অপারচুনিস্ট!

খানিকটা ঠাট্টার মিশেল দিয়ে জয়িতার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করল সুদীপ। কল্যাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু এইসময় ড্রাইভার এমন আচমকা গতি হ্রাস করল যে বেচারার হাত রড থেকে ছিটকে গেল এবং সুদীপকে আঁকড়ে ধরে সোজা হল। বাসের অন্যান্য যাত্রীরা তখন ড্রাইভার কন্ডাক্টরের মুণ্ডপাত করতে শুরু করেছে। সেই ফাঁকে সামলে নিয়ে কল্যাণ খানিকটা চেঁচিয়ে বলল, এই, সুদীপ তোকে অপরচুনিস্ট বলছে?

লেডিস সিটে বসে ওদের টালমাটাল ব্যাপারটা উপভোগ করতে করতে জয়িতা হাসল, আই ডোন্ট মাইন্ড!

সুদীপ কল্যাণকে বলল, ফুটনোট না পড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।

প্রাইভেট বাসটায় ওরা উঠেছে কলেজের সামনে থেকে। তখনই ভিড় ছিল, এখন আরও বাড়ছে। ওরা চারজনে কোনমতে উঠতে পেরেছিল। লেডিস সিটে একজন পুরুষ জাঁকিয়ে বসেছিলেন মহিলাদের সঙ্গে। ওরা যখন ভিড়ে সাঁতরাচ্ছে তখন জয়িতা কোনমতে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমাকে বসতে দিতে আপনার আপত্তি আছে?

ভদ্রলোক ভূত দেখার মত চমকে ছিলেন। জিনসের প্যান্ট আর হ্যান্ডলুমের শার্টে জয়িতাকে তিনি আবিষ্কার করে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। কাঁধের ব্যাগটা কোলে নিয়ে আরাম করে জানলার পাশে বসে বন্ধুদের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে বেশ মজা পাচ্ছিল। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এসপ্ল্যানেড থেকে মিনিট পঞ্চাশেক লাগবে, না রে?

হ্যাঁ, ওইরকম। তোর ব্যাগটা সামলে রাখিস। আনন্দ উত্তর দিল।

ডোন্ট ওরি ম্যান! আমি ঠিক আছি।

ভিড় বাসে দাঁড়িয়ে কথা বলতে মোটেই ভাল লাগে না আনন্দর। কিন্তু সুদীপের বোধহয় চেঁচিয়ে কথা না বলতে পারলে মোটেই আরাম হয় না। ক্রমশ চাপে পড়ে ওরা তিনজনেই ভেতরের দিকে সরে আসছিল। বউবাজারের মুখে তিনটি ছেলে উঠল। ওদের অস্তিত্ব জানা গেল কারণ বাসের পাদানিতে পা রেখেই ওরা কন্ডাক্টরকে অশ্লীল ভাষায় ধমকাল স্টপেজে না বাঁধার জন্যে। এত ভিড় তবু ওদের জায়গা করে দিল যাত্রীরা লেডিস সিটের সামনে যেতে। সুদীপ চাপা গলায় বলল, এটা এখন একটা কায়দা হয়েছে। খিস্তি করলে ফেসিলিটিস পাওয়া যায়। আনন্দ কিছু বলল না। তার কানে খুব বিশ্রী শব্দগুলো এখনও নোংরার মত লেগে আছে। তারপরেই ওর কানে এল উঁচু গলায় গল্প করছে তিনজন। কোন একটি মেয়ে রোজ রাত্রে বাড়ি ফেবে। পাড়ার ছেলেদের পাত্তা দেয় না বটে তবে পয়সা ফেললেই পাওয়া যায়। এইসব গল্পগুলো বলার সময় তারা সমানে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করতে মজা পাচ্ছিল। নিজেদের অতৃপ্ত বাসনাকে ব্যক্ত করতে যে ওইসব শব্দ সাহায্য করছিল। আনন্দ দেখল বাসের সবাই এইসব বাক্য শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করছে না। বরং প্রত্যেকে এমন ভঙ্গিতে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওইসব কথা কিছুই কানে যাচ্ছে না। সবকটা মুখই যেন মুখোশ পরা।

এইসময় জয়িতার গলা শুনতে পেল, এই যে, হয় আপনারা ভদ্রভাবে কথা বলুন, নয় বাস থেকে নেমে যান। এটা আপনাদের শোওয়ার ঘর নয়।

তিনজনেই একটু থমকে গেল প্রথমটায়। তারপর একজন একটু ঝুঁকে একটা হাত বাড়িয়ে বলল, শোওয়ার ঘর করে নিলেই হয়। বাসটা আপনার কাদারের মাল নাকি যে বললেই নেমে যাব!

দ্বিতীয়জন বলল, এগরোল মাইরি, হেভি লঙ্কাঠাসা।

তৃতীয়জন বেঁকিয়ে বলল, বাঙালির মেয়ে হয়ে প্যান্ট পরেছেন লজ্জা করে না। সীতা সাবিত্রী–

তড়াক করে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের ছেলেটার কলার ধরে ঠাস করে চড় মারল জয়িতা। কিন্তু সেইসময় তিনটে ছেলে বিপরীত দিক থেকে আঘাত পেল। তুমুল হইচই শুরু হয়ে গেল বাসে। যাত্রীরা ভয়ে সরে গেল যে যে-দিকে পারে। চলতে চলতে বাসটা দাঁড়িয়ে পড়ল একপাশে। ততক্ষণে তিনটে ছেলে ওদের পা জড়িয়ে ধরেছে। কল্যাণের স্বাস্থ্য ভাল, সে বিরক্তিতে একটা লাথি মেরে বলল, ভাগ, তোদের শরীরে হাত দিতেও ঘেন্না করে। এর পরের বার দেখলে মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব।

তিনটে ছেলে ব্যাঙাচির মত লাফ দিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। এইসময় জয়িতা চাপা গলায় ফুসে উঠল, তোরা কেন এলি? আমি তোদের ডেকেছিলাম?

কল্যাণ একটু অবাক হয়ে বলল, তার মানে?

আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইশেল। ওই তিনটে বাইপ্রোডাক্টকে ট্যাকল করার ক্ষমতা আমার আছে। তোরা কি ভেবেছিস আমাকে? উত্তেজিত অবস্থায় জয়িতা নিজের জায়গায় ফিরে গেল।

ওর পাশে বসা একটি মধ্যবয়সিনী এবার নিচু গলায় বললেন, আমিও সহ্য করতে পারছিলাম না ভাই। কি করে যে ওইসব কথা ওরা উচ্চারণ করছিল!

চট করে মুখ ফেরাল জয়িতা, সহ্য করতে পারছিলেন না তো প্রতিবাদ করেন নি কেন?

ভয় করছিল। আসলে আমার তো বাইরে বলাকওয়ার অভ্যেস নেই।

ক্রমশ সরে যাওয়া ভিড়টা জমাট হল। একজন বললেন, দেশটার কি হল! এদের কিছু বলতে ভয় হয়! শুনেছি খুরটুর থাকে এদের সঙ্গে।

জয়িতার সামনে দাঁড়ানো এক প্রৌঢ় বললেন, না না, ভয় ফয কোনও ব্যাপার নয়। আমি ওদের সুযোগ দিচ্ছিলাম। কতটা বাড়ে বাড়ক তারপর প্রতিবাদ করব।

আর একজন গলা বাড়িয়ে বললেন, আমার তো হাত নিশপিশ করছিল। কিছু করব করব ভাবছি–

হঠাৎ জয়িতা চিৎকার করে উঠল, স্টপ ইট! আপনাদের প্রত্যেকের মুরোদ জানা আছে। এতক্ষণ তো ভয়ে গর্তে ঢুকে বসেছিলেন। যেই ওদের নামিয়ে দেওয়া হল অমনি বীরত্ব দেখাচ্ছেন। আপনারা ভীতু, প্রতিবাদ করতে পারেন না সেটা সহ্য করলেও করা যায়, কিন্তু নিরাপদে দাঁড়িয়ে আস্তিন গোটানো সহ্য করা যায় না।

একজন বিড়বিড় করে বলল, কিন্তু প্রতিবাদ কবলে তো আপনি, মানে, একটু আগে ওনাদের ধমকালেন কেন এসেছে এগিয়ে, তাই না?

অবজ্ঞার হাসি হাসল জয়িতা, সেটুকু যদি বুঝতে পারতেন তাহলে অবস্থাটা অন্যরকম হয়ে যেত। সবাই তো যুধিষ্ঠির হয়ে বসে আছেন দ্রৌপদীকে দুঃশাসনের হাতে ছেড়ে দিয়ে। রাবিশ!

ওপাশ থেকে সুদীপ চিৎকার করে উঠল, ইটস অলরাইট। কেউ আর কথা বাড়াবেন না। কার কত মুরোদ তা আমরা জানি।

ওয়েলিংটনের মোড়ে এসে বাসটা দাঁড়িয়ে গেল। সামনে জব্বর জ্যাম। বউবাজারের উত্তেজনাটা এখন মিলিয়ে গেছে। যাত্রীরা যে যার নিজের বিষয় নিয়ে কথা বলছে। সুদীপের সামনের সিটে বসা এক মধ্যবয়সী বললেন, জ্যাম তো হবেই। পাতাল রেলের ডাইরেক্ট রিঅ্যাকশন এটা।

তার সঙ্গী জিজ্ঞাসা করল, পাতাল রেল এখানে কোথায়?

মধ্যবয়সী বললেন, পা কেটে গেলে সমস্ত শরীরে ধনুষ্টঙ্কার হয় কেন? তাছাড়া পুলিশেরও হাত আছে। দে আর ক্যালাস। জাপানে কখনও এমন হয় না। নিউ ইয়র্কে জ্যাম হয় কিন্তু বড় জোর আধ ঘন্টা। মস্কোতে জ্যাম হলে তো কোট মার্শাল হয়ে যাবে।

চীনে?

ওয়েল, চীনে তো এত গাড়ি নেই। সবই জাতীয় সম্পত্তি। অতএব জ্যামও নেই।

এদেশে সব জাতীয় সম্পত্তি করে নিলে জ্যাম হবে না বলছেন?

তা নেবে কেন? ওই যে পাতাল রেল, যার জন্যে এখানে আমরা বসে আছি, ওটা স্রেফ আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে তৈরি। চীনে পাতাল রেল আছে? নেই। না না, তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করতে এস না। আমি সবই জানি শুধু জানি না কবে মারা যাব! অতি অমায়িক একটা হাসি হাসলেন ভদ্রলোক।

সুদীপ মুখটা নামিয়ে আনল ভদ্রলোকর সামনে, কিছু মনে করবেন না একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি? রেগনের ব্রেকফাস্টের মেনুতে কি কি থাকে?

অ্যাঁ? ভদ্রলোকের মুখ আফ্রিকা থেকে চট করে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ হয়ে গেল।

আপনার স্ত্রী কোত্থেকে কেরাসিন তেল যোগাড় করেন সে খবর রাখেন?

মানে, মানে, আপনি আমাকে অপমান করছেন?

গুল মারাটা বন্ধ করুন তো। এই হামবড়া ভাবটা, সব জেনে বসে আছেন। আপনাদের বয়সে এলে সব বাঙালি খবরের কাগজের নিউজ এডিটরকে হার মানিয়ে দেয়। অদ্ভুত।

সুদীপের কথা শেষ হওয়ামাত্র আনন্দ তাকে ডাকল, এই নেমে আয়, এখানে জগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। হাঁটলে দশ মিনিট লাগবে।

বাস থেকে নেমে সুদীপ কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, আসলে বুঝলি দোষ কারও নয়, দোষটা আমাদের। একটা জাতের যদি মেরুদণ্ডটা প্লাস্টিকের হয়–।

তোর কি দরকার? সব জায়গায় নাক গলাস কেন? আনন্দ বিরক্ত হল। কয়েক পা এগিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল, এই দ্যাখ, জ্যামটা হচ্ছে মিছিলের জন্যে আর লোকটা অবতারের মত বলে গেল পাতাল রেল এর জন্যে দায়ী। লোকটাকে নামিয়ে আনতে ইচ্ছে করছে।

জয়িতা চুপচাপ মিছিলটাকে দেখছিল। ও জানে এই মুহূর্তে সে অনেকের দ্রষ্টব্য। জিনসের প্যান্ট, শার্ট, ছেলেদের মত ছাঁটা চুলে যে লম্বা শরীরটা তারা দেখছে তাকে চট করে মেয়ে ভাবতে ওদের অসুবিধে হচ্ছে। এবং এই অসুবিধে হওয়াটা দর্শকের মনে কিলবিলে বোধের জন্ম দিচ্ছে। সংসারের গণ্ডিতে দাঁড়িয়ে থেকে নাক ঝাড়া ভাবের সঙ্গে রগরগে রহস্যের জন্যে খুশখুশ সুড়সুড়ি। দুটোই চলছে সমানে। বিভ্রান্ত হওয়ার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। বাঙালি মেয়েদের কাঁধ এত চওড়া এবং শরীর অমন লম্বা হয় না। তার বুক কিংবা নিতম্ব শৈশবের অসুস্থতার কারণে সঞ্চয়ী হয়নি। সে প্রসাধন ব্যবহার করে না। মেয়েলিপনার সঙ্গে তার অস্তিত্ব অনেক দূরের। ফলে যারা দেখে তাদের ভ্রান্তি হয়ই। পথেঘাটে চলতে মানুষের চোখে খটকা দেখেছে সে। ইচ্ছে করে সুবিধে আদায় করার সময় সে যখন ঘোষণা করে আমি একজন মহিলা তখন বেশ মজা পায় সে। পুরুষরা তো সব কিছু আগলে বসে আছে, ওদেরই ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে যদি কিছুটা আদায় করা যায় ক্ষতি কি! একবার একটা ত্যাঁদড় ছেলে লেডিস সিট ছাড়তে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি যে মহিলা তা কি করে বুঝব?

জয়িতা চটপট জবাব দিয়েছিল, নিজের দিকে তাকান, বুঝতে পারবেন। এখন আর এসব নিয়ে কোন অস্বস্তি হয় না জয়িতার। তার বন্ধুরাও এই নিয়ে মাথা ঘামায় না।

হঠাৎ জয়িতা গলা তুলে বলল, দ্যাখ সুদীপ, লোকটাকে দ্যাখ!

ওরা তিনজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মিছিলটাকে দেখছিল। জয়িতা সামান্য এগিয়ে। মিছিলটা কোন কারণে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। দুসারি লোক পুরো ধর্মতলা স্ত্রীকে আগলে রেখে আকাশে হাত ছুঁড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বীভৎস ভঙ্গিতে। যোগ দিন যোগ দিন। আনন্দ বলল, এইভাবে ধমকে বললে কেউ যোগ দিতে সাহস পাবে? লোকগুলো নর্মাল বিহেভ করে না কেন?

কল্যাণ বলল, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা এটা।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কোন্ লোকটার কথা বলছিস জয়?

ওই যে বোগা মতন, হাওয়াই শার্ট প্যান্ট পরা, হাতে কাপড়ের ব্যাগ! জয়িতা জানাল।

সুদীপরা দেখল। নিম্নবিত্ত বাঙালির প্রকৃষ্ট উদাহরণটি হাত তুলেছেন। কিন্তু মুখে কোন শব্দ করছেন। বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোকের মোটই ইচ্ছে করছে না ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। এইসময় একটি পঙ্গু মানুষ ক্রাচে ভর করে এগিয়ে গেল অন্য ফুটপাতে যাওয়ার জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি খিঁচিয়ে উঠলেন, নেহি, নেহি! দেখতা নেহি হামলোগ মিছিল করতা হ্যায়। যানে নেহি দেগা। ক্রাচে ভর করা মানুষটি। কাকুতি মিনতি করতে লাগল কিন্তু লোকটা এই মুহূর্তে হিটলারের মত কঠোর হয়ে গেল।

ওপাশ থেকে কেউ চিৎকার করে উঠল, কাউকে মিছিল ভাঙতে দেবেন না। কেন্দ্রের কালো হাত ভেঙে দাও খুঁড়িয়ে দাও। ভদ্রলোক এমন ভাবে হাত চালালেন যে পঙ্গু লোকটা ভয় পেয়ে সরে এল এপাশে।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, এই মিছিলে কত লোক অনুপ্রাণিত হয়ে এসেছে জানতে ইচ্ছে করছে।

জয়িতা বলল, ন্যাকামি করিস না। আমরা সবাই জানি। এই মিছিলগুলো হল কোরামিনের মত। নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধ এবং মিছিল করতে হয় মহাপ্রভুদের। ততক্ষণে মিছিলটা আবার চলতে শুরু করেছে। এর শেষ কোথায় বোঝা যাচ্ছে না, তবে ফেস্টুন দেখে মনে হচ্ছে শহরের চেয়ে শহরতলির মানুষ বেশি সংখ্যায় এসেছেন।

আনন্দ বলল, দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? চল, এই ফুটপাত ধরে ধরে হাঁটা যাক, সুযোগ পেলে পার হওয়া যাবে।

সুদীপ ফুট কাটল, সুযোগ এরা দেয় না, আদায় করে নিতে হয়।

ওরা যখন জ্যোতি সিনেমার সামনে পৌঁছেছে তখন কল্যাণ দেখতে পেল, এই দ্যাখ দ্যাখ, লোকটা মিছিল থেকে সটকেছে।

চারজনেই লোকটাকে দেখল। একটা পানের দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকিমেরে মিছিলটাকে দেখছে। যেন পেছনের সারিতে কোন চেনা মুখ আছে কিনা জরিপ করে নিচ্ছে। সুদীপ চট করে এগিয়ে গিয়ে বলল, নমস্কার, কেমন আছেন?

লোকটি থতমত হয়ে যেন চিনতে চেষ্টা করল, ডাল, মানে, এই একরকম।

সুদীপ বলল, কতদিন পরে দেখা হল। আপনি আমাকে চিনতে পারবেন ভাবিনি। যাক, এদিকে কেন এসেছিলেন?

এই একটু দরকার ছিল। তারপর ফ্যাকাশে হেসে বলল, ওই মিছিলের জন্যে আটকে গেছি।

সুদীপ আড়চোখে বন্ধুদের দেখে নিল, আপনাদের অফিসের লোকজন আসেনি মিছিলে?

আসেনি আবার! ঘাড় ধরে নিয়ে আসে। আমার আজ রেশন ভোলা হল না। কথাটা বলেই লোকটা সচকিত হল, মানে এই মিছিলের জন্যে আটকে গেলাম। আচ্ছা কোথায় দেখেছি আপনাকে— মানে–।

আপনার অফিসে। বড়বাবুর কাছে গিয়েছিলাম।

ও তাই বলুন। আমি সেই থেকেই ভাবছিলাম চেনা চেনা, ঠিক মানে, বয়স হয়েছে তো?

আপনি তো লোয়ার ডিভিসন ক্লার্ক?

আজ্ঞে না, আপার ডিভিসন।

চলে?

লোকটা যেন কুঁজো হয়ে গেল। তারপর বলল, চালাতে হয়।

এইসব মিছিল টিছিল করলে হয়তো মাইনে বাড়বে আপনার।

ছাই বাড়বে। শালারা নিজেদের ধান্দায় আমাদের মিছিলে টেনে আনে। যা দেবার সরকারের ইচ্ছে হলে তবেই দেয়। এখন তো কথায় কথায় কেন্দ্র দেখিয়ে দিচ্ছে। লোকটা আবার নিবে গিয়ে বলল, এদের কথা শুনলে কাজ কম করলেও চলে।

ওহো, যে কথাটা বলতে এসেছি, আপনাকে আপনার বড়বাবু ডাকছেন। উনি এদিকে আসবেন না বলে জ্যোতি সিনেমার কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, আপনাকে দেখে বললেন ডেকে দিতে।

সুদীপের কথা শেষ হওয়া মাত্রই লোকটি সচকিত হয়ে উঠল। এখন সামনে বেলঘরিয়ার ফেস্টুন। লোকটি বলল, এতক্ষণ বলেননি কেন? যাচ্চলে।

তারপর দ্রুত রাস্তায় নেমে এগিয়ে যেতেই মিছিলের একটি মানুষ বাধা দিলেন, না না, যেতে পারবেন না। দেখছেন না আমরা মিছিল করছি।

লোকটি মাথা নাড়ল, জানি, কিন্তু আমার খুব জরুরী দরকার। একটু যেতে দিন।

রিঅ্যাকশনারি কথাবার্তা বলবেন না। এই দেখিস তো, বুড়োটা যেন না পার হয়। পেছনের লোকগুলোর দিকে কথাগুলো ছুঁড়ে এগিয়ে গেল জঙ্গী মানুষটি।

হো হো করে হাসছিল সুদীপ হাঁটতে হাঁটতে। জয়িতা বলল, তুই পারিস বটে।

হাসি থামিয়ে সুদীপ বলল, দ্যাখ, যে লোকটা মিছিলে আসতে চায় না, ঘাড় ধরে নিয়ে আসা হয় সে-ই মিলিটারি মেজাজে একজন খোড়াকে রাস্তা পার হতে দেয় না। আবার নিজের বেলা বোধহয় বাপবাপান্ত করছে। এই হল আমাদের নেতাদের সৈন্যবাহিনী!

আনন্দ বলল, তুই অমন রাফ দিলি, লোকটা টের পেল না কিন্তু! অদ্ভুত!

কল্যাণ বলল, সোজা ব্যাপার। মিছিল থেকে সটকে লোকটা ভয়ে ছিল। তাছাড়া এই ধরনের মানুষ এমনিতেই সারাক্ষণ কেঁচো হয়ে থাকে। নিজের পরিবারের বাইরে একটু ভাল পোশাকের যে কোনও মানুষকেই স্যার বলতে ওদের জিভ সুড়সুড় করে। দোষ নেই, অনেক কালের অভ্যেস। এরা চ্যালেঞ্জ করতে জানে না।

জয়িতা বলল, অল রাইট। বাট আই ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড, কি করে এই লোকটা ছেলের বয়সী সুদীপকে আপনি আজ্ঞে করে গেল!

বয়সটয়স কোন ফ্যাক্টর নয়। আসলে ব্যক্তিত্ব যাদের গড়ে ওঠেনি তারা তো এই রকম আচরণ করবেই। আনন্দ কথাটা শেষ করল এই বলে, এদের নিয়েই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে হচ্ছে!

কল্যাণ প্রতিবাদ করতে গেল। আনন্দ আজকাল মাঝেমাঝেই খুব উলটো-পালটা কথাবার্তা বলে। কতগুলো নিখাদ সত্য সামনে রেখে আমাদের কাজে নামাতে হয়েছে, সেটা জানার পরও এই ধরনের আক্ষেপ মনে অস্বস্তির জন্ম দেয়। সে ঠিক করল আনন্দর সঙ্গে এ নিয়ে পরে আলোচনায় বসবে। ধর্মতলার মোড়ে এসে সুদীপ চেঁচিয়ে উঠল, চলে আয় চটপট। সামনের মানুষজন তাড়াতাড়ি হাঁটায় মিছিলটা আলাদা হয়ে গেছে। সেই ফাঁক গলে ওরা পেরিয়ে এল।

এখন বেশ গুমোট। সময়টাকে আর দুপুর বলা যায় না। আবার বিকেলের ছায়াও নামেনি। ওরা চারজন আগুপিছু মেট্রোর সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিল। হঠাৎ কল্যাণ দেখতে পেল বিমলেশদাকে। বিমলেশদা তাকে দেখে এগিয়ে এলেন, কি ব্যাপার কল্যাণ, তোমার পাত্তা নেই কেন?

আমি একদম সময় পাচ্ছি না বিমলেশদা। ইনফ্যাক্ট নাটক করার ইচ্ছেটা আমার নেই।

কেন জানতে পারি? তুমি তো একসময় খুব উৎসাহী ছিলে!

কথাগুলো শোনার পর বিমলেশদাকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। কল্যাণ পাজামা-পাঞ্জাবি পরা স্বপ্ন দেখতে চাওয়া মানুষটির দিকে তাকিয়ে এক পলক ভাবল রুঢ় কথা ব্যবহার করবে কিনা! তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি রিয়ালইজ করেছি ওই মিডিয়ামটা আমার জন্যে নয়।

কিন্তু তুমি তো ভাল অভিনয় করতে। বুঝতে পারছি না, তুমি সত্যি লুকোতে চাইছ কিনা!

কল্যাণ হাসল, ঠিক আছে। যদি সুযোগ পাই পরে একদিন এ বিষয়ে কথা বলব। বিমলেশদা, ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি কিন্তু। ঠিক আছে, আজ আমাদের একটু তাড়া আছে।

একটু জোর করেই সরে এল কল্যাণ। তার মন ভাল লাগছিল না। তিনমাস হল গ্রুপে সে যায় না। খবর এসেছে অনেকবার। সে নাটক করবে না জানিয়েও দিয়েছে। কিন্তু তবু এই মানুষটির মুখোমুখি হয়ে তার এই মুহূর্তে ভাল লাগছিল না। সুদীপ আর আনন্দ কথা বলতে বলতে সামনে হাঁটছে। জয়িতা কল্যাণের পাশে চলে এল, হঠাৎ ফিউজ হয়ে গেলি কেন?

কল্যাণ কাঁধ নাচাল প্রথমে। তারপর যেন নিজের কাছেই কৈফিয়ৎ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, বিমলেশদাদের মত সিরিয়াস লোক চিরকাল লড়াই করে যান কিন্তু বুঝতেই চান না যুদ্ধটা একতরফা। ফলাফল আগেই ঠিক করা আছে।

জয়িতা বলল, সে কথা উনিও নিশ্চয়ই জানেন। তোর মন খারাপ করার কি আছে!

কল্যাণ কথাটা শুনে একটু উত্তেজিত হল, তুই ব্যাপারটা বুঝবি না। আমাদের দলের জনা পনেরো ছেলে শুধু ভাল নাটক করবে বলে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা রিহার্সালরুমে কাটিয়ে দিল। কিন্তু ভাল নাটক করব বললেই করা যায় না। কলকাতার যে দুটো হলে লোকে কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে নাটক দ্যাখে সেই দুটো হল তুই চাইলেই পাবি না। একটা হল বিখ্যাত দলগুলোর মধ্যে বিতরিত, অন্যটি সরকারি আমলা আর ধামাধরদের খেয়ালখুশিতে চলে। উত্তর দক্ষিণে যেখানেই নাটক করবি তোকে পায়ে ধরে দর্শক ডেকে আনতে হবে। সেটা দুতিনটে শো-এর পরে অসম্ভব। বিমলেশদারা যে প্রযোজনাই করুক প্রতিটিতে ধার বেড়ে যায়। তুই বলবি মফঃস্বলে যা, গ্রামে যা। প্রযোজনার টাকাটা কে দেবে? এ তো গেল বাইরের ব্যাপার, আমরা নাটক পাব কোথায়? কলকাতায় তিনচারজন নাটক লিখতে পারতেন। বড় দলগুলো তাঁদের একচেটিয়া করে রেখেছেন। ইদানীং সেসব কলমও বন্ধ হয়ে আসছে। ফলে অনুবাদ এবং অনুসরণের জোয়ার চলছে। সেসব মঞ্চস্থ করে কি ভ হচ্ছে তা নিয়ে কেউ ভাবছে না। আমাদের দলে কেউ নেই যে নাটক লিখতে পারে। পুরোনো নাটক অভিনয় করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সেসব করে শুধু আত্মপ্রসাদ বাড়ানো, যৌবন এবং অর্থের অপচয়। আসলে আমাদের সব কিছুর মত এই নাটক করার মধ্যেও কোন পরিকল্পনা নেই। এসব কথা বিমলেশদাও জানেন। কিন্তু নেশা জিনিসটা বোধহয় খুব মারাত্মক, সবসময় তার চোখের পাতা বন্ধ থাকে।

জয়িতা একটু অবাক হয়ে বলল, তুই যে এসব নিয়ে ভাবছিস এতদিন জানতাম না। তারপর আবহাওয়া হালকা করার জন্যে জুড়ে দিল, চমৎকার কথা বলতে পারিস তুই। কোথাও বক্তৃতা করার প্রয়োজন হলে তোকে আগে ঠেলে দেব।

কল্যাণ হাত তুলল, ভাগ্‌!

ডায়মন্ডহারবারের বাসে ওরা জায়গা পেয়ে গেল। সমস্ত কিছুই আগে থেকে বারংবার ছকে নেওয়া ছিল। গত সপ্তাহে সুদীপ এবং আনন্দ একবার পাক দিয়ে এসেছে। ঠাকুরপুকুরে সুদীপের আত্মীয়ার বাড়ি বড় রাস্তার কাছাকাছি। খুবই নির্জন বাড়িটা। বৃদ্ধা বিধবা, কোনও আত্মীয়স্বজন সেখানে থাকে না। এক চিলতে বাগান আর পেছনদিকে দুঘর ভাড়াটে আছে। আনন্দের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সুদীপ। ইঙ্গিত দিয়ে এসেছিল যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ওরা এক-আধদিন ওখানে গিয়ে থাকতে পারে। বাড়িটার চারপাশে বেড়াবার নাম করে চিলেকোঠার ঘরটা আনন্দকে দেখিয়েছিল সে। লুকিয়ে থাকার পক্ষে চমৎকার জায়গা। শুধু পাখির ডাক ছাড়া কোন শব্দ সেখানে আসে না। আনন্দ লক্ষ্য করেছিল বৃদ্ধা নির্লিপ্ত হয়ে শুনলেন এবং নিজে যা করছিলেন করতে লাগলেন। সুদীপ বলেছিল ওটা নাকি ভাল লক্ষণ। অপছন্দ হলে এতক্ষণ চিৎকারে আকাশ ফাটাতেন। বস্তুত এই অঞ্চলে ওঁর ওই গুণের বেশ খ্যাতি আছে। অতএব এদিকটা নিয়ে ভাবনা নেই।

সন্ধ্যের পর গ্রামে পৌঁছাতে আনন্দ চেয়েছিল। এতে সুবিধে অনেক। এই লাইনে লোডশেডিং নিয়মিত ব্যাপার। রাত দশটার আগে আলো আসে না। ঠিক গ্রামের মধ্যে না নেমে মুখটায় নামলে কারও চোখে পড়ার কথা নয়। পড়লেও একটা কৈফিয়ৎ দেওয়া যাবে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলে নিশ্চিন্তি। এসব নিয়ে চিন্তা করতে হত না যদি জয়িতা সঙ্গে না থাকত। ওর ওই পোশাক গ্রামের মানুষদের স্মরণে থেকে যাবে। সংশয়ের কথা সে বলেছিল বন্ধুদের। কিন্তু জয়িতাই কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিল, তোর বাড়ির লোকদের নিয়ে ভাব, গ্রামের মানুষদের আমি ট্যাকল করব।

দুবছর ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আনন্দ জেনে গেছে জয়িতার মধ্যে কোন ন্যাকামি নেই। একটা ছেলের পক্ষে যা করা সম্ভব ওর কাছে তা অসম্ভব নয়। প্রথমদিকে তাদের তিনজনেরই যে ওর সম্পর্কে দ্বিধা ছিল এটা অস্বীকার করার মানে হয় না। কিন্তু সময় এবং কাজ সেটাকে ধুয়ে মুছে দিয়ে গেছে কখন। আনন্দ ছুটন্ত বাসে বসে পেছন ফিরে তাকাল। বেশ ভিড়। কল্যাণ চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তার ঠিক পাশে বসে জয়িতা উদাসমুখে জানলা দিয়ে দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। সে আড়চোখে যাত্রীদের মুখ দেখল। জয়িতার দিকে তাকাচ্ছে কেউ কেউ। আনন্দর মনে বিরক্তি এল। ও যদি শাড়ি পরে আসত তাহলে ব্যাপারটা এড়ানো যেত।

ঝুপঝুপ করে অন্ধকার নামছে। এই লাইনে যেতে যেতে অনেকবার দৃশ্যটা দেখেছে সে। প্রথমে অনেক দূরে দিগন্তের কাছে উলের বলের মত অন্ধকার জমে। তারপর সেটা সুতো খোলার মত এগিয়ে আসে সামনে। এবং শেষমেশ রাত হয়ে যায়। এখন রাস্তা অনেক চওড়া হয়েছে, হু-হু করে ছুটতে পারে বাস। হঠাৎ সুদীপ ছটফটিয়ে উঠল, ওই যা!

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

সুদীপ বলল, সিগারেট কিনতে ভুলে গেছি। তোদের গ্রামে সিগারেট পাওয়া যাবে?

পেছন থেকে জয়িতার গলা ভেসে এল, আমার কাছে একটা প্যাকেট বাড়তি আছে। দাম দিয়ে দিস। সঙ্গে সঙ্গে বোবা যাত্রীরা উশখুশ করে উঠল।

কল্যাণ সেটা ধরতে পেরে চোখ খুলে বলল, তোর কাছে রাখতে দিয়েছি বলে প্যাকেটটা নিজের হয়ে যায়নি। ওটা আমার সিগারেট। পরের জিনিস দান করা খুব সোজা।

জয়িতা চোখ বড় করল, বাঃ, তুই এই আটটা বেশ রপ্ত করেছিস তো!

কল্যাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল, সামনের সিট থেকে আনন্দ বাধা দিল, ঠিক আছে। ওখানে সিগারেট পেতে কারও অসুবিধে হবে না। তোরা বড় কথা বলিস।

সুদীপ ঘাড় ঘুরিয়ে জয়িতাকে বলল, এই জন্যে তোকে ভাল লাগে।

জয়িতা ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোর নিজেকে ভাল লাগে তো? তাহলেই চলবে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়, মাঝে মাঝেই দ্বীপের মত আলো দেখা যাচ্ছে এখানে ওখানে। বাসের ভেতরে আলো জ্বলছে। আনন্দর মনে হচ্ছিল এটা নিবিয়ে রাখলেই ভাল হত। কারণ তার পরিচিত একজন অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছেন। শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। আনন্দ গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন?

আধ-খুলন্ত প্রৌঢ়টি বললেন, আছি দেখতেই পাচ্ছ। পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?

হচ্ছে যেমন হয়। ইচ্ছে করেই কথাটা বেঁকিয়ে বলল আনন্দ। এতক্ষণ উনি যেভাবে তাকাচ্ছিলেন তাতে মনে হয়েছিল কথা না বললে অন্যায় হবে। কিন্তু কথা শুরু করতেই কায়দা শুরু করেছেন। ওর গ্রামের কিছু মানুষকে এই কারণেই সে সহ্য করতে পারে না। প্রৌড় এবার বললেন, মন দিয়ে পড়াশুনা কর। তোমার বিধবা মায়ের কষ্ট তুমি ছাড়া আর কে দূর করবে! তোমার বাবা কি সরল মানুষ ছিলেন।

আনন্দ প্রতিটি শব্দ আলাদা উচ্চারণ করলে, আমার মা আপনাকে কষ্টের কথা বলেন নাকি? কি আশ্চর্য, আমাকে ওসব বলেন না!

মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?

খুবই সামান্য কাকাবাবু। আমার মায়ের কি কি কষ্ট আছে সেটা তো আপনার জানার কথা নয়। কেন কথা বলার জন্যে কথা বলছেন?

সুদীপ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি স্কুলের শেষ পরীক্ষায় কত পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিলেন? ও বিরাশি পেয়েছিল। কেন ফটাফট জ্ঞান দেন?

কথাটা শেষ হওয়ামাত্র একটা চাপা হাসি উঠল চারপাশে। দু-একজন আলোচনা শুরু করে দিলেন। কুড়ি বছর আগে যত ছেলেমেয়ে হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করত এখন তার দ্বিগুণ করে। যত নম্বর এরা এখন পায় তখন সেটা স্বপ্নেও ভাবা যেত না। এই সময়ের ছেলেরা বেশি ব্রিলিয়ান্ট কিনা তাই নিয়ে তর্ক শুরু হল। আনন্দ দেখল সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু লোকটা চটেছে এবং সুযোগ দিলেই চিমটি কাটার চেষ্টা করবে। ছোবল মারার ক্ষমতা নেই। সে চাপা গলায় সুদীপকে বলল, কেন আগবাড়িয়ে কথা বলতে যাস!

গা জ্বলে যায়।

কখনও কখনও চামড়া মোটা করতে হয়।

সুদীপ কাঁধ ঝাঁকাল, যারা জীবনে কোন দায়িত্ব নেবে না তারাই নিরাপদে দাঁড়িয়ে জ্ঞান দিয়ে যায়।

আনন্দ আর কথা বাড়াল। সুদীপের বাড়ির অবস্থা সে জানে। প্রাচুর্য সেখানে দমবন্ধ করে ছড়ানো। ওর নিকট আত্মীয়স্বজন যে স্তরের তাতে ভারতবর্ষের একশ্রেণীর সুবিধের চাবি হাতে নিয়ে জন্মানো ছেলেমেয়ের মত সেইরকম জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারত। ইংলিশ মিডিয়ামে ওর রেজাল্ট চোখে পড়ার মতই ছিল। ও তার নম্বরটা চেঁচিয়ে বলেছে কিন্তু নিজেরটা বলতে লোকগুলো হোঁচট খেত। অথচ সুদীপ জে ই-তে বসল না। কিন্তু তার ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছে নেই জানার পর গ্রামের যে পেরেছে সে জ্ঞান দিয়েছে।

বাস থেকে নেমে জয়িতা বলল, জেনারেটর চলছে রাজার মতন।

আনন্দ বলল, রাজার মতনই আছে ওরা।

সুদীপ উদাস গলায় বলল, আজ রাতে রাজা যাবে বনবাসে। চক্ষুলজ্জা বলেও একটা কথা আছে, সমস্ত গ্রামে টিমটিমে হ্যারিকেন জ্বলছে আর ওখানে আলোর ফোয়ারা ছুটছে। আর এসব মানুষ মেনে নেয় চুপচাপ।

কল্যাণ বলল, এটা কোন অভিযোগ নয়। আমার সামর্থ্য থাকা অপরাধ? সেটা আমাকে অর্জন করতে হয়েছে। আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা রাখার জন্যে তোর রাগ করার যুক্তি নেই।

ওরা ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে কয়েক পা এগিয়ে আসার পর পুরো এলাকাটা দেখতে পেল। ঠিক রাস্তার কয়েক পা নিচে মাধবীলতার গাছে সাজানো গেট। দেড় মানুষ উঁচু পাঁচিল তার দুপাশ থেকে চলে গেছে বাড়িটাকে ঘিরতে। লোহার গেটটি বন্ধ। কিন্তু ভেতরের আলোয় বোঝা যাচ্ছে সাদা নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে ভেতরে। গেটের দুপাশে দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে য়ুনিফর্ম পরে। ওরা জানে লোকদুটো নেপালি এবং খুব অনুগত। গেটের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালে একজন গেট খুলে দেয়, অন্যজন প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিক নির্দেশ করে। এদের বিশদ বিবরণ চারজনেই জানে। ওরা দেখল গেটের ওপর ইংরেজিতে লেখা আছে জায়গাটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অতএব প্রবেশ এবং প্রস্থান অনুমতি ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। যারা রাত্রে থাকবেন না তাদের বলা হয়েছে সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে উদ্যান ছেড়ে যেতে হবে নইলে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া কর্তৃপক্ষের সম্ভব নয়। চারপাশের গভীর অন্ধকারের মধ্যে বিশাল এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটাকে স্বপ্নের জাহাজের মত মনে হচ্ছে। জয়িতা কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় পেছনে হেডলাইটের তীব্র আলো এবং গাড়ির গতি হ্রাস হওয়ার শব্দ কানে এল। ওরা দ্রুত সরে এল একপাশে যাতে রাস্তার ধারের বড় গাছটার আড়াল পাওয়া যায়। গাড়িতে আরোহী দুজন। চালাচ্ছেন পঞ্চাশের কাছাকাছি খুব স্মার্ট হতে চাওয়া মানুষ। ওপাশে চটকদার এক ম্যানিকিন যিনি ন্যাকা গলায় বলে উঠলেন, এই তো, প্যারাডাইস, ওঃ নটি ডিয়ার!

বাইরে থেকেই এত এক্সাইটেড হবেন না মিসেস মিত্র, তাহলে ভেতরে গিয়ে নার্ভ ঠিক থাকবে না। দেয়ার আর মোর সারপ্রাইজ। পুরুষটি হাত বাড়িয়ে টান টান চুলে আঙুলের ডগা ছোঁওয়াল।

সঙ্গে সঙ্গে কপট অভিমানে ছিটকে সরে গেলেন ম্যানিকিন, তুমি এখনও মিসেস মিত্র আপনি বলে যাচ্ছ। ডোন্ট টাচ মি।

ইউ আর রিয়েল সুইটি। গাড়িটা ধীরে ধীরে পারাডাইস সাইনবোর্ড ঝোলানো লোহার গেটের দিকে এগিয়ে যেতে একজন প্রহরী কিছু জিজ্ঞাসা করল। ভদ্রলোক উত্তর দেওয়ামাত্র সসম্ভ্রমে গেট খুলে দেওয়া হল। গাড়িটা যেন আলোর সাগরে ড়ুবসাঁতার দিয়ে মিলিয়ে গেল। গেট বন্ধ হল।

আনন্দ বলল, গাড়িতে এলে বেশি প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয় না। অবশ্য হেঁটে খুব কম পার্টি আসে।

জয়িতা বলল, আমরা গাড়িটা কখন পাচ্ছি?

সুদীপ জানাল, এখনও ঘণ্টা আড়াই বাকি আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই। লোজন যাওয়া আসা করছে। চল, এগোই।

আনন্দও আর দাঁড়াতে চাইছিল না। একটু বাদে বড় রাস্তা ছেড়ে ওরা কাঁচা পথে নেমে এল। আনন্দর বাড়িতে যাওয়ার জন্যে একটু বেশি হাঁটতে হবে কিন্তু কারও সামনে পড়ার সম্ভাবনা কম। সুদীপ বলল, পা চালা, জব্বর খিদে পেয়ে গেছে।

কল্যাণ মাথা নাড়ল, আমারও।

জয়িতা হাসল, কি করে তোরা এইসময় খাবার কথা ভাবতে পারিস কে জানে!

সুদীপ চেঁচাল, ঈশ্বর তোমাদের শরীরে এক্সট্রা একটা যন্ত্র দিয়েছেন যা দিয়ে সবরকম প্রাকৃতিক ব্যাপার তোমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা থামিয়ে রাখতে পার, বাট উই আর হেল্পলেস!

আহা বেচারা! কিন্তু তোর মুখে তুমি খুব অশ্লীল শোনাচ্ছে। জয়িতা অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিল।

পালটা সুদীপ কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় স্থির হ্যারিকেনের আলো দেখা গেল। আনন্দ চাপা গলায় বলল, আস্তে!

বিশাল একটা বট কিংবা অশ্বত্থ গাছের গায়ে লম্বাটে মুদির দোকান। সেখানে হ্যারিকেন ঝুলছে। দোকানের সামনে মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে কয়েকজন গল্প করছে। আনন্দরা এমনভাবে হাঁটছিল যাতে জয়িতা আড়ালে থাকে। অবশ্য অন্ধকারে কেউ তাদের স্পষ্ট বুঝতে পারবে না। কিন্তু মুখোমুখি প্রশ্নটাকে এড়াতে পারল না আনন্দ, কে যায়?

আমি আনন্দ।

আনন্দ? সেন-বাড়ির ছেলে?

হ্যাঁ।

সঙ্গে কারা?

আমার বন্ধু, কলকাতা থেকে এসেছে। ভাল আছেন মেসোমশাই?

হ্যাঁ, ওই আর কি!

জায়গাটা পেরিয়ে এসেই সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এত কৈফিয়ৎ দিলি কেন?

আনন্দ হাসল, প্রত্যেক জায়গার নিজস্ব একটা চরিত্র আছে। সেই জায়গার মানুষের ব্যবহারও সেই চরিত্রের মধ্যেই পড়ে। আমি সেটা অস্বীকার করলে সাহায্য পাব না কিন্তু সেটাকে মানিয়ে নিলে অসুবিধে হবে না, বুঝলি?

সুদীপের যে কথাটা ভাল লাগল না এটা বুঝতে পারল আনন্দ। যারা এইরকম গ্রামে আবাল্য থাকেনি তারা বুঝে উঠবে না। তাছাড়া সুদীপ সব ব্যাপারে চাচাছোলা কথা বলতে ভালবাসে। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল ওর। ট্রামে যাচ্ছিল আনন্দ সুদীপের সঙ্গে। এক ভদ্রলোক কংগ্রেস এবং সি পি এম-এর মুণ্ডপাত করছিলেন। কংগ্রেস এইরকম সি পি এম সেইরকম। হঠাৎ সুদীপ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কোন্ দলের?

মানে?

কংগ্রেস না সি পি এম?

কোন দলের নয়। আমি কোন রাজনীতিফিতি করি না।

ভোট দিয়েছেন গতবার?

হ্যাঁ, দেব না কেন? আমার ডেমোক্রেটিক রাইট!

আপনিই সবচেয়ে ডেঞ্জারাস লোক। দেশের শত্রু। সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা হেসে উঠেছিল সজোরে। এই সুদীপের কাছে গ্রাম্য কৌতূহল তো খারাপ লাগবেই।

ক্রমশ একটা অন্ধকার দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। দুটো ঘরে হ্যারিকেনের আলো দেখা যাচ্ছে। সামনে কিছুটা বাগান। আনন্দ বলল, এই আমার বাড়ি।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার