ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। পরিষ্কার কাঁচের কারণে আলো বেশ উজ্জ্বল। ওরা তিনজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল। জয়িতা একটা বেতের চেয়ারে বসে হ্যারিকেনের আলোয় রঙিন পত্রিকায় চোখ রেখেছিল। সুদীপ আনন্দর বিছানায় চিৎ হয়ে পড়েছে। কল্যাণ আর একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে। এই ঘরে বিত্তের চিহ্ন নেই, কিন্তু বাঙালী মানসিকতার ছাপ রয়েছে। এখন আনন্দ বাইরে। ওরা পেছনের দরজা দিয়ে এখানে ঢুকেছে।সমস্ত তল্লাটটা অন্ধকারে ড়ুবে থাকায় ঢোকার সময় কেউ তাদের লক্ষ্য করেনি। এই ঘরে তাদের বসতে বলে আনন্দ বেরিয়েছে অনেকক্ষণ। কোথাও কোন শব্দ নেই। জয়িতা পত্রিকা থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, তোর শরীর ঠিক আছে?

সুদীপ সেই অবস্থায় বলল, ফার্স্টক্লাস।

জয়িতা আবার চোখ নামাল। কিন্তু সে পত্রিকা পড়তে পারছিল না। এই ঘরে আসার পর থেকেই বুকের ভেতর ছটফটানি শুরু হয়েছে। এরকম উত্তেজনা কখনও সে বোধ করেনি। এই ঘরটা যেন মেকআপ রুম। স্টেজে নামবার আগে জিরিয়ে নেবার পালা। এতক্ষণ কলকাতা থেকে আসবার আগে অথবা বাসে বসেও এরকম অস্বস্তি একবারও হয়নি। চোখ বন্ধ করল জয়িতা। তবে সকালে ঘুম থেকে উঠেই বুকের ভেতরে একটা চিনচিনে অনুভূতি শুরু হয়েছিল। কতকালের চেনা দেওয়াল, আসবার এমনকি টুকিটাকি জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা কষ্টবোধ শুরু হচ্ছিল। ঠিক সেইসময় দরজায় শব্দ হয়েছিল। সেই মুহূর্তে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু শব্দটাকে থামাবার জন্যেই দরজা খুলতে হয়েছিল। বহুদিনের অভ্যেসে রাত্রে শোওয়ার সময় হাউসকোট থাকে ওর, দরজা খুলতেই রামানন্দকে দেখতে পেয়ে বুকের কাছটা হাত দিয়ে টেনে ধরল সে। এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা সে কিছুতেই করতে পারে না। এই মুহূর্তে সে একটুও দৃষ্টিকটু পোশাকে ছিল না কিন্তু হাউসকোট পরনে থাকার জন্যেই কি তার হাত বুকের ওপরে উঠে গিয়েছিল? শার্ট প্যান্ট পরে সারাদিনে কত মানুষের মুখোমুখি হয় সে, কিন্তু কখনই তো ওরকম আচরণ করে না। মেয়েলিপনা অভ্যেস নেই, মেয়েরা যা করে থাকে তা ওর ধাতে আসে না কিন্তু একথাও ঠিক কিছু মেয়েলি স্বভাব অগোচরেই রক্তে থেকে গেছে। অচেতন মুহূর্তে সেটা প্রকাশ পায় এবং এ ব্যাপারে তার কিছুই করার নেই। রামানন্দকে দেখে সে সত্যি অবাক হয়েছিল। নিশ্চয়ই তার চোখে মুখে প্রশ্ন ফুটে উঠেছিল নইলে রামানন্দ কেন কৈফিয়ৎ দেবার ভঙ্গি করে বলবেন, তোর সঙ্গে একটা কথা ছিল। ঠিক আছে, তুই ফ্রেস হয়ে নে, আমি না হয় পরে আসব। রামানন্দ বিব্রতভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াতেই জয়িতা বলেছিল, তুমি বসতে পার, আমার দুমিনিট লাগবে। রামানন্দ চকিতে একবার ভেতরের দিকে তাকিয়েছিলেন। তারপর চট করে ঘরে চলে এলেন। জয়িতা আর অপেক্ষা করেনি। বাথরুমে নিজেকে ভদ্রস্থ করতে করতে সে ভেবে পাচ্ছিল না কি কারণে রামানন্দ অমন আচরণ করছেন! বোঝাই যাচ্ছে ওঁর এই আসাটা সীতার দৃষ্টি এড়িয়ে। কেমন একটা চোর-চোর ভাব আছে। হাউসকোটটা পালটাতে গিয়ে মত পরিবর্তন করল জয়িতা। সে এমন কিছু অশোভন পোশাকে মেই যে প্যান্ট পরতে হবে। অস্বস্তিটাকে উড়িয়ে দিতেই সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে দেখল একমাত্র চেয়ারে রামানন্দ বসে আছেন। খাটে পা মুড়ে বসল জয়িতা, বসে বলল, বল।

রামানন্দ মাথা নামালেন। কথাটা কিভাবে বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। লক্ষ্য করল জয়িতা। কিন্তু সে কিছুই বলতে চাইল না। মিনিটখানেকের মত সময় ব্যয় করে রামানন্দ চোখ না তুলে বললেন, ইটস নট মাই ফন্ট, নট অ্যাট অল!

কি ব্যাপারে বলছ?

ঐন্দ্রিলা ব্যাপারটায় রঙ চাপিয়েছে। এটা ওর অভ্যেস। অন্তত আরও পাঁচটা ফ্যামিলিতে ও এই কাণ্ড করেছে।

হঠাৎ এতদিন পরে এইসব কথা বলতে এলে কেন?

না, মানে, আমি ব্যাপারটা ভুলতে পারছি না। তুই, তুই–।

ইটস অলরাইট। এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন আমার নেই।

রামানন্দ এবার চোখ তুলে তাকালেন, ঠিক আছে, তোকে অন্য একটা কথা বলতে চাই। অনেক ভেবেচিন্তে আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। তুই এখন বড় হয়েছিস, তোর কথাটা জানা দরকার। তোর মা যে জীবনযাপন করছে এটা আর আমার পছন্দ নয়। কিন্তু সে আমার নিষেধ মানতে চাইছে না। এই অবস্থায়।

জয়িতা দেখল রামানন্দ পরের কথাটা কিভাবে বলবেন সেটা ভেবে নিচ্ছেন। সে প্রশ্নটা করেই ফেলল, তুমি যা করে যাচ্ছ তা মা পছন্দ করছে?

হ্যাঁ, সে চাইছে। কারণ আমি এইরকম জীবনযাত্রায় থাকলে তার সুবিধে হয়। ও আজ দুপুরের ফ্লাইটে সান্যালের সঙ্গে বাইরে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক করে কাল আমাকে জানিয়েছে। এটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।

সমস্যাটা তোমার এবং মায়ের। আমাকে বলতে এসেছ কেন?

রামানন্দ জয়িতার দিকে তাকালেন, জয়ী, তুই আমার মেয়ে, আমি যদি বিবাহবিচ্ছেদ চাই তাতে তোর আপত্তি আছে?

নোচ, নট অ্যাট অল! এটা তোমাদের ব্যাপার। তবে যদি আমার থাকা নিয়ে কোন অসুবিধে হয় তাহলে জানিয়ে দিও। ওহো, আমাকে হয়তো কয়েকদিন কিংবা অনেকদিনের জন্যে বাইরে যেতে হতে পারে। সেটা হলে তোমরা কোনরকম দুশ্চিন্তা করো না। অবশ্য তার জন্যেও তোমাদের সময় হবে না হয়তো।

কোথায় যাবি? প্রায় চমকে উঠেছিলেন রামানন্দ।

এখন কোথায় যাব আমি তোমাকে এই মুহূর্তে জানাতে চাই না।

তোরা কি আরম্ভ করেছিস? জয়ী, আমি তোকে অন্যরকম মেয়ে বলে জানতাম।

তাই? না, আমি কোন সান্যালের সঙ্গে জয়ট্রিপে যাচ্ছি না!

রামানন্দ এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখমুখ অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। প্রাণপণে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করছিলেন বুঝতে পারছিল জয়িতা। ওর বেশ মজা লাগছিল। এই মুহর্তে অত্যন্ত দায়িত্ববান পিতার মত মনে হচ্ছে তাকে। অদ্ভুত গলায় রামানন্দ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কত টাকা সঙ্গে নিতে চাও?

নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকালো জয়িতা। যেন প্রস্তাবটা সে ধরতে পারছে না।

রামানন্দ এবার সরল করার চেষ্টা করলেন, তাঁর মুখ এখনও লাল, বাইরে যাচ্ছ, তোমার কি টাকার দরকার আছে?

জয়িতা ঘাড় নেড়ে না বলল। রামানন্দ আর দাঁড়ালেন না। সেই মুহূর্তে ওই ঘরে নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল জয়িতার। একটু বড় হবার পর থেকেই একা একা থাকতে থাকতে সেটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে কারও সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা না বলার প্রবণতা এসে গিয়েছিল। চুপচাপ বই পড়া গান শোনা বা ঘুমোনোর মধ্যে বেশ স্বস্তি পাওয়া যেত। কিন্তু রামানন্দ বেরিয়ে যাওয়ার পর ওই শব্দহীন ঘরে বসে কিরকম একটা কাঁপুনি এল শরীরে। ও চটপট বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। এবং সেই সময় সীতার গলা কানে আসতেই কাঁপুনিটা থেমে গেল। টেলিফোনে সীতা কাউকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় যেন তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। শব্দগুলো কানে যাওয়ামাত্র সহজ হয়ে গিয়েছিল জয়িতা। স্বচ্ছন্দে ঘরে ফিরে গিয়েছিল সে।

পত্রিকাটা বন্ধ করে চোখ তুলল জয়িতা। সুদীপ কি এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল? উলটোদিকে বসা কল্যাণ বলল, আনন্দ কোথায় গেল? দেখব?

জয়িতা মাথা নাড়ল, না। বেশি ঘোরাঘুরির দরকার নেই, কখন দেখে ফেলবে, তারপর—! আসবে নিশ্চয়ই কাজ সেরে। তারপর নিচু গলায় প্রশ্ন করল, তোর এখন কি মনে হচ্ছে?

ঠিক হ্যায়। তাছাড়া যাচ্ছিস তো তোরা, মনে হবে তোদেরই।

তোরাও তো একসময় যাবি।

সময়টা আসুক। এখন আমার খিদে পেয়েছে খুব।

তুই একটা পেটুক আছিস! হাসল জয়িতা।

দুপুরে কি খেয়েছিস?

লাঞ্চ। জয়িতা খানিকটা বিস্মিত কল্যাণের প্রশ্ন করার ধরনে।

বাড়িতে ফাটাফাটি হয়ে গেছে আজ। উনুন ধরেনি। ভাত আর তরকারিকে যদি লাঞ্চ বলা যায় তো সেটা আমার ভাগ্যে জোটেনি।

আই অ্যাম সরি!

দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। আমাদের এইসব নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। কেন ঝগড়া হল?

হল–না হয়ে কোন পথ ছিল না তাই। আসলে অভাব থেকেই তো অক্ষমতা, ঈর্ষা আসে। আর সেটাকে ঢাকতে বেশির ভাগ মানুষই গলা চড়িয়ে মেজাজ দেখানো ছাড়া কোন পথ পায় না। কল্যাণ চোখ বন্ধ করল।

এইসময় বারান্দায় শব্দ হল এবং তারপরেই আনন্দ দরজায়, একটু দেরি হয়ে গেল। মা ছিল না বাড়িতে। খবর দিয়ে এলাম, এখনই আসছে।

কল্যাণ বলল, তিনি আসুন, কিন্তু বাবারদাবার কিছু হবে?

আনন্দ বলল, তৈরি হচ্ছে। আমি যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলাম। সুদীপ কি ঘুমোচ্ছিস, কি করে পারিস?

সুদীপ কোন সাড়া দিল না। তার শরীরটা তখনও টানটান পড়ে আছে। আনন্দ এবার জয়িতার দিকে তাকাল, কি শাড়ি এনেছিস?

দক্ষিণী।

মানে? আনন্দর মুখে বিস্ময়।

তুই বুঝতে পারবি না। ভালই কাজ চলবে।

চটপট পরে নে। ওপাশে একটা ঘর আছে, চলে যা।

এক্ষুনি?

হ্যাঁ। যে মেয়েটা খাবার দেবে সে যেন তোর প্যান্ট শট না দেখে। গ্রামের কেউ যদি লক্ষ্য করেও থাকে তাহলে তোকে মেয়ে বলে চেনেননি। সবাই ভাববে তিনটে ছেলে আমার সঙ্গে এসেছিল। একে জিজ্ঞাসা করলে এ বলবে দুটো ছেলে একটা মেয়ে। দুটো মিলবে না। যা।

ব্যাগটা নিয়ে উঠল জয়িতা। তারপর পাশের ঘরে চলে গেল। এই ঘরেও একটা হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে রাখা ছিল। দরজা বন্ধ করে সে ব্যাগটা খুলল। তারপর সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্কটা বের করল। রঙটা সত্যি ভাল কিন্তু এইরকম জমকালো শাড়ি পরার ইচ্ছেই হয় না তার। শার্ট প্যান্ট খুলল সে। তারপর ধীরে ধীরে শাড়ি-ব্লাউজের খোলস চাপাতে লাগল। তার ছোট চুল এই শাড়ির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না। সুদীপের পরামর্শে নকল চুল এনেছিল সে। এখন আধা-আলোয় নিজেকে আয়নায় দেখে কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছিল তার। এইভাবে কোনদিন প্রসাধন করেনি জয়িতা। আজ অনভ্যস্ত হাতে খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সাবধানী আঙুলে নকল চুলকে প্রায় আসলের চেহারায় আনল সে। নিজের দিকে তাকিয়ে হাসি পাচ্ছিল তার। কিছুতেই নিজেকে লবঙ্গলতিকা বলে মনে হচ্ছে না। কি আর করা যাবে, সবার তো সব হয় না। প্যান্টশার্ট ব্যাগের ওপরেই রাখল সে, প্রয়োজনে যেন হাতড়াতে না হয়। দরজা খুলে পাশের ঘরে যেতেই সুদীপ চেঁচিয়ে উঠল, দারুণ দেখাচ্ছে কিন্তু, তুই আমার পাশে আসবি না?

কথাটা সবাই শুনল কিন্তু কেউ কিছু বলল না। আনন্দ আর কল্যাণ জয়িতার দিকে প্রশংসার চোখে তাকিয়ে ছিল। আনন্দ এক পা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, দেখলে মনে হবে তত বড়লোকের মেয়ে ফুর্তি করতে এসেছিস্ বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে!

জয়িতা বলল, সেটা তোরা বল, আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই।

কল্যাণ হাসল, ভাগ! তোদের সোসাইটিতে দেখিস নি?

আনন্দ মাথা নাড়ল, কেউ সন্দেহ করবে না। তোকে চমৎকার মানিয়েছে।

সুদীপ চুপচাপ শুনছিল মুখে হাসি রেখে। বলল, উঃ, এখান থেকেই গন্ধ পাচ্ছি!

জয়িতা চোখ ছোট করল, তখন থেকে কি বকছিস?

পারফিউম আনিসনি সঙ্গে? নাক টানল সুদীপ।

না।

এই জন্যেই তুই মেয়ে হলি না। যে মেয়ে প্যারাডাইসে যাবে তার ব্যাগে দুটো পি থাকবেই।

দুটো পি মানে। কল্যাণ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

একাডেমিক ডিসকাশন হিসেবে নেবে সবাই। পারফিউম অ্যান্ড প্রোটেকশন।

ভাগ্‌। প্রায় চিৎকার করে উঠল জয়িতা।

যে পুজোয় যে ফুল ভাই। তোর ওই নকল চুলে বিটকেল গন্ধ ছাড়ছে নিশ্চয়ই, একটু গন্ধটন্ধ ঢাললে আমার ভাল হত। সুদীপ আবার শুতে শুতে বলল, চলবে আনন্দ?

এই সময় আনন্দ পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, মা আসছে। কথাটা শোনামাত্র সুদীপ আবার উঠে বসল। জয়িতার মুখ তখনও লাল, নিজেকে সামলে নিতেই সে পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। আনন্দ বলল, এসো মা, এরাই আমার বন্ধু।

পঞ্চাশঘেরা এক মহিলা দরজায় এসে দাঁড়ালেন। কল্যাণের মনে হল আনন্দর মা এখনও সুন্দরী। জয়িতা মুগ্ধ চোখে দেখছিল। এত আঘাত, একাকী একটি মহিলার বেঁচে থাকার লড়াই সত্ত্বেও সর্বাঙ্গে কেমন স্নিগ্ধ মা-মা ভাব ফুটে উঠেছে। আনন্দর মা বললেন, তোমরা অনেকক্ষণ এসেছ শুনলাম। কিছু মনে করো না, খুব দরকারেই আমাকে বেরোতে হয়েছিল।

কল্যাণ বলল, না না, আমাদের কোন অসুবিধে হয়নি।

সুদীপ বলল, মাসীমা ঘরে এসে বসুন, আমি সুদীপ।

বাঃ, তোমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাব? তুমি কল্যাণ?

হ্যাঁ মাসীমা।

আর তুমি জয়িতা, তাই তো?

জয়িতা মাথা নাড়ল। তারপর কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করল। মাসীমা তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি তো খুব ভাল।

জয়িতাকে প্রণাম করতে দেখে আনন্দ উঠল। সুদীপ বলল, অহো, আমি তো গতবারও প্রণাম করেছি। জয়টা না এমন ভোবায়—।

না না, তোমাদের ড়ুবতে হবে না। বসো তো সবাই। তুমি এসো আমার সঙ্গে।

মাসীমা চলে গেলেন জয়িতাকে নিয়ে। কল্যাণ বলল, ভাগ্যিস ও শাড়িটা পরে নিয়েছিল, প্যান্ট পরা দেখলে হয়ে যেত চিত্তির!

আনন্দ বলল, কিছুই হত না। মাকে কনজারভেটিভ ভাবার কোনও কারণ নেই।

সুদীপ বলল, পুরো ব্যাপারটা তোর মাথায় আছে?

আছে।

তুই আর কল্যাণ খেয়েদেয়ে আধঘন্টা পরে বের হবি। তার ঠিক ঘণ্টাখানেক পরে আমি জয়িতাকে নিয়ে ডায়মন্ডহারবার রোডের সেই বটগাছটার নিচে থাকব। আবার বলছি গাড়িটা নেবার সময় কোন ঝুঁকি নিবি না। এমন পরিস্থিতি যেন না হয় যে নেওয়ামাত্র চারধারে গোলমাল শুরু হয়ে গেল!

হবে না।

এই সময় দরজায় শব্দ হল। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, খাবার দিয়েছ?

একটি প্রৌঢ়া মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হা বলল। আনন্দ বলল, চল খেয়ে নিই।

ওরা বারান্দায় এল। উঠোনটা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। ওদিকটায় একটা ছোটখাটো বাগান আছে, গাছের গন্ধ বাতাসে। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল মাসীমা ব্যাপারটা জানেন? মানে, এখন যে–।

না।

কোন প্রশ্ন করবেন না?

না। মা মনে করেন আমি কোন অন্যায় করতে পারি না।

সুদীপ চাপা গলায় মন্তব্য করল, স্নেহান্ধ!

না। যদি বুঝি কাজটা অন্যায় হয়ে গেল তাহলে এসে মাকে জানাই।

কল্যাণ ঠোঁটে শব্দ তুলল, তোকে হিংসে হচ্ছে রে! কপাল করেছিলি!

 

চারজনে মাটিতে আসন পেতে খাচ্ছিল। সুদীপ পা ছড়িয়ে বসেছিল। হাঁটু মুড়ে খাওয়ার অভ্যেস না থাকায় তার অসুবিধে হচ্ছিল। জয়িতা দুই হাঁটু মুড়ে শাড়ি নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে কিছুক্ষণ বাদেই টের পেল তার দুটো পা টনটন করছে, ঝিঝি ধরে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। এইভাবে খাওয়ার অভ্যেস তারও নেই। কিন্তু ওরা দুজন মুখে কিছু বলল না। এখন তো সবরকম পরিস্থিতির সঙ্গেই মানিয়ে নিতে হবে, এইরকম একটা ভাবনা ভাবতে চেষ্টা করছিল ওরা। কল্যাণ খুব স্বছন্দ ভঙ্গিতে খেতে খেতে হঠাৎ জয়িতার আওড়ানো পেটুক শব্দটা মনে পড়ে যেতেই শ্লথ হয়ে গেল। আনন্দর কোনও উত্তাপ ছিল না। মাসীমা একটু তফাতে আসন পেতে বসেছিলেন, সুদীপের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কিছুই খাচ্ছ না–তুমিও না জয়িতা।

সুদীপ উত্তর দিল, ও ফিগার ঠিক রাখছে আর আমার খিদে পায়নি।

জয়িতা প্রতিবাদ করল, ওর কথায় একদম বিশ্বাস করবেন না মাসীমা। বড় বাজে কথা বলে।

আনন্দ বলল, ওরা কিন্তু আজকেই চলে যাবে মা।

মাসীমা অবাক হলেন, সেকি! তাহলে আসাই বা কেন? এই অন্ধকারে এসে ফিরে গেলে তোমরা তো কিছুই দেখবে না। চলে যাওয়াটা কি খুব জরুরী?

আনন্দ বলল, হ্যাঁ।

মাসীমা এবার গলার স্বর নামালেন, তুইও যাচ্ছিস?

এখনই বলতে পারছি না, হয়তো ফিরে আসতে পারি।

জয়িতা লক্ষ্য করল আনন্দর মা আর কথা বাড়ালেন না। ভদ্রমহিলাকে সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল। বন্ধুদের কাছ থেকে সরিয়ে নিজের ঘরে এনে উনি বলেছিলেন, বোকা মেয়ে, ওভাবে শাড়ি পড়তে হয়? তোমার সায়া দেখা যাচ্ছে, পেছনদিকটা উঠে আছে।

ঘাড় ঘুরিয়ে সেটা আবিষ্কার করে লজ্জিত হয়েছিল সে শাড়ি পরার ব্যাপারে যে সে একদম আনাড়ি এটা বুঝতে ওঁর মোটেই অসুবিধে হয়নি। নিজের হাতে শাড়ি পরিয়ে দিলেন উনি। আর সেই মুহূর্তে সীতার কথা মনে হচ্ছিল খুব। অবশ্য মনে হওয়াটাও বোকামি। তারপর টুকটাক কথা। কিন্তু কখনই জয়িতার ব্যাপারে শোভনতার বেড়া ডিঙিয়ে নয়। এমন কি এই ছেলে তিন বন্ধুবান্ধবীকে নিয়ে সন্ধ্যের পর হাজির হল তাই নিয়েও বিস্ময় নেই। অথচ মহিলাকে বোকা কিংবা সরল ভাবার কোন কারণ নেই। উনি কথা বললেন সম্ভ্রম রেখে। আনন্দ বোধহয় মায়ের স্বভাবের খানিকটা পেয়েছে। তাদের বয়সী কেউ অমন গাম্ভীর্য রপ্ত করেনি, গুছিয়ে কথা বলতে শেখেনি। জয়িতা আনন্দর মায়ের মুখের দিকে তাকাল। এমন নির্লিপ্ত অথচ স্নিগ্ধ মুখ সে কোনদিন দ্যাখেনি।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে ছেলেরা ঘরে ফিরে গেলে জয়িতা বাথরুমে ঢুকল। হ্যারিকেনটা চৌবাচ্চার উপরে রেখে সে দেখল ঘরটা মোটামুটি পরিষ্কার কিন্তু বালতিতে জল ভোলা আছে, কলের ব্যবস্থা নেই। কমোড নেই। কথাটা মনে হতেই সে হেসে ফেলল। অভ্যেস বড় বদ জিনিস। অজান্তেই মনে কামড় দেয়।

সিগারেট ধরিয়ে সুদীপ বলল, মাসীমাকে কিছু বললি না?

না, বললে অসুবিধে অস্বস্তিতে থাকবে। হয়তো মুখে কিছু বলবে না কিন্তু মন থেকে চাইবে কিনা সন্দেহ আছে। জিনিসগুলো আলাদা কর।

ওগুলো আলাদা করাই আছে। ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে নে। এখন ঠিক সাড়ে আটটা বাজে, তোরা সাড়ে নটায় স্পটটায় চলে আসবি, আগে এলেও ক্ষতি নেই।

আনন্দ সময়টা ঠিক করে নিয়ে বলল, অন্ধকারে পৌঁছাতে পারবি তো?

রাস্তাটা পরিষ্কার মনে আছে, তবে অন্ধকাবে একটু–, আর একবার বল।

তোরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকে হাঁটতে শুরু করবি। মিনিট তিনেক যাওয়ার পর রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে। ডানদিক দিয়ে হাঁটলেই তোরা ডায়মন্ডহারবার রোডে গিয়ে পড়বি। তারপর বাঁ দিকে খানিকটা এগোলেই গ্রামটা শেষ হয়ে যাবে। মিনিট দশেক হাঁটলে পেট্রল পাম্প দেখতে পাবি। বিশদ বুঝিয়ে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, আমি কি তোদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে আসব?

সুদীপ মাথা নাড়ল। তারপর সেই সযত্নে নিয়ে আসা ব্যাগটা খুলে দুটো প্যাকেট বের করল। ভারী প্যাকেটটা সে আনন্দর দিকে এগিয়ে দিল। ওর মুখে সামান্য কঁপন নেই। যেন অভ্যস্ত হাতে সে কাজ করছে। তারপর দুটো রিভলবার বের করে একটা এগিয়ে দিল আনন্দর সামনে, গুলি লোড করা আছে, ওকে আর একবার বুঝিয়ে দিস।

সুদীপ যন্ত্রটাকে লুকিয়ে নিল শরীরে। তারপর কল্যাণের দিকে তাকিয়ে বলল, চল্।

কল্যাণ উঠল। ওকে এখন বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সেটা বুঝতে পেরে আনন্দ বলল, শোন কল্যাণ, তুই ইচ্ছে করলে এখনই কলকাতায় ফিরে যেতে পারিস।

না, মানে, তুই এই কথা বলছিস কেন?

তোর যদি মনে হয়–ইটস আপটু ইউ!

আনন্দ, আমি ঠিক আছি। কিন্তু গ্রামের পথে কেউ যদি পরিচয় জানতে চায় তাহলেই মুশকিল। আসার সময় তো দেখলাম। কল্যাণ স্বাভাবিক হতে চাইছিল।

তোরা বলবি আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলি। কলকাতায় ফিরে যাচ্ছিস। তবে চেষ্টা করবি যাতে সেরকম কারও সামনে না পড়িস।

ওরা বাইরে বেরিয়ে আসতেই জয়িতাকে দেখতে পেল। কল্যাণ বলল, বেরুচ্ছি।

জয়িতা হাসল, উইস ইউ গুড লাক।

সুদীপ বলল, নায়িকা নায়িকা ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার কপালে শেষ পর্যন্ত এই জিনিস জুটল। ওরা ঢুকতে দেবে কিনা সন্দেহ।

জয়িতা তীব্র প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল কিন্তু আনন্দ বাধা দিল, আঃ সুদীপ, এই সময়টায় না হয় ঠাট্টাটা বন্ধ রাখ।

সুদীপ হাসল, পেছনে না লাগলে যেটা খেলাম সেটা হজম হত না। মাসীমা কোথায়?

আনন্দ বলল, বলে যেতে হবে না। গুড বাই।

ওরা দুজনে চুপচাপ অন্ধকারে বেরিয়ে গেল। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, ওরা ঠিকঠাক চিনতে পারবে তো? সুদীপ তো মাত্র একবার এসেছিল!

সুদীপকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই। চিন্তা কল্যাণের জন্যে।

কেন?

টিপিক্যাল লোয়ার মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ও। বিপদে পড়লে কতটা শক্ত থাকবে বলা মুশকিল।

আমার কিন্তু কল্যাণের ওপর আস্থা আছে। ওর তো ভাল রেজাল্ট ছাড়া কোন সম্বল কিংবা পিছুটান নেই। কারও কাছ থেকে কিছু পাওয়ার সুযোগও নেই। ও যেটা করে সেটা এক ধরনের অভ্যেস থেকেই করে, বাঙালীদের অভ্যেস।

ওরা ঘরে ফিরে এল। গ্রাম এখন আরও নিস্তব্ধ। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তোকে কি করতে হবে সেটা আবার বলে দেবার দরকার আছে?

মাথা নাড়ল জয়িতা, তারপর বলল, এই বিদঘুটে চুলটা বড্ড ডিস্টার্ব করছে!

কিছু করার নেই। তোর অরিজিন্যাল চুল মনে রাখতে কারও অসুবিধে হবে না।

আজকাল অনেক শাড়িপরা মেয়ের চুলের কাট এইরকম, আমারটা অবশ্য একটু বেশি।

সেইটেই আমাদের বিপক্ষে যাবে। বরং এই চুলের বর্ণনা পেয়ে কেউ আন্দাজ ঠিক রাখতে পারবে। তুই ঠিক আছিস, এই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আনন্দ দ্বিতীয় রিভলবারটা জয়িতার হাতে দিল; গুলিভরা আছে। কি করে ওপেন করবি তা জানিস? খুব প্রয়োজন না হলে ব্যবহার করিস না। ওটা শরীরে রাখিস না, অসুবিধে হবে। তোর ব্যাগের ঠিক ওপরেই রেখে দে। প্রয়োজন বুঝলে বের করিস। সুদীকেও বলে দিস তোরা যে যে জিনিস নিয়ে ভেতরে যাচ্ছিস সেগুলো যেন ওখানে পড়ে না থাকে।

জয়িতা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রিভলভারটা দেখছিল। এবার হেসে বলল, প্র্যাকটিসের সময় আমি ফর্টি পার্সেন্ট মার্ক পেয়েছিলাম। এবার যেন নম্বরটা একটু বাড়ে। ওটাকে ভালভাবে রেখে দিয়ে জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তোদের এখানে পঞ্চায়েত তো সি পি এমের?

না। শুধু এই দুটো গ্রাম কংগ্রেসের। এর আগেরবার সি পি এমের ছিল।

দুটো পার্টি প্রটেস্ট করেনি?

করলে আমরা এখানে আসতাম না। পোস্টারগুলো কোথায়?

কল্যাণের ব্যাগে। এদিকে নতুন পার্টির কোন কাজকর্ম নেই?

আছে, না থাকার মতন। তুই আধঘণ্টা রেস্ট নে। আমি মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসি।

জয়িতা আনন্দর দিকে তাকাল। তারপর নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

 

কল্যাণ বড় বড় পা ফেলছিল। সুদীপ চাপা গলায় বলল, আস্তে চল্‌।

পথে মানুষ নেই তা নয়। অন্তত পাঁচজনকে ওরা পেয়েছে ইতিমধ্যে। কেউ কারও মুখ দেখতে পায়নি এই রক্ষে। শুধু কল্যাণ বারংবার বলেছে, এই, ঠিক রাস্তায় যাচ্ছিস তো? প্রথম দুতিনবার উত্তর দিয়েছিল সুদীপ, তারপর চুপ করে গেছে। অন্ধকারে পথ চেনা সত্যি অসুবিধেজনক কিন্তু ওর মনে হচ্ছে কোন ভুল করেনি। শেষপর্যন্ত গাড়ির হেডলাইট দেখতে পেয়ে নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হল। মাঝে মাঝেই অন্ধকার চিরে এক একটা গাড়ি কলকাতার দিকে ছুটে যাচ্ছে। ওরা চুপচাপ ডায়মন্ডহারবার রোডে উঠে এল। কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল, পেট্রল পাম্পটা কতদূরে?

দূর আছে। তোর কি হয়েছে কল্যাণ?

কেন, কিছু না। চমকে উঠল যেন কল্যাণ।

চেপে যাচ্ছিস। নার্ভাস লাগছে?

একটু। সময় নিয়ে উত্তর দিল কল্যাণ, আসলে আমি কোনদিন ডাকাতি করিনি তো।

আমি করেছি? আনন্দ করেছে। তাছাড়া আমরা ডাকাতি করতে যাচ্ছি না।

জানি। কিন্তু লোকে তো তাই বলবে।

তা হলে কি চাস বল? মনে হয় স্টেশনে গেলে কলকাতার ট্রেন পেয়ে যাবি।

আমি স্টেশনে যাওয়ার জন্যে এখানে আসিনি। তুই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আমি জানি কি করতে চলেছি, সে ব্যাপারে আমার মন পরিষ্কার, কিন্তু তবু যে ছাই কেন আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছি কে জানে। তারপর নিজেই হেসে বলল, মিডলক্লাস সংস্কার! নে চল, দাঁড়াস না। আর এসব কথা আনন্দকে বলিস না।

সুদীপ কোন কথা বলল না। হেডলাইট বাঁচিয়ে কল্যাণকে নিয়ে সে এগোতে লাগল। এখন গাড়ির সংখ্যা কম আর যারা যাচ্ছে তাদের গাড়ির গতি জোরালো। রিকশা যাচ্ছে কখনও-সখনও। কিছু মানুষ ওপাশ থেকে বোধ হয় গ্রামে ফিরছিলেন বেশ হনহনিয়ে। সুদীপ একটু আশঙ্কা করছিল কিন্তু প্রশ্ন এল না কোন। শেষতক ওরা গ্রাম ছাড়িয়ে গেল। সঙ্গে কিছু নেই সুদীপের কিন্তু কল্যাণকে ব্যাগটা বইতে হচ্ছে। নিজের কথা ভেবে একটু অবাক হচ্ছিল সুদীপ। তার মনে কোন কাঁপুনি নেই। যেন খুব স্বাভাবিক কাজ সে করতে চলেছে।

এই সময় পেট্রল পাম্পের আলোটা চোখে পড়ল। উঁচুতে হ্যাজাকটাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কাছাকাছি গিয়ে ওরা একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল। মেইন রোড থেকে নুড়ির পথটা নেমে গেছে পাম্পের দিকে। পাম্পের ওপাশে দুটো ঘর। একটায় অফিস, অন্যটায় বোধ হয় স্টোরের কাজ চালানো হয়। কল্যাণ বলল, দুটো লোক দেখতে পাচ্ছি।

একজনের তো গলাই পাওয়া যাচ্ছিল। চিৎকার করে হিন্দী গান গাইছে সে হ্যারিকেনের আলোয় বসে। দ্বিতীয়জন প্রৌঢ়। চুপচাপ বসে আছে। এই দুজনকেই এর আগেরবার দেখে গিয়েছিল সুদীপ আনন্দর সঙ্গে এসে। কিন্তু আজ কোন গাড়ি নেই পাম্পে। সেদিন দুটো গাড়ি গ্যারাজ করা ছিল। একটু বাদে প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি ছেলেটিকে কিছু বললেন। গান থামিয়ে সে চিৎকার করল, উরে বাপ, এই অন্ধকারে আমি যেতে পারব না! কথাটা বলে সে ঘরের ভেতরে প্রৌঢ়র কাছে চলে গেল।

ওই ঘরে বিরাট কাঁচের জানলা রয়েছে। কিন্তু পথ একটাই। কল্যাণ চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, গাড়ি কোথায়?

সুদীপ কোন উত্তর না দিয়ে ঘড়ি দেখল। এখনও মিনিট পনেরো সময় আছে। যদি তার মধ্যে কোন গাড়ি না আসে তা হলে আনন্দরা অপেক্ষা করবে। সে চাপা গলায় কল্যাণকে বলল, মালটা বের করে হাতে রেখে দে, পরে হয়তো চান্স পাবি না। তাড়াহুড়ো করবি তখন।

কল্যাণ অন্ধকারেও হাসল, দুরকমের মাল আছে। কোটের প্রয়োজন হবে তা আগে থেকে বুঝব কি করে? চান্স তৈরি করে নেব। এই সময় ডায়মন্ডহারবারের দিক থেকে একটা গাড়ি এগিয়ে এসে পাম্পের হদিশ পেয়ে নেমে এল নিচে। প্রচণ্ড হর্ন বাজাচ্ছিল ড্রাইভার। কল্যাণ বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল গাড়িটাকে দেখে। চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, যাবি? সুদীপ মাথা নাড়ল, না। কারণ গাড়িতে ড্রাইভারকে নিয়ে অন্তত ছয়জন মানুষ বসে। প্রত্যেকেই যুবক, ক্যাসেটে গান বাজছে। ছোকরাটা বেরিয়ে এসে পনেরো লিটার তেল ভরে দিল। দাম মিটিয়ে চলে গেল ওরা কলকাতার দিকে। ছোকরা ফিরে গেল ঘরের ভেতর। বাইরেটা আবার অন্ধকার। এদিকে মশাও আছে বেশ। কানের কাছে তারা ইতিমধ্যেই পাখা বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। সুদীপ আবার ঘড়ি দেখল। তিন মিনিট বাকি আছে। প্ল্যানটা ওরই। কল্যাণ কিংবা আনন্দ এই ঝুঁকি নিতে চায়নি। কিন্তু ওর মনে হয়েছিল এইটেই সহজ পথ। আনন্দর কাছে জেনেছিল এ তল্লাটে সন্ধ্যের পর লোডশেডিং হয় না এমন রাত খুব কমই আসে। সেইটে কাজে লাগাতে চেয়েছিল সে। কিন্তু যদি গাড়ি না আসে আজ পাম্পে তাহলেই চিত্তির। জয়িতা চেয়েছিল কোলকাতা থেকে কারও গাড়ি সরিয়ে এখানে চলে আসতে। তাহলে আর আনন্দর বাড়ি যাওয়া যেত না। সরাসরি স্পটেই ঢুকতে হত। আনন্দ সেই ঝুঁকিটা আবার নিতে চায়নি। এর মধ্যে অনেক গাড়ি বড় রাস্তা দিয়ে ছুটে গিয়েছে, কারও প্রয়োজন হয়নি তেলের। সুদীপ লক্ষ্য করল যত দেরি হচ্ছে তত কল্যাণ শান্ত হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে সময়টা পেরিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই আনন্দ আর জয়িতা বটগাছের নিচে অপেক্ষা করছে এতক্ষণ। সুদীপ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিল। ওকে ঘড়ি দেখতে দেখে কল্যাণ বলল, ওদের তো অপেক্ষা করতেই হবে। যদি গাড়ি না পাই তো আনন্দর বাড়িতে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। তখন আবার আগামীকাল ভাবতে হবে।

সুদীপ বলল, কাল যদি ইলেকট্রিক চলে আসে? যা করার আজই করতে হবে।

লোডশেডিং যে হবেই তা আজ আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। হয়ে গিয়ে সুবিধে হয়েছে। কাল না হলে অন্য কিছু ভাবতে হবে। কিপ ইওর আইজ ওপেন। বলেই কল্যাণ হাসল। সুদীপ ঠাট্টাটা বুঝেও বুঝল না। ওর মনে হল কল্যাণ এতক্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় কোলকাতার দিক থেকে গাড়িটাকে আসতে দেখল সে। আলো দেখেই বোঝা গেছে ওটা অ্যাম্বাসাডার। গাড়িটা গতি কমাচ্ছে। সুদীপ কল্যাণকে নিয়ে গাছের এপাশে চলে এল। হেডলাইটটা বাঁক নিচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে নেমে এল রাস্তা ছেড়ে। পাম্পের সামনে নয়, পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। ভেতর থেকে হোকরাটা মুখ বাড়াল, মাল এনেছ? দাদুর গলা শুকিয়ে গেছে। চটপট চলে এস। রোগামতন একটা লোক গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মদের বোতল হাতে নিয়ে। তারপর ঢুকে গেল ভেতরে। হ্যাজাকের যেটুকু আলো নাম্বার প্লেটে পড়েছিল তাতেই সুদীপ চিনতে পারল। এই গাড়িটাকেই ওরা গতবারে দেখে গেছে।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার