, আর কি ঘন গাছ! …আমাকে ফেলিয়া যাইও না, ওগো ভালবাসার লোক!

***

বাংলোর সম্মুখ দিয়া পথটা সোজা চলিয়া গিয়াছে। সুগঠিত পথ, ইঁটের কুচি ও লাল কাঁকর দিয়া গড়িয়া তোলা হইয়াছে। সরল রেখার মত সোজা, তেমনি প্রশস্থ, অন্তত তিনখানা গাড়ি পাশাপাশি চলিতে পারে। কুয়াশার অল্প ভিজিয়া রাঙা পথখানির রক্তাভা আরও গাঢ় হইয়া উঠিয়াছে।

বাংলো হইতে খানিকটা আসিয়াই পথের দুই পাশে আরম্ভ হইল সারি সারি খড়ের তৈয়ারী কুঁড়েঘর। অনেক বিদেশী কুলী আনিতে হইয়াছে। বাক্স-ফর্মায় ইঁট পাড়া, ইঁটের ভাটি দেওয়া, কলের লোহা-লক্কড়ের কাজ এদেশের অনভিজ্ঞ অপটু মজুর দিয়া হয় না। ওই কুলীদেরই সাময়িক আশ্রয় হিসাবে ঘরগুলি তৈয়ারী হইয়াছে। ও পাশে ইহার মধ্যেই কুলীদের স্থায়ী বসস্থান প্রায় তৈয়ারী হইয়া আসিল, পাকা ইঁটের লম্বা একটা ব্যারাক, ছোট ছোট খুপরি-ঘর, সামনে এক টুকরা বারান্দা।

কুলীদের কুটিরগুলি এখন জনবিরল, বয়লারের ভোঁ বাজিবার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই প্রায় কাজে চলিয়া গিয়াছে, থাকিবার মধ্যে কয়েকটি প্রায়-অক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর উলঙ্গ অর্ধ-উলঙ্গ ছেলের পাল। বৃদ্ধ মাত্র কয়েকজন, তাহারা উবু হইয়া ঘোলাটে চোখে অলস অর্থহীন স্তিমিত দৃষ্টিতে চাহিয়া বসিয়া আছে। বৃদ্ধা কয়েকজন জটলা পাকাইয়া রৌদ্রের আশায় বসিয়া পরস্পরের অপরিচ্ছন্ন মাথা থেকে উকুন বাছিয়া নখের উপর রাখিয়া নখ দিয়া টিপিয়া মারিতেছে, আর মুখে করিতেছে ‘হু’। ওই ‘হু’ না করিলে নাকি উকুনের স্বর্গবাস হয় না। মধ্যে মধ্যে দুর্দান্ত চীৎকার করিয়া ছেলের দলকে গাল দিয়া ধমকাইতেছে

আরে বদমাশে হারামজাদে, তেরি কুচ না করে হাম

ই, হারামজাদী বুঢ়ী, তেরি দাঁত তোড় দেঙ্গে হাম– বলিয়া ছেলের দল দাঁত বাহির করিয়া ভেংচাইয়া দিতেছে। একটা বুড়ী একটি ক্রন্দমানা শিশুকন্যাকে আদর করিতেছে

এ আমার বেটী রানী, সাতপরানী, বেটা লাঙার, পুতা কানি,-বেটী আমার ভাগ্‌মানী! এ-এ-এ। অর্থাৎ ও আমার রাণী মেয়ে, সংসারে তাহার সাতটি প্রাণী, তাহার মধ্যে পুত্রটি খোঁড়া, পৌত্রটি কানা; আহা আমার বেটি বড় ভাগ্যবতী।

বিমলবাবু তাহার আদরের ছড়া শুনিয়া হাসিলেন। বৃদ্ধ্য মেয়েটিকে বলিল, আরে আরে চুপ হো যাও বিটিয়া, মালেক যাতা হ্যাঁয়, মালেক। আরে বাপ রে।

বয়স্ক ছেলেগুলি বিমলবাবুকে দেখিয়া শান্ত হইয়া দাঁড়াইল, ছোটগুলি হাত তুলিয়া সেলাম করিয়া বলিল, সেলাম মালেক।

বিমলবাবু ছোট্ট একটি টুকরা হাসি হাসিয়া কেবল ঘাড় নাড়িলেন। কয়টা অল্পবয়স্ক শিশু পরম আনন্দভরে এ উহার মাথায় পায়ের ধুলা ঢালিয়াই চলিয়াছে। একটা অপেক্ষাকৃত বয়স্ক শিশু বিচিত্র খেয়ালে পথের ধূলার উপর শুইয়া ধপাধপ করিয়া ধূলোর উপর পিঠ আছড়াইয়া ধূলার রাশি উড়াইয়া আপন মনে হাসিতেছিল। ধূলার জন্য বিরক্ত হইয়া হাতের ছড়িটা দিয়া বিমলবাবু তাহাকে একটা খোঁচা দিয়া বলিলেন, এই

ছেলেটা তড়াক্‌ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল সেলাম করিয়া বলিল, সেলাম মালেক।

হাসিয়া বিমলবাবু অগ্রসর হইয়া গেলেন। বিমলবাবু পিছন ফিরিতেই ছেলেটা জিভ কাটিয়া দাঁত বাহির করিয়া কদর্য ভঙ্গিতে তাঁহাকে ভেংচাইয়া উঠিল, তারপর আবার লাফ দিয়া পথের ধূলায় পড়িয়া ধূলার উপর। পিঠ ঠুকিতে ঠুকিতে বলিল, আলবৎ করেঙ্গে, ই-ই-ই-।–বলিয়া আবার একবার ভেংচাইয়া উঠিল।

কুলী-বস্তি পার হইয়াই কারখানার পত্তন আরম্ভ হইয়াছে।

এ-দিকের চরটাকে আর চর বলিয়া চেনাই যায় না। সে বেনোঘাসের জঙ্গল আর নাই, চরের এ দিকটা একেবারে খুঁড়িয়া ফেলিয়া আবার সমান করিয়া ফেলা হইয়াছে, লালচে পলিমাটি এখন তকতক করিতেছে, মধ্যে মধ্যে এখানে ওখানে দূর্বা ও মুথো ঘাসের পাতলা আস্তরণ টুকরা টুকরা সবুজ ছাপের মত ফুটিয়া উঠিয়াছে। তাহারই মধ্যে বড় বড় চতুর্ভুজ ছকিয়া লাল কাঁকরের অনেকগুলি রাস্তা এদিক ওদিক চলিয়া গিয়াছে। বড় রাস্তাটা এখানে আসিয়া সুদীর্ঘ দেবদারু গাছের মত যেন চারিদিকে সোজা শাখা-প্রশাখা মেলিয়াছে।

এমনি একটা চতুস্কোন ক্ষেত্রের উপর প্রকাণ্ড বড় টিনের শেডটা তৈয়ার হইতেছে। মোটা মোটা লোহার কড়ি ও বরগায় ঘাঁদিয়া বাঁধিয়া কঙ্কালটা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। শেডের উপর কুলীরা কাজ করিতেছে। লোহার উপর প্রকাণ্ড হাতুড়ির ঘা দিতেছে সেই উপরে দাঁড়াইয়া অবলীলাক্রমে। লোহার উপর প্রকাণ্ড হাতুড়ির প্রচণ্ড শব্দ চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়া দুই-তিন দিক হইতে প্রতিধ্বনিতে আবার ফিরিয়া আসিতেছে।

একটা লরি হইতে লোহার কড়ি-বরগা নামানো হইতেছিল। স্টেশন হইতে লোহালক্কড় এই লরিতেই আসিতেছে। লোহার একটা স্তূপ হইয়া উঠিয়াছে। যন্ত্রপাতিও অনেক আসিয়া গিয়াছে, নানা আকারের যন্ত্রাদি পৃথক পৃথক করিয়া রাখা হইতেছে। এক পাশে পড়িয়া আছে দুইটা বিপুলকায় ল্যাঙ্কাশায়ার বয়লার-নিদ্রিত কুম্ভকর্ণের মত। এই সব লোহালক্কড় ও যন্ত্রপাতিগুলিকে মুক্ত রোদ-বাতাসের হাত হইতে বাঁচাইবার জন্যই ওই টিনের শেডটা তৈয়ারি হইতেছে। একেবারে মধ্যস্থলে একটা বৃহৎ চতুস্কোন জমির উপর কলের বনিয়াদ খোঁড়া হইয়াছে। ঠিক তাহারই মধ্যস্থলে চিমনিটা উঠিতেছে। একেবারে ও-পাশে লাল ইঁটের লম্বা কুলী-ব্যারাক। ব্যারাকটার ছাদ পিটিতে পিটিতে এ দেশেরই কামিনেরা পিটুনে কোপার আঘাতে তাল রাখিয়া একসঙ্গে গান গাহিতেছে।

বিমলবাবু একের পর একটি করিয়া কাজের তদারক করিয়া ফিরিলেন। ফিরিবার পথে বাংলোয় না আসিয়া ও-দিকে শ্রীবাসের দোকানের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। শ্রীবাসের ছেলে গণেশকে আর সে-গণেশ বলিয়া চেনা যায় না। চৌকা ঘর-কাটা রঙিন লুঙ্গি পরিয়া, ঘাড় একেবারে কামাইয়া চৌদ্দআনা দুইআনা ফ্যাশনে চুল ঘাঁটিয়া, গায়ে একটা পুল-ওভার চড়াইয়া গণেশ একেবারে ভোল পাল্টাইয়া ফেলিয়াছে। দোকানেরও আর সে চেহারা নাই। পাকা মেঝে, পাকা বারান্দা, দোকানে হরেক রকমের জিনিস। লোহার তারের বাণ্ডিল, পেরেক, গজাল, গরুর গাড়ির চাকার হালের জন্য লোহার পেটি, লোহার শলি, গরুর গলায় দড়ির পরিবর্তে লোহার শিকল, জানলায় দিবার জন্য লোহার শিক, মোট কথা লোহার কারবারই বেশি। অদূরে একটা গাছের তলায় একজন পশ্চিম-দেশীয় মুসলমান একটা গরুকে দড়ি বাঁধিয়া ফেলিয়া পায়ের নাল বাঁধিয়া ঠুকিতেছে। কয়েকজন গাড়োয়ান তাহাদের গরুগুলি লইয়া অপেক্ষা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। রাস্তার ধারে এক একটা ইঁট পাতিয়া কয়েকজন পশ্চিম-দেশীয় নাপিত চুল ছাঁটিতে বসিয়াছে। গণেশ বেচিতেছিল লোহার তার, কিনিতেছে একটি সাঁওতাল মেয়ে। গণেশ বলিতেছে, আরে বাপু, আলনা করার জন্যে যে নিবি, তা ক হাত চাই সে– মাপ এনেছিস?

মেয়েটি বুঝিতে পারিতেছে না, বলিতেছে, মাপ কি বুলছিস গো?

 কি বিপদ! ছোট হলে তখন করবি কি। এসে তখন আবার কাঁউমাউ করবি যে।

হুঁ। কি কাঁউমাউ করলম গো?

কি বিপদ! কাপড় টাঙাবার জন্য আলনা করবি তো?

হুঁ।

ঠিক এই সময়েই বিমলবাবু আসিয়া দাঁড়াইলেন। গণেশ ব্যস্ত হইয়া তার ফেলিয়া আসিয়া নমস্কার করিল, বলিল, হুজুর! তাড়াতাড়ি সে একখানা লোহার চেয়ার আনিয়া পাতিয়া দিল; বিমলবাবু বসিলেন না, চেয়ারখানার উপর একখানা পা তুলিয়া দিলেন, বলিলেন, শ্রীবাস কোথায়?

আজ্ঞে, বাবা এখনও আসেন নি। কাল ও-পারে বাড়ি

হুঁ। তুমি শোন তা হলে। মাঝি বেটারা আবার গোলমাল করতে আরম্ভ করেছে। ভেতরের ব্যাপারটা একটু খোঁজ নাও দেখি। শুনছি, ইন্দ্র রায় নাকি সব বেগার ধরেছেন। আসল কথাটা আমাকে জানিয়ে আসবে।

বিমলবাবু ফিরলেন।

আপিসে বসিয়া বিমলবাবু ডাকিলেন, যোগেশবাবু!

যোগেশ মজুমদার আসিয়া দাঁড়াইল, বিমলবাবু বলিলেন, শ্রীবাসের হ্যাণ্ডনোটটা- আপনার দরুন যেটা, সেটার বোধ হয় তিন বছর পূর্ণ হয়ে এল, না?

যোগেশ মজুমদার ফৌজদারী মামলার সময় শ্রীবাসকে ঋণ দিয়াছিল, তাহার দরুণ হ্যাণ্ডনোটটা বিমলবাবু কিনিয়াছেন।

মজুমদার বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ, এবার তামাদির সময় হয়ে এল। তা ছাড়া আপনার নিজেরও দুখানা হ্যণ্ডনোট

সে থাক। এখন এইটের জন্যেই একটা উকিলের নোটিশ দিয়ে দিন। বিমলবাবু নিজেও শ্রীবাসকে ঋণ দিয়েছেন দুইবার। মজুমদার বলিল, ওকে ডেকে

বাধা দিয়া বিমলবাবু বলিলেন, না। ঠিক প্রণালীমত কাজ করে যান। এর পর যা কথা হবে, সে উকিলের মারফতেই হবে। উকিল আমাদের শর্তটা জানিয়ে দেবেন, চরের একশ বিঘে জমিটা ন্যায্য মূল্যেই আমি পেতে চাই।

মজুমদার বলিল, যে আজ্ঞে।

বিমলবাবু বলিলেন, আর এক কথা। একবার ইন্দ্র রায়ের কাছে আপনি যান। তাঁকে বলুন যে, আমার শরীর খারাপ বলেই আমি আসতে পারলাম না। কিন্তু তিনি যে জমিদার স্বরূপে সাঁওতালদের বেগার ধরেছেন, এতে আমার আপত্তি আছে। ওরা আমাদের দাদন খেয়ে রেখেছে। আমার দাদন-দেওয়া কুলী বেগার ধরলে আমার কাজের ক্ষতি হয়। বুঝলেন? সে আমি সহ্য করব না। আচ্ছা, তা হলে আপনি যান ওঁর কাছে।

মজুমদার চলিয়া গেল। বিমলবাবু কাগজ-কলম লইয়া বসিলেন। কিছুক্ষণ পরেই একজন চাপরাসী আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়াইল, বলিল এসেছে।

মুখ না তুলিয়াই বিমলবাবু বলিলেন, নিয়ে আয়।

আসিয়া প্রবেশ করিল যে ব্যক্তি, সে এখানকার নূতন মদের দোকানের ভেণ্ডার। লোকটি ঘরে ঢুকিয়া একটি প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল। বিমলবাবু চাপরাসীটাকে বলিলেন, যা তুই এখান থেকে।

চাপরাসীটা চলিয়া গেল। বিমলবাবু বলিলেন, দেখ আমার জন্যেই তোমার এ দোকান।

লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বিনয় কৃতজ্ঞতার শতমুখ হইয়া বলিয়া উঠিল, দেখেন দেখি, দেখেন দেখি, হুজুরই আমার মা-বাপ

হ্যাঁ। বাধা দিয়া বিমলবাবু বলিলেন, হ্যাঁ। একটি কাজ তোমাকে করতে হচ্ছে। সাঁওতালদের মাথায় একটা কথা তোমাকে ঢুকিয়ে দিতে হবে-কৌশলে। বুঝেছ? দরজাটা ভেজিয়ে দাও। জমিদার বেগার ধরলে ওরা যেন না যায়।

.

২৪.

মজুমদার এই দৌত্য লইয়া ইন্দ্র রায়ের সম্মুখে উপস্থিত হইবার কল্পনায় চঞ্চল হইয়া পড়িল। ইন্দ্র রায়ের দাম্ভিকতা-ভরা দৃষ্টি, হাসি, কথা সুতীক্ষ্ণ সায়কের মত আসিয়া তাহার মর্মস্থল যেন বিদ্ধ করে। আর তাহার নিজের বাক্যবাণগুলি যতই শান দিয়া শানিত করিয়া সে নিক্ষেপ করুক, নিক্ষেপ ও শক্তির অভাবে সেগুলি কাঁপিতে কাঁপিতে নতশির হইয়া রায়ের সম্মুখে যেন প্রণত হইয়া লুটাইয়া পড়ে। তবে এবার পৃষ্ঠদেশে আছেন সক্ষম রথী বিমলবাবু; বিমলবাবুর আজিকার এই বাক্য-শাকটি শুধু সুতীক্ষই নয়, শক্তির বেগে তাহার গতি অকম্পিত এবং সোজা। মজুমদার একটা সভয় হিংস্রতায় চঞ্চল হইয়া উঠিল।

নানা কল্পনা করিতে করিতেই সে চর হইতে নদীর ঘাটে আসিয়া নামিল। চরের উপর নদীর মুখ পর্যন্ত রাস্তাটা এখন পাকা হইয়া গিয়াছে, কালীর বুকেও এখন গাড়ির চাকায় চাকায় বেশ একটি চিহ্নিত রাস্তা রায়হাটের খেয়াঘাটে গিয়া উঠিয়াছে। ও-পার হইতে মজুরশ্রেণীর পুরুষ ও মেয়েরা দল বাঁধিয়া চরের দিকে আসিতেছে। কলের ইমারতের কাজে ইহারা এখন খাটে, আগের চেয়ে মজুরিও কিছু বাড়িয়াছে। কতকগুলি চাষী বেগুন-মূলা-শাকশক্তি বোঝাই ঝুড়ি মাথায় চরের দিকেই আসিতেছে। এখন রায়হাটের চেয়ে জিনিসপত্র চরেই কাটতি হয় বেশী, চরে মিস্ত্রি-মজুরেরা দরদস্তুর করে কম, কেনেও পরিমানে বেশী। এ-পারে যাহারাই আসিতেছিল, তাহারা সকলেই মজুমদারকে সশদ্ধ অভিবাদন জানাইল, মজুমদার এখন কলের ম্যানেজার। রায়হাটের ঘাটে আসিয়া মজুমদার বিরক্ত হইয়া উঠিল, পথে এক হাঁটু ধূলা হইয়াছে। চারিপাশে দীর্ঘকালের প্রাচীন গাছের ঘন ছায়ার মধ্যে হিম যেন জমাট বাঁধিয়া আছে। পথের উপর মানুষ-জনও নাই। মজুমদার চরের ম্যানেজারির গৌরবের গোপন অহঙ্কার নির্জনতার সুযোগে প্রকাশ করিয়া ফেলিল বেশ জোর গলাতেই, আপন মনেই সে বলিয়া উঠিল, মা-লক্ষ্মী যখন ছাড়েন, তখন এই দশাই হয়। হুঁ, অতিদর্পে হতা লঙ্কা অতিমানে চ কৌরবাঃ।

পথের দুই পাশে প্রাচীন কালের নৌকার মত বাঁকানো চালকাঠামোযুক্ত কোঠাঘরগুলির দিকে চাহিয়া তাহার ঘৃণা হইল। বলিল, হুঁ, কি সব জঘন্য চাল-কাঠামো! সেকালের কি সবই ছিল কিম্ভুতকিমাকার! যত জবড়জং-হাতীর গুঁড়, পরী, সিংহী-এই দিয়ে আবার বাহার করেছে। ঘর করবে বাংলো-চাল, সোজা একেবারে পাকা দালান ঘরের মত।

মোট কথা রায়হাটের সমস্ত কিছুকে ঘৃণা করিয়া, ব্যঙ্গ করিয়া ইন্দ্র রায়ের সম্মুখীন হইবার মত মনোবৃত্তিকে সে নিজের অজ্ঞাতেই দৃঢ় করিয়া লইতেছিল।

নায়েব সেরেস্তার সম্মুখে একখানা সেকেলে ভারী কাঠের চেয়ারে বসিয়া ইন্দ্র রায় জমিদারী কাজকর্মের তদারক করিতেছিলেন। নায়েব মিত্তির তক্তপোশে বসিয়া একটি সেকেলে ডেস্কের উপর খাতা লইয়া বসিয়া আছে। এই লোকটিকে রায় চক্রবর্তী-বাড়ির কর্মচারি নিযুক্ত করিয়াছেন। মনে গোপন ইচ্ছা, এইবার তিনি ধীরে ধীরে চক্রবর্তীদের সংস্রব হইতে সরিয়া দাঁড়াইবেন।

মজুমদার ঘরে ঢুকিয়া নমস্কারের ভঙ্গিতে প্রণাম করিয়া বলিল, একবার মুখুজ্জে সায়েব আপনার কাছে পাঠালেন।

 বিমলবাবু এখানে মুখার্জি সাহেব নামেই খ্যাত হইয়াছেন। বাবু নামটি তিনি অপছন্দ করেন, বলেন, ওটা গালাগালি। চরে কুলী কামিন ও রায়হাটের দরিদ্র জনসাধারণের কাছে তিনি মালিক, হুজুর। কর্মচারী ও অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত সাধারণের নিকট তিনি মুখার্জি সাহেব।

ইন্দ্র রায়ের পাশে আরও খানতিনেক চেয়ার খালি পড়িয়া ছিল। মজুমদার তাহার কথার ভূমিকা শেষ করিয়া ওই চেয়ারগুলার দিকেই দৃষ্টি ফেরাইল; ইন্দ্র রায় সাদরে সম্ভাষণ জানাইয়া মিত্তিরের তক্তপোশের দিকে আঙুল দেখাইয়া স্পষ্ট নির্দেশ দিয়া বলিলেন, বস বস।

মজুমদার একটু ইতস্তত করিয়া তক্তপোশের উপরে বসিল। রায় তাঁহার অভ্যস্ত মৃদু হাসি হাসিয়া বলিলেন, কি সংবাদ তোমার মুখার্জি সাহেবের, বল?

আজ্ঞে। মাথা চুলকাইয়া যোগেশ মজুমদার বিনয় প্রকাশ করিয়া বলিল, আজ্ঞে আমাকে যেন অপরাধী করবেন না

ইন্দ্র রায়ের ঠোঁটের প্রান্তে যে হাসির রেখাটুকু ফুটিয়া উঠে, সেটা অভিজাতসুলভ অভ্যাস করা একটা ভঙ্গিমাত্র, হাসি নয়; মজুমদারের বিনয়ের ভূমিকা দেখিয়া কিন্তু রায় এবার সত্য সত্যই একটু হাসিলেন। বুঝিলেন, অস্ত্র প্রয়োগের পূর্বে মজুমদারের এটি প্রণাম-বাণ প্রয়োগ। রায় হাসিয়া সোজা হইয়া বসিলেন, দূত চিরকালই অবধ্য; তোমার ভয় নেই; নির্ভয়ে তুমি মুখার্জি সাহেবের বক্তব্য ব্যক্ত কর।

রায়ের কথার সুরে অর্থে মজুমদার তাঁহার শক্তি অনুমান করিয়া আরও সংহত এবং সংযত হইয়া উঠিল, আরও খানিকটা বিনয় প্রকাশ করিয়া বলিল, তিনি নিজেই আসতেন। তা তাঁর শরীরটা- মজুমদার ভাবিতেছিল, কোন অসুখের কথা বলিবে।

শরীরটায় আবার কি হল তার? প্রশ্ন করিয়াই রায় হাসিলেন, বলিলেন, চালুনিতে যে-কালে সরষে রাখা চলছে যোগেশ, সে-কালে শরীরে যা হোক একটা কিছু হওয়ার আর আশ্চর্য কি? তোমার শরীর কেমন?

লজ্জার সহিত মজুমদার বলিল, আজ্ঞে, আমি ভালই আছি।

রায় বাঁ হাতে গোঁফে তা দিতে শুরু করিয়া বলিলেন, ভাল কথা, শরীর তো সুস্থই আছে, এইবার সরল অন্তঃকরণে স্পষ্ট ভাষায় বল তো, মুখার্জি সাহেবের কথাটা কি?

বাঁ হাতে গোঁফে তা দেওয়াটা রায়ের অস্বাভাবিক গাম্ভীর্যের একটা বহিঃপ্রকাশ।

মজুমদার প্রাণপণে আপনাকে দৃঢ় করিয়া বলিল, বেশ গাম্ভীর্যের সহিতই আরম্ভ করিল, কথাটা চরের সাঁওতালদের নিয়ে। মানে, উনি সাঁওতালদের সব দাদন দিয়ে রেখেছেন। শ্রীবাসের কাছে ধানের বাকী বাবদ কারও বিশ, কারও ত্রিশ, দু’একজনের চল্লিশ টাকাও ধার ছিল। শ্রীবাসের প্যাঁচালো বুদ্ধি তো জানেন, সে আবার ডেমিতে টিপছাপ নিয়ে বন্ধকী দলিল পর্যন্ত করে নিয়েছিল। যোগেশ একটু থামিল।

রায়ের গোঁফে তা দেওয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, তাঁহার মুখ-চোখ ধীরে ধীরে চিন্তাভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

মজুমদার কোন সাড়া না পাইয়া বলিল, মুখার্জি সাহেব সেটা জানতে পেরেই শ্রীবাসকে ডেকে ধমক দিয়ে তার টাকা দিয়ে খতগুলি কিনে নিলেন। সাঁওতালদের বললেন, তোরা খেটে আমাকে শোধ দিবি। মজুরি থেকে দৈনিক এক আনা হিসেবে কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি।

রায় নীরবে চিন্তাভারাতুর দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করিয়া চাহিয়া ছিলেন অদৃষ্টলোকের সন্ধানে, কিছু কি দেখা যায়? দেখা কিছু যায় না, কিন্তু অনুভব করিলেন যে, জীবন-পথ অতি উচ্চ পাহাড়ের উপর দিয়া চলিয়াছে, সঙ্কীর্ণ পথ, পাশ ফিরিয়া গতি পরিবর্তনের উপায় নাই। গতি পরিবর্তন করিতে গেলে, তাঁহারই হাত ধরিয়া যিনি চলিয়াছেন, পঙ্গু, রুগ্‌ণ রামেশ্বর-তাঁহাকেই পাশের খাদে ঠেলিয়া ফেলিতে হইবে। সে ফেলিতে গেলে তাঁহাকেও পড়িতে হইবে এ-পাশের অতল অন্ধকারে-অধোগতির তমোলোকে, কৃতঘ্নতার নরকে।

মজুমদার বলিয়াই গেল, এখন ধরুন, এই সব দাদনের কুলী যদি আপনি আটক করেন, তা হলে কি করে চলে বলুন?

চিন্তাকুলতার মধ্যেও রায় কথাগুলি শুনিতেছিলেন। তিনি এবার সপ্রশ্ন ভঙ্গিতে মিত্তিরের ভাইপোর দিকে চাহিয়া বলিলেন, কি ব্যাপার, রাধারমণ?

রমণ বলিল, আজ্ঞে, আটক কেন করতে যাব! তবে এখন ধান কাটার সময়, মাঝিরা আমাদের খাসের জমির ধান কাটছিল না, তাই তাদের কাটতে হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর ধরুন, অঘ্রাণের শেষ সপ্তাহ হয়ে গেল, এখনও রবি-ফসল বুনল না ওরা, কেবল কলেই খেটে যাচ্ছে; সেই জন্যেই বলা হয়েছে যে, আগে এসব কর, তারপর তোমরা যা করবে কর গে।

মজুমদার প্রতিবাদ করিয়া একটু চড়া সুরে এবার বলিয়া উঠিল, যারা ভাগীদার নয়, তাঁদেরও আপনারা বেগার ধরেছেন খাসের জমির ধান কাটবার জন্যে।

রায় রমণের দিকে চাহিয়া প্রশ্ন করিলেন, বেগারও ধরা হয়েছে বুঝি?

রমণ উত্তর দিবার পূর্বেই মজুমদার বলিয়া উঠিল, ধরা হয়েছে এবং আপনার নাম দিয়ে ধরা হয়েছে। আপনার নাম না নিলে সাহেব আমাকে পাঠাতেন না, বেগার উঠিয়ে নিতেন। সাঁওতালপাড়ায় সকলেই বললে, আমাদের রাঙাবাবুর শ্বশুর, রায় হুজুর হুকুম দিলে, বেগার দিতে হবে। কথার সঙ্গে সঙ্গে একটি শ্লেষভরা হাসি তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল।

মুহর্তে রায়ের মুখ ভীষণ হইয়া উঠিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চোখ বুজিয়া স্থিরভাবে বসিয়া রহিলেন, কিছুক্ষণ পর একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তারা, তারা মা! সে কণ্ঠস্বর ধীর এবং প্রশান্ত; সারা ঘরটা যেন থমথম করিয়া উঠিল। পরমুহূর্তে রায় নড়িয়া-চড়িয়া বসিলেন। সজাগ হইয়া বাঁ-হাতে আবার গোঁফে তা দিতে দিতে হাসিয়া বলিলেন, তারপর?

মজুমদার শঙ্কিত হইয়া বলিল, আজ্ঞে?

হাসিয়াই রায় বলিলেন, এখন মুখার্জি সাহেবের বক্তব্যটা কি?

আজ্ঞে, বেগার নিতে গেলে আমাদের কি করে চলে, বলুন? তা ছাড়া ভেবে দেখুন, বেগার প্রথাটাও হল বে-আইনী।

ওঃ, আইন! আইনের কথাটা আমার স্মরণ ছিল না। তা আইনে কি বলছে শুনি?

 মজুমদার কথাটার সম্যক অর্থ বুঝিতে না পারিয়া শঙ্কিতভাবেই বলিল, আজ্ঞে?

তোমার মুখার্জি সাহেবকে বলো, তিনি বুঝবেন, তুমি বুঝবে না। বলো আমাদের জমিদারির সনদ বাদশাহী আমলের, বেগার ধরার অভ্যেস আমাদের অনেক দিনের। কেউ ছাড়তে বললেই কি ছাড়া যায়? বেগার আমরা চিরকালই ধরে আসছি, ধরবও।

তারপর হা হা করিয়া হাসিয়া বলিলেন, দরকার হলে তোমার মুখার্জি সাহেবকেও বেগার দিতে হবে হে। চক্রবর্তী-বাড়িতে ক্রিয়াকর্ম হলে-ওঁকেও আমরা কোন কাজে লাগিয়ে দেব। কাজ তো নানা ধারার আছে।

মজুমদার সুযোগ পাইয়া চট করিয়া বলিয়া উঠিল, কাজ তো হাতের কাছে, আপনি ইচ্ছা করলেই তো লেগে যায়। উমা-মায়ের সঙ্গে অহীনবাবুর বিয়েটা এইবার লাগিয়ে দিন।

রায় হাসিয়া এবার বলিলেন, ছেলেমেয়ে থাকলেই বিয়ের কল্পনা হয় মজুমদার, পাত্রপক্ষ-পাত্রীপক্ষ তো করেই নানা কল্পনা, আবার পাড়াপড়শীতেও পাঁচরকম ভাবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা ভগবানের হাতে, ভগবানের দয়া যদি হয় তবে হবে বৈকি। সে হলে তুমি জানতে পারবে সকলের আগে। যিনিই অহীন্দ্রের শ্বশুর হোন, তাঁকে আশীর্বাদের সময় তোমাকে একটা শিরোপা দিতেই হবে। চক্রবর্তী-বাড়ির প্রাচীন কর্মচারী তুমি, আপনার জন।

শব্দার্থে ‘শিরোপা’ ‘প্রাচীন কর্মচারী’ শব্দগুলি ক্ষুরধার। মজুমদারের মর্মস্থলে বিদ্ধ হইবার কথা। কিন্তু রায়ের কণ্ঠস্বরে সুরের গুণ ছিল আজ অন্যরূপ; আঘাত করিবার জন্য ব্যঙ্গ-শ্লেষের নিষ্ঠুর গুণ টানিতে তাঁহার আর প্রবৃত্তি ছিল না; অদৃষ্টবাদী মনের দৃষ্টি আপনার ইষ্টদেবীর চরণপ্রান্তে নিবদ্ধ রাখিয়া তিনি কথা বলিতেছিলেন। মজুমদার আজ আহত হইল না, বরং সে সুরের কোমল স্পর্শে বিচলিত ও লজ্জিত হইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া সে এবার অকৃত্রিম সরলতার সহিতই বলিল, আজ্ঞে বাবু, ওই চরের সাঁওতালদের ব্যাপারটা কি কোন রকমে আপোস করা যায় না?

রায় বলিলেন, কার সঙ্গে আপোস যোগেশ? বিমলবাবুর সঙ্গে? তিনি হাসিলেন।

মজুমদার বলিল, লোকটি বড় ভয়ানক বাবু। ধর্ম-ধর্ম কোন কিছু মানেন না। আর লোকটির কূটবুদ্ধিও অসাধারণ।

রায় আবার হাসিলেন, কোন উত্তর দিলেন না।

মজুমদার বলিল, সর্দার মাঝির নাতনী ওই সারী মাঝিনের ব্যাপারটা আমরা তো ভেবেছিলাম, সাঁওতালরা একটা হাঙ্গামা বাধালো বুঝি। কিন্তু এমন খেলা খেললে মশায় যে, কমল আর সারীর স্বামীই হল দেশত্যাগী, আর সমস্ত সাঁওতাল হল বিমলবাবুর পক্ষে। তারা কথাটি কইলে না। আর কি জঘন্য রুচি লোকটার।

রায় বলিলেন, এতে আর ভয় পাবার কি আছে? ও-খেলা আমাদের পুরনো হয়ে গেছে। আগেকার কালে কর্তারা ও-দিকে ভয়ানক খেলা খেলে গেছেন। এ-খেলা ব্যবসায়ীর পক্ষে নতুন। মা-লক্ষ্মীর কপালই ওই, পেছনে পেছনে অলক্ষ্মী জুটবেই। বাণিজ্য-লক্ষ্মীর ঘরে সতীন ঢুকেছে অলক্ষ্মী। যাক গে, ও কথাটা বাদই দাও।

মজুমদার আবার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিল, ঝগড়া-বিবাদটা না হলেই ভাল হত বাবু।

ঝগড়া-বিবাদ? রায় গোঁফে তা দিয়া হাসিয়া বলিলেন, ঝগড়া-বিবাদ করতে তা হলে মুখার্জি সাহেব বদ্ধপরিকর, কি বল?

হ্যাঁ, তা যে রকম মনে হল, তাতে-।মজুমদার ইঙ্গিতে কথাটা শেষ করিয়া নীরব হইয়া গেল।

রায় বলিল, জান তো, আগেকার কালে যুদ্ধের আগে এক রাজা আরেক রাজার কাছে দূত পাঠাতেন; সোনার শেকল আর খোলা তলোয়ার নিয়ে আসত সে দূত। যেটা হোক একটা নিতে হত। তা তোমার মুখার্জি সাহেবকে বলো, খোলা তলোয়ারখানাই নিলাম, শেকল নেওয়া আমাদের কুলধর্মে নিষিদ্ধ, বুঝেছ?

কথা বলিতে বলিতে রায়ের চেহারায় একটা আমূল পরিবর্তন ঘটিয়া গেল; ব্যঙ্গহাস্যে মুখ ভরিয়া উঠিয়াছে, গোঁফের দুই প্রান্ত পাক খাইয়া উঠিয়াছে, চোখের দৃষ্টিই হইয়া উঠিয়াছে সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর। উৎফুল্ল উগ্র সে দৃষ্টির সম্মুখে সব কিছু যেন তুচ্ছ। কপালে সারি সারি তিনটি বলিরেখা অবরুদ্ধ ক্রোধের বাঁধের মত জাগিয়া উঠিয়াছে।

মজুমদার আর কোন কথা বলিতে সাহস করিল না, একটি প্রণাম করিয়া সে বিদায় লইল।

রায় বলিলেন, মিত্তির, একখানা নতুন ফৌজদারী আইনের বইয়ের জন্যে কলকাতায় লেখ দেখি, আমাদের অমলের মামাকেই লেখ, সে যেন দেখে ভাল বই যা, তাই পাঠায়। আমাদের খানা পুরনো অনেক দিনের।

চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া ঘরের মধ্যেই খানিকটা পায়চারি করিয়া বলিলেন, এক পা যদি বিরোধের দিকে এগোয়, সঙ্গে সঙ্গে কালীর বুকে বাঁধ দিয়ে যে পাম্প বসিয়েছে মুখুজ্জে, সেটা বন্ধ করে দাও। চর-বন্দোবস্তির সঙ্গে নদীর কিছু নেই।

দ্বিপ্রহরে উপরের ঘরে প্রবেশ করিয়া ইন্দ্র রায় ডাকিলেন, হেমাঙ্গিনী!

স্বামীর এমন কণ্ঠস্বর হেমাঙ্গিনী অনেক দিন শুনেন নাই। দ্রুতপদে তিনি উপরে আসিয়া রায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, এই বয়েসে এতকাল পরে আবার অসময়ে আরম্ভ করলে? ছিঃ!

অর্থাৎ মদ। হেমাঙ্গিনীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রতারিত হয় নাই। রায় চিন্তা করিতে করিতেই দুই-এক পাত্র কারণ পান করিতেছেন। তাঁহার মুখ থমথমে রক্তাভ, সদ্য-ঘুমভাঙা ব্যক্তির মত।

রায় হাসিয়া বলিলেন, বড় চিন্তায় পড়েছি হেম, সামনে মনে হচ্ছে অগ্নিপরীক্ষা।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, মুখ দেখে তো তা মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে যেন কোন সুখবর পেয়েছ।

না না হেম, চরের কলের মালিকের সঙ্গে দাঙ্গা বাধবে বলে মনে হচ্ছে। লোকটা আজ শাসিয়ে লোক পাঠিয়েছিল। তোমায় একবার সুনীতির কাছে যেতে হবে। ব্যাপারটা তাকে জানানো দরকার। বলবে, কোন ভয় নেই তার, পেছনে নয়, আমি এবার সামনে।

***

মজুমদার ভারাক্রান্ত মন লইয়া সংবাদ দিতে চলিয়াছিল। নদীর ঘাটে আবার যখন সে নামিল, তখন ও-পারে বয়লারে বারোটার সিটি বাজিতেছে। কলরবে কোলাহলে চরটা মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে। এ-পার হইতে চরটাকে বিচিত্র মনে হয়। কালিন্দীর কালো জলধারার কূলে সবুজ আস্তরণের মধ্যে রাঙা পথের ছক, নূতন ঘরবাড়ি, মানুষের চাঞ্চল্য কোলাহল, কুলীদের গান-অদ্ভুত! চরটা যেন এক চঞ্চলা কিশোরীর মত কালিন্দীর জলদর্পণের দিকে চাহিয়া অহরহ প্রসাধনে মত্ত।

এ-পারে রায়হাট নিস্তব্ধ; সমস্ত গ্রামখানা প্রাচীন কালের গাছে গাছে আচ্ছন্ন। গাছগুলির মাথায় রাশি। রাশি ধূলা, কয়খানা প্রাচীন কালের দালানের বিবর্ণ জীর্ণ চিলেকোঠা কেবল গাছের উপর জাগিয়া আছে ধূলি ধুসর জটার কুণ্ডলীর মত। ও-পারের চরটার তুলনায় মনে হয়, যেন কোন লোলচর্ম পলিকেশা জরতী ঘোলাটে চোখের স্থিমিত অর্থহীন দৃষ্টি মেলিয়া পরপারের দিকে চাহিয়া বসিয়া আছে নিস্পন্দ নির্বাক।

মজুমদার প্রত্যক্ষভাবে এমন করিয়া না বুঝিলেও ভারাক্রান্ত মনে ব্যাথা পাইল। সে যখন গিয়াছিল, তখন ইন্দ্র রায় ও চক্রবর্তীদের উপর ক্রোধবশতঃ রায়হাটকেও ঘৃণা করিয়াছিল, কিন্তু ফিরিবার পথে ইন্দ্র রায়ের সহৃদয়তার উত্তাপে তাহার মনে হইয়াছে অন্যরূপ, সে এবার রায়হাটের জন্য বেদনা অনুভব করিল। মাথা নীচু করিয়াই নদীর বালি ভাঙিয়া সে চলিতেছিল; সহসা চিলের মত তীক্ষ্ণ গলায় কে তাহাকে বলিল, কি রকম? কি হল মশায়? কি বললে চামচিকে পক্ষী, আড়াইহাজারী জমিদার?

মজুমদার মাথা তুলিল, সম্মুখে চর হইতে ফিরিতেছেন অচিন্ত্যবাবু, হরিশ রায়, শূলপাণি। প্রশ্নকর্তা তীক্ষ্ণকণ্ঠ অচিন্ত্যবাবু। বিমলবাবুর আশ্রয় করিবার পর হইতেই অচিন্ত্যবাবু ইন্দ্র রায়ের নামকরণ করিয়াছেন, চামচিকা পক্ষী, আড়াইহাজারী জমিদার।

মজুমদার বলিল, ছিঃ অচিন্ত্যবাবু, রায় মহাশয় আমাদের এখানকার মানী লোক

শূলপাণি আসিবার পূর্বেই গাঁজা চড়াইয়াছিল, সে বাধা দিয়া হাত নাড়িয়া বলিয়া উঠিল। মানী লোক! কে হে? ইন্দ্র রায়? মরে যাই আর কি! বলি, আমরাও তো জমিদার হে, আমরাই বা কি কম?

মজুমদার বলিল, দেখ শূলপাণি, যা-তা বাজে বকো না। তুমি মুখার্জি সাহেবের তাঁবেদার, আর রায় মশায় হলেন তোমার সাহেবের জমিদার।

অচিন্ত্যবাবু এককালে চাকুরিজীবী ছিলেন, মজুমদার তাঁহার অপেক্ষা উচ্চপদস্থ কর্মচারী– এ জ্ঞান তাঁহার টনটনে, তিনি ধাঁ করিয়া কথাটি ঘুরাইয়া লইয়া বলিলেন, কি বললেন রায় মশায়!

বললেন আর কি! যা বলবার তাই বললেন। বললেন, ‘বেগার ধরা আমাদের অনেক কালের অভ্যেস, ছাড়তে বললেই কি ছাড়া যায়?’ তারপর অবিশ্যি হাসতে হাসতেই বললেন যে, ‘ এ তো সাঁওতাল, চক্রবর্তী বাড়িতে ক্রিয়াকর্ম হলে তোমাদের সাহেবকেও বেগার ধরব হে! কাজ তো অনেক রকম আছে।’

অচিন্ত্যবাবু পরম বিজ্ঞের মত ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে গম্ভীর ভাবে বলিলেন, লাগল তো হলে। এইবার কিন্তু রায় ঠকবেন। জমিদারী আর সাহেবী বুদ্ধিতে অনেক তফাত। মেয়ে-জামাইয়ের জন্যে এইবার রায় অপমানিত হবেন।

মজুমদার বলিল, না না, ও-কথাটা ঠিক নয় হে।

মানে?

আজ যা বললেন, তাতে বুঝলাম, ও বিয়ের কথাটা ঠিক নয়। বললেন আমাকে, ‘ও ছেলেমেয়ে থাকলেই কথা ওঠে যোগেশ, কিন্তু তা হলে কি তুমি জানতে পারতে না-চক্রবর্তী বাড়ির পুরোন কর্মচারী তুমি! তবে ভগবানের ইচ্ছে হয়, হবে।’

আপনার মাথা! অচিন্ত্যবাবু প্রচণ্ড অবজ্ঞাভরে সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, আপনার মাথা! আমি নিজে জানি, কথা উঠেছিল। রায়ের ছেলে অমল অহীন্দ্রকে পর্যন্ত ধরেছিল। এখন আসল ব্যাপার, রামেশ্বরবাবু আর ও বাড়ির মেয়ে ঘরে ঢোকাবেন না। এ যদি না হয়, আমার কানদুটো কেটে ফেলব আমি। ভগবানের ইচ্ছে হয়, হবে! শাক দিয়ে মাছ ঢাকা আর কি!-বলিয়া তিনি হেঁ-হেঁ করিয়া হাসিতে আরম্ভ করিলেন-বিজ্ঞতার হাসি।

হরিশ রায়ের চোখ দুইটি বিস্ফারিত হইয়া উঠিল। ভ্রূ দুইটি ঘন ঘন নাচিতে আরম্ভ করিল, ঘাড়টি ঈষৎ দোলাইয়া বলিয়া উঠিলেন, অ্যাই ঠিক কথা। অচিন্ত্যবাবু ঠিক ধরেছেন।

শূলপাণি বার বার ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হু-হু, সে বাবা কঠিন ছেলে, রামেশ্বর চক্রবর্তী, আর কেউ নয়। তারপর হি-হি করিয়া হাসিয়া অদৃশ্য ইন্দ্র রায়কে সম্বোধন করিয়া ব্যঙ্গ ভরে বলিল, লাও বাবা, লাও, মেয়ে জামাইয়ের জন্যে চরের ওপর লগর বসাও!

কথাটা মজুমদারেরও মনে ধরিল। ইন্দ্র রায়ের সহৃদয়তার যে সাময়িক কোমলতা তাহার জাগিয়াছিল, কুয়াশার মত সেটা তখন মিলাইয়া যাইতে আরম্ভ করিয়াছে।

হরিশ রায় চুপি চুপি বলিলেন, এই দেখ আমাদের জ্ঞাতি হলে হবে কি, ছোট রায়-বাড়ির ওই কেলেঙ্কারী, যাকে বলে বংশগত, তাই। আমাদের কাছে রায়বংশের কুসীনামা আছে, দেখিয়ে দোব, প্রতি পুরুষে ওদের এই কেচ্ছা, বুঝেছ?

সেই দু’পহরের রৌদ্র মাথায় করিয়া নদীর বালির উপরেই তাহাদের মজলিস জমিয়া উঠিল। সকলেরই মনোভাণ্ডে পরনিন্দার রস রৌদ্রতপ্ত তাড়ির মতই ফেনাইয়া গাঁজিয়া উঠিয়াছে।

.

সন্ধ্যা না হইতেই কথাটা গ্রামময় রটিয়া গেল।

ছোট রায়-বাড়ির কাছারি পর্যন্ত কথাটা আসিয়া পৌঁছিয়া গেল। ইন্দ্র রায় কাছারিতে ছিলেন না, অন্দরে নিয়মিত সন্ধ্যা-তর্পণে বসিয়াছিলেন; কথাটা প্রথম শুনিলেন রায়ের নায়েব মিত্তির। পথের উপর দাঁড়াইয়া অতিমাত্রায় ইতরতার সহিত রায়-বংশের নিঃস্ব নাবালকটির সেই অভিভাবিকা উচ্চকণ্ঠে কথাটা ঘোষণা করিতেছিল। মিত্তিরের সর্বাঙ্গে যেন জ্বালা ধরিয়া গেল, কোন উপায় ছিল না, ঘোষণাকারিণী স্ত্রীলোক। রায়কে কথাটা শুনাইতেও তাহার সাহস হইল না। সে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

রায়ের সন্ধ্যা-উপাসনা তখন অর্ধসমাপ্ত, দ্বিতীয় পাত্র কারণ পান করিয়া জপে বসিয়াছেন। গদগদস্বরে ইষ্টদেবীকে বার বার ডাকিতেছেন, মা আমার রণরঙ্গিনী মা! ধনী মুখার্জির সহিত দ্বন্দসম্ভাবনায় বহুকাল পরে গোপন ও উত্তেজনাবশে আজ ওই রূপ ওই নামটিই তাহার কেবল মনে পড়িতেছে।

সহসা বাড়ির উঠানে কাংস্যকণ্ঠে কে চীৎকার শুরু করিয়া দিল, হায় হায় গো! মরে যাই, মরে যাই! আহা গো! ‘পিড়ি পেতে করলাম ঠাঁই, বাড়া ভাতে পড়ল ছাই।’ দিলে তো চক্কবর্তীরা ঝামা ঘষে? হয়েছে তো? নাবালক শরিককে ফাঁকি দেওয়ার ফল ফলল তো? ঈর্ষাতুরা মেয়েটির পথে পথে চীৎকার করিয়াও তৃপ্তি হয় নাই, সে রায়ের অন্দরে আসিয়া হেমাঙ্গিনীর সম্মুখে হাত নাড়িয়া কথাগুলি শুনাইতেছে।

রায়ের ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, পরক্ষণেই আপনাকে তিনি সংযত করিলেন, ধীর স্থির ভাবে ইষ্ট দেবীকে স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন।

নীচে হেমাঙ্গিনীর মুখের কাছে হাত নাড়িয়া ভঙ্গি সহকারে নাবালকের অভিভাবিকাটি তখনও বলিতেছিল, তাই বলতে এলাম, বলি, একবার বলে আসি। আমার নাবালককে যে ফাঁকি দেবে, ভগবান তাকে ফাঁকি দেবে। আঃ, হায় হায় গো! হায় হায়! সে যেন নাচিতে আরম্ভ করিল।

হেমাঙ্গিনী ব্যাপারটার আকস্মিকতায় এবং রূঢ়তায় অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল, শঙ্কায় বিস্ময়ে কম্পিত মৃদুকণ্ঠে তিনি বলিলেন, কি বলছ তুমি?

ইতর ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ করিয়া বিধবাটি বলিল, আ মরে যাই! কিছু জানেন না কেউ! বলি, চক্কবর্তী বাড়ির রাঙা বর জুটল না তো মেয়ের কপালে? দিয়েছে তো চক্কবর্তীরা হাঁকিয়ে? বলি, কোন মুখে তোরা আবার গিয়েছিলি তাই শুনি? এই বাড়ির মেয়ে নাকি আবার চক্কবর্তীরা নেয়! বলে যে, ‘সেই-মিনসে নেয় না বসতে পাশে, মাগী বলে আমার ভালবাসে’ সেই বিত্তান্ত। আঃ হায় হায় গো! ফসকে গেল এমন সুযোগ! অকস্মাৎ তাহার কণ্ঠস্বর অত্যন্ত রূঢ় হইয়া উঠিল, যা চর ঢুকিয়ে দিগে চক্কবর্তীদের বাড়িতে! মেয়ে-জামায়ের জন্য লগর বসালেন! আঃ হায় হায়! হায় হায় গো!

সে যেমন নাচিতে নাচিতে আসিয়াছিল তেমনি নাচিতে নাচিতেই চলিয়া গেল। চৈতন্যহারা হেমাঙ্গিনী মাটির পুতুলের মতই বসিয়া রহিলেন। উপর হইতে গভীর দীর্ঘ কণ্ঠের ধ্বনি ভাসিয়া আসিল, তারা, তারা মা। সমস্ত বাড়িটার মধ্যে সে ধ্বনি প্রতিধ্বনির মত ঝঙ্কারে সুগম্ভীর হইয়া বাজিয়া উঠিল।

কিছুক্ষণ পর সিঁড়ির উপরে খড়মের শব্দ ধ্বনিত হইয়া উঠিল। সন্ধ্যা-উপসনার পর বিশেষ প্রয়োজন হইলে রায় নীচে নামেন না। আজ রায় নীচে নামিলেন, হেমাঙ্গিনী কিন্তু তবুও সচেতন হইয়া উঠিতে পারিলেন না। রায় নীচে নামিয়া ডাকিলেন, হেম! এ ডাক তাঁহার আদরের ডাক।

হেমাঙ্গিনী সাড়া দিতে পারিলেন না। রায় বলিলেন, উঠতে হবে যে হেম। উঠে একখানা ভাল কাপড় পর দেখি। আমার শালখানাও বের করে দাও।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া হেমাঙ্গিনী এবার উঠিয়া দাঁড়াইলেন। রায় বলিলেন, একটু শিগগির কর হেম, মাহেন্দ্রযোগ খুব বেশিক্ষণ নেই।

হেমাঙ্গিনী এতক্ষণে প্রশ্ন করিলেন, কোথায় যাবে?

হাসিয়া রায় বলিলেন, মা আমার আজ অনুমতি দিয়েছেন হেম। যাব রামেশ্বরের কাছে, উমার বিয়ের সম্বন্ধ করতে। ভাল কাপড় পর একখানা, আমার শালখানাও দাও।

হেমাঙ্গিনীর মুখ এবার উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, সোনার উমা, সোনার অহীন্দ্র তাঁহার। গোপন মনে এ-কথা তাহার কত বার মনে হইয়াছে।

চাকর চলিয়াছিল আলো লইয়া, চাপরাসী ছিল পিছনে। সুদীর্ঘ কাল পরে ইন্দ্র রায় চক্রবর্তী-বাড়ির দুয়ারে আসিয়া ডাকিলেন, কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া উঠিল, রামেশ্বর!

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনির মতই একটা ধ্বনি ভাসিয়া আসিল, কে? বিচিত্র সে কণ্ঠস্বর!

রায় উত্তর দিলেন, আমি ইন্দ্র।

.

২৫.

বিশীর্ণ ন্যুব্জদেহ, রক্তহীনের মত বিবর্ণ পাংশু, এক পলিতকেশ বৃদ্ধ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাহিয়া-দাঁড়াইয়া থরথর করিয়া কাঁপিতেছিলেন। উত্তেজনার অতিশয্যে কঙ্কালসার বুকখানা হাপরের মত উঠিতেছে নামিতেছে। হেমঙ্গিনী সুনীতিকে বলিলেন, ধর, ধর সুনীতি, হয়তো পড়ে যাবেন উনি।

ইন্দ্র রায় বিস্ময়ে বেদনায় স্তম্ভিত হইয়া গেলেন,- এই রামেশ্বর! কৌতুকহাস্যে সমুজ্জল, স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ, বিলাসী রামেশ্বর এমন হইয়া গিয়াছে! সে রামেশ্বরের একটুকু অবশেষও কি আর অবশিষ্ট নাই! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া রায় দেখিলেন, আছে কঠোর বাস্তব একটি মাত্র পরিচয়-চিহ্ন অবশেষ রাখিয়াছে, চোখের পিঙ্গল তারা দুইটি এখনও তেমনি আছে। কয়েক মুহূর্ত পর রায় দেখিলেন, না, তাও নাই; চোখের তারা তেমনি আছে, কিন্তু পিঙ্গল তারার সে দ্যুতি আর নাই। সুরহারা গানের মত অথবা রসহীন রূপের মতই সকরুণ তাহার অবস্থা।

ধীরে ধীরে রামেশ্বরের উত্তেজনা শান্ত হইয়া আসিতেছিল। খাটের বাজু ধরিয়া দেহের কম্পন তিনি রোধ করিয়াছিলেন; কেবল ঠোঁটের সঙ্গে চিবুক পর্যন্ত অংশটি এখনও থর থর করিয়া কাঁপিতেছে, পিঙ্গল চোখে জল টলমল করিতেছে। হেমাঙ্গিনী সুনীতিকে বলিলেন, একটু বাতাস কর তুমি।

ইন্দ্র রায়েরও চোখে জল ভরিয়া উঠিল, কোনরূপে আত্মসম্বরণ করিয়া তিনি বলিলেন, কেমন আছ?

চোখে জল এবং কম্পিত অধর লইয়াই রামেশ্বর হাসিলেন; ইন্দ্র রায়ের কথার উত্তর দিতে গিয়া অকস্মাৎ তাঁহার রঘুবংশের মহারাজ অজের শেষ অবস্থা মনে পড়িয়া গেল, সেই শ্লোকের একটা অংশ আবৃত্তি করিয়াই তিনি বলিলেন, ‘প্লক্ষ প্ররোহ ইব সৌধতলং বিভেদ’। ব্যাধি বটবৃক্ষের মত দেহমন্দিরে ফাট ধরিয়ে মাথা তুলেছে ইন্দ্র। এখন ভূমিস্মাৎ হাবার অপেক্ষা।

রায়ের চোখের জল এবার আর বাধ মানিল না, টপটপ করিয়া মেঝের উপর ঝরিয়া পড়িল, অশ্রু আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলিলেন, না না রামেশ্বর, ও-কথা বলো না তুমি, তোমাকে সুস্থ হতে হবে। আর তোমার হয়েছেই বা কি?

রামেশ্বর ঘৃণায় মুখ বিকৃত করিয়া বলিলেন, দেখতে পাচ্ছ না?-বলিয়া হাত দুইখানি আলোর সম্মুখে প্রসারিত করিয়া ধরিলেন।

রায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আঙুলগুলির দিকে চাহিয়া দেখিলেন; প্রদীপের আলোকের আভায় শুভ্র, শীর্ণ, অকুণ্ঠিত-অবয়ব আঙুলগুলির ভিতরের রক্তধারা পর্যন্ত পরিস্কার দেখা যাইতেছে। রায় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া দৃঢ়স্বরে বলিলেন, না, তোমার কিছু হয় নি, ও কেবল তোমার মনের ব্যাধি। মনকে তুমি শক্ত কর। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ; তোমার ছেলের বিয়ে দাও, স্ত্রী পুত্র-পুত্রবধূ নিয়ে আনন্দ কর।

রামেশ্বর অকস্মাৎ যেন কেমন হইয়া গেলেন, অর্থহীন দৃষ্টিতে শূন্য-লোকের দিকে বিহ্বলের মত চাহিয়া রহিলেন, ঠোঁট দুইটি ঈষৎ নড়িতে লাগিল, আপন মনেই তিনি যেন কিছু বলিতেছিলেন।

রায় রামেশ্বরের এই অসুস্থ অবস্থা দেখেন নাই, তিনি প্রথম দেখিয়া শঙ্কিত হইয়া পড়িলেন, শঙ্কিত হইয়াই তিনি ডাকিলেন, রামেশ্বর! রামেশ্বর!

ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফিরাইয়া রামেশ্বর রায়ের দিকে চাহিলেন; রায় বলিলেন, কি বলছ?

বলছি? ডাকছি, ভগবানকে ডাকছি, বলছি, ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ’। এ অন্ধকারের মধ্যে আর থাকতে পারছি না।

হেমাঙ্গিনী এবার সম্মুখে অগ্রসর হইয়া আসিলেন; ইন্দ্র রায় ও রামেশ্বরের কথাবার্তার ভিতর দিয়া অবস্থাটা ক্রমশঃ যেন অসহনীয় বায়ুলেশহীন অন্ধকারলোকের দিকে চলিয়াছে। দীর্ঘকাল পরে দুই বন্ধু এবং পরম আত্মীয়ের দেখা হওয়ার ফলে উভয়েই আত্মসংযম হারাইয়া স্মৃতির বেদনার তীব্র আবর্তের মধ্যে অসহায়ের মতই আবর্তিত হইয়া ভাসিয়া চলিয়াছেন। রামেশ্বরের পক্ষে এ অবস্থাটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু উচ্ছ্বাসই কথাবার্তাকে টানিয়া লইয়া চলিয়াছে, রায় কথাকে টানিয়া নিজের পথে চালিত করিতে পারিতেছেন না। এ ছাড়া, এই অবস্থাটাও আর সহ্য হইতেছে না। এই বেদনাদায়ক অবস্থাটিকে স্বাভাবিক করিয়া তুলিয়া তাহার মধ্যে একটু আনন্দ সঞ্চার করিবার জন্যই তিনি সম্মুখে আসিয়া বলিলেন, আমি কিন্তু এবার রাগ করব চক্রবর্তী মশায়, আপনি আমাকে এখনও একটি কথাও বলেন নি।

রামেশ্বর ঈষৎ চকিত হইয়া হেমাঙ্গিনীর দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন, সঙ্গে সঙ্গে গভীর বিষণ্ণতার মধ্য হইতেও আনন্দে একটু চঞ্চল এবং সজীব হইয়া উঠিলেন। হেমাঙ্গিনীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং প্রীতির সীমা ছিল না। নিস্তরঙ্গ স্তব্ধতার মধ্যে মৃদু বাতাসের আকস্মিক সঞ্চরণে সব যেমন স্নিগ্ধ সানন্দ চাঞ্চল্যে সজীব হইয়া উঠে, হেমাঙ্গিনীর সস্নেহ সরস কৌতুকে সমস্ত ঘরখানাই তেমনি চঞ্চল সজীব হইয়া উঠিল। রামেশ্বর সত্য সত্যই এতক্ষণ হেমাঙ্গিনীকে লক্ষ্য করেন নাই। দীর্ঘকাল পরে ইন্দ্র রায় ছাড়া অন্য সকল কিছু স্থান কাল পাত্র তাঁহার দৃষ্টির সম্মুখ হইতে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। হেমাঙ্গিনীর কথায় রামেশ্বর তাঁহাকে লক্ষ্য করিলেন, সঙ্গে সঙ্গে মুখ তাঁহার আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, সস্নেহে সম্ভ্রমের সহিত মৃদু হাসিয়া তিনি বলিলেন,

‘স্বপ্নে নু মায়া নু মতিভ্রমো নু কপ্তং নু তাবৎ ফলমেব পুণ্যৈঃ’।

এ আমার স্বপ্ন না মায়া, না মনের ভ্রম, কিংবা কোন পুণ্যফলের ক্ষণিক সৌভাগ্য, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি এসেছেন?

হেমাঙ্গিনী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া অকপট আনন্দে কৌতুক করিয়া বলিলেন, আমি কিন্তু স্বপ্নও নই, মায়াও নই, পুণ্যফলের সৌভাগ্য না কি বললেন, তাও নই। আমি আপনার কুটুম্বিনী। আপনি পণ্ডিত লোক, কবি মানুষ, কবিতা দিয়ে আসল কথা চাপা দিলেন। কথা তো আমিই যেচে কইলাম, আপনি তো কথা বলেন নি।

রামেশ্বর হাসিয়া বলিলেন, তা হলে বুঝতে পারছি, জীবনে সাগরতুল্য অপরাধের মধ্যেও কোথাও ক্ষুদ্রতম প্রবালদ্বীপের মত কোন একটি পূণ্যফল অক্ষয় হয়ে আছে, যার ফলে দেবীকে নিজে এসে দর্শন দিতে হল এবং ভক্তের সঙ্গে যেচেই কথা কইতে হল। ওর জন্যে আপনি নিজেও আক্ষেপ করবেন না, আমার প্রতিও অনুযোগ করবেন না; কারণ আপনি দেবধর্ম পালন করেছেন, আমিও ভক্তের অভিমান বজায় রেখেছি।

রামেশ্বরের কথা শুনিয়া রায় আশ্বস্ত হইলেন, কিন্তু বেদনা অনুভব না করিয়া পারিলেন না। স্বাভাবিক তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচায়ক উত্তর শুনিয়া তিনি আশ্বস্ত হইলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মনে হইল, কল্পনায় ব্যাধির সৃষ্টি, রামেশ্বরের আপনাকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রয়াস-এ শুধু রাধারাণির অভাব। রাধারাণিকে হারাইয়া আজ এই অবস্থা, একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলিতে গিয়া সেটাকে তিনি রুদ্ধ করিলেন। রামেশ্বরের পাশে বসিয়া অবনতমুখী সুনীতি ব্যথিত মুখেও হাসি মাখিয়া ধীরসঞ্চালনে পাখার বাতাস করিয়া চলিয়াছেন। সুনীতির দিকে চাহিয়া, তাঁহার কথা ভাবিয়া রায়ের বেদনার বাষ্প জমিয়া পাথর হইয়া গেল। দীর্ঘনিঃশ্বাস রোধ করিয়াও একটি অসম্বৃত মুহূর্তে গম্ভীর স্বরে তিনি ডাকিয়া উঠিলেন, তারা, তারা মা!

ঘরখানা সে গম্ভীর স্বরের ডাকে মুহর্তে আবার গম্ভীর হইয়া উঠিল। রামেশ্বর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, হেমাঙ্গিনী স্তব্ধ হইয়া গেলেন, সুনীতি উদাস হইয়া সকলের দিকে কোমল করুণ দৃষ্টি মেলিয়া চাহিয়া রহিলেন।

দেওয়ালের ব্র্যাকেটের উপর পুরানো আমলের মন্দিরের আকারের ক্লকঘড়িটার পেণ্ডুলামটা শুধু বাজিতেছিল-টক-টক, টক-টক।

***

ঘড়ির শব্দেই সহসা ইন্দ্র রায়ের খেয়াল হইল, মাহেন্দ্রযোগ পার হইয়া যাইতে আর বিলম্ব নাই। তিনি চঞ্চল হইয়া নড়িয়া-চড়িয়া বসিলেন, গলাটা একবার পরিস্কার করিয়া লইলেন, তারপর প্রাণপণে সকল দ্বিধাকে অতিক্রম করিয়া বলিলেন, রামেশ্বর!

চক্রবর্তী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, ম্লান হাসি হাসিয়া বলিলেন, উঠবে বলছ?

 না, আমি তোমার কাছে আজ ভিক্ষে চাইতে এসেছি।

ভিক্ষে! রামেশ্বর চোখ বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, আমার কাছে?

সুনীতিও সচকিত হইয়া উঠিলেন, মাথার ঘোমটা বাড়াইয়া দিয়া বিস্মিতভাবে রায় ও হেমাঙ্গিনীর দিকে চাহিলেন। চোখে চোখ পড়িতেই হেমাঙ্গিনী হাসিলেন।

ইন্দ্র রায় বলিলেন, হ্যাঁ, তোমার কাছেই ভিক্ষে।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ভিক্ষে বলতে হয় উনি বলুন, আমি বলছি ডাকাতি; না দিলে শুনব না, জোর করে কেড়ে নেব।

রামেশ্বর প্রশান্ত গম্ভীর মুখে ধীরভাবে বলিলেন, রায়-গিন্নী, ভাগ্যদেবতা যার বিমুখ হন, তার লক্ষ্মী ভাণ্ডারের দরজা খুলে দিয়েই বেরিয়ে যান, ভাণ্ডারের দরজা আমার খোলা, হা-হা করছে। আপনি সে ভাণ্ডারে কিছু নেবার অছিলায় প্রবেশ করলে বুঝব, লক্ষ্মী আবার ফিরে আসছেন। কিন্তু আমার লজ্জা কি জানেন, শূণ্য ভাণ্ডারের ধুলোয় আপানার সর্বাঙ্গ ভরে যাবে।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ও-কথা বলবেন না। যে ঘরে সুনীতির মত গিন্নী আছে, সে-ঘরে ধুলোর পাপ কি থাকে, না থাকতে পারে? আর সে-ঘর শূন্যও কখনও হয় না। ভাগ্য বিমুখ হয়, লক্ষ্মীও লুকিয়ে পড়েন, কিন্তু মানুষের পুণ্যের ফল, আঁধার ঘরের মানিক কোথাও যায় না। আমরা আপনার সেই মানিকের লোভে এসেছি। আমাদের ঘরে আছে এক টুকরো সোনা, সেই সোনা-টুকরোর মাথায় আপনার মানিকটি গেঁথে গয়না গড়াতে চাই, সুনীতি আর আমি, ভাগাভাগি করে সে গয়না পরব।

ইন্দ্র রায় একটা স্বস্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, এমন করিয়া গুছাইয়া বলিতে তিনি পারিতেন না। পুলকিত মৃদু হাসিতে তাঁহার মুখ ভরিয়া উঠিল। ও-দিকে সুনীতি বিস্ময়বিহ্বল দৃষ্টিতে হেমাঙ্গিনীর দিকে তাকাইয়া রহিলেন, তাঁহার হাত স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে, মাথার অবগুণ্ঠন প্রায় খসিয়া পড়িয়াছে, বুকের ভিতরটা উত্তেজনার স্পন্দনে দুরুদুরু করিয়া কাঁপিতেছে। সোনা ও মানিকের অর্থ তিনি যে বুঝিতে পারিতেছেন। কিন্তু সে কি সত্য!

গভীর চিন্তায় সারি সারি রেখায় রামেশ্বরের ললাট কুঞ্চিত হইয়া উঠিল; অনন্ত আকাশ হইতে পৃথিবী পর্যন্ত কোথায় তাঁহার কোন ঐশ্বর্য আছে, তিনি যেন তাহাই খুঁজিয়া ফিরিতেছিলেন; কিছু বুঝিতে পারিলেন না, শঙ্কিতভাবে বলিলেন, রায়-গিন্নী, আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, লক্ষ্মী যখন যান, তিনি তো শুধু বাইরের ঐশ্বর্যই নিয়ে যান না, মনকেও কাঙাল করে দিয়ে যান। আমার বোধশক্তিও লোপ পেয়েছে। আমায় আরও বুঝিয়ে বলুন।

এবার হেমাঙ্গিনী কিছু বলিবার পূর্বেই ইন্দ্র রায় বলিলেন, আমি কন্যাদায়গ্রস্থ হয়ে তোমার আশ্রয় ভিক্ষা করতে এসেছি, তোমার অহীন্দ্রের সাথে আমার কন্যার বিবাহের সম্বন্ধ করতে এসেছি।

মুহর্তে রামেশ্বর পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ নিশ্চল হইয়া গেলেন। স্থির বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ইন্দ্র রায়ের দিকে চাহিয়া রহিলেন। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, আমার উমাকে আপনি দেখেছেন, সেই যে, আপনাকে কবিতা শুনিয়েছিল-বাংলা কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা।

তবু রামেশ্বর কোন উত্তর দিলেন না, তেমনি স্তব্ধভাবে বিস্ফারিত চোখে অর্থহীন দৃষ্টিতে রায়-দম্পতির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলেন। এবার ইন্দ্র রায় ও হেমাঙ্গিনী উভয়েই শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। রামেশ্বরের পিছনে সুনীতি বসিয়াছিলেন, আনন্দের আবেগে তাঁহার দুই চোখ বাহিয়া অশ্রুর ধারা বিন্দু বিন্দু করিয়া কোলের কাপড়ের উপর ঝরিয়া পড়িতেছিল। অকস্মাৎ সে ধারা জলের প্রাচুর্যে যেন উচ্ছ্বাসময়ী হইয়া উঠিল। ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু সেদিকে কাহারও দৃষ্টি ছিল না, হেমাঙ্গিনী ও ইন্দ্র রায় শঙ্কিতভাবে রামেশ্বরের মুখের দিকেই চাহিয়া ছিলেন।

রামেশ্বর মুখ বিকৃত করিয়া বলিয়া উঠিলেন, আঃ, ছি ছি ছি! ঘৃণিত রোগ, বীভৎস ব্যাধি ছড়িয়ে গেল, পৃথিবীময় ছড়িয়ে গেল! এ!

ইন্দ্র রায়ের আশঙ্কা এবার বাড়িয়া গেল, তিনি আর থাকিতে পারিলেন না, ডাকিলেন, রামেশ্বর! রামেশ্বর!

কে? কে?-অপেক্ষাকৃত সহজ দৃষ্টিতে রায়ের দিকে চাহিয়া রামেশ্বর এবার বলিলেন, ও, ইন্দ্র! রায় গিন্নী!-বলিতে বলিতেই দারুণ বেদনায় তাঁহার মুখ চোখ আর্ত সকরুণ হইয়া উঠিল, বলিলেন, আঃ, ছি ছি ছি! রায়-গিন্নী, আমার কুষ্ঠ হয়েছে, কুষ্ঠ। আমার সন্তানের দেহে আমারই রক্ত। শাপভ্রষ্টা স্বর্গের উমা– ইন্দ্র, ইন্দ্র, আঃ, ছি ছি ছি, এ তুমি কি বলছ?

রায় পরম আন্তরিকতার সহিত গভীর স্বরে বলিলেন, ছি-ছি নয় রামেশ্বর তোমার রোগ তোমার মনের ভ্রম। আর এ বিবাহ আমার ইষ্টদেবীর প্রত্যাদেশ। মা আমাকে আদেশ করেছেন।

রামেশ্বর আবার যেন বিহ্বল হইয়া পড়িলেন, এত বড় অভাবনীয় ঘটনার সংঘাতে তাঁহার দুর্বল রুগ্ণ মস্তিষ্ক ক্ষণে ক্ষণে অস্থির হইয়া উঠিতেছিল; তিনি বিহ্বলের মত বলিলেন, ইষ্টদেবী? কিন্তু কিন্তু

আর কিন্তু কি হচ্ছে তোমার, বল?

সে কি। সে যদি!–সে না বললে

কে? কার কথা তুমি বলছ?

হেমাঙ্গিনী পিছন থেকে স্বামীকে আকর্ষণ করিয়া কথা বলিতে ইঙ্গিতে বারণ করিলেন, তারপর রামেশ্বরের আরও একটু কাছে আসিয়া বলিলেন, বলেছে, সেও বলেছে, হাসিমুখে বলেছে।

রামেশ্বরের চোখ হইতে টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িল, চোখের জলের মধ্যে ম্লান হাসি হাসিয়া এবার তিনি বলিলেন, সে কি অনুমতি দিয়েছে? আপনাকে বলেছে?

হ্যাঁ। এ বিয়ে না হলে তার গতি হচ্ছে না, সে শান্তি পাচ্ছে না। হেমাঙ্গিনীও এবার কাঁদিয়া ফেলিলেন।

 ইন্দ্র রায় সজল চক্ষে উপরের দিকে মুখ তুলিয়া ডাকিলেন, তারা তারা মা!

দুর্বল রামেশ্বর আর আত্মসংবরণ করিতে পারিলেন না; দরদর ধারায় চোখের জলে বুক ভাসিয়া গেল। হেমাঙ্গিনী তাঁহাকে সান্তনা দিয়া বলিলেন, অধীর হবেন না চক্রবর্তী মশায়।– বলিয়া তিনি সুনীতির পরিত্যাক্ত পাখাখানা তুলিয়া লইয়া বাতাস করিতে আরম্ভ করিলেন। ধীরে ধীরে আত্মসম্বরণ করিয়া রামেশ্বর হেমাঙ্গিনীকে বলিলেন, আপনি একটা কথা তাকে বলবেন? একটি কবিতা। বলবেন।

গিরৌ কলাপী গগনে চ মেঘো লক্ষান্তরেহর্ক সলিল চ পদ্মম্।
দ্বিলক্ষ দূরে কুমুদস্যনাথো যো যস্য মিত্র ন হি তস্য দূরম্।

হেমাঙ্গিনী অশ্রুসজল চোখে বহুকষ্টে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, বলব।

তারপর কিছুক্ষণের জন্য ঘরখানা একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেল। সে স্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া হেমাঙ্গিনীই আবার বলিলেন, তা হলে আমাদের কথার কি বলছেন বলুন?

রামেশ্বর বলিলেন, ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। উমা, উমা, পর্বতদুহিতা উমার মতই সে পুণ্যবতী। ইন্দ্র ইষ্টদেবীর আদেশ পেয়েছে, আপনি তার অনুমতি পেয়েছেন, এ যে আমারই মহাভাগ্য রায়-গিন্নী। চক্রবর্তী-বাড়িতে লক্ষ্মীর প্রত্যাগমনের সময় হয়েছে। সুনীতি! কই, শাঁখ বাজাও

রামেশ্বরের পিছনে আত্মগোপন করিয়া সুনীতি বিরামহীন ধারায় কাঁদিয়া চলিয়াছিলেন, স্বামীর শেষ কথাটির পর আর তিনি থাকিতে পারিলেন না, অতি মৃদুস্বরে করুণতম বিলাপধ্বনিতে তাঁহার বুকের কথা মুখে ফুটিয়া বাহির হইয়া আসিল, মহীন, আমার মহীন!

***

মুহর্তে ঘরখানা স্তব্ধ হইয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল, ঘরের মৃদু আলোটুকু পর্যন্ত কেমন বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে। হেমাঙ্গিনী, ইন্দ্র রায় অপরিসীম বেদনার আত্মগ্লানিতে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতেছিলেন, রামেশ্বর আবার বিহ্বল দৃষ্টিতে চাহিয়া নীরবে বসিয়া ছিলেন। সুনীতির কণ্ঠও স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। মুখে দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টানিয়া তিনি নিশ্চল হইয়া বসিয়া ছিলেন, যেন কত অপরাধ হইয়া গিয়াছে মুহর্তের অসংযমে। এই স্তব্ধতার মধ্যে সুনীতির সেই মৃদু বিলাপের কয়টি কথার সকরুণ ধ্বনি যেন প্রতিধ্বনিত পুঞ্জীভূত হইয়া সমস্ত ঘরখানাকে পরিপূর্ণ করিয়া ভরিয়া দিয়াছে; নিশীথযাত্রীর নীরবতার মধ্যে মাটির বুকে কীটপতঙ্গের রব ধ্বনির নিরবিচ্ছিন্ন একটি উদাস সুরে যেমন পৃথিবীর বুক হইতে অসীম শূন্য পর্যন্ত পরিপূর্ণ করিয়া দেয়।

কিছুক্ষণ পর রামেশ্বর বলিলেন, মহীন! হ্যাঁ হ্যাঁ, মহীন। আচ্ছা, দ্বীপান্তরে এক রকম পাতা পাকিয়ে দড়ি করতে দেয়, যাতে হাতে কুষ্ঠ হয়, না?

রায় বলিলেন, আঃ রামেশ্বর, তুমি মনকে একটু দৃঢ় কর ভাই। ও সব মিথ্যা কথা।

হেমাঙ্গিনী একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বিবর্ণ মুখে অতি কষ্টে একটু হাসির সৃষ্টি করিয়া বলিলেন, বেশ তো, সম্বন্ধ হয়ে যাক।

রামেশ্বর বলিলেন, না না না। এ-বিয়ে না হলে সে যে শান্তি পাচ্ছে না, তার যে গতি হচ্ছে না। রায় গিন্নী বলেছেন, রায়-গিন্নী

রায় বলিলেন, না না। হবে, দু দিন পরেই হবে। তুমি ব্যস্ত হয়ো না।

সুনীতি অন্দরের মধ্যে নির্বাসিতার মত নিতান্ত একাকিনী বাস করিলেও বায়ুতরঙ্গ ধ্বনি বহন করিয়া আনিয়া কানে তুলিয়া দেয়। এই অপমানকর রটনার ধ্বনির ক্ষীণ প্রতিধ্বনি কানে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল। এখন হেমাঙ্গিনীর কথা- ‘এ বিবাহ না হইলে রাধারাণী শান্তি পাইতেছে না, তাঁহার গতি হইতেছে না’, ইহার মধ্য হইতে সহজেই তিনি একটি গূঢ় অর্থ উপলব্ধি করিলেন। রাধারাণীকে লইয়া রায়-বাড়ির লজ্জা সময়ক্ষেপের ক্ষয়ে ক্ষয়িত হইয়া ইন্দ্র রায়কে মাথা তুলিবার অধিকার দিয়াছিল, কিন্তু রায়-বাড়ির জীবন গণ্ডীর মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করিয়া তিনি এবং অহীন্দ্রই আবার সে ক্ষয়িত লজ্জাকে দ্বিগুন করিয়া তুলিয়াছেন, পুরানো লজ্জা আরও নূতন হইয়া উঠিয়াছে। সে আত্মগ্লানি এবং লজ্জাতেই সুনীতি অপরাধিনীর মত স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। তিনি ধীরে মৃদুস্বরে ইন্দ্র রায় এবং স্বামীর সমক্ষেই ডাকিলেন, দিদি!

হেমাঙ্গিনী সচকিত হইয়া সুনীতির মুখের দিকে চাহিলেন, দেখিলেন, অনবদ্য প্রশান্তির একটি ক্ষীণ হাস্যরেখা সুনীতির মুখে নিশান্তের ক্ষীণ প্রসন্নতার মত ফুটিয়া উঠিয়াছে। সুনীতি বলিলেন, না দিদি, হোক, বিয়ে হোক। আমি একা আর থাকতে পারছি না। মহীন যখন ফিরে আসবে, তখন তার বিয়ে দিয়ে আবার আনন্দ করব। সুখের মধ্যে হঠাৎ তাকে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। হোক, হোক, বিয়ে হোক।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া রায় বলিলেন, তোমার মঙ্গল হবে বোন, তুমি আমাকে সত্য-লজ্জা না হোক লোকলজ্জার হাত থেকে ত্রাণ করলে। সুনীতি উঠিয়া বলিলেন, ঠাকুরের পুজোর টাকা তুলে আসি দিদি, আর মানদাকে বলি, শাঁখ বাজাক, বাজাতে হয়। আপনি একটু বসুন দিদি, মিষ্টিমুখ করে যেতে হবে।

<

Tarasankar Bandyopadhyay ।। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়